সামিল

সামিল

পার্ক স্ট্রিট আর সার্কুলার রোডের মোড়ে এসে বাসটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল।

হয়তো সাড়ে ছটা বেজেছে। অফিস-ফেরতা রই রই করা লোকের ভিড়ে তখন ওই মাঝ রাস্তা থেকে অন্য কোনো যানবাহন পাওয়া অসম্ভব। তাই পার্ক সার্কাসের দিকেই হেঁটে যাবে ঠিক। করল রাঘব। ভাবল, আস্তে আস্তে পার্ক সার্কাস ট্রাম ডিপোতে গিয়ে পৌঁছোতে পারলে ট্রামে। হয়তো ওঠা যেতেও পারে।

ট্যাক্সি, পথে থাকলেও তা সাধারণ বা অসাধারণ মানুষেরও চড়ার জন্যে নয়। কোন দিকে যাবে? কেন যাবে? কখন যাবে? এবং আদৌ যাবে কিনা সবই নির্ভর করে ট্যাক্সিওয়ালার মর্জির উপর। তা ছাড়া, যা দাম বেড়েছে পেট্রোলের। ট্যাক্সির আশা এখন ছাড়তে হবে। এখন আসন্নপ্রসবা আত্মীয়া অথবা মরণাপন্ন আত্মীয় কাঁধে চেপেই হাসপাতালে বা অন্যত্র যেতে বাধ্য হন।

রাঘব ভাবছিল, মিনুটা এবারেও পরীক্ষাতে অঙ্কে ভালো করেনি। অথচ ওর টিউটর রাখার সামর্থ্য নেই। রাঘবই ওকে একটু-আধটু দেখিতে দিত অফিসের পর এবং ছুটির দিনে। ও নিজেও অঙ্কে ভালো ছিল না। একগাদা বিষয়, বই, লোডশেডিং এবং শিক্ষার ব্যাপারে কর্মকর্তাদের পৌনঃপুনিক অন্যায়ে দিশেহারা ছেলে-মেয়েদের ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া মুখের দিকে চাওয়া যায়। না আজকাল। অন্য অনেক অসহায় মা-বাবার মতো, রাঘবেরও খুব রাগ হয়। দাঁতে দাঁত ঘষে। কিন্তু কী করে, কেমন করে ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার এই ক্ষমাহীন। অপরাধের প্রতিবিধান করবে তা ভেবে পায় না।

অঙ্কটা ছোটোবেলায় নিজেও যদি ভালো করে শিখত তবে মিনুকে দেখিয়ে দিতে অসুবিধা হত। না। মেয়ে ক্লাশ এইটে উঠল। এখন ওদের যেসব বিষয় এবং যা যা পড়তে হয়, সব কিছু পড়াবার মতো বিদ্যাবুদ্ধি এম এ পাশ রাঘবেরও নেই। যদিও রাঘবদের সময়ে টোকাটুকি করে পাশ করাটা গণতান্ত্রিক, নৈতিক এবং যুগ-যুগ জীও অধিকার বলে কেউই স্বীকার করত না।

নানা কষ্টে ক্লিষ্ট রাঘব পা টেনে-টেনে হাঁটছিল পার্ক স্ট্রিট ধরে, পার্ক সার্কাস ময়দানমুখো। ডানদিকে মোটর গ্যারাজ-ট্যারাজ বাঁ-দিকে খাসি আর ভেড়ার মাংসের দোকান। চামড়া-ছাড়ানো উদলা মাংসে কেমন একটা গন্ধ ওঠে। পা-উপরে ধড়-নীচে করে সার সার খাসি ঝুলছে। কল্পনার নাকে, দই-মাংস অথবা রেজালার গন্ধ পায় রাঘব।

একটু গিয়েই সামনে একটা মিষ্টির দোকানে পড়ল। গরম গরম রসগোল্লা তুলছে কড়াই থেকে এনামেলের পাত্রে, তেলচিটে গামছা পরে একটি কালো মসৃণ চেহারার লোক। লোকটার গায়েও রসগোল্লা-সন্দেশের গন্ধ হয়ে গেছে। পথ থেকেই যেন টের পেল রাঘব। ওর খুব ইচ্ছে হল গোটা চারেক রসগোল্লা খায়। কবে কবে এবং কোথায় কোথায় ছোটোবেলায় ভালো রসগোল্লা। খেয়েছিল সেসব কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু হঠাৎ রাণু আর মিনুর কথাও মনে পড়ল। রসগোল্লা খাওয়া আর হল না।

মিনু ভালোবাসে ঝুঁদিয়া। হলুদ লাল। রাঘবদের ছোটোবেলায় নীল-সবুজ কুঁদিয়াও খেয়েছে ওঁরা? ছোটোবেলার রং মুছে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। সব রংই।

মিস্টির দোকানটা পেরিয়ে গেল। পেরিয়ে যেতে পেরে খুশি হল। যাদের মানুষ ভালোবাসে, তাদের কারণে নিজেকে বঞ্চিত করার মতো সুখ বেশি নেই। কিন্তু নিজেকে বঞ্চনার চরম করেও যখন ভালোবাসার জনদের তবুও সুখে রাখার সামর্থ্য থাকে না তখনকার যে কষ্ট, সে-কষ্টের। জ্বালাও সে ভালোই জানে।

রাণুর শখ বলতে কিছু নেই, শুধু পাউডার। কালে-ভদ্রে একটু সাবান। অনেক বছর আগে একদিন, বিয়ের পর রাণু হেসে বলেছিল, সাবান পাউডার তো তোমারই জন্যে। যখন বিছানায় শুতে আসি তখন ঘামের গন্ধ বুঝি ভালো লাগত তোমার?

হঠাৎই মনে পড়ল রাঘবের যে, আজকাল রাণু হাসেও না। কত দিন, কত বছর যে ভালো করে হাসে না রাণু! হাসি, আনন্দ, মজা বলতে আর কিছু বাকি নেই তার।

কষ্টে কষ্টে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ও। বড়ো কষ্ট রাঘবের। নষ্ট হওয়া বড়ো কষ্টের! ওর এক মামা পাঁচ শো টাকা মাইনে পেতেন সওদাগরি অফিসে, উনিশ-শো সাতচল্লিশে, স্বাধীনতা পাওয়ার বছর। তিনি সেই টাকায় সংসার চালিয়েও বেশ বাবুয়ানিই করতেন তখনকার দিনে। পাড়ার লোকে। তাঁকে বড়োলোক বলে ঈর্ষা করত। রাঘব আজ টাকার অঙ্কে তার চেয়ে অনেক বেশিই পাচ্ছে, কিন্তু তাতেও শুধু বউ-মেয়ে এবং বাবার আংশিক ভার নিয়ে বেঁচে থাকাই মুশকিল। বড়োই। মুশকিল।

তাও ভাগ্যিস রাণু শক্ত মেয়ে। মিনু হওয়ার পরেই জোর করে অপারেশান করে নিয়েছিল। ও মাঝে মাঝে আতঙ্কিত হয়ে ভাবে, যদি মিনুর আরও ভাই-বোন থাকত, তা হলে কী হত? কী হত, ভাবতেও পারে না।

রাঘবদা! বলে, কে যেন ডাকল পেছন থেকে।

রাঘব দাঁড়াল। দেখল, রাজু।

কীরে? কবে এলি? এদিকে কোথায়?

শোনোনি কারো কাছে? বাবার তো সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছে। ডানদিকটা পুরো প্যারালিসিস হয়ে গেছে। এই খবর পেয়েই তো এলাম বম্বে থেকে। অনেকদিন পর এলাম।

কেমন আছেন পিসেমশাই। খবরটা দিসনি কেন আমাদের?

এখন ভালোই আছেন। বাড়ি আনব ভাবছি, দিন সাতেক পর।

তারপর বলল, খবর দেব কী করে? তোমার অফিসে, পোস্টাপিস থেকে টেলিফোন করে করে এতদিন তো হয়রান হয়ে গেলাম। লাইন পাই তো অপারেটর কথা বলে না। কথা বলে তো ভুল লোককে দেয়। যদি-বা তোমাকে একবার দিল, তুমি তখন টেবলে ছিলে না, বাথরুমে গেছিলে।

রাঘব মনে মনে কিন্তু খুশিই হল পিসেমশাইয়ের অসুখের খবরটা পায়নি বলে। কারণ, পেলেও দেখতে যাওয়ার সময় করে উঠতে পারত না যে, তাও জানে। খুব ইচ্ছে থাকলেও পারত না।

কোথায় আছেন রে পিসেমশায়?

মেডিক্যাল কলেজে।

বাবাকে যিনি দেখছেন, সেই ডাক্তারবাবুর বাড়িতেই যাচ্ছিলাম। যাওয়া-আসা কি সোজা ব্যাপার? আজ আবার ট্যাক্সি স্ট্রাইক। ডাক্তারবাবুর মেয়ে বোম্বেতে থাকেন। বোম্বে ফিরছি ক দিন পরে, তা শুনেই বললেন, একটা প্যাকেট পৌঁছে দিতে হবে। বোম্বে থেকে রেজিস্টার্ড ডাকে মেয়ে শাড়ি আর কীসব নাকি পাঠিয়েছিল ওঁদের পার্সেল খোয়া গেছে।

একটু চুপ করে রাজু আবার বলল, তুমি কলকাতার হাসপাতালগুলোতে ঢুকেছ কখনো, উঃ মাইগড। মানুষ যে কত পাপ করলে ওইসব হাসপাতালে যায়! মনে হয়, ওইসব জায়গায় যাওয়ার আগে মরে যাওয়াই উচিত। কলকাতার চেয়ে বোম্বে-ব্যাঙ্গালোর অনেক ভালো।

রাঘব ঘড়ির দিকে চট করে তাকিয়ে নিল। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

বলল, বোম্বে-ব্যাঙ্গালোরে আমি যাইনি কখনো। কোথায়ই-বা গেছি? একবার শিমুলতলা গেছিলাম বিয়ের পরে। তাও তিনদিনের জন্যে…

তোমরা সব বেঁচে আছ কী করে? এখনও কি কোনো বিপ্লব-টিপ্লব হওয়া উচিত নয় এদেশে? কোনো রেভলিউশান? কী? রাঘবদা? এখনও না হলে আর কবে হবে? কী করছ তোমরা? তারপর ফুটপাথের পাশে সি এম ডি-এর একটা গর্তে পড়ে যেতে যেতে রাজু বলল, গর্ত!

গর্ত থেকে উঠেই রাগের গলায় বলল, যেখানে মানুষ থাকে না, সেখানে ফ্লাইওভার আর রাস্তা বানালেই কিছু অগ্রগতি হয় না, হবে না। যাদের সবই সয়, তারা মনুষ্যেতর জীব। জার্মানিতে মানুষ ছিল, জাপানে মানুষ ছিল, যুদ্ধে গুড়িয়ে গিয়েও দ্যাখো, আবার সব গড়ে নিল। ভিয়েতনামেও মানুষ ছিল এবং আছে। ওরা প্রমাণ করেছে যে, ওরা মানুষ। আর আমরা? ফুঃ!

নিরুত্তাপ উদাসীন গলায় কেটে কেটে রাঘব বলল, তুই কোনদিকে যাবি?

অবাক চোখে রাঘবের মুখের দিকে একটু চেয়ে ও বলল, সোজা। তোমার বাড়িতেও হয়ে যেতে পারি। বউদিকে দেখিনি কত্তদিন! ছোটোমামাকেও। বউদি কি সেরকম সুন্দরীই আছে?

রাঘব মনে মনে শঙ্কিত হল। অসময়ে অতিথি! চা-জলখাবার! রাণুর রান্নার ব্যাঘাত। মিনুর পড়াশুনোর অসুবিধা…দু-টিই মাত্র ঘর।

কিন্তু মুখে বলল, বেশ তো! খুব ভালো হয়! চল না। কিন্তু এমন আসা কি আসা? সারাদিন থাকবি, গল্প-সল্প করবি, তবে–না। পথে দেখা না-হলে তো আসতিসই না!

তা ঠিক। তা হলে না-হয় আজ থাক। আরেকদিনই যাব। থাকব সারাদিন। তুমি পারলে বাবাকে একদিন দেখতে যেয়ো কিন্তু রাঘবদা।

নিশ্চয়ই যাব। রাঘব বলল।

সামনেই ফলের দোকান। সার সার ফল সাজানো। পিসেমশাই ছোটোবেলায় বড়ো আদর-যত্ন করেছেন। ঝুড়ি-ঝুড়ি কমলালেবু খাইয়েছেন। ডুয়ার্সের চা-বাগানের অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন। হাসপাতালে চারটি কমলা হাতে করে পিসেমশাইয়ের কাছে নিয়ে যায় এমন সামর্থ্যও আজ রাঘবের নেই। টাকা তো কাগজ হয়ে গেছে। একেবারেই কাগজ। নিজের বাবার জন্যেই-বা কতটুকু করতে পারে ও? অথচ সে মূর্খ নয়। এম এ পাশ! দারুণ বিদ্বান।

রাজু বলল, পান খাবে তো রাঘবদা?

অন্যমনস্ক গলায় ও বলল, খাওয়া?

দোকানদার বাবু হয়ে বসে পান সাজছিল। পানের দোকানের বড়ো আয়নায় রাতের পথের বহমান জনস্রোতের ছায়া পড়েছিল। কুঁজো হয়ে কোনো দেওয়ালহীন জেলখানার নিরুপায় ধূলি ধূসরিত কয়েদিদের মতে, কাতারে কাতারে ক্লান্ত, অপমানিত, মুখ-নামানো লোক হাঁটছে একে অন্যের ঘাড়ে পড়ে, পায়ে পায়ে। বাম্পারে বাম্পারে ঠোকাঠুকি করে হর্ন বাজিয়ে গাড়ি চলেছে। শামুকের মতো। ধুলো, ধোঁয়া, বীজাণু, বিষ, চারদিকে। এর মধ্যে থিকথিক করছে নরকের কীটের মতো মানুষ, অসংখ্য, অগণ্য।

পান মুখে দিয়ে, রাজু বলল, চলি রাঘবদা।

আচ্ছা রে। বলল রাঘব। পান-মুখে, জবজবে গলায়।

তারপরে দুজনে দু-দিকে এগিয়ে গেল। ঠিক সেই সময়েই হঠাৎ ঝুপ করে লোডশেডিং হয়ে গেল।

জর্দা-সুদ্ধ পানটা মুখে দিয়ে, ঢোক গিলতেই রাঘবের মনে হল, সকলে মিলে বোধহয় সত্যিই কিছু একটা করার সময় এসেছে। একটা বিশেষ কিছু। প্রত্যক্ষ, মিনিংফুল, এফেক্টিভ কিছু। এইভাবে চলবে না, চলতে পারে না। গা-বাঁচিয়ে আর বাঁচা যায় না।

জর্দার নেশায় হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে উঠে রাঘব ডান হাতের মুঠি শক্ত করল! ওর হঠাৎ মনে পড়ল, রাজু কী যেন বলছিল, রেভলিউশান, না কী যেন?

ভুল করে, আর একটা বড়ো ঢোকে জর্দাপানের পিক গিলে ফেলেই খু-উব ঘাম হতে লাগল রাঘবের। অচেনা দোকানের পান, অপ্রকৃতিস্থ ভাবনার সঙ্গে মিশে গেল।

পিক ফেলল রাঘব বড়ো করে। তবুও, সারাশরীর গরম হয়ে রইল। ঝাঁ-ঝাঁ করতে লাগল দুই কান।

ওর মনে হল, কান দুটো যেন রাজুই মলে দিয়েছে। মাথার মধ্যে ঝমঝম করতে লাগল নানা মিশ্র আওয়াজ–বুট পায়ে অনেক লোকের হেঁটে যাওয়ার শব্দ। অনেকগুলি রাইফেলের গুলির নির্ঘোষ। একসঙ্গে, চিৎকার, ভারী গাড়ির ইঞ্জিনের গোঙানি।

একটু পরেই আরও একটা বড়ো পিক ফেলতেই প্রায় সবটুকু পান জর্দাসুদ্ধ উগরে দিল ও। মাথাটাও হালকা লাগল। আঃ।

একটু প্রকৃতিস্থ হতেই সৎ, ভিতু, পুরোপুরি মধ্যবিত্ত বাঙালি রাঘব ভাবল, বউ-বাচ্চা নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে চলে তো যাচ্ছেরে বাবা কোনোরকম করে, ভদ্রলোকের মতো! কী হবে? যত্ত ফালতু।

ঝুট-ঝামেলা।

দুস-স-স-স-স-স…।

মিছিমিছি, যত্ত নেই ভাবনা…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *