সাবধান
ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছিলেন এদের থেকে খুব সাবধান, যেমন “প্রথম, বড় মানুষ। টাকা লোকজন অনেক, মনে করলে তোমার অনিষ্ট করতে পারে। তাদের কাছে সাবধানে কথা কইতে হয়। হয়তো যা বলে সায় দিয়ে যেতে হয়।” খাঁটি কথা। আরেকজন সন্তও এইকথা বলে গেছেন—”হাঁ জী, হাঁ জী করতে রহিয়ে; বৈঠিয়ে আপনা ঠাম।” প্রতিবাদ করেছ কি অকারণ ঝামেলায় জড়িয়ে মরেছ। তা বড় মানুষ মানেই কর্মস্থলের বড়কর্তা। তিনি হলেন গিয়ে অন্নদাতা। তাঁর কৃপাতেই আমাদের লপচপানি। বউয়ের টাঙ্গাইল শাড়ি, ছেলের ইংলিশ এডুকেশন, খানায় মুরগীর ঠ্যাঙ, চোখে গগলস, পরনে চোস্ত পাজামা পাঞ্জাবি। তাঁর ঘরে যখন সভা বসে তখন মনের নোটিস বোর্ডের দিকে একবার তাকাতেই হয়—সাবধান বড় মানুষ, প্রভূত ক্ষমতা রে ভাই। এক টুসকিতে তোমার হাঁড়ি শিকেতে তুলে দিতে পারেন, পায়ের তলা থেকে সরিয়ে দিতে পারেন তোমার বিচরণভূমি। তিনি যা বলেন তাই সত্য। হাঁ জী, হাঁ জী। কে না জানে, তস্মিন তুষ্টে জগৎ তুষ্ট। তিনি সন্তুষ্ট হলে জগতের কল্যাণ। আমার জগৎ তো আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নয়। বড় জগৎ নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমার জগৎ আমার পরিবারটুকু। সেই পরিবারের কল্যাণে মাসের শেষে এক গোছা কারেন্সি নোট চাই। বড়কর্তার তালে তাল দিতে পারলে কেয়াবাত। ফ্যামিলিতে ঝাড়লণ্ঠন জ্বলবে। মেয়ের বিয়েতে জোড়া সানাই বাজবে। জীবিকাই তো আমাদের ডিফেন্স-ড্যান্স। তালে লয়ে নাচতে হবে। বড়কর্তা গোঁ ধরবেন, আর আমরা নেচে যাব মিস্টার ঘোষ, মিস্টার বোস, মিস্টার মিত্তির। কেউ বুঝতেই পারে না, এক একসময় আমরা কেমন অক্লেশে বাঁদরের ভূমিকায় নেমে আসি তিনি খেলান আর আমরা খেলি। তিনি মনে করেন—বাঃ এই বাঁদরটা বেশ ভাল নাচে, দাও ওটাকে প্রমোশন দিয়ে। সেই বাঁদরটা অমনি ম্যানেজার হয়ে গেল। গোছায় গোছা যোগ হলো। মানে নোটের গোছায়। পরিবারের সুখ বাড়ল। আরেকজন বিদ্যের জাহাজ। সে ঐ বড় মানুষটির প্রতিবাদ করেছিল, “আজ্ঞে না, আপনি যা বলছেন, তা আমি মানতেই রাজি নই। আপনি জানেন না।’ বড়কর্তার মুখ একটু লালচে হয়েই কালো হয়ে গেল। তিনি একবার হাঁ করলেন। শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন। সেই বিশ্বরূপ দর্শন হলো প্রভুর মুখগহ্বরে। দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে কর্মচারি আর তাদের পরিবারবর্গ। তিনি চিউইংগামের মতো চিবোতে লাগলেন। চোয়ালের হাড় বারকয়েক উঁচু নিচু হলো। বোঝা গেল কি হতে চলেছে সেই অবোধ প্রতিবাদকারীর। ধীরে ধীরে তাকে ‘অফ’ করে দেওয়া হবে। চেয়ারটা সরিয়ে নিয়ে টুল দেওয়া হবে। তখন ঘর ছেড়ে তার বারান্দায় অবস্থান। মডার্ন ম্যানেজমেন্টের ভাষায় একে বলে, ‘করিডর সার্ভিস’। হয় ছাড়পত্র দিয়ে মালপত্র নিয়ে মানে মানে বিদেয় হও, নয়তো বসে বসে অপমান হজম কর। প্রভু, আমরা কলম ব্যবহার করি কলম হিসেবে। আপনার কলম হলো ‘বেয়নেট’। এক খোঁচায় বিদ্যের জাহাজের ভরাডুবি। বিদ্যের জাহাজ যদি সংসার অর্ণব পাড়ি দিতে না পারে, তখন জাহাজের কি প্রয়োজন। তাই প্ৰভু, আর কিছু চাই না, তোমার কৃপায় রাঙঝাল একটু দাও, ফুটোফাটা বন্ধ করে অন্তত একটু ভেসে থাকি। থেকে থেকে ভোঁ মারি। বেঁচে থাকার ভোঁ।
সংসারে আমাদের স্ত্রীরাও খুব বড় মানুষ। সেখানেও হাঁ জী, হাঁ জী, চালাতে না পারলে অস্তিত্ব বিপন্ন। তুমি যন্ত্রী দেবী, আমি যন্ত্র। স্ত্রী যদি বলে, ‘তোমার মতো গর্দভ দুনিয়ায় দুটো নেই।’ ‘ঠিক বলেছ ম্যাডাম।’ পরেরটা উহ্য, ‘তা নাহলে তোমার কাছে ধরা দিই।’ ফ্রয়েডকে প্রশ্ন করা হলো—আপনি তো মানব- মনস্তত্ত্বের একজন দিগ্গজ পণ্ডিত, আপনার সঙ্গে আপনার স্ত্রীর কোনদিন মনোমালিন্য হয়েছিল?
ফ্রয়েড বললেন, জীবনে একদিন। শোবার ঘরের মাথার কাছে একটা জানালা খোলা নিয়ে! স্ত্রী বলেন খুলব, আমি বলি খুলো না, মাথায় ঠাণ্ডা লেগে যাবে। মাঝরাতে হাতাহাতি হয় আর কি। শেষে বাঁচিয়ে দিলে একটা টুপি।
টুপি?
হ্যাঁ, যে টুপি মানুষ অন্যকে পরায় সে টুপি নয়, সত্যিকারের একটা উলের টুপি। টুপিটা মাথায় পরে সুখের নিদ্রা।
তা আপনার সুখী দাম্পত্য জীবনের রহস্যটা কি?
অতি সহজ, হাঁ জী, হাঁ জী, করতে রহিয়ে।
ঠাকুর রামকৃষ্ণের পরবর্তী সাবধান বাণী—কুকুর। কুকুর হইতে সাবধান যখন কুকুর তেড়ে আসে কি ঘেউ ঘেউ করে তখন দাঁড়িয়ে মুখের আওয়াজ করে তাকে ঠাণ্ডা করতে হয়। তারপর ষাঁড়। গুঁতোতে এলে, তাকেও মুখের আওয়াজ করে ঠাণ্ডা করতে হয়। তারপর মাতাল। যদি রাগিয়ে দাও, তাহলে বলবে তোর চোদ্দ পুরুষ, তোর হেনতেন, বলে গালাগালি দেবে। তাকে বলতে হয় কি খুড়ো কেমন আছ? তাহলে খুব খুশি হবে, তোমার কাছে বসে তামাক খাবে।
সাবধান! কাদের থেকে সাবধান—বড়মানুষ, কুকুর, ষাঁড় আর মাতাল। সব এক গোত্রের।