শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের “পুণ্যাহ’ প্রবন্ধটি ক্ষুদ্র, মনোরম এবং কৌতুকাবহ হইয়াছে। অক্ষয়বাবু সেকালের মুসলমানরাজত্বের একটি অদৃশ্য বিস্মৃত ক্ষুদ্র কোণের উপর একটি ছোটো বাতি জ্বালিয়া ধরিয়াছেন এবং পাঠকের কল্পনাবৃত্তিকে ক্ষণকালের জন্য তৎকালীন ইতিহাসরহস্যের প্রতি উৎসুক করিয়া তুলিয়াছেন। “জগৎশেঠ’ প্রবন্ধটি সুলিখিত সারবান। কিছুকাল পূর্বে বাংলা সাময়িক পত্রে পুরাতত্ত্বঘটিত প্রবন্ধগুলি যেরূপ শুষ্ক, তর্কবহুল ও নোট-জালে জড়ীভূত জটিল ছিল অক্ষয়বাবু-নিখিলবাবুর ন্যায় লেখকদের প্রসাদে সে দশা ঘুচিয়া গেছে এবং বাংলা ইতিহাসের শুষ্ক তরু পল্লবিত মঞ্জরিত হইবার উপক্রম করিয়াছে। “সে দেশে’ শ্রীযুক্ত গোবিন্দচন্দ্র দাসের রচিত একটি কবিতা। কবিতা সমালোচনা করিতে আমরা সংকোচ বোধ করি কিন্তু এ স্থলে না বলিয়া থাকিতে পারিলাম না যে, এই আটটি শ্লোকের কবিতাকে চারিটি শ্লোকে পরিণত করিলে ইহার গীতিরসমাধুর্য সু্ন্দর সুসম্পূর্ণ হইয়া উঠে– ইহার জোড়া জোড়া শ্লোকের দ্বিতীয় শ্লোকগুলি বাহুল্য, এবং তাহারা অতিবিস্তারে ভাবের গাঢ়তা হ্রাস করিয়াছে। আমরা নিম্নে এই মধুর কবিতার একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ দিলাম :–
সে দেশে বসন্ত নাই, নাহি এ মলয়। সে দেশে সরলা আছে, তাই ফুল ফোটে গাছে, কোকিল কুহরি উঠে, কথা যদি কয়। সে দেশে বসন্ত নাই, নাহি এ মলয়। সে দেশে বরষা নাই, নাহি মেঘচয়। সরলা আছে সে দেশে, তারি নীল কালো কেশে, খেলে প্রেম ইন্দ্রধনুঃ চারু শোভাময়। সে দেশে বরষা নাই, নাহি মেঘচয়। সে দেশে শরৎ নাই, নাহি শীতভয়। সে দেশে সরলা হাসে, জ্যোছনা তা নীলাকাশে, স্থলে তাহা স্থলপদ্ম, জলে কুবলয়। সে দেশে শরৎ নাই, নাহি শীত ভয়। সে দেশে দিবস নাই, নিশা নাহি হয়। সে দেশে সরলা আছে, রবি শশী তারি কাছে, ঘোমটার তলে হাসে, একত্র উভয়। সে দেশে দিবস নাই, নিশা নাহি হয়।
হেমেন্দ্রপ্রসাদবাবু “রমণীর অধিকার’ প্রবন্ধে যাহা বলিয়াছেন সে সম্বন্ধে তাঁহার সহিত আমাদের মতের সম্পূর্ণ ঐক্য আছে; কিন্তু যাহাদের সহিত তাঁহার মতের ঐক্য নাই তাহাদিগকে পরাভূত করিবার উপযোগী যুক্তি ও প্রমাণবিন্যাস এই ক্ষুদ্রপরিসর প্রবন্ধে সম্ভবপর হইতে পারে না। “হেমের অনধিকার’ নামক গল্পে স্ত্রীবিয়োগবিধুর উদ্ভ্রান্ত বিলাপকারীদের প্রতি করুণরসমিশ্রিত একটি নিগূঢ় বিদ্রূপ প্রকাশিত হইয়াছে। অসংযত হৃদয়োচ্ছ্বাসের মধ্যে যে একটি গোপন অলীকতা আছে লেখক সংক্ষেপে তাহার আভাস দিয়াছেন।
উৎসাহ, বৈশাখ, ১৩০৫