সারমেয় গেণ্ডুকের কাঁটা – ১৫

১৫

আমার মাঝে মাঝে মনে হয় বাসু-মামু নিতান্ত খেয়ালবশে কাজ করে চলেন। প্রফেশনাল কারণে নয়। পেশাগত ব্যারিস্টার নেশার বশে গোয়েন্দা হলে যা হয়। যেমন এই কেসটা। মিস পামেলা জনসন ওঁর আইনসম্মত মক্কেল নন, ছিলেন না—ওঁর ফিজটা জানতে চেয়েছিলেন মাত্র, কোনও ‘রিটেইনার’ দেননি। ভদ্রমহিলা দুর্বোধ্য ভাষায় যে ধাঁধাটা তৈরি করেছিলেন তার পাঠোদ্ধার বাসু-মামু যাই করুন, আমার মনে হয়েছিল তা একটি মাত্র পংক্তিতে সংক্ষেপিত হতে পারে : পাগলা, লা ডুবাস না যেন!

ব্যস। বাসু-মামু সে-কথা শুনেই নৌকার গলুইয়ে দাপাদাপি জুড়ে দিলেন। যাত্রী-বোঝাই নৌকাটা পাল তুলে দিব্যি তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিল—ওঁর এই নাচানাচিতে সেটা এখন প্রচণ্ডভাবে দুলতে শুরু করেছে। যাত্রীরা আতঙ্কগ্রস্ত— ভরাডুবি না হলেও ওরা বুঝতে পেরেছে তাদের মধ্যে একজনকে উনি ধাক্কা মেরে জলে ফেলে দিতে চাইছেন। ওরা সবাই নিজের নিজের জান বাঁচাতে সচেষ্ট হয়েছে।

এক হিসাবে এই ‘সারমেয় গেণ্ডুক’ কেসটা অনবদ্য। এতদিন অন্যান্য কেস-এ দেখেছি, অপরাধটার বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই—প্রশ্ন থাকতো : কে অপরাধী? এবার তা হয়নি। অপরাধ খুঁজতে বসার আগে ওঁকে খুঁজতে হচ্ছে : অপরাধটা। ওঁর অবস্থা দার্শনিকদের মতো—অন্ধকার ঘরে হাতড়ে হাতড়ে একটা কালো বেড়ালকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন উনি—অথচ নিজেও জানেন না, ঐ কালো বেড়ালটা এই নীরন্ধ্র অন্ধকার কক্ষে আদৌ আছে কি না!

পরদিন সকালে দেখলাম উনি টেলিফোন করলেন মিনতি মাইতির হোটেলে। কথোপকথনের এক প্রান্তের কথাই কানে এলো। তাতে বোঝা গেল উনি মিন্টি মাইতির সঙ্গে আজ সন্ধ্যায় দেখা করতে চাইছেন; আর সে বলছে যে, আজ বিকালে সে মেরীনগর যাবে। বাসু-সাহেব বললেন, তাহলে তো ভালোই হয়। কথাবার্তা মেরীনগরে বলতে পারলেই ভালো হয়। আমিও যদি সেখানে যাই তাহলে ওবেলা কথা বলা যাবে? মিনতি জবাবে কী বললো তার আভাস পেলাম বাসু-মামুর প্রত্যুত্তরে : ঠিক আছে। এই ধরো বিকাল চারটে নাগাদ!

টেলিফোনের রিসিভারটা নামিয়ে উনি ঘুরে দাঁড়াতে বলি, তার মানে আমরা আজ ওবেলা আবার মেরীনগর যাচ্ছি?

—হ্যাঁ এবং না। অর্থাৎ ও-বেলায় নয়। এ-বেলাতেই। তৈরি হয়ে নাও। আধঘণ্টার মধ্যে।

বলি, আমার যেন মনে হলো আপনি বিকেলবেলা মিনতির সঙ্গে সেখানে কথা বলবেন বললেন।

—তাই বলেছি। কিন্তু সে মেরীনগরে পৌঁছানোর আগে আমাকে কিছু ইনভেস্টিগেট করতে হবে। নাও, উঠে পড়, কুইক!

১৬

এবার আমাদের দেখে ফ্লিসি চিৎকার চেঁচামেচি একটুও করলো না। বার দুই শুঁকে নিয়েই সে নিশ্চিন্ত হলো। বরং অবাক হলো শান্তি। বললে, মিন্টি আসেনি আপনাদের সঙ্গে?

—না তো। শুনেছি, সে নাকি বিকালে আসবে এখানে।

—হ্যাঁ, তাই তো। আপনারা আসবেন তাও টেলিফোন করে জানিয়েছে। আমি ভেবেছি যে, আপনারা এ বেলাতেই একসঙ্গে এসেছেন।

—না, শান্তি। মিস্ মাইতি বিকালেই আসবে। তখন তার সঙ্গে আমি এসে কিছু আলোচনাও করবো। কিন্তু তার আগেই আমার কয়েকটা কথা জানার দরকার—

শান্তি একটু যেন অবাক হলো। সামলে নিয়ে বললে, যা হোক এসে যখন পড়েছেন, তখন এখানেই দুটি খেয়ে নেবেন দুপুরে –

—না! কাঁচড়াপাড়াতে আমাদের একটা লাঞ্চের নিমন্ত্রণ আছে। আমার এক মাসিমার বাড়ি।

ওঁরা বৈঠকখানাতে এসে বসলেন। দুজনেই। শান্তিও একটা মোড়া নিয়ে এসে বসলো।

ইতিমধ্যে কোথা থেকে বলটা মুখে নিয়ে ফ্লিসি এসে দাঁড়িয়েছে আমার মুখোমুখি। তুরতুর করে লেজটা নাড়ছে। বেচারির বোধহয় অনেকদিন খেলা হয়নি। আমি তাই মামুকে বলি, আপনারা কথা বলুন, আমি ততক্ষণ ফ্লিসিকে একটু খেলাই—

মামু ভ্রূক্ষেপ করলেন না। বার কতক বল ছোঁড়াছুড়ি করে আমার বিবেক-দংশন শুরু হয়ে গেল। মামু কী ভাবছেন? ড্রইং রুমে ফিরে এসে শুনি ওঁরা দুজন মিস্ জনসনের চিকিৎসার বিষয়ে তখনো কথাবার্তা বলছেন। শান্তি দেবী বলছিল, হ্যাঁ, ছোট ছোট সাদা ট্যাবলেট–নাম জানি না। দিনে তিনটে করে খেতেন। ডক্টর দত্তের প্রেসক্রিপশান মতো। এছাড়া একটা ক্যাপসুলও খেতেন। অর্ধেক সাদা, অর্ধেক হলুদ–মানে বাইরের রঙটা।

—সেটা কার প্রেসক্রিপশানে?

—ঐ ডক্টর দত্তেরই প্রেসক্রিপশান। আর কারও প্রেসক্রিপশানে কোনো ওষুধ উনি কখনো খানান। এসব বিষয়ে উনি খুব সতর্ক ছিলেন। একবার—

হঠাৎ মাঝপথেই থেমে পড়ে শান্তি। বাসু-মামু বলেন, জানি। ডক্টর ঠাকুর কী একটা ওষুধ নিয়ে এসেছিল, তা উনি খাননি। হেনা বলেছে আমাকে।

শান্তি আর গোপন করার প্রয়োজন দেখলো না। বললে, তবে তো আপনি জানেনই কিন্তু ম্যাডাম যেভাবে হেনাদিকে দেখিয়ে দেখিয়ে সেটা ওয়াশ-বেসিনে ঢেলে ফেলেছিলেন–তা আমার ভালো লাগেনি। হেনাদির বর কিছু বিষ নিয়ে আসেনি—

—বটেই তো! বটেই তো! তা সেসব ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল কি দু-একটা এখনো আছে?

—না! মিনতি সব বাতিল ওষুধ ফেলে দিয়ে ঘরটা সাফা করেছে।

–কোথায় থাকতো ঐ ওষুধগুলো?

—ম্যাডামের ঘরের লাগোয়া বাথরুমের কাবার্ডে।

—শেষদিকে ডক্টর দত্ত একজন নার্সকে বহাল করেছিলেন—তার নাম বোধহয় আশা, নয়?

—হ্যাঁ, আশা পুরকায়স্থ। কেন বলুন তো?

মিথ্যা ভাষণের কী পারদর্শিতা! বাসু-মামু দিব্যি এক আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে বসলেন। কাঁচড়াপাড়ায় তাঁর যে বৃদ্ধা মাসিমা আছেন—ঐ যাঁর বাড়িতে আজ দুপুরে আমাদের অলীক নিমন্ত্রণ, তিনি নাকি জনডিসে ভুগছেন। ওঁর মাসতুতো ভাই ডেলিপ্যাসেঞ্জার আর তার বউ বুঝি কাঁচড়াপাড়াতেই কী-একটা চাকরি করে। উনি তাই একজন স্থানীয় নার্সকে খুঁজছেন। ডক্টর পিটার দত্তের কাছে আশার কথা শুনে উনি ভাবছেন তার সঙ্গে একবার কথা বলে দেখবেন। কাঁচড়াপাড়ায় সে ডে-টাইম নার্স হিসাবে কাজটা নিতে পারে কিনা

শান্তি খুব সহানুভূতি নিয়ে সেই বৃদ্ধা মাসিমার কল্পিত রোগের বিবরণ শুনলো। আশার বিষয়ে খুব প্রশংসাও করলো। সে নাকি ‘নমিতা মেডিকেল স্টোর্স’-এর দ্বিতলে থাকে। আশা বিধবা। বাবার সঙ্গে থাকে। দোকানটা ওর বাবাই চালান—ঐ ডিপেনসারিটা। আশা ট্রেন্ড্ নার্স। কথার মাঝখানেই ঝন্‌ঝন্ করে টেলিফোনটা বেজে উঠলো। শান্তি গিয়ে ধরলো।

—হ্যালো? হ্যাঁ, মরকতকুঞ্জ। …না, আমি শান্তি, মিন্টি এখনো আসেনি। আপনি কে বলছেন?

…ও! মাসিমা! বলুন? …হ্যাঁ, সাদা রঙের অ্যাম্ব্যাসাডার। …নম্বর? তা তো জানি না। আচ্ছা ধরুন, জিজ্ঞাসা করে বলছি।

মাউথপিসে হাত চাপা দিয়ে শান্তি আমাদের দিকে ফিরে প্রশ্ন করে, আপনাদের গাড়িটার নাম্বার কি 4437?

বাসু-মামুর চোখ কপালে উঠলো। সোজাসুজি জবাব না দিয়ে প্রতিপ্রশ্ন করেন, মাসিমাটি কে?

—ঊষা মাসিমা। উনি পোস্ট অফিস থেকে ফোন করছেন। জানতে চাইছেন, একটা সাদা অ্যামবাসাডারে চেপে মিন্টি এসেছে কিনা।

—তা ওঁকে বলে দাও না যে, আসেনি।

—তা তো বললাম! তারপর উনি আপনার কথাই জিজ্ঞাসা করছেন। আপনার চেহারার বর্ণনা দিয়ে বলছেন, ‘নামটা মনে পড়ছে না, সে ভদ্রলোক কি এসেছেন? W. B. F. 4437 গাড়িতে চেপে?’

বাসু-মামু বাধ্য হয়ে উঠে গেলেন। শান্তির হাত থেকে রিসিভারটা নিয়ে বললেন, গুড মর্নিং দিদি।

….হ্যাঁ, আমিই। তা আমি এসেছি কী করে টের পেলেন?

সে সময়ে আমি এক প্রান্তের কথাই শুনতে পেয়েছিলাম, তবে পরে বাসু-মামুর কাছ থেকে পুরো কথোপকথনটাই জেনে নিয়েছিলাম। পাঠক-পাঠিকাকে বঞ্চিত করবো না, এখানেই দু-পক্ষের ‘বাৎচিত’ ভার্বাটিম লিপিবদ্ধ করে যাই। ঊষা বিশ্বাস ওঁর গুডমর্নিং শুনেই বলেছিলেন, ‘মিস্টার টি. পি. সেন?’ আমাদের আগমনবার্তা কী করে টের পেলেন এ প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘পোস্টাপিসে এসেছিলাম, দেখলাম তোমার গাড়িটা মরকতকুঞ্জের দিকে চলে গেল, তাই ভাবলাম মিন্টিকে নিয়ে তুমি বোধহয় মেরীনগরে এসেছো। তা এখন শুনছি মিন্টি আসেনি। তা যাগ্‌গে, মরুগগে, শোনো ভাই।—তোমার জন্যে একটা দারুণ খবর আমার কাছে লুকানো আছে। কখন আসছো?”

বাসু বলেছিলেন, কী জাতের খবর?

—টেলিফোনে সব কথা বলা যাবে না। তুমি হ্যারল্ড দত্তের নাম শুনেছো?

–না। কে তিনি?

—একটা পরিচয় : তিনি মেরীনগরের একজন আদি বাসিন্দা। দ্বিতীয় পরিচয় : তিনি যোসেফ হালদারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তৃতীয় পরিচয় : তিনি পিটার দত্তের বাবা।

—ও বুঝেছি। তা, তাঁর কথা কেন?

—তোমার কাছে কোমাগাতামারুর গপ্পো শুনে পিটার তার পুরনো কাগজপত্র হাতড়ে দেখেছে। ওর বাবার একটি অতি পুরাতন ডায়েরি উদ্ধার করেছে। তাতে যোসেফ হালদারের বিষয়ে নানান গোপন তথ্য লেখা আছে। আমার মনে হয়, তোমার অনুমান ঠিকই—যোসেফ গুরুজিৎ সিংয়ের সহকর্মী ছিল। কোমাগাতামারু জাহাজে চেপেই সে মার্কিন মুলুক থেকে ফিরে আসে।

টেলিফোনে আচমকা এই বিচিত্র বার্তা শুনে বাসু-মামুর কী আন্তরিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা তিনি আমাকে জানাননি। বাহ্যিক প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছিল উনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। মামুর কাছে কথাটা শুনে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল ত্রৈলোক্যনাথের একটি অনবদ্য আষাঢ়ে গল্প : ‘লে লুল্লু!’

বেগম-সাহেবাকে ভয় দেখাতে আমীর-সাহেব বলেছিলেন, এ রকম বে-আদবি করলে লুল্লুকে ধরিয়ে দেবো। ‘লুল্লু’ আমীর সাহেবের কোনো পোষা বা পরিচিত ভূতপ্রেত নয়; কথার-কথা হিসাবে তাৎক্ষণিক সৃজনশীলতায় ঐ অদ্ভুত নামটা পয়দা করেছিলেন। গিন্নি যখন তাতেও ঘাবড়ালেন না, তখন আমীর চিক্কুড় পাড়েন : লে লুল্লু!

ব্যস্! সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেল!

লেখক ত্রৈলোক্যনাথের উর্বর কল্পনায়, “আশ্চর্যের কথা এই যে, লুল্লু একটি ভূতের নাম ছিল। আবার, দৈবের কথা শুন, লুল্লু সেই মুহূর্তে, আমীরের বাড়ির ছাদের আলিশার উপর পা ঝুলাইয়া বসিয়া ছিল। হঠাৎ কে তাহার নাম ধরিয়া ডাকিল? সে চমকিয়া উঠিয়া শুনিল—কে তাহাকে কি একটা লইতে বলিতেছে; চাহিয়া দেখিল সম্মুখে এক পরমা সুন্দরী নারী। তাহাকেই লইয়া যাইবার নিমিত্ত লুল্লুকে অনুরোধ করা হইতেছে। এরূপ সামগ্রী পাইলে দেবতারাও তদ্দণ্ডে নিকা করিয়া ফেলে, তা ভূতের কথা ছাড়িয়া দিন! চকিতের মধ্যে, দুর্ভাগ্য রমণীকে লুল্লু আকাশপথে কোথায় যে উড়াইয়া লইয়া গেল, তাহার আর ঠিক নাই। “

বাসু-মামু অবশ্য ‘লে-লুল্লু’ বলেননি। বলেছিলেন : ‘লে কোমাগাতামারু!”

টেলিফোনের দিকে যে দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়েছিলেন তাতে মনে হচ্ছিল কোমাগাতামারু-জিন রানী মামিমাকে চুলের মুঠি ধরে নিয়ে যাচ্ছে—আর সেটাই দেখতে পাচ্ছেন উনি, টেলিফোনের মাউথ-পিসে!

বাসু-মামু সামলে নিয়ে বলেছিলেন, ভেরি ইন্টারেস্টিং। ডায়েরিটা কোথায়? আপনার কাছে?

—না। পিটারের কাছে। পিটার বাড়িতে আছে। চলে এসো না ওর বাড়ি। আমিও যাই তাহলে। বেশ গল্পগাছা করা যাবে। তোমার সেই সাকরেদটিকেও সঙ্গে এনেছো তো?

মামু স্বীকার করেছিলেন; কিন্তু তখনই ডক্টর পিটার দত্তের বাড়িতে যেতে পারবেন না, এ-কথাও জানিয়েছিলেন। বললেন, আপনি শান্তিদেবীকে জানালেন যে, আমার নামটা মনে পড়ছে না, অথচ আমার কণ্ঠস্বর শুনেই আমার নামটা উচ্চারণ করলেন। ব্যাপারটা কী?

ঊষা বিশ্বাস সরাসরি জবাব দেননি। তাঁর নিজস্ব ঢঙে প্রতিপ্রশ্ন করে বসেন, তুমি মিস্ মার্পলকে চেনো?

—না। কে তিনি?

—কিছু মনে কোরো না ভাই, ছোটভাই মনে করে বলছি—সাংবাদিকতাকে তোমরা জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করেছো, একটু বই-টই পড়া অভ্যাস করো। মিস্ মার্পল হচ্ছেন অগাথা ক্রিস্টির এক অনবদ্য চরিত্র। তা আমি হচ্ছি তাঁর এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মেরীনগরী সংস্করণ। কখনো আসছো আমার ডেরায়? ভালো কুকি বানিয়েছি কিন্তু

বাসু-মামু প্রতিশ্রুতি দিলেন, কলকাতা ফেরার আগে দেখা করে যাবেন। বিকাল তিনটে নাগাদ ফিরে আসবো জানিয়ে আমরা শান্তি দেবীর কাছে বিদায় নিলাম। গেটের কাছে দেখা হয়ে গেল ছেদিলালের সঙ্গে। মস্ত সেলাম করলো সে।

মামু বোধহয় ঐ নীতিতে বিশ্বাসী : ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই?” ছেদিলালের সঙ্গে জুড়ে দিলেন খেজুরে আলাপ। লোকটা তিন-পুরুষের মালি। গাছের যত্ন নিতে জানে। মামু তাকে এভাবে জেরা শুরু করলেন যে, মনে হচ্ছিল আমরা মেরীনগরে এসেছি ওঁর উদ্ভিদ-বিদ্যার রিসার্চটার ডাটা সংগ্রহে। ছেদিলাল কথা প্রসঙ্গে বললে, ম্যাডাম ছিলেন সত্যিকারের পুষ্পদরদী, বাগিচা-রসিক। নানান ফুলের গাছ লাগাতেন, নানান বীজ, সার, ডাকযোগে আসতো। শীতের মরশুমে ফুলের কেয়ারিগুলো কীভাবে বানানো হবে তা বুঝিয়ে দিতেন ছেদিলালকে। কোথায় ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, কোথায় পপি, জিনিয়া, ডায়ান্থাস, ফ্লক্স, মেরিগোল্ড। ছেদিলালকে তিনিই শিখিয়েছিলেন ‘বনসাই-শিল্প’, অংরেজি কিতাব পড়ে পড়ে। মনে হলো, ছেদিলালই সবচেয়ে মর্মাহত হয়েছে ম্যাডামের প্রয়াণে। ‘জব স্যাটিসফ্যাকশান’ নষ্ট হয়ে গেছে তার। শিল্প রসিকের প্রয়াণে শিল্পীর যে হাল হয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, সত্যিকারের বাগিচা-রসিক সত্যিই দুর্লভ।

যেন ইয়ারবন্ধুর সঙ্গে খোশগল্প করছেন, মামু বললেন, তুমি এই শায়েরটা শুনেছ?

“হাজারোঁ সাল নার্গিস/আপনা বে-নূরী পর রোতী হৈ!
বড়ি মুকিলসে হোতী হৈ/চমন্‌মে দিদাবর পৈদা।”

ছাপরা-জিলার বাগান-রসিকের বোধগম্য হলো না কাব্যরস। ভাষাটা বড়ই উর্দুঘেঁষা। তাই বাসু-সাহেবকে অন্বয়-ব্যাখ্যা দাখিল করতে হলো। “হাজার বছর ধরে নার্গিস-ফুল তার অনিন্দ্য সৌন্দর্য পসরা নিয়ে কাঁদছে। ও জানে, বাগিচার, দরদী সমঝদার এক অতি সুদুর্লভ বস্তু।”

শাঙ্করভাষ্য শুনেও ও কিছু বুঝলো কিনা তা আমার মালুম হলো না, পাকাচুলে ভরা মাথাটা দুলিয়ে বলল, ও তো সহি বাৎ!

আমি উশখুশ করছি। এই অহৈতুকী খেজুরে আলাপ কতক্ষণ চলবে কে জানে!

ছেদিলাল স্বীকার করলো, বর্তমান মালকিন বাগানের দিকে নজরই দেয় না। সব আগাছায় ভরে যাচ্ছে।

মামু বলেন, তা আগাছা নিড়ানোর দায়িত্ব তো তোমার, মালকিন কী করবে?

—ক্যা কিয়া যায় সা’ব? দাওয়াই খতম্ হো গয়া!

—দাওয়াই! কিসের দাওয়াই?

ছেদিলাল জানালো, আগাছা নির্মূল করতে এক জাতের ‘উইড-কিলার’ ব্যবহার করতে হয়। ম্যাডাম কলকাতা থেকে আনিয়ে দিতেন। মুশকিল কি বাৎ, ওটা হচ্ছে জহর, বিষ, তাই কিছুতেই একসঙ্গে বেশি আনতেন না। সার আমদানি করতেন বস্তা বস্তা, বীজ প্যাকেট-প্যাকেট—কিন্তু ঐ ‘উইড-কিলার’ আসতো দু-মাস অন্তর এক ডিব্বা। ওর স্টক ফুরনোর পর বর্তমান মালকিনকে সে জানিয়েছিল—মিনতি মাইতি কিছুতেই রাজি হয়নি—ঐ বিষ কিনতে।

‘বিষ’-এর প্রসঙ্গ উঠে পড়া মাত্র মামুর উর্বর মস্তিষ্কে গজিয়ে উঠলো আর একটি আষাঢ়ে গল্পের আগাছা—শান্তিনিকেতনে ওঁর একটি বাগান-ঘেরা বাড়ি আছে। একজন ওড়িয়া মালি, সে বাগানের দেখভাল করে। তার নির্দেশমতো নানান জাতের ‘উইড-কিলার’ উনি পাঠিয়ে দেখেছেন, কোনও কাজ হয়নি। ‘উইড-কিলার’ মাটিতে মিশিয়ে আগাছা নির্মূল করা যায় না আদৌ। এই নাকি ওঁর অভিজ্ঞতা।

অর্থাৎ সেই একই ট্যাকটিক্স—প্রতিবাদের ইন্ধন জোগানো।

ছেদিলাল দৃঢ়স্বরে আপত্তি জানায়, না স্যার, আপনি কী জাতের ‘জহর’ ব্যবহার করেছেন জানি না, কিন্তু আমি দেখেছি, মেমসাহেব যা আনতেন তা খুবই কার্যকরী।

—কী ‘জহর’? তোমার তো স্টক ফুরিয়েছে, কিন্তু খালি ডিব্বা কি আছে এক-আধটা?

ছেদিলাল জানালো, একটি ডিব্বার সিল খোলেনি সে, সরানো আছে। এই সাতবিঘা বাগানকে আগাছার হাত থেকে বাঁচানো যাবে না এটা ও বুঝে নিয়েছে। তাই একটি কৌটা আলাদা করে সরিয়ে রেখেছে ‘সিমেটরি’র জন্য। সেটা ছোট বাগান, সেখানেই শুয়ে আছেন ওর প্রাক্তন মালকিন এবং তাঁর রিস্তেদারেরা। ছেদিলালের মনে হয়েছে, আগামী বর্ষায় সেই কবরগুলি আগাছায় ভরে গেলে ওর ম্যাডাম-সাহেবা কবরের নিচেও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবেন না—তাই একটি ডিব্বা সে সযত্নে সরিয়ে রেখেছে সিল না খুলে। মামুর আগ্রহে ডিব্বাটা এনে সে দেখালো। বললো, এটা কিনে দেখুন স্যার, নিশ্চিত কাজ দেবে।

বাসু যত্ন নিয়ে কৌটাটিকে পরীক্ষা করলেন। তার গায়ে লেখা লিটারেচার পড়লেন। নির্মাণকারী সাবধানবাণী ছাপিয়েছেন—এটি ‘বিষ’, আর্সেনিক বিষ আছে এতে। উনি বললেন, না এটা কখনো পরখ করে দেখিনি। তা এ বিষ কতটা খেলে মানুষ মরে যায়? ছেদিলাল হেসে ফেলে। বলে, আপনিও যে ছোটোসাবের মতো জেরা শুরু করলেন।

—ছোটসাহেব! মানে?

ছেদিলাল হাসতে হাসতেই জানালো দু-তিন মাস আগে ঠিক এক জাতের প্রশ্ন করেছিলেন ছোটোসাহেব, মানে সুরেশ হালদার : কতটা দাওয়াই খেলে মানুষ গুজর যায়। ছেদিলাল সুরেশকে হাফ-প্যান্ট-পরা যুগ থেকে দেখেছে। প্রাণচঞ্চল যুবকটির প্রতি তার একটা স্নেহমিশ্রিত আকর্ষণ ছিল। জবাবে সে বলেছিল, সে খোঁজে তোমার কি দরকার ছোটাসাব? তুমি কি কাউকে বিষ খাওয়াবার মতলব ভাঁজছো? তাতে নাকি ওর ছোটাসাব জানিয়েছিল, ‘এখন নয়। পরে হয় তো দরকার হবে। ধর আমি ভবিষ্যতে যাকে বিয়ে করবো তাকে যদি পছন্দ না হয়?’ ছেদিলাল নাকি তখন তাকে ধমক দেয়, অমন অলুক্ষণে কথা বোলা না ছোটাসাব! যে লছমীজির সাথে তোমার সাদি হবে—এ বাড়ির বহুরাণী—তার সম্বন্ধে অমন কথা রসিকতার ছলেও বলা উচিত নয়।

বাসু হঠাৎ বলেন, কিন্তু এ ডিব্বার সিল তো খোলা?

ছেদিলাল একটু অবাক হলো। কৌটাটি হাতে নিয়ে বললে, আরে হ্যাঁ, তাই তো! তাহলে নিশ্চয় খুলেছিলাম কখনো অন্যমনস্কভাবে। হ্যাঁ, তাই—এই দেখুন, অনেকটা খরচও করে ফেলেছি।

কৌটার ঢাকনি খোলার পর নজর হলো বেশ খানিকটা খরচ হয়ে গেছে।

বাসু বলেন, কবে খুলেছো তা মনে পড়ছে না?

—জী না। হয়তো অন্যমনস্কভাবে-

—তোমার জেনানা খোলেনি তো?

—জী না। ও এসবে হাত দেয় না। আমি বারণ করে দিয়েছি। আমিই নিশ্চয় খুলেছি বোধহয়। এখন মনে নেই।

১৭

গাড়িতে উঠতে উঠতে বলি, এ তো কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে ভ্যাল্যা সাপ বেরিয়ে পড়লো? বাসু-মামু শুধু বললেন, হুঁ!

—মিস্ জনসনের মৃত্যু বর্ণনার মধ্যে ‘আর্সেনিক—পয়েজনিং’-এর কোনও সিমটম নজরে পড়েছে আপনার?

মামু বোধহয় অন্য লাইনে চিন্তা করছিলেন। বলেন, কী বললে? না, আর্সেনিক বিষের কোনও লক্ষণ নজরে পড়েনি আমার। আর্সেনিকে পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হয়, সেকথা কেউ বলেনি। জ্বর হয়, তা অবশ্য জনডিসেও হয়।

—কিন্তু আপনার মনে আছে মামু, সেদিন সুরেশ বলেছিল—’বড়পিসির খাবারে আমি আর্সে…’স্ট্রিক্‌নিন’ বিষ মেশাইনি?

—না, ভুলিনি। অত ভুলো মন আমার নয়। কিন্তু সেই সূত্র ধরে বলা যায় না–সুরেশ ছেদিলালের ঘর থেকে উইড-কিলার চুরি করেছিল।

—কিন্তু ছেদিলাল নিজেই তো বললো, ছোট-সাহেব জানতে চেয়েছিল—কতটা ঐ বিষ খেলে মানুষ মরে যায়—

—ছেদিলালের স্টেটমেন্ট সত্যি হলে সেটা সুরেশের দিকে যায়। কাউকে হত্যা করার মতলবে সুরেশ যদি ঐ উইড-কিলার চুরি করে থাকে, তাহলে এটা কি প্রত্যাশিত যে, সে ঐ আনপড় মালিটাকেই এ প্রশ্ন করবে? কৌটার গায়েই লেখা আছে আর্সেনিকের পার্সেন্টেজ। কত গ্রেন আর্সেনিক ফেটাল-ডোজ সে তথ্যটা বার করা সুরেশের মতো শিক্ষিত মানুষের পক্ষে কি এতই অসম্ভব?

আবার সব গুলিয়ে গেল আমার। বলি, তাহলে কোন্ বিষে মিস্ জনসনের মৃত্যু হলো?

—বিষের প্রতিক্রিয়াতে যে হয়েছে এ-কথা মনে করার কী যৌক্তিকতা? হয় তো জনডিসে ভুগে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তাঁর

—আমার বিশ্বাস হয় না! এ নিশ্চয় হত্যা।

বাসু-মামু হেসে ফেলেন। বলেন, ইয়া-আল্লাহ্! মনে হচ্ছে আমরা ক্রমাগত ঠাঁই বদল করে চলেছি। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, মিস্ জনসনের হত্যা রহস্যের কিনারা না করে তুমিই গোপালপুর যেতে চাইবে না, আর আমাকে তোমার পিছু পিছু টো-টো করতে হবে।

ওঁর এই জাতীয় রসিকতা আমার আদৌ ভালো লাগে না। কথা ঘোরাতে বলি, আর ঐ মিস্ বিশ্বাসের ব্যাপারটা? পিটার দত্তের বাবার ডায়েরিতে কোমাগাতামারুর উল্লেখ? বাসু-মামু বললেন, সেটাও একটা দারুণ রহস্য! আমি যেটা বানিয়ে বানিয়ে বললাম সেটাই কেমন করে সত্যি হয়ে গেল?

এবার ঠ্যাঙটানার সুযোগ আমার। বলি, এমন দুর্লভ কাকতালীয় ঘটনা কি ঘটতে পারে না? ঘরপোড়া গরুর গোয়ালে দ্বিতীয়বার অগ্নিসংযোগ? হাজারে একটা।

বাসু-মামুও প্রসঙ্গটা বদলে বলেন, বাঁয়ে টার্ন নাও। আমরা এবার নমিতা মেডিকেল স্টোর্সে যাব।

—আপনার মাসিমার জন্যে একজন ডে-টাইম নার্সের সন্ধানে?

—ঠিক তাই।

১৮

নমিতা মেডিকেল স্টোর্স একটি দ্বিতল বাড়ি। একতলায় ডিসপেনসারি, দ্বিতলে মালিকের ডেরা। শান্তি দেবীর কাছেই খবর পাওয়া গেছে, পুরকায়স্থ বিপত্নীক। তাঁর এক নাবালক পুত্র আর বিধবা কন্যাকে নিয়ে ওখানে থাকেন। দোকানটা বাজারের কাছাকাছি, গির্জার বিপরীতে। কাউন্টারে বসেছিল বারো-চোদ্দ বছরের একটি বালক। তাকেই জিজ্ঞাসা করলেন বাসু-মামু, তোমার বাবা দোকানে নেই?

—না নেই। কাঁচড়াপাড়া গেছেন। আপনি কি কিছু ওষুধ কিনতে এসেছেন? প্রেসিক্রিপশান না পেটেন্ট ওষুধ?

ভবানন্দ দত্ত মশায়ের ছেলের চেয়ে এ অনেক ছোট, কিন্তু দোকানদারিতে মনে হলো অনেক বড়।

মামু বললেন, ‘রেডক্সন’ আছে? আর ‘ভিক্স ভেপোরাব’?

চট-জলদি ঐ দুটি দ্রব্য সে এনে দিল। ছোট একটি ঠোঙায় ভরে দামটা জানালো।

পয়সা মিটিয়ে দিয়ে বাসু বললেন, তোমার দিদিও কি বাড়ি নেই? আশা?

এবার ও বললে, না দিদি আছে। দোতলায়। ডাকবো? কেন?

—হ্যাঁ, তাকে ডাকো। দরকার আছে। আমরা দোকানে আছি, তুমি দোতলায় গিয়ে খবর দাও।

ছেলেটি রাজি হলো না। বোধ করি অচেনা লোকের হেপাজতে দোকান ছেড়ে যাবার বিপদ সম্বন্ধে সে ওয়াকিবহাল। তাই একটু পিছনে সরে গিয়ে ঊর্ধ্বমুখে হাঁকাড় পাড়লো, দিদি, নিচে এসো একবার। তোমাকে দু’জন ভদ্রলোক খুঁজছেন।

একটু পরে নেমে এল মেয়েটি। শ্যামলা রঙ, বছর পঁয়ত্রিশ বয়স। বেশ একটু স্থূলাঙ্গী। পরনে সাদামাটা মিলের শাড়ি। ড্রেস করে পরা। অল্প প্রসাধনের আভাস। কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়িয়ে বলে, বলুন?

—তুমিই আশা পুরকায়স্থ?

—হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে তো ঠিক—

—না, আমাকে তুমি আগে কখনো দেখনি। আমি কলকাতায় থাকি। ডক্টর পিটার দত্তের কাছে তোমার নাম শুনে দেখা করতে এসেছি। তাছাড়া মিস্ পামেলা জনসনও—শুনেছি, তুমি তাঁর নার্স ছিলে।

মেয়েটি স্বীকার করলো। বললে, তা আমাকে কেন খুঁজছেন?

ইতিমধ্যে একজন খদ্দের দোকানে এসেছে। মামু বললেন, কোথাও বসে আলোচনাটা হতে পারে?

আশা বললো, তাহলে ওপরে আসুন। দাঁড়ান, ইনি কী চাইছেন আগে দেখি।

আগন্তুক খরিদ্দারকে বিদায় করে আশা আমাদের দ্বিতলে নিয়ে এসে বসালো। মনে হয় দোতলায় দু’খানি শয়নকক্ষ—একটি বাপ-বেটার, একটি আশার। ঘরটা পরিচ্ছন্নভাবে সাজানো। সস্তা আসবাব, ছাপানো শাড়ির পর্দা, দেওয়ালে দু-একটি ফটো ও ক্যালেন্ডার, কিন্তু কেরোসিন কাঠের টেবিলের টেবল-ক্লথে সুন্দর সূচীশিল্পের নমুনা—মাটির ঘটে স্থলপদ্ম। আশা বললে, এবার বলুন?

মামু তাঁর কাঁচড়াপাড়াবাসী মাসিমার কথা বিস্তারিত জানালেন। তাঁর বয়স, রোগ, মেজাজ দেখা গেল প্রয়াত মিস্ জনসনের অনুরূপ। শোনা গেল, তাঁর বাড়িতে চাকর আছে, ঠিকে ঝিও আছে—কিন্তু বৃদ্ধার পুত্র-পুত্রবধূ দুজনেই চাকরি করেন। তাঁরা নিঃসন্তান। তাই দুপুরে একজন কাউকে বাড়িতে রাখতে পারলে ভালো হয়। চাকর অবশ্য থাকে—কিন্তু বৃদ্ধাকে ধরে ধরে বাথরুমেও নিয়ে যেতে হয়। মামু তাঁর কাহিনীর উপসংহারে বললেন, তোমাকে খোলাখুলিই সব কথা বলবো, আশা। মাসিমা লোক ভালো, কিন্তু ইদানীং তাঁর মেজাজ খুব তিরিক্ষে হয়ে গেছে। এর আগেও আমরা দু-একটি নার্সকে রেখেছি—পাশ করা নার্স নয় তোমার মতো, কিন্তু তারা টিকতে পারেনি। উনি আসলে চান না ওঁর বৌমা চাকরি করে; কিন্তু…

আশা বললে, বুঝেছি। আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। এমন কেস আগেও পেয়েছি অনেক।

মিস্ জনসনের কাছে সে দৈনিক কত পেতো সেটা মামু জানতে চাইলেন। এ কথাও বললেন, তার সঙ্গে আশার ক্ষেত্রে রিক্সাভাড়াটাও যোগ করতে হবে।

কথাবার্তা স্থির হলো। আশা জানালো, তার হাতে এখন আর কোনও রোগী নেই। সে কাল বাদে পরশু থেকেই জয়েন করতে পারে। মামু বললেন, আমার মাসতুতো ভাই আর তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলি তাহলে। যদি ওরা রাজি হয় তাহলে কাল সকালে আমি বা অন্য কেউ এসে তোমাকে খবর দেবো। কাল যদি কেউ না আসে তাহলে বুঝতে হবে ওরা রাজি হলো না। কেমন?

আশা সম্মত হলো। মামু এবার কথাপ্রসঙ্গে মিস্ জনসনের অসুখের কথা তুললেন। সেই সাদা-সাদা ট্যাবলেটের নাম, ক্যাপসুলের পরিচয় জানা গেল। আশা জানালো, ঔষধ ও পথ্য শেষ সপ্তাহে—অর্থাৎ সে বহাল হওয়ার পরে—সে নিজেই খাইয়েছে। আরও জানালো, বছর দেড়েক আগেও একবার মিস্ জনসনের বাড়াবাড়ি রকম অসুখ হয়েছিল—ঐ একই অসুখ, জনডিস।

মামু বললেন, শুনেছি সে-কথা। স্মৃতিটুকু বলছিল—

—টুকুকে আপনি চেনেন? সে তো এখানে থাকে না।

—না, কলকাতায় থাকে। তা আমিও তো কলকাতার বাসিন্দা। তুমিও তাকে চেনো দেখছি।

–কেন চিনবো না? ও তো মেরীনগরেরই মেয়ে, না হয় কলকাতাতেই থাকে। স্মৃতিটুকুকে মেরীনগরের সবাই চেনে। দারুণ হ্যান্ডসাম মেয়ে।

মামু বললেন, হ্যান্ডসাম, তবে সুন্দরী নয়। বড় রোগা! একটু কাঠি-কাঠি ঢং।

আশা খুশি হলো। বললে। হ্যাঁ, ও একটু বেশি রোগা। আজকাল মেয়েরা রোগাই থাকতে চায়।

মামু মাথা নেড়ে বললেন, বেচারি একেবারে ভেঙে পড়েছে—ঐ স্মৃতিটুকু—সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে, তার বড়পিসি তাকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করে যাবে। .

আশা বললো, সে-কথা ঠিক। সারা মেরীনগর স্তম্ভিত হয়ে গেছিল বুড়ির উইলের বৃত্তান্ত শুনে। কেন যে উনি শেষ সময়ে সব কিছু মিন্টিকে দিয়ে গেলেন….

–তোমার কী বিশ্বাস? এমনটা কেমন করে ঘটলো? বুড়ি কি শেষ সময়ে তোমাকে কিছু বলেছিল?

—না। সেটা ম্যাডামের স্বভাববিরুদ্ধ—আই মিন, ঘরের কথা পরকে বলা। মন খুললে তিনি হয়তো একমাত্র ঊষা-মাসিমাকে কিছু বলতেন—তিনিই একমাত্র ওঁর বন্ধুস্থানীয়া। কিন্তু ঊষা–মাসিমাকেও তিনি নাকি কিছু বলে যাননি।

—‘উইল’ প্রসঙ্গে শেষদিকে তিনি কি কিছুই বলে যাননি?

—কী জানি! একটা ঘটনায় অবশ্য আমার মনে হয়েছিল উনি উইলের কথাই বলছেন। ওঁর মৃত্যুর ঠিক আগের দিন সন্ধ্যায়। তবে ‘উইল’ শব্দটা উনি উচ্চারণ করেননি।

—কী বলেছিলেন তিনি? কাকে?

—মিস মাইতিকে। উনি মিন্টিকে বলছিলেন কী একখানা কাগজ নিয়ে আসতে। আর মিন্টি বলছিল, ‘সে কাগজ তো এখানে নেই। আপনি উকিলবাবুকে রাখতে দিলেন, মনে নেই?’ আমি তখন ঘরেই ছিলাম। মনে হলো, ম্যাডাম সে-কথার জবাবে কিছু একটা বলতে গেলেন। কিন্তু তখনই তাঁর একটা বমির বেগ এলো। আমি মিন্টিকে সরিয়ে তাঁর কাছে বসলাম। ঘটনা এটুকুই। ঐ ‘কাগজ’ আর উকিলবাবুর সূত্র ধরে আমার মনে হয়েছিল—উনি উইলটার কথাই কিছু বলতে চেয়েছিলেন। অবশ্য সবটাই আমার আন্দাজ।

মামু বলেন, মিনতি মাইতিকে উনি বোধহয় খুব ভালবাসতেন, তাই নয়?

—আমার তেমন কিছু মনে হয়নি। মিন্টি একটা গবেট। গবেট বলেই পাক্কা তিন বছর সে টিকে থাকতে পেরেছিল। ম্যাডাম তাকে প্রায়ই বকাবকি করতেন, ও গায়ে মাখতো না।

—শেষ সময়ে উনি চীন দেশের মাটিতে ভালো ফুল হয় না–না কি-যেন বলেছিলেন, নয়?

—হ্যাঁ। কিন্তু সে তো ঘোর বিকারে।

নিচে থেকে আশার ছোট ভাই হাঁকাড় দিল : দিদি! প্রেসক্রিপশান

আমরা তিনজনে নিচে নেমে এলাম। মামুকে ইঙ্গিত করি—’এবার কেটে পড়া যাক?’ উনি ‘না’-এর ভঙ্গি করলেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে পাইপে টোব্যাকো ভরতে থাকেন। প্রেসক্রিপশান সার্ভ করা শেষ হলে মামু বলেন, ভালো কথা মনে পড়লো। ডক্টর ঠাকুর, মানে হেনার স্বামী মিস্ জনসনকে একটা ওষুধ প্রেসক্রাইব করেছিলেন শুনলাম। ওষুধটা ওঁর খুব কাজে লাগে। তার একটি কপি পেতে পারি?

আশা একটু অবাক হলো। বললে, আমি তো শুনিনি। কে বললো?

—মিস্ জনসনই আমাকে বলেছিলেন। স্থানীয় ডিসপেনসারিতে সার্ভ করিয়ে নিয়ে যায়। এখানে হয়তো আরও ডিসপেনসারি আছে…

—না। মেরীনগরে এই একটিই ডিসপেনসারি। অবশ্য কাঁচড়াপাড়া থেকে যদি সার্ভ করিয়ে এনে থাকেন তাহলে অন্য কথা।

মামু বললেন, তুমি একটু রেজিস্টারটা দেখে বলবে? তাহলে তার একটা কপি করিয়ে নিয়ে আমার ডাক্তারকে দেখাতাম—মানে মাসিমাকে সেটা খাওয়ানো চলে কিনা। একই অসুখ তো?

—কিন্তু তারিখ না জানলে আমি কেমন করে খুঁজে বার করবো?

—তারিখটা মনে আছে আমার। সম্ভবত আঠারই এপ্রিল, অথবা তারই কাছাকাছি।

আশা রেজিস্টারটা খুলে খুঁজতে থাকে। হ্যাঁ পাওয়া গেল। আঠারই এপ্রিল তারিখে ডক্টর প্রীতম ঠাকুরের প্রেসক্রিপশান মোতাবেক সার্ভ করা হয়েছে—না, কোনও তৈরি করা ওষুধ নয়, ঘুমের ওষুধ ‘কামপোজ’।

কিন্তু ‘পেশেন্ট’-এর নামে ‘মিস্ পামেলা জনসন’ নয়, হেনা ঠাকুর। দৈনিক একটি ট্যাবলেট সেব্য—তিন সপ্তাহ ধরে।

মামু বললেন, না এটা নয়,…

পরের পাতাতেই পাওয়া গেল প্রীতমের দ্বিতীয় প্রেসক্রিপশান। মামু সেটা টুকে নিলেন।

নমিতা মেডিকেল স্টোর্স থেকে বেরিয়ে ঘড়ি দেখে বললেন, চলো, এবার সুতৃপ্তিতে যাওয়া যাক।

আমি বাধা দিই—–কেন মামু? আজ আবার সুতৃপ্তি কেন? কাঁচড়াপাড়ার দিদা যে

আমাদের ভাত আগলে বসে আছেন?

—বুঝেছি। তা বেশ, চলো, কাঁচড়াপাড়াতেই কোনও রেস্তোরাঁয় আজ দ্বিপ্রাহরিক আহারটা সারা যাবে।

১৯

কিন্তু তাও আমাদের বরাতে নেই। বাধা পড়ল। ডক্টর দত্তের চেম্বারের কাছাকাছি একটি বিপরীতমুখো ফোর্ড গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগতে লাগতে কোনওক্রমে ব্রেক কষি। দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে মুখোমুখি-যাকে বলে, ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্ৰন্থী।’

কিন্তু আমার পোড়া কপাল। ওদিকের গাড়ি থেকে যিনি নেমে এলেন তিনি ‘লাবণ্য’ ‘ নন, ক্ষ্যাপা মোষ!

গাড়ি চালানোর দোষ হয়ে থাকলে তা আরোহীর নয়, চালকের। কিন্তু আমাকে তিনি আক্রমণ করলেন না আদৌ। সোজা এসে বাসু-মামুকে চার্জ করলেন, আহ্! হিয়ার য়ু আর! মিস্টার টি. পি. সেন, অ্যালায়াস ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু! এবার বলুন মশাই—কেন সেদিন আমার বাড়ি বয়ে এক গঙ্গা মিছে কথা বলে গেলেন—গুরুজিৎ সিং, কোমাগাতামারু, যোসেফ হালদার!

মামু দরজা খুলে নেমে এলেন। বলেন, ইয়েস ডক্টর। একটা কৈফিয়ত আমার দেওয়ার আছে। আপনার কাছেই আসছিলুম। চলুন, আপনার ঘরে গিয়ে বসি। তার আগে গাড়ি দুটো সরিয়ে পথটা ফাঁকা করুন।

ওঁর ঘরে গিয়ে বসলাম আমরা। মামু বলেন, আমার কৈফিয়ত দিচ্ছি। কিন্তু তার আগে বলুন তো—কেমন করে জানলেন যে, আমি সাংবাদিক নই, ব্যারিস্টার?

—শুধু ব্যারিস্টার নন। গোয়েন্দা!

—বেশ তাই সই। কিন্তু কেমন করে জানলেন?

—আপনি কি ভেবেছেন আপনিই দুনিয়ার একমাত্র গোয়েন্দা? মেরীনগরেও গোয়েন্দা আছে! সে প্রথম থেকেই চিনতে পেরেছে আপনাকে—আমি ঊষার কথা বলছি—ঊষা বিশ্বাস।

আমি সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করি : মিস মার্পল অব মেরীনগর!

কথাটা কানে গেল ডক্টর দত্তের। আমার দিকে ফিরে বলেন, কারেক্ট। ঊষা হচ্ছে মেরীনগরের মিস্ মার্পল। দারুণ বুদ্ধি তার। আপনার ছবি দেখেনি, কিন্তু চিনেছে ঠিকই!

—কিন্তু কেমন করে?

—গোয়েন্দা যে! নানান কায়দা-কানুন করে। সেসব কথা তার কাছেই শুনবেন। এখন বলুন তো মশাই—কেন সেদিন এক গঙ্গা মিথ্যা কথা বলে গেলেন?

মামু একটি মাত্র শব্দে কৈফিয়ত দাখিল করলেন : অ্যাটেম্পটেড-মার্ডার!

—কী? কী বললেন? ‘অ্যাটেম্পটেড-মার্ডার’ মানে?

— আজ্ঞে হ্যাঁ : খুনের চক্রান্ত! মৃত্যুর তিন সপ্তাহ আগে মিস্ জনসন সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলেন—মনে আছে নিশ্চয়…

—আলবৎ! ওর সেই হতভাগা কুকুরের বলটায় পা-পড়ায় …

—আজ্ঞে না! ওঁর পদস্খলনের হেতু—সিঁড়ির মাথায় কেউ গোপনে আড়াআড়িভাবে একটা কালো রঙের টোন সুতো টান-টান করে বেঁধে দিয়েছিল। ‘সারমেয় গেণ্ডুক’ সম্পূর্ণ নির্দোষ!

ডক্টর দত্ত নির্বাক তাকিয়ে রইলেন। সিলিং ফ্যানটার দিকে। তাঁর স্ত্রী বর্তমান কি না জানি না। কিন্তু ওঁর সেই হতভম্ব দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছিল মিসেস দত্তকে কেউ চুলের মুঠি ধরে সিলিং ফ্যানটার সঙ্গে বেঁধে দিয়েছে। ধর্মপত্নীকে আকাশপথে ঘূর্ণমাণ অবস্থায় দেখছেন উনি! লুল্লু নয়, কোমাগাতামারু নয়—এবার সারমেয়-গেণ্ডুক!

আত্মস্থ হয়ে অস্ফুটে বললেন, এ-কথা কে বললে আপনাকে?

—আমাকে কে বললো সে-কথা উহ্য থাক, আপনাকে বলছেন, পি. কে. বাসু, গোয়েন্দা—টি. পি. সেন, সাংবাদিক, নন!

কুঞ্চিত ভ্রূভঙ্গে উনি বললেন, তাহলে পামেলা আমাকে সে-কথা বলেনি কেন?

—তার হেতুটা সহজবোধ্য। রাত দশটার পর মরকতকুঞ্জে যে ক’জন ছিল তারা সবাই ওঁর নিকট-আত্মীয়, পরিবারের লোক! এবং ওঁর ওয়ারিশ!

মিনিটখানেক নীরব থেকে উনি বললেন, তা সত্ত্বেও! আপনার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে সে আমাদের দুজনের মধ্যে অন্তত একজনকে বলতো! আমি অথবা ঊষা। আপনি সম্পূর্ণ বাইরের লোক….

মামু গম্ভীরভাবে বলেন, ডক্টর দত্ত! নিজের দেহে ক্যান্সারের লক্ষণ আশঙ্কা করলে মানুষে নিকট-আত্মীয়ের কাছে তা গোপন করে, অকুণ্ঠভাবে জানায় সম্পূর্ণ বাইরের লোক, ডাক্তারকে। ঠিক তেমনি, নিজের পরিবারের মধ্যে হত্যাকারীর লক্ষণ দেখলে মানুষ তা ডাক্তারের কাছে গোপন করে, জানায় গোয়েন্দাকে!

আবার বেশ কিছুক্ষণ গুম মেরে বসে রইলেন ডক্টর দত্ত। তারপর বললেন, পামেলা আমার বাল্যবান্ধবী, আমার ছোট বোনের মতো। আমার দুরন্ত কৌতূহল হচ্ছে সব কিছু জানতে। কিন্তু না, তা আমি জানতে চাইবো না। শুধু একটা কথা বলুন, কে সেই দড়িটা খাটিয়েছিল তা কি আপনি আন্দাজ করতে পারেননি?

—আমাকে মাপ করবেন ডক্টর দত্ত। আমার মক্কেলের নির্দেশ ছিল ব্যাপারটা সম্পূর্ণ গোপন রাখতে হবে!

—কিন্তু আপনার মক্কেল—যদি পামেলাই হয়—সে তো মৃত।

—মৃত্যুর পর আপনি কি জানাতে পারেন আপনার কোন্ রুগী সিফিলিসে ভুগছিল?

-–আই সী! না, প্রফেশনাল এথিক্সে তা আমাকে গোপন রাখতে হয়। কিন্তু তদন্তটা তাহলে এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন কেন? আপনার মক্কেল তো মৃত

—এক্সজ্যাক্টলি ডক্টর, এক্সজ্যাক্টলি! ওখানেই আপনার প্রফেশনের সঙ্গে আমার প্রফেশনের সাদৃশ্য এবং পার্থক্য। আপনার জীবিকার পূর্ণচ্ছেদ রোগীর মৃত্যুতে, আমার জীবিকার প্রারম্ভ–ক্ষেত্রবিশেষে, মক্কেলের মৃত্যুতে। প্রফেশনাল এথিক্সের নির্দেশে তদন্তটা আমাকে চালিয়ে যেতে হবে—মক্কেল পেমেন্ট করুক না বা করুক। মৃত্যুর পরে ডাক্তারের সঙ্গেও রোগীর যে একটি গোপনতার সম্পর্ক থাকে তা তো এইমাত্র আপনি স্বীকার করলেন!

—বুঝলাম। ওয়েল, আমি কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

—আমার জিজ্ঞাস্য : প্রথমবার ব্যর্থ হয়ে কি দ্বিতীয়বার সে-চেষ্টা করেনি সেই অজ্ঞাত আততায়ী?

—মানে, পামেলার মৃত্যু অস্বাভাবিক কিনা? না ব্যারিস্টার সাহেব। পামেলার মৃত্যু নিতান্ত স্বাভাবিক—দীর্ঘদিন জনডিস রোগে ভুগে।

বাসু-মামু একটু ঝুঁকে এলেন। ছেদিলালের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের নিখুঁত বর্ণনা দিলেন। মনে হচ্ছিল, সমস্ত কথোপকথনটা যেন ওঁর মস্তিষ্কে কোনও গ্রে-সেলের ক্যাসেটে রেকর্ড-করা আছে!

আদ্যন্ত শুনে বৃদ্ধ বললেন, বুঝেছি, কী বলতে চাইছেন। হ্যাঁ, এমন নজির আছে বটে—পারিবারিক চিকিৎসক ‘আর্সেনিক পয়েজনিং’ ধরতে পারেনি! ভেবেছে ‘অ্যাকিউট গ্যাস্ট্রিক এন্টেরাইটিস’। কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি। দু-একবার বমি করেছিল বটে, কিন্তু পেটে যন্ত্রণা ছিল না। আর্সেনিকের লক্ষণ কিছু পাইনি। নাঃ! আমি নিশ্চিত–পামেলার মৃত্যু হয়েছিল ‘জনডিস’-এ; আরও পরিষ্কার ভাষায় : ‘ইয়ালো অ্যাট্রপি অব দ্য লিভার’। আর্সেনিক নয়।

বাসু-মামু তাঁর সেই ম্যাজেশিয়ানি ঢঙে পকেট থেকে বার করলেন এক খণ্ড কাগজ। বললেন, দেখুন তো—এতে আপত্তিকর কিছু আছে?

ডক্টর দত্ত খুঁটিয়ে দেখলেন। বলেন, ডক্টর প্রীতম ঠাকুরের প্রেসিক্রিপশন দেখছি। আশ্চর্য! পামেলা তো আমাকে একথা কিছু বলেনি-

—বলেননি সঙ্গত কারণেই। যেহেতু এ ওষুধ তিনি আদৌ খাননি। কিন্তু আপনি আমাকে বলুন তো—এতে আপত্তিকর কিছু আছে?

ডক্টর দত্ত আবার প্রেসক্রিপশনটা খুঁটিয়ে দেখলেন। বললেন, না নেই। আমি অবশ্য এই জাতের আসুরিক চিকিৎসায় বিশ্বাসী নই—বিশেষত বয়স্ক রোগীর ক্ষেত্রে, ক্রনিক কেস-এ। কিন্তু আমি হচ্ছি ওল্ড স্কুলের চিকিৎসক। রাতারাতি বাজিমাত করা আমার ধাতে নেই। তরুণ চিকিৎসকেরা আশু ফল পাওয়ার আশায় এই ধরনের ওষুধ প্রেসক্রাইব করে থাকেন—রোগীর সিটেমে তা দীর্ঘমেয়াদী মূল্যায়নে ক্ষতি করলেও। যা হোক, এতে আপত্তিকর কিছু নেই—অ্যাট লিস্ট আর্সেনিকের নামগন্ধ নেই।

-–সেকেন্ডলি, আপনি যদি মনে করেন আপনার কোনও ইনসমনিয়া রোগীকে দৈনিক একটা করে ‘কামপোজ’ খেতে হবে তিন সপ্তাহ ধরে, তাহলে আপনি কি একুশটি ট্যাবলেটের প্রেসিক্রিপশন একসঙ্গে করেন?

দত্ত সাহেব বললেন, এখনি সেই কথাই বলেছি। ঐ জাতীয় আসুরিক চিকিৎসায় আমার বিশ্বাস নেই। ইনসমনিয়ার ক্রনিক রোগীকে তিন-সপ্তাহ ক্রমাগত একটি করে ‘কামপোজ’ খাবার পরামর্শ আমি দিই না। এতে দেখা যায়, এরপর দৈনিক দুটো করে খাবার দরকার হয়। তাছাড়া একসঙ্গে দু-পাতা ঘুমের ওষুধ কিনে বাড়িতে রাখাও বিপদজনক। ঘুম-না-আসার যন্ত্রণায় রোগী কখনো কখনো একসঙ্গে বেশি ট্যাবলেট খেয়ে ফেলে–হয়তো ভুল করে—আপনি নিশ্চয় জানেন ওভারডোজ হলে রোগীর ঘুম আদৌ ভাঙে না। তা এই অদ্ভুত প্রশ্নটি করলেন কেন?

—ধরুন জ্ঞানবৃদ্ধিমানসে।

—বুঝেছি। এটাও আপনার প্রফেশনাল সিক্রেসি। যা হোক আরও কোনওভাবে আপনার প্রচেষ্টায় আমি কি সাহায্য করতে পারি? আমি সর্বান্তঃকরণে আপনার সাফল্য কামনা করছি, মিস্টার বাসু! পামেলা চিরশান্তির দেশে চলে গেছে। তার মৃত্যু স্বাভাবিক। কিন্তু তাকে মরণের পথে ঠেলে দেবার ঐ জঘন্য চক্রান্ত যদি কেউ করে থাকে—সে ব্যর্থ হোক না হোক—তাহলে তাকে আপনি খুঁজে বার করুন! তার প্রাপ্য শাস্তিটা পাওনা আছে! পামেলা আমার বাল্যবান্ধবীই শুধু নয়, তাকে… ওয়েল, স্বীকারই করি… আমি ভালোবাসতাম!

—থ্যাঙ্কস্ ফর য়োর ক্যানডিড্ কনফেশান ডক্টর! তাহলে আপনাকে আর একটি উপকার করতে হবে। আমার অনুসন্ধানকার্যের একটি অন্তরায়কে সরিয়ে দিতে হবে।

—বলুন?

—আপনাদের ঐ ‘মেরীনগরী মিস্ মার্পল’কে রুখতে হবে। গোয়েন্দার পিছনে তিনি ক্রমাগত গোয়েন্দাগিরি করে গেলে আমার পক্ষে কাজটা কঠিনতর হয়ে উঠবে।

—আই সী! হ্যাঁ, ঊষা মাঝে মাঝে খুব বাড়াবাড়ি শুরু করে। কেন যে সে আপনার পিছনে লেগেছে আমি জানি না—

—তার তিনটি সম্ভাব্য হেতু। এক : বৃদ্ধার হাতে কাজ নেই, তাই খই ভাজতে বসেছেন। একা মানুষ, সময় কাটে না, তাই শৌখিন-গোয়েন্দার ভূমিকাটা গ্রহণ করেছেন। দিব্যি সময় কেটে যাচ্ছে। দুই : মেরীনগরে তাঁর একটা সুখ্যাতি আছে—বুদ্ধিমতী বলে, ধূর্ত বলে। ‘মিস মার্পল অব মেরীনগর’ তাঁর মুকুটে একটি নতুন পালক লাগাতে উদগ্রীব হয়েছেন। তিন : এক্ষুণি আপনি যে কথাটা বললেন, সেটা তিনিও বলতে পারতেন আপনার সম্বন্ধে…

—ঠিক বুঝলাম না। তৃতীয় যুক্তিটা কী?

—কিছু মনে করবেন না ডক্টর দত্ত—এ শুধু অ্যাকাডেমিক ডিস্কাশান : মিস্ বিশ্বাস, মিস্ জনসন আর আপনি বাল্যসহচর। আপনি মিস্ পামেলা জনসনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, হয়তো তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা দেখে, হয়তো তাঁর সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে। মিস্ ঊষা বিশ্বাসের অবচেতনে তাই পামেলার প্রতি একটা ঈর্ষা, আপনার প্রতি একটা অভিমান অর্ধশতাব্দীকাল ধরে তিলে তিলে সঞ্চিত হয়েছে। এ অবশ্য আমার নিছক অনুমান! তাই হয়তো শুধু আপনাকে মোহিত করার জন্যই মিস্ মার্পল তাঁর বুদ্ধির দৌড় দেখাচ্ছেন। বাই দ্য ওয়ে—আপনার বাবার কোনও ডায়েরি কি আপনি খুঁজে পেয়েছেন?

মনে হল, ডক্টর দত্ত অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেন। কী যেন গভীরভাবে চিন্তা করছেন। মিনিটখানেক আত্মসমাহিত অবস্থায় নিশ্চুপ বসে থেকে হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে পেলেন। বলেন, হ্যাঁ, কী যেন বলছিলেন?

—আমি সেবার চলে যাবার পর আপনি কি আপনার কোনও ডায়েরি…

হঠাৎ হো-হো করে হেসে ওঠেন দত্ত-সাহেব। বলেন, ও নো নো! এটাও ঐ মিস্‌ মার্পল-এর উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা। আপনি চলে যাবার পর সে আমার বাড়িতে হানা দিয়েছিল। আমাকে—কী বলবো—যা নয় তাই বলে গালমন্দ করলো। আমি গবেট, আমার মাথায় গোবর পোরা ইত্যাদি! আমার নাকি প্রথম থেকেই বোঝা উচিত ছিল, আপনি যোসেফ হালদারের জীবনী লিখতে আদৌ আসেননি। আপনি টুকু, সুরেশ বা হেনা নিয়োজিত একজন গোয়েন্দা। এসেছেন, পামেলার মৃত্যু অথবা উইল সম্বন্ধে কোনও রহস্য উদ্ঘাটনে। সে নিজেই ঐ টোপটা ফেলতে চেয়েছিল—যাতে আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তখন সেও উপস্থিত থাকবে। আমরা দুজনে গোয়েন্দার মুখোশটা খুলে আপনাকে বেইজ্জত করবো।

মামু বলেন, কিন্তু আমার পরিচয়টা মিস্ বিশ্বাস কেমন করে পেলেন?

—সহজেই। মিন্টির সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাকে নাকি আপনি আপনার প্রকৃত পরিচয়ই দিয়েছিলেন।

ঠিক তখনই ডাক্তার সাহেবের টেলিফোনটা বেজে উঠলো। উনি বসেছিলেন যে চেয়ারে তার পাশেই টেলিফোন রিসিভারটা। তুলে নিয়ে উনি আত্মপরিচয় দিলেন।

এবারও সে সময় আমরা এক প্রান্তের কথাই শুনতে পেয়েছিলাম। কিন্তু আলাপচারির পর ডাক্তার-সাহেব আদ্যন্ত কথোপকথনটা আমাদের জানিয়েছিলেন। এবারেও পাঠককে বঞ্চিত করবো না। দু-প্রান্তের কথাই পরপর সাজিয়ে দেওয়া যাক।

—হ্যালো? ডক্টর দত্ত বলছি!

—টিক্‌টিকি কি তোমার বাড়িতে?

—কে, ঊষা? ‘টিকটিকি’ মানে?

—‘ডিটেকটিভ’ শব্দটার বাংলা পরিভাষা ‘টিকটিকি’ তাও জানো না? তোমার বাবার ডায়েরির খোঁজে কি টিকটিকি-সাহেব ওখানে যায়নি?

—হ্যাঁ, এসেছিলেন তো। এই একটু আগে চলে গেলেন।

—ইস্! নাটকীয় দৃশ্যটা আমার দেখা হলো না। তা তুমি ওর নাকে ঝামা ঘষে দিয়েছো তো?

—ঝামা! মানে? আমি তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।

—আমার কথা তো পঞ্চাশ বছর ধরে তুমি বুঝতে পারলে না পিটার। সে আবার আজ নতুন করে কী বুঝবে! ও কী বললো? মিস্টার কোমাগাতামারু?

—শোনো ঊষা। তুমি পার্টলি কারেক্ট। ভদ্রলোক স্বীকার করেছেন, ওঁর নাম পি. কে. বাসু। টি. পি. সেন নয়। ছদ্মনাম নিতে বাধ্য হয়েছিলেন ব্যাপারটা গোপন রাখতে—

—হুঁ! কিন্তু কোন ব্যাপার? ‘মৃত্যু’ না ‘উইল’?

—আরে না, না! মিস্টার বাসু আঙ্কল যোসেফের জীবনীটা সত্যই লিখছেন—

—এই যে বললে,’“ব্যাপারটা গোপন রাখতে?

—তাই তো বলছি। মানে, মিস্টার বাসু চান না যে, কথাটা জানাজানি হয়ে যাক—আই মিন, উনি যোসেফ হালদার আর কোমাগাতামারুর ওপর একটা রিসার্চ করছেন-

—টিকটিকিটা বুঝি তাই বুঝিয়ে দিয়ে গেল তোমাকে? তোমার মাথায় নিরেট ষাঁড়ের গোবর। ও এই নতুন টোপটা ফেললো আর তুমি কপাৎ করে গিলে ফেললে? তা আঙ্কল হ্যারম্ভের ডায়েরির কথায় তুমি কী বললে?

—কী আবার বলবো? ডায়েরিটা ওঁর হাতে দিয়ে দিলাম।

—ডায়েরিটা! মানে?

—বাবার ডায়েরিটা—সেই যেটায় আঙ্কল যোসেফ আর কোমাগাতামারুর কথা আছে!

—মানে! এবার যে তোমাকে পাগলা গারদে পাঠাতে হয় পিটার! ফিজিশিয়ান, হিল দাইসেলফ্! সকাল থেকে ক-পেগ টেনেছো?

—ও হো! আমারই ভুল! তোমাকে বলা হয়নি। আশ্চর্য কোয়েন্সিডেন্স, ঊষা! তুমি সেদিন বলার পর আমার কেমন যেন সন্দেহ হলো। কোনটা ঠিক—তোমার কথা না কি সেই সাংবাদিক ভদ্রলোকের কথা। আমি পুরনো কাগজপত্র হাতড়াতে বসলাম। কী অদ্ভুত কোয়েন্সিডেন্স দেখো—খুঁজে পেয়ে গেলাম বাবার একটা অতি জীর্ণ ডায়েরি—নাইনটিন ফোর্টিন-এর। তাতে যোসেফ-কাকার বিষয়ে অনেক কথা লেখা আছে, গুরুজিৎ সিং আর কোমাগাতামারুর কথাও! তুমি কেমন করে এটা আন্দাজ করলে ঊষা? য়ু আর এ জুয়েল অব আ স্লথ! আ জিনিয়াস!

এরপর নাকি মিনিটখানেক ও প্রান্ত সম্পূর্ণ নীরব।

—হ্যালো, ঊষা? হ্যালো? আর য়ু স্টিল দেয়ার?

মিস্ বিশ্বাস কোনোক্রমে বলেন, সত্যি কথা বলছো? পিটার? ডায়েরিটা কোথায়?

—মিস্টার বাসু নিয়ে গেলেন। বললেন, কয়েকটি পৃষ্ঠার ফটো-কপি করে ডায়েরিটা আমাকে ফেরত দিয়ে যাবেন। তখন দেখাবো তোমাকে

আবার কিছুটা নীরবতা। তারপর মিস্ বিশ্বাস শ্রান্তভাবে বলেন, সন্ধ্যাবেলা একবার আমার কাছে এসো দিকিনি। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। মাথাটা কেমন যেন… আই মীন রীল করছে!

লুল্লু এবার মিস বিশ্বাসের চুলের মুঠি খামচে ধরেছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *