গীতি [রাগিণী বিভাস,–তাল আড়াঠেকা] বিরাজ সারদে কেন এ ম্লান কমলবনে! আজো কি রে অভাগিনী ভালবাস মনে মনে! মলিন নলিন বেশ, মলিন চিকণ কেশ, মলিন মধুর মূর্ত্তি, হাসি নাই চন্দ্রাননে! মলিন কমল-মালা, মলিন মৃণাল-বালা, আর সে অমৃত-জ্যোতি জ্বলে না ক বিলোচনে! চির আদরিণী বীণা, কেন, যেন দীনহীনা ঘুমায়ে পায়ের কাছে পড়ে আছে অচেতনে! জীবন-কিরণ-রেখা, অস্তাচলে দিল দেখা, এ হৃদি-কমল দেবী ফুটিবে না-আর! যাও বীণা লয়ে করে, ব্রহ্মার মানস সরে, রাজহংস কেলি করে সুবর্ণ নলিনী সনে। ১ আজি এ বিষণ্ণ বেশে কেন দেখা দিলে এসে, কাঁদিলে কাঁদালে দেবী জন্মের মতন! পূর্ণিমা-প্রমোদ-আলো, নয়নে লেগেছে ভাল; মাঝেতে উথলে নদী, দু পারে দু জন– চক্রবাক চক্রবাকী দু পারে দু জন! ২ নয়নে নয়নে মেলা, মানসে মানসে খেলা, অপরে প্রেমের হাসি বিষাদে মলিন; হৃদয়-বীণার মাঝে ললিত রাগিণী বাজে, মনের মধুর গান মনেই বিলীন। ৩ সেই আমি, সেই তুমি, সেই এ স্বরগ-ভূমি, সেই সব কল্পতরু, সেই কুঞ্জবন; সেই প্রেমে সেই স্নেহ, সেই প্রাণ, সেই দেহ; কেন মন্দাকিনী-তীরে দু পারে দু জন! ৪ আকুল ব্যাকুল প্রাণ, মিলিবারে ধাবমান; কেন এসে অভিমান সমুখে উদয়!– কান্তি-শান্তি ময় তনু, অপরূপ ইন্দ্রধনু, তেজে যেন জ্বলে মন, অটল-হৃদয়। ৫ কাতর পরাণ পরে চেয়ে আছে স্নেহভরে, নয়ন-কিরণ যেন পীযূষ-লহরী; এমন পদার্থে হেলি যাব না যাব না ঠেলি, উভয়-সঙ্কটে আজ মরি যদি, মরি। ৬ কেন গো পরের করে সুখের নির্ভর করে, আপনা আপনি সুখী নহে কেন নর! সদাশিব সদানন্দ, সতী বিনে নিরানন্দ, শ্মশানে ভ্রমেণ ভোলা খেপা দিগম্বর। ৭ হৃদয়-প্রতিমা লয়ে, থাকি থাকি সুখী হয়ে, অধিক সুখের আশা নিরাশা শ্মশান; ভক্তিভাবে সদা স্মরি, মনে মনে পূজা করি, জীবন-কুসুমাঞ্জলি পদে করি দান। ৮ বাসনা বিচিত্র ব্যোমে খেলা করে রবি সোমে পরিয়ে নক্ষত্র তারা হীরকের হার, প্রগাঢ় তিমিররাশি ভুবন ভরেছে আসি অন্তরে জ্বলিছে আলো, নয়নে আঁধার। ৯ বিচিত্র এ মত্তদশা, ভাবভরে যোগে বসা, হৃদয়ে উদার জ্যোতি কি বিচিত্র জ্বলে! কি বিচিত্র সুর তান ভরপুর করে প্রাণ, কে তুমি গাহিছ গান আকাশমণ্ডলে! ১০ জ্যোতির প্রবাহ-মাঝে বিশ্ববিমোহিনী রাজে! কে তুমি লাবণ্য-লতা মূর্তি মধুরিমা, মৃদু মৃদু হাসি হাসি বিলাও অমৃতরাশি, আলোয় করেছ আলো প্রেমের প্রতিমা! ১১ ফুটে ফুটে অবিরল হাসে সব শতদল, অবিরল গুঞ্জরিয়ে ভ্রমর বেড়ায়; সমীর সুরভিময় সুখে ধীরে ধীরে বয়, লুটায়ে চরণতলে স্তুতিগান গায়। ১২ আচম্বিতে এ কি খেলা! নিবিড় নিরদমালা! হা হা রে, লাবণ্য-বালা লুকা’ল লুকা’ল! এমন ঘুমের ঘোরে জাগালে কে জোর কোরে, সাধের স্বপন আহা ফুরা’ল ফুরা’ল! ১৩ বসন্তের বনমালা ঘুমের রূপের ডালা মায়ার মোহিনী মেয়ে স্বপন-সুন্দরী! মনের মুকুরতলে পশিয়ে ছায়ার ছলে কর কত লীলাখেলা; কতই লহরী! ১৪ কোথা থেকে এস তারা, মাখিয়ে সুধার ধারা, জুড়াতে কাতর প্রাণ নিশান্ত সময়ে! (লয়ে পশু পক্ষী প্রাণী ঘুমায় ধরণী রাণী,) কোথায় চলিয়ে যাও অরুণ উদয়ে। ১৫ ফের্ এ কি আলো এল! কই কই, কোথা গেল, কেন এল, দেখা দিল, লুকাল আবার! কে আমারে অবিরত খেপায় খেপার মত, জীবন-কুসুম-লতা কোথা রে আমার! ১৬ কোথা সে প্রাণের পাখী, বাতাসে ভাসিয়ে থাকি আর কেন গান কোরে ডাকে না আমায়! বল দেবী মন্দাকিনী! ভেসে ভেসে একাকিনী সোণামূখী তরীখানি গিয়েছে কোথায়! ১৭ এই না, তোমারি তীরে দেখা আমি পেনু ফিরে, তুলে কেন না রাখিনু বুকের ভিররে! হা ধিক্ রে অভিমান, গেল গেল গেল প্রাণ করাল কালিমা ওই গ্রাসে চরাচরে! ১৮ হারায়ে নয়ন-তারা হয়েছি জগত-হারা, ক্ষণে ক্ষণে আপনারে হারাই হারাই; ওই ভাই দাও বোলে কোন্ দিকে যাব চোলে, ও কি ওঠে জ্বোলে জ্বোলে, কোথায় পালাই। ১৯ ও কি ও, দারুণ শব্দ, আকাশ পাতাল স্তব্ধ; দারুণ আগুন সুদু ধুধু ধুধু ধায়, তুমুল তরঙ্গ ঘোর, কি ঘোর ঝড়ের জোর, পাঁজর ঝাঁঝর মোর দাঁড়াই কোথায়! ২০ তবে কি সকলি ভুল! নাই কি প্রেমের মূল! বিচিত্র গগন-ফুল কল্পনা লতার? মন কেন রসে ভাসে প্রাণ কেন ভালবাসে আদরে পরিতে গলে সেই ফুলহার? ২১ শত শত নর নারী দাঁড়ায়েছে সারি সারি, নয়ন খুঁজিছে কেন সেই মুখখানি? হেরে হারা-নিধি পায়, না হেরিলে প্রাণ যায়, এমন সরল সত্য কি আছে না জানি! ২২ ফুটিলে প্রেমের ফুল ঘুমে মন ঢুলু ঢুলু, আপনি সৌরভে প্রাণ আপনি পাগল; সেই স্বর্গ-সুধা পানে কত যে আনন্দ প্রাণে, অমায়িক প্রেমিকে তা জানেন কেবল। ২৩ নন্দন-নিকুঞ্জবনে বসি শ্বেত শিলাসনে খোলা প্রাণে রতিকাম বিহারে কেমন! আননে উদার হাসি, নয়নে অমৃতরাশি; অপরূপ আলো এক উজলে ভুবন। ২৪ পারিজাত-মালা করে, চাহি চাহি স্নেহভরে আদরে পরস্পরে গলায় পরায়; মেজাজ্ গিয়েছে খুলে, বসেছে দুনিয়া ভুলে, সুধার সাগর যেন সমুখে গড়ায়। ২৫ কি এক ভাবেতে ভোর কি যেন নেশার ঘোর, টলিয়ে ঢলিয়ে পড়ে নয়নে নয়ন; গলে গলে বাহুলতা, জড়িমা-জড়িত কথা, সোহাগে সোহাগে রাগে গলগল মন। ২৬ করে কর থরথর, টলমল কলেবর, গুরুগুরু দুরুদুরু বুকের ভিতর; তরুণ অরুণ ঘটা আননে আরক্ত ছটা, অধর কমল-দল কাঁপে থরথর। ২৭ প্রণয়-পবিত্র কাম, সুখ-স্বর্গ-মোক্ষ ধাম! আজি কেন হেরি হেন মাতোয়ারা বেশ! ফুলধনু ফুলছড়ি দূরে যায় গড়াগড়ি; রতির খুলিয়ে খোঁপা আলুথালু কেশ! ২৮ বিহ্বল পাগল প্রাণে চেয়ে সতী পতি পানে, গড়িয়ে গড়িয়ে কোথা চলে গেছে মন; মুগ্ধ মত্ত নেত্র দুটি, আধ ইন্দীবর ফুটি, দুলুদুলু ঢুলুঢুলু করিছে কেমন! ২৯ আসলে উঠিছে হাই, ঘুম আছে, ঘুম নাই, কি যেন স্বপন মত চলিয়াছে মনে; সুখের সাগরে ভাসি কিবে প্রাণখোলা হাসি! কি এক লহরী খেলে নয়নে নয়নে! ৩০ উথুলে উথুলে প্রাণ উঠিছে ললিত তান, ঘুমায়ে ঘুমায়ে গান গায় দুই জন; সুরে সুরে সম্ রাখি ডেকে ডেকে ওঠে পাখী, তালে তালে ঢ’লে ঢ’লে চলে সমীরণ! ৩১ কুঞ্জের আড়াল থেকে চন্দ্রমা লুকায়ে দেখে, প্রণয়ীর সুখে সদা সুখা সুধাকর; সাজিয়ে মুকুল ফুলে আহ্লাদেতে হেলে দুলে চৌদিকে নিকুঞ্জ-লতা নাচে মনোহর। সে আনন্দে আনন্দিনী, উথলিয়ে মন্দাকিনী; করি করি কলধ্বনি বহে কুহূহলে॥ ৩২ এ ভুল প্রাণের ভুল, মর্ম্মে বিজড়িত মূল, জীবনের সঞ্জীবনী অমৃত-বল্লরী; এ এক নেশার ভুল, অন্তরাত্মা নিদ্রাকুল, স্বপনে বিচিত্র-রূপা দেবী যোগেশ্বরী। ৩৩ কভু বরাভয় করে, চাঁদে যেন সুধা ক্ষরে করে মধুর স্বরে অভয় প্রদান; কখন গেরুয়া পরা, ভীষণ ত্রিশূল ধরা, পদভরে কাঁপে ধরা ভূধর অধীর; দীপ্ত সূর্য্য হুতাশন ধ্বক্ ধ্বক্ দু নয়ন, হুঙ্কারে বিদরে ব্যোম, লুকায় মিহির; ঘোরঘট্ট অট্ট হাসি ঝলকে পাবকরাশি; প্রলয় সাগরে যেন উঠেছে তুফান। ৩৪ কভু আলুথালু কেশে শ্মশানের প্রান্ত দেশে জ্যো’স্নায় আছেন বসি বিষণ্ণ বদনে; গঙ্গার তরঙ্গমালা সমুখে করিছে খেলা, চাহিয়ে তাদের পানে উদাস নয়নে। ৩৫ পবন আকুল হয়ে চিতা-ভস্মরজ লয়ে শোকভরে ধীরে ধীরে শ্রীঅঙ্গে মাথায়, শ্বেত করবীর বেলা, চামেলি মালতী মেলা, ছড়াইয়ে চারি দিকে কাঁদিয়ে বেড়ায়। ৩৬ হায় ফের বিষাদিনী! কে সাজালে উদাসীনী! সম্বর এ মূর্তি দেবী সম্বর সম্বর! বটে এ শ্মশান-মাঝে এলোকেশী কালী সাজে দানব-রুধির-রঙ্গে নাচে ভয়ঙ্কর। ৩৭ অবার নয়নে জল! ওই সেই হলাহল, ওরি তরে জীর্ণজরা জীবন আমার; গরজি গগন ভোরে দাঁড়াও ত্রিশূল ধোরে! সংহার-মূরতি অতি মধুর তোমার! ৩৮ আমার এ ব্রজবুক, ত্রিশূলেরো তীক্ষ্ণ মুখ, দাও দাও বসাইয়ে এড়াই যন্ত্রণা! সমুখে আরক্তমুখী, মরণে পরম সুখী, এ নহে প্রলয়-ধ্বনি, বাঁশরী-বাজনা। ৩৯ অনন্ত নিদ্রার কোলে অনন্ত মোহের ভোলে অনন্ত শয্যায় গিয়ে করিব শয়ন, আর আমি কাঁদিব না, আর আমি কাঁদাব না, নীরবে মিলিয়ে যাবে সাধের স্বপন! ৪০ তপন-তর্পণ-আল অসীম যন্ত্রণা-জাল, প্রশান্ত অনন্ত ছায়া অনন্ত যামিনী; সে ছায়ে ঘুমাব সুখে, বজ্র বাজিবে না বুকে, নিস্তব্ধ ঝটিকা ঝঞ্জা, নীরব মেদিনী। ৪১ বাঁধ বুক, ত্যজ ভয়, পুণ্য এ, পাতক নয়; খুনে আর পরিত্রাণে অনেক অন্তর। ভালবাসা তারি ভাল, সহে যারে চির কাল; বাঁচুক্ বাঁচুক্ তারা হউক্ অমর! ৪২ হবে না হবে না আর, হয়ে গেছে যা হবার, ধোরো না ধোরো না, বৃথা রুধ না আমাকে! এ পোড়া পিঞ্জর রাখি উড়ুক পরাণ পাখী, দেখুক দেখুক যদি আর কিছু থাকে! ছাড়! আন! যাও যাও! বেগে বুকে বিঁধে দাও! ওই সে ত্রিশূল দোলে গগনমণ্ডলে!