সাসকোয়াচ এবং এক বাক্স সোনার গল্প

সাসকোয়াট অথবা এক বাক্স সোনার গল্প 

সবে শীতের শুরু। এর মধ্যেই রকি পর্বতের মাথার পুরু বরফ ছুঁয়ে নামতে শুরু করেছে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। অজস্র লেকে ঘেরা এই অঞ্চলে মানুষের বসবাস খুব কম। সাসকাচুয়ান প্রদেশের সিংহভাগ মানুষের বাস দক্ষিণে। ভূগোল বইতে প্রেইরী অঞ্চল বলে পরিচিত এই প্রদেশের উত্তরভাগের আকাশ ঢাকা লম্বা-লম্বা কনিফেরাস বৃক্ষের অরণ্যে আর পাথুরে মাটির ওপর মানুষ সমান উঁচু ঘাসের আচ্ছাদন। সাসকাচুয়ানের প্রাচীন উপজাতিদের মধ্যে যাঁরা এখনও রাষ্ট্রের তালিকাভুক্ত হয়ে ওঠেনি, সেরকমই একটা উপজাতি হল সাসকানি। নানা ধরনের গুহ্য বিদ্যার চর্চা আজও এরা নিজেদের সংস্কৃতি হিসেবে বজায় রেখেছে। অরণ্যের গভীরতায় নিজেদের রহস্য নিয়ে বেঁচে থাকা এই মানুষগুলোর খোঁজ নেয় না রাষ্ট্র। এর পিছনে হয়তো বা এদের সভ্য জগতের সঙ্গে মেলামেশার অনিচ্ছাও দায়ী। লেকের কনকনে ঠান্ডা জলকে স্পর্শ করে একটু কেঁপে উঠল সোফিয়া। পোষা লামা আর ভেড়াগুলোকে সন্ধেবেলায় খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দেওয়ার পর এই সময়টাই সোফিয়ার একটু আরামের সময়। ঠাকমা বুড়ি সারাদিন ঘরের বাইরে রোদে বসে লামার চামড়া জুড়ে শীতের পোশাক বানায়। পশুর হাড়ের তৈরি গুণসূঁচ আর ভেড়ার লোমের সুতো দিয়ে একটা একটা করে ফোঁড় দিতে দিতে মাঝে মাঝে ঘুমে ঢুলে পড়ে বুড়ি। আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই তন্দ্রা ভেঙে পিচুটি পড়া চোখ কুঁচকে দেখে নেয় কাজ আর কতটা বাকি। সোফিয়ার বাবা চার্লি সকালবেলা বেরিয়ে পড়ে কাজে। বছর তিন আগেই মারা গেল ওর মা। তারপর থেকেই সোফিয়ার ওপর দায়িত্ব রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সবকিছুর। খোঁয়াড়ে ওদের দুটো লামা আর দুটো ভেড়া। পাহাড়ের গায়ের ঘাসজমিতে ওদের চড়িয়ে আনাও ওর কাজ। মা যতদিন বেঁচে ছিল, সোফিয়াকে এতকিছু করতে হত না। বড়ো ভালো ছিল মা-টা। নিজের হাতে সোফিয়ার চুল বেঁধে তাতে প্রেইরী লিলি গুঁজে দিত। সেই মায়ের এমন মৃত্যু এখনও মানতে পারে না সোফিয়া। 

সেটাও ছিল এমনিই একটা শীতের শুরু। মা সন্ধেবেলায় কাঠকুটো জোগাড়ে লেগে ছিল আগুন জ্বালাবে বলে। এই মৃত্যু উপত্যকার ঠান্ডা একমাত্র আগুনের সামনেই একটু জব্দ থাকে। সোফিয়া ভেড়ার লোমের আলখাল্লা গায়ে চাপিয়ে ঘরের মধ্যে ঠাকমার পাশে শুয়ে শুনছিল ওদের পূর্বপুরুষরা কীভাবে প্রেইরীর দৈত্যকে পরাজিত করে এই তৃণভূমির দখল নিয়েছিল। সোফিয়ার বাবা তখন ভুট্টার তৈরি মদ খেয়ে প্রায় বেহুঁশ। হঠাৎ ঘরের পিছনে জঙ্গলের দিক থেকে একটা শব্দ। সোফিয়া প্রথমে ভেবেছিল বরফ ভেঙে পড়ছে পাহাড়ের গা দিয়ে। তারপর ঠাকমার মুখের দিকে তাকিয়ে টের পেল ব্যাপারটা আরও গুরুতর। ঠাকমা তখন তাকে বুকে জড়িয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে আর দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু মন্ত্র পড়ছে। তারপর হঠাৎ ওকে ছেড়ে দিয়ে নড়বড়ে পায়ে যত দ্রুত যাওয়া যায় গিয়ে দরজা দিল বন্ধ করে ভেতর থেকে। মুহূর্তের মধ্যে বাইরে মায়ের চিৎকার, একটা হুটোপুটির শব্দ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব চুপচাপ 

সোফিয়া বোধহয় একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল ঘটনার আকস্মিকতায়। কিছু একটা আঁচ করেই মায়ের নাম ধরে চিৎকার করে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল ও। কিন্তু ঠাকমা বুড়ি ওই অশক্ত দেহের সবটুকু জোর দিয়ে ধরে রেখেছিল তাকে। বাবা তো সেই রাতে কিছু টেরই পায়নি। সারারাত ঠাকমা জড়িয়ে রেখেছিল সোফিয়াকে। পরদিন সকালে ঘরের বাইরে মায়ের রক্তের দাগ আর মাংসের টুকরো ছাড়া আর কোনও চিহ্ন মেলেনি। খুব কেঁদেছিল সোফিয়া। ঠাকমা শুনিয়েছিল এক অদ্ভুত গল্প। ‘সাসকোয়াচ, সাসকোয়াচ’ বারবার বুড়ি উচ্চারণ করছিল এই শব্দটা। সদ্য গতরাত্রেই এই শব্দটার সঙ্গে পরিচিত হয়েছে সোফিয়া। সেই প্রেইরীর দৈত্য, যার সঙ্গে চালাকি করে তাকে হত্যা করেছিল তাদের পূর্বপুরুষেরা অন্তত একশ বছর আগে। বুড়ির মতে, সে আবার ফিরে এসেছে। এবার আর খালি হাতে ফেরানো যাবে না তাকে। পূর্বপুরুষদের কর্মের ফল ভুগতে হবে বর্তমান সাসকানিদের। 

ঠাকমার কথা ততদিন বিশ্বাস হয়নি সোফিয়ার, যতদিন না মায়ের মৃত্যুর পরবর্তী দু-বছরেও একজন করে সাসকানি নিখোঁজ হয়েছে। প্রতিবারই সেই শীতকাল, প্রতিবারই ওই অদ্ভুত শব্দ। বছরে শুধু একটাই বলি নেয় সাসকোয়াচ! আবার সময় হয়ে এসেছে। 

আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নামবে। লেকের জলে হাত পা ধুয়ে ঘরের দিকে হাঁটা দেয় সোফিয়া। নিস্তব্ধ তৃণভূমির মানুষ সমান ঘাসের মাথায় তখন সন্ধের শিশির জমে বরফ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। 

(দুই) 

মানুষ সমান উঁচু ঘাসজমির অন্তরালে নিজেকে লুকিয়ে ফাঁকফোকর দিয়ে নজর রাখছিল ফিলিপ। সোফিয়ার ঠাকুমা বাড়ির বাইরে বসে যেমন সেলাই করে তেমনই করছে। ওর বাবা আর একটু পরেই বেরিয়ে যাবে। সোফিয়া সারাদিনের কাজ সেরে বিকেল হতে না হতে ভেড়া আর লামা নিয়ে রওনা হয়ে যাবে পাহাড়ের গায়ের ঘাসজমির দিকে। সোফিয়ার মা বেঁচে থাকলে কতই না ভালো হত! ফিলিপের মা আর সোফিয়ার মা ছিল অভিন্নহৃদয় বন্ধু। ফিলিপ ওর মায়ের মুখে শুনেছে, দুই বন্ধুতে কথা হয়েছিল, দু’জনের ছেলেমেয়ে বড়ো হলে বিয়ে দিয়ে বন্ধুত্বকে চিরদিনের জন্য সিলমোহর দেবে। ছোটবেলা থেকে ফিলিপ এটাই জেনে এসেছে। ওর মা কতই না মজা করত এ নিয়ে। কিন্তু… কিন্তু যেদিন সোফিয়ার মা মারা গেল, তার পর থেকেই ওর মায়ের মাথাতেও গোলমাল দেখা দিল। বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়ল মা-কে নিয়ে। ব্যস, সেদিনের পর থেকে সোফিয়া আর ফিলিপের বিয়ে নিয়ে আর কোনও কথাই হয়নি। ইতিমধ্যে সোফিয়া আর ফিলিপ বালক বালিকা থেকে কিশোর কিশোরী হয়ে উঠল। কিন্তু দুই মায়ের ইচ্ছে রাখতে গেলে যে আর কয়েক বছরের মধ্যে ওদের বিবাহের বন্দোবস্ত করতে হয়, সে কথা কারো মনেই এল না। এতে সোফিয়ার কিছু এল গেল বলে মনে হল না। কিন্তু ফিলিপের হৃদয়ে ঝড় উঠল। কৈশোর উত্তীর্ণ হতে চলা ফিলিপের মন ও মস্তিষ্ক ওলটপালট করে সকাল বিকেল সোফিয়ার আসা-যাওয়া লেগেই রইল। এর মধ্যে বহুবার ফিলিপ একান্তে সোফিয়ার সঙ্গে দেখা করে নিজের মানসিক অবস্থা বর্ণনা করতে চেয়েছে। কিন্তু যতবার সে নিজের মনের কথা বলতে চেয়েছে, ততবার সোফিয়া কঠিন চোয়াল আরও কঠিন করে সরে পড়েছে ওর সামনে থেকে। যত দিন গেছে, ফিলিপের সোফিয়ার প্রতি দুর্বলতা আস্তে আস্তে ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন সকাল হতে না-হতে ফিলিপ ঘুরঘুর করতে থাকে সোফিয়াদের বাড়ির আশেপাশে। নিজেকে লুকিয়ে রাখে উঁচু ঘাসজমির পিছনে। সোফিয়ার প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ্য করে সে। দুপুরে কিছুক্ষণের জন্য বাড়িতে গিয়ে কোনওমতে চটপট বাড়ির কিছু কাজকর্ম সেরে মা-কে খাইয়ে নিজে খেয়ে বিকেল হওয়ার আগেই আবার ছুটে চলে আসে ঘাসজমির আড়ালে। সোফিয়া ভেড়া আর লামা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেই নিজেকে আড়াল করে ওর পিছু পিছু ফিলিপও পৌঁছে যায় পাহাড়ের গায়ের ঘাসজমিতে। ওখানে ঘাসজমি সোফিয়াদের বাড়ির সামনের মতো এত বড়ো আর উঁচু নয়। সেইজন্যই আগে সবাই তাদের ভেড়া আর লামার পাল নিয়ে ওখানেই চড়াতে যেত। কিন্তু সোফিয়ার মা যে বছর মারা গেল, সেবার থেকে সাসকোয়াচের ভয়ে আর কেউ যায় না। আশেপাশের ছোট ছোট মাঠঘাটেই কাজ চালিয়ে নেয়। যদিও পাহাড়ের গায়ের ঘাসজমির মতো মিষ্টি আর রসালো ঘাস এখানে নেই, তবু ওইটুকু লোকে মানিয়ে নেয়। শুধু সোফিয়াই এখনও যায়। মেয়েটার মনে কোনও ভয়ডর নেই। ফিলিপ লুকিয়ে দেখেছে, পোষা ভেড়া আর লামাদের চড়তে দিয়ে সোফিয়া কিছুক্ষণ মাঠে গড়াগড়ি খায়, যতক্ষণ রোদ্দুর থাকে; তারপর একটা বার্চ গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে গলা ছেড়ে সাসকানি লোকগীতি গাইতে থাকে। এরপর বেশ কয়েকদিন ফিলিপ দেখেছে সোফিয়া হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছে পশুচারণের ঘাসজমি ছাড়িয়ে পাহাড়ের দিককার ঘন বনের মধ্যে। ভয়ে গা হিম হয়ে গেছে ফিলিপের। সোফিয়াকে অনুসরণ করার ইচ্ছে হলেও পা সরেনি তার। উলটে চিন্তা হয়েছে, যে মেয়ের ভয়ডর বলে কোনও পদার্থ নেই, তাকে বিয়ে করাটা কি ঠিক হবে? অন্ধকার নেমে আসছে দেখে ফিরে এসেছে ফিলিপ। বেশ কিছুক্ষণ পর ভেড়া-লামাগুলোকে নিয়ে ফিরেছে সোফিয়া। পশুগুলোকে খামারে ঢুকিয়ে লেকের জলে হাত পা ধুয়ে ঘরে ফিরেছে সে। ফিলিপ জানে, আর ঘর থেকে বেরোবে না সোফিয়া। তাই সেদিনের মতো তারও কাজ শেষ। এক একবার সে ভাবে, সোফিয়াকে ডেকে নিষেধ করে পাহাড়ের গায়ের ঘাসজমিতে বা বনে যেতে। কিন্তু সত্যি বলতে সাহসে কুলোয় না। সোফিয়ার ব্যক্তিত্বকে একটু সমীহ করেই চলে ফিলিপ। তাছাড়া সোফিয়া নিজেও কি জানে না? সাসকানিদের মধ্যে প্রচলিত লোককথা বলে, অনেকদিন আগে যিনি সাসকোয়াচকে প্রেইরি থেকে চিরতরে বিদায় করতে সাসকানিদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি সোফিয়ার প্রত্যক্ষ পূর্বপুরুষ। তিনি ছিলেন সাসকানিদের মিডিউ। তন্ত্র মন্ত্র ঝাড়ফুঁক জাদুবিদ্যায় তার সমকক্ষ কেউ ছিল না গোটা সাসকানি উপজাতিতে। কিন্তু এ কথাও জানা যায়, ওই মিডিউ পাপ করেছিলেন। সাসকোয়াচকে হত্যা করার জন্য তিনি যে পথ নিয়েছিলেন তা ঈশ্বর সমর্থন করেন না। এর শাস্তি হিসেবে তাঁদের পরিবারকে একঘরে করা হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল, তাদের পরিবারের কেউ আর মিডিউ হতে পারবে না। যদিও এতবছর পরে একঘরে করার আইন আর মানা হয় না, তবে ওদের পরিবার থেকে মাতব্বর নির্বাচন হয় না। লোকে বলে, এর বদলা নিতে আবার ফিরে এসেছে সাসকোয়াচ। সোফিয়ার মাকে দিয়েই শিকার শুরু করেছে সে। তারপর প্রতি বছর একজন করে সাসকানি…. 

সোফিয়ার মায়ের পর একটা বাচ্চা ছেলে, রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে উঠেছিল, সকালে রক্তের দাগ ছাড়া আর কিছু মেলেনি; আর গত বছর ন্যান্সি বুড়ি। বুড়ি একাই থাকত। সবাই দয়া করে খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল। কী হয়েছিল কে জানে! বুড়ির নড়বড়ে ঘর ভেঙে পড়েছিল। সবাই ভেবেছিল বাড়ির তলায় চাপা পড়ে মরেছে বুড়ি। কিন্তু না, কোথাও ওর দেহ মেলেনি। ভাঙা বাড়ির নীচে হয়তো চাপা পড়ে গিয়েছিল ওই দড়িপাকানো শরীরের রক্তমাংসের চিহ্ন… যদি অবশ্য কিছু থেকে থাকে। এর পর সবাই নিশ্চিত হয়ে যায়, এ কাজ সাসকোয়াচ ছাড়া আর কারোর নয়। সোফিয়াও সে কথা জানে। এও জানে, পাহাড়ের গায়ের ওই বনেই শেষ শয্যায় শায়িত আছে সাসকোয়াচ। বনের ঠিক কোথায় কেউ জানে না। কিন্তু এটা সবাই জানে, ওই বনে যেতে নেই। এমনকি যখন পাহাড়ের গায়ে পশু চরাতে যেত সবাই, বিকেল গড়ানোর আগেই ফিরে আসত। বনের দিকে যাওয়া তো দূর, তাকাতও না পর্যন্ত। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফিলিপ ঠিক করে আজকে ও সোফিয়াকে অনুসরণ করে ওখানে যাবে না। অপেক্ষা করবে এখানেই। পশু চরিয়ে ফিরে সোফিয়া যখন হাত পা ধুতে লেকে আসবে, তখনই মুখোমুখি হবে ওর। আজ তাকে সাহস আনতেই হবে মনে। সে তো একসময় সোফিয়ার স্বামী হবে, নিজের স্ত্রীকে বশে না রাখতে পারলে লোকে কী বলবে? দরকার হলে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। বুকের পেশি ফুলে ওঠে ফিলিপের। 

(তিন) 

ঠোঁটের কোণে সিগারেটটা ঝুলিয়ে কাউবয় হ্যাটটা দিয়ে চোখ ঢেকে গাড়ির বনেটের ওপর পায়ের ওপর পা তুলে শুয়ে ছিল ড্যানিয়েল। হেমন্তের শেষ সূর্যের উষ্ণতা গায়ে মেখে নিতে নিতে গুনগুন করে গান ভাঁজছিল সে। 

“হাই ড্যানি, হোআস্ সাপ?” 

মুখের ওপর থেকে হ্যাটটা সরিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল ড্যানিয়েল। তারপর ঠোঁট থেকে সিগারেটটা দু-আঙুলের ফাঁকে চালান করে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে টুপিটা মাথায় পড়ল, একটু হেসে প্রশ্নকর্তাকে সংক্ষিপ্ত সম্ভাষণ জানাল ‘হাই জুডিথ’। 

“ইউ রেডি? লেটস গো।” জুডিথের কথায় ড্যানিয়েল গাড়ির প্যাসেঞ্জার-সিটের দরজা খুলে ধরল। জুডিথ স্বভাবসুলভ একটা তরতাজা হাসি হেসে উঠে বসল গাড়িতে। ড্যানিয়েল গাড়ির ওদিকের দরজা বন্ধ করে ড্রাইভারের সিটে এসে বসল। তারপর গাড়ি স্টার্ট করে এগোতে লাগল তাদের গন্তব্যের দিকে। 

জুডিথ বছর বাইশের অ্যাফ্রো-আমেরিকান মেয়ে। মাথা ভর্তি স্প্রিং-এর মতো কোঁকড়া চুল, পুরু ঠোঁট, ভরভরন্ত চেহারা, মুখে হাসি লেগেই আছে। ড্যানিয়েলের জীবনটা তবু যে একটা নির্দিষ্ট পথে বইছে, এর পিছনে জুডিথের অবদান প্রায় পুরোটাই। জুলজি পড়তে গিয়ে কলেজে পরিচয় জুডিথের সঙ্গে। পড়াশুনায় বেশ ভালো, পাশাপাশি সদাহাস্যময় জুডিথকে কলেজের শিক্ষক থেকে ছাত্র সবাই পছন্দ করত। ড্যানিয়েল অবশ্য প্রথম থেকেই ছিল বিগড়ে যাওয়া। বয়সেও কিছুটা বড়ো সে অন্য ছাত্রছাত্রীদের তুলনায়। ছোটবেলা কেটেছিল অসহ্য দারিদ্র্যের মধ্যে। কাজেই পড়াশোনা শুরুই হয়েছিল দেরিতে। মদ্যপ বাবা, খিটখিটে মা, এক পাল কুকুরছানার মতো ভাইবোনদের মধ্যে বেড়ে ওঠা। চার্চের একজন ফাদারের চোখে পড়ে যাওয়ায় তাঁর সুপারিশে শহরের একজন বিত্তবান ব্যবসায়ীর ট্যাক্সি সার্ভিস কোম্পানির গাড়ি চালানোর পার্টটাইম কাজ পেয়ে গিয়েছিল ড্যানিয়েল, তাতে পড়াশোনাটুকু চলছিল। কিন্তু কলেজে গিয়েই এক বকাটে গ্রুপে মেশা শুরু করেছিল ড্যানিয়েল। মারিজুয়ানা, কোকেইন, বেঞ্জোস-কিছু আর বাকি ছিল না। পরীক্ষায় অসম্ভব খারাপ গ্রেড আসার পর ফাদার রেগে গেলেন, তাঁর কানে সবই গিয়েছিল। তিনি প্রায় ঠিক করেই ফেলেছিলেন ড্যানিয়েলকে পাঠিয়ে দেবেন রিহ্যাবে। এই সময় হাত বাড়িয়েছিল জুডিথ। 

জুডিথ তখন কলেজের শেষ পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তরে পরবর্তী স্তরে যাওয়ার অপেক্ষায়। এমন সময় জানা গেল জুডিথ আর জুলজি পড়বে না। ওর এক আঙ্কেলের সঙ্গে রিসার্চ করবে। একদিন বিকেলে শ্রান্ত, বিভ্রান্ত ড্যানিয়েলকে ডেকে জুডিথ নিজেই প্রস্তাব দিয়েছিল তার আঙ্কেলের রিসার্চ টিমে কাজ করার অবাক হয়ে গিয়েছিল ড্যানিয়েল। সে তখন প্রাণপণে চাইছে পুরনো সবকিছুকে ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করতে। সেদিন পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে জুডিথ বলেছিল তার আঙ্কেলের রিসার্চের ব্যাপারে। জুডিথের আঙ্কেল মাইকেল মিলার ছিলেন জুলজির প্রফেসর। কিন্তু তাঁর পছন্দের বিষয় ছিল আর পাঁচজনের চেয়ে আলাদা। তিনি যা নিয়ে এগোতে চেয়েছিলেন, তার নাম ক্রিপ্টোজুলজি। এই বিষয়ে রিসার্চ করবেন বলে বছরে সত্তর হাজার ডলারের চাকরি এককথায় ছেড়ে চলে আসেন, কারণ তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর ছিলেন তারা রাজি হয়নি এই রিসার্চে সাহায্য করতে। পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে একটা রিসার্চ টিম তৈরি করেছেন। নাম দিয়েছেন ‘বোস্টন ক্রিপ্টোজুলজি রিসার্চ টিম’। জুডিথের বাবা-মা মারা যাওয়ার পর এই আঙ্কেলের বাড়িতে থেকেই বড়ো হয়েছে সে। কাজেই ওর এই টিমে থাকার কারণটা স্পষ্ট। ড্যানিয়েলকে সে কেন সিলেক্ট করল, আর কারাই বা আছে টিমে, রিসার্চটা ঠিক কী নিয়ে, এসবের উত্তর পেতেই আজ জুডিথের সঙ্গে সে চলেছে জুডিথের আঙ্কেলের বাড়িতে। আজকের আগে ড্যানিয়েলকে একমাস সময় দিয়েছিল জুডিথ। এই একমাস সে সম্পূর্ণ ভদ্র সভ্য জীবনযাপন করবে বলে কথা দিয়েছিল। কথা রেখেছে ড্যানিয়েল। তারই ফলস্বরূপ আজ জুডিথের আঙ্কেলের টিমে তার প্রবেশ ঘটতে চলেছে। 

শহরের শেষপ্রান্তে একটা বেশ বড়ো বাড়ি। একতলা, কিন্তু অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়ানো। বাড়ির বাউন্ডারির চারিদিকে গাছপালা, ছোট বড়ো নানা ধরনের ফুল-ফলের গাছ। বাড়ির মালিক যে বেশ শৌখিন তা বলে দিতে হয় না। জুডিথের নির্দেশে এই বাড়ির সামনে এসেই গাড়ি থামাল ড্যানিয়েল। জুডিথের পিছু পিছু বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই দরজা খুলে গেল। একজন মাঝবয়সী টাকমাথা লোক, পরনে হাউসকোট, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। চশমার কাচের পিছন থেকে অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখ ওদের দেখছিল। জুডিথ দৌড়ে গিয়ে আলিঙ্গন করল ভদ্রলোককে। 

“হেই ওল্ড ম্যান, হাউ আর ইউ?” 

ভদ্রলোকের গায়ের রং ফর্সা। ড্যানিয়েল অবশ্য কোনও অ্যাফ্রো-আমেরিকানকেই আশা করেছিল। সে অনুমান করল, ভদ্রলোকের সঙ্গে হয়তো জুডিথের রক্তের সম্পর্ক নেই। দু’জনের শিশুর মতো খিলখিল হাসি আর আলিঙ্গন, প্রতি-আলিঙ্গনের পালা শেষ হতে ড্যানিয়েলের দিকে নজর গেল ভদ্রলোকের, “ড্যানিয়েল, রাইট? তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লাগছে। আমি মাইক।” 

ড্যানিয়েলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। ড্যানিয়েল হাত এগিয়ে দিতে বুঝতে পারল ভদ্রলোককে দেখতে যতটা সাদামাটা লাগে, ততটা তিনি নন। শুধুমাত্র কব্জির জোরে তিনি ড্যানিয়েলকে গুনে গুনে তিন গোল দিতে পারেন। বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ডে একটা বড়ো জায়গা জুড়ে মাইকের অফিস। দেওয়ালে প্রচুর বইপত্র, প্রোজেক্টার, নানা ধরনের অদ্ভুত প্রাণীর ছবি। ছবিগুলো হাঁ করে দেখছিল ড্যানিয়েল। এরকম প্রাণী পৃথিবীতে আছে বলে ধারণা ছিল না তার। জুলজি পড়ার সুবাদে নানা ধরনের বিচিত্র প্রাণিজগৎ সম্পর্কে তার ধারণা আছে। অবশ্য ধারণাটা শুধু ধারণাই বলা চলে। পড়াশুনো বলতে যা বোঝায় সেটা তো সে প্রায় করেইনি। এই ছবিগুলো দেখতে দেখতে মাইকের কাজকারবার সম্পর্কে কৌতূহল জাগছিল তার। 

একটা বড়ো অর্ধচন্দ্রাকৃতি টেবিলের ভেতরের দিকে বসলেন মাইক। তাঁর মুখোমুখি পাশাপাশি রাখা দুটো চেয়ারে সে আর জুডিথ। ইতিমধ্যে জুডিথ এই ঘরের ভেতরের দিকে কিউবিকলের পেছন থেকে একটা ফ্লাস্ক এনে তিনটে মাগে কফি ঢেলে তাদের দিয়েছে, নিজেও নিয়েছে। কফির মাগে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে মাইক তাকালেন ড্যানিয়েলের দিকে। এতক্ষণ তাঁর মুখে লেগে থাকা হাসি এখন উধাও। 

“তুমি জুডিথের কাছে আমার রিসার্চের সম্পর্কে কিছুটা শুনেছ বলেই ধরে নিচ্ছি। যদিও পুরোটা বলতে আমিই ওকে বারণ করেছিলাম, আমার মতো করে বুঝিয়ে ও বলতে পারবে না বলে। তাতে তোমার কিছু ভুল ধারণা হতে পারত।” একটু চুপ করে আবার মুখ খুললেন মাইক, “ক্রিপ্টোজুলজি সম্বন্ধে তোমার কোনও ধারণা আছে?” 

ড্যানিয়েল নিঃশব্দে মাথা ও কাঁধ ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দিল তার এ ব্যাপারে কোনও ধারণাই নেই। মাইক এবার দেওয়ালের ছবিগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “এগুলো দেখে কী মনে হয়?” 

ড্যানিয়েল একবার ভেবে নিল, যা মনে হয় সেটা বলা ঠিক হবে কিনা! তারপর বলল “মনে হয় এই জীবগুলো কোনও রূপকথা থেকে উঠে এসেছে।” 

মাইকের মুখে আগের হাসি ফিরে এল আবার। 

“ঐ যে দেখছ জলে জিরাফের মতো মাথা উঁচু করে আছে যে প্রাণীটা, ওটার নাম লক-নেস মনস্টার। লোকে বলে স্কটিশ হাইল্যান্ডের জলাশয়ে এর দেখা মেলে। এই ফটোগ্রাফটাও সত্যি বলেই দাবি করা হয়। স্থানীয় মানুষের কাছে এর একটা আদরের নাম আছে, নেসি। এর পাশের যে প্রাণীটাকে দেখছ, ওর নাম জার্সি ডেভিল। এই ফটোটা বর্ণনা শুনে আঁকা। একে দক্ষিণ নিউ জার্সিতে দেখা গেছে বেশ কয়েকবার। ধরো, একটা ক্যাঙ্গারুর মতো প্রাণী, যার ঘোড়ার মতো মাথা, বাদুড়ের মতো ডানা, দুটো লম্বা বলিষ্ঠ ঠ্যাং, অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট হাত, শক্ত বাঁকানো নখ, শয়তানের মতো তীক্ষ্ণ লেজ আর রক্ত হিম করে দেওয়ার মতো গলার আওয়াজ। মনে হয় না দেখতে পেলে খুব খুশি হবে, তাই না?” 

নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলেন মাইক। জুডিথও যোগ দিল। ড্যানিয়েল এখনও কিছুই তেমন বোঝেনি। তাই মাইকের পরবর্তী ছবিতে সে মন দিল। মাইক বলে চললেন, “পরের ছবিতে যে জিনিসটাকে দেখতে পাচ্ছ, সেটাকে কোনও পরী-টরি ভেবে ভুল করো না যেন। কিছু বছর আগে একটা ফিল্ম হয়েছিল ‘মথম্যান প্রফেসি’ বলে। সেটা এই প্রাণীর অস্তিত্বের উপর নির্ভর করেই তৈরি। তারও আগে বই লেখা হয়েছিল। বলতে পারো, একটা মানুষের মতো পাখি, বা পাখির মতো মানুষ। যেটা বলতে তুমি স্বচ্ছন্দ বোধ করবে। ওর নাম মথম্যান। তার পাশের ছবিতে যাকে দেখছ, শোনা যায় আমেরিকার বেশ কিছু জায়গায় তার দেখা মেলে। মূলত ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি প্রাণীর রক্ত শুষে খায় বলেই এর দুর্নাম, কিছুক্ষেত্রে মানুষকে আক্রমণ করেছে এমনও জানা যায়। ওর নাম চুপাকাবরা। যে ছবিটা দেখছ, সেটা অবশ্য শিল্পীর কল্পনা, তবে দেখতে যে সে ভয়ংকর সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।”

প্রায় ঠান্ডা হয়ে আসা কফিটুকু এক চুমুকে শেষ করে ফেলেন মাইক। তাঁর মুখ দেখে মনে হচ্ছে, হঠাৎই কোনও দুশ্চিন্তা গ্রাস করেছে তাঁকে। ড্যানিয়েল অনুমান করতে পারছে দেওয়ালের শেষতম ছবিটি সম্পর্কে মাইক এবার কিছু বলতে চলেছেন। এই ছবিটি অন্যগুলির তুলনায় অনেক কম অস্বাভাবিক। একটা গরিলার মতো দেখতে জন্তু, তবে উচ্চতা অনেকটা বেশি বলেই মনে হয়। 

“বিগফুট, ইয়েতি বা সাসকোয়াচ… যে নামে খুশি ডাকতে পারো একে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দেশে, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ একে দেখেছে বলে দাবি করে। একাধিক ফোটোগ্রাফ পাওয়া গেছে, খুব ভরসাযোগ্য না হলেও কোনওটাই উড়িয়ে দেওয়া যায়নি। এমনকি নেপালসহ বেশ কয়েকটি দেশে একে দেবতার মতো পূজা করা হয়। দেখতেই পাচ্ছ চেহারা গরিলার মতো হলেও আকারে অতিকায়। সাধারণত বরফঢাকা পার্বত্য অঞ্চলে এর বাস।” 

এতক্ষণে মুখ খুলল ড্যানিয়েল, “আপনার রিসার্চ কি একে নিয়েই?” চোখ তুলে তাকালেন মাইক। চোখে তাঁর মুগ্ধতা 

সাসকোয়াচ অথবা এক বাক্স সোনার গল্প 

“বুঝতে পারছি জুডিথ কেন তোমাকে নির্বাচন করেছে এই কাজের জন্য।” জুডিথ আর মাইক পরস্পরের দিকে চেয়ে হাসল। “দেখো ড্যানিয়েল, এই যে যাদের তুমি ছবিতে দেখলে, এ ছাড়াও বহু ধরনের ক্রিপটিড রয়েছে। ও হ্যাঁ, বলা হয়নি, এদের বলে ক্রিপটিড। যাদের অস্তিত্ব বিজ্ঞান স্বীকার না-করলেও অস্বীকার করতেও পারেনি। এদের নিয়ে রিসার্চ করার চেয়ে বুনো হাঁসের পিছনে ছোটা সহজ। যে কয়জন বিজ্ঞানী এদের নিয়ে রিসার্চ চালিয়েছেন, তাদের মধ্যে প্রায় সবাই সম্পূর্ণ বিফল, খুব সামান্য এক দু’জন দাবি করেছেন তাঁরা কিছু দূর এগোতে পেরেছেন। যদিও তা আধুনিক বিজ্ঞানকে বোঝাবার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ নয়। সেইজন্য ক্রিপ্টোজুলজিকে এখনও বিজ্ঞানের মর্যাদা দেওয়া হয়নি, একে বলে সিউডো সায়েন্স বা ছদ্ম বিজ্ঞান।”, বলতে বলতে কঠিন হয়ে ওঠে মাইকের মুখ 

জুডিথ তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো বলে ওঠে, “বাট আই নো ইউ ক্যান প্রভ দেম রং।” 

‘থ্যাঙ্ক ইউ প্রিটি গার্ল”, মাইক ম্লান হাসেন। 

“গত কুড়ি বছর ধরে আমি এই বিগফুট বা সাসকোয়াচকে নিয়ে রিসার্চ করার চেষ্টা চালাচ্ছি। কিছুদিন আগে আমার এক সোর্স আমাকে জানায় কানাডার প্রেইরি অঞ্চলের এক জনবিরল এলাকায় সাসকোয়াচের আক্রমণে একাধিক মানুষ মারা গেছে গত দু-বছরে। যদিও কোনও প্রমাণ নেই যে সেটা সাসকোয়াচেরই কাজ, তবু স্থানীয় মানুষের তাই বিশ্বাস। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আঞ্চলিক মানুষের বিশ্বাসের পিছনে অবশ্যই কোনও না কোনও কারণ থাকে। বিশ্বাস ভুল হতে পারে, কিন্তু অযৌক্তিক সাধারণত হয় না। দেখ, ওরা তো বলতে পারত ড্রাগন মেরেছে, বা কোনও মনস্টার… কই, বলছে না তো! বলছে সাসকোয়াচ মেরেছে। কেন? সেটাই জানতে চাই আমি। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমাকে ওখানে যেতেই হবে। আমার উদ্দেশ্য এটা প্রমাণ করা যে সাসকোয়াচ বাস্তবে আছে অথবা ছিল। তার জন্য আমাকে সাহায্য করবে একটা টিম। তারা আমার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যাবে, আর তথ্য সংগ্রহ করবে। ভাগ্য ভালো হলে একটা স্পষ্ট ছবি, নয়ত নিদেনপক্ষে কিছু ডি.এন.এ স্যাম্পল… নখ, দাঁত, গায়ের লোম… যা হোক। আমার বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে সাহায্য করেনি, এমনকি আমি এসব আজগুবি বিষয় নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের কাছে যেন মুখ না খুলি, তাই নিয়ে রীতিমতো হুমকি দিয়েছিল আমাকে। এক কথায় ছেড়ে দিয়েছিলাম চাকরি। ভাগ্যে কিছু পৈতৃক সম্পত্তি ছিল! তাই দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তুললাম আমার টিম। ইদানীং কিছু স্পনসরও জুটেছে। এতদিনে আমি বলতে পারি, আমি প্রস্তুত। যারা .আমাকে চূড়ান্ত অপমান করে বাধ্য করেছিল চাকরি ছাড়তে, তাদের আর গোটা দুনিয়াকে আমি এবার দেখিয়ে দেব যে আমি বাজে কথা বলি না। কিন্তু এতে তোমাদের সাহায্য আমার দরকার হবে।” মাইক উৎসুক দৃষ্টিতে ড্যানিয়েলের মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু ড্যানিয়েলের এখনও কিছু জানার ছিল। 

“কিন্তু আমাকে কেন আপনাদের সঠিক লোক বলে মনে হল? আমি তো এসবের কিছুই জানি না।” 

“আমাদের টিমে আমাকে আর জুডিথকে নিয়ে সদস্য আছে চারজন। আর তোমাকে ধরলে পাঁচজন। জুডিথ অন্যদের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেবে। ওদের কারো পিছুটান নেই। আমারও না, জুডিথেরও না। …আর তোমারও না। এই রিসার্চে বছরের পর বছর দেশের বাইরে থাকতে হতে পারে, সারা জীবনও। প্রাণসংশয়ও হতে পারে। যদিও টাকা তোমরা মন্দ পাবে না! তবে চ্যালেঞ্জটাই এখানে আসল বেতন। যদি সেই মানসিকতা থাকে, তবে তৈরি হয়ে নাও। কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে।” 

মাইকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বেশ কিছুটা পথ আসার পরও সংশয় কাটেনি ড্যানিয়েলের। লোকটা কি সত্যি বিজ্ঞানী, না পাগল? ওই অদ্ভুত জীবগুলোর পিছনে ছুটে আদৌ কী লাভ? যেখানে বিজ্ঞান পর্যন্ত এদের অস্তিত্ব অস্বীকার করে? আর জুডিথ, সেই বা কোন্ আশায় এসবের পিছনে ছুটছে? প্রশ্নগুলো জুডিথকে করেই ফেলে ড্যানিয়েল। ড্যানিয়েলের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে জুডিথ হয়তো-বা একটু গুছিয়ে নেয় কথাগুলো। 

তারপর ধীর কণ্ঠে বলে, “ড্যানি, তোমাকে আমার জীবনের অনেক কথাই বলা হয়নি। তেমন কাউকেই বলিনি আমি। আমার আঙ্কেল আসলে আমার বাবার বন্ধু। বাবা আর আঙ্কেল একই বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতেন। আঙ্কেলের কথা আর কেউ বিশ্বাস না করলেও বাবা করেছিল। তাই এই রিসার্চের শুরুর দিকে আঙ্কেল আর বাবা দুজনে গিয়েছিলেন এক অভিযানে। কানাডিয়ান শিল্ডের এক ঘন জঙ্গলে তাঁরা দু’জন গিয়েছিলেন সাসকোয়াচের সন্ধানে। কোথাও থেকে তাঁরা ওখানকার এক লোককথা জানতে পারেন, যেখানে স্পষ্টতই বহুদিন আগে ওখানে সাসকোয়াচের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। এই বিষয়ে আমি খুব বেশি জানি না। আঙ্কেল সময় হলে নিশ্চয়ই সব বলবেন। সেখানে গিয়ে আমার বাবা রাতারাতি উধাও হয়ে যান। তাঁর আর কোনও সন্ধানই পাওয়া যায়নি। এমনকি আমি এও জানি না, উনি আদৌ বেঁচে আছেন কিনা! আমার মা আমার ছোটবেলাতেই মারা গেছেন। বাবা ছাড়া আমার আর কেউ ছিল না। এরপর আঙ্কেল আমার সব দায়িত্ব নেন। ওঁর মতো ভালো মানুষ আমি দেখিনি। জীবনের বারোটা বছর আমি আঙ্কেলের সঙ্গে কাটিয়েছি। আমার বাবার সব দায়িত্ব উনি হাসিমুখে পালন করেছেন। অথচ বাবার ব্যাপারটার জন্য আঙ্কেলকে কম অপমানিত হতে হয়নি। ওঁদের কর্মক্ষেত্র ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়, সেখান থেকে ওঁকে চিরতরে বিতাড়িত করা হয়েছে। কোনওদিন কোনওভাবেই যেন উনি ওদের কোনও বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে না পারেন, তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।” 

জুডিথের বড়ো বড়ো চোখদুটো জলে ভরে গেল। ড্যানিয়েল গিয়ার থেকে হাত সরিয়ে ওর পিঠ চাপড়ে দিল। নিজেকে সামলে নিয়ে জুডিথ বলল, “আমি নিজে দেখেছি, আঙ্কেল তার রিসার্চের জন্য কত চেষ্টা করেছেন। এক একটি উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে, আঙ্কেল আবার যেন নতুন উদ্যমে লেগে পড়েছেন। তুমি দেখো ড্যানি, এবার উনি সফল হবেনই। আর ওঁর সাফল্য মানে আমাদেরও সাফল্য। সারা পৃথিবীতে আমাদের নাম ছড়িয়ে পড়বে। টাকার জন্য আর চিন্তা করতে হবে না। তুমি কি চাও না একটা সচ্ছ্বল জীবন কাটাতে? শোনো ড্যানি, আমাদের টিমের বাকি দু’জন, হ্যারি আর বেঞ্জামিন কয়েকদিন আগেই ফিল্ডে চলে গেছে। আমরা পৌঁছালেই কাজ শুরু হবে। তুমি আর আপত্তি করো না প্লিজ।” 

জুডিথের কথা শুনতে শুনতেই ড্যানিয়েল ঠিক করে ফেলেছিল কাজটা সে করবে। তার শুকনো বালিয়াড়ির মতো নীরস জীবনে একটুকরো মেঘের ছায়া পড়েছে সবে। এই কাজটা না করলে হয়তো সেই মেঘটা আর কোনওদিনই অমৃতধারা হয়ে ঝরে পড়বে না। তার সেই জলভরা মেঘের দিকে নরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে ড্যানিয়েল একটু হাসল। তারপর বলল, “আমি তো আপত্তি করিনি।” জুডিথ গাড়ির মধ্যেই প্রায় লাফিয়ে উঠল। নেহাত সিটবেল্টের জন্য অল্পেই থেমে গেল। মুখে আনন্দসূচক একটা আওয়াজ করে পকেট থেকে সেলফোন বের করে ডায়াল করতে লাগল আঙ্কেলকে সুখবরটা দেবে বলে। এদিকে ড্যানিয়েল বোধহয় বোঝার চেষ্টা করছিল, সেই জলভরা মেঘটা নিজের ছায়া দিয়ে আরও একটু ঢেকে দিল কিনা তার বালিয়াড়িকে। 

(চার) 

গতকাল সবে মাইক, ড্যানিয়েল আর জুডিথ কানাডার গ্র্যান্ড প্রেইরি এয়ারপোর্টে নেমেছে। প্রেইরি উপত্যকার এক নির্জন ঘাসজমির আড়ালে ওদের তাঁবু পড়েছে। এখানে এসে ড্যানিয়েলের সঙ্গে আলাপ হয়েছে হ্যারি আর বেঞ্জামিনের। হ্যারি বছর ত্রিশ বত্রিশের যুবক। অবিবাহিত, ইউএস আর্মিতে ছিল। একটা অনাথ আশ্রমে ওর বেড়ে ওঠা। উগ্রপন্থী হামলায় আহত হয়ে একটা পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এখন চাকরি থেকে অবসর নিয়ে মাইকের টিমে নাম লিখিয়েছে। সবরকম আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে পটু। কাজেই সে হল টিমের সিকিউরিটি কাম গার্ড। পাথরে কোঁদা স্বাস্থ্য দেখলে ভরসা করতে ইচ্ছে করে বৈকি। তবে হাঁটার সময় সামান্য খুঁড়িয়ে চলে। 

বেঞ্জামিনের বয়স হবে চল্লিশের আশেপাশে। পেশায় ছিল পশুপাখির ডাক্তার। লোকটার বউ ছেলেমেয়ে একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। তারপর বেশ কিছুদিন ওকে অ্যাসাইলামে থাকতে হয়েছিল। লোকটা এখনও একটুও হাসে না। মূর্তির মতো মুখে আর চাউনিতে কেমন কসাই-কসাই ভাব। জুডিথ যখন ড্যানিয়েলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল, তখন বেঞ্জামিন একটা পাথরের উপরে একটা বড়ো ছুরিতে শান দিচ্ছিল। এখানে সবার জন্য রান্নাবান্না ওই করে। ড্যানিয়েলকে দেখে ওর মুখের একটা রেখাও কাঁপল না, শুধু বাঁ হাতটা সামান্য তুলে অভিবাদন জানালো তাকে। 

পাশাপাশি তিনটে তাঁবু। একটাতে হ্যারি, বেঞ্জামিন আর এখন থেকে ড্যানিয়েলের থাকার জায়গা। আর একটাতে মাইক, অন্যটায় জুডিথ। জুডিথের তাঁবুটা বাকি দু’টোর মাঝখানে। তাঁবুগুলোর একপাশে একটা বিরাট বড়ো ট্রাক। ওতে নাকি প্রচুর খাবারদাবার, আগ্নেয়াস্ত্র ইত্যাদি রয়েছে। হ্যারি আর বেঞ্জামিন ওতে করেই এখানে এসেছে। এখন থেকে ওই ট্রাকটা চালানোর দায়িত্ব ড্যানিয়েলের। এই অঞ্চলে মানুষের বসবাস খুব কম। তাঁবু ফেলার জায়গা থেকে কয়েক বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে কেবল সাসকানি নামে এক উপজাতি সম্প্রদায়ের বাস। তাদের সংখ্যাও বেশি নয়। এই সাসকানিরা নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষা করার জন্য বাইরের জগতের সঙ্গে খুব একটা মেশে না। এরাই হল সেই সম্প্রদায়, যাদের লোককথায় সাসকোয়াচের সন্ধান মেলে। জুডিথের বাবা ও মাইক একসময় এই কানাডিয়ান শিল্ডেই এসেছিলেন সাসকোয়াচের খোঁজে। আবার এতবছর পর আবার সেই একই উদ্দেশ্যে তাঁর আসা, তবে এবার তাঁর টিম রয়েছে তাঁর সঙ্গে। কাল আসার পর থেকে ওরা পাঁচজন মিলে কর্মপন্থা স্থির করেছে। প্রথমে সাসকানিদের হাত করতে হবে। ওদের সাহায্য ছাড়া সাসকোয়াচের সন্ধান পাওয়া সম্ভব নয়। সেই উদ্দেশ্যে মাইক বোস্টন থেকে প্রচুর টিনড ফুড, ওষুধ, পানীয় ইত্যাদি নিয়ে এসেছে। তাছাড়া সত্যি যদি সাসকোয়াচকে দেখা যায়, সঙ্গে আনা ঘুমপাড়ানি গুলি দিয়ে তাকে কব্জা করা যায়, তবে ওর অতবড়ো শরীরটা বয়ে আনার জন্যও লোক লাগবে। তখন এই উপজাতি লোকগুলোই কাজে আসবে। আবার সাসকোয়াচকে ধরতে এসেছে শুনলে হিতে বিপরীতও হতে পারে। কাজেই স্থির হল, ওদের কাছে মাইক নিজেদের পরিচয় দেবে আমেরিকার সরকারি চিকিৎসা দল হিসেবে। এতে ওদের ঘরে ঘরে পৌঁছনো অনেক সহজ হবে। বেঞ্জামিন চিকিৎসক, সে হোক না কেন পশুর; চিকিৎসার প্রয়োজন হলে ও সামলে নিতে পারবে। 

সাসকানিদের সঙ্গে ভাব জমানোর জন্য সরকারি পরিচয়, টিনড ফুড আর ওষুধগুলো কাজে এল। প্রথমটায় ওরা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে দূর থেকে দেখছিল ঠিকই তবে ধীরে ধীরে সহজ হয়ে এল। দেখা গেল সাসকানিদের নতুন প্রজন্ম নিজেদের মধ্যে সাসকানি ভাষা ব্যবহার করলেও মাঝে মাঝে শহরে যেতে হয় বলে ওরা ইংরেজি জানে। জুডিথের সঙ্গে ওদের ঘরের মেয়েদের বেশ ভাব হয়ে গেল। সাসকানিদের মাতব্বর লোকটি খুব বৃদ্ধ। প্রায় শয্যাশায়ী বলা যায়। তাদের মাতব্বরকে এখন আর মিডিউ বলে না। কারণ মিডউইউইনের কঠিনতম প্রয়োগগুলো তাদের শেষতম মিডিউ-এর সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে। এখন তাদের এই পদটি বংশানুক্রমিকও নয়। তাই খুব শীঘ্রই নতুন কাউকে এই দায়িত্ব দেওয়া হবে। 

মাইকের উদ্দেশ্য ছিল সাসকোয়াচ সম্পর্কে এদের কাহিনিটি নতুন করে শোনা। এমন কাউকে সে খুঁজছিল যে নিজের বাবা-মা কিম্বা কোনও প্রিয়জনের কাছ থেকে প্রত্যক্ষভাবে শুনেছে ঘটনাটি অর্থাৎ কিনা যাকে বলে ফার্স্ট-হ্যান্ড এক্সপিরিয়েন্স। এর জন্য দরকার ছিল কোনও বৃদ্ধ মানুষকে। যতদূর জানা যায়, ঘটনার পটভূমি বিংশ শতকের শুরুর দিক। কাজেই এখন যার বয়স আশি বা নব্বই বছর, তার বাবা, মা বা অন্য আত্মীয়ের সেই অভিজ্ঞতা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। মাতব্বরের বয়স প্রায় তেমনই হবে দেখে প্রথমটায় মাইক খুব উৎসাহিত হলেও তার শারীরিক অবস্থা দেখে খুব তাড়াতাড়িই সে মুষড়ে পড়ল। সম্ভবত অ্যালঝাইমার্সের আক্রমণে বৃদ্ধের স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত দুর্বল। উপায় না দেখে মাইক বেরোল অন্য কোনও বয়স্ক মানুষের খোঁজে। চিকিৎসার নাম করে আসার কারণে সাসকানিরা তেমন সন্দেহ করেনি। বরং বছর আঠারো বয়সের একটি ছেলে তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল অন্য একটি বাড়িতে। সেই বলল, একসময় গ্রামের শেষ মিডিউ ছিল এই পরিবার থেকেই। কিন্তু কোনও এক গর্হিত অপরাধ করায় তাদের সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। গৃহকর্তা তখন বাড়িতে নেই। তার বৃদ্ধা মা ও বছর পনেরোর মেয়ে আছে। 

মেয়েটির ফ্যাকাশে মুখ ও শূন্য দৃষ্টি ড্যানিয়েলকে একটু বিষণ্ণ করে তুলল। বাড়ির সামনে কাঠের চেয়ার পেতে বসে আছে বৃদ্ধা। হাতে সেলাইয়ের উপকরণ। প্রথমে মাইকের ইশারায় বেঞ্জামিন বৃদ্ধার নাড়ি পরীক্ষা করল। এটা একেবারেই অভিনয় ছাড়া আর কিছুই নয়। তারপর হাতের ব্যাগ থেকে ভিটামিনের বড়ির শিশি বের করে মেয়েটির হাতে দিয়ে খাওয়ানোর নিয়ম বুঝিয়ে দিল মাইক। মেয়েটি ঘরে ঢুকে যেতেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে দেরি করল না মাইক। জুডিথও মেয়েটির পিছু পিছু ঘরে গেল হয়তো এটা সেটা বলে তাকে আটকে রাখার জন্য। 

“সাসকোয়াচ নিয়ে একটা গল্প শুনলাম এখানে এসে। এটা কি সত্যি? তুমি কিছু জানো?” 

‘…অনেকদিন আগের কাহিনি।” 

বৃদ্ধার মুখের কোঁচকানো চামড়ার প্রতিটি ভাঁজে প্রেইরির ইতিহাস লেখা। চোখের উপরে নেমে-আসা সাদা পাতলা পরদা বুঝিয়ে দেয় দৃষ্টিশক্তি তার বেশ ক্ষীণ। কিন্তু তাঁর চোখের সামনে এখন যে দৃশ্য অভিনীত হচ্ছে, তা দেখার জন্য জাগতিক দৃষ্টির প্রয়োজন হয় না। 

(পাঁচ) 

বৃদ্ধার মুখ থেকে যে কাহিনি জানা গেল, তা কোনও হলিউডি মুভির স্ক্রিপ্টের চেয়ে কম কিছু নয়। তার খাপছাড়া গল্প ও মাঝখানে মাঝখানে মাইকের প্রশ্নের উত্তর জুড়ে যে কাহিনি পাওয়া গেল, তা কিছুটা এরকম – 

অষ্টাদশ শতকের শেষদিক। বর্তমান কানাডা তখন পরিচিত নিউ ফ্রান্স নামে। জনা চল্লিশ মেয়েপুরুষের একটা দল কুইবেক থেকে হাঁটা পথে প্রায় চোদ্দশো মাইল পাড়ি দিয়ে গিয়ে পৌঁছল রুপার্টস ল্যান্ড নামক স্থানে, যার বর্তমান নাম সাসকাচুয়ান প্রদেশ। এরা আলগনকুইন উপজাতির মানুষ, যারা নিজেদের রহস্যময় ও গুপ্ত ‘মিডউইউইন’ বিদ্যাকে ফ্রেঞ্চ মিশনারিদের হাত থেকে রক্ষা করতে রাতের অন্ধকারে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে। জানা যায়, নিউ ফ্রান্সে আলগনকুইনদের ছিল প্রচুর ধনসম্পদ। সেগুলি তারা সঙ্গে করেই এনেছিল। দেশ ছেড়ে যাওয়ার মতো শারীরিক বা মানসিক জোর এবং ইচ্ছা কোনওটাই এদের নেই। তাই নিউ ফ্রান্সেরই অপেক্ষাকৃত জনবিরল অঞ্চলে নিজেদের গুহ্যবিদ্যাকে আঁকড়ে বসতি স্থাপন করতে চলেছে তারা। 

গত কয়েক বছরে ফ্রেঞ্চ মিশনারির দল আলগনকুইনদের সিংহভাগ মানুষকে নানাধরনের প্রলোভন দেখিয়ে ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত করেছে। কিন্তু এই দলটার মতো বেশ কিছু মানুষ নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে কোনও মূল্যেই ত্যাগ করতে চায়নি। তাই অনেক প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ এই চল্লিশজন এসে পৌঁছল নতুন ঠিকানায়। সাসকাচুয়ান প্রদেশের উত্তরদিকের জলাশয়ে ঘেরা অংশে বসতিস্থাপন করার পর এদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় নিজেদের প্রকৃত পরিচয় গোপন করা। তাতে খুব একটা অসুবিধার কিছু ছিল না। কারণ সেই সময় প্রেইরিসহ গোটা সাসকাচুয়ান ছিল বেশ দুর্গম। বিশেষত প্রচণ্ড ঠান্ডার কারণে উত্তরভাগ ছিল প্রায় ব্রাত্য। তাই খুব সহজেই এই উপজাতি দলটি নিজেদের আলগনকুইন নাম গোপন করে নাম নিল সাসকানি। আস্তে আস্তে পরবর্তীকালে এদের সন্তানাদি নিজেদের আর আলগনকুইন বলে জানতে পারবে না। এক নতুন নাম, নতুন বসতি, নতুন জীবনযাত্রার আড়ালে কেবল ফল্গুর মতো অদৃশ্য অথচ জোরালো অস্তিত্ব নিয়ে থেকে যাবে তাদের গোপনবিদ্যা। বংশ থেকে বংশে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সগৌরবে ও সসম্মানে লালিতপালিত হবে এই বিদ্যা, যার জন্য ঘর ছাড়া যায়, নাম ছাড়া যায়, কিন্তু কোনওকিছুর জন্যই একে ছাড়া যায় না। 

আস্তে আস্তে গড়ে উঠল সাসকানিদের জনবসতি। নিজেদের গোপনীয়তার কারণেই বছরের পর বছর ধরে বাইরের পৃথিবী থেকে নিজেদের লুকিয়ে রাখল তারা। মিডউইউইনে সিদ্ধহস্ত; তন্ত্রমন্ত্র, ঝাড়ফুঁক এবং যাদুবিদ্যায় সকলের চেয়ে শক্তিশালী একজন সাসকানি হল তাদের মিডিউ। ঠিক হল, মিডিউ পদটি হবে বংশানুক্রমিক। একজন মিডিউ তার পরের প্রজন্মকে শিখিয়ে দিয়ে যাবে তার বিদ্যা। সেই হবে পরবর্তী মিডিউ। এভাবেই মিডিউ এর নেতৃত্বে চাষবাস, পশুপালন ও মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করল এই সম্প্রদায়। নিউ ফ্রান্স থেকে নিয়ে আসা সোনাদানা সম্পদ তারা একটা বাক্সে ভরে রেখে দেয় মিডিউ-এর জিম্মায়। এই সম্পদ তাদের ব্যক্তিগত নয়, সমষ্টির সম্পদ। কাজেই মিডিউ-এর কাছে থাকাটাই সবচেয়ে নিরাপদ বলে মনে করেছিল তারা। 

ভালোই দিন চলছিল। প্রায় একশ বছর কেটে গেল। ইতিমধ্যে সাসকানিরা সংখ্যায় অনেক বেড়েছে। হঠাৎ শুরু হল এক উপদ্রব। এতকালের জনবিরল প্রেইরিতে কোত্থেকে এসে উপস্থিত হল এক বিশালদেহী প্রাণী। দেখতে অনেকটাই গরিলার মতো, কিন্তু আকার ও আয়তনে দানবের মতো। সাসকানিরা তাকে ডাকত সাসকোয়াচ নামে। রাতের অন্ধকারে তার বিকট গর্জন রক্ত হিম করে দেয় সাসকানিদের। অতর্কিত আক্রমণে সে কেড়ে নিতে শুরু করল একের পর এক সাসকানির প্রাণ। প্রথম প্রথম সাসকানিরা নিজেদের তৈরি নানাধরনের অস্ত্র নিয়ে সেই দানবকে বধ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আরও মৃত্যুসংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছুই হয়নি। এরকম বেশ কিছুদিন চলার পর সব সাসকানিরা এসে পায়ে পড়ল তৎকালীন মিডিউ লুইস-এর। যদি কেউ পারে তবে সে মিডিউ। মিডিউ দু-একদিন সময় চেয়ে নিল। দু’দিন দু’রাত ধরে সে ঘুরে বেড়ালো গোটা অঞ্চলের আনাচে কানাচে। তারপর ফিরে এসে একটা সভা ডাকল মিডিউ। সমস্ত সাসকানি পুরুষেরা এসে ভিড় করল তার গৃহে। মিডিউ জানাল, গত দু’দিন ধরে সে ঘুরে বেড়িয়েছে সাইপ্রাস পাহাড়ের গায়ের ঘন জঙ্গলে। বিশাল বিশাল গাছে ঘেরা সেই জঙ্গলে দিনের বেলাতেই সব জায়গায় সূর্যের আলো প্রবেশ করে না। তেমনই এক জায়গায় রয়েছে বিরাট বড়ো একটা লেক। লেকের চারপাশের পরিবেশ মৃত্যুর মতো শীতল, মৃতের মতো স্থির। 

অজানা কারণে, হয়তো বা অবস্থানের জন্যই লেকের চারপাশের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক কম। কাজেই লেকের জল সম্পূর্ণ বরফাবৃত। তবে লেকের উপরিভাগের বরফে স্পষ্ট দেখা যায় ফাটলের চিহ্ন। অর্থাৎ ওই বরফ হাঁটাচলার জন্য নিরাপদ নয়। সুতরাং কোনওভাবে যদি সাসকোয়াচকে ভুলিয়ে? বরফের উপরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়, তবে তার অত্যধিক ওজনে সহজেই বরফ ভেঙে সলিলসমাধি ঘটবে তার। জলের উপরকার বরফ ভাঙার পর খুব তাড়াতাড়ি আবার জুড়ে যায় বলে ওই বিশালদেহী দানব নিজেকে সামলে জল থেকে ওঠারও সুযোগ পাবে না। মিডিউ এর এই পরিকল্পনায় সকলেই সহমত হলেও ভিড়ের মধ্য থেকে খুব তাড়াতাড়িই একটা অমোঘ প্রশ্ন উঠে আসে, সাসকোয়াচকে ভুলিয়ে লেকের কাছে নিয়ে যাওয়ার পথ কী? বিবেচক মিডিউ নিজেও এ কথা ভাবেনি তা নয়। অনেক ভেবে যে উপায় তার মাথায় এসেছে, তা সকলের সামনে উপস্থাপন করতে তার বাধছিল। সে জানত, তার প্রস্তাবে রাজি হবে না কেউ। তা সত্ত্বেও এ প্রস্তাব তাকে দিতেই হবে। প্রয়োজনে জোর খাটাতে হবে। বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষা করাই মিডিউ হিসেবে তার প্রধান দায়িত্ব। অবশেষে মুখ খোলে সে। ‘টোপ দিতে হবে সাসকোয়াচকে। টাটকা রক্তের গন্ধ দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে হবে লেকের মাঝখানে।’ 

মানে? মিডিউ-এর কথা বোধগম্য হয় না সাসকানিদের। টাটকা রক্ত? তবে কি পশুহত্যা করার কথা বলছে মিডিউ? সে আর বলার মতো কী বিষয়! পশুর অভাব তো নেই সাসকানিদের ঘরে। কিন্তু সাসকোয়াচ তো যতবার এসেছে, মানুষের প্রাণ নিয়েছে। তবে কী…! খুব তাড়াতাড়িই মিডিউ এর কথার মর্ম উদ্ধার করে ফেলে তারা। শুরু হয়ে যায় গুঞ্জন, গুঞ্জন থেকে চেঁচামেচি, ভয়, রাগ, ক্ষোভ কী না প্রকাশ পাচ্ছিল তাদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বরে! অবশেষে গলা তোলে মিডিউ। ‘চুপ করো, চুপ করো সবাই। গোটা সাসকানি সম্প্রদায়ের মঙ্গলের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিতে পারে, এমন একজনও বীর নেই এখানে? আমি নিজেই যেতাম তোমাদের জন্য। কাউকে কিচ্ছু জানতে দিতাম না। কিন্তু আমার পুত্রসন্তান জেসনের এখনও দশ বছর বয়স হয়নি। নিয়ম মতো দশ বছর বয়সের আগে মিডউইউইন এর শিক্ষা শুরু করা যায় না। আমি ওকে না শিখিয়ে গেলে আমাদের প্রাচীন মিডউইউইন বিদ্যার এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটবে। যে বিদ্যাকে রক্ষা করার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষ কুইবেক ছেড়ে এসেছিলেন, সেই বিদ্যা এভাবে লুপ্ত হয়ে যাক তা কি তোমরা চাও? তাছাড়া যে কথা তোমরা জানো না, তা হল পূর্ণবয়স্ক মানুষের ভার লেকের বরফ নিতে পারবে না। সাসকোয়াচ আসার আগেই বরফ ভেঙে জলে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাতে আমাদের উদ্দেশ্য মাঠে মারা যাবে।’ 

মুখে কুলুপ পড়ে সাসকানিদের। তাদের মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে গলা নামায় মিডিউ, ‘আমাদের এ কাজের জন্য প্রয়োজন শিশু। কেউ কি আছো, যে এ কাজ করতে রাজি?’ 

কিন্তু কেউ রাজি হয় না নিজের সন্তানকে সাসকোয়াচের টোপ হতে দিতে। সেদিনের মতো সভা ভেঙে যায় অমীমাংসিত অবস্থায়। 

সেদিন গভীর রাতে আর এক সভা বসে মিডিউ-এর গৃহে। সেই সভায় মানুষ মাত্র তিনজন। মিডিউ, তার ডানহাত রবার্ট আর মিডিউ-এর দেহরক্ষী বিল। রবার্ট-এর ক্ষুরধার বুদ্ধি ও ধূর্ততার জুড়ি মেলা ভার। এই গুণেই সাসকানিদের মধ্যে সেই হয়ে উঠেছে মিডিউ-এর সহকারী। আর অন্যদিকে বিলের শারীরিক শক্তি থাকলেও মানসিকভাবে সে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন। মিডিউ-এর কথায় বিনা প্রশ্নে সে যে কোনও লোককে হত্যা করতে একবারও ভাববে না। কারণ ভাবার মতো মানসিক গঠনই তার নয়। কাজেই সভায় উপস্থিত থাকলেও বিলকে বাদ দিয়ে বাকি দু’জনের মধ্যেই চাপা গলায় আলোচনা চলছিল। প্রায় ভোর পর্যন্ত চলল সভা। ভোরের প্রথম পাখিটা ডাকার সঙ্গে সঙ্গে যে যার বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল। সাসকানিরা আর কেউ জানতেও পারল না এই সভার ব্যাপারে। 

পরদিন মাঝরাতে সাসকানি কলোনির প্রান্তভাগের বাসিন্দা বেন ও তার স্ত্রী এলিসার একমাত্র সন্তান ছয় বছরের আর্নেস্ট উধাও হয়ে গেল তাদের কুঁড়ে থেকে। কেউ টের পাওয়ার আগেই রাতের অন্ধকারে জড়িবুটির প্রভাবে অচেতন আর্নেস্ট একজনের বলিষ্ঠ কাঁধে চড়ে রওনা হয়ে গেল জঙ্গলের উদ্দেশে। তার পিছনে আরও দুটো লোক ছায়ার মতো নিশ্চুপে অনুসরণ করল। জঙ্গলের কাছাকাছি এসে থামল তারা। কোমর থেকে মাংস কাটার ছুরি বের করে ছয় বছরের শিশুটার কব্জির উপরে চালিয়ে দিল একজন। শিশুটিকে কাঁধে নেওয়া লোকটি স্থির মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে, আর অন্যজন চাপা গলায় কিছু দুর্বোধ্য মন্ত্রোচ্চারণ করে চলেছে। অচেতন শিশুর হাত থেকে অঝোরে রক্ত পড়তে শুরু করতেই আবার তিনজন হাঁটা শুরু করল জঙ্গলের ভেতরে। রক্তের ঝরে পড়া ফোঁটা পিছু নিল তাদের। 

জঙ্গলের ভিতরের এক বিশাল লেকের সামনে এসে দাঁড়াল লোকগুলো। সেই যে মন্ত্র পড়ছিল, তার চাপা স্বর এখনও শোনা যাচ্ছে। বাচ্চাটাকে একটা হালকা কাঠের ভেলা ধরনের জিনিসের উপর দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধল বলিষ্ঠ লোকটা। তারপর মন্ত্র-পড়া লোকটির আদেশে লেকের উপর জমে থাকা শক্ত ও পিছল বরফের উপর ভেলাটা রেখে গায়ের জোরে ঠেলে দিল সে। ভেলাটা বাচ্চাটাকে সুদ্ধ পিছলে গিয়ে স্থির হল লেকের প্রায় মাঝখানে। ভেলার যাওয়ার পথ জুড়ে ছড়িয়ে রইল চাপ চাপ রক্ত। এবার সাসকোয়াচকে আবাহনের পালা। মন্ত্রের শক্তিতে তাকে টেনে আনতে হবে সেখানে, যেখানে জঙ্গল শুরু হচ্ছে, যেখানে এলেই কচি রক্তের গন্ধ তাকে আকর্ষণ করে আনবে লেকের মাঝখানে… আর তারপরই ঘটবে তার সলিলসমাধি। 

লেকের ধারে হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাত উপরের দিকে তুলে সজোরে দু’দিকে মাথা দুলিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করতে থাকে মিডিউ। তার পিছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ রবার্ট আর বিল। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর শোনা গেল সাসকোয়াচের রক্ত জল করা গর্জন। আস্তে আস্তে নিজেদের জায়গা ছেড়ে পিছিয়ে গিয়ে ঘন জঙ্গলের ভিতরে আত্মগোপন করে তিনজন। রক্তের গন্ধে উন্মত্তপ্রায় বিশাল মূর্তিটা পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেই ঝাঁপিয়ে পড়ে লেকের বরফের মাঝখানে রাখা ভেলাটার উপর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কড়কড় শব্দে চিড় ধরে লেকের বরফে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জলোচ্ছ্বাসের মতো বিশাল শব্দ করে অতিকায় প্রাণীটা ঢুকে যায় লেকের বরফের নীচে মৃত্যুশীতল জলের গভীরে। শেষবারের মতো এক ভয়ংকর গর্জন করে সাসকোয়াচের দেহটা ডুবে যেতেই লেকের উপরিভাগের বরফ ধীরে ধীরে আবার আগের মতোই জুড়ে যায়। তা দেখে বোঝার উপায় নেই যে সামান্য কয়েক মিনিট আগেই লেকের বরফ গিলে খেয়েছে একটা অতিকায় প্রাণীসহ একটা মানুষের বাচ্চাকে। 

ভোর হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ আগেই অভ্যাসবশত ঘুম ভেঙেছিল এলিসার। হাত বাড়িয়ে ছেলেকে ধরতে যেতেই চমকে উঠল সে। বিছানা খালি। ধড়ফড় করে উঠে বসেই ঘরের দরজা হাট করে খোলা দেখে চিৎকার করে ওঠে সে। এলিসার চিৎকারে ঘুম ভেঙে উঠে বসে বেন-ও। তীরের মতো ছিটকে বেরোয় দু’জনে। বেন আর এলিসার ডাকাডাকি, কান্নাকাটিতে ঘুম ভেঙে বেরিয়ে এল পুরো মহল্লা। নানারকম অনুমান, চিন্তাভাবনা চলছিল। ঠিক তখনই তাদের কানে ভেসে এল একটা বিকট গর্জন। সাসকোয়াচ! ভয়ে স্থির হয়ে গেল পুরো দলটা। দু-একজন দৌড়ল নিজেদের বাড়ির দিকে। কারো বুঝতে বাকি রইল না বেন আর এলিসার ছেলেকে নিয়ে গেছে সাসকোয়াচই। আর কিচ্ছু করার নেই। কিন্তু এমন চোরের মতো ঘরে ঢুকে ছেলে চুরি এর আগে কখনো করেনি সাসকোয়াচ। হঠাৎ এলিসা চিৎকার করে ছুটতে শুরু করল সাসকোয়াচের গর্জনের উৎসস্থল লক্ষ্য করে। সন্তানহারা মা বোধকরি নিজের প্রাণভয়ের অনুভূতিও হারিয়ে ফেলে। 

এলিসাকে ছুটতে দেখে তার পিছনে প্রথমে দৌড়ল বেন ও তার পিছন পিছন সাসকানিদের বেশিরভাগ পুরুষ। তখন আকাশ প্রায় ফর্সা হয়ে এসেছে। জঙ্গলের সামনে এসে রক্তের দাগ দেখে থমকে দাঁড়াল দলটা। কিন্তু এলিসাকে তীরবেগে জঙ্গলে ঢুকতে দেখে তারাও আর দাঁড়ায় না। কিছুটা এগোতেই আবার সেই গর্জন কানে আসে তাদের। সঙ্গে সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসের শব্দ। ভ্রূ কুঁচকে ওঠে সাসকানিদের। তাদের সন্দেহ সত্যে পরিণত হয় যখন তারা দেখতে পায় মিডিউসহ তার দুই অনুচর বেরিয়ে আসছে জঙ্গল থেকে। ফুঁসতে থাকা এলিসা ছুটে গিয়ে গলা চেপে ধরে বিলের। ওই বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী লোকটা কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল এলিসার দিকে। মুহূর্তের অপেক্ষা, সাসকানি উপজাতির পুরো দলটা ঝাঁপিয়ে পড়ে তিনজনের উপর। রবার্ট আর বিলের সেখানেই মৃত্যু হয় জনরোষের কবলে পড়ে। মিডিউকে বাঁচিয়ে রাখা হয় শুধুই তার অধীত বিদ্যার খাতিরে। 

সেদিন সকালে বিচারসভা বসে মিডিউ-এর। সে সবার সামনে নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিজের কৃতকর্ম। কারণ সে যা করেছে গোটা সম্প্রদায়ের ভালোর কথা ভেবেই। কিন্তু তার কথায় চিঁড়ে ভিজল না। জনতার আদালতে মিডিউ পাপী বলে চিহ্নিত হল। সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের অধিকার তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হল। শুধু তাই নয়, স্থির হল পরবর্তীকালে কোনওদিন তার পরিবার মিডিউ হওয়ার সুযোগ পাবে না। তবে আগামী কিছুদিনের মধ্যে তাকে তার বিদ্যা সম্প্রদায়ের কোনও এক যোগ্য যুবককে শিখিয়ে দিতে হবে। তারপরে বর্তমান মিডিউ লুইসকে চলে যেতে হবে সাসকাচুয়ান ছেড়ে 

অপমানে কুঁকড়ে গিয়েছিল লুইস। কয়েকদিন পর সে আত্মহত্যা করে সেই লেকে। লেকের বরফের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে ক্রমাগত মন্ত্রোচ্চারণ করছিল, যতক্ষণ না তার পায়ের তলায় একটু একটু করে ফাটল বাড়তে বাড়তে একসময় কনকনে ঠান্ডা জল তাকে গ্রাস করে নেয়। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে সে সাসকানিদের সঙ্গে আনা সোনাদানার বাক্স নিজের সঙ্গে নিয়ে যায় লেকের জলের তলায়। 

সাসকানিদের মধ্যে কেউ কেউ মিডউইউইন জানলেও লুইসের পরিবারের মতো এই বিদ্যার গলিঘুঁজি নখদর্পণে ছিল না কারো। কাজেই সেইদিনের পর থেকে সাসকানিরা তাদের এত গর্বের বিদ্যা এক হিসেবে হারিয়েই ফেলে। যদিও কেউ কেউ বলে, লুইস নাকি মৃত্যুর আগের কয়েকদিন ধরে দিনরাত এক করে তার বিদ্যা শিখিয়ে গিয়েছিল তার বারো বছরের কন্যা পাওলাকে। তবে যেহেতু মেয়েদের মিডউইউইন শেখার যোগ্য বলে মনে করা হত না, তাই এই দাবির পক্ষে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। 

*****

“তুমি কার কাছ থেকে এসব জেনেছ? লুইস কি তোমার আত্মীয় ছিল?” মাইকের উত্তেজিত স্বর শোনা যায়। 

বৃদ্ধা আগের মতোই ধীর নিস্পৃহ উত্তর দিল, “লুইসের ছেলে জেসন আমার স্বামী ছিল।” 

“আর পাওলা? তার পরিবারও কি এখানেই থাকে?” 

ড্যানিয়েল বুঝতে পারছিল না মাইক ঠিক কী জানতে চাইছে! ক্রিপ্টোজুলজি নিয়ে অত্যুৎসাহী এক গবেষক তার পরম কাঙ্ক্ষিত সাসকোয়াচের অস্তিত্ব সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পেয়ে গেছেন। একটা বাচ্চা ছেলেও বলে দেবে এখন মাইকের উচিৎ জঙ্গলের ভেতরের ওই লেকের সন্ধান করে তার জলের গভীর থেকে সাসকোয়াচের কোনও দেহাবশেষ উদ্ধার করা যায় কিনা তার চিন্তা করা, এবং অবশ্যই সরকারকে জানিয়ে এ ব্যাপারে সাহায্য প্রার্থনা করা। তা না করে মাইক এখন সময় নষ্ট করছে এসব তন্ত্র মন্ত্র কুসংস্কার নিয়ে। কী এক মিডউইউইন না আবোলতাবোল নিয়ে পড়ে রয়েছে। মনে মনে একটু অধৈর্য হয়ে পড়ছিল ড্যানিয়েল। বৃদ্ধার গল্পের মধ্যেই ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে জুডিথ আর বৃদ্ধার নাতনী। জুডিথের মুখ দেখেই বোঝা যায় সে গল্প শুনে মুগ্ধ। 

পাওলার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে বৃদ্ধা। তারপর বলে, “পাওলা খুব কম বয়সে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তার পর থেকে তার আর কোনও খবর পাওয়া যায়নি।” এইটুকু বলেই বৃদ্ধা চেয়ার ছেড়ে ওঠার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় নাতনীর দিকে। মেয়েটি ছুটে এসে তার ঠাকুমার হাত ধরে ধীরে ধীরে নিয়ে গেল ঘরের দিকে। মাইক বুঝেছিল বৃদ্ধার থেকে আর কোনও খবর পাওয়া যাবে না। তারা উঠে চলে আসছে তাদের ট্রাকের দিকে, সাসকানি গ্রামের বাইরে রাখা ছিল সেটা; তখনই ড্যানিয়েলের চোখে পড়ল সেই ছেলেটিকে, যে তাদের পথ দেখিয়ে এনেছিল এখানে, লম্বা লম্বা ঘাসের আড়ালে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে বৃদ্ধার বাড়ির দিকে। এক মুহূর্তে যেন ছেলেটির আকুল দৃষ্টির ভাষা পড়ে ফেলল সে। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক চিলতে হাসি। একটু থেমে গেল ড্যানিয়েল, পিছিয়ে পড়া জুডিথ তার কাছাকাছি আসতেই হাত ধরল তার। নিজেদের উদ্দেশ্যে অটল, কঠিন চোয়ালের তিনজন মানুষের পিছু পিছু হেঁটে চলল অন্তত একজন উদ্দেশ্যহীন পথিক আর তার ধ্রুবতারা। 

(ছয়) 

সোফিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যেতেই ওর পিছু নিল ফিলিপ। সে কোনওমতেই সোফিয়াকে আর একা ছাড়বে না। সেদিন সোফিয়া লেকের ধারে আসতেই একলাফে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ফিলিপ। খপ করে সোফিয়ার একটা হাত নিজের দু’হাতের মধ্যে নিয়ে চাপা গলায় ধমকে উঠেছিল সে, “বনের ভেতরে যাস কেন? জানিস না? বন অভিশপ্ত? জানিস না, ওখানে সাসকোয়াচ ঘুমিয়ে আছে? আর কোনওদিন যেন তোকে ওখানে যেতে না দেখি। এই বলে দিলাম।” 

সোফিয়া গলায় একটা রাগের শব্দ করতে-করতে ঝটকা মারছিল হাত ছাড়ানোর জন্য। কিন্তু ফিলিপের শক্তির কাছে সে পেরে উঠছিল না। ফিলিপের কেমন জেদ চেপে গেল। সোফিয়ার হাতটা আরও জোরে চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে নিজের দিকে টেনে আনে সে। সোফিয়া টাল সামলাতে না পেরে গিয়ে পড়ে ফিলিপের গায়ের উপর। কী যে হল ফিলিপের! সোফিয়ার ভয়, ওর বাবার ভয় সব ভুলে গিয়ে নিজের ঠোঁটজোড়া চেপে ধরল সোফিয়ার ঠোঁটের উপর। কয়েক সেকেন্ড, না কয়েক মিনিট— কে জানে, ছটফটে মেয়েটাও নিশ্চুপ হয়ে ছিল ওর বুকের ওমে। একে অপরের নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় গলে যাচ্ছিল ওরা। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরতে সোফিয়া ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে। ফিলিপও আর জোর খাটায়নি। দৌড়ে বাড়ির দিকে ফিরতে ফিরতে শেষ মুহূর্তে একবার থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরেছিল সোফিয়া। সন্ধের আধো অন্ধকারেও সোফিয়ার লাল হয়ে ওঠা গালের আন্দোলন লক্ষ করে তার মনে হল, সোফিয়া হাসছে। সেদিন প্রায় সারারাত ঘুম হয়নি ফিলিপের। অবশেষে কী বরফ গলছে? নাকি ওপরের জমে থাকা পাতলা তুষারের আস্তরণের নীচে টলটলে কাকচক্ষু জলটার খবরই পায়নি ফিলিপ এতদিন! 

এরপর কয়েকদিন আসেনি সে। মন অস্থির হয়ে উঠলেও উপায় ছিল না। বাড়িতে মায়ের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। ফিলিপ ছাড়া আর কেউ মাকে সামলাতে পারে না। ওর বাবা জোসেফ, সোফিয়ার বাবা চার্লিসহ আরও অনেকে চাষের কাজ করতে যায় অনেক দূরে। সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর তাদের একটাই বিলাসিতা, ভুট্টার তৈরি মদ্যপান করে বেহুঁশ হওয়া। ফিলিপের দুই দাদাও ওঁদের সঙ্গে মাঠে কাজ করে। হয়তো সামনের বছর থেকে ফিলিপকেও যেতে হবে। আজ মায়ের শরীর একটু ভালো। তাই সে ছুটে এসেছে সোফিয়ার কাছে। ওই তো, ভেড়ার লোমের আলখাল্লার মতো দেখতে ক্লোক পরে সোফিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে এগিয়ে চলেছে দূরের পাহাড়ের দিকে। কিন্তু আজ ওর সঙ্গে ভেড়া আর লামাগুলো নেই কেন? অবাক হল ফিলিপ। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে অনুসরণ করল সোফিয়াকে। 

পাহাড়ের গায়ের ঘাসজমিটার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল সোফিয়া। বার্চ গাছটার গায়ে হাত রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে পিছনদিকটা দেখে নিল একবার। ফিলিপ বিদ্যুৎগতিতে নিজেকে গোপন করল অন্য একটা বড়ো গাছের আড়ালে। তারপর সামান্য মুখটা বাড়িয়ে দেখে নিল সোফিয়া আবার দৌড়চ্ছে পাহাড়ের গায়ের জঙ্গলটার উদ্দেশে। ওর পাঁশুটে রঙের ক্লোকটা ঠান্ডা হাওয়ায় উড়ছে পিছনের দিকে। একটু অপেক্ষা করল ফিলিপ। এই গাছটার আড়াল ছেড়ে বেরোলেই বিস্তীর্ণ ছোট ছোট ঘাসের পশুচারণ ভূমি। ওখানে আর আত্মগোপনের জায়গা নেই। সোফিয়ার জঙ্গলের মুখ পর্যন্ত পৌঁছনোর অপেক্ষা করল ফিলিপ। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল হতে দিল না তাকে। সোফিয়া জঙ্গলে পা দিতেই হরিণের মতো ছুট লাগাল ফিলিপ। ওর ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুলগুলো লাফাতে লাগল ছোটার তালে তালে। জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকে একটু ভয় ভয় করতে লাগল তার। সাসকোয়াচের শোনা গল্পগুলো মনে পড়তে লাগল বারবার। মনে যাই হোক, সোফিয়ার ক্লোকের দিক থেকে চোখ সরেনি ফিলিপের। 

জঙ্গলের ঘনসন্নিবদ্ধ গাছপালাকে কোনও এক বিচিত্র কৌশলে এপাশ ওপাশ দিয়ে এড়িয়ে তিরবেগে ছুটে চলেছে সোফিয়া। ফিলিপ কিন্তু বারবার পিছিয়ে পড়ছে। গাছের ফাঁকফোকর গলে চলতে গিয়ে ঘষা খেয়ে ছাল উঠে যাচ্ছে তার গায়ের, বড়ো গাছ থেকে ঝুলে থাকা লতাপাতা মাঝে মাঝেই আড়াল করে দিচ্ছে তার দৃষ্টিপথ। কিন্তু কোথায় চলেছে সোফিয়া? 

জঙ্গল ক্রমশই আরও ঘন হয়ে উঠছে। স্যাঁতস্যাঁতে ঠান্ডা আবহাওয়া দাঁতে দাঁত লাগিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ একটা বড়ো পাথরে হোঁচট খেল ফিলিপ। নিজেকে সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল একটা গাছের গুঁড়ির গায়ে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মুখ থেকে আর্তনাদ বেরিয়ে এল তার। কিন্তু এখন নিজের ব্যথার দিকে তাকানোর সময় নেই। সোফিয়াকে হারিয়ে ফেললে চলবে না। সারা শরীরের আর মনের জোর একত্রিত করে উঠে দাঁড়িয়েই বোকা বনে গেল ফিলিপ। চারিদিকে তন্নতন্ন করে চোখ চালিয়েও কোথাও খুঁজে পেল না সোফিয়াকে। 

জঙ্গলের ভিতরে আলোর অভাবে বেশ ছায়াময় পরিবেশ। মাঝে মাঝে পাখির ডাক শোনা গেলেও একটানা পতঙ্গের শব্দ জঙ্গলের ভেতরের পরিবেশকে ভারী করে তুলেছে। কী করবে এখন ফিলিপ? ফিরে যাবে সে? কিন্তু সোফিয়াকে এই জঙ্গলে একা রেখে যেতেও যে মন চায় না। যদিও সে এর আগে অনেকবারই সোফিয়াকে জঙ্গলে আসতে এবং নিরাপদে ফিরতে দেখেছে। তবু… মনকে মানাতে পারে না ফিলিপ। হঠাৎ পিছন থেকে কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে প্রায় লাফিয়ে ওঠে ফিলিপ। এক ঝটকায় পিছনে ঘুরে দেখে… সোফিয়া। শান্ত দৃষ্টি তার মুখের দিকেই নিবদ্ধ। সোফিয়ার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই সে কী ভাবছে! সে রাগ করেছে কিনা ভাবতে ভাবতে মুখ খুলতে যেতেই ফিলিপের হাত ধরে টানল সোফিয়া। ইশারায় মাথা নেড়ে তার সঙ্গে আসতে বলল তাকে। আবার শুরু হল তাদের দৌড়। এবারেও আগে পিছে, কিন্তু আগে আগে দৌড়নো সোফিয়ার হাতের মুঠোতে শক্ত করে ধরা ফিলিপের হাত। 

ছুটতে ছুটতে ওরা গিয়ে পৌঁছল একটা ফাঁকা জায়গায়। আরে, একটা লেক! লেকের ওপর পুরু বরফের চাদর। ফিলিপের পা কাঁপতে লাগল। সন্ধে নেমে গেছে। লেকের উপরে কালো আকাশে পূর্ণচন্দ্র দেখতে পাচ্ছে সে। ফিলিপের হাত ধরে সোফিয়া নিয়ে চলল লেকের পাশ দিয়ে কোনও এক অজানা ঠিকানায়।

লেক থেকে বেশ কিছুটা এগিয়ে আরও গভীর জঙ্গলের ভেতরে তারা যেখানে পৌঁছল, সেখানে সামনের দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেল ফিলিপ। একটা কুঁড়েঘর। এই জঙ্গলের মধ্যে যে কেউ থাকতে পারে, সেটা ফিলিপের ধারণাতেই ছিল না। সোফিয়ার মধ্যে কোনও হেলদোল নেই। সে ফিলিপের হাত ধরে টানতে টানতে এগিয়ে গেল কুঁড়েঘরটার দিকে। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সোফিয়া হাত দিয়ে দরজায় আঘাত করার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একজন দাড়িগোঁফওয়ালা কৃষ্ণাঙ্গ লোক দরজা খুলে দিল। সোফিয়াকে দেখে মুখে হাসি ফুটল তার। পরমুহূর্তেই ফিলিপকে সোফিয়ার সঙ্গে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সে। সোফিয়া ততক্ষণে ফিলিপকে নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। ঘরের ভিতরে একটা চৌকো কাঠের বাক্সের মতো টেবিলে অদ্ভুত ধরনের সব উপকরণ রাখা। তবে সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপারটা হল, ঘরের দেওয়ালগুলোর যতটা একজন মানুষের হাত পৌঁছতে পারে, ততদূর পর্যন্ত ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে ভর্তি। এরকমভাবে দেওয়াল জুড়ে কী লিখেছে লোকটা? ভয় ভয় ভাবটা আবার ফিরে এল ফিলিপের মনে। সে পিছন থেকে সোফিয়ার ক্লোক টেনে ধরল। সোফিয়া ঘুরে তাকাল ফিলিপের দিকে। তারপর হয়তো ওর ভয় পাওয়া মুখটা দেখেই ফিসফিসিয়ে উঠল ‘মিডিউ’। 

মিনিট কুড়ি পর কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে ওরা আবার হাঁটতে শুরু করল। এবার বাড়ির পথে। লেকের সামনে এসে থমকে যায় দু’জনে। রুপোর মতো আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। লেকটাকে চাঁদের আলোয় একটা সমুদ্রের মতো দেখাচ্ছে। সোফিয়া আর ফিলিপ হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকে লেকের পাশে। কতক্ষণ তারা দাঁড়িয়ে রইল জানে না ফিলিপ। তার মনে হচ্ছিল এভাবে সে সারাজীবন দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, যদি সোফিয়ার হাত এভাবেই ধরা থাকে তার হাতে। 

ওরা দু’জন জানতে পারে না, জঙ্গলের ঝিমঝিমে অন্ধকারে গা মিশিয়ে ওদের ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে দুই মূর্তিমান বিভীষিকা। একজনের হাতে অত্যাধুনিক অটো শটগান, অন্যজনের হাতে চাঁদের আলোয় চকচক করছে ধারালো চপার। 

(সাত) 

তাঁবুর বাইরে কথাবার্তার শব্দ পেয়ে ঘুমটা ভেঙে যায় ড্যানিয়েলের। স্লিপিং ব্যাগের ভেতর থেকে মাথা বের করে প্রথমে বোঝার চেষ্টা করে কারা কথা বলছে এত রাতে! মনে হল, কয়েকটি পুরুষ কণ্ঠ। হাত বের করে পাশে রাখা টর্চটা জ্বালাতে গিয়েও জ্বালায় না সে। অন্ধকারেই চোখ চালিয়ে বুঝতে পারল তাঁবুতে সে একা। তাঁবুর বাইরে প্রায় সারারাতই আগুন জ্বালিয়ে রাখা হয়। সেই আলোতে তাঁবুর ভেতরটাও মোটামুটি আলোকিত থাকে। হ্যারি আর বেঞ্জামিনকে না দেখেই সে ধরে নিল তাঁবুর বাইরের লোকগুলো তারাই। কিন্তু এমন কী গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা যা করার জন্য দিনের আলো ফোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেত না! আস্তে আস্তে স্লিপিং ব্যাগের ওম থেকে বেরিয়ে পা টিপে টিপে তাঁবুর দরজার সামনে গিয়ে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়ায় ড্যানিয়েল। 

ভোরের আলো ফুটতেই তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়ে ড্যানিয়েল। ঘণ্টাখানেক আগে মাইক, হ্যারি আর বেঞ্জামিনকে সে দেখেছে পাহাড়ের দিকে যেতে। ওদের তিনজনের কথা শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনি সে। মাইকের এখানে আসার উদ্দেশ্য সাসকোয়াচ নয়, কোনও গবেষণা নয়- সোনা, সাসকানিদের সম্পত্তির সেই সোনা, যা নাকি মিডিউ সঙ্গে নিয়ে লেকের জলে ডুবে গেছেন। সেই সোনা কীভাবে মাইক পেতে পারে তা মাথায় ঢুকছিল না ড্যানিয়েলের। স্বয়ং মৃত্যুফাঁদ ওই লেকের বরফ; তার নীচের বরফ ঠান্ডা জল থেকে কীভাবে উদ্ধার করা যাবে সেই কতকাল আগের হারিয়ে যাওয়া সোনা! তাছাড়া ওরা কোনও মেয়ের কথা বলছিল। তাকে ওরা অপহরণ করেছে। কিন্তু কেন? কে সেই মেয়ে? সে কীভাবে তাদের সোনা পেতে সাহায্য করবে? এসব ভাবতে ভাবতেই ড্যানিয়েলের মনে হয়েছিল জুডিথের কথা। মাইক, হ্যারি আর বেঞ্জামিন বেরিয়ে যেতেই সে ছুটে গিয়েছিল জুডিথের তাঁবুতে। কিন্তু জুডিথ সেখানে নেই। চিন্তায়, উদ্বেগে হৃদযন্ত্র থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল ড্যানিয়েলের। আবার নিজের তাঁবুতে ফিরে এসে সে অপেক্ষা করছিল ভোর হওয়ার। এখন ভোর হতেই তাঁবুর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। 

পাহাড়ের গায়ে যে ছোট ঘাসে ছাওয়া পশুচারণ ভূমি আছে, সেখানে একপাশে ট্রাকটা দাঁড় করালো ড্যানিয়েল। সে জানে, যে লেকের জলে সোনাভর্তি বাক্সসহ আত্মহত্যা করেছিলেন মিডিউ সেটা এই জঙ্গলের ভেতরেই। অসহায়ের মতো এদিক ওদিক তাকাল সে। এই অজানা জঙ্গলে ঢোকা কতটা নিরাপদ হবে, তা বুঝে উঠতে পারল না। সাসকানিদের সাহায্য চাওয়া যায়। কিন্তু তাদের এসব কথা বললে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। হয়তো ওকেও শত্রু ভেবে আক্রমণ করে বসতে পারে তারা। আবার মাইকরা জঙ্গলেই এসেছে, না অন্য কোথাও গেছে তাও তার জানা নেই। আরে, ওটা কে? টলতে টলতে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে! চোখের উপর হাতের আড়াল দিয়ে বোঝার চেষ্টা করল ড্যানিয়েল। এ তো সেই সাসকানি ছেলেটা, যে ওদের আগের দিন পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেই বৃদ্ধার বাড়িতে! ওকেই তো জিজ্ঞেস করা যেতে পারে এই জঙ্গলের পথ। কিংবা ও যদি রাজি হয় সঙ্গে যেতে… কিন্তু ওর কী হয়েছে? অমন অদ্ভুতভাবে হাঁটছে কেন? 

ড্যানিয়েল কৌতূহলবশত এগিয়ে গেল ছেলেটির দিকে। সে কাছাকাছি যেতেই ছেলেটি সাহায্য চাওয়ার ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দেয় তার দিকে। আরও কাছে গিয়ে ড্যানিয়েল দেখল, ছেলেটির মাথার পিছনে গভীর ক্ষত। সেখান থেকে রক্ত বেরিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে তার পরনের পশমের কোট। মাথার ওই অংশে এখন রক্ত জমাট বেঁধে চুলের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। ফলে ছেলেটির ঝাঁকড়া চুল ওই অংশে সেঁটে রয়েছে মাথার সঙ্গে। ওর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসা প্রয়োজন। ট্রাকের পিছনের বিশাল ট্রাঙ্কে পুরো মেডিক্যাল বক্স রয়েছে। ড্যানিয়েল সেটা আনতে গিয়ে দেখল ট্রাঙ্কে তালা দেওয়া। চাবি তার কাছে নেই। অগত্যা ট্রাকের ড্রাইভার কেবিনে রাখা ছোট কাজ চালানোর ফার্স্ট এইড বক্সে সামান্য যা ওষুধ পেল, তাই যত্ন করে লাগিয়ে দিল ছেলেটির ক্ষতে। ড্যানিয়েল বুঝতে পারছিল, ক্ষত পরিষ্কার করা দরকার, হয়তো সেলাই-এরও প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু এই মুহূর্তে তার কাছে আর কোনও পথ নেই। জুডিথের খোঁজ মিললে তখন ছেলেটি চাইলে সে তাকে শহরে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ না জুডিথকে পাচ্ছে সে, ততক্ষণ এই স্থান ছেড়ে সে যাবে না। সামান্য শুশ্রূষায় একটু চাঙ্গা হল ছেলেটি। ড্যানিয়েল জানতে পারল, তার নাম ফিলিপ। ফিলিপ আর সোফিয়া জঙ্গলে গিয়েছিল কারোর সঙ্গে দেখা করতে। সেখান থেকে বেরিয়ে ফেরার পথে কেউ বা কারা অতর্কিতে আক্রমণ করে তাদের। ফিলিপের মাথায় কোনও ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে আঘাত করায় সে অচেতন হয়ে পড়ে যায়। তারপর তার জ্ঞান ফেরে একটু আগে। জ্ঞান ফিরে সোফিয়ার আর কোনও চিহ্ন দেখতে পায়নি সে। ড্যানিয়েলের মনে পড়ল সেই মেয়েটির কথা, সেই বৃদ্ধার নাতনী, ঘাসের আড়ালে দাঁড়িয়ে যার দিকে নিস্পলকে চেয়েছিল ফিলিপ। নিশ্চয়ই সেই মেয়েটিই সোফিয়া। তার মানে সেই মিডিউ-এর বংশের মেয়ে। খুব ম্লান একটা সংযোগ যেন ধরা দিয়েও ধরা দিচ্ছিল না ড্যানিয়েলের কাছে। সোফিয়াকে অপহরণ করে কী লাভ মাইকের? হঠাৎ কী মনে পড়তে ফিলিপকে জিজ্ঞাসা করল সে “জঙ্গলে কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে তোমরা?” ভীতু চোখদুটো তুলে ড্যানিয়েলের দিকে চেয়ে জবাব দিল ফিলিপ, “মিডিউ।” 

“মিডিউ, মানে? তোমাদের মিডিউ তো অনেকদিন আগেই মারা গেছে।” ড্যানিয়েলের কথা শেষ হওয়ার আগেই ভূতগ্রস্তের মতো জবাব দেয় ফিলিপ “মিডিউ ফিরে এসেছে।” 

হয়তো কৃতজ্ঞতাবোধেই ড্যানিয়েলের সঙ্গে জঙ্গলে যেতে রাজি হয় ফিলিপ। তাছাড়া তাকেও ফিরে পেতে হত সোফিয়াকে। নিজের গলা থেকে স্কাফটা খুলে ফিলিপের মাথায় বেঁধে দেয় ড্যানিয়েল। তারপর অসমবয়সী দুই প্রেমিক নিজের নিজের উদ্দেশ্যে বদ্ধপরিকর হয়ে নিজেদের বিপদ অগ্রাহ্য করে ঢুকে পড়ে জঙ্গলে। ফিলিপ পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে, যেখানে সোফিয়া তাকে নিয়ে গিয়েছিল। অনেক পথ পেরিয়ে লেকের সামনে আসতেই একটা অজানা অনুভূতি গ্রাস করে ড্যানিয়েলকে। এই সেই লেক, কত ইতিহাসের সাক্ষী! যদি অবশ্য সেসব সত্যি হয়! ফিলিপের ডাকে হুঁশ ফেরে ড্যানিয়েলের। লেক পার করে কিছুটা এগিয়ে ওরা গিয়ে দাঁড়ায় সেই কুঁড়েঘরের সামনে। দরজা এখনও ভেতর থেকে বন্ধ। দরজায় ধাক্কা দিতে গিয়েও থেমে যায় ড্যানিয়েল। ফিলিপকে ইশারায় অন্যপাশে সরে দাঁড়াতে বলে দরজার একপাশে সে নিজে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়ায়। ভিতরে মাইকের গলা, “বলতে তোমাকে হবেই কেভিন, আমি জানি তুমি জানো সোনা কোথায়! এতদিন ধরে তুমি মিডউইউইন চর্চা করছ আর এখনও সে বিদ্যা কাজে লাগিয়ে সোনা তুমি উদ্ধার করোনি, এ কথা আমায় বলতে এসো না।” 

খুব আস্তে করে কেভিনের গলা শোনা গেল, পরক্ষণেই তার তীব্র চিৎকারে তার কিছু বলার চেষ্টা থেমে গেল। সম্ভবত তাকে আঘাত করা হয়েছে। ড্যানিয়েল ফিলিপের কাছে গিয়ে কানে কানে কিছু বলল। ফিলিপ একবার তার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে দৌড়ে চলে গেল সেখান থেকে। ড্যানিয়েল আবার শোনার চেষ্টা করতে লাগল, “আমাকে বোকা বানানো অত সহজ না কেভিন। কিছুদিন আগে হ্যারি আর বেঞ্জামিন আমার নির্দেশে তোমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিল। তখন তুমি বলেছিলে সোনা উদ্ধার করতে তুমি মৃত সাসকোয়াচকে জাগাতে পারো, কিন্তু সেজন্য একজন মানুষকে ব্যবহার করতে হবে টোপ হিসেবে। আমি তোমার জন্য টোপ এনেছি। আমাদের তাঁবুতে আছে। কিন্তু এখন তুমি বেঁকে বসছ কেন? তোমার নতুন করে পাওয়া মেয়ে আমার হেফাজতে। আমার কথা না শুনলে ওকে আর কাল সকালের আলো দেখতে দেব না। আর আমাকে সোনা পেতে সাহায্য করলে তোমাকেও আমি বঞ্চিত করব না। বাকি জীবন আরামে কাটানোর ব্যবস্থা করে দেব।” 

এবার কেভিনের মৃদু অথচ স্পষ্ট গলা শোনা গেল, “আমি তোমাকে কোনও সাহায্য করব না মাইক। ওই সোনা সাসকানিদের, আর কারও অধিকার নেই? সোনার উপর। আর হ্যাঁ, ঈশ্বর চেয়েছেন বলে আমি এই বিদ্যা শেখার সুযোগ পেয়েছি। তাকে আমি কোনওমতেই অপব্যবহার করতে দেব না।” 

আবার কেভিনের চিৎকার শোনা গেল। এবার মুহুর্মুহু। হ্যারি আর বেঞ্জামিনের নিষ্ঠুর প্রহার থেকে কেভিনকে বাঁচানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠল ড্যানিয়েল। কিন্তু তার একার পক্ষে কী করে তা সম্ভব, তা বুঝে উঠতে পারল না। এদিকে জুডিথকে খোঁজা দরকার। সে কুঁড়েঘরটার পিছনদিকে যাওয়া যায় কিনা, মনে মনে তাই ভাবছিল। হঠাৎ পিছনে পরিচিত গলায় “হাই ড্যানি, হোআস সাপ?” শুনে চমকে ঘুরে তাকাল ড্যানিয়েল। জুডিথ। ওকে সুস্থ সবল দেখে শুরুতে আশ্বস্ত হলেও খুব শিগগির সবকিছু একটু অন্যরকম ঠেকতে লাগল তার। জুডিথ হাসিমুখে এসে দাঁড়িয়েছে তার মুখোমুখি। তার মুখে কোনও উদ্বেগের লেশমাত্র নাই। ড্যানিয়েলের চোখে চোখ রেখে জুডিথ বলে ওঠে, “সবকিছু খুব অবাক লাগছে, তাই না ড্যানি? কোনও চিন্তা করো না, মরার আগে সবকিছু জানতে পারবে তুমি। এখন একটু কষ্ট হবে, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।” 

পিছন থেকে দুটো বলিষ্ঠ হাত শক্ত করে ধরে ফেলল ড্যানিয়েলকে। মাথা ঘুরিয়ে বেঞ্জামিনের মুখটা দেখতে পেল সে। কিন্তু নড়াচড়ার সুযোগ সে পেল না। শক্ত করে বাঁধা মোটা দড়ির ফাঁসে চলে গেল তার হাত ও পা। তারপর পাঁজাকোলা করে তাকে তুলে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল বেঞ্জামিন। ওদের পিছন পিছন জুডিথও। বাইরেটা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল সে। 

কেভিন মাটিতে পড়ে। তার মুখ, দাড়িগোঁফ রক্তে মাখামাখি। বোঝা যাচ্ছে খুব নির্দয়ভাবে মারধোর করা হয়েছে তাকে। ড্যানিয়েলকেও হাত-পা বাঁধা অবস্থাতে মাটিতে এনে ফেলা হল কেভিনের পাশে। ওদের ঢুকতে দেখে মাইক জুডিথকে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা এখানে? তোমাকে তো বলেছিলাম তাঁবুতে থাকতে। ওকে ওখানে আটকে রাখতে।” 

“কাকে আটকাবো আঙ্কেল? তোমরা বেরিয়ে পরার পরই এই মক্কেল আমার তাঁবুতে এল আমাকে খুঁজতে। আমি তখন ট্রাকের ট্রাঙ্কে তালা দিয়ে ফিরছি। আমাকে না দেখে তো সে কিছুক্ষণ পরেই পাগলের মতো বেরিয়ে পড়ল ট্রাক নিয়ে। আমার মনে হয় ও তোমাদের সব কথা শুনছিল। ওকে বেরোতে দেখে আমিও বেরিয়ে পড়লাম। ইনি তো ট্রাক নিয়ে চলে এসেছেন, তাই হেঁটে আসতে একটু সময় লাগল আমার।” কথা শেষ করে কেভিনের দিকে নজর গেল জুডিথের, “ও তাহলে এই সেই নিজেকে নিজে মিডিউ বলা লোকটা? তা ওকে বলেছ, তার প্রিয় পাতানো মেয়ের খবর?” 

“আহ্, থামো। বড্ড কথা বলছ আজকাল।” ধমকে উঠল মাইক। তারপর কেভিনের উদ্দেশে বলে উঠল, “সব মন্ত্র তন্ত্র মনে করে নাও মিডিউ। আজ রাতেই তোমাকে দিতে হবে সোনার হদিশ। আর তোমার সাসকোয়াচের টোপ তোমার পাশেই আছে। নাহলে আর এই গবেটটাকে কেন খাইয়ে পরিয়ে সঙ্গে রেখেছি!” হেসে উঠল মাইক। তার সঙ্গে ঢাকের বাঁয়ার মতো হ্যারি আর বেঞ্জামিনও। মাটিতে পড়ে থাকা ড্যানিয়েলের বালিয়াড়িটাকে অবশ্য ততক্ষণে ঢেকে ফেলছে একটা বজ্রগর্ভ মেঘ, যা আগুনের গোলা ছাড়া আর কিছুই বর্ষাবে না। 

(আট) 

সন্ধে হয়ে এসেছে। ঘরের ভেতরে জ্বলছে জোরালো একটা ব্যাটারির আলো। কেভিন করুণ স্বরে জল চাইছে অনেকক্ষণ থেকে। ড্যানিয়েলের নড়াচড়ার উপায় নেই। এবার দরজা খুলে গেল। ঘরে ঢুকল জুডিথ। ড্যানিয়েল বলে উঠল, “ওকে জল দাও জুডিথ। ও মরে গেলে তোমাদেরই ক্ষতি।” কথাটা বোধহয় মনে ধরল জুডিথের। কেভিন ড্যানিয়েলের কথা শুনে ছটফট করে উঠল। জুডিথ কেভিনকে সাহায্য করল উঠে বসতে। বড়ো বড়ো চোখ করে জুডিথের দিকে দেখছে সে। জুডিথ কেভিনের মাথাটা একহাতে ধরে অন্যহাতে ওর মুখে জল ঢেলে দিতে লাগল। বেশ অনেকটা জল বেয়ে পড়ল কেভিনের মুখ থেকে। তার রক্তাক্ত মুখ বেয়ে পড়ার সময় জলের রং হয়ে উঠল লাল আর কেভিনের দাড়িগোঁফসহ মুখটা পরিষ্কার হয়ে উঠল। 

“জুডি!” কেভিনের ডাক শুনে হাত থেকে জলের পাত্রটা পড়ে গেল জুডিথের। সে চোখ বিস্ফারিত করে হাঁ করে চেয়ে রইল কেভিনের দিকে। কেভিন আবার ডাকল, “হেই জুড়ি, আয়াম কেভিন, কেভিন স্মিথ। তুমি কি আমাকে চেনো?” জুডিথ এখনও হতবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। মিনিট খানেক পর যেন কণ্ঠস্বর ফিরে পেল সে, “ড্যাড, অ্যাম আই ড্রিমিং?” 

শিশুর মতো হেসে উঠল কেভিন। জুডিথ দৌড়ে এসে কেভিনের হাতের বাঁধন খুলে দিল। এর পরের দৃশ্যটা হাত-পা বাঁধা অবস্থাতেও ড্যানিয়েলের মুখে হাসি ফোটাল। অপ্রত্যাশিত মিলন পিতাপুত্রী উভয়কেই ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। বেশ খানিকক্ষণ পরে জুডিথ প্রশ্ন করল, “কিন্তু ড্যাড, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? আঙ্কেল যে বলল তুমি হারিয়ে গেছ, তোমার জীবিত থাকার কোনও সম্ভাবনা নেই, তাহলে? তাছাড়া তুমি মিডউইউইন কীভাবে শিখলে? এত অদ্ভুত ব্যাপার! প্লিজ আমাকে সব খুলে বল।” 

এরপর কেভিনের মুখ থেকে শোনা কাহিনি জুডিথের পাশাপাশি ড্যানিয়েলেরও কৌতূহল নিরসন করল। বারো বছর আগে কেভিন মাইকের সঙ্গে এসেছিল এখানে। তখন মাইক সত্যিই উৎসাহী ছিল ক্রিপ্টোজুলজি নিয়ে। সাসকোয়াচের খোঁজে এখানে এসে প্রথম তারা জানতে পারে সাসকানিদের হারানো সম্পদের কথা। কেভিনের কথায়, “চোখের সামনে পালটে গেল মানুষটা। কিংবা হয়তো ভেতরে ভেতরে ওর লোভী চরিত্রটা আমি বুঝতেই পারিনি আগে। একদিন রাতে খুব তর্কাতর্কি হল আমার সঙ্গে। আমি স্পষ্টভাবে ওকে জানিয়ে দিলাম, যে সম্পদে আমাদের অধিকার নেই, তার জন্য আমি তাকে সাহায্য করব না। মাইক প্রচণ্ড রেগে গেল। হঠাৎ পকেট থেকে ছুরি বের করে আমার বুক লক্ষ করে চালিয়ে দিল। আমি পড়ে গেলাম। ও বোধহয় ভেবেছিল আমি মারা গেছি। সম্ভবত ওই আমার দেহটা জঙ্গলে ফেলে দিয়ে তখনকার মতো ফিরে যায় বোস্টনে।” 

জুডিথ অস্ফুটে বলে উঠল, “আঙ্কেল! এও সম্ভব!” 

কেভিন একবার জুডিথের দিকে তাকিয়ে বলে চলে, “কিন্তু আমার তখনও মৃত্যু আসেনি। তাই কয়েকদিন পর আমার জ্ঞান ফিরল এই কুঁড়েতে। সোফিয়ার মা ক্রিস্টিন আমাকে পেয়েছিল। ওই আমাকে কীভাবে এখানে নিয়ে আসে জানি না। তবে ওর কাছে আমি সারাজীবন ঋণী থাকব। সোফিয়া তখন মাত্র তিনবছরের। ওকে সঙ্গে নিয়ে ক্রিস্টিন আমাকে খাবার দিতে আসত। তোমরা সাসকানিদের গল্প জানো কিনা জানি না। ওদের শেষ মিডিউ লুইস ছিল সোফিয়াদের পূর্বপুরুষ। ওদের পরিবার এখনও বিশ্বাস করে মিডিউ প্রভু যিশুর মতোই আবার ফিরে আসবেন। ক্রিস্টিনের কেন যেন বিশ্বাস হয়েছিল আমিই সেই মিডিউ। এই বিশ্বাস থেকেই সে আমাকে এই কুঁড়েতে নিয়ে আসে। আমি ওর ভুল ভাঙাইনি। এই কুঁড়েঘরটা ছিল পাওলার। সে তার পিতার দেওয়া বিদ্যা চর্চা করতে চেয়েছিল। কিন্তু সাসকানিদের সঙ্গে থেকে তা সম্ভব ছিল না। কারণ ওদের সমাজে মেয়েদের মিডউইউইন চর্চা করার অধিকার দেওয়া হয় না। তাই কেবলমাত্র তার পরিবারের মেয়েরা ছাড়া আর কেউ জানত না যে পাওলা এখানে বাস করে। ক্রিস্টিন তার শাশুড়ির কাছ থেকে এসব জেনেছিল। কিন্তু এত করেও শুধু এই স্বেচ্ছানির্বাসনের কারণে পাওলা কাউকে তার অধীত বিদ্যা দান করে যেতে পারেনি। তাই মিডউইউইনের সবকিছু সে লিখে গিয়েছিল এই কুঁড়েঘরের দেওয়ালে। আমি ক্রিস্টিনকে বারণ করেছিলাম আমার কথা কাউকে বলতে। বলেছিলাম, সময় হলে আমিই সবাইকে জানাব। সে কথা রেখেছিল। সোফিয়া ছাড়া অন্য কেউ জানত না আমার কথা। সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার জন্য যে সময় লেগেছিল, তার মধ্যে আমি কুঁড়েতে রাখা পাওলার পুঁথিপত্র দেখলাম। খুব কৌতূহল জাগল মিডউইউইন সম্পর্কে। ক্রিস্টিনের কাছ থেকে সাসকানি ভাষা শিখলাম। সরল মনে ও শিখিয়ে দিল। অন্ধবিশ্বাস মানুষকে সত্যিই অন্ধ করে দেয়। তাই ওর মনে হয়তো প্রশ্নও জাগেনি যে মিডিউ-এর ভাষা শেখার প্রয়োজন হল কেন! যাই হোক, এরপর শুরু হল আমার পড়াশোনা। দিনের পর দিন অনলস পরিশ্রম করে শিখলাম মিডউইউইনের মন্ত্রতন্ত্র। আর গত তিন বছর ধরে সোফিয়াকে আমি শিখিয়েছি। ওদের বিদ্যা ওদের সম্প্রদায়ের মধ্যে থাকাই উচিৎ।” 

কেভিন দম নেওয়ার জন্য থামল। ওর কথা শুনতে শুনতেই জুডিথ কেভিন আর ড্যানিয়েলের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল। ড্যানিয়েল উঠে বসতেই সশব্দে খুলে গেল দরজা। মাইক, ওর পিছনে হ্যারি আর বেঞ্জামিন। হ্যারির হাতের অটো শটগান-এর বাঁটে এখনও রক্ত লেগে। কে জানে, ফিলিপের, না কেভিনের! গা-জ্বালানো একটা হাসি হাসতে হাসতে মাইক বলে উঠল, “দাঁড়াও কেভিন, দাঁড়াও। এর পরের গল্পটা আমি বলি, কেমন? তোমাকে মৃত ভেবে এখান থেকে ফিরে গেলেও আমার মন পড়েছিল সাসকানিদের সোনার দিকে। তখন আমার টাকার দরকার। ক্রিপ্টোজুলজির আড়ালে সোনার খোঁজ চালাবার জন্য একটা টিম চাই, সেট আপ চাই। জুডিথ তখন একা। মাত্র দশ বছরের খুকি। আমি ওর অভিভাবকত্ব নিলাম। তোমার টাকাপয়সা সম্পত্তিও এবার এল আমার হাতে। আইনত না হলেও, অভিভাবক হিসেবে ও সাবালক না হওয়া পর্যন্ত এসব হ্যান্ডল করার দায়িত্ব তো আমারই, তাই না? জুডিথ অবশ্য খুব ভালো মেয়ে, ও বড়ো হয়েও কোনওদিন হিসেব চায়নি আমার কাছে। ও জানে আমার প্রচুর পৈতৃক সম্পত্তি, কিন্তু তুমি তো জানো কেভিন, আমি কত গরীব ঘর থেকে উঠে এসেছি!” 

জুডিথ চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাইকের ওপর। “আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম আঙ্কেল। আমি জানতাম সাসকানিদের সোনা আমাদের রিসার্চের কাজে লাগবে, নতুন আবিষ্কারের কাজে লাগবে। এমনকি ড্যানিয়েলকে সাসকোয়াচের টোপ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ভুলিয়ে নিয়ে আসার দায়িত্বও নিয়েছিলাম আমি। আর তুমি? সারা জীবন ধরে আমাকে ঠকিয়েছ, আমার ড্যাডকে খুন করতে চেয়েছ, তুমি কি মানুষ?”

জুডিথ কেঁদে উঠল হাউহাউ করে। মাইকের ইশারায় হ্যারি পিছন থেকে জুডিথকে চেপে ধরতেই ড্যানিয়েল ছিটকে উঠল। হ্যারির দিকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ওকে ধরল বেঞ্জামিন। দু’জনেরই হাত-পা আবার বেঁধে ফেলা হল। মাইক চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছিল। কাজ শেষ হতে আবার মুখ খুলল, “তোমার বোঝা উচিৎ ছিল কেভিন। আমি এর শেষ না দেখে সহজে ছাড়ব না। বোস্টনে বসেই জোগাড় করলাম হ্যারি আর বেঞ্জামিনকে। পয়সার জন্য ওরা সবকিছু করতে পারে। ওদের পাঠিয়ে দিলাম এখানে। তোমরা জানো না, কিন্তু কেভিন জানে ওরা গত পাঁচ বছর ধরে এই জঙ্গলে ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতেই ওরা এই কুঁড়েঘর আবিষ্কার করে, এমনকি কেভিনকেও দেখে, ক্রিস্টিন আর সোফিয়াকে আসতে দেখে। ওদের বর্ণনা শুনে আমি এক কথায় ধরে ফেলি এটা কেভিন ছাড়া আর কেউ না। শুনলাম ওরা কেভিনকে মিডিউ বলে ডাকে। আমার পুরনো আশা আবার জেগে ওঠে। হ্যারি আর বেঞ্জামিনকে নিয়ে একদিন আবার আমি কেভিনের কাছে আসি। ওকে ভয় দেখাই, কিন্তু কেভিনের মাথায় চেপে বসা সততার ভূত কিছুতেই নামবার নয়। কাজেই ওকে ভয় দেখাবার জন্য বাধ্য হলাম হ্যারি আর বেঞ্জামিনের সাহায্যে ক্রিস্টিনকে খুন করতে। কেভিন সোফিয়াকে খুব ভালোবাসে, হয়তো ওর মধ্যে নিজের মেয়েকে দেখে। কাজেই ক্রিস্টিনের মৃত্যু যে ওকে সোফিয়ার জন্য ভয় পাইয়ে দেবে তা জানতাম। ও ভয় পেল। কিন্তু আমাদের বলল, ‘সোনা লেকের বরফ থেকে উদ্ধার করার জন্য যে বিদ্যা শেখা প্রয়োজন, তা শেখা ওর এখনও বাকি আছে। তাই একটু অপেক্ষা করতে হবে।’ আমি রাজি হলাম। এত বছর অপেক্ষা করেছি, আরও কয়েক বছর না হয়! হ্যারি আর বেঞ্জামিনকে এখানে পাহারায় রেখে আমি আবার চলে গেলাম বোস্টনে।” 

মাইক হঠাৎ হাসতে শুরু করল, “এদিকে তখন আর এক কাণ্ড! সাসকানির দল ক্রিস্টিনের মৃত্যুর পর ধরে নিল সাসকোয়াচ জেগে উঠেছে। সে বদলা নিতে এসেছে। এতে আমার মাথায় আর এক প্ল্যান এল। এই গুজবের ফায়দা তোলা যাক! কেভিন যতদিন না সোনা আদায়ের বিদ্যা শিখেছে বলে স্বীকার করল ততদিন সাসকোয়াচের সাউন্ডএফেক্ট ব্যবহার করে প্রতি বছর একজন করে মোট তিনজন সাসকানিকে খুন করতে হল। ওদের দেহ লোপাট করল ওরা লেকের রাক্ষুসে বরফের গভীরে। এবার ওদের কাছে সাসকোয়াচের ফিরে আসার তত্ত্ব বেশ শিকড় গেঁড়ে বসল। এই জঙ্গলে মানুষের আসা বন্ধ হল, আমার সুবিধা হল। কেভিন আমাকে জানাল, সোনা পেতে হলে মন্ত্র পড়ে সাসকোয়াচকে ডাকতে হবে। তার জন্য আগের মতোই চাই টোপ। তো কী করব ড্যানিয়েল, জুডিথ তোমাকেই জোগাড় করে আনল।” 

কেভিন দুর্বল গলায় জিজ্ঞেস করল, “সোফিয়া কোথায়?” 

“সোফিয়াকে ঠিক সময়মতো দেখতে পাবে। আমাদের সময় হয়ে গেছে কেভিন। তুমি তৈরি হয়ে নাও। লেকের ধারে আজকে তুমি মৃত সাসকোয়াচকে দিয়ে সোনার বাস্ক তোলাবে। উষ্ণ আমার বিশ্বাসই হত না, যদি কেভিন না বলত। লেটস গো।” 

বেঞ্জামিন কেভিন আর জুডিথকে চেপে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল আর হ্যারি ড্যানিয়েলকে। জুডিথের মুখে একটা কাপড়ের টুকরো বাঁধা। ও ছটফট করে কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু কিছুতেই পারছে না। বেঞ্জামিন কেভিনের বাঁধন খুলে দিল। সে কয়েক মিনিটের মধ্যে একটা কালো আলখাল্লা জাতীয় পোশাক পরে ঘরের মধ্যে রাখা ভারী কাঠের বাক্সটা নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সম্ভবত বাক্সটার মধ্যে তার মিডউইউইনের উপকরণ আছে। মাইক তাকে অনুসরণ করল। হ্যারি আর বেঞ্জামিন ড্যানিয়েল ও জুডিথকে নিয়ে এগোতে থাকল। 

(নয়) 

চাঁদের আলো আজও রুপোলী বন্যায় ভাসিয়ে নিচ্ছে লেকের চারদিক। বরফঢাকা লেকটাকে কেমন রূপকথার দেশের বলে মনে হচ্ছিল। ড্যানিয়েল আর জুডিথ এখনও হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। কিন্তু কেভিনের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়েছে। সে লেকের পাশে চুপ করে বসে আছে। মাইক বলে উঠল, “তোমার কাজ শুরু করো কেভিন। আর কোনও পথ নেই তোমার কাছে। এখন তো জেনেই গেছ, তোমার আসল ও নকল দুই কন্যাই আমার হেফাজতে। ওদের বাঁচাতে চাইলে কাজে লাগাও তোমার বিদ্যা। মিডউইউইন পৃথিবীর প্রাচীনতম যাদুবিদ্যাগুলোর মধ্যে একটা। অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতা আছে এ বিদ্যার। চটপট, আমার হাতে বেশি সময় নেই।” মাইকের হুমকির পরেও কেভিন ওঠার কোনও লক্ষণ দেখাল না। মাইক প্রচণ্ড রেগে গিয়ে চিৎকার করে উঠল, “হ্যারি, জুডিথকে নিয়ে যাও। বাপ মেয়ে একে অপরের মুখ যেন আর কোনওদিন না দেখতে পারে।” 

“দাঁড়াও!” হ্যারি জুডিথের দিকে এগোতেই ঠান্ডা গলায় বলে উঠল কেভিন, “মিডউইউইন সম্পর্কে তোমার ধারণা ভুল। এটা কোনও যাদুবিদ্যা নয়। এটা আসলে জড়িবুটি ওষুধের বিদ্যা। প্রাচীন উপজাতিদের মধ্যে এমন অনেক ভেষজ বা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত, যা আধুনিক চিকিৎসার চেয়ে কম কিছু নয়। মিডিউরা এর সঙ্গে যেটা প্রয়োগ করতেন, তা হল হিপনোথেরাপি। একেই সাধারণ মানুষ মন্ত্রতন্ত্র বলে মনে করত। কিছু যাদুবিদ্যা এরা জানত ঠিকই, কিন্তু তা ব্যবহৃত হত শুধুই মানুষের ভক্তি ও বিশ্বাস কুড়োবার জন্য। পাওলার লিখে যাওয়া বিস্তারিত বর্ণনা পড়ে আমার এটাই মনে হয়েছে। কাজেই মন্ত্র পড়ে লেক থেকে সোনা উদ্ধার করার গল্পটা একেবারেই আমার মনগড়া। মানুষের টোপ দিয়ে সাসকোয়াচকে জাগানোর কাহিনিও আমার মাথায় আসে সাসকানি লোককথা থেকে। আমি তোমার হাত থেকে রেহাই পেতে এসব বলেছিলাম।” 

ক্ষিপ্ত বাঘের মতো মাইক ছুটে এল কেভিনের দিকে। ওর জ্যাকেটের গলার কাছটা ধরে একটানে দাঁড় করিয়ে দিল ওকে। “মজা করছ, মজা করছ তুমি আমার সঙ্গে? আমার এত বছরের প্রতীক্ষা তুমি মিথ্যে করে দিতে পারো না। জুডিথ, সোফিয়া, ড্যানিয়েল, তুমি কাউকে আমি জীবিত ছাড়ব না। আগুন ধরিয়ে শেষ করে দেব সাসকানি বস্তি।” 

“আমার কথা শেষ হয়নি মাইক। আমি ভেবেছিলাম তুমি শিক্ষিত। কিন্তু সেই তোমার মধ্যেই যে এত কুসংস্কার, এত অন্ধবিশ্বাস, সেটা দেখে আমি সত্যিই হতবাক। একটা উপজাতি সম্প্রদায়ের লোককথা, তাই শুনেই তুমি নিজের রিসার্চ, নিজের পড়াশুনা, সব ছেড়ে জীবনের এতগুলো মূল্যবান বছর দিয়ে দিলে কালের গর্ভে! একের পর এক মানুষ খুন করেছ, আরও করতে চলেছ, এসব কীসের জন্য? তুমি কি জানো, মিডিউ কখনোই সাসকানিদের সম্পদ নিয়ে আত্মহত্যা করেনি! তার আত্মহত্যার সময় পাওলা ছাড়া আর কেউ উপস্থিত ছিল না। তাহলে কী করে জানা গেল, সে সোনাসহ আত্মহত্যা করেছে? তার মৃত্যুর পর সেই সোনাভর্তি বাক্স পাওয়া যায়নি বলে মুখে মুখে এই গল্পই প্রচার হয়েছে। কিন্তু যে মানুষটা নিজের সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে সবকিছু করতে পারত, সে কি তাদের এতবড়ো ক্ষতি করতে পারে? মিডিউ তার কন্যা পাওলাকে নিজের বিদ্যা শিখিয়েছিলেন কারণ তার পুত্র জেসন তখনও দশ বছরের হয়নি। আবার সেইজন্যই সাসকানিরা যে সম্পদ রক্ষা করার ভার দিয়েছিল তাকে, সেই সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্বও তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন পাওলাকে। তবে পাওলা নিজের সম্প্রদায়ের উপর ক্ষোভবশত এ কথা কাউকে বলেনি। নিজের পিতাকে চোখের সামনে লেকের জলে আত্মহত্যা করতে দেখেছিল সে। গৃহত্যাগ করে এখানে আত্মগোপন করে থাকার সময় সেই সোনা তার সঙ্গেই ছিল। পাওলা এই সবকিছু লিখে গেছে তার ঘরের দেওয়ালে। সে অনেক কম বয়সেই মারা গেছে। সেই থেকে সোনা এই ঘরেই লুকনো ছিল যতদিন না আমি এলাম এখানে।”

মাইকের চোখগুলো বড়ো বড়ো হয়ে গেছে। সে বিকৃতকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, “কোথায় সোনা? শিগগির বলো।” 

“বলব মাইক, বলব। জুডিথ আর ড্যানিয়েলের বাঁধন খোলো। সোফিয়া কোথায়?” মাইক বেঞ্জামিনকে ইশারায় ওদের বাঁধন খুলে দিতে বলল। মুখের বাঁধন আলগা হতেই জুডিথ চিৎকার করে উঠল, “আমি জানি সোফিয়া কোথায়! “ সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই মাইক বলল, “নো ডার্লিং, নট সো ফাস্ট। আগে কেভিন আমাকে সোনার সন্ধান দেবে, তবে তোমরা এখান থেকে যেতে পারবে।” 

একটা কোলাহলের শব্দ ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে। সবাই ঘুরে তাকাল সেদিকে। কাতারে কাতারে সাসকানির দল হাতে মশাল নিয়ে এগিয়ে আসছে এদিকেই। তাদের সামনে সামনে পথ দেখিয়ে আসছে ফিলিপ। বহু বছর আগে যে সাসকানিরা এক শিশুর সঙ্গে হওয়া অবিচারের জন্য তাদের পরম শ্রদ্ধেয় মিডিউকে পর্যন্ত ছাড়েনি, তারা আজ আবার তাদের ঘরের মেয়েকে রক্ষা করতে ছুটে এসেছে দল বেঁধে। ওদের দেখে মাইক ছটফট করে ওঠে। হ্যারির হাত থেকে শটগানটা ছিনিয়ে নিয়ে জুডিথের মাথায় ঠেকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “কাম অন কেভিন। কুইক!” মাইকের কথা শেষ হওয়ার আগেই কেভিন মাটি থেকে সেই কুঁড়েঘর থেকে আনা কাঠের চৌকো বাক্সটা সর্বশক্তি দিয়ে ছুঁড়ে দিল লেকের দিকে, “হিয়ার উই গো মাইক, ক্যাচ ইট।” মাইক বাক্সটা ধরার জন্য লাফ দিল, ধরলও সেটা, কিন্তু টাল সামলাতে না পেরে বাক্সসুদ্ধ গিয়ে পড়ল লেকের বরফের উপর। প্রাণপণে বাক্সটা বুকে জড়িয়ে ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই পিচ্ছিল বরফে পা পিছলে প্রচণ্ড জোরে আবার পড়ে গেল। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলেও বাক্সটা ছাড়ল না মাইক। হঠাৎ লেকের বরফ একদিক থেকে ফাটতে শুরু করল। মাইক সেদিকে তাকিয়ে প্রাণভয়ে চিৎকার করতে লাগল। এদিকে সাসকানিরা ততক্ষণে চলে এসেছে। হ্যারি আর বেঞ্জামিনকে ঘিরে ধরে প্রচণ্ড প্রহার চলছে। বেঞ্জামিনের চকচকে ছোরাটা পড়ে রয়েছে মাটিতে। 

ফিলিপ এগিয়ে আসে ড্যানিয়েলের দিকে। “সবাইকে একজায়গায় করে নিয়ে আসতে সময় লেগে গেল। তোমরা সবাই ঠিক আছো তো? কিন্তু আমি সোফিয়াকে এখনও পেলাম না।” 

জুডিথ ফিলিপ আর ড্যানিয়েলকে বলল, “এসো আমার সঙ্গে।” 

ওরা জঙ্গলের পথে এগিয়ে চলল গ্রামের দিকে। কেভিন লেকের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল মাইকের দিকে। মাইকের পায়ের তলায় লেকের বরফের ফাটল তখন ক্রমশ বাড়ছে। কেভিনের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক ঝটকায় পাতালপ্রবেশ করল মাইক। তার সারাজীবনের আকাঙ্ক্ষার সোনা থাকার কথা যে বাক্সে, সেটা তখনও তার বুকের সঙ্গে জড়ানো। 

(দশ) 

সাসকানিদের প্রহারে হ্যারি আর বেঞ্জামিনের অচেতন দেহ পড়ে রইল জঙ্গলের মধ্যে। তাদের দেহে বোধকরি আর প্রাণ নেই। সাসকানির দল হই হই করে ফিরে চলল গ্রামের দিকে। সঙ্গে কেভিনও। ওরা যতক্ষণে পাহাড়ের গায়ের ঘাসজমির কাছে পৌঁছল, ততক্ষণে ফিলিপ আর ড্যানিয়েল ট্রাকের পিছনের ট্রাঙ্ক থেকে ধরাধরি করে বের করে এনেছে সোফিয়াকে। জুডিথ তার পকেটে রাখা চাবি দিয়ে খুলে দিয়েছিল ট্রাঙ্ক। অনেকক্ষণ বদ্ধ জায়গায় থাকার দরুণ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সোফিয়া। কিছুক্ষণের পরিচর্যায় জ্ঞান ফিরল তার। সাসকানিদের দলসহ সবাইকে একজায়গায় দেখে অবাক হয়ে তাকাল সোফিয়া। আনন্দে চিৎকার করে উঠল পুরো দলটা। কেভিন এসে সোফিয়ার মাথায় হাত রেখে বলল, “তুমি ঠিক আছো? এবার আমাদের শেষ কাজটা বাকি আছে যে।” 

সোফিয়া কেভিনের মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেল সেই বার্চ গাছটার নীচে। বাকি সবাই অনুসরণ করল সোফিয়াকে। সে গাছের তলার একটা জায়গায় আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে সেখানটা খুঁড়তে বলল। সাসকানিদের একদম সামনে ছিল সোফিয়ার বাবা চার্লি। সে তার কোমর থেকে ছুরি বের করে মাটি খুঁড়তে শুরু করল। আরও কয়েকজন এগিয়ে এল তাকে সাহায্য করতে। কিছুটা খোঁড়ার পরই একটা বাক্সের মতো কিছু দেখা গেল। ধরাধরি করে সেটাকে বের করে এনে তার ঢাকনা খুলতেই মশালের আলোয় ঝলমল করে উঠল সাসকানিদের প্রাচীন সম্পদ। কেভিন আর সোফিয়া সবার চোখের আড়ালে এখানে লুকিয়ে রেখেছিল সেই হারিয়ে যাওয়া সোনা। সাসকানির দলটা আনন্দে নেচে উঠল। কিন্তু কেভিন জুডিথের সঙ্গে বোস্টন ফিরে যাবে শুনে চোখ ছলছল করে উঠল সোফিয়ার। কেভিন সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল “শুধু তোমাদের সোনা নয়, আরও এক সম্পদ ফিরে পাবে তোমরা। তোমাদের মিডউইউইন বিদ্যা। সোফিয়াকে আমি সব শিখিয়ে দিয়েছি। এবার সিদ্ধান্ত তোমাদের। তোমরা কি ওকে মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও মিডিউ হিসেবে মেনে নেবে? আর যদি কিছুতেই তা সম্ভব না হয়, তবে ফিলিপের সঙ্গে ওর বিয়ে দাও। তারপর ফিলিপ ওর কাছ থেকে শিখে নেবে বিদ্যা। তারপর একে অপরকে সাহায্য করে ওরা তোমাদের নেতৃত্ব দেবে। আবার বংশানুক্রমে এগিয়ে চলবে তোমাদের মিডউইউইন চর্চা। জুডিথ আর ড্যানিয়েলকে দু’পাশে নিয়ে হেঁটে যায় কেভিন। নিজের হাত বাড়িয়ে ড্যানিয়েলের হাতটা শক্ত করে ধরে জুডিথ। সবার চোখ এরিয়ে সোফিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে ফিলিপ। ড্যানিয়েল দেখছিল, প্রবল বর্ষণে ভিজে যাচ্ছে তার মনের রুক্ষ বালিয়াড়ি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *