সারমেয় গেণ্ডুকের কাঁটা – ১১

১১

স্মৃতিটুকুর অ্যাপার্টমেন্ট সাদার্ন অ্যাভিন্যুর উপরে—প্রকাণ্ড এক প্রাসাদের সপ্তম ফ্লোরে। দক্ষিণ-খোলা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট, দারুণ পশ! লিফটে করে উঠে কল বেল দিতে একটি মেড-সার্ভেন্ট পিপ-হোল খুলে উঁকি দিল। বললে, কী চাই?

বাসু-মামু সেই গর্ত দিয়ে একটি ভিজিটিং কার্ড গলিয়ে দিলেন। আটচল্লিশ ঘণ্টার ভিতর উনি নিশ্চয় সাংবাদিক বা রিটায়ার্ড নেভাল অফিসারের জাল-কার্ড বানাননি। আন্দাজ হল এবার সঠিক পরিচয়ই দিয়েছেন। একটু পরে দরজাটা খুলে গেল। মেড-সার্ভেন্টটিকে এবার দেখা গেল—প্রৌঢ়া, পরিচ্ছন্ন। বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে বললো, বসুন। উনি আসছেন এখনই, ফ্যানটা খুলে দেব?

এয়ান-কন্ডিশন করা ঘর। বেশ ঠাণ্ডা। আমি বললাম, দরকার হবে না।

গতকাল মামলায় জিতেছেন বাসু-মামু। তাঁর মেজাজ শরিফ। আমি সাজেস্ট করেছিলুম, সবার আগে সেই অ্যাটর্নি ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে—প্রবীর চক্রবর্তী। মামু রাজী হননি। বলেছিলেন, সে আইনজ্ঞ মানুষ। তার কাছে ‘কোমাগাতামারু’র গল্প শোনানো চলবে না। সে রাজ্যে যেতে হলে পাসপোর্ট চাই। আই মীন ‘ভিসা’।

বোধগম্য হয়নি। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তাঁর রাজ্যে ঢোকার ভিসা কোথায় পাবেন?

-–সেই ‘ভিসা’ যোগাড় করতেই তো এসেছি।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই গৃহস্বামিনী আবির্ভূতা হলেন। বয়স আঠাশ-উনত্রিশ, যদিও সাজসজ্জার বাহারে আরও কম দেখায়, তবু চোখের কোলে আসল বয়সটা ধরা পড়ে ঠিকই। সুন্দরী খুব কিছু নয়, তবে সুতনুকা। দীর্ঘাঙ্গী, তন্বী, এক মাথা শ্যাম্পু-করা চুল, সিল্কের মতো নরম। পরনে একটা ঢিলেঢালা কিমোনো জাতীয় পোশাক। পায়ে হাভানা ঘাসের চটি। এই সাত-সকালেই নিখুঁত প্রসাধন সেরে রেখেছে। যে ভঙ্গিতে সে ভিতর থেকে সাবলীলভাবে এগিয়ে এল তাতে মনে হল, এ বিউটি কম্‌পিটিশনে এবার বুঝি ডায়াসে উঠে দাঁড়াচ্ছে। তার হাতে বাসু-মামুর ভিজিটিং কার্ডখানা। আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে সে স্থির করে নিল তার লক্ষ্য। ওঁর দিকে ফিরে বললে, আপনিই নিশ্চয়?

বাসু-মামু উঠে দাঁড়িয়ে ফরাসী কায়দায় ‘বাও’ করে বললেন, অ্যাট য়োর সার্ভিস মাদমোয়াজেল। আপনার প্রভাতী অবসর বিনোদনে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছি বলে দুঃখিত।

মেয়েটিও একই কায়দায় ‘প্রতি-বাও’ করে বললে, আঁসাতে, মসিয়ো বাসু। বসুন। তারপর আমাকে দেখে নিয়ে মামুকেই প্রশ্ন করে : ডক্টর ওয়াটসন?

বাসু সে প্রশ্নের জবাব দিলেন তির্যকভাবে, আমার পরিচয় জানেন দেখছি

—আমাকে তুমিই’ বলবেন। আপনাকে কে না জানে? খুনী আসামীকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামিয়ে আনাই আপনার স্পেশালিটি!

—ভুল হল তোমার। ‘খুনী-আসামী’ নয়, খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত নির্দোষ আসামীদের!

—সেটা হেয়ার-সে। ‘কাঁটা-সিরিজে’ বেছে বেছে সেই গল্পগুলিই ছাপা হয়, এইমাত্র। কী দুঃখের কথা—আমার অটোগ্রাফ খাতাখানা হারিয়ে ফেলেছি! যা হোক, আপনার প্রভাতী-হানার উদ্দেশ্যটা যদি ব্যক্ত করেন—

—পরশু দিন আমি তোমার পিসির কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছি।

স্মৃতিটুকুর ম্যাসকারা-করা আঁখিপল্লব কিছু বিস্ফারিত হল; বললে, আমার পিসি?

—তাই বলেছি আমি। তোমার পিতৃস্বসা, পিসি।

—আপনার কোথাও কিছু ভুল হচ্ছে মিস্টার বাসু। আমার পিসিরা সবাই স্বর্গগতা। শেষ পিতৃস্বসা নিষ্কৃতি পেয়েছেন মাস দুয়েক আগে।

—তাঁর কথাই বলেছি আমি, মিস্ পামেলা জনসন।

—ওসব ভূতের গল্প পত্র-পত্রিকাতেই মানায় বাসু-সাহেব। স্বর্গীয় পোস্ট-অফিসের কাহিনী এমন প্রকাশ্য দিবালোকে বেমানান।

—জানি। কিন্তু এক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। তিনি চিঠিখানা লিখেছিলেন সতেরই এপ্রিল আমি তা পেয়েছি পরশু, উনত্রিশে জুন!

স্মৃতিটুকু একটু নড়েচড়ে বসলো। সামনের টি-পয়ের উপর থেকে টেনে নিল একটি সুদৃশ্য সিগারেট-কেস। বাড়িয়ে ধরল আমাদের দিকে। আমরা প্রত্যাখ্যান করায় সে নিজেই একটি ধরালো। তারপর এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললে, তা আমার পূজ্যপাদ পিতৃস্বসা কী লিখেছিলেন?

—সেটা এখনই বলতে পারছি না, মিস্ হালদার। ব্যাপারটা নিতান্ত গোপন! স্মৃতিটুকু নীরবে বার-দুই-তিন ধোঁয়া গিলল। তারপর বললে, তা আমার কাছে কী চাইতে এসেছেন?

—কয়েকটি তথ্য। তুমি অনুমতি করলে দু-একটি প্রশ্ন করতে চাই।

—কী জাতীয় প্রশ্ন?

—তোমাদের পারিবারিক বিষয়ে।

আবার মেয়েটি দু-চারবার ধোঁয়া টানলো। তারপর বলে, একটা নমুনা শোনাতে পারেন?

—নিশ্চয়। যেমন, তোমার দাদার বর্তমান ঠিকানাটা আমি জানতে চাই—সুরেশ হালদারের।

স্মৃতিটুকু তার সিগারেটের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বললে, আয়াম সরি। তার বর্তমান ঠিকানা ঠিক জানি না। সে পশ্চিম ভারতে গেছে, বোম্বাই। কোন হোটেলে উঠেছে তা আমার জানা নেই।

—কবে বোম্বাই গেছে?

—গতকাল। এটাই কি জানতে এসেছিলেন আমার কাছে?

—না। আরও অনেকগুলি প্রশ্ন ছিল আমার। যেমন ধর, আমি জানতে চাই : তোমার বড়পিসি যেভাবে তাঁর সম্পত্তি এক অজ্ঞাতকুলশীলাকে দান করে গেলেন তাতে কি তোমরা ক্ষুব্ধ নও? দ্বিতীয়ত : ডক্টর নির্মল দত্তগুপ্তের সঙ্গে তোমার এনগেজমেন্ট কতদিন আগে হয়েছে?

হঠাৎ সোজা হয়ে বসল মেয়েটি। যেন মনস্থির করলো। দৃঢ়স্বরে বললো, দুটো প্রশ্নের একটাই জবাব : আমার ব্যক্তিগত জীবনে অপরের নাক গলানো আমি পছন্দ করি না; বিশেষ করে সে নাকটা যদি হয় কোনও গোয়েন্দার!

বাসুসাহেব হাসলেন। বললেন, আমি গোয়েন্দা নই। যা হোক, আমি তোমার মনোভাব বুঝেছি। আবার বলি, তোমার প্রভাতী অবসর-বিনোদনে ব্যাঘাত করে গেলাম বলে দুঃখিত। এস কৌশিক।

দুজনেই উঠে পড়ি। দ্বারের কাছাকাছি এসে পৌঁছাতেই শোনা গেল : শুনুন?

বাসু-সাহেব ঘুরে দাঁড়ালেন, নির্বাক।

—বসুন।

পায়ে পায়ে ফিরে এসে একই আসনে বসলাম দুজনে। মেয়েটি বললে, দু-তরফাই খোলাখুলি হলে ভাল হয়। হয়তো আপনার মতো একটি মানুষেরই দরকার ছিল আমার। আপনি ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো অযাচিত এসেছেন। ফিরিয়ে দেওয়াটা হয়তো বোকামি হবে। বলুন, ঐ শেষ উইলটা বরবাদ করার কোনও ব্যবস্থা করা যায়?

—উকিলের পরামর্শ নিয়েছো?

—একাধিক! তারা একবাক্যে বলেছে, বুড়ি বজ্র আঁটুনি দিয়েছে, কোনও ফস্কা গেরোর চিহ্নমাত্র কোথাও নেই।

—কিন্তু সেটা তুমি বিশ্বাস কর না?

—না, করি না। আমার ধারণা—এ দুনিয়ায় সব কিছুই সম্ভব যদি যথেষ্ট খরচ করতে কেউ রাজী থাকে, আর এমন সহকারী বেছে নেয় যার বিবেক পাণ্ডবাগ্রজের মতো সজারুর কাঁটা নয়।

—অর্থাৎ তুমি যথেষ্ট খরচ করতে রাজী এবং তোমার অনুমান যে, আমার বিবেক সজারুর কাঁটার মতো নয়?

—তেমন-তেমন অবস্থায় পড়লে স্বয়ং ধর্মপুত্রও ‘ইতি গজ’র আড়ালে নিজের বিবেককে টেম্পরারিলি আড়াল করে রাখেন! নয় কি?

—কারেক্ট! কিন্তু কী জাতীয় সমাধান সেই সহকারী দাখিল করবে?

—সেটা তার বিবেচ্য। মূল উইলটা চুরি যেতে পারে, তার পরিবর্তে একটা জাল উইল আবিষ্কৃত হতে পারে; কিংবা মিনতি মাইতিকে কেউ অপরহরণ করতে পারে, হয়তো ভয়ে সে স্বীকার করবে যে, বুড়িকে ভয় দেখিয়ে সে দ্বিতীয় একখানি উইল বানিয়ে নিয়েছিল—

–তোমার মস্তিষ্ক খুবই উর্বর দেখছি!

—আপনার কী জবাব, তাই বলুন? আমি খোলাখুলি আমার তাস বিছিয়ে দিয়েছি। আপনি যদি প্রত্যাখ্যান করতে চান, তবে উঠে পড়ুন, দরজাটা খোলাই আছে।

আমার বিস্ময়ের অবধি রইল না বাসু-মামুর জবাবে—আমি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করছি না।

টুকু খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। হঠাৎ আমার দিকে নজর পড়ায় বললে, আপনার চ্যালা, ডক্টর ওয়াটসন বোধহয় মর্মাহত। কোনও ছুতোনাতায় ওঁকে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া যায় না?

বাসু-মামু তার জবাবে ইংরাজিতে বললেন, ডক্টর ওয়াটসনকে আমি সামলাচ্ছি। ওর বিবেক মাঝে মাঝে সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে ওঠে, কিন্তু আমার প্রতি ওর আনুগত্য অপরিবর্তনীয়। তুমি বরং তোমার মেড-সার্ভেন্টকে কোনও ছুতোনাতায় বাইরে পাঠিয়ে দাও। মনে হচ্ছে, পাশের ঘরে সে উৎকর্ণ হয়ে উঠেছে।

টুকু সামলে নিল। উঠে ভিতরে চলে গেল। একটু পরেই ফিরে এল সে। লক্ষ করে দেখলাম, সেই প্রৌঢ়া মেড-সার্ভেন্টটি সদর-দরজা খুলে কী কিনতে বাইরে গেল। দরজাটা খোলাই রইল। হাট করে খোলা নয়। কিন্তু লক করাও নয়।

মামু আমার দিকে ফিরে বললেন, নিজেকে সংযত কর কৌশিক। আমরা বে-আইনি কিছু করছি না। কিন্তু আইনের ভিতরে থেকেও অনেক কিছু করা যায়

টুকু বললে, টার্মসটা এই পর্যায়ে ঠিক করে নিলে ভাল হয় নাকি? অর্থাৎ আপনি যদি উইলখানা নাকচ করাতে পারেন তাহলে আমাদের তিনজনের যৌথ শেয়ারের কত পার্সেন্ট দিতে হবে?

—তিনজনের তরফেই তুমি কথা বলবে?

—কেন নয়? তিনজনের একই অবস্থা–আমি, সুরেশ আর হেনা। উইলটা নাকচ হলে তিনজনের একই লাভ। তবে হ্যাঁ, ওদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আপনার প্রস্তাবটা শুনলে আমি আলোচনা করে দেখতে পারি।

–বিটুইন ফাইভ টু ফিফটিন পার্সেন্ট। পার্সেন্টেজটা নির্ভর করবে আমার কাজের ওপর। আই মিন, আইনকে কতখানি নিজেদের স্বপক্ষে টেনে আনতে হবে, তার উপর।

— এগ্রীড!

—এবার মন দিয়ে শোন। সচরাচর –ধর শতকরা নিরানব্বইটি ক্ষেত্রে আমি আইনের অন্ধ সেবক। কিন্তু শততম ক্ষেত্রে—আমি চক্ষুষ্মান! প্রথম কথা, তাতে অর্থের পরিমাণটা যথেষ্ট হওয়া দরকার—এবার যেমন হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমার সুনামে যেন কোনওভাবেই আঘাত না লাগে—ব্যাপারটা বুঝলে?

—জলের মতো। এখন আপনি খোলাখুলি সব কথা জানতে চাইতে পারেন।

—ঠিক আছে। প্রথমত বল, কত তারিখে এই শেষ উইলটা হয়েছিল? কে-কে সাক্ষী?

—একুশে এপ্রিল। প্রবীর চক্রবর্তীর উপস্থিতিতে। সাক্ষী হিসাবে আছে দুজন—তাদের সঙ্গে করেই এনেছিলেন প্রবীরবাবু, ল-ক্লার্ক। স্থানীয় লোক নয়।

—আর আগের উইলখানা? কবে হয়? কী তার প্রভিশন্স?

—প্রায় বছর পাঁচেক আগে সেখানি তৈরি করেন বড়পিসি–ঐ প্রবীরবাবুকে দিয়েই। কে-কে সেবার সাক্ষী ছিল জানি না। তাতে বলা হয়েছিল, শান্তি আর সে-আমলের সহচরীকে দু-দশ হাজার দিয়ে ওঁর সমস্ত সম্পত্তি তিন ভাগ হবে। পাব আমরা তিনজন—আমি, সুরেশ আর হেনা।

—কোনও ‘ট্রাস্ট’-এর মাধ্যমে?

—না, সরাসরি আমরা তিনজনই।

—এবার সাবধানে জবাব দিও–তোমরা সকলেই কি জানতে সেই উইলের কথা?

—নিশ্চয়ই। মেরীনগরের অনেকেই জানতো। পিসিই গল্প করেছিল পিটার কাকার কাছে, ঊষা পিসির কাছে। বড়পিসি আমাদের বলে রেখেছিল। তার কাছে ধার চাইলেই সে বলতো, আমি দু-চোখ বুজলে তো তোরাই সব পাবি বাপু—এখন কিছু চাস না।

—তোমার কি মনে হয়—তোমাদের যদি নিতান্ত প্রয়োজন হত, ধর কোনও কঠিন-অসুখ-বিসুখ, তাহলেও কি মিস জনসন তোমাদের ধার দিতেন না?

—দিত, তবে প্রয়োজনের সত্যতা যাচাই করে। মুখের কথায় নয়! খোঁজখবর নিয়ে যদি দেখত যে, সত্যিই আমাদের টাকার প্রয়োজন, তবেই সে সাহায্য করত। নচেৎ নয়।

-–তার মানে ওঁর ধারণা ছিল তোমাদের আর্থিক সঙ্গতি এখন যা, তাতে তোমাদের টাকা ধার দেওয়ার কোনও মানে হয় না?

—ঠিক তাই।

—অথচ তোমার নিজস্ব ধারণা যে, তোমার আর্থিক সঙ্গতি যথেষ্ট নয়?

আবার সোজা হয়ে বসল টুকু। বললে, খুলেই বলি শুনুন। আমার বাবা বব্ হালদার আমাদের দু-ভাইবোনের জন্য যথেষ্টই রেখে গেছিলেন। মা আগেই মারা যায়। আমরা এক-এক জনে পাই দেড় লাখ করে। হয়তো তার সুদ থেকেই আমাদের গ্রাসাচ্ছাদন মিটত; কিন্তু তা হ’ল না। সুরেশ রেস খেলে টাকাটা ওড়ালো, আর আমি—

দক্ষিণের বড় জানালা দিয়ে টুকু লেক-এর গাছ-গাছালির দিকে তাকিয়ে বসে রইল।

—আর তুমি?

—লুক হিয়ার স্যার! আমি মনে করি ওভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে সুইসাইড করা সহজ! একটাই জীবন, ক্ষণস্থায়ী যৌবন—আমি তার প্রতিটি মুহূর্তকে ভোগ করতে চাই। ‘ভোগ’ শব্দটা সবরকম অর্থে। তাই আমি করে এসেছি, তাই করে যাবো-

বাসু-মামু অকপটে প্রশ্ন করলেন, সেই দেড় লাখের মধ্যে তোমার অংশে কতটা বাকি আছে?

—সতেরশ’ তের টাকা আশি নয়া পয়সা-ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সে; লাস্ট উইথড্রয়ালের পর। এছাড়া হয়তো কিছু আছে আমার ভ্যানিটি ব্যাগে।

—এক্ষেত্রে তো কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হয়।

হঠাৎ খিলখিলিয়ে হেসে উঠল দুঃসাহসী মেয়েটা। বললে, শুধু আমার জন্য নয় বাসু-সাহেব। আপনার জন্যও—কারণ ব্যর্থ হলে আপনার খরচাপাতি মেটাবার ক্ষমতাও আমার নেই!

—তাইতো দেখছি। এখন বল তো, সিগ্রেট খাও, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। মদ খাও?

—খাই— দিশি নয়, খাঁটি বিলাতী হলে। প্রায়ই খাই। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায়।

—ড্রাগস্‌?

—কখনো নয়।

–প্রেম-ট্রেমের ইতিহাস?

—প্রচুর। সবক’টা ছেলের নামও মনে নেই। তবে এখন শুধু একজনই বয়ফ্রেন্ড : নির্মল।

—কিন্তু আমার কেমন যেন মনে হল সে তোমার ভিন্ন-মেরুর বাসিন্দা। তাই নয়?

—ঠিকই! আমাদের জীবনদর্শন সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবু একমাত্র তাকেই আজ ভালবাসি। তার আর্থিক সঙ্গতি বোধহয় সামান্যই, নয়?

—দুর্ভাগ্যবশত তাই। টাকার কথা বিবেচনা করে আমরা কেউই পরস্পরকে ভালবাসিনি। ও জানে আমি প্রায়-নিঃস্ব। কিন্তু ও একজন জিনিয়াস! কী একটা আবিষ্কার প্রায় করে ফেলেছে। সাফল্যমণ্ডিত যদি হয়, পেটেন্ট যদি নিতে পারে—

—ও নিশ্চয় জানত যে, মিস জনসন মারা গেলে তুমি প্রচুর সম্পত্তি লাভ করবে?

—হ্যাঁ তাই। কিন্তু আপনি যা ভাবছেন তা নয়। আমি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার পরেও আমাদের এনগেজমেন্টটা ভেঙে যায়নি। আপনি নির্মলকে দেখেছেন?

—হ্যাঁ, দেখেছি। মেরীনগরে। সেই তোমার ঠিকানাটা আমাকে দিয়েছে। সুরেশের ঠিকানাটা সে জানে না বলল।

—সুরেশকে কেন খুঁজছেন আপনি?

বাসু-মামু জবাব দিতে পারলেন না। ঠিক তখনই সদর দরজাটা হাট করে খুলে গেল। একটি দীর্ঘকান্তি সুবেশ, সুন্দর, প্রাণবন্ত যুবক দ্রুত প্রবেশ করল ঘরে। বললে, সুরেশ! সুরেশের নাম শুনলাম যেন? স্পিক অফ দ্য ডেভিল, অ্যান্ড দ্য ডেভিল জাম্পস ইন

স্মৃতিটুকু হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। চকিতে তাকিয়ে দেখল বাসু-মামুর দিকে। তারপর ভাইয়ের দিকে ফিরে বললে, তুই বম্বে যাসনি?

—বম্বে? মানে?

বাসু-মামু হঠাৎ বলে উঠলেন, ভালই হল তুমি এসে পড়েছ, সুরেশ। তোমার কথাই আলোচনা করছিলাম আমরা।

—বাট হোয়াই?

স্মৃতিটুকু ফর্মাল ইনট্রোডাকশান করিয়ে দিল। আমাকে বাদ দিয়ে। বললে, ইনি হচ্ছেন প্রখ্যাত ক্রিমিনাল-সাইডের ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু। ইনি স্বীকৃত হয়েছেন, আমাদের স্বার্থে ঐ উইলখানি নাকচ করে দেবার ব্যাপারে উনি আমাদের সাহায্য করবেন। পারিশ্রমিক, পাঁচ থেকে পনেরো শতাংশ—আদৌ সাফল্য লাভ করতে পারলে; ব্যর্থ হলে আমরাও ব্যর্থ হব পেমেন্ট করতে!

সুরেশ দারুণ খুশিয়াল হয়ে ওঠে, বলে, গ্র্যান্ড আইডিয়া। তুই ওঁর খোঁজ পেলি কী করে?

—না, আমি ওঁকে ডেকে পাঠাইনি। উনি নিজে থেকেই এসেছেন।

—মোস্ট ইন্টারেস্টিং! কিন্তু আমি যতদূর জানি ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু ক্রিমিনালদের বিপক্ষে থাকেন, তাদের পক্ষে তো ওঁকে—

স্মৃতিটুকু মাঝপথেই বলে ওঠে, আমরা ক্রিমিনাল নই।

—কিন্তু প্রয়োজনে হতে স্বীকৃত! তাই নয়? তুই হয়তো মুখে স্বীকার করবি না, আমার কিন্তু সব খোলামেলা। বুঝেছেন, বাসু-সাহেব, দু-একবার ছোটখাটো ব্যাপারে ইতিমধ্যেই কিছু হাত পাকিয়েছি। বড়পিসির একটা চেক নিয়ে একবার ফ্যাসাদে পড়েছিলাম। আমি শুধু ওঁর লেখা সংখ্যাটায় একটা বাড়তি শূন্য যোগ করেছিলাম—স্রেফ শূন্য! তার আর কী দাম বলুন? কিন্তু বড়পিসি ঠিক ধরে ফেললো। বুড়ির দৃষ্টি ছিল ঈগলের মতো!

–তা ঠিক।—বললেন বাসু মামু—এক বান্ডিল একশ টাকার নোট থেকে মাত্র পাঁচখানা খোয়া গেলেও তাঁর নজরে পড়ে।

—তার মানে?

—আমি ওঁর শেষ জন্মদিনের আগের দিনটার কথা বলছি। হলঘরের ড্রয়ারে, যাতে ফ্লিসির বলটা রাখা ছিল!

ধীরে ধীরে সোফায় বসে পড়ে সুরেশ, বাই জোভ! আপনি তা কেমন করে জানলেন?

স্মৃতিটুকু বললে, উনি পিসির লেখা একটা চিঠি পেয়েছেন। পিসি ওঁকে জানিয়েছিল।

মামু প্রতিবাদ করলেন না। বললেন, শেষ দিকের ঘটনাগুলো তারিখ অনুযায়ী সাজিয়ে নিতে হবে। শুনেছি ওঁর জন্মদিনে তোমরা ওঁর কাছে গিয়েছিলে, কিন্তু জন্মদিনের আগের রাত্রে ছয় তারিখে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়, তাই না?

সুরেশ বলে, হ্যাঁ। রাত সাড়ে দশটায় বড়পিসি সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে যায়। ওঁর একটা কুকুর আছে—ও, আপনি তো জানেনই—সেই ফ্লিসির বলে পা দিয়ে হড়কে পড়ে যায়।

—খুব আঘাত পান তিনি?

—খুব কিছু নয়। দুর্ভাগ্যবশত মাথাটা নিচের দিকে রেখে পড়েননি তিনি। তাহলে না হয় বলা যেত মস্তিষ্কে আঘাত পেয়ে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। আর তাতেই দ্বিতীয় উইলখানা বানিয়ে ফেলেন।

–তা বটে! মাথা নিচের দিকে রেখে না-পড়ায় তোমরা মর্মাহত?

স্মৃতিটুকু প্রতিবাদ করে— কী যা তা বলছেন।

সুরেশ কিন্তু সহজভাবেই নিল ব্যাপারটা। বললে, তুই বুঝতে পারছিস না টুকু, উনি বলতে চাইছেন—সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় উইল বানানো ওঁর পক্ষে সম্ভবপরই হত না! অস্বীকার করে কী লাভ? তিন-হপ্তা বেঁচে থাকায় আমরা গভীর গাড্ডায় পড়ে গেছি!

—তোমরা তারপর কে-কবে কলকাতায় ফিরে গেলে?

—সবাই একই দিনে, শুক্রবার, দশ তারিখ সকালে।

—তারপর কবে তোমরা মেরীনগরে যাও?

—দু’হপ্তা বাদে মানে—পঁচিশে, শনিবার।

—আর মিস্ পামেলা জনসন মারা গেলেন পয়লা মে? শুক্রবার?

—হ্যাঁ, তাই

—তারপর, তৃতীয়বার কবে গেলে?

—ওঁর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শনিবার সকালে, দোসরা মে।

বাসু-মামু এবার টুকুর দিকে ফিরে বললেন, পঁচিশে শনিবার তুমিও সুরেশের সঙ্গে গেছিলে?

— হ্যাঁ।

—সেটা ওঁর দ্বিতীয় উইল করার চারদিন পরে। তখন কি তিনি বলেননি, যে, তিনি দ্বিতীয় একটা উইল করেছেন?

আশ্চর্য! দুজনে প্রায় একই সঙ্গে জবাব দিয়ে বসলো। টুকু বললে—’না’। আর সুরেশ বললে, ‘বলেছিলেন’।

বাসু-মামু সুরেশের দিকে ফিরে দ্বিতীয়বার বললেন, বলেছিলেন?

স্মৃতিটুকুও একই সঙ্গে বললে, সুরেশ!

সুরেশ দুজনের দিকেই তাকিয়ে দেখল। ছোট বোনকে বললে, তোর মনে নেই? আমার যতদূর মনে হচ্ছে তোকে তা আমি বলেছিলাম।

তারপর বাসু-মামুর দিকে ফিরে বললে, বুড়ি আমাকে দ্বিতীয় উইলখানি দেখিয়েও ছিল। ওর ঘরে আমাকে ডেকে নিয়ে বুড়ি উদ্ধার-উন্মুখ আগ্নেয়গিরির মতো বসেছিল। বললে, ‘আমার বাবা, এবং বোনেরা শান্তি পাবেন না তাঁদের রক্ত জল করা টাকা কেউ যদি রেস খেলে বা ফুর্তি করে উড়িয়ে পুড়িয়ে দেয়, অথবা প্রীতমের মতো ফাটকাবাজি করে। তাই আমি আমার সমস্ত সম্পত্তি মিন্টিকে দিয়ে যাব বলে স্থির করেচি। মিন্টিটা বোকা, কিন্তু সৎ। ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ।’ তখন আমি বললুম, ‘এসব কথা আমাকে ডেকে কেন বলছ বড়পিসি?’ উনি বললেন, ‘আমার মৃত্যুর পর যাতে তোমরা নিরাশ না হও, অথবা আমার মৃত্যুর পর লাখ-বেলাখ পাবে আশা করে এখনই যাতে ধারকর্জ না কর, তাই।’

—উনি তোমাকে উইলের কথা মুখে মুখে বললেন, না দেখালেন?

—না, উইলখানা আমাকে দেখালেন।

টুকু আবার বললে, এ-কথা আমাকে জানাসনি কেন?

—আমার যতদূর মনে পড়ছে, আমি তোকে বলেছিলাম।

বাসু-মামু টুকুকে ছেড়ে সুরেশকেই প্রশ্ন করেন, উইলটা দেখে তুমি বড়পিসিকে কী বললে?

—আমি প্রাণ খুলে হাসলাম। বললাম, ‘বড়পিসি, তোমার টাকা তুমি যাকে খুশি দেবে, এতে আমাদের বলার কী আছে? হয়তো একটা ধাক্কা লাগলো, তা লাগুক—এই তো জীবন।’ শুনে বড়পিসি বললে, “ঠিক বাপের মতো। থরোব্রেড স্পোর্টসম্যান!’ তখন আমি বললাম, ‘পিসি, উইলে যখন আমাকে বঞ্চিতই করলে, তখন শ-পাঁচেক টাকা আমাকে ধার দাও।’ তা পিসি দিয়েছিল, পাঁচশ’ নয়। তিনশ’।

—তার মানে তুমি যে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়েছ, সেটা গোপন করতে পেরেছিলে?

—ইন ফ্যাক্ট আমি কোনও ধাক্কা খাইনি আদৌ, আমি ভেবেছিলাম এটা বড়পিসির একটা ফাঁকা হুমকি। ও শুধু আমাদের ভড়কে দিতে চেয়েছিল।

— ফাঁকা হুমকি দেখাতে কেউ ফি দিয়ে অ্যাটর্নিকে বাড়িতে নিয়ে এসে ওভাবে উইল তৈরী করে?

—করে। লোকটা যদি বড়পিসি হয়। আপনি তাকে চিনতেন না বাসু-সাহেব, আমি তাকে হাড়ে হাড়ে চিনতাম! আমি আজও বলবো, বড়পিসি যদি হঠাৎ না মরে যেত তাহলে ঐ দ্বিতীয় উইলখানা ছিঁড়ে ফেলতো। এটা তার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল না। হতে পারে না।

বাসু জানতে চান, তোমার সঙ্গে যখন মিস্ জনসনের এসব কথা হচ্ছিল তখন মিনতি কোথায়?

—খোদায় মালুম। কেন?

—এমন কি হতে পারে যে, সে আড়ালে দাঁড়িয়ে সব কিছু শুনেছে।

—পারে। খুবই সম্ভব। কারণ দরজাটা খোলা ছিল, আমরা কেউই ফিসফিস করে কথা বলিনি।

বাসু এবার স্মৃতিটুকুর দিকে ফিরে বললেন, এসব কথা তুমি কিছুই জানতে না? দ্বিতীয় উইল করার কথা?

সে জবাব দেবার আগেই সুরেশ বলে ওঠে, টুকু, মনে পড়ছে না? আমি তোকে বলেছিলাম কিন্তু।

স্মৃতিটুকু ওর চোখে চোখে তাকাল না। বাসু-সাহেবকে বলল, এমন একটা ব্যাপার ও যদি আমাকে বলে থাকে তা কি আমি ভুলে যেতে পারি?

—না। সম্ভবত না। আর একটা কথা, মিনতি মাইতিকে যদি সাক্ষীর মঞ্চে তোলা যায়, তাহলে তাকে দিয়ে কি বলিয়ে নেওয়া যাবে—

তাঁর বাক্যটা শেষ হল না। সুরেশ সোৎসাহে বলে ওঠে, যাবে! আমি আপনাকে চিনি। আপনি অনায়াসে ওকে দিয়ে কবুল করিয়ে নিতে পারবেন যে, তার জ্ঞান মতে কাক আর বক একই রঙের পাখি, তবে তাদের গায়ের রঙ টিয়া পাখির মতো লাল নয়!

বাসু হেসে ফেলেন। বলেন, উইলটা একবার দেখা দরকার। মিস্ হালদার, আমাকে একটা ইনট্রোডাকশান লেটার দিতে হবে।

—তাহলে এ ঘরে আসুন। আমার লেটার-হেডটা ওঘরে আছে।

ওরা তিনজনে পাশের ঘরে উঠে গেলেন। আমি গোঁজ হয়ে বসেই রইলুম। সেটা কেউ গ্রাহ্যই করল না। মিনিট-পাঁচেক পরে বাসু-মামু ওঘর থেকে বার হয়ে এলেন। সোজা সদর দরজার দিকে গট-গট করে এগিয়ে গেলেন। সশব্দে দরজাটা খুললেন এবং সশব্দেই বন্ধ করলেন। তারপর ঐ শয়ন কক্ষের দিকে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলেন। আমি স্তম্ভিত।

ঠিক তখনই ঘরের ভিতর থেকে প্রায় আর্তকণ্ঠে স্মৃতিটুকুর কণ্ঠস্বর শোনা গেল : য়্যু ফুল।

এই সময়ে নিঃশব্দে সদর দরজা খুলে পরিচারিকাটি প্রবেশ করল। বাসু-মামু তাড়াতাড়ি আমার হাত ধরে–নিঃশব্দেই বেরিয়ে এলেন করিডোরে।

করিডোরে বেরিয়ে এসে আমি বলি, মামু! শেষ পর্যন্ত আমাদের দরজায় আড়ি পর্যন্ত পাততে হবে?

—আমাদের’ বলছো কেন কৌশিক? আমিই কান পেতেছি। তুমি ঘটনাচক্রে শুনতে পেয়েছ মাত্র!

—দিস্ ইজ নট ক্রিকেট!

–নো, ইট ইজ নট! বাট, বডি-লাইন বোলিং ইজ নট ক্রিকেট আইদার!

—কী বলতে চাইছেন আপনি?

—বলছি—’হত্যা’ বস্তুটা ‘খেলা’ নয়, যে স্পোর্টসম্যানশিপের আইনকানুন সবসময় মনে রাখতে হবে।

–হত্যা! ‘হত্যা’ হলো কোথায়?

—তুমি স্থির সিদ্ধান্তে এসেছো? ‘হত্যা’ নয়?

—হত্যার চেষ্টা হয়তো হয়েছিল, মানছি, কিন্তু উনি মারা গেছেন স্বাভাবিকভাবে। জনডিসে।

—আই রিগিট : তুমি স্থির সিদ্ধান্তে এসেছো?

—সবাই তাই বলছে।

—আবার সেই একই কথা : ‘সবাই তাই বলছে।’

আমি রুখে উঠি—এক্ষেত্রে শেষ কথা বলার অধিকার তাঁর চিকিৎসকের। ডক্টর পিটার দত্ত আমাদের তাই বলেছেন—পরিণত বয়সে জনডিস-এ ভুগে তিনি মারা গেছেন।

মামু আমাকে নিয়ে লিফটের খাঁচায় ঢুকলেন। স্বয়ংক্রিয় লিফট। তৃতীয় যাত্রী ছিল না, তাই উনি বললেন, হাজারকরা নশো নিরানব্বইটি ক্ষেত্রে অ্যাটেন্ডিং ফিজিশিয়ানই শেষ কথা বলে, ঠিকই বলেছ তুমি। কিন্তু বাকি একটি ক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশে কবর থেকে মৃতদেহকে খুঁড়ে বার করে তোলা হয়, exhume করা হয়—দেখা যায় ডাক্তার তার বিশ্বাস অনুযায়ী ভুল সার্টিফিকেট দিয়েছিল।

লিফ্ট নিচে এসে থামলো। আমরা বের হয়ে আসি। পোর্টিকোটাও তখন নির্জন। আমি বলি, মামু, এবার আমি আপনাকে ঐ একই প্রশ্ন করবো : আপনি নিজে কি স্থির সিদ্ধান্তে এসেছেন? আপনি ‘ঘরপোড়া গরু’র ভূমিকাটা অভিনয় করছেন না তো? সারা জীবন ‘খুন’ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে যেখানেই ‘সিঁদুরে মেঘ’ দেখেন….

কথাটা তুমি ঠিকই বলেছো, কৌশিক! ‘ঘর-পোড়া-গরু’! কিন্তু গোয়ালে দ্বিতীয়বার আগুন লাগার ক্ষীণ সম্ভাবনাও তো থাকে—হাজারকরা একবার?

আমি দৃঢ়ভাবে বলি, এখানে তা হয়নি! কোনও ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি না আমি সে বিষয়ে।

–পাচ্ছো না? তাহলে আমাকে বুঝিয়ে বল দেখি-এক : স্মৃতিটুকু কেন বললো, সুরেশ বোম্বাই চলে গেছে আগের দিন? দুই : আমি প্রথমাবস্থায় ওর পারিবারিক বিষয়ে প্রশ্ন করতে চাই শুনেই সে কেন নার্ভাস হয়ে ঘন ঘন সিগারেটে টান দিচ্ছিল? তিন : সে কেন স্বীকার করলো না যে, সুরেশ তাকে জানিয়েছিল দ্বিতীয় উইল করার কথা? এবং শেষ প্রশ্ন : নির্জন কক্ষে সে কেন তার দাদাকে তীব্র ভর্ৎসনা করে বসল : য়ু ফুল!

আমি জানতে চাই : আপনি কী অনুমান করছেন?

বাসু-মামু জবাব দিলেন না। আমরা দুজনে গাড়িতে গিয়ে বসি। আমি এবার ড্রাইভারের সিটে। উনি পাইপ ধরালেন। বললেন, হ্যারিসন রোডে চল, মিস্ মাইতির হোটেলে।

মিনতি মাইতি লক্ষপতি, স্মৃতিটুকুর মতো অদ্যভক্ষ্যধনুর্গুণ নয়, কিন্তু সে আছে শিয়ালদহর কাছাকাছি একটি মামুলি ছা-পোষা হোটেলে। পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল হোটেলের এক ছোকরা চাকর। কড়া নাড়তে এক মাঝ-বয়সী ভদ্রমহিলা দ্বার খুলে দিতে ছোকরাটি বললে, এঁরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

বকনা-বাছুরের মতো দুটি চোখ মেলে মহিলাটি আমাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। মামু নমস্কার করে বললে, আমার নাম পি. কে. বাসু।

—ও!

—আপনার সঙ্গে দু’চারটে কথা বলার আছে, ভিতরে আসবো?

বেশ বোঝা যায়, মিনতি মাইতির মাথায় ওঁর নামটা কোনও ধাক্কা মারেনি। সে বোধহয় ওঁর নামটা জীবনে শোনেনি। বললে, হ্যাঁ, আসুন, আসুন। বসুন।

আমরা ভিতরে গিয়ে বসি। ঘরে একটিই চেয়ার। বাসু তাতে বসলেন। আমাকে বসতে হল খাটের প্রান্তে। মিস্ মাইতি ড্রেসিং টুলে বসে বললেন, আমার কাছে…..?

–গত পরশু, আমরা দুজন মেরীনগরে মরকতকুঞ্জটা দেখে এসেছি। অনন্ত স্টোর্সের ভবানন্দবাবু আপনাকে কিছু জানাননি?

—ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, এবার বুঝতে পেরেছি। উনি কাল ফোন করেছিলেন। তা বাড়িটা আপনাদের পছন্দ হয়েছে?

—ভবানন্দবাবু কি টেলিফোনে আমার নামটা জানিয়েছিলেন?

—–নাম? হ্যাঁ, আমি লিখেও রেখেছি। দাঁড়ান দেখি।

উনি এগিয়ে এসে একটি খাতা দেখে বললেন, হ্যাঁ, আপনার নাম কে. পি. ঘোষ। রিটায়ার্ড নেভাল অফিসার।

—আমি কি সেই নামটাই আপনাকে এখনি বললাম?

ভদ্রমহিলা একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলেন। বললেন, মাপ করবেন, তখন আমি খুবই অন্যমনস্ক ছিলাম। ঠিক খেয়াল করে শুনিনি, কিন্তু আপনি তো কে. পি. ঘোষ। তাই নয়?

—না। আমি বলেছি, আমার নাম পি. কে. বাসু। আমি নেভাল অফিসার ছিলাম না। আমি হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করি, ব্যারিস্টার! এ আমার চ্যালা কৌশিক মিত্র।

এবার চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে গেল মিনতির। বললে, আপনিই কি সেই ‘কাঁটা-সিরিজে’র পি. কে. বাসু?

—সে কথাই বোঝাবার চেষ্টা করছি এতক্ষণ।

এরপর মিনিট-তিনেক মিনতি দেবী কী বললেন, কী করলেন, তা তিনি নিজেই জানেন না। অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠলেন ভদ্রমহিলা। প্রথমেই গড় হয়ে প্রণাম করলেন মামুকে। তারপর আমাকে প্রণাম করার উদ্যোগ করতে আমি বাধা দিই; উনি সে-কথা শুনলেন না। আমারও এক খাবলা পদধূলি নিয়ে বললেন, সে-কথা শুনছি না, কৌশিকদা, সুজাতা বৌদিকেও নিয়ে এলেন না কেন?

বেশ বোঝা গেল, কাঁটা-সিরিজের গল্পগুলি ওঁর প্রিয়, বাসু-সাহেবের ‘ফ্যান’। শেষমেশ যখন হোটেলের বয়টাকে ডেকে আমাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে যাবেন তখন বাধা দিলেন বাসু-মামু, শোনো মিনতি, ও-দুটোই কেউ একসঙ্গে পান করে না। হয় চা, নয় ডাব।

হোটেল-বয়টাও হেসে ফেলেছিল। তাকেই বললেন মামু, তিনটে ডাবই নিয়ে এসো হে!

ছোকরাটা চলে যেতে মিনতি বললে, আপনি যদি মরকতকুঞ্জটা কেনেন, তাহলে… —না মিনতি। মরকতকুঞ্জটা কিনবার ইচ্ছে নিয়ে আমি মেরীনগরে যাইনি। আমি পরশু দিন মিস্ জনসনের একখানা চিঠি পেয়েছি। তিনি আমাকে একটি বিষয়ে তদন্ত করতে বলেছিলেন… আশ্চর্য! মিনতি মাইতি অবাক হলো না—পরশু চিঠি পাওয়ার কথায়। বরং বললে, সেই পাঁচশো টাকা চুরি যাওয়ার ব্যাপারে?

—না! সেটা যে সুরেশ নিয়েছিল তা তিনিও জানতেন, তোমরাও বুঝতে পেরেছিলে, নয়?

—হ্যাঁ। কিন্তু কিছু বলা তো যায় না—নিজের বাড়ির লোক…

—তা তো বটেই। মিস্ জনসন আমাকে লিখেছিলেন, অন্য একটি বিষয়ে তদন্ত করতে। ওঁর সেই অ্যাকসিডেন্টটার বিষয়ে….

—তার মধ্যে তদন্তের কী আছে? সে তো ফ্লিসির সেই হতভাগা ‘বল’টায় পা দিয়ে…

—কিন্তু ‘ফ্লিসি’ তো সে রাত্রে বাড়িতে ছিল না? ছিল?

—না, ছিল না। সারা রাত বাইরে কাটিয়ে ভোর রাতে ফিরে এসেছিল। আমিই তাকে দোর খুলে চুপি-চুপি ভিতরে ঢুকিয়ে আনি।

—কেন, ‘চুপি-চুপি’ কেন?

—মায়ের যাতে ঘুম না ভেঙে যায়। তাছাড়া, ফ্লিসি রাত্রে বাইরে বাইরে কাটালে মা ভীষণ বিরক্ত হতেন। ওঁর ঐ শারীরিক অবস্থায় সেটা ওঁকে জানতে দিইনি।

—আই সি! আচ্ছা, তোমার মনে আছে মিনতি? মৃত্যুর আগে উনি কী একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন? চীনের মাটি…

মিনতি জানতে চাইলো না এ সংবাদ বাসু-মামু কোথা থেকে পেলেন। যেন ধরে নিল, মৃত্যু মুহূর্তে উচ্চারিত কথাটাও মিস্ জনসন আগেভাগেই ওঁকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন। বললে, হ্যাঁ, মনে আছে, উনি বলেছিলেন, ‘চীনের মাটিতে খুব দামী ফুল ফোটে’–কিন্তু সে তো বিকারের ঘোরে।

—তোমার কোনও ধারণা আছে, কেন উনি তাঁর উইলটা বদলে ফেলেন।

এই প্রথম মনে হল মিনতি সতর্ক হল। ‘উইল’ শব্দটা উচ্চারিত হওয়ামাত্র। আমতা-আমতা করতে থাকে—উইল? মানে ওঁর উইল?

—এ-কথা তো ঠিক যে, বছর পাঁচেক আগেই তিনি একটি উইল তৈরি করেছিলেন? মৃত্যুর মাত্র দশদিন আগে সেটা উনি কেন বদলে ফেললেন? তোমার কী মনে হয়?

মিনতি একটু ভেবে নিয়ে বললে, বিশ্বাস করুন, আমি জানি না। সত্যিই জানি না। উইলটা যখন পড়ে শোনানো হচ্ছিল তখন আমি একেবারে অষ্টস্তব্ধ হয়ে যাই! আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি যে, উনি সব কিছু আমাকেই দিয়ে গেছেন! আমার এখনো মাঝে মাঝে মনে হয়, স্বপ্ন দেখছি না তো? এ কি হয়? ওঁর তিন-তিনজন নিকট আত্মীয় রয়েছে, তবু উনি কেন সব কিছু আমাকেই দিয়ে গেলেন! প্রথম ধাক্কাটা কেটে যাবার পর আমার এখন মনে হচ্ছে, আমি যেন পরের ধন চুরি করেছি। যা আমার হক্কের ধন নয়, যাতে আমার অধিকার নেই…

—তুমি কি তোমার অগাধ সম্পত্তির কিছু অংশ ওদের তিনজনকে ফিরিয়ে দেবার কথা ভাবছ এখন?

খণ্ডমুহূর্তের জন্য মনে হল মিনতির ভাবান্তর হল। মুখটা হঠাৎ লাল হয়ে উঠলো। যেন, সরল, নির্বোধ মেয়েটির ভেতর থেকে একটি বুদ্ধিমান মেয়ে উঁকি মেরে অন্তরালে সরে গেল। ও বললে, অবশ্য এর আর একটা দিকও আছে…প্রথমত, আমি যদি ওঁর দান গ্রহণ না করি, তবে তাঁর শেষ ইচ্ছাটায় বাধা দেওয়া হবে। ম্যাডাম অনেক বিবেচনা করেই এ-কাজটা করেছেন; হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, ওঁর বাবা এবং বোনেরা শান্তি পাবেন না তাঁদের রক্তজল-করা টাকা কেউ যদি উড়িয়ে-পুড়িয়ে দেয়, অথবা প্রীতমের মতো ফাটকাবাজি করে…

—তিনি যে এই কথা ভেবেছিলেন, ঠিক এই ভাষাতেই, তা তুমি কেমন করে জানলে?

এবারে ও যেন শিউরে উঠলো। মনে মনে জিব কাটলো। আবার শুরু হলো তার আমতা-আমতা : না, মানে আমি কেমন করে জানবো? এ আমার আন্দাজ আর কি! তাছাড়া কেন তিনি তাঁর উইলটা শেষমেশ এভাবে বদলে ফেলবেন?

—তা হতে পারে। সুরেশ রেস খেলে, স্মৃতিটুকু বেহিসাবি খরচে, কিন্তু হেনা..।

ইচ্ছা করেই উনি বোধহয় বাক্যটা অসমাপ্ত রাখলেন। মিনতি সেই অসমাপ্ত বাক্যটা শেষ করলো, না, হেনা মাটির মানুষ। কিন্তু মুশকিল কী জানেন? সে প্রীতম ঠাকুরের হাতের পুতুল। হেনাও অনেক টাকা পেয়েছিল—সব ঐ প্রীতম উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে। প্রীতমকে হেনা ভীষণ ভয় পায়। সে যা বলে ও তা করে। প্রীতম হুকুম করলে ও বোধহয় মানুষ খুন করতে পারে! অথচ এমনিতে ও খুবই ঠাণ্ডা। ছেলেমেয়ে দুটোকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। হেনাকে এভাবে বঞ্চিত করা আমার ভাল লাগেনি। টুকুকে কিছু দেননি, ভালই করেছেন—সুরেশকেও। বিশেষ সুরেশ যেভাবে ওঁকে ভয় দেখাতো…

—ভয় দেখাতো? মানে?

—একবার সে তার বড়পিসিকে বলেছিল : ‘মানুষ মরিয়া হয়ে গেলে বড় বিপজ্জনক, তোমার ভালমন্দ কিছু না হয়ে যায়—’

—তাই নাকি? কবে বললো এ কথা?

—ঐ উনি সিঁড়ি থেকে উল্টে পড়ার আগে।

—তোমার সামনেই?

—না, ঠিক আমার সামনে নয়। তবে ওঁরা কিছু ফিসফিস করে কথা বলছিলেন না। আর আমার ঘরটা তো মায়ের ঘরের কাছাকাছিই।

এরপর বাসু-সাহেব ঊষা বিশ্বাসের কাছে সংগৃহীত সেই প্ল্যানচেটের প্রসঙ্গ তুললেন। সেটাও করবোরেটেড হলো— এবার অবিশ্বাসীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়, বিশ্বাসীর চোখে। মিনতির বিশ্বাস—স্বয়ং যোসেফ হালদার এসে ভর করেছিলেন মিস্ জনসনের দেহে। মেয়েকে নিজের কোলে টেনে নিয়েছেন।

বাসু জানতে চাইলেন, টুকু আর সুরেশ পঁচিশে এপ্রিল শনিবার মেরীনগরে এসেছিল, নয়?

–পঁচিশে কিনা মনে নেই, তবে শনিবারই। তার আগের শনিবারে হেনা আর প্রীতম এসেছিল।

—সেটা তাহলে আঠারো তারিখ। আর উনি উইলটা করেন মঙ্গলবার, একুশে?

—হ্যাঁ, একুশে। উনি উইল করার আগের হপ্তায় হেনারা এসেছিল, পরের হপ্তায় টুকু আর সুরেশ। সেদিন প্রীতমও এসেছিলেন, একা—

—তাই নাকি? প্রীতম পঁচিশে মেরীনগরে গিয়েছিল?

—হ্যাঁ। কিন্তু রাত্রে থাকেননি। মায়ের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক কথাবার্তা বলে ফিরে গিয়েছিলেন।

—তখন সুরেশ আর টুকু মরকতকুঞ্জে?

—হ্যাঁ, কিন্তু তারা বোধহয় জানে না যে, হেনার বর এসে দেখো করে তখনই চলে গেছেন।

—আশ্চর্য! দেখা হলো না কেন?

—সবাই যে যার তালে এসেছিল। বুড়িমার কাছ থেকে টাকা আদায় করতে। ওরা একে-অপরকে এড়িয়ে চলতো। বুড়িমা সবই বুঝতেন, চুপচাপ থাকতেন।

প্রবীরবাবু কেমন লোক?

—প্রবীরবাবু! তিনি কে?

—প্রবীর চক্রবর্তী, সেই যিনি উইলটা তৈরি করে সই করিয়ে নিয়ে যান?

—ও, উকিলবাবু? লোক ভালই, তবে কী-জানি কেন, আমাকে ভাল চোখে দেখেন না।

বাসু-মামু একটু চুপ করে থেকে বললেন, তোমাকে একটা কথা জানানো দরকার মিনতি। আমি খবর পেয়েছি, টুকু আর সুরেশ ঐ উইলটা নাকচ করবার চেষ্টা করছে।

রীতিমত ভাবান্তর হলো এবার। গম্ভীর হয়ে বললে, জানি। হেনা বলেছে আমাকে। কিন্তু ওরা কিছুই করতে পারবে না। আমি ভাল উকিলের পরামর্শ নিয়েছি। আপনি একবার দেখবেন উইলটা?

—তোমার কাছেই আছে সেটা?

—না, হোটেলে নেই। উকিলবাবু বারণ করেছিলেন ওটা নিজের কাছে রাখতে। আমার ব্যাঙ্ক-ভল্টে আছে। উনিই ব্যবস্থা করে ঐ ভল্টটা আমাকে পাইয়ে দিয়েছেন।

—না, থাক। আমি আর দেখে কী বলব? তুমি তোমার উকিলের পরামর্শ মতো চলো।

মিনতি মাইতির হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে প্রশ্ন করি, কী বুঝলেন?

—এক নম্বর : মিনতি আড়ি পাতায় ওস্তাদ! দু নম্বর : সে হয় অতি নির্বোধ, না হলে অত্যন্ত চালাক এবং সুঅভিনেত্রী। দুটোর কোনটা ঠিক, তা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। আমাদের নেক্সট টার্গেট হেনা ঠাকুরের বাড়ি—ঠিকানা তো জানোই। চলো—

হ্যাঁ, হেনার ঠিকানা সরবরাহ করতে পেরেছে মিনতি। প্রীতমের এক আত্মীয়ের বাড়িতে এসে উঠেছে ওরা। এখনও সেখানেই আছে। ভবানীপুরে।

শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রিট যেখানে হরিশ মুখার্জি রোডে এসে পড়েছে সেখানে, শিখদের গুরুদ্বারার কাছাকাছি একটি ত্রিতল বাড়ি। গৃহস্বামী শিখ, প্রীতমের আত্মীয়। তাঁর এক-দু’খানি ঘর দখল করে হেনা সাময়িক সংসার পেতেছে। মেজানাইন ফ্লোর। একতলায় গৃহস্বামীর মোটর-পার্টস্-এর দোকান। একটি ভৃত্য আমাদের পৌঁছে দিল মেজানাইন ফ্লোরে। কড়া নাড়তে যে মেয়েটি দরজা খুলে দিল তার বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। লোকটি আমাদের দেখিয়ে হিন্দিতে বললে, মাইজি, এঁরা দুজন আপনাকে খুঁজছেন।

—আমাকে? না ঠাকুর-সাহেবকে? – প্রশ্নটা সে করেছিল ঐ ভৃত্যস্থানীয় লোকটিকেই।

বাসু-সাহেব তাকে জবাব দেবার সুযোগ না দিয়ে বললেন, তুমিই হেনা ঠাকুর?

—হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে তো আমি…

—না, আমাকে তুমি চেনো না। আমরা আসছি স্মৃতিটুকু হালদারের কাছে থেকে।

—ওঃ! টুকু! হ্যাঁ, বলুন?

—তোমার সঙ্গে দু-চারটে কথা বলার আছে। কোথায় বসে কথাটা বলবো?

—আসুন, ভিতরে এসে বসুন।

মেজানাইন ঘরটা আকারে মাঝারি। একটা ডবল-বেড খাট পাতা। খান-দুই চেয়ারও ছিল। ওপাশে একটি বছর-চারেকের মেয়ে বসে কী লিখছিল। সে চোখ তুলে আমাদের দেখতে থাকে। হেনা আমাদের বসতে দিল, নিজেও বসলো খাটের এক প্রান্তে : বলুন? বাসু-মামু বললেন, আমি তোমার সঙ্গে মিস পামেলা জনসনের মৃত্যুর বিষয়ে দু-একটা কথা আলোচনা করতে চাই।

হতে পারে আমার দৃষ্টিভ্রম—হঠাৎ মনে হল, মেয়েটি যেন সাদা হয়ে গেল। কোনওক্রমে বললে, হ্যাঁ, বলুন?

—মিস্ জনসন মৃত্যুর আগে হঠাৎ তাঁর উইলটা পরিবর্তন করেছিলেন। তোমাদের বঞ্চিত করে সব কিছু তাঁর সহচরীকে দিয়ে যান। এক্ষেত্রে সুরেশ আর স্মৃতিটুকু একটা মামলা আনতে চায়—উইলটা পাল্টে ফেলতে। ন্যায্য উত্তরাধিকারীরাই যাতে ওঁর সম্পত্তিটা পায়। তুমি কি ওদের সঙ্গে হাত মেলাবে?

হেনা রুদ্ধশ্বাসে কী-যেন ভাবছিল। বললে, কিন্তু তা কি সম্ভব? আমার স্বামী উকিলের পরামর্শ নিয়েছেন—তাঁরা বলেছেন, মামলা-মোকদ্দমা করে কিছু লাভ নেই, অহেতুক অর্থব্যয়!

—আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হয় বটে; কিন্তু এ সব ব্যাপারে অনেক কিছুই হয়ে থাকে। আমি উকিল নই, তাই অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটাকে দেখতে পাচ্ছি। মিস্ হালদার লড়তে প্রস্তুত, এ বিষয়ে তোমার কী মত?

হেনা আমতা-আমতা করল, আমি…মানে… এক্ষেত্রে কী করণীয় তা আমি জানি না। উনি জানেন।

—নিশ্চয়ই। ডক্টর ঠাকুরকে না জানিয়ে তুমি কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারো না; কিন্তু তোমার মনোগত ইচ্ছাটা কী? তোমার ব্যক্তিগত ইচ্ছাটা?

হেনা যেন আরও বিব্রত হয়ে পড়লো। বললে, আমি…আমি জানি না। মানে, আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে এর মধ্যে একটা নোংরামি আছে, একটা অর্থলোলুপতা—

—তাই কি?

—নয়? বড়মাসি তার টাকা যাকে খুশি দিয়ে যেতে পারে, তাতে আমরা আপত্তি করতে পারি না।

—তার মানে মিস্ জনসন তোমাদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করায় তুমি ক্ষুব্ধ নও?

—না, তা নয়। ক্ষুব্ধ তো বটেই! বড়মাসি অন্যায়ই করেছে—সে তো শুধু তার নিজের টাকাই দানছত্র করেনি, তার মধ্যে মেজ আর ছোটমাসির টাকাও আছে। তাঁরা নিশ্চয় রাকেশ আর মীনাকে এভাবে পথে বসাতেন না। বড়মাসির এই শেষ পরিবর্তনটা বিস্ময়কর।

—তার মানে কি শেষ সময়ে তিনি সজ্ঞানে সব কিছু করেননি? কারও প্রভাবে পড়ে—

—কিন্তু মুশকিলের কথা এই যে বড়মাসিকে কেউ প্রভাবান্বিত করেছে এটা ভাবাই যায় না।

—সে-কথা সত্যি। শুনেছি তাঁর খুব দৃঢ় ব্যক্তিত্ব ছিল। আর মিস্ মিনতি মাইতির পক্ষে ও জাতীয় চক্রান্ত করা…

—না! মিন্টিদি মোটেই সেরকম নয়। তাঁর মনটা সাদা। হয়তো একটু বোকাসোকা; কিন্তু…মানে, সেটাও একটা কারণ, যে-জন্য আমি উইল-বিষয়ে মামলা-মোকদ্দমার বিপক্ষে।

বাসু একটু ভেবে নিয়ে বললেন, তোমার কী মনে হয়? উনি হঠাৎ সবাইকে বঞ্চিত করে গেলেন কেন?

ওর গাল দুটি একটু রক্তাভ হয়ে উঠল। অস্ফুটে বললে, আমার কোনও ধারণাই নেই।

বাসু বললেন মিসেস ঠাকুর, আমি আগেই বলেছি যে, আমি উকিল নই। কিন্তু তুমি তো জানতে চাইলে না আমার পেশাটা কী?

হেনা জবাব দিল না। ওঁর দিকে ফিরে তাকালো। তার চোখে জিজ্ঞাসা।

—আমার নাম পি. কে. বাসু। আমি একজন ক্রিমিনাল-সাইডের বারিস্টার। সাধারণের ধারণা আমি গোয়েন্দাও। কিছুদিন আগে আমি মিস্ জনসনের কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছিলাম—ওঁর মৃত্যুর ঠিক আগেই লেখা। উনি আমাকে একজনের বিষয়ে তদন্ত করতে…

হঠাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে হেনা বললে, আমার স্বামীর বিরুদ্ধে…?

—সে-কথা বলার অধিকার আমার নেই।

—তাহলে নিশ্চয় প্রীতমের বিষয়ে! কী লিখেছিলেন তিনি? বিশ্বাস করুন, মিস্টার বাসু—এ সবই মিথ্যা! উনি এসব নোংরামির মধ্যে নেই–

—‘নোংরামি’ মানে?

সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হেনা বলে চলে, আর আমি জানি, কে বড়মাসির কান ভাঙিয়েছিল। সেজন্যও আমি ওদের সঙ্গে হাত মেলাতে গররাজি।

—মাম্মি, আমার হাতের লেখা হয়ে গেছে।

বাচ্চা মেয়েটা উঠে এসে তার খাতাখানা মেলে ধরলো মায়ের সামনে। হেনা একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে, বাঃ! বেশ হয়েছে!

—এখন আমি কী করবো মাম্মি?—সব কথাই সে বলছে হিন্দিতে।

হেনা তার ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে একখানা এক টাকার নোট বার করে তার হাতে দিল। হিন্দিতেই বলল, নিচে দরোয়ানজিকে বল, সে ঐ স্টেশনারি দোকানে নিয়ে যাবে—একা-একা যেও না যেন। ওখান থেকে তোমার পছন্দমতো একখানা পিকচার পোস্ট-কার্ড কিনে নিয়ে এস। যমুনাকে তাহলে তুমি এখান থেকে একটা চিঠি লিখতে পারবে, ও. কে.?

টাকাটা নিয়ে মেয়েটা নাচতে নাচতে বেরিয়ে গেল।

মামু প্রশ্ন করলেন, তোমার ঐ একটিই মেয়ে?

—না। মীনার একটি ছোট ভাইও আছে—রাকেশ। সে তার বাবার সঙ্গে বেড়াতে গেছে।

—তোমরা যখন মরকতকুঞ্জে গেছিলে তখন ওদের সঙ্গে করে নিয়ে গেছিলে? –না। এবার ওরা এখানে ছিল, প্রীতমের বোনের কাছে। বড়মাসি বাচ্চাদের হৈ-হাঙ্গামা সইতে পারতো না। তবে নাতি-নাতনিদের ভালোবাসতো খুবই। মাসির বলতে গেলে ঐ দুটিই তো নাতি-নাতনি—আর কেউ তো নেই।

—তুমি শেষ কবে তাঁকে দেখেছ? আঠারই এপ্রিল?

—তারিখ মনে নেই, তবে সুরেশ আর টুকু যে শনিবারে যায়, তার আগের শনিবারে।

—তার আগেই কি উনি দ্বিতীয় উইলখানা করেছেন?

–না। তার পরের মঙ্গলবারে।

—উনি কি বলেছিলেন যে, নতুন একখানা উইল উনি তৈরি করতে যাচ্ছেন?

—না। কিছুই বলেননি।

—ওঁর ব্যবহারে কোনও পরিবর্তন দেখেছিলে কি?

হেনা একটু ভেবে নিয়ে বললে, না, আদৌ না। পরিবর্তন হবে কেন?

বাসু একটু উসকে দিলেন, টুকু আর সুরেশের কান-ভাঙানির কথা বলছিলে না তুমি?

হঠাৎ উৎসাহিত হয়ে পড়ে হেনা। বলে, ও হ্যাঁ, বুঝেছি। ওদের কান-ভাঙানিতে বড়মাসি বেশ কিছুটা বদলে গিয়েছিল। বিশেষ করে আমার স্বামীর বিরুদ্ধে ওঁর মন বিষিয়ে গেছিল। জানেন, প্রীতম একটা ওষুধ প্রেসক্রাইব করলো—ওঁর হজমের ওষুধ—নিজে গিয়ে ডিস্পেনসারি থেকে সার্ভ করিয়ে আনলো, আর বড়মাসি—আপনি বিশ্বাস করবেন না, সেটা মুখেই দিল না! ধন্যবাদ দিয়ে সরিয়ে রাখলো। প্রীতম ঘর ছেড়ে চলে যাবার পর, আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ওয়াশ-বেসিনে শিশির ওষুধটা ঢেলে ফেলে দিল। এ শুধু টুকুর শয়তানিতে।

বাসু-মামু একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন, কিন্তু তা কেমন করে হবে? তোমরা চারজন মেরীনগর থেকে একই সঙ্গে ফিরে এসেছো, তার পরের হপ্তাতে আঠারোই শনিবার তোমরা দুজন গেছিলে। টুকু-সুরেশ তো সেখানে যায় তার পরের হপ্তায় পঁচিশে, তাই নয়?

হেনাকে জবাব দেবার ঝামেলা সইতে হল না। দ্বারপ্রান্তে ছোট একটি ছেলের হাত ধরে একজন দীর্ঘদেহী পাঞ্জাবী পুরুষের আবির্ভাব ঘটলো।

নিঃসন্দেহে প্রীতম ঠাকুর আর রাকেশ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *