সাবধান! সাপ আছে (১)
‘চোখ বুজে ঘুরে দাঁড়াও, বিশ্বাস,’ অনন্ত কর মিঠে সুরে বললেন, সুতরাং আমি চোখ বুঝলাম, ঘুরে দাঁড়ালাম, অনেকটা ঘুমিয়ে-চলা মানুষের মতো। শুনলাম, অনন্ত কর সিন্দুক খোলার কম্বিনেশান ডায়াল ঘোরাচ্ছেন।
ক্লিক—ক্লিক—ক্লিক—ক্লিক।
ডানদিকে ষোলো ঘর। মনে-মনে হিসেব করলাম।
ক্লিক—ক্লিক—ক্লিক—ক্লিক।
বাঁদিকে এগারো ঘর। শয়তানি হাসি হাসলাম।
ক্লিক—ক্লিক—ক্লিক—ক্লিক।
‘ডানদিকে ছাব্বিশ,’ জোরে বলে উঠলাম আমি। কিন্তু সৌভাগ্যবশত অনন্ত কর কানে কম শোনেন।
‘ঠিক আছে, বিশ্বাস,’ বললেন অনন্ত কর, ‘এবার ফিরে দাঁড়াতে পারো’।
ফিরে দাঁড়ালাম। লুব্ধ চোখে দেখলাম দশ আর একশোর নোটের বান্ডিলগুলো: দু-লক্ষ চল্লিশহাজার টাকা। আমার শোওয়ার ঘরের তাকে রাখা তাসের প্যাকেটের মতো সুবোধ শিশু হয়ে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে বান্ডিলগুলো।
অনন্ত কর আরও একটা একশোর বান্ডিল সযত্নে আগেরগুলোর সঙ্গে যোগ করলেন।
দু-লাখ পঞ্চাশ হাজার।
জলতরঙ্গের শব্দ করে সিন্দুকের ভারি দরজাটা বন্ধ করলেন তিনি।
‘আজকের মতো কাজ শেষ,’ অনন্ত বললেন, ‘সাড়ে পাঁচটা বাজে। তুমি এবার যেতে পারো। আমাকে আরও ঘণ্টাখানেক কাজ করতে হবে।’
‘আচ্ছা, স্যার,’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৃষ্ণার্ত চোখে তাকালাম সিন্দুকটার দিকে—যেন একটা কালো কোলাব্যাঙ বসে আছে। আর অনন্ত কর—তিনিও কোলাব্যাঙ, তবে সাদা—সোজা হয়ে দাঁড়ালেন নিজের পায়ে। লোকটা সত্যিই দয়ালু, যাকে দেখলে আমার ঠাকুরদার কথা মনে পড়ে যায়। তা না হলে হয়তো সেই মুহূর্তেই তাঁর দয়ালু মস্তকে এক ঘা বসিয়ে, সিন্দুকের ডায়াল নম্বর অনুযায়ী (আমার জন্মতারিখের চেয়েও যেটা আমার বেশি মুখস্থ) ঘুরিয়ে নোটের বান্ডিলগুলো আমার টেবিলের ড্রয়ারে লুকোনো পলিথিনের ব্যাগে ভরে (দীর্ঘ কয়েকবছরের চাকরি-জীবনে তেতাল্লিশটা ব্যাগ আমি জমিয়ে ফেলেছি টিফিন নিয়ে আসার অছিলায়—) সোজা রাস্তায় নেমে চম্পট দিতাম। লোকে ভাবত ‘জনৈক নিরপরাধ, নিরীহ, কলিকাতাবাসী কৈকেয়ী-ঘরনির আদেশে ক্রয়-কর্ম সমাপনান্তে স্বগৃহে প্র্যাবর্তন করিতেছেন। অহো, উহার প্রতি আমাদিগের সমবেদনা রহিল।’ সুতরাং কাজ শেষ।
কিন্তু সেটা ছিল আমার প্ল্যান নাম্বার ওয়ান। ‘কর ফাইন্যান্স অ্যান্ড লোন কোম্পানি’তে মাসখানেক কেরানি হিসেবে কাজ করার পর ওই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আমার মন রুখে দাঁড়িয়েছে। এত অবুদ্ধিমানের মতো এ-কাজ করাটা সুবিবেচনার পরিচয় নয়। অনন্ত করের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের টেবিলের দিকে এগোতে-এগোতে পরিকল্পনাটা আরও একবার নাকচ করলাম।
‘কর ফাইন্যান্স অ্যান্ড লোন কোম্পানি’র অফিস বলতে একটা ‘এল’ প্যাটার্নের ঘর, তার ‘সবেধন নীলমণি’ একটিমাত্র দরজা, কোনও জানলা নেই। অনন্ত করের টেবিল এবং সিন্দুকটা ‘এল’-এর ক্ষুদ্রতর বাহুতে অবস্থিত, এবং ‘এল’-আকৃতির জন্যে আমার টেবিল থেকে অদৃশ্যমান। আর ‘এল’-এর দীর্ঘতর বাহুর প্রথম বাসিন্দা মিসেস রাও, আমাদের দু-হাজার বছরের পুরোনো স্টেনোগ্রাফার, এবং দ্বিতীয় বাসিন্দা আমি। কাঠের রেলিং দিয়ে ঘেরা আমার চতুষ্কোণ ‘বাসস্থান’, তারপর দুটি সোফা অতিথিদের জন্যে। অবশেষে—সবশেষে, দরজা। এ ছাড়াও কয়েকটা ফাইলিং ক্যাবিনেট, একটা জল-শীতল যন্ত্র, শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, টেলিফোন, কিবোর্ড ইত্যাদি নিজের-নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। এবং সেই কারণেই অফিসের যে-ষাট-সত্তরটা ম্যাপ আমি এঁকেছি তাতে এগুলোর কোনও ছবি নেই।
এককথায় বাড়িটা যেন চুরি-ডাকাতির সুযোগ-সুবিধের দিকে লক্ষ রেখেই তৈরি করা হয়েছে—অর্থাৎ, শুধু আমার জন্যে। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান, সাহসী, তস্করসম্রাট শ্রীনলিনীরঞ্জন বিশ্বাসের জন্যে। বেআইনি কুকাজের অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন শিল্পী, যার সম্পর্কে সারা পৃথিবী একসুরে বলবে, ‘লোকটা জীবনের যে-কোনও ক্ষেত্রে উন্নতি করতে পারত।’ কিন্তু কেউ জানবে না সে হল কলকাতার অন্যতম স্নেহাষ্পদ বাসিন্দা নলিনীরঞ্জন বিশ্বাস।
এ পর্যন্ত আমি শুধু ম্যাপ এঁকে এবং তেতাল্লিশটা ব্যাগ জোগাড় করেই ক্ষান্ত হয়েছি। আর শ্রবণেন্দ্রিয়ের প্রয়োগে সিন্দুকের কম্বিনেশান নম্বরটাও জেনেছি (একবার, আমার কানের হিসেব নির্ভুল কি না পরীক্ষা করতে, আমি চোখ খুলে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম। তখন স্পষ্টই অনন্ত করকে কম্বিনেশান ঘোরাতে দেখেছি। বলাই বাহুল্য আমার চক্ষু এবং কর্ণের বিবাদভঞ্জন হয়েছে)। অনন্ত করই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই কম্বিনেশান নম্বর জানেন। সুতরাং, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলাম, সিন্দুক লুঠ হওয়ার পর তিনি যেন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেন।
অনেক ভাবনাচিন্তার পর কতকগুলো পন্থা আমাকে বর্জন করতে হয়েছে। যেমন, অনন্ত করকে খুন অথবা আঘাত করতে আমি পারব না। তার প্রধান কারণ, আমার মানবিকতা বোধ এবং দয়া এখনও শেষ হয়ে যায়নি। আর দ্বিতীয়ত, বুদ্ধিমান এবং সাহসী হলেও অনন্ত করকে খুন, অথবা খুনের কাছাকাছি কিছু না-করে কীভাবে তাঁর উপস্থিতিতে সিন্দুক খালি করব তা আমি ভেবে পাইনি। ফলে শাস্তি এড়ানোর আশা তখন হয়ে পড়বে দুরাশা। অবশ্য এমন একটা ওষুধ আছে যেটা রক্তের সঙ্গে মিশিয়ে দিলে চিরকালের মতো স্মৃতিভ্রংশ দেখা দেয়। বাথরুমে বসে সেই ওষুধ নিয়ে কত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। কিন্তু সেই সব ধারাবাহিক পরীক্ষার শেষ রিপোর্ট অনুযায়ী ওষুধটার ওপর তেমন ভরসা করা যায় না। আমার কুকুর জিমিকে সেই ওষুধ খানিকটা ইনজেক্ট করে দিয়েছিলাম। ফলে মাত্র ঘণ্টাকয়েক বেচারা লেজ নাড়তে পারেনি। সুতরাং পাকানো বুড়ো করের ওপর সেই ওষুধের প্রভাব (আদৌ যদি কিছু হয়) সহজেই অনুমেয়। অতএব টাকা লুঠ করতে হবে সম্পূর্ণ গোপনে, লোকচক্ষুর আড়ালে। একবার যদি অফিস-বাড়িতে একা ঢুকতে পারি, তা হলে সিন্দুক খুলে টাকাগুলো পলিথিনের ব্যাগে ভরে নেওয়া একমিনিটের কাজ। অবশ্য এখনও অফিস লুকিয়ে বসে থাকা যায়, কিন্তু তাতে—।
‘যাওয়ার সময় দরজাটা বন্ধ করতে ভুলো না,’ অনন্ত ডেকে বললেন।
—অফিস থেকে আর বেরোতে পারব না, কারণ অফিসের দরজাটা ইস্পাতের তৈরি, এমনি বন্ধ করলেই সেটায় তালা লেগে যায়, আর সে-তালার একমাত্র চাবি শুধু করের কাছে।
অবশ্য মোম দিয়ে তালার ছাপ তুলে নকল চাবি বানিয়ে নেওয়া তেমন একটা কঠিন কাজ নয়, কিন্তু তাতে লুকোনো বিপদঘণ্টির তো সুরাহা হবে না। প্রতি রাতে অফিস ছেড়ে বেরোবোর সময় মিস্টার কর বিপদঘণ্টিটা চালু করে দিয়ে যান। এরপর যে-ই অফিসের দরজা খুলুক না কেন ওটা ভয়ঙ্কর শব্দ করে বেজে ওঠে। রোজ সকাল দশটায় অফিসের দরজায় এসে মিস্টার কর তিনপ্রস্ত চাবি দিয়ে বিপদঘণ্টিকে অকেজো করেন—অবশ্য অকেজো হওয়ার আগে ওটা তারস্বরে মিনিটপাঁচেক ধরে চেঁচিয়ে (?) রাস্তার লোক জড়ো করে ফ্যালে।
আমার বাড়ি অফিস থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সুতরাং ঘণ্টির চিল-চিৎকার আমিও শুনতে পাই এবং বুঝতে পারি আবারও আমার অফিসে দেরি হতে চলেছে। ঘণ্টি এভাবে বেজে ওঠার আগে যদি ওটাকে অকেজো করা হয়, তা হলে অফিসের বন্ধ দরজা আর কোনওদিনই খুলবে না।
এই সব ধুরন্ধর মারপ্যাঁচ আমার কাছে, তস্করসম্রাট নলিনী বিশ্বাসের কাছে, এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত গ্রীষ্মটা এই সমস্যা সমাধানের চিন্তাতেই কেটে গেছে। কিন্তু এখন, প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময়, ঝরাপাতা বৃষ্টি মনে করিয়ে দেয় বয়ে যাওয়া সময়ের কথা।
মিস্টার করের কাছ থেকে হতাশ মনে বিদায় নিয়ে দরজা বন্ধ করে অফিস থেকে বেরোলাম। শুনতে পেলাম দরজা লক হয়ে যাওয়ার ‘ক্লিক শব্দ। নেমে এলাম রাস্তায়। জনতার ভিড়ে আমি তখন এক অতি-সাধারণ নাগরিক।
অফিস-বাড়ির (লোহা ও কংক্রিট) এক প্রান্তে চিঠি ফেলার গর্ত (সিমেন্টে বসানো ইস্পাতের বাক্স)। গর্তটা ছ’ইঞ্চি চওড়া, মাটি থেকে সাড়ে তিন ফুট ওপরে। সুতরাং একচোখে উঁকি মারার পক্ষে উপযুক্ত। বহু অন্ধকার রাতে একচোখে অন্ধকার অফিসে উঁকি মেরে নানানরকম মতলব ভেঁজে সময় নষ্ট করেছি—লাভ হয়নি। এখন গর্তের লোহার ঢাকনাটা তুলে আর-একবার উঁকি মারলাম শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ অপরাধের অকুস্থলে। অনন্ত করের টেবিলের আলোয় অফিসটা হালকাভাবে আলোকিত। চুরির পরদিন সকালে পুলিশ এবং সন্ত্রাসিত জনতা যেভাবে বিস্ময় অধ্যুষিত চোখে ঘরটা দেখবে, সেভাবে এখন ওটা দেখতে চেষ্টা করলাম; কোনও ড্রয়ারের হাতলে আঙুলের ছাপ পর্যন্ত নেই, একটা আলপিন পর্যন্ত এদিক-ওদিক হয়নি। কীভাবে কোনওরকম সাক্ষর না-রেখে তস্করচূড়ামণি ভেতরে ঢুকেছে এবং বেরিয়ে এসেছে, সে-কথা ভেবে ওরা কূল পাবে না। অবশ্য এখন, আমার অবস্থাও ওদেরই মতো।
ঢাকনাটা আস্তে নামিয়ে রেখে পা চালালাম। আমার বাতিল করা দু-নম্বর প্ল্যান ছিল অফিস-বাড়ি থেকে বেরোনোর জন্যে কোনও দুঁদে চোরের সাহায্য নেওয়া—যদিও তাতে নিজের তরফে ভয়ের ব্যাপার কিছুটা ছিল। প্ল্যানের বুদ্ধি জুগিয়েছি বলে লুঠের সিংহভাগ আমারই নেওয়া উচিত—হয়তো তাই নেব। কিন্তু ভয়ের ব্যাপার কিংবা গণ্ডগোলটা সেই নির্বোধ দুঁদে চোরকে নিয়ে। এমনও হতে পারে, সে হয়তো অন্য কোনও স্থূলবুদ্ধির কাজে ফেঁসে গিয়ে ধরা পড়ল, আর চট করে পুলিশে আমার নামটা বলে দিল; এ ছাড়া নিজের ভাগে সন্তুষ্ট না-হলে সে হয়তো আমাকে পরে ব্ল্যাকমেলও করতে পারে; কিংবা পাতি চোর-ছ্যাঁচোড়রা যেরকম বদমাইশ আর অকৃতজ্ঞ হয়, সেরকমটা হলে সে চুরির সময়েই আমাকে খুন করতে পারে।
এ ছাড়া আরও একটা বড় অসুবিধে হচ্ছে দাগি চোরদের সঙ্গে মেলামেশা করলে চট করে পুলিশের নজরে পড়বার ভয় থাকে। আমি সাধারণ চোর-ডাকাতদের থেকে আলাদা।
রাস্তা দিয়ে চলতে-চলতে দেখতে পাই ঝকঝকে লাল জাগুয়ারে আমি বসে আছি। আমার ডানহাতের কবজিতে ওমেগার লেটেস্ট মডেল জ্বলজ্বল করছে। আমার ঘরের দেওয়ালে একশো ওয়াট আউটপুটের স্টিরিও সিস্টেম। মেঝেতে কাশ্মীরি কার্পেট। রেফ্রিজারেটর। টি-ভি। আরও কত কী!
দু-লাখ পঞ্চাশ হাজারে দুনিয়া কেনা যায়।
তখন এই অকিঞ্চিতকর নলিনী বিশ্বাস টেরিউলের স্যুট পরে সকিঞ্চিতকর নলিনী বিশ্বাস হয়ে যাবে। নারীজাতির প্রতি তার এতদিনকার অবহেলাজনিত দোষ সে সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠবে। এবং তাদের সীমাহীন প্রশ্রয় দেবে বলে সেই মুহূর্ত থেকেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে নিজের কাছে। জেগে উঠবে নলিনীরঞ্জন রমণীমোহন বিশ্বাস।
লুঠের অবশিষ্ট যাবে বিভিন্ন অর্থকরী উদ্যোগের বিনিয়োগ ও লগ্নী হিসেবে। এভাবে আমার টাকা কয়েকবছরেই ফুলে-ফেঁপে উঠবে। হয়তো কুড়ি বছর পরে বিবেকের দংশন থেকে মুক্তি পেতে দু-লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা গুনে-গুনে আমি ফেরত পাঠাব অনন্ত করকে। সঙ্গে থাকবে রহস্যময় এক চিঠি। অথবা আমার মনের দয়ালু অংশটাকে প্রশ্রয় দিয়ে আমি তৈরি করে দেব অবৈতনিক স্কুল, হাসপাতাল, কিংবা বিশ্বাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড লোন কোম্পানি।
এসব ভাবনায় কোনও ফাঁক নেই, শুধু একটা জিনিস ছাড়া: যদি কোনও মতলব মাথা থেকে বের করতে হয় তবে তা আজ রাতেই করতে হবে। কারণ, আজ শুক্রবার। কাল সেকেন্ড স্যাটারডে। অতএব শনি-রবি কোম্পানি বন্ধ। আর সোমবার থেকেই শুরু হবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অর্থ লগ্নীর ধারাবাহিক কর্মসূচি। অর্থাৎ, সেদিন থেকে আমার রেফ্রিজারেটর, টি-ভি, স্টিরিও ইত্যাদির টাকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিতরণ করা হবে রাজ্যের অভাবী ব্যবসায়ীদের।
সুতরাং এই আড়াই লাখ নিয়ে উধাও হওয়ার আজই শেষ সুযোগ। মিস্টার কর এখনও ঘণ্টাখানেক অফিসে থাকবেন, এবং তারপর অল্পসময়ের জন্যে হলেও অফিস-বাড়িটাকে দখলে পাওয়া যাবে। বুদ্ধির মারপ্যাঁচ দিয়ে একবার শেষ চেষ্টা না-করে এ-সুযোগ আমি ছাড়ছি না।
সুতরাং পায়চারি করতে-করতে ঢুকে পড়লাম ‘বুক কর্নার’ দোকানটায়।
দোকানের মালিক মোহন সরকার।
রহস্য-গোয়েন্দাকাহিনির নেশা আমার বহুকালের। এবং সেই সূত্রেই মোহন সরকারের দোকানে আমার যাতায়াত এবং ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব। বই কিনি আর না কিনি, ঘেঁটে দেখতে আমার ভালো লাগে। আর সেই সুযোগে সন্ধান করি নতুন কোনও রহস্য গল্পের, যেটাকে বাস্তব চেহারা দেওয়া যায়। অর্থাৎ কেতাবী অপরাধে আমার বিরাট আস্থা আছে।
মোহনের বইয়ের দোকানে ঢুকে ম্যাগাজিনের র্যাকের কাছে এগিয়ে গেলাম। মোহন কয়েকটা অল্পবয়েসি মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিল—সম্ভবত বই কেনা-বেচার ব্যাপারেই। আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে হাসল। আমি নতুন রহস্য-গোয়েন্দাজাতীয় পত্রিকাগুলোর ওপর চোখ বোলাতে লাগলাম।
একটু পরে মোহন আমার পাশে এসে দাঁড়াল।
‘কী দেখছিস?’
আমি ঠোঁট উলটে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ‘এই, কিছু না—’ গোছের একটা ভঙ্গি করলাম। তারপর ওকে বললাম, ‘একগ্লাস জল খাওয়া তো—।’
একটু পরেই ও একগ্লাস জল নিয়ে এল। বলল, ‘কিনবি-টিনবি না, ফালতু ঘাঁটাঘাঁটি করিস না। বই লাট হয়ে গেলে খদ্দের নিতে চায় না।’
‘আরে গর্দভ, ম্যাগাজিন লাট না-হলে মানায় না।’ হেসে ওকে বললাম।
‘এগুলো লাট হলে তোকে লাট করে দেব।’
এমন সময় দোকানে জনৈক প্রৌঢ় খদ্দের আসতেই মোহন ‘আসছি’ বলে চলে গেল সেদিকে।
আমার প্রথম দিককার পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে একটা ছিল মোহনের দোকানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া। অনন্ত করের অফিস থেকে ‘বুক কর্নার’ বেশি দূরে নয়। অতএব, ক্ষীণ আশা ছিল যে, চিৎকার শুনে মিস্টার কর অন্তত দু-এক আঁজলা জল নিয়ে মোহনের দোকানে ছুটে আসবেন। এবং এই তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে অফিসের দরজা তিনি হাট করে খুলে রেখে আসবেন। তারপর…। কিন্তু এ-মতলবটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হয়েছে একটা কারণে: মিস্টার কর কানে শুনতে পান না, অতএব আগুন লাগার চিৎকার-চেঁচামেচি তাঁর কানেই ঢুকবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে মোহনের প্রতি ঈর্ষায় সে-মতলবটাকে কাজে লাগাতে ইচ্ছে হল। ওর ল্যামিনেটেড প্লাস্টিক লাগানো নতুন কাউন্টারকে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে দেখলে আমার ভালোই লাগবে। সত্যি, অঢেল পয়সার অভাব শরীরে বড় কাঁটা দেয়! ভাবতে-ভাবতে তেষ্টা পেল। হাতের গ্লাস তুলে মোহনের দেওয়া জলে চুমুক দিলাম। তারপর আচ্ছন্নের মতো কাকিয়ে রইলাম কাচের গ্লাসটার দিকে।
জল, মনে-মনে ভাবলাম। যদি একবার অফিসের নর্দমাগুলো বন্ধ করে জলের কলগুলো সব খুলে দেওয়া যায়? কালা হোক বা না হোক, ব্যাপারটা অনন্ত করের নজরে পড়বেই। তারপরই তিনি দৌড়বেন কলগুলো বন্ধ করতে। কিন্তু কলের ওয়াশারগুলো আগেই আমাকে কেটে রাখতে হবে। তা হলে কর অফিসের বাইরে ছুটে যাবেন সাহায্যের আশায়। তাড়াহুড়োতে যদি তিনি দরজা খোলা রেখে যান তা হলে তো কথাই নেই। আর দরজা বন্ধ করে গেলেও ওই হই-হট্টগোলে, লোকজনের ভিড়ে, আমি ঠিক কাজ হাসিল করে নেব। কিন্তু অফিসের চার-চারটে কল নিয়ে লটঘট করা, নর্দমা বন্ধ করা, এসব অত্যন্ত ঝামেলার কাজ। সুতরাং আনরিয়্যালাইজেবল।
মোহন সরকারের দেওয়াল-ঘড়ির টিক-টিক শব্দে আচ্ছন্নতা কাটল। ছ’টা বাজতে কুড়ি মিনিট। হাতে আর পঞ্চাশ মিনিট। বড় কম সময়।
আরও কুড়ি মিনিট পরে, ঘড়িতে যখন ছ’টা বাজল, তখন আমার দু-দুটো নতুন পরিকল্পনা বাতিল করা হয়ে গেছে। প্রথম, ওপরতলার টি-ভি কোম্পানির মেঝে খুঁড়ে করের অফিসে নেমে আসা। আর দ্বিতীয়টা, অফিস-বাড়ির ছাদ থেকে সটান গর্ত খুঁড়ে-খুঁড়ে করের অফিসে হাজির হওয়া। তা হলে কোনও চাবি-টাবির আর দরকার নেই।
মোহনের দিকে ফিরে তাকালাম। ও কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে কী একটা বই দেখছে।
‘মোহন, তোকে দরজা-জানলা বন্ধ একটা ঘরে বন্দি করে রাখলে কী করে বেরোবি?’ বুঝতে পারলাম, নেহাতই সময় কাটাচ্ছি।
‘বেরোব না।’ বই থেকে চোখ না-তুলেই মোহন জবাব দিল।
অতএব বেরোতে আমিও পারব না।
আরও একটা মূল্যবান মিনিট নষ্ট হল। একইসঙ্গে চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে যেতে লাগল চকচকে লাল জাগুয়ার, ওমেগার লেটেস্ট মডেল, একশো ওয়াট আউটপুটের স্টিরিও-সিস্টেম, কাশ্মীরি কার্পেট, রেফ্রিজারেটর, টি-ভি…স্পষ্ট দেখলাম, লাস্যময়ী ললনার দল আমাকে হাত নেড়ে বিদায় নিচ্ছে। উঠছে গিয়ে মোহন সরকারের গাড়িতে।
ওহে বিশ্বাসবাবু, তুমি বুদ্ধিমান, তস্করকুলশিরোমণি হতে পারো, কিন্তু স্বীকার করে নাও, বুড়ো অনন্ত করের কাছে তুমি হেরে গেছ।
স্বীকার করে নিয়েই আনমনাভাবে হাত বাড়ালাম ম্যাগাজিন র্যাকের দিকে। তুলে নিলাম নতুন এক কপি ‘মাসিক ক্রিমিনাল’। পাতা উলটেই যে-লেখাটা বেরোল সেটাই পড়তে শুরু করলাম:
বন্ধ ঘরের রহস্য
চিন্তাহরণ চাকলাদার
লালবাজারে ডি. সি. সমীর চক্রবর্তী চুপচাপ চেয়ারে বসেছিলেন। মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে। চোখে-মুখে চিন্তার ছায়া। তিনি ভাবছেন ইন্সপেক্টর যুধাজিৎ সেনের কথা। এমন সময় ঘুরে ঢুকলেন লালবাজারের সেই বিখ্যাত প্রতিভাধর অফিসার যুধাজিৎ সেন। নিজের কর্মদক্ষতার জন্য ডি. সি.-র কাছে তিনি অত্যন্ত প্রিয়। তাঁকে ঢুকতে দেখেই ডি. সি. বললেন, ‘বোসো, সেন। তোমার কথাই ভাবছিলাম। কী অদ্ভুত যোগাযোগ বলো!’ একটা সিগারেট ধরালেন তিনি। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘গত রাতে যশবীর মেহেরা নামে এক কোটিপতির ঘরে প্রায় দু-লাখ টাকা দামের একটা নেকলেস চুরি গেছে। মেহেরার বাড়ি সাদার্ন অ্যাভিনিউ। এই নাও তাঁর বাড়ির ঠিকানা।’ সেনের দিকে একটা চিরকুট এগিয়ে দিলেন তিনি, ‘এ-কাজে চৌধুরী আর বোস তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করবে।’
এইবার হাসলেন যুধাজিৎ সেন। বললেন, ‘আমি ঠিক এটাই আশা করছিলাম, স্যার।’ চেয়ারে আর-একটু আরাম করে বসলেন। চোখের সানগ্লাসটা খুলে রাখলেন টেবিলের ওপরে। ডি. সি.-র স্নেহ ও প্রশ্রয়ে যুধাজিৎ সেন যেন তাঁর বন্ধু হয়ে গেছেন। চোখ নাচিয়ে তিনি বললেন, ‘কিন্তু আপনাকে আমি এ-কথাই বলতে এসেছি যে, ঠিক দশমিনিট আগে আমি মেহেরা নেকলেস কেস সলভ করে ফেলেছি। নেকলেসটা এখন পুলিশ হেফাজতে। কেস মিটলেই মিসেস মেহেরা ওটা ফেরত পেয়ে যাবেন। আর নেকলেস-চোর এখন লক-আপে বিচারের অপেক্ষায়।’
‘আশ্চর্য!’ অবাক বিস্ময়ে বললেন সমীর চক্রবর্তী, ‘কী করে ধরলে চোরকে?’
‘বলছি।’ সুবিখ্যাত গোয়েন্দাপ্রবরের চোখে ঝিলিক মারল খুশি। পকেট থেকে পাঁচশো পঞ্চান্নর একটা প্যাকেট বের করে টেবিলে রাখলেন তিনি। আনুষ্ঠানিকভাবে একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘কেসটা বড় অদ্ভুত, আর একইসঙ্গে বড্ড কমপ্লিকেটেড’। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, কী বিচিত্র ঘটনাচক্রেই না চোরকে আমি গ্রেপ্তার করেছি। তখন আমি জানিই না মেহেরাদের নেকলেস চুরি গেছে। গতকাল রাত দশটা নাগাদ আমি বাড়িতেই ছিলাম। সোফায় আরাম করে বসে একটা ডিটেকটিভ বই পড়ছিলাম। হঠাৎই শুনতে পেলাম দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি বেঁটেখাটো রোগা চেহারার একজন যুবক সেখানে দাঁড়িয়ে। প্রথমে সে বিরক্ত করার জন্যে কাঁচুমাচু হয়ে ক্ষমা চাইল, তারপর জানাল যে, তার গাড়িটা আমার বাড়ির সামনে হঠাৎই বিগড়ে গেছে। কাছাকাছি কোনও মোটর গ্যারেজ নেই। আর এত রাতে লোকজনের সাহায্য পাওয়াও মুশকিল। সুতরাং আমি যদি আমার ফোনটা ব্যবহারের অনুমতি দিই তা হলে সে বাড়িতে ফোন করে একটা খবর দিতে পারে।
‘প্রথমটায় আমি তাকে ঠিক চিনে উঠতে পারিনি, কিন্তু তার অতিরিক্ত শৌখিন ভদ্র ব্যবহার আমার মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুলল। ফোন করা হয়ে গেলে আমি তাকে এগিয়ে দিলাম গাড়ি পর্যন্ত। আর তখনই মেহেরার নেকলেসটা আমার নজরে পড়ল—ওটা গাড়ির পেছনের সিটে নিরীহভাবে পড়ে ছিল। তখন নেকলেসটার ঠিকুজি-কুষ্ঠি না-জানলেও এটুকু বুঝেছিলাম, ওটার দাম কম করেও আকাশছোঁয়া। সুতরাং লোকটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে চেপে ধরলাম এবং খুব সহজেই সে সবকিছু স্বীকার করে বসল। তার নাম প্রশান্ত সরখেল। অসমসাহসী এবং বুদ্ধিমান সিন্দুক-ভাঙিয়ে হিসেবে নীচু মহলে তার নাম-ডাক আছে। গত কয়েকবছরে গোটা ভারত জুড়ে যেসব ”আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব” চুরি-ডাকাতি হয়েছে, সেসব তারই কীর্তি। তাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে সমস্ত রাজ্যের পুলিশ।’
‘একেই বলে ঘটনাচক্র!’ সিগারেটটা টেবিলের ওপরে রাখা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে ডি. সি. বললেন, ‘তোমার তারিফ করতে হয়।’
দারুণ, মনে-মনে বলে উঠলাম। তারপর পাতা ওলটালাম।
যুধাজিৎ সেন সামান্য হেসে মাথা ঝোঁকালেন। তারপর আবার শুরু করলেন, ‘ঘটনাচক্রই বটে। তবে আমার কৌতূহল হচ্ছিল কী করে সরখেল এই অসম্ভব কাজ হাসিল করল। সুতরাং সরখেলের কাছ থেকে মেহেরা ম্যানসনের ঠিকানা নিলাম। নেকসেটা রাখলাম নিজের হেফাজতে। আর ওকে হাত-পা বেঁধে বন্দি করে রাখলাম বাড়িতে। তারপর রওনা হলাম সাদার্ন অ্যাভিনিউর দিকে।
‘রাত তখন এগারোটা। কিন্তু মেহেরা ম্যানসন আলোকসজ্জা আর মণ্ডপসজ্জায় ঝলমল। শুনলাম, মিসেস মেহেরার ছোট ছেলের আজ জন্মদিন। তাই এই উৎসব। বাড়ি অতিথি-অভ্যাগতে ভরপুর। চারপাশে রঙচঙে ব্যস্ত মানুষজনের আনাগোনা। আমি একজন সুন্দরী তরুণীর পথ আটকে জানতে চাইলাম মিস্টার মেহেরাকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে। বিশেষ দরকার। তরুণীটি জানাল, মিস্টার মেহেরা দোতলায় তাঁর স্ত্রী ও ছেলের কাছে আছেন।
‘সুতরাং দোতলায় উঠলাম। কেউই আমাকে বাধা দিল না। উৎসব বাড়িতে কে-ই-বা কার খবর রাখে! যেমনটা হয়েছিল প্রশান্ত সরখেলের বেলায়। দোতলায় পৌঁছে খোঁজাখুঁজি করতে হল না। দেখলাম একটা ঘরের দরজায় নিওন সাইনে লেখা ‘হ্যাপি বার্থডে’ এবং সেই ফুলে আলোয় সাজানো ঘর থেকে পাঁচমিশেলি হইহুল্লোড় ভেসে আসছে। সুতরাং সেই ঘরে ঢুকে পড়লাম।
‘বাচ্চা-মেহেরাকে সাজিয়েগুজিয়ে একটা সুন্দর খাটে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাকে ঘিরে আত্মীয়-পরিজন অতিথিদের সমাবেশ। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই গুঞ্জন নীচু পরদায় নেমে এল। সকলেরই চোখে সপ্রশ্ন দৃষ্টি। আমি নীরবে পকেট থেকে আইডেনটিটি কার্ডটা বের করে তুলে ধরলাম। গম্ভীর গলায় বললাম, অ্যাটেনশান প্লিজ, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন। মিস্টার মেহেরা কোথায়?
‘আমার প্রশ্নে বাচ্চাটার পাশ থেকে বছর চল্লিশের জনৈক ব্যক্তি এগিয়ে এলেন। চোখে চশমা, পুরুষ্টু গোঁফ। আমার সামনে এসে থামলেন তিনি: ইয়েস?
‘আপনার স্ত্রীর একটা দামি নেকলেস চুরি গেছে।’ শান্ত স্বরে বললাম।
‘এ-খবরে সব্বাই নির্ঘাত চমকে গেছে।’ টেবিলে টোকা মারতে-মারতে ডি. সি. চক্রবর্তী বললেন।
‘সে আর বলতে!’ সিগারেটে এক সুদীর্ঘ টান দিয়ে যুধাজিৎ সেন বললেন, ‘নেকলেসটা যে ফিরে পাওয়া গেছে সে-কথা বলে ওঠবার আগেই একজন সুন্দরী মহিলা অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়লেন ঘরের মাঝখানে। সম্ভবত মিসেস মেহেরা। তারপর জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল, ঘণ্টাদুয়েক আগে নেকলেসটা সবাইকে দেখিয়ে মিসেস মেহেরা একতলার ভল্টে রেখে আসেন। এবং সেই ভল্ট পরিদর্শনের জন্যে তিনি অতিথিদের আহ্বান জানান। সঙ্গে-সঙ্গেই আমি অনুমান করলাম, সরখেলও নিমন্ত্রিতদের ছদ্মবেশে সেই ভল্টে সকলের সঙ্গে ঢুকেছিল। অবশ্য এটা নেহাতই সহজ কাজ।’
তারপর কী হল? মনে-মনে প্রশ্ন করে পাতা ওলটালাম।
যুধাজিৎ সেনের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে উৎসুক চোখে তাকালেন ডি.সি.।
লালবাজারের তীক্ষ্নধী অফিসার বলে চললেন, ‘ভল্টের ভেতর একটা সিন্দুকে ছিল নেকলেসটা। তার সঙ্গে অন্যান্য গয়নাও ছিল। ভল্টের একটাই মাত্র দরজা—কোনও জানলা নেই। সেই দরজার চাবি সবসময়েই থাকে মিসেস মেহেরার কাছে। যদিও দরজার নকল চাবি তৈরি করতে অসুবিধে নেই, কিন্তু তাতে উপকার হবে সামান্যই। কারণ, দরজায় লাগানো আছে একটা বিপদঘণ্টি। দরজা খুললেই সেই ঘণ্টি বাজতে শুরু করে। বিপদঘণ্টিটা বন্ধ করা যায় একমাত্র ভল্টের ভেতর থেকে। এবং সেটা করতে গেলেও তিনটে চাবির দরকার। এ ছাড়া, একটুও না-বাজতে যদি সেই ঘণ্টি বন্ধ করা হয়, তা হলে ভল্টের দরজা আর খুলবে না—বাইরে থেকেও না, ভেতর থেকেও না।’
‘এ যে ময়দানবের দুর্গ!’ অবাক হয়ে বললেন চক্রবর্তী।
‘মেহেরা দানবের দুর্গ।’ হেসে বললেন যুধাজিৎ সেন, ‘তবে এ-দুর্গকে হার মানিয়েছে প্রশান্ত সরখেল। আমার অনুমান, অন্য সব অতিথিদের সঙ্গে সে ভল্টে ঢোকে, এবং মিসেস মেহেরার অলক্ষ্যে সিন্দুকের পেছনে লুকিয়ে থাকে। অন্যান্য অতিথিরা ভল্ট ছেড়ে বেরিয়ে যান। সব শেষে যান মিসেস মেহেরা। নেকলেসটা সিন্দুকে বন্ধ করে বিপদঘণ্টি চালু করে তিনি বাইরে থেকে ভল্টের দরজা বন্ধ করে দেন। আমরা জানি প্রশান্ত সরখেল পাকা সিন্দুকবাজ। সুতরাং, সিন্দুক খুলে নেকলেস হাতানো তার কাছে নিতান্তই ছেলেখেলা। কিন্তু ওই বন্ধ ভল্ট থেকে বিপদঘণ্টি না-বাজিয়ে সে বেরোল কেমন করে?’
যুধাজিৎ সেন সিগারেটের শেষ টুকরোটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন। পাঁচশো পঞ্চান্নর প্যাকেটটা রাখলেন পকেটে। তারপর টেবিলে রাখা সানগ্লাসটার গায়ে আঁচড় কাটতে লাগলেন। সানগ্লাসের দিকে নজর স্থির রেখেই তিনি বললেন, ‘কেমন করে সরখেল বেরোল সে-কথা জানার জন্যে আমি মিসেস মেহেরাকে বললাম আমাকে সেই ভল্টে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিতে।’ শান্ত স্বরে কথা শেষ করলেন যুধাজিৎ সেন।
‘সাবাস!’ বললেন ডি. সি., ‘তোমার তুলনা নেই, সেন। কিন্তু তুমি বেরোলে কেমন করে?’
যুধাজিৎ সেন চোখ তুলে তাকালেন। মুখে ধূর্ত হাসি। বললেন, ‘ভেবেই দেখুন না।’
‘দরজা ড্রিল দিয়ে ফুটো করে?’ সমীর চক্রবর্তী প্রশ্ন করলেন।
‘উঁহু। মনে রাখবেন, সরখেল ঠিক যে-কায়দায় ওই ঘর থেকে বেরিয়েছে আমাকেও ওই একই কায়দায় বেরোতে হয়েছে। আর, একটা গোটা ড্রিল সঙ্গে করে লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া ওর পক্ষে কোনও মতেই সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া ভল্টের মধ্যে কোনওরকম খোঁড়াখুঁড়ির চিহ্ন আমার নজরে পড়েনি।’
‘তা হলে নিশ্চয়ই বাইরে থেকে কেউ তোমাকে বেরোতে হেল্প করেছে।’ সমীর চক্রবর্তী তাঁর দ্বিতীয় অনুমান উচ্চারণ করলেন।
‘না।’
‘ফলস দেওয়াল?’
‘উঁহু—।’
‘লুকোনো দরজা?’
‘তাও নয়।’
‘দে বইটা দে।’ হঠাৎ পেছন থেকে মোহনের গলা শুনতে পেলাম—শুনে চমকে উঠলাম।
‘দাঁড়া, আর-একটু—।’
কিন্তু তার আগেই মোহন লোমশ হাত বাড়িয়ে বইটা ছিনিয়ে নিয়েছে আমার কাছ থেকে।
‘যা, কাট। বললাম শালা বইগুলো লাট হয়ে যাবে, তাও—।’
‘এই, মোহন—প্লিজ। শুধু ওই গল্পটা শেষ করতে দে।’
‘হ্যাঁ, শেষ করতে দিই, আর পাতা উলটে দেখবি গল্পটার শেষে ”ক্রমশ” লেখা আছে। ব্যস, তখন যে ক’মাস ওই গল্পটা শেষ না-হবে, সে ক’মাস তুমি আমাকে জ্বালাতে আসবে।’
ভগবানকে ডাকলাম, যেন মোহনের ধারণা ভুল হয়। ‘বন্ধ ঘরের রহস্য’ যেন এই সংখ্যাতেই শেষ হয়। কিন্তু অতীতে মাসিক ‘ক্রিমিনাল’ যে এরকম করেনি তা নয়। যুধাজিৎ সেন ও সমীর চক্রবর্তীকে মাসের পর মাস একই কাহিনি নিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তাঁদের খাওয়া নেই দাওয়া নেই, শুধু সিগারেটের পর সিগারেট উড়িয়ে মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত টেবিলে বসে একটাই রহস্যের সমাধান করে গেছেন। জানি না, অনেক পাঠক হয়তো এই মাসিক উৎকণ্ঠা পছন্দ করেন, কিন্তু আমি করি না। আমি ঝাড়াঝাপটা রহস্য পছন্দ করি। গল্পের রহস্যের কায়দা ও চালাকি মেশানো সমাধান আমার মোটেই ভালো লাগে না।
কিন্তু সে-কথা মোহনকে বোঝানোর প্রয়োজন দেখলাম না। শুধু বললাম, ‘শোন, মোহন, ওই গল্পটা যদি এই সংখ্যাতেই শেষ হয়ে থাকে তা হলে ম্যাগাজিনটা আমি কিনব।’
‘কিনবি? তুই?’ ওর চোখ-মুখে হালকা বিস্ময়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ছ’টা পনেরো।
‘বল। রাজি?’ অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম।
‘ঠিক আছে।’ নিমরাজি হয়ে মোহন বলল, ‘তবে আমি দেখব গল্পটার শেষ আছে কি না। তোর কথায় আমি বিশ্বাস করি না।’
অপমানটা গায়ে না-মেখে বললাম, ‘আয়, দুজনে মিলেই দেখি।’
দেখলাম।
দুজনে একসঙ্গে ঝুঁকে পড়ে পাতা উলটে চললাম।
দু-পাতা পরেই গল্পটা শেষ হয়েছে। (যুধাজিৎ সেনকে তা হলে বেশি কষ্ট করতে হয়নি)। দেখলাম, গল্পের নীচে লম্বা ড্যাশ—অর্থাৎ গল্প শেষ। একইসঙ্গে শেষ দুটো লাইনে চোখ বুলিয়ে নেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।
‘ও, তা হলে এই ব্যাপার,’ বললেন সমীর চক্রবর্তী, ‘সাবাস, সেন! তোমার জবাব নেই!’
মোহন ডানহাতটা আমার দিকে এগিয়ে দিল—দামের জন্যে।
‘এই নে—’পকেট থেকে পুরোপুরি তিনটে টাকা বের করে ওর হাতে দিলাম। বললাম, ‘কমিশন চাই না। বাড়তি পয়সাটা তোর বই লাট করার ফাইন হিসেবে রেখে দে।’
দেওয়াল ঘড়িতে ছ’টা সতেরো।
‘আজকের দিনটা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে।’ হেসে বলল মোহন, ‘কারণ, তুই পুরো দাম দিয়ে আমার দোকান থেকে ম্যাগাজিন কিনেছিস।’
আমি চট করে ম্যাগাজিনটা ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে গেলাম। কিন্তু ও আরও তৎপর। ঝটিতি ওটা লুকিয়ে ফেলল পেছনে। হাসল দাঁত বের করে—অনেকটা বাঁদরের মতো। ডারউইন হাজির থাকলে এই মুহূর্তে মোহন সরকারকে মিসিং লিংক ভেবে তুলে নিয়ে যেতেন।
‘ম্যাগাজিনটা তোর ভীষণ দরকার, নারে?’
‘জানিস তো রহস্য গল্প আমার ভালো লাগে?’
‘তাই নাকি? দেখি তো এই ”বন্ধ ঘরের রহস্য”-তে কী এমন আছে। তোর ইন্টারেস্ট দেখে মনে হচ্ছে এ-গল্পের নায়ক নির্ঘাত ছুঁড়ি নিয়ে ফষ্টিনষ্টি শুরু করে দিয়েছে।’
‘নারে।’ ওকে বললাম, ‘বিষ্ময়কর প্রতিভা যুধাজিৎ সেন শুধু রহস্যই ভালোবাসে, অন্য কিছু নয়।’
তা সত্ত্বেও মোহন গল্পটা উলটেপালটে দেখতে শুরু করল। আমি কাড়াকাড়ির চেষ্টা ছেড়ে র্যাকের দিকে ফিরলাম। পয়সা যখন দিয়েছি, তখন দ্বিতীয় এককপি ‘মাসিক ক্রিমিনাল’ পড়বার অধিকার আমার আছে।
কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই র্যাকে দ্বিতীয় কোনও কপি দেখলাম না। কলকাতায় ‘মাসিক ক্রিমিনাল’-ভক্তদের সংখ্যা অস্বাভাবিক। হয়তো মোহন সরকারের হাতের কপিটাই এ-শহরের শেষ কপি। হয়তো পৃথিবীরও শেষ কপি।
ঘড়িতে ছঁটা কুড়ি।
সুতরাং আবার কাড়াকাড়ি অধ্যায় শুরু করলাম।
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, দিচ্ছি।’ মোহন বলল, ‘তবে তুই যা চাইছিস, ফষ্টিনষ্টি, সেসব এ-গল্পে নেই। দাঁড়া, ম্যাগাজিনটা প্যাক করে দিই।’
‘না, না, ওসবের দরকার নেই। আমি গল্পটা পড়তে-পড়তে যাব।’
‘আজ বড় পবিত্র দিন।’ হেসে বলল মোহন। আমার ডারউইনের কথা আবার মনে পড়ল। তারপর: ‘তুই আমার দোকান থেকে প্রথম বই কিনলি, সুতরাং এ-বই আমি জন্মদিনের রঙিন মোড়কে না-মুড়ে ছাড়ছি না।’
দোকানে অন্য খদ্দের নেই। সুতরাং মোহনের সব নজর এখন আমারই দিকে। বইটা হাতে করে ও অদৃশ্য হয়ে গেল কাউন্টারের পেছনে। আমার উৎকণ্ঠিত চোখের সামনে ঘড়িতে সময় বয়ে যায়: ছ’টা বাইশ, ছ’টা তেইশ, ছ’টা চব্বিশ।
ছ’টা পঁচিশে আমাকে ডারউইনের কথা তৃতীয়বার মনে করিয়ে দিয়ে মোহন বেরিয়ে এল কাউন্টারের পেছন থেকে। ম্যাগাজিনটাকে গোলাপি ফুল ছাপা কাগজে মুড়ে ও সোনালি ফিতে দিয়ে বেঁধে এনেছে।
‘পত্রিকা কেনার জন্যে অজস্র ধন্যবাদ।’ হেসে বলল মোহন।
ম্যাগাজিনটা ওর হাত থেকে প্রায় কেড়ে নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম দোকান ছেড়ে। মোড়কটা ব্যস্ত হাতে ছিঁড়তে-ছিঁড়তে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে চললাম অফিসের দিকে। চঞ্চল বইয়ের পাতায় আমার চোখও চঞ্চল:
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও, একটু ভাবতে দাও আমাকে।’ চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন ডি. সি. চক্রবর্তী।
‘ভাবুন স্যার।’ বললেন যুধাজিৎ সেন, ‘আরাম করে ভাবুন।’ তাঁর চোখে দুষ্টুমির হাসি।
সামনের ড়ি সি. এম. শো-রুমের দেওয়াল-ঘড়িতে ছ’টা সাতাশ।
‘কোনও যন্ত্রপাতি সঙ্গে ছিল না বলছ?’ প্রশ্ন করলেন সমীর চক্রবর্তী।
আগেই তো সে-কথা আপনাকে একশোবার বলা হয়েছে, বিরক্ত হয়ে ভাবলাম।
‘না।’ যুধাজিৎ সেন ঠোঁটে হাসলেন—বাচ্চা ছেলের ব্যর্থতায় অভিজ্ঞ শিক্ষকের হাসি:’সাধারণ কোনও মানুষের কাছে সাধারণ যেসব জিনিস থাকে আমার কাছে তার বেশি ছিল না। মানিব্যাগ, চিরুনি আর রুমাল।’
‘মানিব্যাগটা নিশ্চয়ই সাধারণ মানিব্যাগ নয়?’ ধূর্তস্বরে প্রশ্ন করলেন সমীর চক্রবর্তী।
যুধাজিৎ সেন হাসি চেপে বললেন, ‘আপনি ভুল পথে চলেছেন, স্যার।
সরখেল এবং আমি শুধুমাত্র উপস্থিতবুদ্ধি ভাঙিয়ে ওই ভল্ট থেকে বেরিয়ে এসেছি।’
‘দারুণ! তুলনা নেই।’ মনে-মনে বললাম। ম্যাগাজিনটাকে ঢুকিয়ে নিলাম জামার ভেতর। কারণ, আমি এখন অফিসের দরজায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু অনন্ত কর ভেতরে আছেন তো?
বেল বাজালাম। কোনও উত্তর নেই।
দরজায় দমাদম ঘুষি মারলাম। উত্তর নেই।
এবার চিৎকার করে উঠলাম, ‘মিস্টার কর, মিস্টার কর?’
অরণ্যে রোদন।
রাস্তার ওপারে স্টেট ব্যাংক বিল্ডিংয়ের ঘড়িতে ছ’টা ঊনত্রিশ। বুড়ো নির্ঘাত ভেতরেই আছে, মনকে প্রবোধ দিলাম নীরবে। যদি কোনও লোক সাড়ে পাঁচটায় বলে আমাকে এখনও ঘণ্টাখানেক কাজ করতে হবে, তা হলে ছ’টা ঊনত্রিশে তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকারই কথা।
আরও মিনিটখানেক দরজায় ধাক্কা দেওয়ার পর আসল রহস্যটা মাথায় ঝিলিক মারল। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, অনন্ত কর কানে শুনতে পান না। তা হলে তিনি নিশ্চয়ই ভেতরে আছেন। সাড়া দিচ্ছেন না আমার ডাক শুনতে পাচ্ছেন না বলে। সুতরাং নতুন আশা নিয়ে এগিয়ে গেলাম চিঠি ফেলার গর্তের কাছে। উঁকি মারলাম। তাঁর টেবিলের আলোর রেশ অফিসের দেওয়াল থেকে ঠিকরে পড়ছে। কিন্তু অফিসের ‘এল’ আকৃতির জন্যে অনন্ত কর আমার নজরের আড়ালে।
‘মিস্টার কর!’ আমি চিৎকার করলাম (ছ’ইঞ্চি চওড়া গর্তে যতখানি জোরে চিৎকার করা সম্ভব) ‘মিস্টার কর, আমি বিশ্বাস!’
‘বিশ্বাস?’ তাঁর কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ, বিস্ময়।
‘হ্যাঁ, স্যার, আমি!’ ভোক্যাল কর্ডের অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে উত্তর দিলাম।
‘সে কী? আমি তো জানি তুমি অনেকক্ষণ আগে চলে গেছ।’
‘হ্যাঁ, চলে গেছি! এখন আমি অফিসের বাইরে, মিস্টার কর! চিঠি ফেলার গর্তের কাছে!’
‘ও।’ অনন্ত করের গলায় দিশেহারা সুর, ‘তা কী ব্যাপার, ফিরে এলে যে?’
‘আমার ফাউন্টেন পেনটা ফেলে গেছি!’ চিৎকার করে বললাম।
মানসচক্ষে দেখতে পেলাম অনন্ত কর গম্ভীরভাবে বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়ছেন। সৌভাগ্যবশত আমার পরিকল্পনার একটা প্রধান অংশ ছিল দিনের-পর-দিন অনন্ত করের কাছে নিজেকে গর্দভ প্রতিপন্ন করা। কবে এই ইমেজ কাজে লাগবে, সে-কথা না-ভেবেই ফাইল উলটোপালটা জায়গায় রেখেছি, হিসেবে ভুল করেছি, অফিসে সুযোগ পেলেই হোঁচট খেয়ে পড়েছি, বোকার মতো মিসেস রাও এবং মিস্টার করকে প্রশ্ন করেছি, এবং নিজের টুকিটাকি জিনিস প্রায়ই ভুল করে ফেলে গেছি অফিসে। এজন্যে বারদুয়েক আমার চাকরি যেতে-যেতে বেঁচে গেছে। কিন্তু আজ, দু-মাস পরে, আমার সেই গর্দভ-ইমেজ কাজে লাগছে। বড় আনন্দের কথা।
‘দাড়াও, নলিনী, দরজা খুলছি।’ মিস্টার কর চেয়ার ঠেলে (শব্দ শুনে অনুমান করলাম) উঠে দাঁড়ালেন।
আমি স্থির চোখে উঁকি মেরে দেখতে লাগলাম। কর অফিসের বাঁক ঘুরে আমার নজরবন্দি হলেন, এবং আমিও লেটার বক্স ছেড়ে এগিয়ে গেলাম বন্ধ দরজার কাছে।
দরজাটা সামান্য খুলে তিনি আমার দিকে চেয়ে হাসলেন, ‘এই সেদিন ম্যানিব্যাগ ফেলে গিয়েছিলে, আজকে আবার পেন?’
অবাক হতে যাচ্ছি, খেয়াল হল নিজের একটু আগে বলা মিথ্যে কথাটা: অফিসে পেন ফেলে গেছি।
‘হ্যাঁ, স্যার,’ সলজ্জ হাসলাম।
‘আজ রাতটা পেন না-হলে চলছিল না?’
‘মানে, একজনকে চিঠি লিখতে হবে, স্যার। তাই…’
অদ্ভুতভাবে হাসলেন কর, বললেন, ‘প্রেমপত্র?’
চুপ করে রইলাম। জানি না, এসব প্রশ্নরাশির মহান কারণটা কী। তবে আমার মুখে বোধহয় একটা হতাশ বোকা-বোকা ছাপ স্পষ্ট হয়েছিল। কারণ, কর হঠাৎই সদয় হয়ে বললেন, ‘এসো।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি একপাশে সরে দাঁড়ালেন। আমাকে ভেতরে ঢুকতে জায়গা দিলেন।
দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলাম আমার টেবিলের কাছে। বিভিন্ন ড্রয়ার ফাইলপত্র ঘাঁটতে শুরু করলাম। মিস্টার অনন্ত কর দরজায় দাঁড়িয়ে পেচকজাতীয় চোখে আমাকে লক্ষ করতে লাগলেন। আমার পরিকল্পনায় তাঁর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল না।
‘কোথায় যে গেল পেনটা!’ উচ্চগ্রামে স্বগতোক্তি করলাম, ‘ওটা না-পেলে আজ ভীষণ মুশকিল হবে।’ আরও একটা ড্রয়ারকে ব্যবচ্ছেদ করতে শুরু করলাম: ‘পেনটা একজন আমাকে জন্মদিনে দিয়েছিল।’ অকারণেই যোগ করলাম।
মিস্টার করের মুখমণ্ডলে এবার যে অভিব্যক্তি ফুটে উঠল অল্প আলোয় সেটাকে বিরক্তি ও করুণার মিশ্রণ বলে চিনে নিতে ভুল হল না। তিনি থপথপ করে অফিসের বাঁক ঘুরে নিজের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে ক্লান্ত স্বরে বললেন, ‘যাওয়ার সময় দরজাটা বন্ধ করতে ভুলো না, বিশ্বাস।’
বললাম, ভুলব না এবং ড্রয়ার ইত্যাদি নিয়ে আরও মিনিটখানেক খটাখট করার পর চিৎকার করে উঠলাম, ‘এই তো পেয়েছি! আলপিনের বাক্সের পেছনে পড়ে ছিল!’ গলার স্বর তুঙ্গে রেখেই বললাম, ‘আমি চললাম, মিস্টার কর!’
‘আচ্ছা—’ তাঁর আনমনা উত্তর শোনা গেল। রেলিংটা একলাফে টপকে দরজার কাছে গেলাম। দরজাটা খুলে সশব্দে আবার বন্ধ করে দিলাম। তারপর পা টিপে-টিপে ফিরে এসে লুকিয়ে রইলাম আমার টেবিলের তলায়। জায়গাটা যেন একটা ছোট্ট গুহা, তবে সামান্য আলোর রেশ রয়েছে। সুতরাং ‘মাসিক ক্রিমিনাল’টা বের করে পড়তে শুরু করলাম। ডি. সি. সমীর চক্রবর্তী এখনও হালে পানি পাচ্ছেন না।
‘আমি হার মানলাম, সেন।’ ডি. সি. মাথার টাকে হাত বুলিয়ে বললেন। মুখে তাঁর এখনও কৌতূহলের ছায়া।
‘কী যে বলেন—’ হাসলেন যুধাজিৎ সেন: ‘আমি আর প্রশান্ত সরখেল পারলাম, সেখানে আপনি পারবেন না! বিশেষ করে আপনার এত বছরের পুলিশি অভিজ্ঞতা রয়েছে। দাঁড়ান, পুরো ব্যাপারটা আর-একবার আপনাকে গুছিয়ে বলি। আপনি একটা ভল্টে বন্দি হয়ে রয়েছেন—।’
মিস্টার করের আলোর নিভে গেল। শুনতে পেলাম তাঁর এগিয়ে আসা পায়ের শব্দ। চারদিক ভীষণ চুপচাপ। আমিও শব্দহীন, যদিও জানি তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে ট্যাঙ্গো নাচ নাচলেও মিস্টার করের মৃত কর্ণদ্বয় বিন্দুমাত্রও বিচলিত হবে না। চুপিচুপি গিয়ে তাঁর কানের কাছে আচমকা এক চিৎকার করতে ভীষণ ইচ্ছে হল। দেখতাম, বুড়ো কীরকম চমকে ওঠে। কিন্তু এখন বোকামি করার সময় নয়।
রুদ্ধশ্বাসে শুনলাম শীততাপ যন্ত্র বন্ধ করে দেওয়ার শব্দ। শুনলাম বিপদঘণ্টি চালু করার শব্দ। দরজা খোলা ও বন্ধ করার শব্দ। এবং সবশেষে তালার চাবি ঘোরানোর মিষ্টি আওয়াজ।
আরও একমিনিট ঘাড় গুঁজে টেবিলের তলায় বসে রইলাম—অতিরিক্ত সাবধানতায়। তারপর একলাফে বাইরে এলাম। কলকাতার অন্যতম ধনী নাগরিক হতে আর মাত্র দু-পৃষ্ঠা (মাসিক ক্রিমিনালের) এবং দশমিনিট বাকি।
অফিসে কোনও জানলা নেই। সুতরাং একটা আলো জ্বালতে বাধা নেই। ইচ্ছে হলে সবকটা আলোই জ্বালাতে পারি, কিন্তু সে-আলো শীততাপ যন্ত্রের ফাঁক দিয়ে বাইরের লোকের নজরে পড়তে পারে। এছাড়া প্রতিফলিত আলোকেও বিশ্বাস নেই। তার ওপর চিঠি ফেলার গর্ত তো রয়েছেই। হয়তো দেরিতে আসা কোনও দ্বিতীয় বিশ্বাস সেই গর্ত নিয়ে দেখছে এবং টাকা লুঠের মতলব ভাঁজছে। এখন অতিরিক্ত সাবধান হওয়ার সময়। আলিপুর জেল ও কলকাতার মুক্ত বাসিন্দাদের মধ্যে ফারাক শুধু এই অতিরিক্ত সাবধানতাটুকুর। সুতরাং শুধুমাত্র দেশলাই জ্বালানোর ঝুঁকি নেব ঠিক করলাম।
নিজের পকেট ও টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ে স্পষ্ট বুঝলাম, সে-ঝুঁকিও আমাকে আর নিতে হবে না। কারণ দেশলাই কোথাও নেই। এই দুঃখের মুহূর্তে মনে পড়ল, একটা পকেট-টর্চ আমি কিনেছিলাম। তখন আমি সবেমাত্র সিন্দুক লুঠ করবার তোড়জোড় শুরু করেছি। সযত্নে সংগ্রহ করেছি হিন্দি-সিনেমাজাতীয় পোশাক, (কালো প্যান্ট, কালো জামা, কালো মুখোশ—তাতে শুধু চোখের কাছে দুটো ফুটো এবং কালো রবারের জুতো) যাতে কেউ আমাকে অফিস-বাড়ি থেকে বেরুতে দেখলেও ‘আমি’ বলে সন্দেহ না করে। মনে পড়ছে, টর্চ লাইট ও পোশাকগুলো কিনেছিলাম নাকতলা অঞ্চল থেকে, যাতে কেউ পরে মধ্য কলকাতার অপরাধের দায়ে আমাকে শনাক্ত করতে না-পারে। এখন সেই চুরির সাজপোশাক, টর্চলাইট, সব পড়ে আছে খাটের নীচে।
আমার মতো প্রতিভাধর পুরুষও একমুহূর্তের জন্যে হতাশ হল। সূক্ষ্ম ভাবনাচিন্তার মাঝে শুনতে পাচ্ছি ওপরতলার টি-ভি কোম্পানির লটঘট কাণ্ড। কোম্পানির মালিক সুরোলিয়াকে সেক্রেটারি পামেলা হয়তো এই নিয়ে তৃতীয়বার ‘অবৈধ সুরোলিয়া, জুনিয়ার’ উপহার দিতে চেষ্টা করছে। তাই বোধহয় এত গানবাজনার আওয়াজ, খিলখিল হাসির শব্দ।
সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে আমার আর প্রশান্ত সরখেলের পরিস্থিতির মধ্যে আর-একটু মিল খুঁজে পেলাম। অন্ধকার ভল্টে সরখেল যখন বন্দি, তখন ওপরতলা থেকে ভেসে আসছে আত্মীয়-পরিজনের হই-হুল্লোড়ের শব্দ। মিসেস মেহেরা ছেলের জন্মদিন-উৎসব নিয়ে খুশি জাহাজ। আর এখানে সুরোলিয়ার ছেলের আসল জন্মমুহূর্ত স্থির করে উঠতে পামেলা চিন্তা ও হুইস্কিতে মগ্ন। বড় পবিত্র মুহূর্ত।
হঠাৎই মনে পড়ল, অফিসে এসে অনন্ত কর রোজ ধূপ জ্বালান। সিন্দুকের মাথায় রাখেন। তখন আমি কোনও কথা জিগ্যেস করতে গেলে বলেন, ‘এখন নয়, বিশ্বাস। এ বড় পবিত্র মুহূর্ত।’ অতএব এই অফিসে, সম্ভবত পানিকরের ড্রয়ারে, নির্ঘাত কোথাও-না-কোথাও দেশলাই আছে।
চার সেকেন্ড পরেই বিশ্বাস-উপপাদ্যের সত্যতা প্রমাণিত হল। আমি বারদুয়েক পা ফেলে এগিয়ে গেলাম সিন্দুকের কাছে—হাতে দেশলাই। কিন্তু পরমুহূর্তেই পিছিয়ে করের টেবিলের কাছে ফিরে এলাম।
কারণ, গ্লাভস আনতে ভুলে গেছি।
কিন্তু আইনস্টাইন নলিনী বিশ্বাস এতে স্তব্ধ হওয়ার নয়। নিপুণ দক্ষতায় রুমাল বের করে বাঁহাতে জড়িয়ে নিলাম। তারপর এগিয়ে গেলাম মিসেস রাওয়ের টেবিলে। দেশলাইটা রাখলাম। তারপর টাইপ করার টিস্যু কাগজ গোটাকয়েক জড়িয়ে নিলাম ডানহাতে। কাগজের কোনাগুলো গঁদ দিয়ে সেঁটে দিলাম হাতে। এবার দেশলাই নিয়ে সুরোলিয়ার বাজনার তালে-তালে হাজির হলাম সিন্দুকের কাছে।
ডানদিকে ষোলো। বাঁদিকে এগোরো। ডানদিকে ছাব্বিশ।
ক্লিক।
হাতল ঘুরিয়ে টান মারতেই সিন্দুক খুলে গেল।
ফিরে এসে নিজের টেবিলের ড্রয়ার থেকে তেতাল্লিশটা পলিথিনের ব্যাগ বের করে নিলাম। পরীক্ষায় প্রমাণিত হল, ‘কর ফাইন্যান্স অ্যান্ড লোন কোম্পানি’র টাকার তুলনায় আমার ব্যাগের সংখ্যা বেশি। অতএব পনেরোটা ব্যাগ ফিরে গেল তার আগের জায়গায়—আমার ড্রয়ারে। এগুলো সোমবার দিন সরিয়ে ফেলব। এবং সেইদিনই আমার চাকরিতে ইস্তফা দেওয়ার ইচ্ছেটা অনন্ত করের কাছে প্রকাশ করব।
মিস্টার কর, মিসেস রাও এবং ‘কর ফাইন্যান্স অ্যান্ড লোন’ কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকবৃন্দ। জানি কলকাতার বুকে এই অভূতপূর্ব চুরির ঘটনায় আপনারা বিস্ময়ে স্তম্ভিত, শোকে অভিভূত— আমারই মতো। এই দুঃসময়ে আপনাদের কাছে বক্তব্য রাখতে হচ্ছে, এ জন্যে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি। আমি ঠিক করেছি আগামী মাসের মধ্যেই এ-কোম্পানির চাকরিতে ইস্তফা দেব। কারণ, ম্যানেজমেন্ট ডিপ্লোমা কোর্সে সামনের মাসেই আমি ভরতি হচ্ছি (কথাটা সত্যি—মিথ্যে বলে মনে হলেও)। আপনারা হয়তো ভাবছেন আমি হৃদয়হীন, আমার বিবেক নেই। কিন্তু তা নয়। মিস্টার কর বরাবরই মানুষের উন্নতির চেষ্টাকে মনেপ্রাণে সমর্থন করেন, আশা করি আমার বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হবে না। এই দুঃখজনক ঘটনায় আমিও আপনাদের সঙ্গে সমব্যথী। সমবেদনার ভাষা…।
রোববার দিন বাকিটা ভেবে তৈরি করে নেব। চাকরিতে আমার তরফ থেকে ইস্তফা দেওয়ার হয়তো প্রয়োজন হবে না। মিস্টার করই হয়তো কোম্পানির খরচ কমানোর জন্যে নিজে থেকেই আমাকে ছাঁটাই করে দেবেন। সুতরাং অবস্থা বুঝিয়া ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবেক।
টাকাগুলো ব্যাগে ভরে নেওয়ার পর সিন্দুক বন্ধ করলাম। কোম্পানির এই আর্থিক ক্ষতিতে শোক প্রকাশের জন্যে একমুহূর্ত নীরবতা পালন করলাম। মিস্টার করের পয়সা আছে। তিনি হয়তো ঠিক দাঁড়িয়ে যাবেন। কিন্তু মিসেস রাও? সেক্রেটারি হিসেবে চাকরি পাওয়ার মূলধন ওঁর ফুরিয়ে এসেছে। তবে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খায়নি এমন কোনও ‘আদম’-এর অভাব কলকাতায় নেই। তাকে ওঁর জ্ঞানবৃক্ষর ফল খাওয়ালেই মিসেস রাও চটপট চাকরি পেয়ে যাবেন।
টাকার থলেগুলো পায়ের কাছে রেখে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসলাম। মিস্টার করের দেশলাই থেকে আর-একটা কাঠি জ্বাললাম। তারপর এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রতিটি ধাপ মুখস্থ করার জন্যে মনে-মনে তৈরি হলাম। ‘মাসিক ক্রিমিনাল’টা নিয়ে বসলাম।
যুধাজিৎ সেনকে যে-অবস্থায় রেখে এসেছিলাম তিনি এখনও সেই অবস্থাতেই রয়েছেন। অর্থাৎ মেহেরার ভল্টের চরিত্রের পর্যালোচনার পুনরাবৃত্তি করছেন। চর্বিতচর্বণ। সুতরাং পরের প্যারায় আমার চোখ ছিটকে গেল।
সমীর চক্রবর্তী যুধাজিৎ সেনের প্যাকেট থেকে আবার একটা সিগারেট ধরালেন। একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ‘নাঃ, আমার দ্বারা হবে না, সেন। তুমিই বলো, তালাবন্ধ ভল্ট থেকে বেরোলে কী করে?’
যুধাজিৎ সেন আন্তরিক হাসলেন, বললেন, ‘ব্যাপারটা খুবই সহজ, স্যার। মানছি, দরজা খোলা অথবা বিপদঘণ্টি নিয়ে কারসাজি করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা পথ আমার হাতে ছিল। সেটা হল…।’
পাতাটা সেখানেই শেষ। সুতরাং পরের পৃষ্ঠার প্রথম লাইনে নজর দিলাম।
সুরজিৎ সেন হাসিমুখে দৃষ্টি মেলে দিলেন শোভনা রায়ের দিকে। বললেন, ‘দয়া করে আসন গ্রহণ করুন, মিস রায়। বলুন, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’
মোহন সরকার ‘বন্ধ ঘরের রহস্য’র শেষ পাতাটা নিখুঁতভাবে ছিঁড়ে নিয়েছে।
কিন্তু আমিও তাতে হার মানার পাত্র নই। মানছি, প্রথমটা একটু হতাশ হয়েছি, কিন্তু পরক্ষণেই অফিসের টেলিফোন ও আমার সাহস আমাকে আশা দিয়েছে। সত্যি, এ ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা শুধুমাত্র নলিনীরঞ্জন বিশ্বাসের বুদ্ধিতেই সম্ভব।
প্রথমে পরিচিত বন্ধুবান্ধব কয়েকজনকে ফোন করলাম, যারা এ ধরনের পত্রিকা পড়ে। কেউ-কেউ বাড়ি নেই, আর বাকিরা গল্পটা পড়েনি। তাদের বললাম দৌড়ে গিয়ে এককপি পত্রিকা কিনে গল্পটা পড়ে নিতে। মুখে ‘হ্যাঁ’ বললেও আমি জানি পত্রিকা কিনতে ওরা কেউই যাবে না। তারপর একটা বইয়ের দোকানে ফোন করলাম, কিন্তু ওরা বলল টেলিফোনে গল্প পড়ে শোনানো ওদের ধর্ম নয়।
মোহনকে ফোন করলাম। আমার গলা শুনেই ও হাসল। তারপর ফোন নামিয়ে রাখল। আত্মীয়স্বজন দু-একজনকে ফোন করতেই তারা জিগ্যেস করল, আমি কোথা থেকে ফোন করছি। আমার কোনও বিপদ হয়েছে কি না। পুলিশে কি খবর দিতে হবে?
নীরবে ফোন নামিয়ে রাখলাম।
এবার ‘ক্রিমিনাল’টা উলটেপালটে দেখলাম। কোনও ফোন নম্বর দেওয়া নেই। দুটো নাম রয়েছে: সহদেব সাহা ও স্বপন সাহা। যথাক্রমে প্রধান উপদেষ্টা ও সম্পাদক। ডিরেকটরিতে তাঁদের নামে কোনও ফোন নম্বর খুঁজে পেলাম না যে ফোন করব। চিন্তাহরণ চাকলাদারের নাম ধরে ফোন নম্বর খোঁজার কোনও চেষ্টা করলাম না। কারণ, ছদ্মনাম দেখলেই আমি বুঝতে পারি।
স্বীকার করছি, একটু নার্ভাস হয়ে পড়লাম। তারপর শেষ চেষ্টা হিসেবে ফোন করলাম লালবাজারে। না, ডি. সি. সমীর চক্রবর্তী বা ইন্সপেক্টর যুধাজিৎ সেনের নাম তারা কখনও শোনেনি। তবে প্রশান্ত সরখেল বলে একটা লোক বর্তমানে তাদের হাজতে আছে। সে অভিযুক্ত জালিয়াতির অপরাধে, চুরির অপরাধে নয়।
এবার ধীরে-ধীরে নিজেকে শান্ত করলাম। পত্রিকার বাকি গল্পগুলো (মোহনের কৃপায় যেগুলো অটুট আছে) পড়ে শেষ করলাম। বেরোনোর ব্যাপারটা নিয়ে আমি মোটেও আর ভাবছি না। সোমবারে সকাল সাড়ে নটা পর্যন্ত আমার হাতে সময় আছে। তার মধ্যে ফোনে এমন কাউকে নিশ্চয়ই পেয়ে যাব যে ওই গল্পটা পুরোটা পড়েছে। শুধু এখন ঈশ্বরকে ডাকছি, যুধাজিৎ সেন শেষ পর্যন্ত আমাকে ধোঁকা না-দেয়। কারণ, গল্পের রহস্যের কায়দা এবং চালাকি মেশানো সমাধান আমি একটুও পছন্দ করি না।