০৬.
অনুরাধা খোলা জানলাটার সামনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল।
কালো মেঘ ক্রমশ আকাশে স্থূপীকৃত ও ঘনীভূত হচ্ছে, মনে হয় এবারে হয়তো বৃষ্টি নামবে। একটা ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ভাবও পাওয়া যাচ্ছিল সমুদ্রের বাতাসে।
একটা বিশ্রী তিক্ততায় অনুরাধার মনটা যেন ভরে গিয়েছে। একটা কথাই তার কেবলই মনে হচ্ছিল, এখানে এই মানুষটার সঙ্গে এক মুহূর্ত আর নয়, এখুনি এই মুহূর্তে চলে যেতে পারলে যেন ভাল হয়।
সলিল দত্ত মজুমদার এসে ঘরে ঢুকল। অনু—
গলার স্বর তার সম্পূর্ণ পালটে গয়েছে, এ যেন সে মানুষ নয়। সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ। সলিল আরও একটু কাছে এগিয়ে এল অনুরাধার-I am really sorry অনু, আমাকে ক্ষমা কর।
অনুরাধা চেয়ে আছে নিঃশব্দে তখনও জানালা-পথে বাইরের দিকে। একেবারে যেন বোবা অনুরাধা। ফিরেও তাকাল না সলিলের দিকে!
হঠাৎ যেন কেমন রাগ চড়ে গেল অনু, কতকগুলো কটু কথা—
অনুরাধা পূর্ববৎ নীরব। জানলা-পথে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে।
আমাকে ক্ষমা কর অনুরাধা, ক্ষমা চাইছি, তোমায় কথা দিচ্ছি আর এমনটি কখনও হবে না। তাকাও, please, আমার দিকে তাকাও।
অনুরাধা তথাপি ফিরে তাকায় না।
তুমি কেন ঐ লোকটার ঘরে গেলে, ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলে—তাইতেই তো হঠাৎ রাগ চড়ে গেল আমার, সলিল দত্ত মজুমদার আবার বললে।
অনুরাধা এতক্ষণে ফিরে তাকাল, বলল, আমি আজকের এক্সপ্রেসেই ফিরে যেতে চাই
আমাদের রিটার্ন টিকিট তো কালকের, আজ ফিরব কেমন করে? তাছাড়া আমার অফিসের একটা জরুরি কাজ আছে, আমি ভুবনেশ্বরে যাচ্ছি। কাল দশটার মধ্যেই ফিরে আসছি, কালই যাব আমরা।
অনুরাধা কোন কথা বলল না।
আমি বেরুচ্ছি, নীচে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে, আর আমার সঙ্গে যদি তুমি ভুবনেশ্বরে যেতে চাও তো–
না, আমি যাব না।
অনুরাধা তখন ভাবছে, অন্তত একটা রাত তাকে ঐ জানোয়ারটার পাশে শুতে হবে না, ওর পশু-কামনাকে চরিতার্থ করতে হবে না তাকে।
তাহলে থাক তুমি, আমি চললাম। সলিল দত্ত মজুমদার বের হয়ে গেল।
জানালা-পথে একটু পরেই অনুরাধা দেখতে পেল ট্যাক্সিটা হোটেলের সামনে থেকে চলে গেল সলিল দত্ত মজুমদারকে নিয়ে।
এতক্ষণে যেন বুকভরে একটা হালকা নিঃশ্বাস নিল অনুরাধা।
১৮নং ঘরে সরিৎশেখর নিঃশব্দে জানালাটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে, কালো মেঘের ছায়া পড়েছে সমুদ্রের বুকে। এবারে বৃষ্টি নামবে-সমস্ত আয়োজন তার শেষ। বিদ্যুৎ চমকাল। এলোমেলো ঠাণ্ডা হাওয়া সনসন করে বয়ে এল ঘরের মধ্যে। মনে পড়ে গেল আবার সরিশেখরের অনুরাধার সেই কথাটা—আজ ২৯শে জুলাই। ২৯শে জুলাই তার পরিচয় অনুরাধার সঙ্গে, দুজন দুজনকে জেনেছিল প্রথম। মনে পড়ে সরিশেখরের সেদিনের সেই ২৯শে জুলাই ছিল মঙ্গলবার। সরিতের এক বন্ধু হিমাংশু, তার গণনার বাতিক ছিল, ওকে একদিন হিমাংশু বলেছিল, মঙ্গলবারটা সব সময় এড়িয়ে যাবি সরিৎ, মঙ্গলে তোর জন্ম, সেদিন ছিল রাহু আর শনি মুখখামুখি, কোন ভাল কাজ ঐ মঙ্গলবারে করবি না, তোর পক্ষে সবচাইতে ভাল রবিবারটা।
হেসেছিল সরিৎশেখর। বলেছিল, বোগাস!
আজ হঠাৎ মনে পড়ছে সেদিনের সেই ২৯শে জুলাই ছিল মঙ্গলবার।
একটা আবছা পর্দা দুলতে দুলতে সাগরের মাথা ছুঁয়ে এগিয়ে আসছে। বৃষ্টি নেমেছে, বৃষ্টির ধারা ছুটে আসছে। একটু আগে সরিৎ দেখেছে সলিল দত্ত মজুমদার একটা গাড়িতে চেপে বের হয়ে গেল।
অনুরাধা ভাবছিল, এই শেষ। সলিল দত্ত মজুমদারের সঙ্গে তার সমস্ত সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ছাড়বে কি সলিল দত্ত তাকে? যেতে কি দেবে তাকে? অনুরাধা জানে, দেবে না সলিল—অত সহজে সলিল তাকে মুক্তি দেবে না। সে তার হিংস্র নিষ্ঠুর থাবা দিয়ে অনুরাধাকে তার কাছে রাখবার চেষ্টা করবে। ঐ মানুষটার সঙ্গে তার রাতের পর রাতের স্মৃতিসেই কামনাসিক্ত হিংস্র একটা জানোয়ারের মত রাতের পর রাত তার দেহটাকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। যন্ত্রণায় সে কুঁকড়ে কুঁকড়ে উঠেছে। একটির পর একটি রাত গিয়েছে আর মনে মনে মুক্তির জন্য হাঁসফাঁস করেছে সে। একটা কথা মনে পড়ল হঠাৎ অনুরাধার। কটক স্টেশন থেকে একটা ছুরি কিনেছে সে। সুদৃশ্য হরিণের সিংয়ের বাঁট আর ইস্পাতের ফলাটা চকচক করছে, সুটকেসেই আছে ছুরিটি। সুটকেসটা খুলে অনুরাধা ছুরিটা বের করল। ছুরিটা হাতে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। সলিল যদি আবার তার কাছে আসতে চেষ্টা করে, জোর-জার করে, এই ছুরিটা,সমূলে সে বসিয়ে দেবে তার বুকে না হয় পেটে।
টক্ টক্ টক্। দরজার কবাটে মৃদু আঘাত একবার দুবার–তিনবার।
কে? অনুরাধা প্রশ্ন করল।
অনুরাধা-আমি সরিৎ–
অনুরাধা দরজাটা খুলে দিল। হুহু করে একঝলক বৃষ্টিভেজা ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরের মধ্যে ছুটে এল। ঘরের মধ্যে ঝাপসা ঝাপসা আলো।
অনুরাধা—
এই যে আমি, এসো-অনুরাধা সরিতের দিকে এগিয়ে গেল।
এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে দত্ত মজুমদার কোথায় গেলেন?
ভুবনেশ্বরে—
সেখানে কি?
বলে গেল তার অফিসের জরুরি কাজ আছে। মরুকগে সে, জান সরিৎ, একটু আগে তোমার কথাই ভাবছিলাম।
আমার কথা?
হ্যাঁ। বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি আমার কথাটা। সরিৎ, তুমি কি সত্যি সত্যিই আমাকে ভুলে গিয়েছ? মন থেকে তোমার একেবারে মুছে ফেলেছ?
তাই তো স্বাভাবিক অনুরাধা।
স্বাভাবিক, তাই না! আমি তো তোমাকে কই আজও ভুলতে পারিনি।
ঘরের মধ্যে ঝাপসা অন্ধকারটা আরও ঘন হয়েছে। বাইরের অন্ধকার যেন ঘরের মধ্যে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
শুনবে আমার সব কথা? অনুরাধা বললে।
শুনে কি লাভ।
তবু বোধ হয় সব কথা তোমার জানা দরকার সরিৎ–
সরিৎশেখর কোন জবাব দিল না।
অনুরাধা বলে গেল তার কথা। একটু একটু করে থেমে থেমে।
সরিৎশেখর একেবারে নির্বাক বোবা।
আমাকে আমাকে তুমি মুক্তি দিতে পার না?
কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছ তুমি সলিল দত্ত মজুমদারের বিবাহিতা স্ত্রী।
ও বিবাহ তো মিথ্যা, একটা প্রতারণা।
তাই যদি মনে কর তো মুক্তি তো তোমার নিজের ইচ্ছাতে।
না, তোমার হাতে সরিৎ। তোমার হাতে। আমাকে তুমি নিয়ে চল সরিৎ দূরে, অনেক দূরে কোথাও!
আজ আর তা হয় না অনু!
আবার তোমার সেই ভয়—সেদিন যে ভয় তোমার আমাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি, আজও সেই ভয়? কেন—কেন সেদিন তুমি জোর করে আমাকে ধরে রাখলে না? কেন বলতে পারলে– না, না, তোমাকে আমি যেতে দেব না। তবে তো এই আকণ্ঠ গ্লানির মধ্যে আমাকে ড়ুবে যেতে হত না।–
অনুরাধার গলার স্বরটা যেন কেমন হয়ে এল। সরিতের মনে হল, অনুরাধা যেন কাঁদছে।
হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনুরাধা ছুটে এসে সরিশেখরের বুকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল, দুহাতে প্রাণপণ শক্তিতে আঁকড়ে ধরল।
ঝড়বৃষ্টি থামেনি। থেকে থেকে সোনালী একটা চাবুকের মত অন্ধকার আকাশটা চিরে দিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ, প্রবলধারায় বৃষ্টি, সোঁ সোঁ হাওয়ার গর্জন।
রাত কত হল কে জানে!
ইতিমধ্যে কিরীটী তার ঘরে বসেই কিছু খেয়ে নিয়েছে।
হাতঘড়িটার দিকে তাকাল কিরীটী। রাত দশটা পনেরো।
বোঝবার উপায় নেই এত রাত হয়ে গিয়েছে, জানলার কপাটগুলো থর থর করে কাঁপছে হাওয়ার ঝাপটায়। কি খেয়াল হল কিরীটীর, সমুদ্রের দিকের জানলাটা একবার খুলল। একটা বিদ্যুতের ঝলসানো আলোর চমক।
আর সেই ক্ষণিকের আলোয় কিরীটীর চোখে পড়ল—একটা মনুষ্যমূর্তি হোটেলে প্রবেশ করল। এই রাত্রে—এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে হোটেল থেকে কে বাইরে গিয়েছিল? নাকি কেউ এল?
কিরীটী তাড়াতাড়ি জানলার কপাট চেপে এঁটে দিল ছিটকিনিটা।