সান্তা মনিকা স্টেশন পেরিয়ে

সান্তা মনিকা স্টেশন পেরিয়ে

সান্তা মনিকা স্টেশন কলোনির পাশে ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে থাকতাম আমরা। আমি আর আমার বড় বোন। আমার বড় বোন ছিল বেশ ছোটখাটো একজন মানুষ। তার কাঁধের চেয়ে কোমর ছিল অতিরিক্ত রকমের চওড়া। ওর চোখের দু-পাশে তিনটি করে ভাঁজ জমে থাকত তীরের মতো। গালে ছিল বেশ বড় আকৃতির একটি জঙুল। মাথার অল্প কিছু পাতলা চুল নানাভাবে বেঁধে ও নিজের মুখটাকে কিছুটা স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করত। আমার বোনের বাম পা ডান পায়ের চেয়ে ছিল একটু ছোট। তাই ওকে বাম পায়ে একটু উঁচু জুতা পরে হাঁটতে হতো, তাও কিছুটা পা টেনে টেনে।

সান্তা মনিকা স্টেশনের কাছাকাছি যে বাড়িটায় আমাদের বসবাস, সেটা ছিল বহু বছরের পুরোনো, বিবর্ণ ও স্যাঁতসেঁতে। তিনতলায় ছিল আমাদের ফ্ল্যাট। বাড়ির পাশ দিয়ে যখন ট্রেন যেত, তখন বাড়িটা ঝনঝন ঝনঝন বাজনা তুলে কাঁপত মুড়ির টিনের মতো। আমি শুনেছিলাম আমার বাবা-মা ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মারা গেছে আমার জন্মের পরপর। তারা স্বেচ্ছায় ট্রেনের নিচে চলে গিয়েছিল নাকি ট্রেনই দুর্ঘটনাবশত তাদের ওপর চলে এসেছিল তা আমি জানি না। তবে আমার বাবা-মায়ের মৃত্যুর কারণেই হয়তো ট্রেন আসার শব্দ শুনলেই আমার মনে বিচিত্র রকমের একটা আকর্ষণ কাজ করত। একটা দুর্বার ডাক। ওই সময়টা আমি জানালায় কাঁচ সরিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম, যতক্ষণ ট্রেনটা তার চলে যাওয়ার সমস্ত শব্দ নিয়ে আমার চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে না যেত ৷

আমার বোন রান্নাবান্না খুব বেশি পারত না। বাঁধাকপির স্যুপ, ছোট মাছ ভাজা, পাতলা ডাল, আলু-টমেটো ও সবজি দিয়ে বিচিত্র এক রকমের ভর্তা বাদে আর কোনো ধরনের কিছু ওকে বানাতে দেখিনি। ঘুরেফিরে এই খাবারগুলোই খেতাম আমরা। প্রতি শনিবার খুব ভোরে আমাদের বাজারে যাওয়া হতো। আমার বোন এই এলাকার যে ছোট দোকানে হিসাবনিকাশের কাজ করে সেখানে ওকে যেতে হয় টানা ছয়দিন। শুধু শনিবার দিনটাই ছিল ওর ছুটি। তাই সেই দিনটা আমরা কাঁচাবাজারের কাজটুকু সেরে রাখতাম। আমরা কখনোই এক সপ্তাহের চেয়ে বেশি দিনের বাজার করতাম না। আমার বোনের সবকিছু হিসাব করা। তাই, শুক্রবার রাতের খাবারের সাথে সাথেই আমাদের খাবার ফুরিয়ে যেত। কাঁচাবাজার করতে যাওয়ার সময় অন্য শহর থেকে আসা বিভিন্ন দোকানদার প্রায়ই আমাদের নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠত। অকারণেই খোশগল্প জমাতে চাইত। তারা যদি অল্পবয়সি কোনো পুরুষ হতো তা হলে আমার বোন সেই দোকানে থাকত দীর্ঘ সময়। আর তারা যদি হতো মধ্যবয়স্ক বা বুড়ো তা হলে তাদের সাথে প্রতি মুহূর্তে সে শুধু সবজি বা চালের দাম নিয়ে ঝগড়া করে যেত। আসলে সে মনে মনে প্রাণপণে একজন জীবনসঙ্গী খুঁজছিল, কিন্তু কোনো ছেলে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তার মাথার চুল কমে যাচ্ছে, দিন দিন গালের জঙুলটা আরও বড় হচ্ছে, চোখের তীর-আঁকা ভাঁজ হচ্ছে গাঢ়। গলার চামড়ায় জেগেছে ঢেউ। সব মিলিয়ে তাকে দেখতে লাগে বিকট। আমাদের প্রতিবেশীরা অনেক আগে থেকেই কানাঘুষা করে যে আমার বোনের কখনোই বিয়ে হবে না। এমনিতেও ওর অনেক বয়স হয়ে গেছে। কথা অবশ্য কিছুটা সত্য। আমার বোনের সাথে আমার বয়সের তফাৎ এতই বেশি যে বাজারে কোনো পথচারী বা নতুন দোকানি যদি আমাকে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, কিরে মায়ের সাথে বাজারে এসেছিস? আমি উত্তর দেওয়ার আগেই আমার বোন অসম্ভব গম্ভীর ও শীতল স্বরে বলে ওঠে, ও আমার ছোট ভাই…। কিন্তু এই চারটি শব্দেই প্রচণ্ডভাবে বোঝা যায় প্রশ্ন করা মানুষটার ওপরে সে কী অসম্ভব রেগে গিয়েছে।

আমি যেই স্কুলে পড়ি, সেখানে এখন আমার কোনো খেলার সঙ্গী নেই ৷ আগে আমার একটা বন্ধু ছিল। কিন্তু সেই ছেলেটি এলাকা বদল করে অন্যখানে চলে গিয়েছে। তাই ক্লাসে পড়ালেখার বিষয় বাদে আমার কারো সাথেই কোনো গল্পস্বল্প হয় না। আমরা প্রতি সপ্তাহে একই ধরনের খাবার খাই, প্রতি শনিবারে যাই বাজারে, আমার বোন ছয়দিন কাজ করে, আমি পাঁচদিন ক্লাস করি আর প্রতিরাতে আমি জানালার কাঁচ তুলে ট্রেন চলে যাওয়ার সময় একইভাবে জেগে বসে থাকি। আমাদের একঘেয়ে সময় চলে যাচ্ছিল এভাবেই। যতদিন আমাদের জীবনে জোসেফ না এলো।

জোসেফ সান্তা মনিকা শহরের অনেক পুরোনো একটা বেকারির মালিক। সে আগে মালিক ছিল না, ছিল শুধুই কর্মচারী। অল্প কিছুদিন হলো মালিক হয়েছে। আগে মালিক ছিল ওর বাবা। এরপর এক রাতে ওর বাবা হঠাৎ ঘুমের মধ্যে মারা গেল মুখে ফেনা তুলে। অনেকে বলে, তাকে আসলে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। সত্যটা কেউ জানে না। এ ঘটনার পর থেকে বেকারির দোকানের সবকিছু দেখাশোনা করছে জোসেফ। ও মধ্যবয়স্ক, মাঝারি গড়ন, মৃদুভাষী। চওড়া সোলের বুট পরে হাঁটে। ওকে এই এলাকার সবচেয়ে ভদ্র পুরুষদের একজন বলে ধরা হয়। আজ পর্যন্ত কেউ মদ খেয়ে মাতলামি করতেও দেখেনি। এর আগে কখনো দেখা যায়নি কোনো মেয়ে বা নারীর সান্নিধ্যেও। আর কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করা তো দূরের কথা। আক্ষরিক অর্থেই জোসেফ ছিল একজন সাদামাটা, ভদ্র মানুষ। জোসেফের সাথে আমার বোনের কীভাবে পরিচয় হয়েছিল তা আমি জানি না। শুধু এটাই জানি যে, সে আমাদের ফ্ল্যাটে আসা শুরু করল প্রতি সপ্তাহে এক দিন পরপর। আর সবচেয়ে ভালো বিষয় ছিল, মানুষটা কখনোই একা আসত না বা খালি হাতে আসত না। ওর সাথে সবসময় থাকত একটা খয়েরি কাগজের ব্যাগ। সেই ব্যাগে থাকত কোনো না কোনো মিষ্টি খাবার, নিজের বেকারি থেকে আনা।

আমার সঙ্গে দেখা হলেই জোসেফ বলত, এই নাও স্ট্রবেরি টার্ট। খেয়ে দেখো তো মিষ্টি ঠিক আছে নাকি? কখনো সে আমার ঘরে এসে বলত, লেমন চিজ কেক কেমন লাগে তোমার? কখনো বলত, রেড ভেলভেট কেক আজকের স্পেশাল। আগামীকাল ব্লুবেরি মাফিন নিয়ে আসব। জোসেফের বেকারির নানারকম সুস্বাদু মিষ্টি কেক, পেস্ট্রি ও মাফিন দিন দিন এত জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল যে, শহরের অন্যান্য বেকারিগুলোকে লোকজন গোনার মাঝেই রাখত না। কেউ ওখানে একবার গেলে অন্তত তিন রকমের কেক ছাড়া ফিরে আসত না। আর সপ্তাহে তিন-চার দিন একেক রকমের মিষ্টি খাবার পেতে পেতে আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল ওর বেকারিরই সমস্ত খাবারের নাম ও স্বাদ। আমি একটা পর্যায়ে শুধু ঘ্রাণ শুঁকেই বলে দিতে পারতাম কোনটা অরেঞ্জ পাই, কোনটা কুকি কাস্টার্ড, কোন পেস্ট্রিতে পপি সিড দেওয়া বা কোন পুডিংয়ে কেমন চকোলেট মেশানো।

জোসেফের জন্য প্রতি আটচল্লিশ ঘণ্টা পরপর আমি অপেক্ষা করতাম। আমার বোনের পাশাপাশি আমারও জীবনের একটা অংশ হয়ে গিয়েছিল ও। ওর আরেকটা চমৎকার ব্যাপার ছিল। মাঝে মাঝে আমার হাতে বেকারির খয়েরি ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে ও নিচু স্বরে বলত, আজকের কেকটা এমনভাবে খেতে হবে, যেন খাওয়ার সময় অনেক শব্দ হয়। তুমি এমন করে খাবে যেন খাবারটুকু খাওয়ার শব্দটা নিজের কানে পরিষ্কারভাবে শুনতে পারো। খাবারে প্রথম কামড়টুকু দিয়েই সবার আগে বলবে, উমমম… এরপর খাওয়া শেষে আবারও ঢকঢক শব্দ তুলে পানি খেতে হবে। তাহলেই তুমি খাবারের আসল স্বাদটুকু বুঝতে পারবে। আমি জোসেফের প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম। আমাকে এ ঘরে মিষ্টি খাবারের সাথে বসিয়ে রেখে জোসেফ আমার বোনের পিছু পিছু চলে যেত তার ঘরে। এরপর বন্ধ হয়ে যেত ওদের ঘরের দরজা ৷

তারপর জোসেফ যখন আধঘণ্টা পর আমার বোনের ঘর থেকে বের হয়ে আসত, তখন বাড়িজুড়ে ছড়িয়ে থাকত একটা রহস্যময় অথচ হালকা মিষ্টি ঘ্রাণ। জোসেফ চলে গেলে আমি আবারও অপেক্ষা করতে থাকতাম ওর জন্য। ভাবতাম আবার কবে ও আসবে? এর পরের বার আমার জন্য কোন খাবারটা নিয়ে আসবে? শনিবার দিনটাকে আমি নাম দিয়েছিলাম অ্যাপেল পাই, সোমবারকে রেডবেরি মাফিন, বুধবারকে বলতাম টিরামিসু, শুক্রবারকে কোকোনাট ফাজ।

তবে আচমকা একটা ঘটনা ঘটে গেল একদিন! আমার নবম জন্মদিনের দিন আমি টের পেলাম, ঘুম থেকে ওঠার পর বদলে গেছে কিছু একটা। আমার গায়ের শার্টটা অসম্ভব ঢোলা লাগছে আর আমার পায়জামাটা এমনভাবে কোমরে আটকে গেছে যেন কেটে বসে পড়বে পেটের চামড়ার ওপর। বিছানা থেকে নামতে গিয়ে আমি প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবারও হারালাম ভারসাম্য। ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না আসলে আমার কী হয়েছে! চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলাম আমার বোনকে। ও পাশের ঘর থেকে ছুটে এলো। এরপর ঘরে ঢুকে আমাকে দেখেই থমকে গেল! বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে সরু ও শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আমাকে দাঁড়াতে সাহায্য করল, বদলে দিল আমার পায়জামা। তারপর বলল, আমাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে আর নড়াচড়া না করতে। আরও জানাল আগামী কিছুদিন আমাকে স্কুলে যেতে হবে না। এরপর সে আমার বিছানার রেলিং থেকে দরজার ওপর পর্যন্ত আংটা দিয়ে একটি মোটা দড়ি টাঙাল। এরপর সে কোত্থেকে একটা লোহার বেড়ির মতো গোল জিনিস এনে আমার পায়ে আটকে দিয়ে, দরজার পাশে টাঙিয়ে রাখা দড়ির সাথে আমার বাঁ পা উঁচু করে বেঁধে দিল। আর আমার বাঁ পায়ের নিচে রেখে দিল তিনটি বালিশ। একটা পর্যায়ে এসে আমি বুঝতে পারলাম আমারও আসলে আমার বোনের মতো কাঁধ সরু হয়ে যাচ্ছে, দেহ হয়ে যাচ্ছে খর্বকায়। আমার কোমর কাঁধের চেয়ে বেখাপ্পাভাবে চওড়া হয়ে গিয়েছে। এ কারণেই আগের পায়জামা হচ্ছিল না। শুধু তাই নয়, আমারও বাম পা-টা ছোট হয়ে যাচ্ছে, যা কিছুতেই আমার বোন হতে দিতে চাইছে না। তাই সে দড়ি দিয়ে বেঁধে আমার সেই পা-টাকে লম্বা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

আমি টানা এক সপ্তাহ ওভাবেই শুয়ে থাকলাম। বিছানা থেকে নামার কোনো অনুমতি আমার ছিল না। আমার বোন শুধু কাজে যাওয়ার আগে আমাকে একবার টয়লেটে নিয়ে যেত, সে কাজ শেষে বাড়ি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমার টয়লেটে যাওয়াও ছিল বারণ। এদিকে একটানা বাম পা ঝুলিয়ে বিছানায় শুয়ে থেকে আমি হয়ে উঠেছিলাম ক্রমশ বিরক্ত। আমার বোন কাজে থাকলে মাঝে মাঝে আমি চেষ্টা করতাম হেলান দিয়ে বসার। কিন্তু লোহার বেড়ি ও দড়িতে বাম পা-টা আটকে থাকার কারণে একটু নড়াচড়া করলেই আরও বেশি যন্ত্রণা বাড়ত। ওই সময়ে জোসেফের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আমার হাতে আর কোনো কাজ ছিল না। এমনকি আমি আর জানালার সামনে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারতাম না ট্রেন চলে যাওয়ার সময়। ভালো বিষয় হলো, জোসেফ আমার এই অবস্থা দেখে কোনো বিস্ময় তো প্রকাশ করেইনি বরং সে পরের দিন হাজির হয়েছিল আস্ত একটা কেক নিয়ে। কেকটা ছিল লেমন, অরেঞ্জ ও ভ্যানিলা ফ্লেভারের। আমি দীর্ঘ সময় নিয়ে, মুখ দিয়ে নানা রকম শব্দ করতে করতে কেকটা শেষ করেছিলাম।

সেই কয়েকটা দিন আমি ঘর থেকে বের হতে পারতাম না বলে আমার বোনের ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর সেই রহস্যময় মিষ্টি ঘ্রাণটা বাতাসে ঠিক কতটুকু ছড়াত তাও আমি পুরোপুরি জানতে পারতাম না। আমার কিছুটা খারাপ লাগত। অল্প কিছুদিন পর আমার বোন হাল ছেড়ে দিল আমাকে নিয়ে। মনে হয় বুঝে গেল, আমার বাম পা আর কোনোদিন আগের মতো হবে না। এরপর আমাকেও একটা উঁচু জুতা বানিয়ে দেওয়া হলো। যেন ঠিকমতো হাঁটতে পারি। একইসাথে একটা লাঠিও দেওয়া হয়েছিল যেন জুতা ছাড়াও দাঁড়াতে পারি সোজা হয়ে। আমি আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিলাম। কিন্তু, আমার এমন পরিবর্তনের কারণে ক্লাসের ছেলেগুলো আমার সাথে পড়ালেখা নিয়ে কথা বলাও বন্ধ করে দিল। আমি হয়ে গেলাম আরও একা। শুধু তাই নয়, আমার বোন আমার দিকে এমনভাবে তাকাত যেন সে আমাকে চিনতে পারছে না তবে একইসাথে সে আমাকে নিয়ে শঙ্কিত। আমি এসব কিছুর মধ্যে থেকেই কোনোক্রমে পড়ালেখা করে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। রাত হলে অন্ধকারে ছুটে আসা ট্রেনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মাঝে মাঝে আমার মনে হতো জানালা খুলে ঝাঁপ দিয়ে আমিও ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে যাই আমার বাবা-মায়ের মতো।

এভাবে দেখতে দেখতে প্রায় বছর শেষ হয়ে গেল। আমার দশম জন্মদিনে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি আবিষ্কার করলাম, আবারও বিছানা থেকে উঠতে পারছি না। তারপর বুঝতে পারলাম আমার গায়ের শার্টটা হয়ে গেছে আরও ঢিলা। কাঁধ দু-পাশ থেকে চেপে এসেছে সরু হয়ে। এবং আমার কোমরে এতই ব্যথা যে এঁটে থাকা পায়জামাটা এমনি এমনি খোলা যাবে না। সম্ভবত কেটে বা ছিঁড়ে খুলতে হবে। আমি চিৎকার করে ডাকতে থাকলাম আমার বোনকে। আমার বোন এসে, কেঁচি দিয়ে কেটে আমার পায়জামা খুলতে পারল। বাড়িতে থাকা আর কোনো পায়জামা বা প্যান্ট আমার হচ্ছিল না। তাই আমার বোন আমাকে তার বহু আগের একটা গোলাপি স্কার্ট পরতে দিল। আমি সেটা পরে গায়ে চাদর দিয়ে বসে থাকলাম আর জোসেফের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। আমি টের পেয়েছিলাম আমার কাধ ভয়াবহ শীর্ণ হয়ে গিয়েছে এবং সম্ভবত আমার বাম পা আরও ছোট হয়ে এসেছে। আমি উপলব্ধি করতে পারলাম, আসলে আমার জন্মদিনটি একটি অভিশপ্ত দিন।

কিন্তু জোসেফ সেদিন এলো না।

তারপর দিনও না।

এরপরেও না।

এভাবে এক সপ্তাহের বেশি হয়ে যাওয়ার পরেও জোসেফকে আমাদের ফ্ল্যাটে একবারের জন্যও দেখা যায়নি। তার কোনো খবরও পাওয়া যায়নি। সন্ধ্যা নামলেই আমার বোনকে আমি বাইরের ঘরে পায়চারি করতে শুনতাম অস্থিরভাবে। আমি বুঝতাম সে জোসেফের জন্য অপেক্ষা করছে। ভেতরের ঘরে আমিও লাঠি হাতে পায়চারি করা শুরু করে দিয়েছিলাম। এবং এভাবেই আরও কয়েকটি সন্ধ্যা কেটে যাওয়ার পর আমি একদিন বুঝতে পারলাম এটা শুধু মিষ্টি বা রঙবেরঙের পেস্ট্রি-মাফিন নয়, আমি আসলে জোসেফের জন্য অপেক্ষা করছি কারণ, আমি ওকে ভালোবাসি। তীব্রভাবে বুঝতে পারলাম, আমি আসলে ভেতরে ভেতরে হয়ে উঠছি ভিন্ন কেউ। আমি আর আগের মতো নেই। আমার বোনের উপস্থিতি দিন দিন আমাকে আরও বিবর্ণ করে তুলছিল এবং আমার মনে হচ্ছিল আমি আসলে শুধু কাঁধে কিংবা কোমরে বা পায়ের আকার-আয়তনে নয়, দেখতেও অবিকল আমার বোনের মতো হয়ে উঠেছি। আমার গালের জড়লটা আগে কোনোদিন এত বড় ছিল নাকি আমি খেয়াল করিনি। হয়তো ছিল বা ছিল না। তবে শুধু জড়লই না, সেই সাথে আসলেই দেহের গড়ন, চোখের দৃষ্টি ও আচরণ সবকিছু আমার বোনের মতো আমার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। যেন একটা ঘূর্ণিঝড় পাক খেতে খেতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আমার ভেতরে। আমাদের মাঝে শুধু একটা দৃশ্যমান তফাৎ ছিল, তা হলো মাথার চুল। আমার ছিল মাথাভর্তি ঘন, গাঢ় চুল।

আমার বোন আমাকে এত বিমর্ষ দেখে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, বাঁধাকপির স্যুপে অল্প একটু মাংসের কিমা ঢেলে দিলে আমার খেতে ভালো লাগবে কিনা। আমি মানা করে দিয়েছিলাম। আমি শুধু এবং শুধুই অপেক্ষায় ছিলাম জোসেফের। আমার বোন আমাকে জানিয়েছিল রুটিতে মাখন ও চিনি মাখিয়ে দিবে নাকি! আমি সেটা খেতেও আপত্তি জানিয়েছিলাম। পৃথিবীতে তখন সবকিছু বিস্বাদ। ট্রেন চলে যাচ্ছিল। রাত নেমে আসছিল। চলন্ত ট্রেনের জন্য আমাদের ঝুরঝুরে বাড়িটা তুলে যাচ্ছিল ঝনঝন শব্দ। আর আমি শুধু অপেক্ষায় ছিলাম একটা রহস্যময় মিষ্টি ঘ্রাণ পাওয়ার। শুধু দীর্ঘ প্রতীক্ষায় ছিলাম জোসেফের ছায়া দেখার। আমি স্পষ্টভাবে মনে করতে পারতাম জোসেফ যখন খাবার দেওয়ার জন্য আমার ঘরে আসত, তখন সে আমার দিকে একটু ঝুঁকে তারপর খাবারের প্যাকেটটা দিত। এবং ওর সেই ঝুঁকে আসার ভঙ্গিটা, সেই দৃশ্যটা আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমি মনে করতে পারতাম জোসেফের মোট কয় রঙের শার্ট আছে, ওর চুল ঠিক কতটুকু কাঁচাপাকা, ওর আঙুল কেমন শক্ত। আমি সব মনে করতে পারলাম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে।

এভাবে ঠিক কতগুলো দিন পার করেছিলাম তা মনে নেই। তবে একদিন আমি আমার বহু কাঙ্ক্ষিত সন্ধ্যাটা পেলাম। হঠাৎ করে জোসেফ এসে উপস্থিত হলো আমাদের ফ্ল্যাটে। আমি সেদিনও আমার বোনের গোলাপি স্কার্টটা পরে ছিলাম। গায়ে ছিল আমার চার বছর বয়সে কেনা একটি মলিন শার্ট। সেদিন অনেকবার কলিংবেল বাজিয়েছিল জোসেফ। ওকে সেদিন উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছিল এবং একইসাথে কিছুটা ক্লান্ত। দরজা খুলে ওকে দেখামাত্রই আমার বোন প্রচণ্ড উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। সে জোসেফের হাত ধরে টেনে তাকে নিজের ঘরে নিয়ে যাচ্ছিল। আর আমি, সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া এক অন্য আমি, আমার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম জোসেফ খুব জরুরি কিছু একটা ভুলে যাচ্ছে। জোসেফকে কিছুতেই এটা ভুলে যেতে দেওয়া যাবে না।

আমি জোসেফ ও আমার বোনের পিছু নিয়ে একই ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম সন্তর্পণে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *