সার্জন সাহেবের বাড়িতে
বছর কুড়ি আগে একটা সরকারি চাকরি নিয়ে দিল্লি চলে গিয়েছিলেন দিগন্ত রায়চৌধুরী। কলকাতার আচ্ছা ছেড়ে, সংসার গুটিয়ে প্রথম যখন দিগন্তবাবুকে দিল্লি যেতে হল নিতান্তই জীবিকার প্রয়োজনে, তাঁর মনে হয়েছিল খুব বেশিদিন হয়তো কলকাতা ছেড়ে টিকতে পারবেন না।
কিন্তু তারপরে যেরকম হয় যথাসময়ে দিল্লির সঙ্গে দিগন্তবাবু নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। এখন সেখানেই পাকাপাকি বসবাস। এমনকী অবসর গ্রহণের পরে দিল্লিতেই থেকে যাবেন বলে দক্ষিণ দিল্লির শেষপ্রান্তে একটা ছোটখাটো ফ্ল্যাটও বায়না করেছেন।
আগে তবু কালেভদ্রে দু-চার বছরে এক-আধবার কোনও না কোনও কারণে কলকাতায় আসা হত। একবার ভাইপোর পইতে, একবার বিশেষ ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বিয়ে, আরও দুবার অফিসের টুকটাক কাজ নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন দিগন্তবাবু। আত্মীয়স্বজন, ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব, পুরনো অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছিল।
সেসবও অনেক দিন, অনেক বছর হয়ে গেল। কলকাতার প্রতি আকর্ষণ ক্রমশ কমে এসেছে। প্রধান আত্মীয়দের এখন অনেকেই কলকাতা এবং জগৎসংসারের মায়া কাটিয়ে পরলোকে প্রস্থান করেছেন। দু-একজন বন্ধুও সে পথ অনুসরণ করেছে। আর বাকিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানা জায়গায়, তাদের নিজেদের মধ্যেও কদাচিৎ দেখা হয়। আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখন দিগন্তবাবুর মতোই প্রবাসী, দু-একজন বিদেশেও স্থায়ী আস্তানা গেড়েছে।
বছর পাঁচেকের মধ্যে কলকাতায় আসা হয়নি। শেষবার যখন এসেছিলেন সেও খুব অল্প সময়ের জন্য। অফিসের একটা কাজ ছিল, শুক্রবার এসেছিলেন, সে দিনটা অফিসের ব্যাপারে গেল, তারপর দুদিন শনিবার রবিবার ছুটি ছিল, সেই দুটো দিন কলকাতায় কাটিয়ে সোমবার ভোরের বিমানে দিল্লি ফিরেছিলেন দিগন্ত।
ওই ছুটির দিন দুটোয় বন্ধুবান্ধব একটু জমায়েত করে আগের মতো হই-হুঁল্লোড় করার ইচ্ছে ছিল তার। দুঃখের কথা সেবার তার সে আশা পূর্ণ হয়নি। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করাই সম্ভব হল না। কারও কারও ঠিকানা বদল হয়েছে। যাদের টেলিফোন আছে তাদেরও টেলিফোন নম্বর বদলিয়ে গেছে কিংবা টেলিফোন বাজেনি। বাজলেও ভুল বেজেছে, কেউ ধরেনি কিংবা যে ধরেছে সে অন্য লোক, ফোন তুলে নম্বর শুনে বিজাতীয় ভাষায় ধমকিয়ে দিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত তবু কয়েকজনের সঙ্গে সংযোগ করা গিয়েছিল, কিন্তু তাদের মধ্যেও কেমন যেন ছাড়া ছাড়া ভাব। কলকাতায় যে সরকারি অতিথিশালায় দিগন্তবাবু ওঠেন, লোয়ার সার্কুলার রোডের সেই বাড়িতে বন্ধুদের শনিবার সন্ধ্যাবেলায় নিমন্ত্রণ করেছিলেন তিনি। ইচ্ছে ছিল সবাই এলে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে তারপর কাছাকাছি কোনও একটা জায়গায় গিয়ে কিঞ্চিৎ পানভোজন করবেন।
কিন্তু কেউই প্রায় এল না। শুধু মহিমাময় এসেছিল। সেও সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ উঠি উঠি করতে লাগল। একেবারে জমল না ব্যাপারটা। আটটা নাগাদ বন্ধুকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিগন্তবাবু একটা সিনেমা দেখতে একাই বেরিয়ে গেলেন।
সিনেমা ভাঙার পর অতিথিশালায় এসে দেখেন বেশ হইচই হচ্ছে। তার অন্য এক পুরনো বন্ধু। জয়দেব, তারও সন্ধ্যাবেলা আসার কথা ছিল, তখন আসেনি, এখন সঙ্গে তিনজন সম্পূর্ণ অন্য লোক। নিয়ে, চারজনেরই সম্পূর্ণ টালমাটাল অবস্থা, অতিথিশালার ঘরে ঘরে ধাক্কা দিয়ে মিস্টার দিগন্ত রায়চৌধুরীকে খুঁজছে।
প্রায় মধ্যরাত। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সবাইকে ঘুম ভাঙিয়ে ওরা চারজন স্থলিতচরণে এবং জড়িত কণ্ঠে রীতিমতো তত্ত্বতালাসি চালাচ্ছে তার জন্য।
লম্বা টানা বারান্দার দুপাশে সারি দেওয়া ঘর। প্রায় প্রতিটি ঘরেই অতিথি রয়েছে, তাঁদের মধ্যে দরজার ফাঁক দিয়ে সদ্যজাগ্রতা বিস্ৰস্তবসনা মহিলাও রয়েছেন, তারা আলো জ্বালিয়ে জেগে উঠে বসেছেন। পর্যায়ক্রমে জয়দেব ও তার বন্ধুরা দিগন্ত, দিগন্তবাবু, মিস্টার রায়চৌধুরী, রায়চৌধুরী। মশায় ইত্যাদি নানা সম্বোধনে ঘরে ঘরে করাঘাত করে তাঁকে খুঁজছে এবং কোনও ঘরেই পাচ্ছে না–আর সব ঘরেই সরি, ভেরি সরি, খুব দুঃখিত, মাফ কিজিয়ে ইত্যাদি নানা ভাষায় মদ্যপজনোচিত ক্ষমাপ্রার্থনা করছে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে এই দৃশ্য দেখে দিগন্ত প্রথমে ভেবেছিলেন আত্মগোপন করবেন। মাতালের গোঁ বড়জোর দশ মিনিট থাকে। সুতরাং কিছুক্ষণ উলটো দিকের ফুটপাতে পায়চারি করলেই বিড়ম্বনার হাত থেকে অনায়াসে রক্ষা পাওয়া যাবে।
দিগন্ত রায়চৌধুরী তাই করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সেই মুহূর্তে তার মনে হল এই দেড় দশকে কলকাতা শহর অনেক বদলিয়ে গিয়েছে, অনেক পরিবর্তন হয়েছে এই শহরের তার চেনাজানা। লোকেদের মধ্যে। এই তো সন্ধ্যাবেলা মহিমাময় এসেছিল, আগে কী আড্ডাবাজ ছিল, জয়দেবের এককাঠি ওপরে, এখন কেমন হয়ে গেছে। শুধু জয়দেব, একমাত্র জয়দেব আগের মতো আছে। একমাত্র সেই এখনও পুরনো বন্ধুদের খোঁজে মধ্যরাতে তোলপাড় করে। কুড়ি বছর আগের জয়দেবের নানা গল্প দিগন্তের মনে পড়ল। একবার তার জন্ডিস হয়েছিল। পি জি হাসপাতালের দোতলায় একটা ওয়ার্ডে ছিলেন, সেখানে রাত আড়াইটার সময় আজকের মতোই সেদিন। জয়দেবের সদল অনুপ্রবেশ। আরেকবার জয়দেবের সঙ্গে শান্তিনিকেতন যাওয়ার কথা। ট্রেন ছাড়া পর্যন্ত জয়দেব এল না। তারপর ট্রেন যখন বেশ জোরগতিতে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ অন্ধকার থেকে ভূতের মতো এক লাফ দিয়ে জীবন বিপন্ন করে জয়দেব কামরায় উঠল।
অনেক দূরে একটা নতুন হোটেলের কার্নিশ থেকে একটা সাবানের রঙিন বিজ্ঞাপন একবার নীল হচ্ছে, একবার লাল হচ্ছে, একবার পুরো অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। যে কোনও শহরে যে কোনও রাতে এরকম হয়ে থাকে। এখন রঙিন আলোর ওই নেবা-জ্বলার দিকে তাকিয়ে অনেক পুরনো কথা মনে পড়ল দিগন্ত রায়চৌধুরীর। তিনি আর দেরি করলেন না, দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়ে উঠে মাতাল-ত্রয়ীর বেষ্টনী ভেদ করে জয়দেবকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন।
এ অবশ্য পাঁচ বছরের পুরনো ঘটনা। গত পাঁচ বছরে দিগন্তবাবুর আর কলকাতা আসা হয়নি। এবারও আসার কথা ছিল না। একটা কাজে পাটনা এসেছিলেন। আসার কয়েকদিন আগে বন্ধু মহিমাময় অর্থাৎ মহিমার কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছিলেন দিল্লিতে। পুরনোদের মধ্যে ওই মহিমাই এখনও সময়ে অসময়ে যোগাযোগ রাখে। মহিমা লিখেছে, জয়দেবের শরীর খারাপ। খুব সম্ভব পেটে আলসার। গুডবাই নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছে, সেখানেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এখনও সব জানা যায়নি।
এ চিঠি পেয়ে একটু দ্বিধায় পড়েছিলেন দিগন্তবাবু। তাঁর প্রথম খটকা লেগেছিল এই চিন্তা করে যে, কোনও নার্সিংহোমের নাম গুডবাই নার্সিংহোম হওয়া উচিত কিনা। এবং যদি এরকম নামই। হয়, তা হলে সেখানে কারও ভর্তি হওয়া উচিত কিনা। তবে জয়দেবের ব্যাপারই আলাদা।
তা ছাড়া দিগন্তবাবুর একদিন পরে মনে পড়ল, তাদের পুরনো ভবানীপুরের পাড়ায় বলহরি ডাক্তারের কথা। বলহরি নাম হওয়া সত্ত্বেও তার রোগীর কোনও অভাব হত না। বলহরি ডাক্তারের ডিসপেনসারি সর্বদাই লোকের ভিড়ে গমগম করত।
পাটনা থেকে একবেলার জন্যে কলকাতায় এলেন দিগন্তবাবু, একটু জয়দেবের ব্যাপারটা খোঁজ নেবার জন্যে। ঠিক কী হয়েছে, কী চিকিৎসা চলছে।
তবে মহিমার চিঠিতেই দিগন্তবাবু জানতে পেরেছিলেন তাদের এক পুরনো বন্ধু, ডাক্তার লোকনাথ দত্ত, যিনি সার্জন হিসাবে আজ কিছুদিন হল বেশ নাম করেছেন, তাঁরই তত্ত্বাবধানে আছে জয়দেব। গুডবাই নার্সিংহোমের সঙ্গেও ডাক্তার লোকনাথ দত্ত জড়িত রয়েছেন। রোগীরা অনেকে এখানেই ভরতি হয়, এখানেই লোকনাথ তাদের অপারেশন করেন।
পাটনা থেকে রাত্রির ট্রেনে উঠে সকালে এসে কলকাতায় পৌঁছেছেন দিগন্ত। বিকেলের প্লেনে দিল্লি ফিরবেন। হাতে সময় খুব কম। তাও আবার ট্রেনটা হাওড়ায় আসতে তিন ঘণ্টা লেট হয়েছে।
কলকাতায় পৌঁছে হাওড়া স্টেশন থেকে প্রথমেই মহিমাকে একটা ফোন করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পেলেন না, হয় হাওড়া স্টেশনের ফোনটা খারাপ, না হয় মহিমার ফোন খারাপ। অথবা দুটোই খারাপ।
সে যা হোক, ফোন করা নিয়ে বেশিক্ষণ সময় নষ্ট না করে একটা ট্যাকসি নিলেন। ফোন করার চেয়ে হাওড়া স্টেশনে ট্যাকসি ধরা কঠিন নয়। প্রায় আধ ঘণ্টা চেষ্টার পর বহুকষ্টে এবং মিটারের ওপর পনেরো টাকা বেশি দেবেন কবুল করে শেয়ালদা পাড়ায় একটা পুরনো হোটেলে এসে উঠলেন। রাত্রিবাস করতে হচ্ছে না, হোটেলের দরকার তেমন নেই, তবু স্নান-খাওয়া করার জন্যে আর যদি ফোন-টোন করা যায় সেই উদ্দেশ্যে একদিনের জন্যে ষাট টাকা ভাড়ায় একটা ঘর নিলেন। তারপর স্নান-টান সেরে মুখে দুটি ভাত দিয়ে দিগন্ত রাস্তায় বেরোলেন। এর মধ্যে হোটেলের ম্যানেজারের ঘর থেকে আরেকবার মহিমাকে এবং সেই সঙ্গে গুডবাই নার্সিংহোমে ফোন করার বৃথা চেষ্টা করেছিলেন। কাউকে অবশ্য পাননি, তবে এর মধ্যে ক্রস কানেকশনে একটি চাঞ্চল্যকর কথোপকথন শুনতে পান। ভেজাল তেল খেয়ে সদ্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত এক রোগীকে অভিজ্ঞ পক্ষাঘাতগ্রস্ত দ্বিতীয় এক রোগী কীভাবে দেয়াল ধরে হাঁটতে হয় নির্দেশ দিচ্ছিলেন, সেটা শুনে দিগন্ত চমকৃত হন এবং ভবিষ্যতে যদি সত্যি কখনও পক্ষাঘাত হয় সেই জন্যে এই নির্দেশাবলি তিনি মনোযোগ দিয়ে শোনেন। বেশ কিছুক্ষণ লেগেছিল শুনতে, ফলে হোটেল ম্যানেজারের কেমন সন্দেহ হয় যে এটা রং নম্বর নয়, দিগন্তবাবু কথা বলছেন না শুধু শুনছেন, রং নম্বর বলে টেলিফোনের খরচ কাটিয়ে দেবেন বলে। ফলে কিঞ্চিৎ অপমানিত হয়ে দিগন্তবাবুকে ফোনের জন্যে দেড় টাকা দিতে হয়। এরপরে তিনি রাগ করে তখনই তার ছোট সুটকেসটা যেটা হোটেলে রেখেছিলেন সেটা হোটেল থেকে নিয়ে রাস্তায় সরাসরি বেরিয়ে পড়লেন।
রাস্তায় নেমে আবার বহুকষ্টে ট্যাকসি। মহিমার চিঠিতে দুটো ঠিকানা আর ফোন নম্বর দেওয়া আছে, একটা গুডবাই নার্সিংহোমের অন্যটা ডাক্তার লোকনাথ দত্তের। মহিমার ইনল্যান্ড লেটারটা খুলে ডাক্তার লোকনাথ দত্তের ঠিকানা আর ফোন নম্বর চোখে পড়তে দিগন্তের মনে হল একবার ডাক্তার দত্তকে ফোনে ধরতে পারলে হত। কিন্তু কোথায় ফোন করতে যাবেন, আর ফোন পাবেন কি না এই সব ভেবে নিরস্ত হলেন।
একটু খুঁজে বেলেঘাটায় সি আই টি রোডের ধারে গুডবাই নার্সিংহোম পাওয়া গেল। সাইনবোর্ডটা দেখে একটু বিস্মিত হলেন দিগন্ত, একটু কৌতুকও বোধ করলেন। গুডবাই নার্সিংহোম নয়, গুডবাই ম্যাটারনিটি হোম, ঠিকানা মিলিয়ে দেখলেন ঠিকই আছে। মানে জয়দেব এখানেই ভরতি হয়েছে। কিন্তু ম্যাটারনিটি হোমে আলসারের কী চিকিৎসা হবে! শুধু জয়দেবের পক্ষেই এ কাজ করা সম্ভব।
অবশ্য ভেতরে গিয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে দিগন্ত জানতে পারলেন যে ম্যাটারনিটি হোম হলেও যখন প্রসূতির সংখ্যা কম থাকে ছোটবড় চিকিৎসা বা অপারেশনের জন্যে অন্য রোগীও নেওয়া হয়।
সে ঠিক আছে, কিন্তু ম্যাটারনিটি হোমে জয়দেবের পাত্তা পাওয়া গেল না। জানা গেল, জয়দেব বাবু এখানেই চিকিৎসার জন্যে এসেছে বটে কিন্তু তিনি প্রতিদিন সকালবেলা বেরিয়ে যান আর ফেরেন অনেক রাতে। এর মধ্যে আবার দুদিন রাতেই আসেননি।
জয়দেবের স্বভাব দিগন্তবাবুর জানা আছে। তিনি এ খবরে মোটেই বিস্মিত হলেন না, বরং এই ভেবে আশ্বস্ত বোধ করলেন যে জয়দেবের শরীরের অবস্থা খুব খারাপ নয়–তা হলে এত চলাফেরা করতে পারত না।
গুডবাইয়ের লোকেদের কাছে দিগন্ত জানার চেষ্টা করলেন, জয়দেবের শারীরিক অবস্থা এখন সত্যি কীরকম। তারা বললেন, সে বলা অসম্ভব। ভাল করে পরীক্ষাই করা যাচ্ছে না, জয়দেবকে ধরাই কঠিন। তবে ডাক্তার এল এন দত্ত দেখেছেন, তিনি সম্ভবত অপারেশন করবেন। তার কাছে জানা যেতে পারে।
দিগন্ত বুঝতে পারলেন এল এন দত্ত মানে লোকনাথ দত্ত, তাদের পূর্বপরিচিত বন্ধুস্থানীয় ডাক্তার। এখন সার্জন হিসেবে বেশ নাম হয়েছে। মহিমার চিঠিতে সে কথা আগেই জেনেছেন।
দিগন্তবাবু গুডবাইয়ের রিসেপশনে বললেন, আমি জয়দেববাবুর পুরনো বন্ধু, দিল্লি থেকে এসেছি, সার্জন দত্তও হয়তো আমাকে চিনবেন। সার্জন সাহেবের সঙ্গে আমি একটু দেখা করতে চাই।
স্থূলকায়া একজন অবসরপ্রাপ্ত নার্স রিসেপশনে বসেন, তিনি জানালেন, সার্জন সাহেব তো এ বেলা আসবেন না। বিকেলে একটা হার্নিয়া অপারেশন আছে, পাঁচটা নাগাদ আসবেন।
গুডবাই থেকে সুটকেস হাতে আবার রাস্তায় নেমে পড়লেন দিগন্তবাবু। বেলা প্রায় একটা বাজে। চারদিকে গনগনে গরম, কাঠফাটা রোদে চোখ ঝলসে যাচ্ছে। তিনি ঠিক করলেন এসেছেনই যখন অন্তত একবার ডাক্তার লোকনাথ দত্তের বাড়িতে গিয়ে জয়দেবের ব্যাপারটা খোঁজ নিয়ে যাবেন। যদিও বেলা একটায় কারও বাড়িতে যাওয়া সঙ্গত নয়, কী আর করা যাবে–তা ছাড়া লোকনাথ দত্ত একসময়ের চেনা।
কাছাকাছি কোথাও কোনও ট্যাকসি নেই। সুটকেস হাতে রোদে হেঁটে ঘামতে ঘামতে দিগন্ত বড় রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালেন। ট্যাকসি এখানেও নেই। একটা সামান্য খালি মিনিবাস এলে সেটায় উঠলেন। মহিমার চিঠিতে ঠিকানাটা ছিল ডাক্তার দত্তের। এখান থেকে বেশি দূরে না, ভি আই পি রোডে উলটোডাঙার মোড়ের কাছে ডাক্তার দত্ত থাকেন।
মিনিবাস থেকে নেমে একটু খুঁজতেই বাসাটা পাওয়া গেল। বাইরের দরজায় পুরনো ঢঙের পিতলের নেমপ্লেটে ঝকঝকে অক্ষরে নামটা লেখা রয়েছে–ডক্টর এল এন দত্ত এম বি বি এস। আর নীচে চিঠির নীচের পুনশ্চের মতো কাঠের নেমপ্লেটে এম এস এবং আরও দশটি ইংরেজি অক্ষর। বোঝা গেল পিতলের নেমপ্লেট বানানোর পরে এই উপাধিগুলো আয়ত্ত হয়েছে।
কিন্তু দিগন্তবাবুর ভাগ্য আজ ভাল নয়।
সার্জন সাহেব বাড়ি নেই। ডক্টরের ঘরে একটি ফুটফুটে মেয়ে, বয়েস নয়-দশ বছর হবে, সোফার ওপরে উবু হয়ে বসে আপনমনে একটা বড় ড্রয়িংখাতায় একটা লালরঙের বাঘের ছবি আঁকছিল। দিগন্তবাবু দরজায় গিয়ে দাঁড়াতে সে তাড়াতাড়ি বাঘের মুখে কয়েকটা নীল রঙের গোঁফ এঁকে দিয়ে তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।
দিগন্তবাবু প্রশ্ন করলেন, সার্জন সাহেব বাড়ি আছেন?
লাল রিবন বাঁধা চুলের বেণী সমেত পুরো মাথাটা নেড়ে মেয়েটি বলল, না, নেই।
দিগন্তবাবু ভাবললেন একটু বসে গেলে হয়, হয়তো আসতে দেরি হবে না, তাই মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি সার্জন দত্তের মেয়ে?
মেয়েটি বলল, হ্যাঁ। এবং দিগন্তবাবু জিজ্ঞাসা করার আগেই বলল, আমার নাম নীলাম্বরী দত্ত। বাবা বলে নীলা, মা বলে নীলু।
মেয়েটিকে বেশ সাব্যস্ত মনে হল দিগন্তবাবুর। তিনি তাকে বললেন, দ্যাখো নীলাম্বরী, আমি তোমার বাবার একজন পুরনো বন্ধু। এখন দিল্লিতে থাকি, অনেকদিন দেখাশোনা নেই। একটা ব্যাপারে তোমার বাবার কাছে একটু খোঁজ নিতে এসেছিলাম।
নীলাম্বরী বলল, কিন্তু বাবা তো এখন আসবে না। বাবা গেছে ডাক্তার চক্রবর্তীর নার্সিং হোমে। সেখানে একটা অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন আছে।
এইটুকু মেয়ের মুখে অ্যাপেন্ডিসাইটিসের মতো জটিল শব্দের উচ্চারণ শুনে একটু চমকিত হলেন দিগন্তবাবু। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তা কতক্ষণ লাগবে মনে হয়?
নীলাম্বরী বলল, যদি ফেটে-টেটে গিয়ে না থাকে তা হলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাবার কাজ সারা হয়ে যাবে।
এই শুনে দিগন্তবাবু বললেন, তা হলে আসতে দেরি হওয়ার কথা নয়।
নীলাম্বরী বলল, পাগল নাকি! বাবার কি একটা অপারেশন? সকালে একটা করেছে, তারপর বাড়ি এসে জলখাবার খেয়ে এই অপারেশনটা করতে গেছে। অপারেশনের পরে ডাক্তার চক্রবর্তীর বাড়িতে দুপুরের ভাত খাবে। তারপর সেখান থেকে যাবে দমদম।
অন্যমনস্কভাবে দিগন্তবাবু বললেন, দমদম!
নীলাম্বরী বলল, দমদম সেবায়তনে একটা আলসারের অপারেশন আছে। রোগী বুড়ো, তার আবার হার্ট ভাল নয়।
নীলাম্বরীর মুখে এরকম সব কঠিন কথা শুনে এতক্ষণ দিগন্তবাবু বেশ কৌতুকবোধ করছিলেন, জিজ্ঞাসা করলেন, তার পরে?
নীলাম্বরী বলল, তারপরে ওই গুডবাই নার্সিংহোম, বেলেঘাটায়। সেটায় হয়তো তেমন সময় লাগবে না হার্নিয়া অপারেশন।
এসব শুনে দিগন্তবাবু বুঝতে পারলেন এখানে এখন আর অপেক্ষা করার মানে হয় না। তার চেয়ে মহিমার একটা খোঁজ করলে হয়। তার কাছে যদি কিছু জানা যায়।
সুটকেস নিয়ে রাস্তায় বেরোতে বেরোতে তিনি দেখলেন নীলাম্বরী তাঁর পিছনে পিছনে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে। একটু থেমে দাঁড়িয়ে তিনি নীলাম্বরীকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি যে এত সব কঠিন অসুখের নাম করলে, যেগুলো তোমার বাবা অপারেশন করছে, সেগুলো কী ব্যাপার তুমি জানো কি?
নির্বিকার মুখে নীলাম্বরী বলল, হা জানি। অ্যাপেন্ডিসাইটিস সাধারণ হলে এক হাজার টাকা, আলসার দেড় হাজার টাকা, হার্নিয়া সাড়ে সাতশো টাকা।
উত্তর শুনে হতভম্ব হয়ে দিগন্তবাবু রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। বাইরে রোদের তাপ আরও চড়া। রাস্তায় ধোঁয়া উঠছে। এই রোদে জয়দেব কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কে জানে। আর খোঁজ করে লাভ নেই। একটা ট্যাকসি হাতের কাছে পেয়ে গেলেন, সেটা ধরে সোজা এয়ারপোর্টে।