তত্ত্ব ও ধারণার রাজনীতি
পরিচিতির রাজনীতি
উপস্থাপনের রাজনীতি
অনুভূতির রাজনীতি

সাম্প্রতিক হিন্দি চলচ্চিত্রে ‘নতুন ম্যাসকিউলিনিটি’: একটি নারীবাদী পাঠ – সুস্মিতা ঘোষ

সাম্প্রতিক হিন্দি চলচ্চিত্রে ‘নতুন ম্যাসকিউলিনিটি’ একটি নারীবাদী পাঠ – সুস্মিতা ঘোষ

এই প্রবন্ধের মূল পরিসর হল সমসাময়িক হিন্দি চলচ্চিত্রে ম্যাসকিউলিনিটি বা পুরুষত্বের উপস্থাপনা। বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে হিন্দি চলচ্চিত্রে কীভাবে নতুন ধরনের ম্যাসকিউলিনিটি উপস্থাপিত হয়েছে সেটাই এই প্রবন্ধের উপজীব্য। নতুন ধরনের ম্যাসকিউলিনিটি বলতে আমি এখানে নরম ও অনুভূতিশীল ম্যাসকিউলিনিটির কথাই বলছি যা সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রে বিশেষভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। এই নতুন ম্যাসকিউলিনিটি যেন তথাকথিত নারীসুলভ গুণগুলোকে আত্মস্থ করেছে। উগ্র পৌরুষের পরিবর্তে আমরা এখানে পুরুষকে অনেক বেশি কমনীয় হিসেবে দেখতে পাই। সে যেন নারীর রক্ষক নয় বরঞ্চ অনুভূতিশীল সঙ্গী। এই নতুন পুরুষের বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমি সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রে যৌন রাজনীতির জটিলতাকে বোঝার চেষ্টা করেছি। প্রশ্নটা হল এই ম্যাসকিউলিনিটি কতটা নতুন? তাত্ত্বিক আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে আমি দিল চাহতা হ্যায় ছবিটির নিবিড় পাঠের (Close reading) মাধ্যমে এই বিষয়টা দেখার চেষ্টা করেছি।

এখানে আলোচিত হয়েছে হিন্দি চলচ্চিত্রে পুরুষত্বের বা ম্যাসকিউলিনিটির উপস্থাপনের বিষয়টা, যা সামগ্রিকভাবে নারীবাদী ভাবনার উপর প্রতিষ্ঠিত। সাম্প্রতিক নারীবাদী তত্ত্বে নারীর অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত ম্যাসকিউলিনিটির সীমাবদ্ধতাও গুরুত্ব পেয়েছে। পুরুষ যদি তথাকথিত নারীসুলভ গুণগুলো আত্মস্থ না করে তবে লিঙ্গসাম্যের দাবি কখনওই পূর্ণ হবে না। এই তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যেই এই প্রবন্ধের বিস্তার। প্রশ্ন হল, নতুন ম্যাসকিউলিনিটির যে উপস্থাপনা আমরা দেখেছি তা কি আদৌ লিঙ্গসাম্যের ইঙ্গিত করছে? না কি প্রচলিত ম্যাসকিউলিনিটির নতুন বহিঃপ্রকাশ? হিন্দি চলচ্চিত্রের পরিসরে এই পরিবর্তনটা কি শুধুমাত্র বাহ্যিক? না কি এই পরিবর্তন আমাদের কাঙ্ক্ষিত লিঙ্গসাম্যের সূচনা করে? উপস্থাপনের এই রাজনীতিটাই আমি বোঝার চেষ্টা করছি।

আমি এই প্রবন্ধে এটাই বলতে চাইছি সাম্প্রতিক হিন্দি চলচ্চিত্রে আমরা যে নতুন ধরনের ম্যাসকিউলিনিটির উপস্থাপনা দেখি তা অনেকখানিই নারীবাদী আন্দোলনের ফল। নারীবাদী রাজনীতি যেভাবে সাম্প্রতিক সমাজবাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করেছে তার একটা প্রভাব খুব স্বাভাবিকভাবেই সাম্প্রতিক সাংস্কৃতিক পরিসরে দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক হিন্দি ছবিতে ম্যাসিকিউলিনিটির উপস্থাপনার ক্ষেত্রেও তাই এই প্রভাব উপলব্ধি করা যায়। এই প্রবন্ধে আমি নতুন ধরনের পুরুষদের প্রতিচ্ছবি বোঝার চেষ্টা করেছি নারীবাদী রাজনীতির নিরিখে। এই নতুন পুরুষের উপস্থাপনার বাইরে সাম্প্রতিক ম্যাসকিউলিনিটির অনেক দিক আছে যা বর্তমান যৌন রাজনীতি বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। কিন্তু এই প্রবন্ধের পরিসরে শুধুমাত্র নতুন ধরনের অনুভূতিশীল পুরুষের উপস্থাপনার বিষয়টাই আলোচিত হয়েছে। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন হিন্দি চলচ্চিত্রের পরিসরে নতুন ম্যাসকিউলিনিটির সঙ্গে সঙ্গে প্রথাগত ম্যাসকিউলিনিটির উপস্থাপনাও সমানভাবে বিদ্যমান। প্রকৃতপক্ষে আমরা হিন্দি চলচ্চিত্রের পরিসরে বিভিন্ন ধরনের ম্যাসকিউলিনিটির পাশাপাশি অবস্থান দেখি। এই প্রবন্ধে আমার বক্তব্য হল হিন্দি চলচ্চিত্র এমন একটা পরিসর যেখানে বিভিন্ন ও পরস্পরবিরোধী ম্যাসকিউলিনিটির সহাবস্থান সম্ভব।

হিন্দি চলচ্চিত্র সংক্রান্ত তাত্ত্বিক আলোচনায় যেটা প্রধানত উঠে আসে তা হল আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের নেগোশিয়েশনের প্রশ্নটা। মূলধারার হিন্দি চলচ্চিত্র যেন আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের নেগোশিয়েশনে গড়ে ওঠা বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র। আমাদের আলোচ্য ছবিতেও এই নেগোশিয়েশনের প্রসঙ্গটা ধরা পড়বে। এই প্রবন্ধের পরিসরে তাই নেগোশিয়েশনের প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমি এখানে শুধুমাত্র বিভিন্ন ধরনের ম্যাসকিউলিনিটির অনুসন্ধান করতে চাইনি, বরঞ্চ বিভিন্ন ও পরস্পরবিরোধী ম্যাসকিউলিনিটি কীভাবে সহাবস্থান করে এবং এই সহাবস্থানের ক্ষেত্রে কী ধরনের নেগোশিয়েশন দেখা যায়, সেটাই বোঝার চেষ্টা করেছি। সর্বোপরি হিন্দি চলচ্চিত্রের পরিসরে ম্যাসকিউলিনিটির অনুসন্ধান, বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে আমাদের সার্বিক সাংস্কৃতিক পরিসর ও তার রাজনীতি বোঝার উপায় হতে পারে।

প্রশ্নটা হল সাম্প্রতিক হিন্দি ছবির ম্যাসকিউলিনিটির কি বিশেষ কোনও ধরন আছে? সাম্প্রতিক সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার (Cultural practice) বৃহত্তর চিত্রের সঙ্গে কি এর কোনও সম্পর্ক রয়েছে? বিষয়টা আরও জটিল হয়, যদি প্রশ্ন করি যে বিশ্বায়ন কি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কোনও বিভাজন এনেছে, না কি শুধুমাত্র পুনরুক্তি বা পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে। এই প্রবন্ধে আমি পুনরাবৃত্তির বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিয়েছি। ম্যাসকিউলিনিটির উপস্থাপনা বোঝার ক্ষেত্রে এটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন সাম্প্রতিক সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া সাম্প্রতিক ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার আর্থ-সামাজিক দিকের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতে ‘সংস্কৃতি’কে বুঝতে হলে সহাবস্থানের বিষয়টা বিশেষ মাত্রা পাবে বলে মনে হয়। এই প্রবন্ধে ‘বিশ্বায়ন’, ‘পুরুষত্ব’ বা ‘ম্যাসকিউলিনিটি’ দুটো গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। এই দুটো শব্দ দিয়ে আমরা সাম্প্রতিক হিন্দি চলচ্চিত্রের সাংস্কৃতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি অনেকটাই অনুধাবন করতে পারি। প্রথমে বিশ্বায়ন বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করি। বিশ্বায়ন বলতে আমরা বুঝি গোটা বিশ্বের সংকোচন এবং গোটা পৃথিবীর যোগসূত্রতা। এখানে বলে রাখা ভাল বিশ্বায়নের সাংস্কৃতিক দিক নিয়ে আমরা বিশেষভাবে ভাবছি। ফ্রেড্রিক জেমিসনের মতে ‘globalization is a communicational concept, which alternately masks and transmits cultural or economic meanings’এখানে গুরুত্ব পাবে ‘কমিউনিকেশন’ শব্দটি যা সাম্প্রতিক কালে একটা সাংস্কৃতিক মাত্রা পেয়েছে। বিশ্বায়নের পটভূমিতে আমরা দেখি সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক ধরনের দেশান্তরব্যাপী প্রবাহ (Transnational flow)। একইসঙ্গে দেখা যায় স্থানীয় সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও এক ধরনের তারল্য (Fluidity), তাই সংস্কৃতিবাদী অবস্থান থেকে এটা বলাটা মুশকিল যে বিশ্বায়ন একটা সমসত্ত্ব প্রক্রিয়া (Homogeneous process), বরঞ্চ এটাই বলা ভাল যে বিশ্বায়ন যতখানি বিশ্ব সংস্কৃতির আকার ও প্রকৃতি নিয়ে উৎসাহী ততটাই স্থানীয় বা আঞ্চলিক সংস্কৃতির উপর ক্রিয়াশীল। জেমিসনের মতে সাম্প্রতিক ধনতন্ত্রের যুক্তি তাই সাংস্কৃতিক সমসত্ত্বতার উপর নয়, অসমসত্ত্বতার উপর প্রতিষ্ঠিত। বিভিন্ন ও পরস্পরবিরোধী ম্যাসকিউলিনিটি এই যুক্তি দিয়ে অনুসন্ধান করা যায়। এই প্রবন্ধে এটাও প্রতিপাদ্য যে সাম্প্রতিক হিন্দি চলচ্চিত্রে ম্যাসকিউলিনিটির উপস্থাপনা এতটাই বিচিত্র যে কোনও নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত সহজ নয়। বরঞ্চ এটাই বলা যায়, ভিন্নধর্মী সাংস্কৃতিক উপাদানের সহাবস্থানে একটা মিশ্র সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

এবার একটু খুঁটিয়ে দেখা উচিত ম্যাসকিউলিনিটি শব্দটা। ম্যাসকিউলিনিটি শব্দটা সম্পর্কে ধারণা করতে গেলে আমাদের লিঙ্গ রাজনীতির ধরনটা বুঝতে হবে। ম্যাসকিউলিনিটি শব্দটা গড়ে উঠেছে ফেমিনিনিটির বাইনারি হিসেবে। এই বাইনারি সম্পর্কে ম্যাসকিউলিনিটি শব্দটা অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে এবং ফেমিনিনিটির চেয়ে উৎকৃষ্ট বলে মনে করা হয়। শুধু তাই নয়, এই একই যুক্তি ধরে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, যুক্তি ও অনুভূতি ইত্যাদির বাইনারি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। পুরুষ-নারী যে বাইনারি পিতৃতন্ত্র নির্মাণ করেছে সেটাকেই প্রশ্ন করে নারীবাদ। পুরুষ, এবং পুরুষত্বের, নারী এবং নারীত্বের আবশ্যিক যোগসূত্রটা তাই ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। পুরুষও যে ‘নারীসুলভ’ গুণের অধিকারী হতে পারে তা আমরা অনুধাবন করতে পারি নারীবাদী হস্তক্ষেপের (Intervention) ফলে।

এই প্রবন্ধে আমার নিজস্ব অবস্থানটা এবার বলি। সাম্প্রতিক হিন্দি চলচ্চিত্রে ম্যাসকিউলিনিটিকে আমি বুঝতে চেষ্টা করেছি আমার নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। প্রশ্নটা এই নয় যে ম্যাসকিউলিনিটির উপস্থাপনার ক্ষেত্রে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কতটা কার্যকর। প্রশ্নটা এও নয় যে এখানে কোনও সচেতন নারীবাদী রাজনীতি ক্রিয়াশীল কি না। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হল আমার নারীবাদী পাঠ। আমি বোঝার চেষ্টা করেছি হিন্দি ছবিতে ম্যাসকিউলিনিটির উপস্থাপনা সংক্রান্ত বয়ানে নারীবাদী রাজনীতির অবদান ও বিরোধিতা। সুতরাং নারীবাদী বয়ানে ম্যাসকিউলিনিটি শব্দটাকে কীভাবে দেখা হচ্ছে সেটা বোঝা অত্যন্ত জরুরি। এখানে আমি দু’ ধরনের নারীবাদের কথা বলব।সমতাকামী নারীবাদীরা (Equality feminist) মনে করেন জৈবিক লিঙ্গ ও সামাজিক লিঙ্গের পার্থক্য গুরুত্বপূর্ণ। এদের কাছে জৈবিক লিঙ্গ স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক ও প্রাক্‌-সাংস্কৃতিক। এরা শুধুমাত্র ম্যাসকিউলিনিটি ও ফেমিনিনিটির সামাজিক নির্মাণকে প্রশ্ন করেন। ভিন্নতাভিত্তিক নারীবাদীরা (Feminism of difference) জেন্ডার শব্দটির দ্বারা জৈবিক লিঙ্গ ও সামাজিক লিঙ্গ উভয়কেই প্রকাশ করেন এবং দুটোর তফাত এদের কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। সমতাকামী নারীবাদীরা যেখানে ম্যাসকিউলিনিটি ও ফেমিনিনিটির ফারাকের প্রতি গুরুত্ব দেন সেখানে ভিন্নতাভিত্তিক নারীবাদীরা প্রত্যেক যৌনসত্তার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে সেটাকেই প্রাধান্য দেন। ভিন্নতাভিত্তিক নারীবাদীরা শুধু নারী-পুরুষের ভিন্নতা নয় নারীজাতির অভ্যন্তরীণ ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক বিভাজনকেও গুরুত্ব দেন। শুধু তা-ই নয়, একই সাংস্কৃতিক অবস্থানে অবস্থানকারী নারীদের মধ্যে ভিন্নতাও এদের দৃষ্টি এড়ায় না। অর্থাৎ এখানে ভিন্নতার প্রসঙ্গটা উঠে আসে সমতার মধ্যে থেকে। এলিজাবেথ গ্রস-এর মতে ‘Difference resists the homogenization of separate political struggles/ insofar as it implies not only women’s difference from men, and from each other, but also women’s difference from other oppressed groups.’ এই প্রবন্ধে আমি হিন্দি চলচ্চিত্রের ম্যাসকিউলিনিটি বোঝার চেষ্টা করেছি এই ভাবনা থেকে, তাই ম্যাসকিউলিনিটির উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ভিন্নতার বিষয়টা গুরুত্ব পেয়েছে। আমি যে নারীবাদী তত্ত্বের সঙ্গে সহমত তা পুরুষ-নারীর বাইনারিকে মূলগত ভিত্তি (Grounding principle) হিসেবে দেখে না। এখানে ম্যাসকিউলিনিটি ফেমিনিনিটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, কিন্তু ফেমিনিনিটির সাপেক্ষে বিশেষ অধিকারবিশিষ্ট নয়। এখানে যৌন ভিন্নতার ধরন বহুবিধ ও বহুমাত্রিক।

আমি আগেই বলেছি এখানে নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ম্যাসকিউলিনিটিকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমি নারীবাদী চলচ্চিত্র সমালোচক ও সমাজবিজ্ঞানীদের জেন্ডার সংক্রান্ত তত্ত্ব ও উদ্বেগ দ্বারা প্রভাবিত। ভারতীয় নারীবাদীদের আলোচনায় পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোতে নারীর অসম অবস্থানের প্রসঙ্গটাই গুরুত্ব পেয়েছে এবং ম্যাসকিউলিনিটি সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তার ততটা বিস্তার ঘটেনি। তবে অতি সাম্প্রতিক কালের নারীবাদী লেখাপত্রে ম্যাসকিউলিনিটি সংক্রান্ত উদ্বেগও প্রকাশ পাচ্ছে। এইসব লেখায় যেটা উঠে আসছে তা হল, পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোতে পুরুষের অবস্থান উচ্চতর হলেও পুরুষও অনেকসময় লিঙ্গ-ভূমিকার সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করে। নারীবাদী রাজনীতি শুধুমাত্র স্থিতাবস্থার সমালোচনা ও বিরোধিতাই করেনি, এটাও দেখিয়েছে যে এই স্থিতাবস্থা নারী-পুরুষ উভয়কেই নিয়ন্ত্রণ করে। পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোতে ম্যাসকিউলিনিটি বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত কারণ পিতৃতন্ত্রে পুরুষই হল প্রভাবশালী জেন্ডার। কিন্তু ম্যাসকিউলিনিটি অনেক ক্ষেত্রেই অন্যান্য সামাজিক অসমতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত— যেমন জাতি, শ্রেণি। অর্থাৎ কিনা ম্যাসকিউলিনিটির অবস্থান সব ক্ষেত্রে উচ্চতর নাও হতে পারে। উপরন্তু আমি যেভাবে ম্যাসকিউলিনিটিকে দেখছি তাতে পুরুষদেহ ও পুরুষত্বের মধ্যে সম্পর্ক আবশ্যিক নয়। এখানে আমার প্রচেষ্টা হল হিন্দি চলচ্চিত্র তথা সাম্প্রতিক সাংস্কৃতিক পরিসরে পুরুষের আধিপত্যকে প্রশ্ন করা ও পুরুষ ও পুরুষত্বের সম্পর্ককে সহজসরল সমীকরণের বাইরে একটু জটিল করে দেখা। আমার এই দেখা পুরুষ-নারীর বাইনারি ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, বরঞ্চ এখানে আমি এক ধরনের যৌন ভিন্নতার কথাই বলার চেষ্টা করেছি।

এবার দেখা যাক হিন্দি চলচ্চিত্রের সঙ্গে নারীবাদের সম্পর্কটা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মূলধারার হিন্দি চলচ্চিত্র সচেতনভাবে নারীবাদী রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না। একইসঙ্গে হিন্দি চলচ্চিত্র যাদের সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হওয়ার দরুন জনপ্রিয় নারীবাদী বিষয়, দাবি ও বিরোধিতাকে সম্পূর্ণ অস্বীকারও করতে পারে না। মতাদর্শগত ক্ষেত্রে তাই হিন্দি চলচ্চিত্র বাধ্য হয় নারীবাদের সঙ্গে এক ধরনের নেগোশিয়েশনে আসতে। এমনকী, অনেক ক্ষেত্রে হিন্দি চলচ্চিত্র জনপ্রিয়তা অর্জন ও রক্ষার জন্য রাজনৈতিকভাবে সঠিক ও জেন্ডার সংবেদনশীল উপস্থাপনাও করে থাকে। প্রশ্নটা হল এই যে, নারীবাদী হস্তক্ষেপ কি আদৌ ম্যাসকিউলিনিটির উপস্থাপনের ক্ষেত্রে কোনও পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে? না কি এইসমস্ত উপস্থাপনা আদতে মূলস্রোতের নারীবাদী রাজনীতি আত্মসাতের উদাহরণ মাত্র?

সাম্প্রতিক হিন্দি ছবির দিকে একটু তাকালে আমরা বুঝতে পারি, এই পরিসরে নতুন ধরনের পুরুষের প্রতিচ্ছবির সঙ্গে সঙ্গে পুরনো ধরনের পুরুষের প্রতিচ্ছবিও বহুল প্রচারিত। এই সহাবস্থান দেখে আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে হিন্দি চলচ্চিত্রের পরিসরে পুরুষের আধিপত্য অব্যাহত এবং আমাদের সামাজিক কাঠামোয় প্রথানুগ বিসমকামিতা (Heteronormative social matrix)-কে কায়েম রাখতে হিন্দি চলচ্চিত্র সক্ষম। অর্থাৎ কিনা নতুন ধরনের পুরুষের উপস্থাপন কোনওভাবেই হিন্দি চলচ্চিত্রের প্রতিক্রিয়াশীল মর্মস্থলের বিরোধিতা করে না। এই যুক্তি ধরে এগিয়ে আমি এটাও বলতে চাই যে, কোনও র‌্যাডিকাল রাজনীতিকে একসময় মূলস্রোত আত্মসাৎ করে এবং সেই রাজনীতি তার মৌলিকতা ও সূক্ষ্মতা হারায়। প্রশ্নটা হল, হিন্দি চলচ্চিত্র যা কিনা আপাতভাবে নারীবাদী রাজনীতির সাপেক্ষে বলে মনে হতে পারে, সেখানে কীভাবে পুরুষের আধিপত্য কায়েম থাকে?

আমি নতুন ও পুরনো ম্যাসকিউলিনিটির মধ্যে যে-পার্থক্যটা করেছি তা কিন্তু ক্রমিক পার্থক্য নয়। বরঞ্চ দুটো ভিন্ন মূল্যের পরিচায়ক। প্রথাভিত্তিক পুরুষের ভূমিকা পুরুষ-নারী বাইনারির উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু নতুন পুরুষের জেন্ডার সংবেদনশীল প্রতিচ্ছবি সম্ভব হয়েছে নারীবাদী রাজনীতির ফলে। সুতরাং এই নতুন ম্যাসকিউলিনিটিকে অনেক বেশি সমতাকামী (Egalitarian) বলে মনে হয়। এখানে বুঝতে হবে হিন্দি ছবির পরিসরে এই নতুন ধরনের ম্যাসকিউলিনিটি অঙ্গীভূত হলেও তার রাজনৈতিক তীক্ষ্ণতাকে খর্ব করা হয়েছে। ফলত মূলধারার চলচ্চিত্রে বিদ্যমান পুরুষের আধিপত্যকে কোনওভাবেই এই নতুন ম্যাসকিউলিনিটি বিরোধিতা করে না। অর্থাৎ যে আপাত পরিবর্তন আমরা দেখছি তা কোনও মতাদর্শগত পরিবর্তন নয়। এই পরিবর্তন একটা আলংকারিক প্রকাশ ভঙ্গিমা (Rhetorical gesture) যা আমাদের সামাজিক কাঠামোতে প্রথানুগ বিসমকামিতাকে কায়েম রাখতে তৎপর। নারীবাদী রাজনীতি ম্যাসকিউলিনিটি ও ফেমিনিনিটির বাইনারি ভাঙতে উদ্‌গ্রীব হলেও সাম্প্রতিক হিন্দি চলচ্চিত্র এই বাইনারিকেই পুনর্নির্মাণ করে। তাই অনেকসময় এই প্রতিচ্ছবিগুলো বাহ্যিকভাবে র‌্যাডিকাল মনে হলেও একটু তলিয়ে দেখলে এক ধরনের ‘নিও-ট্র্যাডিশনালিজম’-এর ছবি ধরা পড়ে। এককভাবে হিন্দি চলচ্চিত্রের এই নারীবাদী বাগ্মিতা (Feminist rhetoric) নারীবাদী রাজনীতির পরিপন্থী। প্রশ্নটা হল— কেন এই পরিবর্তন? আসলে সাম্প্রতিক কালে বিসমকামী বিবাহের হেজিমনিক প্রতিষ্ঠান আর আগের মতো অটুট নেই। এই হেজিমনি বা আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে নারীকে পুনরায় সক্রিয়ভাবে এই ব্যবস্থার অধীনে আনতে হবে। কিন্তু আগের মতো দমনমূলক আচরণ দিয়ে আর তা সম্ভব নয়। নতুন মুক্তমনা নারীর জন্য চাই বাধ্য ও বিনীত পুরুষ ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দাম্পত্য। হিন্দি চলচ্চিত্র তাই এক নতুন ধরনের পরিবার গঠনে উৎসাহী যেখানে আচরণের পরিবর্তনের মাধ্যমে আপাতভাবে পরিবারের ভিতরকার ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগ (Hierarchy) কমানোর প্রচেষ্টা করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক কালে মানবীবিদ্যাচর্চায় প্রাত্যহিক জীবনে নারীর অবস্থা গুরুত্ব পেয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই গবেষণাগুলোতে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে নারী-পুরুষ সম্পর্কের নানা দিক উঠে এসেছে এবং মানবীবিদ্যাচর্চা কোনওভাবেই নারীর জীবনে পুরুষের ভূমিকাকে অস্বীকার করতে পারে না। এ প্রসঙ্গে এটাও মনে রাখা উচিত পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোতে নারীর আপাত ও বাস্তবিক নিরাপত্তা ও নিরাপত্তাহীনতা উভয়ই বিদ্যমান। কিছুদিন আগে নারীবাদী সমালোচক ও তাত্ত্বিকরা চলচ্চিত্রে নারীশরীরের প্রদর্শন বিষয়টা নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। আখ্যাননির্ভর মূলধারার চলচ্চিত্রের প্রচার ও প্রসারের জন্য নারীশরীরের অবজেক্টিফিকেশন ছিল তাদের তর্কবিতর্কের ক্ষেত্র। এই ধরনের প্রতিচ্ছবি এখনও মূলধারার চলচ্চিত্রে ব্যাপকহারে দেখা গেলেও, অন্য ধরনের কিছু প্রতিচ্ছবিও দেখা যাচ্ছে। এই ‘অন্য ধরনের’ প্রতিচ্ছবি মূলস্রোতে নারীবাদী দাবির আত্মসাৎকেই ইঙ্গিত করে। নারীবাদী সমালোচকদের সমালোচনার প্রভাবে ও নতুন নারীর ক্রয়ক্ষমতাকে লক্ষ করে, হিন্দি চলচ্চিত্র নারীকে এখন সক্রিয় কর্তা (Active agent) হিসেবে বর্ণনা করে। অর্থাৎ কিনা আমরা চলচ্চিত্রে এক ধরনের কৌশলগত রদবদল লক্ষ করি। আগে যেখানে নারীর শরীর ছিল চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি এখন সেখানে গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে নারীর আকাঙ্ক্ষা। নতুন সংবেদনশীল পুরুষের প্রতিচ্ছবির প্রচলনকে এই প্রেক্ষিত থেকে বুঝতে হবে। আমার মনে হয় এই নতুন সংবেদনশীল পুরুষের প্রতিচ্ছবি আদৌ নতুন পুরুষকে উদ্দেশ্য করে নির্মিত নয় বরঞ্চ এই প্রতিচ্ছবি নতুন মুক্তমনা নারীর কথা ভেবেই নির্মিত। এখানে যেন নতুন নারীর যোগ্য নতুন বাধ্য ও বিনীত পুরুষের প্রয়োজনই গুরুত্ব পেয়েছে।

নারীবাদ এখন আর একটা রাজনীতি নয় বরঞ্চ সমৃদ্ধ জীবনের প্রতিভূ। এটা যেন শিক্ষিত মুক্তমনা নারীর জীবনশৈলী নির্বাচনের প্রশ্ন। মুষ্টিমেয় নারীর সাফল্যের কাহিনি নারী আন্দোলনের সুদীর্ঘ ও বৈচিত্রপূর্ণ ইতিহাসকে মুছে ফেলতে যেন প্রায় সক্ষম। মূলস্রোত যেভাবে নারীবাদকে আত্মসাৎ করেছে তাতে মনে হয় নারীবাদের সংকট উপস্থিত। বর্তমান হিন্দি চলচ্চিত্রে প্রচলিত লিঙ্গ-ভূমিকার বিষয়টি জটিল হয়ে উঠেছে। আজকের নারী যদি যৌন আবেদনশীল গৃহিণী ও আদর্শ ভোক্তা হয়ে ওঠে তবে কি আজকের পুরুষ পিছনে পড়ে থাকতে পারে? আজকের পুরুষ তাই কর্তৃত্বপ্রিয় গৃহকর্তা নয়। এটা অনস্বীকার্য বহির্বিশ্বে নারীর সাফল্য অনেকটাই নারীবাদী আন্দোলনের ফলশ্রুতি। নারীর এই সাফল্য একভাবে গৃহে তার ভূমিকাকে প্রভাবিত করেছে, তাই গৃহের অভ্যন্তরে আধিপত্যের প্রশ্নটা একটু জটিল হয়ে পড়েছে। নারী যখন পুরুষের সঙ্গে সমতালে বহির্বিশ্বে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম তখন পুরুষও বাধ্য হয় কিছু নারীসুলভ গুণকে আত্তীকরণ করতে। নতুন নারীর যোগ্য হয়ে উঠতে তাই নতুন পুরুষকে অনুভূতিশীল ও বাধ্য হতে হয়েছে। তবে এই পরিবর্তন কিন্তু পুরুষের আধিপত্যকে খুব-একটা প্রশ্ন করেনি। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখা প্রয়োজন এই নতুন পুরুষ ও নারীর প্রতিচ্ছবি কিন্তু আদতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশের উচ্চাশাকেই প্রতিফলিত করে। প্রশ্নটা হল, এই প্রতিচ্ছবিগুলো আমরা কীভাবে দেখব? নতুন কোনও প্রবণতার সূচনা আমাদের সাম্প্রতিক সমাজ বাস্তবতার নিখুঁত প্রতিফলন, না কি একটা সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা? আমার মনে হয় এই নরম অনুভূতিশীল পুরুষ আদতে পুরনো পিতৃতান্ত্রিক আদর্শের নবরূপায়ণ। পরিবর্তনটা নিছকই ফ্যাশনের স্তরে। জ্যঁ বদ্রিল্যা-র মতে বলা যায়,

Its seems the modernity sets up linear time of technical progress, production and history, and simultaneously a cyclical time of fashion. This only seems to be a contradiction, since the fact, modernity is never a radical rupture. Traditional is no longer pre-eminence of the old over new: It is unaware of either modernity itself invents both at once, at a single stroke, it is always and at the same time ‘neo’ and ‘retro’— modern and anachronistic. The dialectic of rupture very quickly becomes the dynamics of the amalgam and recycling.

সুতরাং এটা বলাই যায়, এই ‘neo’ এবং ‘retro’-র পার্থক্য শুধুমাত্র ফ্যাশনের স্তরে। মূল্যের জায়গা থেকে এদের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই। হিন্দি চলচ্চিত্রের পরিসরে অতি পুরুষালি ও তার বিকল্প প্রতিচ্ছবির ব্যাপক প্রচার দেখে কোনওভাবেই বলা যায় না যে সাংস্কৃতিক উপস্থাপনার পূর্ববর্তী যুগ থেকে আমরা সরে এসেছি। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির অন্যান্য প্রতিমূর্তির মতোই ম্যাসকিউলিনিটির উপস্থাপনা পুনরাবৃত্তিমূলক এবং ম্যাসকিউলিনিটির সাংস্কৃতিক ও সামাজিক তাৎপর্যের বিশেষ কোনও তারতম্য ঘটে না। ফ্রেড্রিক জেমিসনের মতে,

I must limit myself to the suggestion that radical breaks between periods do not generally involve complete change of content but rather the restructuring of a certain number of elements already given: features that in an earlier period or system subordinate now become dominant and features that had been dominant again become secondary.

সংস্কৃতির পরিসর তৈরি হয় বিভিন্ন পাঠ্য ও তার পরিপ্রেক্ষিতের আন্তঃসম্পর্কের মাধ্যমে। হিন্দি চলচ্চিত্রের পরিসরও নির্মিত হয় বিভিন্ন ও পরস্পরবিরোধী পাঠ্য ও তার পরিপ্রেক্ষিতের বুননের ফলে। এর ফলে এটা বলা খুব মুশকিল হিন্দি চলচ্চিত্র আদতে কী বলতে চাইছে। আমার মনে হয় হিন্দি চলচ্চিত্র কোনওভাবেই হেজিমনিক ম্যাসকিউলিনিটির সর্বগ্রাসী নকশার বিরোধিতা করে না। বরঞ্চ নারীবাদের উপাদানের আত্মসাতের মাধ্যমে নিজের জনপ্রিয়তা বাঁচিয়ে রাখতে ও বৃদ্ধি করতে ব্যস্ত। স্টুয়ার্ট ইয়েন-এর মতে বিকল্প সংস্কৃতি

has been reduced to the status of commodity. Whatever significance or value the expression may have had in the context of its earlier development, that value the outweighed by its exchange value, its ability to make something marketably “hip”.

বিকল্প সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য তার বৈপরীত্য দ্বারা মূলস্রোতকে আঘাত করে। সুতরাং বিকল্প সংস্কৃতি সাময়িকভাবে পূর্ববর্তী সাংস্কৃতিক রীতি থেকে বিযুক্তি তৈরি করে। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে এই বিকল্প সংস্কৃতি কেবলমাত্র একটা জীবনশৈলীতে পর্যবসিত হয়, এটাকে ডিক হেডিজ ‘ব্রাইকোলেজ’১০ বলেছেন। ফলত দেখা যাচ্ছে যে, কোনও র‌্যাডিকাল আন্দোলনকে আত্মসাৎ করে মূলধারার সংস্কৃতি তার বৃদ্ধি ও রক্ষা করে এবং দেখা যায় যে, এর ফলে র‌্যাডিকাল আন্দোলন তার তীক্ষ্ণতা হারায়। এখানে আমার রেমন্ড উইলিয়ামসকে১১ প্রাসঙ্গিক মনে হয়। তাঁর মতে যেকোনও সমাজে প্রভাবশালী সংস্কৃতি প্রধানত শাসক শ্রেণির মূল্যবোধ ও অনুশীলনকেই প্রতিফলিত করে। কিন্তু বিকল্প অনুশীলনও এই প্রভাবশালী সংস্কৃতির অন্তর্গত। মজাটা হল, এই বিকল্প অনুশীলন প্রভাবশালী সংস্কৃতির অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্যকে প্রকাশ করলেও, কখনওই প্রভাবশালী সংস্কৃতির বিরোধিতা করে না।

প্রশ্নটা হচ্ছে, কেন মূলস্রোতকে র‌্যাডিকাল উপাদান আত্মসাৎ করতে হয়? র‌্যাডিকাল উপাদানের কি বহুল সমর্থন রয়েছে ? তাহলে কি এটা বলা যেতে পারে যে এই নতুন ধরনের পুরুষের প্রতিচ্ছবির জনপ্রিয় চাহিদা রয়েছে? আমি আগেই বলেছি এই নতুন নরম অনুভূতিশীল পুরুষের প্রতিচ্ছবিগুলো আসলে নতুন নারীর আকাঙ্ক্ষা ও ক্রয়ক্ষমতার কথা দিয়ে নির্মিত। এই প্রতিচ্ছবিগুলো কি তবে নারীর নিত্যদিনের নিরাপত্তাহীনতার বাজার-চালিত সমাধান হিসেবে পড়া সম্ভব? এই ‘সমাধান’ কি একইসঙ্গে নারী আন্দোলনের সীমাবদ্ধতাকেও ইঙ্গিত করে? এটা তো মনে হতেই পারে এই বাজার-চালিত সমাধানের প্রয়োজন তখনই হয় যখন নারীবাদী ভাবধারা সাধারণ নারীর জীবন থেকে অনেকখানি বিচ্ছিন্ন। একভাবে দেখলে মূলস্রোতের এই নারীবাদী রাজনীতিকে আত্মসাৎ করা নারীবাদী আন্দোলনের অসফলতাই প্রকাশ করে। এভাবে যদি আমরা নারী আন্দোলনের মূল্যায়ন করি তবে আমাদের ধরে নিতে হয় নারী আন্দোলনের সময়কাল পার হয়েছে এবং এর সাফল্য-ব্যর্থতা মূল্যায়নের সময় এসেছে। আমার কাছে নারী আন্দোলন একটা প্রক্রিয়া এবং উত্তর-নারীবাদ একটা মিথ মাত্র।

বিশ্বায়ন সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কোনও পরিবর্তনের সূচনা করে কি না তা এই প্রবন্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অনেক তাত্ত্বিকরাই এই প্রশ্নটা তুলেছেন— যেমন ফ্রেড্রিক জেমিসন, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক প্রমুখ। আমি এই পরিবর্তনের বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেছি সাম্প্রতিক হিন্দি চলচ্চিত্রে ম্যাসকিউলিনিটির উপস্থাপনের প্রসঙ্গে। এই প্রবন্ধের পরিসরে শুধু ম্যাসকিউলিনিটির বিভিন্ন ধরন নয়, তার আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরও গুরুত্ব পেয়েছে। তাই বিশ্বায়ন বিষয়টা সাম্প্রতিক বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে কীভাবে আলোচিত হয়েছে সেটা দেখা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমি আগেই বলেছি বিশ্বায়ন বিষয়টা আমি সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেখতে চেয়েছি। সংস্কৃতি এমনই একটা ক্ষেত্র যা কিনা আর্থ-সামাজিক ট্রোপ–এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। এটা যেকোনও যুগ সম্পর্কেই সঠিক। কিন্তু আমরা দেখেছি সাম্প্রতিক কালে সংস্কৃতি যেন সমাজের কেন্দ্রীয় ধারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাই নতুন ম্যাসকিউলিনিটির ধরন বুঝতে গিয়ে ‘সংস্কৃতি’ কীভাবে সাম্প্রতিক কালে প্রতীয়মান সেটা খুঁটিয়ে দেখা জরুরি মনে হচ্ছে।

ফ্রেড্রিক জেমিসনের মতে১২ সংস্কৃতি যেন সাম্প্রতিক ধনতন্ত্রের যুক্তি হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ কিনা সাম্প্রতিক ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যই হল পোস্টমডার্ন সংস্কৃতি। তার মতে পোস্টমডার্নিটি শুধু সাংস্কৃতিক মতাদর্শের প্রশ্ন নয়। এর একটা আর্থ-সামাজিক ভিত্তি আছে যা ধনতন্ত্রের তৃতীয় পর্যায়ের বৈশিষ্ট্যও বলা যেতে পারে। স্লাভয় জিজেক১৩ সংস্কৃতিকে বোঝার চেষ্টা করেছেন সাম্প্রতিক ধনতন্ত্রের নিরিখে। তার মতে পোস্টমডার্নিজ্ম সাম্প্রতিক সমাজ ব্যবস্থার আপাত বৈশিষ্ট্য বা অবয়ব হলেও এর একটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবমূল্য রয়েছে। প্রশ্নটা হল, আমার আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পোস্টমডার্ন সাংস্কৃতিক পরিসরের কী তাৎপর্য রয়েছে? পোস্টমডার্ন সাংস্কৃতিক পরিসর এক ধরনের অসমসত্ত্বতার কথা বলে যার প্রেক্ষিতে আমরা সমকালীন হিন্দি চলচ্চিত্রের নতুন ম্যাসকিউলিনিটির ধরন বুঝতে পারি। সাম্প্রতিক ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা এই অসমসত্ত্বতাকেই উদ্‌যাপন করে। জেমিসনও এই অসমসত্ত্বতার উদ্‌যাপনের পক্ষে। তাই তিনি সাম্প্রতিক ধনতন্ত্রকে মানবতার পক্ষে একইসঙ্গে ভাল ও মন্দ মনে করেন। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক১৪ অবশ্য ধনতন্ত্রের এই ব্যাখ্যাকে সমর্থন করেন না। তার মতে এটা ধনতন্ত্রের এক ধরনের রোম্যান্টিসাইজেশন এবং এর ফলে ধনতন্ত্রের খারাপ দিকের সঙ্গে লড়াইটা শক্ত হয়ে পড়ে। তাঁর মতে, ‘Marx points out, not how to think well and ill of capitalism at the same time, but that one must work to sublate the good things in capitalism out of capitalism.’১৫ ফ্রেড্রিক জেমিসনের সঙ্গে অনেক বিষয়ই অসহমত গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। A Critique of Postcolonial Reason: Towards a History of Vanishing Present-এর ‘Culture’ অধ্যায়ে তিনি সাম্প্রতিক কালের ইতিহাস বোঝার চেষ্টা করেছেন। তিনি মনে করেন সাম্প্রতিক সময়কে বোঝার জন্য শুধুমাত্র সংস্কৃতি একটা মাধ্যম হতে পারে না। সাংস্কৃতিক পরিধিকে বোঝার জন্য অর্থনীতিও গুরুত্বপূর্ণ এবং তিনি অর্থনীতিকে সূক্ষ্মভাবে দেখার পক্ষে। গায়ত্রী স্পিভাকের মতে, ‘Postmodernism, or the Cultural Logic of the Late Capitalism’-এ ফ্রেড্রিক জেমিসন যে-ধরনের অর্থনীতির কথা বলছেন তা সংস্কৃতিবাদীদের নির্মাণ। তাঁর মতে অর্থনীতিকে কখনও সংস্কৃতিতে পরিণত করা উচিত নয়। তবে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন বর্তমানে অর্থনীতি একভাবে সংস্কৃতিতে প্রোথিত। জেমিসন মনে করেন, পোস্টমডার্ন সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া বোঝার জন্য স্পেস হল একটা গুরুত্বপূর্ণ ট্রোপ। এখানে স্পেস বলতে অগভীর বহিঃপৃষ্ঠকেই বোঝায়। অপর দিকে তাঁর মতে মডার্নিস্ট সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া বোঝার জন্য সময়ের বিস্তারটা (Dimension) উল্লেখযোগ্য। গায়ত্রী স্পিভাকের মতে এই পরিবর্তন অর্থাৎ কিনা মডার্নিজ্ম থেকে পোস্টমডার্নিজ্‌মের এই যাত্রা একটা ক্রমিক পরিবর্তন দর্শায়। এটা কোনও ধারণাগত পরিবর্তনের কথা বলে না। গায়ত্রী স্পিভাক জ্যঁ-ফ্রাঁসোয়া লিয়োতার-এর প্রসঙ্গ এনে সাম্প্রতিক সংস্কৃতিকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। জ্যঁ-ফ্রাঁসোয়া লিয়োতার প্রাক্‌-আধুনিক, আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক এই তিন ভাগে সংস্কৃতিকে ভাগ করেছেন। প্রাক্‌-আধুনিক ক্লাসিক যেন একটা আখ্যানের সঞ্চয়াগার যেখান থেকে প্রাক্‌-আধুনিক পরিশোধনকারী (Performer) তার রসদ সংগ্রহ করেন। এমনকী আখ্যানে নতুন অধ্যায়ও সংযুক্ত করেন। আধুনিক যুগেই এই আখ্যানগুলোতে স্পষ্ট অগ্র, মধ্য ও অন্ত দেখা যায়। আবার উত্তর-আধুনিক যুগে যেন আখ্যানগুলো পুনরায় টুকরো টুকরো হয়ে ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ে। যেন প্রাক্‌-আধুনিক পরিবেশনকারীর মতো করে পরিবেশন করা সম্ভব হয়। গায়ত্রী স্পিভাক জ্যঁ-ফ্রাঁসোয়া লিয়োতার-এর এই উপলব্ধি থেকে নিজেকে আলাদা করেন। তিনি এই ধরনের বিভাজনের বিপক্ষে এবং প্রাক্‌-আধুনিক ও উত্তর-আধুনিকের মধ্যে ধারাবাহিকতায় বিশ্বাসী। তাঁর মতে প্রাক্‌-আধুনিক আধুনিকের মধ্যে, আধুনিক উত্তর-আধুনিকের মধ্যে অবস্থান করে। যখন কেউ মনে করেন প্রাক্‌-আধুনিক স্তরবিন্যস্ত ও বৃত্তাকার, অপর দিকে আধুনিক রৈখিক, তখন ভুলে যান যে এই বাইনারিটা আসলে আধুনিক নির্মাণ। তাই গায়ত্রী স্পিভাকের মতে জ্যঁ-ফ্রাঁসোয়া লিয়োতার প্রাক্‌-আধুনিক, আধুনিক ও উত্তর-আধুনিককে বোঝার চেষ্টা করেছেন আধুনিক ট্রোপ দিয়ে।

ফ্রেড্রিক জেমিসন পোস্টমডার্ন সংস্কৃতির গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে পূর্ববর্তী ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংস্কৃতির যে আংশিক স্বনিয়ন্ত্রণ (Semi-autonomy) ছিল তা সাম্প্রতিক ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অবলুপ্ত। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের স্বনিয়ন্ত্রণের অবলুপ্তি মানে কিন্তু সংস্কৃতির অদৃশ্যতা নয়। বরঞ্চ আমরা সংস্কৃতির বিস্ফোরণই দেখতে পাই। সাম্প্রতিক সময়ে সব কিছুই যেন ‘সংস্কৃতি’-তে পরিণত হচ্ছে— তা সে অর্থনীতি হোক বা রাষ্ট্রক্ষমতা। এই বর্ণনার সঙ্গে আমরা মিল পাই এই ধারণার যে, সাম্প্রতিক সমাজ আসলে ‘ইমেজ’ বা ‘Simulacrum’-এর সমাজ। মজাটা হল বিশ্বের এই সংস্কৃতায়ন (Culturalization) কিন্তু ‘সংস্কৃতি’র কোনও মূল্যবৃদ্ধি করে না। এই প্রসঙ্গে জুডিথ বাটলারের ‘Merely Cultural’-এর বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।১৬ তিনি সাম্প্রতিক সংস্কৃতির দুটো দিক উল্লেখ করেছেন— প্রথমত মার্কসবাদীদের ‘সংস্কৃতি’ অধ্যয়নের প্রতি বিমুখতা, দ্বিতীয়ত নতুন সামাজিক আন্দোলনগুলোকে শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক আখ্যা দেওয়া। এখানে নতুন সামাজিক আন্দোলন বলতে নারীবাদী আন্দোলন, জাতিবৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, যৌনতাভিত্তিক আত্মপরিচয়ের রাজনীতি বা কোনও আন্দোলন প্রভৃতি। যখন এই নতুন সামাজিক আন্দোলনগুলোকে শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক বলে অভিধা দেওয়া হচ্ছে তখন বস্তুগত জীবন ও সাংস্কৃতিক জীবনের মধ্যে বিভাজনকে অটুট বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, নতুন সামাজিক আন্দোলনকে ‘Merely Cultural’ বলার মাধ্যমে সংস্কৃতিকে খাটো ও সমাজজীবনে তার অবস্থানকে গৌণ বলে মনে করা হচ্ছে। গোঁড়া মার্কসবাদীরা বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক জীবনের ক্ষেত্রে যে বিভাজন করেছেন তার ফলে কিছু সক্রিয় রাজনীতি প্রান্তীয় হয়ে পড়ে, যেমন ধরা যাক যৌনতা বা জাতির প্রশ্নটা।

জুডিথ এরপর ক্যুইয়ার রাজনীতির মাধ্যমে সংস্কৃতির গৌণ অবস্থান বিষয়টা আলোচনা করেছেন। প্রথাগতভাবে মনে করা হয় শ্রেণির প্রশ্নটা অর্থনৈতিক পুনর্বণ্টনের প্রশ্ন। নারীবাদের প্রশ্নটা একইসঙ্গে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রশ্ন। কিন্তু ক্যুইয়ার রাজনীতি পুরোপুরি সাংস্কৃতিক প্রশ্ন। বাটলার এই প্রচলিত ধারণাকে সমস্যায়িত করেন। তার মতে ‘জেন্ডার’ ও ‘সেক্সুয়ালিটি’ বা ‘যৌনতা’ উৎপাদন ব্যবস্থার অঙ্গ, তার কারণ এর ভিত্তিতেই শ্রমের লিঙ্গায়ন সম্ভব হয়। উপরন্ত জেন্ডার ও যৌনতার ধারণা দ্বারাই বিসমকামী পরিবার গঠিত হয় যা কিনা যৌন বিভাজনের ক্ষেত্র। বাটলার প্রশ্ন করেন, ক্যুইয়ার আন্দোলন, যা কিনা প্রতিষ্ঠিত বা আদর্শ যৌনতাকে প্রশ্ন করে, তা কী করে রাজনৈতিক অর্থনীতির বাইরে হয়? বিশেষত যেখানে যৌনতার কারণে গে, লেসবিয়ান ও ট্রান্সসেক্সুয়ালদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত যৌন অধিকারের প্রশ্নটা কী করে রাজনৈতিক অর্থনীতির বাইরে হয়? জুডিথ বাটলার মনে করেন যৌন রাজনীতির প্রশ্নটা পুরোপুরি সংস্কৃতির এলাকাভুক্ত করাটা আসলে যৌন রাজনীতিকে খর্ব করারই প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টা আরেকটি সাংস্কৃতিক হস্তক্ষেপ বা মধ্যস্থতা মাত্র। জুডিথ বাটলারের আলোচনার নিরিখে আমরা আবার সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অর্থনীতির পরিপূরকতার দিকটা বুঝতে পারি।

এবার প্রশ্ন হল চলচ্চিত্র একটা সাংস্কৃতিক মাধ্যম হিসেবে কীভাবে বিশ্বায়নের আর্থ-সামাজিক দিকের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এটা বুঝতে গেলে আমাদের আবার সাংস্কৃতিক সহাবস্থানের প্রসঙ্গে ফিরতে হবে। হিন্দি চলচ্চিত্রের বয়ানে ঐতিহ্য-আধুনিকতার প্রসঙ্গটা গুরুত্বপূর্ণ। আমার চলচ্চিত্রপাঠ এই ঐতিহ্য–আধুনিকতার সম্পর্ককেই অনুসন্ধান ও বিস্তার করছে। এখানে ঐতিহ্য ও আধুনিকতা পরস্পরবিরোধী হলেও আধুনিকীকরণের প্রকল্পের অন্তর্গত দু’টি ধারা। ঐতিহ্য, যা কিনা আধুনিকতার বিপরীত, প্রকৃতপক্ষে আধুনিকতার নির্মাণ১৭ এবং এরা পরস্পরকে গঠন (Co-constitute) করে। প্রশ্নটা হল, কীভাবে এই পরস্পরিক গঠনের ধারণা সাম্প্রতিক ম্যাসকিউলিনিটির উপস্থাপনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? সাম্প্রতিক কালে আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের নেগোশিয়েশন কি বিশ্বব্যাপী ও স্থানীয় সাংস্কৃতির নেগোশিয়েশন হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে? আমাদের ম্যাসকিউলিনিটির পাঠ কি সেদিকেই ইঙ্গিত করছে? সহজভাবে বললে প্রশ্নটা হল, আধুনিকতা–ঐতিহ্যের ট্রোপ এক ধরনের ম্যাসকিউলিনিটি উপস্থাপিত করছে যা কিনা একইসঙ্গে দেশীয় বা স্থানিক ও কসমোপলিটন, একইসঙ্গে প্রথাগত ও সমকালীন।

ভারতীয় চলচ্চিত্রের আলোচনার ক্ষেত্রে মাধব প্রসাদ১৮ এক গুরুত্বপূর্ণ নাম এবং আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের যে ধারণা হিন্দি চলচ্চিত্রের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তার অন্যতম পুরোধা। এখানে আমি তার ফর্মাল সাবসাম্পশন-এর ধারণাটা আলোচনা করতে চাই। তাঁর মতে ফর্মাল সাবসাম্পশন ধনতন্ত্রের আধিপত্যের কথা বললেও আদতে গ্রামীণ এলিট ও বুর্জোয়া উভয়েরই রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদারিত্বকে স্বীকার করে নেয়। এই রাজনৈতিক চিত্রটা বোঝা যায় মূলস্রোতের হিন্দি চলচ্চিত্রে। অর্থাৎ কিনা মতাদর্শগত ক্ষেত্রে ধনতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের সহাবস্থান আখ্যানের স্তরে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সহাবস্থান হিসেবে প্রকাশ পায়। মাধব প্রসাদ মূলস্রোতের ধ্রুপদি চলচ্চিত্রকে ‘ফিউডাল ফ্যামিলি রোমান্স’ বলে নামকরণ করেন। এই মেলোড্রামা সাধারণভাবে সামন্ততান্ত্রিক পরিবারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এই ফিউডাল ফ্যামিলি রোম্যান্সের গঠনের মধ্যে আমরা নাচ-গান, মারামারি, হাস্যকৌতুক প্রভৃতির সহাবস্থান দেখি। আমরা বুঝতে পারি ধ্রুপদি হিন্দি চলচ্চিত্র এক ধরনের বিমিশ্র কারিগরি প্রণালী (Heterogeneous manufacture) যা বিভিন্ন উপাদানের সহাবস্থান দ্বারা নির্মিত। অনুষ্টুপ বসু১৯ এই সহাবস্থানের বিষয়টা দেখছেন সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এবং বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছেন এসেমব্লেজ শব্দটা দিয়ে। তিনি এখানে নতুন ও পুরনোর সহাবস্থান নিয়ে ভাবছেন। তার মতে এসেমব্লেজের ধারণা পুরনোকে বাতিল করে না, বরঞ্চ পুরনোকে নতুন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। তিনি আরও বলেন সাম্প্রতিক কালে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার দ্বন্দ্বটা যেন আপাতভাবে অপ্রসারিত হয়েছে এবং সহাবস্থানটা যেন অনেকটাই সহজ হয়েছে। সুতরাং মাধব প্রসাদ এবং অনুষ্টুপ বসু উভয়ই একভাবে সহাবস্থানের কথা বলছেন। মাধব প্রসাদ যেখানে এই সহাবস্থান ফিউডাল ফ্যামিলি রোমান্সের পরিপ্রেক্ষিতে দেখেছেন সেখানে অনুষ্টুপ বসু এসেমব্লেজের ধারণা থেকে সাম্প্রতিক হিন্দি চলচ্চিত্রকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। এখানে আমার কাজ হল এই সহাবস্থানের বিষয়টা ম্যাসিকিউলিনিটির ক্ষেত্রে দেখা ও নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এর রাজনৈতিক মাত্রাটা বোঝা। এক্ষেত্রে কোনও একটা ছবির নিবিড় পাঠ একটা উপায় হতে পারে।

এই প্রবন্ধে আমি দিল চাহতা হ্যায় ছবিটার আলোচনা করব। আমি এই ছবিটা দেখতে চাইছি মতাদর্শগত দিক থেকে, ছবির শৈলীগত বৈশিষ্ট্য এখানে গুরুত্ব পায়নি। বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে ও নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নতুন ম্যাসকিউলিনিটিকে বোঝার ক্ষেত্রে ছবিটি সহায়ক। এই ছবিটি নতুন যুগের পুরুষ ও তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে উপস্থাপিত করে। এখানে দেখার বিষয়, হিন্দি ছবির এই নতুন ম্যাসকিউলিনিটি কীভাবে নির্মিত হচ্ছে। একইসঙ্গে আমি ম্যাসকিউলিনিটির এই নতুনত্বকেই প্রশ্ন করেছি। আমি বলতে চেয়েছি এই নতুনত্ব আদতে কোনও নতুনত্বই নয়। শুধু তা-ই নয়, আমি দেখাতে চেয়েছি ‘নতুন পুরুষের প্রতিচ্ছবি’ আসলে নারীবাদী দাবিগুলোকে আত্মসাৎ করার কৌশল। তবে আমি এখানে কোনও চক্রান্তের কথা বলতে চাইছি না। এখানে আমি মনে করিয়ে দেব যে আরও নানা ধরনের নেগোশিয়েশন আমাদের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তথা হিন্দি চলচ্চিত্রের পরিসরে দেখা যায় যা যৌন রাজনীতি বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক। কিন্তু আমি এখানে এই নতুন ধরনের ম্যাসকিউলিনিটিকেই বিশ্লেষণের জন্য বেছে নিয়েছি। এবার দিল চাহতা হ্যায় ছবিটা বাছার পিছনের কারণটা বলি। ২০০১-এ যখন এই ছবি মুক্তি পেল তখন ছবিটা জনপ্রিয় হয়েছিল নতুন প্রজন্মের ছবি হিসেবে। শহুরে যুবক-যুবতীর এক অংশ এই ছবির সঙ্গে নিজেদের আত্মস্থ করতে পারছিল। ছবির প্রথম গান ‘হাম হ্যায় নয়ে, আন্দাজ কিউ হো পুরানা’ শুধু জনপ্রিয়ই হয়নি, গানের কথাগুলো যেন বলছে নতুন প্রজন্ম শুধুমাত্র সময়ের নিরিখেই নতুন নয় তারা যেন ভাবনাচিন্তার ক্ষেত্রেও নতুনত্ব প্রকাশ করতে উদ্‌গ্রীব। হিন্দি চলচ্চিত্রের নতুন ম্যাসকিউলিনিটি বোঝার ক্ষেত্রে তাই খুব স্বাভাবিকভাবে এই ছবির আলোচনা চলে আসে। এই প্রসঙ্গে অবশ্য আরও বেশ কিছু সাম্প্রতিক ছবির কথা আমরা ভাবতে পারি কিন্তু এই প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরে একাধিক ছবি নিয়ে কথা বলা সম্ভব হল না।

আকাশ, সমীর এবং সিদ্ধার্থ নামে তিন উচ্চবিত্ত হালফ্যাশনের শহুরে যুবকদের বন্ধুত্বের গল্প দিল চাহতা হ্যায়। কলেজের সময় থেকে তাদের বন্ধুত্ব হঠাৎই নষ্ট হয়ে যায় কথা কাটাকাটির দরুন। ছবির বেশিরভাগটাই ফ্ল্যাশ ব্যাকে, সমীর সিদ্ধার্থকে পুরনো ঘটনা শোনাচ্ছে। এই ছবির প্রথম গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য হল গ্র্যাজুয়েশন ডে পার্টি। এই দৃশ্যে আমরা প্রথম প্রেম ও বিবাহ সম্পর্কে আকাশের ধারণা জানতে পারি। আকাশ যখন প্রথম বার শালিনীকে দেখে উত্তেজিত তখন সিদ্ধার্থ আকাশকে মনে করিয়ে দেয় যে শালিনী ঠিক আকাশের ‘টাইপ’ নয়। প্রসঙ্গত আকাশের টাইপ বা উপযুক্ত মেয়ে কেমন এই প্রশ্নটা এসেই যায়। আকাশ মনে করে তার উপযুক্ত মেয়ে নিজের মতো করে বাঁচবে ও তাকে তার মতো করে বাঁচতে দেবে। আমি বলতে চাই এই চাওয়ার মধ্যে নতুনত্ব কিছুই নেই। পুরুষেরা চিরকালই লিঙ্গসাপেক্ষে পরিসরের বিভাজন (Gender segregation of space) দাবি করে এসেছে। নতুনত্ব এখানেই যে তারা এখন নারীবাদী বাগ্মিতা (Feminist rhetoric) ব্যবহার করছে। নারীবাদ নারীর স্বাধীনতা ও স্বনির্ভতার বিষয়টা গুরুত্ব দিয়েছে। নতুন পুরুষ নতুন নারীর উপযুক্ত সঙ্গী হতে গিয়ে নারীবাদের এই দিকটা তুলে ধরেছে। তারা লিঙ্গের ভিত্তিতে পরিসরের বিভাজনকে বৈধতা দান করতে গিয়ে নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রসঙ্গটা নিয়ে এসেছে। এক্ষেত্রে স্ববিরোধিতাটা হল, নতুন পুরুষের এই প্রত্যাশা নারীবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েও এই ‘নারীবাদী প্রত্যাশা’ অনেক ক্ষেত্রেই নারীর প্রকৃত চাহিদার পরিপূরক নয়। এরপর আমরা দেখি আকাশ হাঁটু মুড়ে শালিনীকে প্রেম নিবেদন করে। তার এই প্রেম নিবেদন হাস্যকর ও কৌতুক উদ্রেককারী। এখানে পুরুষালি শিভাল্‌রির পরিবর্তে আকাশের সহজ ও পরিহাসপূর্ণ ব্যক্তিত্বই ধরা পড়ে। অপর দিকে রোহিত, শালিনীর বাগদত্ত পুরুষ, বিষয়টাকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে আকাশের চোখে ঘুষি মারে। এই দৃশ্যে আমরা দু’ ধরনের ম্যাসকিউলিনিটি দেখি। এক দিকে আকাশ, যে কিনা সহজ ও পরিহাসপ্রিয়, অপর দিকে রোহিত, যে কিনা আগ্রাসী ও কর্তৃত্বপ্রবণ প্রেমিক। রোহিত এক অর্থে প্রথাগত ম্যাসকিউলিনিটিকেই উপস্থাপিত করে। কিন্তু পর্যায়ক্রমে আমরা দেখব এই পার্থক্য খুবই আপাত। শেষে আকাশও সমান আগ্রাসী ও কর্তৃত্বপ্রবণ প্রেমিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবে।

পরবর্তী দৃশ্যে আমরা দেখি সমীর তার বান্ধবী প্রিয়ার সঙ্গে সমুদ্রের ধারে জগিং করছে। প্রিয়া সমীরকে বলে সমীর যেন আকাশ ও তার মধ্যে একজনকে বেছে নেয়। আমরা এখানে পুরুষের বন্ধুত্ব ও প্রেমের মধ্যেকার চিরাচরিত বিরোধিতাকেই প্রত্যক্ষ করি। যদিও শেষপর্যন্ত এই বিরোধের সমাধান হয় তিন বন্ধুর যোগ্য সঙ্গিনী নির্বাচনের মাধ্যমে। আধুনিক শহুরে পুরুষের যোগ্য আধুনিক নারী এমনই হবে যে তারা তাদের সঙ্গীদের যথেষ্ট পরিসর দেবে এবং আধুনিক পুরুষের বন্ধনও (Male bonding) এমন হবে যা আমাদের সমাজ ব্যবস্থার প্রথানুগ বিসমকামিতাকে সমস্যায় ফেলবে না।

পরের কয়েকটি দৃশ্য গল্পের প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তারা যশপালের সঙ্গে পরিচিত হই। তারা একজন স্বনির্ভর ইন্টিরিয়র ডিজাইনার এবং সিদ্ধার্থের প্রতিবেশী। সিদ্ধার্থের সঙ্গে তার আলাপ হয় যখন সে নতুন বাড়িতে এল। সিদ্ধার্থ তাকে তার আঁকা ছবি দেখতে ডাকে ও তাদের মধ্যে এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়। এরপর আমি গোয়ার দৃশ্যের কিছু অংশ উল্লেখ করব। এখানে আমরা দীপা ও সিদ্ধার্থের মধ্যে কথোপকথন দেখি। দীপাকে দর্শকরা আগেই দেখেছেন আকাশের গুণমুগ্ধ হিসেবে। এখানে আমরা দেখি সিদ্ধার্থ দীপাকে নিয়ে অন্যদের মতো হাসিঠাট্টা করছে না, বরঞ্চ তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। ছবির শেষে গিয়ে আমরা দেখব দীপাই সিদ্ধার্থের আদর্শ সঙ্গিনী। সিদ্ধার্থের প্রতিবেশী ইন্টিরিয়র ডিজাইনার তারা যশপাল কোনওভাবেই তার সঙ্গিনী হতে পারে না। মূলস্রোতের ছবি সিদ্ধার্থের চেয়ে প্রায় পনেরো বছরের বড়, ডিভোর্সি, মদ্যপ ও এক কন্যা সন্তানের মাকে কখনওই সিদ্ধার্থের সঙ্গিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। শেষপর্যন্ত তারা যশপালকে তাই লিভার সিরোসিসে মারা যেতে হয়।

এই ছবিতে ম্যাসকিউলিনিটির নির্মাণ দেখতে হলে একটা প্রান্তিক চরিত্রের কথা উল্লেখ না করলেই চলে না— তিনি হলেন আকাশের বাবা। খাবার টেবিলের একটা দৃশ্যে আমরা জানতে পারি, আকাশের বাবা আকাশকে সিডনিতে তার এক্সপোর্ট ব্যাবসা দেখতে পাঠাবেন বলে মনস্থ করেছেন। তিনি এও বলেন তার ভালবাসা আকাশকে নষ্ট করেছে। তিনি সবসময় ভেবেছেন আকাশের আরেকটু সময় দরকার। হিন্দি চলচ্চিত্রের পরিসরে এইরকম পুরুষ চরিত্র সচরাচর দেখা যায় না। আমরা সাধারণভাবে মাকেই দেখি সন্তানকে (বিশেষত পুরুষসন্তানকে) যত্ন ও ভালবাসা দিয়ে ‘নষ্ট’ করতে, কিন্তু এখানে মায়ের সামনে বাবা তার সন্তানস্নেহ প্রকাশ করছেন। যখন আকাশ তার ও শালিনীর সম্পর্ক নিয়ে বিচলিত থাকবে, তখনও আমরা দেখব, আকাশের বাবাই তাকে সান্ত্বনা ও পরামর্শ দিচ্ছেন। এখানে আমরা দেখি মাতৃত্বের আদলে পিতৃত্ব এবং এই ধরনের পিতৃত্ব কিন্তু নতুন পুরুষ নয় পূর্ববর্তী প্রজন্মের পুরুষের মধ্যেই দেখি। অর্থাৎ কিনা পূর্ববর্তী প্রজন্মও নরম ও অনুভূতিশীল হতে পারে। তবে নতুন পুরুষের নতুনত্ব কোথায়? তফাতটা হয়তো এই— নতুন পুরুষের আপাত নতুনত্ব নারীবাদী আন্দোলন ও বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে বিশেষভাবে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে এবং এর অন্য রাজনৈতিক মাত্রা আছে।

নতুন প্রজন্মের নতুনত্ব বোঝার জন্য তাদের প্রেম ও বিবাহের ধারণাটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সমীর এবং পূজার পরিবার তাদের বিয়ে স্থির করে। কিন্তু সমীর এবং পূজা দু’জনেই মনে করে সম্বন্ধ করে বিবাহ পুরনো পন্থা। মজাটা হল সম্বন্ধ করে বিয়ে পুরনো ধারণা হতে পারে, কিন্তু পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী প্রজন্ম ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে খুব-একটা পার্থক্য দেখি না। তাই সমীরের পূজার প্রেমে পড়াটাই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সে শুধু পারিবারিক বন্ধুর মেয়ে পূজাকেই বিয়ে করে না, পারিবারিক কম্পিউটার ব্যাবসাও উত্তরাধিকারসূত্রে অর্জন করে। অর্থাৎ কিনা কোনওভাবেই পারিবারিক ঐতিহ্যকে না ভেঙে সে তার সামাজিক অবস্থানকে অক্ষুণ্ণ রাখে।

আকাশ, সমীর ও সিদ্ধার্থের বন্ধুত্ব একটা গুরুত্বপূর্ণ বাঁক নেয় তারার জন্মদিনে। সিদ্ধার্থ বন্ধুদের কাছে তারার প্রতি তার ভালবাসা প্রকাশ করে। তার বন্ধুরা এটাকে পাগলামো মনে করে। সিদ্ধার্থ মনে করে কেউ হিসেব করে ভালবাসে না। সে এটাও বলে যে সে আশা করে না তারা তাকে ভালবাসবে বা বিয়ে করবে। আকাশ এতে আশ্বস্ত হয়। তার মতে তারা সিদ্ধার্থের উপযুক্ত। তারা একা থাকে, সিদ্ধার্থের তার বাড়িতে আসা-যাওয়া আছে এবং তারা অভিজ্ঞ। আকাশের মন্তব্য সিদ্ধার্থকে আঘাত করে। সে মনে করে আকাশ বন্ধুত্বের সীমা অতিক্রম করেছে। এই ঘটনা তাদের বন্ধুত্বকে নষ্ট করে। প্রেম বিষয়ে তাদের মতপার্থক্য, বিশেষত বয়স্ক মহিলার সঙ্গে অল্পবয়সি পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে তাদের মতামত, তাদের নিজেদের সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। শুধু তা-ই নয়, এই ধরনের সম্পর্কের প্রতি কোনওরকম সহানুভূতি বা সমর্থন আমরা এই ছবিতে দেখি না। কেউ হয়তো বয়স্ক মহিলার প্রেমে পড়তে পারে কিন্তু যখন সঙ্গিনী নির্বাচনের প্রশ্ন ওঠে তখন অল্পবয়সি মহিলাই নির্বাচন করে।

গল্পটা আরেকটু এগোয়। এই ঘটনায় পরদিন সিদ্ধার্থ কৌশানি চলে যায় এবং এক সপ্তাহের মধ্যে আকাশ সিডনি চলে যায়। প্লেনে আকাশের সঙ্গে শালিনীর দেখা হয়। শালিনী তার মামা মহেশের বাড়ি যাচ্ছে। এরপর আমরা শালিনী ও আকাশকে সিডনিতে ঘুরতে দেখি। একটা রেস্তোরাঁর দৃশ্যে তাদের কথোপকথন আমার আলোচনাযোগ্য বলে মনে হয়। আকাশ শালিনীকে বলে রোহিত নিশ্চয়ই তাকে আকাশের সঙ্গে মেলামেশা না করতে বলেছে। শালিনী জানায় রোহিত কোনও ছেলের সঙ্গেই তার মেলামেশা পছন্দ করে না। সে একইসঙ্গে বলে রোহিত হয়তো একটু কর্তৃত্বপ্রবণ কিন্তু আদতে ভাল ছেলে। আমরা এই কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে আবার রোহিতের আগ্রাসী ও কর্তৃত্বপ্রবণ চরিত্রের আভাস পাই যা কিনা পুরুষালি শিভাল্‌রির উপর প্রতিষ্ঠিত। আপাতভাবে, রোহিতের মধ্যে যে কর্তৃত্বের ধরন দেখি আকাশকে তার দূরে অবস্থিত বলেই মনে হয়। কিন্তু শেষে গিয়ে দেখব আকাশও রোহিতের থেকে খুব আলাদা নয়। শালিনী আকাশকে তার বান্ধবী বিষয়ে প্রশ্ন করে। আকাশ জানায় তার বান্ধবী হয় কিন্তু কয়েক সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয় না। শালিনী এর কারণ জিজ্ঞাসা করে। আকাশ জানায়, সে তার বন্ধুদের দেখেছে তাদের বান্ধবীদের সঙ্গে, প্রেম ছাড়া সব কিছুই তারা আদান-প্রদান করে। আকাশ মনে করে সে ভাল আছে, কারুর কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হয় না। শালিনী জানায় রোহিতকেও তার কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। আমরা উপলব্ধি করি শালিনী সত্যিকারের মুক্তমনা স্বাধীন মহিলা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী। কিন্তু আকাশ মনে করিয়ে দেয়, রোহিতের কাছে শালিনীকে জবাবদিহি করতে হয়। আকাশ এটাও বলে জবাবদিহির দাবিটা যে সবসময় মহিলাদের তরফ থেকে আসে তা-ও নয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত সব সম্পর্কেই স্বতন্ত্রতার কোনও জায়গা থাকে না। এখানেও আমরা নারীবাদী ধ্যানধারণার প্রভাব দেখি। নারীবাদই প্রথম বিসমকামী সম্পর্কে পুরুষের কাছে নারীর জবাবদিহি তথা নারীর আত্মসমর্পণের বিষয়টা তুলে ধরে। এই দৃশ্যের আলোচনা থেকে আমরা কি এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে আকাশের উগ্র পৌরুষ আসলে রোম্যান্টিক সম্পর্কের অস্বীকৃতি দ্বারা নির্মিত? এই রোম্যান্টিক সম্পর্ক কিন্তু আমাদের সামাজিক কাঠামোতে প্রথানুগ বিসমকামিতাকে বহাল রাখতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কি আকাশ একভাবে বিসমকামী পুনরুৎপাদনের ক্ষেত্রকে নস্যাৎ করছে? আকাশের এই প্রথাগত দাম্পত্যের বাইরে থাকার ইচ্ছা কি পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর ক্ষেত্রে কোনও মৌলিক পরিবর্তন ইঙ্গিত করে? কিন্তু শেষে আমরা দেখব আকাশ শালিনীর প্রেমে পড়বে ও তাকে বিয়ে করবে। অর্থাৎ কিনা সাম্প্রতিক কালে আমাদের সামাজিক কাঠামোতে প্রথানুগ বিসমকামিতার যে সংকটের কথা আগে বলেছি তা যেন অপসারিত হয় এই পাঠ্যের শরীর থেকে।

নতুন নারী নতুন পুরুষের ধারণা শুধুমাত্র প্রথাগত নারী-পুরুষের থেকে আলাদা নয়। একে অপরের বৈশিষ্ট্য বা গুণকে আত্মস্থ করে, একে অপরের সুযোগ্য সঙ্গী হবার প্রচেষ্টার মাধ্যমে যেন বিসমকামী পিতৃতন্ত্রকেই বদান্যতা দিতে চেয়েছে। দুটো উদাহরণ দিয়ে এটা বোঝানো যেতে পারে। দুটো উদাহরণই শালিনী ও আকাশের সিডনি ভ্রমণকালীন দৃশ্যে দেখা যায়। আমরা শালিনী ও আকাশকে একটা বিনোদন উদ্যানে দেখি। শালিনী কোনও রাইড বা যানে চড়তে উৎসাহী নয়। আকাশ শালিনীকে তার ভয়ের কারণ জিজ্ঞাসা করলে শালিনী জানায় সে মোটেও ভয় পায় না। সে মনে করে এই রাইড বা যানগুলোতে যারা চড়ে তারা মানসিকভাবে অসুস্থ। আকাশ এটাকে স্রেফ একটা অজুহাত মনে করে। তার মতে এগুলোতে চড়তে সাহস লাগে যা শালিনীর নেই। সুতরাং শালিনী তার নির্ভীকতা প্রমাণের জন্য অবশেষে একটা যানে চড়ে। প্রথাগত ভাবে ‘সাহস’ একটা পুরুষালি বৈশিষ্ট্য। আমাদের সমাজে পুরুষদেরই সাহসের প্রমাণ দিতে হয়। আমি এখানে বলার চেষ্টা করছি নারীবাদী হস্তক্ষেপের ফলেই ‘সাহস’ গুণটা নারীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়। যৌনসমতার দাবির সঙ্গে সঙ্গে নারীকে ‘পুরুষালি বৈশিষ্ট্য’ আত্মস্থ করতে হয়। সুতরাং ‘সাহস’ আর শুধুমাত্র পুরুষালি বৈশিষ্ট্য নয় এবং শালিনীর মতো সমকালীন মুক্তমনা নারীকে সাহসের প্রমাণ দিতে হয়। মজাটা হল, এটা যেমন নারী আন্দোলনের একটা প্রভাব তেমনই প্রথানুগ বিসমকামিতাকে ধরে রাখারও চেষ্টা। নারী পুরুষের গুণ আত্মস্থ করে শুধু আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সমানাধিকারই দাবি করছে না, সে যেন গুণগুলো আত্মস্থ করে পুরুষের যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে উঠছে। এখানে যেন নারী-পুরুষের পরিপূরকতার ধারণাটা ভেঙে, নারী-পুরুষের সহধর্মিতার বা সমমানসিকতার বিষয়টাই প্রকাশ পাচ্ছে। এই সহধর্মিতার ধারণাটা প্রকাশ পাচ্ছে কিন্তু পুরুষের আধিপত্যের প্রশ্নকে উহ্য রেখে। এরপর আরেকটা দৃশ্যের কথা বলি। আমরা দেখি আকাশ একটা মেট্রো ট্রেনে উঠে পড়ে কিন্তু শালিনী উঠতে পারে না। শালিনী মেট্রো স্টেশনে অপেক্ষা করে। একটা ভবঘুরে তার দিকে এগিয়ে আসে এবং সে ভয় পেয়ে যায়। ঠিক এইসময় আকাশ পিছন থেকে উপস্থিত হয়। হিন্দি চলচ্চিত্র দেখতে অভ্যস্ত দর্শক আশা করে আকাশ এই ভবঘুরেটাকে আঘাত করবে বা অন্ততপক্ষে কিছু বলবে ও শালিনীকে বাঁচাবে। কিন্তু ছবিতে এরকম কিছুই হয় না। বরঞ্চ আমরা দেখি আকাশ ভবঘুরেটাকে আলিঙ্গন করে এবং বলে শালিনী নিশ্চই তাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। ভবঘুরেটা আকাশকে পাগল মন করে চলে যায়। এই দৃশ্য শুধু মজারই নয় নতুন ম্যাসকিউলিনিটি বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই দৃশ্য উগ্র ও আগ্রাসী ম্যাসকিউলিনিটির সমালোচনা করে। এখানে নতুন নরম অনুভূতিশীল ম্যাসকিউলিনিটি যেন ফেমিনিনিটির আদলে নির্মিত। নারী যেমন ‘সাহস’-এর মতো পুরুষালি গুণকে আত্মস্থ করে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠেছে তেমনই নতুন পুরুষও যেন নারীসুলভ গুণগুলোকে আত্মস্থ করে নারীর সহযোগী ও সহমর্মী হয়ে উঠেছে। আমি আগেই বলেছি সাম্প্রতিক কালে যেন নারী-পুরুষের পরিপূরকতার ধারণাটা ভেঙে সহধর্মিতার ধারণাটা প্রাধান্য পাচ্ছে এবং এক্ষেত্রে নারীবাদের প্রভাব প্রচ্ছন্ন। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে এখানে পুরুষের আধিপত্যের প্রশ্নটা উহ্য থেকে যাচ্ছে। তাই এই পরিবর্তন আপাত। তা ছাড়া অনেক ধরনের ম্যাসকিউলিনিটির উপস্থাপনার মধ্যে এই ‘নরম অনুভূতিশীল’ অন্যতম এবং হিন্দি চলচ্চিত্রের পরিসরে প্রথাগত ম্যাসকিউলিনিটির উপস্থাপনা এখনও বিদ্যমান। এমনকী আমরা পরে আকাশের মধ্যেই উগ্র ও আগ্রাসী ম্যাসকিউলিনিটির লক্ষণ দেখব।

আমরা আগেই সমীর ও পূজার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছি। তাদের সমস্যাটা এই নয় যে তারা বাবা-মার পছন্দ করা পাত্র বা পাত্রীকে বিয়ে করতে চায় না। তাদের সমস্যা হল, এই পাত্র বা পাত্রীর সঙ্গে তাদের পরিচয়ের ধরনটা (বাবা-মায়ের আলাপ করিয়ে দেওয়া) নিয়ে। এটা বলাই যেতে পারে যে পাত্র-পাত্রী পছন্দের ক্ষেত্রে তারা কোনও মৌলিকত্ব দেখাতে পারেনি। তাদের দাম্পত্য এক অর্থে হিন্দি চলচ্চিত্রের পরিসরে পূর্ববর্তী বিসমকামী দাম্পত্য গঠনের ধারাবাহিকতাকেই ইঙ্গিত করে। এটা ভালো বোঝা যায় ‘ও লেড়কি হ্যায় কাঁহা’ গানের দৃশ্যে। আমরা দেখি সমীর এবং পূজা সিনেমা হলে এই গানের দৃশ্য দেখছে। এরপরেই দেখা যায় তারা নিজেরাই তিনটে পৃথক অবস্থানে নাচ-গান করছে। প্রথমটা সাদা-কালোতে, দ্বিতীয়টা হুড-খোলা গাড়িতে এবং তৃতীয়টা প্রাকৃতিক পরিবেশে যা কিনা হিন্দি চলচ্চিত্রের বিভিন্ন যুগকে প্রতিফলিত করে। এই দৃশ্যেই সমীর উপলব্ধি করে পূজাই তার যোগ্য সঙ্গিনী। এই দৃশ্যটা শুধুমাত্র হিন্দি চলচ্চিত্রের সূত্রনির্দেশ করে উপস্থাপিত একটা শৈলীগত বৈশিষ্ট্য নয়। একভাবে এই দৃশ্যটা হিন্দি চলচ্চিত্রের পরিসরে বিসমকামী দাম্পত্যের অপরিবর্তনশীলতাকেই প্রকাশ করে।

গল্পের দিক থেকে এরপরের গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য হল যখন সিদ্ধার্থের মা ও তারা জানতে পারে সিদ্ধার্থের তারাকে পছন্দ। সিদ্ধার্থ তারার প্রতি তার ভাল লাগা প্রকাশ করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। মা বার বার জিজ্ঞাসা করতে সে বলে যে সে তারাকে ভালবাসে। সিদ্ধার্থের মা এটা শুনে ক্রুদ্ধ হন। এবং তারা মা-ছেলের কথোপকথন শুনে ভেঙে পড়ে। তারা সিদ্ধার্থকে জিজ্ঞাসা করে যে সে কী করে ভাবল এরকম একটা সম্পর্ক সম্ভব। সে আরও বলে যে, এই প্রজন্মের সমস্যা হল তারা মনে করে সব কিছুই সম্ভব। আমরা এখানে দেখি নতুন প্রজন্মের নতুনত্ব নিয়ে তারার অস্বস্তি। কিন্তু এই ছবির আলোচনায় দেখব নতুনত্ব নিয়ে তারার যে অস্বস্তি তা আদতে নতুন নয়।

ওদিকে সিডনিতে আমরা দেখি আকাশ ও শালিনী একসঙ্গে সময় কাটাচ্ছে। অপেরার দৃশ্যটা তাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। প্রেমের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য শালিনী আকাশকে অপেরায় নিয়ে আসে। শালিনী অপেরার গল্পটা আকাশকে শোনায় এবং একটা সময় আকাশকে বলে চোখ বুজে এমন একজনের কথা ভাবতে যার সঙ্গে একটা মুহূর্ত কাটানোর জন্য হাজার মৃত্যু সহ্য করা যায়। আমরা দেখি আকাশ শালিনীর কথাই ভাবে। এরপরে শালিনী মহেশের বাড়িতে আকাশকে রাতের খাবারের জন্য নিমন্ত্রণ করে। আমরা জানতে পারি রোহিত ও শালিনী ভারতবর্ষে ফিরে যাবে ও তারা খুব সম্প্রতি বিয়ে করবে। আকাশ নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসে ও তারা সকলে নীরবে খায়; এমন সময় রোহিত মহেশকে তাদের গ্রাজুয়েশন ডে পার্টির গল্প করে ও আকাশের কাছে ক্ষমা চায়। আকাশ জানায় সে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। শালিনী যদি আকাশের সঙ্গে থাকত এবং কেউ শালিনীর সঙ্গে ওরকম ব্যবহার করত তবে আকাশ তাকে মেরে ফেলত। আমরা যদি আকাশের বক্তব্য আক্ষরিকভাবে না-ও নিই, আমরা বুঝতে পারি আকাশও প্রেমিক হিসেবে যথেষ্ট আগ্রাসী ও কর্তৃত্বপ্রবণ। সহজ পরিহাসপূর্ণ ব্যক্তিত্ব তার চরিত্রের আপাত বৈশিষ্ট্য। এরপরের দৃশ্যে শালিনী, রোহিত ও মহেশ ভারতবর্ষে ফিরে যায় ও আকাশ একা হয়ে পড়ে। ফোনে তার বাবার সঙ্গে কথোপকথনের সময় আকাশ কেঁদে ফেলে। তার গলার স্বর শুনে তার বাবা তাকে ভারতবর্ষে চলে আসতে বলে। এখানে আমরা শুধু আকাশের চরিত্রের নরম দিকটা দেখি না, তার বাবার চরিত্রের স্নেহপ্রবণতাকে অনুভব করি। তার বাবা তাকে সান্ত্বনা ও পরামর্শ দেন। আকাশ ও সমীর মহেশের সঙ্গে দেখা করে ও জানতে পারে কেন শালিনী রোহিতকে বিয়ে করছে। রোহিতের বাবা শালিনীর বাবার ব্যাবসার সঙ্গী ছিল। শালিনীর যখন ছ’বছর বয়স তখন তার মা-বাবা দুর্ঘটনায় মারা যায়। রোহিতের বাবা-মাই শালিনীকে বড় করে। তাই রোহিতের বাবা-মা যখন রোহিতের সঙ্গে শালিনীর বিয়ে দিতে চায় শালিনী না করতে পারে না। মহেশ তাদের এও জানায় যে পরের দিনই শালিনীর বিয়ে।

এরপরে আমরা দেখি শালিনীর বিয়ের নাচ-গানের দৃশ্য। শালিনীকে ঘিরে সবাই নাচ-গান করছে। এমন সময় আকাশ উপস্থিত। আকাশ শালিনীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় এবং জানায় সে একমাত্র শালিনীকেই ভালবাসে। স্বাভাবিকভাবেই নাচ-গান বন্ধ হয়ে যায়। রোহিতের বাবা পুরো বিষয়টা জানার পর বলেন শালিনী যদি তার ঋণ শোধ করতে চায় তবে যেন আকাশকেই বিয়ে করে। তিনি শালিনীকে আকাশের হাতে সমর্পণ করে বলেন শালিনী তার মেয়ে এবং আকাশ যেন তার খেয়াল রাখে। আকাশ ও শালিনী পরস্পরকে আলিঙ্গন করে। রোহিতের কাছে এই পরিস্থিতিটা অসম্মানজনক বলে মনে হয় এবং সে শালিনীকে ধরতে যায়। কিন্তু এবার আকাশ তাকে আঘাত করে। এখন আকাশ শালিনীর বৈধ রক্ষক। আকাশকে এখন আর রোহিতের থেকে খুব আলাদা লাগে না। সেও সমান আগ্রাসী ও কর্তৃত্বপ্রবণ প্রেমিক হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করে। ফ্ল্যাশ ব্যাক এখানেই শেষ হয়। আমরা দেখি আকাশ ও সমীর তাদের যথার্থ সঙ্গিনী খুঁজে পেয়েছে।

গল্পটা আরও এগোয়। আকাশ হাসপাতালে আসে যেখানে তারা ভরতি। আকাশ সিদ্ধার্থের কাছে ক্ষমা চায় ও তারা পরস্পরকে আলিঙ্গন করে। এরপরই আমরা দেখি তারা মারা যায় এবং সিদ্ধার্থ ও তারার কোনওরকম সম্পর্কের সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়। ছ’মাস বাদে দেখা যায় তিন বন্ধু আবার গোয়াতে এসেছে। তাদের সঙ্গে শালিনী ও পূজাও এসেছে। আমরা দেখি সিদ্ধার্থ দীপার কথা ভাবছে এবং বোঝা যায় যে দীপাই সিদ্ধার্থের যোগ্য সঙ্গিনী। শেষ দৃশ্য যখন কলাকুশলীদের নামের তালিকা পরদায় দেখা যায় তখন দেখি ছ’জন একসঙ্গে বসে খাচ্ছে। সমকালীন শহুরে যুবকেরা তাদের যোগ্য সঙ্গিনী খুঁজে পেয়েছে এবং প্রথানুগ বিসমকামী সামাজিক সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ থাকছে। এই ছবির নিবিড় পাঠ থেকে আমরা বুঝি নতুন পুরুষের যে নতুনত্বের কথা গোড়ায় বলেছিলাম তা আদতে প্রথাগত ম্যাসকিউলিনিটির থেকে খুব-একটা আলাদা নয়। এই নতুন পুরুষের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে নতুন নারীকে এই পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে আরও সক্রিয়ভাবে আনতে।

এই প্রবন্ধে আমি বলার চেষ্টা করেছি নারীবাদী আন্দোলনের প্রভাবেই সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রে ‘নতুন অনুভূতিশীল পুরুষের’ প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। কিন্তু এই নতুন পুরুষের প্রতিচ্ছবি প্রথাগত পুরুষের প্রতিচ্ছবির পাশাপাশিই অবস্থান করছে এবং মূলস্রোতের প্রতিক্রিয়াশীল মর্মস্থলকে কোনওভাবেই প্রশ্ন করছে না। এক অর্থে হিন্দি চলচ্চিত্রে বিদ্যমান পুরুষের আধিপত্যের বিষয়টাই এই উপস্থাপনাগুলোয় উঠে আসে। আমি এই আধিপত্যের প্রশ্নটা বোঝার চেষ্টা করেছি বিশ্বায়নের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে যা সাংস্কৃতিক অসমসত্ত্বতা ও বহুরূপতাকেই প্রাধান্য দেয়। এই কারণেই হিন্দি চলচ্চিত্রের পরিসরে ভিন্নধর্মী ম্যাসকিউলিনিটির উপস্থাপনা শুধু সম্ভব নয় সহজও হয়ে উঠেছে। আমি এটাও বলার চেষ্টা করেছি, যেকোনও র‌্যাডিকাল আন্দোলন হয়তো শেষে একটা ফ্যাশনেই পরিণত হয় এবং আপাত পরিবর্তনগুলো হয়তো আদতে কোনও পরিবর্তনই নয়। আমার প্রতিপাদ্য নতুন পুরুষের প্রতিচ্ছবি কোনওভাবেই পুরুষের আধিপত্যকে প্রশ্ন করে না বরং অন্যরূপে পুরুষের আধিপত্যকে অক্ষুণ্ণ রাখে।

টীকা সূত্রনির্দেশ

. Farhan Akhtar, Dil Chahta Hai, 2001.

. Fredric Jameson, ‘Notes on Globalization as a Philosophical Issue’, The Cultures of Globalization, eds. Fredric Jameson and Masao Miyoshi (Duke University Press, Durham, 1998), p. 55.

. Elizabeth Grosz, ‘Sexual Difference and the Problems of Essentialism’, Margins, February 2002, pp. 86-97.

. Ibid., p. 94.

. এখানে আমার ‘নিও-ট্র্যাডিশনালিজ্ম’ শব্দের ব্যবহার আশীষ রাজাধ্যক্ষর ব্যবহার অনুসরণ করে। তার মতে প্রযুক্তিবিদ্যার প্রভাবে একটা নতুন ধরনের ঐতিহ্যের নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। দেখুন: Ashis Rajadhyaksha, ‘Neo-Traditionalism: Film as Popular Art in India’, Framework, 32/33, 1986, pp. 20-65.

. এখানে আমার বিশ্লেষণে একটু সরলীকরণের প্রবণতা আছে বলে মনে হতে পারে। বিষয়টা জটিল করতে ‘Co-option’ বা ‘সহ-যোগ’-এর ধারণাটা সদর্থক হতে পারে। অর্থাৎ কিনা আত্মসাতের প্রশ্নটা সহ-যোগ হিসেবেও দেখা যেতে পারে। নারীবাদী আলোচনায় বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তির সঙ্গে নারীবাদের সহ-যোগ বিষয়টা গুরুত্ব পেয়েছে। মেরি ই. জন-কে উদ্ধৃত করতে চাই: ‘One often hears of the “co-option” of the women’s movement by other forces such as Hindu Right, the state or certain NGOs. This gives one the impression that women’s movement had a “pure” beginning of its own, which only subsequently, that is to say, at some later stage, came to be taken over by different, contrary influence.’ দেখুন: Mary E. John ‘Gender, Development and Women’s Movement: Problems for a History of the Present’, Signposts: Gender Issues in Post–Independence India, ed. Rajeswari Sunder Rajan (New Delhi: Kali for Women, 2001), p. 103.

. Jean Bandrillard, Symbolic Exchange and Death (New Delhi: Sage, 1993), p. 89.

. Fredric Jameson, ‘Postmodernism and Consumer Society’, Norton Anthology of Theory and Criticism, ed. Vincent B Leitch (New York: Norton, 2001), pp 1972-1973.

. Stuart Edwin, ‘All Consuming Images: The Politics of Style in Contemporary Culture’, Literary Theory: An Anthology, eds. Julie Rivkin and Michael Rayan (Massachusets: Blackwell Publishers, 1998), p. 1082.

১০. Dick Hebdige, ‘Subculture: The Meaning of Style’, Literary Theory: An Anthology, eds Julie Rivikin and Michael Rayan (Massachusetts: Blackwell Publishers, 1998), p. 1073.

১১. Raymond Williams, ‘Base and Superstructure in Marxist Culture Theory’, Problems in Materialism and Culture (London: Verso, 1980).

১২. Fredric Jameson, ‘Postmodernism or the Cultural Logic of Late Capitalism’, New Left Review, 146, July-August, 1984, pp. 53-92.

১৩. Slavoj Zizek, ‘Multiculturalism, or the Cultural Logic of Multinational Capital’, New Left Review, 1/225, Sept-Oct, 1997, pp. 28-51.

১৪. Gayatri Chakravorty Spivak, ‘Culture’, A Critique of Postcolonial Reason: Towards a History of Vanishing Present (Harvard: Harvard University Press, 1999).

১৫. Ibid., p. 327.

১৬. Butler, ‘Merely Cultural’, New Left Review, 1/227, January-February, 1998, pp. 33-44.

১৭. এখানে আমি বলতে চাইছি আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের নেগোশিয়েশনটা আধুনিকতার সাধারণ বৈশিষ্ট্য এবং ঐতিহ্যের ধারণাটা একটা আধুনিক নির্মাণ। দেখুন: Eric Hobsbawm & Terence Ranger, The Invention of Tradition (Cambridge: Cambridge University Press, 1983).

১৮. Madhava M Prasad, Ideology of Hindi Film: A Historical Construction (New Delhi: Oxford University Press, 1998).

১৯. Anustup Basu, Bollywood in the Age of New Media: The Geo-Televisual Aesthetic (Edinburgh: Edinburgh University Press, 2010).

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *