সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর বাড়ির পাশেই ছিল মুসলমানপাড়া। জমিদারি শিলাইদহের কাছেও মুসলমান বসতি ছিল; মুসলমান সম্প্রদায়কে প্রতিবেশী হিসেবে খুব কাছ থেকেই তিনি দেখেছিলেন। তাঁদের সম্বন্ধে জেনেছিলেন তাঁদের সঙ্গে মিশে, পড়ে ও আলাপ আলোচনায়। আর নিজস্ব চর্চা অধ্যয়ন এবং ক্ষিতিমোহন সেনের সাহচর্যে বাংলার তথা ভারতবর্ষের সংস্কৃতি যে হিন্দু-মুসলমানের যৌথ প্রয়াসের সৃষ্টি, তাও ভাল করেই বুঝেছিলেন। বিংশ শতকের শুরুর দিকে হিন্দুত্ব সম্বন্ধে তাঁর পূর্ব কয়েক বৎসরে যে মোহ জন্মেছিল, তাও কেটে গেল। ১৯০৮ সালে ‘রাজাপ্রজা’ প্রবন্ধে লিখলেন, ‘বর্তমানকালে হিদুয়ানির পুনরুত্থানের যে একটা হাওয়া উঠিয়াছে তাহাতে সর্বপ্রথমে ঐ অনৈক্যের ধুলা সেই প্রাদেশিক ও ক্ষণিক তুচ্ছতাগুলিই উড়িয়া আসিয়া আমাদের আচ্ছন্ন করিয়াছে।’ ওই বছরেই ‘সমূহ’ প্রবন্ধে লেখেন, ‘বাহির হইতে এই হিন্দমুসলমানের প্রভেদকে যদি বিরোধে পরিণত করিবার চেষ্টা করা হয় তাহাতে আমরা ভীত হইব না— আমাদের নিজেদের ভিতরে যে ভেদবুদ্ধির পাপ আছে তাহাকে নিরস্ত করিতে পারিলেই আমরা পরের কৃত উত্তেজনাকে অতিক্রম করিতে নিশ্চয় পারিব।’ সাম্প্রদায়িক রোগনির্ণয়ের দৃষ্টি তাঁকে জানিয়েছিল যে, বাইরের প্ররোচনা কখনওই মারাত্মক আকারে দেখা দিতে পারে না, যদি দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মন পরস্পর সম্বন্ধে নির্মল ও সৌভ্রাত্রপূর্ণ থাকে।
ওই ১৯০৮ সালেই ‘রাজাপ্রজা’ প্রবন্ধের এক জায়গায় বলছেন, ‘হিন্দুমুসলমান এক হইলে পরস্পরের কত সুবিধা, কোনো সভায় মুসলমান শ্রোতাদিগকে তাহাই বুঝাইয়া বলা হইতেছিল, তখন আমি এই কথাটি না বলিয়া থাকিতে পারি নাই যে সুবিধার কথাটা এস্থলে মুখে আনিবার নহে; দুই ভাই এক হইয়া থাকিলে বিষয়কর্ম ভাল চলে, কিন্তু সেইটাই দুই ভাই এক হইয়া থাকিবার প্রধান হেতু হওয়া উচিত নহে।… আসল কথা, আমরা এক দেশে এক সুখদুঃখের মধ্যে একত্রে বাস করি, আমরা মানুষ, আমরা যদি এক না হই তবে সে লজ্জা, সে অধর্ম।… শুধু সুবিধা নহে, অসুবিধাও একত্রে ভোগ করিতে প্রস্তুত যদি না হই তবে আমাদের মনুষ্যত্বে ধিক। আমাদের পরস্পরের মধ্যে সুবিধার চর্চা নহে, প্রেমের চর্চা, নিঃস্বার্থ সেবার চর্চা যদি করি তবে সুবিধা উপস্থিত হইলে তাহা পুরা গ্রহণ করিতে পারিব এবং অসুবিধা উপস্থিত হইলেও তাহাকে বুক দিয়া ঠেকাইতে পারিব।’ মূলত প্রতিবেশী হিসেবে, ভাই হিসেবে, স্বদেশবাসী হিসেবে হিন্দুমুসলমানের সম্পর্ক যে ভাই-ভাইয়ের সম্পর্ক এ নিয়ে দেশের সকল যথার্থ মহাপুরুষের মতো রবীন্দ্রনাথেরও বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না। হিন্দু বা মুসলমান যদি কেউ ভগবানকে মানে ও বিশ্বপিতা বলে বিশ্বাস করে তবে তো অনিবার্য ভাবে ভগবানের সন্তান হিসেবে দু-সম্প্রদায়ের এবং ভারতবর্ষের ও পৃথিবীর তাবৎ সম্প্রদায়ের সকল মানুষকে ভাই বলে স্বীকার না করাটা মিথ্যাচরণ। আর এর ঊর্ধ্বে যাঁরা উঠতে পেরেছেন, যাঁদের জীবনদর্শনের ছক ঈশ্বর-নিরপেক্ষ, তাঁরা তো অনায়াসেই স্বীকার করেন যে, সব মানুষই পরস্পরের ভাই।
১৯২২ সালে ‘কালান্তর’ প্রবন্ধে লিখলেন, ‘এক সময়ে গ্রিক পারসিক নানা জাতির অবাধ সমাগম ও সম্মেলন ছিল… সে ‘হিন্দু’ যুগের পূর্ববর্তী কালে। হিন্দুযুগ হচ্ছে একটা প্রতিক্রিয়ার যুগ— এই যুগে ব্রাহ্মণ্যধর্মকে সচেষ্ট ভাবে পাকা করে গাঁথা হয়েছিল। দুর্লঙ্ঘ্য আচারের প্রাকার তুলে একে দুষ্প্রবেশ্য করে তোলা হয়েছিল। একটা কথা মনে ছিল না কোনও প্রাণবান জিনিসকে একেবারে আটঘাট বন্ধ করে সামলাতে গেলে তাকে মেরে ফেলা হয়।… এর প্রকৃতিই হচ্ছে নিষেধ ও প্রত্যাখ্যান।’ আজ ‘সঙ্ঘ পরিবার’-এর অভ্যুত্থান ও প্রকোপের কালে এ কথা দ্বিগুণ ভাবে সত্য হয়ে উঠেছে। মুসলমান ভারতবর্ষের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, এ কথা বলে হিন্দু জাতীয়তাবাদ নিজেকে এমন ভাবে সংকুচিত করে তুলেছে আজ, যে তা অমানবিক বলেই অশুচি ও ঘৃণ্য। প্রায় সত্তর বছর আগে কবির দৃষ্টি এই ঠেকিয়ে রাখার নীতি সম্বন্ধে ধিক্কারে সরব ছিল।
ওই ‘কালান্তর’ প্রবন্ধেই বলেছেন, ‘যদি ভাবি, মুসলমানদের অস্বীকার করে এক পাশে সরিয়ে দিলেই দেশের সকল মঙ্গল প্রচেষ্টা সফল হবে, তা হলে বড়ই ভুল করব। ছাদের পাঁচটা কড়িকে মানব, বাকি তিনটে কড়িকে মানবই না, এটা বিরক্তির কথা হতে পার, কিন্তু ছাদরক্ষার পক্ষে সুবুদ্ধির কথা নয়।’ এখানে কবি যে কথাটা বলতে চেয়েছেন তা আজ আরও অনেক বেশি গুরুতর ভাবে উপস্থিত হয়েছে, দেশের স্বার্থরক্ষার কাছে সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষা গৌণ এবং যৌথ ভাবে সব সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষাই যথার্থ ভাবে দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যরক্ষার ও উন্নতির উপায়। কোনও সম্প্রদায়কে সংখ্যাগুরুত্বের জোরে দাবিয়ে রাখার অপচেষ্টা বা ‘কর্মভূমি’ ‘পূণ্যভূমি’ ইত্যাকার ছেঁদো ক্ষুদ্র স্বার্থপ্রণোদিত নীচ কথার উল্লেখ আজ সম্পূর্ণ ভাবে বর্জনীয়, ঘৃণাভরে উপেক্ষণীয়।
‘পরিশেষ’ কাব্যগ্রন্থে কবি মর্মান্তিক সত্যের উচ্চারণ করেন গভীর বেদনাভরে— ‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে/অন্ধ সেজন মারে আর শুধু মরে।/নাস্তিক সে-ও পায় বিধাতার বর, ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।/শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো/শাস্ত্র মানে না মানে মানুষের ভালো।/বিধর্ম বলি মারে পরধর্মেরে/নিজধর্মের অপমান করি ফেরে,/পিতার নামেতে হানে তাঁর সন্তানে,/আচার লইয়া বিচার নাহি কো জানে,/পূজাগৃহে তোলে রক্ত মাখানো ধ্বজা/দেবতার নামে এ যে শয়তান ভজা।/ হে ধর্মরাজ, ধর্মবিকার নাশি/ধর্মমূঢ়জনেরে বাঁচাও আসি।/যে পূজার বেদী রক্তে গিয়েছে ভেসে/ভাঙো ভাঙো, আজি ভাঙো তারে নিঃশেষে, /ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো,/এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।’
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে অনেক বেশি তাৎপর্য পেয়েছে এ কবিতা, এর প্রতিটি ছত্র উচ্চারণ করে আত্মবিচার করবার সময় এসেছে: ‘আমি কি যথার্থই ভারতবর্ষের সব সম্প্রদায়ের মানুষকে আপনজন জ্ঞান করতে পারছি?’ না পারলে আমিই প্রকৃত ভারতবাসী নই।
‘পত্রপুট’ কাব্যগ্রন্থের ১৫নং কবিতায় কবি নিজেদের ধর্মবিশ্বাসের পুনর্মূল্যায়ন করেছেন, একটি অবিনশ্বর সত্যের ঔজ্জ্বল্যে অমর এই কবিতাটি। দু’চারটি ছত্রে তথাকথিত ধর্মবিশ্বাসী ভগবদ্বিশ্বাসীদের থেকে নিজের পার্থক্য সম্বন্ধে সচেতনতার আভাস আছে। ‘আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন,/দেবতার বন্দীশালায় আমার নৈবেদ্য পৌঁছল না।’ ‘আজ আপন মনে ভাবি, কে আমার দেবতা/কার করেছি পূজা।… মন্দিরের রুদ্ধদ্বারে এসে আমার পূজা/বেরিয়ে চলে গেল দিগন্তের দিকে—/সকল বেড়ার বাইরে।’ ‘আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন,/সকল মন্দিরের বাইরে/আমার পূজা আজ সমাপ্ত হল/দেবলোক থেকে মানবলোকে।’ দেশের শ্রেষ্ঠ কবিমনীষীর এই অন্তিম উচ্চারণ এই দুর্দিনে আমাদের প্রেরণা দিক। যেন দেখতে পাই সব ধর্মধ্বজীরাই শেষ পর্যন্ত সিংহাসন-লোভী, স্বার্থান্বেষী, বর্বর ও নির্মম। ধর্মের আড়ালে তাদের লোভের ও রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের উচ্চাশার বেসাতি। যারা সব মানুষকে অন্তর থেকে আপন জেনে, মেনে সেই মতো সৌভ্রাত্রপূর্ণ আচরণ করতে প্রস্তুত নয়, কবি তাদের পামর, মিথ্যাবাদী ও ভণ্ড বলে ধিক্কার দিয়েছেন, শিখিয়েছেন পরস্পরের কাছে মানুষের একমাত্র পরিচয়, সে মানুষ। সেই সুবাদেই সে নির্বিচারে ভাই, সব অধিকারে সম্পূর্ণ সমকক্ষ। এর বিরুদ্ধে যাদের প্রচার ও আচরণ তারা আজ মানবজাতির একান্ত শত্রু। তারা মানববিদ্বেষী, মানব-বিধ্বংসী ক্রিয়াকলাপে রাক্ষসের মতো মানুষের রক্তপানে লোলুপ। তাদের স্বরূপে চিনে নিয়ে সৰ্বতো ভাবে রুখতে আমাদের প্রেরণা দিক কবির উপলব্ধি ও উচ্চারণ।