সারমেয় গেণ্ডুকের কাঁটা – ১

চিঠিখানা যেদিন আমাদের এই নিউ আলিপুরের বাড়িতে এসে পৌঁছালো তখন বাড়ি ফাঁকা। রানীমামীমাকে নিয়ে আমার স্ত্রী সুজাতা গেছে গোপালপুরে। সমুদ্রের ধারে একটা হোটেলে পাশাপাশি দু’খানি ঘর ‘বুক’ করেছি। একটা মামা-মামীর, আর একটা আমাদের দুজনের। কিন্তু বাসুমামার কী একটা কেস-এর শুনানির দিন বেমক্কা এসে পড়ল মাঝখানে। উপায় কী? বাধ্য হয়ে ওঁদের দুজনকে পৌঁছে দিয়ে আমাকে ফিরে আসতে হয়েছে। আগামীকাল, ত্রিশে জুন মামুর হিয়ারিং। সে বখেড়া মিটলে আমরা দুজন ফিরে যাব গোপালপুর-অন-সিতে। কাল বাদে পরশু। এমনই এক ব্রাহ্মমুহূর্তে ঐ অলুক্ষুণে চিঠিখানা এসে পৌঁছাল এ বাড়িতে।

জুন মাসের শেষাশেষি। বেশ গরম পড়ে গেছে। মন উড়ু-উড়ু, মানে গোপালপুর-মুখো। বিশুকে বলে রেখেছি, কোনো লোক টেলিফোন করলে বা দেখা করতে এলে যেন স্রেফ হাঁকিয়ে দেয়। না হলে আবার কোনও ‘কেস’-এ ফোঁসে যাবেন উনি। ভালোয় ভালোয় এ দুটো দিন কাটলে বাঁচি।

সকালবেলা প্রাতরাশের টেবিলে এসে দেখি বাসুমামা অনুপস্থিত। এমনটা কখনো হয় না। উনি ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে জীবনের ছককে বেঁধে ফেলেছেন। আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাবে কম্বাইন্ড-হ্যান্ড-বিশু জানালো, বড়-সাহেব এখনো বাইরের ঘরে।

উঠে ডাকতে যাব, তখনই এসে গেলেন উনি : সরি! আয়াম লেট বাই সেভেনটিন মিনিটস।

বাসু-সাহেবকে যাঁরা চেনেন না, তাঁদের মনে হতে পারে এটা বাড়াবাড়ি। উনি বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড়। তাছাড়া আমি কিছু এ বাড়ির অতিথি নই। পি.কে. বাসু, বার-অ্যাট-ল হচ্ছেন প্রখ্যাত ক্রিমিনাল সাইডের ব্যারিস্টার। সন্তানাদি নেই। প্রৌঢ় মানুষটি সস্ত্রীক বাস করেন এই বাড়িতে। আমরা দুজন ওঁরই আশ্রয়ে ‘সুকৌশলী’ নামে একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিস খুলে বসেছি। ফলে, সতের মিনিট দেরী হওয়ার জন্য ওঁর মার্জনা ভিক্ষার কোনও প্রয়োজন ছিল না; কিন্তু এসব বিলাতি-কেতা ওঁর মজ্জায় মজ্জায়।

প্রাতরাশের টেবিলে বসে জোড়া-পোচের প্লেটটা উনি টেনে নিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী ভাবছো?

সত্যি কথাই বলি, ভাবছি কাল বাদে পরশু আমাদের গোপালপুর যাওয়াটা না ভেস্তে যায়।

ভেস্তে যাবে! কেন? এ কথা মনে হল কেন তোমার? কালকেই তো কেসটার ফাইনাল হিয়ারিং?

—সেটা নয়। আপনার সতের মিনিটের দেরি হওয়ার সূত্র ধরে আমার আশঙ্কা হচ্ছে–হয়তো আজকের ডাকে আপনি এমন কোনও চিঠি পেয়েছেন-

উনি প্রায় লাফিয়ে ওঠেন, কারেক্ট! দারুণ ডিডাক্ট করেছ! ‘বাসুমামু লেট–পত্রাৎ!” হেত্যর্থে পঞ্চমী! আজকের ডাকে তেমনই একটা বিচিত্র চিঠি পেয়েছি বটে।

—মার্ডার কেস?

—আরে না, না। সেসব কিছু নয়। পড়েই দেখ না—

পকেট থেকে বার করে খামখানা বাড়িয়ে ধরেন আমার দিকে। নিতে হল। বলি, পড়ার কী আছে? আপনি মুখে-মুখে বলুন না—ব্যাপারটা কী?

—না, তা হয় না কৌশিক। তোমার সিদ্ধান্ত তুমিই নেবে। নাও, পড়

অগত্যা। দামী লেফাফা। মোটা লেটার-হেডের বন্ড কাগজ। হস্তাক্ষর অতি বিচিত্র—গোটা গোটা, ঝরঝরে। দেখলে মনে হয়, পত্রলেখক দেড়-দু’শ বছর আগে তালপাতার পুঁথিতে মক্‌সো করে হাত পাকিয়েছেন :

সবিনয় নিবেদন,

অনেক সন্দেহ এবং অনিশ্চয়তার বাধা অতিক্রমণান্তে আপনাকে এই পত্রটি লিখিতে বাধ্য হইতেছি শুধুমাত্র এই আশায় যে, আপনি-আপনার ভূয়োদর্শনের প্রগাঢ় প্রজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে আমার এই একান্ত গোপনীয় বিষয়টির রহস্য উদ্ঘাটনে সক্ষম হইবেন। স্বীকার্য, যদিচ আপনার সহিত কখনো আমার সাক্ষাৎ হয় নাই, তথাপি আপনি আমার সুপরিচিত। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড নিবাসী “জগদানন্দ সেন মহোদয়ের নিকট আপনার সংবাদ প্রাপ্ত হই। আপনার সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টায় তিনি বিপন্মুক্ত হইয়াছিলেন। অপিচ তাঁহার পারিবারিক মর্য্যাদাটুকু আপনি কোনওভাবে ক্ষুণ্ণ হইতে দেন নাই। আমি অবশ্য জানি না, সেন মহাশয়ের সমস্যাটি কী জাতের ছিল। কৌতূহলী হওয়াও কুরুচির পরিচায়ক। পরন্তু এটুকু অনুধাবন করিয়াছি যে তাহা ছিল গোপন ও বেদনাদায়ক……

সারমেয় গেণ্ডুকের কাঁটা মাকড়সার জালের মতো— পত্রলেখকের ভাষায় ‘লূতাতন্তুসদৃশ’ ঐ হাতের লেখার ব্যূহ ভেদ করে আর অগ্রসর হতে পারছিলাম না আমি। বলি, এ ভদ্রলোক তাঁর মূল বক্তব্যটা কোন প্যারাগ্রাফে বলেছেন সেটুকু যদি দেখিয়ে দেন-

বাসুমামা কফির পটটা টেনে নিতে নিতে বলেন, লিঙ্গে ভুল হল। ভদ্রলোক নয়, ভদ্রমহিলা। চিঠির পাদদেশে নজর গেল আমার : ‘বিনতা পামেলা জনসন’।

—আর ‘মূল বক্তব্যটা ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। চোখ থাকলে দেখতে পাবে। পড়ে যাও। অগত্যা তাই। রীতিমত বানান করে করে এগিয়ে যেতে থাকি :

আমার আন্তরিক বিশ্বাস : বক্ষ্যমাণ সমস্যায় আপনি আমাকে অনুরূপভাবে সাহায্য করিতে সক্ষম। যদ্যপি অনুসন্ধান সমাপনান্তে আপনি এই সিদ্ধান্তে আইসেন যে, আমার রজ্জুতে সর্পভ্রম হইয়াছে, তাহা হইলে আমিই সৰ্ব্বাপেক্ষা পরিতৃপ্ত হইব। বিশ্বাস করুন, বিশ্বাস করিতে আমার মন সরিতেছে না। পরন্তু দ্বিতীয় কোনও ব্যাখ্যাও খুঁজিয়া পাইতেছি না। সারমেয়-গেণ্ডুকের বিষয়টি এমনই জটিল, এমনই সঙ্গোপন যে, মেরীনগরে কাহাকেও কিছু বলা যায় না।

এবার চিঠির উপর দিকে নজর পড়ল আমার। ছাপা হরফে লেখা আছে ঠিকানা : ‘মরকতকুঞ্জ, মেরীনগর’ এবং পোস্টাল জোন নাম্বার। তার নিচে চিঠি লেখার তারিখটা। 17.4.70.

আপনি নিশ্চয় অনুমান করিতেছেন যে, আমি নিরতিশয় দুশ্চিন্তাগ্রস্তা, বস্তুত আতঙ্কাগ্রস্তা! বিগত দুই দিবস আমি মনকে বুঝাইবার চেষ্টা করিতেছি যে, আমার আশঙ্কা অমূলক, কিন্তু কার্য্যকারণ সম্পর্কের কোনও সূত্র দিয়া এই দুর্ঘটনার কোন ব্যাখ্যা খুঁজিয়া পাইতেছি না। চিকিৎসক বলিয়াছেন মনকে দুশ্চিন্তামুক্ত রাখিতে। বর্তমান অবস্থায় তাহাও অসম্ভব। অনুগ্রহ করিয়া অবিলম্বে আমাকে জ্ঞাত করিবেন—এ বিষয়ে গোপন তদন্ত করিযা আমার সংশয় নিরাকরণের জন্য আপনাকে কী সম্মানমূল্য প্রদান করিতে হইবে। বলা বাহুল্য, এখানে কেহই কিছু জানে না, জানিবে না। পত্রোত্তরের প্রতীক্ষারতা।

বিনতা পামেলা জনসন।

আদ্যোপান্ত পড়ে বলি, ব্যাপারটা কী? কী চাইছেন ভদ্রমহিলা? আর মিস্ বা মিসেস্ জনসন এবম্বিধ দুষ্পাচ্য বঙ্গভাষায় পত্রাঘাত করিলেন কোন হেতুতে?

বাসুমামু শুধু কাঁধ ঝাঁকালেন।

—এ তো আদ্যন্ত পাগলের প্রলাপ।

—হুঁ! তুমি হলে কী করতে? পত্রপাঠ ছেঁড়া কাগজের ঝুলি?

—তাছাড়া কী?

—তার হেতু, ঐ চিঠিতে যেটি সব চেয়ে রহস্যময় দিক সেটা তোমার নজরেই পড়েনি।

—সবটাই তো রহস্যময়। তার ভিতর ‘সবচেয়ে’ বড় কোনটা?

—চিঠির তারিখটা। যা এখনো খেয়াল করে দেখনি তুমি।

তারিখ? তা বটে! চিঠির মাথায় তারিখ দেওয়া আছে : 17.4.70

আর আজ হচ্ছে জুন মাসের উনত্রিশ তারিখ। দুমাসের বেশি।

আমি লজ্জা পাই। এ দিকটা নজরে পড়েনি। সামলে নিয়ে বলি, তার অনেক ব্যাখ্যা হতে পারে। ভদ্রমহিলার মাথায় দু-একটি স্ক্রুপ যে ঢিলে সেটা চিঠিখানা পড়লেই বোঝা যায়। হয়তো ‘17.6’ লিখতে ‘17.4’ লিখে বসে আছেন।

—কাঁচড়াপাড়া থেকে নিউ আলিপুরে চিঠি আসতে দিন-দশ বারো লাগে না।

–ডাক বিভাগের দয়ায় তাও হয়, বাসুমামু। কেউ নিজের কাজ করে না—

—বটেই তো। কেউ নিজের কাজ করে না! পোস্ট-অফিসকে দোষ দেওয়ার আগে পোস্টাল ছাপটুকুও নজর করে দেখে না কেউ

এবার নিরতিশয় লজ্জায় পড়ি। নিতান্ত দুর্ভাগ্য আমার। দুটো ছাপই স্পষ্ট। প্রেরক ও প্রাপক পোস্ট-অফিসের। যথাক্রমে 26.6.70 এবং 29.6.70 1

আমি সলজ্জে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই উনি বলে ওঠেন, বাট হোয়াই? অমন আতঙ্কগ্রস্তা এক বৃদ্ধা এমন একটা জরুরী চিঠি কেন দু-মাস পরে ডাকে দিলেন?

আমি বলি, বৃদ্ধা?

—নয়? হাতের লেখায় বুঝছো না!

এবার বলি, ঠিকানা তো রয়েইছে। একটা চিঠি লিখে সেটা জানতে চাইলেই—

—নো! দু’মাস আগে পেলে চিঠিতেই জবাব দিতাম। বাট ইটস টু লেট নাউ!

—তাহলে? মানে, কী করতে চান আপনি?

—আমার মামলা তো কালকে। চল ঘুরে আসি। আজ তো আমি ফ্রি!

—ঘুরে আসবেন? মেরীনগর? জায়গাটা চেনেন?

—না। তবে পোস্টাল-জোন নাম্বার যখন আছে, খুঁজে পাবই। তৈরী হয়ে নাও।

আমি গ্রীষ্মের এই খরতাপের প্রসঙ্গটা তোলার আগেই উনি বিশুকে ডেকে নির্দেশ দিলেন, এ বেলা আমরা বাইরে খাবো। তুই আর রান্নাবান্নার হাঙ্গামায় যাস না। এই টাকা ক’টা রাখ। হোটেলে খেয়ে আসবি।

.

আমি একটা গোড়ায় গলদ করে বসে আছি। ঊনত্রিশে জুন নয়, আমার গল্পটা শুরু হওয়া উচিত ছিল এপ্রিলের মাঝামাঝি–বস্তুত গুড ফ্রাইডের আগের শুক্রবার থেকে। কিংবা মে মাস থেকে। পটভূমি হওয়া উচিত ছিল মেরীনগর।

মুশকিল কী জানেন? আমি পেশাগতভাবে সিভিল এঞ্জিনিয়ার। বর্তমানে সস্ত্রীক গোয়েন্দাগিরি করি। এককালে কবিতা-টবিতা লিখতুম। গল্প-উপন্যাস কদাচ নয়। পি. কে. বাসুর কাহিনীগুলি মুখে মুখে জানিয়ে দিতুম আমার এক অভিন্নহৃদয় বন্ধুকে। সেই সাজিয়ে-গুছিয়ে ‘কাঁটাসিরিজ’-এর গোয়েন্দা গল্প লিখে ছাপতে দিতো। এবার সে বলেছে তার সময় নেই। সে নাকি কীটপতঙ্গ, কেঁচো-বিছের জগতে ব্যস্ত—অর্থাৎ ‘না-মানুষ’ নিয়ে। ‘মানুষ’ জন্তুটার সম্বন্ধে আপাতত তার কোনও কৌতূহল নেই। তাই এ গল্পটা উত্তমপুরুষে লিখতে বাধ্য হয়েছি। আর তাতেই এই বিপত্তি।

যাক, যা বলছিলাম—আমরা মেরীনগরে তদন্তে যাবার আগে সেখানে যা ঘটেছিল তার পূর্বকথন একটু শোনাই। এসব ঘটনার কথা অনেক পরে আমরা জানতে পারি—নানান সূত্র থেকে। ধরে নিন—এটাই আমার কাহিনীর এক নম্বর পরিচ্ছেদ :

* * *

মিস্ পামেলা জনসন দেহ রাখলেন পয়লা মে তারিখে। দীর্ঘ বাহাত্তরটা বছর পাড়ি দিয়ে। শেষবার বিশেষ ভোগেননি। মাত্র দিন-চারেকের রোগ-ভোগ। জনডিস্। শেষ ক’বছর ঐ পীতরোগেই ভুগছিলেন। মিস্ পামেলা জনসনের মৃত্যুসংবাদে মেরীনগরে কেউ মর্মাহত হয়নি একথা স্বীকার্য। এমনটা যে-কোন দিনই ঘটতে পারত। তবে দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল অনেকেরই। সেবার গীর্জা-প্রাঙ্গণে প্রকাণ্ড শিশুগাছটা কালবৈশাখীর দাপট সহ্য করতে না পারায় যেমন বেদনাবোধ জেগেছিল সকলের। গাছটা ফল দিতো না, ফুল ফোটাতো না, তবু সেই আকাশস্পর্শী মহীরুহের ভূশয্যাগ্রহণে বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা বেদনা জাগেই। পামেলা মেরীনগরে একান্তচারিণীর জীবনযাপন করে গেছেন—রাজনৈতিক, সামাজিক, মহিলামহলের ডামাডোলে সামিল হতেন না—তবু মেরীনগরে বুড়ো-বাচ্চা সবাই তাঁকে একটা সম্মানের আসনে বসিয়েছিল। ঐ শিশুগাছটার মগডাল দেখতে যেমন ঊর্ধ্বমুখ হতে হতো।

মিস্ পামেলা জনসন এই মেরীনগরের এক অতি প্রাচীন বাসিন্দা। প্রাচীনতমা হয়তো ছিলেন না—ডক্টর পিটার দত্ত অথবা উষা বিশ্বাস সম্ভবত ওঁর চেয়ে বয়সে বড়; কিন্তু পামেলাই এখানকার একমাত্র বাসিন্দা যিনি সেই বেণী-দোলানো কৈশোরকাল থেকে এখানে আছেন। জীবনের একটা সপ্তাহও এ গাঁয়ের বাইরে কাটাননি

মৃত্যু সময়ে ওঁর নিকট আত্মীয়-স্বজন কেউ উপস্থিত ছিলেন না। ছিল শুধু বেতনভুক গৃহকর্মীর দল—সহচরী, রাঁধুনি, ঝি, ড্রাইভার আর বাগানের মালি। কিন্তু ওঁর মৃত্যুর দিন দশ-বারো আগে ইস্টারের ছুটিতে সবাই জড়ো হয়েছিল। আর আত্মীয়-স্বজন বলতে আছেই বা কে? বাহাত্তর বছর বয়সের বুড়ির বাপ-মা-মাসি–পিসি থাকার কথা নয়। বিয়ে করেননি যে, সন্তানাদি থাকবে। ওঁর অবশ্য তিন বোন আর এক ভাই ছিল—তারা একে একে দুনিয়ার মায়া কাটিয়েছে ওঁর আগেই। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে উনিই বয়সে সবার বড়—ওঁরই সবার আগে বিদায় নেবার কথা; কিন্তু মা-মেরীর বিধানে উনি টিঁকে ছিলেন দীর্ঘদিন ঐ মরকতকুঞ্জে, ভূষণ্ডীকাকের মতো। তিন কুলে থাকার মধ্যে কুল্যে টিকে আছে তিনটি প্রাণী—টুকু, সুরেশ আর হেনা। তারা সবাই এসেছিল ইস্টারের ছুটিতে। মায় হেনার স্বামী সর্দার প্রীতম ঠাকুর। মৃত্যুর পক্ষকাল আগে।

বছর-দেড়েক আগে আরও একবার যমে-মানুষে টানাটানি গেছে। ডাক্তার পিটার দত্তের চিকিৎসাতেই শুধু নয়, নিজের মনের জোরে সেবার মরকতকুঞ্জের সিং দরোজার বাইরে থেকে ফিরিয়ে দিতে পেরেছিলেন যমরাজকে। এবার পারলেন না।

মেরীনগর একটি খ্রীস্টানপ্রধান গ্রাম। রোমান ক্যাথলিক। কাঁচড়াপাড়া রেল স্টেশন থেকে যে পাকা সড়কটা পাক খেতে খেতে জাগুলিয়ার মোড়ে এসে মিশেছে এন.এইচ.থাট্টিফোরে, তারই মাঝামাঝি একটা ফ্যাকড়া-সড়কে গড়ে উঠেছে এই গ্রামটা। ‘গ্রাম’ শব্দটা অবশ্য এখন আর সুপ্রযুক্ত নয়, ছোটখাটো শহরই বলা যায়। এসেছে বিজলিবাতি এবং দূরভাষণের লাইন। গড়ে উঠেছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র আর সেকেন্ডারি স্কুল। কিন্তু পামেলা জনসনের পিতৃদেব যোসেফ হালদার যখন ওখানে এসে বসবাস শুরু করেন, প্ৰথম বিশ্বযুদ্ধের আমলে, তখন ওটা ছিল রীতিমতো জঙ্গল। হরিণ না থাকলেও হরিণ লুকিয়ে থাকার মতো বড় বড় বেনাঘাস ছিল আ-হরিণঘাটাতক ডাঙা জমিটায়। যোসেফ হালদারের যৌবন কেটেছে বিদেশে–বিলাতে না মার্কিন মুলুকে অথবা দক্ষিণ আফ্রিকায় সেটা জানা যায় না। কী কারণে তিনি প্রৌঢ় বয়সে সে দেশ থেকে ফিরে এসেছিলেন সেটাও ইতিহাসের এক অনুদ্ঘাটিত অধ্যায়। তবে তিনি যে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হিসাবেই স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন এটা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। কারণ ঐ নির্জন আরণ্যক পরিবেশে বিরাট এক জমিদারি কিনে তিনি একটি গ্রামের পত্তন করেছিলেন—মেরীনগর। বানিয়ে ফেললেন একটি গির্জা। খুলে বসলেন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। নলকূপের সাহায্যে ব্যবস্থা করলেন জল সরবরাহের—অনাবাদী ঊষর জমি পরিণত হল কৃষিক্ষেত্রে। মর্কিন মুলুক থেকে আসুন না আসুন—তাঁর পরিকল্পনা মার্কিনী রাঞ্চ-এর।

বছর কয়েকের মধ্যেই কিন্তু সব ওলটপালট হয়ে গেল। একটি দুর্ঘটনায়। একটিমাত্র কন্যা সন্তানকে রেখে স্বর্গলাভ করলেন যোসেফ হালদারের সহধর্মিণী—মেরী জনসন। বাঙালির ছেলেকে বিবাহ করলেও তিনি তাঁর পদবিটা বদলাননি। যোসেফ দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করেন—এবার একটি বাঙালী মেয়েকে। তিনিও বেশিদিন বাঁচেননি। তবে যোসেফ হালদারকে ছেড়ে যাবার আগে তাঁর সংসারকে ভরভরন্ত করে গিয়েছিলেন—তিন কন্যা ও একটি পুত্রসন্তান

বড় মেয়ে পামেলার নামের সঙ্গে মিল রেখে যোসেফ মেয়েদের ভারতীয় নাম দিয়েছিলেন—সরলা, কমলা আর বিমলা। শেষ সন্তানের নাম আবার বিলাতি কেতার : সারমেয় গেণ্ডুকের কাঁটা রবার্ট। বিমাতা যখন বিদায় নিলেন ততদিনে পামেলা কিশোরী; ফলে যোসেফকে তৃতীয়বার দার-পরিগ্রহ করতে হয়নি। পামেলাই তাদের মায়ের স্থান অধিকার করেন।

তাঁরা সবাই একে একে বিদায় নিয়েছেন মরকতকুঞ্জ থেকে। শুয়ে আছেন পাশাপাশি গীর্জা প্রাঙ্গণে। পামেলা প্রতিটি মৃত্যুতিথিতে এসে কবরে সাজিয়ে দিয়ে যান ফুলের ‘ব্যুকে’। নিজস্ব মালিকে পাঠিয়ে সিমেটরির আগাছা নিড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন, মরশুমি ফলের ‘বেড’ বানিয়ে দেন। ঝক্‌ঝক্ তক্তক্ করে এলাকাটা

মরকতকুঞ্জের প্রকাণ্ড বাড়িটায় পরিচারক-বেষ্টিত একান্তবাসিনীর জীবনেই তিনি অভ্যস্ত হয়ে গেছিলেন। বৎসরান্তে ইস্টারের ছুটিতে—ঘটনাচক্রে সাতই এপ্রিল ওঁর জন্মদিন—সেটা ইস্টারের ছুটির কাছাকাছি পড়ে—আসে এই একান্তচারী বৃদ্ধার স্বজনেরা—ভাইঝি স্মৃতিটুকু, ভাইপো সুরেশ আর বোনঝি হেনা।

পামেলা মর্মে মর্মে জানেন তাদের এই বৎসরান্তিক ‘আদিখ্যেতার’ হেতুটা!

মুখে স্বীকার করেন না—সেটা তাঁর ধাতে নেই।

তিনি জানতেন, ওরা জানে—সাত বিঘে-বাগান-ওয়ালা এই প্রকাণ্ড প্রাসাদটার বর্তমান বাজারদর কত। আর জানতেন, ওরা জানে না, আন্দাজ করে, বুড়ির কোম্পানির কাগজের পরিমাণটা!

ওরা সবাই হালদার, কেউই ‘জনসন’ নয়। পামেলাই একমাত্র জনসন। বয়ঃপ্রাপ্তির পর বাপের অনুমতি নিয়ে এফিডেবিট করে নামটা পরিবর্তন করেছিলেন— পামেলা হালদার হয়েছিলেন ‘পামেলা জনসন’। মায়ের উপাধিটাই পছন্দ হয়েছিল তাঁর। তা হোক, তবু রক্তের সম্পর্ক অস্বীকার করবার মতো মানুষ ছিলেন না মিস্ পামেলা জনসন। ওঁর বাপের সলিসিটার ছিলেন ‘চক্রবর্তী, চ্যাটার্জী অ্যান্ড সন্স’। ‘অ্যান্ড সন্স’দের মধ্যে বর্তমানে যিনি সিনিয়ার পার্টনার সেই প্রবীর চক্রবর্তীকে ডেকে উইল করে ওঁর যাবতীয় সম্পত্তি ঐ তিনজনের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন। সে আজ বছর-পাঁচেক আগেকার কথা।

পামেলার স্বাভাবিক মৃত্যুতে কেউই বিস্মিত হয়নি। মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ছুটে এসেছিল ওরা–টুকু, সুরেশ, হেনা আর তার স্বামী। বুড়িকে সাড়ম্বরে শুইয়ে দেওয়া হল চার্চের প্রাঙ্গণে।

আর তার পরেই নাটকের চরম ক্লাইম্যাক্স! বোমাটা ফাটলো!

আত্মীয়-স্বজনকে একত্র করে পামেলার সলিসিটার প্রবীর চক্রবর্তী সদ্যস্বর্গগতার শেষ উইলখানি পড়ে শোনালেন।

বজ্রাহত হয়ে গেল সবাই।

মৃত্যুর মাত্র দশ দিন আগে মিস্ পামেলা জনসন তাঁর পূর্বকৃত উইলখানি নাকচ করে একটি নতুন উইল করে গেছেন। পাচিকা, পরিচারিকা, বাগানের মালিকে কিছু অর্থদান করে, স্থানীয় চার্চ ফান্ডে এবং পিতৃদেবের নামাঙ্কিত স্কুল ফান্ডে কিছু অর্থদান করে বাদবাকি স্থাবর-অস্থাবর যা কিছু—মায় এই মরকতকুঞ্জটি—তিনি নির্ব্যঢ় স্বত্বে দান করে গেছেন এক অজ্ঞাতকুলশীলাকে!!

শেষ উইলে তিনি তাঁর নিকটতম আত্মীয়দের কাউকে কপর্দকমাত্র দিয়ে যাননি।

এমনটা যে ঘটতে পারে তা ছিল সকলেরই দুঃস্বপ্নের অগোচর! সকলেরই আশা ছিল, বুড়ি মাটি নিলে সম্পত্তি তিন ভাগ হবে : টুকু, সুরেশ আর হেনা। পামেলার পাঁচ ভাইবোনের ঐ তিনটি শেষ খুদকুঁড়ো! আশ্চর্য! তিনি ওদের তিনজনকেই সম্পূর্ণ বঞ্চিত করলেন। কেন? মৃত্যুর মাত্র দশদিন আগে?

গোটা মে মাসটায় মেরীনগরে ঐ একটাই ছিল আলোচ্য বিষয় : কেন? কেন? কেন?

কেউ কোনও সম্ভাব্য হেতুর ইঙ্গিত দিতে পারেনি।

এ-কথা স্বীকার্য যে, বুড়ির সঙ্গে ওদের কারও নাড়ির টান ছিল না। বৎসরান্তে ওরা ইস্টারের ছুটিতে এসে জমায়েত হত মরকতকুঞ্জে। সাড়ম্বরে বুড়ির জন্মদিন পালন করত : ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু য়্যু!’ কিন্তু পামেলার মতো মেরীনগরের সবাই বুঝতে পারতো এই বৎসরান্তিক আনন্দোচ্ছ্বাসের অন্তর্নিহিত হেতুটা! ‘ল্যাকল্যাকানির কারণটা।

সে-কথা যেমন সত্য, তেমনি এটাই বা অস্বীকার করা যায় কী করে যে, পামেলা জনসন ছিলেন বিচক্ষণ জাতাভিমানী এবং স্বজনপোষক। তাঁর পূর্বকৃত উইলের কথা তিনি কোনওদিনই গোপন করেননি। বলেছেন ডাক্তার পিটার দত্তকে, ঊষা বিশ্বাসকে, নিজমুখে। তাহলে?

আর সবচেয়ে বড় বিস্ময়—যাকে তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি এককথায় দান করে গেলেন তাকে তিনি কতটুকু চিনতেন? মাত্র তিন বছর আগে সে বহাল হয়েছিল। নামটা গালভারী—’কম্পানিয়ান’ বা ‘সহচরী’। আসলে তো সে বেতনভুক পরিচারিকামাত্র! তিন কুলে তারও কেউ নেই। লেখাপড়া শেখেনি বিশেষ। দেখতে ভাল নয়, বিয়ে-থা হয়নি। পামেলার জীবনের শেষ তিন বছর সে ছিল তাঁর ‘সহচরী’।

রীতিমতো বোকা-সোকা, মোটা-সোটা, গাবলু-গুবলু চেহারা। লোকে বলে মাথায় শুধু চুলই নয়, ‘গ্রে-ম্যাটারও’ কম। তার পক্ষে গৃহস্বামিনীকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে এমন একটা উইল বানিয়ে নেওয়ার কথা যে ভাবাই যায় না।

উইলটা যখন পড়ে শোনানো হচ্ছিল তখন মিনতি মাইতিও উপস্থিত ছিল সেখানে। বোধ করি তার আশা ছিল গৃহস্বামিনী তাঁর সহচরীকেও দিয়ে গেছেন দু-পাঁচ হাজার টাকার কোম্পানীর কাগজ। যখন শুনলো সে নিজেই একমাত্র ওয়ারিশ, তখন সে বজ্ৰাহত হয়ে যায়। হাসবে না কাঁদবে স্থির করে ওঠার আগেই প্রবীর চক্রবর্তীমশাই উচ্চারণ করে বসলেন আর্থিক অঙ্কটা। হাসি-কান্নার রাজ্য পেরিয়ে মিনতি অজ্ঞান হয়ে গেল।

মিস পামেলা জনসনের অস্থাবর সম্পত্তির মূল্যমান সাড়ে সাত লক্ষ টাকা! এ যেন সেই রূপকথার গপ্পো! ঘুঁটেকুড়ুনির মেয়ে রাতারাতি হয়ে গেল রাজকন্যে!

গুড ফ্রাইডের আগের বুধবার সকাল। মিস্ পামেলা জনসন দাঁড়িয়েছিলেন মরকতকুঞ্জের পোর্টিকোর সামনে। যৌবনকালে নিশ্চয় তিনি খুব সুন্দরী ছিলেন। সোনালি চুল, ঘন নীল চোখ আর টকটকে রঙ।

এখনো এই বৃদ্ধবয়সেও তিনি সুন্দরী—সৌন্দর্যের পরিণত সংজ্ঞায়। এখনো তিনি সারমেয় গেণ্ডুকের কাঁটা সোজা হয়ে হাঁটেন। লাঠি ব্যবহার করেন না। মেদ নেই দেহের কোনও প্রত্যন্তদেশে। শুধু টকটকে রঙে একটা হলুদের আভাস। দীর্ঘদিন তিনি ভুগেছেন জনডিস রোগে। এখনও তেল-মশলা বা ভাজা খাবার তাঁর বরদাস্ত হয় না।

মিনতিকে দেখতে পেয়েই গৃহস্বামিনী বলেন, ঘরগুলো সব ঝাড়পোঁছ করা হয়েছে? পর্দা-টর্দা লাগানো হয়েছে ঠিকমতো?

প্রকাণ্ড প্রাসাদের অধিকাংশ ঘরই অব্যবহৃত পড়ে থাকে তালাবন্ধ হয়ে। বৎসরান্তিক এই অতিথি সমাগমের আগে তা ঝাড়পোঁছ করা হয়। সেসব কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়েছে জেনে নিয়ে পামেলা বলেন, কোন ঘরে কাকে থাকতে দিচ্ছ?

—ডক্টর ঠাকুর আর হেনাদিকে ‘ওক-রুমে’ স্মৃতিটুকুদিকে দক্ষিণ-পুবের ‘দোলনা-ঘরে’ আর সুরেশবাবুকে পশ্চিমের ঘরখানায়—

পামেলা কঠিন স্বরে প্রতিবাদ করেন, না। সুরেশ থাকবে ‘দোলনা-ঘরে’; আর টুকু ওই পশ্চিমের ঘরে-

মিনতি আমতা আমতা করে, ঠিক আছে, তাই হবে। আমি ভাবছিলুম দোলনা-ঘরটায় টুকুদির বেশি আরাম হবে, মানে……

—বেশি আরামের দরকার নেই তার!

পামেলার কালে পুরুষদের আরামে রাখার ব্যবস্থা হতো। ‘দোলনা-ঘর’-এ প্রাসাদের সব সেরা গেস্ট রুম। সুরেশ অবিশ্যি নিতান্তই বখে গেছে, তা হোক, পুরুষ-প্রাধান্যের চিন্তাটা ওঁর মজ্জায়-মজ্জায়। সব-সেরা ঘরখানা বংশের পুরুষেরাই ভোগ করবে, যতদিন তিনি জীবিতা।

মিনতি বলে, কী দুঃখের কথা, হেনার বাচ্চা দুটো আসছে না—

আরও কঠিন শোনালো গৃহস্বামিনীর কণ্ঠস্বর, চারজন অতিথিই যথেষ্ট। হেনা তো আদর দিয়ে বাচ্চা দুটোকে মাথায় তুলেছে। ওরা না আসায় বেঁচেছি।

মিনতি অবিবাহিতা, মাতৃস্নেহ তার অতৃপ্ত। সে বোধ করি মনে মনে মর্মাহত হলো। মুখে কিছু বলার সাহস হলো না। পামেলা বলেন, আমি একবার কাঁচড়াপাড়া যাবো। মোহনকে গাড়ি বার করতে বল। বাজারটা সেরে আসবো।

—কী দরকার মা? আমিই তো যেতে পারি। কী কী লাগবে লিস্ট করে দিন-

—তোমাকে দিয়ে যদি হতো তাহলে আমি যেতে চাইতাম না। যা বলছি করো। কই ফ্লিসি কোথায়? ফ্লি–সি!

পরমুহূর্তেই দ্বিতলের সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড়িয়ে নেমে এল একটি স্পিৎজ। ধবধবে সাদা। লোমে ভর্তি তার সারা দেহ। পামেলা ওর কলারে চেনটা গলিয়ে নিলেন। একটু পরেই মোহন একখানা প্রাচীন মডেলের হুড-খোলা মরিস মাইনর নিয়ে এসে হাজির। আউট-হাউসে দুটি কামরা। একটায় থাকে ড্রাইভার মোহন একাই। দ্বিতীয়টায় মালি ছেদিলাল। মোহনের পাশের ঘরখানায় থাকে সস্ত্রীক। ওর জেনানা সরযূবাঈ হচ্ছে ঝি। বাসন মাজা, কাপড় কাচা এবং যে কয়খানি ঘর নিত্য ব্যবহার হয় তা মোছার কাজ সরযূর। ওদের আদি নিবাস ছাপরা জিলা!

বাজারে দেখা হয়ে গেল ঊষা বিশ্বাসের সঙ্গে।

—গুডমর্নিং, পামেলা। নাইস টু মীট য়ু হিয়ার!

—মর্নিং ঊষা! কিসে এসেছো? রিকসায়? ফিরবে কিন্তু আমার সঙ্গে।

—থ্যাঙ্কস। অনেক বাজার করেছো দেখছি। ওরা আসছে তাহলে? কে-কে?

—সবাই। টুকু, সুরেশ, হেনা—

—হেনা তাহলে কলকাতায় এসেছে? তার কর্তাটিও আসছে তো?

–হ্যাঁ।

—বাচ্চা দুটো?

—না।

ঊষা বিশ্বাস পামেলার বাল্যবান্ধবী। প্রায় ষাট বছরের সম্পর্ক। বেঁটেখাটো মানুষ। কথা বলতে ভালবাসেন, কিন্তু ইদানীং কথা বলার মানুষ পান না।

দুজনেই জানেন দু’জনের জীবনের ইতিহাস। ঊষা বিশ্বাস চিরকুমারী। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। পামেলার মতই। ছিলেন স্কুলের শিক্ষয়িত্রী। এখন অবসর নিয়ে পেনশন-নির্ভর। মেরীনগরের বাসিন্দা। জিজ্ঞাসা করেন, হেনারা কোথায় থাকে যেন? পাটনায়?

—না। মজঃফরপুরে। প্রীতমের সেখানে প্র্যাকটিস্ জমছে না, কলকাতায় এসে নতুন করে শুরু করবে বলছে।

—মজঃফরপুরের মতো জায়গায় যার প্র্যাটিস্ জমলো না, সে কি কলকাতার এই কম্পিটিশনে…..

তাঁকে মাঝ-পথে থামিয়ে দিয়ে পামলা বলেন, সে চিন্তা তাদের। ওরা প্রাপ্তবয়স্ক

—তা তো বটেই।—ঊষা বিশ্বাস গুটিয়ে নেন নিজেকে। তিনি জানতেন, হেনা যে একটি সর্দারজীকে বিয়ে করে বসেছে এটা পামেলা ভাল চোখে দেখেননি। প্রসঙ্গটা বদলে নিতে ঊষা বলেন, টুকুর সঙ্গে ঐ ডাক্তার নির্মল দত্তগুপ্তের এনগেজমেন্টটা কি পাকা খবর?

—হ্যাঁ, পাকা বইকি। তবে বিয়েটা পাকতে বেশ দেরি হবে মনে হয়। নির্মলের অবস্থাও অদ্যভক্ষ্যধনুর্গুণ! প্রীতমের মতো।

ঊষা প্রতিবাদ করেন, কেন? টুকুর তো আর্থিক সঙ্গতি যথেষ্ট।

পামেলা আড়চোখে বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে বলেন, য়ু থিংক সো?

হেসে ফেলেন ঊষা বিশ্বাস। তিনি জানতেন ভিতরের ব্যাপারটা। পামেলার ছোট ভাই ববের, মানে রবার্টের মৃত্যুর পর স্মৃতিটুকু আর সুরেশ বেশ কিছু নগদ টাকার উত্তরাধিকারী হয়েছিল। সে আজ দশ বছর আগে। এই দশ বছরে ভাই বোন দুজনেই তা উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে। সুরেশের অংশটা গেছে ঘোড়ার খুরে খুরে ধুলো হয়ে, আর স্মৃতিটুকুর মাত্রাতিরিক্ত বিলাসিতায়। পামেলা বলেন, টুকুর পাশ বইয়ে কত ‘রেস্ত’ আছে জানি না— কিন্তু সেইটের ভরসায় কি নির্মল বিয়ে করতে পারে এখনই?

ঊষা বলেন, আজকালকার ছেলেরা স্ত্রী-ধনে ভাগ বসাতে সঙ্কোচ বোধ করে না।

তা হবে! ফেরার পথে ঊষা বিশ্বাস সবিস্তারে আজকালকার ছেলেমেয়েদের মুণ্ডপাত করতে থাকেন।

আজকালকার ছেলেমেয়েরা! কথাটা ওঁর মস্তিষ্কের একটা অংশ কুরে কুরে খেতে সারমেয় গেণ্ডুকের কাঁটা থাকে। বাড়ি ফিরে এসেও চিন্তাটা গেল না। ঊষা বিশ্বাসের ঐ কথাটা। জেনারেশন- গ্যাপ! একালের ছেলেমেয়েদের সত্যিই বোঝা মুশকিল!

টুকুর কথাই ধর। পামেলার হাতের বাইরে সে। মরকতকুঞ্জে থাকতে সে রাজি হয়নি। বব্ অনেক আগেই মরকতকুঞ্জ ত্যাগ করে চলে যায়। সে ছিল সাউথ ইস্টার্ন রেলওয়ের গার্ড। থাকতো খড়গপুরে। বর্ এ সংসার যখন ত্যাগ করে যায় তখনো পামেলার তিন বোন বেঁচে। যোসেফ অবশ্য আগেই মাটি নিয়েছেন। বব্ মরকতকুঞ্জের অংশ আর্থিক মূল্যে গ্রহণ করেছিল বোনেদের কাছ থেকে। কারণ তার বিবাহটা এঁরা কেউই মেনে নিতে পারেননি। সে বিধবা-বিবাহ করেছিল বলে নয়, বিধবাটিকেই বরদাস্ত করতে পারেননি ওঁরা। টুকু আর সুরেশের মা হয়ে পড়েছিলেন ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার চার্জের আসামী। প্রথম স্বামীকে নাকি বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছিলেন—এই ছিল তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ। আজব কাণ্ড! রবার্ট, মানে বব্ তার হদিশ পায় খবরের কাগজে! কাগজের কাটিং-এ তার ছবি দেখে নাকি মোহিত হয়ে যায়! দীর্ঘদিন দর্শকের আসনে বসে সে ঐ সুন্দরী মেয়েটিকে দেখেছিল কাঠগড়ার আসামীরূপে। বিচারে সে বেকসুর খালাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বব্ তাকে বিবাহ প্রস্তাব দেয়। মেয়েটি রাজি হয়েছিল, কিন্তু রাজি হতে পারেননি পামেলা, সরলা, কমলার দল!

বব্ আলাদা সংসার পাতে।

প্রথম স্বামীকে বিষ প্রয়োগ করেছিল কিনা যীসাস জানেন, দ্বিতীয় স্বামীকে করেনি। ববের আগেই সে মারা যায় দুটি সন্তান রেখে—সুরেশ আর স্মৃতিটুকু। ববের মৃত্যুর পর পামেলা চেয়েছিলেন ওরা দুজনে মরকতকুঞ্জে এসে থাকুক। দুজনের কেউই রাজি হয়নি। তাদের হাতে তখন কাঁচা টাকা। ঐ জঙ্গলে এসে পড়ে থাকতে তাদের বয়েই গেছে!

স্মৃতিটুকু হয়ে উঠল গ্ল্যামার-গার্ল। সুরেশ কাপ্তেনবাবু!

হেনার ইতিহাসটা অবশ্য বেদনাদায়ক। বিমলা হালদারের একমাত্র সন্তান। সরলা যৌবনে পদার্পণের আগেই মারা গিয়েছিলেন, কমলা মারা যান বত্রিশ বছর বয়সে—অবিবাহিতা ছিলেন তখনও। কিন্তু ছোট বোন বিমলা বিবাহ করেছিলেন একজন রসায়নের অধ্যাপককে। ওঁরা থাকতেন পাটনায়। হেনা সুন্দরী নয়, লেখাপড়াতে মাঝামাঝি। বাপের ইচ্ছায় রসায়নে অনার্স নিতে হয়েছিল। বেচারি গ্র্যাজুয়েট হতে পারেনি—পর পর দু’বছর পরীক্ষা দিয়েও। অথচ পাস-কোর্সে নিশ্চয় সে উৎরে যেতো!

পামেলার কেমন যেন মনে হয়—হেনা প্রীতমকে ভালবেসে বিয়ে করেনি। করেছে কিছুটা বাধ্য হয়ে। যৌবনের দিনগুলি থুবড়ি থাকার পর তার অবস্থা তখন ‘এনি পোর্ট ইন দ্য স্টর্ম’! বাপ-মা-হারা মেয়েটা কিছুতেই মরকতকুঞ্জে এসে থাকতে রাজি হয়নি। পাটনাতেই একটি মেয়েদের স্কুলে শিক্ষয়িত্রীর কাজ নেয়। পাটনা মেডিকেল কলেজের ছাত্র প্রীতমের সঙ্গে হেনার কীভাবে আলাপ হয় সেটা পামেলা জানেন না; কিন্তু পরিচয় ক্রমে পরিণত হয় প্রণয়ে, পরিণাম পরিণয়ে।

ইদানীং পামেলার কী জানি কেন মনে হয়েছে—হেনা প্রীতমকে ভালবাসে না। ভয় করে।

অথচ ঘটনাটা উল্টো খাতে বইবার কথা। কারণ বিমলার মৃত্যুর পর হেনা যে স্ত্রী-ধন পায় সেটা ও যথেষ্ট। আর তা শেয়ার বাজারের দুঃসাহসিক ফাটকা বাজিতে উড়িয়ে দিয়েছে ঐ পাঞ্জাবী ছেলেটি : ডাক্তার প্রীতম সিং ঠাকুর। পদবিটা রাজপুতের, আসলে সে খালসা শিখ।

গির্জা প্রাঙ্গণের ঋজু শিশু গাছটার মতো স্থির-স্থবির পামেলা জনসন দেখে গেছেন দুনিয়াদারীর এই বিচিত্র উত্থানপতন। মরকতকুঞ্জের দ্বার ওদের জন্য বরাবরই অবারিত ছিল। কেউ ফিরে আসেনি–প্রডিগাল সানস্ অ্যান্ড ডটার্স। অথচ তিনি নিজের, সরলার এবং কমলার অংশগুলি সুবিনিয়োগ ব্যবস্থায় ক্রমাগত বর্ধিত করে গেছেন। এই যখের ধন তিনি কাকে দিয়ে যাবেন?

—মাঝে মাঝে সিমেটরিতে যান। পাশাপাশি শুয়ে আছেন যোসেফ হালদার, মেরী জনসন, সরলা আর কমলা। তাঁদের সঙ্গেই পরামর্শ করেন। ওঁদের কথা শুনতে পান তিনি। ওঁদের আশ্বস্ত করেন : আই নো! আই নো! ব্লাড ইজ থিকার দ্যান ওয়াটার! ওরা আমাদের পথে—তোমাদের পথে চলে না–জেনারেশন গ্যাপ—তা হোক! হক্কের ধন আমি ওদেরই দিয়ে যাব! তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো! তবে হ্যাঁ, হেনার অংশটা যাতে তার সেই দাড়িওয়ালা, পগ্‌গ-সাঁটা বিদেশী লোকটা না আবার উড়িয়ে-পুড়িয়ে দেয়, এ ব্যবস্থা করতে হবে। একবার জিজ্ঞাসা করতে হবে প্রবীর চক্রবর্তীকে।

পাঁচই এপ্রিল সকাল

সুরেশ আর স্মৃতিটুকু হালদার এল গাড়িতে—কলকাতা থেকে টানা ট্যাক্সিতে। হেনা আর তার স্বামীও এল ট্যাক্সিতে, তবে কাঁচড়াপাড়া স্টেশন থেকে। সুরেশ আর টুকুরাই এল প্রথমে। সুরেশ ছয় ফুটের মত লম্বা, পেশীবহুল সুঠাম দেহ। সুশ্রী, সুন্দর। দেড় কুড়ি বছর যে পাড়ি দিয়েছে তা দেখলে বোঝা যায় না। ট্যাক্সি থেকে নেমে তিন লাফে উঠে এল বারান্দায় : হ্যালো, আন্টি! হাউজ দ্য গোর্ল! য়ু লুক ফাইন!

তার পিছনে ট্যাক্সিভাড়া মিটিয়ে এসে গেল টুকু। বয়সে সুরেশের চেয়ে মাত্র দেড় বছরের ছোট। পামেলার মনে হল নিখুঁত মেক-অপের নিচে স্মৃতিটুকুর মুখখানায় একটা বিষণ্ণতার ছায়া। তার চোখের কোলে যেন কালিমার আলিম্পন-রেখা!

ড্রইংরুমে ওরা এসে জমিয়ে বসল। আধ ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এসে গেল ঠাকুর দম্পতি। হেনা বয়সে টুকুর চেয়ে এক বছরের ছোট; কিন্তু দেখলে তাকেই দিদি বলে মনে হয়। একটু মোটাসোটা ঢিলে-ঢালা; কিন্তু উগ্রসাজের ঘটা। বাস্তবে সে টুকুর পোশাক ও প্রসাধন অবিকল নকল করতে চায়, বোঝে না— দীর্ঘাঙ্গী, তন্বী, মধ্যক্ষামা, নিম্ননাভির পক্ষে যে পরিচ্ছদ বা প্রসাধন সৌন্দর্যবর্ধক, শ্রোণীভারাদলসগমনা স্থূলাঙ্গীর কাছে সেটা পরিহাস! প্রীতম ঠাকুর তার দীর্ঘ শ্মশ্রু এবং দীর্ঘতর উষ্ণীষ সত্ত্বেও সুপুরষ, সুগৌর, চিত্তাকর্ষক।

সারমেয় গেণ্ডুকের কাঁটা ইতিমধ্যে মিনতি আর বামুনদি টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে গেছে ব্রেকফাস্ট, ‘কফি-কোজি’ দিয়ে ঢাকা কফি আর চায়ের পট। মিনতি রীতিমতো ব্যস্ত, বারেবারেই এটা ধরে নাড়ছে, সেটা ধরে টানছে—কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। শেষমেশ ফুলে ভর্তি ফুলদানি দুটো সে টেবিলের তলায় পাচার করতেই চাইছিল। পামেলার ধমক খেয়ে আবার সে দুটো তুলে আনলো টেবিলে। সুরেশ দু’একবার মহিলাটিকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল—বেশ বোঝা গেল, সেটা আবার মিনতির পছন্দ নয়। ধন্যবাদ দিল না সে।

চা-পানান্তে সবাই নেমে এলেন বাগানে। সুরেশ তখন জনান্তিকে টুকুকে বললে, মিনতি আমাকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না! লক্ষ করেছ?

স্মৃতিটুকু হাস্য গোপন করে বলে, দুনিয়ায় তাহলে অন্তত একটি কুমারী আছে যাকে তুই সম্মোহিত করতে পারিসনি, সুরেশ!

সুরেশকে কোনওদিনই টুকু ‘দাদা’ ডাকে না। তুই-তোকারি করে।

সুরেশ অফেন্স নিল না। সহাস্যেই ফিরিয়ে দিল জবাব, আমার সৌভাগ্য, দুনিয়ার সেই একমেবাদ্বিতীয়মটি শ্রীমতী মিনতি মাইতি!

বাগানে মিনতি মাইতি হেনাকে গাছ-গাছড়া চিনিয়ে দিচ্ছিল।

একটু পরেই এসে উপস্থিত হলো ডাক্তার নির্মল দত্তগুপ্ত। কাঁচড়াপাড়া থেকে সাইকেলে চেপে এসেছে। সেখানে সে ডক্টর পিটার দত্তের ক্লিনিকে কাজ করে। তাকে দেখে স্মৃতিটুকু এগিয়ে এলো। নির্মল পামেলার স্বাস্থ্য সম্পর্কে দু-একটা প্রশ্ন করলো সৌজন্যবশত। তারপর টুকুর হাত ধরে বাগানের নির্জন একটা অংশে মিলিয়ে গেল।

পামেলা বেশিক্ষণ বাগানে থাকলেন না। ফিরে এসে ড্রইংরুমে ঢুকতেই তাঁর নজরে পড়ল সুরেশ ফ্লিসির সঙ্গে খেলায় মেতেছে। ফ্লিসি দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির মাথায়, মুখে বল, আর সুরেশ একতলায়।

—কাম অন, ওল্ড ম্যান!

ফ্লিসির ধবধবে লেজটি তুরতুর করে নড়ছে। অতি সন্তর্পণে রবারের বলটা সে নামিয়ে রাখলো সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ। তারপর নাক দিয়ে একটু ঠেলা দিতেই—ধ-ধ-ধপ্। বলটা নিচে এসে পৌঁছতেই সুরেশ সেটা তুলে নিয়ে ছুঁড়লো ওপর দিকে। ফ্লিসি নির্ভুল টিপে লুফে নিল বলটাকে। আবার সযত্নে নামিয়ে রাখলো সিঁড়ির মাথায়।

এই খেলা ফ্লিসির দারুণ প্রিয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চালিয়ে যেতে পারে।

পিসিকে ফিরে আসতে দেখে সুরেশ খেলায় ক্ষান্ত দিল। ফ্লিসি মৰ্মাহত।

পামেলা একটা ইজিচেয়ারে বসলেন। সুরেশও ঘনিয়ে এল। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল—দূরে গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে টুকু আর নির্মল বাগানে পায়চারি করছে। হাত ধরাধরি করে। পামেলা সেদিকেই তাকিয়েছিলেন। সুরেশ বললে, ওরা দুজন যেন দুই ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা। অথচ ..

পামেলা একটু অপেক্ষা করলেন। দেখলেন, সুরেশ বাক্যটা অসমাপ্তই রাখলো।…বললেন, তোর কী মনে হয়? টুকু কি সত্যিই সিরিয়াস?

—প্রেমের দুনিয়াটা বড় আজব, বড়পিসি–চৌম্বকশক্তির মতো। এর আর কোনও ব্যাখ্যা নেই। ঋণাত্মক আর ধনাত্মক শক্তির পারস্পরিক আকর্ষণ : নির্মল নিতান্ত মধ্যবিত্ত ঘরের মেধাবী ছেলে, আর টুকু ধনীর দুলালী। বেহিসাবী খরচের ওস্তাদ! বিয়ে করলে ওরা সংসার চালাবে কী করে?

পামেলা গম্ভীর হয়ে বললেন, টুকুর সামনে দুটোই অবারিতদ্বার। নির্মলকে বিয়ে করে মিতব্যয়ী হওয়া, অথবা নির্মলকে ত্যাগ করে ববের দেওয়া শেষ ক’খানা কোম্পানির কাগজ উড়িয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া-

একগাল হাসলো সুরেশ। বললে, তোমার বুঝি ধারণা শেষ ক’খানা কাগজ ফুলঝুরি হয়ে ফুল কেটে শেষ হয়ে যায়নি আজও।

—সেটা টুকুর জানার কথা

রাত্রে ডিনার টেবিলে সবাই এসে বসেছেন। ওঁরা কজন তো বটেই, মায় ডাক্তার নির্মল দত্তগুপ্তও। তাঁকেও নৈশাহার সেরে যেতে বলেছিলেন পামেলা। নির্মল মেসে থাকে। সে রাজি হয়ে যায়। সকলে গুছিয়ে বসলো। একমাত্র সুরেশই অনুপস্থিত। মিনতি তাকে ডেকে আনতে যাচ্ছিলো; ঠিক তখনই ভিতর থেকে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকলো সুরেশ। বললে, সরি, আন্টি, আমার বোধহয় একটু দেরি হয়ে গেছে। তোমার কুকুরটা আমাকে জানে মেরে দিয়েছিল আর একটু হলে—সিঁড়ির মাথায় তার বলটায় পা পড়ে একেবারে উল্টে যাচ্ছিলাম।

পামেলা বললেন, জানি! ভারি বিপজ্জনক খেলা। মিন্টি, বলটা খুঁজে বার কর। ড্রয়ারে সরিয়ে রাখ।

মিনতি মাইতি দ্রুতপদে নিষ্ক্রান্ত হলো আদেশ তামিল করতে।

সায়মাশের আসরটা প্রীতম একাই জমিয়ে রাখল নানারকম ‘জোকস্’ শুনিয়ে। তার অধিকাংশই যে গোষ্ঠীকে নিয়ে তাতে সে নিজেও সামিল। প্রতিবাদ করলেন পামেলা, জানি না কে বা কারা এসব গল্প সৃষ্টি করে। আমি তো মনে করি, শিখ হিসাবে তোমার গর্বিত হওয়া উচিত। ভারতের লোকসংখ্যার অনুপাতে প্রতি একশ জন ভারতীয়দের মধ্যে মাত্র একজন শিখ, কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়; ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে শিখ। যে কোনও অলিম্পিক্সে ভারতীয় দলের আধাআধি ছিল শিখ। এভারস্টের চূড়ায় এ পর্যন্ত যে চারজন ভারতীয় উঠতে পেরেছে তার তিনজন হচ্ছে শিখ।

প্রীতম স্তম্ভিত হয়ে গেল বৃদ্ধার -এ কথায়। চেয়ার ছেড়ে উঠে, সসম্ভ্রমে মাথা ঝুঁকিয়ে বললে, জোকস্ আর জোকস্ মাদাম! কিন্তু আপনি আজ আমাকে যে কথা বললেন, তা আমি সারা জীবনে ভুলবো না।

সুরেশের স্বভাবের একটা প্রবণতা হচ্ছে লেগ-পুলিং। ঠ্যাং টানার সুযোগ পেলে সে তাকিয়ে দেখে না, কার ঠ্যাঙ ধরে টানছে। ফস্ করে বলে বসে, বড়পিসি দেখছি প্রীতমকে কম্‌প্লিমেন্টস দেবে বলে তৈরি হয়ে আছো! বুক-অব-রেকর্ডস্ দেখে মুখস্থ করে রেখেছো সব কিছু।

পামেলার মুখমন্ডল রক্তবরন হয়ে উঠলো। তবে ভিক্টোরিয়ান যুগের শালীনতাবোধ তাঁর মজ্জায়-মজ্জায়। সংযত হলেন নিমেষেই। হাসতে হাসতেই বললেন, তোর মতো শুধু এক জাতের বইই তো আমি পড়ি না। ‘বুক’ বলতে তুই তো শুধু বুঝিস অশ্বমেধ যজ্ঞের বংশতালিকা।

সুরেশের মুখখানা কালো হয়ে গেল!

বুঝলো, সাপের লেজে পা দেওয়াটা তার বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হয়নি!

নৈশাহারের পর যে যার ঘরে চলে গেলেন।

রাত দশটা নাগাদ গৃহকর্ত্রীর দ্বারের সামনে শোনা গেল, বড় পিসি, ভিতরে আসবো?

পামেলা দৈনিক হিসাব লেখেন। এইটা তাঁর দৈনন্দিন কর্মসূচীর পেন-আলটিমেট কাজ। শেষ দৈনন্দিন কাজটি হচ্ছে শয্যার শীর্ষদেশে কুলুঙ্গিতে রাখা মা-মেরীর মূর্তির সামনে দিবসান্তের প্রার্থনা। হিসাবের খাতাটা সরিয়ে রেখে বললেন, আয়।

পর্দা সরিয়ে সসঙ্কোচে প্রবেশ করলো সুরেশ। রঙের টেক্কাটা নামিয়ে দিল প্রথমেই : বড়পিসি, আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি। তোমাকে নিয়ে রসিকতা করা আমার উচিত হয়নি। পামেলা মিষ্টি হেসে বললেন, আমারও ওভাবে আঘাত করাটা উচিত হয়নি রে। যাক্ দু’পক্ষেরই যখন অনুশোচনা জেগেছে তখন সব শোধবোধ হয়ে গেছে। বোস, দাঁড়িয়ে রইলি কেন?

—না পিসি। তোমার শুতে যাবার সময় হয়েছে। বসবো না আর। কথাটা না বলে গেলে আমার ঘুম আসতো না। সারারাত মন খুঁতখুঁত করতো।

পামেলার কী যেন বাল্য স্মৃতি মনে পড়ে গেল। বললেন, ঠিক বাপের মতো।

—বাপের মতো! মানে?

—বর্-এর সঙ্গে ঝগড়া হলে সেও রাগ পুষে রাখতে পারতো না।

পামেলার মুখের উপর একটা স্বর্গীয় জ্যোতি ফুটে উঠলো যেন। সুরেশ এ সুযোগ ছাড়লো না। এই খণ্ড-মুহূর্তটির সুযোগ। বললে, তাহলে একটা কথা বলবো বড়পিসি?

—বল না? অমন আমতা-আমতা করছিস কেন?

—ইয়ে হয়েছে… আমি, মানে…আয়াম ইন দ্য ডেভিল অব্ আ হোল। তুমি আমাকে কিছু সাহায্য করতে পারো? বেশি নয়, এই ধরো…হাজার দুই….

পামেলার বলিরেখাঙ্কিত মুখখানা থেকে স্বর্গীয় জ্যোতিটা মিলিয়ে গেল। যেমনভাবে মিলিয়ে যায় ধূপের ধোঁয়া। না, উপমাটা ঠিক হলো না। ধূপের ধোঁয়া মিলিয়ে যাবার পরেও বাতাসে ভাসতে থাকে সৌরভের একটা রেশ। এক্ষেত্রে তা হলো না। নস্টালজিক অন্তরনুরাগে পামেলার স্নেহমমতাবঞ্চিত অন্তরে যে অগুরুচন্দনের সৌগন্ধ্য ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল তা যেন দপ করে শেষ হয়ে গেল। নিবাতনিষ্কম্প দীপশিখার মতো ঋজু ভঙ্গিমায় তিনি সোজা হয়ে বসেই রইলেন। সুরেশ ভাবান্তরটা লক্ষ করলো। বুঝলো, চিঁড়ে ভিজবে না, ভেজেনি। মিনিটখানেক অপেক্ষা করে কোনওক্রমে বললে, কই, কিছু তো বললে না, বড়পিসি?

একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়লো পামেলার। বললেন, রাত হয়েছে সুরেশ। শুতে যাও।

তবু স্থান ত্যাগ করতে পারলো না সুরেশ। টাকা ক’টার সত্যিই ওর জরুরি দরকার। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। বললো, যাচ্ছি। কিন্তু তার আগে কয়েকটা কথা বলে যাওয়া দরকার, বড়পিসি। শুধু আমার স্বার্থে নয়, তোমার স্বার্থেও।

পামেলা ওর চোখের দিকে তাকালেন না। বললেন, বলো?—’বল্’ নয়, বলো।

—কথাটা অপ্রিয়। তবু এটা তোমাকে জানিয়ে দেওয়াই মঙ্গল…

পামেলার কোনও ভাবান্তর হলো না। না কৌতূহল, না অনাসক্তি।

—তোমার বয়স হয়েছে, তোমার শরীর দুর্বল। একা-একা থাকো। তুমি জানো, আমরাও জানি, তোমার অবর্তমানে আমরাই সব কিছু পাবো। আমরা তিনজন। তুমি এ-কথাও জানো যে, আমাদের তিন জনের অবস্থাই খুব সসেমিরা। ছ-মাস বা এক বছর পরে যে আশীর্বাদ তুমি আমাদের দেবে, তা থেকে এখনই…

পামেলা একই সুরে বললেন, হয় বাক্যটা শেষ করো, নয় শুতে যাও সুরেশ।

এখনো তিনি সুরেশের দিকে তাকাননি। তাঁর দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে শয্যার মাথার দিকের একটি কুলুঙ্গিতে। সুরেশ আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। বললে, বুঝছো না কেন বড়পিসি? মরিয়া হয়ে গেলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। শেষে তোমার একটা ‘ভালমন্দ’ কিছু না হয়ে যায়। লোভে পাপ, পাপে…

পামেলা এবার ভাইপোর দিকে ফিরলেন। চোখে-চোখ রেখে। বোধ করি এবার সুরেশ তার বাক্যটা যে অসমাপ্ত রাখেনি তা প্রণিধান করলেন বলেই। অতি পরিচিত প্রবাদবাক্যটি সমাপ্ত হবার অপেক্ষা রাখে না। পামেলা বলেন, তোমার সৎ পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ, সুরেশ। ঠিক কথা, আমার বয়স হয়েছে, আমার শরীর দুর্বল! কিন্তু আমি সেকালের মানুষ। নিজেকে রক্ষা করতে জানি। এবার যাও তুমি, গুড নাইট।

সুরেশ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন বৃদ্ধা। তাঁর চোখ-দুটো জ্বলে উঠলো। নিঃশব্দে তিনি দক্ষিণ হস্তটা প্রসারিত করে দিলেন। তর্জনী নির্দেশ করছে খোলা দরজাটা।

সুরেশ তার বড়পিসিকে চেনে। নিঃশব্দেই বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

পরদিন এপ্রিলের ছয় তারিখ সকালে সুরেশ যখন দ্বিতলে উঠে এসে টুকুর ঘরে টোকা দিল তার আগেই স্মৃতিটুকুর ঘুম ভেঙেছে, কিন্তু তখনও সে শয্যাত্যাগ করেনি। টুকুর ‘কাম ইন’ শুনে সুরেশ ঘরে ঢুকল, বসল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে।

টুকুর পরনে একটা নীলরঙের ঢিলে-ঢালা সিল্কের নাইটি। শুয়েই ছিল। চাদরটা গলা পর্যন্ত টেনে নিয়ে বললে, কী ব্যাপার? সাত সকালে?

–তোকে একটা কথা বলতে এলাম। কাল রাত্রেই এক দফা হয়ে গেল। চিঁড়ে ভিজলো না। বড়পিসি সোজা আমাকে দরজা দেখিয়ে দিল।

—তুই বড় তাড়াহুড়া করিস সব কিছুতে।

—আমার উপায় ছিল না রে। ভেবেছিলাম, তোদের ওপর টেক্কা দেব। তুই বা হেনা মুখ খোলার আগেই। কেমন যেন মনে হল, প্রথম আবেদনটা বুড়ি শুনবে, তারপর ও সতর্ক হয়ে যাবে। কিন্তু বড়পিসি তৈরি হয়েই ছিল। ও জানে, কেন বছর বছর আমাদের দরদ উথলে ওঠে।

টুকু খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।

—তুই হাসছিস যে, হেসে নে। তোকে যখন দরজা দেখিয়ে দেবে তখন হাসির পালা আসবে আমার। বুড়ি টাকার পাহাড় জমিয়েছে এর মধ্যে। পাঁচ-সাত লাখ হবেই। অথচ কী কঞ্জুস! মান্ধাতার আমলের মরিস মাইনর গাড়িখানা বেচে একটা ভাল গাড়িও কিনবে না।

টুকু বললে, ওরা বোঝে না রে সুরেশ। জীবনকে উপভোগ করতে ওরা জানে না। জানে না—একটাই জীবন, একটাই যৌবন! যে দিনটা গেল তা আর ফিরে আসবে না। পিসি যেন আশা করে বসে আছে, টাকার পুঁটলিটা নিয়েই ও স্বর্গের পথে হাঁটা ধরবে।

—বুড়ির ভয়ডরও নেই রে। আমি কাল রাতে ওকে রীতিমতো শাসিয়েছিলাম….

—শাসিয়েছিলিস্! মানে? বড়পিসিকে? কী বলে?

—বলেছিলাম, “তুমি দুর্বল মানুষ, একা-একা থাকো। তোমার কোনও একটা ‘ভালমন্দ’ হয়ে গেলে…”

—ডাকাতি? তুই কি ভেবেছিস বড়পিসি তার টাকাকড়ি এখানে নগদে রেখেছে?

-–না, তা নয়। আমি বলেছিলাম, “যারা তোমার ওয়ারিশ তাদের সকলেরই অবস্থা সঙ্গীন। মানুষ মরিয়া হয়ে গেলে খুব বিপজ্জনক। তার চেয়ে আমাদের তিনজনকেই দু-দশ হাজার এখনি যদি দিয়ে দাও…”

টুকু উঠে বসে খাটের ওপর। বলে, মাই গড! এই কথা তুই বলতে পারলি বড়পিসিকে?

—কথাটা তো মিথ্যে নয়, টুকু!

টুকু আবার শুয়ে পড়ে। সুরেশ উঠে দাঁড়ায়। বলে, চলি, তৈরি হয়ে নে। আমার তো হল না, তুই দ্যাখ চেষ্টা করে। উইশ য়ু অল সাক্‌সেস!

টুকু বললে, আমি অন্য দিক দিয়ে চেষ্টা করব। আমাকে বড়পিসি এক কানাকড়িও ঠেকাবে না, মানে বেঁচে থাকতে; কিন্তু নির্মলকে বুড়ি সাহায্য করলেও করতে পারে। নির্মল কী একটা আবিষ্কার প্রায় করে ফেলেছে। হাজার বিশেক টাকা হলেই ও সেই আবিষ্কারটা শেষ করতে পারে। পেটেন্ট নিতে পারে। বড়পিসি সেকেলে মানুষ—জীবনকে উপভোগ করতে জানে না, কিন্তু বৈজ্ঞানিককে সাহায্য করা ওদের পক্ষে সম্ভব।

সুরেশ বলে, হেনার কোনও আশা নেই, কী বলিস?

—আমার তো বিশ্বাস হয় না। তাছাড়া হেনা টাকা নিয়ে কী করবে। ও জানে না জীবনকে উপভোগ করতে। ও শুধু আমাকে নকল করে যায়-আমার পোশাক-পরিচ্ছদ ও সিকি দামে কিনে অনুকরণ করতে চায় শুধু।

সুরেশ বোনের কাছে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে এল।

ফ্লিসি বসেছিল সিঁড়ির নিচে। সুরেশকে নেমে আসতে দেখেই ডেকে উঠল, ঘৌ!

—কী ব্যাপার? তোমার আবার কী চাই?

ফ্লিসি তৎক্ষণাৎ চলে গেল হলঘরের ও প্রান্তে। সেখানে একটা চেস্ট-অব-ড্রয়ার্স। তার সামনে উবু হয়ে বসল। সুরেশ বুঝতে পারে—ঐ টেবিলের টানা-ড্রয়ারের ভিতর রাখা আছে রবারের বলটা। ফ্লিসি খেলতে চায়। সুরেশ এগিয়ে এসে উপরের ড্রয়ারটা টেনে খুললো।

চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে উঠলো তার। উপরের ড্রয়ারে থাক দেওয়া একটা একশ টাকার নোটের বান্ডিল।

সুরেশ চারদিকে তাকিয়ে দেখলো। না, কেউ নেই কাছে পিঠে। কেউ ওকে নজর করছে না। নোটেল বান্ডিলটার পাশে পড়ে আছে ফ্লিসির রবারের বলটা। সুরেশ বলটাকে তুলে নিল। নিপুণ আঙুলে ঐ সঙ্গে তুলে নিল এক কেতা নোট। খান চার-পাঁচ। বান্ডিলের একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ। কারও খেয়াল হবে না এত কম নিলে। নোটগুলো পকেটে রেখে বলটা ছুঁড়ে দিল ফ্লিসির দিকে। বেরিয়ে এল বাগানে।

সূর্যোদয় হয়েছে একটু আগে। তেরচা হয়ে শেষ বসন্তের রোদ এসে পড়েছে গাছ-গাছালিতে। প্রভাত পাখির কলরব এখনো থামেনি। বাতাসে কী যেন একটা মিষ্টি ফুলের গন্ধ। সামনের লনে দু’খানি বেতের চেয়ারে বসেছিলেন পামেলা আর ডক্টর ঠাকুর। ওদের কথোপকথন কানে আসছে। প্রীতম বলছিল, না না, ওটা আপনি ভুল শুনেছেন। মজঃফরপুরে প্র্যাকটিস গুটিয়ে নিয়ে কলকাতায় এসে বসবার কোনও পরিকল্পনা নেই আমার। আমি শুধু মীনাকে কলকাতার কোনও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে দেবার কথা ভাবছি। ভাল হস্টেলে রেখে পড়াতে।

পামেলা বললেন, ভাল স্কুলে অ্যাডমিশন পাওয়া খুবই কঠিন। তাছাড়া হস্টেল….

—তা তো বটেই। তবে ঘটনাচক্রে একটা চান্স পাওয়া গেছে। আমার এক রিস্তাদার একটি ভাল গার্লস স্কুলের গভর্নিং বডিতে আছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর ইনফ্লুয়েন্সে মীনাকে ভর্তি করে নিতে পারবেন। হস্টেলেও সিট আছে—

—তাহলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল। তাই কর তোমরা। আমার এখানে তো ভাল স্কুল… প্রীতম ওঁর বাক্যটা শেষ করতে দিল না। বললে, মুশকিল কি বাৎ হচ্ছে এই যে, আমার রিস্তাদার বলেছেন, এজন্য একটা হেভি ডোনেশন দিতে হবে। আই মিন …

সুরেশ এগিয়ে এলো। পামেলা চোখ তুলে চাইলেন। সুরেশ আলোচনাটার মোড় ঘুরিয়ে দিতে বলে বসলো, বড়পিসি, তোমাদের ব্রেকফাস্ট কটার সময়? আমার পেটে কিন্তু ইঁদুর ডন দিতে শুরু করেছে।

পামেলা হেসে ফেলেন। বলেন, ‘ফাস্ট’ করলি কোথায় যে, ‘ব্রেকফাস্ট’ করবি? কাল রাত্রে ত গণ্ডেপিণ্ডে গিলেছিস। এই তো ঘুম থেকে উঠলি। আচ্ছা, দেখছি আমি—

প্রীতমের দিকে ফিরে বললেন, এক্সিকিউজ মি—

—পামেলা উঠে গেলেন ভিতর দিকে। প্রীতম আগুনঝরা চোখে তাকিয়ে দেখলো সুরেশের দিকে। সুরেশ খুশিয়াল—পিসিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে। বড়পিসি হেসেছে! হয়তো কালকের সেই অপ্রিয় কথাগুলো মনে করে রাখেনি।

দ্বিতলের ওক-রুম’টি আকারে বড়। নাম শুনলে মনে হয় এটি বুঝি ওক কাঠের লগ-কেবিন। বাস্তবে ওক-কাঠের চিহ্নমাত্র নেই। তবে পশ্চিমের দিকে দেওয়াল-জোড়া প্রকাণ্ড একটা আরণ্যকদৃশ্য। খোদায় মালুম, তার ভিতর ওক গাছ আছে কিনা। সম্ভবত এ ঘরের ঐরকম বিচিত্র নামকরণ হয়েছে ভিন্ন কারণে। প্রাসাদটি যখন নির্মিত হয় তখন যোসেফ হালদার আর মেরী জনসন তাঁদের যৌবনকালের কোনও একটি ‘ওক-রুমে’র স্মৃতিতে বিভোর ছিলেন। তাতেই এই নাম।

সে যাই হোক, এই ঘরখানাতে আশ্রয় পেয়েছিল প্রীতম আর হেনা। দ্বিতলের পশ্চিমপ্রান্তের ঘর একটা। পূর্বপ্রান্তে গৃহস্বামিনীর কামরা। মাঝখানে সুরেশের ‘দোলনা-ঘর’, তারপর টুকুর ঘর আর পশ্চিমপ্রান্তে এই ওক রুম।

সেদিন রাত্রের কথা। হেনা ড্রেসিং টেবিলে নৈশ প্রসাধন সারছে। প্রীতম তার প্যান্ট বদলে পায়জামা পরতে পরতে বললে, আমি মোটামুটি জমিটা তৈরী করে রেখেছি। এখন শেষ কিস্তি তুমি দেবে হনি।

হেনাকে প্রীতম জনান্তিকে ‘হনি’ বলে ডাকে।

হেনা ব্লাউজটা খুলে রেখেছে। তার ঊর্ধ্বাঙ্গে শুধু ব্রা। রাত্রে ও মাথায় কিছু বিচিত্র ক্লিপ লাগিয়ে শোয়—চুলটা তাতে স্মৃতিটুকুর চুলের মতো কোঁকড়ানো হয়ে যাবে। আয়নায় দেখে দেখে ক্লিপ সাঁটছিল হেনা। একটু ইতস্তত করে বললে, প্লীজ, আমাকে বোলো না। আমি কিছুতেই মুখ ফুটে বড়মাসিকে টাকার কথা বলতে পারবো না।

প্রীতম সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বললে, কিন্তু তুমি তো নিজের জন্য চাইবে না, চাইবে মীনার জন্যে, রাকেশের জন্যে। তুমি তো জানই নিতান্ত দুর্ভাগ্যবশত শেয়ার বাজারে…

হেনা ঘুরে বসলো। প্রীতম তার চোখে-চোখে তাকাতে পারলো না। মাথার বিরাট পাগড়িটা খুলে চুলটা আঁচড়াতে থাকে। হেনা মিনতির সুরে বলে, বুঝছো না কেন? বড়মাসিকে বোঝা বড় শক্ত। সে কঞ্জুষ নয়, মাঝে মাঝে উপহারও দেয়, তা তুমি জানো; কিন্তু কেউ তার কাছে হাত পাতলে-

—ভিক্ষা তো নয়, ধার। আমরা ধীরে ধীরে শোধ করে দেব।

হেনা এ প্রসঙ্গ তুললো না যে, মজঃফরপুরের সংসারে তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। বরং বললে, শোন; তুমি অন্য কোথা থেকে বরং টাকাটা ধার করার চেষ্টা কর। বড়মাসি দু’চোখ বুজলেই তো আমরা শোধ করে দিতে পারবো; সে আর কতদিন?

প্রীতমের কণ্ঠে এবার স্পষ্টই বিরক্তি, তুমি মাঝে মাঝে বড় অবুঝ হয়ে পড়, হেনা! মুখ ফুটে চাইতেই যদি না পারবে তাহলে এত খরচাপাতি করে বিহার থেকে আমরা এলাম কেন? তোমার মাসির জন্মদিনে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু য়ু’ গাইতে?

প্রীতম যে ‘হেনার’ বদলে ওকে ‘হনি’ ডাকছে না এটা খেয়াল করেছে সে। কিন্তু তবু সে জেদি মেয়ের মত বললে, আমি টাকা ধার চাইতে বাপের বাড়ি আসিনি।

সে কথা আমিও বলছি না; কিন্তু এ কথা কি বলনি যে, আমাদের এই বিপদে তোমার আন্টিই শুধু আমাদের বাঁচাতে পারে? আর আমরা কিছু লাখ-বেলাখ টাকা ধার চাইছি না। সে টেন থাউজেন্ড! তোমার বড়মাসির কারেন্ট অ্যাকাউন্টেই হয়তো সে টাকা পড়ে আছে। বিনা সুদে!

হেনার ক্লিপ আঁটা শেষ হয়েছিল। হাত-ব্যাগ খুলে সে বার করলো একটা হাল্কা রঙের সিল্কের নাইটি। ঢিলে-ঢালা নয়, আঁটোসাঁটো। পাশের ঘরে যে নাইটি পরে অঘোর ঘুমে ঘুমোচ্ছে স্মৃতিটুকু হুবহু সেই রঙ; সেই মাপ। নাইটিটা মাথা দিয়ে গলিয়ে বললে, দেখাই যাক না। বড়মাসি হয়তো নিজে থেকেই প্রসঙ্গটা তুলবে—মীনাকে ভর্তি করার কথাটা—

—আমার মনে হয় তার সম্ভাবনা খুবই অল্প।

—রাকেশকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেই ভাল হত। চোখে দেখলে… কী ফুটফুটে হয়েছে ছেলেটা—

—তাতে লাভ হত থোড়াই! তোমার আন্টি বাঁজাখাজা মানুষ। ছেলেপুলে একদম দেখতে পারে না।

হেনা একটা হাত বাড়িয়ে দেয় সামনের দিকে, প্লীজ প্রীতম!

স্বামীকে নাম ধরেই ডাকে সে। এটাই ফ্যাশন। টুকু বিয়ে করলে নির্মলকে নিশ্চয়ই নাম ধরেই ডাকবে।

প্রীতম বলে, জানি হেনা, কথাটা তোমার ভাল লাগবে না। কিন্তু এটাই সত্যি কথা। তোমার মাসির তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। টাকার কোনও প্রয়োজন নেই তাঁর। খরচ করছেন না, করতে জানেনও না। তবু যখের ধন আগলে বসে আছেন অনন্ত পরমায়ু নিয়ে! তিনি জানেন, তুমিও জানো আমিও জানি—বুড়ি চোখ বুজলেই এই মরকতকুঞ্জ সমেত সমস্ত সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশের মালিক হবে তুমি। তাহলে আজই বা বুড়ি তা থেকে দশ-বিশ হাজার আমাদের ধার দেবে না কেন? না হয় তার উইল থেকে সে ক’হাজার কমিয়ে দিক…

হেনা সাশ্রুলোচনে বলে ওঠে, প্লীজ প্রীতম! ওভাবে বল না! এবার আমি কিছুতেই টাকা ধার করার কথা ওঁকে বলতে পারবো না।

প্রীতম এক পা এগিয়ে আসে। হেনার কাঁধে একখানা হাত রাখে। বাঘের থাবা যেন। দৃঢ়স্বরে বলে, তুমি জান, শেষ পর্যন্ত আমার মতটাই তোমাকে চিরকাল মেনে নিতে হয়েছে। এবারও তাই হবে। হ্যাঁ, এবারও তাই করতে হবে তোমাকে। যা আদেশ করেছি আমি…

হেনা একেবারে কুঁকড়ে গেল।

ঐ ছয় তারিখেরই ঘটনা। সোমবার, রাত দশটা।

কাল পামেলার জন্মদিন, সাতই এপ্রিল। অতিথিরা যে যার ঘরে চলে গেছে। পামেলা তাঁর দ্বিতলের ঘরে বসে নিত্যকর্মপদ্ধতি অনুসারে হিসাবের খাতায় সব কিছু লিখে নিচ্ছিলেন। সামনে একটা টুলে বসে আছে মিনতি। তার হাতে একটা নোট বই। কী কী খরচ হয়েছে তার হিসাব লেখা। গৃহস্বামিনী যোগটা শেষ করে বললেন, ব্যাঙ্ক থেকে যে টাকাটা তুলেছি সে টাকা কোথায় রেখেছ?

—নিচে হলঘরের ড্রয়ারে। যেখানে থাকে।

—না। টাকা-কড়ি অমন ছড়িয়ে রেখো না। হয় তোমার আলমারিতে রেখো, না হলে আমাকে রোজ দিয়ে যেও। বুঝলে?

মিনতি আদেশটা বুঝতে পারে, তার অন্তর্নিহিত বার্তাটির অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। তবে আদেশ তামিল করাতে সে অভ্যস্ত। বললে, আচ্ছা মা।

এবার গৃহস্বামিনী যা বললেন তাতে আদ্যোপান্ত গুলিয়ে গেল ওর। ‘আচ্ছা মা’-ও জোগালো না তার মুখে। এমন বিচিত্র কথা সে তার তিন বছরের চাকরি জীবনে কোনওদিন শোনেনি। পামেলা বলছিলেন, কাল আমার জন্মদিন, মনে আছে নিশ্চয়। কাল সকালে বুড়ো শিবতলায় আমার নামে বিশ টাকার পুজো দিয়ে আসবে। তোমরা সবাই বাবার প্রসাদ পেও—তুমি, মোহন, শান্তি, ছেদিলাল, সরযূ, সবাই-

মিনতিকে নিরুত্তর দেখে আবার বললেন, কী বললাম বুঝতে পেরেছ?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। না, মানে…আপনি তাহলে…ইয়ে, ঠাকুর-দেবতা মানেন?

—আমি যে মানি না, তা তুমি জান মিন্টি। কিন্তু এটা করলে তোমরা সবাই তৃপ্তি পাবে এটাও আমি জানি। এ বুড়ি পটল তুললে তোমাদের কিছু লাভ নেই, বরং চাকরি খোয়াবে। তাই তোমাদের আন্তরিক কামনাটা জোরদার করা আমার কর্তব্য!

কী নিদারুণ অভিমানে উনি কথাকটা বললেন তা বুঝবার মতো মিনতির না ছিল বুদ্ধি না শিক্ষা। সে খুশিয়াল হয়ে ওঠে। কর্ত্রী খেস্টান, তাঁর পরিচারকবৃন্দ অধিকাংশই হিন্দু। আগেকার দিন হলে খেস্টান-বাড়িতে অন্নগ্রহণ করায় ওদের সবার জাত যেতো। এখন দিন-কাল পালটেছে। জাত অত সহজে যায় না—এরকম আলোকপ্রাপ্ত শহরে।

মিনতি বললে, আপনার পেত্যয় হয় না, কিন্তু ঠাকুরমশাই সত্যিই পিচাশসিদ্ধ।

—কথাটা ‘পিচাশ’ নয়, ‘পিশাচ’। তা তুমি কেমন করে জানলে?

—দেখেছি কিনা। প্ল্যানচেটে তিনি ভূত-প্রেত নামাতে পারেন। মানে ভূত ঠিক নয়, অশরীরী আত্মা সব। যাঁরা একদিন এই আপনার-আমার মতো জীবিত ছিলেন।

প্ল্যানচেট ব্যাপারটা জানা ছিল পামেলার। প্রিয়জনেরা একে একে বিদায় নেবার পর নিঃসঙ্গ পামেলা জনসন এককালে সেদিকে ঝুঁকেছিলেন। সরলা, কমলা, বিমলা অথবা বব-এর আত্মাকে নামিয়ে এনে এই মরকতকুঞ্জের নিভৃত কক্ষে দু-চারটে ভালবাসার কথা বলার প্রচেষ্টা। ইংরেজি বই এনে চেষ্টা করে দেখেছেন। কেউ কোনওদিন আসেনি। বুঝেছিলেন—এসব নেহাৎই বুজরুকি। বিশ্বাসপ্রবণ মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভাঙার ধান্দায় একজাতের সুযোগ-সন্ধানী এসব কথা প্রচার করে। আজ জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে, আত্মীয়-স্বজনের নির্লজ্জ লোলুপতা দেখে তিনি হয়তো মনে মনে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়েই ছিলেন। প্রশ্ন করেন, তুমি স্বচক্ষে দেখেছো?

—দেখেছি মা। অনেক-অনেক বার।

–কী দেখেছ?

—ঠাকুরমশাই আর সতী-মা ঘর অন্ধকার করে প্ল্যানচেট করেন। স্বর্গ থেকে এক এক দিন নেমে আসেন এক-একজন। ঠাকুরমশাই তাঁকে প্রশ্ন করেন, তিনি জবাব দেন—

—মৌখিক জবাব?

—না। লিখে লিখে। আমি মিলিয়ে দেখেছি—সেসব কথা নিয্যস সতি!

পামেলা যেন কী ভাবছেন। তাঁর দৃষ্টি একটি কুলুঙ্গিতে নিবদ্ধ। মিনতি সাহস পেয়ে বললো, গত মঙ্গলবারেই এসেছিলেন একজন। বিরাট পুরুষ। নামের আদ্য অক্ষরটুকু জানালেন তিনি—’য’! ঠাকুরমশাই বলে না দিলেও আমি বুঝতে পেরেছিলাম তিনি কে—তিনি অনেক কথা বললেন, মেরীনগরের সবাইকে আশীর্বাদ করলেন। আর একটা কথা বললেন যার মানে আমি তো ছার, ঠাকুরমশাই, নিজেও বুঝতে পারেননি। মনে হল উনি বললেন, ‘এক ঘরে বাবার ব্রহ্মতালুতে উকিলটা লুকিয়ে আছে!’

পামেলার কী যেন হলো। চট করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। বললেন, রাত অনেক হল মিন্টি। এবার আমি শোব। যাও, ঘরে যাও।

মিনতি শশব্যস্তে প্রস্থান করলো।

পামেলা প্রার্থনাতে শয়ন করলেন তাঁর শয্যায়। ঘুম এলো না কিছুতেই। এমন নিদ্রাহীন রাত্রি মাসে পাঁচ-সাতটা আসে। এতে উনি অভ্যস্ত। কিছুতেই স্লিপিং পিল খাবেন না। বলেন, দুর্বল মানুষেরা ওসব খায়। দু’রাত্রি ঘুম না হলে মানুষ মরে যায় না। শরীরের নাম মহাশয়—বাকি দু’দিন বেশি ঘুমিয়ে শরীর তার পাওনাগণ্ডা ঠিক পুষিয়ে নেবেই। এমন নিদ্রাহীন রাত্রে তিনি ঘাসের চটি পায়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ান। এটা ঠিক করেন, ওটা সরিয়ে নাড়িয়ে দেন। পায়চারি করেন ক্রমাগত। তারপর ক্লান্ত শরীরে শেষ রাতের দিকে আপনিই ঘুমিয়ে পড়েন।

আজ ঘুম না আসার অবশ্য যথেষ্ট কারণ আছে। আগামীকাল সেই তাঁর ক্লান্তিকর জন্মদিন। ‘বাহাত্তুরে’ হবার শুভলগ্ন। তাঁর মৃত্যুকামী একদল ‘ওয়ারিশ’-এর সেই বীভৎস গান—’হ্যাপি বার্থ ডে টু য়ু!’ উপায় নেই, ভদ্রতার মুখোশ এঁটে এ অত্যাচার প্রতি বছর সয়েছেন, এবারও সইবেন।

কিন্তু মিন্টি ওটা কি বলল?

‘এক-ঘরে-বাবার ব্রহ্মতালুতে—ওটা কি ‘একঘরের’ বদলে ‘ওক ঘরে’? ‘উকিল ‘টা কি উইল’টা?

অনেক-অনেকদিন আগেকার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল পামেলার। যোসেফের মৃত্যুর পর তাঁর কোনও উইল খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ তাঁর অ্যাটর্নি বলেছিলেন, যোসেফ একটি উইল করে নিজের কাছেই রেখেছিলেন। তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও ওঁরা ক-ভাইবোন সেই কাগজখানি উদ্ধার করতে পারেননি। তাতে অবশ্য প্রবেট পেতে অসুবিধা হয়নি কিছু। ওঁরা কয়জনই ছিলেন আইনানুগ ওয়ারিশ। আর কোনও দাবিদার এসে উপস্থিত হয়নি মৃত যোসেফ হালদারের সম্পত্তি দাবি করে।

তার প্রায় দশ বছর পরে পামেলা উইলখানি খুঁজে পান। সন্তানদেরই সম্পত্তি দিয়ে গিছেন যোসেফ হালদার। ততদিনে সরলাও গত। কিন্তু সেই উইলখানি খুঁজে পেয়েছিলেন এক বিচিত্র স্থান থেকে। ওক-রুমে ঠাকুরদার ছবিখানি পেড়ে নামিয়ে ঝাড়পোঁছ করতে গিয়ে দেখলেন অয়েল-পেন্টিঙের পিছনে একটা গুপ্ত বোতাম। সেটা টিপতেই একটা ছোট্ট কুলঙ্গির পাল্লা খুলে গেল। আশ্চর্য! তার ভিতর যোসেফের একটি ডায়েরি, কিছু গিনি আর তাঁর স্বহস্তে লেখা উইল!

এই বিচিত্র ঘটনার কথা বুড়ো শিবতলার পূজারী ঠাকুরমশায়ের জানার কথা নয়। তাহলে কী ভাবে ঐ কথাটা লেখা হল প্ল্যানচেট কাগজে ‘এক ঘরে বাবার ব্রহ্মতালুতে…’

উঠে পড়লেন উনি। গায়ে একটা গাউন জড়িয়ে নিলেন—যদিও গরম পড়তে শুরু করেছে। পায়ে গলিয়ে নিলেন ঘাসের চটি-জোড়া। ওঁর হঠাৎ ইচ্ছা হল নিচের ঘরে বাবার অয়েল পেন্টিংটার সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন। নিঃশব্দে দ্বার খুলে বেরিয়ে এলেন করিডোরে। স্তিমিত একটা বাল্ব জ্বলছে। এটা সারারাতই জ্বলে। নিচেও একটা লাইট জ্বলছে। মিনতি এ দুটো রাতে নেবায় না। সে জানে, মাসের মধ্যে পাঁচ-সাতদিন ঐ বৃদ্ধা নিদ্রাহীন অবসর যাপন করেন অশান্ত পদাচারণে।

উনি পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন সিঁড়ির কাছে। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিলেন রেলিংটা ধরবেন বলে, আর ঠিক তখনি… কার্যকারণসূত্র বোঝা গেল না, মনে হল তিনি শূন্যে ভাসছেন। দু-হাত বাড়িয়ে রেলিংটাকে আঁকড়ে ধরতে চাইলেন…পারলেন না…উল্টে পড়লেন সিঁড়ির ধাপে…গড়গড়িয়ে নিচের দিকে।

তাঁর চিৎকারে এবং পতনজনিত শব্দে ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠল। হয়তো অনেকে জেগেই ছিল—রাত সাড়ে দশটাও হয়নি। মুহূর্তমধ্যে সবাই ছুটে এল অকুস্থলে।

পামেলা জ্ঞান হারাননি। কিন্তু সর্বাঙ্গে তীব্র বেদনা। সিঁড়ির শেষ ধাপে পড়ে আছেন তিনি। দেখতে পাচ্ছেন অনেকগুলো মুখ। মিনতি দু-হাত উৎক্ষিপ্ত করে মড়াকান্না শুরু করেছে—তার কথাগুলো বোঝা যাচ্ছে না।…টুকুর পরনে একটা নীল সিল্কের কী যেন…হেনার মাথায় একগাদা কী যেন…। চৈতন্যের শেষ প্রান্ত থেকে বৃদ্ধা শুনতে পেলেন সুরেশের কণ্ঠস্বর। সে একটা লাল বল উঁচু করে সবাইকে দেখাচ্ছে। বলছে, ফ্লিসি হতভাগার কাণ্ড! এই দেখ বলটা! সিঁড়ির মাথায় পড়েছিল সেটা…বড়পিসি তাতে পা দিয়েই…

না, তখনও জ্ঞান হারাননি উনি। এবার শুনতে পেলেন একটি আত্মপ্রত্যয়ী কণ্ঠস্বর—তোমরা সবাই সরে দাঁড়াও। আমাকে দেখতে দাও।

ডক্টর প্রীতম ঠাকুর।

পামেলা আশ্বস্ত হলেন সেই কণ্ঠস্বরে। প্রীতম পরীক্ষা করে বলল, মনে হল হাড়টাড় ভাঙেনি। জ্ঞান আছে এখনো।

দু-হাতে পাঁজাকোলা করে বৃদ্ধাকে তুলে নিল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *