২৫
দিন দুই পরের কথা।
বাসুমামুর ব্যবস্থাপনায় সকলে সমবেত হয়েছে মেরীনগর মরকতকুঞ্জে।
মিনতি মাইতি প্রথমটা আপত্তি করেছিল—এতগুলো লোককে নিমন্ত্রণ করতে। বিশেষ, শান্তি দু’দিনের ছুটি নিয়ে তার ভাইয়ের বাড়ি গেছে। বাসুমামু তাতে দমেননি। বলেছিলেন, আহারের নিমন্ত্রণ তো তুমি করছো না মিনতি। একটি শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সমবেত করা হচ্ছে নিতান্ত অন্য উদ্দেশ্যে। হেনার বাচ্চা দুটোর ব্যবস্থা করতে। তুমি চাও তাদের কিছু টাকা দিতে—কিন্তু সে টাকা যেন প্রীতম উড়িয়ে-পুড়িয়ে না দিতে পারে। তাই নয়? তাছাড়া ওরা সবাই জানতে চায়—কীভাবে হেনা মারা গেল? সেটা অ্যাকসিডেন্ট, আত্মহত্যা না হত্যা? পুলিস তা ধরতে পারছে না, আমি জানি। তাই সবাইকে ডেকে সে-কথা বলতে চাই। আমি ওদের খবর দিচ্ছি। তুমি ব্যবস্থা করো।
ফলে মিনতিকে সেই মতো ব্যবস্থা করতে হয়েছে।
মরকতকুঞ্জে বৈঠকখানা ঘরে সেদিন সবাই এসেছে। স্মৃতিটুকু, সুরেশ, নির্মল, প্রীতম, ডক্টর পিটার দত্ত এবং গৃহস্বামিনী। প্রত্যাশিত একজন অতিথি শুধু অনুপস্থিত-মিস্ মার্পল অব্ মেরীনগর। ডক্টর দত্ত জানালেন, বুড়ির ‘ফ্লু’ হয়েছে—গরম-ঠাণ্ডায়। একেবারে শয্যাশায়ী। বুড়ি একা-একা থাকতো—তাকে বাধ্য হয়ে অপসারিত করা হয়েছে পিটার দত্তের বাড়িতে। সাময়িকভাবে আশা-পুরকায়স্থ তার সেবা-শুশ্রূষা করছে। এতদিনে জানা গেল—ডক্টর পিটার দত্তও অবিবাহিত—কনফার্মড ব্যাচিলার। এক ভাইঝি তাঁর সংসারের দেখভাল করে।
বাসুমামু দর্শকদলের দিকে মুখ করে একটু দূরে বসে আছেন। তাঁর মুখে পাইপ।
এমন দৃশ্যে আমি অভ্যস্ত। অনেক-অনেকবার দেখেছি। একদল সুবেশ তরুণ-তরুণী, প্রৌঢ়া-প্রৌঢ়া, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলের মুখেই ভদ্রতার মুখোশ আঁটা। আমি আমার অভিজ্ঞতায় জানি, ওদের মধ্যে একটি মানুষের মুখোশ টেনে খুলে ফেলবেন মামু। আঙুল তুলে তাকে দেখিয়ে বলবেন, এই সেই নৃশংস হত্যাকারী।
হ্যাঁ। সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। এই এতগুলি আপাতভদ্র মানুষের মধ্যে লুকিয়ে বসে আছে একজন পিশাচ। যে শয়তানটা বৃদ্ধার গমনপথে মাঝরাতে ফাঁদ পাততে দ্বিধা করে না—আর্ত মানুষের পানীয়ে বিষ মেশাতে সংকোচ বোধ করে না। হেনার মতো দু-দুটি সন্তানের জননীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে তার বুক কাঁপে না।
বাসু-মামু গলাটা সাফা করে বললেন, আপনারা জানেন, কেন আমরা এখানে সমবেত হয়েছি। আমাকে এ কাজটার দায়িত্ব দিয়েছিলেন স্বর্গগতা মিস্ পামেলা জনসন—এই মরকতকুঞ্জের প্রাক্তন মালিক। আমার অনুসন্ধানের মুখ্য উদ্দেশ্য খুঁজে বার করে দেখা—কীভাবে তাঁর মৃত্যু হলো। প্রসঙ্গত অন্যান্য কথাও আসবে। মিস জনসনের মৃত্যু চারটি সম্ভাব্য হেতুর একটি কারণে। এক : তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণই করেছিলেন। দুই : তিনি দুর্ঘটনায় মারা যান। তিন : তিনি নিজের জীবন নিজেই নিয়েছেন—অর্থাৎ আত্মহত্যা। চতুর্থ সম্ভাবনা : তিনি কোনও অজ্ঞাত আততায়ীর চক্রান্তে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
—মৃত্যুর পরে তাঁর বিষয়ে কোনও ‘ইনকোয়েস্ট’ হয়নি—অর্থাৎ পুলিসী তদন্ত। কারণ তাঁর পারিবারিক চিকিৎসক—যিনি রোগিণীকে দীর্ঘ পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন—ধরে নিয়েছিলেন মৃত্যু স্বাভাবিক কারণে। তাঁর বিশ্বাস অনুযায়ী তিনি ‘ডেথ-সার্টিফিকেট’ দিতে দ্বিধা করেননি।
—মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেললে যেটা সম্ভবপর নয়, ক্রিশ্চিয়ান অথবা মুসলমানদের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভবপর। সন্দেহের বশে মৃতদেহকে কবর থেকে খুঁড়ে বার করা হয়—’এক্সহিউম’ করা হয়। নানা কারণে আমি সে পথে যেতে চাইনি—মুখ্য হেতু আমার মক্কেলের সেটা অভিপ্রেত ছিল না বলেই আমার বিশ্বাস।
নির্মল বাধা দিয়ে বললে, আপনার মক্কেল বলতে?
মামু তার দিকে ফিরে বললেন, মিস্ পামেলা জনসন। আমি তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর তরফেই কথা বলছি। তাঁর অন্তিম বাসনার মর্যাদা দিতে। তাঁর শেষ চিঠিতে দুটি নির্দেশ ছিল পরিষ্কার : ‘সারমেয় গেণ্ডুক’-এর রহস্য উদ্ঘাটন এবং এ অনুসন্ধান কার্যের গোপনীয়তা রক্ষা। তাই এখানে কোনও বাইরের লোক নেই। সকলেই তাঁর পরিবারভুক্ত, একজন অচিরেই তা হতে চলেছেন—একজন তাঁর ওয়ারিশ এবং একজন তাঁর আকৈশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমি তাঁর লেখা চিঠিখানা প্রথমে পড়ে শোনাই। এটা উনি লিখেছিলেন তাঁর পতনজনিত দুর্ঘটনার দশদিন পরে। শুনুন—
এর পরের মিনিট দশেকের ভাষণ আমি অনায়াসে এড়িয়ে যেতে পারি—তাঁর পত্রপ্রাপ্তি এবং প্রথম অনুসন্ধানে আসার বৃত্তান্ত। কীভাবে ধাপে-ধাপে তিনি সিঁড়ির মাথায় পেরেকটা দেখেন এবং বুঝতে পারেন মিস জনসন কী ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিলেন। তারপর উনি আবার শুরু করেন, আমি বুঝতে পারি—আপাত আবোল-তাবোল চিঠির ভিতর দিয়ে মিস্ জনসন আমাকে কী বলতে চেয়েছিলেন। উনি বুঝতে পেরেছিলেন—সারমেয় গেণ্ডুকে পা পড়ায় তাঁর পদস্খলন হয়নি। উনি বুঝতে পেরেছিলেন—মৃত্যুফাঁদ পেতে কেউ ওঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল।
—কিন্তু কে সেই ব্যক্তি? মরকতকুঞ্জে সে রাত্রে ছিল নয় জন ব্যক্তি। তার ভিতর তিনজন ছিল রুদ্ধদ্ধার সৌধের বাইরে, আউট-হাউসে– ছেদিলাল, তার স্ত্রী এবং ড্রাইভার। শান্তিকে তিনি সন্দেহ করেননি, যদিও উইল মোতাবেক—তাঁর পাঁচবছর আগে করা উইলের কথা বলছি—সে কিছু পেতো। কিন্তু শান্তি এ পরিবারে আছে দশ-পনের বছর। আরও একজনকে তিনি সন্দেহ করেননি—কারণ পতনজনিত মৃত্যু হলে তার কোনও লাভ হতো না। সুতরাং বাকি রইল মাত্র চারজন। ওঁর মৃত্যুতে এই চারজনই লাভবান হতো—তিনজন প্রত্যক্ষভাবে, একজন বিবাহসূত্রে।
—মিস জনসন প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় পড়লেন। একথা পুলিসে জানানো যায় না—তাতে পারিবারিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হতে বাধ্য, কিন্তু যে ওঁর প্রাণনাশে উদ্যত হয়েছিল তাকে ক্ষমা ও করতে পারেন না। উনি মনস্থির করলেন। দু-দুটি দৃঢ়পদক্ষেপ করলেন। প্রথম : আমাকে তদন্ত করতে আহ্বান। জানালেন— গোপনীয়তার বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করে। দ্বিতীয় : উনি ওঁর অ্যাটর্নিকে একটি নতুন উইল প্রণয়ন করে নিয়ে আসতে বললেন।
—আমার দৃঢ় বিশ্বাস বাস্তবে আততায়ী যেই হোক, উনি সন্দেহ করেছিলেন একজনকেই। কারণ তিনি জানতেন তার চারিত্রিক দুর্বলতার কথা। ইতিপূর্বেই সে একবার ওঁর টাকা চুরি করেছে, চেক জাল করেছে। অপরাধপ্রবণতা হয়তো তার রক্তে— সেটা সত্যমিথা যাই হোক—মিস পামেলা জনসনের মতে সে অপরাধপ্রবণ। ঘটনাচক্রে, দুর্ঘটনার পূর্বে তার সঙ্গে ওঁর একটি জনান্তিক আলোচনাও হয়েছে। তাতে সেই সন্দেহজনক ব্যক্তি ওঁকে শাসিয়ে রেখেছে—বৃদ্ধা তাঁর টাকা আঁকড়ে বসে থাকলে তাঁর ‘ভালমন্দ’ কিছু হয়ে যেতে পারে। বাস্তবে অপরাধী যেই হোক না কেন—মিস্ পামেলা জনসন সিদ্ধান্তে এলেন : মৃত্যুফাঁদটা সেই পেতেছিল।
—তার তাই প্রথম সুযোগেই তিনি সেই সন্দেহভাজন ব্যক্তিটিকে বলেছিলেন দ্বিতীয় একটি উইল করার কথা। পাছে সে মনে করে এটা একটা ফাঁকা হুমকি তাই তাকে উইলটা দেখিয়েও দিয়েছিলেন। উনি প্রকারান্তরে সেই সম্ভাব্য হত্যাকারীকে বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেন—তাঁর মৃত্যুতে তার কোনো লাভ হবে না।
—বৃদ্ধা ভালভাবেই জানতেন—দ্বিতীয় সম্ভাব্য আততায়ী ঐ ব্যক্তির নিকটজন। আশা করেছিলেন—এ ওকে জানাবে।
—কিন্তু দেখা যাচ্ছে তা হয়নি। অর্থাৎ যে ব্যক্তি স্বচক্ষে উইলটা দেখেছিল সে তার নিকটতম আত্মীয়াকে সেকথা জানায়নি। প্রথম সন্দেহভাজন ব্যক্তি…
এখানে সুরেশ বাধা দিয়ে বলে ওঠে, লুক হিয়ার মিস্টার বাসু। ব্যাপারটা এমনিতেই জটিল—আপনি আর তাকে ক্রমাগত ভাববাচ্যে জটিলতর করে তুলবেন না। সরাসরি ‘প্রপার নেম’ ব্যবহার করলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।
বাসু সকলের দিকে ফিরে বলেন, আমি সৌজন্যরক্ষা করতেই আকারে ইঙ্গিতে কথা বলছি। আপনারা যদি অনুমতি দেন…
আবার সুরেশই বলে ওঠে, ওটুকু নলচের আড়ালে সৌজন্য আদৌ রক্ষিত হচ্ছে না বাসু-সাহেব। উপস্থিত পঞ্চজন জানেন, কোন হতভাগ্য মিস জনসনের চেক জাল করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়, জানে-এক্সকিউজ মি পিটার কাকা ফর বিইং ক্যান্ডিড—আপনার অনুমান-মোতাবেক কোনো বৃদ্ধ পারিবারিক চিকিৎসক বুদ্ধুর মতো ভুল ডেথ-সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন—
মামু এবার ডক্টর দত্তের দিকে ফিরে বলেন, আপনি কী বলেন? আমি খোলাখুলি আলোচনা করবো?
বৃদ্ধ গলাটা সাফা করে নিয়ে বলেন, আমি সুরেশের সঙ্গে একমত। সৌজন্যের নলচের আড়ালে কিছুই ঢাকা পড়ছে না। আপনি খোলাখুলিই সব কথা বলুন। তবে এই সুযোগে আমি আপনাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রাখছি—পামেলার মৃতদেহ ‘এক্সহিউম’ করে আপনি প্রমাণ করতে পারবেন না—আর্সেনিক পয়েজিনিং-এ তার মৃত্যু হয়েছিল। আমি অবশ্য খুবই মর্মাহত হবো কবরের শান্তি বিঘ্নিত হলে—কিন্তু আমি বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, আমি তা সহ্য করবো।
—না ডক্টর দত্ত, আমি মিস জনসনের দেহ কবর থেকে তুলবার প্রস্তাব করিনি, করছি না। দুটি কারণে, প্রথমত আমার মক্কেল—যদি পরলোক থাকে—তাহলে এটা কিছুতেই অনুমোদন করবেন না। দ্বিতীয়ত—মৃতদেহকে নাড়াচাড়া না করেই আমি আততায়ীকে চিহ্নিত করেছি, প্রমাণ পেয়েছি। সে কথাই বলবো। যে কথা বলছিলাম : মিস্ জনসন সন্দেহ করেছিলেন, তাঁর ভাইপো সুরেশকে। তাই তাকে দ্বিতীয় উইলখানি দেখতে দেন। আশা করেছিলেন—সে মিস্ হালদারকে সে কথা জানিয়ে দেবে।
—এখানে আমার অনুসন্ধানে দুটি ধারা দেখা দিল। সুরেশ বারে বারে বলেছিল সে এ-কথা তার বোনকে জানায়, আর স্মৃতিটুকুও দৃঢ়স্বরে জানায় যে, সুরেশ তাকে বলেনি। স্পষ্টতই একজন মিথ্যা কথা বলেছে। কে বলেছে? আমি সিদ্ধান্তে এলাম—মিথ্যাভাষণ করেছিল সুরেশ। যুক্তি? টুকুর মিথ্যা কথা বলার কোনও যৌক্তিকতা নেই। বরং সে যদি বলতো যে সুরেশ তাকে জানিয়েছিল, তাহলে তার সুবিধা হতো। তাকে আমি জানিয়েছিলাম যে, আমার মতে মিস্ জনসনের মৃত্যু অস্বাভাবিক—তাঁর দেহ ‘এক্সহিউম’ করার কথা হচ্ছে। সে নিজে দোষী হলে বরং মিথ্যা করেও বলবে যে, সুরেশ তাকে জানিয়েছিল দ্বিতীয় উইলটার কথা। সেটা টুকুর জানা থাকলে তাকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে হয়। ফলে টুকু মিথ্যা কথা বলেনি। এখন দুটি সম্ভাবনা—সুরেশ মিথ্যা কথা বলেছে নিশ্চয়, কিন্তু কোনটা মিথ্যা? সে দ্বিতীয় উইলটা দেখেছে বোনকে বলেনি অথবা আদৌ দেখেনি, আমাকে মিথ্যা করে বললে যে, দেখেছে। দ্বিতীয় সম্ভাবনা বাতিল করতে হলো মিনতির স্টেটমেন্ট থেকে। মিস জনসন যে-ভাষায় কথা বলেছিলেন ঠিক সেই ভাষাতেই মিনতি আমাকে ঘটনাটা জানিয়েছিল। অর্থাৎ মিনতি কথোপকথনটা স্বকর্ণে শুনেছে। হয় ঘটনাচক্রে অথবা আড়ি পেতে। তার মানে সুরেশ উইলটা দেখেছে, কিন্তু টুকুকে সে কথা জানায়নি।
কেন? একটাই হেতু। ‘গিল্ট কশাস্’–অপরাধী মনোভাবাপন্ন। সে বুঝতে পেরেছিল, তার জন্যে বড়পিসি উইলটা পালটে ফেলেছে। ফাঁদটা সে পাতুক না পাতুক তাকে সন্দেহ করেই—নোট সরানো, চেক জাল করা অথবা ‘ভালমন্দ’ বিষয়ে হুমকি দেওয়ায় বড়পিসি দ্বিতীয় উইল করে সবাইকে বঞ্চিত করেছেন। লজ্জায় সে কথা সে বোনের কাছে স্বীকার করতে পারেনি।
—কিন্তু মৃত্যুফাঁদটা তাহলে কে খাটালো? যে কয়জনকে সন্দেহের তালিকায় রাখা গেছে তার মধ্যে একমাত্র মিনতি মাইতির কোনও লাভ হতো না সে রাত্রে মিস্ জনসনের মৃত্যু হলে। অথচ ঘটনা এমন যে, মৃত্যু না হলে ঐ পতনজনিত দুর্ঘটনার ফলে একমাত্র সেই লাভবান হলো। যদি ধরে নিই মিনতিই ফাঁদটা পেতেছিল…
আর সহ্য হল না মিনতির। সে গর্জে ওঠে : থামুন। কী যা তা বলছেন….
—একটু ধৈর্য ধরে শোনো মিনতি, আমি কী বলতে চাই—
—কী শুনবো? বলি, শুনবোটা কী? আপনি ক্রমাগত যা নয় তাই বলে যাবেন…
মামু ওর কথায় কর্ণপাত না করে বলে চলেন, তাহলে তার একটাই উদ্দেশ্য হতে পারে—মিস্ জনসনের মন তাঁর পরিবারবর্গের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তোলা। সেক্ষেত্রে সে কিছুতেই ঐ তথ্যটা তার ম্যাডামের কাছ থেকে লুকোতে চাইতো না—অর্থাৎ ফ্লিসি সে রাত্রে বাইরে ছিল। খবরটা জানলেই কর্ত্রীর মন তাঁর পরিবারভুক্তদের বিরুদ্ধে বিষিয়ে উঠতো। আমি একাধিক সূত্র থেকে জেনেছি—মিনতি বরং খবরটা গোপন রাখতেই চেয়েছে। ফলে, মিনতি ঐ ফাঁদটা পাতেনি। মিনতি নির্দোষ।
যুক্তির সারবত্তা ও গ্রহণ করতে পারলো কিনা বোঝা গেল না। কিন্তু শেষ পংক্তির অর্থগ্রহণ হলো তার। সংক্ষেপে বললে, ধন্যবাদ।
—এইখানে আর একটা ‘সাইড-ইস্যু’ এসে যাচ্ছে : আর্সেনিক প্রসঙ্গ।
উনি ছেদিলালের সঙ্গে কথোপকথন, তার কৌটার সিল খোলার কথা বিস্তারিত বললেন, এবং সুরেশ যে ‘আর্সেনিক’ শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে হঠাৎ ‘স্টিকনিন ‘ বলেছিল তাও।
এবার ভেঙে পড়লো সুরেশ নিজেই। বললে, আমরা…আমরা বোধহয় সবাই কমবেশি পাষণ্ড! অন্যের কথা জানি না—নিজের কথা বলি—ছেদিলালের কৌটোটা দেখে আমার লোভ হয়েছিল। কতটা ‘উইড-কিলার’ খেলে মানুষের মৃত্যু হয় তাও ওর কাছে জানতে চেয়েছিলাম—কিন্তু বিশ্বাস করুন…না, আয়াম সরি…এ পর্যন্ত আমার যে চরিত্রচিত্রণ হয়েছে, তাতে ‘বিশ্বাস করুন’, শব্দটা উচ্চারণ করার অধিকার আমার নেই!
দুহাতে মুখ ঢেকে বসে থাকে সুরেশ
এবার হঠাৎ স্মৃতিটুকু বলে ওঠে, তোর ঐ কথাটা খাঁটি—আমরা বোধহয় সবাই পাষণ্ড। আমার যে চরিত্রচিত্রণ হয়েছে, তাতে আমিও নিজেকে বিশ্বাসভাজন বলে দাবি করতে পারি না। কিন্তু মিথ্যা অপরাধ তোর স্কন্ধেও চাপতে দেব না রে সুরেশ!… হ্যাঁ, ছেদিলালের সিলড-টিন খুলে ঐ ‘আর্সেনিক বিষ’ আমিই সরিয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন…আয়াম সরি! কথাটা আমারও নাগালের বাইরে।
এবার বাসু-মামু বলে ওঠেন, আমি তোমাদের দুজনের কথাই বিশ্বাস করেছি। কারণ——য়ু আর পার্ফেক্টলি রাইট ডক্টর দত্ত—আর্সেনিক বিষে মিস জনসনের মৃত্যু হয়নি।
সুরেশ আর টুকুর অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় হলো। আমার স্পষ্ট মনে হলো, ওরা দুজনেই দুজনকে সন্দেহ করছিল। তাই টুকু বলেছিল—সুরেশ বোম্বাই চলে গেছে। আর তাই সুরেশ ভাবছিল—টুকুকে দ্বিতীয় উইলটার কথা না-বলা চূড়ান্ত মূর্খামি হয়েছে তার
মামু তাঁর বিশ্লেষণে ফিরে এলেন : এবার মিস্ জনসনের মৃত্যুর প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সচরাচর দেখা যায়, প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে আততায়ী দ্বিতীয়বার সে চেষ্টা করে। এখানে বলি, একটি তথ্য আমি সংগ্রহ করেছিলাম একাধিক সূত্র থেকে। মৃত্যুর তিন দিন আগে মিস্ জনসন প্ল্যানচেটে বসেছিলেন। মিনতি বিশ্বাসী—সে একটা স্বর্গীয় আভা দেখতে পায়। কিন্তু মিস্ ঊষা বিশ্বাস অবিশ্বাসী—তিনি অতি ধূর্ত, বিচক্ষণ। তাঁর বর্ণনা মোতাবেক—কোট ‘প্রথমত রিবনদুটি স্পষ্টতই ওর মুখ থেকে বার হয়েছে। দ্বিতীয়ত ধূপের ধোঁয়া হয় নীলচে-সাদা রঙের। এ দুটি হলুদ-রঙের। তৃতীয়ত রিবনদুটি লুমিনাস, আই মীন, প্রোজ্জ্বল, দীপ্তিময় ঝলমলে বা চক্চকে নয়। স্নিগ্ধ, দ্যুতিমান, প্রভাময়—জোনাকির আলো হলুদরঙের হলে যেমনটা দেখাবে’ আনকোট। মিস্ বিশ্বাস স্কুলে বাংলা আর ইতিহাস পড়াতেন। তার বদলে যদি তিনি বিজ্ঞানের ছাত্রী হতেন তাহলে ঐ বিস্তারিত বর্ণনা একটি মাত্র বাক্যে সংক্ষেপিত করতেন : ‘মিস্ জনসনের নিশ্বাস ছিল ফসফোরেসেন্ট।’
নির্মল একটু নড়েচড়ে বসলো। মামু তার দিকে ফিরে বলেন, হ্যাঁ তুমি ঠিকই ধরেছ নির্মল-আর্সেনিক নয়, ফসফরাস। ফসফরাসের টক্সিক এফেক্টকে অনেক সময় মনে হয় ইয়োলো অ্যাট্রপি অব দা লিভার’। বিষ হিসাবে ফসফরাস দুর্লভ নয়, একরকম দেশলাই কাঠির মাথাতেই পাওয়া যায়। এক গ্রেনের শতভাগ থেকে ত্রিশভাগ হচ্ছে, ‘ফেটাল ডোজ’। অর্থাৎ বিষটা যে প্রয়োগ করেছে সে রসায়ন বিজ্ঞান সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল।
—সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের মধ্যে দু’দুজন ডাক্তার আছেন। কিন্তু নিতান্ত ঘটনাচক্রে আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো অন্য একজনের উপর। বি-এস-সি-তে রসায়নে অনার্স নিয়ে সে দু’দুবার পরীক্ষা দিয়েছে। তার বাবা ছিলেন রসায়নের অধ্যাপক। আমি তার সঙ্গে দেখা করলাম। প্রথম দর্শনেই মনে হল সে আতঙ্কগ্রস্তা। কেন? মিস্ জনসনের ‘মৃত্যু’ সম্বন্ধে খোঁজ নিতে এসেছি শুনে সে খণ্ডমুহূর্তের জন্য শিউরে উঠেছিল। যে মুহূর্তে আমি বুঝিয়ে বললাম—না মৃত্যু নয়, তাঁর উইলের প্রসঙ্গে আমি আলোচনা করতে এসেছি, অমনি তার অন্য মূর্তি। সে ভাব দেখালে—প্রীতমকে সে দারুণ ভয় পায়। ধীরে ধীরে সে আমাকে বিশ্বাস করাতে চাইছিল—যাতে আমি তার স্বামীকে সন্দেহ করি। কেন?
–হেনার চরিত্রটা আমি বিশ্লেষণ করলাম। আমার মনে হল প্রীতমকে সে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে—ভালবেসে নয়। সাজে-পোশাকে সে যাদের আকর্ষণ করতে চেয়েছিল তাদের কাউকে ও ধরে রাখতে পারেনি। মিস্ জনসন বা মিস্ বিশ্বাসের মতো অবিবাহিত জীবন কাটাতে চায় না বলেই সে বাধ্য হয়ে প্রীতমকে বিবাহ করেছিল—এটাই মনে হলো আমার। ক্রমে সে প্রীতমের উপর প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে ওঠে। স্মৃতিটুকুর মতো সাজ-পোশাক করতে চায় সে—পার্টিতে যেতে চায়, গ্ল্যামারাস হতে চায়। মজঃফরপুরে সেসব কিছুই নেই। তাছাড়া প্রীতম শেয়ার-মার্কেটে তার স্ত্রীধন নষ্ট করে ফেলায় ওর মন একেবারে বিষিয়ে উঠলো। ইতিমধ্যে দুটি সন্তান হয়েছে তার। লেডি ম্যাকবেথের যেমন ছিল একটি কন্যাহৃদয়, ওর তেমনই ছিল একটি মাতৃহৃদয়। ও প্রীতমের নাগপাশ ছিন্ন করে স্বয়ম্ভর হতে চাইলো। কলকাতায় টুকুর মতো অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে সে থাকবে। তার টাকার দরকার। একমাত্র পথ—মিস্ জনসনের আশু মৃত্যু। অনেকেই জানে না—মিস্ জনসনের উইল মোতাবেক হেনা সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ পেতো না—পেতো অর্ধেক এ তথ্যটা সে বোধহয় জানতো। ফসফরাস বিষের লক্ষণ যেন জনডিসের অনুরূপ এ তথ্যটাও তার জানা। বিহার থেকে আসার সময়েই সে ঐ ‘ফসফরাস’ সংগ্রহ করে এনেছিল। কিন্তু মরকতকুঞ্জে পৌঁছে একটি সহজতর সমাধান ওর নজরে পড়ে; সারমেয় গেণ্ডুক। সিঁড়ির মাথায় মৃত্যুফাঁদটা সেই পেতেছিল—
মিনতি বাধা দিয়ে বলে ওঠে, কিন্তু আমি সে-রাত্রে স্পষ্ট দেখেছিলাম…
বলছি সে-কথা। তুমি থামো। কথা বোলো না। মিনতি আমাকে জানিয়েছিল যে, দুর্ঘটনার রাত্রে বা তার পূর্বরাত্রে সে স্বচক্ষে দেখেছিল স্মৃতিটুকুকে ঐ পেরেকটা পুঁততে, অথবা নিচু হয়ে কিছু করতে। ব্যাপারটা বিস্তারিত বলি—
এরপর উনি সমস্ত ঘটনাটা জানালেন, মায় টুকুর দৃঢ় অস্বীকার। বললেন, মিনতির ঐ স্টেটমেন্ট শুনেই আমার মনে হয়েছিল—জবানবন্দির ভিতর কিছু আপাত-অসঙ্গতি আছে—যা হবার নয়, তাই বলা হচ্ছে। সেটা যে কী, তা বুঝতে পারিনি। পরে ঘটনাচক্রে একদিন আয়নার সামনে ওই ব্রোচটা ধরায় আমার সমস্ত সংশয় দূরীভূত হলো। মিনতি টুকুকে সনাক্ত করেছিল তার নীলরঙের নাইটি দেখে। আর ঐ T. H. নাম লেখা ব্রোচটা দেখে। না হলে অত কম আলোয় ঘুমঘুম চোখে তার পক্ষে সনাক্ত করা সম্ভব হতো না।
—ঘটনাচক্রে আয়নার সামনে ঐ ব্রোচটা ধরতেই আমার নজর পড়লো প্রতিবিম্বে অক্ষর দুটি উলটে গেছে—T. H. নয়, H. T.
—হেনা টুকুর নকল করতো, পোশাকে-আশাকে। তারও ছিল অনুরূপ নীল নাইটি। সেও টুকুর অনুকরণে কিনেছিল অনুরূপ ব্রোচ—H. T., হেনা ঠাকুর। কিন্তু সাজসজ্জা বিষয়ে তার কোনও রুচি ছিল না। তাই নাইটি পরেও কাঁধে ব্রোচ আটকেছিল—সে ভুল কিছুতেই করতে পারে না নিখুঁত সজ্জা-পারদর্শী স্মৃতিটুকু হালদার। রাতে নাইটির উপর ব্রোচ আটকানো!
—হেনা ফাঁদ পাতলো। তাতে মিস্ জনসনের মৃত্যু হলো না। তিনি যে উইলটা বদলে ফেলেছেন তা হেনাকে জানাননি, কারণ তাঁর সূদুর কল্পনাতেও ছিল না—হেনা একাজ করতে পারে। এবার হেনা তার মূল পরিকল্পনা রূপায়িত করলো। অতি সহজ পদ্ধতিতে। মিস্ জনসনের বাথরুমে ক্যাপসুলের একটি খুলে ‘ফসফরাস’ ভরে দিল—ওষুধটা ফেলে দিয়ে। হেনা জানতো দিন পাঁচ-সাতের মধ্যেই ঐ ক্যাপসুলটা উনি খাবেন। তখন সে অকুস্থল থেকে অনেক দূরে। তাই সে আর মরকতকুঞ্জে একবারও আসেনি।
—হেনা ওখানেই থামেনি। বড়মাসির মৃত্যুর পর সে মর্মাহত হয়ে যায়। দেখে, সে সফল হয়েও ব্যর্থকাম! এখন সে অন্যপথে চলতে শুরু করলো। মিনতি মাইতির হৃদয় জয়। লক্ষ করে দেখলাম—একমাত্র প্রায় সমবয়সী সেই মিনতি মাইতিকে ডাকে ‘মিন্টিদি’ বলে, ‘আপনি’ বলে কথা বলে—যা বলে না প্রায় সমবয়সী সুরেশ বা টুকু। আর সেজন্যই সে সুরেশ-টুকুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে মিনতির বিরুদ্ধে উইল-সংক্রান্ত মামলায় যেতে চায়নি। ওর তখন দুটি লক্ষ্য। এক : প্রীতমের কবলমুক্ত হওয়া সন্তানের অধিকার সমেত। দুই : মিনতির সেন্টিমেন্টে আঘাত করে কিছু অংশ ফিরে পাওয়া।
—হেনা এবার পাগলামোর অভিনয় শুরু করলো। তার স্বামী তাকে ভালবাসে, তাকে মনোবিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা করাতে চায়। এটাই হলো হেনার তুরুপের টেক্কা। সে ধীরে ধীরে আমাকে বিশ্বাস করাতে চাইছিল যে, বিষপ্রয়োগ করেছে প্রীতম নিজেই! তার প্ল্যানটা ছিল অত্যন্ত মারাত্মক। স্বামীর সই জাল করে সে বেশ কিছু ‘কামপোজ’ ট্যাবলেট কিনে নিজের কাছে রেখেছিল। আমার বিশ্বাস দৃঢ়মূল হয়েছে বুঝলেই সে স্বামীকে ঐ ঘুমের ঔষধটা ভুলিয়ে ভালিয়ে খাইয়ে দিতো। সবাই ধরে নিতো ডক্টর প্রীতম ঠাকুরই হত্যাকারী—পি. কে. বাসুর হাতে ধরা পড়ার ভয়ে সে আত্মহত্যা করেছে।
প্রীতম একটা আর্তনাদ করে দুহাতে মুখ ঢাকে। তারপর সংযত হয়ে বলে, তাই…সেদিন আপনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কামপোজের কথা?
—হ্যাঁ, আমি তোমাদের দুজনকে পৃথক করতে চেয়েছিলাম। দ্বিতীয় হত্যা ঠেকাতে চেয়েছিলাম।
প্রীতম রুদ্ধকণ্ঠে বলল, যেদিন ও রাগ করে বাড়ি ছেড়ে সকালবেলা বেরিয়ে যায় সেদিন তুচ্ছ কারণে আমরা ঝগড়াঝাঁটি করেছিলাম। ও আমাকে এক গ্লাস সরবৎ খেতে দিয়েছিল, ওর মুখ দেখে আমার কেমন সন্দেহ হয়েছিল—ওর পাগলামির কথা জানতাম, তাই ভেবেছিলাম ও কিছু বশীকরণের শিকড়-বাকড় খাওয়াতে চাইছে আমাকে। আমি রাগ করে সরবটা ফেলে দিয়েছিলাম।
—এমনটা ঘটতে পারে তা আমি জানতাম। তাই আমি একটা চিঠিতে সব কিছু লিখে হেনাকে পড়তে দিয়েছিলাম—তাকে জানতে দিয়েছিলাম যে, তার ‘গোপনকথা’ আমি জানি।
—মাই গড! তাই সে আত্মহত্যা করেছে! তাই পুলিসে বলছিল, মৃত্যুর আগে হেনা কিছু কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলেছে। কাগজ পোড়া ছাই ছিল ওর ঘরে।
বাসু প্রীতমের কাঁধে একটা হাত রেখে বলেন, এটাই সব থেকে ভালো হল নাকি? আমি ওকে আত্মহত্যা করার কথা বলিনি। শুধু জানিয়েছিলাম—মীনা আর রাকেশের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। সিদ্ধান্তটা হেনা নিজেই নিয়েছে। এছাড়া তার গত্যন্তর ছিল না। এটাই দরকার ছিল প্রীতম। নাহলে একের পর এক দুর্ঘটনা-জনিত অপমৃত্যু ঘটত। প্রথমে তুমি। তারপর মিনতি—যখন ওরা জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খুলতো।
মিনতি উঠে দাঁড়ায়। বলে, বাসু-মামু, এবার আমিও আমার কথাটা বলি। সুরেশদা যে কথা বলেছে তা নিয্যস সত্যি—আমরা সবাই কম-বেশি পাষণ্ড। আমি…আমিও কিছু পাপ-কাজ করেছি।
বাসু বাধা দিয়ে বলেন, জানি, মিনতি। মৃত্যুর ঠিক আগে মিস্ জনসন তোমাকে বলেছিলেন উইলখানা নিয়ে আসতে। আর তুমি মিথ্যে করে বলেছিলে, কাগজখানা উকিলবাবুর কাছে আছে। তাই নয়? তার মানে তুমি ম্যাডামের অগোচরে আলমারি ঘেঁটে দেখেছিলে।
মিনতি দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁটে ওঠে। বলে, আমিও ধোওয়া তুলসীপাতাটি নই। আমি লুকিয়ে আলমারি খুলেছিলাম, জানতাম ঐ উইলের কথা—বুঝতে পেরেছিলাম—উনি সেটা ছিঁড়ে ফেলতে চান। আমি জন্মদুখিনী…কিন্তু উইল পড়ে আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি—বিশ্বাস করুন—যে সম্পত্তিটার পরিমাণ এত! আমি ভেবেছিলাম দশ-বিশ হাজার টাকা! তারপর থেকে রাতে আমার ঘুম হয় না। আমার সব সময়ে মনে হয়, আমি তঞ্চকতা করেছি—সবাইকে ঠকিয়ে যা আমার হক্কের ধন নয়…
বাসু বললেন, তুমি কি মীনা আর রাকেশকে কিছু দিতে চাও?
—শুধু ওদেরই নয়। সুরেশদা, টুকুদি এদের কাছেও আমি অপরাধী হয়ে আছি। আপনি মধ্যস্থ হয়ে একটা বিলিব্যবস্থা করে দিন। মীনা আর রাকেশ এই মরকতকুঞ্জেই মানুষ হতে পারে—প্রীতমভাই যদি রাজি হয়। নাহলে, কবরে শুয়েও ম্যাডাম শান্তি পাবেন না।
মামু ডক্টর দত্তের দিকে ফিরে বলেন আপনি আমার মক্কেলকে পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে ঘনিষ্ঠভাবে চিনতেন। বলুন, কী ব্যবস্থা নিলে মিস্ পামেলা জনসন খুশি হতেন?
পিটার দত্ত বললেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস—ঊষাও তাই বলে—পামেলা ঐ দ্বিতীয় উইলটা বানিয়েছিল অন্তিমে ছিঁড়ে ফেলার জন্যই। মিন্টি যখন নিজে থেকে আপনাকে দায়িত্ব দিচ্ছে তখন আপনি মধ্যস্থ হয়ে একটা বিলি ব্যবস্থা করে দিন। নির্মলের পেটেন্টটা যাতে নেওয়া যায়, সুরেশ আর টুকু যাতে পামেলার ক্ষমাসুন্দর আশীর্বাদ পায়, আর প্রীতমকে আমি একটা সাজেশান দিতে চাইছি : সুদূর মজঃফরপুরে পড়ে থাকার কী দরকার তার? আমি আর কদিন? নির্মলও মেরীনগরে থাকবে না, এখানে ভাল ডাক্তার নেই। ও যদি মরকতকুঞ্জেই এসে বসবাস করে তাহলে আমার প্র্যাকটিসটা ওর হাতে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারি। অবশ্য তার বয়স কম, সে যদি দ্বিতীয়বার বিবাহ করে….
প্রীতম মাঝখানেই বলে ওঠে, মীনা আর রাকেশকে মানুষ করে তোলাই এখন আমার জীবনের লক্ষ্য। দ্বিতীয়বার বিবাহের প্রশ্নই ওঠে না। বাকি জীবনটা আমি আমার হতভাগিনী স্ত্রীর স্মৃতি নিয়েই কাটিয়ে দিতে চাই। এখানে সর্বসমক্ষে আমার স্ত্রীকে নগ্ন করা হয়েছে—আমি প্রতিবাদ করতে পারিনি—বাট য়ু টু ডক্টর্স উড অ্যাপ্রিশিয়েট-সে সত্যিকারের শয়তানী ছিল না। সে একটা অবসেশনে ভুগছিল—ইটস্ আ মেন্টাল ডিজিজ! হ্যাঁ, সুরেশ ঠিক বলেছে—আমরা সবাই কমবেশি পাষণ্ড—কিন্তু ‘হানি’ তা ছিল না—শি ওয়াজ জাস্ট আ পেশেন্ট!
বাসুমামু আজ অনেক অনেক ভেল্কি দেখিয়েছেন—কিন্তু আমার মনে হল, শেষ চমকটা দিল ঐ প্রাণবন্ত পাঞ্জাবী তরুণটি।
‘হানি’র প্রতি তার ভালবাসায় একতিলও মালিন্য স্পর্শ করেনি।
২৬
ডাক্তার পিটার দত্তের পীড়াপীড়িতে ফেরার পথে তাঁর বাড়িতে একবার যেতে হলো।
মিস বিশ্বাস আজকের অধিবেশনে উপস্থিত থাকতে পারেননি— শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায়, কিন্তু তাঁর উৎসাহ নাকি কারও চেয়ে কম নয়। মামুর অনুরোধে ডক্টর দত্ত এ কয়দিন ‘মিস মার্পল অব মেরীনগরকে কোনওক্রমে শান্ত করে রেখেছেন। এখন যদি তাঁর সঙ্গে দেখা না করে আমরা ফিরে যাই তাহলে তিনি মর্মাহত হবেন। ডক্টর দত্তের শেষ যুক্তি : রোগীর মানসিক শান্তির জন্যও এটুকু করা দরকার।
মামু বললেন, শ্যিওর! উনি আমার দিদির মতো, চলুন যাই। ‘
আমাদের দেখতে পেয়ে শয্যালীন বৃদ্ধা বললেন, শেষ-মেশ এমন দিনে এলে ভাই যে, আমি বিছানায় শুয়ে। কেক-কুকি কিছুই বানিয়ে রাখতে পারিনি।
ডাক্তার সাহেবের ভাইঝি দাঁড়িয়ে ছিল ওঁর বিছানার পাশে। বললে, তাতে কী? আমি তো আছি। ও বেলা পুর করে রেখেছি, জানতাম ওঁরা আসবেন। এখনি গরম গরম ভেজে আনছি। কফি না চা?
মামু বললেন, কফি। কিন্তু র। দুধ-চিনি বাদ। শুধু আমারটা।
আশা পুরকায়স্থও উপস্থিত ছিল। হাত তুলে নমস্কার করলো। সেও চলে গেল ভিতর দিকে। বোধ করি সাহায্য করতে।
বৃদ্ধাও বললেন, পিটার, মিস্টার টি. পি. সেনের জন্য যেটা আনিয়ে রেখেছি সেটা নিয়ে এসো।
পিটার আদেশ তামিল করতে গেলেন। মামু বলেন, আমার জন্য আবার কী আনিয়ে রেখেছেন? প্রেজন্টেশান?
উনি জবাব দেবার আগেই ডক্টর দত্ত ফিরে এলেন। তাঁর হাতে কৃষ্ণনগরী মাটির পুতুল। একজন বলিষ্ঠ গঠন নগ্ন যুবক কব্জিতে থুতনি রেখে কী ভাবছে। বিখ্যাত ভাস্কর্যের মিনিয়েচার-কপি : দ্য থিংকার।
মিস্ বিশ্বাস বলেন, তুমি পেশায় সাংবাদিক, চিন্তাজগতের মানুষ। তাই তোমার জন্য ঘূর্ণী থেকে আনিয়ে রেখেছি। টেবিলে সাজিয়ে রেখো, আমার কথা মনে পড়বে।
অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে মামু উপহারটা গ্রহণ করলেন।
বৃদ্ধা বলেন, শুনলাম তুমি আংক্ল্ যোসেফের জীবনীটা লিখবে না বলে স্থির করেছ? সত্যি?
মামু হেসে বলেন, সত্যি। আংকল হ্যারল্ডের ডায়েরিটা পড়ে মনে হল আপনি ঠিকই বলেছেন—কোমাগাতামারু জাহাজের সঙ্গে যোসেফ হালদারের কোনো সম্পর্ক ছিল না। দুজনেই বুঝছেন। তবু কথাবার্তা চলেছে ঠারে-ঠারে! ‘আউল-বাউল’-এর সাঙ্কেতিক ভাষায়। ঊষা বললেন, আঙ্কল যোসেফের মেয়ের দেহটা ‘এক্সহিউম’ না করেই যে সেটা তুমি বুঝে উঠতে পেরেছ এটাই আনন্দের। সেটা করলে আমরা সবাই মর্মাহত হতাম—আমি, পিটার আর পামেলা।…শুনলাম হেনা ভুল করে বেশি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেছিল। বেচারি হেনা! তা প্রীতম কী স্থির করল? মরকতকুঞ্জে এসে থাকবে?
শেষ প্রশ্নটা পিটার দত্তকে। মনে হলো, এ নিয়ে বুড়োবুড়ি আগেই আলোচনা করেছেন। পিটার গ্রীবা সঞ্চালনে জানালেন—প্রীতম রাজি হয়েছে।
বৃদ্ধা খুশি হলেন। বাল্যবন্ধুকে বললেন, তাহলে তোমার ছুটির ঘণ্টাও এবার বাজলো?
—তাই তো আশা করছি।
এবার বৃদ্ধা মামুর দিকে ফিরে বললেন, আই কনগ্র্যাচুলেট য়ু। কাজটা হাসিল করেছ অথচ ডার্টি লিনেল সর্বসমক্ষে ঝাড়তে হলো না। কী করে সবার পেটের কথা বার করলে জানতে দারুণ কৌতূহল হচ্ছে, কিন্তু না, আমি জানতে চাইবো না।
মামু আগ বাড়িয়ে বলেন, জাতে সাংবাদিক যে! সকলের সব কথাই আমার মনে থাকে, তার ঠিক ইন্টারপ্রিটেশান করতে পারি।
—নাকি? একটা উদাহরণ দাও?
যেমন ধরুন, ‘ডিটেকটিভ’ শব্দটার বাংলা পরিভাষা যে ‘টিকটিকি’ এই সোজা কথাটা না বুঝতে পারায় একবার এক বৃদ্ধ যে ভাষায় ধমক খেয়েছিলেন তার কারেক্ট ইন্টারপ্রিটেশন শ্রোতা করতে পেরেছিলেন কি না জানি না, আমি বুঝতে পেরেছিলাম।
রীতিমতো চমকে উঠলেন উনি। আমতা-আমতা করে বলেন, মাই গড! তুমি….তুমি তা কেমন করে জানলে? সে তো টেলিফোনে কথা—
—ঐ যে বললাম, জাতে সাংবাদিক যে। প্রায় গোয়েন্দার মতো।
—কী? কী ভাষায় ধমক খেয়েছিল সেই বৃদ্ধ?
—কোট ‘আমার কথা তো পঞ্চাশ বছর ধরে তুমি বুঝতে পারলে না ডট্ ডট্ ডট্! সে আবার আজ নতুন করে কী বুঝবে?” আনকোট!
বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে গেল ঊষা বিশ্বাসের চোখ দুটো। বাক্যটার কী ইন্টারপ্রিটেশন’ ঐ সাংবাদিক ভদ্রলোক করেছেন তা আর জানতে চাইলেন না। মামু মিটিমিটি হাসতে থাকেন। ঊষা বলেন, না! তুমি সাংবাদিক নও। য়ু আর এ জুয়েল অব আ স্মুথ। আ জিনিয়াস! এয়ারকুল পয়রো! চেনো তাঁকে? নাম শুনেছো?
মামু সে-কথার জবাব না দিয়ে একটি প্রতিপ্রশ্ন করেন। বলেন, ক্রমাগত আপনিই বা প্রশ্ন করে যাবেন কেন? এবার আমার প্রশ্নের জবাব দিন দেখি, আপনি মেরি রোজ-ব্যুরের নাম শুনেছেন? চেনেন মেয়েটিকে?
মিস্ বিশ্বাস অবাক হলেন। বলেন, মেরি রোজ-ব্যুরে? ফ্রেঞ্চ?
—হ্যাঁ। ফরাসী মহিলা। জন্ম 1844। ফ্রান্সের লোরেন অঞ্চলের বাসিন্দা।
অনেকক্ষণ চোখ বুজে ভাবলেন। তারপর বললেন, আর দু-একটা ক্লু!
—অত্যন্ত সুন্দরী। মাথায় সোনা-গলানো চুল। আনপড়। নিজের নাম সই করতে পারতেন না। আপনি আমাকে যে মূর্তিটা দিলেন—’দ্য থিংকার’, তার অরিজিনাল তাঁর সঙ্কলনে ছিল।
মাথা নেড়ে বললেন, ফেল মারলাম। বলে দাও। কে ঐ মেরী রোজ-ব্যুরে?
—মৃত্যুর মাত্র উনিশ দিন আগে তাঁর পদবীটা বদলে গেছিল। মৃত্যু সময়ে তাঁর নাম : মেরি রোজ-রোদ্যাঁ। অগ্যস্ত রেনে রোদ্যার সহধর্মিণী। তাঁর যখন বিবাহ হয় তখন তাঁর বয়স সত্তর, রোদ্যার সাতাত্তর। পঞ্চাশ নয়, পাক্কা তিপ্পান্ন বছর ধরে অগুস্ত রেনে রোদ্যাঁ সেই মহিলাটির কী একটা কথার অর্থ বুঝে উঠতে পারেননি।
মুখ চোখ লাল হয়ে উঠল শয্যালীন বৃদ্ধার। ক্রমে সামলে নিলেন। ডাক্তার দত্তের দিকে ফিরে বললেন, ছোকরার মুখের কোনও আড় নেই!
মামু বলেন, ছোকরা! আমার বয়স কত জানেন?
—জানি। সত্তর বছর বয়সে মেরি রোজ যদি ওয়েডিং গাউন পরতে পারেন তাহলে তোমার বয়সী চ্যাঙড়াও দিদির হাতে পিটানি খেতে পারে। বুঝেছো হে ছোকরা?
গরমাগরম কচুরি হাতে আশারা প্রবেশ করায় বোধ করি সেদিন ভাগ্নের সামনে মামুকে দিদির হাতে ঠ্যাঙানি খেতে হলো না।
-সমাপ্ত-