2 of 3

সার্জেন সাহেব

সার্জেন সাহেব

আমরা বলি ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। একটা ভয়, একটা আতঙ্ক। কখন ভোর হয়! এ তো বাইরে! এই রাত ভোর হবে। কিন্তু আমাদের ভিতরে যে ভোরহীন নিশ্ছিদ্র রাত্রি সেখানে যে অন্ধ অন্তহীন অপেক্ষায় বসে আছে, তার কি হবে! অসহায় নিঃসঙ্গ এক বন্দী! সেই অন্ধকারে কেউ নেই সাথী। একা এবং একা। দিগন্তবিস্তারী কালো সমুদ্র। কালো ঢেউ। তারাশূন্য কালো আকাশ। ভয়, মৃত্যুভয়। মুছে যাওয়ার ভয়। শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার ভয়। যন্ত্রণার ভয়। বুকের লেফাফায় এই অন্ধকার ভরে মানুষ কেমন হাঁটছে, ঘুরছে, খাচ্ছে, সংসার করছে!

আত্মার এই অন্ধকারে ঠাকুরকে অন্বেষণ করি। কোথায় তিনি! ঘরে নেই। উদ্যানে নেই। গঙ্গার পশ্চিমে চাঁদনিতে যেখানে নরেন্দ্রনাথ একা রয়েছেন, সেখানেও নেই। মন্দিরের বিশাল চাতাল জনশূন্য। আরতি হয়ে গেছে। মা ভবতারিণীর দুপাশে দুটি বাতি জ্বলছে। সেখানেও তিনি নেই।

তাহলে! মায়ের মন্দিরের সামনে বৃহৎ নাটমন্দির। সেখানে একটিমাত্র আলো জ্বলছে। সেই ক্ষীণ আলোয়, আলো আর অন্ধকারের তরল মিশ্রণে, বড় বড় থামের আড়ালে আড়ালে, কে ঐ ছায়ামূর্তি! ঠাকুর! ঠাকুর সেই ক্ষীণালোকমধ্যে একাকী পাদচারণ করছেন। একাকী—নিঃসঙ্গ। পশুরাজ যেন অরণ্যমধ্যে আপন মনে একাকী বিচরণ করছেন! আত্মারাম। সিংহ একলা থাকতে, একলা বেড়াতে ভালবাসে! অনপেক্ষ।

ঐ সিংহটিকে ছেড়ে দাও না তোমার আত্মার অন্ধকারে। কিসের ভয়! অন্ধকারের অস্তিত্ব নেই। একটা অভাবের নাম অন্ধকার—আলোর অভাব। অন্ধকার আলোকে দূর করতে পারে না, আলো কিন্তু নিমেষে অন্ধকারকে দূর করে দিতে পারে। হাজার বছরের অন্ধকার একটিমাত্র আলোকশিখায় মুহূর্তে দূর হয়ে যেতে পারে। এক চমকেই শেষ। অতএব অন্ধকার বলে কিছু নেই।

হৃদয়ের নাটমন্দিরে আত্মারাম ঠাকুর একটি চোরা লণ্ঠন হাতে অবিরত পায়চারি করছেন। আমার ইন্দ্রিয়ের থামে অহঙ্কারের ছাদটি ধরা আছে। তারই তলে থাম থেকে থামে তিনি পাদচারণ করছেন। কিন্তু আমি তাঁকে দেখব না। কেন?

কারণটা তিনিই বলে দিয়েছেন—”বিষয়বুদ্ধির লেশমাত্র থাকলে তাঁকে দর্শন হয় না।”

লেশমাত্র? হায় ঠাকুর! গোটা খোলটাই তো বিষয়বুদ্ধিতে ভরা। অন্য কোন বুদ্ধি আছে নাকি?

তাহলে হবে না। দেশলাইয়ের কাঠি যদি ভিজে থাকে হাজার ঘষো, কোনরকমেই জ্বলবে না—কেবল একরাশ কাঠির লোকসান হবে। বিষয়াসক্ত মন ভিজে দেশলাই।

শুকোব কি করে? রোদ্দুরে দেব?

এ বড় মজার বারুদ!

কেমন?

এ তোমার রোদে শুকায়, আবার জলেও শুকায়। আসল কথা হলো কৃপা বড় নিষ্ঠুর, বড় দুয়ে। কৃপা যে তাঁর হাতে। কে পাবে, আর কে পাবে না! কেড়ে নেওয়ারও উপায় নেই। শ্রীমতী (রাধিকা) যখন বললেন, আমি কৃষ্ণময় দেখছি; সখীরা বললে, কই, আমরা তো তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না। তুমি কি প্রলাপ বকছ? শ্রীমতী বললেন, সখি! অনুরাগ-অঞ্জন চোখে মাখ, তাঁকে দেখতে পাবে। ব্রহ্মসঙ্গীতে আছে—

“প্রভু বিনে অনুরাগ, করে যজ্ঞযাগ, তোমারে কি যায় জানা।”

চেষ্টা কর। ভিতরটাকে মোচড়াও। জল বের কর। অনুরাগ অশ্রু। এই অনুরাগ, এই প্রেম, এই পাকা ভক্তি, এই অহেতুক ভালবাসা যদি একবার হয়, তাহলে সাকার-নিরাকার দুই সাক্ষাৎকার হয়।

ঠাকুর! যদি একবার হয়! এই যদিটাই তো মেরেছে।

তা তো মারবেই! সংসারী যে! ম্যাদামারা! রোখ নেই। এই—হচ্ছে, হবে। হলেও হয়, নাহলেই বা কি!

তা ঠিক!

শোন বাবা, দৃঢ় হতে হবে; ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকতে হবে। বিষয়ীর ঈশ্বর কিরূপ জান? “যেমন খুড়ি-জেঠির কোঁদল শুনে ছেলেরা খেলা করবার সময় পরস্পর বলে ‘আমার ঈশ্বরের দিব্য’। আর যেমন কোন ফিট বাবু পান চিবুতে চিবুতে হাতে স্টিক ধরে বাগানে বেড়াতে বেড়াতে একটি ফুল তুলে বন্ধুকে বলে, ‘ঈশ্বর কি বিউটিফুল ফুল করেছেন’। কিন্তু এ বিষয়ীর ভাব ক্ষণিক, যেন তপ্ত লোহার ওপর জলের ছিটে।”

তাই বলি, ডুব দাও।

এই আঁধার সমুদ্রে ডুব দাও—এই তাঁর নির্দেশ। অবশেষে! চলে যাও, তলাতল অতলে। সেখানে? কোথায় অন্ধকার! রত্নরাজি-শোভিত সেই অতলে—”পাবি রে প্রেম রত্নধন।” “পাবি হৃদয়-মাঝে বৃন্দাবন।” সেখানে “দীপ দীপ দীপ জ্ঞানের বাতি, জ্বলবে হৃদে অনুক্ষণ।”

এত কথার মধ্যে তবুও রয়ে গেল সেই সারকথাটি—

“হাজার চেষ্টা কর, তাঁর কৃপা না হলে কিছু হয় না। তাঁর কৃপা না হলে তাঁর দর্শন হয় না। কৃপা কি সহজে হয়?”

কি করে হয়?

“অহঙ্কার একেবারে ত্যাগ করতে হবে। ‘আমি কর্তা’—এ-বোধ থাকলে ঈশ্বরদর্শন হয় না। ভাঁড়ারে একজন আছে, তখন কর্তাকে যদি কেউ বলে, ‘মহাশয়, আপনি এসে জিনিস বার করে দিন।’ তখন কর্তাটি বলে, ‘ভাঁড়ারে একজন রয়েছে, আমি আর গিয়ে কি করব!’ যে নিজে কর্তা হয়ে বসেছে তার হৃদয়মধ্যে ঈশ্বর সহজে আসেন না।”

অন্ধকারে ঠাকুর আমার ‘সার্জেন সাহেব’। অতন্দ্র প্রহরী তিনি। কৃপা হলে দর্শন মিলবে। তিনি জ্ঞানসূর্য। তাঁর একটি কিরণে এই জগতে জ্ঞানের আলো পড়েছে, তবেই আমরা পরস্পরকে জানতে পারছি, আর জগতে কতরকম বিদ্যা অর্জন করছি।

সার্জেন সাহেব, একবার নিজের মুখের ওপর আলোটা ধরুন। সেই অনিন্দ্য ঈশ্বরীয় রূপটি দর্শন করি।

আমাদের প্রার্থনা আপনারই কাছে, ঠাকুর—-আপনারই শেখানো প্ৰাৰ্থনায় “সাহেব, কৃপা করে একবার আলোটি নিজের মুখের উপর ফিরাও, তোমাকে একবার দেখি।”

“সার্জেন সাহেব রাত্রে আঁধারে লণ্ঠন হাতে করে বেড়ায়।”

তাহলে জেগে থাকি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *