দিব্যাবদানমালা বহে মাঘমাসে শীতের বাতাস , স্বচ্ছসলিলা বরুণা । পুরী হতে দূরে গ্রামে নির্জনে শিলাময় ঘাট চম্পকবনে , স্নানে চলেছেন শতসখীসনে কাশীর মহিষী করুণা । সে পথ সে ঘাট আজি এ প্রভাতে জনহীন রাজশাসনে । নিকটে যে ক ' টি আছিল কুটির ছেড়ে গেছে লোক , তাই নদীতীর স্তব্ধ গভীর , কেবল পাখির কূজন উঠিছে কাননে । আজি উতরোল উত্তর বায়ে উতলা হয়েছে তটিনী । সোনার আলোক পড়িয়াছে জলে , পুলকে উছলি ঢেউ ছলছলে — লক্ষ মানিক ঝলকি আঁচলে নেচে চলে যেন নটিনী । কলকল্লোলে লাজ দিল আজ নারী কণ্ঠের কাকলি । মৃণালভুজের ললিত বিলাসে চঞ্চলা নদী মাতে উল্লাসে , আলাপে প্রলাপে হাসি - উচ্ছ্বাসে আকাশ উঠিল আকুলি । স্নান সমাপন করিয়া যখন কূলে উঠে নারী সকলে মহিষী কহিলা , ‘ উহু ! শীতে মরি , সকল শরীর উঠিছে শিহরি , জ্বেলে দে আগুন ওলো সহচরী — শীত নিবারিব অনলে ।' সখীগণ সবে কুড়াইতে কুটা চলিল কুসুমকাননে । কৌতুকরসে পাগলপরানী শাখা ধরি সবে করে টানাটানি , সহসা সবারে ডাক দিয়া রানী কহে সহাস্য আননে — ‘ ওলো তোরা আয় ! ওই দেখা যায় কুটির কাহার অদূরে , ওই ঘরে তোরা লাগাবি অনল , তপ্ত করিব করপদতল ' — এত বলি রানী রঙ্গ বিভল হাসিয়া উঠিল মধুরে । কহিল মালতী সকরুণ অতি , ‘ একি পরিহাস রানীমা ! আগুন জ্বালায়ে কেন দিবে নাশি ? এ কুটির কোন্ সাধু সন্ন্যাসী কোন্ দীনজন কোন্ পরবাসী বাঁধিয়াছে নাহি জানি মা ! ' রানী কহে রোষে , ‘ দূর করি দাও এই দীনদয়াময়ীরে ।' অতি দুর্দাম কৌতুকরত যৌবনমদে নিষ্ঠুর যত যুবতীরা মিলি পাগলের মতো আগুন লাগালো কুটিরে । ঘন ঘোর ধূম ঘুরিয়া ঘুরিয়া ফুলিয়া ফুলিয়া উড়িল । দেখিতে দেখিতে হুহু হুংকারি ঝলকে ঝলকে উল্কা উগারি শত শত লোল জিহ্বা প্রসারি বহ্নি আকাশ জুড়িল । পাতাল ফুঁড়িয়া উঠিল যেন রে জ্বালাময়ী যত নাগিনী । ফণা নাচাইয়া অম্বরপানে মাতিয়া উঠিল গর্জনগানে , প্রলয়মত্ত রমণীর কানে বাজিল দীপক রাগিণী । প্রভাতপাখির আনন্দ গান ভয়ের বিলাপে টুটিল — দলে দলে কাক করে কোলাহল , উত্তরবায়ু হইল প্রবল , কুটির হইতে কুটিরে অনল উড়িয়া উড়িয়া ছুটিল । ছোটো গ্রামখানি লেহিয়া লইল প্রলয়লোলুপ রসনা । জনহীন পথে মাঘের প্রভাতে প্রমোদক্লান্ত শত সখী - সাথে ফিরে গেল রানী কুবলয় হাতে দীপ্ত - অরুণ - বসনা । তখন সভায় বিচার - আসনে বসিয়াছিলেন ভূপতি । গৃহহীন প্রজা দলে দলে আসে , দ্বিধাকম্পিত গদগদ ভাষে নিবেদিল দুঃখ সংকোচে ত্রাসে চরণে করিয়া বিনতি । সভাসন ছাড়ি উঠি গেল রাজা রক্তিমমুখ শরমে । অকালে পশিলা রানীর আগার — কহিলা , ‘ মহিষী , একি ব্যবহার ! গৃহ জ্বালাইলে অভাগা প্রজার বলো কোন্ রাজধরমে ! ' রুষিয়া কহিল রাজার মহিষী , ‘ গৃহ কহ তারে কী বোধে ! গেছে গুটিকত জীর্ণ কুটির , কতটুকু ক্ষতি হয়েছে প্রাণীর ? কত ধন যায় রাজমহিষীর এক প্রহরের প্রমোদে ! ' কহিলেন রাজা উদ্যত রোষ রুধিয়া দীপ্ত হৃদয়ে — ‘ যতদিন তুমি আছ রাজরানী দীনের কুটিরে দীনের কী হানি বুঝিতে নারিবে জানি তাহা জানি — বুঝাব তোমার নিদয়ে ।' রাজার আদেশে কিংকরী আসি ভূষণ ফেলিল খুলিয়া — অরুণবরন অম্বরখানি নির্মম করে খুলে দিল টানি , ভিখারি নারীর চীরবাস আনি দিল রানীদেহে তুলিয়া । পথে লয়ে তারে কহিলেন রাজা , ‘ মাগিবে দুয়ারে দুয়ারে — এক প্রহরের লীলায় তোমার যে ক ' টি কুটির হল ছারখার যত দিনে পার সে - ক ' টি আবার গড়ি দিতে হবে তোমারে । ‘ বৎসরকাল দিলেম সময় , তার পরে ফিরে আসিয়া সভায় দাঁড়ায়ে করিয়া প্রণতি সবার সমুখে জানাবে যুবতী হয়েছে জগতে কতটুকু ক্ষতি জীর্ণ কুটির নাশিয়া ।'