সাবধানি
কিছু মানুষ আছেন যেমন সাবধানি, তেমনি হিসেবি। সাবধানি মানুষের সংস্পর্শে এলে কী হয়,সেই কথাই বলি। বাইরে দিনকয়েকের জন্যে বেড়াতে যাওয়া হচ্ছে। সেই সাবধানি মানুষটি আমাদের দলপতি। বাঁধাছাঁদা শেষ। তিনি বললেন…’কুড়ি ফুট নাইলন দড়ি আর গোটাছয়েক ছোটবড় হুক নিয়ে নাও।’ আমরা সবাই প্রশ্ন করলুম, ‘কেন? হুক আর দড়ি কী হবে?’
‘কাপড়জামা কেচে শুকোতে দেবে কোথায়! ওই দ্যাখো, মনে পড়ে গেল। ওই ছোটো তবলা ঠোকা হাতুড়িটাও নিয়ে নাও। ঠোকাঠুকির কাজে লাগবে। পেরেক কি হুক পোঁতার জন্যে কার কাছে আবার হাতুড়ি খুঁজতে যাবে। চটিতেও তো পেরেক উঠতে পারে।’
সেই সাবধানি মানুষটির নির্দেশে আমাদের বোঝা ক্রমশ গন্ধমাদনের মতো হয়ে গেল। টর্চলাইট প্রয়োজনীয় অবশ্যই; কিন্তু ছাতা! বেডিং-এ ছাতা ভরে কেউ বিদেশ-ভ্রমণে যায়! ওষুধের বাকসের আয়তন বাড়তেই লাগল। খাওয়াদাওয়ার গোলমালে বদহজম হতেই পারে। দশপাতা অম্বলের ওষুধ। জলের গোলমালে পেট বিব্রত করতে পারে; দশপাতা আমাশার ওষুধ। জ্বরের ওষুধ। দাঁত ব্যথার ওষুধ। পা মচকে যাওয়ার ওষুধ। গজ, ব্যান্ডেজ। ইলাস্টিক ব্যান্ডেজ। পোড়ার মলম। নাক বুজে যাওয়ার ড্রপস। মাথা ধরার বাম। সার্জিক্যাল কাঁচি। পায়ে কাঁটা ফুটে গেলে টেনে তোলার ফরসেপ। হটওয়াটার ব্যাগ, আইস ব্যাগ। ঘুমের ওষুধ। জোলাপ। ভেবে-ভেবে খুঁজে খুঁজে যত রকম অসুখ হতে পারে, সেই সব অসুখের প্রাথমিক চিকিৎসার যাবতীয় ওষুধের একটি বিশাল পেটি। শেষে বেরোল, বাইরে কাঁকড়া বিছের ভীষণ উপদ্রব। কাঁকড়া বিছের কামড়ের ওষুধ কেনা হয়নি। একজন ছুটে গেল কিনতে।
বিদেশে ভ্রমণের সঙ্গে বেশি টাকাপয়সা নিয়ে বেরোতে হয়। সেই টাকা কি ভাবে সামলানো হবে। সাবধানি মানুষটি আমরা যতজন ছিলুম তাদের মধ্যে টাকাটা চালিয়ে দিলেন। বললেন, লুক্কায়িত জায়গায় সাবধানে রাখো। গাড়িতে ওঠার পর চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘আঙুল সরাও, আঙুল সরাও। দরজা বন্ধ হচ্ছে।’ মোটরে একসঙ্গে অনেকে থাকলে ওইটাই হয়। কারও না কারও আঙুলের মাথায় দমাস করে দরজা এসে পড়বেই, পড়বে। আর সারাটা পথ সে আঙুল চুষবে আর অন্যরা বলতে থাকবে, ‘আহারে, একটু বরফ পেলে ভালো হত, একটু টুকরো বরফ।’ আর যে আচমকা দরজা বন্ধ করেছে, সে মরমে মরে থাকবে। সাবধানি মানুষটি পরিস্থিতি থিতিয়ে আসার সঙ্গে-সঙ্গে বলবেন, ‘কি, ঠিক আছে তো!’
সঙ্গে-সঙ্গে আর সকলে লুক্কায়িত স্থানে হাত দিয়ে দেখে নেবে গুপ্তধন ঠিক আছে কি না। এই দেখার সময় সকলে এমন একটা ভাব করবে যেন তার দুপাশে পকেটমার বসে আছে। অত:পর স্টেশানে এসে সাবধানি মানুষটি বলবেন, খুব সাবধান! সব চোখে-চোখে রাখবে।’ মালবাহী মানুষটি বাকস-প্যাঁটরা সমেত সরে না পড়ে। শুরু হয়ে যাবে চোরপুলিশ খেলা। অভ্যস্ত মালবাহী তার নিজস্ব ভঙ্গিতে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে দ্রুতপদে চলেছে, আর তাকে চোখে-চোখে রাখতে গিয়ে মা, মাসি, পিসি, বোন, হোঁচট খেয়ে, ধাক্কা খেয়ে, ধাক্কা মেরে নাজেহাল। তাদের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। এই বুঝি সব গেল। আর এইরকম পরিস্থিতিতে সাবধানি মানুষটি সকলকে চমকে দিয়ে বললেন, ‘ট্রেনের টিকিটগুলো মনে করে আনা হয়েছে তো!’ মালবাহী হুড়হুড় করে ছুটছে, পেছনে আমরা ছুটছি, পড়ি কী মরি, সেই সময় টিকিটের সন্দেহ। সেই ছুটন্ত অবস্থায় রব উঠল, ‘টিকিট কার কাছে টিকিট।’ কেউ বলে মায়ের কাছে, কেউ বলে মাসির কাছে।
অবশেষে ট্রেনের আসনে। সাবধানি মানুষটি বলবেন, ‘যে যাই করো মালের দিকে একটা চোখ ফেলে রাখো সব। দিনকাল খুব খারাপ পড়েছে। দ্যাখ তো না দ্যাখ। তার মানে এই দাঁড়াল সারাটা পথ চোখ ঝুলে রইল বাকস-প্যাঁটরায়। ট্রেনের পাশে-পাশে প্রাকৃতিক দৃশ্য ছুটছে সেদিকে তাকিয়ে আত্মহারা হওয়ার উপায় নেই। একবার এদিকে তাকাই, একবার ওদিকে তাকাই। তিনি আবার ফিসফিস করে কানে-কানে বলে দিলেন, ‘স্টেশানে ট্রেন থামলে পূর্ণ সজাগ। ওই সময় লোকজনের ওঠানামা। কিছু নিয়ে সরে পড়ার ওই হল শ্রেষ্ঠ সময়। স্টেশানে ট্রেন থামে আর আমরা সবাই ওঠবোস করে মরি।
কে একজন বাইরে হাত রেখে বসেছিল। সাবধানি মানুষটি তাকে সাবধান করে দিলেন, ‘ঘড়িটা এই সেদিন কিনেছ। সাবধান। পটাং করে ব্যান্ড ছিঁড়ে লাইনে পড়ে গেলে আর উদ্ধার করা যাবে না। হাত ভেতরে। হাত ভেতরে।’ হয়ে গেল তার আয়েস করে বসা। জীবনে সে আর ট্রেনের কী চলমান কোনও যানের জানলায় হাত রেখে বসতে পারবে না। কেবলই মনে হবে, এই বুঝি ব্যান্ড ছিঁড়ে ঘড়িটা পড়ে গেল। এই বুঝি আঙুল থেকে খুলে চলে গেল দামি পাথর-বসানো আংটি।
এরপর ট্রেন যখন আসানসোল ছেড়েছে, সাবধানি মানুষটি বললেন, ‘সদরে তালা দিয়েছিলে তো।’ সকলেই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। কার ওপর শেষ এই কাজটির ভার ছিল? খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ! একজন সাহস করে বললেন, ‘তালা না দিয়ে কেউ আসতে পারে! এত বড় মারাত্মক ভুল কেউ সহজে করবে!’
‘চাবি কার কাছে?’
ধানের খেতে বাতাস চলে যাওয়ার মতো সবাই একটু দুলে উঠল। কারুরই পকেটে, ব্যাগে অথবা আঁচলে চাবি নেই। ব্যাস, বিদেশ-ভ্রমণ হয়ে গেল। সদরে চাবি না দিয়েই সপরিবারে বিদেশ-ভ্রমণ হচ্ছে। সাবধানি মানুষটি বললেন, ‘এত করে বারে-বারে আমি সাবধান করি। তাতেও কারোরও চেতনা হয় না। নাও, এবার বোঝা ঠ্যালা। গিয়ে দেখবে যথাসর্বস্ব ফাঁক। নাও চেন-টানো।’
চেন আর টানতে হল না। স্টেশান এসেছে। ট্রেন আপনিই থামল। নামো নামো। হুড়োহুড়ি করে মালপত্তর নিয়ে নামা। যাত্রীরা অবাক। এই বললে হরিদ্বার যাবে। প্রায় মাঝরাতে ফিরে এসে দেখা গেল সদরে যথারীতি ঘঁটির আকারের ইয়া বোম্বাই একটা তালা ঝুলছে। এ কী? তাহলে চাবি কার কাছে!’
হঠাৎ একজনের মনে পড়ল, চাবি দিয়েছিলেন সাবধানী মানুষটি নিজের হাতে। সে তখন সাহস করে বললে, ‘চাবি তো আপনার কাছে।’
‘আমার কাছে?’ হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল। চাবি দিয়ে সেটাকে রেখেছিলেন সুটকেসে।
লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘সুটকেস! আমার স্যুটকেস কোথায়?’
সুটকেস নেই। সাধারণত এক যাত্রায় পৃথক ফল হয় না। শাস্ত্রের বচন। কিন্তু এযাত্রায় হল। সুটকেস একা-একা দু:সাহসী বালকের মতো হরিদ্বারে চলেছে। বন্ধ দুয়ারের সামনে ভোরের অপেক্ষায় বসে থাকা। বসে-বসে সাবধানি মানুষটি বলছেন, ‘সুটকেস এতক্ষণে পাটনা গেল। বেনারস গেল। লক্ষ্মৌ গেল।’