সামনে সমুদ্র নীল – পরিচ্ছেদ ৭

০৭.

সারাটা রাত্রি বর্ষণ ও ঝড়ের বিরাম ছিল না। শেষরাত্রির দিকে ঝড় ও বৃষ্টির প্রকোপ কমে এল ধীরে ধীরে। কিন্তু বাতাস তখনও বেগে বইছে।

শেষরাতের দিকে বোধ করি সামান্য সময়ের জন্য চোখে একটু তন্দ্রামত এসেছিল কিরীটীর, তাটা ভেঙে গেল দরজায় করাঘাত শুনে–

রায়মশাই, রায়মশাই দরজাটা খুলুন।

হোটেলের মালিক ভবেশ অধিকারীর গলা, কিরীটী উঠে দরজাটা খুলতেই যেন একটা দমকা হাওয়ার মত ভবেশ অধিকারী ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলেন।

কি ব্যাপার ভবেশবাবু?

খুন—

খুন! কিরীটীর বিস্ময়-প্রশ্ন।

হ্যাঁ, খুন। ১৬নং ঘরে—

মানে আমার এই পাশের ঘরে? কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন কর।

হ্যাঁ।

কে খুন হয়েছে?

অনুরাধা দেবী।

সে কি!

চলুন–

মেঝেতে পড়ে আছেন ভদ্রমহিলা, গলাটা দুফাঁক করে কাটা। কিরীটী কয়েকটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বললে, আপনি কখন দেখলেন?

সবে ঘুম ভেঙে উঠে–ভবেশ অধিকারী বললেন, ঘরের বাইরে বের হয়েছি চাকরবাকরকে জাগাব বলে, হঠাৎ ওপরের দিকে তাকাতে নজর পড়ল ১৬নং ঘরের দরজা খোলা, দরজার পাল্লা দুটো হাওয়ায় পড়ছে আর খুলছে। তাড়াতাড়ি ওপরে এলাম, ভদ্রমহিলার স্বামী নেই, কাল কাজে ভুবনেশ্বরে গিয়েছেন, উনি একা ছিলেন, তাই আমাকে বলে গিয়েছিলেন একটু নজর রাখতে ওঁর ওপরে! এখন কি হবে রায়মশাই!

ওঁর স্বামী রাত্রে ফেরেননি?

না, আজ দুপুরে ফিরবার কথা, আজকের এক্সপ্রেসেই চলে যাবেন ওঁরা।

ভবেশ অধিকারী আবার বলতে লাগলেন, এবারে আর হোটেলটা টিকিয়ে রাখতে পারব না। হোটেল এবার উঠেই যাবে। তিন বৎসর আগে এক ভদ্রলোক গলায় ক্ষুর চালিয়ে ১৭নং মানে এই ঘরে আত্মহত্যা করেছিলেন, সেই ঘটনার পর হোটেল প্রায় উঠেই যেতে বসেছিল, এবার হয়েছে খুন–

দুর্ঘটনার জন্য তো আর আপনি দায়ী নন ভবেশবাবু, কিরীটী বলল।

সে কথা লোক কি বুঝবে। হোটেলের নামে দুর্নাম রটে যাবে। এতদিনের ব্যবসা-সর্বনাশ হয়ে গেল আমার রায়মশাই!

চলুন একবার পাশের ঘরে কিরীটী বলল।

আকাশ তখনও মেঘাচ্ছন্ন, বৃষ্টি না থামলেও হাওয়া বইছে এলোমেলো। সমুদ্র আথালিপাথালি করছে, বড় বড় ঢেউ তীরের উপর এসে ভেঙে ভেঙে পড়ছে। হোটেলের বাসিন্দারা তখনও কেউ ওঠেনি। পাশের ঘরে অর্থাৎ ১৬নং ঘরে এসে ঢুকল কিরীটী খোলা দরজাপথে। হাওয়ার দাপটে দরজায় পাল্লা দুটো খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে! ঘরের মধ্যে আলোটা জ্বলছে। সেই আলোতেই কিরীটীর ভয়াবহ সেই দৃশ্যটা নজরে পড়ল। ঘরের মেঝেতে জমাট বাঁধা রক্তের ওপরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে অনুরাধার দেহটা, ঘাড়ে একটা চারইঞ্চি পরিমাণ গভীর ক্ষত, —হাঁ হয়ে আছে। বুঝতে কষ্ট হয় না কোন ধারাল অস্ত্রের সাহায্যে আততায়ী পশ্চাৎ দিক থেকে মেয়েটিকে মোক্ষম আঘাত হেনেছে। এবং সে আঘাতের ফলে মৃত্যু ঘটেছে।

পরনের শাড়িটা আগোছালো। ব্লাউজের পিঠের দিকে ছেড়া—শুভ্র পৃষ্ঠদেশ উন্মুক্ত অনেকটা। বাম হাতটা প্রসারিত, ডান হাতে একটা তীক্ষ্ণ ছুরি মুঠো করে ধরা।

ঘরের চারপাশে তাকাল কিরীটী। একটা চেয়ার উলটে পড়ে আছে, শয্যাটা এলোমেলো, চাদরটা নীচের দিকে ঝুলছে। ঘরের সর্বত্র একটা ধস্তাধস্তির চিহ্ন।

কি নাম ভদ্রমহিলার? কিরীটী প্রশ্ন করল।

অনুরাধা দত্ত মজুমদারসলিল দত্ত মজুমদারের স্ত্রী।

করে এসেছিলেন এখানে?

চারদিন আগে। কথা ছিল দিন দশেক থাকবেন, কিন্তু হঠাৎ মত পালটান দত্ত সাহেব। আজই যাবার কথা ছিল, আমিই টিকিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছি।

আপনি বলছেন ভদ্রমহিলা দত্ত মজুমদারের স্ত্রী, কিন্তু মাথায় সিঁদুর দেখছি না তো! হাতেও শাঁখা বা লোহা দেখছি না। দুগাছা করে মাত্র সোনার চুড়ি।

হয়তো পরেন না। আজকাল তো অনেকেই ওসব ব্যবহার করেন না।

তা বটে, তা আপনি ঠিক জানেন তো ভবেশবাবু, ওঁরা স্বামী-স্ত্রী ছিলেন?

খাতায় তো তাই লিখেছেন।

১৫নং ঘরে কেউ আছেন?

কালই এসেছেন এক ভদ্রলোক, নাম চন্দ্রকান্ত ঘাই–

আমি তো কাল রাত্রে পাশের ঘরেই ছিলাম, কোন চেঁচামেচি বা গোলমালও আমার কানে আসেনি। কিরীটী বলল।

যা ঝড়জল গিয়েছে রাত্রে—তা শুনবেন কি!

তা ঠিক। ভাল কথা, এখানকার থানা অফিসার কে? চেনেন তাঁকে?

খুব চিনি। হেমন্ত সাহু। বছরখানেক হল এখানে এসেছেন।

ঠিক আছে, থানায় একটা খবর পাঠান।

ভবেশ অধিকারী যেন একটু অনিচ্ছার সঙ্গেই ঘর থেকে বের হয়ে যাবার জন্য পা বাড়াতেই কিরীটী বললে, এই ঘরটায় একটা তালা দিয়ে দিন।

আরও মিনিট কুড়ি পরে।

নীচের তলায় অফিসে কিরীটী বসে ছিল। সামনে এক কাপ চা।

ভবেশ অধিকারীও সামনে এক কাপ চা নিয়ে ঝিম মেরে চেয়ারটার ওপরে বসে। তার মাথার মধ্যে চিন্তার ঝড় বইছিল। বোর্ডাররা এখনও কেউ ব্যাপারটা জানে না। কিন্তু আর কতক্ষণ, সাহু এসে পড়বেন হোটেলে, সঙ্গে সঙ্গে জানাজানি হয়ে যাবে ব্যাপারটা। তারপর যে কি ঘটবে ভাবতেও ভবেশ অধিকারীর হাত-পা যেন ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল।

সরিৎশেখর এসে অফিসে ঢুকল।

এই যে ম্যানেজারবাবু, সরিৎ বললে, আপনি এখানেই আছেন, আমার বিলটা তৈরি রাখবেন, আমি আজই চলে যাব।

চলে যাবেন! কেন? কেমন যেন বোকার মতই প্রশ্ন করলেন ভবেশ আধিকারী।

এমন বিশ্রী ওয়েদার শুরু হল, এখানে থাকার আর কোন মানে হয় না। এক্সপ্রেসে তো রিজার্ভেশন পাব না, ভাবছি ভুবনেশ্বর থেকে প্লেনেই যাব।

এই দুর্যোগে প্লেন কি ছাড়বে? কিরীটী বলল।

ছাড়বে না? কিরীটীর কথায় ওর মুখের দিকে তাকাল সরিৎশেখর।

মনে হয় ছাড়বে না। দেখুন আবার বৃষ্টি শুরু হল, বলল কিরীটী!

তা আর কি করা যাবে। ভুবনেশ্বরেই না হয় একটা দিন থাকব। হোটেল তো সেখানে আছেই, আপনি বিলটা রেডি করে বরং আমার ঘরে পাঠিয়ে দিন। কথাগুলো বলে সরিৎশেখর আর দাঁড়াল না, ঘর থেকে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে গেল। কিরীটী সরিতের গমনপথের দিকে তাকিয়েছিল।

কেমন যেন একটা ব্যস্ততা, একটা অস্থিরতা ভদ্রলোকের কথাবার্তায়, হাবেভাবে। কেন জানি

কিরীটীর মনে হল, কেবল কি এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্যই ভদ্রলোক চলে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন?

ভবেশবাবু, ভদ্রলোক দোতলায় কোন্ ঘরে থাকেন?

১৮নং ঘরে, আপনার ঠিক পাশের ঘরে। দেখলেন তো রায়মশাই, আপনাকে বলেছিলাম, আমার সর্বনাশ শুরু হল, সবাই চলে যাবে—

ভদ্রলোক তো এখনও ব্যাপারটা জানেন না! কিরীটী বললে।

জানেন না কি, নিশ্চয়ই জেনেছেন, দোতলারই একটা ঘরে যখন খুন হয়েছে—

কিরীটী প্রত্যুত্তর মৃদু হাসলেন, আচ্ছা ভবেশবাবু, হোটেলের তো সবাই জাগছে, কিন্তু ১৫নং ঘরের ভদ্রলোকটি তো এখনও জাগেননি, এত বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছন নাকি?

ভবেশ অধিকারী কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, বলা হল না। হোটেলের সামনে সাইকেলরিকশা থেকে থানার দারোগা হেমন্ত সাহুকে নামতে দেখা গেল।

ঐ যে দারোগাবাবু—শুকনো গলায় বললেন ভবেশ অধিকারী।

হেমন্তবাবু রিকশা থেকে নেমে একটা কোলাব্যাঙের মত থপ থপ করে হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের অফিস ঘরে এসে ঢুকলেন।

মোটা বেঁটে থলথলে চেহারা, ঠোঁটের ওপরে ভারী একজোড়া গোঁফ। চোখ দুটো ছোেট, বর্তুলাকার মুখ বসন্তের দাগে ভর্তি, পরনের ইউনিফর্ম টাইট হয়ে গায়ে বসেছে।

কি ব্যাপার ভবেশবাবু, কে খুন হল?

ভবেশ অধিকারীর গলার স্বর বসে গিয়েছে। তিনি বললেন, ১৬নং ঘর।

১৬নং ঘর খুন হয়েছে–

না, ঐ ঘরে এক ভদ্রমহিলা খুন হয়েছেন।

ঘরে আর কেউ ছিল না?

না, ওঁর স্বামী গতকাল জরুরি কাজে ভুবনেশ্বর গিয়েছেন, এখনও ফেরেনি, বললে কিরীটাই এবারে।

আপনি? কথাটা বলে সাহু তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।

জবাব দিলেন ভবেশ অধিকারী, উনি স্যার, কিরীটী রায়–নামকরা একজন সত্যসন্ধানী, মানে ডিটেকটিভ।

হুঁ, তা উনি এখানে কেন?

আমি এই হোটেলেই গতকাল এসে উঠেছি।

হুঁ। চলুন ডেড বডি কোথায়? ১৬নং ঘরে বললেন না! কাল রাতে যখন অত ঝড়বৃষ্টি চলছিল তখনই বুঝেছিলাম একটা অঘটন কিছু ঘটবে! কে জানত একেবারে যাকে বলে আমার নাকের ডগাতেই, আপনার হোটেলেই সেটা ঘটে বসে আছে। আর শালার এস. পি.-ও কাল থেকে থানায় এসে বসে আছে—তা ১৬নং ঘরটি কোথায়?

দোতলায়, ভবেশ বললে।

চলুন, যত সব ঝুটঝামেলা, খুরদা রোডে বেশ ছিলাম, ছিচকে চোরের কিছুটা উৎপাত ছিল বটে কিন্তু এমন খুনজখম ছিল না।

কিরীটী মৃদু মৃদু হাসছিল নিঃশব্দে। সেদিকে নজর পড়ায় সাহু বললেন, হাসছেন যে, হাসির কথাটা কি হল জানতে পারি কি?

আপনাদের এস. পি. মিঃ নির্মল বড়ুয়া না?

চকিতে ফিরে তাকালেন সাহু-হ্যাঁ, তার নাম জানলেন কি করে?

তাঁর সঙ্গে আমার যথেষ্ট পরিচয় আছে, থানায় ফিরে গিয়ে আমার নামটা বললেই তিনি চিনতে পারবেন।

কি যেন আপনি করেন, ভবেশবাবু বলছিলেন?

তিন বছর আগে এই হোটেলেই ঐ দোতলায় ১৭নং ঘরে একটা খুন হয়েছিল, সেই ব্যাপারেই–

খুন হয়েছিল তিন বছর আগে এই হোটেলে?

হ্যাঁ, ওঁকেই মানে ভবেশবাবুকেই জিজ্ঞাসা করুন না মিঃ সাহু! তাই এখানে আসার আগে, মিঃ বড়ুয়াকে ট্রাংককলে আমি কটকে আসার কথাটা জানিয়েছিলাম। তার এবং আপনার .. সাহায্যের হয়তো আমার প্রয়োজন হতে পারে। তিনি আমায় বলেছিলেন, আপনি একজন খুব কমপিটেন্ট অফিসার–

তা এসব কথা আমাকে আগে বলবেন তো!

সাহুর ব্যবহার তো বটেই, গলার স্বর কথাবার্তাও যেন পালটে গিয়েছে।

ভেবেছিলাম আজ সকালেই আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাব থানায়–

হ্যাঁ হ্যাঁ, গতরাত্রেই সাহেব আমাকে বলছিলেন বটে–কিন্তু আপনি যে ঘটনার কথা বলছেন সেসব গতরাত্রেই থানার পুরাতন ডাইরি উলটে-পালটে আমি দেখছিলাম—সেটা তো একটা সুইসাইড কেস!

না, হোমিসাইড খুন—ডায়াবলিকাল মার্ডার, আর এখানে এই হোটেলে গতরাত্রে ১৬নং * ঘরে যা ঘটেছে সেটাও তাই, মার্ডার-নৃশংস খুন!

আপনি ডেডবডি দেখেছেন মিঃ রায়?

হ্যাঁ। পিছন থেকে আকস্মিকভাবে কোন ধারাল অস্ত্র চালিয়ে এমন আঘাত করা হয়েছে যে তাতেই ভদ্রমহিলার মৃত্যু হয়েছে বলে আমার ধারণা।

অস্ত্র কি–কাটারী?

না, ধান কাটা হয় যে কাস্তের সাহায্যে, আমার অনুমান সেই ধরনেরই কোন অস্ত্র আততায়ী ব্যবহার করেছিল। তারপর মৃতের হাতে একটা ধারাল ছুরি গুজে দিয়ে ব্যাপারটাকে আত্মহত্যা বলে রূপ দেবার চেষ্টা করা হয়েছে।

বুঝলেন কি করে?

ওটা উল্ডের পজিসন ও ডেপথ দেখলে আপনিও বুঝতে পারবেন মিঃ সাহু।

কিন্তু ভদ্রমহিলাকে কে খুন করল?

হত্যাকারীর মোটিভ বা উদ্দেশ্য একটা কিছু ছিল বৈকি। বিনা মোটিভে তত খুন হয় না। কিরীটী বললে।

আসুন না, চলুন উপরে আমার সঙ্গে। সাহু অনুরোধ জানালেন।

বেশ চলুন।

সেই ১৬নং ঘর, সেই রক্তাক্ত মৃতদেহ। চারপাশে মেঝেতে জমাটবাঁধা কালো চাপ চাপ রক্ত। সাহু সেই দৃশ্যটা দেখে যেন থমকে গেলেন। অস্ফুটকণ্ঠে বললেন, উঃ, কি ভয়ানক!

বাইরে তখন আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মেঘে মেঘে আকাশটা কালো হয়ে গিয়েছে।

মেয়েটার বয়স কত হবে বলুন তো মিঃ রায়? সাহুর প্রশ্ন।

বছর ২৮/২৯ তো হবেই–

বলছিলেন না ভবেশবাবু, মেয়েটি বিবাহিতা, কিন্তু মাথায় বা কপালেও সিঁদুর দেখছি না। বউ-টউ সাজিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে ফুর্তি করতে

না, না, ওঁরা স্বামী-স্ত্রীই—প্রফেসারও তাই বলছিলেন গতকাল সকালে। প্রফেসারও ভদ্রমহিলাকে চিনতেন। ভবেশ অধিকারী প্রতিবাদ জানালেন।

অধ্যাপক! কে অধ্যাপক?

অধ্যাপক সরিৎশেখর সেন, ঐ তো দোতলাতে ১৮নং ঘরে উঠেছেন—

আমার বাম দিককার ঘরে, কিরীটী বললে, আমি ১৭নং ঘরে আছি।

সাহু বললেন, এ ঘরের ডানদিকে ১৫নং ঘরে কেউ নেই ভবেশবাবু?

আছেন। গতকালই এসেছেন। চন্দ্রকান্ত ঘাই নামে এক ভদ্রলোক।

মিঃ রায়, আপনি তো বললেন আপনি ১৭নং ঘরে আছেন। কাল রাত্রে আপনি কিছু শোনেননি?

না। কাল–

কিরীটীর কথা শেষ হল না, ঘরের বাইরে জুতোর শব্দ শোনা গেল। সকলেই দরজার দিকে তাকাল। ঘরে এসে ঢুকল সলিল দত্ত মজুমদার। ঘরে পা রেখেই ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, কি ব্যাপার, আমার ঘরে ভিড় কেন ভবেশবাবু?

কারও মুখে কোন কথা নেই।

আপনিই মিঃ দত্ত মজুমদার? প্রশ্ন করলেন সাহুই সর্বপ্রথম।

হ্যাঁ।

উনি আপনার স্ত্রী? ঐ যে মেঝেয় পড়ে–

মেঝের দিকে তাকিয়ে একটা অস্ফুট চিৎকার করে উঠল সলিল দত্ত মজুমদার, how horrible! এ কি! অনুরাধাকে অমন করে খুন করল কে? নাকি অভিমান করে অনুরাধা শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যাই করল?

আত্মহত্যা নয় মিঃ দত্ত মজুমদার, its a simple case of murder—diabolical murder! কিরীটী ধীরে ধীরে দত্ত মজুমদারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে গেল।

কিন্তু কে—কে হত্যা করল? কাদাঁদ গলায় বলল সলিল দত্ত মজুমদার।

সাহু এবারে বললেন, উনি আপনার স্ত্রী?

স্ত্রী–না, মানে ঠিক

স্ত্রী নন! পুনরায় সাহুর প্রশ্ন।

মানে ঠিক বিবাহিত না হলেও…স্ত্রীর মত ছিল, we used to live together!

সাহু অত্যন্ত স্পষ্টবক্তা। বললেন, মানে উনি তাহলে আপনার রক্ষিতা ছিলেন বলুন?

হ্যাঁ, মানে–স্ত্রীর মতই—

ইতিমধ্যে অনেক জোড়া কৌতূহলী চোখ ১৬নং ঘরের দরজার সামনে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছিল।

সলিল দত্ত মজুমদার বললেন, এখন আমি কি করি—অসহায় গলার স্বর।

সাহু বললেন, ইনভেস্টিগেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনি এ হোটেল ছেড়ে কোথাও এক পা বাইরে যাবেন না।

কেন?

কারণ মৃত্যুর সঙ্গী ছিলেন আপনি—একমাত্র কাছের মানুষ এবং আপনারা দুজন স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে এই হোটলে এসে উঠেছিলেন।

না না, আমি একাই নয়, সলিল দত্ত মজুমদার বললেন, আরও একজন এই হোটেলে আছে। ১৮নং ঘরে-অনুরাধার পূর্বতন প্রেমিক।

কার কথা বলছেন?

প্রফেসর সরিৎশেখর সেন। কাল তো সকালের দিকে অনেকক্ষণ ১৮নং ঘরে দুজনে ঢলাঢলি করছিল। আর কাল তো সারাটা দুপুর ও রাত্রের দিকে আমি হোটেলেই ছিলাম না—ওরাই ছিল।

কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিল সলিল দত্ত মজুদমারকে, হঠাৎ এবার বলল, আপনার সারা জুততা ও প্যান্টের নীচে অত বালি এল কোথা থেকে?

সমুদ্রের ধার দিয়ে হেঁটে এসেছি তো, তাই বোধ করি—

আপনি তো গাড়িতে ভুবনেশ্বর গিয়েছিলেন, ফিরে এসেছেন কি সমুদ্রের ধার দিয়ে হেঁটে হেঁটে?

না না, তা কেন! গাড়িতেই ফিরেছি, তবে হোটেলের কাছাকাছি এসে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে এলাম।

কাল কখন ভুবনেশ্বর পৌঁছেছিলেন–কখন সেখান থেকে রওনা হয়েছেন?

ভোরবেলা রওনা হয়েছি—

এখানে আসতে কতক্ষণ সময় লাগল?

তা ঘণ্টা দুই প্রায়। কিন্তু এত কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? আর আপনি বা কে?

সাহুই জবাব দিলেন সলিল দত্ত মজুমদারের কথাটার, বললেন, উনি আমাদের লোক। যা জিজ্ঞাসা করছেন তার জবাব দিন ওঁকে।

কিরীটী বললে, ওঁকে আমার আর কিছু জিজ্ঞাসা নেই মিঃ সাহু। আপনার যদি কিছু জানবার থাকে—

না, আমি আর কি জিজ্ঞাসা করব—হেমন্ত সাহু বললেন।

ভবেশবাবু, ঘরের দরজায় তো দেখছি গডরেজের তালা লাগানো-কিরীটী বলল।

হ্যাঁ, এই হোটেলের সব দরজাতেই গডরেজের তালা লাগানো–ভবেশ বললেন।

দুটো করে নিশ্চয়ই চাবি আছে প্রত্যেক তালার?

হ্যাঁ। একটা অফিসে থাকে, অন্যটা বোর্ডারকে দেওয়া হয়।

একটা চাবি তো দেখছি তালায় লাগানো, অন্যটা—

নীচে অফিসে আছে, কি বোর্ডে টাঙানো-আনব?

নিয়ে আসুন। আর ঐ সঙ্গে সরিৎবাবুকে এই ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে যান।

ভবেশ অধিকারী ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

কিরীটী আবার সলিল দত্ত মজুমদারের দিকে তাকাল-মিঃ দত্ত মজুমদার, আপনি অনুরাধা দেবীর প্রতি সন্দিহান হয়ে উঠেছিলেন?

মেয়েমানুষকে কেউ পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে কি? মেয়েমানুষ জাতটাই—

অবিশ্বাসিনী হয়—তাই কি আপনার ধারণা?

তাই। নচেৎ দেখুন না, হঠাৎ পুরানো প্রেমিককে দেখেই অনুরাধার পূর্ব স্মৃতি জেগে উঠল—

প্রফেসারকে কি আপনি সন্দেহ করেন?

ঠিক ঐ মুহূর্তে প্রথমে ভবেশ অধিকারী ও তার পশ্চাতে সরিৎশেখর ঘরে এসে ঢুকলেন। ঘরে পা দিয়েই সরিৎশেখর অস্ফুট কণ্ঠে বললে, এ কি! অনুরাধা এভাবে—ওকে কে খুন করলে? উঃ, কি ভয়ানক।

আপনি তো চেনেন সরিৎবাবু, ওঁর সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল—

হ্যাঁ, এক সময় ছিল ঠিকই, পরে অনুরাধা মিঃ দত্ত মজুমদারকে বিবাহ করেছিল।

আপনি সেকথা কার কাছে শুনলেন—অনুরাধা দেবী বলেছিলেন নাকি?

না, সলিল দত্ত মজুমদারই বলেছিলেন কাল। শুধান না ওঁকে!

কিন্তু ওঁদের বিয়ে তো হয়নি। অনুরাধা দেবী ওঁর কিপিংয়ে ছিলেন—

এখন মনে পড়ছে বটে, অনুরাধা ঐরকম কিছু একটা গতকাল আমাকে বলেছিল এবং এও বলেছিল ওঁর স্ত্রী আছেন—

কি মিঃ দত্ত মজুমদার, কথাটা কি সত্যি?

হ্যাঁ  ছিল, বাট শি ইজ ডেড। অনেক দিন আগেই মারা গিয়েছে মনে হয়।

কথাটা ঠিক বুঝলাম না–কিরীটী বলল।

মানে অনেক বছর সে নিরুদিষ্টা হঠাৎ প্রায় চার বছর আগে আমাকে ছেড়ে সে চলে যায়, তারপর থেকে তার অনেক সন্ধান করেছি আমি কিন্তু কোন সন্ধান তার পাইনি।

আচ্ছা তাঁকে আপনি কবে বিবাহ করেছিলেন?

লন্ডন থেকে ফিরে এসে চাকরিতে ঢোকার পর।

ঐ সময় সরিৎশেখর বললে, ওঁর পূর্বতন স্ত্রী, যাকে উনি লন্ডন থেকে ফিরে এসে বিবাহ করেছিলেন বলছেন, সেই মহিলা অর্থাৎ মুকুল রায়কে উনি আদপে বিবাহই করেননি—উনি মিথ্যা বলছেন!

চকিতে সলিল দত্ত মজুমদার সরিৎশেখরের মুখের দিকে তাকাল এবং বলল, নিশ্চয় আপনার প্রেমিকা অনুরাধা আপনাকে বলেছে কথাটা?

যে-ই বলে থাকুক, কথাটা সত্যি কিনা?

না, সত্য নয়।

জীমূতবাহন রায়কে আপনি চেনেন–না তাঁকেও চেনেন না? সরিৎশেখর আবার প্রশ্ন করেন।

কে জীমূতবাহন রায়?

মুকুল রায়ের দাদা, এককালে যার সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা ছিল।

জীমূতবাহন বলেও কাউকে আমি চিনি না।

অথচ ঐ জীমূতবাহনসরিৎশেখর বললে, একদিন ওঁর অফিসে ওঁকে threaten করে গিয়েছিলেন-অনুরাধাই কথাটা আমাকে কাল বলেছিল।

শি ওয়াজ এ র্যাম্পস্বৈরিণী! চাপা ক্রুদ্ধস্বরে সলিল দত্ত মজুমদার বললে।

কিরীটী ওদের তর্ক-বিতর্ক শুনছিল, এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি। এবার বললে, ডঃ সেন, আপনিও পুলিশের এনকোয়ারি-পর্ব সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এই হোটেল ছেড়ে কোথাও যাবেন না।

কিন্তু আমি যে আজই চলে যাব। সরিৎশেখর বললে।

সাহু বললেন, আপনি যেতে পারবেন না!

কেন, আমাকে কি হত্যাকারী বলে সন্দেহ করছেন? সরিৎশেখর বললে।

কিরীটী বললে, ঘটনা পরিস্থিতি এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে কেউই আপনারা সম্ভাব্য সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছেন না। আপনি ও মিঃ দত্ত মজুমদার তো বটেই, ১৫নং ঘরে যিনি আছেন তিনিও না।

ভবেশবাবু বললেন, হয়ে গেল। আমার হোটেলই এবার উঠে গেল।

কিরীটী বললে, আপনি এ ঘরের ড়ুপলিকেট চাবিটা এনেছেন ভবেশবাবু?

না। একটা ছোট্ট ঢোক গিলে হতাশার ভঙ্গিতে ভবেশ অধিকারী বললেন, চাবিটা কি-বোর্ডে নেই রায়মশাই।

নেই মানে কি?

খুঁজে পেলাম না। ভবেশ শুকনো গলায় বললেন, চাবিটা কাল সকালেও কি-বোর্ডে ছিল কিন্তু দেখতে পেলাম না–

তবে চাবিটা গেল কোথায়? চাকরবাকরদের জিজ্ঞাসা করেছেন?

না।

কিরীটী বললে, মিঃ সাহু, চলুন পাশের ঘরের ভদ্রলোকটির সঙ্গে কথা বলা যাক। ডঃ সেন, আপনি আপনার ঘরে যান।

প্রথমে সাহু ও তার পশ্চাতে কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে এল। সরিৎশেখর ও সলিল দত্ত মজুমদারও পিছনে পিছনে এল, সকলের পশ্চাতে ভবেশ অধিকারী। বাইরে আকাশ তখনও মেঘে কালো। থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, তবে হাওয়াটা কিছুটা স্তিমিত। সূর্যের মুখ মেঘের আড়ালে চাপা পড়ে আছে।