সাহসী
সাহসী বলে বিজন আর অঞ্জনের নাম আছে, শুধু সাহসী নয়, দুঃসাহসী। পাড়াগাঁয়ে নির্জন শ্মশানে রাত কাটানো থেকে শুরু করে পোড়োবাড়িতে রাত্রিবাস কিছুই ওদের বাদ যায়নি। ভয়ডর বলে কিছু ওদের অভিধানে নেই। ওরা বলে, ওটা হল মনের দুর্বলতা, দুর্বল মানুষের বিলাস।
বিজনের বয়স বাইশ আর অঞ্জনের তেইশ। দু-জনেই বিজ্ঞান কলেজের ছাত্র, আসছে বছর ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। সব কিছুই ওরা বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করে। ভূতের প্রসঙ্গ উঠলে হেসেই উড়িয়ে দেয়, বলে, যতসব গাঁজাখুরি গল্প। আমরা ভূতের দেখা পাবার আশায় যেখানেই খবর পেয়েছি ছুটে গিয়েছি, কই ভূত বাবাজি তো একবারও আমাদের দর্শন দিলেন না!
সেদিন ওরা কফি হাউসে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মারছে, এক বন্ধু বলল শ্যামনগরে নাকি একটা ভূতের বাড়ি আছে। অনেকদিন আগে ওই বাড়িতে একজন আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল। তারপর থেকেই ভূতের উপদ্রবে সবাইকে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছে। এখন ওটা পোড়োবাড়িই বলা চলে। ভয়ে কেউ সন্ধের পর ওবাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষে না।
ওরা দু-বন্ধু কথাটা হেসেই উড়িয়ে দিল, বিজন বলল, ‘ভূত আমাদের দেখা দেয় না, আমাদের ভয় পায়।’
অঞ্জন বলল, ‘এমন উড়ো খবর শুনে অনেকবারই ছুটে গেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পণ্ডশ্রমই হয়েছে, সবই ফাঁকা বুলি।’
যে খবরটা এনেছিল সে কিন্তু বলল শ্যামনগর হল তার এক মেসোমশায়ের বাড়ি। অবিশ্যি আপন মেসোমশায় নন। সেখানে একটা কাজে গিয়ে খবরটা সে শুনেছে। যিনি বলেছেন তিনি বাজে কথা বলার লোক নন। ওই বাড়িটার নাকি অনেকদিন ধরে দুর্নাম আছে। সাহস করে কেউ রাত কাটাতে পারে না। একবার দু-জন সাহসী তাই করতে গিয়ে ভিরমি খেয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত বিজন আর অঞ্জন ঠিক করল শ্যামনগরে যাবে, ব্যাপারটা দেখেই আসবে।
শনিবার পড়ন্ত বেলায় ওরা শ্যামনগর পৌঁছোল। বন্ধুর কাছ থেকে বাড়িটার ঠিক অবস্থান আগেই ওরা জেনে নিয়েছিল। স্টেশন থেকে বেশি দূরে নয়, আবার লোকালয়ের একটু বাইরে। রাত কাটাতে হলে কিছু খাবারের ব্যবস্থা করা দরকার, খালি পেটে কি ভূতের মোলাকাত করা যায়, অবশ্য ভূত যদি সত্যিই থাকে।
ওরা একটা ঝোলার মধ্যে টিফিন ক্যারিয়ারে রুটি আর কষা মাংস নিয়ে গিয়েছিল, সঙ্গে জলের বোতল আর ফ্লাস্কে চা। রাত জাগতে হলে চা না হলে চলে না। স্টেশন থেকে ওরা হাঁটা দিল। বাড়ি খুঁজে পেতে ওদের কষ্ট হল না। সত্যিই পোড়োবাড়ি, অনেকটা জমি নিয়ে, আগাছা আর জঙ্গলে ভরে গেছে সেই জমি। বাড়িটা দোতলা। চুন-বালি খসে ইটগুলো যেন দাঁত বের করে আছে, কার্নিশের এখানে-ওখানে বট অশ্বত্থ গাছ গেড়ে বসেছে। আশেপাশে বাড়ি চোখে পড়ে না। বেশ গা ছম ছম করা পরিবেশ তাতে সন্দেহ নেই।
ওরা টর্চ আর এক প্যাকেট বড়ো মোমবাতি সঙ্গে নিয়েছিল। তবে সেদিন ছিল পূর্ণিমা, অন্ধকারের ভয় নেই।
ওরা বাড়িটার কাছে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে এমন সময় একজন মাঝবয়সি মানুষকে ওদের দিকেই এগিয়ে আসতে দেখল। ওদের দেখে লোকটি থমকে দাঁড়াল, যেন অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে কাকে খুঁজছেন?’
বিজন হেসে জবাব দিল, ‘ভূত।’
‘ভূত!’ লোকটি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল, বোধ হয় ওদের মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্বন্ধে সন্দেহ জাগল মনে।
‘আসলে আমরা এ বাড়িটার কথা শুনে কলকাতা থেকে এসেছি,’ অঞ্জন এবার বলল, ‘এখানে নাকি ভূতের উপদ্রবে কেউ টিঁকতে পারে না, তাই নিজের চোখে দেখতে এসেছি।’
‘আমাদের খুব ভূত দেখার শখ,’ বিজন কথার পিঠে যোগ করল, ‘অনেক পোড়োবাড়িতেই আমরা রাত কাটিয়েছি, কিন্তু ভূতের দেখা পাইনি। ভূতই বোধ হয় আমাদের ভয় পায়।’
‘আপনাদের সাহস তো কম নয়,’ লোকটি এবার বলল, ‘এখানে রাত কাটাবার জন্য কলকাতা থেকে ছুটে এসেছেন! এ বাড়ির সত্যিই দুর্নাম আছে, আপনারা ভালো কাজ করেননি।’
হো হো করে হেসে উঠল ওরা।
‘বুঝেছি,’ লোকটি বলল, ‘আপনাদের খুব সাহস।’ তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘যদি ভরসা দেন তো একটা কথা বলি।’
‘বলেই ফেলুন,’ বিজন উৎসাহ দিয়ে বলল।
‘মানে,’ লোকটি একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আমারও খুব ভূত দেখার শখ, কিন্তু একা একা সাহস হয় না। তা আপনারা যখন এসেছেন…মানে আপনারা যদি অনুমতি দেন তবে আমিও আপনাদের সঙ্গে এখানে রাত কাটাতে পারি।’
‘সে তো ভালো কথা,’ অঞ্জন বলল, ‘আমাদের একজন সঙ্গী বাড়বে।’
লোকটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, ‘তা আপনাদের রাতের খাওয়া-দাওয়ার কী ব্যবস্থা হবে?’
‘আমরা খাবার নিয়েই এসেছি,’ বিজন জবাব দিল।
‘ও, একেবারে প্রস্তুত হয়েই এসেছেন,’ লোকটি হাসল, ‘তবে আমি খেয়ে-দেয়েই আসব। আপনারা দোতলার মাঝখানের ঘরটায় থাকলেই ভালো করবেন, ওটাই একমাত্র রাত কাটাবার পক্ষে উপযুক্ত। বলেন তো আমি একটা শতরঞ্জি কি মাদুর আনতে পারি।’
‘তবে তো ভালোই হয়,’ বিজন বলল, ‘ঘরটা নিশ্চয়ই খুব নোংরা হয়ে আছে।’
‘তা আর বলতে,’ লোকটি জবাব দিল, ‘মানুষের বাস না থাকলে যেমন হয়। দাঁড়ান, আমি একটা ঝাঁটা আনছি, আপনারা ততক্ষণ ঘরটা পরিষ্কার করুন।’
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই লোকটি একটি ঝাঁটা নিয়ে ফিরে এল।
‘সিঁড়ির ধাপগুলো আস্ত নেই, সাবধানে উঠবেন,’ লোকটি বলল, ‘নইলে পড়ে ঘাড় ভেঙে আপনারাও ভূত হয়ে যাবেন।’ হ্যা হ্যা করে হেসে উঠল লোকটি।
ওরা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দোতলায় উঠতে লাগল। লোকটি মিথ্যে ভয় দেখায়নি, সিঁড়িগুলো ভেঙে পড়েছে, যেকোনো মুহূর্তে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে। বাড়িটাও যে অনেক পুরোনো সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। মাঝখানের ঘরটাই ওরা বেছে নিল। অনেকদিনের ধুলো ময়লা জমেছে। ঘরটা ঝাঁট দিয়ে একটু ভদ্রস্থ করতে বেশ খানিকটা সময় লাগল।
মাথার ওপর নীল আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ, স্নিগ্ধ সুধায় ঝলমল করছে চারদিক। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও বিজন একটু-আধটু কাব্যচর্চা করে, মুখে মুখে ছন্দ মিলিয়ে কবিতা আওড়ায়। রুপোলি সন্ধ্যা ওর কাব্যিক মনে নাড়া দিল, আবৃত্তির সুরে ও বলে উঠল:
ওগো চাঁদ
পুরাও মনের সাধ—
ঘুমে যদি ওঠে হাই
আসে যদি অবসাদ
কোরো নাকো বরবাদ
ভূত দেখা শুধু চাই—
‘বাঃ! বেড়ে কবিতা বানিয়েছেন তো,’ হঠাৎ অন্ধকার থেকে কার কণ্ঠস্বরে ভূত দেখার মতোই চমকে পেছন ফিরে তাকাল ওরা। তারপরই সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল লোকটি, তার হাতে একটা আধময়লা শতরঞ্জি। বলল, ‘এর বেশি কিছু জোগাড় করতে পারলাম না।’
‘ওতেই হয়ে যাবে,’ অঞ্জন বলল, ‘আপনি এর মধ্যেই খেয়ে এলেন?’
‘হ্যাঁ, আমি কাছেই থাকি,’ লোকটি হাসল, ‘তা ছাড়া আপনাদের সঙ্গে ভূত দেখার জন্য আমার মনটাও হাপিত্যেশ করছিল, তাই তাড়াতাড়ি চলে এলাম।’
ওরা শতরঞ্জি বিছিয়ে বসল।
‘আচ্ছা, ভূতের ব্যাপারটা কী বলুন তো?’ বিজন লোকটিকে জিজ্ঞেস করল। ‘গল্পটা রটল কেমন করে? সত্যিই কি কেউ ভূত দেখেছে?’
‘একটা কথা আপনারা বুঝতে পারছেন না কেন,’ লোকটি গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আজকালকার দিনে এমন জমি-বাড়ি মিছিমিছি পড়ে থাকে কখনো? আসলে এই সম্পত্তি নিয়েই তিন ভায়ের মধ্যে ঝগড়া বেধেছিল, সে আজ বছর পঁচিশ তো হবেই। ছোটোভাই তেমন কাজকর্ম করত না, একটু উদাসী প্রকৃতির ছিল। তাকে ঠকিয়ে ওপরের দু-ভাই সব বিষয়সম্পত্তি নিজেদের নামে করে নেবার মতলবে ছিল। সংসারে বিষয়ের মতো বিষ আর নেই, তার বীজ একবার মনে শেকড় গেঁথে বসলে তখন আর ভালো-মন্দর বিচারের ক্ষমতা থাকে না মানুষের, আপনজন হয়ে ওঠে পরম শত্রু। বড়োভাইদের আচরণে ছোটোভাই মনে এত দুঃখ পেয়েছিল যে, সে নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে তাতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। সেই অবস্থায় যন্ত্রণায় সে সারাবাড়ি ছটফট করে বেড়িয়েছিল, আর অভিশাপ দিয়েছিল কেউ এই বিষয়সম্পত্তি ভোগ করতে পারবে না। তারপর থেকেই শোনা যায় এ বাড়িতে তার আত্মা কায়েম হয়ে বসেছে, সবাইকে বাড়িছাড়া করেছে। বেঁচে থাকতে সম্পত্তির অধিকার সে পায়নি, কিন্তু মরে গিয়ে সবাইকে তাড়িয়ে পুরো বাড়িটাই দখল করে আছে। কেমন মজার ব্যাপার বলুন তো।’
নিজের রসিকতায় লোকটি হি হি করে উঠল, আর তখুনি কাছ থেকে ভেসে এল একটা কুকুরের কান্নার শব্দ।
‘ওই শুনুন,’ লোকটি বলল, ‘ওনারা ধারেকাছেই রয়েছেন, কুকুর ঠিক টের পায়। আপনারা খেয়ে নিন, রাত করবেন না।’
ওরা খেতে বসে গেল। লোকটিকেও ওদের সঙ্গে বসতে বলেছিল, কিন্তু সে বলল তার পেটে আর জায়গা নেই।
তারপর শুরু হল অপেক্ষা, ভূত দেখার অপেক্ষা। ওরা দু-বন্ধু তাস নিয়ে বসেছিল, সময় কাটাবার পক্ষে চমৎকার…কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যায় টের পাওয়া যায় না।
রাত একটা…দুটো….তিনটে বেজে গেল। ওদের হাই উঠছে, ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে।
‘ধুত্তোরি,’ হাতের তাস ছুড়ে বিজন বলে উঠল, ‘এবারও পণ্ডশ্রম, মিছিমিছি ছুটে এলাম।’
‘তাই মনে হচ্ছে,’ অঞ্জন মুখ বাঁকাল, ‘লোকে গল্প বানাতে পারলে আর কিছু চায় না।’
শেষের কথাগুলো সেই লোকটিকে ঠেস দিয়ে বলা।
লোকটি কিন্তু বিদ্রূপ গায়ে মাখল না, বলল, ‘সত্যিই আপনাদের অনেক হয়রানি হল, অনেক আশা করে এসেছিলেন।’
‘আপনিই তো বললেন এ বাড়িতে ভূত আছে, লোকে দেখেছে,’ বিজন একটু ঝাঁঝের সঙ্গেই বলল, ‘চমৎকার একটা গল্পও শোনালেন, ভূত সবাইকে তাড়িয়ে সম্পত্তি ভোগ-দখল করছে।’
‘তাই তো জানি,’ লোকটি অপরাধীর মতো মাথা চুলকাল।
‘তবে কই সেই ভূত,’ অঞ্জন প্রায় খিঁচিয়ে উঠল, ‘খুব না বলছিলেন, এবার দেখান!’
‘দেখবেন!’ লোকটি আমতা আমতা করে বলল।
‘কেন আপনি দেখাবেন?’ বিজন ব্যঙ্গ করে বলে উঠল।
‘মানে, আপনারা কলকাতা থেকে এসেছেন,’ লোকটি মিনমিন করে বলল, ‘আমাদের অতিথি, আপনাদের ভয় দেখানো কি উচিত!’
‘আমরা অত ভয়টয় পাই না,’ অঞ্জন গম্ভীর গলায় বলল, ‘তা যদি হত তবে এখানে ছুটে আসতাম না।’
‘তা এক-শোবার!’ লোকটি ঘাড় দোলাল, ‘আপনাদের সাহস আছে স্বীকার করতেই হবে।’
‘কই, ভূত দেখাবেন বললেন!’ বিজন এবার হেসে উঠল।
‘সত্যি দেখতে চান?’ লোকটি সোজাসুজি বিজনের মুখের দিকে তাকাল।
‘সত্যি না তো মিথ্যে নাকি!’ অঞ্জন মুখ বাঁকাল, ‘যতসব ইয়ে…’
‘তা ভূত আমি দেখাতে পারি, মানে এ বাড়ির ভূত,’ লোকটি যেন একটু সংকোচের সঙ্গে বলল, ‘কিন্তু সত্যি আপনারা ভয় পাবেন না তো?’
‘ভয় আমাদের কুষ্ঠিতে লেখা নেই,’ বিজন একটু বাঁকা হাসি হাসল, ‘দেখান আপনার ভূত;;; কোথায় যেতে হবে বলুন, আমরা রাজি আছি যেতে।’
লোকটি উঠে দাঁড়াল, বলল, ‘আপনারা আমাদের অতিথি, কিন্তু কী করব উপায় নেই…’
তারপরই ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। ওদের চোখের সামনেই লোকটির গায়ের মাংস যেন খসে খসে পড়তে লাগল, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সেখানে দাঁড়িয়ে শুধু একটা নরকঙ্কাল…ডান হাতটা ওদের দিকে বাড়িয়ে হি হি করে হাসছে তো হাসছেই।
অত বড়ো সাহসী দুই বন্ধুও মূর্ছা গেল।
ওদের যখন জ্ঞান হল, ভোরের আলো ঘরে ঢুকেছে, ওরা দু-জন ছাড়া ঘরে আর কেউ নেই, এমনকী শতরঞ্জিটা পর্যন্ত নেই।