(একসপ্ততিতম সাম্বৎসরিক মাঘোৎসবে পঠিত)
ভারতসম্রাজ্ঞী মহারানী ভিক্টোরিয়া– যিনি সুদীর্ঘকাল তাঁহার বিপুল সাম্রাজ্যের জননীপদে অধিষ্ঠিতা ছিলেন, যিনি তাঁহার রাজশক্তিকে মাতৃস্নেহের দ্বারা সুধাসিক্ত করিয়া তাঁহার অগণ্য প্রজাবৃন্দের নত মস্তকের উপরে প্রসারিত করিয়া রাখিয়াছিলেন, ক্ষমা শান্তি এবং কল্যাণ যাঁহার অকলঙ্ক রাজদণ্ডকে পরিবেষ্টন করিয়াছিল, সেই ভারতেশ্বরী মহারানী যে পরম পুরুষের নিয়োগে এই পার্থিব রাজ্যভার গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং যাঁহার সুচিরকাল জীবিত থাকিয়া আনন্দিতা রাজশ্রীকে দেশে কালে এবং প্রকৃতিবর্গের হৃদয়ের মধ্যে সুদৃঢ়তররূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন, অদ্য সমস্ত রাজসম্পদ পরিহারপূর্বক ললাটের মাণিক্যমণ্ডিত মুকুট অবতারণ করিয়া একাকিনী সেই রাজরাজের মহাসভায় গমন করিয়াছেন। পরমপিতা তাঁহার মঙ্গলবিধান করুন।
মৃত্যু প্রতিদিন এই সংসারে যাতায়াত করিতেছে কিন্তু আমরা তাহার গোপন পদসঞ্চার লক্ষ্য করি না। সেই মৃত্যু যখন রাজসিংহাসনের উপরেও অবহেলাভরে আপন অমোঘ কর প্রসারণ করে তখন মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুর বিরাট স্বরূপ কোটি কোটি লোকের নিকট পূর্ণসূর্যগ্রহণের রাহুচ্ছায়ার ন্যায় দৃষ্টিগোচর হয়। অদ্য সমস্ত পৃথিবীর উপরে এই মৃত্যুর স্বরূপ প্রকাশিত হইয়াছে। সাধারণ লোকের কুটিরপ্রাঙ্গণে যাহার গতিবিধি লক্ষ্যপথে পড়ে না, সে আজ অভ্রভেদী রাজসিংহাসনের উপরে দণ্ডায়মান হইয়া আপনাকে সর্বসমক্ষে প্রচার করিয়াছে। কিন্তু আমরা আতঙ্কে তাহার নিকট মস্তক অবনত করিব না। ত্রাসের এবং শোকের সমস্ত অন্ধকারপুঞ্জ অপসারণ করিয়া আমরা তাঁহাকেই স্মরণ করিব, যস্য ছায়ামৃতং যস্য মৃত্যুঃ– যাঁহার ছায়া অমৃত যাঁহার ছায়া মৃত্যু। যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে যেন জাতানি জীবন্তি যৎ প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি তদ্বিজিজ্ঞাসস্ব! যাঁহা হইতে এই ভূত সকল উৎপন্ন হয় যাঁহার দ্বারা জীবিত রহে এবং যাঁহার মধ্যে প্রবেশ করে, অদ্য পৃথিবীব্যাপী মৃত্যুশোকের মধ্যে তাঁহাকেই বিশেষরূপে জানিতে ইচ্ছা করে। কত চন্দ্রসূর্য গ্রহতারকা তাঁহার জ্যোতিঃকণায় প্রজ্বলিত ও চরণচ্ছায়ায় নির্বাপিত হইয়াছে, পৃথিবীর কোন্ মৃত্যু কোন্ মহৎশোক তাঁহার মহোৎসবকে কণামাত্র আচ্ছন্ন করিতে পারে? হে শোকার্ত, হে মরণভয়াতুর, অদ্য তাঁহাকেই বিশেষরূপে জানিতে ইচ্ছা করে। আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে আনন্দেন জাতানি জীবন্তি, আনন্দং প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি– তিনি পরমানন্দ– সেই আনন্দ হইতেই এই ভূত সকল উৎপন্ন হইতেছে সেই আনন্দের দ্বারাই জীবিত রহিতেছে এবং ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা, পশু-পক্ষী, কীট-পতঙ্গ, সচেতন-অচেতন যাহা-কিছু অহরহ তাঁহার প্রতি গমন করিতেছে এবং তাঁহার মধ্যেই প্রবেশ করিতেছে।
পৃথিবীর অতীতকালের রাজাধিরাজগণ অদ্য কোথায়! কোথায় দিগ্বিজয়ী রঘু, কোথায় আসমুদ্র ক্ষিতীশ ভরত– যদুপতেঃ ক্ব গতা মথুরাপুরী, রঘুপতেঃ ক্ব গতোত্তর কোশলা! পৃথিবীর সুবৃহৎ রাজমহিমা মুহূর্তে মুহূর্তে যাঁহার জ্যোতিঃসাগরে বুদ্বুদের ন্যায় বিলীন হইতেছে অদ্য আমরা তাঁহার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়াছি এই কথা আমাদিগকে স্মরণ করিতে হইবে; সেখানে ন জরা ন মৃত্যুর্ন শোকঃ! অদ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীশ্বরী তাঁহার দীর্ঘজীবনের সমস্ত কৃতকর্ম যাঁহার পদতলে সমর্পণ করিয়া করজোড়ে মুকুটবিহীন মস্তক অবনত করিয়াছেন– আমরাও অদ্য সেই বিশ্বভুবনেশ্বরের সম্মুখে আমাদের সমস্ত পাপ-তাপ-শোক আমাদের ভক্তি-প্রীতি-পূজা স্থাপন করিয়া নতশিরে দণ্ডায়মান হইয়াছি, তিনি আমাদিগকে বিচার করুন, আমাদের মঙ্গল বিধান করুন, আমাদের এই পার্থিব জীবনকে সার্থকতা দান করিয়া মৃত্যুর পরে পরিপূর্ণতর জীবনের মধ্যে তাঁহার অমৃতবক্ষে আমাদিগকে আহ্বান করিয়া লউন!
ভারতী, ফাল্গুন, ১৩০৭