সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রাম এবং সাম্যবাদ

সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রাম এবং সাম্যবাদ

রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের জন্যে আমরা ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে অহিংস সংগ্রামে লিপ্ত আছি। কিন্তু আজ আমাদের অবস্থা সেই সৈন্যদলের মতো যারা এক দীর্ঘস্থায়ী এবং কঠোর যুদ্ধের মধ্যে হঠাৎ বিনাশর্তে শত্রুপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। সমগ্র জাতি দাবি করেছিল, কিংবা সংগ্রামী দেশবাসী নেতাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সংগ্রাম চালাতে অস্বীকার করেছিল, কিংবা যুদ্ধের উপকরণের জোগান বন্ধ হয়েছিল বলে এমন আত্মসমর্পণ ঘটেনি। এই আত্মসমর্পণ ঘটেছে হয় আমাদের যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি বারবার অনশনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, নয় কয়েকটি মূলগত কারণ তাঁর মন ও বিচারবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করেছে। বাইরের মানুষের পক্ষে তা বুঝতে পারা সম্ভব নয়।

জিজ্ঞাসা করি, অন্য কোনও দেশে এমন ব্যাপার হলে কী ঘটত? প্রথম মহাযুদ্ধের শেষে শত্রুপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণকারী সব রাষ্ট্রে কী ঘটত? কিন্তু ভারত এক বিচিত্র দেশ।

১৯৩৩ সালের এই আত্মসমর্পণ ১৯২২ সালে বারদৌলিতে পশ্চাদপসরণের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু ১৯২২ সালের পশ্চাদপসরণের সমর্থনে কয়েকটি কারণ, তা যতই অসন্তোষজনক হোক না কেন, দেখানো যেতে পারে। চৌরিচৌরার হিংসাত্মক ঘটনাবলীকে ১৯২২ সালের আইন অমান্য আন্দোলন বন্ধ করার একটা অজুহাত হিসাবে দেখানো হয়ে থাকে। কিন্তু ১৯৩৩ সালের আত্মসমর্পণের কী কারণ বা অজুহাত দেখানো হবে? সন্দেহ নেই, ১৯২০ সালের চরম মুহূর্তে যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং যা সেই থেকে কোন-না-কোনও রূপে অব্যাহত আছে, ভারতের পক্ষে সেটিই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। এতেও সন্দেহ নেই যে, ১৯২০ সালে ভারতের রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ যখন আরও সংগ্রামী এক কর্মপন্থার কথা ভাবছিলেন তখন মহাত্মা গান্ধীই ছিলেন একমাত্র মানুষ যিনি সমগ্র জাতির অবিসংবাদী নেতারূপে একের পর এক জয়লাভে দেশকে চালনা করতে পারতেন। এবং এতেও সন্দেহ নেই গত দশকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু আজ ভারতের ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমাদের উচিত অতীতের ভুলত্রুটিকে খুঁজে বার করা যাতে সকল বিপদ পরিহার করে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিকভাবে স্থির করতে পারি।

স্বাধীনতা লাভের জন্যে দু’টি পথ আমাদের সামনে রয়েছে। এক, আপসহীন সংগ্রাম। অন্যটি হল, আপস করে চলার পথ। প্রথম পথটি অনুসরণ করলে, পূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ না করা পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে আপসের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আর যদি দ্বিতীয় পথটি অনুসরণ করি তাহলে সংগ্রাম ক্রমাগত চালিয়ে যাবার আগে নিজেদের শক্তিকে সংহত করতে আমাদের শত্রুপক্ষের সঙ্গে মাঝে মাঝে আপস করতে হবে।

প্রথমে প্রত্যেকের মনে হতে পারে যে গত তের বছর ধরে আমাদের আন্দোলন আপসহীন সংগ্রাম, না আপসের পথ ধরে চলেছে এ ব্যাপারটি পরিষ্কার নয়। ভাবগত অস্পষ্টতাই এরূপ ভুল বোঝাবুঝির কারণ। আপসহীন সংগ্রামই আমাদের কর্মপন্থা হলে ১৯২২ সালে বারদৌলির আত্মসমর্পণ ঘটত না কিংবা ১৯৩১ সালের মার্চ মাসের দিল্লী চুক্তি স্বাক্ষরিত হত না। পক্ষান্তরে আমরা যদি আপসের পথ অনুসরণ করতাম তাহলে ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন অবস্থা আমাদের অনুকূলে ছিল তখন ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় লাভবান হওয়ার সুযোগ কখনই হারাতাম না। কিন্তু ১৯৩১ সালের মার্চ মাসে আমাদের দিক থেকে আপসের জন্যে অবস্থা অনুকূল ছিল না, তা সত্ত্বেও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৩১ সালের মার্চ মাসে আমাদের শক্তির কথা বিবেচনা করলে চুক্তির শর্তাবলী ছিল একেবারে অসন্তোষজনক। সংক্ষেপে, মুক্তি যুদ্ধের ক্ষেত্রে আমরা যথাযোগ্য সশস্ত্র সংগ্রাম কিংবা কূটনীতিতে পারদর্শী ছিলাম না।

ভারতীয়দের মতো নিরস্ত্র পরাধীন মানুষের সঙ্গে গ্রেট ব্রিটেনের মতো এক প্রথম শ্রেণীর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির যুদ্ধে আমাদের মূল রসদ হল, মানুষের মনে উৎসাহ জাগিয়ে রাখা এবং সরকারের বিরুদ্ধে মনোভাবকে বজায় রাখা। সুসজ্জিত এবং সুশিক্ষিত দুই সেনাদলের মধ্যে যুদ্ধে উভয়পক্ষের মনোভাব তেমন প্রধান হয়ে ওঠে না, আমাদের মতো জাতির ক্ষেত্রে যেমন হয়। ১৯২২ সালে সমগ্র জাতি যখন প্রবল আবেগে জেগে উঠল, তারা যখন যে কোনওরকম দুঃসাহসিক কাজ এবং ত্যাগের জন্যে প্রস্তুত, প্রধান সেনাপতি তখন হঠাৎ আন্দোলন থামিয়ে দিলেন। কয়েক মাস আগে বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে শাসকবর্গের সঙ্গে এক সম্মানজনক আপস করার যে সুযোগ এসেছিল তিনি তা নষ্ট করেছিলেন। এবং তারপরে এই ব্যাপার ঘটেছিল।

অতীতের ইতিহাস মনে রাখা বা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা সহজ নয়। ভারতের সর্বশেষ অবস্থা প্রমাণ করে যে ১৯২১ এবং ১৯২২ সালের ঘটনা থেকে কোনও শিক্ষা আমরা এখনও গ্রহণ করিনি। দুর্ভাগ্যের কথা, ভারতের দু’জন স্মরণীয় রাজনৈতিক নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ও পণ্ডিত মতিলাল নেহরুর জীবনাবসান হয়েছে যথাক্রমে ১৯২৫ ও ১৯৩১ সালে। তাঁরা হয়তো বর্তমান দেশব্যাপী বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে ভারতকে উদ্ধার করতে পারতেন।

১৯২৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের পূর্ণ স্বাধীনতা বিষয়ক প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণের মধ্যে দেশবাসীর জাগ্রত মনোভাবটি প্রকাশ পায়। ১৯২৮ সালের প্রথম দিকে সাইমন কমিশনের সদস্যদের বোম্বাইয়ে পদার্পণ করার সঙ্গে সঙ্গে দেশব্যাপী বিক্ষোভ ১৯২১ সালের গৌরবময় দিনগুলির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এক হিসেবে ১৯২১ সালের চেয়ে ১৯২৮ সালের অবস্থা ছিল আরও অনুকূল। কারণ ১৯২১ সালে ভারতের উদারনৈতিক দলের নেতারা (Liberals) সক্রিয়ভাবে ব্রিটিশ সরকারের বিরোধী ছিলেন, কিন্তু সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে কংগ্রেস এবং লিবারেল পার্টি যুগ্মভাবেই ছিলেন। ১৯২২ সালে যে আন্দোলন মহাত্মা গান্ধী আপন ইচ্ছায় হঠাৎ বন্ধ করে দিয়েছিলেন সাইমন কমিশনের আগমন উপলক্ষে তা পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ ছিল। তা সত্ত্বেও পুরো দু’ বছর ধরে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে আমরা পিছিয়ে আসতে শুরু করলাম। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনে আনুমানিক ৯০০-১৩০০ ভোটে কংগ্রেস ডোমিনিয়ান স্ট্যাটাস স্বীকার করতে সম্মত হয়। ফলে নিশ্চিতভাবে আমরা পিছু হটে আসি। কলকাতা কংগ্রেসে আমরা কেবল ১৯২৭ সালের ডিসেম্বরে মাদ্রাজের অবস্থান থেকেই নয়, ১৯২০ সালের ডিসেম্বরে নাগপুরের অবস্থান থেকেও পিছিয়ে আসি। কারণ নাগপুরে ‘স্বরাজ’ সম্পর্কে প্রস্তাব, তা যতই অস্পষ্ট হোক না কেন, ব্যাখ্যা করে বলা যেতে পারত ভারতবাসীর লক্ষ্য হল ‘পূর্ণ স্বরাজ’—‘ডোমিনিয়ান স্ট্যাটাস’ নয়।

কলকাতা কংগ্রেসের অধিবেশনে গৃহীত একটি প্রস্তাবে ব্রিটিশ সরকারকে এক বছরের মধ্যে ভারতকে ‘অধিরাজ্যের মর্যাদা’ (Dominion Status) দান করতে বলা হয়। কিন্তু ভারতকে এরকম মর্যাদা দানের অভিপ্রায় সরকারের ছিল না। অধিরাজ্যের মর্যাদা লাভের কোনও আশা ছাড়া ১৯২৯ সাল যখন শেষ হয়ে এল তখন কংগ্রেস নেতাদের পক্ষে অবস্থা বেশ সঙ্কটজনক হয়ে উঠল। লাহোর কংগ্রেসের অধিবেশনের পূর্বে ১৯২৯ সালের নভেম্বর মাসে কংগ্রেস নেতারা আর একবার তৎপর হয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কোনও ফল হয়নি। ভারতকে অধিরাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হবে এরকম আশ্বাস পেলে নেতারা একটি যৌথ ঘোষণায়, যা সাধারণভাবে দিল্লী ঘোষণা নামে পরিচিত (Delhi Manifesto), লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে সম্মত হয়েছিলেন।

১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেসের অধিবেশনে ডোমিনিয়ান স্ট্যাটাস সম্পর্কে মহাত্মা গান্ধীর প্রস্তাবের বিরোধিতা করার সাহস যাঁদের ছিল এবং ১৯২৯ সালের নভেম্বরে দিল্লী ম্যানিফেসটোর নিন্দা করার ঝুঁকি যাঁরা নিয়েছিলেন আমি তাঁদেরই একজন। আমরা বলেছিলাম যে গোলটেবিল বৈঠক নামটি অর্থহীন কারণ এটি বিবদমান দলগুলির পক্ষ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধিদের কোনও বৈঠক নয়। বিদেশী সরকার এমন অনেক ভারতীয়কে মনোনীত করেছেন যাঁরা কোনও দলের লোক নন এবং বৈঠক উপস্থিত থেকে তাঁরা কেবল কৌশলী ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের নির্দেশমত কাজ করবেন। তা ছাড়া, ভাগ্যক্রমে যদি ভারতের অনুকূলে কোনও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তা মানতে ব্রিটিশ সরকারের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। আমরা এও বলেছিলাম যে, এই বৈঠক আহ্বানের পিছনে সরকারের মূল উদ্দেশ্য হল ভারতীয়দের লন্ডনে নিয়ে গিয়ে পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ বাধিয়ে দেওয়া যা দেখে ব্রিটিশরা হাসাহাসি করবে। সেজন্যেই আমরা জোর দিয়ে বলেছিলাম যে, লয়েড জর্জ কর্তৃক আহুত আইরিশ কনভেনশন যেমন সিনফিন দলের লোকের বয়কট করেছে তেমনি একা ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের উচিত গোলটেবিল বৈঠকে যোগ না দেওয়া।

কিন্তু আমাদের এ বক্তব্য ছিল অরণ্যে রোদন মাত্র। নেতৃবৃন্দ একজোট হয়ে সরকারের সঙ্গে আসন্ন সংঘর্ষ—যা দিনে দিনে অপরিহার্য হয়ে উঠছিল—থেকে পিছিয়ে আসার একটি সম্মানজনক পথ খুঁজতে বেশি উদগ্রীব ছিলেন। কিন্তু সরকারের তরফে এরকম কোনও সুযোগ দেওয়া হয়নি। ফলে ১৯২৯ সালে ডিসেম্বর মাসে লাহোরে কংগ্রেস অধিবেশনের সময় মানুষের মনোভাব এতই উদগ্র হয়ে উঠেছিল যে নেতাদের পক্ষে বাধ্য হয়ে স্বাধীনতার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।

কিন্তু ‘স্বাধীনতা’, যার অর্থ হল ব্রিটিশ সম্পর্ক ছিন্ন করা, এমন একটি বড়ি যার স্বাদ তিক্ত এবং যা হজম করা শক্ত। কংগ্রেস যখন সর্বসম্মতিক্রমে স্বাধীনতা সম্পর্কে প্রস্তাব গ্রহণ করে গত ন’বছরের দ্বিধার মনোভাব একেবারে কাটিয়ে উঠল তখন এদেশের মডারেটরা সতর্ক হয়ে উঠলেন। আমাদের নেতারা অবিলম্বে তাঁদের অশ্বাস দিলেন এবং এজন্যে অনেক সুন্দর সুন্দর বাক্য এবং আকর্ষক স্লোগান শোনাল হল। আমাদের বলা হল, ‘স্বাধীনতা’র অর্থ হল ‘পূর্ণ স্বরাজ’ (যার ব্যাখ্যা নিজের সুবিধামত যে কোনও ব্যক্তি করতে পারেন)। ১৯৩০ সালের প্রথম দিকে মহাত্মা গান্ধী তাঁর বিখ্যাত ‘এগার দফা’ পেশ করেন যা তাঁর মতে স্বাধীনতার যাথার্থ্য ব্যক্ত করেছে এবং যা ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আপসের ভিত্তি হতে পারে। এভাবেই নেতারা নিজেদের কাজের দ্বারাই স্বাধীনতা সম্পর্কে লাহোর কংগ্রেসের গুরুত্ব এবং প্রভাব অনেকাংশে খর্ব করে দিলেন।

লাহোর কংগ্রেসের পর নেতাদের পক্ষে কিছু না করে থাকা সম্ভব ছিল না। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে আবার আন্দোলন শুরু হয়। এপ্রিল মাসের মধ্যেই সারা ভারতে বিপ্লব আন্দোলন (অহিংস আন্দোলন হলেও) ছড়িয়ে পড়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধের আহ্বানে মানুষ এমনভাবে সাড়া দেয় যে, মহাত্মা গান্ধী নিজেও বিস্মিত হয়ে যান এবং তিনি বলেন যে আরও দু’ বছরে পূর্বে এই আন্দোলন শুরু করা যেতে পারত।

১৯৩০ সালের আন্দোলন, পূর্বের ১৯২১ সালের আন্দোলনের মতোই, সরকারকে হতবুদ্ধি করে দেয়। এবং এই আন্দোলন দমন করার জন্যে সবচেয়ে কার্যকর কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে তা তারা দীর্ঘদিন স্থির করতে পারেনি। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ভারতকে সাহায্য করে। এজন্যে ১৯৩১ সালের মার্চ মাসের দিল্লী চুক্তির (গান্ধী-আরউইন চুক্তি) ভিত্তিতে এই আন্দোলন রদ করা ছিল ভুল পন্থা। নেতারা যদি আপসই চাইছিলেন তাঁরা আরও সুবিধাজনক মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করতে পারতেন। এবং যদি এই আন্দোলন আরও ছ’ মাস কিংবা এক বছর চালানো যেত তাহলে নিশ্চয়ই তেমন মুহূর্তটি আসত। কিন্তু আর একবার নীতির প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিল। দিল্লী চুক্তি স্বাক্ষরের সময় মূল লক্ষ্যের কথা বিচার-বিবেচনা করে দেখা হল না। আমি এমন কথাও বলতে পারি, আমাদের নেতারা যদি আরও বেশি দক্ষ এবং কূটনীতিজ্ঞ হতেন তাহলে ১৯৩১ সালের মার্চ মাসে দেশের যে অবস্থা ছিল তাতে তাঁরা সরকারের কাছ থেকে আরও ভাল শর্ত আদায় করতে পারতেন।

অবস্থা যা দাঁড়াল, তাতে দিল্লী চুক্তি হল সরকারের পক্ষে সুবিধাজনক আর দেশবাসীর কাছে বিপর্যয়। ১৯৩০ এবং ১৯৩৩ সালে কংগ্রেস দল কী কৌশল অবলম্বন করবে তা অনুধাবন করতে সরকার সময় পেলেন। এর ফলে তাঁরা কংগ্রেস যখনই আবার আন্দোলন শুরু করবে তা ব্যর্থ করার জন্যে তাদের শাসনযন্ত্র ঠিকমত তৈরি রাখতে পারবেন। একথা এখন সকলেই জানেন, সরকার যেসব অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন এবং সারা বছর ধরে যেসব কৌশল গ্রহণ করেছিলেন সে সবই ১৯৩১ সাল শেষ হওয়ার পূর্বেই যত্ন সহকারে করা হয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেস কী করেছিল? সীমান্ত প্রদেশ, যুক্তপ্রদেশ এবং বাংলাদেশে তীব্র অসন্তোষ সত্ত্বেও, অপরিহার্যভাবে আন্দোলন পুনর্বার শুরু করার জন্যে দেশকে প্রস্তুত করতে নেতারা কিছুই করেননি। বস্তুত একথা বলা আমার পক্ষে ভুল হবে না যে, আন্দোলন পুনর্বার শুরু করা এড়াতে শেষপর্যন্ত সব রকম চেষ্টা করা হয়েছিল।

দিল্লী চুক্তি মোটের ওপর মানুষের উদ্যম এবং উত্তেজনাকে প্রশমিত করে দিল। তা সত্ত্বেও মানুষের মনোভাব ছিল এমনই সংগ্রাম-উন্মুখ যা মিষ্ট কথায় ভোলান যায় না। এবং যদি এমন না হত, আমি নিশ্চিত যে নেতারা আন্দোলন পুনর্বার শুরু করা এড়িয়ে যেতে সফল হতেন। আগামী দিনের কর্মীদের পক্ষে উপলব্ধি করা দরকার যে ১৯৩২ সালের আন্দোলনের পরিকল্পনা এবং পরিচালনা নেতারা করেননি। তাঁদের এটা করা উচিত ছিল; এতে তাঁদের জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। একথা যদি সত্য হয়, তাহলে আজকের নেতারা যাঁরা ১৯৩২ সালের আন্দোলনে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তা থেকে তাঁরা যে বেরিয়ে আসতে উদগ্রীব হবেন তাতে কি কেউ আশ্চর্য হবেন?

১৯৩১ সালের মার্চ মাসের দিল্লী চুক্তি বিচার করে দেখলে এটিকে এক বেদনাদায়ক দলিল বলে বোধ হবে। প্রথমত, মূল বিষয় “স্বরাজ” সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের তরফে প্রতিশ্রুতি দানের বিষয়ে একটি কথাও বলা হয়নি। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় রাজন্যবর্গের সঙ্গে একটি ফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব অকথিতভাবে স্বীকার করা হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক উন্নতির পক্ষে এমন প্রস্তাব, আমার মতে, সর্বনাশের কারণ হবে। তৃতীয়ত, অহিংসার সর্বোত্তম উদাহরণ, বন্দী গাড়োয়ালি সৈন্যরা যারা নিরস্ত্র দেশবাসীর ওপর গুলিবর্ষণে করতে অসম্মত হয়েছিল তাদের মুক্তির কোনও কথা নেই। চতুর্থত, বিনা বিচারে কিংবা বিনা অভিযোগে বিভিন্ন প্রদেশে রাজবন্দীদের মুক্তিদানের কোনও কথা নেই। পঞ্চমত, মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা, যা বছরের পর বছর ধরে চলছিল, তা প্রত্যাহারের কোনও কথা নেই। ষষ্ঠত, অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্যে অভিযুক্তরা ছাড়া অন্য কারণে আটক রাজবন্দীদের মুক্তিদানের কোনও উল্লেখ নেই।

অতএব দেখা যাচ্ছে গাড়োয়ালি সৈন্য, আটক রাজবন্দী, মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা এবং বিপ্লবী বন্দীদের বিষয়ে কোনও উল্লেখ না করে দিল্লী চুক্তি, ভারতে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামে তারাই যে প্রধান দল এই মর্মে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দাবি নস্যাৎ করে দিয়েছিল। ভারতের এইসব সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামী মানুষের মুখপাত্ররূপে অস্বীকৃত হওয়ার ফলে, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস কেবলমাত্র “সত্যাগ্রহী”দের (অহিংস আন্দোলনকারী) মুখপাত্র এবং প্রতিনিধিরূপে দেশবাসীর কাছে পরিচিত হল।

১৯৩১ সালের মার্চ মাসের দিল্লী চুক্তি যদি ভুল ছিল, ১৯৩৩ সালের মে মাসের আত্মসমর্পণ হল চরম দুর্দশা। ভারতের নতুন শাসনতন্ত্র নিয়ে যখন আলোচনা চলেছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের নীতি অনুসারে তখন আইন অমান্য আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে সরকারের ওপর যতটা সম্ভব বেশি চাপ সৃষ্টি করা দরকার ছিল। এই সঙ্কট সময়ে আন্দোলন রহিত করে গত তের বছরের সংগ্রাম, জাতির কষ্টভোগ এবং ত্যাগস্বীকার সবই কার্যত পণ্ড করা হল। এই অবস্থায় দুঃখজনক ব্যাপার হল যেসব মানুষ এমন জাজ্বল্যমান বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে প্রতিবাদ করতে পারতেন তাঁরা এখন কারাগারে বন্দী আছেন। এবং যাঁরা কারাগারের বাইরে আছেন তাঁদের পক্ষেও মহাত্মা গান্ধীর একুশ দিনের উপবাসের জন্যে হয়তো সত্যিকার কোনও প্রতিবাদ করা সম্ভব হয়নি।

কিন্তু ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। একমাসের জন্যে আইন অমান্য আন্দোলন স্থগিত করার অর্থ কার্যত চিরতরে আন্দোলন বন্ধ করা, কারণ গণ-আন্দোলন রাতারাতি শুরু করা যায় না। এখন আমাদের সামনে সমস্যা হল, এই খারাপ সময়কে কীভাবে কাজে লাগানো যায় এবং ভবিষ্যতের জন্যে আমরা কী নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করব।

এই সমস্যার সমাধানের পূর্বে আরও দুটি প্রশ্নের উত্তর আমাদের দিতে হবে।

(১) অভীষ্ট লাভের জন্যে ইংল্যান্ড এবং ভারতের মধ্যে শেষপর্যন্ত একটি আপস মীমাংসা সম্ভব কি না?

(২) কোন পন্থা গ্রহণ করা হবে—ভারত রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করবে মাঝে মাঝে আপস করে, না এক আপসহীন সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা অনুসরণ করে?

প্রথম প্রশ্নের উত্তরে জানাই, এহেন আপস সম্ভব নয়। দুই জাতির মধ্যে একই ধরনের স্বার্থ থাকলে উভয়ের মধ্যে রাজনৈতিক আপস হওয়া সম্ভব। কিন্তু ইংল্যাণ্ড এবং ভারতের ক্ষেত্রে, দু’য়ের মধ্যে স্বার্থের এমন কোনও মিল নেই যার ফলে এদের মধ্যে আপস সম্ভব এবং কাম্য। নিম্নোক্ত কারণ থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হবে:

(১) দুই দেশের মধ্যে কোনও জাতিগত মিল নেই।

(২) ভারত ও ব্রিটেন দুই দেশের সংস্কৃতির মধ্যে মিল প্রায় নেই বললেই চলে।

(৩) অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখা যায়, ভারত ব্রিটেনে কাঁচামাল সরবরাহ করে এবং ব্রিটিশ পণ্যদ্রব্য কিনে থাকে। অপরপক্ষে, ভারত একটি উৎপাদনকারী দেশ হতে চায়, যাতে সে উৎপাদিত পণ্যদ্রব্যে স্বনির্ভর হতে পারে এবং কেবল কাঁচামাল নয় উৎপাদিত দ্রব্যও রপ্তানী করতে পারে।

(৪) ভারত বর্তমানে গ্রেট ব্রিটেনের বৃহত্তম বাজারের অন্যতম, শিল্পক্ষেত্রে ভারতের উন্নতি সেজন্যে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতিকুল।

(৫) বর্তমানে ভারতের সৈন্যবাহিনী এবং অসামরিক শাসন বিভাগে অনেক তরুণ ব্রিটিশ চাকরি পেয়ে থাকে। কিন্তু এ হল ভারতীয় স্বার্থের পরিপন্থী এবং ভারত চায় তার নিজের সন্তানেরা এইসব পদে নিযুক্ত হোক।

৬) ভারত এখন যথেষ্ট শক্তিশালী এবং তার যা সম্পদ আছে তাতে গ্রেট ব্রিটেনের সাহায্য বা পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সে স্বনির্ভর হতে পারে। এই ক্ষেত্রে অন্যান্য ডোমিনিয়ানের তুলনায় ভারতের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের।

(৭) দীর্ঘকাল ধরে ব্রিটেন ভারতে শোষণ এবং তার ওপর আধিপত্য করে আসছে। এজন্যে অনেকের মনে স্বতঃই এমন আশঙ্কা আছে যে দু’ দেশের মধ্যে কোনও রাজনৈতিক আপস হলে তাতে ক্ষতি হবে ভারতের আর ব্রিটেন হবে লাভবান। এছাড়া, দীর্ঘদিন দাসত্ব করার ফলে ভারতীয়দের মনে হীনম্মন্যতা দেখা দিয়েছে এবং যতদিন না ভারত ব্রিটেনের অধিকার থেকে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন হচ্ছে ততদিন এই হীনম্মন্যতার ভাব থাকবে।

(৮) ভারত চায় স্বাধীন দেশের মর্যাদা, তার নিজস্ব পতাকা, সৈন্যবাহিনী, নৌবাহিনী এবং প্রতিরক্ষা বিভাগ এবং স্বাধীন দেশসমূহের রাজধানীতে নিজস্ব রাষ্ট্রদূত। এহেন তেজোবর্ধক এবং জীবনদায়ী স্বাধীনতা ছাড়া ভারতীয়রা কখনই পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠবে না। ভারতের পক্ষে স্বাধীনতা হল মানসিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রয়োজন। ভারতের নবজাগরণের পক্ষে এ হল অপরিহার্য প্রয়োজন। ভারত আজ যে স্বাধীনতা লাভ করতে চায়, তা কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ায় যেমন দেখা যায় সেরকম “ডোমিনিয়ান হোমরুল” নয়, তা হল যেমন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বা ফ্রান্সে প্রচলিত আছে সেই রকম পূর্ণ জাতীয় সার্বভৌম রাষ্ট্র।

(৯) যতদিন ভারত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে থাকবে ততদিন সে সাম্রাজ্যের অন্যদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের স্বার্থরক্ষা করতে পারবে না। ভারতীয়দের স্বার্থ নয়, শ্বেতকায়দের স্বার্থই গ্রেট ব্রিটেন সর্বদা দেখে আসছে এবং পরেও দেখতে থাকবে। অপর দিকে স্বাধীন ভারতের পক্ষেই সম্ভব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব ভারতীয় বসবাস করছেন তাদের প্রতি যাতে আরও ভাল ব্যবহার করা হয় তা নিশ্চিত করা।

অতএব দেখা যাচ্ছে, ভারত ও গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যে আপস করার কোনও ভিত্তি নেই। ফলে, ভারতীয় নেতারা যদি এই মূল তথ্যটি উপেক্ষা করে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আপস করে তাহলে সেই ব্যবস্থা টিকবে না। গান্ধী-আরউইন চুক্তি (মার্চ ১৯৩১)-র মতোই তা অল্পদিন স্থায়ী হবে। ভারতের মধ্যে এখন যে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক শক্তিগুলি সক্রিয় হয়ে আছে তাতে তার বিধিসম্মত পূর্ণ আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যে কোনও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

ভারতের স্বাধীনতা লাভের দ্বারাই বর্তমানের অচল অবস্থা দূর করা যেতে পারে। এর অর্থ হল ভারতে ব্রিটিশ সরকারের পরাজয় স্বীকার করা। কীভাবে ভারত নিজের স্বাধীনতা লাভ করবে, এখন আমরা তা বিচার করে দেখব।

দ্বিতীয় প্রশ্নটি, অর্থাৎ কী পদ্ধতি আমাদের গ্রহণ করা উচিত—এই প্রসঙ্গে আমি বলতে পারি যে দেশ ইতিমধ্যেই মাঝে মাঝে আপস করার পন্থাটি অগ্রাহ্য করেছে। তারা ভারতের স্বাধীনতা আনবে এবং স্বাধীনতা লাভ না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাবে—এই মর্মে কংগ্রেস প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলেই দেশবাসী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে সমর্থন করেছিল। সেজন্যে আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মনীতি ও পন্থা স্থির করার সময় সাময়িকভাবে আপস করার নীতিটি আমরা একেবারে বর্জন করতে পারি।

অসহযোগ এবং আইন অমান্য আন্দোলনের মাধ্যমে শাসনকার্য অচল করে দিয়ে কংগ্রেস রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের আশা করেছিল। এখন আমাদের ব্যর্থতার কারণগুলি বিশ্লেষণ করা দরকার যাতে আমরা ভবিষ্যতে আরও সফল হতে পারি।

ভারতের ব্রিটিশ সরকারের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সম্পর্ক তুলনা করে বলা যায়, এ যেন সশস্ত্র এবং প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছুর দ্বারা সুসজ্জিত একটি দুর্গ একটি দেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এবং সেখানকার অধিবাসীরা হঠাৎ শত্রু হয়ে উঠেছে। একটি দূর্গ যতই সুসজ্জিত হোক না কেন, নিরাপদে সারাক্ষণ টিকে থাকার জন্যে এর চারপাশে এবং কাছাকাছি অঞ্চলে বন্ধুভাবাপন্ন মানুষের বসবাস থাকা দরকার। চারপাশের লোকেরা বিদ্রোহী হয়ে উঠলেও যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা সক্রিয়ভাবে দুর্গটি অধিকার করতে চেষ্টা করে ততক্ষণ পর্যন্ত নিকট ভবিষ্যতে দুর্গের কোনও বিপদের আশঙ্কা নেই। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্য হল যে দুর্গটি এখন ব্রিটিশ সরকার অধিকার করে আছে তা দখল করা। এই লক্ষ্য সাধনের জন্যে যেসব মানুষ দুর্গের চারদিকে এবং দুর্গের কাছাকাছি অঞ্চলে বাস করছে তাদের সহানুভূতি এবং সাহায্য লাভ করতে কংগ্রেস সফল হয়েছে। ভারতীয় দলের পক্ষে এটাই হল আক্রমণের প্রথম পদক্ষেপ। পরবর্তী পর্যায়ে নিম্নোক্ত যে কোনও একটি বা দু’টি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

(১) দুর্গের সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অবরোধ। এতে দুর্গের সৈন্যরা অনাহারে বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করবে।

(২) সশস্ত্র অভিযান করে দুর্গ অধিকারের চেষ্টা করা।

যুদ্ধের ইতিহাসে দেখা গেছে এই দুটি উপায় অবলম্বন করে সফল হওয়া যায়। গত মহাযুদ্ধে জার্মানী সামরিক শক্তির দিক থেকে শক্তিশালী হলেও, মিত্রপক্ষের অর্থনৈতিক অবরোধের জন্যে সে অনাহারে থেকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। সমুদ্রের ওপর এবং জার্মানীর সঙ্গে যোগাযোগকারী সব রাস্তার ওপর মিত্রপক্ষের আধিপত্য থাকার দরুন এমন অর্থনৈতিক অবরোধ করা সম্ভব হয়েছিল।

কংগ্রেস যেহেতু অহিংস-নীতি অনুসরণে অঙ্গীকারবদ্ধ ও সেজন্যে ভারতে শত্রুর দুর্গের উপর সশস্ত্র আক্রমণের কোনও চেষ্টা করা হয়নি। কংগ্রেস সাধারণভাবে অর্থনৈতিক অবরোধ শুরু করলেও তিনটি কারণে তা ব্যর্থ হয়েছে।

(ক) ভারতের সঙ্গে বিদেশের সব যোগাযোগ ব্যবস্থা সরকার নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।

(খ) ভারতের ভিতরকার সংগঠনের ত্রুটির জন্যে সমুদ্রবন্দর থেকে দেশের অভ্যন্তরে এবং দেশের এক বন্দর থেকে আর এক বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ কংগ্রেস করে না, করে সরকার।

(গ) রাজস্ব আদায়, যার ওপর ভারতে ব্রিটিশ সরকারের অস্তিত্ব নির্ভর করে, তার ব্যবস্থা গুরুতরভাবে ব্যাহত হয়নি। সন্দেহ নেই, বেশির ভাগ প্রদেশে ঘাটতি দেখা দিয়েছে কিন্তু সরকার হয় বাড়তি কর চাপিয়ে কিংবা ঋণ করে সে ঘাটতি পূরণ করতে সমর্থ হয়েছে।

সর্বদা মনে রাখা দরকার, জাতীয় আন্দোলনের তরফে নিম্নোক্ত ব্যবস্থার যে কোনও একটি বা সবগুলি গ্রহণ করলেই বিদেশী সরকারকে অচল করা যেতে পারে।

(১) কর এবং রাজস্ব আদায়ে বাধা দেওয়া।

(২) এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে সঙ্কটের সময় সরকারের কাছে অন্য কোনও তরফ থেকে অর্থনৈতিক বা সামরিক কোনও সাহায্য আসতে না পারে।

(৩) ভারতে ব্রিটিশ সরকারের সমর্থনকারীদের, অর্থাৎ সৈন্যবাহিনী, পুলিশ ও সিভিল সার্ভিসের কর্মচারীদের সহানুভূতি ও সমর্থন অর্জনে সক্ষম হওয়া। এর ফলে আন্দোলন ব্যর্থ করার জন্যে সরকারি হুকুমনামা আর পালন করা যাবে না।

(৪) সশস্ত্র অভিযান করে ক্ষমতা দখলের জন্যে প্রকৃত চেষ্টা করা।

শেষের পন্থাটি বাদ দেওয়া যেতে পারে কারণ কংগ্রেস অহিংস পন্থায় বিশ্বাসী। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলি যদি আমরা গ্রহণ করি তাহলে বর্তমান শাসনব্যবস্থাকে অচল করা এবং তাকে নতি স্বীকারে বাধ্য করা যেতে পারে।

(১) কর এবং রাজস্ব আদায়ে বাধা দেওয়া।

(২) শ্রমিক এবং কৃষকদের এমনভাবে সংগঠিত করা যাতে বিপদের সময় সরকারের কাছে সব রকম সাহায্য আসা বন্ধ হয়।

(৩) উন্নততর প্রচারের মাধ্যমে সরকারের নিজস্ব সমর্থকদের সহানুভূতি ও সমর্থন আদায়ে সমর্থ হওয়া।

এই তিনটি ব্যবস্থা গৃহীত হলে সরকারের শাসনযন্ত্র অচল হয়ে পড়বে। প্রথমত, শাসন কাজের ব্যয় নির্বাহের জন্যে কোনও অর্থ পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, যে আদেশ তারা জারি করবেন, তাঁদের কর্মচারীরাই তা পালন করবে না। এবং অন্য কোনও স্থান থেকে কোনও সাহায্য সরকারের কাছে এসে পৌঁছবে না।

রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের জন্যে কোনও সহজ পথ নেই। জয়লাভ করতে হলে উপরের তিনটি উপায়, আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে, গ্রহণ করতে হবে। এই তিনটি পন্থার কোনওটিই ভালভাবে কাজে পরিণত না করার জন্যেই কংগ্রেস ব্যর্থ হয়েছে। গত কয়েক বছরে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণ সভা, শোভাযাত্রা এবং বিক্ষোভ নিঃসন্দেহ মানুষের সব কিছু অগ্রাহ্য করার মনোভাব প্রমাণ করে এবং এর ফলে তারা সরকারের কিছুটা বিরক্তি উৎপাদন করলেও তা সরকারের আসল অস্তিত্বের কোনও বিপদ ঘটায়নি। আমাদের সমস্ত বিক্ষোভ এবং ১৯৩২ সালের জানুয়ারি মাসের পর থেকে সত্তর হাজার মানুষ কারাবরণ করলেও সরকার এখনও দাবি করতে পারে যে,

(১) তাদের সৈন্যবাহিনী এখনও অনুগত।

(২) তাদের পুলিশবাহিনী এখনও অনুগত।

(৩) সাধারণ শাসন কাজের (রাজস্ব আদায়) আদালত এবং কারাগার ইত্যাদির কাজে কোনও ক্ষতি হয়নি।

(৪) সরকারি কর্মচারী এবং তাদের সমর্থকদের জীবন ও সম্পত্তি এখনও বাস্তবিকই নিরাপদ।

সরকার এখনও গর্ব করতে পারে ভারতের জনসাধারণ তাদের নিষ্ক্রিয় বিরুদ্ধাচরণ করলেও সরকারের কিছুই যায় আসে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না জনগণ সশস্ত্র বিদ্রোহ বা কার্যকরী অর্থনৈতিক অবরোধের দ্বারা সরকার বা তার সমর্থকদের বিপদের কারণ না হয়ে উঠছে, আমাদের অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলন সত্ত্বেও বর্তমান সরকার অনির্দিষ্ট কালের জন্যে টিকে থাকবে।

গত দশকে সারা ভারতব্যাপী এক অভূতপূর্ব জাগরণ ঘটেছে। মানুষের মন থেকে শান্ত আত্মতৃপ্তির ভাব দূর হয়েছে। সারা দেশ এক নতুন চেতনায় চঞ্চল হয়ে উঠেছে এবং স্বাধীনতার আকাঙক্ষায় ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। লোকের মন থেকে সরকারি ভ্রূকুটি, কারাবাস বেটন দিয়ে প্রহারের ভয় দূর হয়েছে। ব্রিটিশ সরকারের সম্মান একবারে নীচের স্তরে এসে পৌঁছেছে। ভারতীয়দের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি সদিচ্ছা জানানোর কোনও প্রশ্ন আর নেই। ব্রিটিশ শাসনের নৈতিক ভিত্তিটা ভেঙ্গে পড়েছে এবং তা এখন আর কিছু নয়, কেবলমাত্র উন্মুক্ত তরবারির ওপর নির্ভর করছে। এবং ভারত পৃথিবীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে।

কিন্তু একথা মনে রাখা ভাল যে “স্বাধীন ভারত” এখনও ভবিষ্যতের কথা। ভারতীয়দের আশা আকাঙক্ষার প্রতি ব্রিটিশ সরকারের মনোভাব যা সম্প্রতি প্রকাশিত শ্বেতপত্রে (White Paper) লিপিবদ্ধ হয়েছে তাতে দেখা যায় যে তারা আসল ক্ষমতার একটি বিন্দুও হাতছাড়া করতে প্রস্তুত নয়। আপাতদৃষ্টিতে, ব্রিটিশ সরকার মনে করে যে ভারতের জনগণের দাবি কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করার মতো ক্ষমতা তাদের আছে। তারা যদি আমাদের প্রতিরোধ করার মতো শক্তিশালী হয় তাহলে বুঝতে হবে যে ১৯২০ সাল থেকে ভারতীয় জনগণের এত শ্রমসাধ্য চেষ্টা আমাদের লক্ষ্য “স্বরাজ” লাভের কাছাকাছি আমাদের পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

সেজন্যে আরও বৃহত্তর ও সুতীব্র ভাবে একটি আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত ভারতের নেওয়া উচিত। এর জন্যে মানসিক এবং কার্যকর প্রস্তুতি হওয়া উচিত বিজ্ঞানসম্মতভাবে এবং তার ভিত্তি হবে বাস্তব অভিজ্ঞতা।

মানসিক প্রস্তুতি বলতে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলি বোঝাবেঃ

(ক) ভারতীয় জনগণের সম্পর্কের নিরিখে ব্রিটিশ শাসনের ভাল ও মন্দ দিকটি বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা।

(খ) ভারতে ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে ভারতীয় জনগণের মনোভাবের ভাল ও মন্দ দিকটি বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা।

(গ) পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা।

(ঘ) অন্যান্য দেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং পৃথিবীতে সবিস্তারে স্বাধীনতার ক্রমবিকাশ বিষয়টির বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা।

এই রকম বিচার শেষ হওয়ার পরে—তার আগে কোনমতেই নয়—আমরা আমাদের ভবিষ্যতের করণীয় কাজের গুরুত্ব সম্পর্কে একটা ধারণা করতে সক্ষম হব।

আমাদের পরবর্তী প্রয়োজন হল একদল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ পুরুষ ও নারী যারা, যতই দুঃখ ভোগ এবং ত্যাগ স্বীকার করতে হোক না কেন, ভারতকে শৃঙ্খলমুক্ত করার ব্রত গ্রহণ করবে। ভারত স্বাধীন হবে কি না এবং আবার সে স্বাধীন দেশের মতো বেঁচে থাকবে কি না সেটা নির্ভর করবে ভারতে উপযুক্ত নেতার সৃষ্টির ওপর। উপযুক্ত নেতা সৃষ্টি করতে পারার ক্ষমতাই প্রমাণ করবে ভারতের জীবনশক্তি এবং “স্বরাজ”লাভের জন্যে তার যোগ্যতা।

এরপরে আমাদের দরকার হল বিজ্ঞানসম্মত কর্মপ্রণালী এবং ভবিষ্যতের জন্যে বিজ্ঞানসম্মত কর্মসূচী। কাজ শুরু করার প্রথম দিন থেকে ক্ষমতা দখলের সময় পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটি মানুষের পক্ষে যতটা সম্ভব সেইমত ভেবে নিয়ে বিস্তারিতভাবে কর্মপরিকল্পনা স্থির করতে হবে। ইতিহাসের ঘটনাবলী এবং মানুষের স্বভাব বিচার করে আমাদের ভবিষ্যৎ আন্দোলন একটি সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তির ওপর গড়ে তুলতে হবে। এ পর্যন্ত মানুষের অন্তর্নিহিত শুভচৈতন্য এবং রাজনৈতিক আন্দোলন, যার লক্ষ্য আসলে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধন তার দিকে না তাকিয়ে আন্দোলনের আদর্শগত দিকটির কথাই বড় বেশি বলা হয়েছে।

ক্ষমতা অধিকারের জন্যে কর্মপরিকল্পনা ছাড়াও, ভারতে যখন একটি নতুন রাষ্ট্র গঠিত হবে তার জন্যেও একটি কর্মসূচী দরকার হবে। কোনওকিছুই ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধে যেসব নরনারী নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তাঁদেরই নতুন রাষ্ট্র তথা সমগ্র ভারতবাসীকে নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনা এবং তাঁদের উন্নতিবিধানের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। যুদ্ধের পরবর্তীকালের নেতৃত্বদানের জন্যে যদি আমাদের নেতৃবর্গকে শিক্ষা দেওয়া না হয় তাহলে ক্ষমতা দখলের পর বেশ কিছুকাল অরাজকতা দেখা দেবার সম্ভাবনা রয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসী বিদ্রোহের পর যেমন ঘটেছিল ঠিক তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে ভারতে। সেজন্যে স্পষ্টভাবে জানা দরকার, ভারতের যুদ্ধের সময়কার সেনাপতিদেরই যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠনের পরিকল্পনাটি পুরোপুরিভাবে কার্যে পরিণত করতে হবে; এর দ্বারাই যুদ্ধের সময়ে দেশবাসীর মনে যে আশা আকাঙক্ষা জাগিয়ে তোলা হয়েছিল তার যথার্থতা প্রমাণ করা যাবে। নতুন রাষ্ট্র গঠনের পর নতুন প্রজন্মের নরনারীকে উপযুক্তভাবে শিক্ষা না দেওয়া পর্যন্ত এই নেতাদের দায়িত্ব শেষ হবে না। এরই ফলে এই নতুন প্রজন্ম দেশের দায়িত্বভার সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে সক্ষম হবে।

আগামী কালের নেতৃবর্গকে ভারতের পূর্বতন নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে কারণ গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে কঠোর সংগ্রামের পরবর্তী পর্যায়ে যে নীতি, কর্মসূচী, কর্মপন্থা এবং কৌশল নেওয়া দরকার সেসব শেষোক্ত নেতারা যে গ্রহণ করতে পারবেন তার কোনও সম্ভাবনা নেই। ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল, ক্বচিৎ কোনও ঘটনার কথা অবশ্য বাদ দিলে, যে এক যুগের নেতারা পরবর্তী যুগেও সমানভাবে প্রাধান্য বজায় রাখতে পেরেছেন। সময়ই প্রয়োজনীয় নেতৃত্বের জন্ম দেয় এবং ভারতেও এই রকমই ঘটবে।

নতুন দলকে গ্রেট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে ‘জাতীয়’ সংগ্রামে লড়তে হবে এবং নেতৃত্ব দিতে হবে। এ ছাড়াও তারাই হবে নতুন ভারতের রূপকার; যুদ্ধোত্তর সমাজ পুনর্গঠনের দায়িত্ব তাদেরই গ্রহণ করতে হবে। ভারতীয় আন্দোলনের দু’টি পর্যায় আছে। প্রথম পর্যায়ে সংগ্রাম হবে গ্রেট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে এক ‘জাতীয়’ সংগ্রাম, নেতৃত্ব থাকবে ভারতীয় শ্রমিকদের মুখপাত্র একটি “জনগণের দলে”র হাতে। দ্বিতীয় পর্যায়ে হবে ওই একই দলের নেতৃত্বে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে সংঘর্ষ। এবং সংগ্রামের এই পর্যায়ে আমাদের দেশে সত্যিকার সাম্য (সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক) প্রতিষ্ঠার জন্যে সবরকম সুবিধা, স্বাতন্ত্র্য এবং কায়েমি স্বার্থ বিলোপ করতে হবে। অদূর ভবিষ্যতে ভারতকে পৃথিবীর ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা জানি সপ্তদশ শতাব্দীতে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সম্পর্কে তার মতবাদ প্রচার করার জন্যে পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসে ইংল্যাণ্ডের অসাধারণ অবদান রয়েছে। অনুরূপভাবে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে “স্বাধীনতা, সাম্য এবং মৈত্রী”র আদর্শ প্রচার করে ফ্রান্স পৃথিবীর সংস্কৃতির ইতিহাসে এক বিস্ময়কর অবদান রেখেছে। উনবিংশ শতাব্দীতে জার্মানী মার্ক্সীয় দর্শন নামে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য এক উপহার পৃথিবীকে দিয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে সর্বহারার সরকার এবং সর্বহারার সংস্কৃতির মাধ্যমে সর্বহারার (proletarian) বিপ্লব পৃথিবীর সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। ভারতকে আহ্বান করা হবে পৃথিবীর সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এবার পরবর্তী উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্যে।

আমাদের ব্রিটিশ বন্ধুরা কখনও কখনও বলে থাকেন যে, ভারতের বিষয়ে ব্রিটিশ জনসাধারণের মনে কোনও দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই এবং যদি প্রচারের দ্বারা তাদের সহানুভূতি আকর্ষণ করতে পারি তাতে আমরা খুব লাভবান হব। আমার কিন্তু মনে হয় না যে, ভারতের প্রশ্নে ব্রিটিশ জনগণের মন খোলা—কারণ মানুষের পক্ষে তা থাকা সম্ভব নয়। ভারতে শাসন এবং শোষণ একই সঙ্গে চলে। কেবল একদল ব্রিটিশ পুঁজিপতি বা অর্থবিনিয়োগকারী ভারতকে শোষণ করছে না, সমগ্রভাবে গ্রেট ব্রিটেন ভারত শোষণ করছে। ভারতে যে ব্রিটিশ মূলধন নিয়োগ করা হয়েছে তা কেবলমাত্র উচ্চবিত্ত শ্রেণীর কাছ থেকে আসেনি, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এবং কিছু পরিমাণে দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের কাছ থেকেও এসেছে। উপরন্তু, এমনকি গ্রেট ব্রিটেনের শ্রমিকশ্রেণীও চাইবে না যে ল্যাঙ্কাশায়ারের স্বার্থহানি করে ভারতের বস্ত্রশিল্পের প্রসার ঘটুক। সেজন্যে গ্রেট ব্রিটেনের বড় বড় রাজনৈতিক দলের আলোচনা সভায় ভারত বিষয়ে কোনও কথাবার্তা হয়নি। সেজন্যে লন্ডনে শ্রমিক দল শাসন ক্ষমতা লাভ করলেও ভারতে বর্বরোচিত উৎপীড়ন এবং নির্যাতন নীতি অব্যাহত ছিল। আমি জানি, শ্রমিক দলে এমন সদস্য আছেন যাঁরা স্বার্থচিন্তার উর্ধ্বে উঠতে পারেন এবং ভারতের প্রতি ন্যায় বিচার করা হোক তা তাঁরা আন্তরিকভাবে কামনা করেন। কিন্তু তাঁদের আমরা যতই প্রশংসা করি না কেন এবং তাঁদের সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক যতই আন্তরিক হোক না কেন, একথা ভুললে চলবে না যে দলের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা তাঁদের নেই। এবং আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলতে পারি, ডাউনিং স্ট্রিটে সরকার বদল হলে ভারতের অবস্থার কোনও উন্নতি আমরা আশা করি না।

যেহেতু রাজনীতি ও অর্থনীতি ভারতে অঙ্গাঙ্গিভাবে বিজড়িত এবং যেহেতু ভারতে ব্রিটিশ রাজত্ব কেবলমাত্র রাজনৈতিক প্রভুত্বের জন্যে নয়, অর্থনৈতিক শোষণের জন্যেও বিদ্যমান, সেজন্যে আমাদের কাছে প্রাথমিক প্রয়োজন রাজনৈতিক স্বাধীনতা। লক্ষ লক্ষ ক্ষুধিত মানুষকে অন্নদান, তাদের পরিধেয় ও শিক্ষার ব্যবস্থা, দেশবাসীর স্বাস্থ্যের উন্নতি— এসব সমস্যার সমাধান করা যাবে না যতদিন ভারত পরাধীন থাকবে। রাজনৈতিকভাবে ভারতকে স্বাধীন না করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি এবং শিল্পের বিকাশ সাধনের কথা চিন্তা যেন ঘোড়ার আগে গাড়ি জুতে দেবার মতো। আমাদিগকে প্রায়ই জিজ্ঞাসা করা হয়, আমাদের দেশ থেকে ব্রিটিশ শাসন অপসৃত হলে ভারতের অভ্যন্তরীণ অবস্থা কীরকম দাঁড়াবে। ব্রিটিশ প্রচারযন্ত্রকে ধন্যবাদ, পৃথিবীতে প্রচার করা হয়েছে যে ভারতে সব সময় নানা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সংঘাত লেগেই আছে এবং ইংল্যান্ডের ক্ষমতার জোরেই এখানে শান্তি বজায় আছে। পূর্বে ভারতে নিশ্চয়ই নানা রকম অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সংঘাত ছিল, অন্যসব দেশে যেমন থাকে। কিন্তু দেশের লোক নিজেরাই এসব দ্বন্দ্ব মিটিয়েছিল। সেজন্যে সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতের ইতিহাসে এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে যখন মহামতি অশোকের মতো ক্ষমতাশালী সম্রাটদের অধীনে সারা দেশে সুখ শান্তি এবং সমৃদ্ধি বিরাজ করত। কিন্তু এখনকার দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ হল স্থায়ী ধরনের এবং সেগুলি আমাদের দেশের এক তৃতীয় পক্ষের দালালেরা কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করেছে। যতদিন ভারতে ব্রিটিশ শাসন বজায় থাকবে ততদিন ভারতীয়দের মধ্যে সত্যিকার ঐক্য স্থাপন করা যাবে না, এ বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই।

যদিও ইংল্যান্ডের কোনও রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে আমাদের কিছু আশা করার নেই, আমাদের স্বার্থের জন্যেই ভারতের পক্ষ থেকে আন্তজার্তিক স্তরে প্রচার চালানো ভীষণভাবে দরকার। এই প্রচারের সদর্থক ও নঙর্থক দু’টি দিক আছে। নঙ্‌র্থক দিকে আমাদের উচিত হবে পৃথিবী জুড়ে গ্রেট ব্রিটেনের দালালেরা সজ্ঞানে বা অজান্তে ভারতের সম্বন্ধে যে মিথ্যা প্রচার করে আসছে তার প্রতিবাদ করা। আর সদর্থক দিকটি হল, ভারতের ঐশ্বর্যময় সংস্কৃতির সকল দিক এবং সেই সঙ্গে ভারতের অভিযোগের কথা পৃথিবীর মানুষের সামনে তুলে ধরব। বলা বাহুল্য, আন্তর্জাতিক স্তরে প্রচারের একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র হবে লন্ডন। দুঃখের বিষয় কিছুকাল আগে পর্যন্ত আন্তর্জাতিক প্রচারের মূল্য এবং উপযোগিতা ভারতের জাতীয় কংগ্রেস উপলব্ধি করতে পারেনি। কিন্তু এখন আমরা আশা করি, আগামী দিনে আন্তর্জাতিক প্রচারের মূল্য ধীরে ধীরে বেশি করে আমাদের দেশবাসী উপলব্ধি করতে পারবে।

ব্রিটিশের প্রচার দক্ষতাকে আমি যেমন প্রশংসা করি, বোধ করি সে রকম জিনিস আর কিছু নেই। একজন ব্রিটিশ জন্ম-প্রচারক, তার কাছে হাউইটজারের চেয়েও প্রচার হল বেশি শক্তিশালী। ইউরোপের আর একটি দেশ ব্রিটেনের কাছ থেকে এই শিক্ষা গ্রহণ করেছে। সেই দেশটি হল রাশিয়া। এবং এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, ব্রিটেন মনে মনে ভীষণভাবে রাশিয়াকে অপছন্দ করে। ব্রিটেনের সাফল্যের গোপন রহস্য রাশিয়া জানতে পেরেছে, এজন্যে ব্রিটেন রাশিয়াকে ভয়ও করে।

ব্রিটিশ দালালেরা ভারতের সম্পর্কে এত বিরুদ্ধ প্রচার পৃথিবীতে করেছে যে, আমরা যদি ভারতের প্রকৃত অবস্থা এবং ব্রিটেনের বিরুদ্ধে তার অভিযোগগুলি উল্লেখ করি তাহলে আমরা পৃথিবীর বহুলাংশের সহানুভূতি লাভ করতে সমর্থ হব। যেসব বিষয়ে পৃথিবী জুড়ে সক্রিয়ভাবে প্রচার করা দরকার তার কয়েকটি এখন আমি উল্লেখ করছি।

(১) ভারতে রাজবন্দীদের প্রতি দুর্ব্যবহার এবং দীর্ঘকালের জন্যে অস্বাস্থ্যকর আন্দামান দ্বীপে রাজবন্দীদের প্রেরণ করা। আন্দামানে সম্প্রতি অনশন ধর্মঘটে দু’জন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে।

(২) ভারতীয়দের পাসপোর্ট দেওয়ার বিষয়ে সরকারের চরম প্রতিহিংসামূলক আচরণ। (ভারতের বাইরে অনেকেই জানে না যে ভারত থেকে বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে অসংখ্য ভারতীয়কে এবং বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের দেশে ফেরার জন্যে পাশপোর্ট মঞ্জুর করা হয়নি।)

(৩) অসহায় গ্রামের লোকেদের ভয় দেখানোর জন্যে ভারতে, বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে, বিমান থেকে নিয়মিত বোমাবর্ষণ।

(৪) ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের দেশীয় শিল্পগুলি, জাহাজ নির্মাণ শিল্প-সহ, জোর করে নষ্ট করা।

(৫) Ottawa Pact-সহ যে কোনও Imperial Preference সংক্রান্ত কোনও প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভারতের ব্যাপক এবং গণ-প্রতিবাদ। (জগতবাসীকে জানানো দরকার যে ভারত কখনও Ottawa Pact-এ সম্মত হয়নি। জোর করে তা আমাদের স্বীকার করতে বাধ্য করা হয়।)

(৬) শুল্কসংক্রান্ত কোনও চুক্তির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভারতের প্রতিবাদ জ্ঞাপন। কারণ তার শিশু শিল্পগুলিকে রক্ষা করতে ভারত একান্তভাবে ইচ্ছুক।

(৭) বিনিময় হার ইংল্যান্ড নিজের খুশিমত এমনভাবে স্থির করেছে যা ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী। জগৎবাসীকে জানানো উচিত বিনিময় হার নিজের সুবিধামত স্থির করে গ্রেট ব্রিটেন কীভাবে ভারতের কোটি কোটি টাকা লুট করেছে।

(৮) এছাড়া, জগতবাসীকে জানানো দরকার যে অধিক পরিমাণে সরকারের ঋণের বোঝা ভারতের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতারা এই ঋণের দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। পূর্বেই ১৯২২ সালে গয়া অধিবেশনে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সরকারকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল যে তারা সরকারি ঋণের দায়িত্ব স্বীকার করতে রাজি নয়। একথা সবারই জানা আছে যে, এই ঋণ করা হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের স্বার্থে, ভারতের উপকারের জন্যে নয়।

World Economic Conference ও Disarmament Conference-এর জন্যে ভারতের পক্ষ থেকে প্রচার করা এখন খুব জরুরি এবং প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সযত্নে রচিত একটি স্মারকলিপি যাতে গ্রেট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে ভারতের অভিযোগগুলি এবং অর্থনৈতিক বিষয়ে ভারতের সত্যকার বক্তব্য উল্লেখ করা থাকবে, সেটি World Economic Conference-এর সকল সদস্যের কাছে পেশ করা দরকার।

নিরস্ত্রীকরণ প্রশ্নটি প্রসঙ্গে জগতবাসীকে ভারতের বলা উচিত, ভারতকে একটি পরীক্ষামূলক বিষয় ধরে ব্রিটিশদের আন্তরিকতার পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। যে দেশের মানুষকে গত আশি বছর ধরে নিরস্ত্র করে রাখা হয়েছে এবং যেখানকার সকল মানুষই একরকম হীনবীর্য, সেদেশে কেন্দ্রীয় রাজস্বের পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি পরিমাণ সামরিক খাতে ব্যয় করবার কী যুক্তি থাকতে পারে?

আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, এই প্রসঙ্গে সকল তথ্য যদি পৃথিবীর মানুষের গোচরে আনা যায় তাহলে এটি ইংল্যান্ডের কাছে একটি উত্তর-দেওয়ার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।

যখনই ভারতের বিষয় কোনও World Congress বা World Conference-এর সামনে উত্থাপিত করা হয় তখনই গ্রেট ব্রিটেনের সমর্থকরা সাধারণ অজুহাত হিসাবে বলে থাকেন যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে ভারত হল এক অভ্যন্তরীণ সমস্যা। এই যুক্তিটি ভারতবাসীদের আর স্বীকার করা উচিত নয়। ভারত যদি লীগ অব নেশনসের সদস্য হয়ে থাকে তাহলে সে নিশ্চয়ই একটি দেশ এবং একটি দেশের যেসব অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থাকে ভারতেরও তাই আছে। আমি জানি, আন্তজার্তিক প্রেক্ষাপটে ভারতের পদমর্যাদার পরিবর্তন ঘটাতে হলে আমাদের কঠোরভাবে, নিরলসভাবে চেষ্টা করে যেতে হবে। সে যাই হোক, আর দেরি না করে এখনই চেষ্টা শুরু করা একান্ত প্রয়োজন।

শ্বেতপত্রের পুঙ্খনাপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করা আমার পক্ষে দরকার নেই, কারণ তা এমন বিচারের যোগ্য নয়। আমি কেবল এইমাত্র বলতে পারি, রাজন্যবর্গের সঙ্গে ফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব একটি অবাস্তব এবং অগ্রহণীয় ব্যাপার। আমরা নিশ্চয়ই সারা ভারতের ঐক্যসাধন অথাৎ ভারতীয় জনগণের একটি ফেডারেশন-এর জন্যে কাজ করব। কিন্তু আমরা মিঃ র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ড কিংবা লর্ড সাঙ্কির খেয়ালকে তৃপ্ত করার জন্যে আইনসভায় বর্তমান সরকারি দলের স্থানে রাজন্যবর্গকে গ্রহণের প্রস্তাব স্বীকার করতে পারি না। একই নিঃশ্বাসে “স্বাধীনতা” এবং “রক্ষাকবচ”-এর কথা বলা অর্থহীন। আমাদের যদি স্বাধীনতা লাভ করতে হয় তাহলে রক্ষাকবচের কথা ওঠে না, কারণ স্বাধীনতা নিজেই একটি রক্ষাকবচ যা আমরা পেতে চাই। ‘ভারতের স্বার্থে রক্ষাকবচে’র কথা বলা নিছক আত্ম-প্রবঞ্চনা মাত্র।

এখন বলা সম্ভব নয় কখন আমরা সেই সংবিধান লাভ করব যা জনগণের হাতে কিছু প্রকৃত ক্ষমতা তুলে দেবে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যখন আমরা ক্ষমতা লাভ করব তখন জনগণ অস্ত্রবহনের অধিকারের জন্যে জিদ করবে। তারা পৃথিবীর লোককে, বিশেষ করে ব্রিটিশ সরকারকে বলবে, “নিরস্ত্র হও, নতুবা আমরা অস্ত্র ধরব”। এই দুঃখপীড়িত পৃথিবীতে স্বেচ্ছায় নিরস্ত্রীকরণ যখন বিরাট আশীর্বাদ, তখন প্রায় আশি বছর ধরে পদানত একটি জাতিকে জোর করে নিরস্ত্রকরানো, যা আমরা ভারতে দেখছি, এক ভয়ানক অভিশাপ। ব্রিটেনের তরফে যুদ্ধ বিরতির উচ্চকিত দম্ভোক্তি সুস্থ জীবনের শান্তি নয়, কবরের শাস্তিমাত্র।

নিজের অস্তিত্বের যথার্থতা প্রমাণ করতে গেলে নতুন দলটিকে যে দ্বৈতভূমিকা পালন করতে হবে সেকথা পূর্বেই বলেছি। রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিকার এবং তারপর একটি নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়তে হলে আমাদের জনগণকে এখন থেকেই সে কাজের জন্যে শিক্ষা দেওয়া উচিত। আমার কোনও সন্দেহ নেই যে, জাতীয় জীবনের সমস্যাগুলির সমাধানের বিষয়ে যদি আমাদের সফল হতে হয় তাহলে ভারত স্বাধীন হলে তখন অনেক মৌলিক চিন্তাভাবনা এবং নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার হবে। পুরনো কালের মানুষেরা এবং অতীতের শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা বিশেষ কাজে লাগবে না। এখনকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার চেয়ে স্বাধীন ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থা হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। শিল্প, কৃষি, ভূমি-রাজস্ব, অর্থ বিনিময়, মুদ্রাব্যবস্থা, শিক্ষা, কারা-শাসন, জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে নতুন নিয়মকানুন এবং নতুন পরীক্ষা ব্যবস্থা উদ্ভাবন করতে হবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, জমির অবস্থা এবং ভূমিসংক্রান্ত অন্যান্য তথ্যাদির কথা মনে রেখে রাশিয়াতে একটি জাতীয় (বা রাজনৈতিক) অর্থনৈতিক পরিকল্পনা স্থির করা হয়েছে। ভারতেও ওই একই ব্যাপার ঘটবে। আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা দূরীকরণে Pigou কিংবা Marshall আমাদের খুব সাহায্য করবেন না।

ইউরোপ এবং ইংল্যান্ডে ইতিমধ্যে জীবনের সর্বক্ষেত্রে পুরনো তত্ত্ব বাতিল করে নতুন তত্ত্ব গ্রহণ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ Silvio Gesell-উদ্ভাবিত নতুন Free Money তত্ত্বের কথা বলা যেতে পারে। জার্মানীর একটি ছোট সম্প্রদায়ের জীবনে এই তত্ত্ব প্রয়োগ করে আশানুরূপ ভাল ফল পাওয়া গেছে। ভারতে একই ব্যাপার ঘটবে। স্বাধীন ভারত পুঁজিপতি, জমিদার বা কোন সম্প্রদায়ের (castes) দেশ হবে না। স্বাধীন ভারত হবে এক সামাজিক এবং রাজনৈতিক গণতন্ত্র। বর্তমান কালের ভারতের চেয়ে স্বাধীন ভারতের সমস্যা হবে বেশ ভিন্ন ধরনের। এবং সেজন্যেই মানুষকে এখন থেকে শিক্ষিত করা দরকার, যাতে এরা ভবিষ্যতের কথা ভাবতে পারে, স্বাধীন ভারতের প্রয়োজন হিসাবে চিন্তা করতে পারে এবং আগে থেকেই ভেবে নিয়ে সেই সমস্যা সমাধান করতে পারে। সংক্ষেপে বলা যায়, আজ থেকেই স্বাধীন ভারতের মন্ত্রিসভার সদস্যদের শিক্ষা দেওয়া দরকার।

প্রত্যেকটি বড় আন্দোলন একটি ছোট ঘটনা থেকে শুরু হয়। ভারতেও তাই ঘটবে। আমাদের প্রথম দায়িত্ব হবে একদল নরনারীকে একত্র করা, যারা আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে যে পরিমাণ দুঃখ কষ্ট ভোগ ও ত্যাগস্বীকার করা দরকার, সে সবের মধ্য দিয়ে যেতে প্রস্তুত। তারা হবে সবসময়ের কর্মী, ‘স্বাধীনতা-অনুপ্রাণিত’ একদল নিবেদিতপ্রাণ কর্মী, যারা ব্যর্থতার জন্যে নিরাশ হবে না, কোনও বিপদে কাজ থেকে নিবৃত্ত হবে না এবং প্রতিজ্ঞা করবে মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করবে।

মনের দিক থেকে প্রস্তুত এই রকম নরনারীর দেখা পাওয়া গেলে, তাদের প্রয়োজনীয় মানসিক বৃত্তি বিকাশের জন্যে এমনভাবে শিক্ষা দিতে হবে যাতে তারা তাদের দায়িত্বের সমধিক গুরুত্ব ঠিকমত উপলব্ধি করতে পাবে। তাদিকে অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়টি বিজ্ঞানসম্মতভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। এভাবেই তারা অনুরূপ বিপদের মধ্যে অনুরূপ সমস্যার কীভাবে সমাধান করা যায় তা জানতে পারবে। এরই পাশাপাশি তারা অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন যুগে ভিন্ন ভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যের উত্থান পতনের বিষয়টিও বিজ্ঞানসম্মতভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করবে। এইসব জ্ঞানে বলীয়ান হয়ে ভারতীয়দের সঙ্গে ভারতের ব্রিটিশ সরকারের সম্পর্কের জোরালো এবং দুর্বল দিক এবং ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে ভারতীয়দের সম্পর্কের জোরালো ও দুর্বল দিক বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরীক্ষা করে দেখা উচিত। এভাবে মানসিক শিক্ষা গ্রহণ শেষ হবার পর, কোনও কর্মপরিকল্পনা অনুসারে ক্ষমতা দখল সম্ভব হতে পারে সে বিষয়ে আমাদের একটি স্পষ্ট ধারণা জন্মাবে। ক্ষমতা দখলের পর নতুন রাষ্ট্র জন্ম নিলে তখন কোনও কর্মসূচী অনুসরণ করা যেতে পারে সে বিষয়েও আমাদের স্পষ্ট ধারণা হবে। এ থেকেই প্রতীয়মান হবে যে, আমরা চাই একদল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নরনারী, যারা এক মহৎ উদ্দেশ্য সাধনে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে, যারা প্রয়োজনীয় শিক্ষালাভ করেছে এবং ক্ষমতা দখলের পূর্বে ও পরে কী করা উচিত সে বিষয়ে যাদের স্পষ্ট ধারণা আছে।

এই দলের কাজ হবে বিদেশী শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করা। এই দলের কাজ হবে ভারতে এক নতুন, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করা। এই দলের কাজ হবে যুদ্ধোত্তর আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠনের কর্মসূচী সম্পূর্ণভাবে বাস্তবে রূপায়িত করা। এই দলের কাজ হবে সুশিক্ষিত এবং জীবনযুদ্ধের জন্যে সুসজ্জিত ভারতের এক নতুন প্রজন্মকে তৈরি করা। সবশেষে বলা যায়, এই দলের কাজ হবে জগতের স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যে ভারতকে তার সম্মানের আসনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

এই দলটিকে বলা যেতে পারে সাম্যবাদী সংঘ। এটি হবে একটি কেন্দ্রীয় শৃঙ্খলাবদ্ধ সর্বভারতীয় দল। তা সমাজের সকল শ্রেণীর মধ্যে কাজ করবে। এই দলের প্রতিনিধিরা ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস, কৃষক সংগঠন, নারী সংগঠন, যুব সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, অনুন্নত জাতি সংগঠন, এবং প্রয়োজনবোধে বৃহত্তর স্বার্থে, ছোট সম্প্রদায় বা সাম্প্রদায়িক দলের মধ্যে কাজ করবে। দলের বিভিন্ন শাখা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করলেও তারা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকবে।

পুরোপুরিভাবে বা অংশত একই লক্ষ্যে কাজ করছে এমন দলের সহযোগিতায় এই দল কাজ করবে। কোনও ব্যক্তি বা দলের প্রতি এই দল কোনও বিদ্বেষপোষণ করবে না। একই সঙ্গে এই দলটি মনে রাখবে যে, ইতিহাসে একটি বিশেষ ভূমিকা তাদের পালন করতে হবে। সেই ভূমিকার কথা পূর্বে বলা হয়েছে।

সাম্যবাদী সংঘের কাজের যে বিবরণ পূর্বে দিয়েছি তা ছাড়া নতুন দলের আদর্শ এবং লক্ষ্যের বিষয়ে সাধারণভাবে প্রচারের জন্যে সারা দেশে শাখা স্থাপন করতে হবে। সমাজবাদী সংঘের লক্ষ্য হল ভারতীয় জনগণের সর্বাঙ্গীণ স্বাধীনতা— সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা। যতদিন না দেশের জনগণ প্রকৃতভাবে স্বাধীন হয় ততদিন এই দল সবরকম দাসত্বের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করবে। এই দলের লক্ষ্য ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা—ন্যায়, সাম্য ও স্বাধীনতার চিরন্তন নীতির ভিত্তির ওপর স্বাধীন ভারতে এক নতুন রাষ্ট্রগঠন। ভারতের লক্ষ্যের চূড়ান্ত সিদ্ধির জন্য এই দল সংগ্রাম করবে, যার ফলে যুগ যুগ ধরে বহমান ঐতিহ্যের বাণী ভারত পৃথিবীতে ঘোষণা করবে।

১. মহাত্মা গান্ধীর হঠাৎ আইন অমান্য আন্দোলন স্থগিত করা বিষয়টির ইঙ্গিত করা হয়েছে। —সম্পাদক

Third Indian Political Conference (লন্ডন ১০ জুন ১৯৩৩)-এ সভাপতির অভিভাষণ; অনুপস্থিতিতে পঠিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *