সার্টিফিকেট

সার্টিফিকেট 

আজ নিয়োগ-পত্র পাইয়াছি। 

এমন কিছু বড় চাকরি নয়, গৃহশিক্ষকতা মাত্র, তবে লোভনীয়। জমিদারবাড়ির গৃহশিক্ষকতা; জায়গাটি মফস্সল হইলেও খুব স্বাস্থ্যকর; বেতন আশি টাকা; খাওয়া পরা, থাকার ব্যবস্থা ওঁদেরই; ছেলেটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে, অর্থাৎ তিন বৎসর পরে ম্যাট্রিক দিবে। ছেলে পাস করিলে তাহার সঙ্গে কলিকাতায় আসিয়া থাকিতে হইবে; কলেজ-জীবন শেষ হইলে জমিদারিতেই চাকরির সম্ভাবনা আছে। 

নিয়োগের একটা বড় শর্ত ছিল সার্টিফিকেট। অভিজ্ঞতা, চরিত্র প্রভৃতি সম্বন্ধে খুব উঁচু ধরনের সার্টিফিকেট না থাকিলে দরখাস্ত করিবার ব্যর্থতা সম্বন্ধে স্পষ্ট ভাষায় লেখা ছিল। 

কোনই আশা ছিল না। এমন জায়গায় প্রথম শ্রেণির এম. এ. পি-এইচ-ডি-দের দরখাস্ত পড়িবে, তাহার উপর মুখ-দেখাদেখি আছে, সুপারিশ আছে; আমার মতো নিঃসহায় মামুলি বি. এ. কোথায় ভাসিয়া যাইবে। তবু লোভের বশে দরখাস্তটা করিয়া দিয়াছিলাম। লোভ জিনিসটাকে রিপুর পর্যায়ে ফেলা হইয়াছে, এ ক্ষেত্রে কিন্তু আমার বন্ধুরই কাজ করিল। 

আবার এও ভাবি, বেশি বন্ধুর কাজ কে করিল,–লোভ, না আমার ছাত্র নিকুঞ্জলালের প্রবন্ধ? 

নিকুঞ্জলালকেও আমি অষ্টম শ্রেণি হইতেই পড়াইতে আরম্ভ করি, এইবার ম্যাট্রিকুলেশন পাস করিল, এই সবে এক সপ্তাহ হইল পরীক্ষার ফল বাহির হইয়াছে। মন্দ হইল না, সেকেন্ড ডিভিশন। নিকুঞ্জলালকে সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করাইয়া আমিও যদি আজ নেপোলিয়নের মতো বলি, ‘অসম্ভব’ কথাটা মূর্খদের অভিধানেই পাওয়া যায় তো নিতান্ত অশোভন হয় না। 

নিকুঞ্জলালের পিতা ব্রজমাধববাবু খুবই প্রীত হইয়াছেন; বলিলেন, আপনি এক অসাধ্যসাধন করলেন মাস্টারমশাই, আমার ছেলে বলেই যে আপনার প্রাপ্য যশ থেকে আমি বঞ্চিত করব আপনাকে, তা করব না। 

খুব পদস্থ ব্যক্তি একজন,—রায় বাহাদুর, জমিদার, অনারারি-ম্যাজিস্ট্রেট, আরও  অনেক কিছু। সবচেয়ে বড় কথা বঙ্গীয় জমিদার-সংঘের একজন হোমরা-চোমরা লোক, যেটুকু মুখে বলিলেন শুধু ওইটুকু কথাই যদি কাগজে লিখিয়া দেন তো কাজটার আমার অনেক আশা থাকে। কিন্তু জানি উনি তাহা করিবেন না। 

তাহার কারণ এই যে, আমি অসাধ্য সাধন করিতে পারি। 

নিকুঞ্জর যেদিন পাসের খবর বাহির হইল, সেই দিন সন্ধ্যার সময়ই আমি ব্রজমাধববাবুর সহিত দেখা করিলাম, বলিলাম, এইবার আপনি আমায় একটি ভালো সার্টিফিকেট দিন, অনেক দিন থেকেই আশা করে আছি, আপনি বলেছিলেনও দেবেন। আপনার একটি সার্টিফিকেটে আমার একটা ভবিষ্যৎ হয়ে যেতে পারে। 

ব্রজমাধব স্নেহভরে আমার কাঁধে দুইটি চাপড় দিয়া সস্মিত বদনে কহিলেন, পাবে হে ইয়ংম্যান, ব্রজমাধব সে রকম আন-এপ্রিসিয়েটিভ নয়, কাল সকালে দেখা করো।

দেখা করিতে নিকুঞ্জর কনিষ্ঠকে আমার দিকে একটু আগাইয়া দিলেন, স্মিত বদনেই বলিলেন, এই তোমার সার্টিফিকেট, এটি আবার একটু বেশি ডাল (dull), ভূপেশবাবুর কর্ম নয়,—নিজের ছেলে বলেই যে অযথা প্রশংসা করতে হবে তার মানে কি?…আর এই ধরো, আসছে মাস থেকে আরও পাঁচ টাকা বেশি পাবে। 

পুরস্কারস্বরূপ একটি মাসের মাহিনাও হাতে তুলিয়া দিলেন। উপায়ও নাই; তবুও তো কলিকাতা শহরে খাওয়া-পরা ছাড়া পঁচিশটি করিয়া টাকা মাহিনা পাইতেছি; না আছে সুপারিশের জোর, না আছে কিছু, করিই বা কী। অথচ বিভীষিকা দেখিয়া আতঙ্কে শিহরিয়াও রহিয়াছি—নিকুঞ্জলালের পর কুঞ্জলাল, তারপর রঞ্জনলাল, তারপর মঞ্জুলিকা, সবাই একে একে ঘাড়ে আসিয়া চাপিবে—দুই তিন বৎসর অন্তর এক মাসের বোনাস আর পাঁচটি টাকার বেতন বৃদ্ধি লইয়া? এই আমার জীবনের প্রস্পেক্ট? একটু বেশি ডাল হইতে হইতে সব চেয়ে ছোট রঞ্জনলালটি আবার বোবা হইয়া জন্মাইয়াছেন। 

কুঞ্জলাল জলখাবার খাইতে গিয়াছে। পড়িবার ঘরে চুপ করিয়া বসিয়া এ-বইটা সে-বইটা লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছি, আর নানারকম চিন্তা লইয়া তোলাপাড়া করিতেছি। বিজ্ঞাপনটা দেখা পর্যন্ত মনটা বড় চঞ্চল হইয়া আছে সব জিনিস যেন অত্যন্ত ফিকা বোধ হইতেছে। অবশ্য দুরাশা, তবুও যদি রায় বাহাদুরের একটা সার্টিফিকেট লইয়া দরখাস্তটা পাঠাইয়া দিতে পারিতাম তো কটা দিন আশায় আশায় কাটিত একরকম, আর তাহার পর বিফল মনোরথ হইলে ততটা কষ্টও হইতো না—চেষ্টা করার একটা সান্ত্বনা থাকিত তো। এখন আপশোশ হইবে, চেষ্টা করিলাম না বলিয়াই হইল না। –—একবার ভাবিতেছি, নিজেই গিয়া দেখা করি; কিন্তু দেখা করিবার পাত্রও তো আমি একা নয়। আবার মনে হইতেছে চাই একটা সার্টিফিকেট, যা হইবার হইবে। ভাবিয়া দেখিতেছি—যা হইবার মধ্যে হয়তো নৈরাশ্যজনিত বিরক্তিতে একটু কথাকাটাকাটি হইয়া হাতের চাকরিটাই যাইতে পারে। নিজেকেই প্রশ্ন করিতেছি, তোয়ের আছ তার জন্যে?—হলে দ্যাখো। 

এই সময় নিকুঞ্জলালের হাউন্ড কুকুর টম বাড়ির পোষা কাবুলি বেড়ালটাকে দেখিতে পাইল। টম তাহার প্রিয় আশ্রয় বইয়ের র‍্যাকের নিচেটিতে বসিয়া গরমে হাঁপাইতেছিল, বেড়ালটাকে নিশ্চিন্ত মনে ল্যাজ খাড়া করিয়া চলিয়া যাইতে দেখিয়া সহুংকারে লাফাইয়া উঠিয়াই পাঁচ থাক র‍্যাকের যত বই খাতা ম্যাপ দোয়াতদানি রুল ইনট্রুমেন্ট বক্স,—সমস্তর নিচে চাপা পড়িয়া গেল। 

যতক্ষণে উঠিল ততক্ষণে বিড়ালটা দোতালায় পৌঁছিয়া গেছে, সেখানে আলিসার একটি নিরাপদ কোণে গুটাইয়া বসিয়া ধীর অভিনিবেশের সহিত ঘরের দৃশ্যটি পর্যবেক্ষণ করিতেছে। 

যাই হোক, এই বিদ্যাসাগর-মন্থনে আমার ভাগ্যে একটি রক্ত উঠিল। চাকরটা আসিয়া বই-খাতা গুছাইয়া রাখিতেছিল, নিতান্ত অলস কৌতূহলবশেই আমি তাহার নিকট হইতে একখানি খাতা চাহিয়া লইলাম। নিকুঞ্জলালের বাংলা প্রবন্ধের খাতা, আজকের নয়, নিকুঞ্জ যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়িত সেই সময়ের নিজের কীর্তির আলোচনায় আত্মপ্রসাদ উপভোগ করিতেছিলাম, আর যাই হোক না-হোক, হাতের লেখাটা নিকুঞ্জর মানুষের মতো হইয়াছে। 

…অনেকগুলি প্রবন্ধ—ঘোড়া, গোরু, হস্তী, সত্যবাদিতা, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সিংহ, উষ্ট্র—সবগুলার নিচে এক দিকে নিকুঞ্জলালের নাম, লেখার তারিখ, অপর দিকে স্কুলের শিক্ষকের দস্তখত, তারিখ সমেত। একটি প্রবন্ধের গায়েও এতটুকু সংশোধনের আঁচড় নাই দেখিয়া কৌতূহল হওয়ায় দুই-একটা পড়িয়া দেখিলাম, সবগুলি কোন প্রবন্ধের পুস্তক থেকে যথাযথভাবে সংগ্রহ করা। পাতা উলটাইতে উলটাইতে হঠাৎ চোখে পড়িয়া গেল—”মনুষ্য”। ঝোঁকের উপর উলটাইয়াই যাইতেছিলাম, বারো চোদ্দোখানা পাতা যখন উলটাইয়া গেছি, হঠাৎ বড় কৌতূহল হইল। “মনুষ্য” সম্বন্ধে প্রবন্ধ ইস্কুল-ছাত্রদের গণ্ডির মধ্যে পড়ে না, ও লইয়া কলম চালাইবার সাহস করিতে পারে কার্লাইল, বেকন, হাক্সলির মতো মানুষই। স্কুলের প্রবন্ধ-পুস্তকেও মানুষ লইয়া কোনও প্রবন্ধ কোথাও দেখিয়াছি বলিয়া মনে পড়ে না। শিক্ষকের বিষয় নির্বাচনের তারিফ করিয়া আবার পিছন দিকে পাতা উলটাইয়া যাইতে লাগিলাম—নিকুঞ্জলালই বা কী লিখিল, শিক্ষকই বা কী পরিবর্তন-পরিবর্ধন করিলেন একবার দেখিতে হইল তো! 

প্রবন্ধের শেষ পাতাটিতে আসিলাম—শিক্ষকের দস্তখতে লেখা রহিয়াছে, “তুমি একটি আস্ত গদর্ভ”। কোনওখানে কাটাকুটি কিছু নাই। বুঝিলাম এই এতগুলি রচনার মধ্যে এইটিতে যখন নিকুঞ্জের স্বকীয় রূপ শিক্ষকের নিকট ধরা পড়িয়াছে, তখন এটি নিশ্চয় মৌলিক। প্রবন্ধটি পড়িতে লাগিলাম, যতই অগ্রসর হইতে লাগিলাম, বুঝিলাম— বইয়ে কোথাও না পাওয়ায় গোরু, ঘোড়া, উষ্ট্র, সিংহের আদর্শে নিকুঞ্জ প্রবন্ধটি সত্যই নিজে আগা-গোড়া লিখিয়া গিয়াছে হয়তো শিক্ষক আলগাভাবে ওইরকম একটা নির্দেশ দিয়া থাকিবেন, অর্থাৎ—জীবজগতের এতগুলি জীব সম্বন্ধে যখন প্রবন্ধ লিখিয়াছে, তখন সেই আদর্শে মনুষ্য সম্বন্ধেই রা পারিবে না কেন? যাই হোক, সেটা আমার আন্দাজ—আপাতত মূল প্রবন্ধটা এখানে তুলিয়া দিলাম 

“মানুষ দুই পদের জন্তু। তাহার সামনের দুইটিকে হাত বলা হয়, নতুবা সে চতুষ্পদ হইতে পারিত। মানুষ বনমানুষ সার্কাসের ভাল্লুক প্রভৃতির ন্যায় দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া চলিতে ভালোবাসে। মানুষের দুইটি কান, দুইটি চোখ এবং একটি নাক আছে! ইহাদের মাথায় সিং নাই, তবে রাজপুতনার দিকে এক জাতীয় মানুষ পাওয়া যায় তাহাদের সিং বলে। তাহারা যুদ্ধের দ্বারা প্রাণ ধারণ করে এবং তাহাদের স্ত্রীরা আগুনে ঝাঁপ দেয়। মানুষের লেজও নাই, এই জন্য ইহাদের পাখা দিয়া মশামাছি তাড়াইতে হয়। মানুষ কাঁচা আম, পেঁপে, জাম, আনারস, মধু প্রভৃতি খাইতে বড় ভালোবাসে, নটে শাক, পালং শাক, আলু, পটল, মাছ, মাংস, ডিম্ব প্রভৃতি রন্ধন করিয়া খায়। ইহারা গোরু, মহিষ, ছাগল প্রভৃতির মতো জাবর কাটিতে পারে না; তবে পান চিবায়, বিশেষ করিয়া স্ত্রী-মানুষেরা—ইহাদের মেয়েমানুষ বলা হয়। যে মানুষেরা রন্ধন করে তাহাদের ঠাকুর বলে। ঠাকুর মুসলমান হইলে তাহাকে বাবুর্চি বলে। বাবুর্চি-ঠাকুরের পৈতা থাকে না। তাহারা কাছাও দেয় না, টিকিও রাখে না— তাহার বদলে দাড়ি রাখে। 

“মানুষের খুর নাই, সেইজন্য সে জুতা পরে। মেয়েমানুষরা জুতা পরে না, তবে মেম, চিনা প্রভৃতি কয়েক রকম মেয়েমানুষ জুতা পরিয়া থাকে। মানুষ চুল আঁচড়াইতে অত্যন্ত ভালোবাসে। ইহাকে ফ্যাশান বলে। জামা কাপড় প্রভৃতিকেও কখনো কখনো ফ্যাশান বলা হয়। পাম্পশু, অ্যালবার্ট-শু, স্নো, পাউডার প্রভৃতিকেও কেহ কেহ ফ্যাশান বলে। 

“মানুষ পূজা করিতে ভালোবাসে। যে মানুষেরা পাঁটা খাইতে ভালোবাসে, তাহারা কালীপূজা করে। যে মানুষ পাঁটা খায় না, তাহাকে বোষ্টম বলে। বোষ্টমদের ঠাকুর শ্রীকৃষ্ণের অনেকগুলি বিবাহ ছিল। 

“মানুষ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই পাওয়া যায়, তাহার মধ্যে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার জঙ্গল প্রধান। ইহারা কথা কহিতে পারে। মানুষ দুই প্রকার—বনমানুষ এবং ভালোমানুষ। যাহারা জামা-কাপড়-প্যানটালুন-টুপি প্রভৃতি পরিতে শিখিয়া দাড়ি কামাইয়া শহরে আসিয়া গিয়াছিল, তাহারা ও তাহাদের সন্তানেরা ভালোমানুষ। যাহারা পারিল না, তাহারা বনমানুষ হইয়া রহিল। এই বনমানুষকে মানুষের প্রোপিতামহ বলা হয়। ভালোমানুষের সন্তানেরা পড়াশুনা করে এবং পরীক্ষা দেয়। ইহার জন্য পাঠশালা গুরুমশাই এবং স্কুলে মাস্টারমশাই বলিয়া একরকম রাগী মানুষ থাকে। ইহাদের মধ্যে কেহ কেহ দাড়ি নামক মুখে একরূপ পদার্থ রাখে। আমাদের প্রবন্ধের মাস্টারমহাশয় রাগী নহে। 

“মানুষের চামড়ায় ঘোড়ার জিন, সুটকেশ প্রভৃতি কিছুই তৈয়ার হয় না। এইজন্য মানুষ মরিলে তাদের পুড়াইয়া ফেলা হয়। মানুষের উপরে ষোলোটি ও নিচে ষোলোটি দাঁত আছে, সেগুলি চিবাইবার ও হাসিবার জন্য ব্যবহৃত হয়।…” 

সবটা তুলিয়া দেওয়ার দরকার নাই। এই রকম মানুষের আয়ু, মেয়েমানুষের একেবারে কয়টি করিয়া সন্তান হয়, মানুষ কয়েকটি বিশেষ বিশেষ অভ্যাস—সব খুঁটিয়া খুঁটিয়া ধরিয়া দিয়া ছয় পাতায় বেশ একটি মাঝারি সাইজের প্রবন্ধ শেষ করিয়াছে। সমস্তটি তাহার উর্বর মস্তিষ্ক থেকে বাহির করা, অবশ্য আদর্শ পাইয়াছে গোরু, উষ্ট্র, সিংহের নিকট। 

তীব্র ক্ষোভে মনটা ভরিয়া উঠিল; এই চিজের পিছনে প্রাণান্তকর খাটুনি খাটিয়া আজ তিন বৎসরের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয়িত করিয়াছি! পুরস্কার এক মাসের মাহিনা পঁচিশটি টাকা, আর পুরস্কারের আবরণে অভিশাপ—এই কুঞ্জলাল! 

ভাবিতে ভাবিতে মনটা সত্যই বড় অপ্রসন্ন হইয়া উঠিল। ঠিক করিলাম, যদি বচসাই হয়, চাকরিই যায় তো যাক, সার্টিফিকেট চাহিবই। স্পষ্টই বলিব, রাজভাষায় যাহাকে সার্টিফিকেট বলে, নিতান্ত তাহাই চাহিতেছি, নিকুঞ্জের কনিষ্ঠ কুঞ্জলালকে নয়। না দেয়, সার্টিফিকেট ফিরাইয়া দিব, তাহাতে উপবাস করিয়া মরিতে হয় সেও ভালো। 

এই সব চিন্তার মধ্যেই মাথায় সম্পূর্ণ একটা অন্য ধরনের মতলব ধীরে ধীরে উদয় হইয়া বেশ জাঁকিয়া বসিল।…ভাবিলাম, দেখাই যাক না একটু চেষ্টা করিয়া, কাজ কি রায় বাহাদুরের খোশামোদে? 

প্রবন্ধের পাতা কয়টি পরিষ্কার করিয়া কাটিয়া পকেটে পুরিলাম। চাকরকে বলিলাম, কুঞ্জ এলে বলিস, মাস্টারমশাইয়ের মাথাটা হঠাৎ ধরে উঠল বলে চলে গেছেন, পড়াশুনোগুলো নিজেই একটু দেখেশুনে নিতে 

বাসায় আসিয়া একটি দরখাস্ত করিলাম। সার্টিফিকেট হিসাবে নিকুঞ্জলালের প্রবন্ধটি নথি করিয়া দিয়া তাহার গায়ে লিখিয়া দিলাম—সপ্তম শ্রেণিতে যে ছেলেটির প্রতিভার নমুনা এই, তাহাকে তিন বৎসরের অমানুষিক পরিশ্রমে আমি এই বৎসর পাস করাইয়াছি সেকেন্ড ডিভিশানে। ইহার অতিরিক্ত সার্টিফিকেট চাহিলে সংগ্রহের প্রয়াস করিতে পারি, তবে এত প্রামাণিক হইবে বলিয়া আমার বিশ্বাস হয় না। 

নিকুঞ্জর বংশপরিচয় একটু একটু দিলাম, যাহাড়ে মিথ্যা বলিয়া সন্দেহ না করে, আর খবরের কাগজ থেকে তাহার ইস্কুলের ফলাফলের অংশটুকু কাটিয়া তাহার নামের নিচে লাল দাগ টানিয়া সার্টিফিকেটের সঙ্গে জুড়িয়া দিলাম। 

আজ সকালে নিয়োগপত্র পাইয়াছি,—টেলিগ্রাস, অর্থাৎ এসব অসাধ্য সাধন যে মাস্টার করিতে পারে সে যেন হাতছাড়া না হইয়া যায়। 

।। সমাপ্ত।। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *