উপন্যাস
বড়গল্প
ছোটগল্প
1 of 2

সাপে আর নেউলে

সাপে আর নেউলে

এক

বেলা তখন ক’টা হবে, সকাল আট কি সাড়ে আট। বলা নেই কওয়া নেই চারজন ষণ্ডামার্কা লোক তরতর করে আমাদের দোতলায় উঠে এল। দক্ষিণের হলঘরের মতো বড় ঘরটায় ঢুকে ফার্নিচার-মার্নিচার যা ছিল সব ধরাধরি করে বাইরের বারান্দায় বের করতে লাগল। মেজোমামা পুবের জানলার ধারে জলপাইগুড়ি থেকে আনা আরামদায়ক একটা বেতের চেয়ারে বেশ ফলাও হয়ে বসে দর্শনের বই পড়ছেন। এতটাই ডুবে গেছেন বিষয়ে যে, ঘরের মধ্যে চারটে দৈত্যের মতো লোক কীসব টানাহ্যাঁচড়া করছে, সেদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপই নেই। আমার মেজোমামা এইরকমই। পড়তে বসলে আর জ্ঞান থাকে না। ইদানীং ব্যায়াম করা ছেড়ে দিয়েছেন বলে বেশ একটু মোটা হয়েছেন, রংটাও বেশ ফরসা হয়েছে। এতদিনের ব্যায়াম হঠাৎ ছাড়ার কারণ, বড়মামা একদিন একটা মেডিকেল জার্নাল সামনে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘মেজো, পড়ে দ্যাখো, ব্যায়ামের কুফল। মাথামোটা হয়ে যায়। দর্শন, বিজ্ঞান, গণিত সেই বোদামাথায় আর ঢুকবে না। ভালো চাও তো হোঁত হোঁত ডনবৈঠক মারা ছেড়ে শুধু মর্নিং ওয়াকের ওপর থাকো’।

এই ওয়াকিংটা মেজোমামা কোনওকালেই পছন্দ করেন না। অকারণে হাঁটার কোনও মানে হয়! ফলে হপ্তায়-হপ্তায় ওজন বাড়ছে। যে-বইটায় তলিয়ে আছেন বিষয়টা তার জানি, বিজ্ঞান ও ভগবান। ভগবান কি আছেন!

মেজোমামার পেছনে দেওয়াল ঘেঁষে একটা বড় টেবিল। এইবার সেই টেবিলটা বেরোচ্ছে। হুটপাট শব্দ শুনে মাসিমা এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। দেখছেন ব্যাপারস্যাপার। বলা নেই কওয়া নেই, এরা কারা! মেজোমামা যেমন গ্রাহ্য করছেন না, ওরাও তেমনই গ্রাহ্য করছে না। টেবিলটাকে চারজনে মিলে তুলেছে। পেছনে একটা ড্রয়িং বোর্ড খাড়া করা ছিল, সেটা সপাটে পড়ল।

মাসিমা তখন একটা হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘মেজদা।’

মেজোমামার কানের রকমটা আমি জানি। মোটা, ভোঁতা, গম্ভীর শব্দ কানে যায় না। সরু, তীক্ষ্ন আওয়াজে চমকে ওঠেন। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে।

মাসিমা বললেন, ‘তোমার ঘরে এরা কারা?’

মেজোমামা এই প্রথম লোক চারজনকে দেখে মাসিমাকেই প্রশ্ন করলেন, ‘এরা কারা?’

‘ঘরের আদ্দেক জিনিস বাইরে বেরিয়ে গেল, তুমি জানো না এরা কারা! কোন জগতে ছিলে?’

মেজোমামা ভুবনভোলানো সেই বিখ্যাত হাসিটি হেসে বললেন, ‘কুসি, আমি এখানে ছিলুম না রে!’ লোক চারজন টেবিল ধরে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। ভয় পেয়ে গেছে ভয়ানক। মাসিমার চেহারাটা ঠিক মা-দুর্গার মতো তেজস্বী।

মাসিমা বললেন, ‘তোমরা কে?’

যে উত্তর দিল সে মনে হয় দলের নেতা, ‘আমরা বড়বাবুর লোক।’

‘বড়বাবুর লোক তো মেজোবাবুর ঘরে ঢুকে কী করছ?’

‘বড়বাবুর অর্ডার।’

‘বড়বাবুর অর্ডার! বড়বাবু কী অর্ডার দিয়েছে! টেবিল রাখো। উতারো।’

টেবিলটাকে মেঝেতে রেখে দলনেতা বলল, ‘মেঝেটা চটাব।’

‘চটাব মানে?’

‘মানে খুঁড়ে ফেলব।’

‘খুঁড়ে ফেলব মানে, এটা কি বড়বাবুর মামার বাড়ি!’

দলনেতা বেশ এয়ার নিয়ে বলল, ‘অর্ডার সেই রকমই।’

মাসিমা আমাকে জিগ্যেস করলেন, ‘বড়দা কোথায় রে?’

বেশ কিছুক্ষণ আগে বড়মামাকে তিনতলার ছোট ছাতে দেখেছিলুম। শর্টস পরে সিদ্ধাসনে বসে সাঁই-সাঁই প্রাণায়াম করছেন। সেই কথা বললুম।

মাসিমা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, ‘প্রাণায়ামের নিকুচি করেছে। শিগগির টেনে তুলে আনো।’

হঠাৎ কানে এল বড়মামার গলা। সুর করে বলছেন, ‘কুসি, হিয়ার আই অ্যাম। কুসি।’

একটু সরে গিয়ে আমরা ওপর দিকে তাকালুম। তিনতলার ছাদের বাহারি আলসের ফাঁকে বড়মামার হাসি-হাসি মুখ, ‘ম্যাডাম কুসি, দে আর জাস্ট এগজিকিউটিং মাই অর্ডার। গো অন আলম।’

‘তুমি নেমে এসো।’

‘নামছি, নামছি। জাস্ট অ্যানাদার রাউণ্ড অব ডিপ অ্যাণ্ড সিনসিয়ার ব্রিদিং।’

‘এইটাই তোমার লাস্ট ব্রিদ হবে, যদি এখুনি, এই মুহূর্তে না নেমে আসো।’

মেজোমামা ওপর দিকে তাকিয়ে যোগ করলেন, ‘ইউ উইল হ্যাভ টু কাউণ্ট সরষে। ইউ উইল সি মাস্টার্ড ফ্লাওয়ার।’

মাসিমা তিরস্কার করলেন, ‘তোমার রাগ হচ্ছে না মেজদা!’

মেজোমামা হাসতে-হাসতে বললেন, ‘কী সুন্দর দুষ্টু-দুষ্টু মুখ দ্যাখো। রাগ করা যায়! অবিকল একটা লাউ। এসো, নেমে এসো ভ্রাতা, কুসির হাতে ছেঁচকি হবে।’

লোক চারজন অবাক হয়ে কাণ্ড দেখছে। এমন ফ্যামিলি এই বাজারে কে কোথায় দেখেছে।

বড়মামা সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে আসছেন ছোট ছেলের মতো।

মেজোমামা বললেন, নামছে দেখেছিস, যেন অনুষ্টুপ ছন্দ!

মাসিমা বললেন, ‘পড়বে যখন, ছন্দ বেরিয়ে যাবে, হয়ে যাবে সিঁড়ি-ভাঙা অঙ্ক।’

বড়মামার এখন এই সাধনা চলছে, ‘থিঙ্ক ইয়াং অ্যাণ্ড ইউ উইল রিমেন এভার ইয়াং’। একটা বই কিনে এনেছেন, ‘লাফটার ইজ দা বেস্ট মেডিসিন’। একটা বড় আয়না কিনে এনেছেন, রোজ সেইটার সামনে দাঁড়িয়ে নানাভাবে নিজেকেই নিজে ভেংচি কাটেন। আপনমনে নানারকম পাগলামি করেন। নিজের সঙ্গেই আবোলতাবোল বকেন। এইসব নাকি মডার্ন মেডিসিন।

শর্টস আর স্যাণ্ডো গেঞ্জি পরা বড়মামাকে ফ্যানটাসটিক দেখাচ্ছে।

মাসিমা কোনওরকম ভনিতা না করে বললেন, ‘তুমি এদের বলেছ মেজদার মেঝে খুঁড়তে!’

‘বলেছি।’

‘কেন বলেছ? এটা কী ধরনের শত্রুতা!’

‘শত্রুতা নয় বৎস, মিত্রতা। প্রবল মিত্রতা। ওর জন্মদিনে ওকে আমি মার্বেল পাথরের ধবধবে সাদা একটা মেঝে উপহার দেব বলে মনস্থির করেছি। আমার গভীর বিশ্বাস, আগামী বছরে ও নোবেল পুরস্কার পেয়ে জাতির মুখ উজ্জ্বল করবে।’

মাসিমা বললেন, ‘কীজন্যে পুরস্কার পাবে?’

‘ভগবানকে আবিষ্কার করার কারণে, আজ পর্যন্ত কেউ যা পারেনি।’

‘এই বংশে কেউ যদি নোবেল পুরস্কার পায়, সে পাবে পাগলামির জন্য। নমিনেশনের একেবারে এক নম্বরে থাকবে তোমার নাম। এমন সুন্দর লাল চকচকে মেঝেটো কী কারণে তোমার অসহ্য লাগছে! পয়সা বেশি হয়েছে? যদি হয়ে থাকে নষ্ট না করে গরিবকে দান করে দাও। তোমরা দুই পাগলে সংসার খরচটাকে কোথায় তুলেছ, কোনও ধারণা আছে? বিশ হাজার!’

বড়মামা বললেন, ‘কুসি, তোর এই এক আছে, টাকা টাকা, আরে টাকা কি তোর সঙ্গে যাবে! খরচ করতে শেখ। আমার কোষ্ঠীতে কী লেখা আছে জানিস, যত খরচ করবে, তত টাকা আসবে। আমি স্বপ্ন দেখছি রে! ভোরের স্বপ্ন। আমার গ্রেট, গ্রেট গ্র্যাণ্ডফাদার এসে বলছেন, মিস্টার মুখার্জি, আমি ইতালিয়ান মার্বেল পাথরের মেঝেতে, ভেলভেটের আসনে বসে রুপোর জামবাটিতে, নিজেদের চাষের গোবিন্দভোগ চাল আর আমাদেরই কালো গাইয়ের ক্ষীরের মতো দুধ দিয়ে তৈরি পায়েস খেতুম, তাতে কান্দাহারের পেস্তা, বাদাম, কিশমিশ গজগজ করত। আমাদের সেই পুরনো গৌরব ফিরিয়ে আন। কুসি, থিঙ্ক বিগ ইউ উইল বি বিগ। ছুঁচোর কথা ভাবিসনি, হাতি ভাব, ছুঁচের কথা ভাবিসনি, শাবলের কথা ভাব। মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার। আমি কী ভাবি জানিস, আমি নেপোলিয়ান, আমি কাইজার, আমি এম্পারার, আমি জার, আমি বিক্রমাদিত্য, আমি হর্ষবর্ধন…।’

মাসিমা ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, ‘তুমি একটি গোবর্ধন। গবা। তোমার মাথায় গোবর। মার্বেল পাথরের দাম জানো? এই কুড়ি বাই আঠারো ঘরে কত লক্ষ টাকার মার্বেল লাগবে, আইডিয়া আছে?’

‘কুসি, মার্বেল কি আমি মার্কেট থেকে কিনব রে ভাই! আমার এক পেশেন্ট একটা মার্বেল পাহাড় কিনেছে।’

‘নিশ্চয় মেন্টাল পেশেন্ট।’

‘আজ্ঞে না, সুগারের। আমি সেই সুগার ফ্যাকট্রিকে ম্যানেজ করেছি মানিক। সেই পাহাড়ের কিছুটা অংশ ধসিয়ে আমাকে দেবে। দি হোল হাউস উইল বি এ মার্বেল প্যালেস। ঘরে-ঘরে ঝাড়লণ্ঠন, দেওয়ালে-দেওয়ালে দেওয়ালগিরি। সকালে ভাত, রাতে বিরিয়ানি।’

‘তোমার লজ্জা করে না বড়দা? তোমার আক্কেল কবে হবে? একজন তোমাকে একটা ভাঙা মোটরগাড়ি ড্যাম চিপ বলে চৌত্রিশ হাজারে গছিয়ে গেল। সেই গাড়ি অ্যায়সা তেল খেতে আরম্ভ করল যে, শেষে সংসারটাই খেয়ে ফেলে আর কী! এমন এক ড্রাইভার আনলে সাত মাসে সাতবার অ্যাকসিডেন্ট, গচ্চা আরও সাত হাজার। এই করতে-করতে চৌত্রিশ লাখে উঠল। সেই গাড়ি পড়ে আছে গোয়ালে। বেড়ালের আঁতুর ঘর। তোমাকে আমি মেঝে করতে দেব না। যা আছে, বেশ আছে, সুন্দর আছে।’

মেজোমামা আমতা-আমতা করে বললেন, ‘একটা ইচ্ছে যখন হয়েছে, স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশ, ফুলফিল না করলে পূর্বপুরুষদের ক্রোধ হবে, সংসারের ক্ষতি হবে, ইত্যাদি, ইত্যাদি।’

মাসিমা ভেংচি কেটে বললেন, ‘ইত্যাদি, ইত্যাদি। তোমরা তোমাদের গ্রেট, গ্রেট, গ্রেট গ্র্যাণ্ডফাদারকে দেখেছ! মিথ্যে বলতে গিয়ে এতটাই পেছিয়েছ যে, অরণ্যের কালে চলে গেছ। সেই সময় তোমাদের গ্রেটেস্ট গ্র্যাণ্ডফাদার বল্কল পরে ঘুরতেন, ঝলসানো মাংস খেতেন আর গুহায় থাকতেন। মার্বেল পাথরের গুহা হলেও বোঝা যেত। অর্ডিনারি পাথরের গুহা। রুপোর জামবাটি, গোবিন্দভোগ, স্বপ্নই বটে! আলমসাহেব, মেঝেফেজে হবে না। যেখানকার-যেখানকার জিনিস সব সেইখানে-সেইখানে ফিট করে দিন।’

টেবিল এতক্ষণ আট হাতের চ্যাংদোলায় দোল খাচ্ছিল, ঠক ঠকাস করে মেঝেতে নেমে এল। আলমসাহেব বারকতক হাতের ব্যায়াম করে নিয়ে বললেন, ‘বড়বাবু গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল করবেন না। পাথর রইল পাহাড়ে আপনি হুকুম দিয়ে দিলেন মেঝে খুঁড়ে ফেল। মায়েদের পরামর্শ না নিয়ে কেন কাজ করতে যান! বেকার পরিশ্রম হল।’

এই বেকার শব্দটাই হল কাল। বড়মামা ইদানীং অনেক সাধনার মধ্যে এই সাধনাটাও ঢুকিয়েছিলেন, কিপ আইসকুল। শতকাণ্ডেও মেজাজ বরফ। এর নাম তিতিক্ষা। সেই তিতিক্ষা সামান্য একটা শব্দের গুলিতে তাসের ঘরের মতো চুরমার হয়ে গেল। সম্বোধন তুমি থেকে তুই-এ নেমে এল, ‘কী বললি, বেকার! কত টাকা তোকে দিতে হবে বল! ফুলরোজ দিয়ে দেব। সুধাংশু মুকুজ্যে বেকার কাজ করায় না। বল তোদের কত টাকা রোজ।’

আলমসাহেব থতমত খেয়ে বললেন, ‘বড়বাবু, টাকার কথা কি আমি একবারও বলেছি? আমাদের এটা কথার মাত্রা।’

সঙ্গে-সঙ্গে বড়মামা বললেন, ‘মেঝে আজই খোঁড়া হবে। পাহাড় থেকে পাথর না আসে, দোকান থেকে আসবে। বিশ-বাইশ লাখ যা লাগে এই সুধাংশু মুকুজ্যেই ক্যাশডাউন করবে।’

মাসিমা গম্ভীর মুখে বললেন, ‘তোমার অ্যাকাউন্টে বাইশ হাজারও নেই।’

‘কেন নেই?’

‘বদখেয়ালে উড়িয়ে দিয়েছ।’

‘কুছ পরোয়া নেই, বাড়ি বিক্রি করে দেব। তিরিশ থেকে চল্লিশ লাখ টাকার প্রপার্টি।’

‘বাড়িই যদি বিক্রি করে দিলে, তা হলে মেঝেটা হবে কোথায়! আমাদের মাথায়! যতসব আজগুবি কথা।’ বড়মামার মুখটা দেখার মতো হল। অসহায়, করুণ।

নিজের মনেই প্রশ্ন করলেন, ‘মেঝে তা হলে হবে না!’

মাসিমা বললেন, ‘না, সুখে থাকতে আর ভূতে কিলোবে না। অনেক খেলা তুমি দেখিয়েছ, এইবার রেস্ট।’

বড়মামা আবার উত্তেজিত, ‘রেস্ট! আমার খেলা শেষ হবে না কালীচরণ! সারাজীবন আমি খেলব। আমি দুবাই যাব।’

মেজোমামা এতক্ষণে কথা বললেন, ‘দুবাই যাবে কি সোনা আনতে?’

‘না, পেট্রোডলার আনতে। কাগজে দেখেছি, দুবাই ভারতীয় ডাক্তার চাইছে। তিন বছর ডাক্তারি করে তিরিশ লাখ টাকা কামিয়ে ফিরে আসব।’

মাসিমা আলমদের বললেন, ‘ব্যস, একেবারে পাকা কথা, আজ থেকে তিন বছর পরে কাজ শুরু হবে।’

বড়মামা বললেন, ‘না না, অত দেরি নয়, লোনে সব হবে। এসে ঝটাঝট শোধ করে দেব।’

‘তোমাকে লোনটা কিসের এগেনস্টে দেবে?’

‘এই বাড়িটা। শোধ করতে না পারলে, বাড়ি, জমি, সব তোমার, আমি ডিড সই করে দেব।’

মাসিমা বললেন, ‘এটার মাথায় তিন বালতি বরফজল ঢেলে দে ভাগনে। প্রাণায়ামের বায়ু ফুসফুসে না ঢুকে মাথার চড়ে বসেছে। তাতেও না হলে রাঁচি।’

আলমসাহেব বললেন, ‘সব বেক…।’

ঢোক গিলে সামলে নিলেন। বলতে চাইছিলেন, সব বেকার হয়ে গেল। জোর করে একমুখ হেসে বললেন, ‘ফালতু টাকা নষ্ট করে কী হবে! এমন সুন্দর বিলিতি পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের মেঝে, আয়নার মতো চকচক করছে। এক যদি হাওলার টাকা ধরতে পারতেন, তা হলে গোটা বাড়িটাই মার্বেলে মোড়া যেত। বরং কোথাও মার্বেলের একটা রক করে নিন। সকাল, বিকেল সবাই একসঙ্গে বসে চা-বিস্কুট খাবেন। গল্প করবেন।’

দুই

গভীর রাতে কী একটা কারণে ঘুম ভেঙে গেল। একটা ঘরে দুটো আলাদা খাটে আমি আর বড়মামা ঘুমোই। দেখি, বড়মামার খাটটা খালি। এত রাতে ভদ্রলোক গেলেন কোথায়! দেখা দরকার। দরজা ভেজানো ছিল। খুলে বাইরে ছাতে এলুম। অল্প চাঁদের আলোয় চারপাশে ওড়ানা টানা। আগে আমার খুব ভূতের ভয় ছিল। নাইন থেকে টেনে ওঠার পর ভয় চলে গেছে। এখন আমি একা একটা পোড়াবাড়িতে থাকতে পারি। ভূত বাঘ নয়, সাপ নয়, বিছে নয়। ভূত কামড়ায় না, আঁচড়ায় না, কেবল একটু ভয় দেখায়। ভয় না পেলেই হল। চেহারার কোনও ছিরিছাঁদ নেই, কঙ্কালসার। সে আর কী করা যাবে।

যেদিকটায় বাগান, আম, কাঁঠাল, কলা, নারকেল কদম, কৃষ্ণচূড়ার একাকার কাণ্ড, ছাতের সেই দিকটায় বড়মামা চুপ করে বসে আছেন। একটা উল্কা জ্বলতে-জ্বলতে দক্ষিণ থেকে পশ্চিম আকাশের দিকে সাঁই-সাঁই করে চলে গেল। স্কুলে আমরা এর নাম রেখেছি ‘তারকার আত্মহত্যা’। বড়মামা আমার দিকে পেছন ফিরে বসে আছেন। আমি যেই কাঁধে হাত রেখেছি, শিউরে উঠলেন। ভয়ে কাঠ। আমাকে ভূত ভেবেছেন। মৃদু স্বরে বলছেন, ‘রাম, রাম।’

আমি ধীরে ডাকলাম, ‘বড়মামা।’

আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, ‘তুই?’

‘এত রাতে একা-একা তুমি এখানে কী করছ?’

‘সত্য খুঁজছি।’

‘সত্য আবার কী?’

‘বোস এইখানে। রাতের বেলা ঘুমোস কেন? ঘুমিয়ে জীবনটাকে নষ্ট করলি। জেগে থাকলে কত কী জানতে পারা যায়! কত কী দেখা যায়! জানিস তো, পাখিদের মধ্যে একমাত্র প্যাঁচাকেই বলে জ্ঞানী, ওয়াইজ আউল। কারণ, পৃথিবীর সবাই যখন ঘুমোয় তখন প্যাঁচা জেগে থাকে, রাতের চৌকিদার। এই তো একটু আগে আমগাছের এই ডালটায় বসে আমাকে দেখছিল, কী ঘুমোওনি! সবাই তো ঘুমোচ্ছে, তুমি কেন জেগে! যেই বলেছি, আমি যে তোমার শিষ্য, কী খুশি! বললে, রাতকে জানলেই সত্যকে জানতে পারবে।’

‘আপনি এক-একদিন এক-একরকম বলেন। এই সেদিন বললেন, উপনিষদ বলছে, জ্ঞানই সত্য আর সূর্যই হল জ্ঞান, দিন ছাড়া সূর্য পাবেন কোথায়! সেদিন বললেন, ‘জ্ঞান সূর্যের আলো, অজ্ঞানের অন্ধকার।’

‘এইসব ব্যাপারে তোর মাথাটা রিয়েল মোটা। যে-সূর্য পুব আকাশে ধকধক করে জ্বলে, ওটা ফায়ার বল। টন টন হিলিয়াম দাউ-দাউ জ্বলছে। আমাদের গরমে, ঘামে, ঘামাচিতে রোজ অতিষ্ঠ করে মারছে। কবে যে এই জ্বলা শেষ হবে! পৃথিবীটা একটু ঠান্ডা হবে! দরকার নেই আমার আমগাছ, জামগাছ, দরকার নেই ফড়িং প্রজাপতি। পৃথিবীটা কিছুদিনের জন্যে আইসক্রিম হয়ে যাক। শ্বেত ভালুক আর হোয়াইট টাইগার, স্নো লেপার্ড আর ব্ল্যাক অ্যাণ্ড হোয়াইট পেঙ্গুইন। আর কুছ নেহি মাংতা।’

কোথা থেকে অন্যরকম একটা গলায় কে প্রশ্ন করল, ‘খায়েগা কেয়া। হরি মটর!’

গলাটা বেশ ভারী। ছাতে সম্প্রতি যে নতুন জলের ট্যাঙ্কটা তৈরি হয়েছে, প্রশ্নটা এল তার ওপাশ থেকে। সেদিকে একটা বেলগাছ আছে। খুবই প্রাচীন। প্রবাদ আছে, গাছে নাকি বন্ধুভাবাপন্ন এক ব্রহ্মদৈত্য বহুদিন বসবাস করেছেন। এই পরিবারেরই এক মানুষ, সামান্য অপরাধে ব্রহ্মদৈত্য হয়ে আছেন। কিন্তু কেউ কোনওদিন তাঁর দর্শন পায়নি।

বড়মামা আমার হাতটা কষকষে করে চেপে ধরলেন। আমার বুকের ভেতরটাও গুমগুম করছে। যুক্তিবাদে তেমন জোর পাচ্ছি না। লৌকিক অলৌকিক হয়ে গেল বলে। আমিও বড়মামার হাতটা জোরে চেপে ধরেছি। এই কণ্ঠস্বর তাঁরই। বড়মামা খুব ভক্তিভরে বললেন, ‘প্রভু! রাতের প্রাণী প্যাঁচাদেরও তো খাদ্য আছে।’

‘কী খাদ্য বৎস?’

‘ইঁদুর।’

‘ইঁদুর পাবে কোথায়, সবই যদি বরফ হয়ে যায়!’

‘প্রভু, বরফে গর্ত খুঁড়ে শ্বেত ইঁদুর বের করব। হোয়াইট র‍্যাট।’

‘বৎস, হোয়াইট র‍্যাট কী খেয়ে বাঁচবে? হোয়াইট ব্যাট? গবেট!’

বড়মামা ব্রহ্মদৈত্যের ওপর ভীষণ কুপিত হয়ে বললেন, ‘আমার বাঁচার ব্যবস্থা আমি করে নেব, আপনাকে ভাবতে হবে না আমি সকাল-বিকেল আচ্ছাসে পেঁয়াজ, আদা, কাঁচালঙ্কা দিয়ে পেঙ্গুইনের ডিমের ওমলেট আর কফি খাবে। চমরি গাইয়ের দুধ দিয়ে রাবড়ি করে খাব। লেবু দিয়ে ছানা কাটিয়ে কমলাভোগ তৈরি করব।’

এইবার ব্রহ্মদৈত্য আরও কুৎসিত গালাগাল দিলেন, ‘পাঁঠা, সূর্য চলে গেলে সবুজও অদৃশ্য হবে। যে ঘাস তুমি এখন খাও সেই ঘাসও হবে না, শাকপাতা, গাছপালা সব মরে যাবে। কোথায় পাবে তোমার পেঁয়াজ, লেবু, কাঁচালঙ্কা, সরষে, সরষের তেল। সব প্রাণী, জীবজগৎ মরে ভূত হয়ে যাবে। সূর্য আছে বলেই জল থেকে বাষ্প, বাষ্প থেকে মেঘ, মেঘ থেকে বৃষ্টি। মরুভূমি আছে বলেই মৌসুমী বায়ু, ধান চাল, গম, রবিশস্য। গর্দভ, সূর্য ফাদার হলেও পৃথিবীর মাদার।’

‘প্রভু, এত গালাগাল দিচ্ছেন কেন?’

‘আমি তোমার শিক্ষক ছিলাম বৎস। তোমার মতো গাধাকে পিটিয়ে ঘোড়া করার কৃতিত্ব যে আমার। সূর্যশূন্য পৃথিবী মৃত পৃথিবী।’

‘মানতে পারলাম না প্রভু, সাইবেরিয়া, আইসল্যান্ডে মানুষ বাঁচছে কী করে! সমুদ্রের তলায় আছে অঢেল সম্পদ। নতুন ধরনের মানুষ নতুন জীবনে অভ্যস্ত হবে। সবুজ মাঠের বদলে সাদা মাঠ, সাদা বাড়ি, জুতোর বদলে স্কেটিং শু মোটরের বদলে স্লেজ, টানবে বলগা হরিণ, স্কি করতে-করতে অফিস। আলোর মালায় শহর, নগর ঝিলমিল করবে। ঠান্ডার দেশের ধর্ম হবে খ্রিস্ট ধর্ম। দিকে-দিকে ক্রিসমাস ট্রি, পাতায়-পাতায় আইসক্রিমের মতো বরফ। চার্চ বেল। হিম। লুঙ্গি, গামছা, পাজামা, পাঞ্জাবি বিদায়। শুধু প্যান্ট, কোট, হ্যাট, টাই। সিল মাছের গ্রিল, ডলফিনের ড্রিল! আকাশে সবসময় চাঁদ আর তারা। কেয়া মজা!’

‘ছাগল।’

‘কে ছাগল?’

‘তুমি একটি আস্ত বোকাপাঁঠা। সূর্য চলে গেলে চাঁদ আলো পাবে কোথায়?’

‘আমাদের রকেট গিয়ে হ্যালোজেন ফিট করে দিয়ে আসবে।’

‘তুমি একটা পাগল।’

‘তুমি একটা ভূত।’

‘তুমি একটা মুক্তকচ্ছ উন্মাদ।’

‘মনে পড়েছে, কচ্ছপ আর কাঁকড়া খাব, ঝিনুক আর মাশরুম খাব।’

আমাদের পেছনে কখন যে মাসিমা এসে দাঁড়িয়েছেন আমরা খেয়াল করিনি। তরজার মতো ঝগড়া, ঝগড়ার মতো তরজা চলেছে। মাসিমার হাতে বেত। সেটা নাচাতে-নাচাতে বললেন, ‘এই যে, বলি এটা যে রাত সেটা খেয়াল আছে কী?’

‘আছে।’

‘রাত্তিরে মানুষ কী করে!’

‘ভোগীরা ঘুমোয়, যোগীয় জেগে থাকে।’

‘পাগলরাও জেগে থাকে, আর দাওয়াই হল পেটাই।’

মাসিমা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই এখানে কী করছিস। তোর কাল স্কুল নেই।’

আমার তখন উত্তেজনার শেষ নেই। মাসিমাকে আমি মৌ বলি। ‘জানো মৌ, বেলগাছের ব্রহ্মদৈত্য এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। সত্যি-সত্যি। নিজের পরিচয় দিলেন, বড়মামার মাস্টারমশাই ছিলেন। খুব ভালো ব্রহ্মদৈত্য, বড়মামাকে গাধা ছাগল, পাগল সব বলেছেন।’

‘ব্রহ্মদৈত্য! সিদ্ধিফিদ্দি খেয়েছিস নাকি? এত বছর এ-বাড়িতে আছি, একদিনও কিছু শুনলাম না।’

বড়মামা বেশ অহঙ্কারের গলায় বললেন, ‘সাধক ছাড়া ওরা দর্শন দেন না কথাও বলেন না।’

‘কথাটা কোনদিক থেকে আসছিল রে!’

‘ট্যাঙ্কের ওপাশ থেকে। যেদিকে বেলগাছ।’

মাসিমা দুদ্দাড় করে সেদিকে এগোলেন। শুনতে পেলুম মাসিমা বলছেন, ‘ও পালের গোদা, তুমিও আছ।’

বড়মামা হামা দিয়ে সেদিকে কিছুটা এগিয়ে ট্যাঙ্কের পাশ থেকে উকি মারলেন, ‘মেজো তুই?’

‘ভগবানকে দেখব বলে বসে ছিলুম, এমন সময় ব্রহ্মদৈত্য ভর করল।’

মাসিমা হতাশ হয়ে বসে পড়লেন থেবড়ে, ‘বুঝলে, আমার দ্বারা আর হবে না। তোমাদের জন্যে চাই জাঁদরেল একজন শাসক। তোমরা যা বেড়েছ না!’

দূরে একটা বিশাল কারখানা আছে, সেখানকার পেটা ঘড়িতে ঢ্যাং-ঢ্যাং করে দুটো বাজল। উত্তরের আকাশে ব্লপ করে ভেসে উঠল একটা আলোর বল। ধীরে-ধীরে ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে ফানুসের মতো। এদিকে বিরাট ক্যান্টনমেন্ট। মিলিটারিরা গভীর রাতে অনেক কিছু পরীক্ষা করে। আলোর বলটায় অনেকরকম শব্দ হচ্ছে, যেন মন্ত্র পড়ছে। সহসা আকাশভর্তি আলো হয়ে গেল। সেই আলোয় ছাতে আমাদের ছায়া পড়ল। গাছের পাতায় ঘন কালো ছায়া, এত জোর আলো। কিছু পাখি ভোর হয়ে গেছে ভেবে বোকার মতো কিচিরমিচির করে উঠল।

বড়মামা বললেন, ‘মার্কার। সেকেন্ড ওয়ারে আমি অনেকবার দেখেছি।’

জিগ্যেস করলুম, ‘মার্কার কী?’

‘রাত্তিবেলা শত্রু কোথায় দেখার জন্যে এই ফসফরাস আলো ভাসানো হয়।’

হঠাৎ মাসিমা বললেন, ‘রাতটা কত সুন্দর! এমন কত সুন্দর রাত আমরা ঘুমিয়ে নষ্ট করি। ভাগ্যিস জেগে ছিলুম তাই না এমন সুন্দর আলো দেখতে পেলুম।’

বড়মামা মাসিমার কথায় খুব খুশি হলেন, ‘আমি তো সেইজন্যে জেগে থাকারই চেষ্টা করি। রাতে অনেক সত্য ধরা যায়।’

মেজোমামা জ্ঞানী মানুষ, সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, ‘একটু কারেকশন করে দিই, সত্য অনেক নয়, সত্য এক এবং অদ্বিতীয়।’

বড়মামা বললেন, ‘সেটা কী?’

মেজোমামা গান গেয়ে উত্তর দিলেন, ‘আমি নেই, তুমি নেই, কেউ নেই, কেউ নেই, ওড়ে শুধু একঝাঁক পায়রা।’

‘এ তো সেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান রে! আমার কলেজ জীবনের। শ্যামল মিত্রের সেই গান, স্মৃতি তুমি বেদনা। সতীনাথের পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম। কীসব গান! ও দয়াল বিচার করো। সিনেমার আমার প্রিয় হিরো ছিলেন অসিতবরণ। সেইসব দিন হইহই করে চলে গেল মিছিলের মতো। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান হয়ে গেল, আসবে না ফিরে কোনওদিন।’

মাসিমা আমাকে বললেন, মোটা বড় শতরঞ্জিটা আনতে, সেটা ধরাধরি করে পাতা হল। উত্তর আকাশের মিলিটারি আলো মিলিয়ে গেছে। গাছপালা আবার মিশে গেছে নরম অন্ধকারে। চাঁদ আবার তার জেল্লা ফিরে পেয়েছে। তিনটে সরাল ওঁয়াক-ওঁয়াক করে ডাকতে-ডাকতে আকাশের অনেকটা উঁচু দিয়ে উত্তর দিকে উড়ে গেল। এইবার সোজাসুজি একটা উল্কাপাত হল। ছেলেবেলায় আমরা বলতাম, তারা খসে পড়ল।

শতরঞ্জির মাঝখানে বসেছেন মাসিমা, আমরা তিনজনে তাঁকে ঘিরে আছি মুখোমুখি। মাসিমার প্রিয় দুধসাদা, থুপুরথাপুর বেড়ালটা কোলে এসে বসেছে। নাম তার ‘চিত্রা’। রূপের গরবে আমার সঙ্গে বেশি কথাই বলে না, পাত্তাও দেয় না, মাসিমা একবার ডাকলেই, যেখানেই থাকুক, চামরের মতো লেজ খাড়া করে ছুটে আসবে। রুপোলি চাঁদের আলোয় চিত্রার রূপ ফেটে পড়ছে, সাদা বড়-বড় লোমের ডগা জরির মতো চকচক করছে। সব যেন ফ্লুরোসেন্ট ফাইবার। নারকেল গাছের পাতা চাঁদের আলো ধরায় এক্সপার্ট। পাতার ঝিরিঝিরি বেয়ে পিছলে পড়ছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, আমি একটা ভয়ঙ্কর রকমের সুন্দর স্বপ্নের মধ্যে বসে আছি। মাঝরাতের পরেই বাতাস ঘুরে যায়। তাই গেল। এতক্ষণ ফুলের গন্ধ ছিল না। তাও এল। ভোরের জন্য ফুল তার সাজি সাজাচ্ছে। সূর্যপ্রণাম করবে, মন্দিরে যাবে।

মাসিমা বললেন, ‘একটা প্রশ্ন আমার খুব ইচ্ছে করে তোমাদের করি।’

বড়মামা বললেন, ‘করো, করো। প্রশ্নোত্তরের আসর হয়ে যাক।’

‘আচ্ছা, তোমরা দু’জনেই কেন বিয়ে করলে না!’

বড়মামার চটজলদি উত্তর, ‘মেয়েদের দেখলেই আমার মনে হয় বোন অথবা মা, আর জীবনের সেরা বোন-কাম-মা কুসিকে তো পেয়েই গেছি। আর আমি কিছু চাই না বাবা! জীবন ভরপুর। একমেবাদ্বিতীয়ম আমার কুসি। আর আমি চাই না কিছু।’

‘মেজদা, তোমার কেস?’

‘এমন একটা বোন থাকতে কোন ছাগল বিয়ে করবে! কুসি, আমি তোর নাবালক ডিপেন্ডেন্ট। বিয়ে খুব ব্যাড থিং। যতবার বিয়ের নেমন্তন্ন খেয়েছি, ততবারই আমার পেটখারাপ হয়েছে। মালা, সানাই, টোপর এ তিনো হায় ফাঁসিকা ফান্দা!’

‘তুমি এই ডায়ালগ শিখলে কোথা থেকে, ফাঁসিকা ফান্দা!’

মেজোমামা অপরাধী বালকের মতো মাথা নীচু করে ভয়ে-ভয়ে বললেন, ‘লুকিয়ে-লুকিয়ে শোলে দেখেছি।’

‘তুমি লাইন দিয়ে টিকিট কেটে হলে বসে শোলে দেখেছ। শেম, শেম!’

মেজোমামা হাত নেড়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে প্রতিবাদের গলায় বললেন, ‘সত্যি বলছি হলে নয় শোভনদের বাড়িতে ভি সি আরে। কী মিউজিক! এ দোস্তি, ছোড়েঙ্গে নেহি। কুসিকো নেহি ছোড়ুঙ্গা। লালা, ট্রালা ট্রালা।’

‘কী বরাত! এক ছবিতে এতদিনের চরিত্রটা বিগড়ে গেল। সত্যি বলছ, হিন্দি গান গাইছ, ডায়ালগ বলছ, ভাগনে বসে আছে পাশে।’

‘ও তো আমাদের বন্ধু।’

অনেক উঁচু দিয়ে একটা প্লেন যাচ্ছে। একেবারে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে। ডানার তলায় আলো ফ্ল্যাশ মারছে। আমি বললুম, ‘এত রাতে প্লেন যায় কোথায়!’

মেজোমামা বললেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট। লণ্ডন হয়ে নিউ ইয়র্ক। তুইও একদিন আমাদের মাথার ওপর দিয়ে এইভাবে উড়ে যাবি বিশাল জগতে।’

বড়মামা বললেন, ‘ওই ভাঙা চণ্ডীমণ্ডপটার দিকে তাকিয়ে আজ আমার কত কথাই মনে পড়ছে! চাঁদের আলোয় কেমন পড়ে আছে দ্যাখ। বৃদ্ধ অতীত। পুরনো সেই দিনের কথা। এক সময় এই গোটা গ্রামটা আমাদের জমিদারী ছিল। দূরের ওই কারখানা, কাগজ কল, কাপড়ের কল, উত্তরের ওই বিল, সব ছিল আমাদের সম্পত্তি। বাবার কথা তোদের মনে পড়ে!’

মেজোমামা বললেন, ‘অস্পষ্ট!’

মাসিমা বললেন, ‘একেবারেই নয়।’

‘মানুষের মতো মানুষ ছিলেন, আমরা তাঁর পায়ের নখের যুগ্যি নই। তিনি ছিলেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী। ওই যে দেখছিস চণ্ডীমণ্ডপের ধ্বংসস্তূপ, ওর তলায় আছে একটা চোরকুঠুরি। একটা সুড়ঙ্গও আছে। সোজা চলে গেছে জোড়া বিলের ধারে। ছেলেবেলায় দেখেছি সেখানে একটা ডাম্বা লেটার বক্স। ওই যেমন দেখা যায়, মন্দিরের মতো লাল রং করা। আসলে সেটা লেটার বক্স ছিল না। কায়দাটা ছিল অদ্ভুত। উলটে শুইয়ে দিলে গহ্বরের মুখ। নামলেই সুড়ঙ্গ। বিপ্লবীরা ওই পথে এসে কুঠুরি থেকে বোমা, রিভলভার, পিস্তল, গুলি, সব নিয়ে যেতেন। বারীন ঘোষ অনেকদিন লুকিয়ে ছিলেন আমাদের চিলেকোঠায়।

‘তুমি তখন কত বড়?’

‘বালক। বোধবুদ্ধি হয়েছে। চণ্ডীমণ্ডপে বাবা পাঠশালা করতেন। আমার খুব মজা লাগত। বিরাট, সাঙ্ঘাতিক একটা কিছু হচ্ছে। দেশ থেকে ইংরেজ খেদানো। মায়ের সব গয়না গেল। জমিদারি বিক্রি হতে লাগল। বিপ্লবের খরচ জোগাতে বাবা ফতুর। মাঝে-মাঝে পুলিশ আসে, বাড়ি সার্চ করে। বাবা টিকিতে জবাফুল বেঁধে চণ্ডীপাঠ করেন, ঘণ্টা নাড়েন। পুলিশের সব প্রশ্নের উত্তরে সংস্কৃত বলেন। গ্রামের রটে গেল বাবার অলৌকিক ক্ষমতা। যাকে যা বলেন তাই হয়। গভীর রাতে শূন্যপথে ভ্রমণ করেন। তাগা-তাবিজে অসম্ভবকে সম্ভব করেন। খোদ দারোগার মরো-মরো মেয়ের গায়ে আঙুল ঠেকাতেই সে উঠে বসল। ধন্য, ধন্য। গোটা পুলিশ-ব্যারাক বাবার ভক্ত। কে ধরবি ধর!’

মেজোমামা বললেন, ‘সত্যি, এইরকম পাওয়ার এসেছিল।’

‘কতটা পাওয়ার কতটা প্রচার, সে-বিচারের বুদ্ধি তখন আমার ছিল না। তবে হাঁ, বাবা ছিলেন মহাসাধক। সে-ব্যাপারে আমার কোনও সন্দেহ নেই। অষ্টমীর দিন দুর্গাদালানে বসে যখন চণ্ডীপাঠ করতেন, মনে হত মায়ের শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছে। বুক ওঠানামা করছে। অসাবধানে মায়ের গায়ে অস্ত্রের খোঁচা লাগলে রক্ত বেরোবে। প্রকৃত শাক্ত ছিলেন। বিসর্জনের দিন রাতে জ্বর আসবেই আসবে, ধুম জ্বর। একদিন মনে আছে, ওই যে বুড়ো আমগাছ, এখন বুড়ো, তখন যুবক, গাছটার তলায় বাবা বসে আছেন খোলা গায়ে, আমরা বাচ্চারা সব খেলা করছি। গাছে কচি-কচি আম। কে একটা ছেলে আধলা ইট ছুড়েছে। ইটটা ডালে লেগে ছিটকে এসে সপাটে বাবার পিঠে। চওড়া পিঠ। ফরসা ধবধবে। একেবারে থেঁতলে গেল। বাবা ছেলেটাকে ডেকে শান্ত গলায় বললেন, ‘ইট ছুড়ো না বাবা, তোমাদেরই মাথায় লাগবে।’ ছেলেটা বাবার ক্ষতস্থান, আর অমন শান্ত কথা শুনে, হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। ছেলেরা দুব্বো ঘাস ছিঁড়ে, চিবিয়ে-চিবিয়ে রস বের করে বাবার ক্ষতস্থানের ওপর থেবড়ে-থেবড়ে লাগাচ্ছে। বাবা হাসছেন। সে এক দৃশ্য। আজও ভুলিনি। কী সহ্যশক্তি! বাবা বলতেন, বিপ্লবী মানে সাধক, সাধক মানে বিপ্লবী। চলে যাওয়ার দু’দিন আগে, আমার হাতে একটা ডায়েরি দিয়ে বললেন, ‘আমি চলে যাওয়ার পর মন দিয়ে পড়বে। এটা শুধু তোমারই জন্যে, আর কেউ যেন না পড়ে। হৃদয়ে গেঁথে নিয়ে, একটা বাক্সয় ভরে দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গায় বিসর্জন দেবে। কোনও ভুল যেন না হয়।’ তখন আমার বয়েস ষোলো।’

মাসিমা খুব উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘সে কী, এই ডায়েরির কথা তো তুমি আগে আমাদের কখনও বলোনি। কোথায় সেই ডায়েরি! আমি পড়তে চাই।’

‘সরি! বাবার নির্দেশ পালন করতে আমি বাধ্য, অন্তত এই ডায়েরিটা পড়ার পর।’

মেজোমামা বললেন, ‘আমিও দাদার সঙ্গে ছিলাম। বাক্সটা জলে পড়ে ধীরে-ধীরে তলিয়ে গেল। তারিখটা ছিল ২৫ ডিসেম্বর, আমার মনে আছে স্পষ্ট। একজন সুন্দর চেহারার সন্ন্যাসী স্নান করছিলেন, তিনি বললেন, ‘সব মনে আছে তো, ভুলে যাওয়ার আগে লিখে রেখো। শুধুমাত্র শ্রুতি আর স্মৃতিতে বিশ্বাস কী!’ আচ্ছা দাদা, সাধু কেমন করে বলেছিলেন! একটু পরে আমরা তাঁকে কত খুঁজলুম, আর পাওয়াই গেল না!’

বড়মামা সুন্দর একটা উত্তর দিলেন, ‘দ্যাখ, বিদ্যুতের খুব শক্তি, আমরা জানি, মাপতেও পারি। কিন্তু কেন এই শক্তি আমরা বলতে পারব না। সেদিন একটা হার্ট অপারেশনের সময় আমি অ্যাসিস্ট করছিলাম। রিববক্স ফেঁপে হার্টটাকে বের করে এনে, আইসপ্যাক দিয়ে তার ধুকপুকুনি থামানো হল। রোগী তখন হার্ট অ্যাণ্ড লাং মেশিনে। প্র্যাকটিক্যালি ডেড। এদিকে তার নিজের হার্টও ফ্রোজন। অপারেশন হল। হার্টটাকে ক্যাভিটিতে ভরে টুক করে বিদ্যুৎ-তরঙ্গ দেওয়া হল। চালু হয়ে গেল সঙ্গে-সঙ্গে। এখন একটা প্রশ্ন, প্রথম স্পন্দনটা কে দিয়েছিল। আমরা তো চালু যন্ত্র নিয়েই এসেছি; কিন্তু ভাই, প্রথম কে চালু করেছিলেন। দেখলুম, বরফ দিয়ে বন্ধ করা যায়, আবার বিদ্যুৎ দিয়ে চালু করা যায়, তা হলে কে তিনি?’

বড়মামা তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে, সাধকের মতো দু’হাত তুলে বললেন, ‘এই সত্যটাই জানতে চাই, রাতের পর রাত তাই জেগে থাকি। জানতে চাই, কে আমি!’ মেজোমামা তাঁর উদাত্ত গলায় বলে উঠলেন :

 খেলো খেলো, হে আকাশ, স্তব্ধ তব নীল যবনিকা—

 খুঁজিব তারার মাঝে চঞ্চলের মালার মণিকা।

 খুঁজিব সেথায় আমি যেথা হতে আসে ক্ষণতরে

 আশ্বিনে গোধূলি-আলো, যেথা হতে নামে পৃথ্বী’ পরে

 শ্রাবণের সায়াহ্নযূথিকা—

 যেথা হতে পারে ঝড় বিদ্যুতের ক্ষণদীপ্ত টীকা।।

এই মেজোমামার কাছে আমি আবৃত্তি শিখে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছি। মেজোমামা খুব ভালো অভিনয় করতেন কলেজে। শেকসপিয়ারের নাটকে। সুইমিং চ্যাম্পিয়ান ছিলেন। বড়মামা মাঝে-মাঝেই বলেন, মেজো আমাদের গর্ব।

মাসিমা জিগ্যেস করলেন, ‘বড়দা, ডায়েরিতে কী লেখা ছিল আমাদেরও বলা যাবে না?’

‘দ্যাখো, ডায়েরিতে বাবা আমাকে দীক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন। বাবাই আমার গুরু। একটা কাগজের মোড়কে ছিল বীজমন্ত্র। ডায়েরিতে ছিল নির্দেশ। আমার জীবনের পথটা তিনি এঁকে দিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বরফের ধ্যান করবে। বলেছিলেন, রাতকে আপন করে নেবে। বলেছিলেন, বাঘ যেমন অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকে, সত্যও সেইরকম অন্ধকারে থাকে। তিনটে জিনিস মানতে বলেছিলেন, নারীর অঙ্গ স্পর্শ করবে না, আরতি লঙ্ঘন করবে না, মিথ্যা বলবে না।’

মাসিমা বললেন, ‘আরতি লঙ্ঘনের মানে?’

‘ধর যদি দেখিস কোনও মন্দিরে আরতি হচ্ছে, যত তাড়াই থাক একটু দাঁড়িয়ে প্রণাম করে যাবি।’

‘আর কি লেখা ছিল?’

‘লেখা ছিল, চণ্ডীমণ্ডপের তলায় চোরকুঠুরিতে ভয়ঙ্কর একটা জিনিস আছে, যেটা পেলে যে পাবে তার অদ্ভুত একটা শক্তি আসবে, পাওয়ার। সে যা ইচ্ছে করবে তাই হবে।’

‘সেটা কী?’

‘জানি না।

‘তুমি অনুসন্ধান করোনি?’

‘কী করে করব! এক ঝড়ের রাতে মণ্ডপটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। স্তূপাকার। জঙ্গল। কার সাহস হবে ওখানে যাওয়ার!’

‘জীবনের পথ কী বলেছেন?’

‘কর্তব্য। দেশ স্বাধীন হল, দেশ ভাগ হল, আমাদের জায়গাজমি সব জবরদখল হয়ে গেল। সুবিধাবাদীরা গদিতে বসল। এই গ্রামের এক ধান্দাবাজ, ইংরেজের ইনফরমার মন্ত্রী হয়ে গেল। বিপ্লবীদের স্থান হল না। দশমীর সন্ধেবেলা বাবা মারা গেলেন। শ্মশানে মুখাগ্নি করছি, ওদিকে বিসর্জনের বাজনা বাজছে। মা পাগল হয়ে গেলেন। ষোলো বছরের আমি। সংসারের দিকে তাকালাম। দুই বোন, এক ভাই, অপ্রকৃতিস্থ মা। তিন মাস স্বাভাবিক, ন’মাস অস্বাভাবিক। ডায়েরিতে লেখা, কর্তব্য। মামলা, দেনা জ্ঞাতি-শত্রুতা। ঘুম চলে গেল। সেই থেকে আমি রাতজাগা প্রাণী। প্যাঁচা আমার বন্ধু। সাহস করে একদিন চোরকুঠুরিতে নামলাম।’

মাসিমা বললেন, ‘এই যে বললে অনুসন্ধান করোনি!’

‘আমি করিনি বলিনি, আমি প্রশ্ন রেখেছি, কী করে করব! তার মানে এই নয় আমি করিনি। আমি তোদের সাসপেন্সে রেখেছি।’

চটপট, চটপট কয়েক ফোঁটা জল আমাদের গায়ে পড়ল। আমরা সবাই আকাশের দিকে তাকালুম। কোথাও কিছু নেই। হাহাকার ফাঁকা। বড়মামা বললেন, ‘অবাক হওয়ার কিছু নেই, মাঝে-মাঝে মেঘ ছাড়াই আকাশ থেকে ফোঁটা-ফোঁটা জল পড়ে শিশিরবিন্দুর মতো। একেই বোধ হয় বলে স্বাতী নক্ষত্রের জল। ঝিনুক জানে। কপ করে গিলে নিলেই মুক্তো। কে যেন বলেছিল, একটি-একটি শিশির কণায় ধানের গর্ভে চাল আসে।’

বাতাস একটু ভিজে-ভিজে। মাসিমা তাঁর শাড়ির আঁচলটা আমার গায়ে জড়িয়ে দিলেন। পাছে ঠান্ডা লেগে যায়। আঁচলে সুন্দর ধূপের গন্ধ। মাসিমা কাপড়ের আলমারিতে ধূপের খালি প্যাকেট রাখেন, সুবাসিত হবে বলে। মাসিমা উদগ্রীব, চোরকুঠুরি থেকে বড়মামা কী পেলেন, ‘কী পেলে তুমি?’

‘ধপাস করে তো নীচে গিয়ে পড়লুম। মড়াক করে একটা শব্দ হল। ভাবলাম ঠ্যাংটা ভাঙল বুঝি। পাঁচ সেলের টর্চটা জ্বালালাম। কিসের ওপর পা পড়ল দেখি। শুকনো একটা গাছের ডাল। বিজবিজ করে উইপোকা বেরোচ্ছে। অজস্র ইঁদুর চারদিকে দৌড়ছে চিঁক-চ্যাক করে। টর্চের আলোয় তাদের বিন্দু বিন্দু চোখ হিরের মতো জ্বলছে। ওপর থেকে নেমে এসেছে ঘন কালো ঝুল। বিরাট-বিরাট মাকড়সা দেওয়ালে-দেওয়ালে ঘাপটি মেরে আছে। অনেকটা দূরে দেখি ডাইনির চুলের মতো কী ঝুলছে, জায়গাটায় ঘুরপাক খাচ্ছে নীল বাষ্প। পরে আবিষ্কার করলাম, ওপরের কোনও বড় গাছ, যাকে বলে বৃক্ষ, শিকড় নামিয়ে দিয়েছে। থেকে-থেকে শিসের শব্দ। প্রথমে ভেবেছিলাম, বড় কোনও সাপ। গোখরো অথবা তক্ষক। পরে বুদ্ধি খাটিয়ে বুঝলাম বাতাস, নানা ফুটো দিয়ে সাঁই-সাঁই করে ঢুকছে। অনুসন্ধান করব কী! ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র প্রাণীদের জ্বালায় পালাই-পালাই অবস্থা। সেই সময় হঠাৎ যেন নির্দেশ এল, সামনে দশ পা এগোও। এইবার ডান দিকে তাকাও একটু ওপরে। তাকাতেই মনে হল, সেখানে একটা খুপরি আছে। লুজ একটা ইট। সাহস করে ইটটা টানতেই প্রথমে খানিক ধুলো বেরোল ঝুরঝুর করে। পায়ের ওপর সব জমা হল। ভয় করছে, ফ্যাঁস করে সাপ না বেরোয়! টর্চ মারলুম। বেশ গভীর। কাঁধ পর্যন্ত হাত ঢুকে যাবে। প্রথমে-হাত পা ঢুকিয়ে গাছের সেই ভাঙা ডালটা সাঁদ করালাম। মনে হল কিছু একটা আছে, শুধু আছে না, ঠেললে সরে যাচ্ছে। তখন ‘জয় মা’ বলে ঢোকালাম হাত। বার করে আনলাম জংধরা একটা লোহার বাক্স। একটু টানাটানিতেই ঢাকনাটা উপড়ে চলে এল হাতে। আলো ফেলতেই ভয়ে হাড় হিম। গুটিয়ে পাকিয়ে রয়েছে সাপের একটা কঙ্কাল। ভয়ে তিন লাফ। কিছুক্ষণ ভাবলাম। আবার নির্দেশ, সাহস করে জিনিসটা তোলো। তবু সাহস হচ্ছে না। অনেকক্ষণ থম মেরে রইলাম। দেওয়ালের ভয়ঙ্কর মাকড়সাগুলো হঠাৎ খুব তৎপর হয়ে খিড়খিড় করে নাচানাচি শুরু করল। দু-একটা লাফিয়ে নেমে পড়ল মেঝেতে। বাতাসের সিঁসিঁ ভীষণ বেড়ে গেল। গাছের ঝুলো শেকড়গুলো হিলহিল করে উঠল। আবার, যা থাকে বরাতে—দু’আঙুল দিয়ে জিনিসটাকে টেনে তুললাম। আঃ, কী সুন্দর!’

বড়মামা হঠাৎ থেমে গেলেন। আকাশে সেই ভোরের তারাটা মুকুটের কোহিনুরের মতো জ্বলজ্বল করছে। সমস্ত প্যাঁচা রাত শেষ হবে বলে সমস্বরে ডেকে উঠল, চলো, ভাই শুতে যাই, বিশ্রী দিন ওই আসছে। কর্কশ, ঘসঘস, গোলমাল, চিৎকার, মানুষেরা এইবার জাগছে।

মাসিমা উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘হঠাৎ হঠাৎ থেমে পড়াটাই তোমার রোগ। ব্যাটারি ডাউন, গাড়ির মতো। তারপর বলো, কী হল তারপর!’

বড়মামা বললেন, ‘আর তো শোনার কিছু নেই। এইবার যা তা দেখার। জিনিসটা তোদের দেখাব।’

‘কবে?’

‘আজই। ভোরের নীল আলোয়। দেখলে অজ্ঞান হয়ে যাবি, গ্যারাণ্টি।’

তিন

আকাশে আলোর ডানা। সত্যিই ডানা। রাজহাঁসের পালকের মতো শিল্পীর তুলিতে আঁকা নিখুঁত একটু মেঘ। যেন মা-সরস্বতী তাঁর হাতের কলমটি সুপ্রভাত লিখে ভাসিয়ে দিয়েছেন পুব আকাশে! ধারে-ধারে লাল রং! তিনি আসছেন নতুন একটি দিনের ঘোষণাপত্র হাতে নিয়ে।

বড়মামা হাঁক পাড়লেন, ‘হরিদা।’ সঙ্গে-সঙ্গে জাহিরুলদের বাড়ির মুরগি ডেকে উঠল, কোঁকোর কোঁ। ওদিকে সিদ্ধেশ্বরীতলায় মঙ্গলারতি শুরু হয়ে গেল। শুকতারা আকাশের গায়ে অস্পষ্ট একটা টিপ।

হরিদা আমাদের ম্যানেজার কাম অভিভাবক কাম সব কিছু। ত্রিভুবনে নেই কেউ। এই বাড়িকেই নিজের বাড়ি করে নিয়েছেন। আমরাই তাঁর সব। তবে শোনা যায়, হরিদা খুব বড় পরিবারের মানুষ। বিরাট জমিদার ফ্যামিলির ছেলে। বিষয়-সম্পত্তির লোভে হরিদার বাবাকে বিষ দিয়ে খুন করা হয়েছিল। হরিদার মাকে সাপে কামড়েছিল, সেও এক সমাধানহীন রহস্য। হরিদা সেই শৈশবেই এক সাঁওতাল পরিবারের আশ্রিত হয়েছিলেন। জঙ্গলে মানুষ। সেই পালকপিতা ছিলেন এক সেরা গুণিন। হরিদা তাঁর কাছ থেকে অনেক বিদ্যা আয়ত্ত করেছেন। ঘড়ি ছাড়াই বলতে পারেন ঠিক-ঠিক ক’টা বেজেছে। কাক কী বলছে তিনি বোঝেন। এক মুঠো ধুলো মাটিতে ফেলে দিয়ে বলে দিতে পারেন দিনটা কেমন যাবে। মুখ দেখে বলে দিতে পারেন শরীরের কোথায় গোলযোগ। আরও, আরও অনেক কিছু। পরিষ্কার একটা ধুতি মালকোঁচা মেরে পরেন। পায়ে হাফশার্ট। অঙ্কে ভীষণ পাকা। শিবঠাকুরের পরম ভক্ত। কত বয়েস, তবু ভীষণ ফিট। ওষুধ হল গাছপাতা, শিকড়বাকড়। সংস্কৃত স্তোত্র যখন সুরে আবৃত্তি করেন, বাড়িটা ঋষির আশ্রম হয়ে যায়। খুব ভালো রাঁধতে পারেন। হরিদা সকলের দাদা, পরামর্শদাতা। গরিবের চিকিৎসক। চিকিৎসায় অসুখ অবশ্যই সারে। বড়মামা হরিদাকে স্পেশ্যাল এটা ঘর তৈরি করিয়ে দিয়েছেন। গান শুনতে ভালেবাসেন বলে একটা মিউজিক সিস্টেম কিনে দিয়েছেন।

হরিদা এসে দাঁড়ালেন। এরই মধ্যে চানটান করে টিপটপ। এইটাই তাঁর অভ্যাস। পুকুরের জলে আলো যেই ফুটল, শালুকের পাপড়ি যেই খুলল, যেই ফুটল টগর, মাথায় ফুল দিয়ে হরিদা ডুব দেবেন জলে, ফুলগুলো সব ভেসে-ভেসে চলে যাবে জলের আন্দোলনে। একটা-একটা করে হাঁস ভারিক্কি চালে জলে নামবে। মন্দিরের ত্রিশূলে বসে দোয়েল ধরবে তান। হরিদা উদাত্ত গলায় পাঠ করবেন গায়ত্রীমন্ত্র। এই সময়টাকেই বলে ব্রাহ্ম মুহূর্ত।

বড়মামা বললেন, ‘দাদা, রাতটা কাল ছাতেই কাটল, এইবার বারান্দায় বসে একটু চা সেবন।’

‘সব রেডি, নামলেই হয়।’

আমরা খুব দুঃখ-দুঃখ মুখে আকাশের দিকে তাকালাম। রাতের রহস্য-উপন্যাস যেন হঠাৎ শেষ হয়ে গেল। ডিমের কুসুমের মতো সূর্য ক্ষণকাল পুবদিগন্তে অবস্থান করে চড়চড় করে মধ্যগগনে উঠে পড়বে আগুনের গোলার মতো। সবকিছু এত স্পষ্ট হবে, উত্তাপ এত অসহ্য হবে যে, ভালো লাগবে না। নিজেকে মনে হবে জোয়াল পরানো বলদ।

সাবিত্রীদি আমাদের বাড়িতে সর্বক্ষণ থাকেন। তাঁর জীবন সবচেয়ে দুঃখের, তাই তিনি সবচেয়ে আনন্দে থাকেন। সদাই যেন নাচছেন। চকচকে মুখে সবসময় ঝকঝকে হাসি। বড়মামা পাটনা স্টেশন থেকে উদ্ধার করে এনেছিলেন। মাসিমার ট্রেনিং-এ একেবারে চোস্ত। নাচকে ভালোবাসেন বসে মাসিমা নাচ শেখাচ্ছেন। পাড়ার লোকদের খুব হিংসে। তারা বলে, পাঁচিলের এপারে নিজেদের জগতে সব বেশ আছে। ক’দিনে থাকবে রে বাপ! চিরদিন কি সমান যায়। পতন একদিন হবেই হবে। কারও ক্ষমতা নেই ঠেকায়। মাসিমাকে সবাই মেমসায়েব বলে ব্যঙ্গ করে। বলে, ‘মেমসায়েব যেন ইউরোপ আমেরিকা তৈরি করে ফিরিঙ্গিনি সেজেছে।’

বিশাল ট্রেতে সাজানো কাপ, টিপট বাহারি, এক প্লেট বিস্কিট। মার্বেল পাথরের টেবিলে নামিয়ে রেখে সাবিত্রীদি বললেন, ‘গুড মর্নিং।’

আমরা সমস্বরে বললাম, ‘মর্নিং।’

সাবিত্রীদি পদ্মের ডাঁটার মতো দীর্ঘ হাত দুটো জড়ানো সাপের ভঙ্গিতে ওপর দিকে তুলে নমস্কার করলেন পুব আকাশের সূর্যকে। অপূর্ব ভঙ্গি। ‘হ্যাভ টি’, বলে চলে গেলেন। দিনটাকে ভালো করে শুরু করতে হয়। তারপর যা হয় হোক। এই সেই শুরু।

হরিদা বললেন, ‘ঝট করে মুখ ধুয়ে এসো। বাসী মুখে চা আমি অ্যালাউ করব না।’

ভিজে-ভিজে মুখে আমরা ফিরে এসে যে যার জায়গায় বসলুম। গভীর বারান্দা। সাবেক আমলের জাফরি। তরুণ তপনের কিরণ বিরীত দেওয়ালে নকশা এঁকেছে। সার-সার অর্কিডের টব। সামনের গাবগাছে সাদা একটা বক বসে-বসে প্ল্যান করছে, কোন পুকুরে যাবে আজ। হরিদা কাপে-কাপে চা ঢালছেন। মাসিমা রোজই বলেন, আমি ঢালি। আজও বললেন। হরিদার সেই একই উত্তর, ‘যেদিন আমার হাত কাঁপবে।’ বড়মামার তিনটে কাক, আমরা বলি কাকত্রয়ী, ঠিক এসে গেছে। বড়মামার হাত থেকে তিনজনে তিনখানা বিস্কুট ঠোঁটে নিয়ে সাট-সাট উড়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে সেই পরিচিত কাশির শব্দ। নেপালবাবু। প্রবীণ শিক্ষক। কেউ কোথাও নেই। ভাঙা একটা বাড়িতে থাকেন। ছেলেরা বিরাট চাকুরে, প্রবাসী। বৃদ্ধ একা কমা দিয়ে যাচ্ছেন, একদিন ফুলস্টপ বসিয়ে দেবেন। কষ্ট দেখে বড়মামা ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, চা, ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার সব এখানে। ‘মর্নিং টি’-র জন্য আসছেন। সাবিত্রীদি ম্যানেজ করবেন। ইংরেজির নামকরা শিক্ষক। সাবিত্রীদির সঙ্গে একটা কথাও বাংলায় হবে না। দু’পক্ষই ইংরেজি চালাবেন। ভুল বললেন মাস্টারমশাই শুধরে দেবেন। রাতের খাবার আমি পৌঁছে দিয়ে আসি। নোনাধরা ভাঙা বাড়ির দোতলায় বড় একটা লাইব্রেরি আছে। ভালো-ভালো বই। আমুণ্ডসেনের আন্টার্কটিকা অভিযান। এভারেস্ট অভিযান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস। ডেভিড লিভিংস্টোনের ডার্কেস্ট আফ্রিকা। ভলক্যানো। কত কী? বলেছেন, ‘খোকা! তুই এত সেবা করিস, তোকে সব দিয়ে যাব। জীবনে লেখাপড়ার চেয়ে আনন্দের কিছু নেই।’

বড়মামা বললেন, ‘এইবার তা হলে সেইটা। ওয়াণ্ডার অব ওয়াণ্ডার্স।’

বড়মামা বারান্দার একেবারে শেষ ঘরটায় চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে সেইঘর থেকে আদেশ এল, ‘ক্লোজ ইওর আইজ।’

আমরা চোখ বোজালাম। পায়ের শব্দে বুঝতে পারছি বড়মামা আসছেন। শ্বেতপাথরের টেবিলের কাছে এসে গেছেন। কিছু একটা রাখার শব্দ হল।

‘ওপেন ইওর আইজ।’

এ কী! এমন জিনিস জীবনে দেখিনি। ছোট-ছোট সমান মাপের হাড় দিয়ে তৈরি একটা বেল্ট। প্রতিটি হাড়ের মাঝখানে একটা করে ঝকঝকে লাল পাথর বসানো। বকলসটা ড্রাগনের মুখ। সেখানে সমান দূরত্বে ছোট-ছোট নীল পাথর।

বড়মামা বললেন, ‘লালগুলো সব বহুমূল্য রুবি, আর নীলগুলো নীলা।’

আমরা সবাই ভয়ে-ভয়ে কাছে এগিয়ে গিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়লুম। এমন অপূর্ব জিনিস অতীতে দেখিনি কখনও। ভবিষ্যতেও দেখব বলে মনে হয় না। মন মনে-মনেই বলছে, কী সুন্দর, কী সুন্দর! স্পর্শ করার সাহস হচ্ছে না। ভয় এবং ঘেন্না। কিসের হাড় কে জানে!

হরিদা ভালো করে দেখে, সোজা হয়ে বললেন, ‘আমার সামান্য জ্ঞান থেকে যা মনে হচ্ছে, এটা চিন দেশের।’

মেজোমামা বললেন, ‘এটা তো ওই ড্রাগনটা দেখলেই বোঝা যায়।’

হরিদা বললেন, ‘এই ব্যাপারে আমার আরও একটু লেখাপড়া করা আছে। এটা শাং ডাইন্যাস্টির জিনিস। তোমরা যে যার জায়গায় বসে পড়ো, আমি ঝট করে তোমাদের মতো জ্ঞানীদের একটু জ্ঞান দিয়ে যাই। জিনিসটা আমি বিলক্ষণ চিনতে পেরেছি। বেশি না, তোমাদের হাজার ছয়েক বছর পেছোতে হবে। তবে আরও দু’হাজার বছর এগিয়ে এসে চার হাজার বছর থেকেই শুরু করব।’

বড়মামা বললেন, ‘পিপাসা।’

মেজোমামা বললেন, ‘হ্যাং ইওর পিপাসা। এখন একমাত্র পিপাসা হল জ্ঞানের পিপাসা। থার্স্ট ফর নলেজ।’

বড়মামা বললেন, ‘তা হলে চা এখন থাক।’

মেজোমামা বললেন, ‘চা! আরে চা তো লিকুইড নলেজ। সৃষ্টির কাজ শেষ করে হাত ধুতে-ধুতে ভগবান বললেন, ‘নাও, আই উইল সেটল ফর এ কাপ অব টি। ইংরেজ শুনল টি, বাঙালি শুনল চা, হিন্দুস্থানিরা শুনল চায়ে।’

মাসিমা বললেন, ‘তা হলে ঢালি।’

হরিদা বললেন, ‘আমি একটু খাব।’

মেজোমামা কারেকশান করলেন, ‘পান করব।’

কুলকুল করে সোনালি রঙের চা ঝরনাধারায় নামতে লাগল স্বচ্ছ সুন্দর কাপে। আর তখনই সাবিত্রীদি নীচে থেকে বলল, ‘বড়দা, মাস্টারমশাই ওয়ান্টস টু সি ইউ।’

বড়মামা তাড়াতাড়ি বাস্কেটে জিনিসটা ভরতে-ভরতে বললেন, ‘দয়া করে ওপরে আসবেন।’

মাস্টারমশাই আসছেন। পায়ের শব্দ। ধীরে-ধীরে উঠছেন। চুড়ির শব্দ। তার মানে সাবিত্রীদি ধরে-ধরে আনছেন। শার্লক হোমস হতে আর বিলম্ব নাই! আমরা সবাই ভালোমানুষের মতো মুখ করে বসে আছি। মাস্টারমশাই প্রায় ছ’ফুট লম্বা। সামনে সামান্য ঝুঁকে আছেন। একমাথা পাকা চুল। টকটকে ফরসা। বনেদি ঘরের মানুষ।

চেয়ারে বসে দু’কদম কাশলেন। ভালো করে সকলকে দেখে নিলেন একবার, ‘যাক তোমরা সকলে ভালো আছো দেখে ভালোই লাগছে। সৎচিন্তায় মানুষ ভালোই থাকে। শোনো ডাক্তার, আমি একটা কাজের কথা বলি। আমাদের ঠাকুরদালানটা তুমি দেখেছ?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘বাড়িটা আমি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দুটো প্লট করে, একটা বেচে দেব, আর সেই টাকায় নিজের জন্যে ছোট্ট একটা বাংলো তৈরি করব।’

‘সুন্দর সিদ্ধান্ত। যতদিন না বাড়িটা তৈরি হচ্ছে, ততদিন আপনি আমাদের সম্মানিত গেস্ট।’

মাস্টারমশাই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। ছানিপড়া বড়-বড় চোখ দুটো জল-টলটলে হচ্ছে। আবেগে শরীর কাঁপছে।

আবেগটা কেটে যেতেই গলা পরিষ্কার করে মাস্টারমশাই বললেন, ‘তোমরা ভালো, তোমরা যে এত ভালো তা জানতাম না। তোমরা ভিন্নগ্রহের মানুষ। মনে আছে ডাক্তার, তোমাদের আমি অস্কার ওয়াইল্ডের ‘হ্যাপি প্রিন্স’ পড়াতাম। মনে পড়ে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। সেই পড়ানো কি ভোলা যায়!’

‘সোয়ালো, সোয়ালো, আমি দেখতে পাচ্ছি, দূরে, বহু দূরে গরিবের একটি কুটির। One of the windows is open, and through it I can see has a woman seated at a table. Her face is thin and worm, and she a coarse, radhands, all pricked by the needle far she is a Seamstren. রানির প্রধান পরিচারিকার নাচের পোশাকে এমব্রয়ডারি করছে। খাবার নেই, আগুন নেই, ছেলেটা খিদেয় কাঁদছে। সোয়ালো, তুমি আমার তলোয়ারের হাতলে যে বহুমূল্য রুবিটা রয়েছে সেইটা খুলে ওকে দিয়ে এসো। কিছুদিন তবু চলবে। এইভাবে সোয়ালোকে দিয়ে প্রিন্স তার সবকিছু দান করে দিল গরিবদের। সোনার আস্তরণ, চোখের মণি। মেয়র একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করলেন সোনার মূর্তি সিসের হয়ে গেছে। পায়ের তলায় মরে পড়ে আছে ছোট্ট সোয়ালো। মূর্তি উৎপাটিত। আগুনে দেওয়া হল ধাতুটাকে উদ্ধার করে নেওয়ার জন্যে। সব গলে গেল, গলল না তার হৃদয়টি। মনে পড়ে সেই শেষ লাইন ক’টা।

Bring me the two most precious things in the city–said the God to one of His Angels; and the Angel brought Him the leader heart and the dead bird.

You have rightly chosen—said God,—far in my garden of Paradise this little bird shall sing for evermore, and in my city of Gold the Happy Prince shall praise me.

‘ডাক্তার, তোমার হৃদয়টা ওই প্রিন্সের হৃদয়।’

‘মাস্টারমশাই, আপনার সব মুখস্থ।’

‘ভালো যা কিছু সব আমি স্মৃতিতে ধরে রাখি। শোনো ডাক্তার, আমি আশ্রয়ের জন্যে আসিনি। আমি এসেছি তোমাকে কিছু দিতে, যদি অনুগ্রহ করে নাও।’

‘কী জিনিস মাস্টারমশাই!’

‘ঠাকুরদালানের বিরাট মেঝেটা ইটালিয়ান মার্বেল পাথরের। দু’রকমের, সাদা আর কালো। তাঁদের পয়সা ছিল। তুমি ওই পাথরগুলো সব নিয়ে এসো তোমার লোক দিয়ে।’

‘কত দাম হবে মাস্টারমশাই?’

‘এক পয়সাও না।’

বিস্ময়ে বড়মামার মুখটা কেমন হয়ে গেল। এইবার তাঁর চোখে জল।

‘কাল থেকেই শুরু করিয়ে দাও।’

মাস্টারমশাই ধীরে-ধীরে, পা টেনে-টেনে চলে গেলেন।

বড়মামা অভিভূতের মতো আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী আশ্চর্য! এইটাকে যখনই আমি বের করি, তখনই ভয়ঙ্কর রকমের ভালো একটা কিছু ঘটে। এর কোনও ব্যাখ্যা নেই। কুসি, কাল তোকে বলেছিলুম, এই বাড়িতে মার্বেল আসছেই আসছে।’

হরিদা বললেন, ‘ওটা এমন একটা অঞ্চলের জিনিস, যে অঞ্চলের মাটিতে জাদু আছে।’

বড়মামা বেতের চেয়ারে নড়েচড়ে বসে বললে, ‘বলুন বলুন, শুনি, আর বেশি সময় নেই। লাফিং ক্লাব হয়ে আমাকে চেম্বারে যেতে হবে।’

হরিদা শুরু করলেন, ‘চীন ভূখণ্ডের ঠিক মাঝখানের অঞ্চলটিকে এখন বলা হয় হেনান। চার হাজার বছর আগে নাম ছিল, য়ু ঝাও। পশ্চিম থেকে পুবে ঢালু একটি প্রদেশ। তিন দিকে পাহাড়, পশ্চিমে ঝিয়াও আর ফুনিউ পর্বতমালা, দক্ষিণে থংবো আর দাবিয়ে পাহাড়, আর উত্তরে তাইহান। আর পুব দিক দিয়ে ভীমবেগে ছুটে চলেছে চিনের বিখ্যাত হলুদ নদী হুয়াংহে, সঙ্গে দোসর হুয়েহে। এই হেনানেই থাকতেন সেই বিখ্যাত মানুষটি, চীনের রূপকথায় যাঁর নাম, দি ফুলিশ ওল্ড ম্যান।’

হরিদা চা খেলেন এক চুমুক, তারপর শুরু করলেন, ‘Long long ago there lived a foolish old man. বৃদ্ধের বাড়ির সামনে আকাশছোঁয়া দুটি পাহাড়, তাইহান আর ওয়াংয়ু। আকাশ আটকে দাঁড়িয়ে অছে। ও-পাশের কোনও কিছুই দেখা যায় না। বৃদ্ধ তার ছেলেদের ডেকে বললে, আয়, আমাকে একটু সাহায্য কর। পাহাড় দুটোকে এখান থেকে সরাব। শুরু হয়ে গেল খোঁড়া। গর্ত করে পাহাড় দুটোকে তুলে অন্য জায়গায় নিয়ে যাবে বোকা বুড়ো। দিনরাত তারা খুঁড়ছে আর খুঁড়ছে। মানুষ বলছে, দ্যাখো, বোকাটার কী বুদ্ধি! কিন্তু, স্বয়ং ভগবান যখন জানতে পারলেন, তখন একেবারে অভিভূত! মানুষটার কী জেদ, কী কঠিন তার সঙ্কল্প! ভগবান তাঁর দুই দেবদূতকে ডেকে বললেন, ‘যাও, পাহাড় দুটোকে একেবারে উত্তরে সরিয়ে দিয়ে এসো।’ রাতের অন্ধকারে দেবদূত দু’জন পাহাড় দুটো পিঠে নিয়ে উড়ে গেলেন উত্তরে। এই কাহিনী ছড়িয়ে গেল ঘরে-ঘরে। পরে, আধুনিককালে এর ব্যাখ্যা হল, ইচ্ছে থাকলে, উদ্যোগী হলে মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। এই হুয়াংহে নদীতে আধুনিক চীন বাঁধ তৈরি করে। খরস্রোতা এই ত্রিধারার জলকে সেচের কাজে লাগিয়ে কী ফসলই না ফলাচ্ছে। এই হেনানের মাঝখানে আছে বিখ্যাত, পবিত্র পঞ্চ পাহাড়ের একটি—মাউন্ট সং। এই পাহাড়ের দক্ষিণ ঢালে আছে হাজার বছরের প্রাচীন বিদ্যাপীঠ সংগিয়াং। আর একেবারে পাদদেশে আছে সেই বিখ্যাত মন্দির, শাওলিন, যেখানে ক্যারাটে আর কুংফুর চর্চা হয়। শাং ডাইনাস্টিতে এইখানে স্থাপিত হয়েছিল দাস রাজ্য। হেনানের উত্তরে ছিল রাজধানী—জিন। পুরাতত্ত্ববিদরা ঝিয়াউটানে এক্সকাভেশন চালিয়ে সেই রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছেন। দশ হাজারের মতো অপূর্ব-অপূর্ব সব শিল্পনিদর্শন উদ্ধার করা গেছে। বেরিয়েছে হাড়ের কাজ, কচ্ছপের খোল কেটে তৈরি শিল্পকর্ম। বেরিয়েছে প্রাচীনতম অক্ষরে কচ্ছপের খোলের ওপর লেখা পুঁথি। সেকালের মানুষের জ্যোতির্বিদ্যা, ক্যালেণ্ডার, আবহাওয়াতত্ত্ব এবং শিল্পচর্চার লিখিত ইতিহাস। ব্রোঞ্জের পাত্র বেরিয়েছে নানারকম আর পাওয়া গেছে ব্রোঞ্জের তৈরি আটশো পঁচাত্তর কিলোগ্রাম ওজনের চার নৌকো, চার পায়াঅলা একটি ধূপদান বা ধুনুচি। অসাধারণ তার কারুকার্য। চারপাশে ড্রাগন। তোমার ওই হাড়ের বেল্টটা প্রায় চারহাজার বছরের প্রাচীন। শাং ডাইনাস্টির জিনিস। কচ্ছপের খোলা কেটে তৈরি। হয়তো কোনও রাজকুমারীর কোমরবন্ধনী। তোমার কাছে ওটা আছে কেউ যেন কোনওভাবেই জানতে না পারে। লন্ডনে সুদবির অকশনে নিয়ে গেলে কোটি টাকা দাম উঠবে। যারা ট্রেজার হান্টার তারা জানতে পারলে তোমাকে খুন করবে। ওই বেল্টে ম্যাজিক্যাল পাওয়ার, অকাল্ট, স্পিরিচুয়াল পাওয়ার, সবই থাকতে পারে। ওই জগতের কূলকিনারা নেই।’

বড়মামার মুখটা কেমন হয়ে গেল ভয়ে। বললেন, ‘এইটা পাওয়ার পর থেকে আমাদের ভাগ্য ফিরেছে। এটাকে এখন কাছছাড়া করি কী করে!’

বড়মামা অসহায়ের মতো আমাদের মুখের দিকে তাকালেন।

চার

মোহনদার দোকানের সামনে সাইকেল থেকে নামলাম। নামলাম বললে ভুল হবে। কারণ, সাইকেল থেকে আমি বেশ কায়দা করে নামতে পারি না। আমার সপাটে পতন হল। মোহনদার দোকানের নাম, প্রথম বিল্ডার্স। মোহনদা কাচের গেলাসে চা খাচ্ছিলেন। সাইকেল থেকে আমার নামার রকম দেখে জটায়ুর মতো হেসে উঠলেন। কয়েক মাস হল শিখেছি। ওঠা আর নামাটায় এখনও কিছু কাজ বাকি আছে। হরিদা বলেছেন, ও হতে-হতে হয়ে যাবে। কয়েকবার মোক্ষম ধরনের পতন না হলে সাইকেলকে ঠিক চেনা যায় না।

মোহনদার হাসি দেখে ভীষণ রাগ হল। রাগ-রাগ গলায় জিগ্যেস করলাম, ‘আলমদা কোথায়?’ রেগে গেছি বুঝতে পেরেছেন। হাসতে-হাসতে বললেন, ‘ডাক্তারবাবুর সাইকেল?’

‘হ্যাঁ!’

‘তোমার বড়মামা যত বিদঘুটে জিনিস কেনেন। একটা কোম্পানি প্রথম এই মডেল বের করেছিল। বিরাট উঁচু। ছ’ফুট না হলে পা পাবে না। তোমার ছ’ফুট হতে আর কতটা বাকি?’

‘দু’ফুট।’

‘ও হয়ে যাবে। এই তো তোমার বাড়ের বয়েস, চড়চড়িয়ে বেড়ে যাবে। ওই তোমার আলম আসছে। শুনলাম তোমার বড়মামা পাহাড় কিনেছেন! এইবার একটা সমুদ্র কিনতে বলো।’

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এত রেগে যাও কেন, তোমার মামারা কত বড়লোক ছিলেন, সে আমার ঠাকুরদার কাছে শুনেছি। তোমার দাদুর বিশাল বড় কাঠের ব্যবসা ছিল বার্মায়। নিজেদের একটা জাহাজও ছিল। যা-তা ভেবো না ভাগনে! এই গোটা গ্রামটাই তোমাদের ছিল। এত রেগে যাও কেন! তোমার সঙ্গে একটু মজা করব না তো কার সঙ্গে করব?’

আলমদাকে বললাম, ‘সাইকেলে উঠুন, বড়মামা তলব।’

‘কে উঠবে?’

‘আপনি।’

‘কোথায় উঠব?’

‘সিটে।’

‘তাই বলো। বড়মামা কোথায়?’

‘এই মুহূর্তে লাফিং ক্লাবে। সেইখানেই যেতে বলেছেন। ত্রাণনাথের মাঠে।’

‘পাগলের আখড়ায়!’ সাইকেল চালাতে-চালাতে আলমদা বললেন। আমি বসে আছি সামনের রডে। মাঠে ওরা খেটেখুটে খুব সুন্দর সবুজ ঘাস করেছে। ময়দানে যেমন ক্লাবটেন্ট আছে, সেইরকম একটা সুন্দর টেন্ট। একটা ফোল্ডিং টেবিল, একটা ফোল্ডিং চেয়ার। চেয়ারে বড়মামা। সাদা ট্রাউজার, সাদা স্পোর্টস শার্ট। আমরা যখন গেলাম, তখন বড়মামা একজনকে প্রশ্ন করছেন, আমরা শুনেছি, ‘আপনি কতদিন হাসছেন?’

‘সাতদিন। আজ নিয়ে আট।’

‘কোনও উন্নতি!’

‘কী উন্নতি, তা তো বলেননি।’

‘হুঁ, ঠিক কথা। আচ্ছা, পাখির মতো হালকা লাগছে?’

‘পাখি কীরকম হালকা তা তো জানি না স্যার।’

‘স্যার নয়, দাদা, এটা সরকারি অফিস?’

‘আজ্ঞে না।’

‘আজ্ঞে বাদ।’

‘ইয়েস স্যার!’

‘স্যার বাদ স্যার।’

‘কোথায় কাজ করেন বলুন তো?’

‘রাইটার্সে স্যার।’

‘তুলোর মতো হালকা মনে হয় নিজেকে?’

‘না।’

‘শোলার মতো?’

‘না স্যার।’

‘থার্মোকলের মতো?’

‘নো স্যার।’

‘মাটির খালি কলসির মতো?’

‘না স্যার।’

‘তা হলে কতটা হালকা মনে হয়?’

‘সিমেন্টের বস্তার মতো।’

‘তা হলে উন্নতিটা কী হল?’

‘হল না স্যার!’

‘আচ্ছা অন্য বিভাগে যাই। হজম কেমন হচ্ছে?’

‘হচ্ছে না, খেতেই ইচ্ছে করে না।’

‘মোটা হচ্ছেন কী করে?’

‘পিতামাতার কৃপায়। একজন ছিলেন পর্বত, আর একজন পার্বতী।’

‘ক’ গেলাস জল খান?’

‘ঢুক-ঢুক খাই, ক’ গেলাস হয় বলতে পারব না।’

‘ঘুম?’

‘ভীষণ। পড়লুম কি মরলুম।’

‘রাগ?’

‘ভীষণ! মনে হয় সব ব্যাটাকে পেটাই।’

‘গুনগুন করে সব সময় গান গাইতে ইচ্ছে করে?’

‘না, গালাগাল দিতে ইচ্ছে করে।’

‘কাকে?’

‘আমার বাড়িঅলাকে।’

‘পৃথিবীকে সুন্দর মনে হচ্ছে?’

‘নরক।’

‘বাঁচার ইচ্ছে বাড়ছে?’

‘বাতের যন্ত্রণায় মরে গেলাম।’

‘আপনাকে কোন ধরনের হাসি দেওয়া হয়েছে, হিহি, হাহা, হোহো, কোনটা?’

‘হিহি তো মেয়েদের স্যার। আমার পাঁচ রাউন্ড হাহা, তিন রাউন্ড হোহো।’

‘আমি লিখে দিচ্ছি, ওর সঙ্গে পাঁচ রাউন্ড খ্যাখ্যা যোগ হবে।’

‘একটু দেখিয়ে দেবেন না স্যার!’

‘পঞ্চানন।’

বড়মামা আমাদের ইশারায় দাঁড়াতে বলেছিলেন। এতক্ষণের কাণ্ড দেখে আলমদা অনবরত হাসছিলেন। বড়মামা জিগ্যেস করলেন, ‘হাসছ কেন?’

আলমদা বললেন, ‘হাসির ক্লাবে হাসব না!’

‘ঠিকই তো।’

বড়মামা মাঠে নামলেন। আমরা পেছনে। একজনকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, বড়মামা প্রশ্ন করলেন, ‘হাসছ না কেন? হাসছ না কেন?’

তিনি বললেন, ‘হাসা উচিত নয়।’

বড়মামা বেশ অসন্তুষ্ট হয়ে, প্রায় ধমকে উঠলেন, ‘হাসা উচিত নয় কেন?’

‘কাল আমার শ্বশুরমশাই মারা গেছেন।’

বড়মামা হনহন করে হাঁটতে-হাঁটতে বললেন, ‘আর পাঁচ মিনিট, কাতুকুতু সেকশনটা দেখলেই কাজ শেষ।’

ওইটুকু সময়ের মধ্যে আমাদের অনেক বিভাগ দেখা হল, কাতুকুতু, গড়াগড়ি, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে, দেঁতো হাসি, হাসি কাশি। হাসি কাশি হল, যাঁরা হাসতে-হাসতে কাশিতে চলে যান, তারপর জল, পাখা, বুকে মালিশ।

বড়মামা মাঠের একপাশে এসে আলমসাহেবকে বললেন, ‘তোমার ফুলটিম নিয়ে আজই চলে যাও মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে। ঠাকুর দালানের সমস্ত পাথর সাবধানে একটাও না ভেঙে তুলে ফেলো। আমাকে দান করেছেন।’

‘ও তো খুব দামী পাথর!’

‘জানি। রাজভবনে আছে।’

ওপাশে পরিচালক তখনই হাঁকলেন, ‘স্টার্ট, হাহা, ওয়ান, টু, থ্রি!’

সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হয়ে গেল, ‘হাহা, হাঃ হা, হাহা।’

আমরা পালিয়ে বাঁচলাম। ওদিকে নারীবিভাগে হিহি। ডানপাশে একটা ব্যানারে লেখা রয়েছে স্লোগান, লাফ ফর লাইফ, লাফ ফর হেলথ, লাফ ফর ওয়েলথ, লাফটার দি বেস্ট মেডিসিন।’

পাঁচ

বড়মামাও এলেন মাস্টারমশাইয়ের ঠাকুরদালানে। চারপাশে অনেক গাছ, তার মাঝখানে তিনপাশ খোলা বিশাল সেই নাটমন্দির। যে দেওয়ালকে পেছনে রেখে মায়ের মূর্তি বসত, সেই দেওয়ালের অপূর্ব কারুকার্য এখনও কিছু-কিছু আছে। সবচেয়ে সুন্দর মেঝেটা। কিছুই যত্ন হয় না, তাও কী শোভা! সাদা, কালো ইতালিয়ান মার্বেলের চোখধাঁধানো কাজ।

বড়মামা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ ফরমান দিলেন, ‘আলম এ জিনিস তোলা হবে না।’

‘তা হলে?’

‘তা হলে এইখানেই থাকবে। এই নাটমন্দির আমি সংস্কার করাব। ছাত আর কিছু-পিলার ড্যামেজ হয়েছে! এখানে আমি মহাপ্রভুর মূর্তি স্থাপন করব। এখানে হবে একালের শ্রেষ্ঠ পাঠবাড়ি। পাঠ হবে, সঙ্কীর্তন হবে। কী না হবে?’

‘মাস্টারমশাইয়ের জিনিস, আপনি করার কে?’

‘আমি কিনে নেব। এর ওপর কোনও কথা আছে!’

‘না, নেই।’

‘তুমি মেরামতির কাজে লেগে যাও। রথের দিন উদ্বোধন।’

‘মূর্তি কোথায় পাবেন এত তাড়াতাড়ি!’

‘সেটা আমার ব্যাপার, আমি বুঝব।’

‘আমরা এখন তা হলে কী করব!’

‘তুমি এইখানে বোসো। আমি পাকা কথাটা কয়ে আসি।’

মাস্টারমশাই নীচের বৈঠকখানায় বসে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে মোটা একটা বই পড়ছিলেন। এমনই তন্ময় যে, আমাদের প্রবেশ বুঝতে পারেননি।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বড়মামা বললেন, ‘আমি এসেছি।’

চোখ তুলে তাকালেন, ‘তোমরা! আরে এসো এসো, বোসো। কী সংবাদ!’

বড়মামা উত্তেজনায় বসতে পারলেন না। মাস্টারমশাইয়ের হাত দুটো ধরে বললেন, ‘ওই অংশটা আপনি আমাকে বিক্রি করুন, আমি ওই মন্দির সংস্কার করে মহাপ্রভুর মূর্তি বসিয়ে, পাঠবাড়ি করব। আপনার পূর্বপুরুষ খুশি হবেন। ওইখানে দাঁড়িয়ে আমি এই নির্দেশ পেলাম। আপনার বসবাসের জন্য আমি একটা ছবির মতো ব্যবস্থা করব। আপনি আপনার লাইব্রেরি আর নিত্যপূজা ও পাঠ নিয়ে থাকবেন। ইচ্ছে করলে এই অংশটা বিক্রি করে টাকাটা ফিক্সড করে দিন।’

চশমার মোটা কাচের আড়ালে বড়-বড় চোখ। মাস্টারমশাই অস্বাভাবিক দৃঢ় গলায় বললেন, ‘আমি বিক্রি করব না।’ একটু থেমে রইলেন, বড়মামার মুখটা কেমন হয়ে গেছে। মাস্টারমশাই আরও জোর গলায় বললেন, ‘আমি সবটাই তোমাকে দিয়ে দেব। তুমি এখানে এমন একটা কিছু করো, যাতে অগ্নিযুগের সেই বিপ্লবীর স্মৃতি রক্ষা হয়। তিনি ছিলেন গৃহী সাধক, সর্বত্যাগী দেশসেবক।’

বড়মামা একটু ভাবনা-চিন্তা করে বললেন, ‘বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপার, অনেকের তো আপত্তি থাকতে পারে!’

‘কার আপত্তি! এসব আমার নামে। আমি তোমাকে উইল করে দিয়ে যাব।’

‘পাড়ার লোকে পাঁচ কথা বলবে। বলবে, আমি আপনাকে তোয়াজ করে সব লিখিয়ে নিয়েছি।’

‘রাখো তোমার পাড়ার লোক! শোনো ডাক্তার, আমার যথেষ্ট বয়েস হয়েছে। যে কোনওদিন চলে যেতে পারি। মানুষকে বেশি পাত্তা দিয়ো না। নিজের কাজ করে যাও।’

‘আমরা তা হলে আসি।’

‘এসো, তুমি আমাকে বড় নিশ্চিন্ত করে গেলে বাবা।’

আলমদা বাইরে বসেছিলেন। বড়মামা বললেন, ‘কাল থেকে কাজে লেগে যাও।’

সাইকেলে চেপে আমরা ফিরে এলুম। চেম্বারে রোগীদের লাইন পড়ে গেছে। বড়মামা খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘একটা দিনের তরেও কি শান্তি নেই! আমার যে এখন নুন-লেবু মাখিয়ে ভুট্টা খেতে ইচ্ছে করছে। আমার যে এখন মাছ ধরতে ইচ্ছে করছে।’

বড়মামা গজগজ করতে-করতে চেম্বারে ঢুকলেন। ঢুকেই একজনকে ভীষণ ধমক দিলেন, ‘আপনার অসুখ মশাই কোনওদিন সারবে না। এখানে আপনি ইয়ার্কি মারতে আসেন। কাল গুপির দোকানে আলুর চপ খাচ্ছিলেন। এদিকে আলসারের রোগী!’

এ ধাতানি খেয়েও ভদ্রলোক হাসছেন, ‘জানি, এই ভুলটা আপনিও করবেন। ওটা আমি নই, আমার যমজ ভাই। আমাদের দু’জনকে অবিকল একরকম দেখতে। কে বিশ্বনাথ, কে জগন্নাথ, বুঝতে পারবেন না। ছেলেবেলায় একজনকে দু’বার খাওয়ালেন, আর একজনের উপোস। খাওয়ানো হয়ে গেলেই কপালে কাজলের টিপ। যেন ভোট দেওয়া হল। এই বুদ্ধিটা বেরোতে আমরা দু’জন খেয়ে বাঁচলুম। আর স্কুলে ঢোকার পর আমাকে ন্যাড়া করে দিলেন। একজনের চুল, একজন ন্যাড়া। ন্যাড়া জগন্নাথ। চুলো বিশ্বনাথ। চমৎকার ব্যবস্থা।’

বড়মামা একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ‘আমার কাছে কে আসে?’

‘আমরা দু’জনেই আসি। এ চুলোয় আর কে আছে যে, ডেথ-সার্টিফিকেট দিতে পারে!’

বড়মামা অতিশয় অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, ‘আমি ফিট-সার্টিফিকেটও দিই। আপনি কে?’

‘নাম বললে গুলিয়ে যাবে, আমি আলসার, আমার ভাই আলুর চপ। তবে প্রবলমেটা কী হয় জানেন, আলুর চপ অনেক সময় ভুল করে আলসারের মুখে ঢুকে যায়, চিনতে পারে না তো! মাঝে-মাঝেই আমারই সন্দেহ হয়, কে প্রকৃত বিশ্বনাথ, কে প্রকৃত জগন্নাথ। আমার মা গুলিয়ে ফেলেননি তো!’

‘মাকে জিগ্যেস করলেই হয়!’

‘করেছিলুম। মা বলেছিলেন, দুটো নামই রইল, যখন যার যেটা ইচ্ছে, সেইটা ব্যবস্থা করিস। নাম হল জামা। লোক কখনও নীল জামা পরে, কখনও লাল।’

‘আরে দূর, ও উপমাটা আসছে না এখানে। নামের ওপর লোকে জামা চড়ায়। লাল বিশ্বনাথও বিশ্বনাথ, নীল বিশ্বনাথও বিশ্বনাথ।’

ওপাশ থেকে এক প্রবীণ মানুষ বললেন, ‘একজনকে নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে, এখানে তো অসুখের হরিহর ছত্রের মেলা! ওই ইয়ারটিকে ছাড়ুন এইবার।’

‘আপনার প্রবলেম!’ স্টেথো নিয়ে বড়মামা এগোলেন সেইদিকে।

ভদ্রলোক বললেন, ‘সেই যে আমি বিষ খেয়েছিলুম!’

বড়মামা থমকে গেলেন, ‘সে তো পুলিশ কেস।’

‘না, পুলিশ কেস নয়, হাউসহোল্ড পয়জন। গৃহপালিত বিষ।’

‘কী খেয়েছিলেন? আমার আজকাল আর কিছুই মনে থাকে না।’

‘রোগীদের আপনারা কি আর মানুষ ভাবেন! সব গোরু-ছাগল। আমি কাফ মিক্সচার খেতে গিয়ে দু’ঢোক টিংচার আইডিন খেয়ে ফেলেছি। ভুল করে।’

পাশে বসে ছিল বাচ্চা নাতনি। সে অমনই চিৎকার করে উঠল, ‘না ডাক্তারবাবু, না, দিদার সঙ্গে ঝগড়া করে দাদাইয়া আইডিন খেয়েছিল, তারপর বাবা এসে নুন-জল খাইয়ে বমি করিয়ে দিল, অনেক রাত্তিরে, আমি জেগে-জেগে সব দেখেছি।’

‘অ্যায় চোপ, একদম চোপ, বড়দের কথায় একদম কথা বলবি না।’ বৃদ্ধ খ্যাঁক-খ্যাঁক করে উঠলেন। নাতনিও কিছু কম যায় না। সে ঘাড় বেঁকিয়ে, মুখ ভেঙিয়ে বলল, ‘না, বলব না আবার, তুমি আমার দিদাকে কেবল কষ্ট দাও, সেলফিশ জায়েন্ট।’

বৃদ্ধের ফরসা মুখ লাল হয়ে গেল। বড়মামার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওর একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না। বুড়ির আদরে বাঁদর হয়ে গেছে। দিদার গুপ্তচর। একালের মাতাহারি। ওর কোর্টমার্শাল হওয়া উচিত।’

নাতনির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দিদা আমার, আমি যা খুশি তাই করব, তোর তাতে কী! এই যে সকালে তোর বাবা গরম জিলিপি এনেছিল, আমাদের একখানাও দিয়েছিলিস!’

‘দিদা তিনটে খেয়েছে, তোমাকে বলেনি। তোমার তো সুগার, জিলিপি খাবে! জিলিপি!’

বড়মামা তাড়াতাড়ি বললেন, ‘আপনার কমপ্লেনটা কী?’

‘নো খিদে, নো স্লিপ, চোখে সরষে ফুল।’

‘আয়োডিনের এফেক্ট। সুগার কত?’

‘লাস্ট তিনশো আশি।’

‘বলেন কী, সুগার ফ্যাক্টরি। খুব হাঁটুন। ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি।’

‘মেয়েরা খেতে পারে?’

‘ঘুমের ছেলে-মেয়ে নেই।’

‘অলরাইট।’

‘তার মানে!’

‘মানে, আমার ওয়াইফকে খাওয়াব। বুড়ি যদি একটু ঘুমোয়, তা হলে এই বুড়োটাও সুখে নিদ্রা যেতে পারে। কমপ্লেন অ্যাণ্ড কমপ্লেন অ্যাণ্ড কমপ্লেন। প্লেন আর ল্যাণ্ড করে না, সারা রাত চক্কর।’

কম্পাউণ্ডার মানিকদা এসে বললেন, ‘করছেন কী, সাতটা কল আছে। দুটো এখন-তখন।’

বড়মামা তৎপর হলেন, ‘ঝপাঝপ প্রেসক্রিপশন, ধপাধপ ইঞ্জেকশন। চেম্বার খালি। কেবল একজন মহিলা চুপ করে বসে আছেন উদাস মুখে। কাঁচাপাকা চুল। একেবারে যেন মায়ের মূর্তি। বড়মামা ড্রয়ার খুললেন, এক খামচা নোট দিয়ে সসম্ভ্রমে গিয়ে দাঁড়ালেন ভদ্রমহিলার কাছে, যেন অঞ্জলি দিচ্ছেন। কারও মুখে কোনও কথা নেই। ভদ্রমহিলা লজ্জায় অধোবদন, বড়মামা চোখ বুজে আছেন। নোট হস্তান্তরিত। ভদ্রমহিলা কাঁদছেন।

আমি জানি, কেসটা কী! এক বিখ্যাত ডাক্তারের স্ত্রী। দুটো ছেলেই অমানুষ, চোর, চিটিংবাজ। ডাক্তারবাবুর অকালমৃত্যুর কারণ তারাই। বাড়ি, গাড়ি, চেম্বার সব বিক্রি হয়ে গেছে। একটি ছেলে বোধহয় জেল খাটছে।

বড়মামা পূব দিকের জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন, ভদ্রমহিলা চলে যাচ্ছেন। ফিরে-ফিরে তাকাচ্ছেন। গোটা ব্যাপারটাই ঘটে গেল নিঃশব্দে। ভীষণ শব্দে উড়ে যাচ্ছে একটা প্লেন। বুম করে একটা শব্দ হল। টায়ার ফাটল রাস্তায়।

বড়মামা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘পথ পেয়ে গেছি মাস্টার হাবু।’

যখন যা খুশি নামে ডাকা বড়মামার অনেক মজার একটা মজা। কয়েকদিন আগে মাসিমাকে ডাকছিলেন, ‘ম্যাডাম ফিশফ্রাই’। মেজোমামাকে কয়েকদিন ডেকেছিলেন, ‘শ্রীমান ভরদ্বাজ’। আমাদেরও বেশ মজা লাগে। কম্পাউন্ডার দাদা তাড়া দিলেন, ‘সাতটা কল, দুটো এখন-তখন।’

বড়মামা ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘যাক, মরে যাক সব, বেঁচে থেকে কী হবে! মানুষের হাতে মরার চেয়ে রোগে মরা ভালো।’

চেয়ারে ধপাস করে বসে বললেন, ‘পাকা পেয়ারা খেতে ইচ্ছে করছে।’

বড়মামা ডাক্তারি ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললুম, ‘চলুন, চলুন, কল শেষ করে আমাদের পেয়ারাবাগানে যেতে হবে ক্রোটন গাছ কিনতে।’

‘রা-রাইট ইউ আর। লেটস গো।’

গাড়িতে বসে বললেন, ‘দ্যাখ তো, এখন-তখনে প্রথম কে আছেন!’

কলবুক খুললুম, ‘হরিসাধন দত্ত।’

‘থ্রোট ক্যানসার, লস্ট কেস।’

বিছানায় আধশোয়া, জ্বলে-পুড়ে যাওয়া কঙ্কালসার এক মানুষ। জোরে-জোরে শ্বাস ফেলছেন হাপরের মতো, ফ্যালফ্যালে দুটো চোখ। পাশে বসে আছেন স্ত্রী। শীর্ণ চেহারা, উদ্বিগ্ন মুখ। দেখলেই মনে হয় বড় ঘরের মেয়ে। ঘরের বাইরে লাল মেঝেতে, পা গুটিয়ে হতাশ হয়ে বসে আছেন বড় ছেলে, মানবদা। কলেজের অধ্যাপক। আমার সঙ্গে আলাপ আছে। বড়মামা রোগীর ঘরে ঢুকে গেলেন, আমি মানবদার পাশে মেঝেতে বসে পড়লাম।

মানবদা আমার ডান হাতটা আলতোভাবে ছুঁয়ে বললেন, ‘আজকের দিনটা কাটে কি না সন্দেহ। এ কষ্ট আর সহ্য করা যায় না। মাঝে-মাঝে মনে হয়, কিছুই যখন করার নেই, চলে যাওয়াই ভালো।’

সারা বাড়ি থম মেরে আছে। যেন বর্ষার আকাশের তলায় মৃত্যুর কালো ছাতা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বড়মামা বেরিয়ে এলেন, থমথমে মুখ। বুকপকেট থেকে টাকা বের করে মানবদা ভিজিট দিতে গেলেন। বড়মামা ফিসফিস করে বললেন, ‘আমাকে জানোয়ার ভেবো না। শোনো, এক পারসেন্টও আশা নেই। প্রস্তুত থাকো। একটা স্টেরয়েড দিয়ে গেলুম। যতক্ষণ চলে। হার্ট স্ট্রং, তাই ফাইট করতে পারছেন। তুমি মাকে এইবার একটু রিলিফ দাও।

‘পাশ থেকে কিছুতেই সরানো যাচ্ছে না। অনেকবার চেষ্টা করেছি।’

গাড়িতে এসে বড়মামা বললেন, ‘চারপাশে গিজগিজ করছে মৃত্যু, তার মধ্যে আমরা কোলা ব্যাঙের মতো খপাং-খপাং লাফাচ্ছি। লোকসভা, বিধানসভা করছি। আকাশ ভেঙে সব চাপা পড়ে গেলে বাঁচা যায়। তোর স্কুল কবে খুলছে?’

‘এখনও পনেরো দিন।’

‘বাঁচা গেছে। তুই সব দেখে রাখ, পরে গল্প, উপন্যাসে মানুষের কথা লিখবি। দু’নম্বরটা দ্যাখ।’

‘বিনোদ দত্ত।’

‘মরেছে।’

‘না, মরেনি, মরলে কেউ কল দেয়!’

‘ধুর ও মরবে কেন! মরেছি আমি। কিছু রুগি থাকে যারা ডাক্তারকে মারে। পকেটে-পকেটে রোগ। দুটো কথা মনে রাখ, পরে জট ছাড়াবি। মানুষের রোগ, আর রোগের মানুষ। ইংরেজি করতে পারিস, আর ও জি ইউ ই। রোগ।’

বিনোদবাবুর বিশাল বাড়ি। চতুর্দিকে তার ধ্যাবড়া-ধ্যাবড়া কাজ। উৎকট রং। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে শুনছি, রেকর্ড প্লেয়ার ধাঁইধাপ্পড় গান হচ্ছে। বিচ্ছু টাইপের গোটাকতক বাচ্চা উঠোনে রবারের বল পেটাচ্ছে। একটা বউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কর্কশ গলায় কাজের মেয়েটাকে গালাগাল দিচ্ছে। আর একটা বউ খ্যাড়খেড়ে গলায় উপদেশ দিচ্ছে, ‘ও বলে কিছু হবে না, বেশ করে পিটিয়ে দাও।’ মোটা থলথলে, আদুর গা, লুঙ্গি-পরা একজন লোক বারান্দায় বেরিয়ে এসে বলছে, ‘হ্যাঁ, আমার জেলে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। খেদদাও, খেদদাও, উকিলের সঙ্গে অ্যাপয়েন্ট আছে। আঃ, কুমার শানু যা গায় না, নাচতে ইচ্ছে করে। বাংলার গৌরব, শানু আর সৌরভ। আর একটা সেঞ্চুরি হাঁকড়ে দিলে।’

নীচের উঠোনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অ্যায় গুটকে, ফুটবল রাখ, ব্যাট পেটা। মেরাদোনা নয়, সৌরভ।’

সেই শব্দব্রহ্ম ভেদ করে, বারান্দায় প্যাঁচ খুলে আমরা দ্বিতীয় মহলে এলাম। বিছানায় ছত্রিশটা বালিশ ফিট করে শয্যাশায়ী, পাকা টুসটুসে এক বৃদ্ধ।

‘ডাক্তার, আজ আবার একটা করে বিট মিস করছে।’

‘ভয় নাই, আজ শেষ ওষুধ অব্যর্থ নিয়ে এসেছি।’

‘কী, কী, বিলিতি?’

‘জাপানি।’

‘আরে, ওরা তো বামন অবতার! কী ওষুধ!’

‘সাইজটা একটু বড়, গিলতে পারবেন?’

‘চেষ্টা করে গিলতেই হবেই। বাঁচতে যখন হবে! কত বড়?’

‘একটা কোয়ার্জ রিস্টওয়াচ। জেন্টস নয়, লেডিজ।’

‘আমি মরে যাচ্ছি ডাক্তার, আর তুমি আমার সঙ্গে কৌতুক করছ!’

বড়মামা হঠাৎ ডিক্টেটরের গলায় বললেন, ‘গেট আপ, উঠে বসুন।’

ভদ্রলোক ভয়ে-ভয়ে উঠে বসলেন।

‘বিছানা থেকে নেমে আসুন। গেট ডাউন।’

ইংরেজি কমাণ্ডে বেশ কাজ হচ্ছে। ভদ্রলোক কাঁপতে-কাঁপতে মেঝেতে দাঁড়ালেন।

বড়মামা বললেন, ‘কানে কিছু আসছে, গান-বাজনার শব্দ!’

‘ও তো অষ্টপ্রহরই আসছে। তিষ্টোতে দিচ্ছে না শান্তিতে।’

‘দু’ মাত্রার তাল, লেফট-রাইট। নিন আসুন, আমার সঙ্গে নাচুন। ধেই, ধেই, ধেই, ধেই। এই বিটে নাচুন। হার্টবিট আর মিস করবে না।’

পাকা ঠানদির মতো চেহারার এক ভদ্রমহিলা পান-জর্দা চিবোতে-চিবোতে ঘরে ঢুকে বললেন, ‘বুড়ো, এইবার জব্দ হয়েছে। সারাটা জীবন বাতিকের অসুখে আমাকে জেরবার করে দিলে।’

বৃদ্ধ নাচতে-নাচতে বললেন, ‘বেশ লাগছে নাচতে!’

বড়মামা মহিলাকে বললেন, ‘এবার আর আমাকে ডাকবেন না, নাচের মাস্টারমশাইকে কল দেবেন। অনেক কম খরচে আরোগ্য।’

মহিলা বললেন, ‘কাউকে ডাকতে হবে না, আমি নাচিয়ে দেব।’

‘এর পর আমাকে ডাকলে, ঘুমের ওষুধ দিয়ে ওপরের বাঙ্কে তুলে দেব। ঘুমোতে-ঘুমোতে ডেস্টিনেশনে। হরিবোল ইস্টিশন।’

বড়মামা ভিজিটের টাকা গুনে-গুনে পকেটে পুরলেন।

ভদ্রলোক করুণ কণ্ঠে বললেন, ‘ডাক্তার আমাকে ত্যাগ কোরো না, তা হলে আমায় প্রাণত্যাগ করতে হবে।’

বড়মামা গাড়িতে বসে উত্তরটা দিলেন, ‘তোমার মতো দুধেল গোরুকে কেউ ত্যাগ করে? তোমার তো অসুখ নয়, ব্যায়রাম। ব্যায়রামের ব্যুৎপত্তি জানিস—ব্যয় করিলেই আরাম।’

পেয়ারাবাগানে যখন পৌঁছলাম, তখন প্রায় দুটো। রোদের দুপুর চড়চড় করছে। গাছের পাতা ঝিম মেরে আছে। জায়গাটা এতই সুন্দর যে লোকে বলে, দ্বিতীয় বারাণসী। কোনও গাছে ঝাপড়া হয়ে আছে হলদে ফুল, কোনও গাছে সাদা। তামাটে-নীল আকাশ, হলুদ, সাদা ফুলের বাহার, নিঝুম সবুজ পাতা, ঘন ছায়া, এত বড়-বড় ফিঙে পাখি, শালিকের ঝাঁক।

মেটে রাস্তা দিয়ে ঢিকোতে ঢিকোতে চলেছে বড়মামার হিন্দুস্তান ফোর্টিন। যার সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াল সেটা যেন মুঘল আমলের দুর্গ। ছোট-ছোট লাল ইটে গাঁথা সুউচ্চ পাঁচিল। কয়েদি টপকাতে পারবে না। জায়গায়-জায়গায় সবুজ শৈবাল ছোট-ছোট পরগাছা। বিশাল একটা দরজা। হাতি গলে যাবে। বড়মামা হর্ন দিলেন। ঘড়ঘড় করে খুলে গেল দুর্গের দরজা। যেন স্বপ্ন খুলে গেল। লাল টুকটুক চওড়া একটা পথ ভেতরে হারিয়ে গেছে। শুধু গাছ আর গাছ। রঙের বিস্ফোরণ। মশমশ শব্দে গাড়ি দরজা অতিক্রম করে কিছুটা গিয়ে ঘস করে থামল।

অদ্ভুত এক শীতলতা, অদ্ভুত শান্তি। জীবনে প্রথম বাবুই পাখির বাসা দেখলাম। গাছের ডালে সার-সার ঝুলছে। প্রত্যেকটায় একটা করে গোল দরজা। একটা করে পাখির ঠোঁট উঁকি মারছে। এক জোড়া কুবো পাখি বিশাল লেজের ভারে টলবল করে উড়ছে। যে ডালে বসছে সেই ডালই ঝুঁকে পড়ছে দেহভারে। ছোট-ছোট পেয়ারাগাছ আষ্টেপৃষ্ঠে ফল ধরে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম দেখলাম আফ্রিকার কালো পেঁপেগাছ। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব কালো। ক্রোটন অন্তত পঁচিশ-তিরিশ রকমের। ফার্ন বহুরকমের। রাশি-রাশি হাইব্রিড গোলাপ। অবাক-করা ডোরাকাটা গোলাপ। প্রায় এক-একটা বারকোশের মতো সূর্যমুখী। রং হল সানসেট ইয়েলো! গোল্ডেন কাঞ্চন। জিনিয়ার কী বাহার! পিটুনিয়া এখনও ফুটছে। হেঁটে-হেঁটে আর শেষ করা যাচ্ছে না। পান্থপাদপ পাতার পাখা মেলে উড়ে যেতে চাইছে। আয়নার মতো এখানে-ওখানে পড়ে আছে ছোট-ছোট জলাশয়। পাড় বাঁধানো বিশাল এক পদ্মপুকুর। বাতাসে পাতার কানগুলো মুচড়ে দিয়ে যাচ্ছে। বড়-বড় পদ্মফুল গোটা-গোটা ভ্রমরের অহঙ্কার ফেটে পড়ছে। বড়মামা একদিকে হারিয়ে গেছেন, আমি একদিকে। হেথায় আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা।

‘আর পারি না।’ বলে, সিমেন্ট বাঁধানো একটা বেঞ্চে বসে পড়লাম। পায়ের তলায় মখমল-সবুজ ঘাস। হাতের পাতার চেয়েও বড় চিত্র-বিচিত্র প্রজাপতি ভেসে-ভেসে যাচ্ছে চারপাশ দিয়ে। আমি আর এখান থেকে যাব না। তামাটে রঙের চারজন বলশালী মানুষ দূরে একটা কিছু করছেন। রোদে চকচক করছে শরীর। মাথার ওপর ফড়িংয়ের ঝাঁক।

বহু দূর থেকে বড়মামার গলা, ‘শিগগির আয়।’

বাগানের একেবারে শেষপ্রান্তে একটা কুঠিয়ার সামনে বড়মামা। জানলায় উঁকি মারছেন। দরজায় মরচে-ধরা তালা।

আগাছা, লতা, গুল্ম দণ্ডবৎ হয়ে আছে।

বড়মামা বললেন, ‘দ্যাখ, দ্যাখ, উঁকি মেরে দ্যাখ।’

আলোছায়ায় একটা মূর্তি। পাথরের কোন দেবতার, বুঝলাম না। ‘একটা মূর্তি!’

বড়মামা খলখল করে হেসে বললেন, ‘মহাপ্রভু! চিনতে পারছিস না, মহাপ্রভুর মূর্তি।’ ‘কানু, কানু!’ বড়মামা ছুটছেন।

তামাটে বর্ণ মানুষদের মধ্যে একজন এগিয়ে এলেন, ‘কী হয়েছে ডাক্তারবাবু!’

‘মহাপ্রভুর মূর্তি।’

‘হ্যাঁ, অবহেলায় পড়ে আছেন বহুদিন। চোদ্দ বছর আগে এক বৈষ্ণব সাধক এখানে ছিলেন। তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ”বৃন্দাবন দর্শন করে আসি” বলে সেই যে গেলেন, আর এলেন না।’

‘মূর্তি আমার চাই, যা লাগে।’

‘আপনি নেবেন! নিয়ে যান, একটা পয়সাও লাগবে না। রাতে আমার ঘুম হয় না। স্বপ্ন দেখি। কিছু না করতে পারার ভয়ে মরি।’

বড়মামা ঘর্মাক্ত সেই মানুষটিকে জড়িয়ে ধরলেন। ফড়িং উড়ছে, প্রজাপতি খেলছে, একঝাঁক টিয়া মহাকলরবে পেয়ারাগাছে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তিনটে রাজহাঁস, চতুর্থটাকে গলা মিলিয়ে ডাকছে। বড়মামা কাঁদছেন। দমকা একটা বাতাসে গাছের মাথা দুলিয়ে দিয়ে গেল। কৃষ্ণচূড়ায় চূড়াপাতায় বাতাস নাচছে।

বহুকালের পুরনো চাবি। তালার প্যাঁচ আর ঘোরেই না। ফোঁদলে করে তেল ঢালা হল। একসময় ফস করে তালা খুলে গেল। ঘরের মধ্যে ঠাকুর-ঠাকুর গন্ধ। মনে হল সঙ্কীর্তন চলছিল। এইমাত্র বন্ধ হল। দেওয়ালে একটি মৃদঙ্গ ঝুলছে। বেদির ওপর একজোড়া খঞ্জনি। বিছানার একটি রোল একপাশে। পূজার আসনটি আজও পাতা। মনেই হচ্ছে না ঘরটি অব্যবহৃত। কেউ কি রোজ গভীরে রাতে এসে সব পরিচ্ছন্ন করে পূজায় বসতেন! শ্বেতপাথরে দণ্ডায়মান মূর্তি যেন বড়মামাকে দেখে হাসছেন, ‘এসো, এসো, এগিয়ে এসো, চোদ্দটা বছর আমি তোমার অপেক্ষায় আছি।’

বড়মামা এগোচ্ছেন। কোথায় পা পড়ছে দিশা নেই। মূর্তির সামনে তিনিও মূর্তি হয়ে গেলেন। আমাদের পণ্ডিতমশাই যেমন বলেন, কাষ্ঠপুত্তলিবৎ। চিত্রার্পিত। আমি অতশত বুঝি না; কিন্তু আমারও মনে হচ্ছিল মূর্তির একটা প্রভাব আমাদের মধ্যে ধীরে-ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা সবাই বর্তমান ছেড়ে অতীতের দিকে চলেছি।

সন্ধে তখন প্রায় সাতটা। একটা ম্যাটাডর ভ্যানে আমরা বসে আছি। মহাপ্রভুর মূর্তি ধরে। আমাদের ঘিরে আছে ক্রোটন আর ফার্নের টব। বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন মেজোমামা আর মাসিমা।

তাঁরা দু’জনে ঝাঁ-ঝাঁ করে ওঠার আগেই বড়মামা চিৎকার ছাড়লেন, ‘ওরে শাঁখ বাজা শাঁখ বাজা, তিনি এসেছেন।’

দু’জনেই থ’ হয়ে গেছেন। অন্ধকারে হদিশ পাচ্ছেন না। পাতার ফাঁকে উকি মেরে দেখেই মাসিমা বললেন, ‘এ কী গো! এ কী সুন্দর!’

গাড়ির ওপর বড়মামার নৃত্য, ‘মহাপ্রভু এলেন, মহাপ্রভু।’

শাঁখ বাজল। ছুটে এসেছেন হরিদা। প্রথমে নামল গাছের টব। এইবার নামছেন মহাপ্রভু, ধীরে, সাবধানে, সন্তর্পণে। শীতল, মসৃণ। চন্দনের গন্ধ। গাড়িতে যতক্ষণ ধরে বসে ছিলাম, মনে হচ্ছিল, আমার সবচেয়ে প্রিয়জনকে ধরে আছি। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীটা কত সুন্দর।

দোতলার বারান্দায় এসে বসলেন মহাপ্রভু। যেন বাড়ির সর্বময় অভিভাবক! গলায় দুলছে জুঁইফুলের গোড়ের মালা। সবাই বসেছি সামনে।

হরিদা বললেন, ‘অনেক আশ্চর্য দেখেছি, এমন দেখিনি কখনও। মহাপ্রভুর এমন সুন্দর মূর্তি তোমার জন্যে অপেক্ষা করে ছিলেন পেয়ারাবাগানে! এমন মূর্তি সহসা দেখা যায় না!’

বড়মামা বললেন, ‘আমি আজ সকালে আমাদের ডাক্তারবাবুর স্ত্রীর অবস্থা দেখে ঠিক করেছি, অনাথ মেয়েদের জন্যে একটা আশ্রম করব। যেখানে কর্মই হবে ধর্ম। ধর্মই কর্ম নয়।’

মেজোমামা বললেন, ‘গুড আইডিয়া।’

মাসিমা বললেন, ‘এটা আমার অনেক দিনের ইচ্ছে। আর তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে আমাদের বাবা আর মায়ের নাম। আমাদের মা জীবনে কোনও সুখই পাননি। আমাদের বিপ্লবী বাবার জন্যে সব ত্যাগ করেছিলেন। ছেঁড়া কাপড়, দিনের পর দিন উপোস।’

ছয়

আবার সেই চাঁদের আলোর রাত।

রাতের ঘড়িতে সংখ্যা এক। আকাশ থেকে রুপোর তবক খসে-খসে পড়ছে। এমন প্রখর চাঁদের আলো যে, গাছের প্রতিটি পাতা গুনে নেওয়া যায়। দক্ষিণের বাতাস বইছে, বুঝি বসন্তকাল। কোকিলরা চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারছে না। আকুল আবেগে বারেবারে ডেকে উঠছে।

পুবের আকাশে নতুন এক ছবি, দুধসাদা এক মন্দিরের চূড়া। সাদা একটি পতাকা ফনফন করে উড়ছে। সেই মন্দির, যে মন্দিরের স্বপ্ন বড়মামা দেখেছিলেন। মহাপ্রভু সেখানে শ্বেতপাথরের বেদিতে। ফুলের সাজে সেজে আছেন। মাস্টারমশাইয়ের আশ্রম তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে মহিলাবাস। ডাক্তারবাবুর স্ত্রী এসে গেছেন। তিনি আবার মাস্টারমশাইয়ের দেখাশোনা করছেন।

আমাদের প্রত্যেকের বয়েস দু’বছর বেড়ে গেছে। হরিদার সব গোঁফ পেকে গেছে। মাসিমা নাকি চার-পাঁচটা পাকা চুল খুঁজে পেয়েছেন নিজের মাথায়। মেজোমামার ভুঁড়ি আরও দু’ইঞ্চি বেড়েছে। আমি আরও লম্বা হয়েছি।

সকলে একসঙ্গে বললেন, ‘পুব দিকে তাকালে মনে হচ্ছে স্বপ্ন। পতাকাটা যেন প্রেম-ভালোবাসার মতো উড়ছে। ঠিক মাথার ওপর সেই সাক্ষীতারাটা।’

বড়মামা বললেন, ‘তা হলে আমি বাকি গল্পটা বলি। আমাদের বেঁচে থাকার গল্প! আমাদের অপ্রকৃতিস্থ মা ওই ভাঙা চণ্ডীমণ্ডপে বসে আছেন। একটা-একটা করে ইট তুলে আঁচলে রাখছেন আর বলছেন, ‘এক টাকা, দশ টাকা, কুড়ি টাকা, একশো টাকা।’ ছোট্ট ফ্রক পরা কুসি যতবার মা বলে কাছে যাচ্ছে, মা বলছেন, ‘খুকি রাত হয়েছে বাড়ি যাও, রামছাগলে গুঁতিয়ে দেবে।’ কুসি কাঁদতে-কাঁদতে ছুটে আসছে আমার কাছে, ‘দাদা, মা কেন আমাকে চিনতে পারছে না!’ মেজোর টনসিলের ধাত, নাগাড়ে কেশে যাচ্ছে। কেউ নেই। ওই অতটুকু মেয়ে আমাকে রান্নায় সাহায্য করছে। অতীতের সেই দৃশ্য চোখ বুজলেই দেখতে পাই। বুকের কাছে কাঠকুটো ধরে এগিয়ে আসছে। দু’হাতে বালতি নিয়ে আসছে হেঁইসো-হেঁইসো করে। নিজেই নিজের চুল বাঁধছে। আমাকে জিগ্যেস করছে, ‘দাদা, তুমি বিনুনি করতে পারো!’

‘এই দুর্দিনে এলেন হরিদা। দাদা বলি, কিন্তু হরিদা আমার বাবা। আজ আমি যা হয়েছি তা ওই মানুষটির জন্যে। আমাদের সংসার চালাবার জন্যে, আমাদের লেখাপড়া শেখাবার জন্যে হরিদা জুটমিলে চাকরি করেছেন। হরিদা আমাদের মাকে চোখে-চোখে রেখেছেন, বাড়ি থেকে যাতে ছিটকে বেরিয়ে না যান। হরিদা আমাদের সম্পত্তি রক্ষার জন্যে মাসের পর মাস কোর্ট-কাছারি করছেন। শেষে যা হল, সে এক অলৌকিক ব্যাপার। কে একজন জোর করে হরিদাকে একটা লটারির টিকিট গছিয়েছিল, সেই টিকিটে লেগে গেল ফার্স্ট প্রাইজ। আমার, মেজোর, কুসির লেখাপড়ার খরচ ওই টাকা থেকেই হল।’

‘আর মায়ের মৃত্যু! সে তো ভোলার নয়! মা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন। যেন দীর্ঘ একটা ঘুমের পর জেগে উঠলেন। বলতে লাগলেন, ‘ওমা! তোরা কবে এত বড় হলি! এই বুঝি কুসি, তোকে কত ছোট দেখেছি।’ মা আবার সংসারটাকে সাজিয়ে তুললেন। মায়ের হাতের বিখ্যাত রান্না খেয়ে আমরা মোটা হতে লাগলুম। কী আনন্দ! হঠাৎ পায়ে একটা পেরেক ফুটল। আমাদের কাউকে জানতে দিলেন না। টিটেনাসে মৃত্যু হল। আমরা ভাবছি হিস্টিরিয়া, একমাত্র হরিদাই ঠিক ধরেছিলেন ডাক্তার না হয়েও। নতুন করে শুরু করতে গিয়ে মা শেষ হয়ে গেলেন। শ্বাস আর দীর্ঘশ্বাস, এই আমাদের জীবন। বুঝলি মেজো, ডাক্তার হওয়ার ফলে জীবনটাকে আচ্ছাসে দেখা গেল।’

‘তুমি তো সাধক দাদা!’

‘তুই একদিন আমাকে শয়তান বলেছিলিস।’

‘তুমি আমাকে একদিন পাঁঠা বলেছিলে।’

‘তুমি তার আগে আমাকে উড়নচণ্ডে বলেছিলে।’

মাসিমা এইবার হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘স্টপ, স্টপ আই সে।’

বড়মামা বললেন, ‘কেন এমন করলুম জানিস, মাকে ভুলব বলে। দৃশ্যটা যে চোখের সামনে ভাসছে। পরের দিন রেজাল্ট বেরলো। ডাক্তার হয়েছি আমি। ডাক্তার! শ্মশানচিতার সামনে দাঁড়িয়ে বলে এলাম, জানো মা, তোমার সব দুঃখের অবসান করব বলে, রাত জেগে, রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বেলে এই এতটা পথ এলাম, তুমি খাঁচা খুলে উড়ে গেলে। তোমার মুখটা কত সুন্দর ছিল, তোমার দু’চোখে কত স্নেহ ছিল, তোমার দু’হাতে কত সেবা ছিল, তোমার মনে কত ত্যাগ ছিল, তোমার হৃদয়ে কত বড় একটা আকাশ ছিল, তুমি ছাই হয়ে গেলে!’

‘স্টপ, স্টপ আই সে।’

‘সেদিনও ছিল এমনই চাঁদের আলোর রাত। কেউ ছিল না শ্মশানে। কুসি, তোর মুখটা ঠিক আমার মায়ের মতো।’

‘দাদা’—মাসিমা বড়মামার কোলে মুখ গুঁজলেন। মেজোমামা ধীরে ধীরে হাত রাখলেন মাসিমার পিঠে। সেদিনের সেই প্লেনটা উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে আলোর পিচকিরি ছুড়তে-ছুড়তে। সেই প্যাঁচা আমগাছের ডালে।

মাসিমা বড়মামার কোলে মুখ গুঁজে পড়ে আছেন। চাঁদের অলোয় সাদা ব্লাউজ-পরা পিঠটা যেন দুধের মতো সাদা! ঘাড়ের কাছে আলগা খোঁপা। পিঠের ওপর পড়ে আছে তিনটে হাত, দুটো বড়মামার, একটা মেজোমামার। প্রশ্ন জাগছে, মানুষের অতীতটা কি লিকুইড, শুধু জল? হাসি আর আনন্দের পাউডার বলে কিছু নেই। থাকবে কী করে! নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। পৃথিবীর তিনভাগই যে জল। বড়মামার বড়-বড় চোখ থেকে ফোঁটা-ফোঁটা জল মাসিমার পিঠে পড়ছে।

মাস্টারমশাই সেদিন হ্যাপি প্রিন্সের কথা বলছিলেন। সারাদিন ওড়াওড়ির পর ক্লান্ত সোয়ালো সোনায় মোড়ায় প্রিন্সের মূর্তির দু’পায়ের ফাঁকে আশ্রয় নিয়ে ভাবছে, আই হ্যাভ এ গোল্ডেন বেডরুম। সোয়ালো ডানার তলায় তার ছোট্ট মাথাটা গুঁজে সবে ঘুমোতে যাবে, পিঠের ওপর বড় একফোঁটা জল পড়ল। আকাশে একটুকরো মেঘ নেই, বড়-বড় তারা, উজ্জ্বল একটি রাত, তাও বৃষ্টি। উত্তর ইউরোপের আবহাওয়া প্রকৃতই ভয়ঙ্কর।

আবার একফোঁটা জল।

সোয়ালো ভাবছে, দুর ঘোড়ার ডিম, এই মূর্তির কী দরকার, সে একটা ছোট্ট পাখিকে বৃষ্টির আশ্রয় দিতে পারে না। এর চেয়ে বরং একটা চিমনি ভালো। যাই, আবার উড়ি।

ডানা মেলার আগেই আবার একফোঁটা জল। সোয়ালো তখন ওপর দিকে তাকাল, এ কী দেখছি! দ্য আইজ অব দ্য হ্যাপি প্রিন্স ওয়্যার ফিল্ড উইথ টিয়ারস, অ্যান্ড টিয়ারস ওয়্যার রানিং ডাউন হিজ গোল্ডেন চিকস। হিজ ফেস ওয়াজ সো বিউটিফুল ইন দ্য মুনলাইট!

আমার বড়মামা যেন হ্যাপি প্রিন্স। সেই মূর্তির মতোই তিনি দেখতে পাচ্ছেন—অল দ্য আগলিনেস, অ্যাণ্ড অল দ্য মিজারি অব মাই সিটি।

পুব দিকের আলসের কাছে আমরা গিয়ে দাঁড়ালুম পাশাপাশি। চাঁদের সমুদ্রে ভাসছে নতুন মন্দিরের চূড়া। হাঁসের ডানার মতো পতপত করছে পতাকা। একটি তারা তাকিয়ে আছে নীচের দিকে। দুধসাদা মন্দির-চূড়া।

আমি বললুম, ‘বড়মামা, আপনার মন্দিরের চূড়াটা কী ফ্যানটাসটিক দেখাচ্ছে!’

বড়মামা বললেন, ‘আমার মন্দির কী রে! বল, মানুষের মন্দির; বল, দুঃখ নয় সুখ; বল, ঘৃণা নয়, প্রেম; বল, মৃত্যু নয়, জীবন; বল, অশান্তি নয়, শান্তি; বল, আমরা মানুষ।’

শঙ্খ-ঘণ্টার শব্দ। সে কী! মঙ্গল আরতি শুরু হল বড়মামার মানবমন্দিরে। রাত তা হলে ভোর হল! মাস্টারমশাই মহামানবের ঘুম ভাঙাচ্ছেন!

একটু আগে আমরা কেঁদেছি

এখন আমাদের মুখে হাসি

মানুষের দুটো পা

সুখ আর দুঃখ!

এইরকম কিছু মনে হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই বড়মামা বললেন, ‘রাতের রহস্য যদিও-বা জানা যায়, মানুষের জীবনের রহস্য কোনওদিনই জানা যাবে না।’

মেজোমামা বললেন, ‘স্টিফেন হকিং প্রায় একই রকম বলেছেন, যে নিয়মে প্রকৃতি বাঁধা তা বোঝা হয়তো কঠিন নয়, কিন্তু মানুষের সমাজের নিয়মকানুন চির দুর্বোধ্য।’

‘তার মানে তুই বলতে চাইছিস আমি হকিং থেকে মেরেছি?’

‘এর মানে কি তাই হল?’

‘হ্যাঁ, হল।’

‘আচ্ছা কুচুটে তো!’

‘তুমি ভারি সরল!’

‘তোর মতো কুটিল নই!’

মাসিমা শাসন করলে, ‘স্টপ, স্টপ আই সে। তোমাদের স্বভাব জীবনে পালটাবে না।’

দুই মামা হাসতে-হাসতে সমস্বরে বললেন, ‘সাপে আর নেউলে, ম্যাডাম!’

মন্দিরে শুরু হয়েছে নাম-সঙ্কীর্তন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *