সাফারিংস অব ইয়ং ওয়ার্দার (উপন্যাস)
আমি যথাসম্ভব যত্নসহকারে হতভাগ্য ওয়ার্দারের জীবনকাহিনী সংগ্রহ করে আপনাদের সামনে উপস্থাপিত করছি। জানি, এর জন্য আপনারা আমাকে অবশ্যই ধন্যবাদ দেবেন। তার মন ও চরিত্রের মহানুভবতার জন্য তাকে শ্রদ্ধা না করে পারবেন না। তেমনি তার দুর্ভাগ্যের জন্য চোখের জল না ফেলেও পারবেন না।
হে সদাশয় পাঠকবর্গ, যাঁরা হতভাগ্য ওয়ার্দারের মতোই দুঃখ ভোগ করেছেন, তাঁরা অবশ্যই তার দুঃখময় জীবনকাহিনী থেকে কিছু সান্ত্বনা পাবেন। এবং বইটি তাদের জীবনের পরম বন্ধুর মতো কাজ করবে যারা ভাগ্যক্রমে অথবা নিজ দোষে এর চেয়ে ভাল বই-এর সংস্পর্শে আসতে পারেননি।
প্রথম
মে ৪, ১৭৭১
এখান থেকে আমার পক্ষে চলে যাওয়াটা সত্যি কত সুখের। হে আমার প্রিয় অন্তরঙ্গ বন্ধুগণ, মানুষের অন্তর সত্যই বড় অদ্ভুত। তা না হলে যাদের আমি এত ভালোবাসি, যাদের সঙ্গে আমি এতদিন জড়িয়ে ছিলাম অবিচ্ছেদ্যভাবে, তাদের ছেড়ে যেতে এত আনন্দ হবে কেন? তবু জানি, এর জন্য আমাকে ক্ষমা করবে তোমরা। ভাগ্যক্রমে যাদের সংস্পর্শে এসেছিলাম তারা আজ কত দুঃখ পাচ্ছে আমার জন্যে। হতভাগিনী লিওনোর। তবু এতে আমার কিন্তু কোনও দোষ ছিল না। তার বোনের রূপসৌন্দর্য আমাকে মোহমুগ্ধ করেছিল ঠিক, কিন্তু তার বোনের মধ্যে আমার জন্য যে এক প্রেমগত দুর্বলতা গড়ে উঠেছিল ধীরে ধীরে, তার জন্য আমি কি করতে পারি? তথাপি আমি কি নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলতে পারি? তার সেই প্রেমানুভূতিকে আমি কি প্রশ্রয় দিইনি? তার প্রেমের স্বাভাবিক অভিব্যক্তিগুলো দেখে আমি কি আনন্দ পাইনি? মানুষের জীবন কত আশ্চর্য দেখো। নিজের অবস্থার শোচনীয়তার অনুশোচনা করার অধিকার তার আছে। তবে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি শুধু নিজের দুর্ভাগ্য বা দুঃখের কথাই বলব না, তার সঙ্গে আমার জীবনের অনেক জ্ঞাতব্য তথ্যও জানাব আপনাদের। আমি বর্তমানকে উপভোগ করব অতীত জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে। অতীত অতীতই থেকে যাবে। মানুষ প্রায়ই বিবর্ণ বর্তমানকে ছেড়ে কল্পনার পাখায় ভর করে বর্ণাঢ্য অতীতে উড়ে যেতে চায় বলেই তার দুঃখ অনেক বেড়ে যায়। আর তার মনটা এমনভাবে গড়া যে তা না গিয়ে পারে না সে।
দয়া করে আমার মাকে বলবে, আমি তার কথা যতদূর সম্ভব মেনে চলব এবং যথাশীঘ্র চিঠি দিয়ে সবকিছু জানাব। আমি আমার পিসিমার সঙ্গে দেখা করেছি। তার মেজাজটা কড়া হলেও তার অন্তরটা খুব ভালো। সম্পত্তির যে উত্তরাধিকার হতে আমরা বঞ্চিত আছি সে সম্বন্ধে আমার মার অভিযোগের কথা আমার পিসিমাকে আমি জানিয়েছি। তিনি তার কারণ আমাকে সব বুঝিয়ে বলেছেন এবং যে কোনও শর্তে তিনি সে সম্পত্তির অধিকার আমাদের উপর ছেড়ে দিতে পারেন এবং আমাদের দাবির থেকে বেশিও দিতে পারেন তাও বলেছেন। এত সব কথা এই মুহূর্তে বলব না। মাকে শুধু বলবে সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তার কোনও খারণ নেই। এ ব্যাপারে আমি একটা জিনিস ভালো করে বুঝেছি, মানুষে মানুষে আসল হিংসা ও প্রতারণার থেকে ভুল বোঝাবুঝিটা আরও ভয়ঙ্কর।
এখানকার নির্জনতাটা সত্যি ওষুধের মতো কাজ করছে আমার অন্তরের ক্ষতের উপর। আমার হিমশীতল অন্তরের কম্পমান সত্তাটার উপর বসস্ত তার নব-যৌবনের সব মধুর উত্তাপটুকু ঢেলে দিচ্ছে। থোকা থোকা ফুলের প্রাচুর্যে ফেটে পড়েছে প্রতিটি গাছপালা, বনঝোঁপ। যে কোনও দিকে একবার তাকালেই সৌরভের বিশাল সমুদ্রে মন ভাসতে থাকে। আর তার মধ্য থেকে প্রচুর পরিমাণে বাঁচার আনন্দ খুঁজে পাই।
শহরটা এমন কিছু ভালো নয়। তবে তার চারদিকের প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো বড় মনোরম। এই কারণেই বিগত কাউন্ট পাহাড়ের ধারে এর উপত্যকায় একটা চমৎকার বাগান তৈরি করেন। তার মাঝখানে একটা শান্তশীতল কুঞ্জ আছে। তিনি সেখানেই বেশি সময় থাকতেন। এখন আমি সেখানেই থাকি। বাগানের মালী আমাকে বড় ভালোবাসে। এই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধুত্ব করে ফেলেছে। একদিন আমিই হয়ত হয়ে উঠব এই বাগানের সর্বেসর্বা।
মে ১০.
বসন্তের সকালের মতো এক উজ্জ্বল আনন্দোফুল্লতা আচ্ছন্ন করে ফেলেছে আমার সমগ্র অন্তরাত্মাকে। এই শহরের এই মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে আমি একা এবং এ পরিবেশ যেন আমরই জন্য সৃষ্টি হয়েছিল। হে আমার প্রিয়তম বন্ধু, এক প্রশান্ত আত্মোপলব্ধির গভীরে আমি এমনভাবে ডুবে গিয়েছি যে আমার শিল্পগত কাজকর্ম মোটেই হয়ে উঠছে না। এসে থেকে আমি একটা রেখাও আঁকতে পারিনি। অথচ এত বড় শিল্পপ্রেরণা এর আগে আমি কখনও দেখিনি।
গভীর অন্ধকারে ঢাকা বনভূমির মাথার উপরে আকাশে যখন সূর্য কিরণ দিতে থাকে আর তার একটা রশ্মি গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে বনস্থলীর সবুজ বুকে তখন আমি লম্বা লম্বা ঘাসের উপর ছোট্ট পাহাড়ি নদীটার ধারে শুয়ে থাকি পা ছড়িয়ে। আমি তখন নদীর কলতানের সঙ্গে ঘাসের ভিতর উড়ে বেড়ানো কীটপতঙ্গের গান শুনি। এই সব অসংখ্য উৎফুল্ল কীটপতঙ্গের প্রাণচঞ্চলতার মধ্যে আমি সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অনুভব করি যিনি তাঁর মনের মতো করে আমাদের সৃষ্টি করেন। আর যখন শান্ত ধূসর গোধূলি নেমে আসে তখন বনভূমি ও তার চারপাশের জগতে, যখন সারা আকাশখানা তার বুকভরা নীল ভালোবাসা নিয়ে আমার বুকের উপর ঝুলে পড়ে কোনও প্রেমময়ী নারীর মতো তখন আমার মনের মাঝে শুধু একটা ইচ্ছাই জেগে ওঠে। মনে হয়, হায়,, আমি যদি আমার এই অভিজ্ঞতার কথা সব ব্যক্ত করতে পারতাম। মানুষের যে আত্মার স্বচ্ছ মুকুরে ঈশ্বরের সমস্ত অস্তিত্ব প্রতিফলিত হয় সেই আত্মার অব্যক্ত বাণীর মধ্যেই সকল মানুষ তার মর্মবাণী খুঁজে পায়। কিন্তু হে বন্ধু, এ দৃশ্যের কথা যথাযথভাবে প্রকাশ করা আমার সাধ্যের অতীত। আমি শুধু চোখে যা দেখছি তার মধ্যে নিজেকে বিনিয়ে দিচ্ছি। নিজে হারিয়ে যাচ্ছি।
মে ১২,
জানি এই মায়াবী বনভূমিতে কোনও দেবদূত নেমে আসে না অথবা এমনও হতে পারে, আমার মনের কল্পনার স্পর্শে স্বর্গে পরিণত হয়ে উঠেছে এই বনভূমি। এই শহরের বাইরে পাহাড়ের এক ঢালু সানুদেশে একটা ঝর্না আছে। ঝর্নাটা বেরিয়ে এসেছে একখণ্ড সাদা পাথর থেকে। ঝর্নার দুধারে লম্বা লম্বা গাছ। সে গাছের ছায়ায় শীতল হয়ে উঠেছে জায়গাটা। মেলুসিনা ও তার বোনদের মতো আমি মায়ার বাঁধনে। জড়িয়ে গেছি এই ঝর্নাটার সঙ্গে। আমি রোজ সেখানে গিয়ে অন্তত এক ঘণ্টা না থেকে পারি না। দেখতে দেখতে অপরাহের ছায়া গাঢ় হয়ে উঠতেই দূর গাঁ থেকে মেয়েরা জল নিতে আসে এই ঝর্না থেকে। একদিন রাজকন্যারাও ঝর্না থেকে জল নিয়ে যেত। অন্য সব মেয়েদের সঙ্গে। এই স্নিগ্ধ: শীতল ঝর্নাধারার কোনও অভিজ্ঞতা যার নেই তার মনুষ্যজন্মই একরকম বৃথা।
মে ১৩,
তুমি জানতে চেয়েছ আমার বইগুলো পাঠিয়ে দেবে কি না। আমি শুধু ঈশ্বরের ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই চাই না। তুমি শুধু সেই ভালোবাসার জন্য প্রার্থনা করবে। ঈশ্বরের কাছে। আমি আর কোনও মানুষ বা পুঁথিগত নির্দেশের দ্বারা চলতে চাই না। আমি শুধু আমার নিজের অন্তরাত্মার নির্দেশেই চলব এখন থেকে। আমি এখন শুধু একটা জিনিসই চাই, তা হলো ঘুমপাড়ানি গান। অনেকবার আমার বিক্ষুব্ধ অন্তরকে। শান্ত করে ঘুম পাড়াতে হয়। হে আমার প্রিয় বন্ধু, তোমাকে একথা নতুন করে বলার দরকার নেই। তুমি জান, তুমি দেখেছ, কতবার আমার খেয়ালী অন্তর গভীর দুঃখ। থেকে অমিত আনন্দের উত্তেজনায় ফেটে পড়েছে, কতবার আমার অন্তর এক মিষ্টি বিষাদ থেকে এক ভয়ঙ্কর আবেগের প্রবলতায় উত্তাল হয়ে উঠেছে। মানুষের অন্তরের মতো এত বন্ধুর, এত ক্ষণভঙ্গুর ও পরিবর্তনশীল আর কোনও বস্তু নেই। আমি সেই অন্তরকে এক রুগ্ন শিশুর মতো জ্ঞান করি। তার সব কামনা-বাসনা পূরণ করে চলি। তুমি কি ভাবতে এতে জানি না। তবে এমন অনেকে আছে যারা আমাকে এর জন্য কাছে পেলে তিরস্কার করবে রীতিমতো।
মে ১৫,
এখানকার তথাকথিত নিচু শ্রেণীর লোকেরা আমাকে এরই মধ্যে বেশ চিনে ফেলেছে এবং ভালোবাসতে শুরু করে দিয়েছে। বিশেষ করে তাদের ছেলেমেয়েরা খুব ভক্ত হয়ে উঠেছে আমার। কিন্তু প্রথম প্রথম যখন আমি তাদের কাছে যাই, নানারকম প্রশ্ন করে নানা কাত জানতে চাই তখন তারা আমাকে অবিশ্বাসের চোখে দেখে। ভাবে আমি উপহাস করছি তাদের সঙ্গে। আমি কিন্তু তাতে দমে না গিয়ে তাদের আরও কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। আমি জানতাম উঁচুতলার লোকেরা গভীর মানুষদের মধ্যে একটা হিমশীতল ব্যবধান বাঁচিয়ে রাখে। তাদের মধ্যে কিছু লোক আবার গরিবদের কাছে গিয়ে তাদের দূরবস্থা নিয়ে ঠাট্টা করে তাদের বেদনা বাড়িয়ে দেয়।
অবশ্য আমি এটা জানি যে ধনী-গরিব সমান নয়, এবং সমান হতে পারে না। তবে আমি বিশ্বাস করি যে যারা আত্মসম্মানের খাতিরে গরীব অন্ত্যজদের কাছ থেকে দূরে থাকে তারা সেই সব কাপুরুষদের মতোই হীন যারা পরাজয়ের ভয়ে শত্রুদের কাছ থেকে দূরে লুকিয়ে থাকে।
সম্প্রতি একদিন আমি যখন ঝর্নার দিকে বেড়াতে গিয়েছিলাম তখন একটি নিচু শ্রেণীর মেয়ে সেখানে ঘাটে নেমে তার কলসীতে জল ভরছিল। জল ভরা হয়ে গেলে সে চারদিকে তাকিয়ে দেখল সেখানে কেউ নেই। তার মাথায় কলসীটি তুলে দেবার মতো কাউকে না পেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঘাটের সিঁড়িতে। আমি তখন তার কাছে গিয়ে বললাম, চলো, আমি তুলে দিচ্ছি।
সে তখন প্রথমে আপত্তির সুরে বলল, না। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
আমি বললাম, নাও আর ভণিতা করতে হবে না। এই বলে তার মাথায় কলসীটা তুলে দিতে সে আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেল।
মে ১৭,
আমি অনেকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করেছি এখানে, কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধু এখনও পাইনি কাউকে। কিন্তু জানি না, কি আছে আমার মধ্যে যা এত লোককে আকর্ষণ করে আমার প্রতি। যদি বলো, এখনাকার লোকেরা কেমন, তাহলে বলব, এখানকার লোকরা আর পাঁচ জায়গার লোকের মতোই। বেশির ভাগ সময় তাদের রুজি রোজগারের চেষ্টাতেই কাটাতে হয়। তবে তারা মানুষ হিসাবে সত্যিই খুব ভালো। তাদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে বা নাচগানের আসরে যোগ দিয়ে বড় আনন্দ পেয়েছি।
হায়, আমার যৌবনের বন্ধুকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। আমি ভাবতেই পারিনি এত তাড়াতাড়ি সে চলে যাবে। আমার সমগ্র অন্তরাত্মার নিবিড়তা দিয়ে আমি আমাদের বন্ধুত্বকে মধুর ও প্রগাঢ় করে তুলেছিলাম। আমাদের দুজনের প্রেমানুভূতি ছিল যেমন সূক্ষ্ম, তেমনি আমাদের সম্পর্কে নিবিড়তা ছিল পবিত্র। সে আমার থেকে বয়সে কিছু বড় ছিল বলেই কি চলে গেল আমার আগে? আমি তাকে কোনওদিন ভুলতে পারব না। তার সংস্পর্শে ও সাহচর্যে আমার সত্তার পূর্ণতাকে নতুন করে অনুভব করি আমি।
দিনকতক আগে এক যুবকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। সে নিজেকে বড় পণ্ডিত পণ্ডিত তাবে। আমি গ্রিক জানি একথা শুনে সে আমাকে খুঁজে বের করে এবং কি কি বই পড়েছে তার কথা বলে।
আর একজন লোকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। লোকটি কোনও এক রাজকুমারের কর্মচারী। সে থাকে আমাদের শহর থেকে মাইলখানের দূরে এক বনের ভিতরে যেখানে তার মালিক প্রায়ই শিকার করতে যায়। তার স্ত্রীর মৃত্যুর পরই দুঃখে সে শহরের বাসা ত্যাগ করে বনবাসে গেছে। তার নয়টি ছেলেমেয়ে। তার বড় মেয়েকে নিয়ে ওরা বেশ মজা করে। তার বাড়িতে আমাকে যাবার জন্য নিমন্ত্রণ করছে।
এ ছাড়া আরও কিছু লোকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে বটে তবে তাদের আমি কোনওমতেই সহ্য করতে পারি না। আজ এইখানেই বিদায় নিচ্ছি।
মে ২২,
মানুষের জীবনটা যে স্বপ্ন তা আমি বেশ করেই বুঝেছি। অনেকেই অবশ্য এর আগে তা বুঝেছে। আমি বুঝছি আজ। যখন দেখি মানুষের কর্মশক্তি ও কর্মপ্রচেষ্টা কত সীমাবদ্ধ, যখন দেখি তার সকল যোগ্যতা ব্যয়িত করে তার প্রয়োজন চরিতার্থ হলেও তার অভাব যায় না জীবনে, যখন দেখি তার জীবনে সকল প্রয়াস, প্রতিশ্রুতি ও আশা ভরসা কুহেলিঘেরা স্বপ্নমোত্র তখন আমি সব আশা ছেড়ে দিই। নীরব হয়ে যাই। তখন আমার মনে হয় এই সমগ্র জগৎটা যেন এক বিরাট কারাগার, যে কারাগারে বন্ধ থেকেও তারা ভিতরকার দেওয়ালগুলোকে চিত্রিত করে চলেছি মূঢ়ের মতো। তখন আমি জগৎ থেকে প্রতিনিবৃত্ত হয়ে ফিরে আমি আমার নিজের মধ্যে। কিন্তু সেখানেও এক আশ্চর্য জগৎ। অতৃপ্ত কামনায় ভরা অস্পষ্ট সে জগতের অন্তহীন অন্ধকারে আমি হাতড়ে বেড়াই যেন।
শিক্ষক আর শিক্ষাবিদরা এ বিষয়ে একমত হবেন যে শিশুরা কি চায় তা তারা নিজেরাই জানে না। আমার মনে হয় বয়স্ক লোকেরাও তা জানে না। তবে সেই সব মানুষেরই সুখী যারা দুঃখের ভাত সুখ করে খায়। বড় মন নিয়ে ছোট কাজ সুষ্ঠুভাবে করে যায়। এ জগতে সুখী তারাই যারা আর পাঁচজন মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে পারে। যারা তাদের ছোট্ট বাগানটাকে স্বর্গের উদ্যানে পরিণত করতে পারে জীবন তারা বন্ধ জেনেও মুক্তির আনন্দ হতে বঞ্চিত হয় না কখনও। কারণ তারা জানে সে কোনও মুহূর্তেই তারা ইচ্ছা করলে বন্ধনকে মুক্তিতে পরিণত করতে পারবে।
মে ২৬,
তুমি হয়ত আগেই জেনেছ ঘুরতে ঘুরতে যে জায়গাটা আমার ভালো লাগে, আমি সেই জায়গাতেই তাঁবু খাঁটিয়ে বাস করতে থাকি। এমনি করে পথ চলতে চলতে হঠাৎ একটা জায়গা ভালো লেগে গেল আমার।
জায়গাটা সত্যিই বড় মনোরম। পাহাড়ের একটা গা। গাটার নাম ওয়ালহোম। গাঁ থেকে বার হলেই চোখের সামনে পড়বে বিস্তীর্ণ এক উপত্যকাভূমি।
আমি যার ঘরে উঠেছি তিনি হচ্ছেন এক বয়স্কা মহিলা। তাঁর মনটা বেশ উদার এবং মুখটা হাসিখুশিতে ভরা। মোটের উপর প্রয়োজনীয় সব কিছুই পাওয়া যায়। জায়গাটা বড় নির্জন আর শান্তিপূর্ণ। আমার বাসার পাশেই আছে দুটো বিরাট লিন্ডেন গাছ। চারদিকের শূন্য প্রান্তরের তাদের লম্বা লম্বা ডালপালা ছড়িয়ে আছে। আমি সেই গাছের নিচে টেবিল-চেয়ার পেতে কফি খাই, অনেক সময় আমার প্রিয় গ্রন্থ হোমার পড়ি। একদিন বেড়াতে বেড়াতে দেখি একটা চার বছরের দেহাতি ছেলে তার এক বছরের এক ভাইকে কোলে নিয়ে বসে আছে। দৃশ্য দেখে আমার এত ভালো লেগে যায় যে আমি সঙ্গে সঙ্গে আঁকতে শুরু করি।
আঁকতে গিয়ে আমার একটা কথা মনে হলো। মন হলো প্রকৃতির মধ্যেই আছে অফুরন্ত সৌন্দর্য আর সম্পদের ভাণ্ডার। অনন্ত সৌন্দর্যময়ী ও সম্পদশালিনী প্রকৃতিই কোনও শিল্পীকে সার্থক করে গড়ে তুলতে পারে। কোনও নিয়মকানুন তা পারে না। নিয়মকানুন মানুষকে কেতাদুরস্ত ও নীতিবাদী করে তোলে ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির প্রতি তার স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি স্বচ্ছ সুন্দর প্রকাশের পথটাকে রুদ্ধ বা জটিল। করে দেয়। যেমন মনে করো ভালোবাসার ব্যাপারটা। মনে করো কোনও একটি যুবক একটি যুবতাঁকে ভালোবাসে। সব সময় তার কাছে কাছে থাকে। তার প্রতিটি কর্মে ও আচরণে তার প্রেমাস্পদের প্রতি তার অকৃত্রিম প্রেমানুভূতির ও সততার পরিচয় দেয়। এমন সময় ধরো, কোনও লোক তাকে উপদেশ দিয়ে বলল, শোনো যুবক, তুমি ভালোবাস ক্ষতি নেই, কিন্তু কাজকর্ম সব বজায় রেখে অবসর সময়ে ভালোবাস, মেয়েটির কাছে অবসর সময়টা স্বচ্ছন্দে কাটাও। কিন্তু ভেবে দেখো, এই উপদেশ মানলে নিয়মকানুনের দ্বারা তার প্রেমানুভূতিকে খর্ব করলে তার প্রেমের সাবলীল গতিপ্রকৃতি কি ক্ষুণ্ণ হবে না?
মে ২৭,
আমার আবেগ আর বাগিতার স্রোতে ভাসতে ভাসতে অনেক দূর চলে গিয়েছিলাম। আমার ছবির বিষয়বস্তু সেই ছেলে দুটো সম্বন্ধে সব বলা হয়নি। মাঠের ধারে পড়ে থাকা একটা লাঙলের উপর বসে আমি ছেলে দুটোর ছবি আঁকছিলাম; বড় ছেলেটার নাম ফিলিপ। এইভাবে অনেকক্ষণ কেটে গিয়েছিল। অবশেষে বিকালের দিকে তার মা এল শহর থেকে। মেয়েটি বয়সে যুবতী এবং তার মাথায় ছিল একটা ঝুড়ি।
ছবি শেষ করে আমি বললাম, ফিলিপ, তোমার কাজ শেষ হয়ে গেছে। ফিলিপ তার ভাইকে কোলে করে একভাবে অনেকক্ষণ স্থির হয়ে বসে ছিল। তার মা আমাকে বলল, তার বড় ছেলেকে সঙ্গে করে শহরে গিয়েছিল দুটো জিনিস কিনতে। তার স্বামী সুইজারল্যান্ডে গেছে। সেখানে তার একক খুড়তুতো ভাই-এর কিছু সম্পত্তি পেয়েছে সে। কিন্তু বেশ কিছুদিন তার স্বামীর কাছ থেকে কোনও খবর বা টাকা-পয়সা পায়নি সে। তার ফলে বড় কষ্টে ছেলেদের মানুষ করতে হচ্ছে তাকে।
তবু দেখলাম, মেয়েটির কোনও ক্ষোভ না অভিযোগ নেই। সহজভাবে সহ্য করে চলেছে ভাগ্যের সব বিড়ম্বনা। জীবনের দুঃখময় দুঃসহ অস্তিত্ব হাসিমুখে প্রশান্তচিত্তে এইভাবে বহন করে চলার ক্ষমতা যাদের থাকে তাদের সে ক্ষমতা দেখে মনে বল পাই। আমার চিত্তের সব বিক্ষোভ, সব অশান্তি দূর হয়ে যায়। আমি দিনের শেষে সেদিন ছেলেগুলির হাতে একটি পেনি দিলাম। এরপর রোজ তাদের সঙ্গে দেখা হয়। আমি কফি খাবার সময় কিছুটা করে চিনি দিই। মাখন ও রুটি খাবার সময় তার অংশ দিই তাদের। আর প্রতি রবিবার তাদের হাতে দিই একটা করে পেনি।
মে ৩০,
ছবির সম্বন্ধে যে কথা বললাম, কবিতার সম্বন্ধেও ঠিক সেই কথা খাটে। আসলে কোনটা সুন্দর বা অসুন্দর কবিদের তা দেখার দৃষ্টি থাকা চাই আর তার প্রকাশ করার সাহস ও ক্ষমতা থাকা চাই। এ বিষয়ে আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলব। ঘটনাটা ঘটেছে ওয়ালহেম গাঁয়েই।
আজ একটি তরুণ চাষি যুবকের সঙ্গে আলাপ হলো আমার। সে এক বিধবা মহিলার অধীনে চাকরি করে। মহিলাটির যৌবন আর নেই, তবু তার স্বাস্থ্য এখনও অটুট আর বড় চমৎকার। তাঁর প্রথম স্বামী তার উপর পীড়ন করত বলে সেই দুঃসহ স্মৃতির বশবর্তী হয়ে উনি আর কাউকে বিয়ে করেননি। এবং স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে নিষ্ঠার সঙ্গে বৈধব্য জীবনযাপন করে চলেছেন। কিন্তু তার আচরণ বড় সৌজন্যপূর্ণ। মন বড় উদার। ছেলেটি বুঝতে পারে না, যে মেয়ের এত সুন্দর দেহমন সে কেন লাঞ্ছিত হতো তার স্বামীর দ্বারা। সে মহিলাটির বিভিন্ন গুণের অকুণ্ঠভাবে প্রশংসা করতে লাগল। মহিলাটির প্রতি তার আনুগত্য আর অব্যক্তনিবিড় প্রেমানুভূতির শীতল অন্তঃসলিলা আর মনটাকে স্পর্শ করল। তার কথা বলার আন্তরিক ভঙ্গিমা, তার কণ্ঠের সঙ্গতিপূর্ণ মাধুর্য, তার চোখের দৃষ্টির অবদমিত উত্তাপ–এই সব কিছুর মাধ্যমে সে তার যে মানসী ও অদৃশ্য আনন্দপ্রতিমাকে মূর্ত করে তোলার চেষ্টা করছিল, আমার মনে জেগে উঠল তার ছবি। তাকে দেখতে আমার ইচ্ছা হলো। কিন্তু পরক্ষণে ভাবলাম না, মেয়েটিকে কোনওদিন নিজের চোখে দেখব না। দেখব সেই ছেলেটির চোখে, সেই ছেলেটির অব্যক্ত প্রেমানুভূতির রঙে-রসে যে মেয়েটি অপরূপা ও অনিন্দ্যসুন্দরী হয়ে উঠেছে। সে আমার চোখের সামনে এলে হয়ত তাকে আর তেমন দেখাবে না।
জুন ১৬,
তুমি লিখেছ কেন আমি তোমাকে চিঠি লিখি না এখন নিয়মিত। তুমি বিজ্ঞ। তুমি নিশ্চয়ই ব্যাপরটা বুঝতে পারবে। আমি বেশ ভালোই আছি। আমি সম্প্রতি আমার মনের মানুষকে খুঁজে পেয়েছি। আমি তাকে ঠিক জানি না।
কথাটা একসঙ্গে বলে ফেলা সম্ভব হবে না আমার পক্ষে। আনন্দের আবেগে আমার মনটা এখন আমার কানায় কানায় ভরা বলেই হয়ত ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না আমি সব কথা ব্যক্ত করার। কি করে ঘটল ব্যাপারটা তা আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছি না।
সত্যিই এক দেবদূত। তুমি বলবে সব লোকই তার প্রেমাস্পদকে দেবদূত ভাবে। আমিও ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না কেন তাকে দেবদূত বলছি, কোন গুণের দিক থেকে পূর্ণতা অর্জন করেছে সে। তবু একথা সত্যি যে আমার সমগ্র অন্তরাত্মাকে আত্মস্থ করে ফেলেছে সে। বুদ্ধির সঙ্গে সরলতা, দয়ার সঙ্গে দৃঢ়তা, শান্তশীতল আত্মিক প্রশান্তির সঙ্গে উষ্ণনিবিড় এক প্রাণচঞ্চলতা, সব কিছু মিলেমিশে অতুলনীয় করে তুলেছে তাকে আমার চোখে।
কিন্তু এত কথা বলেও আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না। তার দেহের একটি অঙ্গেরও যথাযথ বর্ণনা দিতে পারছি না। অন্য সময় বলব। না না, অন্য সময় নয়, এখনি বলব। এখন না বললে আর কখনও বলা হয়ে উঠবে না।
আমি তাকে দেখে বিচলিত না হয়ে পারিনি। আর আটটি ভাইবোনের মাঝে তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই আমি। এখানে আমি সত্যি সত্যি সুখী উইলেম।
তোমাকে এর আগে একবার লিখেছিলাম এক রাজকর্মচারী তার বনমধ্যস্থ বাসভবনে আমাকে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। আমি যাইনি। হয়ত যেতাম না। কোনও দিনই, ঘটনাক্রমে যদি না একদিন হঠাৎ গিয়ে পড়তাম সেখানে।
সুযোগটা এসে গেল হঠাৎ। আমাদের পাড়ার ছেলেরা এমন একটা নাচের আসরের আয়োজন করেছিল যেখানে যেতে হলে সেই বন আর ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে হবে।
আমরা সেদিন একটি ঘোড়ার গাড়িতে করে রওনা হলাম আমাদের সঙ্গে জনকতক মহিলাও ছিলেন। তাঁরাও এই অনুষ্ঠান দেখতে যাচ্ছিলেন। আমার এক জ্ঞাতি ভাইও সঙ্গে ছিল। গাড়ি বনপথের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলল। আমার জ্ঞাতি ভাই বলল, দেখবে মেয়েটি কত সুন্দর। তাকে আমরা যাবার পথে তাদের বাড়ি থেকে তুলে নেব গাড়িতে। ওর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য শহরের একটি লোক চেষ্টা করছে।
ওদের বাড়ির কাছে গাড়িটা থামতেই একজন ঝি এসে বলল, লোত্তে এখনি আসবে। আমি গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঘরের ভিতর চোখ মেলে তাকাতেই তার রূপ দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেলাম আমি। অমন রূপবতী আমি কখনও দেখিনি আমার জীবনে। মেয়েটি আমাকে দেখে বলল, ক্ষমা করবেন, আমার জন্য আপনাদের কষ্ট করতে হলো।
সে তখন তার ভাইবোনদের জন্য রুটি কেটে সকলের হাতে দিচ্ছিল। আমি বুঝলাম তারই নাম লোত্তে। লোত্তে বলল, আমি যাবার জন্য পোশাক পরতে ও তৈরি হতে গিয়ে রুটি কাটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। অথচ আমি ছাড়া এ কাজ করার আর কেউ নেই।
তার কথার উত্তরে আমি কি বলব কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তার অপরূপ অঙ্গসৌষ্ঠব ও রূপলাবণ্য, তার মধুর কন্ঠস্বর ও নম্র আচরণে আমি বিমুগ্ধ ও বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। অভিভূত হয়ে পড়েছিল আমার অন্তর।
ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটটির নাম লুই। বয়স দু বছর। তার মুখখানা দেখতে বড় ভালো। আমি তার কাছে গিয়ে তার সঙ্গে ভাব করলাম। ওরা আমাদের পানে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। লোত্তের কথায় সে আমার করমর্দন করতে এলে আমি তাকে কোলে নিয়ে চুম্বন করলাম।
মেয়েদের মধ্যে লোত্তের পরের বোন সফি। লোত্তের অনুপস্থিতিতে তারই হাতে থাকবে সংসারের ভার। লোত্তে তাকে সব বুঝিয়ে দিল। দুটি ভাই বাইরে আমাদের গাড়ির পিছনে বসেছিল। ওদের বাবা ঘোড়ায় চেপে কোথায় বেড়াতে গেছেন।
লোত্তে এসে বসতেই আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিল। আমাদের জ্ঞাতি ভাই লোত্তেকে চিনত। সে লোত্তেকে বলল, যে বইটা পাঠিয়েছিলাম পড়েছ? লোত্তে বলল, আমার ভালো লাগেনি। আগের বইটাও ভালো লাগেনি। যখন ছোট ছিলাম সংসারের কোনও দায়িত্ব ছিল না, তখন যে কোনও উপন্যাস হাতে পেলেই পড়ে ফেলতাম বাছবিচার না করে। কিন্তু এখন সময় কম সুতরাং বাছাই করতে হয়। আমার ভালো লাগে সেই সব উপন্যাস যার মধ্যে আমি পাই আমার বাস্তব জীবনের সার্থক প্রতিচ্ছবি। সুখ-দুঃখ-আনন্দ বেদনায় ভরা যে পারিবারিক জীবন আমি যাপন করছি সেই ধরনের পারিবারিক জীবনের কথা যে সব উপন্যাসে থাকে সেই সব উপন্যাস সত্যিই খুব ভালো লাগে।
লোত্তের সব কথা আমার মনঃপূত হচ্ছিল না। তবু আমি তার কোনও প্রতিবাদ করতে পারছিলাম না। কারণ তার চোখ-মুখ ও কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে দারুণ মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তবে সে গোল্ডস্মিথের লেখা ভিকার অব ওয়েকফিল্ড নিয়ে যখন কথা বলল তখন তার প্রতিবাদ না করে আমি থাকতে পারলাম না। তাও অনেক পরে প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু সেকথা আর না বাড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল লোত্তে।
উপন্যাসের কথা ছেড়ে লোত্তে এল নাচের কথায়। নাচের প্রসঙ্গ তুলে সে আবেগের সঙ্গে বলল, নাচা বা নাচ দেখার আনন্দ যদি খারাপ হয় তাহলে আমি বলব নাচের থেকে ভালো শিল্প কি তা আমার জানা নেই। যত দুঃখেই পীড়িত হোক না আমার মন, পিয়ানোতে একটা নাচের সুর বাজাতেই সব দুঃখ দূর হয়ে যায় আমার।
যে যখন কথা বলছিল তখন আমি তার কালো চোখের পানে সর্বক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। তার উত্তেজিত ও মৃদুকম্পিত ওষ্ঠাধর, তার তপ্ত ও রক্তাভ গণ্ডদ্বয় আমার অন্তরাত্মাকে আকৃষ্ট করে রেখেছিল একান্তভাবে। আমি নিবিষ্ট মনে তার আদর্শের কথাগুলি শুনে যাচ্ছিলাম বিনা প্রতিবাদে। অথচ সে কথার মানে কি তা বুঝতে পারিনি। বুঝতে চাইনি। অবশেষে যখন গাড়ি এসে ঘটনাস্থলে থামল আর আমি নামলাম তখন আমার মনে হচ্ছিল এতক্ষণ আমি স্বপ্ন দেখছিলাম গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে ।
দুজন ভদ্রলোকে এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে গেলেন নাচের আসরে। নাচ শুরু হলো। লোত্তে প্রথমে নাচল অন্য জনের সঙ্গে। পরে আমার সঙ্গে কোয়াড্রিল নাচ নাচল। নাচতে নাচতে দেখলাম নাচের মধ্যে এমনভাবে ডুবে গেছে লোত্তে যে আর কোনও কিছু তার মনে নেই। মনে হলো জগত ও জীবনের আর সব কথা ভুলে গিয়ে পরিবার ও সমাজ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে শুধু নাচের মধ্যে ডুবে আছে।
নাচ শেষ হয়ে গেলে আমি তাকে আর একবার এই নাচ নাচতে অনুরোধ করলাম। সে বলল, একবার কেন দুবার নাচব। তবে তারপর ওয়ালৎস নাচ নাচতে হবে তার সঙ্গে। তার সবচেয়ে এই জার্মান নাচ ওয়ালস ভালো লাগে। তবে এই নাচে অংশীদার ভালো হওয়া চাই এবং সে নাচে বিশেষ দক্ষতার দরকার হয় বলে সকলে পারে না।
ওয়ালস নাচতে গিয়ে আমার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন লঘু হয়ে গেল আপনা থেকে। আমার আকাঙ্ক্ষিত যে পরমাসুন্দরী মেয়েকে আমি ধরে আছি, তার স্পর্শের মধুর নিবিড়তায় আমার দেহ যেন লঘু হয়ে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। আমার মনে হলো আমাদের দেহের কোনও ভার নেই। আমার আত্মা যেন এই লঘু দেহটা ধারণ করে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে যে কোনও জায়গায় উড়ে যেতে পারে। আমার মনে হলো আমার প্রিয়তমা লোত্তের হাত ধরে আমি এমনি করে অনন্তকাল ধরে নেচে চলতে পারি। নাচতে নাচতে সারা হলটা আমরা দুজনে ঘুর বেড়ালাম বাহুবদ্ধ হয়ে।
নাচ শেষ করে আমরা কিছু কমলালেবু খেলাম। লোত্তে নিজে বেশি না খেয়ে অন্য মেয়েদের দিয়ে দিল।
এবার লোত্তের সঙ্গে আমি তৃতীয়বার কোয়াড্রিল নাচতে শুরু করলাম। নাচতে গিয়ে তার চোখে দেখলাম এক সরল অনাবিল আনন্দের স্বচ্ছ সুন্দর প্রকাশ। মনে হলো, তার অন্তরের অসাধারণ শুচিতা ও পবিত্রতাই ফুটে উঠেছে সে চোখের আনন্দে।
এমন সময় একজন মহিলা এসে লোত্তের পানে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ‘আলবার্ত’ নামটা উচ্চারণ করল। এ নামের অর্থ আমি বুঝতে না পেরে সরলভাবে লোত্তেকে তা জিজ্ঞাসা করলাম।
লোত্তে আমার প্রশ্নের উত্তরে বলল, আলবার্ত আমার জীবনের অংশীদার হতে চলেছে। তার সঙ্গে আমার বিয়ের কথাটা একরকম পাকাপাকি হয়ে গেছে।
কথাটা আমি গাড়িতে মেয়েদের মুখ থেকে শুনেছিলাম। সুতরাং তা নূতন নয়। তবু আমার কানে যেন বিষ বর্ষণ করল কথাটা। আমার নাচের ছন্দের তাল কেটে যেতে লাগল বারবার। যদিও অবশ্য লোত্তে তা শুধরে নিতে লাগল।
নাচ তখনও সম্পূর্ণ শেষ হয়নি। এমন সময় শুরু হলো ঝড়, বৃষ্টি। আমরা পথে আসার সময় দিগন্তে মেঘ জমতে দেখেছিলাম। এখন সেখানে বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করেছে। বজ্রের গর্জনে আমাদের বাজনার সুর চাপা পড়ে যাচ্ছিল। পরে বাজনা থেমে গেল। নাচ বন্ধ হয়ে গেল। খোলা জানালা দিয়ে বিদ্যুতের চমক দেখে আর বজ্রের গর্জন শুনে মেয়েদের অনেকে ভীত হয়ে পড়ল। দুজনে পড়ে গেল মেঝের উপর। আবার অনেক ভয়ে তাদের নিজেদের জড়িয়ে ধরতে লাগল।
এমন সময় বাড়ির মালিক এসে আমাদের অন্য একটি ছোট্ট বন্ধ ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় বজ্রের আওয়াজ তেমন শোনা যাচ্ছিল না। লোত্তে বলল আমরা সংখ্যা গণনার খেলা খেলতে পারি। তোমরা সব গোল হয়ে বসে থাক। আমি তোমাদের চারদিকে ঘুরব। প্রথমে ধীরে, পরে জোরে। যার কাছে। যাব সে তার সংখ্যা বলবে। অর্থাৎ আগের লোকের যে সংখ্যা হবে, পরের লোকের হবে তার পরের সংখ্যা। কিন্তু কেউ যদি তার সংখ্যা আমি তার কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চটপট বলতে না পারে তাহলে আমি তার কান মলে দেব অথবা চড় মারব।
আমাদের সকলকে ঘিরে লোত্তে যখন খুব বেগে ঘুরতে লাগল তখন অনেকেই এবং দুবার আমি চড় আর কানমলা খেলাম। তবু বেশ মজা লাগছিল। খেলা শেষ করে লোত্তের সঙ্গে আমি আবার নাচঘরে গেলাম। তখন ঝড় থেমে গেল।
লোত্তে বলল, আমি ভীষণ ভীরু প্রকৃতির। কিন্তু পরকে সাহস দেবার জন্য তখন আমি সাহসের ভান করছিলাম।
এক জায়গায় লোত্তে তার কনুই-এর উপর ভর দিয়ে বসেছিল। আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম। সে বলল, তার একটা কবিতার কথা মনে পড়েছে। সে তখন জানালা। দিয়ে প্রকৃতির শোভা দেখছিল। আমি তার চোখপানে তাকিয়ে দেখলাম তার দুচোখ জলে ভরে গেছে।
তার চোখে জল দেখে আমার চোখেও জল আসছিল। আমি সেই জলভরা চোখের উপর থেকে তার একটি হাত টেনে ধরে চুম্বন করেছিলাম। আমি তাকে ধীরে ধীরে আমার জীবনকাহিনী শুনিয়েছিলাম। সে কাহিনী শেষ করে যখন বিছানায় শুতে গিয়েছিলাম তখন রাত দুটো বাজে। ৩৮৪ গোটে রচনাসমগ।
জুন ১০,
পরের দিন সকালকে বড় উজ্জ্বল আর মিষ্টি মনে হচ্ছিল। সকাল হতেই আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিল সকলকে নিয়ে। গাড়িতে আমি সর্বক্ষণ লোত্তের কালো চোখের পানে তাকিয়েছিলাম। সে হয়ত তখন তার বাড়ির কথা ভাবছিল। ভাবছিল। তার বাবা আর ভাইবোনদের কথা।
সে যখন গাড়ি থেকে নেমে গেল তখন আমি তাকে বললাম, আজই বিকালের দিকে আমি তাদের বাড়ি যেতে পারি। সে তাতে রাজি হয়ে মত দিল। তারপর থেকে কি যেন হয়ে গেল। সব ওলট-পালট হয়ে গেল আমার জীবনে। সেদিন থেকে আমার প্রায়ই মনে হতো চন্দ্র-সূর্য-নক্ষত্র সব থেমে গেছে আমার আপন গতিপথে। মনে হতো। রাত্রি-দিন বলে কিছু নেই।
জুন ২১,
এখন আমি প্রচুর আনন্দের মধ্যে আছি। ঈশ্বর যে আনন্দ একমাত্র সাধুসন্তুদের দান করেন সেই রকম আনন্দ আমি উপভোগ করে যাচ্ছি। আমি এখন ওয়ালহেম গায়েই বাস করছি পরম শান্তিতে। এখান থেকে লোত্তেদের বাড়ি মাত্র আধঘণ্টার পথ। অথচ আমি যখন এখানে-সেখানে যারাবরের মতো ওয়ালহেম গাঁটাকে পছন্দ করি তখন কিন্তু ভাবতে পারিনি এ গাঁয়ে এত আনন্দ পাব একদিন।
দেখো উইলেম, মানুষের মধ্যে আছে পরস্পর বিরুদ্ধ দুটো প্রবৃত্তি। একটা প্রবৃত্তির বশে সে নিজেকে প্রসারিত করতে চায়, সে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চায়। আর একটা প্রবৃত্তির বলে সে নিজেকে সঙ্কুচিত ও কেন্দ্রীভূত করতে চায় এক বিশেষ ধরনের প্রথাগত জীবনযাত্রার মধ্যে। সে তারই মধ্যে জীবনের আসক্তি খুঁজে পেতে চায়।
আমার কথাটাই ধরো। আমি যখন এ গাঁয়ে প্রথম আসি তখন এখানকার বন উপবন দেখে মনে হয়েছিল আমি তার শীতল ছায়ার সঙ্গে মিশে যাই। এখানকার পাহাড়-পর্বত দেখে মনে হয়েছিল আমি যেন ওদের মতো উঁচু হই, বিস্তীর্ণ উপত্যকাভূমির মতো আমার বুকটাও প্রসারিত হোক। কিন্তু আমি যখন সত্যি-সত্যিই। ওদের খুব কাছে গেলাম তখন দেখলাম ওরা যা ছিল তাই আছে। শুধু আমার চোখে। ছিল মায়ার কাজল। মানুষ তাই প্রথম জীবনে ঘুরে বেড়িয়ে পড়ে সে চায় এক নিশ্চিন্ত গৃহকোণ যেখানে সে তার সন্তানদল পরিবৃত হয়ে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর বুকের কাছে এক নিবিড় গার্হস্থ সুখ উপভোগ করতে পারবে।
আমি এখন রোজ সকাল হতেই সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তোমার ‘হোমার’ বইখানি নিয়ে আমার হোটেলের বাগানে গিয়ে এক গাছতলায় বসে পড়ি। পড়তে পড়তে তন্ময়। হয়ে পড়ি। তখন আমার আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় আমি খুব সুখী।
জুন ২৯,
গত পরশু যখন আমি লোত্তেদের বাড়িতে ছিলাম তখন শহর থেকে ডাক্তার আসে। তাদের বাবাকে দেখতে। আমি তখন মেঝের উপর ছড়িয়ে থাকা লোত্তের ভাইবোনদের সঙ্গে তাসের ঘর তৈরির খেলা খেলছিলাম।
ডাক্তার ভদ্রলোক শহরের লোক এবং ছেলেদের মোটেই পছন্দ করতেন না। তাছাড়া লোত্তেদের বাড়ির ছেলেরা নোংরা এবং বদমায়েশ একথা তিনি প্রায় পাঁচ জায়গায় বলে বেড়াতেন। আমি সেই নোংরা বদমায়েশ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলা করছি দেখে তিনি চলে গেলেন কোনও কথা না বলে।
আমার কিন্তু ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকতে বা খেলা করতে খুব ভালো লাগে। লোত্তের সঙ্গে তাদের বাড়িতে দেখা করতে গেলে দেখতাম সে কোনও কাজে ব্যস্ত তখন তার ভাইবোনদের সঙ্গে খেলা শুরু করে দিতাম। পৃথিবীতে যত জীবিত প্রাণী আছে তার মধ্যে শিশুদের আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। মানুষের সব ভালো গুণ তাদের মধ্যে ছোট আকারে দেখতে পাই আমি। তাদের একগুঁয়েমির মধ্যে আমি দেখতে পাই মানুষের চারিত্রিক দৃঢ়তার ক্ষুদ্রতর রূপ। হে ঈশ্বর, তুমি স্বর্গ থেকে। তোমার সকল সন্তানদেরই দেখতে পাচ্ছ। তাদের মাঝে আছে বড় শিশু আর ছোট শিশু। তবে তোমার পরম পুত্র বলে গেছেন তুমি কাজের থেকে বেশি আনন্দ পাও। যাই হোক, আজকের মতো বিদায় উইলেম। আজ তার কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
জুলাই ১,
আমার মনের অবস্থা এখন খুবই খারাপ। রোগশয্যায় কোনও রোগীর পাশে বসে থাকা মানুষের থেকে আমার বিষাদ অনেক বেশি। ঠিক হয়েছে লোত্তে দিনকতকের জন্য শাহরে যাবে তাদের কোনও এক আত্মীয়ের সেবা করতে। ভদ্রমহিলা শেষ সময় লোত্তেকে দেখতে চেয়েছেন।
গত সপ্তায় আমি লোত্তের সঙ্গে একটা ছোট্ট গায়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। গাঁটা এখান থেকে এক ঘণ্টার পথ। লোত্তে তার সঙ্গে তার দ্বিতীয় বোনকে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা সেখানে বেলা চারটের সময় পৌঁছলাম। আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছতেই একটি বুড়ো মানুষ বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ উঠে ছুটে আসছিল লোত্তের দিকে। মনে হলো লোত্তেকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সে নবজীবন লাভ করেছে। কিন্তু লোত্তে ছুটে গিয়ে তার। পাশে বসল। তার কোলের ছেলেটিকে আদর করল। বুড়োটির নাম প্যাস্টর। আমরা তারই বাড়ি বেড়াতে গিয়েছি। প্যাস্টর কানে কালা বলে লোত্তেকে খুব চিৎকার করে কথা বলতে হয়েছিল। প্যাস্টর বলছিল সে আর বেশিদিন বাঁচবে না। লোত্তে বলল, অনেক বলিস্ট যুবক অকালে মারা যাচ্ছে। আমি প্যাস্টরের স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করলাম।
বাড়ির বাইরে ছিল দুটো বিরাট কাজুবাদামের গাছ। তার ছায়া ভারা উঠোনটাকে ছেয়ে রেখেছিল। আমি গাছটার প্রশংসা করতেই প্যাস্টর আর ইতিহাস বলতে শুরু করল।
সে বলল, গাছটা কে বসিয়েছে তা জানি না। তবে ছোট গাছটা বসায় আমার স্ত্রীর বাবা। সে গাছের বয়স হলো আমার স্ত্রীর বয়সের সমান। তার মানে আমার শ্বশুর যেদিন সকালবেলায় এই গাছটা রোপণ করেন সেইদিন বিকালেই আমার স্ত্রীর জন্ম হয়। সে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের কথা। এ বাড়িঘর একদিন আমার শ্বশুরেরই ছিল। আমি এসেছিলাম আজ হতে সাতাশ বছর আগে। তখন আমি ছাত্র ছিলাম। আমাকে তিনি ভালোবাসতেন এবং পরে তাঁর মেয়েও আমাকে ভালোবাসতে থাকে। পরে একদিন আমিই এ বাড়ির মালিক হয়ে বসি।
লোত্তে প্যাস্টরের মেয়ের খোঁজ করতে লাগল। মেয়েটি তার সমবয়সী। প্যাস্টর বলল, তার প্রণয়ী স্কুমিদের সঙ্গে বেড়াতে গেছে মাঠ দিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্যাস্টারের মেয়ে ফ্রেদারিক ও স্কৃমিদ এসে গেল। লোত্তেকে দেখতে পেয়ে খুশি হয়ে এগিয়ে এসে হাত ধরল ফ্রেদারিক। আমরা একসঙ্গে বেড়াতে লাগলাম। কিন্তু ফ্রেদারিকের প্রণয়ী ছেলেটি আমাদের সঙ্গে আলোচনায় ভালো করে অংশগ্রহণ করল না। তাকে কেমন যেন অসামাজিক দেখাচ্ছিল। বিশেষ করে আমি যখন ফ্রেদারিকের। গাঁ ঘেষে বেড়াচ্ছিলাম তখন মুখখানা কালো হয়ে উঠেছিল তার। তা দেখে লোত্তে আমার হাতে চাপ দিয়ে তার লক্ষ্য করতে বলল।
সন্ধের সময় আমরা প্যাস্টরের বাড়িতে ফিরে এলাম সবাই। খাবার টেবিলে বসে আমরা যখন সুখ-দুঃখ সম্বন্ধে আলোচনা করছিলাম তখন আমি প্রসঙ্গক্রমে বললাম, আমরা সাধারণত আমাদের দুর্দিন বা দুঃখের দিনের জন্য অভিযোগ করি ঈশ্বরের কাছে। আমরা অভিযোগ করে বলি সুখের দিন কত কম। কিন্তু আমার যতদূর মনে হয় এ ধারণা, এ অভিযোগ ভিত্তিহীন। কারণ আমরা যখন কোনও সুখের দিন হাতের মুঠোর মধ্যে পাই তখন ভোলা মন নিয়ে যদি তা নিবিড়ভাবে উপভোগ করি, তার থেকে যে আত্মশক্তি পাব তা দিয়ে অনেক দুঃখ সহ্য করতে পারব। আসলে আমি ফ্রেদারিকের প্রণয়ীকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম। প্যাস্টরের স্ত্রী তখন বলল, কিন্তু আমাদের অনুভূতির উপর আমাদের সব সময় জোর খাটে না। কারণ এই সব অনুভূতি। দেহের উপর বেশি নির্ভরশীল। সুতরাং দেহ খারাপ থাকলে কোনও কিছুতেই আনন্দ পাই না।
আমি বললাম, তাহলে সেটা রোগ বলে ধরে নিতে হবে।
লোত্তে বলল, যদি আমার মনে কোনও দুঃখ, বিষাদ বা বিরক্তির ভাব আসে তাহলে আমি বাগানে গিয়ে একা-একাই একটা কোয়াড্রিল নাচ নাচতে থাকি। ফ্রেদারিক আমাদের কথা মনে দিয়ে শুনছিল। তার প্রণয়ীও শুনতে শুনতে একসময় প্রতিবাদের সুরে বলল, মানুষ সব সময় তার আবেগের উপর খরবদারি করতে পারে না।
আমি বললাম, অস্বস্তিকর আবেগের হাত থেকে সবাই মুক্তি পেতে চায়, এই অস্বস্তিকর আবেগের মাত্রা যদি বেড়ে যায় তাহলে সেটা রোগ বলে ধরে নিতে হবে এবং তার প্রতিকারের জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
আমি লক্ষ করলাম, প্যাস্টর আমাদের কথা মন দিয়ে শুনছে। আমি তাকে লক্ষ করে বললাম, যাজকরা বক্তৃতামঞ্চ থেকে মানুষের অনেক দোষের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেন। কিন্তু তাঁরা অহেতুক বিষাদ বা বদমেজাজের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেন না।
প্যাস্টর বলল, গ্রাম্য চাষিদের দোষ নেই। এ দোষ যদি থাকে তাহলে তা শহুরে লোকদেরই আছে এবং শহরের যাজকরাই তার বিরুদ্ধে প্রচারকার্য চালাবে। তবে মাঝে মাঝে এ বিষয়ে কিছু উপদেশ দিলে অবশ্যই আমাদের স্ত্রীরা উপকৃত হবে।
প্যাস্টরের কথায় সবাই হেসে উঠল। কিন্তু ফ্রেদারিকের প্রেমিক যুবকটি বলল, বিষাদ বা বদমেজাজ একট দোষ একথা আমার কাছে অত্যুক্তি বলে মনে হচ্ছে।
তার উত্তর আমি বললাম, মোটেই না। যার দ্বারা আমরা আমাদের নিজেদের ও অপরের আনন্দকে নষ্ট করি তার অন্য নাম কি হতে পারে বলুন? আমরা কাউকে সুখী না করতে পারি, তবে আনন্দ না দিতে পারি কিন্তু তার ছোট্ট সুখ বা আনন্দটুকুকে কেড়ে নেবে কোন অধিকারে বলতে পারেন? আচ্ছা আপনি কি এমন কোনও বিষাদগ্রস্ত বা বদমেজাজী লোকের নাম করতে পারেন যিনি তাঁর অন্তরের বিষাদময়তাকে অন্তরের মধ্যেই চেপে রেখে দিতে পারেন? অর্থাৎ যিনি তাঁর নিজের দুঃখানুভূতির কোনওরূপ অভিব্যক্তি না ঘটিয়ে অন্য কারও সুখ বা আনন্দের অনুভূতিকে নষ্ট করেন না? এ বিষাদ কি আমাদের নিজেদের প্রতিই এক বিরাগময় অর্থহীন আত্মভিমানের দ্বারা লালিত এক আত্মবিরূপতা নয় যা মানবচরিত্রের একটি দোষ ছাড়া কিছুই নয়?
লোত্তে আমার পানে তাকিয়ে হাসল। ফ্রেদারিকের চোখে এক ফোঁটা জল দেখে আমি উৎসাহিত হয়ে বললাম, যারা অপরের অন্তরের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দেকে কেড়ে নেয় তাদের ধিক, শত ধিক। যদি কারও একটি মুহূর্তের আনন্দ নষ্ট হয় তাহলে তার সে ক্ষতি পৃথিবীর কোনও দান কোনও সময় পূরণ করতে পারে না কখনও।
আমরা যেন প্রতিদিন এই কথাই সকলকে বলি যে যদি তোমার অপরের উপর প্রভাব বিস্তার করার কোনো ক্ষমতা থাকে তাহলে তার দ্বারা অপরকে আনন্দ দান করো বা সুখী করার চেষ্টা করো। অপরের অন্তরখানি কোনও কারণে দুঃখের দ্বারা পীড়িত হলে সে দুঃখের উপর কি কোনো শান্তির প্রলেপ লাগিয়ে দিতে পার?
হঠাৎ একটা কথা আমার মনে পড়ে গেল। একটি লোক তার স্ত্রীকে ভালোবাসত না। এইভাবে তাদের যৌবন কেটে যায়। কিন্তু মেয়েটির মৃত্যুকালে তার স্লান মুখ আর সকরুণ অবস্থা লোকটার মনে করুণা জাগায়। তার হঠাৎ মনে হলো তার স্ত্রীকে বাঁচাবার জন্য সে তার সব কিছু দিয়ে দিতে পারে।
আমাদেরও উচিত এইভাবে প্রতিটি ম্লান মুখে হাসি ফোঁটাবার জন্য তাদের নিরানন্দ অন্তরে এক ফোঁটা আনন্দ সঞ্চারের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করা।
আবেগের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার চোখে জল এসেছিল। আমি রুমালে চোখ ঢেকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। যাবার সময় লোত্তে আমায় ডাকতে আমার হুঁশ হলো। পথে লোত্তে বলল, তুমি বড় ভাবপ্রবণ। সব কিছুতেই এতখানি গুরুত্ব আরোপ করা উচিত নয়। এতে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। আমি তখন মনে মনে বললাম, তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্যই আমি বাঁচব হে কন্যা।
জুলাই ৬,
হে প্রায়ই তার মুমূর্ষ বন্ধু প্যাস্টরকে দেখতে যায়। আর একদিন দুই বোন মেরিয়ানে ও আমেলিয়াকে সঙ্গে করে গিয়েছিল। পথে আমি ওদের সঙ্গী হয়েছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে চলার পর পথে একটা ঝর্না পড়ল। আমরা সবাই সেই ঝর্নার ধারে গিয়ে বসলাম। স্বচ্ছশীতল জলের ধারা দেখে লোত্তের বোনরাও আনন্দিত হলো। ওদের সঙ্গে একটা গ্লাস ছিল। ঝর্নার জল পান করার জন্য মেরিয়ানে সেই গ্লাসটা বার করতেই ছোট্ট আমেলিয়া বলল, লোত্তে, তুমি আগে খাও। তার কচি মুখের আধো আধো কথা শুনতে আমার ভারি ভালো লাগল। আর আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে কোলে তুলে নিয়ে তার মুখে ও গালে আন্তরিকতার সাথে চুম্বন করলাম। মেয়েটি তাতেই কেঁদে উঠল।
লোত্তে তখন আমাকে বলল, তুমি অন্যায় করেছ। এই বলে আমেলিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে ঝর্নার ধারে নিয়ে গিয়ে বলল, এই জলে মুখটা ধুরে নাও নিজের হাতে। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আর আমেলিয়া তার কচি হাত দিয়ে জল তুলে তার গাল, মুখ সব ধুতে লাগল। লোত্তে বলল, এবার হয়েছে। তবু সে ধুয়ে যেতে লাগল। আমি তার মুখ চুম্বন করে যে কলুষ ও অপবিত্রতায় ভরে দিয়েছি সে মুখ তার যেন শেষ নেই।
এই ঘটনায় আমি দুঃখ পেয়েছিলাম। কথাটা কোন একজন লোককে বলি। সে বলে, লোত্তে সত্যিই খুব অন্যায় করেছে। এটা কুসংস্কার, বাচ্চা মেয়ের মুখ, বাইরের কোন লোক চুম্বন করলে সে মুখে দাড়ি গজায় বা মুখ অপবিত্র হয় এটা অন্ধ কুসংস্কারমাত্র।
আমার মনে হলো আমরাও অনেক সময় শিশুর মতো ভ্রান্তি বা মায়ার ছলনায় মুগ্ধ হয়ে ভুল করে বসি।
জুলাই ৮,
হায়, কি ধরনের শিশু আমরা। সামান্য দুটো চোখের দৃষ্টির জন্য কত লোভ আমাদের। আমরা সেদিন গাড়িতে করে ওয়ালহেম গাঁয়ে ফিরলাম। গাড়িতে কয়েকজন মহিলা ও দুটি যুবক ছিল। আর ছিলাম আমি আর লোত্তে। সব সময় সারা পথ ধরে শুধু লোত্তের পানে তাকিয়েছিলাম। শুধু লক্ষ করেছিলাম সে কোন দিক কখন তাকায়। কিন্তু একবারও সে আমার পানে তাকাল না। তার দৃষ্টি কেবল এদিকে-সেদিকে ঘোরাঘুরি করছিল। আমার কেবলি মনে হচ্ছিল তার কালো চোখের চতুর দৃষ্টিতে আমি এক নির্বোধ মাত্র। তার বাড়ির দরজার কাছে গাড়ি থেকে নেমে গেল লোত্তে। সে আমার মুখপানে একবার নীরবে তাকাল মনে হলো। কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না সে আমাকেই দেখল না অন্য কাউকে দেখল।
জুলাই ১০,
লোত্তের পাল্লায় পড়ে আমি এক বৃদ্ধ মহিলার বাড়িতে মাঝে-মাঝে যাই। বৃদ্ধা অনেকদিন ধরে ভুগছেন। এখন তার অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। লোত্তেকে তিনি স্নেহ করতেন। একদিন লোত্তের সামনে বৃদ্ধা এক স্বীকারোক্তি করলেন। বড় অদ্ভুত লাগল সে কথা। তাঁর স্বামী বরাবর অতিশয় কৃপণ প্রকৃতির ছিল। তার অবস্থা যখন খারাপ ছিল তখন সপ্তায় যা সংসার খরচ দিত, তার অবস্থা ভালো হলে অর্থাৎ কাজ-কারবারের উন্নতি হলেও সেই খরচই দিত। কোনও মতেই সে তার থেকে বেশি দিতে রাজি হয়নি। অথচ আগের থেকে সংসারের বহর বেড়ে যাওয়ায় খরচপত্রও বেড়ে যায় প্রচুর। তখন অগত্যা বৃদ্ধা ভদ্রমহিলাকে স্বামীর ক্যাশবাক্স থেকে প্রতিমাসে চুরি করতে হতো। এছাড়া কোনও উপায় ছিল না তার। মৃত্যুকালে একথা প্রকাশ না করে শান্তি পাচ্ছেন না তিনি মনে। তাই স্বীকারোক্তি করলেন।
জুলাই ১৩,
না, নিজেকে আমি ভোলাচ্ছি না, আমি সত্যিই তার চোখে স্পষ্ট দেখেছি আমার প্রতি এক অকৃত্রিম মমতাকে মূর্ত হয়ে উঠতে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি আমার নিজের অন্তরকে বিশ্বাস করি। সে আমাকে সত্যিই–হ্যায়, সে আমাকে ভালোবাসে। একথাটা মনে ভাবতেই নিজের কাছে নিজেকে মূল্যবান মনে হতে লাগল আমারও। একথা তোমাকে না বলে পারলাম না। কারণ তোমার বোধ শক্তি আছে, হৃদয় আছে।
আমি কিন্তু জানি না সে আমাকে ঠিক ভালোবাসে কি না। বুঝতে পারছি না আমার এই ধারণা দুঃসাহসের নামান্তর কি না। তবে লোত্তে যখন ভাবী স্বামীর কথা বলে তখন বেশ বোঝা যায় সে তাকে ভালোবাসে। সে ভালোবাসার সঙ্গে মিশিয়ে আছে অন্তরের উত্তাপ। তখন আমার খুব খারাপ লাগে। নিজেকে ছোট মনে হয়। বঞ্চিত মনে হয়।
জুলাই ১৬,
এক জায়গায় বসে কথা বলতে বলতে যখন আমার হাত বা হাতের আঙুল লোত্তের হাতে কোনওভাবে ঠেকে যায় তখন কেমন যেন একটা প্রবল আলোড়ন শুরু হয়ে যায় আমার সারা দেহ-মনে। আমার প্রতটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শিরায় শিরায় রক্ত উত্তাল হয়ে ওঠে। এক রহস্যময় অদম্য শক্তি তার দিকে অর্থাৎ তার আরও কাছে টেনে নিয়ে যায় আমায়। তার নিষ্পাপ সরলতা আমার বড় ভালো লাগে। তার মন কত পবিত্র। সে কথা বলতে বলতে আবেগের ঝোঁকে অনেক সময় আমার হাতে হাত দিয়ে বসে। কিন্তু বুঝতে পরে না তার প্রতিক্রিয়া কত ভীষণ আমার পক্ষে।
তবে আমার কাছে সে সত্যিই এক পবিত্র দেবদূতের মতো। সে আমার কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমারও দেহগত সকল কামনা-বাসনারা নীরব নিরুচ্চার হয়ে যায়। আমার সকল দুঃখ-বেদনা স্তব্ধ হয়ে যায়। সে যখন পিয়ানো বাজিয়ে গান গায়, তার গানের মিষ্টি সুরে আমারও হৃদয়ের যতসব অন্ধকার, যতসব ভ্রান্তি কোথায় যেন মুহূর্তে উবে যায়। নিজেকে তখন বড় হালকা মনে হয়। খুব সহজ মনে হয়।
জুলাই ১৮,
বলো উইলেম, প্রেম ছাড়া জীবনের কি অর্থ হয়? ম্যাজিক লণ্ঠনের মধ্যে বাতি না থাকলে তার যেমন অবস্থা হয়, প্রেম ছাড়া জীবনেও হয় সেই অবস্থা। অথচ ম্যাজিক লণ্ঠনের প্রভাবে সাদা পর্দার উপর যে সব রঙিন ছবি ফুটে ওঠে সেগুলো মিথ্যা অর্থহীন হলেও আমরা তা শিশুর মতো অবাক বিস্ময়ে দেখি। বিশেষ কারণে আটকে পড়ায় আজ আমি লোত্তেকে দেখতে যেতে পারিনি। আমার বালক ভৃত্যটাকে তার কাছে পাঠাই। ছেলেটার পথপানে তাকিয়ে অধীর অপেক্ষা করতে থাকি আমি। সে যখন ফিরে আসে তখন লজ্জায় বিরত না হলে তাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করতাম আমি।
শুনেছি বেলোগনা পাথর নামে এক ধরনের পাথর আছে যা সূর্যের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তুলে ধরে থাকলে তা সূর্যরশ্মিকে আকর্ষণ করে ধরে রাখে তার মধ্যে। আমরা বালক ভৃত্যটাকে সেই পাথরের মতো মনে হলো আমার। আমার কেবলি মনে হতে লাগল ও লোত্তের কাছে গেলে লোত্তে ওকে দেখেছে, কথা বলেছে। তার মধুর দৃষ্টির স্বর্গীয় দ্যুতি ঝরে পড়েছে ওর সারা দেহে এবং তা এখনও লেগে আছে। সে দ্যুতির স্পর্শে পবিত্র হয়ে আছে ওর সারা দেহ। সেই মুহূর্তে অসংখ্য মুদ্রার বিনিময়েও ছেলেটাকে ছাড়তে পারতাম না আমি। বলো উইলেম, সেই সময় আমি ছেলেটাকে দেখে ও তার সাহচর্য উপভোগ করে যে আনন্দ পেয়েছিলাম তা কি মিথ্যা? তা কি অর্থহীন?
জুলাই ১৯,
আজ আমি তাকে দেখতে যাচ্ছি। সকালে উঠে উজ্জ্বল সূর্যের সামনে তাকিয়ে চিৎকার করে কথাটা বলতে ইচ্ছা করছে আমার। আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। সারা দিনের মধ্যে আর কিছু করার ইচ্ছা নেই আমার।
জুলাই ২০,
তুমি আমাকে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিদেশে যেতে বলেছ। কিন্তু তোমার পরামর্শ মানতে পারলাম না। আমি নিয়ম-শৃংখলার কথা কিছু বুঝি না। আমরা সবাই জানি লোকটা ভালো নয়। তুমি লিখেছ আমার মা চান আমি কোনও একটা কাজে নিযুক্ত হয়ে পড়ি। কথাটা শুনে হাসি পেল আমার। আমি কি কাজে নিযুক্ত হইনি? এটা কি কাজ নয়? বাইরের কাজটাই কি সব? যে মানুষ নিজের কোনও না কোনও উচ্চাশা বা লাভ করার বাসনা ত্যাগ করে শুধু পরের জন্য খেটে খেটে জীবনপাত করে চলে সে বোকা।
জুলাই ২৪,
তুমি আমাকে ছবি আঁকার কথা প্রায়ই বলো। এ বিষয়ে আমি স্পষ্ট স্বীকার করতে চাই যে আমি একদিন কিছুই আঁকতে পারিনি।
প্রকৃতির কাছে গিয়ে আমি আনন্দ পেতাম। প্রকৃতির ঘাস-পাথর প্রভৃতি প্রতিটি বস্তুকে আমি ভালোবাসতাম। কিন্তু আমার পর্যবেক্ষণ শক্তি ভালো না থাকায় আমি আমার চোখের দেখা সেই সব প্রকৃতির বস্তুকে ঠিকমতো ফুটিয়ে তুলতে পারিনি অথবা তাদের সম্বন্ধে আমার মনের অনুভূত সত্যকেও প্রকাশ করতে পারিনি। ছবি আঁকার সময় আমার মনশ্চক্ষুর সামনে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যায়। আমার তখন মনে হয়। আমার হাতে একতাল কাদামাটি থাকলে আমি তাই নিয়ে কিছু একটা গড়তে পারতাম।
আমি তিন-তিনবার লোত্তের একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করি আর তিনবারই ব্যর্থ হই। তাতে আমার নিজের উপর রাগ হয়। অথচ কিছুদিন আগে আমি তা ভালোভাবেই পেরেছিলাম।
জুলাই ২৬,
আমি প্রায়ই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি এত ঘন ঘন তার কাছে যাব না। যাওয়া ঠিক নয়। কিন্তু হায়, এ প্রতিজ্ঞা আমি রাখতে পারি না। প্রতিদিনই আমি প্রতিজ্ঞা করি আর প্রতিদিনই আমি সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করি। লোত্তের কাছে যাওয়ার প্রলোভন আমি জয় করে পারি না। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে যাবার জন্য কোনও না কোনও যুক্তি খাড়া করি এবং কখন এক সময় তার কাছে গিয়ে পড়ি। কোনও কোনওদিন অবশ্য লোত্তের কাছ থেকে আসার সময় সে আমাকে বলে, কাল তুমি আসবে না? কি বলছ? এই ধরনের কথা শুনে কেউ কখনও ঠিক থাকতে পারে? না গিয়ে থাকতে পারে? অথবা যেদিন লোত্তে এসব বলে না বা যাবার জন্য কোনও অনুরোধ করে না সেদিনও দিনটা উজ্জ্বল হলেই আমি আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে তাদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছই। আমার ঠাকুরমা ছেলেবেলায় এক চুম্বক পাহাড়ের গল্প করতেন। সেই অদ্ভুত পাহাড়টা দূর থেকে জাহাজের লোহার পেরেকগুলোকে দুর্বার বেগে আকর্ষণ করত। জাহাজগুলোও সেই আকর্ষণে পাহাড়ে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে খান খান হয়ে যেত। আমারও আজ হয়ত সেই অবস্থা।
জুলাই ৩০,
আলবার্ত এসে গেছে, আমাকে এবার যেতে হবে। যদি মানুষ হিসাবে আলবার্তের মহত্ত্বকে শ্রদ্ধা করি আমি তথাপি আমার সামনে আমার প্রেমাস্পদের কাছে তার উপস্থিতিকে সহ্য করতে পারি না আমি কিছুতেই। আমারই সামনে সে আমার প্রেমের বস্তুকে করায়ত্ত করে ফেলবে এটা ভাবতেও পারি না আমি। অথচ ও তার ভাবী স্বামী। কথাবার্তা সব হয়ে গেছে। আর পাত্র হিসাবেও সব দিক থেকে যোগ্য আলবার্ত। তার গুণের জন্য আমিও তাকে পছন্দ না করে পারি না। কিন্তু তাহলেও আলবার্তকে যদি আমার সামনে অভ্যর্থনা জানাত লোত্তে তাহলে আমি তা সহ্য করতে পারতাম না। আমার অন্তর বিদীর্ণ হয়ে যেত। আলবার্তের আত্মসম্মান ও মর্যাদাবোধ বড় তীক্ষ্ণ। আমার সামনে সে কোনওদিন লোত্তেকে চুম্বন করেনি। লোত্তের প্রতি তার সংযত ও শোভন আচরণ দেখে তাকে আমি ভালো না বেসে পারি না। তাছাড়া আমার প্রতিও সে বন্ধুত্বের ভাব পোষণ করে। অবশ্য বলতে পার লোত্তে আমাকে কিছুটা পছন্দ করে বলেই হয়ত সে আমাকে ভালোবাসে। অনেক সময় মেয়েরা সম্ভব হলে তাদের দুজন গুণগ্রাহী বা প্রেমিককে পুষে রাখে, কারণ তাতে তাদেরই লাভ।
কিন্তু আলবার্তকে আমি শ্রদ্ধা না করে পারি না। তার শান্ত স্বভাব ও আচার আচরণ আমার চঞ্চল স্বভাবের সম্পূর্ণ বিপরীত। মনের চঞ্চলতা আমি কখনও দমন করে রাখতে পারি না। সে কখনও রাগে না বা মাথা গরম করে না, যেটা তুমি জান আমি মোটেই পছন্দ করি না।
আলবার্ত আমাকে বিজ্ঞ মানুষ বলে জানে। লোত্তের সঙ্গে মেলামেশা করে আমি আনন্দ পাই তা সে জানে। তুমি কিছু মনে করে না। অবশ্য আমার অসাক্ষাতে সে লোত্তেকে কিছু বলে কিনা তা জানি না।
সে যাই হোক, লোত্তের সাহচর্যে আনন্দ লাভের পথ বন্ধ হয়ে গেল। তার প্রতি আমার এই আসক্তির প্রবণতা কি নির্বুদ্ধিতা? যাই হোক, যাই বলল, সে সুখে থাকত জানি। আলবার্তের আসার আগেই এমন ঘটবে আমি জানতাম। আলবার্ত যখন এসে গেছে তখন লোত্তের উপর আর আমার কোনও আসক্তি নেই।
আমার নিজের অসহায়তা ও হতভাগ্য অবস্থায় আমি নিজেই তা-হুঁতাশ করি। আমি নিজেকেই উপহাস করি। যারা আমাকে এ অবস্থায় ধৈর্য ধরতে বলে অথবা মুখ। বুঝে সব নীরবে সহ্য করে যেতে বলে তাদেরও উপহাস করি আমি। আমি আজকাল সময় কাটাবার জন্য শূন্য মনে বনে বনে ঘুরে বেড়াই। বেড়াতে-বেড়াতে এক সময় লোত্তের বাড়িতে পৌঁছে যাই। দেখি তাদের বাগানে আলবার্ত তার পাশে রয়েছে। তাদের কাছে আমি অনেক সময় কোনও কিছু করার বা বলার না পেয়ে ভাঁড়ের মতো আজেবাজে কথা বলি এবং অভিনয় করি। তা দেখে লোত্তে নিজেই অস্বস্তি বোধ করে।
একদিন সে স্পষ্টই বলে আমায়, গতকালকার মতো ওরকম অভিনয় আর তুমি দেখিও না। আলবার্ত লোত্তের কাছ থেকে অন্য কোথাও না যাওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করি। লোত্তেকে একা পেয়ে আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচি।
আগস্ট ৮,
কিছু মনে করো না উইলেম, যারা আমায় ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দেয়, আমি তাদের দলে তোমাকে ধরিনি। তুমি যে এই ধরনের উপদেশ দেবে তা আমি ভাবতে পারিনি। জগতে ও জীবনে কখনও মানুষ একই সঙ্গে দুটো পথে চলতে পারে না। দুটো পথের মধ্যে একটাকে তাকে বেছে নিতেই হয়, কারণ একটা পথ ধরতে গেলেই অনেক আবেগ বা অনুভূতির স্তর অতিক্রম করতে হয়। তাই তোমার সব যুক্তি ও পরামর্শ ভালোভাবে বিবেচনা করে দেখার পরও আমি সেইমতো চলতে না পারি তাহলে কিছু মনে করো না যেন।
হয় লোত্তেকে পাবার আশা আছে আবার হয়ত তা নেই। যদি আশা থাকে তাহলে তাকে লাভ করার জন্য। আমার চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য আমাকে চেষ্টা করে যেতে হবে শেষ পর্যন্ত। আর যদি তা না থাকে তাহলে এই অস্বস্তিকর আবেগের হাত থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নিতে হবে। তা না হলে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাব আমি।
কিন্তু যন্ত্রণাকাতর কোনও মানুষকে কি তুমি যন্ত্রণার হাত হতে মুক্তি পাবার জন্য ছুরিকাঘাতে আত্মহত্যা করার পরামর্শ দেবে? যে রোগ থেকে এ যন্ত্রণার উদ্ভব হয় সে রোগ করি তার সব সাহস ও শক্তিও নষ্ট করে দেয় না?
তুমি হয়ত যুক্তি দেখিয়ে বলবে দীর্ঘ যন্ত্রণাভোগের থেকে অস্ত্রোপচার মেনে নেওয়া অনেক ভালো। দরকার বুঝলে আমাকেও তাই হয়ত করতে হবে।
আগস্ট ১০,
আমি যদি নির্বোধ না হতাম তাহলে এই অবস্থায় আমি প্রচুর সুখে-শান্তিতে দিন কাটাতে পারতাম। আনন্দোপভোগের এমন অনুকূল অবস্থা, এমন সুন্দর যোগাযোগ ঘটে ওঠে না কোনও মানুষের ভাগ্যে। একটি গোটা পরিবারের সকলের ভালোবাসা পাওয়া কি সহজ কথা? পরিবারের বৃদ্ধ কর্তা আমাকে আপন সন্তানের মতো ভালোবাসেন। পরিবারের ছেলেমেয়েরা সবাই আমাকে তাদের বাবার মতোই ভালোবাসে। লোত্তে নিজেও আমাকে সহাভূতির চোখে দেখে। আলবার্ত আমাকে পর বন্ধুর মতো ভালবাসে। সে আজ পর্যন্ত একটি মুহূর্তের জন্যও আমাকে দেখে বিন্দুমাত্র বিরক্ত হয়নি। আমার সুখে কখনও ব্যাঘাত ঘটায়নি সে। সবচেয়ে আমার ভালো লাগে আলবার্ট আর আমি দুজনে যখন পথ চলি আর আলবার্ট আমাকে শোনায় লোত্তের গুণের কথা তখন সত্যিই আমার চোখে জল আসে। আলবার্ত বলে, লোত্তের মা মৃত্যুকালে লোত্তের উপর সংসারের সব ভার দিয়ে যায়। তারপর থেকেই লোত্তে ঘোর সংসারী হয়ে ওঠে। সব ছেলেমেয়েরা তাকে মায়ের মতো জ্ঞান করতে থাকে। অথচ ঘর-সংসারের এত সব কাজকর্ম করেও তার বিরক্তি নেই মুখে। সব সময় হাসি লেগে আছে সে মুখে। লোত্তের গুণের এই সব কথা শুনতে শুনতে আমার চোখে জল আসত। আলবার্ট কিছুদিনের মধ্যেই কাউন্টের কাছ থেকে ডাকযোগে কিছু টাকা পাবে। তার মতো পরিশ্রমী ও নিষ্ঠাবান যুবক খুব কমই আছে।
আগস্ট ১২,
আলবার্ত সত্যিই বড় চমৎকার লোক। গতকাল অদ্ভুত একটি ঘটনা ঘটে। গতকাল তার বাড়িতে আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম তার সঙ্গে। আমি কিছুদিনের জন্য পাহাড় অঞ্চলে বেড়াতে যাচ্ছি। তার বাড়িতে গিয়ে আমি তার দুটো পিস্তল দেখে সে-দুটো চেয়ে বসি। বলি, ও দুটো আমায় ধার দাও। কিছুদিনের জন্য। পথে কাজে লাগতে পারে।
তখন আলবার্ত তার এই পিস্তলের গল্প বলতে থাকে। সে বলে, একবার সে তাদের গায়ের বাড়িতে তার কোনও এক বন্ধুর সঙ্গে তিন মাস কাল থাকে। এই পিস্তল দুটা তখন তার কাছেই ছিল। কিন্তু কোনও কাজে লাগেনি। কোনও প্রয়োজন হয়নি ওদের। কোনও এক বৃষ্টির দিনে হঠাৎ আমার মনে হয় আজ রাতে হয়ত দরকার হতে পারে। হয়তো কোনও চোর-ডাকাত আসতে পারে। এই ভেবে একজন চাকরকে। পিস্তল পরিষ্কার করতে বলি। সে পরিষ্কার করে গুলি ভরে ঝিদের ঠাট্টা করে ভয় দেখাতে থাকে। হঠাৎ একটি গুলি ফস্কে যায় আর তা একটি মেয়ের হাতে লাগে। সার্জন ডেকে তার চিকিৎসার সব খরচ দিতে হয় আমায়। সেই থেকে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি ওদের আমি ব্যবহার করব না। সেই থেকে ওরা পড়ে আছে এইভাবে। জানবে মানুষ সব বিপদ হতে আত্মরক্ষার সব ব্যবস্থা করে রাখতে পারে না। বিপদ যখন আসার আসবেই। তার কথা বলা শেষ হলে আমি একটা পিস্তল নাড়াচাড়া করতে করতে তার নলটা আমার মাথার কপালের কাছে ঠেকিয়ে ধরলাম। আলবার্ত আমার হাত থেকে পিস্তলটা কেড়ে নিয়ে বলল, এর মানে কি?
আমি বললাম, ওর ভিতরে গুলি নেই।
আলবার্ত বলল, তা হলেও এর কোনও মানে হয় না। মানুষ কিভাবে যে নিজেকে গুলি করে মারে তা আমি বুঝতে পারি না।
আমি বললাম, কোনও একটা কাজ ঘটলেই তোমরা সবাই ভালোমন্দ নাম দিয়ে বিচার করতে থাকো। কিন্তু কোন অন্তর্নিহিত প্রেরণার বশে মানুষটা সে কাজ করতে বাধ্য হলো তা তোমরা কেউ ভেবে দেখো না। সেখানে এত তাড়াতাড়ি বিচারের রায় দিতে হবে।
আলবার্ত বলল, কতকগুলো কাজ আছে বিশ্বাস করো, সত্যিই খারাপ, তার কারণ যাই থাক, যে কোনও দিক দিয়ে তা বিচার করা যাক।
আমি বললাম, তা হয়ত ঠিক বন্ধু, কিন্তু সেখানেও কথা আছে। মনে করো, চুরি করা পাপ কিন্তু যে মানুষ নিজেকে বা তার পরিবারকে অনশন আর মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবার জন্য চুরি করে, সে ঘৃণার যোগ্য না সহাভূতির পাত্র? কেউ যদি তার অবিশ্বাসী স্ত্রী ও তার অবৈধ প্রণয়ীকে রাগের বশে হত্যা করে তাহলে সে তাকে অপমান করবে? এমনকি আইনও অনেক সময় এই সব ঘটনার শাস্তিদানে বিরত থাকে।
আলবার্ত বলল, ওটা অন্য ব্যাপার। যে মানুষ আবেগের দ্বারা তাড়িত হয়ে কোনো কাজ করে তার কোনও যুক্তিবোধ বা চিন্তাশক্তি থাকে না। তার আচরণ তখন পাগল অথবা মাতাল লোকের আচরণের পর্যায়ে গিয়ে পড়ে।
আমি চিৎকার করে বললাম, তোমরা যুক্তিবাদীরা আবেগপ্রবণ লোকদের মাতাল ও পাগল বলে ঘৃণী করো। ঠাণ্ডা মাথায় এসব কথা বলা সহজ। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিও কারণ সে অবস্থায় তোমরা পড়নি। তবে দুনিয়ায় যারা বড় কাজ করছে বা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে তাদের লোকে পাগল অথবা মাতাল বলে বদনাম দিয়ে এসেছে।
আলবার্ত বলল, তুমি আবেগের বশে বাড়াবাড়ি করছ। আত্মহত্যার কথা আলোচনা হচ্ছিল। আত্মহত্যাটাকে কোনও মহৎ কাজের সঙ্গে তুলনা করা চলবে না। তুমি এইখানেই ভুল করছিলে। আসলে আত্মহত্যা কাজটা একটা দুর্বলতা ছাড়া কিছুই নয়। দুঃখের জীবন সহ্য করার থেকে মৃত্যুবরণ করা সহজ বলেই লোকে আত্মহত্যা করে থাকে।
আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল। এক উত্তপ্ত আবেগে অন্তর আমার পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তবু কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, তুমি এটাকে দুর্বলতা বলছ? যখন মানুষ প্রবল অত্যাচারে উৎপীড়িত হয়, যখন তার চোখের সামনে তার ঘরবাড়ি ভস্মীভূত হয়, তখন যদি সে এক নিরস্ত্র অবস্থায় আধ ডজন সশস্ত্র লোকের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমে পড়ে, তখন তার সেই মরিয়া ভাবটাকে দুবর্লতা বলবে?
আলবার্ত আমার মুখপানে তাকিয়ে বলল, কথাটাকে অন্যভাবে নিও না। তুমি যে সব দৃষ্টান্তের উল্লেখ করলে তা ঠিক এখানে প্রযোজ্য নয়।
আমি বললাম, আমার খাড়া করা সব যুক্তি যে অসার, এ অভিযোগ এর আগেও শুনেছি। যাই হোক, কথাটাকে অন্যভাবে বলা যেতে পারে। আমাদের উদ্দেশ্য হলো, আত্মহননেচ্ছু একটি মানুষের মনের প্রকৃত অবস্থাকে যথাযথভাবে ব্যক্ত করা।
আলবার্ত কিছু বলার আগেই আমি আরও বললাম, মানুষের প্রকৃতিটা এমন ভাবে গঠিত যে তার সহ্যের একটা সীমা আছে। সেই সীমা কোনোভাবে অতিক্রান্ত হলেই সে তা আর সহ্য করতে পারে না। তাহলে আসল কথা হচ্ছে মানুষের সহ্য শক্তির পরিসীমা যে কতখানি সবল বা দুর্বল তা নিয়ে এ ব্যাপারে তার কোনও বিচার চলবে না। দেখতে হবে পার্থিব-অপার্থিব যে সব দুঃখ সে পাচ্ছে তা সহ্য করার ক্ষমতা তার আছে কিনা। যদি না পারে তাহলে সে আত্মহত্যা করবেই। এক্ষেত্রে সে যদি সে দুঃখ সহ্য না পেরে আত্মহত্যা করে বসে তাহলে কোনওক্রমেই তাকে কাপুরুষ বলা চলবে না, যেমন কোনও দূষিত জ্বরের প্রকোপে কোনও কোনও লোক মারা গেলে তাকে কাপুরুষ বলা চলে না।
আলবার্ত বলে উঠল, তোমার কথা বৈপরীত্যমূলক।
আমি বললাম, যতটা ভাবছ তুমি ততটা নয়। যখন কোনও ভয়ঙ্কর রোগের আক্রমণ আমাদের দেহের সব শক্তিকে ক্ষয় করে ফেলে এবং সে ক্ষয় পূরণ হবার কোনও আশা থাকে না তখনই সে রোগকে আমরা মারাত্মক রোগ বলি। মানুষের মনও অনেক সময় এই ধরনের ভয়ঙ্করভাবে প্রবল ভাবাবেগের দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং সে। আক্রমণের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা তার থাকে না। কোনও সুস্থ ও বলিষ্ঠ মানুষ যেমন কোনও অসুস্থ রুগ্ন ব্যক্তিতে সৎ পরামর্শ দিয়ে তার রোগ সারাতে পারে না তেমনি কোনও প্রকৃতিস্থ মানুষ তার ঠাণ্ডা মাথায় যুক্তি দিয়ে অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মারাত্মক ভাববেগকে প্রশমিত করতে পারে না কোনওভাবে।
আমি বুঝলাম এসব কথা বলে আলবার্তকে আমার মনে আসল কথাটা ঠিক বোঝানো যাবে না। আমি তাই এক বিশেষ ঘটনার কথা বললাম। কিছুদিন আগে স্থানীয় একটা জলাশয়ে একটি মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া যায়। আমি তার সূত্র ধরে বললাম, কোনও এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে একটি কুমারী মেয়ে বাস করত। বাড়িটি রক্ষণশীল বলে সে কোথাও যেতে পারত না। শুধু রবিবার একটু ভালো পোশাক পরে কিছুক্ষণ বেড়াতে পেত। তারও আবার তার সমবয়সী বান্ধবীদের সঙ্গে। অন্যদিক শুধু সারাদিনের মধ্যে দু-এক ঘণ্টা কোনও প্রতিবেশিনীর সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলা ছাড়া অন্য কোনো আমোদ-প্রমোদের সুযোগ পেত না। আর কোনও কোনও উৎসবের দিন। কোনও নাচের আসরে যোগদানের সুযোগ পেত। এইভাবে যখন মেয়েটির দিন কাটছিল তখন একটি লোকের সঙ্গে আলাপ হলো এবং সেই আলাপ-পরিচয় ক্রমে। ঘনিষ্ঠতা ও পরে ভালোবাসায় পরিণত হলো। সব কিছু ভুলে লোকটিকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলল মেয়েটি। সারা জগৎ ও জীবনের মধ্যে সেই লোকটিই হয়ে উঠল তার একমাত্র আশ্রয়স্থল। কিন্তু তাদের ভালোবাসাবাসি যখন আদর-চুম্বন ও প্রতিশ্রুতির বিভিন্ন স্তর পার হয়ে চরমে উঠেছিল তখনই হঠাৎ একদিন লোকটি মেয়েটিকে ত্যাগ করে চলে গেল। নিতান্ত স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত জগৎ অন্ধকার হয়ে গেল মেয়েটির কাছে। তার মনে হলো, সমগ্র জগতের মধ্যে সে একেবারে একা। তার যে প্রেমাস্পদের সঙ্গে তার জীবনের অস্তিত্ব ছড়িয়ে পড়েছিল, সে প্রেমাস্পদ তাকে ছেড়ে দূরে চলে যেতেই তার অস্তিত্ব হয়ে গেল বিপন্ন। যে ভয়ঙ্কর বেদনায় প্রতিমুহূর্তে নিপীড়িত হচ্ছিল তার সমগ্র অন্তরাত্মা, সে বেদনার হাত হতে মুক্তি পাবার জন্য সে আত্মহত্যা করে বসল। এখন বলো আলবার্ত, মেয়েটির সেই জটিল মানসিক অবস্থা ও অন্তর্দ্বন্দ্ব কি দূরারোগ্য কোনও ব্যাধির মতোই ভয়ঙ্কর নয়?
অনেকে হয়ত বলতে পারে মেয়েটি কি বোকা? সে কিছুদিন নীরবে অপেক্ষা করলেই হয়ত তার বিক্ষুব্ধ চিত্তাবস্থা শান্ত হতো, হয়ত সে তার একজন প্রেমিক খুঁজে। পেত। কিন্তু আসলে কি এ কথার কোনও অর্থ হয়? কোনও লোক দূষিত জ্বরে মারা। গেলেও তাকে বলতে হয় সে আর কিছুদিন অপেক্ষা করলেই তার জ্বর সেরে যেত, সে তার ক্ষয় হয়ে যাওয়া জীবনীশক্তি ফিরে পেত। রক্তের সব তাপ ও উত্তালতা প্রশমিত হলে সে আবার বাঁচতে পারত।
তবু আলবার্ত আমার যুক্তি মানতে পারল না। সে বলল, আমি এমন এক সরলমনা মেয়ের কথা তুলে ধরেছি যার কোনও মানসিক শক্তি নেই। কোনও পরিণত বয়স্ক মানুষ যার যুক্তিবোধ প্রবল এবং মন শক্ত সে কখনও এ ধরনের কাজ করতে পারে না।
আমি তখন বললাম, দেখো, মানুষের যুক্তিবোধেরও একটা সীমা আছে। সেই যুক্তিবোধ দিয়ে সে তার চিত্তের সব ভাবাবেগকে শান্ত করে বা তার সব অন্তর্দ্বন্দ্বকে দমন করতে পারে না। যাই হোক, আজ আমি চলি। আসল কথা, এ জগতে সকলেই আপন আপন মনে চলে। কেউ কাউকে বুঝিয়ে তার স্বমতে আনতে পারে না।
এই বলে আমি আমার টুপিটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আলবার্তের ঘর থেকে।
আগস্ট ১৫,
ভালোবাসা ছাড়া মানুষকে এত আপন এত অত্যাবশ্যক আর কিছু করে তুলতে পারে না আমাদের কাছে। আমার মনে হলো লোত্তে আমাকে একেবারে ত্যাগ করতে পারবে না। লোত্তেদের বাড়ি আমি একদিন না গেলে চলে না। তার ভাইবোনেরা আমাকে রোজ যেতে বলে। আসার সময় বারবার বলে দেয় কাল সকালে এসো। যেন। আমি রোজ সকালে গিয়ে পাউরুটি কেটে তাদের সবাইকে ভাগ করে দিই। তারা আমার কাছে রূপকথার গল্প শুনতে চায়। অনেক সময় তাদের জন্য আমি গল্প বানিয়ে বলি।
আগস্ট ১৮,
ভাগ্যের কি পরিহাস। একদিন মানুষ যার থেকে কত আনন্দ পায়, পরে একদিন তাই দুঃখের কারণ হয়ে ওঠে তার কাছে।
আমি প্রকৃতিকে কত ভালোবাসতাম। প্রকৃতির যে সব বস্তু একদিন আমার এক চরম আনন্দে পরিপ্লাবিত করে তুলত আমার অন্তর, আজ তাদের দেখার সঙ্গে সঙ্গে বেদনায় পীড়িত হতে থাকে আমার সে অন্তর। আগে আমি যখন কোনও শান্ত গোধূলিবেলায় কোনও পাহাড়ের উপর বসে নদী ও প্রস্রবণবিধৌত উপত্যকাভূমির পানে তাকাতাম, কত অজানা পাখির সুর ঝরে পড়া ঘাসে ঢাকা প্রান্তরের উপর কত কীটপতঙ্গ উড়ে বেড়াত, তখন মুক্ত আকাশের তলে আমার চারদিকে পাহাড়ে উপত্যকায় বনে প্রান্তরে সৃষ্টির লীলাবৈচিত্র্য দেখে ও তার কথা ভাবতে ভারতে মুগ্ধ হয়ে যেতাম আমি। মনে হতো সৃষ্টির এই বিশাল ব্যাপক লীলাবৈচিত্রের পাশে আমি কত তুচ্ছ, কত নগণ্য। সঙ্গে সঙ্গে আমি এই বিশ্বসৃষ্টির বৈচিত্র্য থেকে পরম স্রস্টার চিন্তায় চলে যেতাম। তখন আমার চোখে দেখা প্রতিটি প্রাকৃতিক বস্তু আর প্রাণীর মধ্যে সেই পরম স্রষ্টার বিচিত্র প্রকাশকেই মূর্ত দেখতাম আমি। মনে হতো সেই এক অনন্ত পরম সত্তা বিচিত্ররূপে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে পাহাড়ে অরণ্যে প্রান্তরে, প্রতিটি প্রাণীর প্রাণচঞ্চলতায় ছড়িয়ে আছে। তাঁর সৃষ্টির আনন্দের একটা সামান্য অংশমাত্র আমাকেও বিভোর করে তুলছে।
আজ সেদিনের কথা ভাবতেও ভালো লাগছে। সেদিন যে অনির্বচনীয় আনন্দের। আবেগ অনুভব করতাম, আজ তার স্মৃতি আমার আত্মাকে দান করে এক মহান ভাবসমুন্নতি।
আজ আমাদের মনে আর সে অবস্থা নেই। আজ মনে হচ্ছে আমার মনের উপর যেন যুগান্তকারী এক যবনিকা তুলে দিয়েছে কে। অতীতে একদিন সৃষ্টির এক সর্বব্যাপী আনন্দকে পরিব্যাপ্ত দেখতাম সারা বিশ্ব জুড়ে, আজ সেখানে দেখি সাক্ষাৎ মৃত্যুর পর শূন্য বিশাল গহ্বর। আজ সর্বত্র সর্বক্ষণ বিশ্বসৃষ্টিতে ভূমিকম্প, জলোচ্ছাস, ঝড় প্রভৃতি ধ্বংসের লীলাটাকেই বড় করে দেখি। মনে হয় এ জগতে সব কিছুই অনিত্য, সব কিছুই পরিবর্তনশীল। মনে হয় বিশ্বপ্রকৃতি এক সর্বধ্বংসী বিরাট মহাকাল আর চির উন্মুক্ত করাল বদন প্রতিটি মুহূর্তরূপী কালখণ্ডকে গ্রাস করে যাচ্ছে অবলীলাক্রমে।
আগস্ট ২১,
এক-একদিন সকালে উঠেই তাকে ধরার জন্য দুহাত বাড়িয়ে দিই। রাত্রিতে ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে স্বপ্নের মধ্যে আমার বিছানায় তার খোঁজ করি। স্বপ্নে দেখি কোনও নির্জন প্রান্তরে আমি তার পাশে বসে আছি। তার একটা হাত ধরে আমি চুম্বন করছি বার বার। জেগেই উঠেই হতাশ হই। চোখ দিয়ে জল পড়ে। আমার অন্তর বেদনায় মোচড় দিয়ে ওঠে। অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভেবে আরও কান্না পায়।
আগস্ট ২২,
আমার অবস্থা খুবই খারাপ উইলেম। এই সদাচঞ্চল অর্থহীন চঞ্চলতায় আমার সব উদ্যম ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। চুপ করে বসে থাকতে পারছি না আমি। আবার কোনও কাজও করতে পারি না। আমার আর কল্পনাশক্তি নেই, প্রাকৃতিক সৌন্দযে আমার কোনও আগ্রহ নেই। বই পড়তেও ভালো লাগে না। প্রতিদিন একটা আশা নিয়ে জেগে উঠি। কিন্তু সে আশা কোথায় বিলীন হয়ে যায়। আলবার্তকে দেখে হিংসা হয়। কতবার মনে হয়েছে আমি তোমাকে সেই চাকরিটার কথা লিখি। সেই মন্ত্রী আমাকে অনেক দিন ধরে একটা চাকরি করার কথা বলছিলেন। আমার অবস্থা এখন রূপকথার সেই ঘোড়টার মতো যে তার অবাধ মুক্তিতে হাঁপিয়ে উঠে আবার লাগাম কাঁধে নিয়ে খাটতে চেয়েছিল এবং মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল তাকে তার ফলে। আমি কি করব ঠিক তা বুঝে উঠতে পারছি না। আজ আমি যে পরিবর্তন চাইছি তা হয়ত আমার মনের এক গভীর অস্থিরতারই ফল। এই অস্থিরতা থেকে আমার মুক্তি নেই।
আগস্ট ২৮,
আমার মনের রোগ যদি কেউ দূর করতে পারে তো এরাই পারবে। আজ আমার জন্মদিন। আজ সকালে আলবার্তের কাছ থেকে একটা উপহার পাই। সেই উপহারের প্যাকেটে ছিল একটা গোলাপ আর দুখানা বই। লোত্তেকে আমি যখন প্রথম দেখি এই রঙের গোলাপ তার বুকের উপর পরেছিল।
দুখানা বই-এর মধ্যে একখানা ছিল আমার বহু আকাঙ্ক্ষিত হোমারের ওয়েটস্লেন সংস্করণ। বইখানার কথা আমি একদিন বেড়াতে বেড়াতে বলেছিলাম আলবার্তকে। ওরা আমার মনের কথা বোঝে। তাকে কতখানি গুরুত্ব দেয়। জাঁকজমকপূর্ণ অন্য সব উপহারের থেকে এ উপহার আমার কাছে কত দামী। জীবনের কুঁড়ি কত ক্ষণভঙ্গুর উইলেম। কত কুঁড়ি অকালে ঝরে যায়, ম্লান হয়ে যায়। খুব অল্প কুঁড়িই ফুলে-ফলে পরিণত হয়। তবে কুঁড়িকে যেমন আমরা ভালোবাসি তেমনি পরিণত পাকা ফলকেও অবহেলা করা উচিত নয়। বিদায়, আজ এই পর্যন্ত থাক। এবারকার গ্রীষ্মটা ভালো লাগছে। আমি প্রায় দিন লোত্তেদের বাগানে লগা দিয়ে উঁচু ডাল থেকে পিয়ারা ফল পাড়ি আর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে লোত্তে তা কুড়িয়ে নেয়।
আগস্ট ৩০,
কী নির্বোধ, কী হতভাগ্য আমি! আমি কি নিজেকে প্রতারিত করছি না? এই অন্তহীন প্রেমাবেগের অর্থ কি? তাকে লাভ করার কথা ছাড়া আর কোনও কথা আমার মুখে আসে না। তার ছবি ছাড়া আর কোনও ছুবি ফুটে ওঠে না আমার মনে। জগতে যা কিছু দেখি লোত্তের সঙ্গে তাকে সম্পর্ক যুক্ত করে দেখি। যখন আমি লোত্তের পাশে দু-তিন ঘণ্টা ধরে বসে থাকি আর তার সুন্দর মুখ, থেকে ঝরে পড়া মিষ্টি কথা শুনি তখন মনে হয় যেন কোনও নরঘাতক আমার গলাটা চেপে ধরেছে। মনে হয় আমার কোনও অনুভব শক্তি নেই। মনে হয় আমি যেন আর ইহজগতে নেই। তারপর লোত্তে যদি দয়া করে তার হাতটা আমার চোখের জলে একবার ভিজিয়ে দিতে দেয় তাহলে আমার আর সেখানে না থেকে ছুটে পালিয়ে যাই। তখন আমি কোনও শূন্য বিশাল প্রান্তরে ঘুরে বেড়াই অথবা কোনও খাড়াই পাহাড়ে কষ্ট করে উঠতে থাকি। নিজেকে অকারণে ক্লান্ত করে বা কোনও কাঁপাঝোপে দেহটাকে ক্ষত-বিক্ষত করে অদ্ভুত একটা আনন্দ পাই। অনেক সময় রাত্রে বাসায় ফিরি না। ক্লান্ত দেহে পথেই শুয়ে থাকি। মাথার উপর মুক্ত আকাশে যখন চাঁদ ভাসতে থাকে আমি তখন কোনও নির্জন বনভূমিতে কোনও গাছের তলায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। হায় উইলেম, একমাত্র মৃত্যু ছাড়া আর আমার এ দুঃখের শেষ হবে না কিছুতে।
সেপ্টেম্বর ৩,
আমাকে অবশ্যই চলে যেতে হবে। তুমি আমার প্রস্তাব সমর্থন করেছ জেনে খুশি হলাম। তোমাকে ধন্যবাদ। এক পক্ষকাল ধরে আমি এ বিষয়ে মনস্থির করার চেষ্টা করি। তাকে ছেড়ে যেতেই হবে। সে আবার শহরে গেছে তার কোনও এক বন্ধুর কাছে।
সেপ্টেম্বর ১০,
হায়, আজকের এই রাত্রির কথা যদি আমি তোমাকে চোখের জলের মাধ্যমে ব্যক্ত করতে পারতাম। আমার অন্তরের সব আবেগ যদি প্রকাশ করতে পারতাম তোমার কাছে। আজ রাতে আমি যে কোনও বাধা অতিক্রম করতে পারব। আজ এই নিস্তব্ধ নিঝুম রাত্রির শান্ত বাতাসে বসে নিজের বিক্ষুব্ধ অন্তরে শান্ত করার চেষ্টা করছি। সকালের জন্য প্রতীক্ষা করছি। সকাল হলেই ঘোড়া ঠিক করে রওনা হব।
লোত্তে এখন শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। আমার চলে যাওয়ার কথা সে কিছুই জানে না। সে জানে না আর আমাকে সে কোনওদিন দেখতে পাবে না। আজই বিকালে তার সঙ্গে আমার কত কথা হয়েছে। আলবার্তও তখন ছিল। আজই বিকালে ওদের বাগানে বাদাম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আমি যখন সূর্যাস্ত দেখছিলাম তখন আলবার্ত ছিল না। বলেছিল ওরা একটু পরে রাতের খাওয়া সেরে আসবে। সামনে নদীবিধৌত উপত্যকাভূমিকে সূর্যাস্তের রং ছড়িয়ে পড়তে দেখছিলাম এ দৃশ্য আমি কতদিন এর আগে লোত্তের সঙ্গে দেখেছি। কী আশ্চর্য! এ দৃশ্য আমি লোত্তের সঙ্গে আমার পরিচয় হবার আগেই দেখতে ভালোবাসতাম আর আমার এই প্রিয় দৃশ্যটা লোত্তেও ভালোবাসত।
এই বাদামগাছের তলায় যেদিন আমি প্রখম আসি সেদিন আমার কেমন যেন ভয় লাগছিল। তার নির্জনতা ও নিস্তব্ধতায় হারিয়ে যেতে যেতে আমার কেবলি মনে হচ্ছিল আমাকে যেন অনেক দুঃখে পেতে হবে। আমাকে অনেক অনেক দুঃখবেদনা সহ্য করতে হবে।
আমি সেই গোধূলিবেলায় সেই বাদামগাছের তলায় দাঁড়িয়ে লোত্তেকে ছেড়ে যাবার কথা ভাবছিলাম, তাকে ছেড়ে যাবার বেদনাটাকে আপন মনে লালন করেছিলাম। এমন সময় আলবার্ট আর লোত্তে এসে হাজির হলো। লোত্তের পাশে আলবার্ত বসল। আমি ওদের সামনে বসলাম। আমি এক জায়গায় চুপ করে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না।
হঠাৎ লোত্তে এক সময় বলল, চাঁদের আলোয় একা একা বেড়ালেই আমার মৃত প্রিয়জনদর কথা যেন মনে পড়ে জান? আমরা হয়ত দীর্ঘদিন বেঁচে থাকব, কিন্তু আবার। কি আমাদের দেখা হবে? আমরা কি চিনতে পারব পরস্পরকে?
আমি লোত্তের একটা হাত চোখের জলে ভিজিয়ে দিয়ে বললাম, আবার আমাদের দেখা হবে লোত্তে। দেখা হবে ইহলোকে ও পরলোকে।
বলতে পার উইলেম, লোত্তে কেন আমার চলে যাবার কিছু আগেই ওকথা জিজ্ঞাসা করল?
লোত্তে আবার তখন আমায় জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আমাদের মৃত প্রিয়জনরা কি আমাদের কথা জানতে পারে? আমাদের ভালোবাসা কি তারা অনুভব করতে পারে? কতদিন নির্জন সন্ধ্যায় আমার মনে হয়েছে আমার মার আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার চারপাশে। অশ্রুসজল চোখ তুলে আমাদের পানে তাকিয়ে কতবার মনে হয়েছে মা কি আমার স্বর্গ হতে দেখছেন আমি তাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করে চলেছি কিনা। মনে মনে বলি, তা তুমি দেখে যাও আমি আমার ভাই-বোনদের কত ভালোবাসি। কত। সম্প্রীতি ও ঐক্যের মধ্যে বাস করছি আমরা।
তার সে কণ্ঠস্বর কেমন করে চিঠিতে বোঝাব উইলেম। আলবার্থ একবার বলল, তুমি বড় আবেগে অভিভূত হয়ে পড়েছ লোত্তে। এখন এসব কথা থাক। কিন্তু লোত্তে বলল, সেই সন্ধ্যার কথা মনে ভাব একবার আলবার্ত, যেদিন বাবা বাইরে গিয়েছিলেন,
যেদিন আমার ভাই-বোনদের সব ঘুম পাড়িয়ে আমি বসে প্রার্থনা করেছিলাম আর তুমি। বই পড়ছিলে। আমি প্রার্থনা করছিলাম ঈশ্বরের কাছে, আমার মার আত্মার কাছে যাতে । আমি মার কথা রাখতে পারি, যাতে আমি তার মতো হতে পারি।
আমি তখন লোত্তেকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ঈশ্বরের আশীর্বাদ ও তোমার মার আত্মার শুভেচ্ছা ঝরে পড়ুক তোমার উপর।
লোত্তে বলল, আমার মাকে তুমি দেখনি। দেখা হলে ভালো হতো। এটা সত্যিই দুঃখের কথা যে তাঁর মতো নারী অকালে চলে গেলেন পৃথিবী থেকে। কিন্তু তাতে কোনো দুঃখ ছিল না। তার একমাত্র দুঃখ ছিল শুধু তাঁর সন্তানদের জন্য। মৃত্যুকালে মা সব সন্তানদের ডাকলেন তাঁর কাছে। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। ছোটরা। তার অর্থ বুঝল না। তারপর আমার উপর তাদের দেখাশোনার ভার দিয়ে বললেন, বলো লোত্তে, এ ভার তুমি বহন করতে পারবে?
আমি আমার হাতখানি আশ্বাসের ভঙ্গিতে তাঁর হাতে তুলে দিলাম। তিনি তখন বললেন, জান এ প্রতিশ্রুতির অর্থ? মনে করবে আজ থেকে তুমিই হবে ওদের মা। ওদের সব কিছুর ভালো তোমার উপর। সেদিন বাবা বাড়িতে ছিলেন না। এ দুঃখ সহ্য করতে না পেরে তিনি বাইরে চলে গিয়েছিলেন। সেদিন সেই মুহূর্তে আলবার্ত তুমিও ছিলে সেখানে। তোমাকেও কাছে ডেকে আমাদের আশীর্বাদ করে দুজনকে যেন আমরা চিরদিন সুখে-শান্তিতে ঘর করি।
হঠাৎ কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আলবার্ত লোত্তের ঘাড়ে চুম্বন করে আবেগের সঙ্গে বলল, আজও আমরা তাই আছি লোত্তে।
আলবার্ত সাধারণত সংযমী, আত্মস্থ। কিন্তু সেদিন প্রথম তাকে আবেগের বশীভূত হতে দেখলাম। লোত্তে উঠে পড়ল। আমি তার হাতখানি তখনও ধরে রেখেছিলাম। আমি বললাম, আবার আমাদের দেখা হবে। সে যে আকারেই থাক না কেন আমরা চিনে নেব পরস্পরকে।
লোত্তে বলল, আবার কাল দেখা হবে হয়ত। কাল’ এই কথাটা শুনে আমার বড় দুঃখ হলো। সে জানত না আমার চলে যাবার কথা।
আমি সেইখানে স্তব্ধ ও বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। ওরা দুজনে চাঁদের আলোভরা উপত্যকার উপর দিয়ে হেঁটে গেল ধীর পদক্ষেপে। একটু দূরে গেলে আমি মাটির উপর শুয়ে কাঁদতে লাগলাম। কিছু পরে উঠে আবার এগিয়ে গেলাম। দেখলাম সাদা ফ্ৰকপরা লোত্তের মূর্তিটা বাগান পার হয়ে মিলিয় যাচ্ছে ওদের বাড়ির সদর দরজায়। আমি দুটো হাত শূন্যে বাড়িয়ে দিলাম।
অক্টোবর ২০,
আমি গতকাল এখানে এসেছি। রাষ্ট্রদূত অসুস্থ থাকার জন্য দিনকতক বাড়িতে বিশ্রাম করবেন। তিনি যদি নির্দয় না হন তাহলে সব ভালোভাবে চলবে। কিন্তু আমি দেখছি আমার দুঃখ আছে। তবু সাহস অবলম্বন করতে হবে আমাকে। হায়, আমার অন্তরটা যদি একটু হাল্কা হতো। হে ঈশ্বর! তুমি আমার এত প্রতিভা আর আবেগানুভূতির গুরুভার না দিয় আমায় যদি একটু আত্মবিশ্বাস দান করতে!
আর কিছুদিন ধৈর্য ধরো। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ঠিক বলেছ বন্ধু, আমি আমার চারপাশের জনগণের জীবনযাত্রাপ্রণালী নিজের চোখে দেখে অনেক শান্তি পাচ্ছি মনে। নিজের সুখদুঃখ আর পাঁচজন মানুষের সুখদুঃখের সঙ্গে তুলনা করে মনটা অনেক হালকা হয়। তাই নির্জনতার মতো এত ভয়ঙ্কর বস্তু আর কিছু হতে পারে না। আমরা নির্জনে থাকলেই কল্পনায় আমরা আমাদের থেকে সুখী ও আদর্শ মানুষের ছবি ফুটিয়ে তুলি মনের উপর। নিজেদের অপূর্ণতার কথা মনে করে কষ্ট পাই মনে মনে।
কিন্তু আমরা যদি আর পাঁচজনের সঙ্গে আমাদের অবস্থার তুলনা করে দেখি তাহলে দেখব আমরা অন্যদের থেকে খুব একটা পিছিয়ে নেই। ফলে তার থেকে। আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় আমাদের। মনে শান্তি ও স্থিরতা আসে।
নভেম্বর ১৩,
ধীরে ধীরে মনটা স্থির হয়ে আসছে আমার। বিচিত্র ধরনের মানুষ ও তাদের জীবনযাত্রা দেখে আমারও কাজ করতে ইচ্ছা জাগছে। বিভিন্ন রঙের ছাপ পড়ছে আমার মনে। জনৈক কাউন্টের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। তাঁর মনটা বড় উদার, বড় সহানুভূতিশীল। তাঁর মতো লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়াটা সত্যি ভাগ্যের কথা। প্রথম আলাপের দিনই আমার প্রতি আগ্রহ জাগে তাঁর মনে। আমার সঙ্গে রোজ কথা বলতে ও গল্প করতে চান। মহানুভব ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার থেকে আনন্দের কথা আর কিছু হতে পারে না।
ডিসেম্বর ২৪,
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই হলো। রাষ্ট্রদূত ব্যক্তি আমার যথেষ্ট বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বুড়ি মেয়েমানুষের মতো প্রতিটি খুঁটিনাটি ঘটনা নিয়ে বড় হৈ-চৈ করেন। যেসব লোক স্বভাবত অসন্তুষ্ট প্রকৃতির, কেউ তাদের কখনও সন্তুষ্ট করতে পারে না। আমার স্বভাব হচ্ছে সব কাজ তাড়াতাড়ি করা। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ফেলতে চাই আমি। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রদূত আমাকে বলেন আবার একবার ভালো করে দেখো। তাতে আমার মাথা গরম হয়ে যায়।
কিন্তু কাউন্টের বিশ্বাস আর ভালোবাসা আমার সব অভাব দূর করে দেয়। কাউন্ট তো একদিন আমায় স্পষ্ট বললেন, তিনি খুঁতখুঁতে স্বভাবের লোক, রাষ্ট্রদুত ভদ্রলোককে মোটে দেখতে পারেন না। এই ধরনের লোক সব কাজকে বেশি কঠিন করে তোলে। তবু আমাদের মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে। কোনও পথিকের সামনে পাহাড় পড়লে তার পার হতে হবেই।
আমাদের রাষ্ট্রদূত আবার আমার সঙ্গে কাউন্টের ভালো সম্পর্কটা ভালো চোখে দেখননি। তিনি এতে বিরক্ত বোধ করেন এবং সুযোগ পেলেই যখন-তখন আমার কাছে কাউন্টের নিন্দা করেন। আমি তার প্রতিবাদ করি আর তা করতে গিয়ে ব্যাপারটা আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে। গতকাল তার একটা কথা শুনে আমার প্রবল রাগ হয়ে যায়। তিনি বলেন কাউন্ট আর পাঁচজন সাহিত্যানুরাগী লোকের মতো অনেক বিষয় ভাসাভাসাভাবে জানেন। কিন্তু কোনও বিষয়ে গভীর ব্যুৎপতি বা পাণ্ডিত্য নেই। আমি তার প্রতিবাদ করে বলি কাউন্টের চরিত্র আর পাণ্ডিত্য দুটোই শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে আমাদের। তিনি নিজের দৈনন্দিন কাজকর্ম বজায় করেও অনেক বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছেন। এই বলে আর কথার উত্তাপ না বাড়িয়ে উঠে পড়লাম।
আজকের আমার এই অবস্থার জন্য তোমরাই দায়ী। তোমরা আগে শুধু কাজের কথা বলতে। যে লোকটা আলুর চাষ করে, শহরের বাজারে রোজ আলু বেচতে যায় তার সঙ্গে আমার তফাৎ কোথায়? এই সব অবাঞ্ছিত অস্বস্তিকর লোকদের মাঝে বসে কাজ করা কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার! ওদের মনের ভাবধারা কত সংকীর্ণ! এক ভদ্রমহিলা সবার কাছে তার দেশের বাড়ি আর বংশ পরিচয়ের গর্ব করেন। তিনি সামান্য এক কেরাণির মেয়ে। এতে তাঁকে যে সবাই বোকা ভাবে তা তাঁর খেয়াল নেই।
তবে কে কি করছে তা দেখার আমার কোনো দরকার নেই। কারণ এ ছাড়া ভাববার অনেক কিছু আছে আমার। তা যে যা খুশি করুক, আমি আপনার নিজের কাজ করে যাব।
সবচেয়ে আমার দেশের সমাজ ব্যবস্থাটা খারাপ লাগে আমার। অনেকের মতো আমিও মনে করি সমাজে শ্ৰেণীবৈষম্য তুলে দেওয়া উচিত। তবে যতদিন আমরা আমার মনে সুখশান্তি ছিল ততদিন এ বিষয়ে কোনও কিছু ভাবিনি। সেদিস এক যুবতীর সঙ্গে আমার আলাপ হয়। মেয়েটি তার পিসির কাছে থাকে। পিসি ভদ্রমহিলা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। কিন্তু বর্তমানে গরিব হয়ে গেছেন। এখন শুধু বংশ ছাড়া বড়াই করার মতো কিছুই নেই। তার চেহারাটার মতো মন-মেজাজও খারাপ। তিনি সবাইকে ঘৃণার চোখে দেখেন। তিনি এক অফিসারকে বিয়ে করেন। কিন্তু ভদ্রলোক কিছুকাল আগে মারা যাওয়ায় এখন তিনি বিধবা। সম্পূর্ণ একা। এখন তাঁর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মনোভাবটাও অনমনীয় হয়ে উঠেছে।
জানুয়ারি ৮,
কতকগুলো মানুষ আছে যারা প্রথাগতভাবে তাদের কাজকর্ম চিরকাল যথারীতি করে যেতেই ভালোবাসে। যাদের জীবনে লক্ষ্য ও ভাবধারার কোনও পরিবর্তন হতে চায় না কখনও। তারা কোনও সুযোগ পেলেও গ্রহণ করতে চায় না। গত সপ্তায় একজনের সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়ে যায়। যারা আসন বা পদটাকে গুরুত্ব দেয় তারা বোকা। রাজাদের পদ সবচেয়ে বড় হয়েও মন্ত্রীদের দ্বারা চালিত হয় আর মন্ত্রীরা চালিত হয় তাদের সচিবদের দ্বারা। যারা বুদ্ধি ও চাতুর্যের দ্বারা অন্যদের নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কাজে লাগাতে পারে, তারাই মানুষ।
জানুয়ারি ২০,
আজ আমি তোমাকে চিঠি লিখব লোত্তে। ঝড়ের প্রকোপ হতে নিজেকে বাঁচাবার জন্য আজ এই পান্থশালাটার একটা ছোট্ট ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আজ এখান থেকেই চিঠি লিখব তোমায়। আমি যখন শহরের পথে এগিয়ে চলেছিলাম আর পাঁচজনের সঙ্গে তখন তোমার কথা মনে হয়েছিল আমার। তারপর ঝড় উঠতেই এলাম। ঘরে ঢুকতেই তোমার ছবি ভেসে উঠল মনে।
আজ যদি তুমি আমায় দেখতে তাহলে একেবারে অবাক হয়ে যেতে। আজ আমার মনে আর সেই আবেগের বন্যা নেই। সব শুকিয়ে গেছে। আজ আমার মনের মধ্যে কোনও আবেগ বা অনুভূতিকে লালন করার মতো সময় নেই। ফ্রলিন নামে একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে আমার। তাকে দেখতে তোমার মতো। সে বলে আমার আচরণ নাকি খুব দ্র ও মাজির্ত। মাঝে মাঝে আমরা দুজনে বসে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করি। তোমার কথা বণি আমি প্রায়ই। সে তোমাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে।
হায়, আজ ঠিক এই মুহূর্তে আমি যদি তোমাদের সেই ঘরে বসে থাকতাম তোমার কাছে। তোমার ভাই-বোনেরা খুব বেশি জ্বালাতন করলে আমি তাদের ডেকে বেশ কেমন একটা রূপকথার গল্প শোনাতাম। এখন বরফে ঢাকা প্রান্তরের উপর সূর্য অস্ত যাচ্ছে। ঝড় সবেমাত্র শেষ হয়েছে। আমাকে এরই মধ্যে ঘরের খাঁচায় ঢুকতে হবে? আলবার্ট কি এখন তোমার কাছেই আসবে? বিদায়! কেমন আছ তোমরা?
ফেব্রুয়ারি ১৭,
আমার ভয় আমি আমার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বেশিদিন মানিয়ে চলতে পারব না। ভদ্রলোক সত্যিই অসহ্য। তাঁর কাজ করার পদ্ধতিটি একেবারে হাস্যকর, কথায় কথায় তাঁর কাজের প্রতিবাদ না করে পারি না। আর আমি প্রায়ই নিজের মতো করে কাজ করে যাই যা তাঁর মোটেই ভালো লাগে না। সম্প্রতি তিনি রেগে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন মন্ত্রীর কাছে। আমি তাতে আমার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিই। মন্ত্রী তখন ব্যক্তিগত পত্র মারফৎ আমাকে ডেকে পাঠান। আমাকে শান্ত হতে বলেন। অনেক করে বোঝান। তার মনটা সত্যিই উদার এবং মহৎ। এখন আমি অনেকটা আত্মস্থ হতে পেরেছি। এর মতো শান্তির আর কিছু হতে পারে না।
ফেব্রুয়ারি ২০,
ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন। যে সুখ আমার কেড়ে নিয়েছেন সে সুখ যেন তোমরা পাও।
আলবার্ত, তুমি আমাকে ঠকিয়েছ। আমি আশা করেছিলাম তোমার বিয়ের খবরটা জানাবে। তাহলে সেদিন আমি আমার ঐ দেওয়ালে টাঙানো লোত্তের ছবিখানা নামিয়ে আমার পুরনো কাপজপত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখতাম। তোমাদের বিয়ে যখন হয়ে গেছে তখন ও ছবিটার ওখানে থাকার কোনও আর অর্থ হয় না। আবার ভাবি থাকণেই বা। আমি তো লোত্তের অন্তরে তোমার পাশেই বিরাজ করছি। লোত্তে যদি আমাকে ভুলে যায় তাহলে হয়ত পাগল হয়ে যাব আমি। এই ধরনের নাটকীয় চিন্তা যেন আমার মনে না আসে। বিদায় আলবার্ত। বিদায় লোত্তে।
মার্চ ২৫,
এখানেও আমি এমন এক দুঃখের কবলে পড়েছি যে এখান থেকে চলে যেতে হবে আমায়। আমার নিজের দাঁত নিজেই ভাঙতে ইচ্ছে করছে। এর কোনও প্রতিকার নেই। সব দোষ তোমাদের। তোমরাই আমাকে এমন এক পদ গ্রহণ করতে বাধ্য করেছ যে পদ গ্রহণ করতে মন আমার চায়নি। কিন্তু তোমরা যাতে আমাকে দোষ দিতে না পার, যাতে বলত না পার আমার আবেগের আতিশয্য সব কিছু মাটি করে ফেলেছে তার জন্য আমি একটা কাহিনীর উল্লেখ করছি।
আমি তোমাদের আগেই বলেছি কাউন্ট আমাকে ভালোবাসেন। গতকাল তাঁর বাড়িতে সম্ভ্রান্ত অভিজাত পরিবারের লোকজনের উপস্থিতিতে সমৃদ্ধ এক ভোজসভায় যোগদান করি। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম এ ধরনের ভোজসভায় আমার মতো লোকের যোগদান করা সাজে না। আমি হলঘরে কাউন্টের সঙ্গে পায়চারি করতে করতে কথা বলছিলাম। এমন সময় কোনও এক মহিলা তার স্বামী ও কন্যাকে নিয়ে ঢুকলেন। এ পরিবেশ আমার ভালো লাগছিল না। আমি চলে যাবার কথা ভাবছিলাম, এমন সময় ফ্রলিন নামে আমার পরিচিত সেই মেয়েটি এল। তাকে দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। কিন্তু সে অন্যদিনকার মতো প্রাণ খুলে কথা বলল না আমার সঙ্গে। এর কারণ আমি বুঝতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম না ফ্রলিন এই ধরনের পরিবেশ ভালোবাসে কি না। চলে যেতে গিয়েও যেতে পারলাম না আমি। এদিকে একের পর এক তথাকথিত সম্মানিত অতিথিরা আসতে লাগল। ব্যারন, কর্নেল, কাউন্ট প্রভৃতি কত সব উজ্জ্বল পোশাক পরা গণ্যমান্য অভিজাত সমাজের ব্যক্তিরা। আমি ক্রমশই হাঁপিয়ে উঠছিলাম। মহিলারা আমার অবস্থা দেখে এক কোণে নিজেদের মধ্যে কি সব বলাবলি করছিল। কাউন্ট একসময় আমাকে জানালার ধারে নিয়ে নিয়ে বললেন, ওঁরা তোমাকে এখানে দেশে বিস্ময় ও অস্বস্তি বোধ করছেন। কিন্তু আমি কিছুই–। আমি তখন কাউন্টকে বললাম, আমি আগেই এটা অনুভব করেছি। আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি যাচ্ছি। কাউন্ট সহানুভূতির সঙ্গে আমার হাতে চাপ দিলেন। আমি সভা থেকে অসময়ে বিদায় নিয়ে বাইরে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। বাইরে এসে একটা ঘোড়ার গাড়িতে করে পাহাড়ে সূর্যাস্ত দেখতে চলে গেলাম। হোমার পড়তে লাগলাম।
সন্ধের সময় আমি আমার হোটেলে ফিরে এসে রাতের খাওয়া খেলাম। অ্যাডেলিন এসে আমাকে বলল, তুমি খুব রেগে গিয়েছিলে। কাউন্ট তোমাকে সভা। ত্যাগ করতে বলেছিল। আমি বললাম, বাইরের আলো-হাওয়ায় এসে আমি খুশি হই। কিন্তু অ্যাডেনিল বলল, আমার খারাপ লাগছিল। ওরা সবাই তোমার কথা বলাবলি করছিল। এতে আমার রাগ আরও বেড়ে যায়।
এইভাবে আমি দুষ্ট গ্রহের মতো যেখানে যাচ্ছি সেখানেই সবাই করুণা করছে। তুচ্ছ ভাবছে। ওই সব অপদার্থ অহঙ্কারী লোকগুলো অকারণে আমার সম্বন্ধে যা তা বলবে এটা আমি চাই না। কোনও লোকই তা সহ্য করতে পারে না।
মার্চ ১৬,
আমার সব কিছুই খারাপ লাগছে। এখানে সব কিছুই যেন ষড়যন্ত্র করছে আমার বিরুদ্ধে। আজ ফ্রনিলের সঙ্গে দেখা হলো। আমি তাকে ডেকে আমার প্রতি তার সেদিনকার দুর্ব্যবহারের কারণ জানতে চাইলাম। ফ্রনিল তখন বলল, কিছু মনে করো না ওয়ার্দার। আমি তোমাকে ঐ ভোজসভায় দেখেই চিন্তিত হয়ে পড়ি। দুজন মাদাম অর্থাৎ সম্ভ্রান্ত মহিলা তোমাকে দেখে চলে যাচ্ছিল ভোজসভা থেকে। কাউন্ট মুস্কিলে পড়েছিলেন, কারণ তিনি তাদের সঙ্গে মনোমালিন্য করার ঝুঁকি নিতে পারছিলেন না। তখন আমার মনে কি দারুণ কষ্ট হচ্ছিল তা তোমায় বোঝাতে পারব না।
আমি দেখলাম কথা বলতে বলতে চোখ দিয়ে জল পড়ছিল ফ্রলিনের। সত্যিই সে দুঃখ পেয়েছিল আমার জন্য। ফ্রলিন আর বলল, সবচেয়ে দুঃখের বিষয় সেই ভোজসভায় আমার পিসিও ছিলেন। তিনি আমাকে পরে তোমার সঙ্গে মেলামেশার জন্য আমাকে অপমান করলেন। তোমার নামেও যা তা বলতে লাগলেন। কিন্তু তোমার সমর্থনে আমি খুব বেশি কথা বলতে পারলাম না।
ফ্রলিনের প্রতিটি কথা তীক্ষ্ণ ছুরির মতো আমার বুকে বিঁধছিল। সে বলল, এই নিয়ে আরও কথা হবে। হিংসুটে লোকগুলো অনেক কানাঘুষো করবে আমাকে নিয়ে। উইলেম, ফ্রলিনের কণ্ঠে প্রকৃত সহানুভূতির স্পষ্ট আভাস পেয়ে সত্যিই আমি অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল একটা ছুরি নিয়ে আমার বুকে আমূল বসিয়ে দিই। আমার নিজের চোখে আমার নিজের রক্ত দেখলেই আমি শান্ত হব চিরদিনের জন্য। এ ছাড়া কোনও উপায় নেই। এক ধরনের ঘোড়ার কথা শুনেছি যারা খুব রেগে গেলে বা ক্লান্ত হয়ে নিজেদের দেহের শিরা কামড়ে আত্মহত্যা করে। আমারও তাই ইচ্ছা হচ্ছিল নিজের দেহের শিরা ছিঁড়ে চিরমুক্তি লাভ করি।
মার্চ ২৪,
আমি কাউন্টের কাছে আমার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছি। মনে হয় তা গৃহীত হবে। তোমার মতামত চাইতে না পারার জন্য ক্ষমা চাইছি। প্রথম কথা আমাকে অন্যত্র যেতে হয়েছিল। দ্বিতীয় কথা তোমার মত চাইলে তুমি আমাকে থাকতে বলতে। মাকে সব কথা বুঝিয়ে বলো। তাঁকে সব কিছু সহ্য করতেই হবে। কারণ এ ছাড়া আমার করার কিছুই নেই। ভবিষ্যতে প্রিভি কাউন্সিল বা রাষ্ট্রদূত অফিসের ভালো পদের আশা ত্যাগ করে তাঁর পুত্র চলে গেল। যাই হোক, আমি যাচ্ছি। জনৈক রাজকুমার…আমার সাহচর্য চান। তিনি আমাকে তাঁদের দেশের বাড়িতে গিয়ে বসন্তকালটা কাটাবার কথা বলছেন। মোটামুটি আমাদের মধ্যে কিছুটা বোঝাপড়া হয়েছে। দেখা যাক ভাগ্য পরীক্ষা করে।
এপ্রিল ১৯,
তোমার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আমি তোমার দুখানি চিঠিই পেয়েছি। কিন্তু উত্তর দিতে পারিনি। আমার ভয় হচ্ছিল আমার মা যদি মন্ত্রীর কাছে দরখাস্ত করেন তাহলে আমার পদত্যাগপত্র সহজে গৃহীত হবে না। যাই হোক, এখন সব কিছুর শেষ। হয়ে গেছে। বিশেষ অনিচ্ছার সঙ্গে মন্ত্রী মহোদয় আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। তাঁর চিঠিখানা পড়লে তোমার সত্যিই কষ্ট হবে। রাজকুমার আমাকে একখানি চিঠির সঙ্গে পঁচিশটি ডুকেট দান করেছেন। সুতরাং মাকে যে টাকা পাঠানোর কথা লিখেছিলাম তা না পাঠালেও চলবে।
মে ৫,
আমি আগামীকাল এখান থেকে চলে যাচ্ছি। আমার আমার জন্মস্থানে বেড়াতে যাব। আমার বাবার মৃত্যুর পর মা আমাকে নিয়ে যে বাড়ি থেকে চিরদিনের মতো বেরিয়ে আসেন সেই বাড়িটা আমার দেখব আমি। বিদায় উইলেম, পরে আবার সব জানাচ্ছি।
মে ৯,
তীর্থযাত্রীর মতো নিবিড় শ্রদ্ধার সঙ্গে আমি আমার জন্মভূমি দর্শন করেছি। আমি আমার তীর্থযাত্রা শেষ করেছি। সেখানে পৌঁছে গাড়িটা দূরে রেখে পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলাম আমি। কত বিচিত্র আবেগানুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল আমার অন্তর। সেই লাইম গাছটার তলায় দীর্ঘকাল পরে আবার দাঁড়ালাম। একদিন যখন ছোট ছিলাম, যখন বাইরের জগৎ সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণা ছিল না, আমার ছোট মনে তখন কত আশা ছিল, কত স্বপ্ন ছিল। আর আজ যখন বাইরের জগৎ থেকে ঘা খেয়ে ফিরে এলাম। সেই জায়গায় তখন আমার সব আশা সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ছেলেবেলায় যে স্কুলটায় পড়তাম এখন সেটা এক দোকান ঘরে পরিণত হয়েছে। আমাদের পুরনো। বাড়িটার পাশে একটা হোটেলে উঠলাম আমি। শহরের বাইরে নদীর ধার দিয়ে বেড়াতে গেলাম। নদীর ধার আর খামারবাড়ি দিয়ে কত বেড়াতে যেতাম। তখন অবারিত মাঠ আর মুক্ত আকাশ দেখে ইউলিসেসের মতো মনে হতো সমুদ্র-মেখলা পৃথিবী অনন্ত, আর শেষ নেই, সীমা নেই। আজকালকার ছেলেরা শেখে পৃথিবী গোল এবং তাদের কাছে পৃথিবী কত ছোট।
আমি রাজকুমারের শিকারের জায়গায় এসে গেছি। লোকটি সত্যি খুব ভালো। কিন্তু যখন শুনলাম উনি সাধারণত বই পড়ে আর লোকের মুখ থেকে শুনে সব জ্ঞান লাভ করেন তখন একটু দুঃখ পেলাম। আর একটা দুঃখের কথা, উনি আমার অন্তরের থেকে বুদ্ধির উপরেই গুরুত্ব দেন বেশি। কিন্তু উনি জানেন না আমার যা কিছু সম্পদ তা সব আছে আমার অন্তরে।
মে ২৫,
আমার মনের একটা কথা গোপন করে রেখেছিলাম। সেটা তোমায় বলতে চাইনি। ভেবেছিলাম কাজটা হয়ে গেলে বলব। আমি যুদ্ধে যোগদান করতে চেয়েছিলাম। রাজকুমার নিজেই সামরিক লোক। আমি তাঁকে আমার ইচ্ছার কথা জানাতে তিনি এ বিষয়ে নিবৃত্ত করতে চাইলেন। অনেক যুক্তি দেখালেন।
জুন ১১,
যা বলো বলবে আমি আর থাকতে চাইছি না। কি হবে থেকে? আমার মোটেই ভালো লাগছে না। রাজকুমার আমাকে তার সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসাবেই জ্ঞান করেন। তবু আমি সহজ হতে পারি না। স্বভাবের দিক থেকে আমাদের দুজনের মধ্যে অনেক তফাৎ। তার বুদ্ধি আছে কিন্তু সে বুদ্ধি নিচু স্তরের। আর এক সপ্তা মাত্র এখানে আছি। এখানে এসে একটা লাভ হয়েছে। আমি কিছু ছবি আঁকতে পেরেছি। তবে রাজকুমারের ছবির প্রতি আগ্রহ থাকলেও তার মনটা বিজ্ঞানভাবাপন্ন। কোনও ছবি। দেখলেই তাই একটা শ্রেণীগত নাম দিয়ে দেন। প্রথাগত রীতিতে সব কিছুর বিচার। করে থাকেন।
জুন ১৮,
কোথায় আমি যাচ্ছি? পরে তোমায় গোপনে বলব। এখানে এখনও একপক্ষকাল থাকতে হবে আমায়। তারপর এক খনি অঞ্চল দিয়ে বেড়াতে যাব। আসলে আমি যাব লোত্তেকে দেখতে। আবার তাকে একবার দেখব। কথাটা উপহাসের মতো শোনাচ্ছে। তবু এটা আমার অন্তরের দাবি আর সে দাবি মেটাতেই হবে।
জুলাই ১৯,
হে ঈশ্বর, তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ। তুমি তবে তাকে আমার স্ত্রী হিসাবে আমায় দান করো। তাহলে সারা জীবন আমি তোমার প্রার্থনায় কাটিয়ে দেব। সে যদি আমার স্ত্রী হয়, স্ত্রী হিসাবে আমার বাহুবন্ধনে ধরা দেয়–কথাটা ভাবতেও বুকটা কেঁপে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে আলবার্ত যখন তার কোমরটা জড়িয়ে ধরে তখনকার কথাটা মনে পড়ে যায়।
কথাটা বলা কি উচিত হবে? কেন হবে না উইলেম? আমার সঙ্গে বিয়ে হলে লোত্তে আরও সুখী হতো। আলবার্ত ঠিক তার মনের সব বাসনা পূরণ করতে পারবে না। আমার সঙ্গে লোত্তের মনের সব বিষয়ে মিল হয়। কিন্তু আলবার্তের মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম ব্যবধান আছে। অবশ্য আলবার্ত সমস্ত অন্তর দিয়ে ভালোবাসে লোত্তেকে।
আগস্ট ৪,
একা আমিই দুঃখ পাই না। এ পৃথিবীতে অনেকেরই অনেক আশা, অনেক কামনা-বাসনা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। সেই লাইম গায়ের তলায় যার কুঁড়ে সেই মেয়েটির বাড়ি সেদিন বেড়াতে গিয়েছিলাম। তার ছেলেটা আমায় ধরে নিয়ে গেল। মেয়েটি বলল, তার ছোট ছেলেটি মারা গেছে। তার স্বামী সুইজারল্যান্ডে থেকে হতাশ হয়ে ফিরে এসেছে। এখন সে অসুস্থ। আমি তার কথা শুনে খুব দুঃখ পেলাম। ছেলেটির হাতে কিছু পয়সা দিলাম। মেয়েটি আমাকে কিছু আপেল দিল জোর করে।
আগস্ট ২১,
মাঝে মাঝে জেগে-জেগে স্বপ্ন দেখি আমি। স্বপ্নের মাঝে আনন্দ পাই। কিন্তু সে আনন্দ ক্ষণিকের জন্য। এই ধরনের স্বপ্নের মাঝে মনে হয় আলবার্ত যদি মারা যায়। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর কথাটা ভাবতে ভাবতে আমি এক অন্ধকার খাদের প্রান্তে চলে যাই। নিজেই শিউরে উঠি।
যে শহরের নাচের আসরে প্রথম লোত্তেকে নিয়ে আসি এবং যেখানে তার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়, সেই শহরের দ্বারপ্রান্তে সেদিন আবার গেলাম। কিন্তু অতীত সুখের দিনের কোনও চিহ্নই নেই সেখানে। সেদিনকার আনন্দের আবেগ বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই আমার মনে। আমার মনে হলো আমি যেন কোনও প্রেতাত্মা, মৃত্যুর পর আবার ছেড়ে যাওয়া প্রাসাদে ফিরে এসেছি।
সেপ্টেম্বর ৩,
আমি বুঝতে পারি আমি যখন তাকে এমন গভীরভাবে, এমন একান্তভাবে ভালোবাসি তখন কি করে তাকে অন্য লোকে ভালোবাসতে পারে। আমি তো তাকে ছাড়া আর কাউকে জানি না। জানতে চাই না।
সেপ্টেম্বর ৬,
আমার একবার ইচ্ছা হলো সেই পুরনো কোটটা পরি। এই নীল কোটটা পরে আমি একদিন লোত্তের সঙ্গে তার হাত ধরে নেচেছিলাম। কোটটা তাই প্রিয় আমার। কাছে। ওটাকে আজও ভালোবাসি। কিন্তু সেটা পুরনো হয়ে গেছে। আর একটা কোট আমি করিয়েছি।
সেপ্টেম্বর ১৫,
মাঝে মাঝে শয়তান আর নরকের কুকুরের বেয়াদপি সহ্য করা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না। তোমার মনে আছে চার্চের কাছে সেই বাদাম গাছগুলোর তলায় আমি কতদিন লোত্তের সঙ্গে বসে থেকেছি। যাজক সেই গাছগুলোকে একদিন নিজের হাতে বসান। সেই সব গাছের ডালপালাগুলো বড় হয়ে চারদিকে সারা উঠোনটাকে। ছায়াশীতল করে রাখত। কিন্তু এবার গিয়ে দেখলাম সেই সব গাছগুলো কাটা হয়ে গেছে। মন্ত্রীর স্ত্রীর হুকুম। কথাটা শুনে রাগ হলো আমার। গাঁয়ের সব লোকই এতে ক্ষুব্ধ। কিন্তু কোনোও উপায় নেই। মন্ত্রীর স্ত্রীর অসুবিধা হচ্ছিল গাছগুলো থাকাতে, ছেলেরা বাদাম পাড়ত। গাছের ডালে আলো-বাতাস আটকাত। তাই তার সহ্য হয়নি।
অক্টোবর ১০,
যদি আমি একবার তার কালো চোখের পানে তাকাই তাহলে সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে আমার। সবচেয়ে আমার দুঃখ এই যে আলবার্ট আগের মতো আমার কাছে সহজ হতে পারে না।
অক্টোবর ১২,
হোমার আমার অন্তরকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন। এই মহান প্রতিভাধর কবি কি এক অলৌকিক মায়াময় জগতেই না আমার মনটাকে নিয়ে যান। আমি যেন ঘুরতে ঘুরতে ঝড়ের প্রহারে ক্রমাগত জর্জরিত ও প্রেতাত্মা অধূষিত কুয়াশাচ্ছন্ন এক বিশাল প্রান্তরে এসে পড়েছি। মনে হচ্ছে যেন প্রেমবিধুরা কোনও নিঃসঙ্গ কুমারী তার মৃত প্রণয়ীর তৃণাচ্ছন্ন সমাধি প্রান্তরের উপর বসে অশ্রুবর্ষণ করছে নির্জনে। আমার মনে হয় যেন কোনও বৃদ্ধ চারণ কবি এক শূন্য প্রান্তরে তার পূর্বপুরুষদের সমাধিভূমির মাঝে তাদের কায়াহীন অশরীরী উপস্থিতির মাঝে এক অতিসূক্ষ্ম আত্মিক আনন্দে বিভোর হয়ে হিমশীতল পৃথিবীর পানে তাকিয়ে আছে তার আপন মনে চিৎকার করে বলছে, আমার কবরের উপর দিয়ে কোনো পথিক হেঁটে যেতে যেতে হয়ত আমার কথা মনে করবে, হয়ত বৃথাই আমার খোঁজ করবে।
অক্টোবর ১৯,
হায়, আমার বুকের ভিতরে কি এক বিরাট শূন্যতা! আমার কেবল মনে হয় আমি যদি একবার এই বুকে তাকে চেপে ধরতে পারতাম, তাহলে আমার সব শূন্যতা পূরণ হয়ে যেত।
অক্টোবর ২৬,
লোত্তের এক বন্ধু দেখা করতে এসেছিল তার সঙ্গে। আমি পাশের ঘরে গিয়ে বই পড়তে লাগলাম। কিন্তু পড়া হলো না। আমি তাদের কথা শুনতে লাগলাম। ওরা। শহরের এক গরিব হতভাগ্য দম্পতির কথা বলাবলি করছিল। স্ত্রীর কাশি হয়েছে, ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। স্বামীটিও ভুগছে, তার হাত-পা ফুলে গেছে। ওরা দুজনেই মরবে।
আমি একা একা ঘরে বসে ভাবতে লাগলাম। এই ঘরে লোত্তের কাপড়-জামা ছড়ানো আছে। তার কানের দুল রয়েছে টেবিলে। আলবার্তের কাগজপত্রও রয়েছে। আমিও যখন একদিন মরে যাব, এদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাব, তখন কি এরা আমার কথা মনে রাখবে? হায়, মানুষের অস্তিত্ব কত ক্ষণভঙ্গুর! তার যে অস্তিত্বকে প্রিয়জনের মনে সুপ্রতিষ্ঠিত করে যায় সে অস্তিত্ব সেখানে বেশিদিন সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে না। কোথাও হারিয়ে যায়, মিলিয়ে যায়। অক্টোবর ২৭,
আজকাল একটা কথা আমার প্রায়ই মনে হয়। কথাটা মনে হলেই দুঃখে বুকটাকে বিদীর্ণ করে ফেলতে ইচ্ছে হয়, মাথাটা ফাটাতে ইচ্ছে যায়। মানুষ কত স্বার্থপর। আমি যদি কাউকে ভালোবাসা না দিই তাহলে সে কখনই আমাকে ভালোবাসবে না, আমার অন্তর পরম আনন্দের প্রাচুর্যে পূর্ণ থাকলেও আমি অন্য কাউকে সুখী করার চেষ্টা করব না, আমার সে আনন্দের ভাগ দেব না–এটা কখনই উচিত নয়।
অক্টোবর ৩০,
আমি শত শতবার লোত্তেকে চুম্বন করতে গেছি। কিন্তু পারিনি। কোনও সুন্দর বস্তুকে দেখে মুগ্ধ হয়েও তাকে স্পর্শ না করে থাকটা যে কত কঠিন তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।
নভেম্বর ৩,
প্রায় দিন রাত্রিতে ঘুমোতে ঘুমোতে আমার মনে হয় আমি আর জেগে উঠব না। কিন্তু সকাল হলেই রোজ জেগে উঠি অন্যদিনকার মতো। আমি যদি পরের উপর দোষ চাপিয়ে দিতে পারতাম তাহলে এতটা কষ্ট আমাকে পেতে হতো না। কিন্তু এই সব কিছুর জন্য আমি একা দায়ী–এই বোধ থেকে আমার কষ্ট আরও বেড়ে যায়। আমার কষ্টের মূল কারণ এই যে, আমার জীবনের একমাত্র আনন্দপ্রতিমা হারিয়ে গেছে অকালে। আমি যখন রোজ সকালে জানালা দিয়ে দূর পাহাড়ের দিকে তাকাই, যখন সকালের সোনা রোদ উপত্যকাভূমির উপর ছড়িয়ে থাকা কুয়াশা আর এঁকেবেকে এগিয়ে যাওয়া রূপালি নদীর উপর ঝরে পড়ে তখন সেই মনোরম দৃশ্যের আনন্দ আমার অন্তর থেকে মস্তিষ্কে কেউ নিয়ে যেতে পারে না। আমার সমগ্র অন্তরটা শুকিয়ে যাওয়া ঝর্নার মতো শূন্য হয়ে পড়ে থাকে। ঈশ্বরের কাছে আমার চোখে কিছু অশ্রু দেখার জন্য প্রার্থনা করি, কৃষকরা যেমন বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে।
কিন্তু পরে বুঝলাম ঈশ্বর কখনও আমাদের প্রার্থনা অনুসারে বৃষ্টি অথবা রোদ পাঠিয়ে দেন না। একদিন অতীতে ঈশ্বর আমাকে সুখ দিয়েছিলেন তার কারণ তখন আমার ঈশ্বরে বিশ্বাস ছিল। ভালো-মন্দ সব আবেগ ঈশ্বরের দান হিসাবে গ্রহণ করতাম আমি। তাই শান্তি পেতাম সব সময়।
নভেম্বর ৮,
আমার সংযম না থাকার জন্য আমাকে তিরস্কার করেছে সে। অবশ্য খুব মৃদুভাবে। অনেক সময় আমি একটু মদ্যপান করতে গিয়ে গোটা বোতলটা খেয়ে ফেলি। লোত্তে তখন বলে, না না, আর খেও না। আমি তখন বলি, তুমি যদি নিষেধ করো, তাহলে খাব না। তুমি সব সময় আমার আত্মার মাঝে উপস্থিত আছ।…আজ সে যখন গাড়ি থেকে নামে তখন আমি বসেছিলাম। সে এসেই প্রসঙ্গটা পাল্টে দেয়। তার উপর আমার কোনও হাত নেই। সে যা খুশি তাই করতে পারে।
নভেম্বর ১৫,
তোমার সৎ পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ উইলেম। তবে আমি তোমাকে শান্ত হতে বলছি। আমি শেষ পর্যন্ত সহ্য করে যেতে চাই। তুমি জান ধর্মের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। এই ধর্ম বহু আত্মার উপাদান, অনেক দুর্বল মানুষের আশ্রয়, কিন্তু তাই বলে কি সকলের ক্ষেত্রেই এই কথা প্রযোজ্য? বিরাট পৃথিবীতে তাকিয়ে দেখবে হাজার হাজার লোকের ক্ষেত্রে একথা খাটে না। তা যদি না খাটে তাহলে আমার জীবনেই বা খাটবে কেন? ঈশ্বরের পুত্র কি বলেননি যে ঈশ্বর যাদের দান করেছেন তাঁর হাতে তাঁরাই তাঁর কাছে থাকবে সব সময়। ভাগ্যে যা আছে তা সব সহ্য করতেই হবে তা সে যতই তিক্ত হোক না কেন। এখন আমার সারা ভবিষ্যৎ এক বিরাট শূন্যতা আর অন্ধকারে ভরা আর সেই অন্ধকারে আমার অতীত বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে। আর আমার সমগ্র অস্তিত্ব কেঁপে কেঁপে উঠছে। হে ঈশ্বর, তুমি কি আমাকে ত্যাগ করেছ?
নভেম্বর ২১,
সে বুঝতে পারে না, সে মাঝে মাঝে এক বিষ প্রস্তুত করে যে বিষ তার ও আমার দুজনেরই ধ্বংস ডেকে আনবে। সে যে বিষের পাত্র তুলে দেয় তাতে আমার ধ্বংস অনিবার্য জেনেও অবশ্য আমি তার সবটুকু পান করি। সে মাঝে মাঝে আমার পানে সদয় দৃষ্টিতে তাকায়। মাঝে মাঝে আমার দুঃখের প্রতি এক অনুচ্চারিত সহানুভূতি মূর্ত হয়ে ওঠে তার জযুগলের মধ্যে। গতকাল আমি যখন তার কাছ থেকে বিদায় নিই তখন সে আমার হাত ধরে বলে, বিদায় প্রিয় ওয়ার্দার! প্রিয় এই কথাটা প্রথম সে। বলে আমায়। কথাটা যেন আমার সমগ্র অস্থিমজ্জায় ঢুকে যায়। গতকাল বিছানায় শোবার সময় আপন মনে কথাটা উচ্চারণ করে চলি আমি। নভেম্বর ২৪,
সে আমার দুঃখের কথা সব বোঝে। আজ তার চোখের দৃষ্টি আমার অন্তরের গভীরে চলে যায়। আজ সে একটা ছিল। আমি কোনও কথা বলিনি। সে নীরবে আমার মুখপানে তাকাল। কিন্তু আগের মতো তার চোখে-মুখে আর সে উজ্জ্বলতা খেলে যেতে দেখলাম না। তবে তার চোখে-মুখে আমার প্রতি সহানুভূতিটা আগের থেকে আরও গভীরভাবে ফুটে উঠেছিল। আমি কি তার পায়ে গড়িয়ে পড়ব? তার এই নিবিড় সহানুভূতির প্রতিদানস্বরূপ আমি তাকে অসংখ্য অভিনন্দন ও চুম্বনে তৃষিত করব না? সে হার্পসিকর্ড বাজিয়ে গান করতে লাগল। তার যে ওষ্ঠাধর থেকে মধুর সুর ও বাণী ঝরে পড়ছিল, সেই স্বর্গীয় সুষমামণ্ডিত ওষ্ঠাধর আমি চুম্বন করতে পারব না কখনও? কারণ আমি প্রতিজ্ঞা করেছি। তবু মনে হচ্ছে এ কাজ পাপের হলেও এ পাপ একবার করে সারা জীবন ধরে তার প্রায়শ্চিত্ত করে যাব আমি।
নভেম্বর ৩০,
আমি নিজেকে নিজে সামলাতে পারছি না। আত্মস্থ হতে পারছি না। যেখানেই যাচ্ছি আমি তার ভূত দেখছি যেন। হায কী দুর্ভাগ্যের কথা।
দুপুরের দিকে আমি গিয়েছিলাম নদীর ধার দিয়ে। যাবার কোনও ইচ্ছা ছিল না আমার। চারদিকে কেমন যেন একটা বিষাদের ভাব বিরাজ করছিল। হিমশীতল পশ্চিমা বায়ু বয়ে আসছিল পাহাড় থেকে। পাহাড় আর উপত্যকার উপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল ঝড়ো মেঘ। পাহাড়ের কোলে ঝোঁপ-ঝাড়ের ভিতরে একটা লোক ময়লা সবুজ কোট পরে গাছের শিকড় খুঁজে বেড়াচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কোনও দরকারী ওষধি খুঁজছে সে। আমি গেলাম তার কাছে। লোকটার চেহারার মধ্যে অদ্ভুত একটা বিষণ্ণ। ভাব ছিল। তার মাথার কালো চুল দুভাগ করে পিন দিয়ে আটকানো। দেখে মনে হলো লোকটি নিচু শ্রেণীর। আমি তার পেশার কথা জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল, সে নোজগে ফুল খুঁজছে। সে তার প্রিয়তমাকে উপহার দেবে। তার প্রিয়তমা ধনী। সম্পদশালিনী; সে শুধু ফুল চায়। কিন্তু শীতকালে সে ফুল পাচ্ছে না। সে আরও বলল, একদিন তার অবস্থা ভালো ছিল, এখন খারাপ হয়ে গেছে। এমন সময় এক বৃদ্ধা এসে লোকটির খোঁজ করতে লাগল। আমি বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম লোকটি তার। ছেলে। এখন ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বছর খানেক পাগলা গারদে ছিল। এখন। ছাড়া আছে। মারধোর করে না, এইভাবে কি সব খুঁজে বেড়ায় পাহাড়ে-জঙ্গলে।
আমি তখন লোকটির উদ্দেশ্যে বললাম, একদিন তুমি সুখী ছিলে। কিন্তু এটা তুমি বুঝতে পারছ না তোমার এই দুঃখ তোমার আপন অন্তর ও মস্তিষ্ক হতেই উদ্ভূত হচ্ছে।
কিন্তু রুগ্ন মানুষের রোগ নিয়াময় প্রচেষ্টাকে উপহাস করা উচিত নয়। তাকে পাগল বলে বিদ্রূপ করা উচিত নয়। হে ঈশ্বর, পরমপিতা, তুমিই আমাদের সৃষ্টি করেছ, আমাদের দুঃখের প্রতিকার এই পৃথিবীর সবখানেই ছড়িয়ে রেখেছে। হে পিতা, তুমি চুপ করে থেকো না আমার দুঃখে । আমি তোমার কাছে অকালে ফিরে যাচ্ছি। তুমি রাগ করো না। আমার যাত্রা গন্তব্যস্থলে গিয়ে শেষ না হতেই মাঝপথে থেমে যাচ্ছে। আমি ফিরে যাচ্ছি তোমার কাছে। এ পৃথিবীর সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষার আমার কোনও প্রয়োজন নেই। আমি যদি এইভাবে অকালে ফিরে যাই তাহলে আমাকে কি তুমি তাড়িয়ে দেবে?
ডিসেম্বর ১,
শোনো উইলেম, যে লোকটির কথা আমি তোমাকে সেদিন লিখেছিলাম সেই লোক লোত্তের বাবার অফিসে কাজ করত। সে কেরানি ছিল। সে মনে মনে লোত্তেকে ভালোবাসত। পরে কথাটা প্রকাশ করায় তার চাকরি যায়। তখন থেকে সে পাগল হয়ে যায়। কথাটা আমাকে জানায় আলবার্ত।
ডিসেম্বর ৪,
আমাকে ক্ষমা করো, আমি আর পারছি না। আমি আজ তার পাশে বসেছিলাম। সে গান গাইছিল। তার এক বোন আমার কোলের উপর বসে পুতুল নিয়ে খেলা করছিল। আমার চোখে জল আসছিল। তার হাতে বিয়ের আংটিটা দেখে আমার আরও কষ্ট হচ্ছিল। এমন সময় সে একটি পুরনো গান ধরল। সেই গানের সুরে অতীত সুখের দিনের কথা মনে পড়ল। আমার ব্যথা বেড়ে গেল। আমি তার কাছে গিয়ে তাকে অনুরোধ করলাম, দয়া করে গান থামাও, আমি আর পারছি না। সে বলল, ওয়ার্দার তোমার শরীর খারাপ। তুমি তোমার প্রিয় খাদ্য কিছুই খেতে পারছ না। আমি হঠাৎ চলে গেলাম তার কাছ থেকে।
ডিসেম্বর ৬,
তার ছবিটা সব জায়গায় দেখতে পাচ্ছি আমি। স্বপ্নে ও জাগরণে সব সময় তাকে দেখছি আমার চোখের সামনে। চোখ বন্ধ করলেই অন্ধকারে মনের পটে ছড়িয়ে রয়েছে তার ছবি। বিশেষ করে তার কালো চোখ দুটো অন্ধকার সমুদ্র বা খাদের মধ্যে প্রসারিত হয়ে থাকে আমার মুদ্রিত চোখের সামনে।
হায়, মানুষের জীবন কি অদ্ভুত! যখন সে ইন্দ্রিয়চেতনার শক্তিকে নিবিড়ভাবে চায় তখন সে শক্তি মিলিয়ে যায় ও বিলীন হয়ে যায়। অথচ যখন সে এ শক্তি চায় তখন শক্তি নিবিড় হয়ে ওঠে তার দেহে-মনে।
ডিসেম্বর ৮,
প্রিয় উইলেম, আমার অবস্থাটা এখন ঠিক ভূতে পাওয়া লোকের মতো। এখন যা আমার মনটাকে আচ্ছন্ন করে আছে তা ভয় বা কামনা নয়। শুধু এক ভয়ঙ্কর ক্রোধ যেন আমার বুকটাকে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে, আমার গলাটাকে ধরে টিপতে চাইছে। সত্যিই আমি বড় হতভাগ্য। রাত্রিতে আমি প্রায়ই পথে পথে ঘুরে বেড়াই।
গত রাতে আমি বাইরে বেরিয়ে যাই। আমি শুনেছিলাম, নদীতে বান এসেছে। কূল ছাপিয়ে নদীর জল ওয়ালহেম গায়ের চারদিক প্লাবিত করে তুলেছে। আমি রাত্রি এগারোটার সময় বাইরে যাই। কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য! প্রবল বন্যায় প্লাবিত সমস্ত উপত্যকাটা এক সমুদ্রের রূপ ধারণ করেছে। তার উপর ঝড় বইছে। তবে চাঁদের আলো ছিল আকাশে। সে আলোয় বন্যার রূপটাও আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল। আমার কেবলি মনে হচ্ছিল ঝড়ে আকাশের মেঘগুলো ছিঁড়েখুড়ে গিয়ে মর্ত্যে নেমে এসে বন্যার ব্যাপ্ত জলধারাকে আলিঙ্গন করুক। মনে হলো তাহলে আমি শান্তি পাব।
চারদিকে তাকাতে গিয়ে একটা জায়গায় নজর পড়ল আমার। ফাঁকা প্রান্তরে একটা উইলো গাছের তলায় একদিন বেড়াতে বেড়াতে ক্লান্ত হয়ে লোত্তের সঙ্গে বসেছিলাম। জায়গাটা এখন জলে ডুবে গেছে। গাছটা কোথায় বুঝতেই পারছি না। আমার মনে হলো আমি যেন এমন এক অসহায় বৃদ্ধার মতো বসে আছি সে শুধু পরের কাছে রুটি ভিক্ষা করে তার নীরস নিরানন্দ জীবনটাকে অহেতুক দীর্ঘায়িত করে চলেছে।
ডিসেম্বর ১৭,
আমার নিজের আচরণে আমি নিজেই চমকে উঠছি বন্ধু। তার প্রতি আমার ভালোবাসা কি পবিত্র ভ্রাতৃসুলভ ভালোবাসা নয়? সে ভালোবাসার মধ্যে কি প্রাপপ্রবৃত্তি আছে? কিন্তু গত রাত্রিতে, একথা বলতে আমার কুণ্ঠবোধ হচ্ছে–আমি তাকে প্রবলভাবে চেপে ধরেছিলাম আমার বুকে। অসংখ্য চুম্বনে সিক্ত করে দিয়েছিলাম তার মুখ। আমার মাথাটা ঘুরছিল। আমি সব বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছি। এক সপ্তা হলো আমি কথা বলতে পারি না। চোখে শুধু জল আসে। কোথাও কোনও শান্ত পাই না। এখন পৃথিবী থেকে চলে যেতে পারলেই ভালো।
(পাঠকের নিকট সম্পাদকের নিবেদন)।
ওয়ার্দারের শেষ জীবনের কাহিনীর উপদান আমি পেয়েছি লোত্তে, আলবার্ট আর তার চাকরের কাছ থেকে। সেই কাহিনীটি বলার জন্যই তার চিঠির প্রকাশ বন্ধ করে দিলাম।
ওয়ার্দারের প্রেমাবেগের ক্রমবর্ধমান প্রবলতা আলবার্ত ও তার স্ত্রীর মানসিক শান্তিতে ক্ষুণ্ণ করে তুলেছিল। আলবার্ট ক্রমশ ভাবতে শুরু করল ওয়ার্দারের এই ক্রমবর্ধমান প্রেমাবেগ লোত্তের মনটাকেও ক্রমশই প্রভাবিত করে তুলছে। ফলে ওয়ার্দারের প্রতি আলবার্তের মনটা বিষিয়ে যেতে লাগল ক্রমশ। লোত্তের ঘরে যতক্ষণ ওয়ার্দার থাকত ততক্ষণ সে ঘরে যেত না আলবার্ত। একদিন সে তার স্ত্রীকে স্পষ্ট বলে দিল, ওয়ার্দার যেন এত ঘন ঘন তার কাছে না আসে। সেটা লোকচক্ষে দৃষ্টিকটু ঠেকছে।
কথাটা হয়ত জানতে পারে ওয়ার্দার। এই সময় তার আত্মহতার ইচ্ছাটা প্রবল হয়ে ওঠে। লোত্তের কাছে দ্বিতীয়বার ফিরে আসার পর থেকেই এ ইচ্ছাটা জাগে তার মধ্যে। এর সঙ্গে হঠকারিতার কোনও সম্পর্ক ছিল না। সে ঠাণ্ডা মাথাতেই এ কাজ করতে চেয়েছিল। তার মনের মধ্যে কি ধরনের অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছিল তা উইলেমকে লেখা তারিখবিহীন একটি চিঠির প্রথম অংশ থেকে জানা যাবে। ওয়ার্দার লিখেছে, তার উপস্থিতি আর আমার প্রতি সহানুভূতি আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্ক থেকে শেষ অশ্রুবিন্দুটুকুকেও টেনে বার করে নিয়েছে। এবার যবনিকা সরিয়ে পিছনে পা ফেলে যাওয়া। কিসের ভয়, কিসের কুণ্ঠা? কারণ পিছনে কি আছে তা আমরা জানি না, কারণ সেখান থেকে ফিরে আসা যায় না। আর একটা কারণ এই যে, মানুষের মনের গঠন প্রকৃতিটাই এমনি। যেখানে আমরা নির্দিষ্ট ও নিশ্চিত করে জানি না কি আছে সেখানে, যত সংশয় আর শঙ্কার অন্ধকার ভিড় করে আসে।
রাষ্ট্রদূত অফিসের চাকরির ব্যাপারটা চাকরি ও রাজনীতিক কাজকর্মের প্রতি তার বিতৃষ্ণাটা বাড়িয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যর্থ প্রেমাবেগের আতিশয্যও বেড়ে যায় তার মনে ভীষণভাবে। এই আবেগের আতিশয্য তার সব প্রাণশক্তি ক্ষয় করে ফেলে ধীরে ধীরে। সে তার প্রেমাস্পদের মনের ভারসাম্যও নষ্ট করে ফেলে। তার এই প্রাণশক্তির নিদারুণ অপচয় এবং তার অসংযত প্রেমাবেগের ধ্বংসাত্মক পরিণতিই অবশেষে তাকে এই ভয়ঙ্কর কাজে প্রবৃত্ত করে।
ডিসেম্বর ২০,
আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার জন্য ধন্যবাদ উইলেম। তুমি আমাকে তোমার কাছে যেতে লিখেছ। এতে আমি কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। তুমি আমাকে নিতে আসবে জেনে খুশি হলাম। তবে কিছুদিন অর্থাৎ একপক্ষকাল দেরি করতে হবে। এখন এখানে বরফ পড়ছে। রাস্তাঘাট খারাপ। আমি তোমাকে চিঠি দেব। আমার চিঠি পেলে আসবে। মাকে তাঁর সন্তানের জন্য প্রার্থনা করতে বলবে। তিনি যেন আমার সব অপরাধ ক্ষমা করেন। আমরা যারা হিতাকাঙ্ক্ষী তারা আমার থেকে কষ্ট পায়–এটাই আমার ভাগ্যে আছে। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।
সেদিন ছিল রবিবার। খ্রিস্টের জন্মদিনের আগে। সে গিয়েছিল লোত্তের কাছে। লোত্তে তার ভাই-বোনদের পাওয়া উপহারের পুতুলগুলো গুছিয়ে রাখছিল। ছেলেদের উপহার আর তাদের আনন্দ নিয়ে কথা বলছিল ওয়ার্দার। লোত্তে একসময় বলল, তুমি যদি ভালোভাবে চলো, তোমার আচরণ শোভন ও মঙ্গলজনক হয় তাহলে তুমিও অনেক সুন্দর উপহার পাবে। ওয়ার্দার তখন প্রশ্ন করল লোত্তেকে, ভালো আচরণ বলতে কি চাও? আমাকে কি করতে হবে? লোত্তে বলল, আগামী বৃহস্পতিবার খ্রিস্টের জন্মদিন। ঐদিন সন্ধ্যায় তুমি আসবে, তার আগে নয়। আমার মনের শান্তির খাতিরে অন্তত নিজেকে সংযত করো। এভাবে আর চলে না।
কথাটা গভীর রেখাপাত করে ওয়ার্দারের মনে। সে অশান্তভাবে পায়চারি করতে থাকে ঘরে। লোত্তে বুঝতে পেরে প্রথমটা পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনও ফল হলো না। ওয়ার্দার স্পষ্ট বলল, না লোত্তে, তোমার সঙ্গে আর আমার কোনওদিন দেখা হবে না।
লোত্তে ব্যস্তভাবে বলল, কেন হবে না? অবশ্যই হবে, তবে শুধু নিজেকে একটু সংযত করে চলো। ওয়ার্দারের কথাটা টেনে নিয়ে লোত্তে আবার বলল, কী ভয়ঙ্কর আবেগ নিয়েই না তুমি জন্মেছিলে! অথচ তোমার বুদ্ধি ও প্রতিভা আছে। কিন্তু শুধু একটু আত্মসংযমের অভাবে সব মাটি হয়ে যেতে বসেছে। তুমি আমার কথাটা একবার ভেবে দেখো ওয়ার্দার। শুধু আমার কথাটা। আমি এখন অপরের। আমাকে পাওয়া সম্ভব নয় বলেই আমাকে পাওয়ার কামনা এমন দুর্বার হয়ে উঠেছে তোমার মনে।
ওয়ার্দার বলল, চমৎকার! বেশ চতুরের মতো কথা বলছ তো! কথাগুলো কি আলবার্ত শিখিয়ে দিয়েছে? লোত্তে বলল, কেন, একথা তো সবাই বলবে। জগতে মেয়ের অভাব নেই। একটু খোঁজ করলেই তোমার ভালোবাসার পাত্রীকে ঠিকই খুঁজে পাবে। খুঁজে নিয়ে এস। তখন আমাদের বন্ধুত্ব আরও সুখের হয়ে উঠবে।
ওয়ার্দার তখন বলল, আমাকে শুধু একটু সময় দাও। একটু বিশ্রাম করতে দাও। লোত্তে বলল, না, এখন না, তুমি খ্রিস্টের জন্মদিনের আগে এসো না। এমন সময় আলবার্ত এসে ঘরে ঢুকল। এতে আলবার্ট ও ওয়ার্দার দুজনেই অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। আলবার্ত লোত্তেকে কয়েকটা কাজের কথা জিজ্ঞাসা করে জানল সে কাজ হয়নি। তাতে সে লোত্তেকে তিরস্কারের ভাষায় কি বলল। ওয়ার্দার যাব যাব করেও আটটা পর্যন্ত রয়ে গেল। আলবার্ত তাকে নৈশভোজে আহ্বান করল। কিন্তু ওয়ার্দার টুপিটা তুলে নিয়ে না খেয়েই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
নিজের বাসায় ফিরে নিজের ঘরে একা চলে গেল ওয়ার্দার। ঘরে ঢুকে কাঁদতে লাগল জোরে। আপন মনে কথা বলতে লাগল উত্তেজিতভাবে। চাকর এসে তার পায়ের জুতো খুলে দিল। ওয়ার্দার তার চাকরকে বলল, সকাল বেলায় তাকে না ডাকা পর্যন্ত সে যেন ঘরে না আসে।
২১শে ডিসেম্বর ছিল সোমবার। ঐদিন সকালে ওয়াদার লোত্তেকে একখানা চিঠি লেখে। চিঠিটা তার টেবিলে তার মৃত্যুর পর পাওয়া যায়। চিঠিখানা তুলে দিচ্ছি।
আমি আমার মনস্থির করে ফেলেছি। আমি মরতে চাই। এ কথা আমি তোমাকে বিনা আবেগে লিখছি শান্তভাবে ঠাণ্ডা মাথায়। এ চিঠি যখন পড়বে তখন থেকে আমাকে দেখতে পাবে না। হে প্রিয়তমা, তুমি যখন এ চিঠি পাবে তখন আমার মতো এক অশান্ত চঞ্চল লোকের চিরশান্ত কঠিন হিমশীতল মৃতদেহটা কবরে শায়িত হবে। আমার জীবনের শেষদিকে তোমার সঙ্গে কথা বলতে পেরেছি–এটাই আমার একমাত্র সান্ত্বনা। গত রাতটা আমি অতি কষ্টে কাটিয়েছি। রাত্রির কষ্ট আমার মৃত্যুবাসনাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। বুকে একরাশ উত্তেজনার আবেগ নিয়ে যখন তোমার কাছ থেকে চলে আসি তখন এক হিমশীতল শঙ্কায় শিউরে উঠছিল আমার অন্তরাত্মা। সঙ্গে সঙ্গে মনে অনেক সম্ভাবনা জাগলেও শেষ পর্যন্ত এক সিদ্ধান্তে আমি স্থির ও অনড় হয়ে উঠি। সে সিদ্ধান্ত হলো মৃত্যুর সিদ্ধান্ত। এ মৃত্যুর সিদ্ধান্ত আমি হতাশা থেকে করিনি, করেছি তোমার জন্য আত্মত্যাগের আদর্শের বশে। হা লোত্তে! কেন মরব না? আমাদের তিনজনের মধ্যে একজনকে যেতেই হবে। উন্মত্ততার বশবর্তী হয়ে মাঝে মাঝে তোমাকে ও আমার স্বামীকে খুন করার কথাও মনে হয়েছে আমার। সুতরাং আমাকে মরতেই হবে। কোনও এক সুন্দর বসন্ত সন্ধ্যায় যখন তুমি পাহাড়ে উঠতে উঠতে সামনে উপত্যকার পানে তাকাবে যেখানে আমি প্রায়ই বেড়াতে যেতাম তখন তুমি আমার কথা ভাববে এবং আমার কবরের পানে তাকিয়ে দেখবে। সুর্যাস্তের রঙে রাঙা আমার কবরের পাশের ঘাসগুলো বাতাসে দুলতে থাকবে তখন। চিঠিখানা শান্তভাবে লিখতে শুরু করি। কিন্তু এখন চোখে জল আসছে।
বেলা দশটার সময় তার চাকরকে ডাকল ওয়ার্দার। বলল সে দিনকতকের জন্য বাইরে যাচ্ছে। সব বইপত্র যাকে যা দেওয়া আছে তা যেন সব আনা হয়। ভিখারীদের সাপ্তাহিক বরাদ্দ যেন বেশি করে দিয়ে দেওয়া হয়। তার ঘরে দুপুরের খাবার খেয়ে ঘোড়ার চড়ে বেরিয়ে গেল। সোজা চলে গেল লোত্তের বাবার বাড়ি।
লোত্তের বাবা তখন বাড়ি ছিল না। তার ভাইবোনদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল। বড় ছেলেটা তাদের জন্য খ্রিস্টের আসন্ন জন্মদিন উপলক্ষে এক সাদর সম্ভাষণ। লিখেছে।
সেখান থেকে সোজা বাসায় ফিরে এল ওয়ার্দার। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকা সত্ত্বেও ছটায় সময় আবার বেরিয়ে গেল আলবার্তের বাড়ি। গিয়ে দেখল লোত্তে একা রয়েছে ঘরে। ওয়ার্দারকে অসময়ে দেখে ভয় পেয়ে গেল লোত্তে। এখন আলবার্ত বাড়ি নেই। ওয়ার্দারের সঙ্গে বসে কথা বললে আলবার্ত তাকে সন্দেহ করবে। তাই ঝিকে দিয়ে তার দুজন বান্ধবীকে ডাকতে পাঠাল। কিন্তু কাউকে পাওয়া গেল না। তখন হতাশ হয়ে ভাবতে লাগল। কিন্তু তার অন্তরের শুচিতায় নিজেই আশ্বাস পেল মনে মনে। ভাবল সে যখন অন্তরে খাঁটি, তার মনে যখন কোনও পাপ নেই, সে কাউকে কোনও ভয় করবে না। সে ওয়ার্দারের কাছে বসে থাকবে। আলবার্ত এলে সব কথা বলবে। এই ভেবে সে ওয়ার্দারের সোফায় গিয়ে বসল। ওয়ার্দার তাকে বইগুলো ফেরত। দিতে এসেছে। লোত্তে আবৃত্তি শোনাতে বলল। ওয়ার্দার পড়তে শুরু করল। বইটার নাম ‘দি সংস অব সেলমা’।
হে শেষরাতের তারা! মেঘের ভিতর থেকে তুমি মুখ তুলতেই তোমার আলো পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ছে। পাহাড়ে শোনা যাচ্ছে তোমার শব্দহীন পদধ্বনি। সমতলভূমির পানে তাকিয়ে তুমি কি দেখছ? ঝড়ের শব্দ আসছে। সমুদ্রের ঢেউগুলো আছাড় খেয়ে পড়ছে দূরের পাহাড়ে। আমি আমার মৃত বন্ধুদের দেখতে পাচ্ছি। তাদের গান শুনতে পাচ্ছি। সেই পক্ককেশ বৃদ্ধ ইউলিন, রাইনো, আলপিন আর মিলানো। সেলমার ভোজের পর থেকে তোমরা কত বদলে গেছ!!
মিলানো এল তার উজ্জ্বল সৌন্দর্য নিয়ে। তার চোখে জল, মুখে বিষাদ। তার। এলো চুল বাতাসে উড়ছিল তার সকরুণ গান শুনে মৃতরাও বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। কলমা এক পাহাড়ে পড়ে রইল। সালগাতের আসবে বলেছিল। কিন্তু রাত্রির অন্ধকার ঘন হয়ে উঠল। অথচ সে এল না। এবারে কলমার কথা শোনো।
কলমা
এখন রাত্রিকাল! আমি একা! এই বিক্ষুব্ধ ঝড়-জলের মাঝে এই পাহাড়ে আমি একা। মাথা গোঁজার মতো কোথাও একটা কুঁড়েও নেই।
হে চাঁদ, হে নক্ষত্র, মেঘের আবরণ ছিঁড়ে বেরিয়ে এস। আমাকে আলো দিয়ে অন্তত একটু পথ দেখাও। আমার ক্লান্ত প্রেমাস্পদ কোথায় আছে তা দেখিয়ে দাও। আমি এই পাহাড়ের কোণে শ্যাওলাভরা ঝর্নার ধারে বসি। কিন্তু আমি তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি না কেন? কোথায় গেল আমার সালগাত? সে গর্জনশীল বাতাস, হে ঝর্নাধারা, তোমরা একটু চুপ করো। আমি আমার প্রেমাস্পদকে ডাকছি। তোমরা চুপ না করলে সে আমার ডাক শুনতে পাবে না। এই সেই গাছ, ঝর্নার ধারা, সেই পাথরের আসন। এখানেই সে আসবে বলেছিল। কিন্তু এল না। হে মৃত আত্মারা, তোমরা নির্জন গিরিকান্তার হতে কথা বলো। আমি মোটেই ভীত হব না। আমি সারারাত এইভাবে চোখের জলে কাটিয়ে মৃত্যুরবরণ করব। তোমাদের সমাধির পাশে আমাকে একটু স্থান দিও।
রাইনো
ঝড়-জল থেমে গেছে। এখন বেলা দ্বিপ্রহর। এখন চারদিক শান্ত। আকাশে খণ্ড খণ্ড মেষ ভেসে বেড়াচ্ছে। সবুজ পাহাড়ের মাথার উপর সূর্য দেখা যাচ্ছে। ঝর্নার মিষ্টি কলতানের থেকেও মিষ্টি কার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছ আমি? এ কণ্ঠস্বর সঙ্গীতের সন্তান। আলপিনের। সে আলপিন, এই নির্জন পাহাড়ে একা তুমি কি করছ?
আলপিন
হে রাইনো, আমি মৃতদের জন্য চোখের জল ফেলছি। আমার মৃত প্রিয়জনের জন্য দুঃখে গান গাইছি।
ওয়ার্দারের আবৃত্তি শুনতে শুনতে লোত্তের চোখে জল ঝরে পড়ছিল। এত দুঃখের কথা কখনও শোনেনি সে। তার চোখে জল দেখে ওয়ার্দারের পড়া বন্ধ হয়ে গেল। সে লোত্তের একটি হাত টেনে নিয়ে তার চোখের জলে ভিজিয়ে দিল। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে লোত্তে ওয়ার্দাররকে আরও পড়ে যেতে বলল। ওয়ার্দার আবার পড়তে লাগল, কেন তুমি আমায় জাগাচ্ছ হে বসন্ত বাতাস? আমার পাতায় যে শিশিরবিন্দু ঝরে পড়ে তাতে তুমি শীতল হও। কিন্তু আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে। তুষারঝড়ে আমার পাতাগুলো সব ঝরে পড়ছে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। যে পথিক একদিন আমার যৌবনসৌন্দর্য দেখে বিমুগ্ধ হয়েছিল সে কাল আসবে, আমাকে খুঁজবে। কিন্তু দেখতে পাবে না।
নিজেকে আর সামলাতে পারল না ওয়ার্দার। লোত্তের পায়ের কাছে পড়ে গেল। লোত্তের হাত দুটো টেনে নিয়ে নিজের চোখ ও কপালে চেপে ধরল। ফলে লোত্তের মাথাটা ঘুরে গেল। সব ভাবনাচিন্তা ওলটপালট হয়ে গেল। উল্টে গেল তার মনের কাঠামোটা। সেও সহসা উত্তেজিত হয়ে ওয়ার্দারের হাত দুটো টেনে নিয়ে নিজের বুকের উপর চেপে ধরল। তার গালটা ওয়ার্দারের গালে ঠেকল। ওয়ার্দার তখন লোত্তের হাত দুটো নিয়ে নিজের বুকে চেপে ধরে তার কম্পমান উত্তপ্ত ঠোঁটদুটো অসংখ্য চুম্বনে ভরিয়ে দিল।
এবার হুঁশ হলো লোত্তের। সে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে ডাকল, ওয়ার্দার! সে নিজেকে ওয়ার্দারের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করার জন্য সচেতনভাবে চেষ্টা করল।
ওয়ার্দার আর তাকে আটকে রাখল না। তাকে ছেড়ে তার পায়ের তলায় নতজানু হয়ে বসে পড়ল। লোত্তে তখন ভালোবাসা আর ক্রোধ এই দুই পরস্পরবিরুদ্ধ ভাবের। দ্বন্দ্বে কাঁপছিল। কম্পিত কণ্ঠে সে বলল, ওয়ার্দার, মনে রেখো এই আমাদের শেষ দেখা।
এই বলে সে শেষবারের মতো ওয়ার্দারের পানে তাকিয়ে পাশের ঘরে ছুটে চলে গেল। তাকে মরিয়া হয়ে ধরার জন্য হাত দুটো একবার শূন্যে বাড়িয়ে দিল ওয়ার্দার। কিন্তু তখন লোত্তে পাশের ঘরে গিয়ে খিল দিয়ে দিয়েছে।
ঘরের মেঝের উপর হতাশ হয়ে আধঘন্টা মতো শুয়ে রইল ওয়ার্দার। পরে হুঁশ হতে সে পাশের ঘরের রুদ্ধ দরজায় বাইরে থেকে ডাকল, লোত্তে, শোনো একবার। বিদায়কালে শুধু একটা কথা বলতে চাই।
কিন্তু লোত্তে কোনও উত্তর দিল না। তখন হতাশ হয়ে ওয়ার্দার চলে গেল। শুধু বলে গেল, চিরদিনের জন্য বিদায় লোত্তে।
লোত্তেদের বাড়ি থেকে সোজা শহরে চলে গেল ওয়ার্দার। তখন বৃষ্টি পড়ছিল গুঁড়িগুড়ি। তার উপর তুষারপাতও হচ্ছিল। ওয়ার্দার যখন তার বাসায় পৌঁছল তখন রাত্রি এগারোটা। তার চাকর দরজা খুলে দিয়ে দেখল তার মাথায় টুপিটা কোথায় পড়ে গেছে। তার গায়ের জামাকাপড় সব ভিজে গেছে।
রাত্রে ভালোভাবে বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে ঘুমোল ওয়ার্দার। সকালে চাকরকে কফি বানাতে বলল। তারপর একখানা চিঠি লিখল লোত্তেকে।
এই শেষবারের মতো চোখের পাতা খুলে চাইছি সূর্যের পানে। আর কোনওদিন এই সকালের আলো প্রাণভরে উপভোগ করব না। কথাটা যেন সত্যিই স্বপ্নের মতো শুনাচ্ছে। জীবিত অবস্থায় মৃত্যুর কল্পনা বা চিন্তা অস্পষ্ট ধূসর এক তরল স্বপ্নের মতোই মনে হয়। কিন্তু আশ্চর্য কথা দেখ। আজ আমি এই মুহূর্তে আমার দেহ-মনের সব শক্তির নিবিড়তা নিয়ে বেঁচে রয়েছি। অথচ আগামীকাল সকালে আমার অসাড় দেহটা টান টান হয়ে ছড়িয়ে থাকবে। মৃত্যু। কিন্তু কথাটার মানে কি? কত মানুষ মরেছে, কত মানুষ জন্মেছে, তবু এই জন্মমৃত্যুর আদি-অন্তহীন চক্রবর্তনের আসল মানেটা কেউ আজও বুঝতে পারেনি।
আমি চলে যাব। তোমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব। সেই অন্ধকার সংকীর্ণ কবরে গিয়ে ঢুকে থাকব। কিন্তু চলে যাব মানে? কথাটা কি শুধু এক অর্থহীন শব্দ নয়? মৃত্যু, কবর–এসব কথার আমল মানে আমি সত্যিই বুঝি না।
আমাকে ক্ষমা করো। আমি গতকালই সর্বপ্রথম আমার অস্তিত্বের গভীরতম প্রদেশ হতে এক সংশয়হীন সত্য এক প্রবল আবেগে সিক্ত হয়ে বেরিয়ে আসি। আমি সন্দেহাতীতভাবে বুঝতে পারি তুমি আমাকে ভালোবাস। তুমি আমাকে ভালোবাস। তোমার ওষ্ঠাধর থেকে যে উত্তাপ বেরিয়ে আসে, সে উত্তাপ আমার ওষ্ঠাধরকেও পুড়িয়ে দেয়। আমার অন্তরকেও স্পর্শ করে। তবু বলছি ক্ষমা করো আমায়।
তুমি আমাকে ভালোবাস একথা আমি জেনেছিলাম আমার প্রতি তোমার চাউনি দেখে, আমার হাতের উপর তোমার হাতের চাপ দেখে। তবু তোমার পাশে যখনি। আলবার্তকে দেখতাম তখুনি এক উত্তপ্ত সংশয় হতাশ করে তুলত আমায়। আচ্ছন্ন করে তুলত আমার মনকে।
তোমার মনে আছে, তুমি যখন আমাকে মুখে কোনও ভালোবাসার কথা বলতে না অথবা তোমার হাত স্পর্শ করতে দিতে না, তখন তুমি মাঝে মাঝে কিছু ফুল দিতে।
সেই ফুল আমি রাত্রিতে ঘরে রেখে তার সামনে অর্ধেক রাত নতজানু হয়ে বসে থাকতাম। সে ফুলের মধ্যে আমি পেতাম তোমার ভালোবাসার অভ্রান্ত স্বাক্ষর। কিন্তু এই বোধ আমার বেশিক্ষণ স্থায়ী হতো না। কারণ এই সব পবিত্র প্রতাঁকের মাধ্যমে ঈশ্বরের যে কৃপা ঝরে পড়ত আমার উপর তাতে বিশ্বাস আমি ক্রমশই হারিয়ে ফেলতাম।
ভালোবাসার এই সব স্বাক্ষর যত পবিত্রই হোক তা ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু গতকাল তোমার ওষ্ঠাধরে প্রেমের যে উত্তপ্ত নির্যাস আমি লাভ করি, আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে অনুভব করি, কোনও অবস্থাই তা তুলনীয় নয়। আমার এই বাহু তাকে আলিঙ্গন করেছে। আমার এই ওষ্ঠ তার ওষ্ঠ স্পর্শ করেছে, এই মুখ তার মুখ চুম্বন করেছে। তুমি আমার। হা লোত্তে, তুমি চিরকালের জন্য আমার।
তাহলে আলবার্ত তোমার স্বামী–এ কথার অর্থ কি? তার মানে এই কি যে তোমাকে ভালোবাসা পাপ? তার মানে এই যে আমি তোমাকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে আনতে চাই এবং তোমাকে ভালোবেসে আমি পাপ করেছি। তা হোক, এটা যদি পাপ হয় তাহলে এ পাপের স্বর্গীয় সুষমা আমি প্রাণভরে আস্বাদন করতে চাই। তাহলে তাতে আমি শক্তি পাব মনে। আমি আমার ও তোমার পরম পিতার কাছে চলে যাচ্ছি নির্ধারিত সময়ের আগেই। যতদিন পর্যন্ত তুমি সেখানে না যাও এবং আমি তোমাকে তাঁর সামনে অন্তহীন আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরতে না পারি ততদিন আমাদের সেই পরম পিতাই আমাকে সান্ত্বনা দেবেন।
এটা কোনও স্বপ্ন বা ভ্রান্তি নয়। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি অনেক কিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আমি বেশ জানি আমাদের আবার দেখা হবেই। আমি গিয়ে তোমার মার সঙ্গে দেখা করব। তিনি নিশ্চয়ই দেখতে তোমার মতোই। আমি তাকে আমার সব কথা খুলে বলব।
বেলা এগারোটা নাগাদ ওয়ার্দার তার চাকরকে জিজ্ঞাসা করল আলবার্ত বাড়ি ফিরেছে কি না। চাকর বলল, ফিরেছে। তার ঘোড়া সে দেখতে পেয়েছে। ওয়ার্দার তখন একটা চিরকুট লিখে চাকরের হাতে দিয়ে আলবার্তের কাছে পাঠাল। তাতে লিখল, আমি বাইরে যাচ্ছি কিছুদিনের জন্য, তোমার পিস্তল দুটো দেবে। বিদায়।
সই না করে চিরকুটটা পাঠিয়ে দিল ওয়ার্দার।
এদিকে গত সন্ধের সময় সেই ঘটনা ঘটার পর থেকে সারারাত ধরে একটু ঘুমোতে পারেনি লোত্তে। পরস্পরবিরোধী ভাবের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছিল তার অন্তর। একদিকে ওয়ার্দারের নিবিড় আলিঙ্গনের পর থেকে তার প্রতি ভালোবাসার আবেগটাকে দূরীভূত করতে পারছিল না কিছুতেই; আবার তার অতীতের নিষ্পাপ নিষ্কলুষ নারীজীবনের হারানো শুচিতার জন্য দুঃখ হচ্ছিল। আলবার্ত ফিরে এসে ওয়ার্দারের আসার কথা জানতে পেরে বিরক্ত হয়ে নানারকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে, তাতে উপহাস করবে, তার মুখে ক্রোধের ছায়া ফুটে উঠবে। এসব কথা মনে করে ভয় পেয়ে গেল লোত্তে। সে কখনও মিথ্যা কথা বলেনি জীবনে। কিন্তু আজ আলবার্তের কাছে মিথ্যা কথা বলা ছাড়া কোনও উপায় নেই। তার ক্রমবর্ধমান অস্বস্তি তার পাপটাকে বড় করে তুলল তার কাছে। তথাপি এ পাপের যে নায়ক তাকে অন্তরের
সঙ্গে ঘৃণা করতে পারল না অথবা তার মুখ কখনও দেখবে না সে প্রতিজ্ঞাও করতে পারল না। সারারাত অতন্দ্রভাবে চোখের জল ফেলে কাটিয়ে শেষ রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল লোত্তে। সকালে উঠতেই দেখল আলবার্ত এসে গেছে। আলবার্তের উপস্থিতিটা আজ প্রথম অসহ্য ঠেকল তার কাছে। পাছে তার চোখ-মুখ দেখে তার নিদ্রাহীনতার কথা জানতে পারে আলবার্ত এই ভয়ে কাঁদতে লাগল লোত্তে। সে। আলবার্তকে বেশ নিবিড় করে জড়িয়ে ধরল। সে আলিঙ্গনের মধ্যে আনন্দের আবেগের থেকে ভয় আর দুশ্চিন্তাটাই প্রকট হয়ে উঠল। আলবার্ত তাকে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে অথবা কেউ এসেছিল কিনা। লোত্তে সত্যি কথা বলল। বলল গতকাল ঘণ্টাখানেকের জন্য ওয়ার্দার এখানে এসেছিল। তখন আলবার্ত বলল, সে এখানে। আসার সময়টাও ঠিক বেছে নেয়।
এই কথা বলে তার পড়ার ঘরে গেল আলবার্ত। লোত্তে তার কাছে গিয়ে তার কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞাসা করল। আলবার্ত নীরসভাবে উত্তর করল তার কিছু লাগবে না। সে আপন মনে কি লিখতে লাগল। লোত্তে উন বুনতে লাগল। এইভাবে একঘণ্টা কেটে গেল। লোত্তে আলবার্তকে কি বলল। কিন্তু তার কোনও উত্তর দিল না আলবার্ত। লোত্তের মনে অনেক বিষণ্ণ চিন্তা ভিড় করে এল। তাতে তার দুঃখ আরও অনেক বেড়ে গেল। তার চোখে জল এল। সে মুখটা ঘুরিয়ে চোখের জল লুকোতে লাগল।
এমন সময় সেই চিরকুট নিয়ে ওয়ার্দারের লোক এল। চিরকুট দেখে আলবার্ত নীরসভাবে তার স্ত্রীকে বলল, পিস্তল দুটো দিয়ে দাও। আমি তার শুভযাত্ৰা কামনা করি।
কিন্তু কথাটা বজ্রপাতের মতো শোনাল লোত্তের কানে। নানারকম বিপদের আভাসে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল তার অন্তর। এক অব্যক্ত অনির্বচনীয় বেদনায় ভরে গেল তার মন। কিন্তু কোনও কথা বলতে পারল না সে। সে নীরবে ঘরে গিয়ে দেওয়ালের তাক থেকে পিস্তল দুটো বার করে ঝেড়ে মুছে ওয়ার্দারের লোকটার হাতে তুলে দিল যন্ত্রচালিতের মতো। একবার লোত্তের মনে হলো তার স্বামীর পায়ের উপর পড়ে। গতকাল যা যা হয়েছে সব বলবে। কিন্তু পরে আবার ভাবল তাতে কোনও ফল হবে না। আলবার্তকে অনুরোধ করলেও সে ওয়ার্দারের কাছে যাবে না।
খাবার টেবিলে সাজানো হলো। লোত্তের বান্ধবী এসেছিল। তার সঙ্গে কিছু কথা বলে কিছুটা হালকা হলো লোত্তে।
এদিকে পিস্তল পেয়ে সেগুলো আগ্রহভরে নিল ওয়ার্দার। যখন শুনল সেগুলো লোত্তে লোকটার হাতে তুলে দিয়েছে তখন তার আনন্দ বেড়ে গেল। সে রুটি আর মদ আনিয়ে সেই ঘরে বসে খেল। তারপর কি লিখতে লাগল। সে লোত্তেকে লিখল :
এই পিস্তল দুটো তোমার হাতের ছোঁয়া পেয়েছে। তুমি তাদের গা থেকে ধুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করেছ। আমি এগুলোকে তাই অসংখ্যবার চুম্বন করেছি। আমি আমার চাকরকে সব কথা খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করায় সে বলল তুমি পিস্তল দুটো যখন তার হাতে তুলে দাও তখন তোমার হাত কাঁপছিল। কিন্তু তুমি আমাকে বিদায় জানাওনি। তবে কি আমার প্রতি তোমার অন্তরের দরজাটা রুদ্ধ করে দিয়েছ? কিন্তু লোত্তে, আমার মনে যে ছাপ তুমি রেখেছ তা হাজার হাজার বছরেও মুছে যাবে না। যে তোমাকে এত জ্বালাচ্ছে তাকে তুমি ঘৃণা করতে পার না।
খাওয়ার পর কতকগুলো কাগজপত্র বেছে তা নষ্ট করে ফেলল। একবার বাইরে গিয়ে ঘুরে এল ওয়ার্দার। তখনও বৃষ্টি পড়ছিল। তবু বাইরে বেরিয়ে বেড়াতে বেড়াতে কাউন্টের বাগানবাড়ি পর্যন্ত চলে গেল ওয়ার্দার। তারপর বাসায় ফিরে এল। তারপর রাত্রিতে আবার দুটো চিঠি লিখল। একটা উইলেম আর একটা আলবার্তকে। উইলেমকে লিখল, শেষবারের মতো মাঠ, বন আর আকাশটাকে দেখে এলাম। তোমাকে শেষবারের মতো বিদায় জানাচ্ছি উইলেম। আমাকে ক্ষমা করো। মাকে সান্ত্বনা দিও। ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুক। বিদায়। পরে সুদিন এলে দেখা হবে।
এরপর আলবার্তকে লিখল, তোমার দানের প্রতিদান ঠিকমতো দিতে পারলাম না আলবার্ত। এজন্য ক্ষমা করো আমায়। আমি তোমাদের মধ্যে অবিশ্বাস জাগিয়ে তোমাদের পারিবারিক শান্তি নষ্ট করেছি। আমার মৃত্যু যাতে তোমাদের সংসারে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে তার জন্যই আমি মরছি। আলবার্ত, আমার দেবদূতকে সুখী করো। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।
এরপর লোত্তেকে আবার একটা চিঠি লিখল ওয়ার্দার।
এখন আমার অন্তর চমৎকারভাবে শান্ত। হে ঈশ্বর, শেষ সময়ে আমাকে এই আত্মশক্তি দান করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। জানালার ধারে গিয়ে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে কিছু নক্ষত্র দেখলাম। লোত্তে, গতকালও তোমার ঘর থেকে বেরিয়ে ওদের দেখেছিলাম। ওদের দেখে তোমার কথা মনে পড়ল।
আমি তোমার বাবাকে একটা চিঠিতে জানিয়েছি চার্চের উঠোনে সমাধিভূমিতে যে দুটো লাইম গাছ আছে কোণের দিকে, আমার দেহটা যেন সেইখানে সমাহিত করা হয়। আশা করি তিনি তার বন্ধুর জন্য এটুকু অন্তত করবেন। আমার ইচ্ছা ছিল কোনও পথের ধারে অথবা কোনও নির্জন উপত্যকাভূমিতে আমার দেহটাকে সমাহিত করা হবে।
এবার যে মৃত্যুর পেয়ালা তুমি নিজের হাতে তুলে দিয়েছ লোত্তে, আমি তা প্রাণভরে পান করব। আমি তোমার জন্য মৃত্যুবরণ করছি। তোমার জন্য আত্মত্যাগ করছি–একথা ভেবে এ মৃত্যুতে আনন্দবোধ করছি আমি। প্রিয়জনের জন্য জীবনদান করার ঘটনা এমন কিছু নূতন নয়। আমি এই পোশাক পরেই মরব। এ পোশাক তোমার স্পর্শে পবিত্র হয়ে আছে। যে গোলাপটি তুমি আমার জন্মদিনে দান করেছিলে সে গোলাপটি আমার মৃতদেহের সঙ্গে সমাহিত হবে কবরে। তুমি শান্তভাবে সব কিছু সহ্য করবে।
পিস্তল দুটো গুলিভর্তি আছে। এখন রাত্রি বারোটা বাজে। বিদায়, লোত্তে, বিদায়।
ঐ সময় জনৈক প্রতিবেশী ওয়ার্দারের ঘরে গুলির শব্দ শোনে এবং আগুনের একটা ঝিলিক দেখে। কিন্তু তা শুধু মুহূর্তে জন্য। পর পরমুহূর্তে সব চুপ হয়ে যায়।
পরদিন সকাল ছটায় সময় ওয়ার্দারের চাকর বাতি হাতে তার ঘরে ঢোকে। ঢুকেই দেখে ওয়ার্দার মেঝের উপর পড়ে রয়েছে। তার মাথা থেকে রক্ত ঝরছে এবং তার পাশে একটা পিস্তল পড়ে রয়েছে। সে তখন ওয়ার্দারের দেহটা ধরে নাড়া দেয়। কিন্তু সে দেহ নিথর নিস্পন্দ। শুধু তার গলা থেকে ঘর্ষর একটা আওয়াজ হচ্ছিল। সে তখন ছুটে গিয়ে ডাক্তার ডাকে। আলবার্তকে খবর দেয়। কথাটা শুনে আলবার্তের সামনেই মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে লোত্তে।
ডাক্তার এসে ওয়ার্দারকে পরীক্ষা করে দেখল কোনও আশা নেই। তার নাড়ীতে তখনও অবশ্য স্পন্দন ছিল। কিন্তু অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো অসাড় হয়ে গেছে। ওয়ার্দার তার ডান চোখের পাশ দিয়ে রগের ভিতর গুলি করেছে। তার মাথার ভিতরটা গুড়ো গুড়ো হয়ে গেছে। তার হাতে আর চেয়ারে রক্ত লেগে ছিল। এর থেকে বোঝা গেছে যে টেবিলের কাছে চেয়ারে বসে গুলি করেছে নিজের মাথায়। তারপর সে চেয়ার থেকে মেঝেয় গড়িয়ে পড়ে যায়। তার পায়ে জুতো ছিল আর পরনে ছিল প্যান্ট, নীল কোট আর হলুদ রঙের ওয়েস্ট কোট।
ওয়ার্দারের মাথায় ব্যান্ডেজ করে তাকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়। সারা শহরের মধ্যে চাঞ্চল্য পড়ে যায়। অনেকে দেখতে আসে। খবর পেয়ে আলবার্ত ছুটে আসে। আলবার্ত ভয় পেয়ে যায়, লোত্তে দুঃখে অভিভূত হয়ে পড়ে।
লোত্তের বাবা খবর পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এল। তার চোখ থেকে জল ঝরে পড়ছিল। ওয়ার্দারের দেহটা ধরে বারবার চুম্বন করতে লাগল বৃদ্ধ। সব ছেলেমেয়েদের মধ্যে বড় ছেলেটিকে সবচেয়ে ভালোবাসত ওয়ার্দার। সব ছেলেমেয়েরা এসে দুঃখে ভেঙে পড়ল। তার হাতটা টেনে নিয় চুম্বন করতে লাগল। বড় ছেলেটি ওয়ার্দারের মুখে মুখ রেখে কাঁদতে লাগল। তাকে জোর করে ছাড়িয়ে নিতে হলো।
দুপুরে মারা গেল ওয়ার্দার। তার নির্বাচিত জায়গায় তাকে কবর দেয়া হলো। লোত্তের বাবাই সব ব্যবস্থা করল। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হতে রাত্রি এগারোটা বেজে গেল। লোত্তের বাবা ও সব ভাইবোনেরা উপস্থিত ছিল। কিন্তু লোত্তের অবস্থা খারাপ থাকার জন্য আলবার্ত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান করতে পারেনি।