সান জিমিনিয়ানো
তুমিও?
ভালেরি চমকে উঠল। ‘তুমিও যেতে চাও সান জিমিনিয়ানোয়? আমার স্বপ্নের শহরে? কেমন করে তোমার মনে এই ইচ্ছেটা এল?
–সেদিন আমাদের যে স্পেশ্যাল ওয়াইনটা সার্ভ করা হল, সান জিমিনিয়ানো নামে তখনই আমি জিয়ানা চেল্লিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এটা কেমন নামের ওয়াইন? জিয়ানা যেমন ভাবে ছোট শহরটার বর্ণনা দিলেন, তাতেই আমার মাথায় সান জিমিনিয়ানোর নেশা চড়ে গেছে। আমি ইউরোসিটি, আর এমনি ট্রেনে মিলিয়ে টিকিট কাটছি—দামি কিছু, সস্তা কিছু, পকেটে তো মোটে পাঁচশো ডলার স্কলারশিপ ভরসা, তার পঞ্চাশ খরচাই করে ফেলেছি। তবু ভাবছি, কুলোলে যাব।
—’টাকার জন্য ভেবো না, সান জিমিনিয়ানো তোমাকে ফ্রি রাইড দিতে পারি।’
—‘মানে?’
—মানে আমি তো যাচ্ছিই। অনেকদিনের প্ল্যান ছিল আমার। গাড়ি ভাড়া করেও ফেলেছি, চাইলে আমার সঙ্গী হতে পার।—আমি খুবই খুশি হব। একা একাটি যাচ্ছি তো? তিনদিনের জন্য।’
ফ্রি রাইড শুনে আমি আহ্লাদে আটখানা হয়েও, জিজ্ঞেস করি—’কেন তোমাকে যেতেই হচ্ছে সান জিমিনিয়ানো? তুমি তো ছবি আঁকো না, ছবি তোলও না, সাহিত্য পড়াও না, তুমি এডুকেশনের স্কলার। ওখানে কি তোমার কোনও কাজকম্মো আছে?’
ভীষণ হেসে ফেলে ভালেরি বলল, ‘তুমি তাহলে সান জিমিনিয়ানোর চরিত্র কিছুই বোঝনি মশাই, ওখানে কেউ কাজকম্মো করে না। ওখানে লোকে বেড়াতে যায়, মুগ্ধ হতে যায়, স্তম্ভিত হতে যায়। বুঝেছ কবিমশাই? ওটা তোমাদের মতো অকম্মা লোকেদের পক্ষে আদর্শ জায়গা, এমনকি আমার পক্ষেও! এত আনরিয়্যাল দেখতে, মনে হবে যেন কোনও ফিল্মের স্টুডিওর সেটের মধ্যে হাঁটছি! ভীষণ রিল্যাক্সিং।’
স্বৰ্গ
কোমো হ্রদের তীরে বেলাজিওর ভূস্বর্গে, সপ্তদশ শতাব্দীর প্রাসাদ ভিলা সেরবেলোনিতে স্বপ্নময় পাঁচ হপ্তা রাজকীয়ভাবে কাটিয়ে, এবার আমরা যে-যার দেশে প্রত্যহের জীবিকার কাজে ফিরব। এখানেও সকলে যে-যার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেছি—কিন্তু অহো! কী অনৈসর্গিক নিসর্গ শোভায় আর অনাবিল সুখ সম্ভারে চর্চিত হয়েছে মস্তিষ্ক এবং ইন্দ্রিয়সকল—দৃশ্যে, সুবাসে, শ্রুতিতে, স্বাদে, আর বাতাসের ছোঁয়াকে যদি ছোঁয়া বলে ধরি, তবে ত্বকেরও তৃপ্তি অশেষ। আলাপ, আলোচনা, বিতর্ক তো আছেই এবং ব্যায়াম। এমন সেন্টারে বেড়াতে এলে কার রিসার্চ এগোবে না? কিন্তু বাড়িতে ফেরাটা স্বর্গ থেকে পতন। তাই মাঝে সকলেই কদিন একটু বেড়িয়ে বেড়িয়ে আস্তে ধীরে বাস্তবের সঙ্গে পুনর্বার পরিচিত হতে চাইছি।
সময়, ১৯৯৩-এর মে মাস, বসন্তউদ্বেল ইতালি। আমি বেরুচ্ছি একটা ছোট্ট ঠেলা স্যুটকেস আর আমার ঝোলাব্যাগ নিয়ে মিলান, ফ্লোরেন্স, ভেনিস, ভেরোনা, পাদুয়া, বোলোনিয়া, সান জিমিনিয়ানো, ফিয়েসোলে, সিয়েন্না, রাভেন্না এইসব ঘুরব প্ল্যান করেছি। জানি না এর মধ্যে কতটা আমার সময় কুলোবে, আর কতটা গাঁটের কড়িতে। এর মধ্যে একটা ঠাঁইও যদি ফ্রি রাইড পেয়ে যাই তবে আহ্লাদে বিগলিত না হওয়াই অস্বাভাবিক।
তাছাড়া ঝাঁকড়া পাকা চুল ভালেরি লীর সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়েছে। আমরা দুজনে রনেবাদাড়ে ফুল তুলতে যাই। নৌকো করে গ্রামে গ্রামে গির্জা দেখতে যাই। আমার মতো সেও একটু দেরি করে চাকরি-বাকরি শুরু করেছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে, উইসকনসিনে। ছেলেমেয়ের তো বিয়ে হয়ে গেছেই, তার স্বামীরও বিয়ে হয়ে গেছে। এসবের পরেই ভালেরি পি এইচ ডি করতে ঢুকেছে, করে ফেলেছে এবং চাকরিও পেয়েছে। স্বামী একদা মার্কিন সরকারের বিদেশমন্ত্রকের উচ্চপদে থাকার দরুন পঁচিশ বছর দেশের বাইরে বাইরে বসবাস করেছে ভালেরি সপরিবারে। জীবনে অনেক দেখেছে। আর পুত্রটি হয়েছে হিপি, কন্যা সেক্রেটারি, মাঝে মাঝে দোকানেও চাকরি করে। পড়াশোনায় মন ছিল না তাদের।
কোথায় যাব না
মিলান হয়ে, সোজা টাসকানির বড় রাস্তা ধরে, অটোস্ট্রাডা দিয়ে বোলোনিয়া শহর হয়ে আমরা পান ক্রিমিনিয়ানো যাব। আমার যদিও সিয়েন্না যেতে বেদম ইচ্ছে, সেখানে অপূর্ব মাটির বাসনের কারুকার্য হয়। ভাইমারে, কবি গ্যোয়টের বাসগৃহ দেখেছিলাম। তাঁর শৌখিন সংগ্রহ, ইতাসি থেকে আনা সিয়েন্নার পটারি। সেই থেকে আমারও শখ, অন্তত একটা তো চন্দনবাটিও কিনব? কিন্তু ভালেরি আগেই বলে দিল, ‘দ্যাখো, সারা পথটা দেখবে ‘সিয়েন্না’ বলে তীরচিহ্ন দেওয়া আছে—খবর্দার কিন্তু আমাকে সেদিকে পাঠাবে না! কক্ষনো নয়। আমি ভীষণ লোভী, ঘরে আমার প্রচুর সিয়েন্নার মৃৎপাত্র মজুত—কিন্তু আবার গেলেই আবার কিনে ফেলব, ঠিকই এবং সেসব প্যাক করে উইসকনসিনে প্লেনে প্রেরণ করা, বাসনের চেয়ে ঢের বেশি খরচসাপেক্ষ! অতএব যত কাছেই হোক সিয়েন্না যাওয়া চলবে না। তবে ‘ফিয়েসোলে’ নিয়ে যেতে পারি তোমাকে, ফ্লোরেন্স থেকে। গাড়ি না হলে ওখানে যাওয়া কঠিন, আর আমিও কখনও যাইনি ফিয়েসোলে। শুনেছি পাহাড়ের ওপর ছোট্ট গ্রাম, সেখানে থেকে নাকি ফ্লোরেন্সের শ্রেষ্ঠ ‘ভিউ’ দেখা যায়। সিয়েন্নার বদলে ফিয়েসোলে কেমন অফার?’
—গ্র্যান্ড! খুব ভালো। ফ্লোরেন্সে না গিয়ে তো ফিয়েসোলে যাওয়া যায় না, যেমন কলকাতা না এসে শান্তিনিকেতন যাওয়া সহজ নয়—এর ফলে আমি ‘ফ্রি রাইড টা ফ্লোরেন্স পর্যন্ত পেয়ে যাচ্ছি।—অপূর্ব ব্যবস্থা! থ্যাংক ইউ ভালেরি।’
যাত্রাশুরু
মিলারে মালপেনসে এয়ারপোর্ট থেকে ভাড়া গাড়িটি তুলে নিয়ে আমরা বোলোনিয়ার পথ ধরি। ঠিকমতো গেলে ওখানে লাঞ্চটাইমে পৌঁছে যাব—হাইওয়ে ধরে ছুটছি, মাঝে মাঝে লাল টকটকে পপি ফুলে ঢাকা মাঠ ছাড়া দৃশ্য তেমন কিছুই নয়। ছয় লেনের অটোস্ট্রাডা—শোঁ শোঁ করে গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে।
বোলোনিয়া শহরে ঢুকছি, ভালেরিই খেয়াল করিয়ে দিল রাস্তার নামটা—‘Via M K Gandhi’, এম কে গান্ধি পথ। হঠাৎ কেমন যে করে উঠল বুকের ভেতরটা, কী করে বলি?—বোলোনিয়ার অত পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা জানি, কিন্তু এই হালফিলের রাস্তাটার খবর তো জানা ছিল না? বোলোনিয়ার আধুনিক অঞ্চলে নতুন এই পথ, এখানে একটি শহিদ মিনারও আছে। আমরা সেটি দেখে নিয়ে, চললাম পুরনো শহরে। সেখানে কাশীর গলির মতো সরু সরু নুড়ি বাঁধানো অলিগলিতে ষাঁড়ের মতো বড় বড় অনড় ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। দুপাশে নিচু নিচু দোতলা বাড়ির সারি, হলুদ, গোলাপি। তাদের খিলেনের নীচে দিয়ে ফুটপাথ চলেছে ছায়ায় ছায়ায়।
Ananas! Coco! খিলেন দেওয়া বারান্দার নীচে নীচে বহু দোকান। আর রাস্তার ধারে বিক্রি হচ্ছে অনেক কিছু। হঠাৎ চোখে পড়ল, দোতলা ফোয়ারার মতো করে সাজানো, কাটা আনারস আর কাটা নারকেলের বেসাতি। মাঝে মাঝেই কাফে—ফুটপাথে পাতা চেয়ার টেবিলে। আমরা এইরকম এক কাফেতে বসে পিচফলের সুগন্ধ মাখা ঠান্ডা চা, আরেকটা করে টাটকা রুটির স্যান্ডউইচ খেলাম। খানিকটা বাধ্য হয়েই, কেননা সামনের ট্রাক না সরলে, আমাদের গাড়ি নড়বে না। তারপর (সম্ভবত ট্রাকচালকেরও) লাঞ্চ শেষ হলে ট্রাক এবং আমরা যে যার পথে চলি। প্রথমে টাউন হল, (ঝুরঝুরে পুরনো ইতিহাসমাখা হলুদ বাড়ি)—তারপর বিশ্ববিদ্যালয়। ওই যেমন হয়, অনেক প্রাচীন মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেখার সৌভাগ্য তো হয়েছে জীবনে, এটিও তেমনই। সম্ভ্রান্ত, শান্ত, সমাহিত। এইখানেই কোথাও বসে এখন হয়তো লেখাপড়া করছেন, কিংবা ছাত্র পড়াচ্ছেন উমবেরতো একো। তখনওকি জানি যে পরের বছরই তাঁর সঙ্গে আমি সেমিনারে যোগ দেবো বার্কলিতে?
তন্বীপথ
বোলোনিয়াতে বেশিক্ষণ থাকিনি আমরা, ম্যাপ দেখে খুঁজে বের করলাম একটা সরু মতো আঁকাবাঁকা পথ, হাইওয়ে নয়, যেটা টাসকানি অঞ্চল দিয়ে আমাদের নিয়ে যাবে সান জিমিনিয়ানোর দিকে। এযাত্রায় আমার ভূমিকা চালকের নয়, ন্যাভিগেটরের। যার নামে গাড়ি ভাড়া, সেই কেবল চালাতে পারে, নইলে ধাক্কাধুক্কি লাগলে, ইনশিওরেন্স পয়সা দেবে না। ফলে আমার খুব ভালোই হয়েছে, প্রাণভরে দেখছি আশপাশের দৃশ্য, মনে মনে সব সময়ে অ্যাটেনশনে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে নেই! এমনই সুন্দর তন্বী সেই রাস্তা, যে একটা পুলে ওঠার আগে খানিকক্ষণ আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হল। এখানে পথটি ওয়ান ওয়ে হয়ে যাচ্ছে। ওদিকের গাড়ি চলে এলে, তবেই এদিকের গাড়ি ওপারে যাবে। সেতু পার হয়ে আবার অবশ্য মুক্তপথ।
বোলোনিয়া পর্যন্ত শুধু ধোঁয়াশার আস্তরণ ছিল অটোস্ট্রাডায়। দৃশ্যশূন্য পথিমধ্যে চতুর্দিক ছিল অকারণ রহস্যে মণ্ডিত এবং বোরিং। হঠাৎ যেন কে এসে সেই রহস্যের ওড়নাটা তুলে দিয়েছে,—আর রূপসী টাসকানি তার নগ্ন, নির্জন সৌন্দর্য নিয়ে সহসা আমাদের সামনে পূর্ণ বিশ্বাসে আবির্ভূত হয়েছে।
টাসকানি
এদিকে ঝরনা, ওদিকে তটিনী, ঢেউখেলানো সবুজ পাহাড়তলি, ঝকঝকে সবুজের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ ফুটন্ত পপির গাঢ় লাল চাদর বিছানো—শুধুই পপি? বেগুনি ভায়োলেট ফুল, ম্যভ রঙের আইরিস আর বুনো আগাছা ফুল ড্যান্ডিলায়নের সোনালি হলুদ রঙে রঙে চোখকে অস্থির করে দিচ্ছে বনফুলের দল। তবে সেটা শুধু তখনই, যখন আমরা টানেলের বাইরে আসছি! হঠাৎ হঠাৎ আমাদের নিয়ে আঁকাবাঁকা পথটি না বলে-কয়ে টানেলের অন্ধকারে লুকিয়ে পড়ছে, আবার বের করে এনে ফেলছে অবিশ্বাস্য রং আর আলোর রাজ্যে। আর দুর্গ। আর গির্জা। পাহাড়ের চুড়োয় চুড়োয় ছবিতে দেখা পুরনো কেল্লা, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে প্রাচীন গির্জা। কখনও আমরা পাহাড়ের মাথায়, অনেক নীচে সবুজ উপত্যকা দেখা যাচ্ছে, আবার কখনও আমরাই উপত্যকায়, মাথা তুলে দেখছি দূরের শিখরে পাথরের কেল্লা।
Viridata diretta
মাঝে মাঝেই পথের ধারে ছোট ছোট গ্রাম, জনবসতি, যে যার প্রাত্যহিক কাজ করছে, আমাদের গ্রাহ্যই করছে না। গৃহস্থের উঠোনের খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভেতরে উঁচু করে মাচা বেঁধে আঙুরলতা আর তার নীচে টেবিল চেয়ার পাতা, গৃহস্থর ছায়ায় বসে কফি খাবার জায়গা। শিশু খেলছে। কুকুর শুয়ে আছে। আশপাশে ভারি পাথরের টবে নানা রঙের ফুল। দেওয়াল বেয়ে উঠছে গোলাপ ফুলের লতা, বড় বড় হলুদ, গোলাপি, গেরুয়া ফুলে দেওয়াল ছেয়ে আছে। মাঝে মাঝে এই চোরা দৃশ্য দেখবার জন্য চোখ সজাগ রাখছি। এটা কেবল টাসকানিতেই নয় কিন্তু কোমো অঞ্চলেও লক্ষ করছি, গ্রামাঞ্চলে, ছোট শহরেও হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখছি অতি লোভনীয় এই দৃশ্য, উঠোনের খোলা দরজার ফাকে—ইচ্ছে করছে ঢুকে পড়ি, দুদণ্ড ওখানে বসে জিরিয়ে নিই। বড় সুন্দর করে বাঁচতে জানে এরা। দ্রাক্ষাচাষিরা তাদের আঙুরখেতে তো ঠিক এমন মাচা বাঁধে না। লম্বা করে লাঠি পুঁতে পুঁতে গাছ জড়িয়ে দেয়। ঝোপের মতো হয়ে বেড়ে ওঠে দ্রাক্ষালতার সারি।
রাস্তার দুদিকে এত ভিন-ইয়ার্ড আর তার সঙ্গে সঙ্গে ওয়াইনারি, তারপর স্বাভাবিকভাবেই এসে যায় টাসকানির বিখ্যাত সুরা কিয়ান্তির দোকান। দুপাশে প্রায়ই আঙুরখেত আর ছোট ছোট ওয়াইনারি। তারা খুচরো বিক্রেতা, তাজা টাটকা কিয়ান্তি (ফরাসি ওয়াইনের মতো পুরনো করে পান করে না কিয়ান্তি) বিক্রি হচ্ছে, সর্বত্রই প্ল্যাকার্ড আছে Vendita diretta ‘সোজাসুজি বিক্রয় হয়’, অর্থাৎ চাষির ঘরের খাঁটি মাল, মধ্যবর্তীর দালালি নেই। চারদিকে শুধু দ্রাক্ষাখেতই নয়, আরও আছে সাদাটে পাতার জলপাই বাগান। টাটকা অলিভ তেলও এ অঞ্চলের অহংকার।
আকাশ রেখা
হঠাৎ আমাদের নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়তে হল একটা মোড় ঘোরবার পরে। এখনই সন্ধে নেমে আসছে না, রোদের জোরটা কিন্তু পড়ে গিয়েছে। আমরা স্পষ্ট দেখতে পেলাম, একটা মাতাল করা সাদা ফুলগাছের পিছনে আঁকা নিউ ইয়র্কের স্কাইলাইন। সব দোষ এই ফুলটার। সারাটা পথ, সমানে টাসকানির আকাশ বাতাস মাতাল করে মূর্ছিত করে রেখেছে এক তীব্র, নাছোড়, মদির সৌরভে, হাস্নুহানার গন্ধ যদি সারা দিনভর আপনাকে তাড়া করে বেড়ায় তাহলে কি সন্ধেবেলায় আপনার মাথার ঠিক থাকবে? ভালেরি বলল, ‘হতে পারে না!’‘আমি বললাম, ‘টাসকানির এই শান্ত গ্রাম্যতায় এরকম স্কাইস্ক্রেপার্স? কী বেয়াড়া দেখাচ্ছে!’—‘সান জিমিনিয়ানো।’ ভালেরি বলল,—‘দ্য সিটি অব টাওয়ার্স! স্কাইস্ক্রেপার নয়, টাওয়ার্স, আজকের নয়, মধ্যযুগের শহর। প্রাচীর ঘেরা দুর্গনগরী, দেখছ না, পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে? আমি তো ছবি দেখেছি,–আমি জানি।’ আমি ছবি দেখিনি। আমি ভাগ্যিস জানি না! তাহলে এই অমূল্য চমকটা মাঠে মারা যেত।
আমরা অধীর আগ্রহে এগিয়ে যাই, ছবি তুলি, ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আসে সান জিমিনিয়ানোর অবিশ্বাস্য শিখরখচিত স্কাইলাইন। ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে চড়ি, প্রচুর গাড়ি বাইরে পার্ক করা আছে, মধ্যযুগের প্রাচীর নগরীর ভেতরে মোটর গাড়ির প্রবেশ নিষিদ্ধ। আমরা সামনের তোরণটি ছেড়ে পিছনের তোরণ সেন্ট জনস গেট দিয়ে ঢুকি। ওখানে গাড়ি রাখার জায়গা পাওয়া গেল। ঢুকে ভালোই হল, আমাদের ছোট হোটেলটি এদিকেই।
লেকচার
‘সান জিমিনিয়ানোর এত নাম কেবল এত টাওয়ারের জন্যই নয় অবশ্য—এর আর্কিটেকচার ছাড়া টাউন প্ল্যানিং, শিল্প সম্পদ, আর রাজনৈতিক কারণেও সান জিমিনিয়ানো টাসকানির এমনকী ইতালির ইতিহাসে জরুরি নাম।’ মহানন্দে আমাকে বোকা পেয়ে লেকচার মারতে শুরু করেছে ভালেরি। পড়েটড়ে এসেছে দেখছি অনেক। ‘যদিও মধ্যযুগের শহর, কিন্তু এর শুরু সম্ভবত এট্টুস্কান যুগে, প্রিক্রিশ্চিয়ান সভ্যতায়। রোমান যুগে এর নাম হয়েছিল সিলভিয়া এখানে এত সবুজ গাছপালা ছিল, আবার কেউ কেউ বলে, এক রোমান সৈন্য সিলভিউসের’—’আমার ইতিহাসে তেমন উৎসাহ নেই। ভালেরি,’—বলেই ফেলি। ‘কেন নেই? বিনা ইতিহাসে একটা জায়গার আত্মার খবর তুমি পাবে কেমন করে? কেবল তো শরীরটুকুই দেখতে পাচ্ছ।’
সেকথা ঠিকই। কিন্তু এই মাতাল করা ক্যাসিয়া ফুলের তীব্র গন্ধ। অলক্ষে যেন কোটি যুই ফুলের মালা দুলছে বাতাসে, এই চমৎকার নুড়ি বাঁধানো সরু পথ, এই অপরূপ পাথরে তৈরি লাল টালির ছাদে ছাওয়া ঘরবাড়ি, এরা তো নিজেই নিজেদের কথা বলবে।
—’এ শহরের পত্তন কবে, কেউ ঠিক করে না জানলেও দশম শতকে সই করা একটা জমির দলিল রয়েছে এখানে।’—ভালেরির কথা এ কান দিয়ে ঢুকে ও কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কান খাড়া হয়ে ওঠে, ভালেরি বলছে, ‘ত্রয়োদশ শতকে দান্তে আলেগিয়েরি এসেছিলেন এখানে। ফ্লোরেন্সের রাজনৈতিক দূত হয়ে। টাসকানির সব গুয়েলফ শহরগুলিকে একজোট হবার ডাক দিতে। বক্তৃতা দিয়েছিলেন এখানে দান্তে। সবচেয়ে মজা কী জানো, রেনেসাঁসের পরবর্তীকালে ভীষণ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে প্রায় জনবর্জিত এই শহরটার কোনও পরিমার্জনা হয়নি শত শত বছর, অদলবদল হয়নি কোনও। সেই কল্যাণেই আজ আমরা এখন মধ্যযুগীয় দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। অন্যান্য শহরে তো এরকম সুরক্ষা ঘটে না, শহর বাড়ে, বাড়ির সংস্কার হয়, শহর বদলে যায়। এখানে সেসব হতেই পারেনি!’
দান্তে
—আচ্ছা, দান্তে কোনখানে বক্তৃতাটা দিয়েছিলেন? এখনও লোকে চেনে, সেই জায়গাটা? এবারে ভালেরির ভুরু কুঁচকোয়—দেখি, আমাকে গাইড বুক দেখতে হবে। গাইডবুক দেখে উজ্জ্বল হাসল ভালেরি,–পেয়েছি। এই যে এইখানে, সিভিক মিউজিয়ামে বক্তৃতা দিয়েছিলেন—নাকি, টাউন হলে? নাকি দুটোই এক? সংশয় উপস্থিত! আমি নিৰ্ভীক—ওইখানে গিয়ে জেনে নিলেই হবে। তখন নিশ্চয়ই সিভিক মিউজিয়াম বলে কিছু ছিল না।
গিয়ে দেখা গেল দুটোই পাশাপাশি, গায়ে গায়ে লাগা। টাউন হলের বিরাট উঠোনের ওপাশেই সিভিক মিউজিয়াম। সেখানে আছে ‘দান্তে সভাঘর’। সেখানে মহাকবি দান্তেকে সান জিমিনিয়ানো থেকে নাগরিক সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে। এখন ঘরটি পেন্টিং গ্যালারিতে পরিণত করা হয়েছে।
টাসকানির চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকের প্রসিদ্ধ চিত্রকরদের ছবি সেখানে আছে। আগাগোড়া ফ্রেস্কো ছবিতে ভরা ঘরটির দেওয়াল। কিন্তু এসব কিছুই আমরা দেখতে পেলাম না। বিপুল এক কালো রঙের কাপড় না প্লাস্টিক কী জানি দিয়ে সৌধটি সযত্নে বোরখা পরানো রয়েছে, সর্বাঙ্গে তার পাইপ দিয়ে ভারা বাঁধা, ভারি দরজার গায়ে, নোটিস মারা,—‘ মেরামতির জন্য বন্ধ।’ কতদিন যাবৎ বন্ধ আছে? রাস্তায় যাঁরা ট্যুরিস্টদের উপকারের জন্য এটা ওটা বিক্রি করতে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁরা বললেন,–’অনেক দিন। কয়েক মাস
ডুয়োমো
ওঃ তাহলে মন খারাপ করে লাভ নেই। চলো বরং যাই, ডুয়োমোতে, অর্থাৎ ক্যাথিড্রালে। কী? সেটা খোলা তো? যাক, খোলা। ভেতরে ঢোকার আগে অনেকগুলো সিঁড়ি পার হতে হয়। সিঁড়িতে ইতিউতি মানুষ বসে আছে। সান জিমিনিয়ানো ট্যুরিস্টে ভর্তি। চতুর্দিকে পৃথিবীর হেন ভাষা নেই যা শুনতে পাচ্ছি না। কেবল আমার স্বদেশী, ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্টের কোনও ভাষা কানে এল না, কোনও মানুষ চোখে পড়ল না। বিদেশে দেখা হলে তো আর ইন্দো-পাক বিরোধ মনে থাকে না। বাংলাদেশীদেরও মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধির সহায়তার কথা মনে পড়ে গিয়ে রাগ হয়ে যায় না, শ্রীলঙ্কাও তামিল ব্যাঘ্রের হুঙ্কার ভুলে যায়। কিন্তু দেশোয়ালি ভাইবোন কাউকেই দেখলাম না সান জিমিনিয়ানোর পাঁচিলের অন্তরালে হাওয়া (বা অন্য কিছু) খেতে
ডুয়োমোর ভেতরটি সুন্দর সংরক্ষিত আছে। দ্বাদশ শতকের গির্জা। বাইরে থেকে দেখলে খুব কঠোর মূর্তি, কোনও রসকষ নেই। ওই যুগের অনেক ইতালীয় গির্জারই এমনই রুক্ষ শুষ্ক বহিরঙ্গ। কিন্তু তাদের ভেতরে ঢুকলে ছবিতে ছবিতে ছয়লাপ। অন্তরঙ্গে অন্য দৃশ্য। এখানেও তাই। কিন্তু আমার মনে হল এখানে নানান জাতের নানা যুগের কারুকৃতির ছাপ রয়েছে। বাইরেটা রোমানেস্ক, অথচ ভেতরের অপূর্ব খিলেনগুলো গথিক, আবার রংচঙে ছবি আঁকার ধরন দেখে নিও-ক্ল্যাসিক্যাল বলেও মনে হয়। অথচ সবচেয়ে মজা, ভেতরে ঢুকলে ছবিতে, রঙে, খিলেনে মিলেমিশে ভারি সুন্দর দেখায়। কোনওটাই চোখে বেমানান লাগে না। যুগে যুগে শিল্পীদের হাত পড়েছে। কিন্তু ছন্দ ভাঙেনি। এই কালজয়ী ‘কোলেজিয়াটা’ গির্জার দুটি বিরাট দরজা, একটি পুরুষ, অন্যটি নারীর প্রবেশের জন্য। আমরা ঠিক যেটা দিয়ে ঢুকলাম, হবি তো হ, সেটাই নাকি ছেলেদের জন্য, বাঁদিকের সেন্ট জনের দোর!
মৃৎপাত্র
আমরা মুগ্ধ নয়নে সান জিমিনিয়ানোর ভেতরে বেড়াচ্ছি, বড় বড় তোরণের মধ্য দিয়ে। একেকটা চকমেলানো পিয়াৎজাতে গিয়ে পড়ছি—বাড়িঘর সবই সেই পাথরে তৈরি মধ্যযুগের ইমারত, সেখানেই ছেলেপুলে নিয়ে ঘরসংসার করেন সান জিমিনিয়ানোর বাসিন্দারা। যাঁরা ওখানে দোকানপাট ব্যবসা-বাণিজ্য চালান, সরকারি অফিসে কাজ করেন, রেস্তোরাঁয় কাজ করেন। বড় বড় চক থেকে সরু সরু সব গলি বেরিয়েছে বড় বাড়ির পিছন দিকে বসবাসের বাড়িঘর। সান জিমিনিয়ানোতে কেবল দোকান, কেবল রেস্তোরাঁ। চমৎকার সব পটারি (সিয়েন্নার পটারিই) এখানে বিক্রি হচ্ছে। সিয়েন্না না গিয়েও ভালেরি আত্মসংবরণ করতে পারল না, বিশাল একটি আলপনা আঁকা থালার মতো মৃৎপাত্র কিনে বসল, ফল রাখার তারপর প্যাকিং, এয়ার ফ্রেইট…ঠিক যা যা ও করতে চায়নি! ওর ক্ষতিটা যা হবার তা হলই, মাঝখান থেকে বেচারি আমার সিয়েন্নাটা ফসকে গেল।
ভিয়া জিয়োভাল্লির দুপাশে ফ্যাশনেবল দোকান, তাতে হরেকরকম চিজ। সবই ইতালির বলে চলে যাচ্ছে। তারই মধ্যে দিব্যি আমাদের মুর্শিদাবাদি সিল্কের রুমাল ঝুলছে, কাশ্মীরি কাঠের বাক্স, ত্রিপুরার বেতের পাখা। প্রধানত বিক্রি হচ্ছে নানারকমের বেতের ঝুড়ি, সাজি, টুপি আর কাঠের জিনিসপত্র, সুন্দর-সুন্দর-আর হলুদ, নীল কারুকার্য করা মৃৎপাত্র। আর কত যে পুঁতি-পাথরের মালা! কত দুল! যেন দিল্লির জনপথে হাঁটছি।
ছাদের অতিথি
আমাদের হোটেল এই রাস্তারই ওপরে। ছাদের ওপর একটা ঘর, বাথরুম, দুটি খাট। সঙ্গে মস্ত খোলা ছাদ। আঃ—বেরিয়ে দেখি, আরে, ওখানে কে? ছাদে যে হাওয়া খাচ্ছেন আরেকজন! তিনিও খুব অবাক আমাকে দেখে। তিনি আছেন পাশের ঘরে। কিন্তু তাঁর বাড়িটা অন্য। তাঁর সিঁড়িটা অন্য। তিনিও জানতেন না এখানে আরেকটা ঘর আছে। তাঁর স্ত্রী ছুটে বেরিয়ে এলেন, চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি। স্বামীর হাত জড়িয়ে দাঁড়ালেন। তাঁদের পিছনে সন্ধ্যার আকাশে উঁচু উঁচু মিনারগুলিকে সশস্ত্র প্রহরীর মতো দেখাচ্ছিল। কোনও কারণে ছাদটাকে দেওয়াল দিয়ে ভাগ করে ছোট করে ফেলা হয়নি। আমাদের উত্তর কলকাতায় তো ছাদে ছাদে জোড়া অনেক বাড়ি আছে। তবে ঠিক এইরকম নয়। এবারে ভালেরিও বেরিয়ে এল—এবং মহিলা একটু স্বস্তি পেলেন। আমি তাহলে ওঁর স্বামীর পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক এসে হাজির হইনি। ভালেরির স্বভাব খোলামেলা। ওদের দেখেই বলল, ‘কী আশ্চর্য! এরা আবার কোথা থেকে এল?’ ওঁরা হাঁফ ছেড়ে বললেন, ‘কানাডা থেকে!’ একঝলক হাসি মিশে গেল ক্যাশিয়া ফুলের গন্ধে। ছাদের কিনারে গিয়ে দেখি কোথায় জনবহুল ভিয়া জিয়োভান্নি? এখানে তো শহর নেই? নিঃশব্দ উঁচু উঁচু মিনার বাঁদিকে—আর প্রাচীর। বাইরে ঢালু পাহাড় নেমে গেছে আর সারি সারি ক্যাশিয়া গাছেরা আমাদের ‘শুভ সন্ধ্যা’ বলছে। এটা এ শহরের পিঠের দিক। এবাড়িও পিঠের দিক।
নিশাচরী
চলতে চলতে, দেখতে দেখতে, না আসে পায়ের ক্লান্তি, না চোখের। চোখের খিদে আর মিটছে না সান জিমিনিয়ানোতে। তবু পেটের খিদে বলেও একটি ব্যাপার আছে। অতএব আমরা ডিনার করতে বেরুই। এবার যাই সান মাতেও ধরে। আহা কী সুন্দর খিলেন দিয়ে জোড়া পথের দুপাশের বাড়িঘর। খিলেনের পর খিলেন। শান্ত পথ। অমন দোকানপাট নেই। অবশ্য সান জিওভান্নির দোকানপাটও বন্ধ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। তার ডিজাইনার পোশাকের জানলাগুলিও অন্ধকার। এ গলি সে গলি হাঁটছি এখন আমরা, ভালেরির আদর্শ ‘টাসকান ফুড’-এর সন্ধানে। এক কোণে একটা মার্কিন হ্যামবার্গারের দোকান দেখেই আমি মহাউল্লসিত–দিব্যি সস্তায় খাওয়া হয়ে যাবে? কিন্তু ভালেরি তাতে ঢুকবে কেন? তার তো পকেট ভারি! অথচ খেতে ঢুকলে, যা বিল হবে, তা আধাআধি ভাগ হবে, ‘ফ্রি রাইড’ বলে তো থাকা-খাওয়াও ফ্রি করে নিইনি। ‘আহা, আমি তৃতীয় বিশ্বের গরিব কবি’ ভাব করলেই ভালেরি তক্ষুনি আমার ভার নিয়ে নিত, কিন্তু আমারও তো টুনটুনির আধুলি আছে!
ভালেরির শখের দোষ নেই, সারাটা রাস্তা আমার ‘টাসকান ফুড’ আর ‘কিয়ান্তির’ বিজ্ঞপ্তি দেখতে দেখতে কন্ডিশন্ড হয়ে গিয়েছি। শেষে একটি আঙুরওলার রেস্তোরাঁ ওর মনে ধরল। মনোরম পরিবেশ। আমরা ঢুকে টেবিল বেছে নিয়ে গুছিয়ে বসে পড়ি। এবং বসেই থাকি। আমাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। আমরা অনন্ত প্রতীক্ষায় উদ্গ্রীব। তাতে তাদের ভারি বয়েই গেল। এদিকে খিদে অনন্ত প্রতীক্ষায় রাজি নয়, সে গাঁইগুই করছে। একসময়ে আমরা তেড়ে ফুঁড়ে উঠে পড়ি, রেগেমেগে বাইরে এসে ‘যাহাই পাইব তাহাই খাইব’ মনে করে যে দোকানেই ঢুকি সেইখানেই কেউ মিষ্টি হেসে জানিয়ে দেয়, ‘সরি, সার্ভিস ক্লোজড!’ তবে কী আমাদের উপোস করতে হবে? একটি ওয়েট্রেস খুব পরোপকারিণী। তিনি একটি রেস্তোরাঁর সন্ধান দিলেন যেখানে অনেক রাত পর্যন্ত খেতে পাওয়া যাবে। সেখানে গিয়ে দেখি বেশ শান্ত, ছোটখাটো, সুন্দর দোকান। তবে অত রাতে কোনও ফ্যান্সি খাবারের অর্ডার নেবে না তারা, পিৎসা করে দেবে—’ফ্যান্সি ওয়াইন খাও’, ওয়েটার বুদ্ধি দেন। তাই করি। তবে ওখানে যে বস্তুটি পিৎসা বলে খেলাম মার্কিনি পিৎসার সঙ্গে তার তুলনা চলে না। অপূর্ব সুস্বাদু খাদ্য-টাসকান পিৎসা কিনা? ভালেরি তাতেই খুশি এখন। সঙ্গে কিয়ান্তি। তারপরে আমি তাদের বিশাল টেবিলক্লথটি তুলে সযত্নে ভাঁজ করে বগলদাবায় পুরছি দেখে হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন ওয়েটার।—ওটা কেন, ওটা কেন, ফ্রেশ একটা নিয়ে যাও!’ হালকা ক্রিম রঙের দানা-দানা কাগজে সিপিয়া রঙে আঁকা সান জিমিনিয়ানোর স্কাইলাইন। অপূর্ব সুভেনির। ওঁরা তো এটা এক্ষুনি ফেলেই দেবে! দিলও। আমাকে একটা নতুন কাগজের ফ্রেশ টেবিলক্লথ এনে প্রেজেন্ট করলেন হাসিখুশি ওয়েটার। এতক্ষণ আমার দেহাতী আচরণে লজ্জিত, সংকুচিত, নিস্তব্ধ ভালেরি এবার সবিনয়ে বলল, ‘আমিও একটা পেতে পারি কি?’
আমার পকেট বেশি হালকা হয়নি, পিৎসা বলে কথা! কিয়ান্তিটাই যা দামী। তাও তো এখানেই সবচেয়ে সস্তায় কিয়ান্তি পাওয়া যায়। পশ্চিমে এত ওয়াইনারি আর Vendita diretta (সান জিমিনিয়ানোর ভেতরেও ক্রেটে ভর্তি কিয়ান্তি, আর সান জিমিনিয়ানো ওয়াইন বিক্রি হচ্ছে দোকানির নিজস্ব ওয়াইনারিতে তৈরি) দেখতে দেখতে টাসকানি এসে কিয়াস্তি না খেলেই চলছিল না আর।
কবেকার অন্ধকার
খেয়ে বেরিয়ে দেখি, আরে, একটা অজপাড়াগাঁয় এসে পড়েছি। যখন বেরিয়েছিলাম, তখন সবে সন্ধে হয় হয়, আকাশে দিনের আলোর সামান্য রেশ লেগে আছে নীলচে আভা হয়ে, এদিকে পিয়াসা ডেল্লা সিস্টের্নার দোকানপাটে রঙিন আলো জ্বলে উঠেছে, ভিয়া জিওভান্নির স্টাইলিশ দোকানে পুরনো দিনের ধরনের বাতি জ্বলছে, চারপাশে এক মায়াময় নাগরিকতা ঝলমল করছিল। সন্ধ্যারাত্রের সেই মোহনমায়া কোথায় মুছে গিয়েছে—রীতিমতো গা ছমছমে অন্ধকারে, সেই ফাঁকা ফাঁকা পাথুরে রাস্তায় অলিগলি দিয়ে টর্চের আলোয় পথ খুঁজে নিয়ে হোটেলে ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিল বুঝি হারিয়েই যেতে বসেছি দ্বাদশ শতাব্দীর গহন ঘন অন্ধকারে।
ভোর ভি
পরদিন ভোরে উঠে স্নান করে আমরা বেরিয়ে পড়ি কফি খেতে। ভিয়া জিয়োভান্নিতেই অনেক টেবিল চেয়ার পড়েছে, টাটকা কফির সুবাসে পথের বাতাস ‘ম-ম’ করছে। বসব? না হাঁটব? ঠিক করলাম আমরা আবার যাব সেই ইঁদারার আঙিনায়। শহরটি ছোট কিন্তু অনেক কটি চক আছে, সবচেয়ে বড়টি এই সিস্টার্ন স্কোয়্যার। মাঝখানে একটি আটকোনা ঢাকা ইদারা আছে। ইঁদারাকে যে এরা সিস্টার্ন বলে তাইবা কে জানত? পিয়াসা ডেল্লা সিস্টের্না। ক্যাথিড্রালের চকটির নাম পিয়াসা ডেল ডুয়োমা। সত্যি তার চরিত্রই আলাদা। সাধুসন্নিসী টাইপের, শুকনো, সংযত চেহারা। এটি কিন্তু বেশ রসেবশে টুসটুসে করছে। রীতিমতো সুন্দরী, চতুর্দিকে সাজানো রেস্তোরাঁ, সুন্দর দোকানপাট, রঙিন ফুলের টবে, পাতাবাহার গাছের টবে সাজানো রঙিন ছাতার নীচে কাফে (মাটি তো নেই, পাথর বাঁধানো উঠোন, গাছ-ফুল চাইলে, টবই ভরসা!) চারদিকে উঁচু উঁচু মিনার-দর্পিত, মধ্যযুগের গল্পভরা প্রাসাদ আর দিগ্বিদিকে ছুটে গেছে রহস্যময় সব পথ, সুন্দর সুন্দর তোরণের তলা দিয়ে আশ্চর্য সব পিয়াসাতে হারিয়ে যেতে। এই ইঁদারা আঙিনায় সান জিমিনিয়ানোর নাড়ীটা যেন দপ দপ করছে। কিছুটা আলস্য, কিছুটা স্মৃতি ধূসরিত রহস্য, বিগত সময়ের প্রতি সম্ভ্রম–আর কিছুটা ব্যবসা, বিদেশি পদচ্ছাপে ভরা কৌতূহল।—এই চকটাই আমাদের সকালবেলার কফি খাবার পক্ষে সবচেয়ে যোগ্য ঠাঁই বলে মনে হল।
সকালবেলায় অন্য আরেক মায়াময়তা আছে এই চকের। গতকাল যেখানে বসে বুকজুড়োনো টাটকা লেবুর শরবত খেয়েছি দুজনে আজ আর সেখানে না-বসে টাটকা রুটির গন্ধ শুঁকে শুঁকে গিয়ে উল্টোদিকের একটা কাফে বেছে নিই। রঙিন ছাতার নীচে নরম গোলাপি টেবিলক্লথ পাতা, সাদা টেবিল চেয়ার। আজকে খাচ্ছি ফেনাওঠা কাপুচিনো কফি আর টোস্ট। না মশাই, এ টোস্ট সে টোস্ট নয়, এ হল অলিভ অয়েল আর রসুন দিয়ে সেঁকা ঘরে তৈরি তাজা রুটি। আর অলিভ অয়েল মানেও যেমন তেমন অলিভ অয়েল নয়, সদ্য পেষা সবুজ রঙের জলপাই তেল, যাতে কাঁচাফলের স্বাদটা, রংটা, এখনও লেগে রয়েছে। বড় বড় শহরের মুদির দোকানে যা মিলবে না। ভালেরি আরেকটু মদতদার খাদ্য খাবে এবং কমলালেবুর রস। এই বেলাটা যার-যার, তার তার। আমি কমলালেবুর রস দেশে গিয়ে খাব ভাই। এখন থাক বড্ড দাম!
স্মৃতিবিধুরতা
গরম কফি ঠান্ডা করে খাওয়া আমার স্বভাব। ভালেরির খাবারও আসবে। অলস চোখে তাকিয়ে আছি নির্দিশা দৃষ্টি। ক্যাশিয়ার তীব্র সৌরভে কি ‘অভ্যস্ত’ হয়ে গেলাম? কী সর্বনাশ। আর তো তেমন পাগল-পাগল লাগছে না? নাঃ, তার আগেই, নেশাটা কাটাবার আগেই টাসকানি ছেড়ে পালাতে হবে। এই স্কোয়্যার দিয়ে দান্তে হেঁটে গিয়েছিলেন আজ থেকে ছশো বছর আগে। পলিটিক্যাল ক্যাম্পেন করতে তাঁর দলের জন্য। কবিতা লিখতে নয়।
সামনে দিয়ে বিচিত্র মানুষের মেলা চলেছে—সবাই ছুটির মেজাজে, সবাই যৎসামান্য পোশাকে। সান জিমিনিয়ানো বয়ে যেতে লাগল আমার স্মৃতির মধ্য দিয়ে। আকাশচুম্বী মিনারের সারিতে ভরা দর্পিত এক প্রাচীর নগরীর চিত্ররেখা। নানান ভাষায় দর করতে ব্যস্ত হাফপ্যান্ট পরা নানান বয়সের প্রেমিক-প্রেমিকা। পাথর বিছানো পথে পথে চলে-ফিরে বেড়ানো, আর ডুয়োমোর শান্ত স্তব্ধতায় থমকে দাঁড়ানো ত্রয়োদশ শতক। ভিয়া সান জিওভান্নির ভিড়, ভিয়া দেল কাসডেন্নোর কঠোরতা, ভিয়া সান মাতেওর খিলেনের পরে খিলেন। পিয়াসা পেকোরির শান্ত চত্বর, সালভুচ্চিদের যমজ মিনার, খ্রিস্টপূর্ব এট্টুস্কানদের সমাধিভূমি। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পিয়াসা ডেল্লা সিস্তের্নার শান্ত সাদা প্রশস্ত পাথুরে প্রাঙ্গণের মাঝখানে, আটকানো ইঁদারার সিঁড়ির ওপর আস্তে করে বসে পড়ল বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক। একটা সিগারেট ধরাতে গেল। দেশলাইটা জ্বলে উঠতেই তার খেয়াল হল, দ্বাদশ শতকের এমন ঝকঝকে উঠোনে ছাই ঝাড়াটা কি উচিত হবে।
প্রকাশ : ‘ভ্রমণ’ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৯৬