সামান্য কুয়াশা ছিল
আগাম কোনও খবর না দিয়েই বর্ষা এবার সময়ের আগেই হাজির। আর শুধু হাজির নয়, ইনিংসের প্রথম বল থেকেই একেবারে ঝোড়ো ইনিংস খেলতে শুরু করেছে। যেমনই বৃষ্টির জোর তেমনই হাওয়ার দাপট। শুরুতে অবশ্য এতটা বোঝা যায়নি। বিকেল পড়ে আসার আগেই সুপ্রকাশ পালিতের বৈঠকখানায় সকলে এসে পড়েছেন—জগৎ শ্রীমানী, বরেন মল্লিক, বিজন সরকার আর প্রিয়নাথ জোয়ারদার। আজ ওঁরা অন্যদিনের তুলনায় একটু তাড়াতাড়ি এসেছেন। কারণ, আজ শোকসভা। ওঁরা এসে পৌঁছনোর কিছুটা পরে শুরু হয়েছে ঝড় আর বৃষ্টির ঘটা।
ওঁরা পাঁচজন নীচু গলায় কথা বলছিলেন। ওঁদের কথাবার্তায় কেমন যেন একটা বিষণ্ণ সুর মাখানো ছিল। আর একইসঙ্গে সদ্য-চলে-যাওয়া মানুষটার নানান স্মৃতি ওঁদের মনে অস্থিরভাবে উঁকিঝুঁকি মারছিল।
তিনদিন আগে এ-পাড়ার ডাকসাইটে উকিল বাসুদেব ভদ্র হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। ওঁর বয়েস হয়েছিল প্রায় সত্তর বছর। কিন্তু শরীর জবরদস্ত ছিল। রোজ ভোর পাঁচটায় শিরদাঁড়া টান-টান করে হেঁটে গঙ্গাস্নানে যেতেন। ওকালতিতে অসম্ভব দাপট ছিল, জজসাহেবরাও তটস্থ হয়ে থাকতেন। বাসুদেববাবুর সঙ্গে পাড়ার অনেকেরই হৃদ্যতা ছিল। ওঁর আচমকা চলে যাওয়ায় অনেকেই কম-বেশি ধাক্কা খেয়েছেন। কেউ-কেউ আবার যেন ভগবানের অদৃশ্য নোটিশ দেখতে পেয়েছেন।
সুপ্রকাশ পালিতের সঙ্গে বাসুদেব ভদ্রর বয়েসের তফাত থাকলেও যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল। তা ছাড়া সুপ্রকাশবাবুদের রাঁচির জমিজমা ইত্যাদি নিয়ে বাসুদেববাবু মামলাও লড়েছিলেন। সেইজন্যই সুপ্রকাশবাবু নিজে উদ্যোগ নিয়ে সবাইকে খবর দিয়ে একটা ঘরোয়া স্মরণসভা গোছের আয়োজন করেছেন।
সুপ্রকাশ বাসুদেব ভদ্র সম্পর্কে নানা কথা বলছিলেন। অন্য চারজন একমনে ওঁর কথা শুনছিলেন। মাঝে-মাঝে সুপ্রকাশ থামলে অন্যরা নিজেদের দু-একটা মন্তব্য করছিলেন।
বরেন মল্লিক বললেন, ‘বাসুদেবদা খুব মিশুকে ছিলেন। আমার লন্ড্রিতে যখনই যেতেন প্রাণ খুলে গল্প করতেন।’
বৈঠকখানার একটা জানলা খোলা ছিল। সেটা দিয়ে ঠিক টিভির সিনেমার মতো বাইরের ঝড়বৃষ্টি দেখা যাচ্ছিল। ঝোড়ো বাতাস হঠাৎই বেশ বেড়ে গেল। শনশন হাওয়া কাটার শব্দ উঠল বাইরে। জানলা দিয়ে বৃষ্টির ছাট ভেতরে ঢুকে পড়ছিল। সেটা লক্ষ করে সুপ্রকাশ পালিত বিজন সরকারকে বললেন, ‘জানলাটা একটু বন্ধ করে দিন না…।’
বিজন সরকার এ-পাড়ার শান্তি কমিটির সেক্রেটারি। বেশিরভাগ সময়েই খোশমেজাজে থাকেন। তবে এখন নিষ্প্রভ মুখে বসে আছেন।
সুপ্রকাশ পালিতের কথায় হাত বাড়িয়ে জানলার পাল্লা দুটো ভেতর থেকে এঁটে দিলেন। তারপর নীচু গলায় বললেন, ‘ভদ্রবাবুর পদবির সঙ্গে তাঁর ক্যারেক্টারের দারুণ মিল ছিল। পাড়ার ব্যাপারে কখনও আমাকে খালি হাতে ফেরাননি।’
হঠাৎই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জগৎ শ্রীমানী বললেন, ‘বাসুদেবটা মারা যাওয়ার সময়েও ওকালতি প্যাঁচ কষে গেল…।’
সকলে অবাক হয়ে ওঁর দিকে তাকাতেই তিনি যোগ করলেন, ‘…আমাকে সমন ধরিয়ে দিয়ে গেল। জানিয়ে দিল, আমার ওভারটাইম চলছে।’
‘না, না—ও-কথা বলছেন কেন!’ সুপ্রকাশ পালিত সামাল দেওয়ার সুরে জগৎবাবুকে লক্ষ্য করে বললেন। তারপর কাচের শার্সি-আঁটা জানলার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে যোগ করলেন, ‘এরকম জোর বর্ষা এবারে এই প্রথম নামল। চার-ছ’ঘণ্টার মধ্যে থামবে বলে মনে হয় না।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সুপ্রকাশ। শার্সির গা বেয়ে জলের ফোঁটা গড়িয়ে নামছিল। সেই রেখার দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ গলায় বললেন, ‘আমাদের জীবনটাও যেন কাচের গায়ে জলের রেখার মতন। মাধ্যাকর্ষণের মতো কোনও একটা টানে কিছুক্ষণ এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলা। তারপর-তারপর সব শেষ। কী বলো, ভূতনাথ?’
প্রিয়নাথ ভীষণ চুপচাপ ছিলেন। সকলের কথা যেন শুনছিলেন, অথচ শুনছিলেন না। ওঁর চশমার কাচে আলো পড়ে চকচক করছিল। চশমার গাঢ় রঙের মোটা ফ্রেমের সঙ্গে ভুরু জোড়া যেন মিশে গেছে। তার ওপরে কয়েকটা ছোট-বড় ভাঁজ স্পষ্ট নজরে পড়ছে।
অনেকক্ষণ ধরে সিগারেট খেতে পারেননি বলে প্রিয়নাথের গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, মুখের ভেতরটা কেমন বিস্বাদ লাগছিল। তিনি আপনমনে চুপচাপ বসে বাসুদেব ভদ্রর কথা ভাবছিলেন। সুপ্রকাশের শেষ কথাটার খেই ধরে ঠোঁটের কোণে দুর্জ্ঞেয় হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘মৃতেরা ছুটি নিয়ে বেড়াতে এলে সেটাকে বলা হয় জীবন। বেঁচে থাকা মানে স্বপ্ন দেখা—ঘুম ভাঙলেই মৃত্যু। বাসুদেববাবুর স্বপ্নটা বেশ লম্বা ছিল। নাকি বলব ছুটিটা বেশ লম্বা ছিল…।’
প্রিয়নাথের কথা শুনে সকলেই কেমন চুপ করে গেলেন। প্রিয়নাথ মৃত্যু নিয়ে এত ভাবেন! মৃত্যুকে যেন ওঁরা নতুনভাবে অনুভব করতে পারছিলেন। সুপ্রকাশ পালিত কিছুক্ষণের জন্য চোখ বুজলেন। ঘরের পরিবেশ যেন অনুভব করতে চাইলেন।
ওঁরা সকলে তক্তপোশের ওপরে বসে ছিলেন। তার কাছাকাছি ছিল একটা হাতলওয়ালা বড় চেয়ার। চেয়ারের রং পালিশ কিছু বোঝার উপায় নেই। তার ওপরে ধূপদানিতে কয়েকটা ধূপ জ্বলছিল। সেই ধূপের গন্ধে ঘরের ভেতরে স্মৃতিচারণের আবহাওয়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বাসুদেব ভদ্র সম্পর্কে ওঁরা যাঁর-যাঁর মতন করে দু-চার কথা বলছিলেন। প্রিয়নাথ চুপ করে ওঁদের কথা শুনতে লাগলেন।
প্রিয়নাথের মনে হল, ধূপের গন্ধের সঙ্গে প্রথম বৃষ্টির গন্ধ মিশে গিয়ে ঘরের ভেতরে কেমন এক অলৌকিক আমেজ তৈরি হয়ে গেছে। তিনি ঘরের দেওয়ালে টাঙানো অ্যানসনিয়া পেন্ডুলাম-ঘড়িটার দিকে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে তাকিয়ে রইলেন।
হঠাৎই প্রিয়নাথ বললেন, ‘আপনারা বাসুদেববাবু সম্পর্কে নানা কথা বললেন। আমার সঙ্গে ওঁর তেমন কিছু ঘনিষ্ঠতা ছিল না। তবে আমার ভূত-প্রেতের নেশার কথা তিনি জানতেন। তাই একদিন নিজের বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটা অদ্ভুত কাহিনি শুনিয়েছিলেন—শুনলে বিশ্বাস হবে না এমন কাহিনি…।’
এমন সময় একজন মাঝবয়েসি লোক ঘরে ঢুকল। পরনে ধুতি আর হাতাওয়ালা গেঞ্জি। হাতে শৌখিন ট্রে। তাতে সাজানো চা আর বিস্কুট।
সুপ্রকাশ লোকটিকে ডেকে বললেন, ‘আয়, নিরঞ্জন। সকলের হাতে-হাতে দিয়ে দে।’
নিরঞ্জন প্রত্যেকের হাতে চায়ের কাপ-প্লেট তুলে দিল। বিস্কুটের প্লেটটা নামিয়ে রাখল সকলের হাতের নাগালে। তারপর ধীরে ধীরে পা ফেলে চলে গেল।
পেন্ডুলাম-ঘড়িতে আটটার ঘণ্টা বাজল।
চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিয়ে প্রিয়নাথ নীচু গলায় বললেন, ‘বাসুদেববাবু ওকালতিতে হাতেখড়ি দেওয়ার আগে বছরখানেক নানা পেশায় যুক্ত ছিলেন। খাতা লেখার কাজ করেছেন, ওষুধের সেলসম্যান ছিলেন, হোটেলের ম্যানেজারি করেছেন, শাড়ির দোকানে চাকরি করেছেন। খানিকটা অস্থির মতির জন্যেই বোধহয় কোনও কাজেই টিকে থাকতে পারেননি। তারপর বাড়ির চাপে, আর ওঁর বাবার বকুনি খেয়ে ল’ পড়তে ঢোকেন। ব্যস, ওঁর জীবনটা একটা পথ পেয়ে গেল।
‘যে-ঘটনাটার কথা বাসুদেববাবু বলেছিলেন সেটা একটা ছোটখাটো হোটেলকে নিয়ে। তিনি তখন সেই হোটেলের ম্যানেজার ছিলেন…।’
বাসুদেবের বারবার হাই উঠছিল। এই ভয়ঙ্কর শীতে বারবার হাই তোলা মানে হিম-বাতাস বুকের ভেতরে টেনে নেওয়া। কিন্তু উপায় কী। কাউন্টার থেকে পাতাতাড়ি গুটিয়ে যে সরে পড়বেন তার উপায় নেই। ঠিক রাত এগারোটায় মালিকের ফোন আসবে। উনি দেখতে চান কাঁটায়-কাঁটায় রাত এগারোটা পর্যন্ত তাঁর হোটেল খোলা আছে কি না। বাসুদেবকে যে চোদ্দোশো টাকা মাস-মাইনে দেন, তার পাইপয়সা পর্যন্ত কড়ায়-গণ্ডায় উসুল করে নেন। কিন্তু কাস্টমার কোথায়! খোলা দরজা দিয়ে শুধু অন্ধকার রাত আর শীতের হালকা কুয়াশা চোখে পড়ছে।
আর কখনও-কখনও দিল্লি রোড ধরে ছুটে যাওয়া ট্রাকের ঘোলাটে হেডলাইট।
যে-রাস্তাটা দিল্লি রোড থেকে ডানকুনির দিকে ঘুরে গেছে তারই বাঁকে দাঁড়িয়ে আছে বাসুদেবের হোটেল। দোতলা হোটলটা যে অত্যন্ত কষ্ট করে দাঁড়িয়ে আছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তার জরাজীর্ণ চেহারার দিকে তাকালেই স্পন্ডিলাইটিসের পেশেন্ট বলে মনে হয়। হোটেলের পলেস্তারা থেকে শুরু করে জল-কল-আলোর ব্যবস্থা পর্যন্ত সবই নড়বড়ে অগোছালো।
হোটেলটার নাম ‘দ্য হোস্ট’। সদর দরজায় তেরছা হয়ে থাকা রং-চটা একটা সাইনবোর্ডে ইংরেজি হরফে নামটা লেখা আছে। এ-হোটেলের ম্যানেজারিতে জয়েন করার পর থেকেই বাসুদেবের বারবার সাধ হয়েছে, হোটেলের নামের আগে একটা ‘জি’ হরফ বসিয়ে ‘দ্য গোস্ট’ করে দেন। বেকার জীবনের টানাপোড়েন ঘোচাতে কপাল ঠুকে এখানে কাজে লেগে গেছেন বটে, কিন্তু এখানে কাজ বলতে তেমন কিছু নেই। সারাদিন শুধু পালিশ-চটা কাউন্টারে বসে থাকো আর রাস্তার গাড়ি গোনো। আর মাঝে-মাঝে সাতকাজের ফরমাশের লোক এবং রাঁধুনি পঞ্চাননকে ডেকে একটু তম্বি করো।
বাসুদেব আরশোলাকে যথেষ্ট ভয় পান। কেন তিনি জানেন না। এ অনেকটা যেন মন্ত্রশক্তির মতো। যারা আরশোলা ভয় পায়, তারা জানে না কেন। আর, যারা ভয় পায় না, তারাও জানে না তার কারণ কী। এ-হোটেলে সুপ্রচুর আরশোলা আছে—নানা মাপের, নানা ধরনের। ফলে বাসুদেব আর পঞ্চানন বেশ ভয়ে-ভয়ে দিন কাটান। এবং রাতও।
হোটেলের মালিকের নাম হরেকৃষ্ণ মণ্ডল। জঘন্যরকম বড়লোক। তবে নানান কুসংস্কারে ভোগেন। আর ধর্ম-কর্ম নিয়ে থাকেন। অন্তত বাইরে থেকে দেখে তাই মনে হয়।
‘দ্য হোস্ট’-এ হরেকৃষ্ণবাবু মাসে মাত্র একবার আসেন। হিসেবপত্র বুঝে নিয়ে চলে যান। তাঁর অন্যান্য আরও জমকালো ব্যবসা আছে। সেগুলো নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। তবে তাঁর নিয়মের এতটুকু নড়চড় হওয়ার জো নেই।
যেমন, ঢুকে থেকেই বাসুদেব দেখছেন এ-হোটেলে একটা নিয়ম চালু আছে। হোটেল কখনও ফাঁকা রাখা চলবে না—কমসে কম খাতায়-কলমে। অর্থাৎ, সব ঘর ফাঁকা থাকলেও অন্তত দুটো ঘর ভরতি বলে সবসময় দেখাতে হবে। কারণ, হোটেলে কোনও বোর্ডার যদি এসে দ্যাখে সব ঘরই ফাঁকা, তা হলে সে হয়তো ঘাবড়ে গিয়ে এ-হোটেলে আর উঠবে না। অন্য কোনও হোটেল খুঁজবে।
যুক্তিহীন কুসংস্কার। কিন্তু কোনও উপায় নেই।
সেই কারণেই হরেকৃষ্ণবাবুর ঠিক করে দেওয়া দুটো কাল্পনিক নাম-ঠিকানা সবসময় হোটেল-রেজিস্টারে লেখা থাকে। অরিন্দম পোদ্দার, পাদরীপাড়া, চন্দননগর, হুগলি। আর কালাচাঁদ নস্কর, ব্রহ্মপুর, গড়িয়া। প্রথমজনকে আপাতত রাখা হয়েছে রুম নম্বর বারোয়—দোতলার দ্বিতীয় ঘরে। আর কালাচাঁদ নস্কর আছেন তেরো নম্বর ঘরে। অর্থাৎ দোতলার তিন নম্বর ঘরে।
হোটেলে মোট সাতটা ঘর। একতলায় তিনটে, দোতলায় চারটে। তার মধ্যে একটা সিঙ্গল, বাকিগুলো ডাবল-বেড-এর ঘর। একতলার সিঙ্গলটায় বাসুদেবের থাকার কথা। তাই-ই থাকেন। তবে বেশিরভাগ সময়েই ঘর ফাঁকা থাকে বলে দোতলার চার নম্বর ঘরটায় তিনি রাত কাটান। ওই ঘরটায় দুটো জানলা বেশি আছে। হাওয়া-বাতাস ঠিকমতো খেলতে পারে। আর আরশোলার ভয় কম।
বাসুদেব শীতকাতুরে মানুষ। উলিকটের গেঞ্জি, ফুলহাতা সোয়েটার, মাফলার ইত্যাদি চড়িয়েও ওঁর শীত যাচ্ছিল না। তার ওপরে ঘুমে চোখ বুজে আসতে চাইছিল। বারবার রিসেপশনের দেওয়াল-ঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছিলেন। এগারোটা বাজতে এখনও মিনিট পনেরো মতন বাকি। পঞ্চানন বোধহয় এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর জন্য সিঁড়ির নীচের একটা খুপরি বরাদ্দ করা আছে। একটু আগেই ও বলে গেছে, বাসুদেবের রাতের খাবার ঘরে ঢাকা দেওয়া আছে।
সুতরাং শীত এবং একঘেয়েমিতে ক্লান্ত বাসুদেব দেওয়াল-ঘড়ির মিনিটের কাঁটার সঙ্গে হাত ধরে হাঁটছিলেন। কতক্ষণে ওটা বারোটার দাগে পৌঁছবে?
ঠিক তখনই ওরা এল।
খোলা দরজার ফ্রেমে কালো অন্ধকারের পটভূমিতে ঠিক ছবির মতো দাঁড়িয়ে থাকা একজন পুরুষ ও একজন মহিলাকে দেখতে পেলেন বাসুদেব। দেখে খানিকটা চমকে উঠলেন। ওরা যেন আচমকা হাজির হয়েছে দরজায়। কারণ, বাসুদেব ওদের হেঁটে আসতে দেখেননি। কখন কোথা দিয়ে দরজার কাছে চলে এল ওরা!
সামান্য কুয়াশা গায়ে মেখে পুরুষ ও মহিলাটি ভেতরে ঢুকল। খানিকটা যেন ছন্দে পা ফেলে চলে এল কাউন্টারের সামনে—বাসুদেবের খুব কাছে। বাসুদেব উগ্র পারফিউমের গন্ধ পেলেন।
ওদের দেখে বাসুদেবের কেমন যেন সন্দেহ হল। ওরা কি অবিবাহিত দম্পতি? এ-হোটেলে রাত কাটাতে এসেছে? কিন্তু ওদের পোশাক-আশাক ভারী অদ্ভুত।
পুরুষটির বয়েস তিরিশের এপিঠ-ওপিঠ। ইয়োরোপীয় ধাঁচের কাটা-কাটা মুখ। চওড়া কাঁধ। চোখ ছোট-ছোট, কিন্তু চাউনি যেন বর্শার ফলা। মাথার চুল তেল-চকচকে। টান-টান করে পিছনদিকে আঁচড়ানো। দাড়ি-গোঁফ কামানো তামাটে মুখে কেমন যেন ফ্যাকাসে ভাব। আর চোয়ালের হাড় সামান্য উঁচু হয়ে থাকায় মুখে একটা নিষ্ঠুর ভাব ফুটে উঠেছে।
সঙ্গের মেয়েটির বয়েস পঁচিশ কি ছাব্বিশ। ফরসা, রোগা, ছোটখাটো চেহারা। এলানো চুল। চোখের পালক অস্বাভাবিকরকম দীর্ঘ। গালে হালকা লালচে ভাব। কপালে বড় টিপ।
পুরুষটির গায়ে চেক-চেক ফুল-হাতা শার্ট, তার ওপরে একটা সাধারণ হাত-কাটা সোয়েটার। আর মেয়েটি সিল্কের শাড়ির ওপরে একটা মামুলি শাল জড়িয়ে রেখেছে।
এই ভয়ংকর হাড়কাঁপানো শীতে এইরকম সাধারণ শীতের পোশাক পরে কী করে এরা চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে? এই প্রশ্নটাই বাসুদেবের মনে প্রথম দেখা দিল।
ওদের মুখ এতই স্বাভাবিক যে, মনেই হচ্ছে না প্রচণ্ড ঠান্ডায় ওদের এতটুকুও কষ্ট হচ্ছে। যদি ওরা ‘দ্য গোস্ট’-এ উঠে এক-দু-দিন ফুর্তি করতে চায় তো করুক। মনে-মনে ভাবলেন বাসুদেব। এরকম অনেক জোড়া পায়রাই এখানে রাত কাটাতে আসে। অত বাছবিচার করতে গেলে বিজনেস চলে না। হরেকৃষ্ণ মণ্ডল প্রথমেই বাসুদেবকে এ-কথা জানিয়ে দিয়েছেন। শুধু কোনওরকম গোলমাল হুজ্জুতি না হলেই হল।
পুরুষটির প্রথম প্রশ্নে বাসুদেব স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। ওঁর বুকের ভেতরে ঘণ্টা বাজতে শুরু করল। গলা শুকিয়ে জিভটা গিরগিটির চামড়া হয়ে গেল পলকে।
‘অরিন্দম পোদ্দার নামে কেউ এ-হোটেলে এসে উঠেছে?’ ঠান্ডা গলায় জানতে চাইল পুরুষটি।
বাসুদেবের মাথা গুলিয়ে গেল। হোটেলের খাতায় গত তিন মাস ধরেই তো এই ভুয়ো নামটা লেখা রয়েছে! এর আগেও বহু বছর ধরে হরেকৃষ্ণ মণ্ডল হয়তো এই নামটা চালিয়েছেন। কিন্তু কোনওদিন কেউ এই কাল্পনিক বোর্ডারের খোঁজ করতে আসবে এ-কথা বাসুদেব কখনও আঁচ করতে পারেননি। এখন কী জবাব দেবেন এই প্রশ্নের?
‘খাতা দেখে জলদি বলুন।’ প্রায় ধমক দিয়ে উঠল পুরুষটি, ‘অরিন্দম পোদ্দার নামে কেউ উঠেছে কি না দেখুন—।’
সব জেনেশুনেও খাতা খুললেন বাসুদেব। তিনি বলতেই পারতেন, ‘আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই।’ কিন্তু পুরুষটির চেহারা এবং গলায় এমন একটা কিছু ছিল যে, বাসুদেব কেমন যেন ভয় পেয়ে ঘাবড়ে গেলেন। ওঁর মনের কোণে একটুকরো সন্দেহ উঁকিঝুঁকি দিল : এরা পুলিশের লোক নয় তো!
খাতা খুলে খুঁটিয়ে দেখার ভান করে বাসুদেব বললেন, ‘হ্যাঁ—আছেন। দোতলার বারো নম্বর রুমে।’
পুরুষটি মেয়েটির দিকে তাকাল। অদ্ভুতভাবে হাসল। উত্তরে মেয়েটিও সামান্য হাসল। যেন কোনও গোপন ইশারা চালাচালি হল দুজনের ভেতরে।
এমন সময় ফোন বেজে উঠল।
রিসিভার তুললেন বাসুদেব। হরেকৃষ্ণ মণ্ডলের ফোন।
ওরা দু-জন তীব্র চোখে বাসুদেবকে দেখছিল। বাসুদেব কোনওরকমে ‘হুঁ-হাঁ’ বলে ফোনে কথা শেষ করলেন।
রিসিভার নামিয়ে রাখার সঙ্গে-সঙ্গে দেওয়াল-ঘড়িতে এগারোটার ঘণ্টা বাজতে শুরু করল।
ঘণ্টা বাজার শব্দ শেষ হলে পুরুষটি নীচু গলায় বলল, ‘আমরা পুলিশের লোক। কাউকে এ-কথা জানাবেন না। আমরা অরিন্দম পোদ্দারকে একটা ক্রাইমের ব্যাপারে অ্যারেস্ট করতে এসেছি।’
বাসুদেব ফ্যালফ্যাল চোখে পুরুষটির দিকে তাকিয়ে ওর কথাগুলো শোনার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ওঁর মগজে কথাগুলো ঠিকমতো পৌঁছোচ্ছিল না। কেমন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছিল।
‘আজ রাতটা আপনার হোটেলে আমরা থাকব। আমাদের নাম-ধাম খাতায় লিখে নিন। সবাই জানবে আমরা অর্ডিনারি বোর্ডার।’
‘সবাই’ বলতে তো শুধু পঞ্চানন! আর খাতায় নাম-ধাম লিখলে তো মালিককে পয়সার হিসেব দিতে হবে! বাসুদেব মনে-মনে ভাবলেন।
পুরুষটির যেন বাসুদেবের মনের কথা বুঝতে পারল। পকেট থেকে দুটো একশো টাকার নোট বের করে বাসুদেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘অরিন্দম পোদ্দারের পাশের ঘরটাই আমাদের দেবেন। তা হলে আমাদের কাজের সুবিধে হবে।’
বাসুদেব টাকাটা নিয়ে ড্রয়ারে রাখলেন। ব্যালান্সটা ফেরত দেওয়ার জন্য ড্রয়ার হাতড়াচ্ছিলেন, পুরুষটি বলল, ‘বাকিটা রেখে দিন। বয়-বেয়ারাদের বকশিশ দিয়ে দেবেন।’
বাসুদেব খাতার সঙ্গে সুতলি দিয়ে বাঁধা ডট পেনটা বাগিয়ে ধরে ওদের নাম জানতে চাইলেন।
পুরুষটি হেসে বলল, ‘আমার নাম কালাচাঁদ নস্কর, আর ওর নাম লিখুন রীতা…রীতা নস্করই লিখুন। তা হলে সবাই হাজব্যান্ড-ওয়াইফ ভাববে।’
বাসুদেব লিখবেন কী! ওঁর হাতে ধরা কলমটা তখন বরফের কলম হয়ে গেছে। চোখের সামনে গোটা দুনিয়াটা যেন টলে উঠল। পাছে মাথা ঘুরে পড়ে যান, তাই বাঁ-হাতে কাউন্টারটা শক্ত করে চেপে ধরলেন।
নামটা তিনি ঠিক-ঠিক শুনেছেন তো! কালাচাঁদ নস্কর! খাতার দ্বিতীয় কাল্পনিক মানুষটা জ্যান্ত হয়ে চোখের সামনে দেখা দিয়েছে! আজ কি মঘা, নাকি ভূত চতুর্দশী? বাসুদেবের কেমন পাগল-পাগল লাগছিল।
‘লিখুন—’ তাড়া দিল পুরুষটি, ‘কালাচাঁদ নস্কর, রীতা নস্কর। আর ঠিকানা যা-হোক কিছু একটা বানিয়ে-টানিয়ে লিখে দিন। তবে অরিন্দমের পাশের ঘরটাই চাই কিন্তু।’
অতি কষ্টে বাসুদেব লিখতে পারলেন। খাতায় লেখা কালাচাঁদ নস্করের নামের নীচে রীতা নস্কর লিখে দিলেন। তবে সই করার জন্য খাতাটা ওদের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন না। কারণ, কালাচাঁদ নস্করের কাল্পনিক সইটা আগে থেকেই করা রয়েছে।
কিন্তু কালাচাঁদ এবং রীতা উলটো দিকে দাঁড়িয়েও ব্যাপারটা বোধহয় বুঝতে পেরেছিল। কারণ ওরা দুজনেই কেমন ঠোঁট টিপে হাসছিল।
‘তেরো নম্বর ঘরটা আপনাদের দিলাম।’ কোনওরকমে বলতে পারলেন বাসুদেব, ‘আপনারা কি ডিনার করবেন? তা হলে কাছেই একটা ভালো ধাবা আছে—সারা রাত খোলা থাকে। ওখান থেকে খাবার আনিয়ে দেব। আমাদের এখানে খাবারের কোনও ব্যবস্থা নেই।’
রীতা সাততাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না, না—আমরা ডিনার সেরে এসেছি।’
পারফিউমের গন্ধে বাসুদেবের মাথা ঝিমঝিম করছিল। খাতা-পেন একপাশে গুছিয়ে রেখে তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হাত বাড়িয়ে দেওয়ালের কীবোর্ড থেকে তেরো নম্বর রুমের চাবিটা পেড়ে নিলেন। পঞ্চানন নিশ্চয়ই এতক্ষণে নাক ডাকা শুরু করে দিয়েছে। ওকে বিরক্ত করে আর লাভ নেই। সুতরাং বাসুদেব কাউন্টারের পিছন থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। হোটেলের সদর দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিয়ে বাইরের আলোটা নিভিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, ‘চলুন, আমিই আপনাদের ঘর দেখিয়ে দিই। আমাদের বেয়ারাটা ঘুমিয়ে পড়েছে।’
ওদের নিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে রওনা হতে যাবেন, ঠিক তখনই একটা অদ্ভুত ব্যাপার বাসুদেবের নজরে পড়ল।
রিসেপশনের আলোটা তেমন জোরালো নয়। একটি মাত্র টিউব লাইট—তার আবার একটা দিক কালচে হয়ে গেছে। কিন্তু তার সত্ত্বেও বাসুদেবের দেখতে ভুল হল না।
রীতা বাঁদিকে মুখ ফিরিয়ে কালাচাঁদকে কিছু একটা বলছিল। ফলে বাসুদেব ওর মুখের ডানপাশটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন। রীতার কানের ওপর থেকে চুল সরে গেছে একপাশে। তাই কানের গহ্বরটা সরাসরি নজরে পড়ছে। সেই গহ্বরের মুখে ছোট মাপের একটা মাকড়সার জাল। যেন কোনও গুহার মুখ আগলে মাকড়সার জালটা তৈরি হয়েছে।
এবং সেই জালের কেন্দ্রবিন্দুতে একটা খুদে মাকড়সা সামান্য নড়াচড়া করছে।
বাসুদেব কেন যে ভয় পেলেন তা বুঝতে পারলেন না। কল্পনায় কানের গহ্বরটাকে তিনি ধূলিমলিন কোনও প্রাচীন সুড়ঙ্গ বলে ভাবছিলেন। মাকড়সার জাল ছিঁড়ে তার ভেতরে মনে-মনে ঢুকে পড়েছিলেন তিনি। অজানা ভয়ংকর কিছু আবিষ্কারের ভয়ে বারবার কেঁপে-কেঁপে উঠছিলেন।
রীতা মাথা ঝাঁকাল। ওর চুল ঝটকা মেরে সরে এল কানের ওপরে। মাকড়সার জালটা ঢাকা পড়ে গেল। কিন্তু বিচিত্র এক আতঙ্ক বাসুদেবের হৃৎপিণ্ডটাকে আঠালো কাগজের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রইল।
হোটেলের ফাঁকফোকর দিয়ে কুয়াশা আর শীত পা টিপে-টিপে ঢুকে পড়ছিল। বাসুদেব হঠাৎই শিউরে উঠলেন।
সেটা লক্ষ করে কালাচাঁদ বলল, ‘কী হল, মশাই। এই শীতেই কাবু হয়ে পড়ছেন! আমাদের ওখানে গেলে বুঝতেন ঠান্ডা কাকে বলে!’
রীতার সঙ্গে চোখাচোখি হল কালাচাঁদের। ওরা দুজনে একইসঙ্গে হেসে উঠল। হাসির দমকে ওদের ছিপছিপে শরীর দুটো সাপের মতো এঁকেবেঁকে যাচ্ছিল।
‘আমাদের ওখানে’ মানে! বাসুদেব কালাচাঁদের কথাটার মানে বুঝতে চাইলেন। কিন্তু কী ভেবে ওদের আর কিছু জিগ্যেস করলেন না।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে রীতা জানতে চাইল, ‘অরিন্দম পোদ্দার কবে এখানে এসে উঠেছে?’
‘পরশুদিন…সন্ধেবেলা…।’ বাসুদেব মরিয়া হয়ে গল্প তৈরি করছিলেন। যা মনে আসে তাই বলছিলেন।
‘ওর সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছিল?’
‘না।’
এবার কালাচাঁদ নস্কর বলল, ‘অরিন্দম পোদ্দারকে দেখে কি আপনার মনে হয়েছে যে, ও ভয় পেয়েছে?’
কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন বাসুদেব। এভাবে বাতাসে কতক্ষণ দুর্গ তৈরি করা যায়! আন্দাজে গল্প বলার তো একটা সীমা আছে! কিন্তু কিছু একটা তো বলতেই হয়! অতএব বললেন, ‘ঘর ছেড়ে উনি খুব একটা বেরোন না। তবু দু-একবার যা দেখেছি তাতে ভয় পেয়েছেন বলে মনে হয়নি…।’
তেরো নম্বর ঘরের দরজায় ওরা তিনজন পৌঁছে গিয়েছিল। বাসুদেব যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। নাইট ল্যাচ খুলে ওদের ঘর দেখিয়ে দিলেন।
কিন্তু ফিরে আসার পথে আর-একবার হোঁচট খেলেন বাসুদেব।
বারো নম্বর ঘরের দরজার নীচ দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে না!
বাসুদেবের পা আর কাজ করছিল না। আজ রাতে এসব কী শুরু হয়েছে! যারা নেই—কোনওদিন ছিল না—তারা সব একে-একে হাজির হচ্ছে! নাকি তিনিই ভুল করে কোনও এক সময়ে বারো নম্বর ঘরের আলো জ্বেলে গেছেন!
খানিক ইতস্তত করে ভয়ে-ভয়ে ঘরের কলিংবেল টিপলেন বাসুদেব।
টুং-টাং শব্দ শেষ হতেই ভেতর থেকে ভারী গলায় কেউ সাড়া দিল।
‘কে?’
বাসুদেবের পাকস্থলীতে কেউ যেন বরফের ছুঁচ ফোটাতে শুরু করল। ওঁর হাত কাঁপতে লাগল থরথর করে। দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইল। অনেক চেষ্টায় গলা দিয়ে স্বর বের করতে পারলেন তিনি।
‘আমি, স্যার—হোটেলের ম্যানেজার।’
‘কী চাই?’ রুক্ষ্ম প্রশ্ন ভেসে এল বন্ধ দরজার ও-পিঠ থেকে।
‘আমার রেজিস্টারে মনে হয় একটু গোলমাল হয়ে গেছে, স্যার। আপনাকে কি আমি বারো নম্বর ঘরই দিয়েছিলাম?’
‘তাই তো মনে হয়।’
‘আপনার নামটা কাইন্ডলি বলবেন, স্যার। রেজিস্টারের সঙ্গে একটু চেক করে নেব—।’
‘অরিন্দম পোদ্দার…।’
নামটা বলার সঙ্গে-সঙ্গেই বন্ধ দরজা খুলে গেল।
এবং অপার্থিব এক হিমেল বাতাসের ঝাপটা বাসুদেবকে অসাড় করে দিতে চাইল।
অরিন্দম পোদ্দারকে ভালো করে দেখতে চাইলেন বাসুদেব। কিন্তু দেখতে পেলেন কি?
মাথায় ঘোমটা মুড়ি দিয়ে চাদর জড়ানো। তাতে মুখের অনেকটাই আড়াল হয়ে গেছে। তার ওপরে চোখে কালো চশমা। ঘরের আলোটা মাথার ঠিক পিছনে থাকায় মুখটা অস্পষ্ট অন্ধকার দেখাচ্ছে।
‘আর কিছু জানতে চান?’ সামান্য ফ্যাঁসফেঁসে গলায় প্রশ্ন করল অরিন্দম।
‘না, স্যার।’ মাথা নাড়লেন বাসুদেব।
সঙ্গে-সঙ্গে দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল।
কিন্তু তার আগেই একটা জিনিস বাসুদেবের নজরে পড়েছিল। অরিন্দমের চাদরে আর ঘরের মেঝেতে সাদা রঙের গুঁড়ো-গুঁড়ো কী যেন ছড়িয়ে রয়েছে। নুন, চিনি, নাকি মিল্ক পাউডার? বন্ধ কোনও কৌটো জোর করে খুলতে গিয়ে ওরকম ছিটকে ছড়িয়ে পড়েছে?
এলোমেলো বহু কথা ভাবতে-ভাবতে নীচে নেমে এলেন বাসুদেব। ওঁর শরীর তখনও কাঁপছিল। কতটা শীতে, কতটা ভয়ে তা বলা মুশকিল।
কাউন্টারের কাছে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। ফোন করে ব্যাপারটা কি মালিককে জানানো যায়? উনি কি আদৌ বিশ্বাস করবেন? আর যদিও বা বিশ্বাস করেন, তা হলে কাল সকালের আগে কিছু করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া কালাচাঁদ আর রীতা যদি সত্যি-সত্যি পুলিশের লোক হয় তা হলে পুলিশে খবর দিলে সেটা হাস্যকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু রীতার কানের মাকড়সার জালটা কি অস্বাভাবিক নয়? অরিন্দমের চাদরের সাদা-সাদা গুঁড়োগুলোই বা কী?
এইসব উলটোপালটা ভাবনা বাসুদেবের বুকের ভেতরে উথালপাথাল ঢেউ তুলছিল। একবার ভাবলেন পঞ্চাননের পাশটিতে গিয়ে শুয়ে পড়বেন। কিন্তু তারপরই আবার মনে হল, না, ওপরের ঘরে শোওয়াই ভালো। যদি রাতে কোনও কাণ্ড হয় তা হলে বাসুদেব জানতে পারবেন। আসলে ভয়ের পাশাপাশি কৌতূহলও বাসুদেবের মনে মাথাচাড়া দিচ্ছিল। অরিন্দম পোদ্দার যদি সত্যি-সত্যিই একজন মারাত্মক ক্রিমিনাল হয়, তা হলে কালাচাঁদ আর রীতা কি ওকে এখানেই অ্যারেস্ট করবে? কী করেছে অরিন্দম—খুন, চুরি, ডাকাতি? ও যদি মারাত্মক ক্রিমিনাল হয়, তা হলে ওকে অ্যারেস্ট করতে গেলে তো রিভলভার ইত্যাদি দরকার! অথচ কালাচাঁদ আর রীতা এ-হোটেলে এসে উঠেছে কোনও লাগেজ ছাড়াই। প্যান্টের পকেটে অথবা কোমরে কোনওরকম অস্ত্র লুকোনো আছে বলে তো মনে হয়নি!
আরও আধঘণ্টা পর নিজের ঘরের দিকে রওনা হলেন বাসুদেব। নিজের ঘর বলতে চোদ্দো নম্বর ঘর—কালাচাঁদ আর রীতার পাশের ঘরটা।
পা টিপে-টিপে ওপরে উঠে এলেন আবার। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছিল। সুতরাং ঘরে ঢুকে হাত-মুখ ধুয়ে জামাকাপড় ছাড়লেন। উলিকট গেঞ্জির ওপরে হাতকাটা সোয়েটার চাপিয়ে তার ওপরে শাল জড়ালেন। তারপর খাওয়াদাওয়া সেরে নিলেন।
অন্যদিন হলে এরপর ঘুম। এবং বিছানায় শোওয়ামাত্রই ঘুমপাড়ানি মাসিপিসির দাপট শুরু।
কিন্তু আজ? আজ দু-চোখের পাতা এক হয় কই!
ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করলেন বাসুদেব। তারপর…রাত তখন কত ঠিক বলা মুশকিল…শুনতে পেলেন তীব্র শিসের শব্দ। আওয়াজটা এত মিহি যে, কানের পরদা যেন ফুটো করে দিতে চায়।
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন বাসুদেব। ঘরের লাগোয়া অ্যাটাচড বাথে ঢুকে পড়লেন। ফলে দ্বিতীয় শিসের শব্দটা বেশ জোরে শোনা গেল। কারণ, তেরো আর চোদ্দো নম্বর ঘরের বাথরুম দুটো গায়ে-গায়ে লাগানো। এমনকী বেয়ে উঠে সামান্য চেষ্টা-চরিত্র করলে এ-বাথরুম থেকে ও-বাথরুমে ঢুকে পড়া যায়।
পরের বাথরুমে উঁকি মারার স্বভাব বাসুদেবের কোনওকালেই ছিল না। কিন্তু এখন, এই অদ্ভুত রাতে, একটা অচেনা আকর্ষণ ওঁকে নীতি থেকে সরিয়ে দিল। অন্ধকারের মধ্যেই জলের পাইপে পা দিয়ে বাথরুমের দেওয়াল বেয়ে উঠে পড়লেন। ভেন্টিলেটারের কাচের পাল্লা খুব সাবধানে ঠেলে সরিয়ে পাশের বাথরুমে উঁকি মারলেন।
যে-দৃশ্য বাসুদেব দেখতে পেলেন, সন্দেহ নেই, সেটা ভারী অদ্ভুত।
পাশের বাথরুমে কেউ নেই। বাথরুমের পাল্লা খোলা। সেই খোলা অংশ দিয়ে ঘরের বেশ খানিকটা নজরে পড়ছে। ঘরের মেঝেতে সাদা রঙের গুঁড়ো-গুঁড়ো কী যেন ছড়িয়ে আছে। আর গোটা ঘরে নীল আলোর এক অলৌকিক আভা খেলে বেড়াচ্ছে। সেই আলোর আভা ঘরের কোনও-কোনও জায়গায় কমে গেলে তবেই গুঁড়োগুলোকে সাদা রঙের বলে চেনা যাচ্ছে।
বাসুদেব বোধহয় কৌতূহলে উন্মাদ হয়ে গেলেন। কারণ, গায়ের চাদর খুলে ফেলে দিয়ে শরীরটাকে সরীসৃপের মতো ভেন্টিলেটারের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিলেন। তারপর খুব সাবধানে দেওয়াল আর জলের পাইপ আঁকড়ে নেমে পড়লেন তেরো নম্বর ঘরের বাথরুমে।
একটা তুচ্ছ জিনিস বাসুদেবকে অবাক করল।
বাথরুমের মেঝে খটখটে শুকনো। সেখানে জলের কোনও ছিটেফোঁটাও নেই। অর্থাৎ, এসে থেকে কালাচাঁদ বা রীতা বাথরুম ব্যবহার করেনি!
বাথরুমের পাল্লার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতরে উঁকি মারলেন বাসুদেব।
ঘরের ঠিক মাঝখানে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রীতা ঠোঁটজোড়া ছুঁচলো করে শিস দিচ্ছে। আর কালাচাঁদ মূকাভিনেতার ভঙ্গিতে ধীরে-ধীরে পা ফেলে এগিয়ে আসছে রীতার কাছে। ওদের দুজনের শরীর থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে উজ্জ্বল নীল আলো।
রীতার খুব কাছে পৌঁছে যাওয়ামাত্রই কালাচাঁদের ঠোঁটজোড়া ছুঁচলো হল। কিসিং গোরামি মাছের মতো ওরা ঠোঁটে ঠোঁট এঁটে চুমু খেল। ওদের ঠোঁটজোড়া যেন লোহা আর চুম্বকের মতো গায়ে-গায়ে সেঁটে গেল। এবং একইসঙ্গে শিসের শব্দ থেমে গেল।
তারপর ওরা পায়ে-পায়ে পিছোতে শুরু করল। কিন্তু কী আশ্চর্য! ওদের ঠোঁটজোড়া একই অবস্থায় পরস্পরের গায়ে এঁটে রইল। শুধু কোন এক অলৌকিক প্রক্রিয়ায় ওদের ঠোঁটের অংশ ইলাস্টিকের মতো লম্বা হয়ে ওদের শরীর দুটোর মাঝের দূরত্ব বাড়াতে লাগল।
হঠাৎই একটা ‘চকাৎ’ শব্দ হয়ে ঠোঁট দুটো ছেড়ে গেল। কালাচাঁদ আর রীতা বেহালার ছড় টানা তারের মতো তিরতির করে কাঁপতে লাগল। আর পাউডারের মতো মিহি সাদা গুঁড়ো ঘরময় উড়তে লাগল।
শীতে কেঁপে উঠলেন বাসুদেব। এবং তখনই সাদা গুঁড়োগুলোকে কুচো বরফ বলে চিনতে পারলেন। অরিন্দমের চাদরে আর ঘরের মেঝেতে তা হলে বরফকুচি ছড়িয়ে ছিল! এ ঘরের মেঝেতেও তাই। তা হলে কি…তা হলে কি…?
রীতা এবার মুখ খুলল।
‘অরিন্দমকে এবার ডেকে নিয়ে আসি। ও কী বলতে চায় ওর মুখ থেকেই শোনা যাক।’
খিলখিল করে বিদ্রুপের হাসি হাসল কালাচাঁদ : ‘কী আর বলবে! আমি ওর বাজে কথা শুনতে চাই না। আমি গয়নার ভাগ চাই। ও-দোকান থেকে আমরা যা হাতিয়েছি তা প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ লাখ টাকার গয়না হবে…।’
‘আর আমাকে যে তুমি ওর কাছে থেকে হাতিয়েছ!’ চোখ মটকে বলল রীতা। অচেনা এক শীতের হাওয়া বুকের ওপর থেকে ওর শাড়ির আঁচল উড়িয়ে দিল।
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসা দিয়ে কাছে পেয়েছি—কারও কাছ থেকে চুরি করে নয়।’
কথা শেষ করার সঙ্গে-সঙ্গেই দুটো শরীর বিদুৎঝলকের মতো ছুটে এল সামনে। সংঘর্ষ হল, কিন্তু কোনও শব্দ হল না। তারপর বাসুদেবকে স্তম্ভিত করে দিয়ে দুটো শরীর নাইলনের দড়ির মতো পাক খেয়ে গায়ে-গায়ে জড়িয়ে গেল। প্রায় দশ সেকেন্ড ধরে চলল ওদের ভালোবাসাবাসি। তারপর ওরা পরস্পরকে ছেড়ে দিয়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াল।
‘চলো, এবার অরিন্দমকে নিয়ে আসি।’ বলল কালাচাঁদ।
সঙ্গে-সঙ্গে ওদের চারটে হাত লম্বা হয়ে ধেয়ে গেল বারো নম্বর-আর তেরো নম্বর ঘরের পার্টিশন ওয়ালের দিকে।
একতাল ময়দার মধ্যে যেভাবে লোকে হাত ঢুকিয়ে দেয় ঠিক সেভাবেই চারটে হাত গেঁথে গেল দেওয়ালে। এবং পরমুহূর্তেই একটা অবয়বহীন শরীর টেনে নিয়ে এল ঘরের ভেতরে।
বাসুদেব দেখলেন, দেওয়ালটা যেন রবারের তৈরি। একটা চাদরের মতো টান-টান হয়ে অরিন্দমকে মুড়ে রয়েছে। সেই রবারের চাদরের আড়ালে অরিন্দমের দেহটা প্রাণপণ ছটফট করে চলেছে, নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইছে।
কিন্তু রীতা আর কালাচাঁদ নাছোড়বান্দা। অরিন্দমের চেষ্টা দেখে ওরা মজা পেয়ে হেসে উঠল। তারপর এক হ্যাঁচকা টানে অরিন্দমকে দেওয়ালের চাদর ছিঁড়ে বের করে নিয়ে এল বাইরে।
হাড়কাঁপানো ঠান্ডা বাতাস পাক খেতে লাগল ঘরের ভেতরে। বাসুদেবের চোয়াল থরথর করে কাঁপছিল। দাঁতে-দাঁতে ঠোকাঠুকি লেগে বিশ্রীরকম শব্দ হচ্ছিল।
অরিন্দমের পরনে সেই একই পোশাক। গায়ে চাদর মুড়ি দেওয়া, চোখে কালো চশমা। আর পায়ে হালকা নীল রঙের পাজামা।
ওকে খাটের ওপরে বসিয়ে রীতা আর কালাচাঁদ ওর দু-পাশে দাঁড়াল।
কালাচাঁদ প্রশ্ন করল, ‘গয়নাগুলো কোথায়?’
‘আমার কাছে নেই।’ রুক্ষ বিরক্ত স্বরে জবাব দিল অরিন্দম। তারপর হঠাৎই চোখ থেকে কালো চশমাটা এক ঝটকায় খুলে ফেলল।
বাসুদেব অবাক হয়ে দেখলেন, অরিন্দম পোদ্দারের বাঁ-চোখের মণি ঘোলাটে সাদা। বড়সড় টল গুলির মতো মণিটা যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
কালাচাঁদ রীতার দিকে তাকিয়ে কী যেন ইশারা করল। তারপর ওরা দুজনে অরিন্দমের কাছ থেকে চার-পাঁচ পা করে পিছিয়ে গেল। তারপর ওরা দুজনেই ডান হাতের পাতা মেলে আঙুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে অরিন্দমকে তাক করল।
দশটা আঙুলের ডগা থেকে সবুজ শিখার বিদ্যুৎ-ঝিলিক ধেয়ে গেল অরিন্দমের দিকে। আর তৎক্ষণাৎ ওরা তিনজনেই পোশাকহীন হয়ে গেল। কিন্তু ওদের নিরাবরণ চেহারা দেখে হতবাক হয়ে গেলেন বাসুদেব। তিনটে নগ্ন শরীর আপাদমস্তক স্বচ্ছ বরফ দিয়ে তৈরি। যেন কাটগ্লাসের তৈরি তিনটে ভাস্কর্য। তা থেকে নীল আলো প্রতিফলিত হয়ে ঠিকরে পড়ছে। স্বচ্ছ শরীরের কোনও কোনও জায়গা দিয়ে শরীরের ওপাশের জিনিসপত্র স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।
সবুজ শিখার ছোঁয়ায় অরিন্দম পোদ্দারের শরীরে ফাটল ধরল। মাথা থেকে রক্তের ধারা শুরু হল। তারপর শরীর বেয়ে নামতে লাগল।
অরিন্দম টলতে-টলতে উঠে দাঁড়াল।
বরফের ওপরে লাল সিরাপ ঢেলে দিলে সেই সিরাপ বরফের নানা ফাটল বেয়ে চুঁইয়ে-চুঁইয়ে নেমে এলে যেমন দেখায়, অরিন্দমকে ঠিক সেরকম দেখাচ্ছিল। অনেকটা যেন বরফের ওপরে উজ্জ্বল লাল বাটিক প্রিন্টের কাজ।
যন্ত্রণায় ঝুঁকে পড়ে দাঁতে-দাঁত চেপে অরিন্দম বলল, ‘আমাকে ছেড়ে দাও। আমি সব দিয়ে দিচ্ছি…।’
রীতা খিলখিল করে হেসে উঠল : ‘তোমাকে দিতে হবে না। আমরাই নিয়ে নিতে পারব।’
‘রীতা, তোমাকে আমি চিনতে পারিনি। ভুল জায়গায় আমার ভালোবাসা রেখেছিলাম। আমি কখনও ভাবিনি তোমার মতো…।’
অরিন্দম আর কথা বলতে পারল না। তার আগেই কালাচাঁদের আঙুলের ডগা থেকে বেরিয়ে আসা সবুজ বিদ্যুৎ ওকে শতচ্ছিন্ন করে দিল। পলকে বরফের ধুলো হয়ে গেল অরিন্দম। ওর শরীর কোন এক অলৌকিক বাতাসে ঘরময় উড়ে বেড়াতে লাগল। শীতের ঢেউ উথালপাথাল করতে লাগল ঘরের ভেতরে।
রীতা আর কালাচাঁদ হাত বাড়াল পার্টিশন ওয়ালের দিকে। ওদের হাত লম্বা হয়ে দেওয়াল ভেদ করে ঢুকে গেল অরন্দিমের ঘরে। একটু পরেই একটা ব্রিফকেস টেনে নিয়ে এল।
ব্রিফকেসটা আগের মতোই রবারের চাদর দিয়ে মোড়া। রীতা আর কালাচাঁদ হ্যাঁচকা টান মারতেই রবারের চাদর ছিঁড়ে ব্রিফকেসটা চলে এল ঘরের ভেতরে। ওটা বিছানায় রেখে একটানে ওটার ঢাকনা খুলে ফেলল কালাচাঁদ।
সোনালি আলোয় ঝলমল করে উঠল ঘর। সোনা-রং ঠিকরে পড়ল রীতা আর কালাচাঁদের বরফের শরীর থেকে।
ব্রিফকেস ভরতি সোনার গয়না।
বরফের শরীর বাঁকিয়ে-চুরিয়ে রীতা আর কালাচাঁদ হাসতে শুরু করল পাগলের মতো। তারপর হাসির দমক থামলে ওরা ব্রিফকেসের গয়নাগুলো আঁজলা ভরে বারবার তুলে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগল। তখনই ব্রিফকেস থেকে ভাঁজ করা একটা খবরের কাগজ অসাবধানে পড়ে গেল মেঝেতে। কিন্তু সেদিকে ওরা কোনও ভ্রূক্ষেপই করল না। ওরা পাগলের মতো গয়না ঘাঁটতে লাগল।
একসময় ওদের পাগলামি শেষ হল।
তখন ব্রিফকেসটা বন্ধ করে কালাচাঁদ সেটা রীতার হাতে দিল, বলল, ‘চলো, আমাদের কাজ শেষ।’
তারপর ওরা ঠোঁট ঠোঁট ছোঁয়াল, শরীরে শরীর। ওদের ঘিরে বরফের গুঁড়ো তখনও পাক খাচ্ছে।
আবার তীব্র শিসের শব্দ শোনা গেল। আর একইসঙ্গে ভেসে বেড়ানো বরফের গুঁড়ো গাঢ় হল। বাসুদেব ভালো করে কিছু আর দেখতে পাচ্ছিলেন না। তীব্র শীতে ওঁর শরীর ঠকঠক করে কাঁপছিল। তুষার ঝড়ে গোটা ঘরটা উত্তাল হয়ে গেল। রীতা কিংবা কালাচাঁদকে আর দেখা যাচ্ছিল না। শিসের শব্দটা তীব্র হতে-হতে হঠাৎই একসময় মিলিয়ে গেল।
আর তখনই বাসুদেব জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন বাথরুমের মেঝেতে।
বাসুদেবের জ্ঞান ফিরেছিল ভোরের দিকে।
গতরাতের ঘটনা ওঁর কাছে দুঃস্বপ্ন বলে মনে হচ্ছিল। কারণ, বারো নম্বর আর তেরো নম্বর ঘর আগের মতোই পরিপাটি করে সাজানো। সম্প্রতি কেউ সেখানে থেকেছে বলে মনে হয় না। কালাচাঁদ, রীতা অথবা অরিন্দমের কোনও চিহ্নই সেখানে নেই।
ব্যাপারটা পুরোপুরি দুঃস্বপ্ন বলে বাসুদেব মেনে নিতেন, যদি না তেরো নম্বর ঘরের খাটের নীচে হঠাৎ করেই খবরের কাগজটা তিনি দেখতে পেতেন।
খবরের কাগজের পাঁচ নম্বর পৃষ্ঠার একটা খবর ওঁর নজর কাড়ল :
পুলিশের গুলিতে ডাকাত প্রেমিক-প্রেমিকার মৃত্যু
১৬ জানুয়ারি, হুগলি : গতকাল সকাল দশটা নাগাদ বালি স্টেশনের কাছে মুখোমুখি সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে কালাচাঁদ নস্কর ও রীতা নস্কর নামে ডাকাত প্রেমিক-প্রেমিকার মৃত্যু হয়। ওদের কাছে প্রায় পঞ্চান্ন লক্ষ টাকার সোনার গয়না পাওয়া যায়। মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে রীতা জানায় যে, ওরা ওদের এক শাগরেদ অরিন্দম পোদ্দারকে গত ১৪ জানুয়ারি রাতে খুন করে। ভাগাভাগির বিবাদ থেকেই এই খুন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, এই তিনজনের ডাকাতদলই গত ১০ জানুয়ারি বউবাজারের একটি অভিজাত সোনার দোকানে দুঃসাহসিক ডাকাতি করেছিল। বিশেষ সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ বালি স্টেশনের কাছে ফাঁদ পেতে রেখেছিল। কালাচাঁদ নস্করের কাছে একটি রিভলভার ও তিন রাউন্ড গুলি পাওয়া যায়।
ব্যাপারটা খুব পরিষ্কারভাবেই শেষ হত, যদি-না বাসুদেব হঠাৎই খবরের কাগজটার তারিখ খেয়াল করতেন।
কাগজের তারিখটা দশ বছরের পুরোনো।