০৯.
১৭নং ঘরে দুটো চেয়ারে কিরীটী আর সরিৎশেখর মুখখামুখি বসে।
অনুরাধার সঙ্গে তার পূর্ব পরিচয় ও এক সময়ের ঘনিষ্ঠতার কথা সবিস্তারে বলছিল সরিৎশেখর, আমি এখানে আসবার আগে স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি মিঃ রায়, এইভাবে হঠাৎ এতদিন পরে অনুরাধার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যাবে। সত্যি, অনুরাধার কথা যেন কিছুতেই আমি ভুলতে পারছি না!
আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে ডঃ সেন, আপনি যেমন অনুরাধা দেবীকে ভুলতে পারেননি, অনুরাধা দেবীও ঠিক তেমনি আপনাকে ভুলতে পারেননি।
আরও কি দুঃখ হচ্ছে জানেন আমার, অনুরাধা সেদিন ঝোকের মাথায় হঠাৎ যে ভুলটা করে বসেছিল এবং যে ভুলটা সে শোধরাবার জন্য এতখানি ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল, শেষ পর্যন্ত সে ভুলটা শোধরাবার আর সুযোগ পেল না।
অনুরাধা দেবী সত্যিসত্যিই কি তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়েছিলেন বলে আপনার মনে হয় ডঃ সেন?
হ্যাঁ। আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি সে অনুতপ্ত হয়েছিল, আর তাই ঐ মানুষটার হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য একপ্রকার মরীয়া হয়ে উঠেছিল। শেষটায় হয়তো আর কোন পথ না খুঁজে পেয়েই আত্মহত্যা করে।
আত্মহত্যা নয় ডঃ সেন, তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে হয়েছে।
কিন্তু কে-কে তাকে অমন করে হত্যা করল?
একজন কেউ তাকে হত্যা করেছে নিশ্চয়ই!
শুনলাম চন্দ্রকান্তবাবুর সুটকেসে একটা রক্তমাখা ভোজালি পাওয়া গিয়েছে—তাই কি দারোগাবাবু ওঁকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেলেন?
ঠিক তাই।
আপনি কি মনে করেন চন্দ্রকান্তবাবুই–
মনে হওয়াটা তো আশ্চর্য না, উনি তো গতরাত্রে ঠিক ওঁর পাশের ঘরেই ছিলেন। সে যাক, আপনি কি কাউকে ঐ ব্যাপারে সন্দেহ করেন ডঃ সেন?
না, কাকেই বা সন্দেহ করব!
আচ্ছা আপনি আমার একটা কথার জবাব দিন তো-গতকাল ঐ সকালের পর অনুরাধা। দেবীর সঙ্গে আর আপনার সাক্ষাৎ হয়নি বা তার সঙ্গে কোন কথাবার্তা হয়নি?
ডঃ সেন চুপ করে রইলেন।
মনে হয় হয়েছিল, তাই নয় কি ডঃ সেন?
হয়েছিল। ম্লানকণ্ঠে ডঃ সেন বললে, কাল রাত্রে যখন খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে তখন আমি ওর ঘরে গিয়েছিলাম।
রাত তখন কটা হবে?
বোধ করি সোয়া আটটা।
কতক্ষণ ছিলেন সেখানে?
অনেকক্ষণ। ঘণ্টা দু-তিন তো হবেই।
যদি আপত্তি না থাকে, আপনাদের মধ্যে কি কথাবার্তা হয়েছিল বলবেন?
অনুরাধা গতরাত্রে সরিশেখরের বুকের ওপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে ড়ুকরে কেঁদে উঠেছিল।
সরিৎ প্রথমটায় কি করবে বুঝে উঠতে পারেনি, তারপর একসময় বললে, কেঁদো না অনু, কেঁদো না, শোন
আমাকে তুমি বাঁচাও সরিৎ–
শোন আমার কথা–
না না, আগে বল এই যন্ত্রণা থেকে তুমি আমায় মুক্ত করবে।
শোন–সরিৎ সযত্নে অনুরাধার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বললে, মুক্তি আজ তোমাকে নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে অনু। বাইরের কেউ তোমাকে সাহায্য করতে পারবে না।
আমাকেই খুঁজে বের করতে হবে? অনুরাধা বললে, জানো না ঐ মানুষটাকে তুমি? চেনো না?
একটা মিথ্যাকে মেনে নিতে নিতে তুমি আজ দুর্বল হয়ে গিয়েছ রাধা। এই দুর্বলতাকে কাটিয়ে ওঠ, দেখবে মুক্তির পথটা তখন খুঁজে পেতে তোমার কষ্ট হবে না। মিথ্যে জুজুর ভয় মন থেকে যতদিন না দূর করতে পারবে
চল—তুমি আমাকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে চল।
তাতে করে তো তোমার এই প্রবলেমের কোন সমাধান হবে না!
তবে কি আত্মহত্যা করে ছাড়া আমার আর অন্য কোন উপায় নেই?
ছিঃ রাধা, ওকথা ভাবাও অন্যায়।
তাহলে বল, কি করতে হবে আমাকে?
কাল যখন দত্ত মজুমদার ফিরে আসবেন, তাকে সবকিছু স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়ে তুমি কলকাতায় চলে যাও।
তারপর?
আমি এখনও সেই বাসাতেই আছি। ভানুকে তুমি চেনোই, আমার সেই পুরাতন চাকর, তোমার কোন অসুবিধা হবে না—সেখানেই উঠো।
তুমি?
পরশু বা তার পরের দিন ফিরে যাব।
ঠিক তো?
ঠিক। আমি এবার চলি, কেমন? তুমি ভাল করে দরজাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়।
কিরীটী শুধাল তারপর?
সরিৎশেখর বললে, আমি তার ঘর থেকে বের হয়ে চলে এলাম। বাইরে তখনও প্রচণ্ড ঝড় আর বৃষ্টি। আমি সোজা আমার ঘরে ঢুকে খিল তুলে দিলাম।
রাত তখন কটা হবে?
জানি না। ঘড়ি দেখিনি, তবে মনে হয় রাত সোয়া দশটা কি সাড়ে দশটা।
অনুরাধা দেবী কি দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, আমি দরজার কবাট দুটো টেনে দিতে ভিতর থেকে দরজার লকটা পড়বার শব্দ পেয়েছিলাম।
অনেক ধন্যবাদ, আপনার স্টেটমেন্ট থেকে অন্তত এটা প্রমাণিত হল যে গতরাত্রে সোয়াদশটা পর্যন্ত অনুরাধা দেবী জীবিতই ছিলেন। যা ঘটেছে, ঘটেছে তারপর। রাত সাড়ে দশটার। পর কোন এক সময় হত্যাকারী তাকে হত্যা করেছে। এবং অনুরাধা দেবী নিজেই হত্যাকারীকে তার ঘরের দরজা খুলে দিয়েছিলেন। অথচ তিনি জানতেও পারেননি, সাক্ষাৎ মৃত্যুকে তিনি ঘরে ঢুকিয়েছিলেন? অবিশ্যি তাতে করে এও প্রমাণ হচ্ছে যে হত্যাকারী তার অপরিচিত কেউ ছিল না। নচেৎ নিশ্চয়ই তিনি তাকে দেখে চেঁচামেচি শুরু করতেন, লোক ডাকতেন। আর ঘরেও আলো জ্বলছিল–
সরিৎশেখর কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল এবং বললে, আপনি কি অনুমান করতে পেরেছেন মিঃ রায়, কাল রাতে অনুকে কে হত্যা করেছে?
কিরীটী শান্ত গলায় বললে, এতক্ষণ সেটা অস্পষ্ট থাকলেও এখন আর নেই। দুএকদিনের মধ্যেই সেটা জানতে পারবেন। আচ্ছা ডঃ সেন, আপনি এবারে আসুন, আমি একটু বেরুব।
সরিৎশেখর ঘর ছেড়ে চলে গেল। কিরীটীও উঠে দাঁড়াল।
কিরীটী হোটেল থেকে বের হয়ে একটা সাইকেল-রিকশা নিল।
সকাল থেকে যে সন্দেহটা তার মনের মধ্যে ধোঁয়ার মত অস্পষ্ট ছিল, এখন সেটা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
কৌণ্টি যিবে? রিকশাওয়ালা শুধায়।
থানায় চল। সাইকেল-রিকশা থানার দিকে চলল।
গতরাত্রে ঝড়-বৃষ্টির পর শহর অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আকাশে এখানে ওখানে সামান্য ভাসমান মেঘ থাকলেও মোটামুটি পরিষ্কার।
থানার অফিস-ঘরেই হেমন্ত সাহু বসেছিলেন। কিরীটী ঘরে ঢুকতেই বললেন, এই যে আসুন মিঃ রায়। একটু আগেই এস.পি. সাহেব চলে গেলেন।
চলে গিয়েছেন?
হ্যাঁ, তবে বার বার করে বলে গিয়েছিল, আজকের কেসটার ব্যাপারে আমি যেন আপনার পরামর্শ নিই। এদিকেও মহা ঝামেলা
কি আবার ঝামেলা?
ঐ যে আমাদের চন্দ্রকান্ত ঘাই–দাড়িগোঁফ কামাবে না কিছুতেই।
কামায়নি?
কামিয়ে দিয়েছি।
কোথায় সে?
হাজতঘরে—
এখানে আনান লোকটাকে।
সাহু একজন সেপাইকে আদেশ করলেন চন্দ্রকান্তকে অফিস-ঘরে আনবার জন্যে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন সেপাই চন্দ্রকান্তকে ঘরে নিয়ে এল।
কিরীটী তাকাল চন্দ্রকান্তর মুখের দিকে। আর তার কোন সন্দেহ নেই। তার অনুমান মিথ্যা নয়, মন তার মিথ্যা বলেনি। তবু কিরীটী পকেট থেকে একটা ফটো বের করে একবার মিলিয়ে নিল।
ওটা কার ফটো মিঃ রায়? হেমন্ত সাহু শুধালেন।
দেখুন না, চিনতে পারেন কিনা! কিরীটী ফটোটা এগিয়ে দিল সাহুর হাতে।
সাহু দেখতে দেখতে বললেন, আশ্চর্য! এ যে—
ঠিক তাই। দিন ফটোটা।
কিরীটী ফটোটা নিয়ে আবার পকেটে রাখল।
এবার একটা কাজ করতে হবে মিঃ সাহু কিরীটী বললে।
কি করতে হবে?
একটা ঠিকানা দিচ্ছি বলে একটা কাগজে নামধাম লিখে কাগজটা সাহুর হাতে তুলে দিল কিরীটী, এই ঠিকানায় একে একটা আর্জেন্ট টেলিগ্রাম করে দিন, আর বিষ্ণুপুরের থানা অফিসারকেও একটা কেবল পাঠান, যেন অবিলম্বে এখানে তিনি চলে আসেন। মানে ওঁর এখানে আসবার ব্যবস্থা করে দেন।
এখুনি দিচ্ছি উঠে পড়লেন হেমন্ত সাহু।
হেমন্ত সাহু বের হয়ে যাবার পর কিরীটী আবার চন্দ্রকান্তর দিকে তাকাল।
এবার বলুন, আপনাকে কোন নামে ডাকব? কিরীটী চন্দ্রকান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে।
মানে? কুটি করে চন্দ্রকান্ত তাকাল কিরীটী মুখের দিকে।
মানে চন্দ্রকান্ত ঘাই তো আর আপনার আসল নাম নয়?
আপনি বলতে চান, আমি আমার নাম ভাড়িয়েছি? চন্দ্রকান্তর গলার স্বর রুক্ষ।
ক্ষিতীন্দ্রবাবু—
সঙ্গে সঙ্গে যেন চন্দ্রকান্ত চমকে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
খুব আশ্চর্য হচ্ছেন, না? আপনি যে ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেটা আজ আর আমার কাছে অজ্ঞাত নেই।
কি বলছেন যা-তা?
যা বললাম আমি জানি তার চাইতে বড় সত্য আর নেই। কিন্তু এবারে বলবেন কি—এই। তিন-তিনটে বছর ঐ ছদ্মবেশের কি প্রয়োজন ছিল?
আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না!
খুব ভাল করেই বুঝতে পারছেন, কিন্তু স্বীকার করতে চাইছেন না। কিন্তু এটা তো বুঝেছেন, দারোগা সাহেব কেন আপনাকে এখানে হাতকড়া দিয়ে নিয়ে এসেছেন—অনুরাধা দেবীর হত্যার অভিযোগ থেকে যদি নিজেকে এখনও বাঁচাতে চান তো সব কথা আমাকে খুলে বলুন।
আমি অনুরাধা দেবীকে হত্যা করিনি।
সাহুর পক্ষে খুব এটা কঠিন হবে না আপনার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আদালতে প্রমাণ করতে—ঐ রক্তমাখা ভোজালি যেটা আপনারই ঘরে আপনারই সুটকেসের মধ্যে পাওয়া গিয়েছে, তার চাইতে আর মোক্ষম প্রমাণ কি হতে পারে এবং আরও একটা কথা, অনুরাধা দেবী কাল রাত্রে ছিলেন ১৬নং ঘরে এবং আপনি ছিলেন ঠিক তার পাশেই অর্থাৎ ১৫ নম্বরে।
না না, আমি বলছি আমি এর বিন্দুবিসর্গ কিছুই জানি না। অনুরাধা দেবীকে আমি হত্যা করিনি, তাকে আমি চিনি না, কখনও আগে দেখিওনি।
কিন্তু circumstantial evidences যে আপনাকে কোণঠাসা করে ফেলবে, আদালতে কোন ক্রমেই তো আপনি benefit of doubt পাবেন না! আমি—একমাত্র কিরীটী রায়ই আপনাকে বাঁচাতে পারে—
দোহাই আপনার কিরীটীবাবু, আপনি আমাকে বাঁচান। বলতে বলতে ক্ষিতীন্দ্র হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল।
হেমন্ত সাহু এসে ঘরে ঢুকলেন, পাঠিয়ে দিলাম কেবল দুটো।
কিরীটী বললে, এখন ক্ষিতীন্দ্রবাবুকে নিয়ে কি করবেন মিঃ সাহু?
হেমন্ত সাহু বিস্ময়ের সঙ্গে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে, ক্ষিতীন্দ্রবাবু!
ওঁর আসল নাম চন্দ্রকান্ত ঘাই নয়, উনি আপনাকে একটা ধোঁকা দিয়েছিলেন!
কি বলছেন কি?
হ্যাঁ মিঃ সাহু, ওঁর আসল নাম ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিন বৎসর আগে ঐ হোটেলে যিনি নিহত হয়েছিলেন, এবং আপনাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, গলায় ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন, ইনি তিনিই—আদি ও অকৃত্রিম ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-জামসেদপুর-নিবাসী মালতী দেবীর স্বামী! গোলমাল হয়ে যাচ্ছে সব আপনার মিঃ সাহু বুঝতে পারছি—its a long story!
ক্ষিতীন্দ্রবাবু তবে আত্মহত্যা করেননি? তাহলে–
তাহলে তিন বছর আগে ঐ হোটেলে কে খুন হয়েছিল, তাই তো? না, সেটা এখনওমানে সে রহস্য এখনও ধোঁয়া। সম্ভবত সেই তিন বৎসর আগেকার এক হত্যার জেরই—অনুরাধা দেবীকে হত্যা!
সত্যই মিঃ রায়, আমার সব কিছু যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। হেমন্ত সাহু বললেন।
কিরীটী প্রত্যুত্তরে হেসে বললে, তবে মনে হচ্ছে আমাদের হাতে যতটুকু প্রমাণাদি এসেছে, তার মধ্যে কিছু সূত্র আছে যে সূত্র ধরে এগুলেই হয়তো আমরা সমস্ত রহস্যের মীমাংসা খুঁজে পেয়ে যাবদুটো দিন অপেক্ষা করুন।
তবে কি অনুরাধা দেবীকে উনি হত্যা করেননি?
যদি বলি, না!
তাহলে ঐ ভোজালি, ঐ রুমাল—
বললাম তো, দুটো দিন অপেক্ষা করুন, আপনাদের সব প্রশ্নের জবাব পাবেন।
ওঁর কি ব্যবস্থা করব? হেমন্ত সাহু শুধালেন।
কেন–যেমন হাজতে আছেন তেমনিই থাকবেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হচ্ছে ক্ষিতীন্দ্রবাবু গতরাত্রে অনুরাধা দেবীকে হত্যা করেননি! আচ্ছা আমি এখন উঠব মিঃ সাহু–উঠে দাঁড়াল কিরীটী।
আপনি–
ভয় নেই, হোটলে থাকব-মালতী দেবী না এসে পৌঁছানো পর্যন্ত। বলে থানা থেকে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল কিরীটী।
কিছুটা পথ হেঁটে আসার পর কিরীটী একটা খালি সাইকেল-রিক্শা দেখে তাকে হাতঈশারায় ডেকে উঠে বসল।
কৌটি যিবে বাবু?
স্বর্গদ্বার হোটেলে চল।
চলন্ত রিকশাতে বসে কিরীটীর হঠাৎ মনে পড়ল, বিশেষ একটা জরুরি কথা হেমন্ত সাহুকে বলে আসা হয়নি। আবার ফিরে গেল কিরীটী থানায়।
থানার সামনে পৌঁছে দেখল, হেমন্ত সাহু বেরুচ্ছেন একটা সাইকেল চেপে।
কি, আবার ফিরে এলেন যে? হেমন্ত সাহু শুধালেন।
ট্যাক্সি ড্রাইভার জগন্নাথ পাণ্ডাকে চেনেন মিঃ সাহু?
হ্যাঁ, তার নিজেরই একটা ট্যাক্সি আছে, নিজেই চালায়।
তাকে একটিবার আপনার থানায় বিকেলে ডাকিয়ে আনতে পারেন?
ভাড়া খাটতে যদি না বের হয়ে থাকে তো ডেকে পাঠাব।
আমি তো হোটেলেই আছি, এলে খবর পাঠাবেন।
ঠিক আছে।
কিরীটী আবার ফিরে চলল। হোটেলের সামনে নামতেই হোটেলের নুলিয়া আড়িয়ার সঙ্গে দেখা হল। তাকে ডেকে কিরীটী কি যেন বললে। সে ঘাড় নেড়ে বললে, বুঝেছি।
কিরীটী বললে, ২০ টাকা বকশিস পাবি, যা।
আড়িয়া চলে গেল।
রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে কিরীটী এসে তার নিজের ঘরে ঢুকতেই দরজার বাইরে সলিল দত্ত মজুমদারের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ভিতরে আসতে পারি মিঃ রায়?
আসুন, আসুন।
সলিল দত্ত মজুমদার ঘরে এসে ঢুকলেন। পরনে তার পায়জামা পাঞ্জাবি।
মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, বোঝা গেল স্নানপর্ব শেষ হয়েছে।
বসুন মিঃ দত্ত মজুমদার।
সলিল দত্ত মজুমদার একটা চেয়ারে উপবেশন করলেন।
তারপর মিঃ দত্ত মজুমদার-I. G. মিঃ গুপ্তর সঙ্গে ট্রাংক কলে কথা হল?
না। তাকে এখনও ফোনে কনটাক্ট করতে পারিনি। এদিকে পরশু দুপুরে আমার একটা জরুরি মিটিং অ্যাটেন্ড করবার কথা, মিটিংটা অ্যাটেন্ড না করতে পারলে ভীষণ ক্ষতি হবে।
এখানকার ব্যাপারটাও তো কম জরুরি নয় মিঃ দত্ত মজুমদার।
আপনাদের কি ধারণা মিঃ রায়, অনুরাধাকে আমি হত্যা করেছি?
ব্যাপারটা ঠিক তা নয় মিঃ দত্ত মজুমদার, কিরীটী বলল, এমন কিছু সার্কাস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স আমাদের হাতে এসেছে যাতে করে আপনিও সন্দেহের তালিকার বাইরে যেতে পারছেন না!
ননসেন্স! আমি কেন অনুরাধাকে হত্যা করতে যাব?
আপনার দিক থেকে হত্যা করবার কারণ যেমন ছিল তেমনি প্রভোকেশানও ছিল। আপনি নিশ্চয়ই চাইতেন না অনুরাধা দেবী আপনার মুঠোর বাইরে চলে যাক!
সে চলে যেতে চাইলে নিশ্চয়ই আমি আটকাতাম না।
আমার প্রশ্নটার ঠিক জবাব নয় ওটা। আমি আপনার মনের ইচ্ছার কথাটা বলেছি কি, আপনি তা চাইতেন?
বললাম তো, আটকাতাম না।
কিরীটী মৃদু হাসল। তারপর বলল, গতকাল আপনি ভুবনেশ্বরে যাবার আগে অনুরাধা দেবীর সঙ্গে আপনার কথাকাটাকাটি হয়েছিল, তাই না?
কে বললে?
যেই বলে থাকুক–কথাটা সত্যি কিনা তাই বলুন।
না।
ভুবনেশ্বরে কখন গিয়ে পৌঁছেছিলেন?
বেশীক্ষণ লাগেনি, ঘন্টা দুই পরেই।
তারপর ফিরলেন কখন?
আজ সকালে প্রায় দশটা নাগাদ।
আচ্ছা মিঃ দত্ত মজুমদার, আপনার ওয়াটারপ্রুফটা কি আসার সময় এখানে সঙ্গে করে এনেছিলেন?
এনেছিলাম। বৃষ্টির সময় এটা-ওয়াটারপ্রুফটা তাই সঙ্গে এনেছিলাম।
কাল বেরুবার সময় সেটা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন?
নিয়েছিলাম বৈকি।
কিন্তু আজ সকালে যখন ফিরলেন, ওয়াটারপ্রুফটা তো আপনার সঙ্গে ছিল না?
সলিল দত্ত মজুমদার যেন একেবারে বোবা।
ভুবনেশ্বরে ফেলে আসেননি তো ভুল-টুল করে—
না, না।
তবে কোথায় ফেলে এলেন, মনে করার চেষ্টা করুন।
মনে হচ্ছে ট্যাক্সিতে ফেলে আসতে পারি—
ট্যাক্সিতে ফেলে আসলে কি আর সেটা পাবেন?
কেন পাব না, নিশ্চয়ই পাব। জগন্নাথ পাণ্ডা সেরকম লোক নয়।
তা বেশ। কিন্তু আপনি যে চলে যেতে চাইছেন, অনুরাধা দেবীর শেষ কাজটুকু কে করবে?
চুলোয় যাক অনুরাধা, I dont care!
সে কি! এতকাল ভদ্রমহিলাকে নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়ে এসেছেন—
স্ত্রী না ছাই। একটা লোক-দেখানো বিয়ে না করলে—
ওঁকে ধরে রাখতে পারতেন না, তাই কি?
অফিসের মাইনে ছাড়াও কম টাকা ওকে আমি মাসে মাসে দিইনি। নেমকহারাম, ছোটলোক–
মিথ্যে রাগ করছেন মিঃ দত্ত মজুমদার, রক্ষিত রাখতে হলে টাকা খরচ করতে হয় বৈকি। যা সেকথা—মুকুল দেবী তত ছিলেন আপনার স্ত্রী, তাই না?
নিশ্চয়ই, রীতিমত রেজেস্ট্রি করে বিবাহ করেছিলাম তাকে।
তবে যে সরিৎশেখরবাবুর কাছে অনুরাধা দেবী বলেছিলেন, তিনিও আপনার বিবাহিত স্ত্রী নন–মানে আইনসঙ্গত স্ত্রী ছিলেন না?
বাজে কথা। মুকুলকে আমি রেজেস্ট্রি করে বিবাহ করেছিলাম।
তা হঠাৎ তিনি নিরুদ্দেশটা হলেন কেন? এমন কিছু আপনাদের মধ্যে ঘটেছিল কি?
না, কিছুই ঘটেনি।
আচ্ছা মুকুল দেবীর দাদার নাম জীমূতবাহন, না?
হ্যাঁ।
সেই যে একদিন অফিসে এসে তিনি আপনাকে থ্রেন করে গিয়েছিলেন, তারপরে আর তার সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?
না।
আমি যদি বলি আপনি ঠিক সত্য কথাটা বলছেন না!
মিথ্যা কিসের জন্য বলতে যাব?
কারণ একটা মিথ্যা ঢাকতে গেলে আর একটা মিথ্যা এসে পড়ে, তারপর আর একটা মিথ্যার পাহাড় জমে ওঠে ক্রমশ। আর তখন সবটাই মিথ্যা হয়ে যায়। তাছাড়া ভুলে যাবেন না, মিথ্যাকে চিরদিন সত্য বলে চালানো যায় না, একদিন না একদিন অনিবার্য ভাবেই সত্য যা তা প্রকাশ হয়ে পড়ে।– সলিল দত্ত মজুমদার আর কিছু বললেন না, নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
ঐদিনই দ্বিপ্রহরে। কলকাতায় ট্রাংককলে কার সঙ্গে যেন কথা বলে সবে এসে ঘরে ঢুকছে কিরীটী, চোরের মত এদিক ওদিক চাইতে চাইতে প্রৌঢ় নুলিয়া আঁড়িয়া এসে ঘরে ঢুকল, কাপড়ের তলায় কি যেন একটা বস্তু সযত্নে আড়াল করে।
–সাহাব।
কে, আঁড়িয়া—আয়, পেয়েছিস?
হ্যাঁ, পেয়েছি সাহেব। দেখ—সযত্নে কাপড়ের আড়াল থেকে একটা ওয়াটারপ্রুফ বের করে কিরীটী সামনে ধরল।
কিরীটীর চোখের দৃষ্টি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। ওয়াটার প্রুফটা উলটে-পালটে দেখে হৃষ্টচিত্তে বললে, কোথায় পেলি এটা?
স্বর্গদ্বার ছাড়িয়ে আরও এক মাইল দূরে-বালুর চরায় কাঁটাঝোপের মধ্যে।
কিরীটী ব্যাগ থেকে দশ টাকার দুটো নোট বের করে আঁড়িয়াকে দিল। আঁড়িয়া হৃষ্টচিত্তে, টাকাটা ট্যাকে খুঁজতে খুঁজতে ঘরে থেকে বের হয়ে গেল।
বিকেলের দিকে থানা থেকে সাহু লোক পাঠালেন। জগন্নাথ পাণ্ডা থানায় বসে আছে। থানায় গিয়ে জগন্নাথের সঙ্গে কথাবার্তা বলে কিরীটী যখন ফিরে এল, সন্ধ্যার অন্ধকার চারদিকে ঘন হয়ে এসেছে তখন।