সানাই
‘খাট এসেছে খাট এসেছে!’
মামা একটা মাছের চপ টেস্ট করছিলেন। আধখানা মুখে, আধখানা প্লেটে ফিকে ধোঁয়া ছাড়ছে। তাড়াতাড়ি দোতলার জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালেন। রাস্তায় দুটো বাজখাঁই কুলি। মাথায় ঝকঝকে খোলা খাটের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। একজনের হাতে একটা চিরকুট।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ এই বাড়ি। সাতান্ন নম্বর।’
চপের আধখানা মামার গলা দিয়ে ততক্ষণে নেমে গেছে। তিনি ফিনফিনে আর্টিস্টিক গলায় চিৎকার করে বললেন, ‘রাস্তায় মাত উতারো। থুতু হ্যায়, গয়ার হ্যায়। দিনো, দিনো, তোমার খাট এসেছে।’ বাবা ভেতরের দিকে ছিলেন। চা তৈরির ডিরেকসান দিচ্ছিলেন, ‘যত ভালোই চা হোক, তৈরির গুণেই টেস্ট আর ফ্লেভার। পাক্কা পাঁচ মিনিট পটে ভিজবে। নো তাড়াহুড়ো। তাড়াহুড়ো মিনস সব নষ্ট।’
দিনু তখন সিল্ক সিল্ক একটা গেঞ্জি, নতুন একটা দিশি ধুতি পরে, নতুন বউয়ের ঘরে বসে ছিল। নিজের বউয়ের একটু তদারকি করছিল। আড়ষ্ট ভাবটা কাটানো দরকার। কত বড়ো একটা দায়িত্ব। পিসতুতো বোন দুটো বড়ো সন্দেশ আর এক গেলাস জল রেখে গেছে। লজ্জায় হাত ঠেকায়নি। সিঁথিতে এতখানি লাল মেটে সিঁদুর। কপালে চাপা টিপ, চাকাপানা মুখটাকে বেশ ডাঁসাপানা করেছে। ট্যাপোর টোপোর গালে যৌবন আর স্বাস্থ্যের লাল আভা। লাল শাড়ির জোরালো জেল্লা। দিনু মনে মনে তারিফ করছিল, বেশ র্যাডিয়েটিং মহিলা। আদরে আদুরে হবার জন্যে মুখিয়ে আছে।
‘সন্দেশ দুটো খেয়ে নাও।’
‘ওরে তোর খাট এসেছে।’ বাবার গলা।
‘হ্যাঁ যাই, খেয়ে নাও, খেয়ে নাও। শোনো লজ্জা কোরো না। আমার মা নেই। তোমাকেই সেই ভ্যাকুয়াম ফিল আপ করতে হবে।’
দিনু খাট তুলতে চলে গেল। দক্ষিণের ঘরে কোরা সতরঞ্জির ওপর পা মুড়ে নতুন বউ। বসার ধরনটা বেশ জমাটি। সামনের দেয়ালে দিনুর মার প্রমাণ সাইজের যৌবনের ছবি। পরনে বেনারসি, পায়ে ডোরাকাটা পামশু, ব্লাউজের থ্রিকোয়ার্টার হাতা। বউ সেই ছবিটির দিকে এক নিমেষে তাকিয়ে রইল। একটা ধেড়ে মাছি সন্দেশের ওপর ভ্যান ভ্যান করছে। গেলাসের জলে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ধুলো ভাসছে। ছবিতে দিনুর মা, আর সতরঞ্জিতে দিনুর বউয়ের প্রায় একই বয়েস। শাশুড়ি যেন অনেক বেশি সুন্দরী ছিলেন। একটু পাতলা চেহারা কিন্তু বেশ ধারালো। অনেকটা মামাশ্বশুরের মতো। দিনুর বাবা সে তুলনায় অনেক বেশি পুরুষালী। ভীষণ শক্ত, সমর্থ। বাটারফ্লাই গোঁফ, ব্যায়াম করা শরীর। মুখের ভাব বেশ কঠোর আর গম্ভীর। এমন মানুষের সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে চলতে হবে জানা নেই। বেশ নার্ভাস লাগছে।
ঘরের বাইরে ভীষণ সোরগোল।
‘আহা আহা, বাঁয়া বাঁয়া। দেয়ালে ধাক্কা লাগেগা, পালিশ চট যায়েগা।’ মামার গলা।
‘সামলে, সামলে, ওরে দিনু মাথা সামলে, হঠাৎ অ্যাকিউট অ্যাঙ্গেলে ঘুরে গেলেই কপালটা দাগরাজি হয়ে যাবে।’ বাবার সাবধান বাণী। মামা ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘আহা তুমি অত উতলা হচ্ছ কেন, আমরা তো রয়েছি। বাঁয়া বাঁয়া, হাঁ! হ্যাঁ, থোড়া বাঁয়া!
‘আজ্ঞে এসে গেছি।’ দরজার সামনে দিনু, ‘ইলেকট্রিসিয়ানও এসে গেছেন। কোথায় কী ক্যারাচে করকে।’
খাট ঢুকছে দিনুর ঘরে। নতুন বউ মাঝারি মাপের ঘোমটা টেনে জুল জুল করে তাকিয়ে আছে। দুটো বিশাল মাপের মানুষ চকচকে খাটের কাঠামো মাথায় ছোটো দরজা গলে ঘরে ঢুকতে চাইছে। নতুন ডিসটেম্পার করা দেয়ালে সামান্য ধাক্কা লাগলেই চটা উঠে যাবে। পেছনে বিভিন্ন মাপের তিনজন মানুষ। ভয়ঙ্কর শ্বশুরমশাই, ঝকঝকে মামাশ্বশুর আর সদ্য বিয়ে করা বোকা বোকা স্বামী।
‘বউমা একটু উঠতে হবে যে।’ মামাশ্বশুরের মিষ্টি অনুরোধের গলা। শুনেছে বড়ো গাইয়ে। দিনুই বলেছে।
‘শুধু উঠলেই হবে না, বেরিয়ে আসতে হবে। টেম্পোরারিলি ঘরটা ছাড়তে হবে।’ শ্বশুর- মশাইয়ের নির্দেশ। গীতা আলতো ভঙ্গিতে সতরঞ্জি থেকে অনেকক্ষণ বসে থাকা অলস শরীরটা তুলতে গেল। এবং গায়ের ধাক্কা লেগে জলভরতি গেলাসটা উলটে পড়ল। ‘এই যা:!’
দিনু দরজার এপাশ থেকে সারসের মতো গলাটাকে উঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল গো!’ গো শব্দটা খচ করে কানে লাগল। একদিনের পক্ষে বড়ো বেশি নৈকট্য। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে প্রশ্নটাকে আর একবার রিপিট করল অন্যভাবে, ‘কী হল কী?’
উত্তর দিল খাট মাথায় কুলি, ‘পানি গির গিয়া।’
‘পানি? পানি এল কোথা থেকে?’ দিনুর বাবা অবাক হলেন।
দিনু বললে, ‘আজ্ঞে, খাবার জল, গেলাসে ছিল।’
‘আই সি, আই সি, তা একটু কাজ বেড়ে গেল। জলটা তাহলে মুছে নিতে হয়।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ’ বলেই দিনু প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে কুলিদের থামের মতো পা গলে ঘরে ঢুকে গেল। বেশিরভাগ জলই সতরঞ্জি শুষে নিয়েছে। বউয়ের শাড়ির তলার দিকটা সামান্য ভিজেছে। শাড়ির ভিজে অংশটা টকটকে লাল। মেঝেতে সরু জলের ধারা লয়াবয়া সাপের মতো ঢালের দিকে একটু একটু করে গড়িয়ে চলেছে। কী দিয়ে মোছা যায়! হাতের কাছে কিছু দেখছে না। কোঁচা দিয়ে কাজটা সারা যায়। সদ্য ভাঙা ধবধবে ধুতি। একটু কিন্তু কিন্তু ভাব। দিনু উবু হয়ে বসে আছে বউয়ের প্রায় পায়ের কাছে। টকটকে আলতা পরা জীবন্ত পা। লক্ষ্মীর পটেই এমন পা এতকাল দেখে এসেছে। দিনুর স্বগতোক্তি, ‘কী দিয়ে মুছি।’
দিনুর চেয়ে দিনুর বউয়ের উপস্থিত বুদ্ধি অনেক বেশি। আধভেজা সতরঞ্জিটার কোণা ধরে একটা ক্লিন সুইপ। জলের ধারা মুছে গেল, সেই সঙ্গে সন্দেশের ডিশটাও গেল উলটে। দুটো কড়াপাক রাতাবি সন্দেশ ক্যারামের স্ট্রাইকারের মতো ছিটকে গেল। দিনু নামাজ পড়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছিল। ‘যা: গেল।’
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী গেল রে?’
দিনুকে বলতে হল না, কুলিরাই বলে দিলে, ‘মেঠাই উলটলবা হো।’
‘মেঠাই আবার কোথা থেকে এল?’
দিনু বলল, ‘ডিশে ছিল।’
কুলিদের তাগাদা, ‘হট যাইয়ে বাবুজি।’ কথার সঙ্গেসঙ্গেই অ্যাকশান। ঘরে খাট ঢুকে পড়েছে ধুপধাপ শব্দে। ধুলো মাখা গোদা গোদা পায়ের ছাপ ভিজে মেঝেতে। দিনু দাঁড়িয়ে আছে বউয়ের গা ঘেঁষে। হাতে মেঝে থেকে তুলে নেওয়া সন্দেশ দুটো। বউ ধরে আছে সতরঞ্জির কান।
মামা মিষ্টি গলায় বললেন, ‘তোমরা এবার সরে পড়ো। খাটটাকে আমরা ফিট করে ফেলি।’
বাবা বললেন, ‘গেলাস আর ডিশটা!’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’ দিনুও হেঁট হল, দিনুর বউও হেঁট হল। দু-জনেরই টারগেট স্টিলের গেলাস। দিনুর নাকের সঙ্গে বউয়ের মাথার জোরালো কলিসান। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এলেও বেশ রোমাঞ্চকর অনুভূতি। হাঁচি পাচ্ছে। কোনোরকমে চাপতে চাপতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নাকের ডগায় লম্বা চুলের সুড়সুড়ি।
‘তোমার কী মনে হয় মোহর!’ দিনুর বাবা প্রশ্ন করলেন তাঁর শ্যালককে।
‘আজ্ঞে খুব উঁচু দরের খাট দিয়েছে বাঁড়ুজ্যেমশাই। কোনো সন্দেহ নেই!’
‘কে দিয়েছে?’
‘আজ্ঞে দিনুর শ্বশুরমশাই।’
‘আজ্ঞে নো স্যার। এ খাট দিনুর বাপের পয়সায়। তুমি কী ভাব আমার ছেলে অকশানের মাল! হায়েস্ট বিডারের কাছে ঝেড়ে দিয়েছি। নো স্যার। মেয়েটি ছাড়া কিছুই নিইনি। আমি তোমাকে খাটের কথা জিজ্ঞেস করিনি। খাট ইজ এ খাট। নাথিং নিউ। বউমাটিকে আমার কেমন যেন জড়ভট্টি মনে হল।’ বেশ জোরে জোরেই কথা হচ্ছে দু-জনে। খাট ফিটিংয়ের ঠকাঠক শব্দ হচ্ছে।
শ্যালক বললেন, ‘ও জড়ভট্টি। না না তেমন কিছু নয়। নতুন তো তাই একটু পায়ে পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। মেয়েটির অ্যাপিয়ারেন্স কিন্তু ভালো। বেশ মনোরম।’
‘অল দ্যট গ্লিটার্স ইজ নট গোল্ড, বুঝলে মোহর! প্রথম থেকেই যদি ঘরের কোণে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকার হ্যাবিট গ্রো করে যায় তা হলেই মহামুশকিল। দেখা যাক কী হয়। সবই ভাগ্য বুঝলে মোহর! বিবাহ হল অ্যালয়, তিন ভাগ তামা আর এক ভাগ দস্তা মিলেমিশে ভরনের কাঁসা। তিন ভাগ স্বামী আর এক ভাগ স্ত্রী তবেই না সুখের সংসার, শান্তির সংসার। যে সংসারে স্ত্রীর দাপট বেশি সে সংসার জানবে ট্রয়ের যুদ্ধ!’
‘কিন্তু একদিনেই কোনো মারাত্মক সিদ্ধান্তে আসা কি ঠিক হবে?’
‘অফকোর্স নট, তবে মুখে চোখে কেমন যেন একটা অহঙ্কারীর ভাব। যাক ফিউচার লাইজ ইন দি উম্ব অব টাইম, মহাকালই জানেন কী হবে! খাটটার প্লেসিং ঠিক হল? মাথা কী উত্তরের দিকে হবে!’
‘আজ্ঞে না, উত্তরে মাথা করা ঠিক হবে না, ভারতের উত্তরে হিমালয়, মহাপ্রস্থানের দিক।’
‘দ্যাটস রাইট। তবে ঘোরাতে বলো। দক্ষিণে মাথা, উত্তরে পা।’
মামা সঙ্গেসঙ্গে হুকুম জারি করলেন, ‘খিঁচো, উসকো খিঁচো।’
খাট টানাটানির মাঝেই আবার বাইরে সোরগোল, ‘সানাই এসেছে, সানাই!’
‘মোহর, সানাই তোমার ডিপার্টমেন্ট। একটু পরেই আমি সব দপ্তর বন্টন করে দোব। তোমার হবে সানাই, অভ্যাগতদের অভ্যর্থনা, আর্টিস্টিক ব্যাপার সব তোমার। ওস্তাদের নামটা যেন কী!’
‘আজ্ঞে বানারসের ছোটে মিঞা, বহত নামজাদা ঘরানা।’
‘দেন ইউ গো। একেবারে আসরে বসিয়ে দাও। সকালটা তো চলেই গেল। তবিয়ত যদি ঠিক থাকে ওস্তাদজীকে বল বৃন্দাবনী সারঙে একটু ছাড়তে। অ্যাটমসফিয়ারটা একটু জমে যাক। ওয়ানস ইন এ লাইফটাইম এই সব সব অকেসান আসে।’
‘রামকেলি কিংবা মাড়োয়াও চলতে পারে।’
‘মাড়োয়াও পারে তবে রামকেলিটা চালাতে হলে গায়ের জোরে। তুমি ওদিক থেকে দিনুটাকে একটু খুঁচিয়ে এদিকে পাঠাতে পারবে? পয়েন্ট হবে…।’
‘পয়েন্ট! চতুর্দিকে পয়েন্ট হবে! তুমি ওপরের প্যাণ্ডেল থেকে স্টার্ট করো। আগে ফিউজটা দেখে নাও, একস্ট্রা লোড টানতে পারবে কিনা! ফিউজ বক্সটা দেখিয়ে দাও দিনু।’
‘দেখাতে হবে না, আমি জানি।’
‘ভেরি গুড। তাহলে লেগে পড়ো।’
কুলিরা খাট ফিট করে ছতরিমতরি সব লাগিয়ে দিয়েছে। এইবার চালান সই, বকশিশ, ভাড়া দেবার পালা।
‘কুছ মিঠাই-উঠাই নেহি মিলেগা বাবু?’
‘জরুর মিলেগা। দিনু, তুমি এদের গণেশকাকাবাবুর জিম্মা করে দিয়ে এসো। যাবে আর আসবে। আটকে থেকো না। থাউজেণ্ড অ্যাণ্ড ওয়ান কাজ!’
বাবার প্রাণের বন্ধু গণেশ চট্টোপাধ্যায়, ভিয়েনের সামনে চেয়ার পেতে বসে আছেন। মুখে সিগারেট। কোলের ওপর সেদিনের খবরের কাগজ। বিশাল কড়ায় ছ্যাঁচড়া চেপেছে। দু-জনে যোগাড়ের একজন হামানদিস্তেতে মশলা ঠুকছে ঠ্যাং ঠ্যাং করে। আর একজন উবু হয়ে বসে প্লাসটিক চাটনির পেঁপে কুটছে ফিনফিনে সরু করে। হালুইকরের নাম অনন্ত। নামজাদা রাঁধিয়ে। হাতিবাগানের কাছে ডেরা। জজ, ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়িতে বড়ো বড়ো কাজে রেঁধে রেঁধে হাত পাকিয়েছে। মুখের হাসিতে বিনয়ী গুমোর চুঁইয়ে পড়ছে। নৌকোর হাল চালাবার মতো করে কড়ায় খুন্তি চালাচ্ছে আর সমানে বকবক করে চলেছে। বুকের কাছে গেঞ্জির ওপর হলদে মতো পৈতের একটা অংশ ব্রাহ্মণত্বের বিজ্ঞাপন হয়ে লতরপতর করছে।
দিনু কুলি দু-জনকে গণেশকাকার হেপাজতে রেখে চলে আসছিল! হঠাৎ তার চোখ পড়ল ছাদের আর এক অংশে। সেদিকটা ঘেরা হয়নি। সব ক-টা ফুলগাছের টব একসঙ্গে জলসায় বসেছে যেন। কিছু ফুটন্ত চন্দ্রমল্লিকা, গোটাকতক বাজখাঁই সাইজের ডালিয়া। তারই পাশে উদাসী দিনুর বউ। গণেশকাকা নিজের খেয়ালেই আছেন। ভিয়েনের ইনচার্জ। বালীগঞ্জে বাড়ি। একমাথা অতৈলাক্ত ফুরফুরে চুল। যে কাজের ভার পেয়েছেন সেই কাজেই মশগুল। দিনু যদি একবার বউয়ের কাছে চক্কর মেরে আসে খেয়াল করবেন বলে মনে হয় না। করলেও কিছু ভেবে বসবেন না। পিতৃবন্ধু হলেও বেশ মাইডিয়ার লিবারেল মানুষ।
দিনু আস্তে আস্তে বউয়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। ঘাড়ের কাছে বিয়ের রাতের খোঁপাটাই নেতিয়ে আছে। একটু বাসী হয়ে যেন আরও সুস্বাদু হয়েছে। ভি-কাট ব্লাউজ থেকে পিঠের আর কাঁধের বেশ খানিকটা মসৃণ অংশ বেরিয়ে আছে। একটা কটা তিল। শাড়ি, কোমর, নিতম্ব একটা ছন্দের মতো, দ্বিপ্রহরের কবিতা। হাতের একটা আঙুল দিয়ে ঘাড়ের কাছে স্পর্শ করতেই প্যাঁ করে সানাই বেজে উঠল। দিনু চমকে উঠল। বউ চমকে ফিরে তাকিয়েছে। দু চোখে টলটলে জল। বড়ো বড়ো চোখের পাতা ভিজে। সানাই কথা বলার সুবিধে করে দিয়েছে। গণেশকাকা আড়ালে। একজন যোগাড়ের পিঠটা দেখা যাচ্ছে।
‘তুমি কাঁদছ?’
আঁচলে চোখ মুছে বউ বলল, ‘কই না তো!’
‘কাঁদছ কেন? মন খারাপ?’
‘কই না তো।’
‘নীচে চলো। একলা একলা দাঁড়াতে হবে না, চলো নীচে চলো।’ দিনুর মনে হল হঠাৎ তার গলায় এক ধরনের আদেশের সুর এসে গেছে। এতদিন সে সকলের আদেশ শুনে এসেছে, আজ এক নতুন অভিজ্ঞতা। স্নেহমিশ্রিত আদেশ।
বউ ম্লান হেসে বললে, ‘আপনি, না, তুমি, তুমি নেমে যাও আমি আসছি।’
‘ঠিক?’
‘ঠিক।’
‘তুমি ওদের সঙ্গে একটু মেশো না। পানটান সাজছে। কত কী কাজ রয়েছে।’
‘যাচ্ছি। তুমি যাও।’
দিনু গুটি গুটি ছাদ থেকে নেমে এল। দক্ষিণের ঘরে তখন খাটপর্ব আরও এক ধাপ এগিয়েছে। কাঠের ওপর নতুন একটা সতরঞ্জি পড়েছে। বাবা বললেন, ‘যাও ও-ঘর থেকে ধরাধরি করে তোশকটা নিয়ে এসো। একলা চেষ্টা কোরো না, ভেরি হেভি—ঘাড়ে ফিক ব্যথা লেগে যাবে।’
দিনুর খুব লজ্জা করছিল। গুরুজন মানুষ। এইভাবে তাদের ফুলশয্যার খাট বিছানা ঠিক করবেন। কী? না রাতে ছেলে আর ছেলের বউ জড়াজড়ি করে শোবে। বিয়ে করে দিনু এমনিই মরমে মরে আছে। কেমন যেন পাপী পাপী লাগছে। ব্যভিচারের লাইসেন্স হাতে এসেছে। ছিল একা। বাবার নেওটা। এখন দোকা। মসৃণ একটি যুবতীর স্বত্বাধিকারী। এতকাল বাবার বিছানায় বাবার পাশে শুয়ে এসেছে। আজ শুতে হবে প্রায় অচেনা একটি মেয়ের পাশে। সানাই তখন মাঝরাতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে দরবারী ছাড়বে। নিমন্ত্রিতদের শেষ ব্যাচ ততক্ষণে চ্যাকোর-চোকোর করে পান চিবোতে চিবোতে বাড়ি পৌঁছে যাবে। ভাবা যায় না, তবু ভাবতে হচ্ছে। দিনু একটু প্রতিবাদের গলায় বললে, ‘এবার আমরাই সব করে নিচ্ছি, বাবা।’
‘আমরা! হোয়াট ডু ইউ মিন বাই আমরা! তুমি আর আমি এই দু-জনে মিলেই তো আমরা। যাও ডোন্ট ওয়েস্ট টাইম। আহা বেড়ে বাজাচ্ছে!’
উত্তরে বারান্দার ধারে কলের পাশে উবু হয়ে নিরঞ্জন সোডা দিয়ে দু-ডজন কাঁচের গেলাস ধুচ্ছিল। দিনু বললে, ‘হেলপ। দুটো হাতই ভেজা। ওপর হাত দিয়ে কপালের ধারে ঝুলেপড়া চুল ঠিক করতে করতে নিরঞ্জন বললে, ‘কী ধরনের হেলপ, ঝুল ঝাড়া?’
‘তার চেয়েও মারাত্মক, বিছানা বওয়া।’
‘এখন আবার কে শোবে?’
‘এখন নয়, রাতের জন্যে রেডি করা হচ্ছে।’
‘রাত এখনও অনেক দূরে, একটু পরে হবে।’
‘ছোটোবাবু ওয়েট করছেন। তুমি না পারলে অন্য কারোকে ধরতে হবে।’
‘ওরে বাবা কুরুক্ষেত্র হো যায়েগা!’
স্টোররুমে বিছানাপত্তর সব লটঘট হয়ে পড়েছিল। নিরঞ্জন একাই একশো। গন্ধমাদন ঘাড়ে করে দক্ষিণের ঘরে লাফিয়ে পড়ল। দিনু দর্শক। দিনুর বাবা আর নিরঞ্জন, দু-জনে ধস্তাধস্তি। নিরঞ্জন মোটা তোশকটা খাটের মাঝখানে রোলকরা অবস্থায় পাতলা সতরঞ্জির ওপর ফেলে একটা পাশ খুলেছে। নিরঞ্জন খাটিয়ে, তবে সব কাজই একটা ধুমধাড়াক্কা গোছের। যে পাশটা খুলেছে সে পাশটার ভাঁজ ছোটো। খাটের সমান সমান হয়নি। হিড়হিড় করে টান। সতরঞ্জি-মতরঞ্জি গুটিয়ে পাকিয়ে একাক্কার। দিনুর বাবা চটে উঠলেন, ‘তোর এই ইডিয়টিক কাজকর্ম দেখলে আমার বাইলস ঠিক থাকে না নিরঞ্জন!’
নিরঞ্জন বোকার মতো মুখ করে বললে, ‘আপনার তো পাইলস ছিল না ছোটোবাবু! এবার দেশে গেলে পাইলসের মাদুলি এনে দেব, সেরে যাবে।’
‘আ মূর্খ, কোথায় বাইলস আর কোথায় পাইলস! পনেরোটা অ্যালফাবেট টপকে জাম্প করে বি থেকে জি-তে চলে গেলি! ধড়ফড়ে স্বভাব যাবে কোথায়? বাইলস মানে পিত্তি। তোর কাজকর্ম দেখলে আমার পিত্তি চটে যায়।’
‘আজ্ঞে ধনেপলতা।’
‘নামা ইডিয়েট নামা। সব নামা। আবার বিগিন ফ্রম দি বিগিনিং।’
সানাই পিলুতে ঠুমরি ধরেছে। দাদরয়া বলে মোরা সোর। সমের মাথায় দিনুর বাবা হাঁ করে একটা শব্দ করে বললেন, ‘আহা জমিয়ে দিয়েছে!’
নিরঞ্জন সঙ্গেসঙ্গে বললেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ! তুই গানের কী বুঝিস রাসকেল?’
‘ছেলেবেলায় অনেক যাত্রা দেখেছি যে ছোটোবাবু।’
‘বেশ করেছিস। এখন বকবক করে সময় নষ্ট না করে সতরঞ্জিটা আবার সমান করে পাত।’
‘তা পাতছি তবে থাকবে না, আবার গুটিয়ে যাবে।’
‘আলবাত থাকবে। সব কিছুর একটা সায়েন্স আছে।’
‘সে আবার কী?’
‘সে বোঝার ক্ষমতা থাকলে তুই নিরঞ্জন হবি কেন আর আমি তোর ছোটোবাবু হব কেন?’
‘আজ্ঞে তা ঠিক।’
দিনু আর নিরঞ্জন দু-দিক থেকে ধরে সতরঞ্জিটাকে টান টান করে পাতল।
‘পেতেছি ছোটোবাবু।’
‘বেশ করেছিস। এবার আয় তোশকটাকে দু-জনে দু-দিক থেকে ধরে স্ট্রেট নামিয়ে দি, নো টানাটানি। যাকে বলে প্যারাচুট ড্রপিং!’
‘সে আবার কী?’
‘ও হল যুদ্ধের ব্যাপার, তুই বুঝবি না, যা বলি তাই কর। তোশকটা খোল, চাদর পাতার মতো পাততে হবে।’
‘তোশক আর চাদর এক হল? তোশক কত ভারি! আপনার না সাইটিকা আছে, এখুনি কোমরে লেগে যাবে খচ করে।’
‘সাইটিকা যেমন আছে তুইও তো তেমনি আছিস, দুরমুশ করে দিবি।’
‘আজ কাজের বাড়ি, দুরমুশ হবে কী করে!’
‘আজ তো রাতে ঘুম নেই। যন্ত্রণা হলে জেগে বসে থাকতে হয়, আজ তো এমনিই বসে থাকতে হবে। তবে উড়ো খই গোবিন্দায় নমঃ!’
‘আজ্ঞে কোমর যদি বেঁকে যায় গোবিন্দর বাপের ক্ষমতা কী সোজা করে!’
‘তুই গোবিন্দর বাপ তুললি, এরপর তো দিনুর বাপকে তুলবি রাসকেল!’
‘ছি বাবু, ওটা হল কথার কথা।’
‘নে ধর।’
‘পারবেন না বাবু। বেজায় ভারি।’
‘ভীমচন্দ্রকে স্মরণ কর। বল ভীমায় নমঃ।’
‘একবার কেন এক-শোবার বলছি কিন্তু মহাভারতের যুগ কি আর ফিরে আসবে ছোটোবাবু!’
‘খুব আসবে, ইফ দুর্যোধন অ্যাণ্ড দুঃশাসনস ক্যান কাম ভীমসেন মাস্ট টার্ন আপ।’
‘মালা এসেছে, ফুল এসেছে, ছোটোমামা কোথায়, ছোটোমামা।’ দিনুর বড়ো পিসতুতো বোন ছোটোমামা, ছোটোমামা করতে করতে দরজার সামনে দর্শন দিল। চেহারাটি ভালো। এখনও কিন্তু পাত্র জোটেনি। চাঁদের আলোয় নির্জন ছাদে দাঁড়িয়ে একদিন দিনুকে চকাম করে চুমু খেয়ে বলেছিল, ‘তোর মুখটা ভারি মিষ্টি।’
চরাচর ভেসে গেছে চন্দ্রালোকে। কোথাও একটা কোকিল ডাকছে। গালের ভিজে ভিজে জায়গাটায় দিনু হাত বুলোচ্ছে। সেই দৃশ্যটা দিনুর কেবলই মনে পড়ে। সেই নরম অনুভূতিটা ফিরে আসে বারে বারে।
‘ক-টা মালা এসেছে গুনেছিস?’ দিনুর বাবা প্রশ্ন করলেন।
‘না তো ছোটোমামা।’
‘এক ডজন গোড়ের মালা আছে কিনা দেখ।’
‘আপনি একবার চলুন না।’
‘বিছানা!’
‘আমরা আছি তো!’
নিরঞ্জন যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল, ‘হ্যাঁ বাবু আপনি যান আমরা আছি তো!’
গোড়ের মালা এসেছে। নতুন বউকে সাজাবার ফুলের গহনা এসেছে। চূড়, বাজু, মালা। সরু তার দিয়ে পাকানো পাকানো। দিনুর বাবা দিনুর মামাকে বললেন, ‘মোহর, এ তো বড়ো বিপজ্জনক জিনিস হে। বউমাকে পরাবে বটে তবে রক্তারক্তি হয়ে ধনুষ্টঙ্কার না হয়ে যায়। একটা ইঞ্জেকসান দিয়ে দিতে পারলে ভালো হত।’
‘মেয়েরা একটা দিন এসব পরেই থাকে, ভয়ের কিছু নেই।’
‘কিন্তু এই শীতকালে সারা গায়ে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ফুল জড়িয়ে ঠায় ঘণ্টা চারেক বসে থাকাও একটা পানিশমেন্ট হে। বিবাহ মাথায় থাক।’
‘আজ্ঞে বিবাহ জিনিসটাই তো এক ধরনের শাস্তি। তবু আনন্দের।’
‘যাক মেয়েদের ব্যাপার মেয়েরাই বুঝবে, আমার বারোটা মালা আমি তুলে নিয়ে সরে পড়ি। ও হো, একটা ভুল হয়ে গেল হে!’
‘কী ভুল?’
‘তোমার ওই ওস্তাদদের একটা করে মালা দেওয়া উচিত, তবেই না বাজাবার মেজাজ আসবে।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ তা ঠিক, তবে ভুল যখন হয়েই গেছে তখন তো আর উপায় নেই। মালা ছাড়াই সানাই বাজবে। মালাটা তো আর এসেনসিয়াল নয়।’
‘কিচ্ছু ভেবো না মোহর, সব ভুলেরই সংশোধন আছে। নিরঞ্জন! নি-রঞ্জ-ন!’
ছোটোবাবুর তীক্ষ্ণ ডাক নিরঞ্জনের কানে গেছে। তোশক পাততে গিয়ে শতরঞ্জিটা কুঁচকেছে কিনা দেখার জন্যে সে খাটের তলায় চিত হয়ে শুয়েছিল অনেকটা গাড়ি মেরামতের কায়দায়— ‘আজ্ঞে যাই ছোটোবাবু!’ তেলা মেঝে। হড়কে বেরিয়ে এল সটান!
‘নিরঞ্জন! আর ইউ ডেড?’
নিরঞ্জন একলাফে ছোটোবাবুর সামনে এসে বললে, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ বাবু!’
‘হ্যাঁ বাবু? ডেড মানে কী?’
‘জানি না তো।’
‘না জেনে সব কথায় হ্যাঁ বলিস কেন? সোজা বাজার। তিনটে মালা। বেস্ট মালা কিনবি।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘আবার হ্যাঁ!’
‘আজ্ঞে না।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। বেস্ট মানে কী?’
‘মুখ্যু বাবু, ইংরেজির মানে সব কি জানি?’ নিরঞ্জন সকলের মুখের দিকে তাকাল।
‘বেস্ট মানে সেরা।’
‘আজ্ঞে সেটা যেন আন্দাজ করেছি।’
‘গুড। পৃথিবীর সব কিছুই কমনসেন্স দিয়ে বোঝা যায়, পন্ডিত হবার প্রয়োজন হয় না। যাবি আর আসবি। হাঁ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাক দেখো না।’
‘হাঁটুর ওপর তোলা ধুতিটাকে নামিয়ে দিয়ে শরীরের ধুলোটুলো ঝেড়ে ওরই মধ্যে একটু ফিটফাট হয়ে নিরঞ্জন ঘোঁত ঘোঁত করে সদরের দিকে দৌড়োলো।
দিনুর বাবা শ্যালকের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘সংসারের অ্যাসেট, মাথায় করে রেখেছে। এসব মানুষ দুর্লভ।’ হাতে বারোটা রজনীগন্ধার গোড়ের মালা, শরীরের চারপাশ বেয়ে ঝুলছে, সারা মুখে একটা তৃপ্তির হাসি। বাবাকে খুশি দেখে দিনুর বেশ লাগছিল। ভেতরের নরম মানুষটি কদাচিৎ এইভাবে বেরিয়ে আসে। সারা সংসারটা তখন হেসে ওঠে। দিনুকে পাশে পেয়ে দিনুর বাবা যেন হালে পানি পেলেন। সংসারে তো দু-টিমাত্র মানুষ। দিনু আর তিনি নিজে। নিরঞ্জনকে ধরলে, ধরলে কেন ধরতেই হবে, সে বেচারা সব ছেড়ে এখানেই জড়িয়ে পড়েছে, সংখ্যা দাঁড়ায় তিন। বউমা আসায় চার। আত্মীয়স্বজন আজ যাঁরা এসে বাড়ি গমগমে করে তুলেছেন তাঁরা তো সব ক্ষণিকের অতিথি। সুখটি নিয়েই সরে পড়বেন। দুঃখে-সুখে এই ক-জন মানুষই সাতান্ন নম্বর বাড়ির প্রধান চরিত্র।
‘এই নাও মালা। আজ শুভদিন, নিজে হাতে পরাবে।’
কাকে পরাবে? বউকে? ভেবেই চোখে একটা লাজুক দৃষ্টি নেমে এল। হাত বাড়িয়ে মালাগুলো নিল।
‘একটা তোমার মার ছবিতে, একটা জ্যাঠাইমার ছবিতে, একটা জ্যাঠামশাইয়ের ছবিতে, পরলোকগত যাঁদের ছবি আছে সব ছবিতে একটা করে। ঠাকুর্দার ছবি অনেক উঁচুতে। টেবিলের ওপর চেয়ার রেখে উঠতে হবে। চেষ্টা কোরো না। রেখে দাও। এটা আমার কাজ। চান করে এসে ঠাকুর আর ঠাকুর্দার গলায় আমি পরাব। বিছানা-পর্ব কত দূর?’
‘আজ্ঞে হয়ে গেছে।’
‘তাহলে মোহর, উই হ্যাভ আর্নড এ কাপ অফ টি। একটু চায়ের ব্যবস্থা দেখো।’
‘ঠিক বলেছেন, ভেতরটা সত্যিই চা চা করছে।’
‘করতেই হবে, শালা ভগ্নীপতির এক বাত। তা ছাড়া জানবে, উৎসবে ব্যসনে একমাত্র উৎসাহদাতা চা। কিন্তু কে করবে?’
‘করার জন্যে ভাবছেন! ও তো লাগাতার হয়েই চলেছে। শুধু হুকুমের মামলা। চা দপ্তরে শুধু বললেই হল।’
‘তা হলে বলে ফেলো।’
দিনুর বড়ো পিসতুতো বোন রেখা চায়ের চার্জে। মামা হেঁকে বললেন, ‘রেখা, রেখা, দু কাপ কড়া জিনিস এদিকে ছেড়ো।’
উত্তর দিক থেকে উত্তর এল, ‘আচ্ছা মামা।’
উত্তর দিকটা আপাতত মেয়েমহল। কেচরমেচর কথার খই ফুটছে। মাঝেমধ্যে হাসির শব্দ। অন্য সময় হলে নারীদের উচ্চকন্ঠ দিনুর বাবা এক দাবড়ানিতে শেষ করে দিতেন। আজ শুধু বললেন, ‘আইডিয়েল হিন্দু বিবাহের অ্যাটমসফিয়ারটা ঠিক জমেছে।’
সানাই পোঁ ধরেছে, এইবার কোনো রাগ বেজে উঠবে। ওস্তাদজি দম নিচ্ছেন। মেয়ে মহলে হঠাৎ খিলখিল হাসি উঠল, অনেকটা হাওয়ায় দুলে ওঠা ঝাড়-লণ্ঠনের শব্দের মতো। দিনুর বাবা অবাক হয়ে উত্তরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘মেয়েছেলে জাতটাই অদ্ভুত হে মোহর, যেমন কাঁদতে পারে তেমনি হাসতে পারে, যেমন রাগতে পারে তেমনি রাগাতে পারে।’
দিনুর বউ চা নিয়ে আসছে গুটি গুটি পায়ে। দেখলেই হাসি পায়। যেন দম দেওয়া পুতুল! মাথায় সামান্য ঘোমটা। খুলে যাবার ভয়ে একটা পাশ ঠোঁটের ক্লিপে আটকানো। লালের ঘেরাটোপে ধবধবে ফর্সা মুখ।
‘বাবা চা।’ হাতটা দিনুর বাবার দিকে উঠল। একটু যেন কাঁপছে। বাবার নজর এড়াল না। বউ বাবা বলেছে, দিনুর কী আনন্দ! এতদিনে বাবাকে বাবা বলার দু-জন লোক হল সংসারে।
দিনুর বাবা চায়ের কাপটা নিতে নিতে বললেন, ‘হোয়াই সো শেকি! আমাকে অত ভয়ের কী আছে মা! বাঘ না ভাল্লুক! মিশে দেখো মানুষটা তত খারাপ নয়। তবে হ্যাঁ, লোকে বলে ধাতটা একটু কড়া। সব সময় গম্ভীর। কিন্তু মা, তুমি যদি জানতে, একের পর এক কত ধাক্কা, মৃত্যুর মিছিল চলে গেছে জীবনের ওপর দিয়ে। হাসব কী করে! এক সময় সব ছিল, জমজমাট সংসার। এখন আমরা মাত্র দু-টি প্রাণী টিমটিম করছি। এইবার তুমি এলে। মোহর!’
‘আজ্ঞে!’
‘সেই গানটা, শূন্য এ বুকে পাখি মোর ফিরে আয় ফিরে আয়।’
‘জ্ঞান গোঁসাই।’
‘দ্যাটস রাইট। রাত্তিরে তোমার গলায় গানটা শুনতে চাই।’
দিনুর বউ ধীরে ধীরে পেছু হটে হটে সরে পড়ার তালে ছিল। মেয়ে মহলের অনেক তালিমের পর ভয়ে ভয়ে চা দিতে এসেছিল। একটু আগের হাসির কারণ ছিল সেটাই। দিনুর পিসতুতো বোন শেখাচ্ছিল, বলবে, ‘বাবা এই নিন চা।’ বউ বলছিল, ‘শুধু দিয়ে এলেই তো হল, আবার বাবা বলতে হবে?’
‘তা হবে না! বাবাকে বাবাই তো বলতে হবে, না শ্বশুরমশাই বলবে?’
‘কিছুই বলব না, দিয়েই পালিয়ে আসব।’
‘তা কী হয় বাছা! বলতে হবে, বাবা চা কিংবা চা বাবা।’
দিনুর বউ আবৃত্তি করতে লাগল, ‘চা বাবা, বাবা চা, চা বাবা…’
দিনুর বাবা চায়ের চমুক দিয়ে বললেন, ‘আহা ফাসক্লাস। তুমি পালাচ্ছ কেন মা! আরে বোকা সংসারটা তো তোমার। যত তাড়াতাড়ি সহজ হতে পার ততই তো ভালো। আচ্ছা আচ্ছা, ধীরে ধীরে হবে। পেছু হটে নয়, সামনে তাকিয়ে বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচু করে যাও।’
দিনু মায়ের ছবিতে ফুলের মালাটা পরিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ছেঁড়াছেঁড়া অস্পষ্ট স্মৃতি। মনে পড়ে কী পড়ে না। ‘তুমি খুব স্বার্থপর মা। কেমন ফেলে পালালে! সব ফাঁকা করে, ধীরে ধীরে আবার জমজমাট। এ যেন নীলকন্ঠের গানের সেই লাইনটা, এক কূল নদী ভাঙে নিরবধি আবার অন্য কূলে আকুলে সাজায়। কেন নেই! আজ কেন তুমি নেই? আমার শৈশবটাকে মরুভূমি করে দিয়ে কেমন সট করে কেটে গেলে! মা আমার একটা বউ এসেছে, একটা বউ। দু-জনে মা মা করে ডাকতুম, কেমন মজা হত…’। দিনুর চোখ ছাপিয়ে জল এসে গেল। ভাবটা চটকে দিলে দিনুর পিসতুতো বোন।
‘তোর কাছে অ্যানাসিন কী সারিডন আছে রে?’
দিনু চোখ মুছে ধরাধরা গলায় বললে, ‘কেন কে খাবে?’
‘তুই একা একা মামিমার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিস? উৎসবের দিনে চোখে জল!’ আঁচল খুলে চোখের জল মোছাতে মোছাতে বললে, ‘তোর বউয়ের মাথা ধরেছে।’
‘না না, অ্যানাসিন-ফ্যানাসিন দিও না। পেটের পক্ষে, হার্টের পক্ষে খুব মারাত্মক।’
‘দেখিস! একটা অ্যানাসিনে মেয়েরা মরে না। কইমাছের প্রাণ! থাকে তো দে।’
‘নেই গো।’
‘নেই গো।’ দিনুর কথাটাই ঠোঁট উলটে উচ্চারণ করে দিনুর গালটা টিপে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গালে লেগে রইল আদার গন্ধ। বোধ হয় আদা বাটছিল। অদ্ভুত মেয়ে। মনে পড়ল, সেই চাঁদের আলো, ভিজে ভিজে চুমু, সামান্য শিহরন।
দিনু এবার চেয়ারে উঠল দ্বিতীয় মালাটা জ্যাঠাইমার ছবিতে ঝোলাবার জন্যে। মালাটা আর একটু বড়ো হলে ভালো হত। হাসি হাসি মুখে জ্যাঠাইমা তাকিয়ে আছেন দিনুর দিকে। সময় পেছোতে শুরু করেছে। সন্ধ্যে। ঠাকুরঘর। মিটিমিটি প্রদীপের আলো। চারদিকের দেওয়ালে কাঁপা কাঁপা ছায়া। জ্যাঠাইমা হাত জোড় করে বসে আছেন। পাশে ছোট্ট দিনু। সুরেলা গলা, ভবসাগর তারণ কারণ হে। স্বপ্নময় শৈশব জীবনকে পাশ কাটিয়ে কতদূরে চলে গেছে সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে। আহা! আজ যদি সবাই বেঁচে থাকতেন, বাড়িটা আরও কত জমজমাট হত।
ডেকরেটারের লোক এসে দরজায় দরজায় রেশমী কাপড়ের ঝালর বাঁধছে। ইলেকট্রিসিয়ান সানাইয়ের টংঘরে, প্রবেশ পথের দু-পাশে ছোটো ছোটো টুনি ঝোলাচ্ছে। মিউনিসিপ্যালিটির খাবার জলের ট্রেলার এসেছে। সূর্য হন হন করে পশ্চিমের দিকে চলেছে। আকাশের টং-এ চিল ঘুরপাক খাচ্ছে।
সন্ধ্যে যথাসময়ে সেজেগুজে এল। সানাইয়ে ইমন কল্যাণ চড়েছে। দিনুর সাজগোজ শেষ। দিশি ধুতি। সোনার বোতাম লাগানো সাদা সার্জের পাঞ্জাবি। মামা নিজের হাতে কোঁচায় চুনট করে দিয়েছেন। কানের পাশে আতর ঘষে দিয়েছেন। তাঁর নিজের সাজেও শিল্পীর মেজাজ। হাতে হাড়ের নস্যির ডিবে, সিল্কের রুমাল জড়ানো। ফর্সা চেহারায় সরষে রঙের গরম পাঞ্জাবি। হাড়ের বোতাম তাকিয়ে আছে। পায়ে কোলাপুরী। মাঝে মাঝে গায়কোচিত গলাখাঁকারি। দিনুর ঘরে খাটের ওপর ঔরঙ্গাবাদের সোনালী বেডকভার। ভেলভেটের সিংহাসন চেয়ারে ফুলসাজে দিনুর বউ। দিনুর পিসতুতো বোনের এক বান্ধবী খাতা আর পেনসিল নিয়ে রেডি। উপহারের হিসেব রাখবে।
একটা দুটো গাড়ি আসছে। ‘আসুন, আসুন’ চলছে। একটি শিশু ফোলডিং চেয়ার উলটে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তার কান্না, সানাইয়ের তীক্ষ্ণ সুর, ‘ওরে, পশ্চিমের আলোটা দপ দপ করছে,’ ‘মাধুরী একটা মালা দে ভাই, খোঁপায় জড়াই’, দিনুর বউকে একটি ফচকে মেয়ে কী বলেছে, সবাই হাসছে, সিল্ক, যৌবনে, সেন্টে, রান্নার গন্ধে অ্যাটমসফিয়ার জমজমাট। নিরঞ্জন চায়ের ট্রে নিয়ে ঘুরছে। পাতলা কাগজে ছাপা রুমাল-কবিতা হাতে হাতে ঘুরছে, ‘চেয়েছিলে গীতা, পেয়ে গেছে গীতা, কর এবে তুমি সেই আরাধনা, আর কি থাকবে মনে।…রয়েসয়ে ভাই, চোখ কান খুলে, জ্ঞানের সঙ্গে ভক্তি মিশায়ে কর্মের ভিয়েনে ছেঁকে, গীতাকে তোমার সঙ্গী করে, পাল তুলে চলো দুলে দুলে।’ ইতি তোমার অমুক তমুক। একটা স্টেশান ওয়াগনে করে শ্বশুরবাড়ির লোকজন এসেছে গোনাগুণতি। বউয়ের ঘরে ঢোকে কার বাবার সাধ্যি! কুঁচোকাঁচা, উঠতি পড়তি মেয়েতে ঠেসে গেছে।
মাঘের শেষ ফাল্গুনের শুরু, খুব দখিনা বাতাস ছেড়েছে। রজনীগন্ধা তাজা হয়ে উঠেছে। হাওয়ায় তেরপল কাঁপছে। ক্যালেণ্ডারের পাতা উড়ছে। নতুন তোয়ালে কোমরে জড়িয়ে পরিবেশকরা পেতলের বালতি আর হাতা নিয়ে চরকিপাক খাচ্ছে। দিনুর বাবা তসরের শাল গায়ে হাত জোড় করে জনে জনে জিজ্ঞেস করছেন, ‘ঠিক হচ্ছে তো!’
‘ও খুব হচ্ছে।’
‘কেমন রেঁধেছে?’
‘জবাব নেই!’
‘ওহে পোলাওটা আর একবার ঘুরিয়ে দাও।’
‘এ পাতে মাছ।’
একজন পরিবেশক আর একজনকে ফিস ফিস করে বলছে, ‘ছিটে বেড়া! তেত্রিশটা কমলাভোগ সেঁটে এখনও দাও দাও করছে।’ দূরে সুন্দরী একজন মহিলাকে একজন পরিবেশক খুব তোয়াজ করছে, ‘বউদি, দইয়ের মাথা, আর একটু আর এক চামচে।’
সানাই বেহাগ ধরেছে। দিনুর বউ ভেলভেটের সিংহাসন ছেড়ে উঠে পড়েছে। নিমন্ত্রিতদের শেষ ব্যাচ পান চিবোতে চিবোতে বহু দূর চলে গেছেন। নির্জন রাতে বাতিরমালা পাগল করা দখিনা বাতাসে দুলছে। এবার বাড়ির সবাই খেতে বসবেন। দিনুর পিসিমা এসে বলছেন, ‘ছোড়দা, মোহর, তোমরা সব চলো। পাতা করা হয়েছে।’
‘বউমা! বউমা বসবে না? দিনু বসবে না?’
‘তোমাদের হয়ে যাক।’
‘ও নো নো। রাত প্রায় বারোটা হল। সব একসঙ্গে। কতক্ষণ আর টাঙিয়ে থাকবি!’ কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। ছাদের এ মাথায় পুরুষ। ও মাথায় মেয়েরা। দিনুর বউয়ের চিবুকটা পাতায় প্রায় ঠেকে গেছে। মুখের ফাঁদ যতটা সম্ভব কম খুলে টুকটুক খাচ্ছে। পরিবেশনকারীরা মিলিটারি মেজাজে পরিবেশন করে চলেছে। সারা সন্ধ্যে খেটে সকলেই প্রায় ক্লান্ত। কেউই খাবেন না। দিনুর বাবা বলেছেন, পরে একদিন সকলকে পরিতোষ করে খাওয়াবেন।
মাঝের বড়ো হলঘরে পড়েছে। মাঝখানে চকচক করছে স্কেলচেঞ্জ হারমোনিয়াম। চিত হয়ে শুয়ে আছে তুঁত কাঠের এসরাজ। সানাই স্তব্ধ। বাতাস ঠাণ্ডা। দিনুর মামার গা থেকে আতরের গন্ধ বেরোচ্ছে। দিনু বসে আছে পা মুড়ে।
এসরাজটা কাঁধে তুলে নিতে নিতে দিনুর বাবা বললেন, ‘নাও ধরো মোহর। একটা বসন্ত ছাড়ো তো!’
গণেশকাকা পান চিবোতে চিবোতে বললেন, ‘একটু পরোজ মিক্স করে দিবেন।’
একে একে সব বাতিই নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনেরগুলোই জ্বলছে। মেয়েরা সব দিনুর ঘরে নতুন বউকে নিয়ে পড়েছে। স্ত্রী-আচার চলছে। ফুলশয্যার প্রস্তুতি।
হারমোনিয়াম থেকে সুর ঠিকরে বেরোলো। এসরাজে ছড় পড়ল। দিনুর মামা অপূর্ব সুরেলা গলায় গাইতে লাগলেন, ‘হোরি খেলত নন্দকুমার।’ দিনুর হঠাৎ মনে হল, সে দিনু নয় সাজাহান। খুব জমেছে। ঠুংরির পর ঠুংরি। কাফি সিন্ধু, পিলুবারোয়া, ধানি, দেশ। ঢং ঢং করে দুটো বাজল।
গণেশবাবু দিনুর বাবাকে বললেন, ‘দিনুকে এবার ছেড়ে দাওয়া হোক। বেচারা ইমপেশেন্ট হয়ে পড়েছে। আজ ওর নাইট অফ অল নাইটস।’
‘হোয়াট ইমপেশেন্ট, নেভার! তুমি কী ভাব আমার ছেলের সেই ব্রীড।’
দিনুর সুরের লতাবিতান ছিঁড়ে ধপাস করে মৃত্তিকায় এসে পড়ল। ইঙ্গিতটার মধ্যে দেহের গন্ধ। দিনুর ব্রহ্মচর্য আজ শেষ হবে। সে হবে গৃহী। স্ট্যাটাসটাই পালটে গেল। ব্যাচেলার থেকে ম্যারেড। গণেশবাবু বললেন, ‘আই ডোন্ট মিন দ্যাট। তবে রাতটাই তো ফুলশয্যার। সবাই অপেক্ষা করে আছে।’
‘অপেক্ষাই তো মধুর গণেশ। সবই তো থাকবে, থাকবে না এই রাতটা। হাওয়েভার, দিনু, ইউ মে গো।’
দিনুর মাইমা দিনুকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে গেলেন। মহিলারা ভীষণ অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। দিনুর পিসতুতো বোন বললে, ‘ছোট মামার যেমন কান্ড! রাত ভোর হয়ে গেল! কখন আর ঘুমোবে?’
‘আরে রাখ তোর ঘুম! কত রাত এখন জেগে কাটবে!’
‘তা যা বলেছিস ভাই।’
‘প্রথমে কত্তা বলবেন গিন্নী শুনবেন, তারপর বলবেন গিন্নী শুনবেন কত্তা, তারপর দু-জনে বলাবলি করবেন পাড়া-প্রতিবেশী শুনবেন।’
নিজেদের রসিকতায় নিজেরাই হেসে উঠলেন। দিনুকে একটা গরদের ধুতি পরতে হয়েছে। তার হাতে একটা ডিশ। তাতে একটা সন্দেশ। আধখানা কামড়ে খেয়ে বাকি আধখানা বউকে খাওয়াতে হবে। ডিবেতে দু-খিলি পান দু-জনের। এক গেলাস জল। দিনুর ঘরটা নিয়ে মহিলাদের ভীষণ অভিযোগ। সব কটা জানালাই রাস্তার দিকে। এমন একটা ফাঁকফোকর নেই যে আড়িপাতা যাবে!
‘তুমি তা হলে দরজাটা দিয়ে দাও।’
রাত, প্রায় তিনটে। বাইরের বাতাসে শীত আর বসন্ত একসঙ্গে উড়ে চলেছে। মামার গান ভেসে আসছে—‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয় ফিরে আয় ফিরে আয়, তোরে না হেরিয়া ওরে উন্মাদ, পান্ডুর হল আকাশের চাঁদ।’
‘সত্যিই তাই। পশ্চিম আকাশে চীনে লণ্ঠনের মতো ফ্যাকাসে চাঁদ হাওয়ায় দুলছে। রজনীগন্ধার ঝাড় থেকে দু-একটি আলগা ফুল শব্দ করে টেবিলের ওপর ঝরে পড়ল। উপহার মোড়া একটা সেলোফোন কাগজ বাতাসে খড়খড় করছে। অনেক দূরে কে যেন বলছে, ‘উনুনে এখনও আঁচ আছে, নিরঞ্জন চায়ের জল বসা।’
দিনু বউকে ডাকল, ‘গীতা!’
স্বচ্ছ মশারির ভেতর থেকে উত্তর এল, ‘বলো।’
‘ঘুমোলে?’
‘না তো!’
‘তবে?’
‘জেগেই আছি।’
দু-জনে পাশাপাশি বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে রইল। দিনু চিৎ, বউ কাত। রেশমী লেপ দু-জনকেই ঢেকে রেখেছে। সারা ঘরে ফুলের গন্ধ মেখে গোলাপী অন্ধকারে রেণু রেণু হয়ে ভেসে যাচ্ছে। কামসূত্র কী শিখিয়েছে এখন আর মনে পড়ছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ। এক গেলাস জল খেতে পারলে ভালো হত। অনেক রকম ভাবনা আসছে মনে। বহু ধরনের শব্দ আসছে কানে। দিনুর মনে হচ্ছে, সারা দেওয়ালে অজস্র জোড়া জোড়া চোখ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বউয়ের দিকে একটা কাঁপা কাঁপা হাত বাড়াতে গিয়ে টেনে নিল। মনে হল, হাত ঠেকালেই সারা ঘরে হিস করে একটা সম্মিলিত শব্দ ছড়িয়ে পড়বে।
দিনু কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলে, ‘গীতা ঘুমোলে?’
কোনও সাড়া পেল না। বালিশে কনুইয়ের ভর রেখে দিনু নিজেকে তুলে ধরল, ঝুঁকে পড়ল বউয়ের দিকে। মুখটা ওপাশে ফেরানো। পুঁটলি হয়ে শুয়ে আছে। যেন পরের বিছানায় বিদেশি বালিকা। এখনও অধিকার বোধ জন্মায়নি। গাছ কী অত সহজে জমিতে শিকড় নামায়! ছোট্ট কপাল। ফোঁটা ফোঁটা চন্দনের টিপ। চুলের কুঁচি। মুখময় সারা দিনের ক্লান্তি। সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে। ভয়ে মটকা মেরে পড়ে নেই। না, তুমি তা হলে ঘুমোও। দিনু লেপটা বউয়ের গায়ে টেনে দিল ভালো করে। মেয়েলি ঘুমের আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে। বড়ো মোলায়েম। পাখির বাসার মত পলকা কিন্তু নির্ভরতায় ভরা। বড়ো স্নেহ আসছে। দিনু একটা পুতুল পেয়েছে।
লেপের আর একটা পাশ তুলে, মশারি খুলে দিনু রাজবেশে খাট থেকে নেমে পড়ল। ভারমুক্ত হল খাটটা ক্যাঁচ করে একটা শব্দ ছাড়ল। যাক বাবা, বাঁচা গেল। ফুলশয্যা অতি সহজে শেষ হল। ফাঁড়া কেটে গেল। ওদিকে উনি আবার আর একটু সরতে গিয়ে খাট থেকে পড়ে যাবেন না তো! পাশবালিশটা দিতে পারলে ভালো হত। যাক গে? যা হয় হবে।
একটা পাখি ডেকে উঠল। রাত প্রায় শেষ হয়ে এল। চাঁদ আরও ফ্যাকাশে। তারার রং সাদা। ঘরের বাইরে যাওয়া যাক। দিনু দরজার ছিটকিনি খুলতেই একটা দেহ চিত হয়ে চৌকাঠে তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল। দিনুর বিস্ময় কাটার আগেই পায়ের কাছে উলটেপড়া মূর্তি আড়মোড়া ভেঙে বসতে বসতে বললে, ‘আড়িপাততে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম রে। সারাদিন কত খেটেছি বল?’
‘বিছানায় শুলেই পারতে। যাও আমার বিছানায় গিয়ে একটু শুয়ে পড়ো। এখনও অন্ধকার আছে।’
দু-হাত মাথার ওপর তুলে খোঁপা ঠিক করতে করতে দিনুর পিসতুতো বোন মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে থেকেই বললে, ‘এখন আর শোব না রে, ঘুমোলে আর সহজে উঠতে পারব না। তোরা কী কথা বললি রে! শুধু তো একবার শুনলাম, গীতা ঘুমোলে? তারপর নিজেই ঘুমিয়ে পড়লুম।’
‘ওই একই কথা আর একবার বলেছিলুম। তুমি শুধু শুধু এত কষ্ট করলে কেন!’
‘করতে হয় রে। অনেক কালের নিয়ম আড়িপাতা।’
দিনু ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বাইরেটায় বেশ ঠাণ্ডা। শীত শীত করছে। চোখ জ্বালা করছে। লম্বা হলঘরে শূন্য ফরাস। একপাশে হারমোনিয়ম, অন্য পাশে এসরাজ টানটান শুয়ে। একটা খালি প্লেটে গোটা কতক লবঙ্গ। চারদিকে থই থই আলোআঁধারি। বিয়ের বাসী বাড়ি। সময় এক রাতেই সব উৎসব মুছে জীবনে যেমন ছিল তেমনি করে দেবে। স্মৃতি ম্লান হয়ে আসবে। এক কাপ চায়ের সন্ধানে দিনু বেরিয়ে পড়ল।
বছর থেকে বছর ঘুরে গেল। জীবনের সুরে সময়ের নদীর ওপর দিয়ে একটু একটু করে বড়ো হতে হতে সাতটা বছরের পিলার পেরিয়ে এল। সেই বাড়ি। জীবনটা শুধু ঝরতে ঝরতে, ক্ষইতে ক্ষইতে সরু হয়ে এসেছে।
২
মাঘের শেষ ফাল্গুনের প্রথম খুব দখিনা বাতাস ছেড়েছে। দিনু দাঁড়িয়ে আছে দোতলার ঘরে কাছা গলায়। নীচে সোরগোল, ‘খাট এসেছে, খাট এসেছে।’ দিনু চমকে উঠল। অনেক দিন আগের অস্পষ্ট স্মৃতি। সেদিনও খাট এসেছিল, সেদিনও উৎসব ছিল, সেদিন সানাই ছিল। সে উৎসব ছিল আনন্দের, আগমনের। আজকের উৎসব বিদায়ের, বেদনার। বাবা চলে গেছেন। অগ্রদানীকে দেবার খাট এসেছে। লেপ, তোশক, বালিশ, চাদর আগেই এসে গেছে। গতকাল ঘাট হয়ে গেছে, আজ শ্রাদ্ধ, ব্রাহ্মণ ভোজন প্রভৃতি অনুষ্ঠান। বাবার ঘরেই বাবার ছবি ঝুলছে। প্রমাণ মাপের ছবিটি সবে হয়ে এসেছে। বীরেনবাবুর হাতের কাজ। ফোটোর ওপর নিপুণ হাতে রং লাগিয়েছেন। ফ্রেমটা ঝকঝক করছে। দিনু ছবিটা নামাতে এসেছে। নীচের শ্রাদ্ধবাসরে ছবিটি বসবে। চোখে চোখে থাকবেন।
ঘরের কোণে একটা টুল। তার ওপর ভাঁজ করে করে খবরের কাগজ রাখা। শেষ কাগজ পড়েছেন গত পনেরো তারিখে। চশমার খাপটা টেবিলের ওপর সেই যাবার দিনের মতো করে রাখা। বিছানায় টানটান চাদরপাতা। চটি দু-পাটি খাটের তলায়, দেওয়াল আলনায় জামা, ধুতি, চাদর, সাদা সোয়েটার। এই যেন বাথরুমে গেছেন। এখুনি এসে পড়বেন গামছায় হাত মুছতে মুছতে। মৃত্যু যেন অদৃশ্য আততায়ীর মতো ওঁত পেতে থাকে। কখন যে হঠাৎ লাফিয়ে এসে খপ করে টুঁটি টিপে ধরে!
সেদিন সকালে অফিস বেরোবার সময় সব কিছুই স্বাভাবিক ছিল। দিনুর ছ-বছরের ছেলে ফ্ল্যানেলের জামা, পাজামা, সোয়েটার পরে, হাতে একটা লাল বল নিয়ে দাদুর কোলে বসে পা নাচাচ্ছিল। দিনু প্রণাম করে হাসি হাসি মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সামনেই তার বউ গীতা। হাতে দু-গেলাস দুধ। কথায় কথায় বলে, আমার এখন দুটো ছেলে, ছোটো খোকা আর বড়ো খোকা। দুটোকেই দুধ খাওয়াতে জীবন বেরিয়ে যায়। বেলা দুটোর সময় সব শেষ। হয়তো কিছু বলার ছিল, শোনা হল না।
দিনু এসে দেখল টেবিলের ওপর একরাশ গ্রামার আর ট্রানস্লেশনের বই। হাওয়ায় পাতা উড়ছে। চশমাটা উপুড় হয়ে আছে। বাবার চোখের দৃষ্টি মহাশূন্যে স্থির। মুখে ক্ষীণ হাসি। বালব আছে, আলো নেই। একটা সূক্ষ্ম তার কোথাও ছিঁড়ে ঝুলে পড়েছে।
ইদানীং খুব গ্রামার আর ট্রানস্লেশনের বই পড়ছিলেন। দিনু একদিন অবাক হয়ে ব্যাপারটা জানতে চেয়েছিল। বলেছিলেন, উত্তর পাবে জাতকের ভূমিকায়। দিনু জাতক খুলে দেখেছিল: শুদ্ধ একজন্মের কর্মফলে কেহই গৌতম প্রভৃতির ন্যায় অপার বিভূতিসম্পন্ন সম্যকসমৃদ্ধ হইতে পারে না; তিনি বোধিসত্ত্ব অর্থাৎ বুদ্ধাঙ্কুর বেশে কোটি কল্পকাল নানা যোনিতে জন্মজন্মান্তর পরিগ্রহপূর্বক দানশীলাদি পারমিতার অনুষ্ঠার দ্বারা উত্তরোত্তর চরিত্রের উৎকর্ষসাধন করেন এবং পরিশেষে পূর্ণপ্রজ্ঞা লাভ করিয়া অভিসম্বুদ্ধ হন।
আবার তাহলে আসতে হবে! কোথায়? কীভাবে?
গীতা এসেছে। একমাথা রুক্ষ চুল। সাদা কোরা শাড়ি। করুণ মুখে ছলছলে দৃষ্টি, ‘তুমি একা একা এ ঘরে কী করছ? চলো কাজে বসবে চলো। ভটচাজ্যিমশাইরা এসে গেছেন।’
বুকের কাছে ছবিটা দু-হাতে আঁকড়ে ধরে দিনু সিঁড়ি ভেঙে নামছে। আজ আর সানাই নেই। নিরঞ্জন নেই, দিনুর মামা নেই, গণেশকাকা নেই। সেদিনের সেই হালুইকর অনন্ত নেই। সেদিনের নিমন্ত্রিতদের মধ্যেও অনেকে নেই। আম আর অশ্বত্থ গাছে সবুজ সোনা পাতার লুটোপুটি। গীতার গলায় ভাঁজ পড়েছে। দিনু সব দেখতে পাচ্ছে। সময় চলেছে নদীর মতো ভাঙতে ভাঙতে, গড়তে গড়তে।
কীর্তনিয়ারা এসে আসর জাঁকিয়ে বসেছেন। খোল বেজে উঠেছে কুপ কুপ করে। বড়ো একা লাগছে আজ। জনসঙ্গেও নিজেকে আজ বড়ো নি:সঙ্গ মনে হচ্ছে। কীর্তনিয়ারা হঠাৎ গেয়ে উঠলেন:
আমি একা রৈলাম ঘাটে
ভানু সে বোসিলো পাটে…
দিনুর বাবা বেঁচে থাকলে দিনুর মামাকে বলতেন, ‘আহা অ্যাটমোসফিয়ারটা বেশ জমেছে মোহর!’