সাপুড়ে সর্দার

সাপুড়ে সর্দার

বোরখার নিচে মনিরার চোখ দুটো আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। স্বামীর হাসির শব্দ তার কানে যেন মধু বর্ষণ করলো। যার সন্ধানে সে পাগলিনী প্রায় যার জন্য সে নিজের প্রাণ বিনষ্ট করতেও। দ্বিধা বোধ করতো না, সেই আরাধ্যজন তার সম্মুখে দন্ডায়মান। মুহূর্তে ভয়-ভীতি সব উবে গেলো। তার কিন্তু সে নিশ্চুপ রইলো, মুখের আবরণ সে উন্মোচন করলো না।

বনহুর এবার মনিরাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে ফেললো–এবার তোমার মুক্তি নেই বান্ধবী। তুমি জানো দস্যু বনহুরের হাতে যে পড়ে তার নিস্তার নেই।

বললো মনিরা কি চাও তুমি?

 বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–তোমার সর্বস্ব আমি লুটে নেব।

এতো বড় সাহস তোমার?

জানি আজ তোমার হাতে রিভলভার নেই।

তাই তোমার এতো স্পর্ধা–

হাঁ, আজ তোমাকে দস্যু বনহুরের কবল থেকে কেউ উদ্ধার করতে সক্ষম হবে না। পুলিশ। সুপার হাশেম চৌধুরীও না।

না না, আমাকে ছেড়ে দাও। স্বামীর হাত কামড়ে দিয়ে বলে মনিরা।

রক্ত বের করে দাও তবু ছাড়বো না। বনহুর আরও নিবিড় করে মনিরাকে আকর্ষণ করে।

মনিরা কামড়ে দিলেও চাপ দিতে পারে না।

 হাসে বনহুর, মনিরার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে–মনিরা, আমার সঙ্গে তোমার এ আত্মগোপনতা কেন?

মনিরা সঙ্গে সঙ্গে নিজের মুখের আবরণ উন্মোচন করে তাকায় স্বামীর মুখের দিকে তুমি আমাকে চিনেছিলে?

হাঁ, তুমিও যেমন আমার সঙ্গে ছলনা করে বান্ধবী সেজে আমাকে নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছিলে, আমিও তাই তোমাকে–

মনিরা স্বামীর মুখ থেকে শিখের দাড়ি-গোঁফ খুলে রাখে। ব্যথা-করুণ কণ্ঠে বলে তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

বনহুর মনিরার দেহের বোরখাটা খুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় দূরে, তারপর ওকে বলিষ্ঠ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলে।

স্বামীর প্রশস্ত বক্ষে মনিরা নিজকে বিলিয়ে দেয়। আজ মনিরার মনে অফুরন্ত আনন্দ উৎস, সমস্ত অন্তর জুড়ে এক আবেগময় অনুভূতি!

মনিরা ভাবতে পারেনি, আজ তার ভাগ্য এতো প্রসন্ন হবে! ভয়ঙ্কর এক বিপদের মধ্য দিয়ে আসবে পরম মধুময় মুহূর্ত। খুশির উচ্ছ্বাসে সে স্বামীর বাহুবন্ধনে নিজকে অর্পণ করলো। অনাবিল পাওয়ার আনন্দে বুক তার স্ফীত হয়ে উঠেছে।

মনিরার দক্ষিণ হাতখানা স্বামীর কণ্ঠ বেষ্টন করে ধরলো। ভাববিহ্বল মনিরার চোখ দুটি মুদে এলো আপনা আপনি। বললো মনিরা বড় দুষ্ট তুমি!

উঁ হুঁ মোটেই না, মনিরার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে বনহুর।

সত্যি, বেশি রাতে ফিরে গেলে বাংলোর ওরা কি ভাববে বলতো?

তুমি তো জানোই দস্যু বনহুরের কবলে পড়লে তার নিস্তার নেই। কাজেই ফিরে যাওয়া যত সহজ মনে করেছো তত সহজ নয়।

সন্ধ্যার অন্ধকার জমাট বেঁধে উঠে।

বনহুর মোম জ্বেলে দেয়।

 মনিরা বলে–এই নির্জন পোড়াবাড়িতে কি করে থাকো তুমি?

 কেন?

 ভয় করে না তোমার?

হেসে উঠে বনহুর–ভয়! মনিরা, তোমার স্বামীই যে পৃথিবীর সব চেয়ে বড় ভয়।

ভূতের ভয় করে না তোমার?

কি বললে মনিরা–ভূতের ভয়। হাঃ হাঃ হাঃ ভূত আমাকে দেখলে ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়, বুঝলে?

সত্যি তুমি যে কি!

আজও তুমি আমাকে চিনলে না মনিরা।

চিনি বলেই অবাক হই তোমার কার্যকলাপ দেখে। বলতো কেন তুমি আমাদের কাউকে কিছু না বলে অমন করে পালিয়ে এসেছে এই ভারতবর্ষে?

আমার সে কাহিনী অদ্ভুত রহস্যময়। কিন্তু তুমি কি করে পুলিশ সুপার হাশেম চৌধুরীর আত্মীয় হলে তা তো বললে না?

বলবো, সে আর এমন কোনো রহস্যপূর্ণ কথা নয়। তুমি তো ডুব মেরেছো আমি কাকে নিয়ে কাটাই বলো?

কেন, তোমার মামীমা–তোমার নূর?

তারা তো আছেই কিন্তু নিষ্ঠুর তুমি জানো না, স্বামী যার ঘরে নেই, তার মত দুঃখিনী বুঝি আর কেউ নেই।

তাই স্বামীর অভাব পূরণ করবার জন্য—

না, স্বামীর অভাব পূরণ করবার জন্য নয়, স্বামীর সন্ধানে আমার মন আমাকে টেনে এনেছে। সত্যি আমি মাসুমার কাছে চিরঋণী। ওকে আমি ধন্যবাদ দেই, ওর জেদেই আমি এসেছিলাম। তাই আজ তোমায় পেলাম। স্বামীর বুকে মাথা রাখে মনিরা।

বনহুর বলে মা কেমন আছে মনিরা?

ভাল আছেন তিনি, তবে তোমার জন্য পাগলিনী প্রায়।

 নূর কত বড় হয়েছে?

 অনেক বড় হয়েছে। তোমার কথা বলে সব সময়ে মন খারাপ করে সে।

পড়াশোনা করছে তো?

 হাঁ।

লেখাপড়া শিখে ও মানুষ হোক মনিরা। আমি যা পারিনি নূর তাই করবে। মনিরা ওর সম্মুখে যাবার ইচ্ছা আর আমার নেই।

এ তুমি কি বলছো?

হাঁ, সত্যিকথা বলছি। যদি যাই, রাতের অন্ধকারেই ওকে দেখে আসবো কিন্তু পিতা বলে কোনোদিন আমি তার সাক্ষাতে গিয়ে দাঁড়াবো না।

কি নিষ্ঠুর পাষন্ড তুমি!

মনিরা আমি কত বড় অভিশপ্ত মানুষ তা তো জানো। কোন মুখ নিয়ে আমি নূরের সরল-সহজ প্রাণের সম্মুখে নিজকে তুলে ধরবো? কোন মন নিয়ে–বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে বনহুরের কন্ঠ।

মনিরা স্বামীর মাথায়-কপালে হাত বুলিয়ে দেয়। আঁচল দিয়ে মুছে দেয় চোখের পানি। মনিরার চোখদুটোও শুষ্ক ছিলো না।

রাত বেড়ে আসে। মনিরা বলে চলো এবার আমাকে রেখে আসবে?

মনিরা! বনহুর নিবিড়ভাবে মনিরাকে আবার বুকে জাপটে ধরে– চলে যাবে?

গিয়ে কোনো উপায় আছে বলো? স্বামীর গলায় বুকে হাত দিয়ে অনুভব করে মনিরা। গন্ডের সঙ্গে গন্ড মিলিয়ে বলে–আবার আসবো।

আসবে?

হাঁ যখন তুমি বলবে তখনই আমি আসবো তোমার পাশে।

 চলো মনিরা রেখে আসি এবার তোমায়।

চলো! মনিরা উঠে দাঁড়ায়।

বনহুর আর মনিরা গাড়িতে এসে বসে। এবার মনিরা ড্রাইভ আসনের পাশে বসে, স্বামীর পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসতে গিয়ে অনাবিল এক শান্তিতে ভরে উঠে ওর মন। এ যে জীবনের এক পরম শান্তি!

বাংলোয় ফিরবার পূর্বে মনিরাসহ বনহুর দিল্লীর এক দোকানে গিয়ে অনেক কিছু কিনে ফেললো। মাসুমার জন্য কিনলো শাড়ি ব্লাউজ, হাশেম চৌধুরীর জন্য নতুন নাইট ড্রেস আর খাবার নিলো বেশ কিছু।

এবার বনহুর শিখ ড্রাইভারের বেশে সজ্জিত হয়ে নিলো। ড্রাইভার সেজে গাড়ি চালাচ্ছে বনহুর আর মনিরা পিছনের আসনে বসে আছে। বাংলোয় ফিরতেই শশব্যস্তে ছুটে এলেন হাশেম চৌধুরী আর মাসুমা, এতো বিলম্ব দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলো ওরা।

হাশেম চৌধুরী ড্রাইভারকে ধমক দিলেন–শিবাজী, এ দের কিয়াতুম্ লোক? কাঁহা গিয়া থা বোলো?

হাম কেয়া কসুর কিয়া হুজুর। মেম সাহাব তো দোকান পর এত না দেড় কিয়া।

মনিরা গাড়ি থেকে জিনিসপত্র নামাতে নামাতে বললো–হঠাৎ এসব দেখে না নিয়ে আর পারলাম না।

অতো সব কি এনেছিস মনিরা? বললো মাসুমা।

সব দেখবি চল। বললো মনিরা।

হাশেম চৌধুরী বললেন ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে–শিবাজী এসব অন্দর মে লে চলো।

 বহুৎ আচ্ছা হুজুর, আপ লোক চলিয়ে আভি হাম্ লে আতা।

আচ্ছা লে আও। চলো তোমরা চলল। অগ্রসর হলেন হাশেম চৌধুরী।

মনিরা বললো–এখন শরীর কেমন আছে মাসুমা?

 তোর চিন্তায় অসুখ পালিয়ে গেছে কোথায় কে জানে।

বাঃ তাহলে তো ভালই হয়েছে। আমার চিন্তায় যদি অসুখ পালায় তাহলে অসুখের দামটা না। হয় আমায় দিস।

মাসুমা বলে বেশ তাই দেব। কিন্তু এতো দেরী করলি কোথায় বলতো?

ঐ তো বললাম দোকানে।

এত সব কি কিনেছিস্ মনিরা? মামীমা টাকাগুলো দিয়েছিলেন, সব বুঝি শেষ করে এসেছিস না?

না না, তেমন কি আর এনেছি।

 চল্ আগে দেখি তারপর মজাটা দেখাবো। আচ্ছা বল্ রঞ্জন বাবুর কোনো সন্ধান পেলি কিনা?

আমি কি ওকে খুঁজতে গিয়েছিলাম তাই পাবো?

 জিনিসপত্র দেখে তো হাশেম চৌধুরী আর মাসুমার চক্ষুস্থির। সেকি মূল্যবান জামা-কাপড় অনেক দামী দামী ফলমূল আর কতরকম খাবার!

মাসুমা তো গালে হাত দিয়ে বসলো–সর্বনাশ, এসব তুই কি করেছিস বল্ তো?

আগে বল পছন্দ হয়েছে কিনা?

কি যে বলিস্ এতো দামী জামা-কাপড় আর এসব পছন্দ হবে না?

হাশেম চৌধুরীও বিস্ময়ভরা গলায় বললেন–আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এসব কেন আনতে গিয়েছিলেন বলেন তো?

কোনোদিন কিছু দেইনি আপনাদের তাই এই সামান্য কিছু।

এ সব সামান্য? বললেন হাশেম চৌধুরী।

এরপর থেকে মনিরা প্রায়ই শিবাজীসহ চলে যেতো বাইরে। হয়তো কোনো কাজের নাম করেই যেতো। কিন্তু বনহুর আর মনিরা মিলিত হতো সেই পোড়াবাড়িতে।

মনিরার জীবন আবার আনন্দে হাসি-গানে ভরে উঠলো। স্বামীসঙ্গ তার জীবনকে করে তুললো মুখর।

পোড়োবাড়ির নির্জনতায় মনিরা স্বামীকে একান্ত নিজের করে পেতো, সমস্ত অন্তর দিয়ে উপভোগ করতো স্বামীর অস্তিত্ব।

বনহুর যখন মনিরাকে নিয়ে আত্মহারা তখন সাপুড়ে পল্লীতে নূরী বনহুরের প্রতীক্ষায় অহরহ অশ্রু বিসর্জন করে চলেছে। সেই যে তার গলার মালা দেখে আনমনা হয়ে গেলো, তারপর আর ওকে ধরে রাখতে পারলো না নূরী কিছুতেই। নূরী নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে লাগলো কেন সে ঐ মালা গলায় পরেছিলো। কেন সে ঐ মালা খুলে রাখেনি–ঐ মালার জন্যই বনহুর হয়তো কোথাও কোনো বিপদে জড়িয়ে পড়েছে।

নূরীর চোখের পানি বিচলিত করে তুললো কেশবকে।

সাপুড়ে সর্দার যখন জানলো নূরীর প্রিয়জন হলো ঐ বাবুজী তখন সেও কম ব্যথিত হলো না। নূরীর মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলো।

নিঃসন্তান সাপুড়ে সর্দার এই মেয়েটিকে যারপর নাই স্নেহের চোখে দেখতো। কেন যেন তার অত্যন্ত ভাল লাগতো ওকে। তাই নূরীর চোখের পানি তার অন্তরে দারুণ আঘাত করলো।

রংলাল কিন্তু সব সময়ে নূরীকে হস্তগত করার জন্য গোপনে প্রচেষ্টা চালিয়ে চলেছে।

একদিন নূরী একা একা বসে চিন্তা করছিলো হয়তো বনহুরের কথাই ভাবছিলো সে–এমন সময় হঠাৎ রংলাল এসে তার কাঁধে হাত রাখলো। চমকে ফিরে তাকালো নূরী, সঙ্গে সঙ্গে বিবর্ণ ফ্যাকাশে হলো ওর মুখমন্ডল।

রংলাল হেসে বললো–এতো করে কার কথা ভাবছিস ফুল?

নূরী ক্রুদ্ধ নাগিনীর মত ফোঁস্ করে উঠলো–সেকথা তোমার শুনে কাজ নেই। যাও এখান থেকে।

যাবো আমি! হুম তোমাকে নিয়ে তবেই যাবো। রংলাল জাপটে ধরে ফেললো নূরীকে।

নূরী চিৎকার করে উঠলো–বাবাজী–বাবা–বাবা–

হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো সাপুড়ে সর্দার; হিংস্র জন্তুর মত ঝাঁপিয়ে পড়লো রংলালের উপর, টুটি টিপে ধরলো ওর।

রংলাল নূরীকে তখনকার মত ছেড়ে দিলো বটে কিন্তু সে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেলো।

নূরী সাপুড়ে সর্দারের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ক্রন্দন ভরা কণ্ঠে বললো– বাবা, আমাকে রংলালের হাত থেকে বাঁচাও।

এমন সময় হঠাৎ আবির্ভাব হয় বনহুরের।

 সাপুড়ে সর্দার খুশি হলো বনহুরকে দেখতে পেয়ে।

নূরী ছুটে গিয়ে লুটিয়ে পড়ে বনহুরের বুকে।

সাপুড়ে সর্দার বললো–একটা কথা বলবো তোমাকে বাবু অত্যন্ত গোপন কথা। এদিকে এসো বাবু আজ সব কথা বলবো। আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই তাই তোমরা আমার ছেলেমেয়ে। বাবু হামি যখন খুব জোয়ান ছিলাম তখন এক দিন কাহাতুর নামে এক পাহাড়ে সাপ ধরিতে গিয়েছিলাম হামার বাপুজি ছিলো সাথে।

বনহুর অবাক কণ্ঠে বললো–কাহাতুর পাহাড়?

হাঁ বাবুজী, কাহাতুর পাহাড় দিল্লীর শহর হইতে পাঁচশত মাইল দক্ষিণে। ওখানে যাইতে তিন মাস তের দিন সময় লাগে।

কেন? কোনো যানবাহন চলে না?

না বাবুজি পায়ে হাইটে যাইতে হয়। সেই কাহাতুর পাহাড়ে এক গুপ্তধনের গুহা আছে। বাবুজী, হামি সেই পথ জানি।

বনহুর বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো আবার–গুপ্তধন।

হাঁ বাবুজী বহুৎ সোনা-দানা হীরা জহরৎ আছে সেই গুপ্ত গুহায়। হামার কোনো বেটা পুত্র নেই, এক ভাতিজা রংলাল–বাবুজী বড় নিমকহারাম উ লোক আছে। তাই আমি উহাকে এ রাস্তা দেখাইমু না।

বনহুর স্তব্ধ হয়ে শুনছে তার চোখের সম্মুখে ভাসছে এক সুড়ঙ্গ পথ, তারপর এক গুহা গুহার মধ্যে অসংখ্য ধনরত্ন, মণি মানিক্য। বনহুরের চোখ দুটো জ্বলে উঠলো, লোভ তার নিজের জন্য নয়–ওগুলো আনতে পারলে অনেক কাজে লাগবে।

বললো বনহুর-সর্দার, সত্যি বলছো?

হা বাবুজী, হামি কোনোদিন মিথ্যা বলিবো না। বাবুজী, তুম হামার বেটা।

 বেশ তাহলে তুমি রাজি আছো?

হ রাজী আছি। বাবুজী হামি আর দেরী করিতে পারিবো না। দু’একদিন পর কাহাতুর পাহাড়ে রওয়ানা দেব।

তাই হবে। বললো বনহুর।

সেদিনের মতো বিদায় নিয়ে বনহুর চলে গেলো তার পোড়ো বাড়িটিতে। দূরদেশে পাড়ি জমাবার যা প্রয়োজন সব সঙ্গে নেবার ব্যবস্থা করে নিলো।

বিদায় দিনে বনহুর মনিরাকে নিয়ে এলো তার পোড়োবাড়িতে। আজ বনহুরকে বেশ গম্ভীর আর ভাবাপন্ন লাগছিলো।

মনিরার খুশির অন্ত নেই–স্বামীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো, বললো–আজ এত উদাস মনে হচ্ছে কেন তোমাকে বলতো?

মনিরার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো বনহুর–একটা কথা তোমাকে বলবো মনিরা, অমত করবে না তো?

চমকে উঠলো মনিরা সোজা হয়ে বসে বললো–তার মানে?

মনিরা, আমাকে কোনো এক ব্যাপারে দূরে যেতে হচ্ছে। হয়তো ফিরতে বিলম্ব হবে।

 মনিরা অভিমান ভরে বললো চলে যাবার পূর্বে আমাকে হত্যা করে যাও।

 ছিঃ লক্ষ্মীটি জরুরি কাজ না হলে যেতাম না।

তা আমি জানি, সবই তোমার জরুরি কাজ। কবে তোমার অবসর হলো? জীবনে তুমি কোনোদিন অবসর হবে কিনা তাই বা কে জানে!

বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বনহুর মনিরাকে–মনিরা লক্ষীটি হাসি মুখে আমাকে বিদায় দাও? হাসো–হ্যাঁসো মনিরা?

আমিও যাবো তোমার সঙ্গে।

 পাগলী মেয়ে তা কি হয়–সে যে অনেক দূরের পথ।

না না, তা হবে না, আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো না। তাহলে আমাকে তুমি কান্দাই রেখে এসো।

আচ্ছা তাই হবে, ফিরে এসে তোমায় কান্দাই নিয়ে যাবো। এবার আমাকে যেতে দাও।

অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললো মনিরা–কবে ফিরে আসবে আমাকে কথা দিয়ে যাও তবে!

বনহুর মনিরার চোখের পানি হাত দিয়ে মুছে বললো–সঠিক বলে যাওয়া সম্ভব নয় মনিরা। তবে শীঘ্রই ফিরে আসবে বলে আশা করি।

বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে মনিরা বিদায় সম্ভাষণ জানালো তার স্বামীকে।

খুশি হলো বনহুর। স্ত্রীর ললাটে একটা চুম্বনরেখা এঁকে দিয়ে বললো–চলো মনিরা, এবার তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

চলো।

মনিরাকে শিবাজী-বেশি বনহুর যখন বাংলোয় পৌঁছে দিয়ে ফিরে এলো তখন রাত গম্ভীর হয়ে এসেছে।

বনহুর শয্যায় অর্ধশায়িত অবস্থায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নিলো। তারপর গাড়ি নিয়ে হাজির হলো সাপুড়ে আস্তানায়।

সাপুড়ে সর্দার তার দলবল নিয়ে তৈরি হয়ে নিয়েছে। এমনকি নূরীও যাবে তাদের সঙ্গে। শুধু রংলালকে নেবে না সাপুড়ে সর্দার। বনহুরও সাপুড়েদের দলে সাপুড়ে সেজে নিলো।

মাথায় পাগড়ি কানে বালা, হাতে বালা গায়ে ছোট্ট ধরনের ফতুয়া পায়ে নাগড়া। হঠাৎ করে কেউ দেখলে তাকে সাপুড়ে যুবক ছাড়া কিছুই বলবে না।

এ ড্রেসে অদ্ভুত সুন্দর মানিয়েছে বনহুরকে।

সাপুড়ে সর্দার দলবল নিয়ে রওয়ানা হলো কাহাতুর পাহাড়ের উদ্দেশ্যে।

তিরিশ বছর পূর্বে এই পথে একদিন রওয়ানা দিয়েছিলো সাপুড়ে সর্দার। সেদিন তার সঙ্গে ছিলো একমাত্র পিতা মতিলাল। আজ মতিলাল নেই–আজ দলের সর্দার হীরালাল।

গভীর রাতে ওরা রওনা দিলো।

হীরালাল, বনহুর কেশব আর সাপুড়ে পল্লীর কেউ জানলো না এরা কোথায় গেছে।

 দিল্লী নগরী পিছনে পড়ে রইলো, এগিয়ে চলেছে সাপুড়ে দল।

নূরীর আনন্দ আর ধরে না, বিশেষ করে তার আনন্দের কারণ– সঙ্গে আছে বনহুর স্বয়ং। বনহুরের পাশে পাশে চঞ্চল যুবতী নূরী নৃত্যের ভঙ্গীমায় এগিয়ে চলেছে।

কতদিন পর আবার সে পাশে পেয়েছে তার চিরসাথী বনহুরকে। দু’চোখে তার আনন্দের দ্যুতি উছলে পড়ছে। ধমনীতে তার প্রবাহিত হচ্ছে উষ্ণ রক্ত। পায়ের নুপুরে রুমঝুম্ শব্দ হচ্ছে।

*

রাত ভোর হয়ে এলো।

তখন তারা দিল্লী নগরী ছেড়ে অনেক দূরে এসে পড়েছে।

সর্দার হীরালাল পিঠের বোঝা নামিয়ে রাখলো একটা পাথর খন্ডে বললো এখানে আমরা আরাম করিবো বাবুজী।

বনহুর আর কেশবও দাঁড়িয়ে পড়েছে। বললো বনহুর–বেশ তাই হোক।

কেশব হেসে বললো–ফুল বড় হাঁপিয়ে পড়েছে।

 নূরী রাগতঃ কন্ঠে বললো–হাঁপিয়ে পড়ার মেয়ে নূরী নয়।

সর্দার নূরীর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো–সাবাস বেটি।

 বনহুর আর নূরীর দৃষ্টি বিনিময় হলো।

 হাসলো বনহুর।

ওরা যখন বিশ্রাম করছে তখন একটা ছোরা হঠাৎ এসে গেঁথে গেলো সর্দারের পায়ের কাছে।

 চমকে উঠলো সবাই।

 বনহুর ছোরাখানা টেনে তুলে নিলো হাতে।

সর্দার বললো–ও ছোরা রংলালের আছে। শয়তান হামার পিছু নিয়াছে বাবুজী।

 নূরীর মুখ কালো হয়ে উঠলো মুহূর্তের জন্য ভয়ার্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করলো–রংলাল।

বললো সাপুড়ে সর্দার–বাবুজী, ঐ বদমাইস বড় সাংঘাতিক মানুষ আছে। আমাদেরও বিপদে ফেলতে পারে বাবুজী।

বনহুর ছোরাখানা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো–সর্দার কোনো ভয় তুমি করো না। রংলাল কেন, অমন সাতজন রংলালকে আমি দেখে নেবো।

বাবুজী তোমার কথা যেন ঠিক হয় বাবুজী।

সঙ্গে শুকনো রুটী আর কিছু রান্না করা মাংস নিয়েছিলো তাই পেট পুরে খেলো ওরা। তারপর আবার রওয়ানা দিলো সম্মুখের দিকে।

গহন জঙ্গল অতিক্রম করে এগিয়ে এলো সাপুড়ে সর্দারের দল।

আরও একটি দল সাপুড়ে সর্দারের দলের অগোচরে তাদের অনুসরণ করে চলেছে। সে হলো রংলালের দল। তাদের সঙ্গে আছে কয়েকজন লোক। সব গুন্ডা এবং শয়তান লোক। মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা চলেছে।

রংলাল জানতো, তার কাকা কোনো গুপ্ত গুহার সন্ধান জানে এবং সে গুহায় যে প্রচুর ধনরত্ন। সঞ্চিত রয়েছে তাও সে জানতো। হীরালাল কোনোদিন তাকে না বললেও সে এ সংবাদ গোপনে সংগ্রহ করে নিয়েছিলো।

রংলালের দলে ছিলো একজন শিক্ষিত লোক। যে লোকটি সেদিন নূরীকে গাড়িতে তুলে নিয়ে উধাও হতে চেয়েছিলো। লোকটা দিল্লীর একজন অধিবাসী। কুকর্মই তার পেশা ও নেশা। রংলালকে বশীভূত করে সে চেয়েছিলো নূরীকে হস্তগত করতে। এজন্য ওকে সে প্রচুর অর্থও দিয়েছিলো। কিন্তু বনহুরের জন্য কার্যসিদ্ধ হয়নি।

সেদিন নূরীকে নিয়ে পালাচ্ছিলো লোকটা। হঠাৎ বনহুর এসে পড়ায় তার সমস্ত আশা পন্ড হয়ে গিয়েছিলো। দূর থেকে রংলাল লক্ষ্য করেছিলো, ভেবেছিলো ওকে ধরতে আর পারবে না। তারপর যখন বনহুর নূরীসহ ফিরে এলো তখন তার মুখ চুন হয়ে গিয়েছিলো। এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করেছিলো বনহুরের মুখের উপর।

বনহুর পাল্টা জবাব দিয়েছিলো মুষ্ঠিঘাতে।

বনহুরের ঘুষি খেয়ে রংলালের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়েছিলো, কোনো রকম টুশব্দ করতে সাহসী হয়নি সেদিন রংলাল।

কিন্তু তার মনে যে আগুন জ্বলে উঠেছিলো সে অতি ভয়ঙ্কর। কৌশলে সে এর প্রতিশোধ নেবার জন্য বদ্ধপরিকর হলো। পুনরায় যোগ দিলো সেই দুষ্ট লোক হরনাথের সঙ্গে যে নূরীকে হস্তগত করতে নিয়েও পারেনি।

রংলালের দলে ছিলো সাত জন আর বনহুরের দলে ছিলো তারা মাত্র চার জন। সাপুড়ে সর্দার কেশব, বনহুর আর নূরী। মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে বনহুরের নিকটে ছিলো তার রিভলভার ও একটি ছোরা। সাপুড়ে সর্দারের কাছে এবং কেশবের কাছে ছোরা আর বল্লম ছিলো।

সাপ ধরার জন্য কয়েকটা ঝাঁকা আর বাঁশি ছিলো তাদের সঙ্গে আর ছিলো কয়েকটা বড় বড় ত্রিপলের থলে।

সাপুড়ে সর্দার যখন জানতে পারলো রংলাল তাদের অনুসরণ করছে তখন সে অত্যন্ত চিন্তিত হলো। কিন্তু মুখোভাবে সে কিছু প্রকাশ করলো না।

*

দুই দিন কেটে গেলো।

এখন তারা এমন এক জায়গায় এসে হাজির হলো যেখানে শুধু বন আর বন।

এ দুই দিনের মধ্যে রংলালের বা তার দলের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। কতকটা নিশ্চিন্ত হয়েছে সাপুড়ে সর্দার। ভেবেছে সে রংলাল হয়তো তাদের খোঁজ না পেয়ে ফিরে গেছে।

গহন বনের মধ্যে নেমে এলো রাতের অন্ধকার।

বিশেষ করে নূরীর দেহ অবসন্ন হয়ে এসেছে। সম্পূর্ণ একরাত আর দু’দিন তারা অবিরাম চলে বহুদূরে এসে পৌঁছে গেছে। ভীষণ বন–কাজেই রাতের বেলা অগ্রসর হওয়া আর মোটেই সম্ভব নয়।

একটা ফাঁকা জায়গা দেখে তারা বিশ্রামের আয়োজন করলো।

 কেশব আর সাপুড়ে সর্দার বন থেকে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে আগুন জ্বালালো।

আগুন দেখলে কোনো হিংস্র জীবজন্তুর আগমন হয় না জানে তারা, তাই বিরাট অগ্নিকুণ্ডের আয়োজন করলো।

সঙ্গের খাবার পেট পুরে খেলো ওরা।

তারপর পালা করে ঘুমানো ঠিক হলো। প্রথম রাত জাগবে সর্দার স্বয়ং মধ্যরাত বনহুর, ভোর রাত কেশব।

হেসে বললো নূরী–আমি কিন্তু গোটারাত জাগবো তোমাদের সঙ্গে।

 কেশব আর বনহুর হেসে উঠলো তার কথায়।

সর্দার বললো–তোমাকে আর জাগতি হবি না মা। তুমহি ঘুমাইতে পারো।

সবাই ঘুমাবার জন্য শয়ন করলো, শুধু জেগে রইলো সর্দার।

সম্মুখে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।

বল্লম হস্তে চারিদিকে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে সাপুড়ে সর্দার। মাঝে মাঝে অগ্নিকুণ্ডে কাঠ নিক্ষেপ করছিলো সে।

রাত বেড়ে আসছে।

দূর থেকে ভেসে আসছে নানারকম জীবজন্তুর গর্জন। গাছের ঝোপের আড়ালে হুতুম পাখি পাখা ঝাপটা দিয়ে উঠছে। কেমন একটা অশুভ ভয়ঙ্কর ভাব বিরাজ করছে সমস্ত জায়গাটা জুড়ে।

হঠাৎ একটা আর্তচিৎকারে বনভূমি প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। ঘুম ভেঙে গেলো বনহুর, কেশব আর নূরীর। আচমকা উঠে বসলো ওরা। বনহুর একেবারে সাপুড়ে সর্দারের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

সাপুড়ে সর্দার আর্তচীঙ্কার শুনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিলো; বনহুর বললো–সর্দার মানুষের চিৎকার বলে মনে হলো।

হাঁ বাবুজী, এ আওয়াজ মানুষের গলার হামি ঠিক ধরিয়াছি।

গহন বনে মানুষ এলো কোথায় হতে তবে কি কোনো পথিক বিপদে পড়েছে। বনহুর কথা কয়টি ব্যস্তভাবে বলে দ্রুত চলে যাচ্ছিলো।

নূরী ওর জামার আস্তিন চেপে ধরে–না না যেও না যেও না হুর, কোনো অমঙ্গল ঘটতে পারে।

সাপুড়ে সর্দার বলে উঠলো–এই গহন জঙ্গলে কে কি হলো দেখার জন্য উতালা হচ্ছো কেন। তুমি যেও না বাবুজী।

তা হয় না সর্দার, তোমরা নূরীর কাছে থাকো, আমি দেখে এক্ষুণি ফিরে আসছি।

আমি তোমাকে যেতে দেবো না হুর। নূরী এঁটে ধরলো বনহুরকে।

বনহুর নূরীর হাত ছাড়িয়ে মশালটা তুলে নিলো বাম হস্তে। আর দক্ষিণ হস্তে নিলো রিভলভার দ্রুত চলে গেলো যেদিক থেকে আর্তচিৎকার ভেসে এসেছিলো সেইদিকে।

নূরী কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে রইলো।

সাপুড়ে সর্দার কেশবও হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সেই দিকে যেদিকে চলে গেলো বনহুর।

বাম হস্তে মশাল দক্ষিণ হস্তে গুলীভরা রিভলভার নিয়ে বনহুর সম্মুখে অগ্রসর হলো। ভয়ঙ্কর জঙ্গলে তীব্র আর্তচিৎকার শুনে যে লোক দ্রুত ছুটে যেতে পারে সে কত বড় সাহসী ভাবলো সর্দার; তার দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময় ঝরে পড়ছে যেন।

সাপুড়ে সর্দার নিজেও কম সাহসী নয়, তবু বনহুরের দুঃসাহসে সে অবাক না হয়ে পারলো না। মনে মনে ওকে অন্তর দিয়ে ধন্যবাদ জানালো।

বনহুর কিছুদূর অগ্রসর হবার পর একটা যন্ত্রণাদায়ক গোঙ্গানীর শব্দ শুনতে পেলো।

এবার বনহুর সেই দিকে দ্রুত ছুটতে লাগলো। কিন্তু বেশিদূর অগ্রসর না হতেই তার হস্তস্থিত মশালের আলোতে দেখলো অনতিদূরে একটা ঝোপের পাশে পড়ে আছে একটি রক্তাক্ত দেহ। পরক্ষণেই নজর পড়লো মনুষ্য দেহটার বুকে দু’খানা থাবা তুলে দিয়ে বসে আছে একটি ব্যাঘরাজ।

মশালের আলোতে ব্যাঘ্ররাজের চোখ দুটো আগুনের গোলার মত জ্বলে উঠলো।

 থমকে দাঁড়ালো বনহুর।

ব্যাঘ্র মহারাজ প্রথম হকচকিয়ে গিয়েছিলো হঠাৎ মশালের আলো দেখে। এবার গর্জন করে উঠলো দাঁতমুখ খিঁচিয়ে।

বনহুরও এ দৃশ্য দেখে একটু হতভম্ব হয়ে পড়েছিলো কিন্তু পরমুহূর্তে সামলে গিয়ে পর পর দুটো গুলী ছুঁড়লো ব্যাঘ্রটাকে লক্ষ্য করে।

মুখের আহার ত্যাগ করে ব্যাঘ্ররাজ ভীষণ এক গর্জন করে লাফ দিলো সম্মুখে কিন্তু অগ্রসর হতে পারলো না, মুখথুবড়ে পড়ে গেলো মৃতদেহটার পাশে।

বনহুর পুনরায় একটা গুলী নিক্ষেপ করলো তারপর মশাল হস্তে মৃতদেহটার পাশে এসে দাঁড়ালো। মশালের আলোতে স্পষ্ট দেখলো– একটা বলিষ্ঠদেহী লোক পড়ে আছে ভূতলে! গলা এবং বুকের খানিকটা অংশ ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। ঘাড়টা সম্পূর্ণ মুচড়ে ফেলছে। রক্তের চাপ জমাট বেঁধে ওঠেনি এখনও তবু সমস্ত জামাটা লালে লাল হয়ে গেছে। সেকি বীভৎস দৃশ্য!

লোকটার এইমাত্র মৃত্যু ঘটেছে বলেই মনে হলো। কারণ একটু পূর্বেও সে গোঙ্গানীর শব্দ শুনতে পেয়েছিলো।

বনহুর আর বিলম্ব না করে ফিরে এলো সর্দার, কেশব আর নূরীর পাশে। নূরী তো ছুটে গিয়ে বনহুরের বুকে মাথা রেখে ব্যাকুল কণ্ঠে বললো– ইস ফিরে এসেছো! আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

সর্দার আর কেশব এগিয়ে এলো।

 বললো সর্দার–কিসের আওয়াজ বাবুজী?

বনহুর বললো–একটা লোককে বাঘে খেয়েছে।

অবাক কণ্ঠে বললো সর্দার–লোক?

 হা সর্দার একটা লোককে নৃশংসভাবে বাঘে হত্যা করেছে।

 সে রাত আর কেউ ঘুমাতে পারলো না।

তবু বনহুর নিজে রিভলভার হস্তে জেগে রইলো পাহারায়। সর্দার কেশব আর নূরী মিলে অর্ধন্দ্রিাভাবে কাটিয়ে দিলো রাতটা।

*

পরদিন যখন সাপুড়ে সর্দার দলবল নিয়ে ঝোপের পাশে মৃত দেহটার নিকটে এসে হাজির হলো তখন সেখানে কিছু ছেঁড়া রক্ত মাখা জামা কাপড় ও কয়েকখানা হাড়গোড় ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়লো না।

পাশেই একটু দূরে পড়ে আছে ব্যাঘ্র মহারাজের মৃতদেহ। কতকগুলো ক্ষুদ্রকায় কীট বাঘটার চোখমুখ ছিদ্র করে মাংস বের করে ফেলেছে।

এখানে বিলম্ব করা উচিৎ নয় আর তাই সাপুড়ে সর্দার ওদের নিয়ে রওয়ানা দিলো।

ওদিকে রংলাল তাদের দলবল নিয়ে অনুসরণ করে চলেছে। হঠাৎ গতরাতে তারা যখন গহন বনে একটা নিরিবিলি জায়গা দেখে নিয়ে বিশ্রামের আয়োজন করছিলো ঠিক তখন তাদের দলের উপর আক্রমণ চালায় একটি ব্যাঘ্র এবং সে নিয়ে যায় একজনকে।

গতরাতে বনহুর যে মৃতদেহটাকে ব্যাঘ্ৰ কবল থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলো সেই মৃতদেহটাই হলো ঐ হতভাগ্য ব্যক্তির যে রংলালের দলে যোগ দিয়ে চলেছিলো রত্ন ভান্ডারের সন্ধানে।

রংলালের জনসংখ্যায় একজন কমে গেলেও তারা দমেনি এতোটুকু। মৃত্যুর ভয় তারা পরিহার করেছে রত্নের লালসায়। হরনাথের তো রত্নের চেয়ে বেশি লোভ নূরীর প্রতি। নূরীকে নিজের করে পাওয়ার জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছে সে।

সাপুড়ে সর্দারের মনে অফুরন্ত আশা–জঙ্গলে দুটো দিন ভালয় ভালয় কেটে গেলো, এবার। তাদের সম্মুখে একটি বড় নদী পড়বে।

ইতিমধ্যে তারা বেশ কয়েকটা নদী পারাপার হয়েছে। এগুলো পার হতে তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি। নৌকা ছিলো, তাতে করেই পার হয়েছিলো ওরা।

এবার যে নদীর সম্মুখে এসে তারা পৌঁছলো সে নদী পারাপার হবার কোনো নৌকা বা ঐ ধরনের কিছু নেই। কাজেই অত্যন্ত অসুবিধার সম্মুখীন হলো তারা।

নদীতীরেই বন।

সর্দার বললো–এখানে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কারণ আমাদের একটা ভেলা তৈরি করে নিতে হবে।

সঙ্গে কুঠার এবং দা ছিলো, বনহুর কেশব আর সর্দার মিলে শুরু করলো ভেলা তৈরির কাজ।

 নানারকম গাছ আর লতা দিয়ে কৌশলে তারা একটি ভেলা তৈরি করে ফেললো।

 এবার সবাই মিলে ভেলাটা নদীতে টেনে নামিয়ে ফেললো। নূরীর আনন্দ আর ধরে না।

ভেলায় উঠে বসলো সর্দার কেশব আর নূরী।

 বনহুর মাঝির কাজ করতে লাগলো। সে একটা লম্বা ডাল নিয়ে পানি টানতে লাগলো।

নূরী হাত দিয়ে পানি নাড়ছে।

সর্দার আর কেশব এরাও এক একটা কাঠের টুকরা হাতে নিয়ে বৈঠার মত পানি টানতে লাগলো।

কখন যে নূরী পা দু’খানা জলস্রোতে নামিয়ে দিয়েছিলো কেউ লক্ষ্য করেনি,হঠাৎ একটা কুমীর তেজের আঘাতে নূরীকে টেনে নেয়।

সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে পড়ে যায় নূরী।

 সর্দার আর কেশব চিৎকার করে উঠে–সর্বনাশ হয়েছে বাবুজী–সর্বনাশ হয়েছে–

বনহুর মুহূর্তে বিলম্ব না করে রিভলভারখানা সর্দারের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছোরাখানা মুক্ত করে নিয়ে লাফিয়ে পড়লো নদীবক্ষে।

নূরীকে তখনও কুমীর আক্রমণ করেনি।

বনহুর নূরীকে বাম হস্তে ধরে ফেললো তারপর তীক্ষ্ণধার ছোরা খানা বাগিয়ে ধরলো উদ্যত করে।

কিন্তু বেশিক্ষণ নূরীকে ধরে রাখা সম্ভব হলো না। কুমীরটা সোজা এবার বনহুরকে আক্রমণ করে বসলো। নূরীকে ছেড়ে দিয়ে এবার বনহুর কুমীরের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলো।

সর্দার আর কেশব সব দেখেছিলো, এবার তারা নূরীকে তাদের ভেলায় উঠিয়ে নিলো।

তখন কুমীর আর বনহুর চলেছে লড়াই।

বনহুর সূতীক্ষ্ণ-ধার ছোরা দিয়ে কুমীরের চোখে আঘাতের পর আঘাত করে চললো। কয়েকবার আঘাত করলো থোতনায়। রক্তে রাঙা হয়ে উঠলো নদীর পানি।

কুমীরকেও পরাজয় বরণ করতে হলো বনহুরের কাছে। চোখে এবং মুখে ভীষণ আঘাত পেযে কুমীরটা বনহুরকে ছেড়ে দিয়ে প্রাণ নিয়ে পালালো।

এবার সর্দার আর কেশব বনহুরকে তুলে নিতে সক্ষম হলো।

বনহুরের দেহের কতক জায়গা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিলো। নূরী তাড়াতাড়ি ওড়না ছিঁড়ে বনহুরের ক্ষত স্থানগুলো বেঁধে দিলো। খোদার কাছে হাজার শুকরিয়া করলো নূরী। তার নিজের চেয়েও বেশি ঘাবড়ে গিয়েছিলো নূরী বনহুরের জন্য।

বনহুরের বুকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় নূরী।

সর্দার ক্ষতে ঔষধ লাগিয়ে দেয়।

সাপুড়ে সর্দার তার থলের মধ্যে কিছু কিছু ঔষধও নিয়েছিলো বিপদ-আপদের জন্য। এক্ষণে তা কাজে লাগলো।

বনহুরের ক্ষতগুলো তেমন বেশি সাংঘাতিক বা মারাত্মক হয়নি। অল্পক্ষণেই বনহুর সুস্থ হয়ে উঠলো।

নদীটি অত্যন্ত প্রশস্ত হওয়ায় বেশ সময় লাগলো ওপারে পৌঁছতে।

ওপারে যখন তারা পৌঁছল তখন সন্ধ্যার অন্ধকার জমাট বেঁধে উঠেছে। তীরে পৌঁছতেই তারা একটা গুড় ম গুড় ম ঢাকের আওয়াজ শুনতে পেলো।

সাপুড়ে সর্দারের মুখ বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো। সে ভীত কণ্ঠে বললো–বাবুজী, জংলী রাজা এদিকে আসিতেছে। এখন উপায় কি হইবে!

অবাক কণ্ঠে বললো বনহুর–জংলী রাজা–সে কি রকম সর্দার।

বাবুজী ও মানুষ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর লোক আছে। ওরা মানুষ ভি খায়। কাঁচা মাংস ওরা খুব ভালবাসে।

কান পেতে শুনলো ওরা-গুড় ম গুড় ম আওয়াজটা ক্রমান্বয়ে আরও এগিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে এক সঙ্গে অনেকগুলো ঢাক ওয়ালা নদীর দিকেই এগুচ্ছে।

বনহুর বললো–সর্দার যেমন করে হোক ওদের দৃষ্টি থেকে নিজেদের গোপন রাখতে হবে,নাহলে বিপদ হবে।

হাঁ বাবুজী শুধু বিপদ না হবে, জান বাঁচাতে পারবো না হামরা লোক। কিন্তু কি করা যায়?

 কেশব আর নূরীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।

কেশব বললোবাবু, ঐ দেখেন কত মশাল জ্বলে উঠলো।

ওরা সবাই তাকালো সম্মুখে দেখতে পেলো অসংখ্য মশাল এক সঙ্গে জ্বলে উঠলো পট পট করে। ঢাকের শব্দ আরও তীব্র এবং স্পষ্ট মনে হচ্ছে।

মশালের আলোগুলো এগিয়ে আসছে দ্রুত নদী তীরের দিকে।

ভেলা ছেড়ে সর্দার কেশব বনহুর আর নূরী নেমে পড়লো তীরে। নদীর ওপার যেমন গহন বনে ঢাকা, এপারে তা নয় উঁচুনীচু কতকগুলো টিলা আর শুধু প্রান্তর। নদীতীর থেকে বহুদূরে নজর যায়।

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে এলো।

আকাশে জ্বলে উঠলো অসংখ্য তারকারাজি। যদিও এটা শীতকাল নয় তবু নদীতীরে ঠান্ডা হাওয়ায় হাড়ে কাঁপন লাগে।

নূরী তো কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে।

 সর্দার ভীতকণ্ঠে বললো–আর দেরী করা যায় না বাবুজী, উহারা আইসে পড়িলো বলো।

বনহুর বললো–সর্দার তুমি ঐ উঁচু টিলাটার ওপাশে যাও আর কেশব তুমি ঐ ওদিকের ঝোপটার আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে পড়ো। মোটেই বিলম্ব করো না, ওরা এসে পড়লো বলে। আর আমরা দু’জনা এই টিলার আড়ালে লুকিয়ে পড়বো।

সর্দার বললো–বাঁচিবার যখন কোনো উপায় নেই বাবুজী তখন তাই করিবো। চলো কেশব। হামরা উধারে যাই। বাবুজী আপনি মাই ফুলরে নিয়া শীগগির লুকাইয়া পড়েন।

এসো নূরী। বনহুর নূরীর হাত চেপে ধরলো।

একি তুমি কাঁপছো নূরী? তুমি না দস্যু দুহিতা?

 হুর, আমার জন্য ভয় আমি করি না। তোমার জন্য আমার চিন্তা এইতো কুমীরটার পাল্লায় পড়ে কতকষ্ট পেলে! কত রক্তপাত হয়েছে তোমার একটু পূর্বে। আবার যদি–

এতো বিপদেও বনহুর হাসলো–সাধে বলে নারী প্রাণ। মরতে হয় এক সঙ্গে মরবো তাতে দুঃখ কি বলো?

হুর, ঐ দেখ কি ভয়ঙ্কর জংলী দল এগিয়ে আসছে।

সম্মুখে দৃষ্টি ফেলতেই দেখলো অসংখ্য জংলী এগিয়ে আসছে। সমস্ত দেহ উলঙ্গ সামান্য একখন্ড চামড়া দিয়ে লজ্জা নিবারণ করেছে। প্রত্যেকের হাতে একটা জ্বলন্ত মশাল আর দক্ষিণ হস্তে সূতীক্ষ্ণ ধার বল্লম।

এক একটা জংলীর চেহারা জমকালো। বলিষ্ঠ দেহ, যেন পোড়া লোহার তৈরি। মাথায় পাখির পালকের টুপি। কানে লোহার বালা, হাতেও বালা আছে অনেকের।

সবাই আনন্দধ্বনি করছিলো আর একটা অদ্ভুত শব্দ করেছিলো।

সম্মুখে সারিবদ্ধভাবে একদল জংলী গলায় ঢাক বেঁধে এগুচ্ছে তারাই বাজাচ্ছিলো ঢাকগুলো। সেকি গুরুগম্ভীর গুড় ম গুড় ম আওয়াজ।

জংলীদের চেহারা দেখে শিউরে উঠলো নূরী। বনহুরের বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কম্পিত কণ্ঠে বললো–ওরা যদি আমাদের দেখে ফেলে তাহলে কি উপায় হবে?

কি আর হবে–আত্মাহুতি দিতে হবে।

আমার ভয় করছে হুর।

বনহুর নূরীকে নিবিড় করে কাছে টেনে নিলো, ফিস ফিস করে বললো–চুপ করে থাকো নূরী। ওরা ওদিকেই চলে যাবে বলে মনে হচ্ছে।

হঠাৎ একটা আর্তচিৎকারে চমকে উঠলো বনহুর, বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে দেখলো কয়েকজন। জংলী কেশবকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসছে। নূরী এ দৃশ্য লক্ষ্য করা মাত্র চিৎকার করতে যাচ্ছিলো–বনহুর হাতচাপা দিলো ওর মুখে। তারপর চাপা গম্ভীর কণ্ঠে বললো–চুপ, ওরা শব্দ পেলেই এদিকে ছুটে আসবে।

নূরী ভীত করুণ স্বরে বললো কেশবের এখন কি হবে হুর?

প্রায় একশতের বেশি হবে জংলী কেশবকে ঘিরে ধরে অদ্ভুত শব্দ করছে আর ধেই ধেই করে নাচছে। জংলীদের চিৎকারের সঙ্গে ঢাকের আওয়াজ এক ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি করে চলেছে। মশালের আলোতে দেখলো ওরা কেশবের মুখ মড়ার মুখের মত ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।

বনহুর রিভলভার উদ্যত করে ধরলো, বললো সে–কেশবকে বাঁচাতেই হবে।

নূরী বনহুরের হাত চেপে ধরলো, কম্পিত কণ্ঠে বললো– সর্বনাশ হবে হুর তোমার রিভলভার কজনাকে কমাতে পারবে বরং ওরা আমাদের সন্ধান পেয়ে এদিকে ছুটে আসবে!

তা হয় না, কেশবকে এভাবে মরতে দেব না নূরী।

কিন্তু আমরা সবাই যে মরবো তাহলে?

কি করা যাবে বলো, মরতে হয় সবাই এক সঙ্গে মরবো।

না না, তা হয় না হুর, আমি সব সহ্য করতে প্রস্তুত আছি কিন্তু তোমাকে হারাতে পারবো না।

 নূরী!

হুর, তুমি গুলী করো না শব্দ হলেই ওরা তীরবেগে আমাদের আক্রমণ করবে।

 নূরী, দেখছো না কেশবের কি অবস্থা? বেচারাকে এক্ষুণি ওরা হত্যা করে খেয়ে ফেলবে।

বনহুরের কথা মিথ্যা নয়–কতগুলো জংলী কেশবকে নিয়ে ধেই ধেই করে নাচছে। যেমন। খেলোয়াড়দের হস্তে ফুটবলের অবস্থা হয়। এ ওর হাতের উপর ছুঁড়ে দিচ্ছে যেন একখন্ড পাউরুটি।

বনহুরের সহ্যের সীমা অতিক্রম করলো,–তার হস্তের রিভলভার গর্জে উঠলো, রাত্রির জমাট অন্ধকার ভেদ করে ছুটে এলো একটা গুলী।

সঙ্গে সঙ্গে তীব্র আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়লো একটি জংলী।

মুহূর্তে ঢাকের আওয়াজ গেলো থেমে।

বনহুরের রিভলভার পুনঃ পুনঃ গর্জে উঠতে লাগলো এবং পর পর তীব্র আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ছে এক একটি জংলী।

অল্পক্ষণের মধ্যে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো জংলী দল। সবাই অদ্ভুত শব্দ করতে লাগলো। বিপদসূচক শব্দ এটা।

কতকগুলো জংলী বনহুর আর নূরী যে টিলাটার ওদিকে লুকিয়েছিলো সেইদিকে ছুটে আসতে লাগলো।

বনহুর পর-পর তাদের এক একজনকে ধরাশায়ী করে চললো। তার জামার পকেটেই ছিলো রিভলবারের গুলী, দ্রুতহস্তে রিভল ভারে গুলী ভরে নিচ্ছিলো সে।

কিন্তু বনহুর বেশীক্ষণ ওদের সঙ্গে লড়াই করে পেরে উঠলো না। পিছন দিক থেকে কতগুলো জংলী বল্লম হাতে ঘিরে ধরলো। ওদিকে সাপুড়ে সর্দারকেও কয়েজন জংলী হিড়হিড় করে টেনে এনেছে। বনহুর আর নূরীর চারপাশে অসংখ্য জংলী বল্লাম উঁচু করে দাঁড়ালো।

বনহুর জংলীদের অলক্ষ্যে রিভলভারটা পকেটে গোপন করে রাখলো।

জংলীদল এবার বনহুর কেশব, সাপুড়ে সর্দার আর নূরীকে মাঝখানে রেখে ধেই ধেই করে। নাচা শুরু করলো।

জংলীদের যে কয়েকজনকে বনহুর গুলীবিদ্ধ করে হত্যা করেছিলো, তাদের লাশগুলো জংলীরা নদীর পানিতে নিক্ষেপ করলো।

হাউ মাউ করে কয়েকজন কাদলো। কি যেন সব বিলাপ করলো মাথায় আঘাত করে!

 এবার জংলী দল বনহুরের দলকে ঘেরাও করে নিয়ে ঢাক বাজিয়ে ফিরে চললো।

কেশব তো বনহুর আর নূরীকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো।

সর্দারের মুখমন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।

নূরীর গন্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু। বার বার সে করুণ চোখে তাকাচ্ছে সর্দার আর বনহুরের দিকে।

জংলীর দল তাদের নিয়ে এগিয়ে চলেছে।

সম্মুখে একজন জংলী ঢাক বাজিয়ে এগুচ্ছে।

 মাঝে মাঝে সবাই একরকম অদ্ভুত শব্দ করছিলো। সেকি ভয়ঙ্কর তীব্র শব্দ! সাধারণ মানুষের কানে এ শব্দ তালা লাগিয়ে দেয়। বনহুরের সাহসী প্রাণেও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে এবার হয়তো তাদের আর রক্ষা নেই। জংলীদের হস্তে মৃত্যু অনিবার্য।

সাপুড়ে সর্দার জংলীদের ভাষা কিছু জানতো সে ঐ ভাষায় অনুনয় বিনয় শুরু করলো, করজোড়ে প্রার্থনা করতে লাগলো কিন্তু কেউ তার কথা শুনলো না।

বনহুর নূরী আর কেশবকে লক্ষ্য করে বললো–অহেতুক রোদন বাতুলতা মাত্র। যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ ধৈর্য ধারণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

বেশ কিছুদূর অতিক্রম করার পর শুরু হলো আবার জঙ্গল সেই ভয়ঙ্কর গহন বন। মশালের আলোতে জংলীরা পথ দেখে অগ্রসর হচ্ছিলো।

যদিও জংলী দল হই-হুল্লোড় করে এগুচ্ছিলো কিন্তু তাদের সতর্ক দৃষ্টি ছিলো সাপুড়ে সর্দার বনহুর কেশব আর নূরীর উপর — এক মুহূর্তের জন্যও তারা বল্লম নীচু করেনি। কয়েকজন সূতীক্ষ্ণ বল্লম উদ্যত করে ধরে পথ চলছিলো।

 প্রায় ঘন্টা দুই অবিরাম চলার পর জঙ্গলের মধ্যে একটা বেদী বা মন্ত্রের মত উঁচু জায়গায় এসে থামলো জংলীর দল।

বনহুর লক্ষ্য করলো, উঁচু জায়গাটা মাটি বা পাথর নয়। কিছু সংখ্যক বড় বড় কাঁটা দিয়ে তৈরী একটা মঞ্চ বনের মাঝখানে উঁচু হয়ে রয়েছে।

এবার জংলী দল বন্দীদের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ঢাক বাজাতে শুরু করলো।

সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চের উপরে কয়েকজন মশালধারী জংলী উঠে গিয়ে দাঁড়ালো। সমস্ত বনভূমি মশালের আলোতে আলোময় হয়ে উঠলো।

হঠাৎ ঢাকের আওয়াজ থেমে গেলো।

বনহুরের দল তাকিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হলো। দেখলো– বেদী বা ঐ মঞ্চটার উপরে এসে দাঁড়িয়েছে এক নারীমূর্তি। সমস্ত দেহ তার উলঙ্গ শুধু মাথায় একটা হরিণের চামড়া জড়ানো চুলগুলো মাথার উপরে উঁচু করে বাঁধা। গলায়, হাতে বাজুতে কতকগুলো পাথরের টুকরো মালার মত করে গাঁথা রয়েছে। এসব পাথরের টুকরো থেকে একরকম আলোকরশ্মি ঠিকরে বেরুচ্ছিলো। কোনোটা লাল, কোনোটা নীল আবার কোনোটা থেকে ফিকে সবুজ আলোকচ্ছটা বিচ্ছুরিত হচ্ছিলো।

মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়েও বনহুরের চোখ দুটো ধক্ করে জ্বলে উঠলো। নারীমূর্তিকে দেখে নয় তার দেহসজ্জিত পাথরখন্ডগুলোর উপর নজর পড়তেই সে বুঝতে পেরেছিলো–ওগুলো মূল্যবান পাথর।

নারীমূর্তি মঞ্চের উপরে এসে দাঁড়ালো।

তীক্ষ্ণ নজরে দেখতে লাগলো বন্দীদের দিকে তাকিয়ে।

 সাপুড়ে সর্দার করজোড়ে প্রণাম জানাতে লাগলো।

কেশব আর নূরী আকুলভাবে রোদন করে চলেছে।

বনহুর স্থির দৃষ্টি মেলে তাকালো নারীমূর্তির দিকে। বনহুরের চোখেও যেন আগুন ঝরে পড়ছে। বনহুর দেখলো নারীমূর্তির দুটি চোখ এবার তার উপর এসে সীমাবদ্ধ হয়েছে। জংলী হলেও যুবতীকে সুন্দরী বলা চলে। কালো নিটোল দেহ, টানাটানা দুটি জ যেন দুটো বাঁকা তারবারি। চোখ দুটো যেন কাঁচের টুকরো। মশালের আলোতে চোখ দুটো যেন সাপের চোখের মত মনে হলো।

নারীমূর্তি বনহুরের চোখের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর হাতের ইংগিতে বনহুরকে দেখিয়ে কি যেন বললো।

নারীমূর্তির শ্যেন দৃষ্টি যে বনহুরের উপর এসে স্থির হয়েছে- এ দৃশ্য আর কেউ লক্ষ্য না করলেও নূরীর দৃষ্টি এড়ালো না। সে বনহুরের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো।

নারীমূর্তি এবার মঞ্চ থেকে নেমে অদৃশ্য হলো মঞ্চের নীচে। জংলীরা বন্দী সবাইকে টানতে টানতে নিয়ে চললো। ওদিকে কিছুদূর গিয়েই দেখলো, মস্তবড় একটা খাঁচার মত বন্দীখানা। জংলীরা এবার সাপুড়ে সর্দার কেশব আর নূরীকে ঐ খাঁচায় বন্দী করে ফেললো। বনহুরকে বের করে নিলো ভিতর থেকে। নূরী তো ছুটে এসে জড়িয়ে ধরুলো –হুঁর তোমাকে যেতে দেবো না।

কিন্তু জংলীরা শুনলো না নূরীর কোনো বাধা। বনহুরকে নিয়ে চলে গেলো। নূরী কাঠের খাঁচায় মাথা ঠুকে বিলাপ করতে লাগলো।

সাপুড়ে সর্দার বা কেশবের মুখে কোনো কথা নেই। সর্দার ভাবছে তার জন্যই আজ সকলের এ অবস্থা।

কয়েকজন জংলী বনহুরকে সঙ্গে করে নিয়ে চললো। বেশ কিছুটা চলার পর একটা ঝোপঝাড় আর জঙ্গলে ঢাকা সুড়ঙ্গমুখের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। সুড়ঙ্গমুখেই ছিলো দুজন বল্লমধারী জংলী, তাদের হাতে ছিলো চোং ধরনের এক একটা বাঁশি।

জংলিগণ বনহুরকে নিয়ে সুড়ঙ্গমুখে পৌঁছতেই চোংধারী দু’জন জংলী চোঙ্গে মুখ লাগিয়ে বাজাতে লাগলো। ভোঁ ভোঁ শব্দে বেজে উঠলো।

সঙ্গে সঙ্গে সুড়ঙ্গ মুখের কপাট সরে গেলো এক পাশে।

বনহুরকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো এবার দু’জন জংলী। বাকীগুলো সুড়ঙ্গ মুখের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো।

বনহুর এবং জংলীদ্বয় সুড়ঙ্গপথে এগিয়ে চললো।

জংলীদ্বয়ের হস্তে জ্বলন্ত মশাল।

মশালের আলোতে বনহুর সুড়ঙ্গ মধ্যে নজর রেখে এগুতে লাগলো। সুড়ঙ্গ মধ্যে অন্ধকার হলেও বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। পাথর দিয়ে মজবুত করে তৈরি পথ। কিন্তু সুড়ঙ্গপথের উচ্চতা খুব বেশি নয় জংলীরা লম্বায় বেঁটে আকার তাই তাদের পথের উচ্চতাও কম। বনহুরকে অবশ্য মাথা নিচু করে চলতে হচ্ছিলো। একটু অসাবধান হলেও মাথা ঠুকে যাবার সম্ভাবনা ছিলো।

কিছুটা পথ অগ্রসর হতেই আর একটা দরজার মুখ পাওয়া গেলো। কাঠের তৈরি দরজার মুখে দু’জন জংলী বল্লম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের হাতেও এক একটা চোং রয়েছে।

বনহুরকে নিয়ে জংলীদ্বয় দরজা মুখে পৌঁছতেই প্রথম সুড়ঙ্গ মুখের জংলীদ্বয়ের মত চোংগে ফুঁ দিলো সঙ্গে সঙ্গে দরজার মুখ খুলে গেলো।

বনহুর আর জংলীদ্বয় প্রবেশ করলো ভিতরে।

 আর একটি সুড়ঙ্গমুখ পেরিয়ে তবে বনহুরকে নিয়ে জংলীদ্বয় হাজির হলো একটা গুহার মধ্যে।

গুহাটা খুব বড় এবং পাথর দিয়ে তৈরি।

গুহার চার কোণে চারটা মশাল দপ দপ করে জ্বলছে।

বনহুর তাকালো সম্মুখে, বিস্ময় বিস্ফারিত নয়নে দেখলো–সেই যুবতী নারীমূর্তি একটা। আসনে উপবিষ্টা। তার পাশে কয়েজন জংলী বল্লম হস্তে দন্ডায়মান রয়েছে।

বনহুর নারীমূর্তির দিকে স্থির দৃষ্টি মেলে তাকালো। মশালের উজ্জ্বল আলোতে তার শরীরের পাথরখন্ডগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। তীব্র আলোকচ্ছটা যেন ঠিকরে বের হচ্ছে ঐ সব রত্নাভরণ থেকে।

নারীমূর্তি বনহুরের দিকে নিশ্চলভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালো। হাত দিয়ে ইংগিৎ করলো সঙ্গে সঙ্গে তার পাশে দন্ডায়মান জংলীগুলো গুহা থেকে বেরিয়ে চলে গেলো। বনহুরের সঙ্গী জংলীদ্বয়ও বেরিয়ে গেলো তাদের সঙ্গে।

বনহুর সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

তার দেহে এখনও সাপুড়ে ড্রেস বর্তমান। কানে বালা, হাতে বালা রয়েছে। গায়ের জামাটা অবশ্য কয়েক স্থানে ছিঁড়ে গেছে। কুমীরের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে জামাটার এ অবস্থা হয়েছে। হাতে এবং বুকের ক্ষতে এখনও পট্টি বাঁধা রয়েছে যদিও তবু বনহুরকে এ ড্রেসে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিলো।

দীর্ঘদেহী বলিষ্ঠ পুরুষ বনহুরের সৌন্দর্যে অভিভূতা জংলী রাণী। সভ্য সমাজের মানুষ বুঝি সে কোনোদিন দেখেনি।

আসন ত্যাগ করে জংলী রাণী উঠে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো বনহুরের সম্মুখে।

বনহুর নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দেখছে।

 জংলী রাণী বনহুরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তার দক্ষিণ হাতখানা এগিয়ে দিলো।

বনহুর কিছু বুঝতে না পারলেও সে তার দক্ষিণ হাতখানা জংলী রাণীর দক্ষিণ হাতের উপর রাখলো।

জংলী রাণীর চোখ দুটো যেন মুহূর্তে আনন্দ-উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ঠোঁট দুটির ফাঁকে ফুটে উঠলো হাসির রেখা। বনহুরের হাতের উপর মুখ রেখে চুম্বন করলো গভীর আবেগে।

বনহুর বিস্মিত হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

জংলী রাণী এবার বনহুরকে হাত ধরে নিয়ে চললো। বনহুর কোনো আপত্তি না করে অগ্রসর হলো তার সঙ্গে। জংলী রাণী এবার বনহুরকে বসিয়ে দিলো তার নিজের আসনে।

বনহুর বুঝতে পারলো এ যাত্রা প্রাণ রক্ষা পেলো তার। নিজের দেহের দিকে তাকালো। বনহুর–অসংখ্য ধন্যবাদ দিলো সে খোদাতায়ালাকে। ভাগ্যিস কার্পণ্যহীনভাবে তার দেহে তিনি সৌন্দর্যের বিকাশ করেছিলেন তাই মরণ ছোবল থেকে তার প্রাণ রক্ষা পেলো আজ। শুধু আজ নয়, এমনি আরও কতবার সে জীবন রক্ষা পেয়েছে।

জংলী রাণী ওপাশ থেকে একটা ঝুড়ি হাতে তুলে নিয়ে এগিয়ে এলো বনহুরের সম্মুখে বাড়িয়ে। ধরলো।

বনহুর দেখলো ঝুড়িটার মধ্যে অনেকগুলো নাম না-জানা অদ্ভুত ধরনের ফল রয়েছে। বনহুর একটা ফল হাতে তুলে নিলো।

জংলী রাণী খুশি হলো বনহুরের আচরণে।

বনহুর ফলটা ভক্ষণ করতে লাগলো।

অত্যন্ত সুস্বাদু ফল, বনহুর সমস্ত ফলটা খেয়ে ফেললো।

জংলী রাণী এবার বনহুরের সম্মুখে একটা মাটির পাত্র উঁচু করে ধরলো।

চমকে উঠলো বনহুর মাটির পাত্রটা নিয়ে পাশে নামিয়ে রাখলো। দস্যু সে, কিন্তু রক্তপিপাসু নয়। বনহুর উঠে দাঁড়ালো এবার।

জংলী রানী পুনরায় বনহুরের দক্ষিণ হাতখানা উঁচু করে ধরলো, তারপর এগিয়ে চললো তাকে নিয়ে।

এবার অন্য একটা পথ ধরে অগ্রসর হলো জংলী রাণী। যাবার সময় একটা মশাল সে হাতে তুলে নিয়েছিলো। কিছুটা অগ্রসর হতেই দেখলো বনহুর সম্মুখে বন্ধ দরজা। রাণীকে দেখেই দরজা মুক্ত করে দিলো দু’জন জংলী। তারপর পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ালো।

জংলী রাণী বনহুরকে নিয়ে একটা কক্ষমত জায়গায় এসে দাঁড়ালো। তারপর নিজের কণ্ঠ থেকে একটা মালার মত লকেট খুলে পরিয়ে দিলো বনহুরের গলায়।

এবার জংলী রাণী করতালি দিলো।

সঙ্গে সঙ্গে পূর্বের সেই মশালধারী জংলী এসে দাঁড়ালো তার পাশে।

জংলী রাণী ইশারা করলো।

বনহুরকে ওরা নিয়ে যাবার জন্যই এসেছে বুঝতে পেরে বনহুর ওদের সঙ্গে অগ্রসর হবার জন্য পা বাড়ালো।

কিন্তু জংলী রাণী পুনরায় বনহুরের দক্ষিণ হস্ত উঁচু করে হাতের পিঠে চুম্বন করলো।

বনহুর নিজের অজ্ঞাতেই একবার তাকালো জংলী রাণীর মুখের দিকে। দেখলো জংলী রাণীর ঠোঁটের কোণে সেই পূর্বের হাসির আভাষ ফুটে উঠেছে।

জংলীদ্বয় বনহুরকে নিয়ে পরপর কয়েকটা দরজা পেরিয়ে আবার ফিরে আসে সেই বন্দীশালায়।

কাঠের মজবুত দরজা খুলে ভিতরে নিয়ে গেলো বনহুরকে। বনহুরের কণ্ঠে তখনও শোভা পাচ্ছে জংলী রাণীর দেওয়া রত্নাভরণ সেই হারখানা।

বনহুরকে দেখতে পেয়ে নূরী ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার বুকে হুর ফিরে এসেছো তুমি? হায়, আমি ভেবেছিলাম তোমাকে ওরা নিয়ে গিয়ে হত্যা করে ফেলবে।

বনহুর নূরীর মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে বললো–হত্যা ওরা আমাকে করবে না বলেই মনে হলো।

একি! তোমার গলায় এ হার এলো কোথা হতে হুর? নূরী বনহুরের গলার হারটা উঁচু করে ধরে বিস্ময় ভরা কন্ঠে বললো।

স্মিত হেসে বললো বনহুর–জংলী রাণীর উপহার।

রুদ্ধ কণ্ঠে বললো নূরী–জংলী রাণী?

হাঁ, যাকে প্রথম আমরা ঐ মঞ্চের উপর দেখেছিলাম।

কি সর্বনাশ! ঐ জংলী রাণী তোমাকে–না না, ওটা তুমি ফিরিয়ে দিয়ে এসো হুর, ওটা তুমি ফিরিয়ে দিয়ে এসো।

নূরী, এটা ফিরিয়ে দিলে হয়তো জীবন দিতে হবে। থাক না ক্ষতি কি? তাছাড়া জানো এটা মূল্যবান হীরক।

চাই না হীরক। এটা দিয়ে তোমাকে কেড়ে নেবে আমার কাছ থেকে। নূরী বনহুরের বুকে মাথা রেখে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো।

বনহুর নূরীর চিবুক ধরে উঁচু করে বললো–নূরী, আমাদের এতোগুলো জীবনের পরিবর্তে জংলী রাণীর কাছে আত্মসমর্পণ করাই কি উচিৎ নয়?

না, আমি তা চাই না। মৃত্যু আমার কাছে অনেক ভাল তোমাকে হারানোর চেয়ে।

 আমি যদি রাণীকে তার উপহার ফিরিয়ে দেই তার পরিণতি কি জানো?

জানি মরতে হবে।

শুধু আমাকে নয়, তোমাকেও ওরা হত্যা করবে আর ঐ ওদের দু’জনাকে। দুটো নিরীহ প্রাণ আমাদের জন্য বিনষ্ট হবে।

নূরী তাকালো–অসহায় করুণ চোখে তাকিয়ে আছে কেশব আর সাপুড়ে সর্দার তাদের দিকে। চোখে মুখে ভীত ভাব। মুখ ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে।

বললো বনহুর–নূরী, জংলীরা কত বড় ভয়ঙ্কর তা আমি একটু পূর্বেই বুঝতে পেরেছি। ওরা আমাকে তাজা রক্ত এনে দিয়েছিলো পান করার জন্য।

নূরী কোনো কথা বললো না নীরবে রোদন করে চললো। পুব আকাশ দৃষ্টিগোচর হলেও বোঝা গেলো রাত ভোর হয়ে আসছে। বন্য মোরগ দলের কণ্ঠ ভেসে আসছে দূর দূরান্ত থেকে। পাখিরা সব বৃক্ষ শাখায় কলরব শুরু করেছে।

বনহুরের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে নূরী।

সাপুড়ে সর্দার আর কেশব কাঠের খুঁটিতে ঠেশ দিয়ে নাক ডাকাচ্ছে।

বনহুরের চোখেও নিদ্রা জড়িয়ে আসছে। ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ে সেও কাঠের খুঁটিতে ঠেশ দিয়ে।

*

মাসুমা, আমার মন বলছে সে কোনো বিপদে পড়েছে। আমি যে বড় অস্থির বোধ করছি। ভাই। মনিরা প্রায় কাঁদো কাঁদো কন্ঠে কথাটি বললো।

মাসুমা হাসার চেষ্টা করে বললো–ছিঃ অযথা মন খারাপ করা উচিৎ নয়, তাছাড়া তোর স্বামী। তো আর ছোট্ট ছেলে নয়। তাঁর চেহারা দেখেই মনে হয় অসীম শক্তিবান তিনি। সত্যি মনিরা তোর স্বামী ভাগ্য বলতে হবে।

কিন্তু ভাগ্য হলে কি হয় বল্ তাকে তো ধরে রাখতে পারলাম না কোনোদিন। ওকে ভালবেসে চিরদিন আমার চোখের পানি শুকালো না মাসুমা। আর যে আমি পারছি না সহ্য করতে।

কি করবি সহ্য না করে কি উপায় আছে! যেমন গেছেন তেমনি আবার হঠাৎ একদিন এসে হাজির হবেন।

আর যদি তার কোনো অমঙ্গল ঘটে থাকে?

ও সব চিন্তা করতে নেই বোন। নিশ্চয়ই তিনি ভাল আছেন। আবার ফিরে আসবেন।

মনিরা মাসুমার সান্ত্বনায় আশ্বস্ত হতে পারে না। কে যেন তার মনের গহনে ডেকে বলছে তোমার স্বামীর অমঙ্গল ঘটেছে। তার সম্মুখে ভয়ঙ্কর বিপদ।

মনিরার চোখের অশ্রুতে বসন সিক্ত হয়।

 মাসুমা চিন্তিত হলো। কদিন সে এমনি সান্ত্বনা বাক্যে ওকে ভুলিয়ে রাখবে।

হাশেম চৌধুরীও ভয়ঙ্কর ভাবনায় পড়লেন। মনিরা সব সময় বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু রোদন। করছে। নাওয়া-খাওয়া প্রায় ছেড়ে দিলো সে। এমনি করে ক’দিন বাঁচতে পারে মানুষ।

বনহুরের জন্য শুধু মনিরাই নয়, নূরীর অবস্থাও তাই হয়েছে। নূরী কাঁদছে বনে জংলীদের বন্দীশালায় বসে; আর মনিরা কাঁদছে দিল্লী নগরীর বুকে। মনিরা স্বামীর বিরহে উন্মাদিনী আর নূরীর প্রিয়কে হারানোর আশঙ্কা।

জংলী রাণীর নজরে পড়েছে বনহুর।

ভোর হতেই ঢাকের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো নূরীর। সাপুড়ে সর্দার কেশব আর বনহুরও জেগে উঠেছে। সবাই বিস্ময়ভরা নয়নে দেখলো–বন্দীশালার বাইরে কয়েকজন জংলী বর্শা হস্তে দন্ডায়মান। আর দুইজন প্রবেশ করেছে বন্দী শালার ভিতরে।

অদ্ভুত শব্দ করে উঠলো বন্দীশালার ভিতরে প্রবেশকারী জংলীদ্বয় ইংগিৎ করলো উঠবার জন্য। বনহুরকে।

বনহুর উঠতে যাচ্ছিলো, নূরী বনহুরের হাত চেপে ধরলো। না না, ওকে তোমরা নিয়ে যেও না, ওকে তোমরা নিয়ে যেও না কিন্তু নূরীর কোনো বাধাই শুনলো না জংলীদ্বয়, বনহুরকে টানতে টানতে বের করে নিয়ে চললো।

নূরী আকুলভাবে কেঁদে উঠলো।

 সর্দার আর কেশবের চোখও শুষ্ক ছিলো না।

পর-পর আবার কয়েকজন জংলী এসে নূরী, কেশব আর সাপুড়ে সর্দারকেও বেঁধে নিয়ে চললো।

ঢাকের আওয়াজ গুরুগম্ভীরভাবে বেজে চলেছে। তার সঙ্গে শোনা যাচ্ছে জংলীদের অবিশ্রান্ত কলধ্বনি।

নূরী সর্দার এবং কেশব মঞ্চের নিকট পৌঁছলো। ওরা দেখলো–সুউচ্চ কাষ্ঠমঞ্চের উপরে উপবিষ্টা জংলী রাণী, পাশে আজ আর একটি অদ্ভুত জংলী বসে আছে। ঠিক জংলীহস্তীর মত তার চেহারা। জমকালো গায়ের রং মাথায় সজারু কাঁটার মত খাড়া খাড়া চুল। চোখ দুটো দেহের আকারে অনেক ছোট আর লাল। সমস্ত দেহে সাদা রং এর চিত্র আঁকা।

জংলী রাণীর ঠিক দক্ষিণ পাশে বসেছিলো ভীমকায় জংলীটা।

অল্পক্ষণেই বুঝতে পারলো নূরী-জংলী রাণীর পিতা ঐ জংলী। হয়তো জংলী সর্দার হবে। আজ জংলী রাণীর মাথায় পাখীর পালকের মুকুট শোভা পাচ্ছে। মুকুটের মাঝখানে একটা হীরক খন্ড জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

নূরী, কেশব আর সর্দারকে নিয়ে যেতেই জংলী সর্দার রক্ত চক্ষু বিস্ফারিত করে তাকালো। তীক্ষ্ণ নজরে দেখতে লাগলো সে।

বনহুরকেও কয়েকজন জংলী ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেক জংলীর হস্তে এক একটা সূতীক্ষ ধার বর্শা।

বনহুরকে দেখামাত্র নূরী তার দিকে ছুটে যাবার জন্য পা বাড়াতেই জংলীরা তাকে ধরে ফেললো।

সর্দার আর কেশবকেও ধরে রেখেছে কয়েকজন জংলী।

বনহুরের হাত দুখানা মোটা লতা দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা রয়েছে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বনহুর।

সর্দার, কেশব আর নুরীর হাতও বেঁধে এনেছে জংলীরা।

তাদের চারপাশ ঘিরে কতকগুলো জংলী ঢাক বাজিয়ে চলেছে।

হঠাৎ জংলী সর্দার দক্ষিণ হাত উঁচু করে উঠে দাঁড়ালো।

 সঙ্গে সঙ্গে ঢাকের আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেলো।

 জংলী দল সমস্ত দেহ নুইয়ে অভিবাদন করলো।

এবার জংলী সর্দার এক রকম অদ্ভুত শব্দ করে উঠলো– হুংহো হুয়াই হু লং লো।

অমনি জংলী দল এক একটা মোটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে এক এক জনকে বেঁধে ফেললো মজবুত করে।

সারিবদ্ধভাবে কতকগুলো গাছের গুঁড়ি মাটিতে পোতা রয়েছে।

এক একটা গুঁড়ির সঙ্গে এক একজনকে পিছমোড়া করে বাঁধলো।

বনহুরকে মাঝের মোটা খুঁটির সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে নিলো।

এবার এক মর্মান্তিক দৃশ্য শুরু হলো।

 প্রত্যেকটা খুঁটির পাশে চারজন করে জংলী বর্শা উদ্যত করে দাঁড়ালো।

এবার তাদের সম্মুখে একটা অগ্নিকুন্ড জ্বেলে দেওয়া হলো।

দাউ দাউ করে অগ্নিকুন্ডটা জ্বলে উঠলো। গহন জঙ্গলের মধ্যে শুরু হলো এক মহা প্রলয় নৃত্য। ঢাকের তালে তালে কতকগুলো জংলী নারী-পুরুষ নৃত্য শুরু করলো। যেন হস্তিশাবকগণ দুলে দুলে নৃত্য করছে।

জংলী সর্দার এবার আর একটা শব্দ করলো–হুম্ হুয়া হুই হুই…

অমনি নাচ বন্ধ হলো।

 জংলী সর্দার একটা শব্দ করলো–চুংচিও হুম হুয়াম্।

তৎক্ষণাৎ কয়েকজন জংলী বর্শা উদ্যত করে দাঁড়ালো।

আর এক মুহূর্ত–এবার নিহত হবে বনহুরের দল।

সেই দন্ডে জংলী রাণী জংলী সর্দারকে লক্ষ্য করে বললো–ভূঁই হু হুম নং হুম…শব্দটা বড় করুণ শোনালো জংলী রাণীর কণ্ঠে। সে আংগুল দিয়ে বনহুরকে দেখালো।

জংলী সর্দার তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালো বনহুরের দিকে। ক্রুদ্ধভাবে গর্জন করে। উঠলো–নুয়ং হুম হুই নো কুম্ কুম্।

জংলী রাণী ভীমকায় জংলী সর্দারের পায়ে উবু হয়ে পা জড়িয়ে ধরলো–উঁই হু পিও হুম্ হুম্ নং ননা কুম্।

পূর্বের ন্যায় গর্জে উঠলো জংলী সর্দার–নো নো কুম কুম হুই হুম—

 এবার জংলী রাণী মাথার মুকুট খুলে রাখলো জংলী সর্দারের পায়ের কাছে।

 সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জংলী হাতের অস্ত্র মাটিতে নামিয়ে রাখলো।

নত মস্তকে দাঁড়ালো সবাই।

সেকি এক নীরব নিস্তব্ধতা।

মৃত্যু মুহর্তেও বনহুর, কেশব, সর্দার আর নূরীর চোখে বিস্ময় ঝরে পড়েছে। সবাই স্তব্ধ হয়ে দেখছে জংলীদের কার্যকলাপ।

এততক্ষণ তাদের মৃতদেহ কাঠের খুঁটির সঙ্গে ঝুলে পড়তো, যদি না জংলী রাণী বাধা দিতো।

অগ্নিকুন্ডটা আরও ভীষণ আকার ধারণ করেছে। অগ্নিকুন্ডের লেলিহান শিখার তীব্র তাপ এসে লাগছে তাদের দেহে।

মৃত্যু অনিবার্য জেনে কারো মুখে কোনো কথা নেই।

নূরীর চোখে অশ্রু শুকিয়ে গেছে।

 সাঁ সাঁ করে বাতাস বইছে।

দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।

মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে কয়েকটা প্রাণী।

এখানে জংলিগণ যেমন অস্ত্র মাটিতে নামিয়ে রাখলো অমনি জংলী সর্দার হাত তুলে বললো– ফুলোই হুম, নাংলো ফুং।

অমনি জংলী রাণী উঠে দাঁড়ালো, মুখমন্ডল দীপ্ত উজ্জল হয়েছে, খুশি হয়েছে বলে মনে হলো।

জংলী সর্দার বললো আবার–লাংলো লুই হুম…

জংলী রাণী আসন গ্রহণ করলো।

সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জংলিগণ ভূতল হতে অস্ত্র হাতে উঠিয়ে নিলো।

 জংলী সর্দার ইংগিৎ করলো, হাত তুলে দেখালো বনহুরকে।

অমনি দুইজন জংলী বনহুরের দিকে এগিয়ে গেলো। সবাই বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে জংলীদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করছে। দুইজন জংলী বনহুরের দিকে এগুতেই নূরী আর্তনাদ করে উঠলো– হুর, হুর, ওদের সঙ্গে যেও না হুর!

বনহুর এবার ফিরে তাকালো নূরীর দিকে, কোনো কথা সে বললো না।

 সাপুড়ে সর্দার বললো–ওরা বাবুজিকে খুন কইরিবে না মা ফুল। তুই কাদিস না।

ততক্ষণে বনহুরের বন্ধন উন্মোচন করে দিয়েছে জংলীদ্বয়। এবার বনহুরকে নিয়ে ওরা মঞ্চের উপরে উঠে গেলো।

নূরী আর্তনাদ করে কাঁদছে–হুর, তুমি যেও না।

হুর……যেও না ……

বনহুর এসে জংলী সর্দারের সম্মুখে দাঁড়ালো।

জংলী সর্দার হাতখানা বাড়িয়ে দিলো বনহুরের সম্মুখে।

বনহুর বুঝতে পারলো–তার সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করতে চায় জংলী সর্দার। বনহুর হাত রাখলো জংলী সর্দারের হাতের উপর।

এবার জংলী সর্দার বনহুরের হাতের পিঠে চুম্বন করলো। ঠিক পূর্বদিন রাতে জংলী রাণী যেভাবে তার হস্তপৃষ্ঠে চুম্বন করেছিলো।

সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো আবার ঢাকের আওয়াজ।

বনহুরকে জংলী সর্দার তার পাশের আসনে বসার জন্য ইংগিত করলো।

 বনহুর আসন গ্রহণ করলো।

জংলী রাণী তাকিয়ে আছে বনহুরের মুখের দিকে, দু’চোখে তার আনন্দের দ্যুতি খেলা করছে।

দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকালো বনহুর মঞ্চের নিচে যেখানে কাষ্ঠ গুঁড়ির সঙ্গে পিছমোড়া করে বাঁধা আছে সাপুড়ে সর্দার, কেশব আর নূরী।

নূরী রোদন করছে অবিরত।

বনহুরের প্রাণ বিচলিত হলো, বিশেষ করে নূরীর চোখের পানি তার মনে অস্বস্তি এনে দিচ্ছিলো। বনহুর জংলীদের ভাষা বুঝতেও পারছে না বা বলতেও পারছে না। তবু জংলী সর্দারকে লক্ষ্য করে বনহুর ইংগিৎ করলো ওদের মুক্ত করে দিতে।

কিন্তু জংলী সর্দার মাথা দুলালো–মুক্তি তাদের দেবে না।

বনহুর মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও স্থির হয়ে বসে রইলো। একবার তাকালো সে পাশের জংলী রাণীর দিকে। জংলী রাণীকে খুশি করে তবে ওদের মুক্তি সাধন করতে পারে। নূরী কিছু বোঝে না–এখন নিজকে শক্ত করে নিতে হবে। যেমন করে হোক এদের কবল থেকে মুক্তি চাই।

জমকালো ভয়ঙ্কর চেহারার জংলী সর্দারের পাশে বনহুরকে রাজ কুমারের মতই লাগছিলো। যেন যমদূতের পাশে ফেরেস্তা। বনহুরের গলায় জংলী রাণীর দেওয়া হীরকখন্ডটা থেকে আলোকচ্ছটার মত একটা নীলাভ দ্যুতি বেরিয়ে আসছিলো।

জংলী সর্দার এবার উচ্চারণ করলো–জুপি টং জো হুম হুয়াম।

জংলী রাণী উঠে বনহুরের সম্মুখে হাত বাড়ালো।

বনহুর কি করবে ভেবে পায় না, সে জড়গ্রস্তের মত উঠে জংলী রাণীর হাতের উপর হাত রাখলো।

জংলী রাণী বনহুরের হস্তের পিঠে চুম্বন করলো।

 আবার শুরু হলো ঢাকের আওয়াজ।

তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচতে লাগলো সমস্ত জংলী নারী-পুরুষ।

 এ যেন এক মহা প্রলয় নাচ।

আনন্দে জংলী দল যেন মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে।

নূরী সাপুড়ে সর্দারকে জিজ্ঞাসা করলো বাবা, ওরা কি জন্য এমন করছে।

বললো সাপুড়ে সর্দার–বাবুজীর সাথী রাণীজীর বিয়া হবে, তাই উরা খুশি হইয়াছে।

নূরী যেন আর্তনাদ করে উঠলো–জংলী রাণীর সঙ্গে বাবুজীর বিয়ে!

হাঁ ফুল। বাবুজীর সাথী জংলীর বিয়া হলি হয়তো আমরা প্রাণে বাচতি পারি।

চাই না বাঁচতে বাবা, ওকে আমি জংলী রাণীর হাতে দেবো না বাবা, আমার বাঁধন খুলে দাও বাবা। খুলে দাও আমার বাঁধন–

নূরীর কণ্ঠ তলিয়ে যায় ঢাকের আওয়াজের তলায়।

কিছুসংখ্যক জংলী নারী বনফুল নিয়ে ঘিরে ধরে বনহুর আর জংলী রাণীকে, কতকগুলো ফুল ছড়িয়ে দেয় জংলী রাণী আর বনহুরের মাথায়।

এবার নিয়ে যায় জংলী নারীগণ বনহুর আর জংলী রাণীকে মঞ্চের উপর থেকে নামিয়ে।

জংলী রাণীর হাতের মুঠায় তখন বনহুরের দক্ষিণ হাতখানা ধরা রয়েছে।

জংলী রাণীর সঙ্গে বনহুর চলে যায়।

নূরীর চোখের সম্মুখে নেমে আসে জমাট অন্ধকার। সহ্য করতে পারে না নূরী এই দৃশ্য, ঢলে পড়ে সে কাঠের খুঁটির সঙ্গে।

সাপুড়ে সর্দার লক্ষ্য করে নূরী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সে অত্যন্ত ভড়কে যায় কিন্তু কি উপায় আছে–তার হাত-পা সব যে খুঁটির সঙ্গে মজবুত করে বাঁধা।

জংলী সর্দার এবার হাত তুলে বলে–চুল্লং চুল্লি হুম।

অমনি ড্রাম ভর্তি কিছু তরল পদার্থ নিয়ে আসে জংলী দল।

জংলী সর্দার মাটির পাত্র ভর্তি করে পান করতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে অন্য জংলিগণ শুরু করে পান করা।

ঢাক বাজছে।

তার সঙ্গে চলেছে নাচ আর বিকট সুরে অদ্ভুত গান।

কিছুক্ষণ এভাবে নাচ-গান চলে, তারপর দেখা যায় সবগুলো জংলী ভূতলে শুয়ে নাক। ডাকাচ্ছে।

মঞ্চের উপরে চিৎ হয়ে পড়ে আছে জংলী সর্দার। মনে হচ্ছে যেন হস্তীশাবক ঘুমিয়ে পড়েছে।

ওদিকে জংলী রাণী পূর্বদিনের সেই কক্ষে নিয়ে এলো বনহুরকে। জংলী নারীগণ শুধু দরজা পর্যন্তই এগিয়ে দিয়েছে। কাষ্ঠ ফটকের ওপাশে কারো প্রবেশ চলে না।

বনহুরকে জংলী রাণী পূর্বদিনের সেই কক্ষে নিয়ে এসে দাঁড়ালো। আজও পূর্বদিনের মত কিছু ফল তার সম্মুখে বাড়িয়ে ধরলো।

বনহুর দু’একটা ফল ভক্ষণ করলো।

 বনহুর যখন ফল খাচ্ছিলো তখন জংলী রাণী স্থির নয়নে তাকিয়ে দেখছিলো বনহুরকে।

খাওয়া শেষ হলে বনহুরের সম্মুখে একটি তাজা রক্ত ভরা বাটি বাড়িয়ে ধরলো।

বনহুর মাথা নেড়ে বললো ও সব সে খায় না।

জংলী রাণী বনহুরের মাথার চুলে, গালে, মুখে হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলো। দিনের আলো হলেও ভিতরটি বড় অন্ধকার ছিলো, কাজেই গুহার মধ্যে দপ দপ করে মশাল জ্বলছিলো তখনও।

জংলী রাণী বনহুরের কানের বালা আর হাতের বালা দেখিয়ে কি যেন বললো বুঝতে পারলো না বনহুর, তবু মাথা দোলালো।

হাসলো জংলী রাণী।

এবার বনহুর জংলী রাণীর দেওয়া তার গলার হীরকখন্ডটা দেখিয়ে বললো–এগুলো তোমরা কোথায় পেয়েছো জংলী রাণী?

জংলী রাণী বনহুরের কথার জবাব না দিয়ে শুধু হাসলো, কারণ সে বনহুরের কথা কিছুমাত্র বুঝতে পারেনি।

বনহুর এবার জংলী রাণীর গলার উজ্জ্বল হীরক হার দেখিয়ে বললো–এগুলো কোথায় পেয়েছো?

জংলী রাণী মনে করলো, ওগুলো বুঝি সে তার কাছে চায়। তাই সে নিজের সমস্ত হার, মালা হাতের বালা খুলে বনহুরের গলায় হাতে পরিয়ে দিতে লাগলো।

বনহুর তো হকচকিয়ে গেলো, সে বিভ্রাটে পড়লো। বার বার বললো –না না, ওসব আমি চাই না। নেবো না আমি। তুমি কোথায় পেয়েছে তাই জিজ্ঞেস করছিলাম?

জংলীরাণী তেমনি পূর্বের ন্যায় হাসলো। কারণ সে বনহুরের কথার একবর্ণও বুঝতে পারছিলো না।

বনহুর কিন্তু অত্যন্ত বিরক্তি বোধ করছিলো জংলীরাণী তার কথা বুঝতে না পারায় অসহ্য লাগছিলো তার। বনহুর তার গলা থেকে সব আবার খুলে পরিয়ে দিলো জংলীরাণীর গলায়।

জংলী রাণী তখন বনহুরের মুখোভাব লক্ষ্য করে ঘাবড়ে গেলো।

বুঝতে পারলো বনহুর রাগ করেছে। তাই নিজের হার-মালাগুলো পুনরায় খুলে বনহুরের কণ্ঠে পরিয়ে দিয়ে হাসতে লাগলো।

বনহুর নিরূপায়–কিছু বুঝাতে পারে না জংলী রাণীকে সে। বিপদে পড়লো বনহুর, কিভাবে এর হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। জংলী রাণীকে কাবু করা তার পক্ষে সামান্য ব্যাপার। কিন্তু জংলী রাণীর যে অসংখ্য অনুচর আছে তাদের কবল থেকে উদ্ধার পাওয়া মুশকিল। তারা শুধু ভয়ঙ্করই নয়–দুর্দান্ত নরখাদক।

বনহুর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে–তাকে হয়তো সহজে হত্যা করবে না, জংলী রাণীর নজর তার উপরে পতিত হয়েছে, তার সৌন্দর্য জংলী রাণীকেও আকৃষ্ট করেছে কিন্তু আশঙ্কা সাপুড়ে সর্দার, কেশব আর নূরীর জন্য। জংলীরা যদি ওদের হত্যা করে বসে–

বনহুরের চিন্তাজালে বাধা পড়ে, জংলী রাণী বনহুরের কন্ঠ তার বাহু দুটি দিয়ে বেষ্টন করে ধরেছে। একি! জংলী রাণীর ওষ্ঠদ্বয় তার গন্ড স্পর্শ করেছে। কি তীব্র উষ্ণময় সে ওষ্ঠদ্বয়!

বনহুর মুহূর্তে জংলী রাণীর বাহুবন্ধন থেকে নিজকে মুক্ত করে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কঠিন বিরক্তি ভাব ফুটে উঠলো তার চোখেমুখে।

বনহুরের আচরণে জংলী রাণী ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলো। ক্রুদ্ধ নাগিনীর মত জ্বলে উঠলো আর কালো চোখ দুটো। সেকি জ্বালাময় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি চোখ দুটো দিয়ে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছে। অধর। দংশন করে জংলী রাণী।

বনহুর তাকালো জংলী রাণীর মুখের দিকে।

দৃষ্টির সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো বনহুর। .

আতঙ্কিত হলো–জংলী রাণীর মুখোভাব সাংঘাতিক হয়ে উঠেছে। এখন কি করা তার কর্তব্য। সাপুড়ে সর্দার কেশব আর নূরীকে বাঁচাতে হবে নিজকেও বাঁচতে হবে। দ্রুত চিন্তা করতে লাগলো বনহুর। এই মুহূর্তেই হয়তো জংলী রাণী করতালি দিয়ে তার অনুচরগণকে এনে বসবে, হয়তো বা তাকে পুনরায় বন্দী করে নিয়ে যাবে সেই মঞ্চের সম্মুখে। বেঁধে ফেলবে সেই কাষ্ঠ খুঁটির সঙ্গে তারপর হত্যা করবে বল্লম দিয়ে এক একজন করে। বনহুর মৃত্যুর জন্য ভীত নয় কিন্তু এতোগুলো প্রাণ বিনষ্ট হবে! না না, জংলী রাণীকে এভাবে ক্রোধান্ধ করা চলবে না। তাকে খুশি করে তবেই কার্যোদ্ধার করতে হবে। কিন্তু কি করে তা সম্ভব! বনহুর পুনরায় তাকায় জংলী রাণীর দিকে।

জংলী রাণী তখন ক্রুদ্ধভাবে অধর দংশন করে চলেছে। সেকি রুদ্র মূর্তি! এত বিপদেও বনহুরের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো। এবার সে মন স্থির করে নিলো, বাড়িয়ে দিলো দক্ষিণ হাতখানা জংলী রাণীর সম্মুখে।

বনহুর জানতো তার কথা জংলী রাণী বুঝতে পারবে না। সে লক্ষ্য করেছে এদের সন্ধি স্থাপনের কায়দা তাই বনহুর তার দক্ষিণ হাত প্রশস্ত করে দিলো জংলী রাণীর সম্মুখে।

সঙ্গে সঙ্গে জংলী রাণীর মুখমন্ডল খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠলো। হাসির ছটা দেখা দিলো তার মুখে! বনহুরের হাতের উপর হাত রাখলো জংলী রাণী।

বনহুর জংলী রাণীর হস্তপৃষ্ঠে চুম্বন করলো।

*

সন্তর্পণে বনহুর উঠে দাঁড়ালো। তাকিয়ে দেখলো জংলী রাণী নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছে। মশালের আলোগুলো স্তিমিত হয়ে এসেছে। নিভু নিভু মশালের আলোতে জংলী রাণীর কণ্ঠের। উজ্জ্বল রত্নাভরণগুলো থেকে আলোকচ্ছটা বিচ্ছুরিত হচ্ছিলো।

জংলী রাণীর পরিয়ে দেওয়া কয়েক গাছা রত্নহার এখনও বনহুরের গলায় দুলছে। বনহুর নিজের কণ্ঠের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো তারপর তাকালো একবার জংলী রাণীর দিকে। আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে দ্রুত সুড়ঙ্গ মুখের দিকে অগ্রসর হলো।

প্রথম দ্বারে দু’জন জংলী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছিলো। বনহুর আস্তে এসে দাঁড়ালো তাদের পাশে। একসঙ্গে দু’জনার গলা দু’হাতের মধ্যে চেপে ধরলো। চাপ দিতে লাগলো দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে।

বনহুরের বলিষ্ঠ বাহুর কঠিন চাপে অল্পক্ষণেই অবশ হয়ে এলো জংলীদ্বয়ের দেহ। ভূতলে লুটিয়ে পড়লো জংলীদ্বয়। বনহুর এবার আরো দ্রুত চলতে লাগলো।

একটি দ্বার পেরিয়েছে সে।

দ্বিতীয় দ্বার।

এখানে বনহুরকে একটু বেগ পেতে হলো। কারণ পাহারারত জংলীদ্বয় পায়চারী করছিলো। তারা তাদের জংলী রাণীকে সজাগভাবে পাহারা দিয়ে থাকে।

মশালের আলোতে জংলীদ্বয়ের হস্তের বর্শাফলা ঝক্ মক্ করে উঠছে।

বনহুর সুড়ঙ্গ পথের আড়ালে আত্মগোপন করে দাঁড়ালো। যেমন তার সম্মুখে একজন জংলী অন্যমনস্কভাবে পায়চারী করতে করতে এসে পড়লো অমনি বাম হস্তে টেনে নিয়ে দক্ষিণ হস্তে গলা টিপে ধরলো।

মাত্র কয়েক সেকেন্ড– জংলীটা মুখ বিকৃত করে ভূতলশায়ী হলো। লোকটার মুখ থেকে একটা গোঙ্গানীর মত শব্দ বেরিয়ে এসেছিলো।

শব্দ শোনা মাত্র দ্বিতীয়জন দ্রুত এগিয়ে এলো।

 অমনি বনহুর আড়ালে লুকিয়ে পড়লো।

যেমন জংলীটা তার সঙ্গীর পাশে ঝুঁকে দেখতে গিয়েছে অমনি বনহুর তাকেও পূর্বজনের মত এটে ধরলো। সুড়ঙ্গ মধ্যে চীৎ করে ফেলে বুকের উপর চেপে বসে টিপে ধরলো ওর গলাটা। একটা গোঙ্গানীর মত শব্দ হলো, পরক্ষণেই জিভটা বেরিয়ে এলো এক পাশে। সমস্ত শক্তি দিয়ে। চাপ দিলো বনহুর।

আর নড়ছে না জংলীটা।

বনহুর বুঝতে পারলো–এরও মৃত্যু ঘটেছে। উঠে দাঁড়ালো এবার বনহুর। আরও একটা দরজা পেরুতে হবে তাকে। সেখানেও আছে দু’জন বল্লমধারী জংলী। তাদের কাবু করে তবেই বের হতে হবে বাইরে পৃথিবীর আলোতে।

বনহুর অতিদ্রুত এবার সুড়ঙ্গ মুখের দিকে অগ্রসর হলো। এবার সে তার নিজের কোমরের ছোরখানা মুক্ত করে নিলো।

খোদাকে ধন্যবাদ দিলো বনহুর কারণ এখনও তার কাছে রিভলভার এবং সূতীক্ষ-ধার ছোরাটা। রয়েছে। অবশ্য সভ্য সমাজের শ্রেষ্ঠ জীবগুলোর হস্তে যদি বন্দী হতো তাহলে সর্বপ্রথম তার নিকট হতে অস্ত্র কেড়ে নিতো তারা। জংলীরা নৃশংস বটে কিন্তু সুচতুর নয় এবং সেই কারণেই এখনও তাদের সঙ্গের সব কিছু সঙ্গেই রয়েছে।

বনহুর সূতীক্ষ্ণ-ধার ছোরাখানা নিয়ে চুপি চুপি সুড়ঙ্গ মুখের অনতিদূরে একটু আড়ালে দাঁড়ালো। কান পেতে শুনলো কোন শব্দ পাওয়া যায় কিনা।

কোনো শব্দ এলো না সুড়ঙ্গমুখ থেকে।

বনহুর সন্তর্পণে এগুতে লাগলো।

একেবারে সুড়ঙ্গমুখে এসে অবাক হলো বনহুর। পাহারাদার জংলীদ্বয় সুড়ঙ্গ মুখের দেয়ালে ঠেশ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বনহুর ছোট্ট একটা পাথরের টুকরা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিলো একজনের দেহে। আশ্চর্য জংলীটা একটুও নড়লো না।

বনহুর পুনরায় আর একটি পাথরের টুকরা অপরজনের দেহে নিক্ষেপ করলো।

কিন্তু সেও নড়লো না।

তবে কি ওরা নেশা করেছে কিছু! বনহুর সুড়ঙ্গমুখ থেকে বেরিয়ে এলো বাইরে। গাছপালার আড়ালে আত্মগোপন করে অগ্রসর হলো।

সুড়ঙ্গ মুখের অদূরেই কাঠের বিরাট মঞ্চ।

বনহুর বিস্ময়ভরা নয়নে দেখলো মঞ্চের আশে পাশে জংলীদল সব ছড়িয়ে পড়ে আছে। চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে জংলী সর্দার হস্তী শাবকের মত। বনহুর আরও দেখলো প্রত্যেকের সামনে এক একটা মাটির হাড়ির মত বস্তু পড়ে রয়েছে। মঞ্চের অদূরে কয়েকটা বড় বড় ঢোলের মত ড্রাম। সেই সব ড্রামে একরকম তরল পদার্থ রয়েছে। বনহুর এগিয়ে আসতেই একটা উৎকট গন্ধ তার নাকে প্রবেশ করলো। বুঝতে পারলো সে ঐ গন্ধ কিসের। একরকম তালগাছ জাতীয়। বৃক্ষ থেকে জংলিগণ এই রস সংগ্রহ করে এবং কোনো উৎসবে পান করে।

বনহুর নিশ্বাস ফেলে বাচলো যা জংলিগণ তাহলে সব মাতাল হয়ে জ্ঞান শূন্য রয়েছে। দ্রুত এগিয়ে গেলো বনহুর কাষ্ঠ খুঁটিগুলোর দিকে।

নিকটে পৌঁছতেই বনহুরের চুক্ষুস্থির হয়ে গেলো। বনহুরের দস্যু প্রাণও শিউরে উঠলো ক্ষণিকের জন্য। যদিও সে একটু পূর্বে চার চারটা জংলীকে হত্যা করেছে তবু এ দৃশ্য তাকে উদভ্রান্ত করে তুললো। দেখলো–তখনও খুঁটির সঙ্গে ঠিক পূর্বের মত করে বাঁধা অবস্থায় রয়েছে সাপুড়ে সর্দার কেশব আর নূরী। কিন্তু সাপুড়ে সর্দারের দেহে মস্তক নেই। কি বীভৎস দৃশ্য!

বনহুর দু’হাতে নিজের চোখ দুটো একবার ঢেকে ফেললো। তারপর আবার তাকালো ধীরে ধীরে সাপুড়ে সর্দারের দেহ থেকে মাথাটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। মাথাটা পড়ে আছে ঠিক তার পায়ের কাছে। চাপ চাপ রক্ত জমাট বেঁধে আছে ছিন্ন গলাটার উপর।

বনহুর কেশব আর নূরীর দিকে তাকালো।

 ওরা দু’জনাই জ্ঞানশূন্য অবস্থায় রয়েছে। দু’জনারই মাথাটা কাৎ হয়ে আছে এক পাশে।

বনহুর দ্রুত হস্তে কেশবের বন্ধন উন্মোচন করে দিলো তারপর ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকলো –কেশব–কেশব উঠো–উঠো শীঘ্র–উঠো– কেশব–কেশব–

কেশব আস্তে চোখ মেলে তাকালো, পর মুহূর্তে বনহুরকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো–বাবু সর্দারজীকে ওরা কেটে ফেলেছে–রক্ত খেয়েছে ওরা–রক্ত–

হাঁ দেখলাম। কেশব যা হবার হয়েছে, আর বিলম্ব করে কোনো ফল হবে না। ওরা সবাই নেশায় অজ্ঞান হয়ে আছে। এই মুহূর্তে পালাতে হবে! বনহুর কেশবকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে দ্রুত নূরীর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে নূরীর বন্ধন ছুরি দিয়ে কেটে ফেলে কিন্তু নূরীর জ্ঞান ফিরে আসে না কিছুতেই। ওদিকে জংলীগণের সংজ্ঞা ফিরে এলে আর রক্ষা থাকবে না। তাছাড়া জংলী রাণীও যদি জেগে উঠে তাহলে নিস্তার নেই।

বনহুর নূরীর সংজ্ঞাহীন দেহটা কাঁধে তুলে নিলো। কেশবকে লক্ষ্য করে বললো–দ্রুত পা চালিয়ে চলো কেশব।

কেশব কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো –বাবু সর্দারের–

তার জন্য দুঃখ করার সময় এখন আর নেই কেশব। তাড়াতাড়ি চলে এসো–বনহুর নূরীর দেহটা কাঁদে নিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে গহন জঙ্গল মধ্যে আত্মগোপন করলো।

সংজ্ঞাহীন নূরীর দেহটা কাঁধে নিয়ে যতদূর সম্ভব পা চালিয়ে চললো বনহুর। কেশব তাকে অনুসরণ করে চলেছে।

দূরে–অনেক দূরে চলে যেতে হবে। নাহলে জংলীগণ জেগে উঠলে আর তাদের রক্ষা থাকবে না। সমস্ত বনভূমি চষে ফেলবে জংলীরা।

অনেকটা পথ চলার পর হঠাৎ বনহুর আর কেশবের কানে ভেসে এলো ঢাকের আওয়াজ।

 বললো বনহুর–কেশব,সর্বনাশ জংলীরা জেগে উঠেছে। তাদের নেশা ছুটে গেছে—

এখন কি হবে তাহলে বাবু?

জীবন রক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে। কেশব, নূরীর জ্ঞান এখনও ফিরে এলো না।

 বাবু ফুলের জ্ঞান ফিরে এসেছিলো, কিন্তু যখন সাপুড়ে সর্দারের মাথা কেটে ফেলা হলো তখন আমার চোখ দুটো কেমন যেন মুছে এলো–ঠিক সেই সময় ওর জ্ঞানও চলে গেছে।

হাঁ তাই হবে কিন্তু এখন কোথায় যাওয়া যায় বলো?

হঠাৎ কেশব বলে উঠলো–বাবু, ঐ দেখেন সামনে একটা পাথরের ঢিবি চলুন আমরা ঐ ঢিবির আড়ালে লুকিয়ে পড়ি।

তাইতো ঢিবির মতই লাগছে–চলো দেখা যাক কোনো উপায় হয় কিনা।

বনহুর নূরীর সংজ্ঞাহীন দেহটা নিয়ে অগ্রসর হলো।

কেশব চললো পিছু পিছু।

ঢিবিটার নিকটে পৌঁছতেই আনন্দে বনহুরের মন দুলে উঠলো। ঢিবির ওপাশের বিরাট একটা গর্ত নজরে পড়লো। আপাততঃ এখানে আত্মগোপন করা যায়। গর্তটা বেশ বড়সড় তিন জনের পক্ষে যথেষ্ট হবে।

বনহুর নূরীসহ গর্তমধ্যে প্রবেশ করলো।

 কেশবও এলো তার সঙ্গে।

নূরীকে গতমধ্যে শুইয়ে দিয়ে বনহুর দ্রুত বেরিয়ে গেলো। কেশবও বেরিয়ে যাচ্ছিলো। বনহুর বাধা দিয়ে বললো–তুমি ওর পাশে থাকো, আমি এক্ষুণি আসছি।

কোথায় যাবেন বাবু?

এখানেই রয়েছি যাবো না কোথাও। বনহুর বেরিয়ে গেলো এবং সূতীক্ষ্ণ-ধার ছোরা দিয়ে কতকগুলো ডাল পালা ঝোপঝাড় কেটে এনে গর্তটার মুখে চাপা দিলো–যেন বাইরে থেকে কেউ বুঝতে না পারে।

কাজ শেষ করে বনহুর ফিরে এলো গুহা মধ্যে।

নূরীর সংজ্ঞা ফিরানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো বনহুর।

কিন্তু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, নূরী আর্তচিৎকার করে উঠলো–উঃ মাগো–মা– মা–

বনহুর ঝুঁকে পড়লো নূরীর মুখের উপর, ডাকলোনূরী নূরী–

চোখ মেলে তাকালো নূরী বনহুরকে দেখতে পেলে তার চোখ মুখ আনন্দোদ্দীপ্ত হয়ে উঠলো। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে ডাকলো–হুঁর তুমি এতোক্ষণে এলে?

বনহুর নূরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো-নূরী, সুস্থ হও আমরা জংলীদের কবল থেকে। পালাতে সক্ষম হয়েছি।

নূরী উঠে বসলো–সর্দার কই কেশব ভাই কই–এখন আমরা তবে কোথায়? কোথায় বলো?

 স্থির হও সব বলছি নূরী এই তো কেশব তোমার পাশে। বনহুর কেশবকে দেখালো। তারপর ধরা গলায় বললো–কিন্তু যে আমাদের পথ প্রদর্শক সেই সাপুড়ে সর্দার আর আমাদের মধ্যে নেই।  

এবার নুরীর মনে উদয় হলো সেই দৃশ্য। একজন জংলী খড়গ হস্তে এসে দাঁড়ালো সর্দারের পাশে, আর একজন একটা মাটির পাত্র উঁচু করে ধরলো। মাত্র একমুহূর্ত–সর্দারের মাথাটা খড়গের আঘাতে খসে পড়লো–তারপর আর মনে নেই কিছু। নূরী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো– বাবুজী মরে গেছে কি হবে আর আমাদের বেঁচে থেকে। ওরা আমাদের সবাইকে কেন হত্যা করলো না! আমাদের বেঁচে থেকে কি হবে হুর?

নূরী, রোদন করার সময় এটা নয়। জংলিগণ এক্ষুণি সমস্ত জঙ্গলময় ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের সন্ধান যদি তারা পায় তাহলে আর রক্ষা নেই।

কেশব ক্রন্দনজড়িত ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো–কেন আমরা এসেছিলাম! কেন আমরা আগে এসব কথা স্মরণ করিনি এখন কি হবে বাবু?

কেশব, মিছামিছি দুঃখ করা বাতুলতা মাত্র। এখন কি করে প্রাণে বাঁচা যায় সেই চিন্তা করো।

কি করা যায় বাবু ভেবে পাচ্ছি না। ঐ শুনুন জংলীরা বোধ হয় এদিকেই আসছে। কান পেতে শোনে কেশব।

বনহুর আর নূরীও শুনলো–দূরে মহা হই-হুল্লোড় শোনা যাচ্ছে। এখন রাত্রি নয়, দিনের আলো সব পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। বনহুর বললো–এ জায়গাটা সমতল ভূমি থেকে বেশ উঁচুতে। গর্তটাও সহজে কারো নজরে পড়বে না। তাছাড়া আমি গাছপালা দ্বারা গর্তটার মুখ বেশ করে ঢেকে দিয়েছি সহজে কেউ বুঝতে পারবে না এখানে কোনো গর্ত আছে।

হই-হুল্লোড় ক্রমে অস্পষ্ট হয়ে আসছে বলে মনে হলো।

বনহুর বললো–জংলীরা আমাদের সন্ধানে অন্য পথে অগ্রসর হচ্ছে। কিছুক্ষণের জন্য আমরা নিশ্চিন্ত।

বললো নূরী–এমন করে কতক্ষণ লুকিয়ে থাকবো আমরা?

যতক্ষণ কোনো পথ আবিষ্কার না হয়। কেশবকে লক্ষ্য করে বললো আবার বনহুর–কেশব আমরা সাপুড়ে সর্দারের নির্দেশ মত অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। ফিরে যাবার পূর্বে তার সেই গুপ্ত গুহার সন্ধান নিয়ে তবেই যাবো।

নূরী বলে উঠে–কি হবে হুর গুপ্ত গুহার সন্ধান নিয়ে। জীবন যদি হারাতে হয় তাহলে–একি, তোমার গলায় এতোগুলো হীরক হার! এগুলো তুমি কোথায় পেলে?

বনহুর গম্ভীর গলায় বললো–জংলী রাণীর উপহার।

মুহূর্তে নূরীর মুখ কালো হয়ে উঠলো। জংলী রাণী যখন বনহুরকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলো, তখন নূরীর বুকে কে যেন তীর বিদ্ধ করে দিয়েছিলো। নিজকে সে কিছুতেই স্থির রাখতে পারেনি। অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো নূরী–জংলী রাণীর উপহার তুমি সযতনে গলায় করে আনছো? না না, ও হার আমি তোমায় পরতে দেবো না–নূরী একটানে বনহুরের কণ্ঠের হীরক হার ছিঁড়ে ফেললো।

উজ্জ্বল হীরকগুলি ছড়িয়ে পড়লো মেঝেতে।

কেশব বলে উঠলো–একি করলে ফুল? দ্রুতহস্তে হীরক গুলো কুড়িয়ে তুলতে লাগলো সে।

 বনহুরের মুখ গম্ভীর হলো।

নূরী বনহুরের জমার আস্তিন চেপে ধরলো–জংলী রাণীর উপহার তুমি কেন গ্রহণ করলে বলো? কেন নিলে এসব?

নূরী মনকে এত সঙ্কীর্ণ করো না। জংলী রাণীর উপহার গ্রহণ না করে আমার কোনো উপায় ছিলো না।

তুমি-তুমি–

হাঁ হাঁ নূরী–এই নাও এসব তোমার। বনহুর কেশবের হাত থেকে হীরক খন্ডগুলো নিয়ে নূরীর আঁচলে তুলে দেয়।

নূরী পাথরের মূর্তির মত নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে।

*

জংলীদের কবল থেকে কোনোরকমে আত্মগোপন করে দু’দিন কাটিয়ে দিলো বনহুর কেশব আর নূরী। গর্তটার মধ্যে কোনো অসুবিধা হলো না তাদের।

বনহুর বাইরে গিয়ে ফলমূল সংগ্রহ করে আনতো। কেশব আর নূরীকে কোনো সময় সে বাইরে যেতে দিতো না। হঠাৎ কখন জংলিগণ এদিকে এসে পড়ে–তাহলে কিছুতেই ওদের কবল থেকে বাঁচতে পারবে না তারা।

ইতিমধ্যে জংলীরা আশে পাশে জঙ্গলে তন্ন তন্ন করে খুঁজে গেছে।

বনহুর আর কেশব গাছপালার পাতা এনে শয্যা তৈরি করেছে। গর্তের একপাশে শোয় কেশব আর বনহুর। অপর ধারে শোয় নূরী।

সমস্ত দিন ধরে পরামর্শ চলে তিন জনের মধ্যে কেমন করে এখান থেকে পালানো যায়। কিন্তু পালানোর কোনো উপায় খুঁজে পায়না। যে পথেই তারা পালাতে যাবে সেই পথেই ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে। সমস্ত জংগলময় জংলী রাণীর ক্ষুব্ধ অনুচরগণ পাহারা দিয়ে চলেছে।

দিবারাত্র তারা সূতীক্ষ্ণ বল্লম নিয়ে অন্বেষণ করে ফিরছে। এই ঢিবিটা এমন জায়গায় যেখানে সহজে কারো দৃষ্টি যায় না এবং সেই কারণেই এতোক্ষণও তারা জংলীদের কড়া নজর এড়িয়ে জীবিত রয়েছে।

আজ তৃতীয় দিন।

 বনহুর লক্ষ্য করেছে–কেশব আর নূরী যেন হাঁফিয়ে উঠেছে। দুশ্চিন্তায় ম্লান হয়ে উঠেছে তাদের মুখমন্ডল। বিশেষ করে সর্দারের নৃশংস মৃত্যু তাদের দুজনার হৃদয়ে দারুণ আঘাত করেছে। বনহুরও সর্দারের মৃত্যুতে কম মর্মাহত হয়নি, কিন্তু বনহুর জীবনে এর চেয়েও বিকৃত মৃতদেহ দেখেছে এর চেয়েও নৃশংস হত্যা সে নিজে করেছে। কাজেই তার মনে সর্দারের মৃত্যু তেমন করে রেখাপাত করতে পারেনি। তাছাড়াও সর্দারের কথা ভাববে কখন সে। তার মস্তিস্কে এখন নানারকম চিন্তার প্যাঁচ চলেছে। জংলীদের মৃত্যু-ছোবল থেকে নূরী ও কেশবকে বাঁচাতে হবে। শুধু জীবন রক্ষাই এখন বনহুরের উদ্দেশ্য নয়। তার প্রবল ইচ্ছা যে অভিসন্ধি নিয়ে তারা এতোদূর অগ্রসর হয়েছে সেই গুপ্তরত্ন গুহার সন্ধান না নিয়ে সে ফিরবে না।

বনহুর বিফল হয়ে ফিরে যাবার লোক নয়।

যতক্ষণ তার অভিসন্ধি সিদ্ধ না হয়েছে ততক্ষণ সে বিরত হবে না। কার্যোদ্ধার করে তবেই সে ক্ষান্ত হবে। সাপুড়ে সর্দার তাকে বলেছিলো–সেই কথাটা আজও মনে আছে বনহুরের– বাবুজী সেই গুপ্তরত্ন গুহার সন্ধান আমি আজও কাউকে বলিনি। আমার ভাতিজা রংলালকে আমি বিশ্বাস করি না, তাই ওকেও বলিনি। বাবুজী আপনাকে আমি ছেলের মতই মনে করি। তাই আপনাকে আমি সেই গুপ্তরত্ন গুহার সন্ধান দিয়ে যাবো। আহা, বেচারা শেষ পর্যন্ত তাকে গন্তব্য স্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হলো না।

রাত বেড়ে আসছে।

বনহুর কেশবের পাশে শুয়ে শুয়ে ভাবছে কত কথা। ঘুম চোখে আসছে না। আজ সর্দারের প্রতিটি কথা মনে উদয় হচ্ছে একটির পর একটি করে। সাপুড়ে সর্দার সেই গুপ্তরত্ন গুহার পথের বর্ণনা বলেছিলো, বলেছিলো সে পথ কেমন। সব বনহুর আজ পুনরায় মনের পর্দায় এঁকে নিচ্ছে। গভীর মনোযোগের সঙ্গে।

কিন্তু ঘুম যে তার চোখে আসছে না, এ পাশ-ওপাশ করছে বনহুর। পাশেই কেশব ঘুমিয়ে পড়েছেনাক ডাকছে তার। নূরী ঘুমিয়েছে তার জায়গায়। মাঝখানে মাত্র কয়েক হাতের ব্যবধান। নূরীকে পাশে পাবার জন্য বনহুরের মন চঞ্চল হয়ে উঠলো।

অনেক চেষ্টাতেও বনহুর নিজকে সংযত রাখতে পারলো না। কেশবের পাশ থেকে উঠে এগিয়ে গেলো নূরীর পাশে। শিয়রে এসে বসলো বনহুর, অন্ধকারে নূরীর ললাটে হাত রাখলো।

সঙ্গে সঙ্গে নিদ্রা ছুটে গেলো নূরীর, বললো কে?

 বনহুর চাপা কণ্ঠে বললো–নূরী আমি!

এতো রাতেও ঘুমাওনি কেন?

ঘুম আসছে না আমার চোখে। বনহুর নূরীর মুখখানা তুলে ধরে নিজের মুখের কাছে।

নূরী বাধা দিয়ে বলে উঠে–ছিঃ কেশব ভাই রয়েছে।

উঁ হুঁ ছাড়বো না তোমাকে।

তোমার পায়ে পড়ি হুর! তোমার পায়ে পড়ি—

নূরী!

 হুর আমার লক্ষীটি!

 ঘুম যে আমার পাচ্ছে না নূরী।

 তুমি শোও আমি তোমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

তোমার কোলে মাথা রেখে শোবো।

 বেশ তো শোও।

 বনহুর নূরীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।

নূরী ধীরে ধীরে ওর চুলের ফাঁকে আংগুল চালাতে লাগলো।

কখন এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো বনহুর।

নূরী ঘুমন্ত বনহুরের চিবুকে ছোট্ট একটা চুম্বন রেখা এঁকে দিয়ে আস্তে আস্তে ওরা মাথাটা নামিয়ে রাখলো নিচে। তারপর নিজের জায়গায় এসে শুয়ে পড়লো।

হঠাৎ ঢাকের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো বনহুরের, ধড়মড় করে উঠে বসলো। সঙ্গে সঙ্গে কেশব আর নূরীর নিদ্রাও ছুটে গিয়েছিলো।

বনহুর বললো মৃদু চাপা কণ্ঠে নিশ্চয়ই এ জংলীদের ঢাকের আওয়াজ।

 কেশব ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো–জংলীরা কি এদিকে আসছে?

আমার সেই রকমই মনে হচ্ছে। কারণ ঢাকের আওয়াজ ক্রমশ স্পষ্ট হতে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে।

তাহলে কি হবে হুর? অন্ধকারে নূরী বনহুরের জামার আস্তিন চেপে ধরে তার বুকের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো।

বনহুর নূরীকে নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নিয়ে বললো– ঠিক বোঝা যাচ্ছে না–ওরা এদিকে আসছে, না ওই পথে অন্য কোথাও যাচ্ছে।

কান পেতে শুনলো ওরা–ঢাকের আওয়াজ অল্পক্ষণেই আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বনহুর। বললো–তোমরা অপেক্ষা করো, আমি বাইরে গিয়ে দেখছি।

নূরী এটে ধরলো বনহুরকে–দেহে প্রাণ থাকতে তোমাকে বাইরে যেতে দেবো না।

বনহুর হাসলো, বললো–কতক্ষণ আমাকে ধরে রাখতে পারবে নূরী? জংলী রাণী যদি তোমার কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়?

দাঁতে দাঁত পিষে বললো নূরী–যুদ্ধ করবো তার সঙ্গে।

পারবে জংলী রাণীর অনুচরদের সঙ্গে?

না পারি মরবো, তারপর জংলী রাণী তোমাকে নিয়ে যাবে আমার কাছ থেকে–বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে নূরীর কণ্ঠ।

বনহুর নূরীর গন্ডে মৃদু চাপ দেয়, কিছু বলতে যায় সে কিন্তু কেশবের উপস্থিতি তাকে বিরত করে।

কেশব বলে–মশালের আলো না?

বনহুর নূরীকে সরিয়ে দিয়ে গর্তের মুখের কাছে সরে আসে।

সেও দেখতে পায় অসংখ্য মশালের আলো সারিবদ্ধভাবে গহন জঙ্গলে এগিয়ে আসছে। ঢাকের আওয়াজ এখন আরও বেড়ে গেছে চরম আকারে। বনহুর ভীত না হলেও আতঙ্কিত হলো, নিশ্চয়ই ওরা জানতে বা বুঝতে পেরেছে এখানে তারা লুকিয়ে আছে।

নূরী আর কেশব প্রায় কেঁদেই ফেললো।

বনহুর ছোরাখানা কেশবের হাতে দিয়েই নিজে রিভলভার প্রস্তুত করে নিলো। বনহুরের চোরা পকেটে এখনও বেশ কয়েকটা গুলী জমা ছিলো।

ক্রমেই মশালের আলো স্পষ্ট মনে হচ্ছে।

 দ্রুত যেন আলোগুলো এগিয়ে আসছে। নূরী পুনরায় আঁকড়ে ধরলো বনহুরকে।

কেশবের অবস্থাও শোচনীয়। কাঁপতে শুরু করেছে কেশব।

বনহুর বললো–নূরী মানুষ চিরকাল বাঁচতে আসেনি। কাজেই মরতে যখন একদিন হবেই তখন এতো ভীত হবার কারণ কি? কেশব মরতে যদি চাও তবে বীরের মতই মরবে– দুঃখ কি এতে। সাহস সঞ্চয় করে নাও তোমরা, আমার মনে হচ্ছে–ওরা আমাদের অবস্থান জানতে পেরেছে।

ঢাক-ঢোল বাজিয়ে এভাবে কেন আসছে ওরা? বললো নূরী?

ওটা ওদের নিয়ম। বিশেষ করে জংলীরা যখন রাত্রিতে গহন জঙ্গলে বিচরণ করে তখন জ্বলন্ত মশাল আর ঢাকের আওয়াজ তাদের বন্য হিংস্র জীবজন্তুর কবল থেকে রক্ষা করে থাকে।

কেশব বলে উঠলো আবার –বাবু ঐ দেখুন ওরা প্রায় এসে পড়েছে।

বনহুর বললো–কোনোরকম কথা না বলে চুপ করে থাকতে হবে। যতক্ষণ ওরা আমাদের গুহার ভিতরে প্রবেশ না করে ততক্ষণ আমরা নিশ্চুপ রইবো।

বনহুর আর কেশবের কথাবার্তা অত্যন্ত চাপা স্বরে হচ্ছিলো।

বনহুর, কেশব আর নূরী, অন্ধকারময় গর্তের মধ্যে রইলেও তাদের দৃষ্টি ছিলো অদূরস্থ জংগল মধ্যে।

মশালের আলো অত্যন্ত নিকটে এসে পড়েছে।

 ভয়ে কুঁকড়ে গেছে নূরী আর কেশব।

বনহুর উদ্যত রিভলভার বাগিয়ে গর্তের মুখে হাঁটু গেড়ে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে লক্ষ্য করছে।

সমস্ত বনভূমি যেন প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে। কানে তালা লাগাবার জোগাড়। মশালের আলোতে সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বনহুর হঠাৎ চাপা কণ্ঠে বলে উঠলো–কেশব, আশ্চর্য দেখো দেখো কয়েকজন লোককে ওরা ধরে আনছে না?

কেশব আর নূরী ঢিবির উপর গর্তমুখ হতে তাকালো নিচে বনের মধ্যে। মশালের আলোতে স্পষ্ট দেখলো–অসংখ্য জংলী দল ঢাক বাজিয়ে মশাল হস্তে বন্যহস্তীর মত ঘোৎ ঘোৎ করে এগুচ্ছে। ওদের মাঝখানে কয়েকজন সভ্য মানুষ রয়েছে বলে মনে হলো।

কেশব বলে উঠলো–বাবু, বাবু এ যে রংলাল দেখছি!

বনহুর তীক্ষ্ণ নজর ফেললো নিচের দিকে–তাইতো, সাপুড়ে সর্দারের ভাতিজা রংলাল। আরও কয়েকজন লোক দেখছি তো সবাইকে ওরা পিছমোড়া করে বেঁধে আনছে।

নূরী যেন খুশি হয়ে বললো–শয়তান রংলালের দল তাহলে জংলীদের হাতে ধরা পড়েছে?

যা ভালো হয়েছে। নূরীর কণ্ঠ খুশি ভরা।

বনহুর বললো–যা খোদার কাছে হাজার শুকরিয়া। এ যাত্রা ওরা আমাদের এদিকে এলো ন্স। ঐ দেখো ওরা ওদের নিয়ে চলে যাচ্ছে। এটা জংলীদের পথ বলে মনে হচ্ছে।

কেশবের এতোক্ষণে যেন কম্প দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেলো, সে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো–বাঁচলাম বাবু!

নূরীর মুখ অন্ধকারে দেখা না গেলেও বনহুর বুঝতে পারলো সেও অত্যন্ত খুশি হয়েছে। বনহুরের বুকে মুখ লুকিয়ে হাফ ছেড়ে বললো–উঃ বাঁচলাম এতোক্ষণে।

জংলিগণ তখন রংলালের দলকে বন্দী করে মহা হই-হুল্লোড় এবং ঢাক বাজিয়ে ঢিবিটার বিপরীত দিকে চলে যাচ্ছে। বনহুর নির্বাকভাবে তাকিয়ে দেখছে– যেদিক থেকে জংলিগণ এলো, সেই দিকেই জংলী রাণীর আস্তানা। তবে এরা যাচ্ছে কোথায়?

বনহুর মুহূর্ত চিন্তা করে নিলো–ওরা নিশ্চয়ই কোন নতুন জায়গায় যাচ্ছে, যেখানে হবে তাদের আজ নব উৎসব। বনহুর ওদের অনুসরণ করবে–দেখবে কোথায় যায় ওরা এবং রংলালের দলকে কি করে।

বনহুর তীক্ষ্ণ নজরে দেখছে–ক্রমান্বয়ে জংলীর দল তাদের টিবি ছেড়ে অনেক দূর পিছিয়ে চলে গেলো। মশালের আলোগুলো ধীরে ধীরে ঘন হয়ে আসছে, ঢাকের আওয়াজও অস্পষ্ট লাগছে। বনহুর বললো– কেশব এবার আমাদের এ গর্তের মায়া ত্যাগ করতে হবে।

নূরী আঁতকে উঠলো–কোথায় যাবে তাহলে হুর?

যেদিকে জংলিগণ গেলো।

সর্বনাশ! ওরা আমাদের অবস্থাও সাপুড়ে সর্দারের মত করে ফেলবে। বললো নূরী।

কোনো উপায় নেই নূরী।

তাই বলে ইচ্ছা করে ধরা দেবে জংলীদের হাতে?

কে বলে ইচ্ছা করে ধরা দেবো? দেখতে চাই জংলিগণ বিপরীত পথে কোথায় চলেছে।

 কি হবে জংলীদের গন্তব্য স্থানের সন্ধান নিয়ে?

তুমি বুঝবে না নূরী।

 কেশব এবার কথা বললো–বাবু জংলীদের পিছু নেওয়া কি আমার ঠিক্ হবে!

সব পরে বলবো এখন শীঘ্র তোমরা প্রস্তুত হয়ে নাও।

 নূরী ভীত কণ্ঠে বললো–আমার কিন্তু বড্ড ভয় করছে!

বনহুর বললো–নূরী তুমি না দস্যু দুহিতা ভয় পেলে চলবে কি করে? যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা এতোদূর অগ্রসর হয়েছি, যে কারণে আমরা হারিয়েছি আমাদের সাপুড়ে সর্দারকে সেই কাজ সফল না করে কি করে ফেরা যায়!

হুর, তুমি তাহলে গুপ্তরত্ন গুহার সন্ধান না নিয়ে ফিরবে না?

পিছু হটা বনহুরের নীতি নয়।

এরপর নূরী আর কোনো কথা বলতে সাহসী হয় না। কারণ বনহুরের কণ্ঠমধ্যে এমন একটা গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছিলো যা তার অতি পরিচিত। বনহুরকে সে ভালভাবেই জানে। জানে সে যখন ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে তখন কাউকে সমীহ করে না। নূরী তাকে যেমন ভালবাসতো তেমনি করতো। ভয়। ক্রুদ্ধ হলে সে তখন হিংস্র জন্তুর চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতো, অতি প্রিয়জনকেও সে তখন ক্ষমা করতো না, যদি পেতো তার কোনো অপরাধ। এই বিপদসঙ্কুল মুহূর্তেও নূরীর মনে পড়লো অনেকদিন আগের একটা ঘটনা। কালু খাঁ তখন জীবিত। একদিন বনহুর দস্যুতা করে ফিরে এলো তাজের পিঠে চেপে। দেহে তার জমকালো ড্রেস, মাথায় পাগড়ি, কানে বালা। কোমরের বেল্টে সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা, অপর পাশে রিভলভার।

অগণিত অনুচরসহ বনহুর দরবারকক্ষে প্রবেশ করলো। প্রত্যেকটা অনুচরের হস্তে লুণ্ঠিত দ্রব্যাদি।

কালু খাঁর সম্মুখে এসে দাঁড়ালো বনহুর।

অনুচরগণ লুণ্ঠিত দ্রব্যাদি সর্দারের সম্মুখে পাকার করে রাখলো। বনহুরের পিছনে দাঁড়ালো সারিবদ্ধ হয়ে।

বনহুর কালু খাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে কুর্ণিশ জানালো। সমস্ত অনুচরও অনুকরণ করলো বনহুরকে, তারাও কুর্ণিশ জানালো সর্দার কালু খাঁকে।

সেদিন প্রচুর ধনরত্ন আর টাকা-পয়সা নিয়ে এসেছিলো বনহুর।

কালু খাঁ সন্তুষ্ট হয়ে বনহুরের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলো সেদিন–বনহুর তুমি দস্যু-নেতা হবার যোগ্য পাত্র বটে। নাও, এই মুক্তার মালা ছড়া তুমি নাও।

বনহুরের লুষ্ঠিত স্থূপাকার মালপত্রের মধ্য হতে একটি মূল্যবান মুক্তামালা তুলে পরিয়ে দিয়েছিলো কালু খাঁ বনহুরের কণ্ঠে।

বনহুর খুশি না হয়ে মুক্তার মালা ছড়া একটানে ছিঁড়ে ছুঁড়ে দিয়েছিলো দূরে। গম্ভীর দীপ্ত কণ্ঠে বলেছিলো সেবাপু বনহুর দস্যু বটে কিন্তু লোভী নয়। মুক্তার মালার কোনোই প্রয়োজন আমার নেই।

স্তব্দ হয়ে তাকিয়ে রইলো কালু বনহুরের দিকে।

সমস্ত অনুচরের অন্তর কেঁপে উঠলো। এইবার কালু খাঁ নিশ্চয়ই বনহুরকে হত্যা করে ফেলবে। কিন্তু আশ্চর্য, পর মুহূর্তেই কালু খাঁ জড়িয়ে ধরেছিলো বনহুরকে বুকের মধ্যে, বলেছিলো –বেটা তুই শুধু দস্যু নেতাই হবি না, পৃথিবী বিখ্যাত দস্যু হবি তুই। লোভ, মোহ তোকে কোনদিন আকৃষ্ট করতে পারবে না।

আড়াল থেকে সব সেদিন দেখেছিলো নূরী। কালু খাঁর কথায় তার অন্তর ভরে উঠেছিলো। সেদিন দেখেছিলো বনহুরের সাহস, দেখেছিলো কতবড় তার বুকের বল। দস্যু সর্দার কালু খাঁর সম্মুখে সে তার দান উপেক্ষা ভরে বিনষ্ট করতে পেরেছিলো।

আরও কতদিনের কথা নূরীর অন্তরে গাঁথা হয়ে আছে। বিশেষ করে বনহুরের স্মৃতিগুলো নূরীর মনের আকাশে ধ্রুব তারার মতই চিরদিন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।

বনহুরের সৌন্দর্যেই নূরী শুধু অভিভূত ছিলোনা তার পুরুষোচিত আচরণে বিমুগ্ধ ছিলো সে! বনহুরের আবেগ মাখা কণ্ঠ তাকে যেমন করতো আত্মহারা তেমনি তার পৌরুষভরা কণ্ঠস্বর ওকে করে তুলতো ভীত। বনহুরের সম্মুখে যেতে তখন সাহসী হতো না নূরী।

আজ যখন বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–পিছু হটা দস্যু বনহুরের নীতি নয়। এরপর নূরীর। আর কোনো কথা বলার মত দুঃসাহস হলোনা। জানে নূরী–বনহুর যা বলবে তা সে করবে। তাতে যদি তার প্রাণ যায় তবু সে নাছোড়বান্দা।

বনহুর বললো–আর মুহূর্ত বিলম্ব করা ঠিক নয়, তোমরা আমাকে অনুসরণ করো!

বনহুর উদ্যত রিভলভার হস্তে গর্তমধ্য হতে বেরিয়ে পড়লো।

কেশব আর নূরীও বের হলো তার পিছু পিছু।

নূরীর ওড়নার আঁচলে জংলী রাণীর দেওয়া সেই হীরকখন্ডগুলো রয়েছে। সেগুলো নূরী সযত্নে রক্ষিত করেছিলো আঁচলে।

কেশবের হাতে সূতীক্ষ্ণধার ছোরা।

বনহুরের হস্তে রিভলভার।

 সম্মুখে বনহুর মাঝখানে নূরী আর কেশব পিছনে।

জংলীদল অনেক দূরে চলে গেছে। তাদের মশালের আলো মাঝে মাঝে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে ঘন জঙ্গলের ফাঁকে, আর ঢাকের আওয়াজ এখনও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

উঁচু ঢিবিটির গা বেয়ে নেমে আসতে লাগলো বনহুর, কেশব আর নূরী। বনহুর নূরীকে মাঝে মাঝে হাত ধরে সাহায্য করছিলো, কখনও বা কেশব ওকে নামিয়ে নিচ্ছিলো।

অল্পক্ষণেই ঢিবির পাদমূলে এসে হাজির হলো ওরা তিনজনা।

বনহুর বললো–আমরা অন্ধকারে আত্মগোপন করে জংলীদের অনুসরণ করবো। কেশব,নুরী–এসো তোমরা। আমার মনে হচ্ছে যে পথে জংলীগণ অগ্রসর হচ্ছে সেপথ কোনো গোপন আস্তানার পথ।

কেশব বললো–তাইতো, আমরা যেদিক থেকে পালিয়ে এসেছিলাম ওরা ঠিক তার বিপরীত দিকে চলে যাচ্ছে।

হাঁ, আমি তাই দেখতে চাই ওরা কোথায় যাচ্ছে। বনহুর কথাটা বলে চলতে লাগলো।

বললো নূরী–রংলালের দলকে ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

আমার মনেও সেই প্রশ্ন নূরী, আস্তানা ছেড়ে বিপরীত পথে কোথায় চলেছে ওরা কে জানে। কেশব, নূরী–তোমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে আমাকে অনুসরণ করো। হয় কার্যোদ্ধার হবে নয় জংলিদের হাতে প্রাণ যাবে।

উঃ! কি ভীষণ মানুষ তুমি? নূরী চলতে চলতে বললো।

 বনহুর বললো-ঘাবড়াবার সময় এটা নয়, কাজেই কথা না বলে নীরবে এসো।

মনে মনে নূরী আতঙ্কিত হলেও কোনো কথা না বলে চলতে লাগলো। জানে সে কোনো বাধা বিঘ্নই বনহুরকে তার সঙ্কল্প থেকে বিরত করতে সক্ষম হবে না।

ভীষণ জঙ্গলে গভীর রাত্রিতে জমাট অন্ধকারে অত্যন্ত সাবধানে চলতে হচ্ছিলো তাদের। অল্পক্ষণ পূর্বে জংলিগণ ঢাক বাজিয়ে মশাল জ্বালিয়ে চলে গেছে এই পথে, কাজেই হিংস্র জীবজন্তুর তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

জংলীদের মশালের আলো দূরে–অনেক দূরে সরে গেলেও রাত্রির অন্ধকারে বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিলো, তাছাড়া ঢাকের আওয়াজও গুরুগম্ভীর স্বরে ভেসে আসছিলো তাদের কানে।

জংলীদের অনুসরণ করে পথ চলতে কিছুমাত্র অসুবিধা হচ্ছিলো না বনহুরের দলের।

নূরীকে নিয়ে অবশ্য বেশ বিব্রত হচ্ছিলো বনহুর, কারণ সে অন্ধকারে বার বার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলো। বনহুর আর কেশব তাকে সাহায্য করছিলো।

ধীরে ধীরে জংলীদের মশালের আলো অস্পষ্ট হয়ে আসছে। ঢাকের আওয়াজ লক্ষ্য করে এগুতে লাগলো তারা। সেকি দুর্গম পথ! এ পথে মানুষ কখনও চলতে পারে! তদুপরি রাতের অন্ধকার।

অবিশ্রান্ত চলেছে ওরা।

এখন মশালের আলোর ক্ষীণ– রশ্মিও আর নজরে পড়ছে না। ঢাকের শব্দও ক্রমে অস্পষ্ট হয়ে আসছে।

তবু বনহুর, কেশব আর নূরীর চলার বিরাম নেই।

জংলিগণ যে বনহুরের দলের চলার গতির চেয়ে দ্বিগুণ বেশি জোরে চলছিলো তাতে কোনো ভুল নেই। কারণ জংলিদের চলার সঙ্গে পেরে উঠা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। অবশ্য বনহুর যদি একা হতো সে জংলীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গহন বনে আত্মগোপন করে একেবারে পৌঁছে যেতো তাদের অতি নিকটে।

কিন্তু নূরীর জন্যই বনহুর জংলীদের ঠিকভাবে অনুসরণ করে অগ্রসর হতে পারছিলো না।

ওদিকে ঢাকের আওয়াজও আর শোনা যাচ্ছে না।

ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে এসেছে ঢাকের শব্দ।

কেশব বললো–বাবু, এখন আমরা কোন্ পথে চলবো? ঢাকের আওয়াজ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছেনা আর?

হাঁ, অসুবিধা হবে এখন, তবু আমাদের যেতে হবে। দেখতে চাই জংলিগণ কোথায় গেলো।

 নীরবে অগ্রসর হচ্ছে ওরা।

ঢাকের শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না।

তবে বনহুর অনুমানে চলতে লাগলো যে পথে জংলীদের মশালের আলো অদৃশ্য হয়েছিলো। যেদিকে ঢাকের আওয়াজ মিশে গেছে ঠিক সেই পথ অনুসরণ করে অন্ধকারে এগুতে লাগলো।

বনহুর মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছে। যদিও গাঢ় জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে তারা চলেছে তবু বৃক্ষ-লতাপাতার ফাঁকে আকাশের কিঞ্চিৎ অংশ দেখা যাচ্ছিলো।

রাত প্রায় শেষ হয়ে এলো। ভোরের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। রাত যদি শেষ হয়ে যায়। তাহলে আত্মগোপন করা মুস্কিল হবে। বনহুর একটু চিন্তিত হলো।

আরও জোরে পা চালিয়ে অগ্রসর হলো তারা।

কিছুটা এগুতেই পুনরায় ঢাকের আওয়াজের ক্ষীণ শব্দ কর্ণগোচর হলো বনহুর, কেশব আর নূরীর।

শিউরে উঠলো নূরী–হুর, জংলিগণ বোধ হয় ফিরে আসছে।

বনহুর আর কেশব কান পেতে শুনতে লাগলো।

কেশব বললো-হাঁ, আমারও ঐ রকম মনে হচ্ছে।

বনহুর বললো–না ওরা ফিরে আসছে না। বোধ হয় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ঢাক বাজাচ্ছে। যাক তবু নিশ্চিন্ত হলাম, এবার আমরা অল্প সময়ে জংলীদের অনতিদূরে পৌঁছতে সক্ষম হবো।

বেশ কিছুক্ষণ চলার পর ঢাকের আওয়াজ আরও স্পষ্ট হতে স্পষ্টতর হয়ে কানে বাজতে লাগলো।

কেশব আর নূরীর মুখ ভয়ে বিবর্ণ হলেও বনহুরের মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হলো।

বেশ কিছুদূর অগ্রসর হবার পর ঢাকের আওয়াজ একেবারে স্পষ্ট শোনা যেতে লাগলো। কিন্তু মশালের আলো দৃষ্টিগোচর হলো না। বনহুর বললো নূরী, জংলিগণ কোনো গোপন জায়গায় স্থির হয়ে ঢাক বাজিয়ে চলেছে। দেখছো না ঢাকের আওয়াজ একভাবে বেজে চলেছে।

তাইতো ওরা অগ্রসর হচ্ছে না বা ফিরেও আসছে না, তা হলে শব্দ আরও জোরে কানে এসে বাজতো। কিন্তু আমার কেমন যেন ভয় করছে হুর?

এখন মন থেকে ভয়-ভীতি মুছে ফেলা নূরী। কেশব, তুমি নিশ্চয়ই ভয় পাওনি তাই না?

কেশব ভয় পেয়েছিলো নূরীর মতই কিন্তু বনহুরের এ কথার পর আর সে ভয় পাবার কথা বলতে পারলো না। কিছুই না বলে নিশ্চুপ চলতে লাগলো।

আর কিছুটা অগ্রসর হয়েই বনহুর, কেশব আর নূরী আরও বিস্মিত হলো–ঢাকের আওয়াজ এখন তারা একেবারে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু আওয়াজ স্পষ্ট হলেও কেমন যেন অস্পষ্ট ধরনের। মনে হচ্ছে, কোনো পাতালগহ্বর থেকে শব্দটা পৃথিবীর বুকে ভেসে আসছে।

আরও অবাক হলো ওরা তিনজন।

 ঢাকের শব্দ শোনা যাচ্ছে বটে কিন্তু মশালের আলো তো নজরে পড়ছে না।

তবু বনহুর, নূরী আর কেশব অগ্রসর হচ্ছে।

এখন কিন্তু ঢাকের আওয়াজ স্পষ্ট শোনা গেলেও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না আর কতদূর বা কোথায় জংলীদল ঢাক বাজাচ্ছে।

হঠাৎ বনহুরের দলের নজরে পড়লে–তাদের অনতিদূরে অন্ধকারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক পর্বতমালা। বনের পশ্চিম দক্ষিণজুড়ে জমাট অন্ধকারের মতই লাগছে পর্বতমালাগুলো।

অন্ধকারেও বনহুরের মুখ উজ্জ্বল হলো, আলো থাকলে নূরী আর কেশব লক্ষ্য করতো বটে, প্রশ্নও করে বসতো নানারকম। এসব প্রশ্নের জবাব বনহুর দিতো কিনা সন্দেহ। কিন্তু ওরা অন্ধকারে বনহুরের মুখোভাবের পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারছিলো না, কাজেই নীরবে শুধু অনুসরণ করছিলো তাকে।

সম্মুখে জমকালো রাক্ষসের মত পর্বতমালা লক্ষ্য করে নূরী আর কেশব দাঁড়িয়ে পড়লো।

বললো নূরী–এ যে পর্বতমালা, তবে কি জংলিগণ পর্বতের ওপাশে চলে গেছে?

কেশব বললো–আমারও সেই রকম মনে হচ্ছে বাবু। জংলিগণ নিশ্চয়ই পর্বতের ওপাশে গিয়ে ঢাক বাজাচ্ছে। তাই এমন অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

বনহুর বললো এবার–ওপাশে নয় কেশব, জংলিগণ এই পর্বতের ভিতরে প্রবেশ করেছে এবং সেখানে তাদের উৎসব চলছে।

নূরী অবাক কণ্ঠে বললো– পর্বতের ভিতরে, বলো বনহুর?

হ নূরী, দেখছো না শব্দটা কেমন গুরুগম্ভীর মনে হচ্ছে।

কেশব বললো–মশালের আলো কই? আলো তো নজরে পড়ছে না?

বললাম তো পর্বতের ভিতরে চলে গেছে ওরা। বললো বনহুর।

 এমন সময় দূরে মোরগের ডাক শোনা গেলো।

আকাশ ফর্সা না হলেও ভোর হবার লক্ষণ দেখা গেলো।

বনহুর বললো–দূরী, তোমরা এসো, জংলিগণ এখন হয়তো ফিরে যাবার জন্য পর্বতের মধ্য হতে বেরিয়ে আসবে। ওরা বের হবার পূর্বেই আমাদের লুকিয়ে পড়তে হবে। আর বিলম্ব করোনা তোমরা।

নূরী মাটিতে বসে পড়লো আমি চলতে পারছি না।

সেকি, উঠে পড়ো–এক্ষুণি হয়তো ওরা বেরিয়ে আসবে।

মিথ্যা নয়–বনহুরের কথা শেষ হয় না, হঠাৎ পর্বতের মধ্যে ঢাকের আওয়াজ দ্রুত এবং আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো।

বনহুর নূরীকে একরকম প্রায় টেনে নিয়ে চললো, কেশবও অনুসরণ করলো বনহুরকে। পর্বতের গায়ে আশে পাশে প্রচুর বৃক্ষ-লতা-গুল্ম রয়েছে, আর রয়েছে অসংখ্য ফাটল।

বনহুর নূরী আর কেশবকে নিয়ে লুকিয়ে পড়লো পর্বতের একটি ফাটলের মধ্যে। একি ফাটলটা যেন ভূমিকম্পের মত কাঁপছে। বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে নূরী আর কেশবকে লক্ষ্য করে বললো– এখান থেকে চলে নূরী-কেশব। এটাই জংলীদের পর্বতগুহার মুখ বলে মনে হচ্ছে।

সত্যিই ফাটলসহ পর্বতের কিছুটা অংশ যেন দুলে দুলে উঠছে। পায়ের নিচেও ভূমিকম্পের। মত কাঁপছে। বনহুর নূরী এবং কেশবসহ দ্রুত ফাটলের বাইরে বেরিয়ে এলো। অমনি ফাটলের মুখটা ভীষণভাবে নড়ে উঠলো।

বনহুর নূরী আর কেশবকে একটানে টেনে নিয়ে ওদিকে একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। ভাগ্য বলতে হবে পাথরের নিচেই একটা মস্ত বড় গর্ত। নূরী আর কেশবকে গর্তের ভিতরে লুকিয়ে দিয়ে নিজে পাথরের আড়ালে আত্মগোপন করে দেখতে লাগলো বনহুর।

আশ্চর্য হয়ে দেখলো বনহুর–পর্বতের গায়ে ফাটলটার ভিতর থেকে হুড় হুড় করে বেরিয়ে আসছে অসংখ্য জংলী দল। মশালের আলোতে বনভূমি আলোকিত হয়ে উঠলো। সকলের হাতে একটি করে মশাল।

জংলিগণ সবাই বেরিয়ে এলো, ঢাক বাজিয়ে যারা চলেছে তারা এখন সকলের পিছন সারিতে। কিন্তু অবাক হলো বনহুর-রংলালের দল এখন তাদের মধ্যে নেই।

বনহুর সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলো কিন্তু জংলিগণ তাকে দেখতে পাচ্ছিলো না। যদিও জংলীদের অবস্থান হতে সে বেশি দূরে ছিলো না।

জংলিগণ আনন্দে আত্মহারা।

সবাই ঢাক বাজিয়ে এবার ফিরে চললো।

যেমন সারিবদ্ধভাবে সবাই এসেছিলো তেমনি এখনও মিছিল হয়ে চললো। কোনোদিকে নজর ছিলো না ওদের। অবশ্য ওরা জানে এস্থানে তাদের জংলিগণ ছাড়া আর কারো গমন সাধ্য নেই।

জংলিগণ যখন পাথরখন্ডটার একেবারে পাশ কেটে চলে যাচ্ছিলো তখন বনহুর নিজকে গোপন করে রেখেছিলো পাথরের তলায় গর্তের মধ্যে যেখানে নূরী আর কেশব ছিলো। নূরী আর কেশবের অবস্থা মৃতপ্রায়– হঠাৎ যদি জংলীদের দৃষ্টি কোনক্রমে এদিকে আসে তাহলে আর উদ্ধার নেই।

বনহুরের হস্তে রিভলবার ও কেশবের হস্তে সূতীক্ষ্ণ-ধার ছোরা যদিও ছিলো তাহলেও অসংখ্য জংলীদের সঙ্গে পেরে ওঠা তাদের সাধ্য নয়। নৃশংস জংলী দলের হস্তে তীক্ষ্ণ-ধার বল্লাম-বর্শা ও আরও অনেক রকম লৌহ এবং পাথরের অস্ত্র রয়েছে।

রুদ্ধ নিশ্বাসে বনহুর কেশব আর নূরী দেখছে। তাদের চোখের সম্মুখ দিয়ে মোটা থামের মত কতকগুলো পা চলে গেলো সারিবদ্ধভাবে।

ঢাকের আওয়াজ এবং মশালের আলো স্তিমিত হয়ে আসছে ক্রমান্বয়ে।

হাফ ছেড়ে বাঁচালো বনহুর, কেশব আর নূরী।

 জংলীদের চলার ধরন অত্যন্ত দ্রুত; কাজেই অল্পক্ষণে জংলীর দল বহুদূরে চলে গেলো।

পাথরের ওপাশের গর্তের মধ্য থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। পূর্বদিকে তখন ফর্সা হয়ে এসেছে। প্রভাতের স্নিগ্ধ হাওয়া গহন জঙ্গলের জমাট অন্ধকার ভেদ করে একটা শীতল প্রলেপ বুলিয়ে দিয়ে গেলো তাদের সমস্ত দেহে।

পাখির কলরবে মুখর হয়ে উঠলো বনভূমি।

বনহুর বৃক্ষ-লতা-পাতার ফাঁকে তাকালো আকাশের দিকে। ভোরের আলোতে তার মুখমন্ডলকে দীপ্ত উজ্জ্বল মনে হলো। বনহুর হয়তো দয়াময়ের নিকট লাখ লাখ শুকরিয়া করে নিলো।

নূরীর হাত ধরে বললো বনহুর–এসো তোমরা।

কেশবও অনুসরণ করলো বনহুর আর নূরীকে।

যে ফাটলের মধ্যে থেকে জংলিগণ সারিবদ্ধভাবে বেরিয়ে এসেছিলো সেইদিকে অগ্রসর হলো তারা। বেশিদূর নয়–তাদের অনতি দূরেই সে ফাটলটা।

প্রথম বনহুর নূরী আর কেশবকে নিয়ে এই ফাটলের মধ্যেই লুকিয়েছিলো। সে কল্পনাও করতে পারেনি–এটা পর্বত মধ্যে প্রবেশের একটি সুড়ঙ্গমুখ।

বনহুর নূরী এবং কেশবসহ ফাটলমুখে এসে দাঁড়ালো। ঘন লতা-পাতা আর ছোট ছোট জঙ্গলের ফাঁকে মসৃণ একটা পথ নজরে পড়লো।

প্রভাতের আলো এখন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বৃক্ষাদির ফাঁকে সূর্যের আলো প্রবেশ করছে। একটু একটু করে। পাখিরা নীড় ছেড়ে ডানা মেলে আকাশে উড়ছে।

বনহুর ফাটলটার দক্ষিণ-পূর্ব পার্শ্বে তাকালো সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ ধ্বনি করে উঠলো–পেয়েছি পেয়েছি সাপুড়ে সর্দারের সেই গুপ্তরত্ন ভান্ডারের সন্ধান পেয়েছি।

কেশব আর নূরী অবাক হয়ে তাকালো।

বনহুর বললো–সাপুড়ে সর্দার বলেছিলো যেখানে পাশাপাশি পর্বতের তিনটি শৃঙ্গ–দু’পাশে দুটি ছোট ছোট শৃঙ্গ আর মাঝখানের শৃঙ্গটা আকারে বড় এবং ঠিক গরিলার মস্তকের মত দেখতে। সেটাই রত্নভাণ্ডার গুহার প্রবেশমুখ।

একসঙ্গে কেশব আর নূরী তাকালো সম্মুখস্থ পর্বতমালার দিকে। সত্যিই দু’পাশে দুটো আকারে ছোট শৃঙ্গ আর মাঝখানের শৃঙ্গটা প্রায় আকাশ চুম্বন করছে কিন্তু শৃঙ্গটার উপরিভাগ ঠিক একটি গরিলার মাথার মত।

বনহুর অগ্রসর হলো ফাটলটার দিকে।

জমকালো পাথরের গায়ে শেওলা জাতীয় পদার্থ জমে জমে মাটির স্তর তৈরি হয়েছে, তারই গায়ে নানা জাতীয় বৃক্ষ-লতা-গুল্ম সৃষ্টি করেছে ঝোপজাড় আর জংগল।

ফাটলটার মধ্যে প্রবেশ করলো ওরা তিনজন। কিন্তু বেশিদূর অগ্রসর হতে পারলো না। কিছুদূর এগুতেই দেখলো পাথরের বিরাট একটা চাপ দ্বারা ফাটলের মধ্যকার সুড়ঙ্গমুখ বন্ধ।

বনহুর থমকে দাঁড়ালো।

কেশব আর নূরীও দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলো।

 বনহুরের ললাটে দেখা দিলো চিন্তার ছাপ।

 কেশব বললো–বাবু, এখন কি করে ভিতরে যাবেন?

জংলীদল যখন এই পথে বেরিয়ে এসেছে তখন নিশ্চয়ই ওপাশে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তোমরা অপেক্ষা করো, আমি চেষ্টা করে দেখি।

নূরী ভীত কণ্ঠে বললো-জংলিগণ যদি হঠাৎ আবার এসে পড়ে?

বললো বনহুর–না এখন ওরা আর ফিরে আসবে না। বনহুর কৌশলে ফাটলের মুখের পাথর। বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো।

খাড়া পিচ্ছিল পাথর বেয়ে উঠা কম কথা নয়। বনহুর অত্যন্ত চেষ্টা করে উঠছিলো। ফাটলের আশে পাশে যে সব আগাছা বা লতা-গুল্ম ছিলো তারই শিকড় আঁকড়ে ধরে কোনোরকমে এগুচ্ছিলো।

নূরী আর কেশব বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো। কি অদ্ভুত কৌশলে বনহুর এগুচ্ছে উপরের দিকে। নূরী জীবনে বনহুরকে বহু অসাধ্য সাধন করতে দেখেছে। আজ যেন সে আরও বেশি আবাক হচ্ছে। নূরী যেমন বিস্মিত হচ্ছিলো তেমনি ভীতও হচ্ছিলো, হঠাৎ যদি পড়ে যায় তাহলে কি উপায় হবে! ফাটলের মুখে পাথরখানা অনেক উঁচু এবং খাড়া। নিচে কঠিন পাথর সমতল নয়, পাথরখন্ডগুলো লাল আকারের ছোট-বড় অনেক রকম।

অতো উঁচু থেকে পড়ে গেলে মৃত্যু সুনিশ্চয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

নূরী বনহুরকে নেমে আসার জন্য বার বার অনুরোধ করতে লাগলো। বনহুর কিন্তু তার কথা কানে না নিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। অত্যন্ত পরিশ্রমে নানা উপায়ে কিছুক্ষণেই অনেক উপরে উঠে গেছে বনহুর। সমস্ত দেহ তার ঘামে ভিজে চুপসে উঠেছে। হঠাৎ ফাটলের মধ্যে দেয়ালের গায়ে বিরাট এক অজগর বেরিয়ে এলো। জড়িয়ে ধরলো বনহুরের দেহটাকে অক্টোপাশের মত।

বনহুর কোনোরকম চিৎকার করবার পূর্বেই নূরী আর্তনাদ করে উঠলো–উঃ মা গো সর্বনাশ, হুর–সাপ–হুঁর–।

কেশব কি করবে, সেও আর্তনাদ করে শুরু করলো–হ্যায় এবার কি হবে কি হবে–বাঁচাও কে কোথায় আছো। কেশব নিচে লাফালাফি করতে লাগলো।

বনহুর এক হস্তে ফাটলের মধ্যের একটা শক্ত করে শিকড় ধরে অন্য হস্তে সাপটার কবল থেকে নিজকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো। রিভলভার অবশ্য তার পকেটেই আছে কিন্তু বের করার সুযোগ পাচ্ছে না।

পাথরটার উপরে সর্পরাজের সঙ্গে চললো ভীষণ লড়াই।

নূরী আর কেশব নিচে আর্ত-চিৎকার করে চললো।

নূরী যখন দু’হাতে চোখ ঢেকে আকুলভাবে কাঁদছে তখন হঠাৎ পর-পর দুটো শব্দ হলো, রিভলভারের আওয়াজ গুড় ম গুড় ম্। তারপরই উপর থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়তে লাগলো।

কেশব আর নূরী উপরের দিকে ভয়ার্ত নয়নে তাকালো। দেখলো –বনহুর বামহস্তে একটা শিকড় ধরে দক্ষিণ হস্তে সাপটাকে তার নিজের দেহ থেকে ছাড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করছে।

নূরী মনে মনে খোদার নাম স্মরণ করতে লাগলো।

অল্পক্ষণেই সাপটা কুন্ডলী পাকিয়ে থপ করে নিচে এসে পড়লো। সেকি বিরাট বিপুলদেহী অজগর সাপ। মাটিতে পড়ে উল্টে পালোট করতে লাগলো। রক্তে ভিজে উঠলো পাথরখন্ডের গা গুলো। ঠিক সাপটার বুকের কাছে রিভলভারের পর-পর দুটি গুলী বিদ্ধ হয়েছিলো।

গুলী করার পরই বনহুর রিভলভার পকেটে রেখেছিলো এবং সাপটাকে দক্ষিণ হস্তে শরীর থেকে মুক্ত করে নিচে ফেলে দিয়েছিলো। এতক্ষণে নূরী প্রাণভরে নিশ্বাস নিলো। পা দিয়ে সাপটাকে লাথি দিতে লাগলো সে ক্রুদ্ধ হয়ে।

ঠিক সেই মুহূর্তে বনহুরের আনন্দভরা কণ্ঠ শোনা গেলো পেয়েছি নূরী, পেয়েছি–

বনহুর পাথরের উপরিভাগে উঠে পড়েছিলো সে, ওদিকে নজর করতে দেখতে পেলো– পাথরটার অপর পাশে বড় আকারের একটা চাকার সংযোগ রয়েছে।

বনহুর পাথরটার উপরিভাগে উঠে পড়েছিলো সে ওদিকে নজর করতেই আশায়-আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে ‘পেয়েছি পেয়েছি’ বলে চিৎকার করে উঠেছিলো। বনহুর পাথরটার ফাঁক দিয়ে ওদিকে নজর করতেই দেখতে পেয়েছিলো-ওপাশে পাথরটার নিচের দিকে মস্ত বড় আকারের তিনটা পাথরের তৈরি চাকা। এবার বনহুর যেভাবে উপরে উঠে গিয়েছিলো, সেইভাবে দ্রুত নেমে এলো নীচে।

বনহুর বললো–কেশব, এবার এ পাথরখানা সরিয়ে ফেলার কৌশল জানতে পেরেছি। বনহুর কথা শেষ করে পাথরখানার পূর্ব ধারে গিয়ে ভীষণ জোরে ধাক্কা দিতে লাগলো। না, একটুও নড়লো না পাথরটা। বনহুরের সুন্দর মুখমন্ডল রাঙা হয়ে উঠলো। দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে বার বার ধাক্কা দিচ্ছে সে। কেশবও সাহায্য করতে লাগলো তার দেহের সমস্ত বল দিয়ে কিন্তু একচুল নড়লো না পাথরখানা।

বনহুর এবার গভীরভাবে কি যেন চিন্তা করতে লাগলো। যা হোক, বেশিক্ষণ বিলম্ব করাও সমাচীন নয়। হঠাৎ যদি জংলিগণ এসেই পড়ে তাহলে আর নিস্তার নেই। মরতেই হবে তখন।

বনহুর একটা পাথরখন্ডে বসে ভাবতে লাগলো।

নূরী এসে বনহুরের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। কেশবের উপস্থিতিতে বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলো নূরী। নিজের ওড়নার আঁচলে বনহুরের মুখের এবং গন্ডের ঘাম মুছে দিতে লাগলো।

একটু বিশ্রাম করে নিয়ে বনহুর উঠে পড়লো, পাথরটার চারিদিকে নিপুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। দেখতে লাগলো সে। হঠাৎ বনহুরের চোখেমুখে খুশি উপচে পড়লো, এবার বনহুর বুঝতে পেরেছে কি ভাবে এ পাথরটা সরানো যাবে। পাথরটার ঠিক পশ্চিম পাশে দাঁড়িয়ে চাপ দিতেই ধীরে ধীরে সেটা একপাশে সরে যেতে লাগলো।

পাথরখন্ডটা সরে যেতেই পর্বতমালার মধ্যে বেরিয়ে এলো একটা সুদীর্ঘ সুড়ঙ্গপথ। বনহুর অস্ফুট আনন্দধ্বনি করে উঠলো-হুঁররে, পেয়েছি পেয়েছি, সাপুড়ে সর্দারের সেই ভান্ডারের গুহা বনহুরের সুন্দর মুখমন্ডলে খুশি যেন উপচে পড়ছে। ওষ্ঠদ্বয় হাসিতে স্ফীত হয়ে উঠেছে। দু’চোখে করে পড়ছে একটা অদ্ভুত দ্যুতি।

বনহুর নূরী এবং কেশবসহ সুড়ঙ্গপথে অগ্রসর হলো।

সুড়ঙ্গপথে চলতে গিয়ে তেমন কোনো অসুবিধা হচ্ছিলো না। তবে অন্ধকারটা ক্রমেই গাঢ় হয়ে আসছে। বনহুরের হাতের মুঠোয় নূরীর হাত।

কেশব পিছনে তাকে অনুসরণ করছে।

সুড়ঙ্গমুখ ছেড়ে যতই ওরা ভিতরে প্রবেশ করছিলো ততই পৃথিবীর আলো নিভে আসছিলো। সুড়ঙ্গমুখ দিয়ে যতটুকু আলো আসছিলো এটুকু আলোই ছিল তাদের সম্বল। জংলিগণ মশাল হস্তে সুড়ঙ্গ মধ্যে প্রবেশ করে–তাই তাদের পৃথিবীর আলোর কোনো প্রয়োজন হয় না।

সুড়ঙ্গপথটা কিছুদূর অগ্রসর হয়েই বাঁদিকে মোড় ফিরেছে। বনহুর, নূরী এবং কেশব বামদিকে সুড়ঙ্গপথ ধরে কিছুটা এগুতেই আলোর ছটা তাদের চোখ বাঁধিয়ে দিলো। বনহুর বললো– মশালের আলো।

কেশব আর নূরী আঁতকে উঠলো, ভীত কণ্ঠে বললো–জংলীদের লোক এখনও আছে। এখানে?

দেখা যাক। বনহুর রিভলভার বের করে গুলী ভরে নিলো। বনহুরের চোরা পকেটে এখনও বেশ কয়েকটা গুলী মজুত আছে। সে আসবার সময় কিছু গুলী তার চোরা পকেটে লুকিয়ে নিয়েছিলো।

বনহুর সন্তর্পণে সম্মুখে এগুতে লাগলো।

তার পিছনে নূরী এবং কেশব।

বনহুরের হস্তে গুলী ভরা রিভলভার, কেশবের হস্তে সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা। নূরীও তার খোঁপার ভিতর দেহরক্ষী ছোরাখানা বের করে নিলো।

চারিদিকে তীক্ষ্ণ নজর নিক্ষেপ করে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলো বনহুর। কেশব আর নূরী তাকে অনুসরণ করছে।

এখানে সুড়ঙ্গ বেশ কিছুটা প্রশস্ত কিন্তু এদিকে ওদিকে তেমনি জমাট অন্ধকার। মশালের আলোরছটা আসছে বেশ কিছুটা দূর হতে।

বনহুর নূরী আর কেশব আলোর ছটা লক্ষ্য করে সেদিকে এগুতে লাগলো। বিরাট গুহা, যেন একটা প্রাসাদ। পর-পর কয়েকটা সুড়ঙ্গমুখ রয়েছে প্রত্যেকটা সুড়ঙ্গমুখে এককালে লৌহ কপাট ছিলো বলে মনে হচ্ছে–এখন অবশ্য লৌহ কপাটের কিছু কিছু ভগ্ন অংশ দেখা যাচ্ছে।

বনহুর যত এগুচ্ছে ততই তার বিস্ময় বাড়ছে।

এখন তারা আলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। গুহার ঠিক মাঝখানে নজর পড়তেই নূরী দু’হাতে চোখ ঢেকে আর্তচিৎকার করে উঠলো।

বনহুর আর কেশব দেখলো–সুড়ঙ্গ মধ্যে ঠিক মাঝখানের প্রশস্ত একটি জায়গায় কয়েকটা মস্তকহীন মৃতদেহে ঝুলছে। পা উপরের দিকে মাথাটা ঠিক নিচের দিকে ঝোলানো। প্রত্যেকটা মৃতদেহের নিচে এক একটি মাটির গামলা দেওয়া রয়েছে। কিন্তু গামলায় রক্ত নেই সামান্য কিছু রক্ত তখন গামলাগুলোর তলায় জমাট বেঁধে আছে।

বনহুর ফিরে তাকালো নূরীর দিকে নৃরী ঢলে পড়ে যাচ্ছিলো, ধরে ফেললো বনহুর।

কেশব ভয়ার্তস্বরে বললো–বাবু এ যে দেখছি–কথা শেষ না করে কাঁপতে থাকে কেশব ঠক ঠক করে।

বনহুরের হাতের উপর নূরীর সংজ্ঞাহীন দেহটা এলিয়ে পড়েছে। বনহুর বললো–হ কেশব তোমার অনুমান ঠিক এই যে মৃতদেহগুলো দেখছো এগুলো রংলালের দলের। ঐ দেখো মাঝখানের মস্তকহীন দেহটা রংলালের বলে মনে হচ্ছে।

কেশব ভীত নজরে তাকিয়ে বললো–হাঁ বাবু, ঐ তো রংলালের দেহ। বাবু জংলীরা ওদের। অমনভাবে কেটে ফেলেছে কেন?

জংলীরা ওদের মস্তক কেটে রক্ত পান করেছে। ঐ দেখছে না প্রত্যেকটা মৃতদেহের নিচে মাটির গামলা দেওয়া রয়েছে।

দেয়ালে কতকগুলো মশাল পোতা রয়েছে তারই আলোতে সব স্পষ্ট দেখাচ্ছিলো।

বললো বনহুর–কেশব, জংলিগণ আজ এখানে নর-রক্ত পান করে উৎসব পালন করেছে।

পর-পর কাষ্ঠখন্ডে মৃতদেহগুলো ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। প্রত্যেকটা দেহের অদূরে তাদের ছিন্ন মস্তক পড়ে আছে। সেকি বীভৎস দৃশ্য! কেশব কিছুতেই এ দৃশ্য সহ্য করতে পারছিলো না, সে দু হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লো। নূরীর অবস্থা আরও সঙ্কটময়, সংজ্ঞাহীন নূরীর দেহটা এখনও বনহুরের বাহুর মধ্যে আবদ্ধ।

বনহুর স্থিরভাবে তাকিয়ে দেখছে জংলীদের নৃশংস হত্যার শেষ পরিণতি। রংলালের দলে ছিলো কয়েকজন তার মধ্যে একজন ব্যাঘ্ৰ কবলে প্রাণ দিয়েছে। আর বাকীগুলোর শেষ পরিণতি জংলীদের হাতে হয়েছে। কঠিন প্রাণ বনহুরের–তবু সে কেমন যেন বিব্রত হয়ে পড়লো।

বনহুর নূরীকে নিয়ে সরে গেলো সেখান থেকে।

কেশব অগত্যা বনহুরকে অনুসরণ করলো। কিছুটা এগুতেই দেখলো ওদিকে একটা উঁচু ঠিক আসনের মত জায়গা। বনহুর নূরীকে শুইয়ে ওর মাথাটা তুলে নিলো কোলে, বার বার ডাকতে লাগলো–নূরী, নূরী, নূরী–

অল্পক্ষণ পর নূরী চোখ মেলে তাকালো।

বনহুর বললো–নূরী, শক্ত হতে হবে। এতো সহজে, এতো সামান্যে সংজ্ঞা হারালে চলবে কি করে? উঠো নূরী, তুমি না দস্যু বনহুরের সঙ্গিনী।

নূরী চারিদিকে ভয়ার্ত নজরে তাকিয়ে দেখতে লাগলো পরে কম্পিত কণ্ঠে বললো– মৃতদেহগুলো কার বনহুর?

সে পরে শুনো এখন উঠো দেখি। বনহুর নূরীকে উঁচু করে তুলে ধরলো এবং নূরীসহ দাঁড়াতে চেষ্টা করলো।

বনহুরকে ধরে উঠে দাঁড়ালো নূরী। কিছুক্ষণে সুস্থ হয়ে উঠলো সে।

নূরীকে এবার মৃতদেহের দিকে না নিয়ে অন্যদিকে এগুলো বনহুর। হঠাৎ তার নজর চলে গেলো অদূরে–দেখলো কতকগুলো লৌহ সিন্দুক স্তরে স্তরে সাজানো। সিন্দুকগুলোর প্রত্যেকটার গায়ে শিকল আটকানো রয়েছে।

বনহুর কেশব আর নূরী দ্রুত অগ্রসর হলো।

বনহুর একটা মশাল তুলে নিলো হাতে। মশালগুলো জ্বলে জ্বলে প্রায় নিভু নিভু হয়ে এসেছিলো। জংলিগণ চলে যাবার সময় কতকগুলো মশাল রেখেই গিয়েছিলো।

মশাল হস্তে বনহুর লৌহ সিন্দুকের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। বনহুরের চোখ দুটো যেন দীপ্ত হয়ে উঠেছে।

লৌহ সিন্দুকের ডালা খুলে ফেললো বনহুর। অমনি মশালের আলোতে সিন্দুকের মধ্যস্থ বস্তুগুলো থেকে উজ্জ্বল দ্যুতি ঠিকরে পড়তে লাগলো। চোখ ঝলসানো নীলাভ আলোকরশ্মির মত ছটা।

নূরী আর কেশব ভুলে গেলো বীভৎস মৃতদেহগুলোর কথা। মন থেকে ভয় যেন মুছে গেলো মুহূর্তে। নূরী দু’হাতে যতটুকু আঁচল ভরে তুলে নিয়ে উচ্ছল কণ্ঠে বললো–হুঁর, এ যে মনি-মুক্তা আর হীরে। মনি-মুক্ত-হীরে আঁচল ভরে নিতে লাগলো নূরী।

হেসে বললো বনহুর–সবই এখন তোমার। কত নেবে নূরী নাও।

বনহুর দ্বিতীয় সিন্দুকটা খুলে ফেললো এবার।

নূরী আর কেশবের চোখে বিস্ময়ের পর বিস্ময় জাগলো। বনহুরের আস্তানায় বহু ধন-রত্ন মনি মুক্তার অলঙ্কার আছে কিন্তু এতো তো নেই। লুট করে যা নিয়ে আসে বনহুর তা তো জমিয়ে রাখে না সে বিলিয়ে দেয় দীনহীন গরিবদের মধ্যে। আজ একসঙ্গে এতোগুলো মনি-মুক্তা আর হীরক অলঙ্কার দেখে বনহুরের চোখেও বিস্ময় জাগে।

কেশব তো হতভম্ব হয়ে গেছে।

বনহুর পর-পর কয়েকটা সিন্দুক খুলে দেখে নিলো। সবগুলো মনি-মুক্তা আর হীরে-সোনা দানায় পরিপূর্ণ। সর্বশেষ দুটো সিন্দুক খুলে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে হতবাক হলো বনহুর। অবাক হয়ে দেখলো–এ দুটো সিন্দুকে শুধু রয়েছে স্বর্ণ মোহর। অদ্ভুত ধরনের এ মোহরগুলো।

বনহুর একটা মোহর তুলে নিয়ে এপিঠ-ওপিঠ উল্টে দেখে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো–শত শত বছর পূর্বের এ মোহর।

কেশব আর নূরীও হাতে তুলে নিলো, অবাক হয়ে দেখতে লাগলো মোহরে কোনোরকম সন তারিখ নেই, শুধু ভয়ঙ্কর জীবজন্তু আর অদ্ভুত সব মূর্তি আঁকা রয়েছে। বনহুর গুহার মধ্যে ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলো। এক একটা কামরার মত ছোট-বড় অনেক গুহা রয়েছে। পর্বতমালার মধ্যে যে এমন ফাঁকা আর অনেকগুলো গুহা পাশাপাশি থাকতে পারে বিস্ময়কর ব্যাপার।

বনহুর তার নিজের আস্তানা তৈরি করেছে কৌশলে নানা পদ্ধতিতে অত্যদিক বিস্ময়করভাবে কিন্তু এ গুহা যে তার চেয়েও বিস্ময়কর। পাথর কেটে কেটে তৈরি করা হয়েছে, দুর্গম সুড়ঙ্গ পথ আর বিভিন্ন ধরনের গুহা। হঠাৎ গুহার মধ্যে প্রবেশ করতেই বনহুর চমকে উঠলো। এ গুহাটা জমাট অন্ধকার এবং অত্যন্ত জঙ্গলাকীর্ণ। মাকড়সার জাল আর নানারকম পোকামাকড়ের ভীড়। মানুষের সাড়া পেয়ে বড় বড় মাকড়সাগুলো জাল বেয়ে এদিক ওদিক ছুটে পালাতে লাগলো।

বনহুরের হস্তে তখনও মশাল ছিলো। মশালের আলোতে সে দেখতে পেলো এক একটা মাকড়সার চোখ যেন মশালের আলোতে জ্বলছে। কেমন যেন কটমট করে তাকাচ্ছে ওরা। অন্ধকার গুহার প্রেত আত্মার মতই লাগলো।

বনহুর মশাল উঁচু করে এগুতেই মাকড়সা এবং অন্যান্য জীবজন্তুগুলো সরে যেতে লাগলো। বনহুর মশালের আলোতে এবার গুহাটার মেঝেতে নজর ফেললো। চমকে উঠলো বনহুর অসংখ্য লৌহ-অস্ত্র স্তূপাকার হয়ে পড়ে আছে। যদিও সেগুলো মরচে ধরা এবং অযত্নে বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে আছে তবু বেশ বোঝা যাচ্ছে সেগুলো বহু পুরোনকালের অস্ত্রশস্ত্র। বনহুর অবাক হয়ে এসব অস্ত্র দেখতে লাগলো। যতই দেখছে ততই যেন দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময় জাগছে। আরও কিছুটা এগুলো সে মশাল উঁচু করে দেখতে লাগলো সে। বুঝতে পারলো বনহুর–এই গুহাটি সম্পূর্ণ কোনো দস্যুর আস্তানা ছিলো। মারাঠা জলদস্যুদের আস্তানা হবে। বনহুর স্তূপাকার অস্ত্রগুলোর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। মরচে ধরা অস্ত্রগুলো হাতে তুলে নিয়ে দেখতে লাগলো অবাক হয়ে।

এমন সময় নূরী কোঁচড়ে এক গাদা মনি মুক্তা আর হীরক নিয়ে বনহুরের পাশে এসে দাঁড়ালো কেশবও এসে পড়লো নূরীর সঙ্গে।

নূরী বললো– বনহুর কি দেখছো? এগুলো কি?

 বনহুর অস্ত্রগুলো নেড়ে-চেড়ে দেখতে দেখতে বললো–এগুলো অস্ত্র।

অস্ত্র!

 হ নূরী বহু বছর আগের অস্ত্র এগুলো। দেখছো না মরচে ধরে কেমন জিরজিরে হয়ে গেছে।

কেশব ততক্ষণে মরচে ধরা জরাজীর্ণ অস্ত্রগুলো হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখছে। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো সে–এগুলো কি ধরনের অস্ত্র বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু?

বনহুর বললো–বহুদিন পূর্বে এ ধরনের অস্ত্রই ব্যবহৃত হতো। কোনো মারাঠা জলদস্যুর আস্তানা ছিলো এ গুহা। এসব অস্ত্র এবং ধনরত্ন সবই সেই দস্যুদের।

বললো কেশব–তাহলে জংলীরা এখানে কি করে সন্ধান পেলো?

বহুকাল আগের এ গুহা দস্যুদের অস্তিত্ব মুছে যাবার পর জংলীদের কবলে এসে গেছে বলে মনে হচ্ছে। উঠে দাঁড়ালো বনহুর আরও ভিতরের দিকে এগুতে লাগালো সে। নূরী হাত চেপে ধরলো বনহুরের না না, যেও না ওদিকে।

বনহুর বললো–সব কিছু আমি দেখতে চাই নূরী।

আমার গা কিন্তু কাঁটা দিয়ে উঠছে।

কেশবের মুখে কোনো কথা নেই।

বনহুর হেসে বললো–মৃত্যুগহ্বরে এসে মৃত্যুকে ভয় করলে চলবে কি করে? এসো আমার সঙ্গে।

বনহুর নূরী আর কেশবসহ অগ্রসর হলো। দক্ষিণ হস্তে তার জ্বলন্ত মশাল রয়েছে।

 মানুষের সাড়াশব্দ পেয়ে নানারকম জীব এদিক-সেদিক ছুটে পালাতে লাগলো। মাকড়সা, বাদুড়, বিছা অগণিত রয়েছে। কিছুটা এগুতেই একটা সাপ ফোঁস করে উঠলো।

নূরী আর্তনাদ করে বনহুরকে আঁকড়ে ধরলো।

 বনহুর মশাল উঁচু করে বাড়িয়ে ধরতেই সাপটা সরে গেলো ওদিকে।

মাকড়সাগুলোর চোখ দেখে নূরী ভীত হলো, বললো–ওগুলো কামড়ে দেবে হুর।

কেশব বললো–বাবু আর না যাওয়াই ভাল। এ সব গুহায় মানুষ আসে না।

নূরী বললো–হুঁর জংলিগণ তাহলে এসব দিকে আসে না বুঝি?

হাঁ, ওরা এসব গুহায় আসে না বা দেখেনি বলেই মনে হয়। জংলিগণ সম্মুখে যা দেখেছে বা পেয়েছে তাই নিয়েই খুশি হয়েছে। এসব দেখার মত সখ তাদের নেই।

কি হবে এসব দেখে বলো তো? আমার কিন্তু বড্ড ভয় করছে। কথাগুলো বলে নূরী বনহুরের জামার আস্তিন চেপে ধরে এগুতে লাগলো।

ওদিকে কিছুটা অগ্রসর হতেই বনহুর থমকে দাঁড়ালো। সম্মুখে একটা বিরাট পাথর পথ রোধ করে পড়ে আছে। হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি চলে গেলো পাথরটার নিচে। বিস্ময়ের পর বিস্ময় জাগলো, দেখলো পাথরের নিচে চাপা পড়ে আছে কতকগুলো কঙ্কাল। কারো বা মাথা ভিতরে শুধু অর্ধেকটা বাইরে, আর কোনটার সম্মুখভাগ বাইরে–পিছন দিকটা ভিতরে।

বনহুর অবাক চোখে দেখছে। ভাবছে, ব্যাপার কি এমন কেন! হাঁটু গেড়ে বসে একটা কঙ্কালে হাত দিলো বনহুর। সঙ্গে সঙ্গে কঙ্কালের হাড়গুলো ঝরে গুড়ো হয়ে খসে পড়লো।

উঠে দাঁড়ালো বনহুর বললো –নূরী, ওপাশে আমাকে যেতে হবে।

ওপাশে? অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করলো বনহুর।

হাঁ এই পাথরের চাপটার ওপাশে আমি যেতে চাই।

সর্বনাশ, ওপাশে কি করে যাবে তুমি?

যাওয়াটা অত্যন্ত অসম্ভব নূরী, কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। আমি দেখতে চাই ওপাশে কি আছে।

আচ্ছা লোক তুমি হুর, দেখছো মানুষের কঙ্কাল চাপা পড়ে আছে? নিশ্চয়ই ওপাশে ভয়ঙ্কর কোনো বিপদ ওৎ পেতে আছে।

বিপদ– হাঃ হাঃ হাঃ অট্টহাসি হেসে উঠলো বনহুর। সে ভয়ঙ্কর হাসির শব্দে অন্ধকার গুহা থর থর করে যেন কেঁপে উঠলো।

কেশব আর নূরীর অন্তর শিউরে উঠলো।

ভয়ার্ত চোখে তাকালো ওরা বনহুরের মুখের দিকে।

বনহুর মশালটা কেশবের হাতে দিয়ে পাথরটার পাশে এসে দাঁড়ালো। ভীষণভাবে দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠেলে ফেলে দেবার চেষ্টা করতে লাগলো। হঠাৎ নড়ে উঠলো পাথরটা, সঙ্গে। সঙ্গে কাৎ হয়ে পড়লো এক পাশে।

ভাগ্যিস কেশব আর নূরী সরে গিয়েছিলো সেখান থেকে। পাথরটা ঠিক ঐ জায়গায় এসে গড়িয়ে পড়লো যেখানে একটু পূর্বে কেশব আর নূরী দাঁড়িয়েছিলো।

পাথরটা সরে যেতেই একটা পথ বেরিয়ে এলো। একটা জমাট অন্ধকার গুহা। পাথরটা সরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা ভ্যাপসা গ্যাসের মত গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত গুহাটার মধ্যে।

বনহুর, কেশব এবং নূরী একসঙ্গে নাকে হাত চাপা দিলো। মাথা কেমন যেন ঝিম ঝিম করতে লাগলো তাদের। কিছুক্ষণ লাগলো তাদের সামলে নিতে।

বনহুর বললো–বহুদিন ঐ গুহায় হাওয়া প্রবেশ না করায় এই গ্যাস সৃষ্টি হয়েছে।

অপেক্ষা করলো বনহুর কিছু সময়, তারপর নূরী এবং কেশবের বাধা বিপত্তি অগ্রাহ্য করে প্রবেশ করলো সেই বদ্ধ গুহায়।

বনহুরের হস্তে তখন মশাল রয়েছে।

সেই বদ্ধ গুহায় প্রবেশ করতেই বনহুর বিস্ময়ে স্তব্দ হয়ে পড়লো। এ গুহাটা সবচেয়ে বড় এবং প্রশস্ত। কিন্তু মেঝেতে নজর করতেই আড়ষ্ট হলো সে, অগণিত নর-কঙ্কাল গুহার মধ্যে বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে পড়ে আছে। যদিও নানারকম ময়লায় কঙ্কালগুলো ঢাকা পড়ার জোগাড় হয়েছে। তবু বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কঙ্কালগুলো মানুষের ছাড়া আর কিছুর নয়।

বনহুরের ললাটে গভীর চিন্তারেখা ফুটে উঠলো। এই বদ্ধ গুহায় এতোগুলো নরকঙ্কাল এক সঙ্গে কেন? তাছাড়াও কিছু সংখ্যক নরকঙ্কাল সম্মুখস্থ পাথরখন্ডটার তলায় চাপা পড়ে থাকতে। দেখলো সে। এবার বনহুর চারিদিকে লক্ষ্য করে বুঝতে পারলো যে, গুহার মধ্যে এখন বনহুর। বোঝা মুস্কিল।

গভীরভাবে বনহুর চিন্তা করতেই বুঝতে পারলো মারাঠা দস্যুগণ হয়তোবা এই গুহা মধ্যে বসে শলা-পরামর্শ করছিলো কিংবা দরবার বসেছিলো তাদের, হয়তো ঠিক সেই সময় সহসা। কোনো দৈব-দুর্বিপাকে পড়ে দস্যুদল সেখানেই অঘোরে প্রাণ হারায়।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বনহুর। বহুদিন পূর্বের একটি দস্যুদলের স্মৃতি ভেসে উঠে তার মানসপটে। সুউচ্চ আসনে উপবিষ্ট দলপতি, ভীমকায় বিরাটদেহী এক পুরুষ।

দুচোখে তার আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। সম্মুখে দন্ডায়মান অগণিত দস্যু। সবাই স্থির নয়নে তাকিয়ে আছে দলপতির দিকে। দলপতি গুরুগম্ভীর কণ্ঠে তার অনুচরদের প্রতি আদেশ দান করছে।

মনোযোগ সহকারে শুনছে অনুচরগণ। ঠিক সেই মুহূর্তে ভীষণ!

কোন দৈব বিপর্যয়ে একসাথে প্রাণ হারায় দদল। হায়রে জীবন! চিরদিনের সঞ্চিত রত্ন ভান্ডার ত্যাগ করে চলে যেতে হলো!

বনহুর আনমনা হয়ে পড়েছিলো, হঠাৎ নূরীর করুণ কণ্ঠস্বরে সম্বিৎ ফিরে আসে তার।

নূরী ডাকে–বনহুর, শিঘ এসো,জংলীরা এসে পড়বে। এসো, তোমার পায়ে পড়ি হুর, শিঘ্র এসো তুমি…

বনহুর আর বিলম্ব না করে ফিরে আসে দ্রুত নূরী আর কেশবের পাশে। আর এখানে দেরী করা মোটেই উচিত নয়।

বনহুর নূরী এবং কেশব ফিরে আসে রত্ন ভরা সিন্দুকগুলোর পাশে।

বনহুর বলে এবার–নূরী এসব তুমি নিতে চাও?

হাঁ নিতে চাই হুর। কিন্ত আমি অবাক হচ্ছি, তুমি আমাকে এ প্রশ্ন করলে কেন? তুমি কি এ সব চাও না?

হেসে বললো বনহুর– এ সব নিয়ে কি হবে নূরী? এ সবে কিইবা প্রয়োজন আমার?

এ তুমি কি বলছো হুর?

 ঠিকই বলছি।

 তবে এত করে কেন এলে এখানে? সাপুড়ে সর্দারের জীবনই বা গেলো কেন? আর…

বেশ চলো, কত নিতে চাও নাও।

কেশব বললো–সিন্দুকগুলোসহ নিয়ে যাওয়া যায় না কি?

যায়, কিন্তু নেবে কেমন করে? গহন জঙ্গলে যানবাহন তো আর নেই। তাছাড়া ওগুলো যৎসামান্য ভার নয়, প্রায় অনেক ওজন হবে।

নূরী তখন আঁচলে যা নিয়েছিলো সেগুলো আরও ভালভাবে পুটলী করে বাঁধতে থাকে।

 কেশব তার জামাটা ভূতলে পেতে যতটুকু ধরে নিতে থাকে।

বনহুর তখনও গুহামধ্যে চারিদিকে তাকিয়ে দেখছিলো।

যতই দেখছে ততই যেন ওর দেখার বাসনা জাগছে। কত দিন আগের কতরকম স্মৃতি জড়িয়ে আছে এসব গুহার মধ্যে। বনহুর এবার গুহার পশ্চিমদিকে অগ্রসর হলো। অনেকটা এগিয়ে গেছে। বনহুর–এমন সময় একটা শব্দ ভেসে এলো তার কানে। কান পেতে স্থির হয়ে দাঁড়ালো বনহুর। অল্পক্ষণ শোনার পর বুঝতে পারলো, নিকটেই কোথাও জলপ্রপাতের শব্দ এটা। বনহুর আরও দ্রুত এগুতে লাগলো।

ওদিকে একেবারে গুহার শেষ প্রান্তে গিয়ে বনহুর চমকে দাঁড়ালো। স্পষ্ট দেখলো–একটা সুড়ঙ্গমুখ রয়েছে সেখানে এবং সেই মুখে লৌহকপাট আটকানো আছে।

বনহুরের মুখ খুশিতে দীপ্ত হলো, এদিকে যে এমন একটা গোপন পথ আছে, কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। বনহুর দৃঢ় হস্তে জিরজিরে লৌহকপাটে ঝাঁকুনি দিলো। লৌহকপাট হলেও অনেক দিনের অব্যবহারে মরচে ধরে একেবারে অকেজো হয়ে পড়েছিলো। বনহুরের দৃঢ়হস্তের ঝাঁকুনিতে খসে পড়লো ভূতলে।

সঙ্গে সঙ্গে একটা সচ্ছ শীতল হাওয়া বনহুরকে আলিঙ্গন জানালো। বনহুর কিছুটা এগিয়ে গিয়ে তাকাতেই দেখলো–ঠিক তাদের গুহার এই গোপন সুড়ঙ্গমুখের অতি নিকটেই বেয়ে চলেছে একটি জলপ্রপাত। ঠিক পাহাড়িয়া নদী বলা চলে। ভালভাবে লক্ষ্য করতে বনহুর দেখলো– সুড়ঙ্গমুখের সঙ্গে সিঁড়ির ধাপের মত কতকগুলো ধাপ চলে গেছে নিচের দিকে ঠিক জলপ্রপাতের নিকটে।

সুড়ঙ্গমুখে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখা যায়।

বনহুর আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রাণভরে নীল আকাশটা দেখে নিলো। এ সুড়ঙ্গমুখ এবং জলপ্রপাতটা পর্বতের ঠিক অপর পাড়ে।

এবার বনহুর তাড়াতাড়ি নূরী এবং কেশবের নিকটে এসে বললো–গুহা থেকে বের হবার দ্বিতীয় পথ পেয়েছি।

নূরী আর কেশব কি করে রত্নগুলো ভালভাবে নিতে পারবে সেই চেষ্টা করছিলো। বনহুরের কথায় খুশিতে আনন্দধ্বনি করে উঠলো।

বনহুর বললো–রেখে দাও ওসব, আগে চলো দেখা যাক্ জলপ্রপাত বেয়ে! যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না।

জলপ্রপাত বেয়ে! এ তুমি কি বলছো বনহুর?

 হা চলো দেখবে।

বনহুর নূরী এবং কেশবসহ গুহার শেষভাগে সুড়ঙ্গমুখে এসে দাঁড়ালো। মুক্ত আলো-বাতাস তার চোখেমুখে লাগতেই এবং জলপ্রপাতে নজর পড়তেই উচ্ছল হয়ে উঠলো সে খুশিতে। সোনালী সূর্যের আলো রূপালী জলপ্রপাতে পড়ে অপূর্ব সুন্দর লাগছিলো।

নূরী বনহুরের দক্ষিণ হাতখানা চেপে ধরে খুশিভরা কণ্ঠে বললো–হুঁর, কি সুন্দর–না?

বনহুর তখন গম্ভীর কণ্ঠে বললো–সুন্দরের মাধুর্য উপভোগ করার সময় এখন নয়। কি করে আমরা এখন এ গুহা থেকে জংলীদের নিষ্ঠুর দৃষ্টি এড়িয়ে চলে যেতে পারি, সেই চিন্তা করতে হবে।

বনহুরের কথায় নূরীর মুখ চিন্তাযুক্ত হলো।

 কেশব বললো–ভয়ানক দুশ্চিন্তার কথা বাবু, কি করে এখান হতে যাওয়া যাবে?

উপায় একটা করতেই হবে কেশব। বনহুর সুড়ঙ্গমুখে দাঁড়িয়ে তাকাতে লাগলো দূরে চারিদিকে। সুড়ঙ্গমুখের উপরেই সুউচ্চ পর্বতমালার শ্রেণীবদ্ধ শৃঙ্গ, আর নীচে জলপ্রপাতের কাকচক্ষুর ন্যায় সচ্ছ জলরাশি পর্বতমালার গায়ে অসংখ্য গাছ-পাছড়া আর লতাগুল্ম আচ্ছাদিত।

বনহুর ভ্রূকুঞ্চিত করে কি যেন ভাবলো, তারপর বললো–এসো কেশব, আমাদের জলপথেই পালাতে হবে।

জলপথে! অবাক কণ্ঠে বললো নূরী।

বললো বনহুর–হ, জলপথে–জলপথে পালানো ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই।

কিন্তু কি করে তা সম্ভব বাবু? বললো কেশব।

সম্ভব করে নিতে হবে, বুঝলে? এসো তোমরা আমার সঙ্গে। বনহুর নূরী আর কেশবসহ সুড়ঙ্গমুখের বাইরে পা বাড়ালো। এদিকে ঘন জঙ্গল বা অন্ধকারময় নয়। পরিষ্কার আকাশ দেখা যাচ্ছে। বনহুর ওদের নিয়ে পর্বতের গা বেয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগলো।

পর্বতের গা অত্যন্ত খাড়া ছিলো, নূরী এবং কেশবের উঠতে খুবকষ্ট হচ্ছিলো। বনহুর নূরীর হাত ধরে তাকে সাহায্য করছিলো। নূরী এবং কেশব ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছিলো। ঠিকভাবে চলতে পারছিলো না তারা। বনহুরের ক্ষুধাও কম নয় তবে সে সহ্য করতে পারে। কতদিন সে প্রায় সপ্তাহ না খেয়ে কাটিয়েছে হয়তো সামান্য পানি বা ফলমূল খেয়ে তাকে মাসের পর মাস জীবন কাটাতে হয়েছে। কাজেই এসব তার কাছে অতি সামান্য ব্যাপার।

বনহুর আর কেশব মিলে গাছ-গাছড়া কেটে এবং মোটা মোটা লতাপাতা দিয়ে কাঠের একটা ভেলা তৈরি করতে শুরু করে দিলো।

বনহুর এবং কেশবের কাছে সূতীক্ষ্ণ-ধার ছোরা ছিলো, কাজেই ভেলা তৈরির ব্যাপারে তেমন বেগ পেতে হলো না।

কিন্তু এখন সবচেয়ে বেশি সমস্যা হলো খাবে কি ওরা।

নূরী নিজের চেয়ে বেশি চিন্তিত হলো তার বনহুরের জন্য। অত্যন্ত পরিশ্রমে বনহুরের সুন্দর মুখমন্ডল রাঙা হয়ে উঠেছিলো। ললাট বেয়ে ঘাম ঝরছিলো দরদর করে। বার বার বনহুর হাতের পিঠে ললাটের ঘাম মুছে ফেলছিলো।

নূরী বললো–আর কত খাটবে? সত্যি তোমার কষ্ট আমার মনকে বিচলিত করছে হুর।

হাসলো বনহুর, কোনো জবাব দিলো না।

অবিরাম প্রচেষ্টায় একটি সুন্দর মজবুত ভেলা তৈরি করে ফেললো বনহুর আর কেশব। গাছপালার ডাল এবং লতাপাতা দিয়েই তৈরি হলো ভেলাটা।

এবার বনহুর বললো–এখন খাবার অন্বেষণে চলো কেশব।

এই বন-জঙ্গল আর পর্বতে খাবার? অবাক হয়ে বললো কেশব।

হয়তো ভাগ্য প্রসন্ন হলে খাবার জুটেও যেতে পারে। বনহুর কেশবসহ অগ্রসর হলো।

নূরীও অনুসরণ করছিলো, বললো বনহুর–তোমার যেতে হবে না নূরী তুমি এখানে বসে থাকো।

নূরীর পা দুখানা অবশ হয়ে পড়েছিলো যেন। বড্ড ক্লান্তি বোধ করছিলো সে, বনহুরের কথায় সে বসে পড়লো ভেলাটার উপরে।

বনহুর আর কেশব চলে গেলো।

ক্ষুধায় কাতর শুধু বনহুর নয়–কেশব আর নূরীর জন্য অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়েছিলো সে। তাছাড়া ভেলায় চেপে জলস্রোতে ভাসবার পূর্বে কিছু খাবারের নিতান্ত প্রয়োজন।

বনহুর আর কেশব হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলো দূরে–অনেক দূরে। এদিকে পর্বতের গায়ে জঙ্গল বেশ ফাঁকা ও স্বল্প। প্রায় বৃক্ষই ফলশূন্য, তবে মাঝে মাঝে দু’একটা ফলযুক্ত বৃক্ষ নজরে। পড়তে লাগলো। কিন্তু সেসব ফল ভক্ষণ উপযোগী নয়।

বনহুর আর কেশব তবু এগিয়ে চলেছে।

বসে বসে ঝিমুচ্ছিলো নূরী।

ক্ষুধা এবং ক্লান্তিতে অল্পসময়েই ঘুমিয়ে পড়লো সে। শুন্য ভেলার উপরে একটি ঝরা বনফুলের মতই লাগছিলো তাকে। তৈলবিহীন রুক্ষচুল, ঘাগড়া আর ওড়না মলিন হয়ে পড়েছে। ছিঁড়েও গেছে কয়েক স্থানে। বিষণ্ণ ক্ষুধাকাতর মুখখানাকে অপূর্ব লাগছে। গহন জঙ্গলে দেবকন্যার মতই সুন্দর লাগছে নূরীকে।

এমন সময় একদল লোক এসে পড়ে সেখানে। কয়েকজনের হস্তে রাইফেল। পর্বতমালার বুক হতে জলপ্রপাতের ধারে হঠাৎ তাদের নজর চলে যায় নূরীর উপরে।

প্রত্যেকের চোখে মুখে জাগে রাজ্যের বিস্ময়।

এ-ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নেয়। ভাবে ওরা এই সুউচ্চ পর্বতগাত্রে জঙ্গলে মানবকুমারী এলো কোথা হতে। পা পা করে দলটি এসে দাঁড়ালো নূরীর পাশে ভেলাখানার অদূরে। নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে দেখছে ওরা–একি আশ্চর্য ব্যাপার।

এ দলটি এসেছে জলপথে। অনেক দূরদেশ থেকে তারা এখানে এসেছে কোনো এক ছবির সুটিং-এর জন্য। জাহাজে তাহাদের ক্যামেরা এবং সুটিং-এর প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি রয়েছে। আর আছে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য।

ছবির পরিচালক স্বয়ং আছেন এ দলে।

তারা ভাল একটি জায়গার অন্বেষণ করে ফিরছেন। এমন সময় হঠাৎ নজর পড়লো ঘুমন্ত নূরীর উপর।

নূরীর অপূর্ব রূপচ্ছটা সবাইকে বিমুগ্ধ করলো।

স্বয়ং পরিচালকের চোখে আনন্দের দ্যুতি খেলে গেলো। একটা ভবিষ্যৎ আশার স্বপ্ন দেখলেন তিনি মনের আকাশে। হস্তস্থিত অর্ধদ্বগ্ধ সিগারেট নিক্ষেপ করে ঝুঁকে পড়লেন তিনি নূরীর মুখের কাছে। ডাকলেন পরিচালক সাহেব–এই মেয়ে শুনছো? এ মেয়ে–

অত্যন্ত ক্লান্তি আর অবসাদে নূরীর নিদ্রা ঘনীভূত হয়ে পড়েছিলো। কানে মানুষের কণ্ঠস্বর পৌঁছতেই নিদ্রা ছুটে গেলো তার। চোখ মেলতেই দেখলো–তার চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন লোক। চমকে উঠে বসলো নূরী। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো সে সকলের মুখে।

পরিচালক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে এগিয়ে এলেন নূরীর পাশে, শান্ত গলায় বললেন-তুমি এখানে এলে কি করে?

নূরী কোনো জবাব দিলো না, মনের মধ্যে তার ঝড় উঠেছে–না জানি এরা কে বা কোথা হতে এসেছে। বনহুর আর কেশবই বা গেলো কোথায়–কত দূরে। নূরী ভীত দৃষ্টি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো, চকিত হরিণীর মত তাকাতে লাগলো এদিক-ওদিকে।

পরিচালক পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন–এই বনে তুমি কোথা হতে এসেছো? কি নাম তোমার?

নূরী কি জবাব দেবে ভেবে পায় না। পরিচালকের কথাবার্তা সে সব স্পষ্ট বুঝতে পারছে কিন্তু জবাব দিতে পারছে না। কি বলবে সে কি বলতে কি বলে বিপদে পড়বে, তাই নীরব রইলো নূরী।

পরিচালক মনে করলেন, মেয়েটি বোবা বা সে তার কথাবার্তা বুঝতে পারছে না, হয়তো বা বাংলা ভাষা সে জানে না কিংবা বোঝে না।

অন্যান্য সবাই বিস্ময়ভরা নয়নে তাকিয়ে দেখছে।

পরিচালক ইশারা করলেন মেয়েটিকে ধরে তাদের জাহাজে নিয়ে যেতে।

মালিকের আদেশ পেয়ে কয়েকজন কর্মচারী ধরে ফেললো নূরীকে, টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চললো জাহাজের দিকে।

নূরী আঁচড় দিয়ে কামড়ে তবু উদ্ধার করতে পারলো না নিজকে। পরিচালকের অদেশে তাঁর সঙ্গিগণ নূরীকে জোর করে ধরে নিয়ে জাহাজে এনে তুললো।

এমন একটা মেয়েকে হঠাৎ বনে কুড়িয়ে পাওয়ায় খুশিতে আত্মহারা হলেন পরিচালক আসলাম আলী। তিনি আর এখানে বিলম্ব করা উচিৎ মনে করলেন না। নূরীকে একটা ক্যাবিনে বন্ধ করে রাখলেন এবং তৎক্ষণাৎ জাহাজ ছাড়ার আদেশ দিলেন।

বন্ধ ক্যাবিনে কুদ্ধ সিংহীর ন্যায় ছট ফট করতে লাগলো নূরী। মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলো টেনে। মেঝেতে পা আছড়ে দেয়ালে মাথা ঠুকে রোদন করতে লাগলো সে।

জাহাজ তখন চলতে শুরু করেছে।

পরিচালক এবং অন্যান্য সহকর্মী একটা ক্যাবিনে বসে আলাপ-আলোচনায় মেতে উঠলেন। এমন একটা অপ্সরীর মত যুবতীকে তারা লাভ করেছেন, যার জন্য আনন্দে উৎফুল্ল সবাই।

প্রধান সহকারী বশীর আহম্মদ বললেন–স্যার বরাৎ বলতে হবে। হঠাৎ এই গহন জঙ্গলে এমন রত্ন কুড়িয়ে পাবো আমরা কল্পনাও করিনি।

হা, সত্যিই বলেছেন আহম্মদ সাহেব।

ক্যামেরাম্যান জ্জোহা চৌধুরী বললেন–আমাদের আগামী ছবির নায়িকার জন্য মেয়েটি সুন্দর মানাবে।

অন্য একজন সহকারী বললো–মেয়েটিকে বাগে আনাই বড় মুস্কিল হবে বলে মনে হচ্ছে।

মিঃ আহম্মদ বললেন–বনের পশুও পোষ মানে, আর এতো মানুষ। কৌশলে একে বশে আনতে হবে, বুঝলেন গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–আশ্চর্য, এমন স্থানে মেয়েটি এলো কি করে?

সহকারীদের একজন বললো–হয়তো জংলীদের মেয়ে।

 ক্যামেরাম্যান জ্জোহা চৌধুরী বললেন–আমার মনে হয় কোনো ইরানী মেয়ে।

আর একজন বললো–ঠিক তাই হবে, ইরানীদের মেয়েরাই এতো বেশি সুন্দরী হয়।

অন্য আর একজন বললো “কাশ্মিরী মেয়ের মত কিন্তু চেহারা—

এক একজন এক একরকম মতামত প্রকাশ করতে লাগলো মেয়েটি সম্বন্ধে।

পরিচালক তখন গভীরভাবে ভেবে চলেছেন কার মেয়ে কোথা হতে এলো এই পর্বতমালার উপরে। জনহীন নির্জন স্থানে কিভাবে এলো মেয়েটি– সব যেন বিস্ময়কর লাগছে তাঁর কাছে।

*

সমস্ত জাহাজময় চলেছে যুবতীটিকে নিয়ে নানারকম আলাপ আলোচনা। এক একরকম মতামত চলতে লাগলো। এমন কি কুলি খালাসী এবং সারেঙ্গাদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হলো।

এখানে যখন নূরীকে ক্যাবিনে আবদ্ধ করে তাকে নিয়ে নানা রকম আলোচনা চলছে তখন এক গাদা সুস্বাদু ফলমূল নিয়ে ফিরে আসে বনহুর আর কেশব। প্রচুর ফল সংগ্রহ করে এনেছে তারা নূরীর জন্য।

কিন্তু ভেলার পাশে এসে বনহুর আর কেশব নূরীকে না দেখতে পেয়ে হতভম্ব হয়ে পড়লো। প্রথমে মনে করলো নূরী নিকটে কোথায় গেছে; তাই বনহুর চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। এখানে বন হলেও বেশ ফাঁকা এবং পরিস্কার। বহুদূরে নজর চলে যায়। কোনোরকম হিংস্র জীবজন্তু এ জঙ্গলে নেই, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বনহুর আর কেশব নূরীকে একা রেখে যেতে কোনোরকম দ্বিধা বোধ করেনি।

নূরীও অত্যন্ত ক্লান্তি বোধ করায় ওদের সঙ্গে যায়নি বা যেতে রাজি হয়নি।

বনহুর অবশ্য কেশবকে নূরীর নিকটে থাকবার জন্য বলেছিলো কিন্তু নূরীই তাকে থাকতে দেয়নি তখন। বনহুর একা যাবে–কোনো অসুবিধায় পড়বে, সেই কারণে নূরী চিন্তিত হয়ে পড়েছিলো। এমন পরিস্কার স্বচ্ছ সুন্দর জায়গায় তার কোনো বিপদ ঘটবে বা ঘটতে পারে, কল্পনাও করতে পারেনি সে।

বনহুর আর কেশব নূরীকে না দেখতে পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো, চিৎকার করে ডাকতে লাগলো–নূরী নূরী নূরী–

কিন্তু কোথায় নূরী!

কেশব ছুটাছুটি শুরু করে–একবার এদিকে যায়–একবার ওদিকে। মুখ তার অন্ধকার বিষাদময় হয়ে উঠেছে মুহূর্তে।

নূরীকে কেশব নিজ বোনের মতই স্নেহ করে–ভালবাসে। একদিন অবশ্য নূরীকে সঙ্গিনীরূপে পাবার জন্য সে উন্মুখ ছিলো, আজ তার ভালবাসা পবিত্রতার বন্ধনে গম্ভীর হয়ে উঠেছে। নূরীর অদর্শনে কেশব পাগলের মত বনের মধ্যে এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করতে লাগলো আর উচ্চকণ্ঠে ডাকতে লাগলো–ফুল, ফুল, কোথায় তুমি গেলে ফুল—

বনহুর নির্বাক নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার কেঁচড় হতে ফলগুলো গড়িয়ে পড়লো ভূতলে।

কেশব বনের মধ্যে ডেকে ডেকে এক সময় ফিরে এলো বনহুরের সম্মুখে, ব্যাকুল কণ্ঠে বললো–এখন কি হবে বাবু?

বনহুর কোনো জবাব দিলো না বা দিতে পারলো না। আর কিইবা দেবে! হৃদয়ে আগুন জ্বলছে–এতবড় ভুল সে করলো কি করে! এই যে পর্বতমালা রয়েছে, এই যে গাছপালা রয়েছে–বনহুর বা কেশবের এখনও কোনো হিংস্র জীবজন্তু নজরে পড়েনি। গেলো কোথায় নূরী! হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি চলে গেলো ভেলার পাশে। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ে চক্ষু তার স্থির হয়ে গেলো, উবু হয়ে হাতে তুলে নিলো একখন্ড অর্ধদগ্ধ সিগারেট।

সোজা হয়ে দাঁড়ালো বনহুর, অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা চোখের সম্মুখে ধরে বললো–কেশব এখানে কোনো সভ্য সমাজের মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিলো।

কেশবও অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে সিগারেটের টুকরাটা, বললো সে–বাবু তাহলে ফুলকে কি কোনো মানুষ ধরে নিয়ে গেছে?

হ নূরীকে কোনো সভ্য সমাজের মানুষ ধরে নিয়ে গেছে। জংলী বা অসভ্য জাতিরা এমন সিগারেট পাবে কোথায় বলো? কিন্তু কারা তারা এবং নূরীকে নিয়ে গেলই বা কোথায়?

বাবু নিশ্চয়ই জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করেছে।

না কেশব, জঙ্গলে তারা যাবে না, নিশ্চয়ই নিচের দিকে–মানে পর্বতের পাদমূলে নেমে গেছে।

বনভূমি এবং পর্বতের পাদমূলে বনহুর আর কেশব নূরীর অন্বেষণ করে ফিরলো তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফিরলো তারা দু’জন সমস্ত দিন ধরে। একসময় সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলো পর্বতমালার গায়ে।

বনহুর হতাশ হয়ে বসে পড়লো ভূতলে। সন্ধ্যার অন্ধকার শুধু বিশ্বটাকেই অন্ধকারময় করে দেয়নি তার অন্তরের সমস্ত আলোও যেন নিভে গেলো বেলাশেষের অস্তমিত আলোকরশ্মির সঙ্গে সঙ্গে।

কেশবের অবস্থা আরও শোচনীয়। একে ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর সে তদুপরি নূরীর অন্তর্ধান নিয়ে সমস্ত দিন ধরে প্রায় সমস্ত পর্বতমালা এবং পর্বতের পাদমূল চষে ফিরেছে তবু যদি ফিরে পেতো তাকে। অত্যন্ত ভেঙে পড়লো কেশব। বনহুর মুষড়ে পড়লেও সে কঠিন পুরুষ–সহ্য করা। তার অভ্যাস হয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ হতবাক বিষাদমগ্ন হয়ে থেকে বললো বনহুর–কেশব, নূরী এ পর্বতমালা বা এ জঙ্গলে নেই। তাকে নিয়ে হরণকারী দল চলে গেছে দূরে কোথাও।

তাহলে কি হবে বাবু? কেঁদে উঠে বললো কেশব।

কি বলবো কেশব, আমি যে তোমার প্রশ্নের জবাব দিতে অক্ষম। এমন যে হবে আমি ভাবতেও পারিনি।

সত্যি বাবু, কোথা থেকে কেমন করে কারা এলো যারা ফুলকে চুরি করে নিয়ে গেলো। আহা ফুল না জানি কত চিৎকার করেছে কত ডেকেছে আমাদের দু’জনাকে–

কেশবের ক্রন্দনভরা আকুল কণ্ঠে বনহুরের মন আরও গুমড়ে কেঁদে উঠে বলে বনহুর– কেশব, আজ রাত আমাদের এ বনেই কাটাতে হবে।

তারপর কি করবেন বাবু?

 চলে যাবো এ বন ছেড়ে।

কিন্তু ফুল! ফুলের সন্ধান না নিয়ে আপনি কেমন করে এ বন ত্যাগ করবেন বাবু?

গভীর চিন্তাযুক্ত কণ্ঠে বললো বনহুরফুল আর এ জঙ্গলে নেই কেশব! তাকে নিয়ে হরণকারীদল এ জঙ্গল, এ পর্বতমালা ত্যাগ করে চলে গেছে।

বনহুর আর কেশব রাতটা কাটিয়ে দেবার মানসে একটা বৃক্ষে আহরণ করলো, চওড়া ডাল। দেখে বসলো দু’জনা। নিচে হঠাৎ কোনো জীবজন্তুর আবির্ভাব ঘটতে পারে, সেজন্যই গাছের ডালে উঠে বসেছিলো ওরা।

গাছের ডালে উঠে বসার একটু পর হঠাৎ একটা শব্দ ভেসে এলো জাহাজের শব্দ ছাড়া অন্য কিছু নয়। কিন্তু বহু দূর-দূরান্ত হতে এ শব্দ আসছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পর্বতমালার ঠিক সম্মুখ বা পিছন কোন দিক থেকে আওয়াজ আসছে তাও বোঝা যাচ্ছে না।

কেশব বললো–এটা কিসের শব্দ বাবু?

বনহুর অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শব্দটা শোনার পর বললো–কোনো জাহাজ আমাদের পর্বতের আশপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কিংবা কোনো স্টীমারের শব্দ–

বাবু, এই জাহাজেই ফুলকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, না হলে এদিকে কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেলো না।

এ কথার কোনো জবাব দিলো না বনহুর।

গভীর রাতে একটু তন্দ্রার মত হয়ে পড়েছিলো বনহুর আর কেশব। হঠাৎ একটা হই-হুঁল্লোড়ের শব্দে তন্দ্রা ছুটে গেলো। দেখলো ওরা দু’জনা দূরে–অনেক দূরে পর্বতের পাদমূলে ঠিক যেখানে রত্নগুহার মুখ এবং যেখান দিয়ে জলপ্রপাত বেয়ে চলেছে সেখানে অসংখ্য মশালের আলো দপ দপ করে জ্বলছে। যদিও আলোকরশ্মি খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো না এবং হই-হুল্লোড়ও অত্যন্ত অস্পষ্ট তবু বোঝা যাচ্ছে সেখানে খুব হট্টগোল চলেছে।

কেশব আর বনহুর বৃক্ষশাখায় বসে দেখতে লাগলো।

অল্পক্ষণ লক্ষ্য করতেই বনহুর বুঝতে পারলো– জংলিগণ ছাড়া ওরা অন্য লোক নয়। বনহুর বললো–কেশব চলো ওখানে যেতে হবে।

ভয়-বিহ্বল কণ্ঠে বললো কেশব–বাবু ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না ওরা জঙ্গলী দল—

সে আমি বুঝতেই পারছি কেশব, জংলী দল তাদের রত্নগুহায় মানুষ প্রবেশের গন্ধ পেয়েছে।

 তাই বুঝি—

 হা, ওরা উন্মাদ হয়ে উঠেছে এখন।

সেখানে যাওয়াটা কি তাহলে উচিত হবে বাবু?

না গিয়ে যে উপায় নেই কেশব। দেখতে চাই নূরী, ওদের কবলে পড়ে যায়নি তো?

তাই তো বাবু, চলুন চলুন বাবু আর দেরী করবো না। কেশব গাছ থেকে নামতে শুরু করলো, নূরীর কথা মনে হতেই ভয়-ভীতি ভুলে গেলো সে।

বনহুর আর কেশব দ্রুত চলতে লাগলো, একরকম প্রায় ছুটেই চললো ওরা। রাতের অন্ধকার হলেও বনটা ফাঁকা কাজেই চলতে অসুবিধা হচ্ছিলো না। তবে পর্বতের গা বেয়ে নিচে নামতে একটু সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছিলো তাদের।

অত্যন্ত দ্রুত চলার জন্য কিছু সময়ের মধ্যেই তারা দু’জন অনেক নিচে নেমে এলো। এখান হতে পর্বতের পাদমূল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মশালের উজ্জ্বল আলোতে দেখলো বনহুর আর কেশব অসংখ্য জংলী সুড়ঙ্গমুখের বাইরে ছুটাছুটি আর হই-হুল্লোড় করছে। বনহুর বুঝতে পারলো জংলী দল তাদের রত্ন-গুহায় মানুষের প্রবেশ জানতে পেরেছে এবং গুহার পিছন দরজা মুক্ত দেখে ভীষণ ক্ষেপে গেছে।

এক এক জংলীকে ক্রুদ্ধ অবস্থায় ঠিক হিংস্র জন্তুর মতই লাগছিলো। সেকি জমকালো তাদের চেহারা! সমস্ত শরীরে সাদা সাদা রেখা টানা ঠোঁট এবং দাঁতগুলোও সাদা ধবধবে। চোখগুলো দেহের আকারে ক্ষুদ্র মাথার চুলগুলো খাড়া খাড়া আর খাটো। প্রত্যেকের হস্তে সূতীক্ষ্ণ-ধার বর্শা আর বল্লাম।

বনহুর আর কেশব একটা গাছের আড়ালে বেশ কিছু উঁচুতে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। জংলিগণ কি যেন একরকম শব্দ করছে আর ছুটোছুটি হুটোহুটি করছে।

মশালের আলোতে সুড়ঙ্গমুখ এবং আশপাশ আলোকিত হয়ে উঠেছে। সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বনহুর ও কেশব। নূরীর সন্ধানে বনহুর তীক্ষ্ণ নজরে দেখতে লাগলো, কিন্তু নূরী বা কোনো সভ্য মানুষের চিহ্ন দেখতে পেলো না। ভাবলো বনহুর নূরীকে নিশ্চয়ই ওরা হত্যা করেছে বা গুহার ভিতর বন্দী করে রেখেছে। বুকটা ধক ধক করে উঠলো কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো–নুরী জংলীহস্তে বন্দী হয়নি। তাকে সভ্য সমাজের কোনো দুষ্ট দল ধরে নিয়ে গেছে–সে নিজ চোখে দেখেছে দামী সিগারেটের টুকরো–

হঠাৎ বনহুরের চিন্তা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। সে দেখলো সুড়ঙ্গ মুখে এসে দাঁড়িয়ে আছে জংলী রাণী তার প্রেমানুরাগিনী বিচিত্রময়ী নারী। চোখেমুখে তার কঠিন ভাব, দু’চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। অদ্ভুত শব্দে কি যেন উচ্চারণ করলো জংলী রাণী।

সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জংলী নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়ালো।

জংলী রাণী সুউচ্চ কণ্ঠে পুনরায় কিছু উচ্চারণ করলো। অমনি বনহুর লক্ষ্য করলো– কয়েকজন জংলী গুহার ভিতরে প্রবেশ করলো।

স্তব্ধ হয়ে দেখছে বনহুর আর কেশব।

কেশব বললো ফিস ফিস করে না জানি কি দেখতে হবে বাবু। আমার মাথা ঘুরছে আমি আর দাঁড়াতে পারছি না–

তুমি বসে পড়ো কেশব তোমাকে দেখতে হবে না।

বনহুর তাকে বসতে বললেও সে বসতে পারলো না। বনহুরের পিছন দিকে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো।

বিস্ময়ভরা নজরে দেখলো বনহুর আর কেশব এক অদ্ভুত কান্ড! যেসব জংলী গুহামধ্যে প্রবেশ করেছিলো তারা কয়েকজন মিলে রত্নসিন্দুক ধরে বের করে নিয়ে এলো, সুড়ঙ্গমুখে সারিবদ্ধ করে রাখলো।

বনহুর আর কেশব অন্ধকারেও একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিলো। দেখলো বনহুর আর। কেশব-জংলী রাণী হাত উঁচু করে কি যেন শব্দ করলো অমনি বলিষ্ঠ জংলিগণ এক একটা রত্নসিন্দুক তুলে নিয়ে নিক্ষেপ করলো গভীর জলোচ্ছাসের মধ্যে।

কেশব অস্ফুট আর্তকণ্ঠে বললো–বাবু, সর্বনাশ-ওরা রত্নসিন্দুকগুলো গভীর জলপ্রপাতের মধ্যে নিক্ষেপ করছে। হায় কি হলো বাবু?

কেশব স্থির হও। ওরা বুদ্ধিমানের কাজই করছে। কারণ রত্নগুহার সন্ধান মানুষ যখন জানতে পেরেছে তখন তারা এ গুহা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত নয়, তাই নিশ্চিন্ত স্থানে ওরা রত্নসিন্দুকগুলো লুকিয়ে রাখলো।

গভীর জলমধ্যে নিক্ষেপ করে ওরা—

হাঁ, ওরা নিশ্চিন্ত হলো।

বাবু!

কেশব, আমিও নিশ্চিন্ত হলাম। কারণ রত্নসিন্দুকগুলো এখন ঠিক জায়গায় রক্ষিত রইলো।

বাবু! কেশবের চোখেমুখে বিস্ময়, অন্ধকারে কেশবের মুখ বনহুর দেখতে না পেলেও তার কণ্ঠস্বরে মনোভাব বুঝে নিলো।

বললো বনহুর–কেশব, জংলিগণ তাদের রত্নসিন্দুক যেখানেই লুকিয়ে রাখুক, দস্যু বনহুরের কবল থেকে নিশ্চিন্ত রাখতে সক্ষম হবে না। জংলীরা সিন্দুকগুলো জলমধ্যে নিক্ষেপ না করলেও আমিই ওগুলো জলমধ্যে গোপন রেখে তবেই যেতাম। যা আমার কাজগুলোই ওরা সমাধা করলো।

কেশব স্তব্ধ হয়ে গেছে। কোনো কথা তার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হলো না।

বনহুর অন্ধকারেই একটু হাসলো, তারপর বললো–কেশব তুমি কি মনে করো ওগুলো আমাদের নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলো?

বাবু, তাহলে কি ওগুলো নিতেন না?

না কেশব, এখন ওসব নেওয়া কিছুতেই সম্ভব ছিলো না। কারণ আমরা এখন কোন পথে কেমনভাবে কোথায় গিয়ে পৌঁছব কে জানে। জীবন রক্ষাই সঙ্কটাপন্ন হয়ে দাঁড়াবে।

রত্নসিন্দুক সামলাবে কখন? ঐ দেখো জংলিগণ এবার নিশ্চিন্ত মনে ফিরে যাচ্ছে। আর কোনা চিন্তা নেই ওদের। হঠাৎ হেসে উঠে অদ্ভুতভাবে বনহুর তারপর হাসি থামিয়ে বলে–নির্বোধ জংলী দল–

জংলিগণ সব অন্তর্হিত হলো সুড়ঙ্গমুখে গুহার ভিতরে। মশালের আলো এবং তাদের কলকন্ঠের চিৎকারধ্বনি আর কর্ণ গোচর হচ্ছে না।

ওদিকে পূর্বাকাশ আলোকিত করে ভোরের সূর্য উঁকি দিচ্ছে তখন।

 বনহুর আর কেশব বৃক্ষতলে বসে পড়লো।

 কেশব বললো–ফুলের সন্ধান না নিয়ে আমি কিছুতেই এ পর্বত ত্যাগ করবো না বাবু।

 একটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করে বললো বনহুর–সে এ পর্বতের কোথাও নেই কেশব।

কেমন করে জানলেন বাবু?

ঐ সিগারেটের টুকরো এবং রাত্রিতে জাহাজ বা ষ্টীমারের শব্দ আমাকে নিঃসন্দেহ করেছে। কেশব।

তাহলে ফুলকে নিয়ে হরণকারীদল পালিয়ে গেছে?

সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত আমি।

এখন কি করবেন বাবু?

চলো বেলা উঠবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা জলপ্রপাতে আমাদের ভেলা ভাসিয়ে দেই। যেমন করে হোক সন্ধান করতেই হবে নূরীর।

তাকে আমরা আর পাবো বাবু?

কেমন করে বলবো কেশব। কেমন করে বলবো বলো?

*

বনহুর আর কেশব অনেক কষ্টে তাদের তৈরি ভেলাখানা নিয়ে আসতে সক্ষম হলো। জলপ্রপাতে ভেলা ভাসিয়ে চেপে বসলো বনহুর আর কেশব।

কেশবের গন্ড বেয়ে ঝরতে লাগলো অশ্রুধারা।

বনহুরের চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত না হলেও মন তার জমাট বেদনায় গুমড়ে কেঁদে কেঁদে উঠছিলো। অতিকষ্টে নিজকে সংযত রেখেছিলো সে। কেশব কেঁদে কেটে আকুল হয়ে পড়েছে–সেও যদি কোনোরকম দুর্বলতা প্রকাশ করে তাহলেও আরও ভেঙে পড়বে।

জলপ্রপাতে ভেলা ভাসিয়ে বনহুর আর কেশব উঠে বসলো, ভোরের সূর্য তখন তীব্র হয়ে উঠেছে।

 ভেলাখানা তীরবেগে ভেসে চললো উঁচু থেকে নিচের দিকে। ক্রমান্বয়ে সুড়ঙ্গমুখ অস্পষ্ট হয়ে আসছে। পর্বতমালার ভিতর দিয়ে খরস্রোতা জলপ্রপাত বেয়ে ভেলাখানা এগুচ্ছে।

বনহুর গম্ভীর স্থির কণ্ঠে বললো–কেশব, পথ চিনে রাখো, আবার আমাদের এই পথে একদিন। আসতে হবে।

অবাক হয়ে কেশব তাকালো বনহুরের মুখের দিকে বললো–সেকি বাবু?

হাঁ কেশব, আগে নূরীকে খুঁজে বের করবো। তারপর ফিরে যাবো আমার আস্তানায়। আমার দলবল নিয়ে আবার আসবো। না হলে সাপুড়ে সর্দারের শেষ বাসনা সিদ্ধ হবে না।

বনহুরের কথা শেষ হয় না, একটা বর্শা এসে বিদ্ধ হয় বনহুরের ঠিক পাশে ভেলার গায়ে।

চমকে এক সঙ্গে ফিরে তাকায় বনহুর আর কেশব। বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যায়, দেখতে পায়– তীরে একটা জমকালো বিরাট অশ্বপৃষ্ঠে বসে আছে জংলী রাণী স্বয়ং। বাতাসে তার কটা চুলগুলো উড়ছে। দক্ষিণ হস্তে তার আর একখানা উদ্যত বর্শা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *