সারমেয় গেণ্ডুকের কাঁটা – ২০

২০

মধ্যাহ্ন আহার সেরে আমরা যখন দুজন কাঁচড়াপাড়া থেকে মরকতকুঞ্জে ফিরে এলাম তখনও রোদের তেজ কমেনি। বেলা সাড়ে তিনটে। একটু আগেই নাকি কলকাতা থেকে মিনতি মাইতি এসে পৌঁছেছে। আমাদের দেখে সে যথারীতি পাগলামো শুরু করলো। কীভাবে আমাদের যথোচিতভাবে আপ্যায়ন করা যায়, তা সে বুঝে উঠতে পারছে না যেন। প্রথমেই বললো, একটা কথা বাসুমামু। কাল আমার একটা দারুণ ভুল হয়ে গেছে। আমাকে ক্ষমা করতে হবে। বলুন, আমাকে ক্ষমা করেছেন?

—তোমার অপরাধটা কী আগে বলো? তারপর তো ক্ষমা করার প্রশ্ন উঠবে।

—আজ রাত্রে আপনারা এখানে খেয়ে যাবেন। যাবারই বা দরকার কী? রাতে এখানেই থাকবেন। কাল সকালবেলা ফিরে যাবেন। আপনার জন্য সব কিছু কলকাতা থেকেই বাজার করে এনেছি। শান্তি রান্না চড়িয়েও দিয়েছে—কিন্তু আমার এমন ভুলো মন, আপনাকেই বলা হয়নি। আমার উচিত ছিল রানী মামিমাকে আর সুজাতা বৌদিকেও নেমন্তন্ন করা। সবই ভুল হয়ে গেছে আমার।

মামু বললেন, ও! এই কথা! শোন মিনতি। আমরা দুজন তোমার নিমন্ত্রণ নিচ্ছি। রাতে এখানেই খাবো। তবে আজই আমাদের কলকাতায় ফিরতে হবে। উপায় নেই। তাই ডিনারটা যেন একটু আর্লি হয়, ধর সাড়ে সাতটা নাগাদ। তোমার রানী মামি আর সুজাতা বৌদি এখন কলকাতায় নেই—তুমি কাল তাদের নিমন্ত্রণ করলেও তাদের আনা যেতো না। কিন্তু আমরা এখনো তোমার দোরগোড়াতেই দাঁড়িয়েই আছি। আমাদের বসতে বলবে না?

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়। আসুন। বসুন! কী অন্যায় আমার! দোরগোড়াতেই আটকে রেখেছি!

আমরা বৈঠকখানায় এসে বসি। মামু জানতে চান—শান্তি কোথায়?

সে রান্নাঘরে ব্যস্ত শুনে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলেন, তুমি ঐখানে বসো। তোমাকে যে কথাটা বলবো বলে এসেছি, তা এবার বলে ফেলি।

মিনতি এমনভাবে বসলো যেন সে শিবরাত্রির ব্রতকথা শুনতে বসেছে।

তোমাকে সেদিন আমি বলেছিলাম যে, মিস পামেলা জনসনের একটি চিঠি আমি পেয়েছি। তুমি ধরে নিয়েছিলে সেই পাঁচখানা একশ টাকার নোট চুরি যাওয়ার বিষয়ে তিনি আমাকে তদন্ত করতে বলেছিলেন। সেটা ঠিক নয়। উনি আমাকে লিখেছিলেন অন্য একটি বিষয়ে তদন্ত করে দেখতে—উনি কেমন করে সিঁড়ি দিয়ে উলটে পড়লেন।

—হ্যাঁ, সে-কথাও তো সেদিন আপনি আমাকে বলেছিলেন। তাতে আমি বলেছিলাম—’তাতে তদন্ত করার কী আছে? সে তো ফ্লিসির সেই বলটাতে পা পড়ায়।’

আমি একটু অবাক হলাম। মিনতির এ জাতীয় স্মৃতিশক্তি আমি আশা করিনি। চকিতে আমার আবার সেই একই কথা মনে হলো—মেয়েটা কী? হাবাগোবা না ধূর্ত?

মামু এটা লক্ষ করলেন কি না জানি না। বললেন, না মিনতি! ফ্লিসির বলে পা পড়ায়, তাঁর পদস্খলন হয়নি। হয়েছিল সম্পূর্ণ অন্য কারণে—

—কিন্তু আমি যে দেখলাম, বলটা ম্যাডামের পায়ের কাছে পড়ে আছে।

—কিন্তু কেমন করে এলো? রাত্রে সবাই শুতে যাবার সময় বলটা সিঁড়ির নিচে ছিল, অথবা ড্রয়ারের ভিতর—তাই নয়?

—না, ড্রয়ারে ছিল না। সিঁড়ির নিচেই ছিল। ম্যাডাম সিঁড়িতে উঠতে উঠতে সেটা নজর করেছিলেন। আমাকে বলেও ছিলেন ওটা তুলে রাখতে। আমি ভুলে গেছিলাম।

—তবেই দেখ। বলটা সিঁড়ির নিচে স্থির ছিল, উপরে নয়। বলটা কেমন করে একতলা থেকে দোতলায় উঠে গেল?

—ফ্লিসি-ই নিশ্চয় মুখে করে তুলে এনেছিল।

—তা কি সম্ভব? তোমরা যখন দোতলায় উঠে যাচ্ছ তার আগে সদর দরজা বন্ধ হয়েছে। ফ্লিসি তার আগেই বাড়ির বাইরে গেছে। সে ফিরে এসেছিল ভোর রাত্রে। তাই নয়? তুমি চুপি চুপি তাকে দরজা খুলে ভিতরে নিয়ে এসেছিলে। মনে পড়ছে? তার মানে বলটা ফ্লিসি মুখে করে উপরে নিয়ে যায়নি। যেতে পারে না। ফ্লিসির অ্যালেবাই প্রতিষ্ঠিত।

যুক্তিটা এমন কিছু কঠিন নয়। কিন্তু বেশ কিছুটা সময় লাগলো ওর ব্যাপারটা সমঝে নিতে। যেন ধাপে ধাপে ফিথাগোরাস থিয়োরামের প্রমাণটা প্রণিধান করল। তারপর বললে, তাহলে বলটা কেমন করে দোতলায় এলো? তাতে পা পড়েই…

—না মিন্টি! তাতে পা-পড়ায় ম্যাডাম হড়কে যাননি। তাঁর পদস্খলন হয়েছিল সম্পূর্ণ অন্য কারণে। কেউ একজন সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এর শেষ ধাপে আড়াআড়ি একটা কালো রঙের টোন সুতো বেঁধে দিয়েছিল। একদিক বাঁধা ছিল সিঁড়ির রেলিং-এ; অন্যপ্রান্তে একটা পেরেকে। দেওয়ালের দিকে পেরেকটা কেউ গেঁথে দিয়েছিল। তার মাথাটা ভার্নিশ করা।

এটা পিথাগোরাস থিয়োরেম নয়। দ্বিমাত্রিক জ্যামিতির অঙ্কই নয়, স্ফেরিকেল ট্রিগনোমেট্রি। ওর বোধগম্য হলো না। শাস্তি রান্নাঘরে ব্যস্ত আছে কিনা পরখ করে নিয়ে আমরা তিনজনে সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতলে উঠে এলাম। স্কার্টিং-এর গায়ে পেরেকটা দেখিয়ে উনি বলেন, এই দেখো তার প্রমাণ! এ পেরেকটা কতদিন আছে ওখানে?

বকনা বাছুরের সেই দৃষ্টিটা ফিরে এল। ওর গলকণ্ঠটা বার কতক ওঠানামা করলো। তারপর বললে, আসুন, ঐ ঘরে গিয়ে বসি।

সেটা মিনতির শয়নকক্ষ। এখন সে এ ঘরে শোয় না। কিন্তু ম্যাডামের জমানায় সে এই ঘরেই শুতো। ঘরে একটি জনকে-খাট, একটি আলনা, আর একটি কাঠের আলমারি, তার গায়ে প্রমাণ সাইজ আয়না। আমরা কোথায় বসলাম সেটা ও ভ্রূক্ষেপ করল না। নিজে খাটে বসে রীতিমতো হাঁপাতে থাকে। অনেকক্ষণ পরে মনস্থির করে বলে, আপনি বলতে চাইছেন… মানে কেউ ম্যাডামকে এভাবে…

—হ্যাঁ। সুতোটা যে খাটিয়েছিল সে জানতো—মাঝরাতে মিস জনসন উপর-নীচ করেন। তাঁর বয়স হয়েছে, চোখে ভালো দেখেন না। সুতোটা কালো রঙ করা, যাতে চট করে নজরে না পড়ে। সে লোকটা চেয়েছিল উনি যাতে উলটে পড়েন—মারা যান।

—মারা যান! তার মানে এটা তো খুন!

—মারা গেলে তাই বলা হতো। এখন একে আইনের ভাষায় বলা যায় ‘অ্যাটেম্পট্ টু মার্ডার’—খুনের চক্রান্ত।

—কিন্তু…কিন্তু কে এমন কাজ করবে? সবাই তো ঘরের লোক, বাইরের লোক তো কেউ ছিল না।

—তা ছিল না। তবে সে রাত্রে ঐ পতনজনিত দুর্ঘটনায় যদি ওঁর মৃত্যু হতো, তাহলে তিনি দ্বিতীয় উইল করার সুযোগ পেতেন না। ঐ ঘরের লোকেরাই তাঁর সম্পত্তিটা পেত—যে লোকটা মৃত্যুফাঁদ পেতেছে সেও সম্পত্তির ভাগ পেতো। নয় কি?

বজ্রাহত হয়ে গেল মিনতি। অন্তত তার মুখভঙ্গি দেখে তাই মনে হলো, যদি না সে অতিদক্ষা অভিনেত্রী হয়।

—এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছো ব্যাপারটা? এটাই আমাকে তদন্ত করে দেখতে বলেছিলেন মিস জনসন। তিনি জানতেন—ঐ চারজনের মধ্যে একজন ওঁকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সে স্মৃতিটুকু, সুরেশ, হেনা অথবা প্রীতম—ঠিক কে, তা তিনি স্থির করে উঠতে পারেননি। কিন্তু এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন যে, ওদের মধ্যেই আছে সেই শয়তানটা। আর সেই জন্যেই তিনি উইলটা পালটে ফেলেন। মিনতি জবাব দিলো না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই থাকলো।

—এখন বলো তো আমাকে, ঐ পেরেকটা কবে তোমার প্রথম নজরে পড়ে? মিনতি এবারও জবাব দিল না। নেতিবাচক গ্রীবাভঙ্গি করল শুধু।

—যে পেরেকটা পুঁতেছে সে সম্ভবত মাঝরাত্রে কাজ সেরেছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পরে। তুমি কি কোনও রাত্রে কাঠের গায়ে পেরেক ঠোকার আওয়াজ শুনেছিলে?

এবার ও গ্রীবাভঙ্গিও করলো না। মুখটা ক্রমশ লাল হয়ে উঠছে তার। সে যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে।

—অথবা কোনও রাত্রে কি ভার্নিশের গন্ধ পেয়েছিলে? টাটকা ভার্নিশের গন্ধ? হঠাৎ মনস্থির করলো মিনতি। চট করে উঠে দাঁড়ালো। বললে, আমি জানি বাসু-মামু—কে…কে এভাবে মৃত্যুফাঁদটা খাটিয়েছিল!

—তুমি জান? কী জান? কেমন করে জান?

—আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমি চিনতে পেরেছিলাম। আমি জানি।

—কী? কী দেখেছিলে নিজের চোখে? বলো, সব কথা খুলে বলো আমাকে। এবার আর হড়বড় করলো না আদৌ। মোটামুটি গুছিয়েই বক্তব্যটা পেশ করলো : তারিখটা সে মনে করতে পারলো না। তবে একটু মনে আছে তখন অতিথিরা সবাই মরকতকুঞ্জ এসে গেছেন—আর ঘটনাটা ঘটে ম্যাডামের পদস্খলনের আগে। সে রাত্রে ওর নিজেরও ঘুম আসছিল না। জেগে জেগেই বিছানাতে শুয়ে ছিল। ওর ঘরের দরজাটা খোলাই থাকে—যাতে ম্যাডাম ডাকলে ও শুনতে পায়। মাঝরাত্রে—কত রাত্রি সে জানে না—ও একটা অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পায়; ঠক্‌ঠক্‌… ঠক্‌ঠক্ ঠক্‌ঠক্। ওঁ প্ৰথমটা ভেবেছিল দোতলার কোনও ঘরে মশারি টাঙানোর দড়িটা আচমকা খুলে গেছে। কোনও ঘরেই খাট-পালঙ্কের সঙ্গে ছত্রি নেই। দেওয়ালে পেরেক খাটানো। মিনতির মনে হলো—কোনও ঘরের পেরেক অসাবধানে উপড়ে এসেছে। ঘরের বাসিন্দা সেটা নতুন করে দেওয়ালে পুঁতছে। যুক্তি-সম্মত সিদ্ধান্ত। তাই ও নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করে। ঘুমিয়ে পড়েছিল কি না মনে নেই—একটু পরেই—কত পরে তা ও বলতে পারে না—একটা অদ্ভুত গন্ধ পেল। বাল্যকালে সে নাকি অগ্নিদাহের কবলে পড়ে। তখন ওর বাবা-মা বেঁচে। ওদের খড়ো ঘরে আগুন লেগে যায়। সেই থেকেই অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে ওর অবচেতনে একটা ‘অবসেশন’ আছে। প্রায়ই মাঝরাতে ও পোড়া-পোড়া গন্ধ পেয়ে উঠে বসে। সেদিনও ও উঠে বসলো খাটে। ভালো করে শুঁকে দেখল—না পোড়া-পোড়া গন্ধ নয়—রঙের গন্ধ। রঙও নয়, বছর খানেক আগে ম্যাডাম তাঁর সেগুন কাঠের কিছু ফার্নিচার পালিশ করেছিলেন— সেই গন্ধটাই! মিনতি অবাক হল—মাঝরাতে এমন গন্ধ কোথা থেকে আসছে? তখনই তার নজর পড়ে আলমারির গায়ে আটকানো প্রমাণ-সাইজ আয়নাটার দিকে। আয়নার ভিতর দিয়ে খোলা দরজার ওপাশে সিঁড়ির ল্যান্ডিংটা দেখা যায়। একটা বালব সারারাতই জ্বলে। সেই আলোয় ও স্পষ্ট দেখতে পেল—

—কী? কী দেখলে তুমি?

—ওকে! সিঁড়ির চাতালে নিচু হয়ে সে কিছু একটা জিনিস কুড়িয়ে নিচ্ছে। ঠিক এখন যেখানে পেরেকটা পোঁতা সেখানেই। আমি কিন্তু অবাক হইনি। আমার মনে হল, ওর হাত থেকে কিছু পড়ে গেছে, তাই কুড়িয়ে নিচ্ছে। হয়তো বাথরুমে গেছিল…

—কাকে দেখলে তুমি?

দোতলায় একমাত্র ম্যাডামের ঘরে সংলগ্ন বাথরুম আছে। আর কোনও ঘরে তো নেই। কিন্তু কী আশ্চর্য দেখুন। ঠিক সে সময়ে আমার মনে পড়েনি যে, কোনও ঘর থেকে বাথরুমে যেতে হলে সিঁড়ির দিকে আসার দরকার পড়ে না। কমন বাথরুমটা বারান্দার একেবারে উলটো দিকে….

—বুঝলাম। কিন্তু কাকে দেখলে তুমি? কে নিচু হয়ে কিছু কুড়িয়ে নিচ্ছিল?

—টুকুদিকে।

—স্মৃতিটুকুকে?

—হ্যাঁ।

—মিনতি! তুমি যা বলছ তার গুরুত্ব বুঝতে পারছো? প্রয়োজনে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হলপ নিয়ে একথা বলতে হতে পারে।

হঠাৎ কী যেন হল মিনতির। বললে, প্রয়োজনে তাই বলব। ম্যাডাম স্বর্গে গেছেন। কিন্তু কেউ যদি তাঁকে এভাবে খুন করতে চেয়ে থাকে তবে তার সাজা হওয়া উচিত।

—ঠিক কথা। কিন্তু ভেবে দেখো, ইলেকট্রিক বালটা মাত্র কুড়ি ওয়াটের। সিঁড়িতে আবছা আলোই ছিল। তুমি ওকে দেখেছিলে ঘুম-ঘুম চোখে। তুমি আদালতে হলপ নিয়ে শুধু একথাই বলতে পারো যে, একটি নারীমূর্তিকে তুমি দেখতে পেয়েছিলে। সে স্মৃতিটুকু, হেনা বা শান্তি যে কেউ হতে পারে…

—না। শান্তি অমন নাইটি পরে না। তাছাড়া ওর ব্রোচটায় আলো পড়ায় চিকচিক করে উঠেছিল। হ্যাঁ, আমার স্পষ্ট মনে আছে। ওর কাঁধের ব্রোচে দুটো অক্ষর স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম আমি : T. H.! টুকু হালদার। ছি-ছি-ছি! শেষকালে টুকুদি—

—উত্তেজিত হয়ো না মিন্টি। আগে আমাকে ব্যাপারটা সমঝে নিতে দাও। নাও, তুমি সরে এসো দিকিন। আমি ঐ খাটে শোবো। কোন দিকে মাথা করে শুয়েছিলে তুমি? এইদিকে? বেশ আমি শুচ্ছি। তুমি ঐ সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ চলে যাও তো। ঠিক যে ভঙ্গিতে ওকে কিছু কুড়িয়ে নিতে দেখেছিলে সেইভাবে কুড়িয়ে নেবার ভঙ্গি করো। আমি নিজে পরীক্ষাটা করে দেখতে চাই।

মিন্টিকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে কিছুটা সময় লাগলো। তারপর সে এগিয়ে গেল।

সিঁড়ির মাথায় কিছু কুড়িয়ে নেবার অভিনয় করে ঘরে ফিরে এলো। বাসুসাহেব দেওয়ালের দিকে মুখ করে আয়নার ভিতর দিয়ে দৃশ্যটা দেখলেন। তারপর বলেন, চল, এবার সবাই নিচে যাই। কিন্তু তার আগে আর একবার ভেবেচিন্তে বলো দেখি মিন্টি—তুমি সত্যিই স্মৃতিটুকুকে চিনতে পেরেছিলে? অত কম আলোয়?

—পেরেছিলাম। টুকুদিকে আমি খুব ভালোভাবেই চিনি! আমার ভুল হয়নি!

২১

ফেরার পথে মামু একেবারে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে রইলেন। আমার দু-একটি প্রশ্নের জবাবে হুঁ-হাঁ দিয়ে গেলেন। শুধু একবার উনি মন খুলে দু-চার কথা বললেন। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আপনার কি মনে হল—মিনতি মাইতি অত কম আলোয় ঠিকমতো চিনতে পেরেছিল স্মৃতিটুকুকে?’ তার জবাবে উনি বললেন, ঐ কথাটাই ভাবছি আমি। শোনামাত্র আমার মনে হয়েছিল কোথায় কী যেন একটা অ্যাপারেন্ট ফ্যালাসি আছে…

—’অ্যাপারেন্ট ফ্যালাসি’ মানে?

—আপাত-অসঙ্গতি—যা হবার নয়, তাই।

—একটা উদাহরণ দিন। তাহলে বুঝবো।

—ধরো কেউ যদি বলে, ‘এ বছর গুড ফ্রাইডের ছুটিটা রবিবারে পড়ায় একটা ছুটির দিন কমে গেল’, কিংবা ‘জুলিয়াস সিজারের একটা স্বর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে, যাতে সালটা ছাপা আছে 55 B. C’.—যেটা হবার নয়। হয় না! তাই! তোমারও এমনটা মনে হয়নি?

—না তো! কোথায় দেখতে পেলেন সেই আপাত-অসঙ্গতি। কী জাতের অসঙ্গতি?

উনি অসহিষ্ণুর মতো বলে ওঠেন, কোথায়, কী জাতের মনে করতে পারলে তো বুঝেই ফেলতাম। মিন্টির ঐ ঘরটায়, মিন্টির ঐ স্টেটমেন্টে—

সমস্ত ঘটনা আর কথোপকথনটা আমি খতিয়ে দেখতে থাকি। অসঙ্গত কিছুই মনে করতে পারলাম না।

নিউ আলিপুরে যখন এসে পৌঁছলাম তখন রাত দশটা। রাস্তায় বেশ জ্যাম ছিল। বেল দিতে দরজা খুলে দিল বিশু। কিন্তু তখনো নিস্তার নেই। বললে, এক দাড়িঅলা বাবু এসে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করছেন। কী যেন জরুরি দরকার। আজ রাতেই কথাটা বলতে হবে। বিশু তাঁকে বসিয়ে রেখেছে বৈঠকখানায়। তাঁর নাম বলেছেন ডক্টর প্রীতম ঠাকুর।

মামু সেদিকে একপা এগিয়ে যেতেই বিশু পথরোধ করে বললে, আরও একটা কথা বাবু। সাঁঝের বেলা আরও একজন দিদিমণি এসেছিলেন। কিছুতেই তাঁর নামটা জানালেন না। আপনি নেই শুনে চলে গেছেন। বললেন, পরে আসবেন। মনে হলো, তিনি খুবই চনমন করছিলেন—যেন তাঁকে পুলিস কুকুরে তাড়া করেছে। বারে বারে ইতি-উতি চাইছিলেন। চোর-চোর ভাবখানা!

বিশুর বয়স বছর তের-চৌদ্দ। কিন্তু গোয়েন্দাদের বাড়িতে থাকতে থাকতে দারুণ সেয়ানা হয়ে উঠেছে। মামু জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়েটির বর্ণনা দে

নিখুঁত বর্ণনা দিল বিশে : বয়স দিদিমণির কাছাকাছি (অর্থাৎ সুজাতার, আমার স্ত্রীর)। পরনে হালকা নীল রঙের একটা শাড়ি। বেশ মোটা-সোটা। বাঁ ভুরুর উপরে একটা কাটা দাগ। রঙ মাজা, ফর্সা নয়, যদিও মুখে কীনব হাবিজাবি মেখে ফর্সা হয়েছেন।

মামু পকেট থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বার করে ওর হাতে দিলেন। মুখে শুধু বললেন, একসেলেন্ট। নে—

এক গাল হাসল বিশু। মামু আমার দিকে ফিরে বললেন, দ্বিতীয়বার ওর গোপন কথাটা শোনার সুযোগ হলো না, বুঝেছো নিশ্চয়?

—হ্যাঁ। বাঁ ভুরুর উপর কাটা দাগেই শুধু নয়, মুখে হাবিজাবি মাখা থেকেই বোঝা যায় হেনা ঠাকুর আপনাকে সেই গোপন কথাটা বলতে এসেছিল।

আমরা প্রবেশ করতেই ডক্টর ঠাকুর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বললে, নিতান্ত নিরুপায় হয়েই আপনাকে অসময়ে বিরক্ত করতে এসেছি।

মামু আসন গ্রহণ করে বললেন, বিলক্ষণ! বলুন কী ব্যাপার? কফি খাবেন?

—না। কাজের কথাটা সেরেই চলে যাব। অনেক রাত হয়ে গেছে। আমি….মানে…হেনাকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়েছি!

–হেনাকে নিয়ে? কেন কী হয়েছে?

—আপনার কাছে আজ সে এসেছিল নিশ্চয়?

—না, আজ তো তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। ইন ফ্যাক্ট, আপনার বাড়িতে আপনার সামনেই তাকে শেষ দেখেছি। কেন বলুন তো?

এবার উনি একটুও মিথ্যা বলেননি। ট্রুথ, হোলট্রুথ, নাথিং বাট দ্য ট্রুথ!

—ও! আমি ভেবেছিলাম, ও বুঝি আপনার কাছেই ছুটে এসেছে।

—কেন? বিশেষ করে আমার কাছে আসার কোনও কারণ আছে নাকি?

—না, মানে ওর মানসিক অবস্থায়… ব্যাপারটা কী জানেন বাসু-সাহেব, আজ মাস-দুয়েক ওর একটা দারুণ মানসিক পরিবর্তন হয়েছে। ও এমনটা ছিল না, হঠাৎ কী-জানি কেন সে অত্যন্ত নার্ভাস হয়ে পড়েছে। সব সময় দারুণ ভয়ে ভয়ে থাকে। একটু শব্দ হলে চমকে ওঠে। ও যে মানসিক অসুখটায় ভুগছে তাকে বলে ‘পার্সিকিউশন ম্যানিয়া’। ও কল্পনা করছে—কেউ সুপরিকল্পিতভাবে ওকে গোপনে হেনস্তা করছে। বিপদে ফেলতে চাইছে।

মামু যে শব্দটা করলেন তার ধ্বনিরূপ ‘স্ত্, স্ত্’–সহানুভূতির দ্যোতক।

—তাই আমার মনে হয়েছিল ও বুঝি আপনার কাছে ছুটে এসেছে, না এসে থাকলে হয়তো কালই সে এসে দেখা করবে, আমার বিরুদ্ধে আবোল-তাবোল কিছু বলবে–মাকে সে ভয় পাচ্ছে, আমি তার ক্ষতি করতে পারি এইসব আর কি।

—কিন্তু আমার কাছে কেন?

ডক্টর ঠাকুর মিষ্টি করে হাসলেন। বললেন, আপনি একজন স্বনামখ্যাত ক্রিমিনাল সাইডের ব্যারিস্টার। সাধারণ লোকের ধারণা আপনি গোয়েন্দা। আপনি নিজে থেকে ওর সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছেন–এটাকে সে ঈশ্বরের একটা আশীর্বাদ বলে ধরে নিয়েছে। ওর এই মানসিক অবস্থায় একজন প্রখ্যাত গোয়েন্দার সঙ্গে এরকমভাবে পরিচিত হওয়াটাকে সে তার দুর্লভ সৌভাগ্য বলে মনে করছে। আমার মনে হয়, আজ যদি না এসে থাকে, কাল নিশ্চয় আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। আর আমার বিরুদ্ধে অনেক কিছু হড়বড় করে বলে যাবে। ‘পার্সিকিউশান ম্যানিয়া’ অসুখে এই রকমটাই হয়। রোগীর সবচেয়ে কাছের মানুষের বিরুদ্ধেই অবচেতনে সবচেয়ে সোচ্চার প্রতিবাদ জন্মায়।

মামু মাথা নাড়তে নাড়তে বলেন, কী দুঃখের কথা।

—হ্যাঁ, দুঃখের। অত্যন্ত দুঃখের! মিস্টার বাসু, আমি আমার স্ত্রীকে ভালবাসি। প্রাণ দিয়ে ভালবাসি। তার প্রতি একটা গভীর শ্রদ্ধাও আছে আমার। সে ভালবেসে আমাকে বিবাহ করেছে—স্বজাতি নই আমি, তবুও। কিন্তু আমি চিকিৎসক—এ রোগের লক্ষণ জানি, তাই বিচলিত হইনি। আমি জানি, চিকিৎসা করলে এ রোগ সারে। একটাই পথ আছে….

—কী পথ? কী চিকিৎসা?

—শান্ত পরিবেশে ওর মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। আমার একজন বিশ্বস্ত সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধু আছে। আমরা একসঙ্গে কলেজে পড়তাম। ও বিদেশ থেকে মনোবিজ্ঞানে ডক্টরেট করে এসেছে—একটা মেন্টাল হোম খুলে বসেছে। হিমাচল প্রদেশে। আধুনিক মনোবিজ্ঞানের চিকিৎসা হয় সেখানে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মাস তিনেকেই হেনা ভালো হয়ে যাবে।

—আই সি! —এমনভাবে কথাটা বললেন যাতে বোঝা গেল না তাঁর মনের ভাব।

তাই আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ—ও যদি আপনার কাছে আসে তাহলে ভুলিয়ে তুলিয়ে ওকে আটকে রাখবেন, আর আমাকে খবর দেবেন।

—তার মানে? মিসেস ঠাকুর এখন কোথায়?

—আমি জানি না। সকালবেলাই সে বেরিয়ে গেছে। দুপুরে খেতে আসেনি। জানি না, কোথায় সে টো-টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

—বাচ্চা দুটো?

—আমার বোনের কাছে। ও যদি আপনার কাছে আসে আর আমার বিরুদ্ধে উলটো-পালটা কথা বলে তাতে কান দেবেন না, প্লিজ। সেটা ওর রোগের একটা লক্ষণ!

—বুঝেছি। না, দেবো না।

ডক্টর ঠাকুর বিদায় নিতে উঠে দাঁড়ালেন। মামু ফস করে বললেন, হেনার কি ইনসমনিয়া আছে? রাতে ঘুমায় না?

—না। ঘুমের তো ব্যাঘাত হয় না। তবে মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখে…

—আপনি কি ওর জন্যে ইদানীং কখনো ‘কামপোজ’ প্রেসক্রাইব করেছেন?

আমার মনে হল প্রীতম রীতিমতো চমকে উঠল। সামলে নিয়ে বলে, না তো! ঘুমের কোনও ওষুধই ও কোনওকালে খায় না। ইদানীং আমার দেওয়া কোনও ওষুধই খায় না।

—বুঝেছি। আপনাকে বিশ্বাস করে না বলে! ভাবে, আপনি বিষ খাওয়াতে চান!

তৎক্ষণাৎ বদলে গেল ওঁর চেহারা। বলে, মানে! কী বলতে চান আপনি?

—পার্সিকিউশান ম্যানিয়া’য় সে রকমটাই হবার কথা নয় কি? রোগী মনে করে তার অতি প্রিয়জন তাকে বিষ খাওয়াতে চাইছে!

ডক্টর ঠাকুর শান্ত হলো, ও হ্যাঁ, তাই বটে! আপনি রোগটার বিষয়ে জানেন দেখছি।

—তা জানি। আমার প্রফেশনেও এমন কেস তো মাঝেমধ্যে আসে দু-একটা। কিন্তু আপনাকে আর ধরে রাখবো না। হয়তো বাড়ি ফিরে দেখবেন আপনার জন্যে মিসেস ঠাকুর প্রতীক্ষায় বসে আছেন।

—থ্যাঙ্কস! গুরুজি তাই করুন!

প্রীতম ঠাকুর আমাদের কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল।

মামু তৎক্ষণাৎ তাঁর মানিব্যাগটা বার করলেন। একটা টুকরো কাগজ দেখে টেলিফোনে ডায়াল করলেন : হ্যালো, হ্যালো…ইয়েস… ডক্টর ঠাকুর অথবা মিসেস ঠাকুর কি আছেন?…ও আই সি!

টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে বললেন, প্রীতমের বোন ফোন ধরেছিল। বললে, মিসেস ঠাকুর রাত আটটার সময় এসেছিল। বাচ্চা দুটোকে নিয়ে, একটা সুটকেস সমেত ট্যাক্সি করে কোথায় বেরিয়ে গেছে। বোধহয় ডক্টর ঠাকুর এখনো সে-কথা জানে না।

আমি বলি, মামু, প্রীতম কি তার স্ত্রীকে লোকচক্ষুর আড়ালে সরিয়ে দিতে চাইছে? দুনিয়া থেকে যখন সরানো যাচ্ছে না, তখন অন্তত পাগলা-গারদে আটকে রাখা?

—শুধু তাই নয়, কৌশিক। হেনা ‘পাগল’ বলে প্রমাণিত হলে তাকে সাক্ষীর মঞ্চে তোলা যাবে না। তার সেই ‘গোপন কথা’—যেটা সে বলবার জন্য বারে বারে আমার কাছে ছুটে আসছে—সেটা হয়ে যাবে ‘পাগলের প্রলাপ’!

এদিকটা আমার খেয়াল হয়নি। বলি, কিন্তু প্রীতম জলজ্যান্ত মিথ্যাকথাটা বললো কেন? ঐ ‘কামপোজ’ প্রেসক্রিপশান ব্যাপারে? সে কিন্তু জানতে চায়নি ‘এ-কথা মনে হল কেন আপনার?” অথবা ‘কামপোজের কথা উঠছে কোন সূত্রে?” স্পষ্টতই সে আলোচনাটা এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। কেন?

মামু গম্ভীরভাবে বললেন, মুশকিল কী জান কৌশিক, আমি স্থিরভাবে সবগুলো ‘ব্লু’-কে বিচার করতে পারছি না—আমার সবসময় মনে হচ্ছে, খুনীটা দ্বিতীয় খুনের চেষ্টা করবে—এভিডেন্সগুলো নষ্ট করতে। আমি এখন সেইদিকেই সমস্ত ইন্দ্রিয়গ্রামকে সজাগ রেখেছি—কী করে দ্বিতীয় হত্যাটাকে ঠেকানো যায়।

এ আশঙ্কার কথা উনি আগেও বলেছেন। জানতে চাই, খুলে বলুন তো আমাকে—কাকে সন্দেহ করছেন আপনি? কে কাকে খুন করতে চাইছে?

—একটু চিন্তা করলেই তো বুঝবে। তুমি আমার কাছে শিক্ষানবিশ, তোমার অঙ্ক তুমিই কষবে, আমি তোমার হয়ে কষে দিতে পারবো না। এখন তো কেসটা পরিষ্কার হয়ে এসেছে। শুধু মিনতি মাইতির ঐ আপাত-অসঙ্গতিটা – জুলিয়াস সিজার কেমন করে তার মুদ্রায় ছাপ মারে ‘55’ বি. সি.? আমরা জানি, জুলিয়াস সিজার জীবিত ছিলেন পঞ্চান্ন বি. সি.-তে; কিন্তু সিজার নিজে তো জানতেন না যে, তাঁর পঞ্চান্ন বছর পরে যীশুখ্রীস্ট জন্মগ্রহণ করবেন!

২২

পরদিন সকালে সাদার্ন অ্যাভিন্যুর অ্যাপার্টমেন্টে যখন ‘বেল’ দিলাম তখন স্মৃতিটুকু নিজেই দরজা খুলে দিল। মনে হল, সে কোথায় বেরুবার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। সাত সকালেই দারুণ সাজের বাহার। ম্যাজেন্টা রঙের মুর্শিদাবাদী, ম্যাচ করা ব্লাউজ, চোখে ম্যাস্কারা, পায়ে হাই-হিল, হাতে ফুটানির বটুয়া।

মামু বললেন, অসময়ে বিরক্ত করছি মনে হচ্ছে। কোথাও বেরুচ্ছো?

টুকু মিষ্টি করে হাসল। বললে, আপনার ‘ডিডাকশান’ ভুল হয় না। তবে ঘণ্টাখানেক দেরী করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখার একটা বদনাম আমার আছেই; সেটা সওয়া-ঘণ্টা হলে কেউ মূর্ছা যাবে না। আসুন, বসুন

ড্রইং-রুমে দেখা গেল বসে আছে ডক্টর নির্মল দত্তগুপ্ত। স্যুটেড-বুটেড। হয়তো দুজনে মিলে কোথাও যাচ্ছিল। স্মৃতিটুকু তার দিকে ফিরে বললে, ইনট্রোডাকশান বাহুল্য মনে হয়। মেরীনগরে এঁকে দেখেছ। তখন অবশ্য উনি সাংবাদিকতা করতেন। আমার পূজ্যপাদ পিতামহের জীবনী লিখতেন। নির্মল, তুমি বরং চলে যাও! ওদের গিয়ে বলো, আমি আধঘণ্টা পরে আসছি—একটা ট্যাক্সি নিয়ে।

নির্মল সংক্ষেপে বলল, আয়াম সরি, টুকু। এ আলোচনা আমারও শোনা দরকার।

দুজনে দু’জনের দিকে কয়েকটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো। তারপর টুকু একটু রাগত স্বরেই বললো, বেশ, থাকো। তুমি তো আমার কোনও কথাই কখনো শোনো না।

টুকু এবার বাসু-মামুর দিকে ফিরে বলে, বলুন স্যার, এদিকে কদ্দুর কী হলো? উইলটা দেখেছেন শুনেছি। কিছু আশা আছে?

মামু নিজের আঙুলের দিকে তাকিয়ে সংক্ষেপে বললেন, আশা নেই, একথা বলবো না। তবে এখনই সব কথা বলতে পারছি না। দু’পক্ষই তো সবে ‘কাসলিঙ’ শেষ করলো। আরও দু-চার চাল খেলাটা এগিয়ে যাক।

স্মৃতিটুকু আন্দাজ করলো নির্মলের সামনে বাসু-মামু রেখে-ঢেকে কথা বলবেন। বললে, তাহলে আজ এ আবির্ভাবের হেতু?

—একটা কথা জানতে এসেছি। একটু ভেবে নিয়ে সঠিক করে বলো তো মিস হালদার-এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তোমরা মেরীনগরে যাবার পরে এবং তোমার বড়পিসির পদস্খলনের আগে, কোনো একদিন রাত্রে—সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর, তুমি কি সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ নিচু হয়ে কিছু কুড়িয়ে নিয়েছিলে?

স্মৃতিটুকু নির্বাক তাকিয়ে রইলো সেকেন্ড দশেক। তারপর বললো, প্রশ্নটা আর একবার করবেন?

মামু দ্বিতীয়বার প্রশ্নটা পেশ করলেন থেমে-থেমে।

ও অবাক হয়ে বললে, এমন অদ্ভুত প্রশ্নের অর্থ?

—অর্থ যাই হোক। ভেবে নিয়ে বলো তো, এমন ঘটনা ঘটেছিল?

—না! নিশ্চয় নয়। আমি বড়পিসির মতো ইনসমনিয়ায় ভুগছি না। বিছানায় শুলেই ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু এর কি কোনও গুরুত্ব আছে?

—আছে। একজন বলছে যে, মাঝরাতে সে তোমাকে দেখেছে সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ নিচু হয়ে কিছু কুড়িয়ে নিতে

স্মৃতিটুকু রুখে ওঠে, যে বলছে সে ডাহা মিথ্যুক। আর যদি কুড়িয়ে নিয়েই থাকি, তাতে হলোটা কী? শিবঠাকুরের আপন দেশেও এমন আইন নেই যে মাঝরাতে সিঁড়িতে নিচু হয়ে কিছু কুড়িয়ে নিলে তিন মাসের জেল হবে!

মামু গম্ভীর হয়ে বললেন, প্লিজ ডোন্ট বি ফ্রিভলাস মিস্ হালদার। আমি রঙ্গরসিকতা করতে আসিনি তোমার সঙ্গে। আমার প্রশ্নের সরাসরি জবাব দাও—’গভীর রাত্রে সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এর মাথায় তুমি নিচু হয়ে কিছু কুড়িয়ে নিয়েছিলে?’ জবাবে কী বলবে? ‘হ্যাঁ, না, অথবা মনে পড়ছে না।’

—টুকু প্রায় ধমকে ওঠে, না-না-না! না, টু-দ্য পাওয়ার ইনফিনিটি!

নির্মল নড়ে চড়ে বসলো। বললে, মিস্টার বাসু, আপনি সওয়াল করেছেন, জবাবও পেয়েছেন। এবার কি দয়া করে জানাবেন—কেন এই অদ্ভুত প্রশ্নটা করছেন?

—জানাবো। কারণ আমি স্বচক্ষে দেখে এসেছি, মরকতকুঞ্জে সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ কাঠের স্কার্টিঙের গায়ে একটা পেরেক পোঁতা আছে। তার মাথাটা ভার্নিশ করা, যাতে নজরে না পড়ে।

—কেন! ওখানে কেউ পেরেক পুঁততে যাবে কেন? কোনও তুক-তাক?

—না! মিস্ জনসনের বাহাত্তরতম জন্মদিনের পূর্বরাত্রে—সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর কেউ একজন একটা কালো সুতো টান-টান করে বেঁধে দিয়েছিল সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এর শেষ ধাপে—নয় ইঞ্চি উঁচুতে।

—তাই বা কেন?

—যে দড়িটা খাটায় সে জানতো মিস জনসন রাত্রে উপর-নিচ করেন, তিনি চোখে ভালো দেখেন না! জানতো যে, পাঁচ বছর আগে মিস্ জনসন যে উইল করেছেন তার সে অন্যতম ওয়ারিশ।

—মাই গড! কী বলছেন এসব? উনি তো ফ্লিসির সেই হতভাগা বলটায়…

—আয়াম সরি! সে থিওরিটা ভুল। ‘সারমেয় গেণ্ডুক’ নির্দোষ। ইট ওয়াজ আ ডেলিবারেট অ্যাটেম্পট অন হার লাইফ!

পুরো এক মিনিট ঘর নিস্তব্ধ। শুধু সিলিং ফ্যানটার শব্দ। সবার আগে নির্মল কণ্ঠস্বর ফিরে পায়। বলে, আপনার এ সিদ্ধান্তের কী যুক্তি!

বাসু-মামু সংক্ষেপে সবকিছু বর্ণনা করলেন—মিস্ জনসনের চিঠি, তাতে গোপনীয়তার বিষয়ে নির্দেশ, ফ্লিসির বলটা কোনও যুক্তিতে সিঁড়ির মাথায় থাকতে পারে না। পেরেকের অস্তিত্ব, তার মাথায় ভার্নিশ করা। গন্ধটা দু’মাসেও যায়নি। পকেট থেকে মিস্ জনসনের চিঠিখানা বার করে তিনি ওদের দেখতে দিলেন।

স্মৃতিটুকুর মুখটা সাদা হয়ে গেল। কথা যোগালো না তার মুখে। নির্মলই বললে, কিন্তু আপনি হঠাৎ টুকুকে ঐ প্রশ্নটা করলেন কেন? ঐ সিঁড়িতে নিচু হয়ে কিছু কুড়িয়ে নেবার কথা।

মামু এবার অকপটে বললেন, মিস্ মাইতি তোমাকে ঐ অবস্থায় দেখতে পেয়েছিল।

—শি ইজ আ লায়ার। ড্যাম্ড লায়ার। আমি সিঁড়িতে পেরেক পুঁতিনি।

–তাহলে নিচু হয়ে কী কুড়িয়ে নিচ্ছিলে? পেরেক পোঁতোনি যখন

আগুনভরা চোখে টুকু মামুর দিকে তাকিয়ে বললে, মিস্টার বাসু! ডোন্ট আস্ক মী লীডিং কোয়েশ্চেনস্! আমি সিঁড়ির মাথায় আদৌ নিচু হইনি—কোনোদিন নয়, কোনো রাত্রে নয়।

—কিন্তু মিনতি তোমাকে চিনতে পেরেছিল। তুমি নীল নাইটি পরেছিলে, তোমার কাঁধে একটা ক্রোমিয়াম-প্লেটেড ব্রোচ ছিল, তাতে T. H. লেখা!

—মাই গড! আপনি বিশ্বাস করলেন? আমি গোপনে মৃত্যুফাঁদ পাততে যাচ্ছি। আর পাছে আমাকে শ্রীমতী মাইতি চিনতে না পারেন তাই নিজের নাম-লেখা ব্রোচ কাঁধে সেঁটেছি।

—তোমার কাছে অমন একটা ক্রোমিয়াম-প্লেটেড ব্রোচ আছে?

—আছে। দেখতে চান? ঠিক আছে, দেখুন –

দুম দুম করে স্মৃতিটুকু পাশের ঘরে উঠে গেল। একটু পরে ফিরে এসে সে ব্রোচটা প্রায় ছুঁড়ে দিল বাসু-মামুকে লক্ষ্য করে। উনি সেকেন্ড-স্লিপে কোনোদিন ফিল্ড করেছেন কিনা জানি না। ব্রোচটা ঠিক লুফে নিলেন। মিনতির বর্ণনা মোতাবেক ক্রোমিয়াম-প্লেটেড ব্রোচ : T. H. লেখা। অস্বীকার করে লাভ নেই, এই মাপের একটি ব্রোচ অত অল্প আলোয় চকচক করে নির্ভুলভাবে সনাক্ত হতে পারে।

মামু সেটা নেড়েচেড়ে দেখলেন। ফেরত দেবার উপক্রম করতেই টুকু বলে ওঠে, থাক ওটা আপনার কাছে। ওটা আর আমি পরি না। এ জাতীয় ব্রোচ এখন ‘ফ্যাশন’-এ দাঁড়িয়ে গেছে।

—‘ফ্যাশন’-এ দাঁড়িয়ে গেছে। তার মানে?

—সবাই পরে। আমি ‘স্টাইল’-এ বিশ্বাস করি। ‘ফ্যাশন’-এ নয়। ওটা যখন কিনেছিলাম তখন সেটা কেউই পারতো না—একমাত্র অনারেবল এক্সেপশান মিস্ ঊষা বিশ্বাস! তিনি পঞ্চাশ বছর ধরে ঐ রকম একটা ব্রোচ পরেন। তাই এই পুরাতন স্টাইলটা আমি ফিরিয়ে আনি। তারপর আমার দেখাদেখি খেঁদি-পুঁটি-হেনা সবাই ঐ জাতের ব্রোচ কিনেছে।

–হেনাও?

—হ্যাঁ! হেনাও। সে আমার নকল করেই সাজগোজ করে, লক্ষ করেননি?

—তা হবে। তা আমি এটা নিয়ে কী করব?

–রেখে দিন। আমার বিরুদ্ধে যদি ‘কেস’ সাজান তাহলে ওটাই হবে জবর এভিডেন্স। যা হোক, আপনার আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে!—টুকু উঠে দাঁড়ায়।

—আছে। মাদমোয়াজেল! ‘একজিউমেশান’-এর একটা কথা উঠেছে। সেটার বিষয়ে-

ধীরে ধীরে আবার বসে পড়ে টুকু। বলে, এটা কি আপনার কীর্তি? কিন্তু কবর থেকে মৃতদেহ তুলতে হলে তো নিকটতম আত্মীয়দের অনুমতি লাগে—

—না! স্বরাষ্ট্র বিভাগের নির্দেশে নিকট-আত্মীয়ের আপত্তি সত্ত্বেও কবর থেকে মৃতদেহ তোলা হয়। এমন নজির আছে।

—মাই গড! —টুকুর মুখখানা সাদা হয়ে গেল।

মিনিটখানেক কী ভেবে নিয়ে বললে, কিন্তু কেন? কী হেতুতে?

—কর্তৃপক্ষ সন্দেহ করেছেন, মিস্ পামেলা জনসনের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।

-–কর্তৃপক্ষ, না আপনি নিজে?

মামু নীরব রইলেন। নির্মল বললে, অত উতলা হচ্চো কেন টুকু?

—য়ু শাট আপ। তুমি কী বুঝবে? য়ু আর নট আ রোমান ক্যাথলিক! তারপর মামুর দুটি হাত নিজের মুঠিতে নিয়ে সে কাতরভাবে বললো, প্লীজ স্যার! এটা যেমন করে হোক বন্ধ করতে হবে! বুড়িটাকে সারা জীবন অনেক অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে! আমরা…আমরা সবাই নীচ, স্বার্থপর…কিন্তু মৃত্যুর পর বুড়ির কঙ্কালটাকে টেনে তুলবেন না! তাকে শান্তিতে ঘুমোতে দিন!

—এটাই তোমার অনুরোধ?

—অনুরোধ নয়, নির্দেশ! মাই ইন্সট্রাকশান্স। তাতে যদি আপনার ‘কালিঙ’ বিধ্বস্ত হয়ে যায় তো যাক! কবরের শান্তিকে কিছুতেই নষ্ট করা চলবে না।

—অল রাইট! তাই যদি তোমার নির্দেশ হয়।

* * *

নিচে নেমে এলে বলি, মামু, আমি ভাবছিলাম—

মামু আমাকে মাঝপথেই থামিয়ে দেন, ভাবো ভাবো ভাবতে থাকো। বাট প্লীজ ডোন্ট ডিসটার্ব মাই ঔন থট-প্রসেস। আমার চিন্তাধারায় বাধা দিও না। নাও সরে বসো। আমি গাড়িটা চালাবো। তুমি ভাবতে থাকো।

—কোথায় যাচ্ছি আমরা?

—নিউ আলিপুরে।

পিছনের সিটে বসলাম এবার। মনে হচ্ছে সমাধানে পৌঁছে গেছি। মামুর আশঙ্কাই ঠিক—মিস্ জনসনের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়—তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। আর সেটা স্মৃতিটুকু জানে! না হলে কবর থেকে মৃতদেহকে ওঠানোর প্রশ্নে সে অমন সাদা হয়ে যেতো না। কৈফিয়ত যেটা দিয়েছে সেটা ধোপে টেকে না। মিস্ হালদার আধুনিকা—পিটার দত্ত, ঊষা বিশ্বাস বা মিস জনসনের মতো সে-আমলের মানুষ নয়। রোমান ক্যাথলিক ও নামেই–হয়তো সাতজন্মে চার্চে যায় না! তাহলে মৃতদেহের উৎপাটনে সে কেন এত বিচলিত? কবরের শান্তি! সেটা আর যে কেউ বলুক–মিস্‌ টুকু হালদারের মুখে বেমানান। টুকু জানে—বড়পিসিকে কেউ খুন করেছে। সম্ভবত এটাও জানে—’কে’ খুনটা করেছে। কে? সুরেশ? তাই কি তার ঠিকানা চাওয়াতে সে মিথ্যে করে বলেছিল সুরেশ বোম্বাই চলে গেছে? নাকি এটা নিৰ্মল দত্তগুপ্তের কীর্তি? ডক্টর পিটার দত্তের পাঠানো ওষুধে কি সে এক পুরিয়া বিষ মিশিয়ে দেবার সুযোগ পায়নি? নির্মলের টাকার প্রচণ্ড দরকার—ওর সেই পেটেন্টটা নেবার ব্যাপারে। ওরা দুজনে মিলে কি এই কাজটা করেছিল? সিঁড়ির মাথায় মৃত্যুফাঁদটা খাটিয়েছিল নিশ্চয় টুকু। তাকে মিনতি স্বচক্ষে দেখেছে। পামেলা সে বাধা অতিক্রম করেছিলেন। তখন নাট্যমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছিল নির্মল–টুকুর যোগসাজশে। আর তাতেই ওদের দৃঢ় আপত্তি মৃতদেহটা কবর থেকে খুঁড়ে বার করে পরীক্ষা করানোতে! কিন্তু আমরা নিউ আলিপুরে ফিরে যাচ্ছি কেন? প্রশ্নটা করাতে মামু বললেন, আজ সকালেই হেনা আবার আসতে পারে। এবার যেন তাকে মিস্ না করি-

হ্যাঁ! হেনা! হেনা ঠাকুর। কী তার গোপন কথা? স্বামী তাকে পাগল বানাতে চায়? কেন? কোন্ তথ্যটা হেনা জানে, যাতে তার স্বামী তাকে পাগলা গারদে আটকে ফেলতে চাইছে? হঠাৎই একটা কথা মনে হলো! বলি, মামু! সবাই মিলে কিছু একটা করেনি তো?

—মিটিং করে সর্বসম্মতিক্রমে হত্যার সিদ্ধান্ত? না, কৌশিক! এক্ষেত্রে তা হয়নি। একটি মাত্র মস্তিষ্ক কাজ করেছে এক্ষেত্রে—এ আমার স্থির সিদ্ধান্ত! সর্বসম্মতিক্রমে তো নয়ই, এমনকি যৌথ প্রচেষ্টাও নয়।

—টুকু পেরেকটা পুঁততে পারে—কিন্তু বিষ প্রয়োগ—

–শোনো কৌশিক। মিনতি মাইতির গল্পটার তিন-তিনটি ব্যাখ্যা হতে পারে। এক : মিনতি আদ্যন্ত সত্যি কথা বলেছে। দুই : মিনতি কোনও স্বার্থ চরিতার্থ করতে বানিয়ে বানিয়ে বলেছে। তিন : সে যা বিশ্বাস করে তাই বলেছে—অর্থাৎ সে মিথ্যা বলেনি, কিন্তু তার ধারণাটাই মিথ্যে।

—আপনি তো স্মৃতিটুকুকে জিজ্ঞাসা করলেন না—মেরীনগরে যাওয়ার সময় সে ঐ ব্রোচটা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল কি না?

—কী লাভ হতো? সে হয় সত্যি কথা বলতো, অথবা মিথ্যা! প্রমাণ তো নেই!

নিউ আলিপুরে পৌঁছে শোনা গেলো ইতিমধ্যে কেউ আসেনি।

মামু টেলিফোনটা তুলে নিয়ে প্রীতমের বাড়িতে ফোন করলেন :

—হ্যালো, ডক্টর ঠাকুর? আমি বাসু বলছি…কোনো খবর পেলেন?…বলেন কী?…কাল রাত আটটায়?…বাচ্চাদের নিয়ে গেছে?…তা তো বটেই…আমি কি কোনও চেষ্টা করে দেখবো?…ও আচ্ছা আচ্ছা! উইশ য়ু বেস্ট অফ লাক!

টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রেখে বললেন, হেনা কাল রাত্রেই বাচ্চাদের নিয়ে চলে গেছে সে তো জানোই। প্রীতম এখনো তার সন্ধান পায়নি। তবে সে আমার সাহায্য চাইছে না। সে নিজেই খুঁজে বার করতে পারবে বলছে। মিসেস ঠাকুরের কাছে টাকাকড়ি সামান্যই আছে—অর্থাৎ বেশিদিন সে লুকিয়ে থাকতে পারবে না।

—আপনার কি মনে হয় হেনার সামান্য মস্তিষ্ক বিকৃতি সত্যিই হয়েছে।

-–সে খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছে এটা বোঝা যাচ্ছে। পাগল হয়নি।

—তাহলে এখন আমরা কী করবো?

—খেয়ে নিয়ে কিছু বিশ্রাম। বিকালে মিনতির কাছে যেতে হবে।

—আবার মিনতি? ঐ তিনটে বিকল্প পথের কোনটা ঠিক যাচাই করতে?

—চলো খেয়ে নেওয়া যাক। বিকেল চারটেয় আমরা বের হবো।

২৩

বাসু-মামুর সঙ্গে কাজ করতে হলে ঘড়ির কাঁটার দিকে নজর রাখতে হয়। ঠিক চারটের সময় ওঁর ঘরে গিয়ে দেখি উনি তৈরিই, তবে টেবিলে বসে কী-যেন লিখছেন তখনো।

—কী লিখছেন মামু? চিঠি?

উনি বাঁ-হাতটা তুলে আমাকে গোল করতে বারণ করলেন। চুপচাপ বসে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাতে থাকি। আর মিনিট পনেরো লাগলো ওঁর চিঠিটা শেষ করতে। তারপর ড্রয়ার থেকে একটা বড় খাম বার করে চিঠিখানা ভরলেন। নজর হলো, চিঠিটা বেশ বড়—পাঁচ-ছয় পাতা। তার মানে দ্বিপ্রহরে উনি আদৌ বিশ্রাম নেননি। আশ্চর্য! খামটায় কাগজগুলো ভরে আঠা দিয়ে বন্ধ করলেন, কিন্তু উপরে ঠিকানা লিখলেন না, টিকিটও সাঁটলেন না। পকেটে ভরে ফেলে বললেন, চলো, এবার যাওয়া যাক।

আমি বলি, আপনি কিন্তু চিঠির উপর প্রাপকের নাম লেখেননি!

—আই নো হোয়াট আয়াম ডুইং! —হেসে বললেন উনি।

আমিও হাসতে হাসতে বলি, ও-কথা মিস্ জনসনও বলেছিলেন। তিনি কিন্তু খামের উপর নাম-ঠিকানা লিখেছিলেন, টিকিটও সেঁটেছিলেন। শুধুমাত্র ডাকে দিতে ভুলে যান।

—দ্যাটস্ আ গুড ওয়ান! চলো!

***

মিনতি আমাদের পেয়ে যথারীতি ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এবার অবশ্য তার উত্তেজিত হবার যথেষ্ট হেতু আছে। দোরগোড়ায় আমাদের রুখে দেবার। বললে, আপনি এসে পড়েছেন, খুব ভালো হয়েছে। আপনাকে ফোন করবো কিনা ভাবছিলাম। ইতিমধ্যে একটা ভীষণ কাণ্ড হয়েছে।

বাসু ওকে সরিয়ে ঘরে ঢুকলেন। চেয়ারে বসতে বসতে বলেন, ভীষণ কাণ্ড! কী? মিনতি দরজার ছিটকিনিটা বন্ধ করে ফিরে এলো। ফিফিস্ করে বললে, ইয়ে হয়েছে…. হেনা আমার কাছে পালিয়ে এসেছে!

–হেনা! পালিয়ে এসেছে? কোথায় সে?

শেষ প্রশ্নটাই আসল। সেটাকে এড়িয়ে মিনতি বাকি দুটো প্রশ্নের উপর একটা থিসিস রচনা করতে বসলো; হেনা তার স্বামীকে ভয় পায়… পাওয়ার কথা। কাবুলিওয়ালাকে সবাই ভয় পায়! ও যে কেমন করে অমন একটা দাড়িয়ালা যণ্ডামার্কাকে বিয়ে করেছিল এটাই আশ্চর্য!… তবে এটা সে ভালোই করেছে… ঐ ডিভোর্স নেবার সিদ্ধান্ত। একথা ঠিক যে, হেনা নিঃস্ব, তার উপার্জন নেই—তা হোক, অমন স্বামীর কাছে ফিরে যেতে দেবে না মিনতি।…হ্যাঁ, লোকটা যদি কাবুলিওয়ালা না হতো, বাঙালি হতো…

বাসু-মামু ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন না যে, প্রীতম ঠাকুর কাবুলিওয়ালা নয়, বললেন, হেনা এখন কোথায়?

—এই হোটেলেই। একতলার চার নম্বর ঘরে। আমরা বুদ্ধি করে হোটেলের খাতায় ওর নাম-ধাম সব বদলে দিয়েছি। যাতে সেই কাবুলিওয়ালাটা না খোঁজ পায়।

—ও কি কাল রাতে এসেছে? রাত সাড়ে আটটা ন’টায়? ছেলেমেয়ে নিয়ে?

–না তো! সে এসেছে আজ সকালে। ছেলেমেয়েদের আনেনি। আজ ওবেলা নিয়ে আসবে। তারা আছে ওর এক বান্ধবীর বাড়ি। ভবানীপুরে, পদ্মপুকুর রোডে।

—তার মানে তুমি হেনাকে সাহায্য করবে বলে স্থির করেছো?

—করবো না? এ তো আমার কর্তব্য! আপনি সেদিন যা বললেন—ম্যাডাম যদি সেজন্যই তাঁর সর্বস্ব আমাকে দিয়ে গিয়ে থাকেন, তাহলে হেনা বেচারি অহেতুক শাস্তি পাচ্ছে! ফাঁদ পাতলো টুকু, টাকা হাতালো সুরেশ আর দু-দু’টো সন্তানের জননী বঞ্চিত হলো তার ন্যায্য পাওনা থেকে! আর বেচারীর কী কপাল দেখুন—ওর স্বামী এখন ওকে পাগলা গারদে পাঠাতে চায়।

—তাই নাকি। ও বলছে?

—চলুন! ওর নিজ মুখেই শুনুন।

আমরা একতলায় নেমে আসি। চার নম্বর ঘরের রুদ্ধদ্বারে ‘নক’ করতে ভিতর থেকে কেউ সাড়া দিল না। মিনতি ইতিউতি দেখে নিয়ে অনুচ্চস্বরে বললে, হেনা ভয় নেই, দোর খোল, আমি মিন্টিদি—

এবার দরজাটা খুলে গেল। হেনাকে যেন চেনাই যায় না। চুল উসকো-খুসকো! প্রসাধনের চিহ্নমাত্র নেই। প্রায় পাগলির মতো দেখতে হয়েছে তাকে। চোখে উদভ্রান্ত না হলেও আতঙ্কতাড়িত দৃষ্টি। মিনতির পিছনে আমাদের দুজনকে দেখে একটা চাপা আর্তনাদ করে উঠলো। মিনতি দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে বললে, ভয় নেই হেনা, বাসু-মামু তোমাকে ধরিয়ে দেবেন না। তিনি আমাদের দলে। পারলে উনিই তোমাকে বাঁচাতে পারেন। উনি উকিল—বিবাহ-বিচ্ছেদের সুলুক-সন্ধান দিতে পারবেন।

মামু একটা চেয়ারে বসলেন। আমাকেও বসতে বললেন। তারপর মিনতির দিকে ফিরে বললেন, তুমি বরং তোমার ঘরে যাও মিনতি। প্রীতম হেনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সে তোমার ঘরে খোঁজ নিতে আসতে পারে। হোটেলের বয়টা তোমাকে নিচের চার-নম্বর ঘরে আসতে দেখেছে….

মিনতি ত্রিং করে লাফ মারে : ঠিক কথা! আমি যাই। আপনারা কথা বলুন। যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে দেখা করে যাবেন কিন্তু।

মিনতির প্রস্থানের পরে বাসু-মামু দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে ফিরে এসে বসলেন। বললেন, হেনা, তুমি কাল বিকালে আমার কাছে এসেছিলে…

—হ্যাঁ! আমার নিতান্ত দুর্ভাগ্য আপনি বাড়ি ছিলেন না। তাই…তাই নিজে নিজেই সিদ্ধান্তটা নিতে হলো..

—কী সিদ্ধান্ত? প্রীতমকে ছেড়ে পালিয়ে আসা?

— হুঁ

—তুমি সেদিন আমাকে কী-একটা কথা বলতে এসেছিলে–সেই যেদিন আমি তোমাদের বাড়ি প্রথম যাই। তুমি বলবার সুযোগ পাওনি, প্রীতম এসে যাওয়ায়। কথাটা এখন বলো—

হেনা আঙুলে তার আঁচলের খুঁটটা একবার জড়াচ্ছে, একবার খুলছে! সুস্থ-মস্তিষ্কের লোক এমনটা সচরাচর করে না। সে জবাব দিল না আদৌ।

—কী হলো? বলো? কী? তোমার সেই গোপন কথা?

—না! আমার সাহস হচ্ছে না! আমি… আমি বলতে পারবো না…

— কেন? বললে কী হবে?

—ও যদি জানতে পারে… তাহলে… তাহলে আমার ভীষণ বিপদ হবে।

—কেউ তা জানতে পারবে না। এখানে তো আর কেউ নেই।

–ও ঠিক টের পেয়ে যাবে! ও যে কী ভীষণ, আপনি জানেন না।

–‘ও’ মানে? তোমার স্বামী?

—আবার কে?

মামু একটু টুপ করে ওকে দেখতে থাকেন। তারপর বললেন, কাল বিকালে তুমি চলে যাবার পরেই প্রীতম আমার কাছে এসেছিল।

স্পষ্টতই শিউরে উঠলো মেয়েটা। বললে, কী বললে? আমি… আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি?

—প্রীতম বললে, তুমি খুব মানসিক উত্তেজনার মধ্যে আছো!

—না! আপনি রেখে-ঢেকে বলছেন! ও বলেছে, আমি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছি। ছলে-বলে-কৌশলে ও আমাকে ওর বন্ধুর পাগলা গারদে আটকে রাখতে চায়। যাতে সেই কথাটা আমি কাউকে বলতে না পারি। বললেও সবাই ভাববে পাগলের প্রলাপ! তাই নয়?

—কোন কথাটা হেনা! কী এমন কথা?

—না! আমার সাহস হচ্ছে না।

—লুক হিয়ার হেনা! কথাটা বলে ফেললে আর তোমার ভয় নেই। তখন আর সেটা গোপন কথা থাকবে না—এখন যদি তুমি আমাকে বলো, তাহলে তা তো আর পাগলের প্রলাপ হবে না। এখনো তো কেউ তোমাকে পাগল প্রমাণিত করেনি!

—আমি কেমন করে জানবো যে, আপনি ওর দলে নন? ও আপনার সঙ্গে দেখা করেছে বললেন–হয়তো ও আপনাকে এমপ্লয় করেছে, ওর স্বার্থে…

বাসু-মামু দৃঢ়স্বরে বললেন, শোন হেনা। এই কেস-এ আমার মক্কেল মৃতা পামেলা জনসন। আর কেউ নন। তাঁর কোনো স্বার্থের প্রশ্ন উঠছে না। আমি শুধু ‘সত্য’র পক্ষে, ন্যায়-ধর্মের পক্ষে।

হেনা মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, সে তো আপনি বলছেন। প্রমাণ কী? আপনি জানেন না, এই কয় বছর কী যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে আমার কেটেছে! না, আমি ওর কাছে ফিরে যাবো না। বাচ্চাদেরও দেবো না! আমি নিঃস্ব, কিন্তু মিন্টিদি আমাকে সাহায্য করবেন! তিনি কথা দিয়েছেন!

মামু বলেন, উত্তেজিত হয়ো না হেনা। খোলাখুলি বলো তো—মিস্‌ পামেলা জনসনের মৃত্যু যে স্বাভাবিকভাবে হয়নি, তা তুমি জানো। নয়?

হেনা মুখটা তুলতে পারে না। গ্রীবা সঞ্চালনে স্বীকার করে।

—বিষের ক্রিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। ঠিক?

এবারও সে নীরব। কিন্তু মাথা নেড়ে সায় দেয়।

—তুমি কি সন্দেহ কর এর পিছনে তোমার স্বামী, প্রীতমের হাত আছে?

হঠাৎ মুখ তুলে তাকালো মেয়েটা। যেন দপ্ করে জ্বলে উঠলো। সন্দেহ করবো কেন? আমি তো জানিই!

—কী জানো? কেমন করে জানো? খুলে বলো আমাকে—

আবার নীরবতা।

—ব্যাপারটা কি ঘটে সেই শেষ রবিবারে, যেদিন তোমাকে না জানিয়ে প্রীতম ঘণ্টাখানেকের জন্য মরকতকুঞ্জে গিয়েছিল?

—হ্যাঁ! সে গোপন করতেও চেয়েছিল তার মেরীনগরে যাবার কথাটা।

—কিন্তু তুমি কেমন করে তা জানতে পারলে?

—সেটা এখনি আপনাকে বলতে পারবো না।

বাসু-মামু একটু ভেবে নিয়ে বললেন, কিন্তু সেটা যদি আমি তোমাকে এখনি বলে দিই, তুমি কি সেটা স্বীকার করবে, অথবা অস্বীকার?

—আগে বলুন—

—বলছি। তার আগে আমাকে বলো তো—মীনা আর রাকেশকে তুমি যে বান্ধবীর বাসায় রেখে এসেছো সে কি জানে তুমি প্রীতমকে ছেড়ে এসেছো?

—না। সে কিছুই জানে না।

—তাকে কি প্রীতম চেনে? তোমার বান্ধবীকে? তার বাড়ি চেনে?

—হ্যাঁ, তা চেনে। কিন্তু প্রীতম সেটা সন্দেহ করবে না।

—করবে। সে অত্যন্ত ধূর্ত। তাছাড়া কলকাতায় তোমার বান্ধবী খুব কম, তাই নয়? তুমি পাটনায় মানুষ হয়েছো। কলকাতায় তোমার যে পাঁচ-সাতটি বান্ধবী আছে প্রীতম পর্যায়ক্রমে তাদের বাসায় যাবে। তোমার বান্ধবী জানে না যে, তুমি চিরকালের জন্যে প্রীতমকে ত্যাগ করে এসেছো—ফলে প্রীতম যদি মীনা আর রাকেশকে নিয়ে যেতে চায়, তোমার বান্ধবী বাধা দেবে না। প্রীতম যদি ছেলেমেয়েকে আটকে রাখে তখন তোমার পক্ষে আর পালিয়ে বেড়ানো সম্ভবপর হবে না।

—কিন্তু তা কেমন করে হবে? আমি তো এখনি গিয়ে ওদের নিয়ে আসবো?

—বুঝলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে যদি দেখো প্রীতম বসে আছে?

হেনা শিউরে উঠলো। বিহ্বলের মতো মামুর দিকে তাকিয়ে দেখলো। মামু বললেন, তার চেয়ে এক কাজ করো, একখানা হাত চিঠি লিখে দাও আমার সঙ্গে সে বাচ্চাদের আসতে দেয়। লেখো, তোমার শরীরটা হঠাৎ খারাপ হয়েছে তাই নিজে যেতে পারছো না।

হেনা যুক্তির সারবত্তা প্রণিধান করলো। রাজি হলো। একখণ্ড কাগজে সেই মতো চিঠি লিখে দিল বান্ধবীকে। বললো, ওদের নিয়ে এখনই চলে আসুন।

—না। বাচ্চাদের আমার বাড়ি নিয়ে যাবো। আমার কাছে এক রাত্রি রাখবো। এখানে ওদের নিয়ে আসা ঠিক হবে না। কাল সকালে অন্য কোনও হোটেলে তোমার জন্য ঘর বুক করে বাচ্চাদের নিয়ে আমি সেখানে অপেক্ষা করবো। এই কৌশিক এসে তোমাকে সেখানে নিয়ে যাবে। বাচ্চারা সেখানেই থাকবে তোমার কাছে।

—কেন? এখানে কী আপত্তি?

—বুঝছো না কেন? তুমি নিজে এখানে ঘরের ভিতর লুকিয়ে থাকতো পারো, বাচ্চাদের লুকিয়ে রাখতে পারবে না। প্রীতম জানে, তোমার কাছে টাকাকড়ি বিশেষ নেই। সে স্বতই ভাববে, তুমি মিনতির দ্বারস্থ হবে। তাই এই হোটেলটায় বারে বারে খোঁজ করবে। তুমি মিন্টির কাছে যাতায়াত করছো কি না জানতে। যে কোন সময়ে তুমি বাচ্চাদের জন্য ধরা পড়ে যাবে।

এবার যুক্তির সারবত্তা প্রণিধান করলো হেনা। রাজি হলে।

—তাহলে বাচ্চাদের আমার হেপাজতে রেখে তুমি নিশ্চিন্ত হলে তো?

—কেন হবো না? রাকেশ কিন্তু ঝাল খেতে পারে না। রাত্রে ও দুধ রুটি খায়। -ও আচ্ছা। এবার মন দিয়ে শোনো আমি কি বলছি—

হেনা প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে : না! আমি তো বলেছি, আর কিছু বলতে পারবো না।

—আমি তোমাকে শুনতে বলছি হেনা, কিছু বলতে নয়। শোনো—ধরে নাও আমি জানি—আমি জানি, কী করে মিস্ জনসন মারা যান। মানে যুক্তির খাতিরে তোমাকে এটা ধরে নিতে বলছি। ধরো, তুমি যে কথাটা জানো, তোমার ‘গোপন কথা’ সেটা আমি জানি। আমি সেটা অনুমান করতে পেরেছি। তা যদি ঘটে থাকে তাহলে পরিস্থিতিটা একটু বদলে যায়। যায় না কি?

হেনা সন্দিগ্ধ চোখে একদৃষ্টে ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকে।

—বিশ্বাস কর হেনা, কথার প্যাঁচে তোমাকে দিয়ে কিছু স্বীকার করিয়ে নিচ্ছি না আমি। প্রতিটি কথার উত্তর ভেবেচিন্তে দিও। তোমার ‘গোপন-কথা’র বিষয়ে কোনও ইঙ্গিত না দিয়ে। এবার বলো, যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায় যে, আমি সব কিছু জানি, তাহলে পরিস্থিতিটা অন্যরকম হয়ে যায়। তাই না?

হেনা একগুঁয়ের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে বললে, আপনি কিছুতেই সেটা অনুমান করতে পারবেন না—এ হয় না! প্রীতম কী ভাবে…না, না, আমি কিছু বলবো না!

মামুর পেশাই হচ্ছে সওয়াল-জবাব করা। ধৈর্য ধরে একই কথা বললেন আবার, তোমাকে বলতে তো কিছু বলছি না। শুধু স্বীকার করতে বলছি, যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায় যে, আমি সব কিছু জানি, তাহলে তোমাকে আবার সব কিছু নতুন করে ভাবতে হবে—যেহেতু পরিস্থিতিটা বদলে যাচ্ছে। নয়?

হেনা এবার স্বীকার করতে বাধ্য হলো, হ্যাঁ, তাই।

—গুড। এবার শোনো : আমি পি. কে. বাসু, এ রহস্যের কিনারা সন্দেহাতীতভাবে করেছি! এটাই আমার পেশা। আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। আমি সব কিছু জানি—মায় তোমার ঐ ‘গোপন-কথা’টা…না, না, কথা বোলো না। শুধু শুনে যাও। তুমি যে কথাটা আমাকে বলতে পারলে না, কখনো কাউকেই বলতে পারবে না—সেটা আমি লিখে এনেছি। এই নাও এটা ধরো-

পকেট থেকে সেই মুখবন্ধ খামটা বার করে ওর হাতে গুঁজে দিলেন। বললেন, আমরা চলে যাবার পর ঘরটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে এটা পড়ো। তারপর পুড়িয়ে ফেলো! যদি মনে করো, আমি যা লিখেছি তা ঠিক নয় তাহলে কাল সকালে আমাকে তা জানিও। না, কাল সকালে নয়। আজ রাত্রেই আমাকে টেলিফোন কোরো। আর যদি মনে করো আমি ঠিকই লিখেছি…

—তাহলে?

–সে কথা কাল হবে। চিঠিটা আগে পড়ে দেখো।

হোটেল থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে মামু বললেন, মানুষের পক্ষে যেটুকু সম্ভব তা আমরা করেছি। বাকিটা করুণাময় ঈশ্বরের হাতে!

আমি বলি, আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?

—করি, আই হ্যাভ ইম্পেকে ফেইথ ইন হিজ ইনয়েজরে জাস্টিস!

***

বাড়ি ফিরে দেখি আমাদের প্রতীক্ষায় বসে আছে ডক্টর নির্মল দত্তগুপ্ত

—কী ব্যাপার? ডক্টর দত্তগুপ্ত কী মনে করে?

—আপনার বেশি সময় নষ্ট করবো না স্যার। আমার নিজেরও তাড়া আছে কাঁচড়াপাড়ায় ফিরতে হবে। দু-একটি কথা জানতে এলাম।

—বলো?

—আপনি আসলে কী চাইছেন, বলুন তো? আপনার ভূমিকাটা কী? কে আপনার মক্কেল?

—কেন? তুমি তো জানোই-মিস্ স্মৃতিটুকু হালদার।

নির্মল গম্ভীরভাবে বললে, এক্সকিউজ মি স্যার, আমি নির্বোধ নই। দুজনেরই সময়ের দাম আছে। কথাবার্তা খোলাখুলি হলেই ভালো হয়। প্রথম কথা, আপনি ছদ্ম পরিচয়ে যখন প্রথম মেরীনগরে যান তখনো আপনি টুকু বা সুরেশকে চিনতেন না। কিন্তু তার আগেই আপনি মিস্ জনসনের চিঠিখানা পেয়েছেন। সেকেন্ডলি, আপনার সম্বন্ধে ইতিমধ্যে আমি খোঁজখবর নিয়েছি—প্রতিটি সূত্রই বলছে, আপনার ইন্টিগ্রিটি ইম্পেকেল্’! অসত্যের সঙ্গে মিথ্যার হাত মেলানো আপনার ধাতে নেই। টুকুকে যেভাবে মিথ্যার লোভ দেখিয়ে বিশ্বাসভাজন হয়েছেন সেটা আপনার চরিত্রের সঙ্গে মেলে না। আই রিপিট! আপনি কী চাইছেন?

মামু বললেন, যদি বলি, আমার মক্কেল মিস্ পামেলা জনসন, তাহলে তুমি বিশ্বাস করবে না। তাই বলছি : আমার মক্কেল একটি অ্যাবস্ট্রাক্ট নাউন—টুথ! আমি সত্যান্বেষণ করছি।

—কিন্তু আপনার ব্যক্তিগত স্বার্থটা কী? ঘরের খেয়ে কেন বনের মোষ তাড়াচ্ছেন?

-–বলছি। তার আগে বলতো ডক্টর দত্তগুপ্ত-তোমার স্বার্থটা কী? তুমি কেন ঘরের খেয়ে বোনের মোষ তাড়াতে এই এখন নিউ আলিপুরে ছুটে এসেছো? কাকে বাঁচাতে চাইছো? সুরেশকে না টুকুকে?

নির্মল হাসলো। বললো, আমি ডাক্তার আর আপনি ব্যারিস্টার। বাকযুদ্ধে আপনার সঙ্গে পারবো না। হ্যাঁ, আমাকে বলতে হবে যে, দুটোর একটাও নয়। সুরেশ বা টুকুকে বাঁচাবার জন্যে আমি ছুটে আসিনি। এ শুধু দুরন্ত কৌতূহল। আর সে কথাটা বললেই আপনার যুক্তিটা মেনে নেওয়া হয়—আপনিও ঐ চিঠিখানা পেয়ে দুরন্ত কৌতূহলে মেরীনগরে ছুটে গেছিলেন।

—না, নির্মল, ভুল হলো তোমার। শুধুমাত্র অ্যাকাডেমিক কৌতূহল নয়। মিস্ পামেলা জনসনের চিঠিখানা পড়েই আমি মনশ্চক্ষে দেখতে পেয়েছিলাম তাঁকে—দৃঢ়চেতা, বুদ্ধিমতী, পরমশ্রদ্ধেয়া একটি বৃদ্ধাকে। পারিবারিক কৌলিন্য সম্বন্ধে যাঁর কঠোর দৃষ্টি, কিন্তু যিনি আত্মরক্ষা করতে জানেন। তিনি আমার বুদ্ধির উপর আস্থা রেখেছিলেন—সেই আস্থার মর্যাদাটুকু আমাকে কড়ায়-গণ্ডায় মিটিয়ে দিতে হবে। আমার মক্কেল–বিলিভ ইট, অর নট : আমার বিবেক।

—অর্থাৎ ঐ ‘বুবি-ট্র্যাপটা’ যে খাটিয়েছিল তাকে আপনি খুঁজে বার করবেনই?

—না। সেটা আমি জানি। আমি খুঁজে বার করছিলাম—কে বিষ প্রয়োগে তাঁকে হত্যা করেছে।

—এটাই আপনার অনুমান?

—না। আবার ভুল হলো তোমার—অনুমান নয়, স্থির সিদ্ধান্ত। শুধু তাই নয়, আমি এ-কথাও জানি—কে তাঁকে হত্যা করেছে।

—তাও জানেন? তবে তাকে গ্রেপ্তার করছেন না কেন? প্রমাণের অভাবে?

—ঠিক তাই। তবে আশা করছি আগামীকালই প্রমাণটা আমার হাতে আসবে। নির্মল আবার হাসলো। মাথা ঝাঁকিয়ে বললে : আহ্! টুমরো! ‘আগামীকাল’! দ্য লাস্ট সিলেব্‌ব্ল অফ রেকর্ডেও টাইম। আমার অভিজ্ঞতা বলে, ‘আগামীকাল’ বস্তুটা মরীচিকার মতো—কেবলই পিছিয়ে যায়।

—তুমি ক্রমাগত ভুল বলে যাচ্ছো। নির্মল! আমার জীবনে ‘আগামীকাল’ বস্তুটা আরও কয়েক হাজার বেশিবার এসেছে—আই মিন, তোমার চেয়ে। আমি বরাবর দেখেছি, ‘আগামীকাল টা অনিবার্যভাবে আজকের ঠিক পরেই আসে!

নির্মল দাঁড়িয়ে ওঠে। বলে, আগেই বলেছি, আপনার সঙ্গে আমার মতো লোকের তর্কযুদ্ধ শোভা পায় না। তাহলে পরশুই আসবো—

—এসো। তোমার নিমন্ত্রণ রইলো।

—থ্যাঙ্কস। গুড নাইট স্যার! আগামী পরশুটাও অনিবার্যভাবে আসবে আগামীকালের পরেই। তখনই জানা যাবে কে আপনার টার্গেট—টুকু, সুরেশ, হেনা অথবা প্ৰীতম?

—ব্যস্! লিস্ট খতম? সন্দেহভাজন আর কেউ নেই?

—আপনার তালিকায় আছে কি না আমি জানি না। কিন্তু মিনতি মাইতিকে আমি লিস্ট থেকে বাতিল করেছি অনেক আগেই—

—না, মিনতির কথা বলছি না আমি; কিন্তু আর একটি পঞ্চম সন্দেহজনক লোকের নাম তো নেই তোমার তালিকায়?

—পঞ্চম নাম? কী সেটা?

—ডক্টর নির্মল দত্তগুপ্ত।

একটু হকচকিয়ে যায়। পরমুহূর্তেই হেসে ওঠে। বলে, আয়াম রিয়ালি সরি স্যার! হ্যাঁ, সে নামটা আমার মনে পড়েনি। দশমত্ত্বমসি! কারেক্ট! তার হবুপত্নীর অর্থলোভে সেও লাভবান হতো বটে! তাছাড়া সে ছিল ডক্টর পিটার দত্তের সাকরেদ। আচ্ছা চলি। অনেকটা সময় নষ্ট করে গেলাম আপনার।

—নট অ্যাট অল! নট অ্যাট অল!

২৪

নৈশাহারের টেবিলে এসে দেখি একটিমাত্র খাবার প্লেট সাজিয়েছে বিশু। তার দিকে কৌতূহলী চোখ মেলে তাকাতেই সে কৈফিয়ত দিল—বড়সাহেব রাতে খাবেন না বললেন।

শুয়ে পড়েছেন?

—আজ্ঞে না। আজ আবার বোতলটা বার করেছেন।

ইদানীং মামু প্রত্যহ সন্ধ্যায় মদ্যপান করেন না। আগে তাঁর দৈনিক বরাদ্দ ছিল এক পেগ বিলাইতি। ইদানীং মাঝে মধ্যে বোতলটা বার করেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না, আজ তাঁর চিত্তচাঞ্চল্যের কোনও হেতু হয়েছে। এটাও বুঝতে পারছি, সমস্যাটার সমাধান হয়ে গেছে। হেনার সেই ‘গোপন কথা’—যেটার কোনও আঁচ আমি করতে পারছি না, সেটা কোনও না কোনও সূত্রে উনি জেনে ফেলেছেন। কিন্তু কেমন করে তা হলো? উনি যা জানেন, যেটুকু জানেন, আমিও তো তাই জানি। আমার চোখের আড়ালে এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি যা শুধুমাত্র ওঁর জানা। তাহলে? প্রীতম ঐ এক ঘণ্টার মধ্যে কীভাবে কাজ হাসিল করে এলো? যদি হেনার কথাটা সত্যি হয় অবশ্য। না হলে, কী তার গোপন কথা? আর তাহলে মিনতি কেমন করে স্মৃতিটুকুকে দেখলো সিঁড়ির মাথায়? তাহলে কি ধরে নেবো—দুটো কাজ দুজনের? ফাঁদটা পেতেছিল টুকু, আর বিষটা মিশিয়েছে প্রীতম? কিন্তু তাও তো হবার নয়—মামু আমাকে স্পষ্টই বলেছেন, এটা একই হাতের কাজ। হত্যাকারী এবং হত্যার যে চেষ্টা করেছিল তারা এক এবং অভিন্ন। তাহলে? কে সে?

আহারান্তে গুটিগুটি এগিয়ে গেলাম বাসু-মামুর শয়নকক্ষে। পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখলাম উনি একটা সিল্কের গাউন পরে ইজিচেয়ারে অর্ধশয়ান। পাশের টিপয়ে রাখা আছে ‘শিভাস রিগাল’-এর বোতলটা, একটা গ্লাস, বরফের প্লেট! চোখ দুটি বোজা। পাইপটা ওঁর ঠোট থেকে ঝুলছে। জেগেই আছেন।

মামুর শয়নকক্ষ একতলায়। রানীমামিমা সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে পারেন না। আমাদের শয়নকক্ষ দ্বিতলে। পা টিপে টিপে ফিরে এলাম নিজের ঘরে। খাটে শুয়েও ঘুম এলো না। আবোল-তাবোল চিন্তা করতে করতে ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। রাতে পৌনে এগারোটার সময় হঠাৎ ঝনঝন করে বেজে উঠলো টেলিফোনটা। নিচে মামুর ঘরে রাখা আছে সেটা—একটা এক্সটেনশান দ্বিতলের লাউঞ্জেও আছে। নিচে যে ইজিচেয়ারে মামু বসে আছেন সেখান থেকে হাত বাড়ালেই উনি ফোনটার নাগাল পাবেন। তাই ব্যস্ত হইনি। কিন্তু বার পাঁচ-ছয় বাজার পরে মনে হলো, উনি নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। উঠে গিয়ে ফোনটা ধরলাম।

—হ্যালো?

—মিস্টার পি. কে. বাসু স্যার?—মহিলার কণ্ঠস্বর।

—না, আমি কৌশিক বলছি। আপনি কে? মিসেস ঠাকুর?

—হ্যাঁ বাসু-সাহেব কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?

—সম্ভবত। ডেকে দেব?

—না, দরকার নেই। কাল সকালে ওঁকে খবরটা দিলেই চলবে।

—কী খবর? বলুন?

—ওঁকে বলবেন, তিনি চিঠিতে যা লিখেছেন তাই ঠিক।

—বলবো। আর কিছু?

—মীনা আর রাকেশ ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়?

বুঝতে পারি, ও ধরে নিয়েছে ওর বাচ্চা দুটো এ বাড়িতেই আছে। আমরা যে এখনো ওদের নিয়ে আসিনি তা ও জানে না! কিন্তু মামুর শাকরেদি করে করে এটাও অভ্যাস করে ফেলেছি। রাত পৌনে এগারোটায় হেনার বান্ধবীর বাড়িতে বাচ্চা দুটো নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে। ফলে এটা টুথ, হোলট্রুথ অ্যান্ড নাথিং বাট দ্য ট্রুথ!

বলি, খুব সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছে। ওরা আমার ঘরে শোয়নি। আর কিছু?

—হ্যাঁ। বাসু-সাহেবকে বলবেন কাল সকালেই এখানে চলে আসতে। জরুরি দরকার আছে। বাচ্চা দুটোকে তখন আনার দরকার নেই। বুঝেছেন? তাদের পরে আনলেই চলবে।

—বলবো। আর কিছু?

—না!

—গুড নাইট!

হেনা নিঃশব্দে টেলিফোনটা রিসিভারে নামিয়ে রাখল। ‘শুভরাত্রি’ না বলেই।

বারান্দায় গিয়ে উঁকি দিলাম। মামুর ঘরে বাতিটা জ্বলছে। বাতি জ্বেলেই ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম নীচে। ওঁর ঘরের সামনে এসে পর্দাটা সরিয়ে দেখতে পেলাম—ঠিক একই ভঙ্গিতে ইজিচেয়ারে বসে বসে আছেন উনি টেলিফোন-রিসিভারটা তখনো তাঁর কানে ধরা আছে। আমাকে দেখতে পেয়ে যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন। যন্ত্রটা যথাস্থানে নামিয়ে রাখলেন। অর্থাৎ এক্সটেনশান-লাইনে উনি দু’পক্ষের কথাই শুনেছেন। আমার কোনও কিছু বলা নিতান্ত বাহুল্য। তখনই নজর হলো উনি হাত নেড়ে আমাকে স্থানত্যাগ করতে বলছেন। মনে হলো, নেশাটা বেশ জমেছে তাঁর।

দ্বিতলে উঠে আসি। ঘুম আসতে দেরি হলো। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।

ঘুম ভাঙলো বেলায়। টেলিফোনের শব্দে। প্রথমেই নজরে পড়লো ঘড়ির দিকে। পৌনে আটটা। টেলিফোনটা কতক্ষণ বাজছে কে জানে। উঠে গিয়ে ধরলাম!

—হ্যালো? বাসু-মামু? ও, আপনি কৌশিকদা? শুনুন! আমি যে কী বলবো ভেবেই পাচ্ছি না।

কণ্ঠস্বরেই শুধু নয়, বাচনভঙ্গিতেও বোঝা যায় ও প্রান্তে মিনতি মাইতি। আর কেউ সাত সকালে টেলিফোন করে বলতে পারে না—সে কী বলবে তা ভেবে পাচ্ছে না।

—শুনুন কৌশিকদা। এদিকে একটা সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার হয়ে গেছে কাল রাত্রে।

–কী ‘সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার’? প্রীতম খোঁজ পেয়ে গেছে?

—না, না, সেসব কিছু নয়! প্রীতম কিছুই জানে না। ওর ফোন নাম্বারটা আমি জানি না। ওকে কি এখন জানানো উচিত? আমাকে এরা নাজেহাল করছে—হেনার মিথ্যা পরিচয় দেওয়ার জন্য। হেনা তো ধরা-ছোঁওয়ার বাইরে—এখন এরা যত দোষ নন্দ ঘোষ’ করছে। বলছে, আপনিই তো ওর মিথ্যা পরিচয় দিয়েছেন। দোষ তো আপনারই। বলুন, দাদা, আমার কী দোষ? আমি ওকে প্রীতমের হাত থেকে বাঁচাতেই তো এই মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিলাম। আমার আর কী স্বার্থ থাকতে পারে?

এ ভদ্রমহিলা কি একটা কথাও সহজ করে বলতে পারে না? ধমকে উঠি : কী হয়েছে আগে জানি। হেনা হোটেল ছেড়ে পালিয়ে গেছে?

—না, না, সে তো এখনও ওর ঘরেই শুয়ে আছে! ঘণ্টাখানেক আগে ব্যাপারটা জানাজানি হয়েছে!

—কোন ব্যাপারটা জানাজানি হয়েছে? আসল কথাটা যে এখনো জানি না আমি?

—কালরাতে হেনা ভুলের বশে বেশি করে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেছে। আজ সকালে বেড-টি নিয়ে যে যায় সে প্রথম টের পায়—ও প্রথমটায় ভেবেছিল….

—হেনা মারা গেছে?

—তাই তো বলছি তখন থেকে। ভুল করে বেশি ঘুমের ওষুধ খেয়ে! এখন কী হবে? মীনা আর রাকেশ এতটুকু বয়সে মাতৃহীন হয়ে গেল! অবশ্য আমি ওদের বেশ কিছু টাকাকড়ি দেব—ম্যাডামের তাই ইচ্ছে ছিল—কিন্তু মায়ের অভাব কি পূরণ করা যায়? আপনিই বলুন? তাছাড়া টাকাটা যদি সেই কাবুলিওয়ালা কেড়ে নেয়? আচ্ছা কৌশিকদা … আপনার কি মনে হয়

আমি ঠক করে যন্ত্রটা রিসিভারে নামিয়ে রাখি। চটিটা পায়ে গলিয়ে হুড়মুড়িয়ে নেমে আসি নিচে। মামুর ঘরের পর্দা সরিয়ে দেখতে পাই—কাল রাত্রের ভঙ্গিতেই একইভাবে অর্ধশয়ান অবস্থায় বসে আছেন ইজিচেয়ারে। টেলিফোন যন্ত্রটা এখনো তাঁর কানে ধরা আমাকে দেখতে পেয়েই সেটা নামিয়ে রাখলেন।

উনি নিশ্চয় সারারাত ঐখানে ঐভাবে বসেছিলেন না। কিন্তু নয় ঘণ্টা আগে যে দৃশ্য দেখেছিলাম হুবহু সেই দৃশ্য, একই ভঙ্গি, একই অবস্থানে। পরিবর্তনের মধ্যে ঘরে এখন বিজলি বাতি নয়, দিনের আলো। পরিবর্তনের মধ্যে বোতলটা শূন্যগর্ভ। উনি এবার আমাকে চলে যেতে বললেন না। বসতে বললেন। ওঁর খাটের প্রান্তে বসে বলি, কী মনে হল? অ্যাকসিডেন্টাল ডেথ? সত্যিই ভুল করে?

—না, কৌশিক, ভুল করে নয়।

—আত্মহত্যা হতে পারে না। কাল রাতে পৌনে এগারোটায় হেনা টেলিফোনে আমাকে বলেছিল আজ সকালেই যেন আপনি ওর হোটেলে যান। ওর কী একটা জরুরি কথা বলার আছে। ফলে আত্মহত্যা হতেই পারে না। হয় অ্যাকসিডেন্ট, না হলে প্রীতম কোনও ছল ছুতোয় …

—রাত এগারোটার পর প্রীতম ওর নাগাল পাবে কেমন করে? চল, যাওয়া যাক

আমরা যখন গিয়ে পৌঁছলাম তার আগেই প্রীতম সেখানে পৌঁছেছে। পুলিসের জেরায় মিনতি তার নাম-ঠিকানা জানাতে বাধ্য হয়েছিল। দেহ তখনো অপসারিত হয়নি। পুলিস-ফটোগ্রাফার ছবি নেওয়া সবে শেষ করেছে। মিনতি আমাদের দেখেই হাউমাউ করে উঠল। প্রীতম ঠাকুর হয় সত্যই উঁচু দরের অভিনেতা, অথবা সে সত্যিই একেবারে ভেঙে পড়েছে।

তাকে দেখে মনে হচ্ছিল—বাজে পোড়া তালগাছ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *