সাধুসঙ্গ ও সন্ন্যাসীর আদর্শ

সাধুসঙ্গ ও সন্ন্যাসীর আদর্শ

‘কথামৃতে’র যে অংশ দিয়ে আমরা এখানে আলোচনা শুরু করছি, সেখানে দেখছি মণিলাল মল্লিক এসেছেন শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে দক্ষিণেশ্বরে। রবিবার, ৮ই এপ্রিল, ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দ, ২৬শে চৈত্র, প্রাতঃকাল। ⋯ঠাকুর বালকের ন্যায় বসিয়া আছেন। কাছে বসিয়া একটি ছোকরা ভক্ত—রাখাল। মাষ্টার আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র রামলাল আছেন, কিশোরী ও আরও কয়েকটি ভক্ত আসিয়া জুটিলেন। (২-৩-১) এমন সময় পুরাতন ব্রাহ্মভক্ত মণিলাল মল্লিক এসে উপস্থিত হলেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রণাম করলেন। মণি মল্লিক কাশীধামে গিয়াছিলেন। তিনি ব্যবসায়ী লোক, কাশীতে তাঁহাদের কুঠি আছে। (ঐ) কাশী থেকে ফিরে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে এসেছেন। কাশী একটা অদ্ভুত জায়গা। হিন্দুদের কাছে চিরকাল এই কাশীর খুব বড় আকর্ষণ। কাশী সম্বন্ধে বলা হয় যে, পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন নগরী। বাবা বিশ্বনাথ আর মা অন্নপূর্ণা সেখানে বিরাজ করছেন। হিন্দুদের বিশ্বাস : কাশীতে মরলেই মুক্তি হয়। কাশীতে গিয়ে ঠাকুর দেখেছিলেন যে, শ্মশানে যাদের দাহ করা হচ্ছে, বিশ্বনাথ স্বয়ং তাদের কানে তারকব্রহ্ম নাম শোনাচ্ছেন আর মা অন্নপূর্ণা তাদের সমস্ত বন্ধন মোচন করে দিচ্ছেন। মহাতীর্থস্থান এই কাশী। কাশীর আর একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, সেখানে নানা সম্প্রদায়ের সাধুদের দেখতে পাওয়া যায়। প্রধানত হিন্দু সমাজেরই লোক তাঁরা সবাই। কিন্তু বিচিত্র তাঁদের পোশাক, বিচিত্র সাধনপদ্ধতি। সেই অর্থে কাশী এক মহামিলনভূমি।

মণি মল্লিককে ঠাকুর জিজ্ঞেস করছেন : হ্যাঁগা, কাশীতে গেলে, কিছু সাধু-টাধু দেখলে? (ঐ) আমরা হলে হয়তো জিজ্ঞেস করতাম। সেখানে গরম না ঠাণ্ডা, চালডালের কিরকম দর সেখানে, ইত্যাদি। কিন্তু ঠাকুরের প্রশ্ন আলাদা। তিনি জানতে চাইছেন : কিছু সাধু-টাধু দেখলে? তীর্থস্থানে আমরা যাই বিগ্রহ দর্শন করতে। বিগ্রহই যদি না দেখলাম তীর্থস্থানে গিয়ে, তাহলে সব বৃথা। দু-রকমের বিগ্রহ আছে তীর্থস্থানে। এক রকমের বিগ্রহ—তিনি মন্দিরে আছেন, তীর্থস্থানের আরাধ্য দেবতা বা দেবী। তিনি অচল বিগ্রহ। অবশ্য সেইরকম দৃষ্টি যাঁদের, পুণ্যাত্মা যাঁরা—তাঁদের চোখে তিনি আর অচল থাকেন না। তবে অধিকাংশের কাছেই তিনি অচল বিগ্রহ। কিন্তু আর একরকম বিগ্রহও সেখানে আছে—সচল বিগ্রহ। সাধুসন্ত—এঁরা হচ্ছেন সেই সচল বিগ্রহ। দুই প্রকার বিগ্রহই দেখতে হয় তীর্থস্থানে গিয়ে। সাধুদেরও দেখতে হয়। অনেক সময় তাঁরাই আমাদের মনে বেশী প্রেরণা যোগান। এত ত্যাগ, এত তিতিক্ষা, এত কষ্টও মানুষ করতে পারে ঈশ্বরের জন্য? আমিও তাহলে একটু চেষ্টা করি না কেন?—এই প্রেরণা পাই তাঁদের কাছ থেকে। আমরা শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখছি তিনি নিজে যাচ্ছেন অনেক সাধু-সন্দর্শনে। কিরকম ব্যবহার পাবেন জানেন না। যেমন কেশব সেনকে দেখতে গেলেন। শুনেছেন তিনি ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ করেন, তাই গেছেন তাঁকে দেখতে। কালনায় গেছিলেন ভগবানদাস বাবাজীকে দেখতে। দয়ানন্দ সরস্বতীকে দেখতে গেছিলেন। দয়ানন্দ কলকাতায় এসেছিলেন, তখন তাঁকে দেখতে গেছিলেন। আবার কাশীতে যখন গেছিলেন, তখন সেখানে ত্রৈলঙ্গস্বামীকে দেখতে গেছিলেন। ত্রৈলঙ্গস্বামী মৌন হয়ে থাকতেন। ইশারায় দুজনের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান হয়েছিল। ত্রৈলঙ্গস্বামী সম্বন্ধে ঠাকুর বলেছিলেন ; এঁর ঠিক ঠিক পরমহংস অবস্থা। আমাদের হিন্দুদের ঐতিহ্য এই সাধু-দর্শনে যাওয়া। আমাদের জাতীয় জীবনের লক্ষ্যটা কি, এই একটা জিনিস থেকেই বোঝা যায়।

বস্তুত, দুটো রূপ ভারতবর্ষের। একটা তার বহিরঙ্গ রূপ। সেই ভারত পরিবর্তনশীল—যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে বদলে যাচ্ছে। দোষের নয় কিছু! কিন্তু আর একটা অন্তরঙ্গ রূপ আছে ভারতের। ভারত ‘ভারত’ তার সেই অন্তরঙ্গ রূপটির জন্য। সেই ভাবতবর্ষ শাশ্বত ভারতবর্ষ। সেই ভারতবর্ষ বলে : এই জগৎসংসার সত্য নয়, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ সত্য নয়। এর বাইরে আরও কিছু আছে, সে-ই একমাত্র সত্য। আমাদের জীবনের লক্ষ্য সেই সত্যকে উপলব্ধি করা। আমি নিজে হয়তো সেই লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে আছি—কিন্তু লক্ষ্যটাকে ভুলে যাইনি আমি। একদিন না একদিন সেখানে আমি পৌঁছবই। হয়তো বহুদিন পরে পৌছব, কিন্তু পৌছব আমি নিশ্চয়ই। সেই আদর্শকে আমি শ্রদ্ধা করি, সেইজন্য সেই আদর্শ যাঁদের জীবনে মূর্ত হয়েছে, লক্ষ্যস্থলে যাঁরা পৌঁছতে পেরেছেন বা লক্ষ্যের খুব কাছাকাছি যাঁরা গেছেন—সাধু-সন্ত যাঁরা—তাঁদের কাছে যাচ্ছি আমি। ঠাকুর বলছেন : সাধুসঙ্গ হ’লে তবে ধারণা হয়। (৩-১৩-১) শাশ্বত ভারতবর্ষকে তাঁরাই ধরে রেখেছেন। তাঁদের সঙ্গ করে আমি লক্ষ্যটা আর একবার চিনে নিচ্ছি, সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে কি কি করতে হবে, জেনে নিচ্ছি। স্বামীজী বারবার করে বলছেন যে, আমাদের জাতীয় জীবনের মূল সুর হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা। এটা বোঝা যায়, যখন দেখি সাধু-সন্তদের প্রতি আমাদের দেশের সাধারণ লোকের কতটা আকর্ষণ। ‘কথামৃতে’ দেখি যে, ঠাকুর বারবার করে এই সাধুসঙ্গের উপরে জোর দিচ্ছেন। বলছেন ; সাধুসঙ্গ করলে সদসৎ বিচার আসে। সদসৎ বিচার অর্থাৎ ঈশ্বরই যে একমাত্র সত্য বস্তু,আর সব মিথ্যে—এই বোধটা আসে সাধুসঙ্গ করলে। বলছেন : সাধুসঙ্গে নিজের ঘড়ি অনেকটা ঠিক ক’রে লওয়া যায়। (৫।পঃ ক। ৪) আমার একটা ঘড়ি আছে। সেই ঘড়িটা ঠিক চলছে কিনা তা বুঝবার জন্য মাঝে মাঝে অন্যের ঘড়ির সাথে আমার ঘড়িটা মেলানো দরকার। সাধুসঙ্গ হচ্ছে সেই ঘড়ি। বিশেষত সংসারীদের পক্ষে। সংসারে অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি না, ঠিক করছি কি ভুল করছি ; ঈশ্বরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি না সংসারে আরও জড়িয়ে পড়ছি। সাধুদের কাছে গেলে সাধুরা আমাদের ধরিয়ে দেন—আমি কোথায় আছি। ভুল করলে বুঝিয়ে দেন। আরও উৎসাহ দেন, প্রেরণা দেন। অনেক সময় দেখা যায়, শুধু আধ্যাত্মিক সমস্যা নয়, সংসারের অনেক সমস্যার সুন্দর সমাধান করে দেন সাধুরা। কারণ, তাঁদের বুদ্ধি নির্মল, দৃষ্টি স্বচ্ছ—চট করে যে কোন জিনিসের গভীরে তাঁরা প্রবেশ করতে পারেন। তাঁরা যে সবাইকে সংসার ত্যাগ করতে বলেন—তা নয়। সংসারে থেকেও কিভাবে ধর্মপথে থাকা যায়, ঈশ্বরের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায় সেই উপদেশ দেন তাঁরা। সংসারে আমার অর্থের প্রয়োজন আছে। আমি নিশ্চয়ই অর্থ উপার্জন করতে চেষ্টা করব। কিন্তু এরকম যদি হয়, অর্থের প্রতি আমার একটা লোভ এসে গেছে, আরও অর্থ চাই আমার, প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ চাইছি আমি, শেষ পর্যন্ত হয়তো অসৎ উপায়েও অর্থ উপার্জন করছি, ন্যায়-অন্যায় বোধ সব নষ্ট হয়ে গেছে—সাধুসঙ্গ থাকলে, সাধু আমাকে বলে দেবেন : না, এটা তুমি ঠিক করছ না, অর্থের প্রতি এতটা আকর্ষণ ভাল না। আমি তখন সংযত হব, ভালভাবে চলবার চেষ্টা করব। ঠাকুর যে বারবার বলছেন, ‘এক হাতে ঈশ্বরের পাদপদ্ম ধরে সংসারে থাক’, সাধুপুরুষেরা আমাদের সেইকথা স্মরণ করিয়ে দেন : তোমার এক হাত ঈশ্বরে আছে তো? তাঁকে একেবারে ভুলে যাওনি তো তুমি? ঠাকুর বলছেন : সাধুসঙ্গে ঈশ্বরে অনুরাগ হয়। (৫-১-২) সাধুসঙ্গ করলে ঈশ্বরীয় বিষয়ে শ্রদ্ধা হয়। শ্রদ্ধার পর নিষ্ঠা। (৪-১৬-২)।

ঠাকুর বলতেন : সাধুসঙ্গ হচ্ছে চাল-ধোয়ানি জল। চাল-ধোয়ানি জল কেন বলছেন? কেউ যখন মাতাল হয়ে যায়—মাতাল হয়ে তার তো খেয়াল নেই সে কি বলছে বা করছে—তাকে তখন যদি চাল-ধোওয়া জল খাওয়ানো যায় তখন নাকি সে আবার প্রকৃতিস্থ হয়। আমরা সবাই সংসার-সুখে মত্ত হয়ে আছি—যদি সাধুসঙ্গ করি তাহলে আবার আমরা প্রকৃতিস্থ হব, বিষয়ের প্রতি এখন যে একটা বিরাট মোহ আছে সেটা কেটে যাবে আমাদের। কুলার্ণবতন্ত্রে বলছে : ‘সতাং সঙ্গো হি ভেষজম্‌।’ সাধুসঙ্গই হচ্ছে ওষুধ। এই যে বিরাট ভবব্যাধি আমাদের—এর একমাত্র ওষুধ হচ্ছে সাধুসঙ্গ। কেন ব্যাধি বলা হচ্ছে? কারণ যতই শাস্ত্ৰ-উপদেশ শুনি, যতই দুঃখ-কষ্ট ভোগ করি না কেন বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ আমাদের কিছুতেই যেন যেতে চায় না। এই দুরারোগ্য ব্যাধিও দূর হয়—সাধুসঙ্গ করলে। একটা পুরাণ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি আর একটা শ্লোক। সেখানে বলছে : ‘অনেকজন্মজনিতং পাতকং সাধুসঙ্গমে ক্ষিপ্রং নশ্যতি ধর্মজ্ঞ জলানাং শরদো যথা’—বর্ষাকালে নদী-নালার জল ঘোলা থাকে। কিন্তু শরৎকাল এলেই নদী-নালার জল আপনা-আপনিই নির্মল, স্বচ্ছ হয়ে যায়। তেমনি জন্মজন্মান্তরের সঞ্চিত পাপও সাধুসঙ্গের ফলে খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। তুলসীদাস বলছেন :

তাত স্বর্গ অপবর্গ সুখ ধরিয় তুলা এক অঙ্গ।

তূল ন তাহি সকল মিলি জো সুখ লব সতসঙ্গ ॥

পৃথিবীর যত সুখ—স্বর্গ অপবর্গ সব তুমি দাঁড়িপাল্লার এক দিকে রাখ, আর অন্যদিকে রাখ সাধুসঙ্গ। দেখবে যে, সাধুসঙ্গের যে আনন্দ তার সঙ্গে সেসবের কোন তুলনা হয় না। কাজেই, সাধুসঙ্গ কর তুমি। আমার এই প্রসঙ্গে ‘শ্রীম’র কথা মনে পড়ছে। তাঁর সঙ্গ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তাঁর কাছে যাঁরা আসতেন, ‘কথামৃত’ পড়ে অনেকেই তখন তাঁর কাছে আসতেন, তিনি তাঁদেরকে মঠে পাঠিয়ে দিতেন। তিনি বলতেন যে, ঠাকুর ছিলেন কাম-কাঞ্চনত্যাগী সন্ন্যাসী। তাঁকে বুঝতে গেলে তাঁর যাঁরা ত্যাগী-সন্তান তাঁদের দেখতে হবে। আর একটা কথা তিনি বলতেন যে, ঠাকুরের যাঁরা ত্যাগী-সন্তান, তাঁরা হচ্ছেন খুব ভাল জাতের আম ; আর গৃহী-ভক্তরাও আম, কিন্তু জাতটা খুব ভাল না—হয়তো টোকো আম। কেউ মঠ থেকে ফিরে এলে তিনি জিজ্ঞেস করতেন : সেখানে গিয়ে সাধুদের দেখেছ? সাধুরা কি করছিলেন তখন? বলতেন যে, তাঁরা কিভাবে ধ্যান করেন, কিভাবে কাজকর্ম করেন—সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হয়।

বাস্তবিক, সাধুসঙ্গের ফল পেতে গেলে সাধুদের ভাল করে দেখতে হয়—ভাসা ভাসা দেখলে হয় না। মঠে গেলে দেখা যাবে : কোন সাধু হয়তো খুব দ্রুতপদে চলেছেন। কোথায় যাচ্ছেন? ফুল তুলতে হবে, দেরি হয়ে গেছে—তাই তাড়াতাড়ি চলেছেন। এই একটা দৃশ্য। কার জন্যে এই ফুল? কার জন্যে এই ব্যস্ততা? ঠাকুরের জন্যে। আবার আর এক জায়গায় গিয়ে হয়তো দেখা যাবে : তরকারি কোটা হচ্ছে স্তূপাকারে, সাধুরা তরকারি কুটছেন। কার জন্যে এই তরকারি? ঈশ্বরের জন্য। তাঁদের সবকিছুই ঈশ্বরকেন্দ্রিক। এইসব দৃশ্য চোখে পড়ে মঠে গেলে। খুবই সাধারণ দৃশ্য সব, যা নাকি আমরা ঘরে দেখি। কিন্তু তফাৎটা হচ্ছে সাধুরা সবকিছু করছেন ঈশ্বরের জন্যে। এটা যদি কেউ বুঝতে পারেন, তবে এই সব সামান্য দৃশ্যগুলিও অ-সামান্য হয়ে দাঁড়ায় তাঁর কাছে, ভক্তির উদ্রেক করে তাঁর মনে। সেইজন্য ‘শ্রীম’কে দেখতাম, মঠ থেকে ফিরে এলে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতেন ; সাধুদের দেখলে? কি তাঁরা করছেন লক্ষ্য করলে? আর একটা জিনিস লক্ষ্য করতাম, মঠ থেকে কোন একজন সন্ন্যাসী হয়তো তাঁর কাছে এসেছেন, বয়সে অনেক ছোট তাঁর থেকে, তাঁরই অনুপ্রেরণায় হয়তো তিনি সাধু হয়েছেন—কিন্তু তিনি তাঁকে ‘আপনি’ করে বলছেন, নমস্কার করছেন। বলতেন : আপনাদের দেখলে উদ্দীপন হয়। আপনারা তাঁর কথা মনে করিয়ে দেন। বস্তুত, সাধুসঙ্গ লোকে করে এই উদ্দীপনের জন্য। প্রকৃত সন্ন্যাসীর সংসর্গে এলে মনটা অন্য রকম হয়ে যায়। তাঁদের জীবন, তাঁদের আচরণ, তাঁদের প্রতিটি চিন্তা অপরের কল্যাণার্থে। তাঁরা যা কিছু করেন, তাতেই লোকের কল্যাণ হয়। সাধুরা যদি কাউকে গালাগালও দেন, তাতেও প্রকারান্তরে লোকের কল্যাণ হয়। ঠাকুর বলতেন : সতের রাগ জলের দাগ। জলের উপরে যেমন দাগ টানা যায় না, সাধুদের রাগও তেমনি—স্থায়ী হয় না। তাঁরা যদি রাগ প্রকাশ করেন, সে-ও আমারই কল্যাণার্থে। মঠে ঠাকুরের সন্ন্যাসী-সন্তানরা রয়েছেন, তাঁদের সম্বন্ধে শ্রীশ্রীমা বলছেন : এঁরা যেখানে শৌচ করেন, সেখানকার হাওয়াও যদি গায়ে লাগে, তাতেও লোকের মঙ্গল হয়। এত পবিত্র এঁদের জীবন। শঙ্করাচার্য বলছেন : ‘ক্ষণমপি সজ্জনসঙ্গতিরেকা, ভবতি ভবার্ণবতরণে নৌকা’—সাধুসঙ্গ যদি মুহূর্তের জন্যও কেউ লাভ করে, তাহলে সেটাই তার কাছে ভবসমুদ্র পার হওয়ার নৌকা হয়, তার বলেই সে ভববন্ধন ছিন্ন করতে পারে। সাধুসঙ্গের এমনই মাহাত্ম্য।

ঠাকুরকে একজন প্রশ্ন করছেন : সাধু চিনবো কেমন করে? (১-৯-২) খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। ঠাকুর বলেছেন, সাধুসঙ্গ প্রয়োজন ; সেই প্রসঙ্গে এই প্রশ্ন করছেন একজন। ঠাকুর উত্তর দিচ্ছেন : যাঁর মন প্রাণ অন্তরাত্মা ঈশ্বরে গত হয়েছে, তিনিই সাধু।(ঐ) প্রধান লক্ষণ হচ্ছে এইটা। সাধু ঈশ্বরের জন্য সব ত্যাগ করেছেন। ঈশ্বরই তাঁর সর্বস্ব। সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে যিনি বলেন, ‘আমি ঈশ্বরকে চাই, এ ছাড়া আর কিছু চাই না’—তিনিই সত্যিকারের সাধু। যিনি কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী, তিনিই সাধু। (ঐ) অর্থ আর নারী—এই দুই-ই ত্যাগ করেছেন সাধু। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যে সুখ, সেই সুখ তিনি ত্যাগ করেছেন। তার মানে এই নয় যে,সাধু নারীদের ঘৃণা করেন। নারীদের তিনি শুদ্ধ, পবিত্র দৃষ্টিতে দেখবার চেষ্টা করেন। যিনি সাধু তিনি স্ত্রীলোককে ঐহিক চক্ষে দেখেন না। (ঐ) কি ভাবে দেখেন? তাঁকে মাতৃবৎ দেখেন ও পূজা করেন। (ঐ) সমস্ত নারী তাঁর চোখে মা। শ্রদ্ধার পাত্রী। প্রতিটি নারীই জগন্মাতার এক একটি রূপ। সেই হিসেবে তাঁরা তাঁর পূজার্হ। কিন্তু তবুও তিনি স্ত্রীলোকদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখেন—সর্বদাই তাদের অন্তরে থাকেন। (ঐ) ‘অন্তরে থাকেন’ অর্থাৎ দূরে থাকেন। কারণ, একটা আদর্শ স্থাপনের জন্য তাঁর জীবন। সাধুকে দেখে লোকে শিখবে। ঠাকুর বলছেন : সাধুর ষোল আনা ত্যাগ দেখ্‌লে অন্য লোকে ত্যাগ করতে শিখ্‌বে।(৪-২-১) বলছেন ; সংসারীরা মনে ত্যাগ করবে, বাইরে ত্যাগ করা তাদের পক্ষে সবসময় সম্ভব নয়। কিন্তু সাধু বাইরেও ত্যাগ করবে ভিতরেও ত্যাগ করবে। সাধু যদি জিতেন্দ্রিয়ও হন, তাহলেও তিনি মেয়েদের সাথে বিশেষ মেলামেশা করবেন না। নারীকে তিনি ঘৃণা করেন না—শ্রদ্ধা করেন, সাধারণের চেয়ে অনেক বেশী শ্রদ্ধা করেন, আর এই শ্রদ্ধার ভাবটা রক্ষা করার জন্যই নারীদের থেকে একটু দূরত্ব রেখে চলেন। ঠাকুরের কাছে আসতেন একজন যুবকভক্ত—নিত্যগোপাল। ঠাকুর তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। বলতেন যে, ওর খুব উঁচু অবস্থা—পরমহংস অবস্থা। তিনি এক মহিলার কাছে মাঝে মাঝে যেতেন। মহিলাটিও ঠাকুরের খুব ভক্ত, একত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়স। নিত্যগোপালকে সন্তানের মতো স্নেহ করতেন, মাঝে মাঝে তাঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খুব আদর-যত্ন করতেন। আপাতদৃষ্টিতে কিছুই দোষের নেই এতে। কিন্তু ঠাকুর নিত্যগোপালকে বলে দিচ্ছেন : সাধু সাবধান। এক আধবার যাবি, বেশি যাবি না। শ্রীচৈতন্যের জীবনেও এরকম দেখা যায়। তাঁর একজন সন্ন্যাসী-সন্তান—ছোট হরিদাস। খুব স্নেহের পাত্র তাঁর। সেই হরিদাসকে চৈতন্যদেব ত্যাগ করেছিলেন, কারণ তাঁর বারণ সত্ত্বেও হরিদাস এক ভক্ত মহিলার কাছ থেকে ভিক্ষে নিয়েছিলেন। নিত্যগোপালকে যখন ঠাকুর সাবধান করে দিয়েছিলেন, মাস্টারমশাই উপস্থিত ছিলেন। ‘কথামৃতে’ আছে, ঠাকুরের সাবধান-বাণী শুনে মাস্টারমশাই স্বগত চিন্তা করছেন : এমন উচ্চ অবস্থা সত্ত্বেও কি ইঁহার বিপদ সম্ভাবনা! সাধুর পক্ষে ঠাকুর কি কঠিন নিয়মই করিলেন।⋯এই উচ্চ আদর্শ না থাকিলে জীবের উদ্ধারই বা কিরূপে হইবে? স্ত্রীলোকটি তো ভক্তিমতী। তবুও ভয়! এখন বুঝিলাম, শ্রীচৈতন্য ছোট হরিদাসের উপর কেন অত কঠিন শাসন করিয়াছিলেন।⋯ হরিদাস যে সন্ন্যাসী। তাই মহাপ্রভু তাঁকে ত্যাগ করিলেন। কি শাসন! সন্ন্যাসীর কি কঠিন নিয়ম! ⋯ভক্তেরা অবাক। (অর্থাৎ বাক্যশূন্য, নিঃশব্দ) ‘সাধু সাবধান’-ভক্তেরা এই মেঘগম্ভীরধ্বনি শুনিতেছেন। (২-২-২) এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ছে। একবার কাশী অদ্বৈতাশ্রমে ভাগবত পাঠ হচ্ছে। একটা বড় সতরঞ্চি পাতা আছে। সেখানে বসে সাধুরা সব পাঠ শুনছেন। বাবুরাম মহারাজ (স্বামী প্রেমানন্দ) আর হরি মহারাজ (স্বামী তুরীয়ানন্দ)-ও ঐ সতরঞ্চিতে বসে পাঠ শুনছেন। সেখানে স্বামী আত্মানন্দ আছেন। স্বামীজীর শিষ্য তিনি, খুবই উন্নত ধরনের সাধু একজন। এমন সময় একজন স্ত্রীভক্ত পাঠ শুনবেন বলে ঐ সতরঞ্চির শেষ ধারটায় এসে বসেছেন। যথেষ্ট দূরত্ব রেখেই বসেছেন তিনি—সবার পেছনে। কিন্তু স্বামী আত্মানন্দ সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন। আর পাঠ শুনলেন না। পরে একজন তাঁকে জিজ্ঞাসা করল ; উঠে এলেন যে? স্বামী আত্মানন্দ বললেন : নারীর সঙ্গে একাসনে বসা সন্ন্যাসীর উচিত না।—বাবুরাম মহারাজ, হরি মহারাজ এঁরা বসে আছেন, আর আপনি বসতে পারেন না? আত্মানন্দ বলছেন : দেখুন, ওঁদের কথা স্বতন্ত্র। ওঁদের এক একটা চাঁটিতে আমার মতো হাজার শুকলের* ব্রহ্মজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। ওঁদের সঙ্গে আমার তুলনা চলে না। আমি এই নিয়ম মেনে চলব। বস্তুত, সন্ন্যাসীর জীবন অপরের শিক্ষার্থে। সেইজন্য তাঁকে এতটা সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। মা বলছেন : সন্ন্যাসীরা হচ্ছে সাদা কাপড়। সাদা কাপড়ে যদি এক ফোঁটা কোন দাগ পড়ে সেটাই খুব চোখে পড়ে। সন্ন্যাসীকে সেইজন্য খুব সাবধানে চলতে হবে।

ঠাকুর বলছেন : সাধু সর্বদা ঈশ্বর চিন্তা করেন, ঈশ্বরীয় কথা বই কথা কন না। আর সর্বভূতে ঈশ্বর আছেন জেনে তাদের সেবা করেন। মোটামুটি এইগুলি সাধুর লক্ষণ। (১-৯-২) অর্থাৎ প্রধান লক্ষণ হল এই যে, সাধু ঈশ্বরময় হবেন। ঈশ্বরই তাঁর কাছে একমাত্র সত্য—আর সব মিথ্যা। সবসময় তিনি ঈশ্বরচিন্তা করবেন। ঠাকুর বলছেন : সাধু যদি ঈশ্বরচিন্তা করে সেটা কোন আশ্চর্যের বিষয় নয়। বরং সে যদি ঈশ্বরচিন্তা না করে তাহলে সেটাই হবে আশ্চর্যের বিষয়, তাহলেই বরং লোকে তাকে নিন্দে করবে।

এই যে লক্ষণগুলোর কথা বলা হল এগুলো পরিপূর্ণভাবে আমরা দেখি শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনেই। আদর্শ সন্ন্যাসী তিনি। মা বলছেন যে, তাঁর ষোল আনা ত্যাগ ; ত্যাগই তাঁর ভূষণ। স্বামীজী তাঁর সম্বন্ধে বলছেন : ত্যাগীর বাদশা। মথুরবাবু তাঁর কাছে এসে প্রস্তাব দিচ্ছেন : বাবা, আমি আর ক’দিন থাকব? আমার অবর্তমানে যাতে তোমার দেখাশুনোর অসুবিধে না হয়, তার একটা ব্যবস্থা আমি করে যেতে চাই, তোমার নামে একটা জমি লিখে দিতে চাই।—একজন দরিদ্র পুরোহিতের কাছে এর চেয়ে লোভনীয় প্রস্তাব আর কি হতে পারে? কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ এই কথা শুনে মথুরবাবুকে প্রায় মারতে যান, বলছেন : শালা, তুই আমাকে বিষয়ী করতে এসেছিস। মথুরবাবু গিয়ে তাঁর বৃদ্ধা মা-কে ধবলেন। তিনি তখন নহবতে। তাঁকে গিয়ে বললেন : দিদিমা, আমার কাছ থেকে কখনও তুমি কিছু নাও না। এবার একটা জিনিস নিতেই হবে—না হলে বুঝব তুমি আমাকে ভালবাস না। বৃদ্ধা তো শুনে খুব মুশকিলে পড়ে গেছেন। কি চাইবেন, তাঁর যে কিছুর অভাব আছে এ তিনি ভেবে পাচ্ছেন না। শেষে অনেক ভেবেচিন্তে তিনি বললেন : হ্যাঁ, মনে পড়েছে, আমার দোক্তাপাতাটা কয়েকদিন হল ফুরিয়ে গেছে। তুমি বরং আমাকে দু-পয়সার দোক্তাপাতা কিনে দাও।—এই কথা শুনে মথুরবাবু একেবারে কেঁদে ফেলেছেন : এরকম মা না হলে কি আর ‘বাবা’র মতো ছেলে হয়। লছ্‌মীনারায়ণ নামে এক মাড়োয়ারী ভক্তও এসেছিলেন দশ হাজার টাকা দিতে। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকেও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তবে তার আগে সারদাদেবীকে একটু পরীক্ষা করে নিয়েছিলেন, দেখতে চেয়েছিলেন, সারদাদেবী ঐ টাকা নেন কিনা। কিন্তু সারদাদেবীও সেই টাকা নেননি। তিনি তো শ্রীরামকৃষ্ণের উপযুক্ত সহধর্মিণী, শ্রীরামকৃষ্ণ যদি ত্যাগসম্রাট হন, তিনিও ত্যাগসম্রাজ্ঞী—কাজেই, সেই পরীক্ষায় তিনি অনায়াসে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ অর্থ স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারতেন না। হাত বেঁকে যেত, শরীরে যন্ত্রণা বোধ করতেন। আমরা সবাই জানি যে, স্বামীজী তাঁকে পরীক্ষা করেছিলেন বিছানার নীচে একটা টাকা রেখে। শ্রীরামকৃষ্ণ জানেন না সেকথা, কিন্তু বসতে পারছেন না বিছানায়। চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না। আপাতদৃষ্টিতে এটা অসম্ভব বলে মনে হয়। কিন্তু ‘অসম্ভব’ না। আমাদের মন শরীরকে প্রভাবিত করে। একটা চিন্তা, একটা ভাব, চেষ্টা করলে এমনভাবে আমি আয়ত্ত করতে পারি যে, আমার মনই শুধু নয়—আমার ইন্দ্রিয়, আমার স্নায়ু, আমার সমস্ত শরীর সেই চিন্তায় একেবারে যেন বাঁধা আছে—বাদ্যযন্ত্রকে যেমন একটা পর্দায় বাঁধা যায়। শ্রীরামকৃষ্ণেরও ঠিক তাই। অর্থের প্রতি তাঁর এতটা বিতৃষ্ণা যে, জ্ঞাতসারে তো নয়ই, অজ্ঞাতসারেও কোন মুদ্রার সংস্রব তিনি সহ্য করতে পারছেন না। এ তো গেল অর্থের কথা। আবার দেখছি, সব নারীতে তাঁর মাতৃভাব। পতিতা নারীর মধ্যেও তিনি জগন্মাতাকে দেখছেন। থিয়েটারের অভিনেত্রীদের বলছেন : মা আনন্দময়ী। তখনকার দিনে যেসব মহিলা অভিনয় করতেন, তাঁদের খুব হেয় করে দেখা হত। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁদের বলছেন : মা আনন্দময়ী। নিজের স্ত্রীকে দেবীজ্ঞানে পুজো করলেন। স্ত্রী-গুরু গ্রহণ করলেন। বস্তুত, এই যুগে নারীকে এতটা সম্মান তাঁর আগে কেউ দেননি। সন্ন্যাসীর নারীকে কতটা শ্রদ্ধার চোখে দেখা উচিত, শ্রীরামকৃষ্ণ তা দেখালেন। আবার দেখছি, মানযশ-প্রতিপত্তি— যার জন্য লোকে এত কাঙ্গাল, পাগল, তার প্রতি তাঁর কী ঔদাসীন্য। মায়ের কাছে প্রার্থনা করছেন : মা, আমি লোকমান্য চাই না, দেহসুখ চাই না, সিদ্ধাই চাই না, কিচ্ছু চাই না—শুধু তোমার পাদপদ্মে আমার যেন শুদ্ধা ভক্তি থাকে।

বাবুরাম মহারাজ একরাতে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সঙ্গে এক ঘরে ঘুমোচ্ছন। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেতে দেখেন, কাপড়টা বগলে নিয়ে ঠাকুর ঘরময় পায়চারি করছেন। অর্ধবাহ্যদশা। মুখে ‘থু থু’ শব্দ করছেন আর বলছেন : দিস না, মা, দিস না। বাবুরাম মহারাজের মনে হল : মা যেন তাঁকে ধামা ভরে নাম-যশ দিতে আসছেন। আর তিনি ভয়ে-আতঙ্কে বলছেন : দিস না, মা, দিস না। মিলটন বলেছেন : ‘Fame is the … last infirmity of noble mind.’ মহৎ লোকদের শেষ দুর্বলতা হচ্ছে মানযশের প্রতি আকর্ষণ। এই আকর্ষণ দূর করা সবচেয়ে শক্ত। শ্রীরামকৃষ্ণ অক্লেশে সেই আকর্ষণ উপেক্ষা করছেন। আর দেখছি, ঈশ্বরময় তিনি। সন্ন্যাসীর প্রধান লক্ষণ তো সেটাই। ঠাকুর বলছেন : সাধুর ঈশ্বরের কথাতেই বেশী হুঁশ।(৪-১৩-২) শ্রীরামকৃষ্ণ ঈশ্বর ছাড়া আর কিছু জানেন না। নিরবচ্ছিন্ন তৈলধারাবৎ তিনি ঈশ্বরচিন্তা করে যাচ্ছেন। বাইরে তিনি গেরুয়া পরেননি, লোকালয় ছেড়ে বনে যাননি। কিন্তু শাস্ত্রসম্মতভাবে বিরজাহোম করে তিনি সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। তোতাপুরী তাঁকে সন্ন্যাস দিয়েছিলেন। সব দিক দিয়েই তিনি আদর্শ সন্ন্যাসী।

ভারতবর্ষে নানা সম্প্রদায়ের সাধু আছেন। শঙ্করাচার্য প্রবর্তন করলেন দশনামী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়। তীর্থ, আশ্রম, বন, অরণ্য, গিরি, পর্বত, সাগর, সরস্বতী, ভারতী ও পুরী—এই দশটি সম্প্রদায়। রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুরা এই দশনামী সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। পুরী-পন্থী সাধু তাঁরা—স্বামী বিবেকানন্দ পুরী, স্বামী ব্রহ্মানন্দ পুরী, ইত্যাদি। শঙ্করাচার্য বৈদিক ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করে এই দশটা নাম দিয়ে একটা সাধু-সম্প্রদায় সৃষ্টি করলেন। বেদান্ত-অনুসারী সাধু এঁরা। ভারতবর্ষের চার প্রান্তে তিনি চারটি মঠ স্থাপন করলেন। এই দশনামী সম্প্রদায় এই চারটা মঠের অনুসরণ করে চলবে। এইভাবে তিনি বৈদিক ধর্মকে রক্ষা করবার একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করলেন। এই দশনামী সম্প্রদায়ের বাইরেও অনেক সাধু আছেন। নানারকম আচার-আচরণ দেখা যায় তাঁদের মধ্যে। নানারকম ‘লিঙ্গ’ বা চিহ্ন ধারণ করেন তাঁরা। কেউ গৈরিকধারী, কেউ হয়তো আবার গেরুয়া পরেননি, কেউ মুণ্ডিত-মস্তক, কারও বিরাট শ্মশ্রু। মূল লক্ষণ কিন্তু ঐ—ঈশ্বর-নির্ভরতা, ঈশ্বরময়তা। অনেক সাধু আছেন, তাঁরা কোন জায়গায় বেশীদিন থাকেন না। ‘রম্‌তা’ সাধু। এক তীর্থ থেকে আর এক তীর্থে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের বলা হয় ‘বহূদক’। আবার আর এক ধরনের সাধু একটা জায়গাতে বসে সাধনভজন করছেন——‘কুটিচক’ বলা হয় তাঁদের। ঠাকুর বলতেন : ‘বহূদকে’র পরে ‘কুটিচক’। সাধু নানা জায়গায় হয়তো ঘুরল, ঘুরে দেখল কিছুই হল না—তখন একটা জায়গায় স্থির হয়ে বসে সাধনভজনে লেগে গেল। মাস্তুলের পাখির যেমন খেয়াল নেই যে জাহাজ মাঝ সমুদ্রে চলে এসেছে। যখন খেয়াল হল, তখন সে চারদিকে অনেকদূর পর্যন্ত উড়ে বেড়াল। কূল-কিনারা পেল না, তখন ফিরে এসে মাস্তুলেই স্থির হয়ে বসে থাকল। ‘বহূদকের পর কুটিচক’। আবার আর একরকম সন্ন্যাসীর নাম হচ্ছে ‘হংস’। হংস’ শব্দটির একটা বিরাট তাৎপর্য আছে। জল আর দুধ মিশে আছে একসাথে। হাঁস কিন্তু তার থেকে জলটা বাদ দিয়ে দুধটা নেবে শুধু। এই সংসারেও সার আর অসার, নিত্য আর অনিত্য মিশে আছে। সেই সন্ন্যাসীই ‘হংস’ যে সবসময় নিত্য-অনিত্য বিচার করছে, বিচার করে নিত্যটাকে বেছে নিচ্ছে, অনিত্যকে বাদ দিচ্ছে। আর আছে ‘পরমহংস’—হংসের থেকেও উপরে ‘পরমহংস’। সে একেবারে আত্মস্থ হয়ে আছে ; নিত্য অনিত্য বিচার করে, অনিত্যটা ত্যাগ করে সর্বদা সে নিত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। শ্রীরামকৃষ্ণ হচ্ছেন ‘পরমহংস’। কে তাঁকে এই উপাধি দিল জানা যায় না। তবে তাঁর এই ‘পরমহংস’ উপাধি নিয়ে সাধুসমাজ কখনও কোন আপত্তি তোলেনি বা কখনও কেউ প্রশ্ন তোলেনি। পরমহংস কিন্তু সমস্ত বিধি-নিষেধের বাইরে। শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখি, শুধু একটা নিয়ম তাঁর আছে—সেটা হচ্ছে : ঈশ্বরপ্রাণতা। ঈশ্বর ছাড়া আর কিছু তিনি জানেন না। এই একটিই নিয়ম তাঁর ক্ষেত্রে। আর কোন নিয়ম নেই। তিনি সন্ন্যাসী, অথচ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বাস করছেন। সংসারে আছেন আবার অর্থ সঞ্চয় করেন না, স্ত্রীকে মনে করেন সাক্ষাৎ জগন্মাতা। কোন একটা সংজ্ঞার মধ্যে তাঁকে বাঁধা যায় না। সব সংজ্ঞার বাইরে তিনি। স্বামী শিবানন্দজীর জীবনের একটা ঘটনা। তিনি তখন মঠে আছেন। গৈরিকধারী সন্ন্যাসী তিনি, সবসময় গেরুয়া পরে থাকেন, সাদা কাপড় পরেন না কখনও। শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথি-উৎসব। হঠাৎ স্বামী ব্রহ্মানন্দ তাঁকে বললেন : তারকাদা, আজকে তো অনেক লোক হয়েছে, আপনি গরদের জামা-কাপড় পরে একবার এই ভিড়ের মধ্যে ঘুরে আসতে পারেন? শিবানন্দজী বললেন : হ্যাঁ, পারি।—তিনি বেশ ভাল গরদের জামাকাপড় পরে লাঠি নিয়ে ভিড়ের মধ্যে ঘুরে এলেন। কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। অর্থাৎ এমন একটা অবস্থা হয়, যখন এই ‘ভেক’টা অনাবশ্যক হয়ে যায়। সাধারণ সন্ন্যাসীদের জন্য ‘ভেকে’র প্রয়োজন আছে, নিয়মবিধির দরকার আছে—কিন্তু পরমহংস সব বিধিনিয়মের ঊর্ধ্বে। তিনি নিয়ম মানতেও পারেন আবার না মানতেও পারেন। তাতে তাঁর কোন দোষ হয় না।

সাধুর যে সব লক্ষণের কথা আগে আমরা আলোচনা করেছি, তা ছাড়াও আরও কিছু কিছু লক্ষণের কথা বলেছেন ঠাকুর। যেমন বলছেন : সাধু হবে অ-সঞ্চয়ী, সঞ্চয় করবে না সে। বলছেন : অবধূতের আর একটি গুরু ছিল—মৌমাছি! (১-৮-৩) ভাগবতে আছে অবধূতের কথা—তাঁর চব্বিশটি গুরু ছিল। একটি গুরু হচ্ছে মৌমাছি। মৌমাছি অনেক কষ্টে অনেক দিন ধরে মধু সঞ্চয় করে। কিন্তু সে মধু নিজের ভাগ হয় না। আর একজন এসে চাক ভেঙ্গে নিয়ে যায়। মৌমাছির কাছে অবধূত এই শিখলেন যে, সঞ্চয় করতে নাই। (ঐ) তারপরে ঠাকুর বলছেন : সাধুরা ঈশ্বরের উপর ষোল আনা নির্ভর ক’রবেই। তাদের সঞ্চয় ক’রতে নাই।⋯পন্‌ছী (পাখী) আউর দরবেশ (সাধু) সঞ্চয় করে না। (ঐ) মহানির্বাণতন্ত্রে আছে : সাধু কিরকম হবেন? তিনি হবেন ‘নিস্ত্রৈগুণ্যো। নির্বিকপ্পো নির্লোভঃ স্যাদসঞ্চয়ী’। ‘নিস্ত্রৈগুণ্যো’ হবেন অর্থাৎ, সত্ত্ব, রজ, তম এই তিনটি গুণের উপরে তিনি চলে যাবেন। ‘তম’র থেকে ‘রজ’ ভাল, ‘রজ’র থেকে আবার ‘সত্ত্ব’ আরও ভাল। কিন্তু ‘সত্ত্ব’গুণও বন্ধন। স্বামীজী বলছেন : সোনার শিকলও শিকল। সত্ত্বগুণ হচ্ছে সোনার শিকল। সাধু সোনার শিকলও ছিন্ন করবেন—সত্ত্বগুণেরও পারে চলে যাবেন তিনি। ত্রিগুণাতীত হবেন। ‘নির্বিকল্পঃ’—কোন বিকল্প নেই। একটা সুর তাঁদের জীবনে—বৈরাগ্যের সুর। এছাড়া আর কোন বিকল্প নেই তাঁদের জীবনে। ‘নির্লোভঃ’—লোভ থাকবে না মোটেই। আর কি? ‘স্যাৎ অসঞ্চয়ী’—সঞ্চয় তিনি কখনও করবেন না। অনেক সাধু অজগরবৃত্তি অবলম্বন করে থাকেন। অজগরবৃত্তিটা কিরকম? অজগর হচ্ছে ময়াল সাপ। একটা গাছের গুঁড়ির মতো সে একটা জায়গায় পড়ে থাকে—নড়তে-চড়তে পারে না। কিন্তু যখন কোন জন্তু-জানোয়ার তার মুখের কাছ দিয়ে যায়, তখন খপ্‌ করে সে তাকে ধরে ফেলে। সাধু ঐরকম অজগরবৃত্তি অবলম্বন করে থাকবেন। কারও কাছে তিনি কিছু চাইবেন না।‘যদৃচ্ছালাভসন্তুষ্টঃ’। ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে আছেন তিনি। অযাচিতভাবে যা আসবে, তাতেই তিনি সন্তুষ্ট। কেউ যদি সেধে কিছু দিয়ে যায় তিনি খাবেন, নাহলে খাবেন না। দেনেওয়ালা তো একজন—‘ভগবান’, তিনি যদি দেন, খাব, নাহলে খাব না। স্বামীজীর পরিব্রাজক জীবনের একটা ঘটনা। ট্রেনে করে যাচ্ছেন তিনি—তাঁর একজন সহযাত্রী বিদ্রুপ করছে তাঁকে। স্বামীজীর সুন্দর স্বাস্থ্য, অল্পবয়স, তিনি পয়সা উপার্জন করছেন না, সন্ন্যাসী হয়েছেন—এ দেখে তাঁর সহযাত্রী বিদ্রূপ করছে। স্বামীজীর সামনেই খুব ভাল ভাল খাবার বের করে খাচ্ছে আর বিদ্রূপ করে বলছে : দেখ, আমি এসব খাচ্ছি। সংসারে ছিলাম বলেই তো এসব খেতে পাচ্ছি। আর তোমার ভাগ্যে তো কিছুই জুটছে না। কি লাভ হল তোমার গেরুয়া পরে? স্বামীজী চুপ করে বসে আছেন, কিছু বলছেন না। বলবেনই বা কি! খিদে পেয়েছে—সত্যিই তো কিছু খেতে পাচ্ছেন না। তারপরে, এমনই যোগাযোগ, একই স্টেশনে দুজনে নেমেছেন। স্বামীজী স্টেশনের বাইরে এসে এক গাছতলায় চুপ করে বসে আছেন আর সেই লোকটি স্টেশনে অন্য কোন কাজ-কর্ম করছে। এমন সময় একটি হালুইকর বেশ কিছু খাবার নিয়ে স্বামীজীর কাছে উপস্থিত। স্বামীজীকে সে বলছে : আমি খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম করছিলাম, এমন সময় রামজী এসে স্বপ্নে বললেন, আমার এক ভক্ত স্টেশনের কাছে অভুক্ত অবস্থায় আছে, তুই তাকে কিছু খাবার দিয়ে আয়। বারবার তিনবার স্বপ্নে দেখে আমি আপনার জন্য এই খাবার এনেছি। স্বামীজী বললেন : তুমি ভুল করেছ। সে আমি নই, তোমার রামজী হয়তো অন্য কোন সাধুকে দেওয়ার জন্য বলেছেন। সেই লোকটি বলছে : না, আমার ভুল হয়নি, আপনিই সেই সাধু। কারণ, এই জায়গায় আপনি ছাড়া আর কোন সাধু নেই। স্বামীজী তখন গ্রহণ করলেন সেসব। তিনি যখন সেসব খাচ্ছেন, তখন সেই সহযাত্রী সেখান দিয়ে যাচ্ছে। সব দেখে সে খুব অবাক হয়ে গেছে।—এই হচ্ছে অজগরবৃত্তি। সাধু ঈশ্বরের উপর পুরোপুরি নির্ভর করে থাকেন, আর এও দেখা যায় যে, ঈশ্বরও অদ্ভুত অদ্ভুত উপায়ে তাঁর যা কিছু প্রয়োজন মিটিয়ে থাকেন।

ভাগবতে বলা হচ্ছে :

সায়ন্তনং শ্বস্তনং বা ন সংগৃহ্ণীত ভিক্ষিতম্‌।

পাণিপাত্রোদরামাত্রা মক্ষিকেব ন সংগ্রহী ॥

—সাধু এরকম করবেন না যে, সকালবেলা ভিক্ষে করে যা পেলেন, তার খানিকটা খেলেন, বাকীটা রাত্রে খাবেন কিংবা তার পরদিন খাবেন বলে রেখে দিলেন। এরকম কখনও করবেন না সাধু। ভিক্ষা করে যা এনেছেন, তা থেকে তিনি সঞ্চয় করবেন না। হাতই হবে তাঁর পাত্র। করপাত্র। সত্রে গিয়ে হাত পেতে দাঁড়ালেন, হাতে যতটা খাবার ধরল, সেখানেই দাঁড়িয়ে খেয়ে চলে গেলেন। আর পেটে যতখানি ধরে ততটাই তিনি খাবেন। খানিকটা বেঁচে গেল, নিয়ে যাই—তা হবে না। মৌমাছি যেমন সঞ্চয় করে রাখে, সেরকম তিনি করবেন না। ঠাকুরের জীবনে আমরা দেখি—এই সঞ্চয় না করা। তাঁর একখানা তেলধুতি দরকার হয়েছে। তেলধুতি হচ্ছে তেলমাখার জন্য যে ধুতি ব্যবহার করা হয়। সাধারণ ধুতির থেকে ছোট ধুতি। মাস্টারমশাই একটার জায়গায় দুটো তেলধুতি নিয়ে এসেছেন, আবার অন্য ধুতিও নিয়ে এসেছেন। ঠাকুর ঐ একটা তেলধুতিই রাখলেন—বাকীগুলো ফিরিয়ে দিলেন। গেছেন বেণীমাধব পালের বাড়িতে। উৎসব সেখানে। ফেরবার সময় বেণী পাল রামলালদার জন্য কিছু খাবার ঠাকুরের গাড়িতে দিয়ে দিয়েছেন। ঠাকুর বলছেন : ও বাবু বেণী পাল, আমার ওতে দোষ হয়। আমি কোন জিনিস সঞ্চয় করে নিয়ে যেতে পারি না। সত্যিই তিনি ভুল করেও সঞ্চয় করতে পারতেন না। খাওয়ার পর নহবতখানায় গেছেন, মুখশুদ্ধি নিতে। মা (শ্রীমা সারদাদেবী) মুখশুদ্ধি দিয়েছেন, খেয়েছেন—আর খানিকটা মুখশুদ্ধি মা হাতে দিয়ে দিয়েছেন পরে খাওয়ার জন্য। সেইটুকু হাতে নিয়ে তাঁর এমন অবস্থা হল যে, তাঁর নিজের ঘরে ফেরবার পথ তিনি আর খুঁজে পাচ্ছেন না। একেবারে গঙ্গার দিকে চলে গেছেন আর বলছেন : মা ডুবি, মা ডুবি। মা সব দেখছেন। বৌ মানুষ—বেরোতে পারেন না, কাউকে ডাকতেও পারেন না। তখন, মন্দিরেরই এক ব্রাহ্মণ, সে ওদিকে আসছিল—তাকে দিয়ে হৃদয়কে খবর দিলেন, হৃদয় এসে তাঁকে ধরে নিয়ে এল। অদ্ভুত ব্যাপার! আমরা দেখি যে , সাধুর ত্যাগের উপরই জোর, ত্যাগই হচ্ছে আসল। ‘ত্যাগেনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ’—একমাত্র ত্যাগের দ্বারাই অমৃতত্ব লাভ করা যায়। সাধুর ধর্ম হচ্ছে ত্যাগ, ঈশ্বরের জন্য সাধু সর্বস্ব ত্যাগ করবেন। ঠাকুর বলছেন : সাধুর সঙ্গে যদি পুটলী-পাটলা থাকে, পনেরটা গাঁটওয়ালা যদি কাপড় বুচ্‌কি থাকে তাহলে তাদের বিশ্বাস ক’রো না। (ঐ) বলছেন : আমি বটতলায় ঐ রকম সাধু দেখেছিলাম। (ঐ) দু-তিনজন মিলে বসে তারা গল্প করছে : অমুক বাড়িতে খুব খাইয়েছে, এই এই জিনিস সব খাইয়েছে। এঁরা ঠিক ঠিক সাধু নন। গানে বলছে :

পাবি না খেপা মায়েরে খেপার মতো না খেপিলে,

সেয়ান পাগল বুঁচকিবগল, কাজ হবে না ওরূপ হ’লে ॥

ভগবানকে পেতে হলে নিঃস্ব হতে হয়। বুঁচকি বগল থাকলে চলবে না। একূল-ওকূল দুকূল রাখলে চলবে না, ‘সেয়ান পাগল’ হলে চলবে না—ঠিক ঠিক পাগল হতে হবে। ঠাকুরের সেই গল্প আছে : ‘কৌপীন-কা ওয়াস্তে’। একজন খুব কঠোরী সাধু, ভয়ানক ত্যাগী—তাঁর শুধু কৌপীন সম্বল, সেই কৌপীন ইঁদুরে এসে কেটে যায়। কি করা যায়? একজন বললেন : একটা বিড়াল পোষ, বিড়াল পুষলে ইঁদুর দূর হবে। বিড়াল পুষলেন তিনি। বিড়ালকে তো দুধ খাওয়াতে হবে, দুধের জন্য গরু পুষলেন। গরুর খাওয়ার জন্য একটু জমি রাখলেন সাধু—সেখানে গরু চরে বেড়ায়। ধীরে ধীরে দেখা গেল, সাধু নিঃস্ব ছিলেন, থাকতেন গাছতলায়—এখন তিনি বিরাট সম্পত্তি করে বসে আছেন। কিছুদিন পরে এই সাধুর গুরু এসেছেন এঁর খোঁজে। সব দেখেশুনে তিনি তো অবাক। শিষ্যকে জিজ্ঞেস করলেন ; এ কী করেছ তুমি? তখন সেই সাধু বলছেন ; এসব শুধু ‘কৌপীন কা ওয়াস্তে’। কৌপীন বাঁচাতে গিয়ে এই অবস্থা আমার।—সেইজন্য সাধুকে খুব সতর্ক থাকতে হয়। কখন কোন্ দিক দিয়ে যে মহামায়া তাঁকে কাবু করবে, কেউ জোর করে বলতে পারে না। সাধু সর্বদা মহামায়ার কাছে শরণাগত হয়ে থাকে : মা, আমাকে রক্ষা কর। ঠাকুরও মায়ের কাছে প্রার্থনা করছেন : মা, তুমি আমাকে তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় ভুলিও না। কখন কিভাবে মায়া আমাদের আক্রমণ করবে কেউ বলতে পারে না।

সন্ন্যাসীর আর একটা লক্ষণ হচ্ছে কারও কোন অনিষ্ট করেন না। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : সাধুর হৃদয় সকলের চেয়ে বড়। (৫-৮-১) তাঁর ধর্ম হচ্ছে ক্ষমা, অহিংসা। তাঁর প্রতি যদি কেউ কোন অন্যায় আচরণও করে, তবুও তিনি তাকে ক্ষমা করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে দেখি এরকম ঘটনা—তিনি ভাবাবস্থায় পড়ে আছেন। একজন লোক এসে তাঁকে লাথি মারল। লোকটি মথুরবাবুর পুরোহিত বংশের। মথুরবাবু ঠাকুরকে খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করেন, তাই তার রাগ ঠাকুরের উপর। ঠাকুরকে এসে সে জিজ্ঞেস করছে : ওরে বামুন, বাবুটাকে কি করে হাত করলি বল না। ঠাকুর উত্তর দিচ্ছেন না—উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থা নেই তাঁর তখন। বিরক্ত হয়ে লোকটি তাঁর গায়ে কয়েকটা লাথি মেরে চলে গেল। সব দেখলেন শ্রীরামকৃষ্ণ, কিন্তু কাউকে কিছু বললেন না। যদি মথুরবাবুর কানে তুলতেন, মথুরবাবু মাথা কেটে ফেলতেন লোকটির। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ ক্ষমা করলেন তাকে। ব্রহ্মজ্ঞ সন্ন্যাসীর ধর্মই হচ্ছে ক্ষমা, অপ্রতিকার। ঠাকুর বলছেন : সংসারী ফোঁস করবে—কিন্তু ত্যাগী যে, সে ফোঁসও করবে না। স্বামীজী একবার ট্রেনে করে যাচ্ছেন। তাঁর পরিব্রাজক জীবনের ঘটনা। যে কামরাতে তিনি আছেন সেই কামরাতেই দু-জন সাহেব উঠেছে। ওরা ভেবেছে স্বামীজী ইংরেজি-টিংরেজি জানেন না, তাই স্বামীজীর সামনেই জোরে জোরে তাঁর সম্বন্ধে যা-তা বলছে। তারপর একটা স্টেশনে গাড়ি থেমেছে, স্বামীজী স্টেশন মাস্টারের কাছে ইংরেজিতে এক গ্লাস জল চেয়েছেন। এরা তো অবাক—আরে এ তো ইংরেজি জানে! স্বামীজীকে জিজ্ঞেস করছে : একটু আগে আমরা যেসব কথাবার্তা বলছিলাম তুমি সেগুলো শুনেছ নাকি? স্বামীজী বললেন : শুনেছি বৈকি।—কিন্তু তুমি তো আমাদের কিছু বললে না? স্বামীজী বলছেন: আহাম্মকেরা কত কী-ই’তো বলে—তাদের সব কথার কি প্রতিবাদ করতে আছে? এই হচ্ছে অ-প্রতিকার। স্বামীজী অবশ্য অনেক জায়গায় ফোঁস করেছেনও। বিদেশ থেকে ফিরছেন। তখন একজন মিশনারী তাঁর সামনেই হিন্দু আর হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে যা-নয়-তাই বলে যাচ্ছেন। স্বামীজী অনেকক্ষণ সহ্য করলেন, শেষে আর পারলেন না। উঠে গিয়ে ঐ মিশনারীর কলার চেপে ধরে শান্তভাবে বললেন : আমার ধর্মের বিরুদ্ধে আর একটা কথাও যদি বল তো তোমাকে জাহাজ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেব। তখন সেই মিশনারীটি খুব ভয় পেয়ে গেছেন—স্বামীজীর যা চেহারা সত্যিই তিনি তাঁকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ক্ষমা চাইলেন স্বামীজীর কাছে। স্বামীজীর সামনে আর তিনি ঐ ভুল করেননি। অর্থাৎ সাধু যদি সমাজে থাকে—সমাজে নানারকম লোক রয়েছে, আদর্শের মর্যাদা রক্ষার জন্য মাঝে মাঝে সাধুকেও সেখানে ফোঁস করতে হতে পারে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যে, সে শুধু আদর্শের জন্যে। যে অন্যায় একান্তভাবে শুধু তাঁরই উপর, সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাধু কোন প্রতিবাদ করবেন না বা প্রতিকার করার চেষ্টা করবেন না। মুখ বুজে তা সহ্য করবেন। এই হচ্ছে ব্ৰহ্মজ্ঞ সন্ন্যাসীর ধর্ম। এই যে ক্ষমা, অহিংসা বা অপ্রতিকার এটা কিন্তু সন্ন্যাসীর দুর্বলতার পরিচয় নয়, কেউ যেন তা মনে না করেন। এই গুণগুলি তাঁর শক্তির পরিচয়। ইচ্ছে করলে তিনি হিংসা অবলম্বন করতে পারেন, ইচ্ছে করলে তিনি তাঁর প্রতিপক্ষকে চুর্ণ-বিচূর্ণ করতে পারেন। কিন্তু তবুও তিনি ক্ষমা করছেন। এখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। কিন্তু আসলে তিনি এই জগতে কারও অপেক্ষা রাখেন না। ‘নির্গচ্ছতি জগজ্জালাৎ পিঞ্জরাদিব কেশরী’। পিঞ্জরমুক্ত সিংহ যেমন, সেরকম তিনি। জগজ্জাল ছিন্ন করে তিনি বেরিয়ে পড়েছেন। মহাবিক্রমে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন সংসারে। কারও কাছে তিনি মাথা নত করেন না। তিনি মাথা নত করেন শুধু আদর্শের কাছে, সত্যের কাছে—ঈশ্বরের কাছে। হতে পারি আমি নিঃস্ব—কিন্তু কারও থেকে আমি হীন নই, কারও কাছে কোন কিছুর প্রার্থী নই। তাঁর চালচলন হাবভাবে এমন একটা তেজ, এমন একটা আভিজাত্য ফুটে ওঠে যে, সবাই তাঁকে সমীহ করে চলে। স্বামীজীকে যেমন দেখি পরিব্রাজক জীবনে কত কষ্ট সহ্য করছেন, কত অযত্ন হচ্ছে শরীরের— তবুও যে কেউ তাঁকে দেখছে আকৃষ্ট না হয়ে পারছে না। অপরিচিত সন্ন্যাসী— কিন্তু যেখানে যাচ্ছেন সেখানেই সাধারণ লোক, বড় বড় লোেক সবাই তাঁর দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন। স্বামী ব্রহ্মানন্দ একটা জায়গায় স্টেশনে বসে আছেন—পোশাক-পরিচ্ছদে বিশেষ কিছুই অসাধারণত্ব নেই। একটি ছেলে আর একটি ছেলেকে জিজ্ঞেস করছে : ইনি কে বলতো? সেই ছেলেটি বলছে : আমি ঠিক জানি না কে। তবে মনে হয় কোন জায়গার রাজা-টাজা হবেন। এই আভিজাত্য ফুটে ওঠে সন্ন্যাসীর সর্বাঙ্গে। তাঁর চালচলন আচার-আচরণে একটা স্বাতন্ত্র্য ফুটে ওঠে। প্রকৃত সন্ন্যাসীকে অন্য দশজনের সঙ্গে কিছুতেই এক করে ফেলা যায় না।

সন্ন্যাসীর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য যে, সর্বভূতে তাঁদের প্রেম। যা কিছু করেন তাঁরা—পরার্থে। সবসময় তাঁরা অপরের কল্যাণ করে চলেছেন। নিজেদেরও অজ্ঞাতসারে অন্যের মঙ্গল করে চলেছেন তাঁরা। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস যেমন স্বভাব আমার—আমি জানিই না যে আমি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছি—এও ঠিক তেমনি। অপরের প্রতি করুণা, অপরের প্রতি ভালবাসা—এগুলি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেছে তাঁর কাছে। কেউ যদি তাঁকে আঘাতও করে, তবুও তিনি তাকে ভাল না বেসে পারেন না। একজন সাধু দেখছেন যে নদীর জলে একটা বিছে ভেসে যাচ্ছে। বিছেটাকে হাত দিয়ে তিনি তুললেন, কিন্তু বিছেটা তাঁর হাতে কামড়ে দিয়ে জলে পড়ে গেল। আবার তিনি বিছেটাকে তুললেন—আবার কামড়াল। বারবার এরকম বিছেটাকে জল থেকে তুলছেন আর বিছেটাও তাঁর হাতে কামড়ে দিয়ে জলে পড়ে যাচ্ছে। তখন আর একজন ঐ সাধুকে বলছেন : কেন যাচ্ছেন ওটাকে বাঁচাতে? ছেড়ে দিন না। মরুক ও জলে পড়ে। তখন সেই সাধু বলছেন : বিছের ধর্ম কামড়ানো—সে তা-ই করছে। আমার ধর্ম তাকে রক্ষা করা—আমাকে তা করতে দাও। এই বলে তিনি বিছেটিকে জল থেকে তুলে ডাঙায় অনেক দূরে ফেলে দিলেন, যাতে তার কোনমতে সে জলে এসে পড়তে না পারে।—এই হচ্ছে প্রকৃত সাধুর ধর্ম। আর একজন সাধুর গল্প আছে। তাঁকে একজন এমন মেরেছে যে, তিনি অজ্ঞান হয়ে গেছেন। তাঁকে তখন ধরাধরি করে আশ্রমে আনা হয়েছে। তাঁর যখন জ্ঞান ফিরেছে, তখন তাঁকে দুধ খাওয়ানো হচ্ছে, আর একজন সাধু তাঁকে জিজ্ঞাসা করছেন : আচ্ছা বল তো, কে তোমাকে মেরেছে? সেই সাধু তখন উত্তর দিচ্ছেন : এখন যিনি আমায় দুধ খাওয়াচ্ছেন, তিনিই তখন আমায় মেরেছিলেন। অর্থাৎ সবার মধ্যে আমি আমার ইষ্টকে দেখছি। ভাল-মন্দ, পাপী-পুণ্যবান—সবার মধ্যে। তাই যে আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করল আর যে আমাকে শুশ্রূষা করে বাঁচাল এদের মধ্যে কোন তফাত দেখছি না আমি। দুজনকেই আমি সমান ভালবাসছি। বুদ্ধদেব বলছেন :১০ ‘মাতা যথা নিয়ং পুত্তং আয়ুসা একপুত্তমনুরক্ষে এবম অপি সব্বভূতেসু মানসম্ভাবয়ে অপরিমাণম্‌’—জীবের প্রতি ভালবাসাটা কেমন হবে? মার যেমন পুত্রের প্রতি ভালবাসা। মা তাঁর একমাত্র পুত্রকে নিজের আয়ু দিয়েও রক্ষা করে। চেষ্টা করে ভালবাসতে হয় না তাকে। মায়ের ভালবাসা স্বতোৎসারিত হচ্ছে ছেলের জন্য। সন্ন্যাসীও ঠিক সেইভাবে সকল প্রাণীকে ভালবাসেন। বুদ্ধদেবই আর এক জায়গায় বলছেন : ভিক্ষু কে? সন্ন্যাসী কে? ‘সেই ভিক্ষু প্রেম যার জীবনের সার।’

শঙ্করাচার্য বলছেন :১১ ‘শান্তা মহান্তো নিবসন্তি সন্তো বসন্তবল্লোকহিতং চরন্তঃ’—বসন্তকাল যখন আসে তখন প্রকৃতি শান্তিতে আনন্দে ভরে ওঠে। বসন্ত হচ্ছে সবচেয়ে মধুর ঋতু। সাধুরা সংসারে থেকে বসন্ত ঋতুর মতো লোকের কল্যাণ করে চলেন। তাঁরা যেখানে থাকেন সেখানেই একটা আনন্দের পরিমণ্ডল সৃষ্টি হয়। ঠাকুর বলছেন : সাধুসঙ্গে শান্তি হয়। (৫-১৫-৩) লোকে শান্তি পায় তাঁদের সংস্পর্শে এসে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : আমি সাবু খেয়েও লোকের কল্যাণ করব। শ্রীশ্রীমাকে বলছেন : আমি একাই সব করব? তুমি কিছু করবে না? কলকাতার লোক সব পোকার মতো কিলবিল করছে, তুমি তাদের দেখো।—মর্ত্যলীলা শেষ হয়ে আসছে তাঁর, সেই সময় বলছেন এই কথা। যেন মানুষের দুঃখ দেখে তিনি নিশ্চিন্ত মনে বিদায়ও নিতে পারছেন না। যাওয়ার আগে তাদের ভার যোগ্য হাতে অর্পণ করে যেতে চাইছেন। স্বামীজী তাঁর সম্বন্ধে বলছেন : ‘আচণ্ডালাপ্রতিহতরয়ো যস্য প্রেমপ্রবাহঃ’—যাঁর প্রেমের স্রোত চণ্ডাল পর্যন্ত অপ্রতিহতবেগে প্রবাহিত। সকলের প্রতি শ্রীরামকৃষ্ণের প্রেম। নদীর ধারার মতো অপ্রতিহত গতিতে তা বয়ে চলেছে। চণ্ডাল পর্যন্ত তাঁর প্রেম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না। সবচেয়ে যে দীন, সবচেয়ে যে ক্ষুদ্র তার প্রতিও তাঁর প্রেম। স্বামীজী (তখন নরেন্দ্রনাথ) যখন নির্বিকল্প সমাধি চেয়েছিলেন তাঁর কাছে, শ্রীরামকৃষ্ণ তিরস্কার করেছিলেন : ছি ছি ছি, এত হীনবুদ্ধি তুই! শুধু নিজের মুক্তি চাস? কোথায় তুই বিরাট বটগাছের মতো হবি, সবাইকে শান্তি দিবি, আনন্দ দিবি, তা নয় তুই শুধু নিজের কথা ভাবছিস? ছি ছি! পরে দেখছি, সেই স্বামীজীই আমেরিকা যাবার আগে তুরীয়ানন্দজীকে বলছেন : হরি ভাই, আমি তোমাদের ধর্ম-টর্ম কিছু বুঝি না। তবে এই দেখছি যে আমার হৃদয়টা খুব বড় হয়ে গেছে ; আর অন্যের দুঃখে দুঃখবোধ করতে শিখেছি আমি। মহাপুরুষ মহারাজের কাছে কেউ আশীর্বাদ চেয়েছে, মহাপুরুষ মহারাজ বলছেন : always flowing, always flowing—সবসময় বয়ে চলেছে আশীর্বাদ—বাতাসের মতো। আশীর্বাদ ছাড়া আমাদের আর কিছু নেই। ‘সৰ্ব্বে ভবন্তু সুখিনঃ সর্ব্বে সন্তু নিরাময়াঃ সর্ব্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু মা কশ্চিৎ দুঃখভাক্‌ ভবেৎ’—সকলে সুখী হোক, সকলের সমস্ত আধি, ব্যাধি, মলিনতা দূর হয়ে যাক, সকলের কল্যাণ হোক—কোন দুঃখ যেন কখনও কেউ না পায়। আর একটা শ্লোক স্বামী অখণ্ডানন্দ খুব বলতেন। তিনি রাজস্থানে গেছিলেন, সেখানে ‘ভটজী’ নামে এক পণ্ডিতের কাছে তিনি এটা শুনেছিলেন। শ্লোকটা হচ্ছে : ‘ন ত্বহং কাময়ে রাজ্যং ন স্বর্গং নাপুনর্ভবম্‌ কাময়ে দুঃখতপ্তানাং প্রাণিনামার্তিনাশনম্‌’—আমি রাজ্য চাই না, স্বর্গও চাই না—এমনকি মুক্তি পর্যন্ত চাই না আমি। যারা দুঃখে পড়ে আছে, কষ্ট পাচ্ছে—তাদের আর্তি যেন আমি দূর করতে পারি। এই একমাত্র কামনা আমার। অখণ্ডানন্দজী বলতেন :১২ আমার প্রভু গিরিশৃঙ্গে নেই, আকাশেও নেই—সর্বজীবে আমার প্রভু। সেই সর্বজীবরূপী ভগবানের সেবায় এ জীবন দিয়েছি, আরও কত জীবন যে দিতে হবে জানি না।

রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের মূল দৃষ্টিভঙ্গি এ-ই। স্বামীজী যে শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করলেন—অনেক দিক দিয়ে এই সন্ন্যাসী সঙ্ঘ অভিনব। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, এ কি ধরনের সন্ন্যাসী এঁরা—গাছতলায় থাকবার কথা, বাড়ি-ঘরদোর বানিয়ে দিব্যি আছে। ভিক্ষা করবার কথা—অথচ ভিক্ষে তো করছে না। আপাতদৃষ্টিতে অন্যান্য সাধু-সম্প্রদায়ের সঙ্গে একটু তফাৎ আছে বটে—কিন্তু মূল বিষয়ে কোন তফাৎ নেই। রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সাধুরাও ঈশ্বরের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করে এসেছেন। তবে গিরি-গুহায় বসে থাকেননি তাঁরা। একটা পরিবারের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে তাঁরা একটা বিরাট পরিবার গড়ে তুলেছেন। সমস্ত জগৎটাই তাঁদের কাছে পরিবার। শুধু বাংলা নয় বা ভারতবর্ষ নয়। রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের শাখা প্রশাখা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। এখানেও মূল হচ্ছে ত্যাগ, পবিত্রতা, ঈশ্বরনির্ভরতা। ত্যাগ জিনিসটা তো বাইরের নয়—মনের ত্যাগ। আসল ত্যাগ হচ্ছে ‘এষণা’ ত্যাগ। তিনটে মূল ‘এষণা’ আছে। পুত্রৈষণা, বিত্তৈষণা আর লোকৈষণা। ‘পুত্ৰৈষণা’ অর্থাৎ পুত্র হবে এই বাসনা। ‘বিত্তৈষণা’ অর্থাৎ ধনসম্পদের বাসনা। ‘লোকৈষণা’ অর্থাৎ লোকমান্য হবে এই বাসনা। এই তিনটে ‘এষণা’ ত্যাগ করেন রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সাধুরা। তাঁদের যা কিছু ‘এষণা’ সব ঈশ্বর-কেন্দ্রিক। স্বামীজী রামকৃষ্ণ মঠ-মিশন প্রতিষ্ঠা করে বলেছিলেন এর আদর্শ : ‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ।’ নিজের মুক্তি এবং সঙ্গে সঙ্গে জগতের কল্যাণ। একবার এক সন্ন্যাসী-শিষ্যকে বলেছিলেন : দ্যাখ, যদি নিজের মুক্তি চাস তাহলে নরকে যাবি, আর যদি অপরের কল্যাণার্থে কাজ করিস, তাহলে মুক্তি তোর হাতের মুঠোয়। সাধুরা জগদ্ধিতায় জীবন দেবেন। আর এই জগৎকে তাঁরা কি চোখে দেখছেন? জগৎ তাঁদের কাছে ঈশ্বরের মন্দির। জগতের যত প্রাণী, যত জীব—জীব নয়, শিব। রামকৃষ্ণ মিশনের মূলমন্ত্র হল জীবকে শিবজ্ঞানে দেখা। শ্রীরামকৃষ্ণই এই মন্ত্র দিয়ে গেছিলেন, স্বামীজী শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের মাধ্যমে এই মন্ত্র বাস্তবে রূপায়িত করলেন। মন্দিরে রয়েছেন বিগ্রহ। কিন্তু সেই বিগ্রহের ব্যাপক রূপ, আরও বিরাট রূপ, আরও প্রত্যক্ষ রূপ ছড়িয়ে রয়েছে মন্দিরের বাইরে। নানা রূপে, নানা মূর্তিতে, নানা নাম নিয়ে সেই বিগ্রহ আমার সামনে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছেন। সেই বিগ্রহ কখনও দরিদ্ররূপে কখনও রোগীর রূপ ধরে, কখনও বা ধর্মপিপাসুরূপে আমার সামনে উপস্থিত। মন্দিরে যে বিগ্রহ তিনি আমার পুজো নেন কিনা আমি বুঝতে পারি না। নিশ্চয়ই নেন—কিন্তু আমি তা বুঝতে পারি না। কিন্তু এই যে সচল বিগ্রহ বহুরূপে আমার সম্মুখে, এই বিগ্রহ আমার সেবা নিচ্ছেন, বুঝতে পারি আমি। আমি যদি কোন দরিদ্রকে অন্ন বস্ত্র বা অন্য কিছু দিয়ে সেবা করি—তাহলে সে খুশি হচ্ছে কিনা তখনই বুঝতে পারি। তার মুখে তৃপ্তির ছাপ ফুটে ওঠে—সে আমাকে কৃতজ্ঞতা জানায়। এ যেন দেবতা আমার সেবায় তুষ্ট হয়ে আমাকে বর দিচ্ছেন অনুগ্রহ করে—আমি সাক্ষাৎ দেখতে পাচ্ছি তা। স্বামীজী বলছেন : এই জীবন্ত দেবতা ছেড়ে দিয়ে আর কোন্ পাষাণ-প্রতিমাকে তুমি পুজো করবে? গঙ্গার তীরে বসে তুমি কূপ খনন করতে চাও?—রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের সাধুরা যা কিছু করছেন সব এই বিরাট দেবতার উদ্দেশে, নররূপী নারায়ণের উদ্দেশে, জীবরূপী শিবের উদ্দেশে। তাঁরা হাসপাতাল দেখাশুনা করছেন, দুর্ভিক্ষ বা বন্যায় ত্রাণের কাজ করছেন, ছাত্র পড়াচ্ছেন, বক্তৃতা করছেন—সবকিছু তাঁরা করছেন ঐ বুদ্ধিতে, শিবজ্ঞানে জীবসেবার ভাব নিয়ে। কোন কাজই তাঁদের কাছে আর কাজ নয়—পূজা। যেহেতু পূজা, সেহেতু সব কাজেই তাঁদের গভীর নিষ্ঠা। সাধুরা যে টাকা-পয়সার হিসেব রাখেন—একটি পয়সার হিসেব পর্যন্ত নিখুঁতভাবে রাখেন তাঁরা। দেখে মনে হবে, এঁদের তো সংসারীদের চেয়ে টাকা-পয়সার প্রতি বেশী টান। কিন্তু তা নয়। সাধুর কাছে সব কাজ পূজা। টাকা-পয়সা ঠাকুরের। কাজেই, একটা পয়সা যাতে এদিক-ওদিক না হয়, আমি দেখব। একবার আমাদের এক সাধু হিসেবে ভুল করে ফেলেছেন—প্রায় কয়েক শ টাকা কম হচ্ছে। কিছুতেই হিসেব মিলল না। সেই সাধু একেবারে কেঁদে ফেললেন। কোথা থেকে পাবেন এই টাকা? তাঁর নিজের তো এক পয়সাও নেই। শেষে এর কাছ থেকে তার কাছ থেকে ভিক্ষে করে তিনি সেই কয়েক শ টাকা শোধ দিলেন। পরে অবশ্য ভুলটা বের হল—একটা টাকার অঙ্ক দুবার লেখা হয়ে গেছিল। এই যে নিষ্ঠা, এই যে সতর্কতা, হিসেব না মেলাতে পারার ফলে এই যে অশান্তি—এ কোনটাই তো সাধুর নিজের জন্য নয়। সবই ঈশ্বরের জন্য। এর থেকে বড় তপস্যা আর কি হতে পারে? তপস্যা তো আর শুধু শরীরের নয়, তপস্যা হচ্ছে মনের। ঈশ্বরের জন্য যা কিছু করা হয়, তা-ই তপস্যা। আগেকার দিনে সাধু-সন্ন্যাসীরা বনে-জঙ্গলে গিরি-গুহায় গিয়ে যে তপস্যা করতেন সমাজের মধ্যে বাস করে মিশনের সাধুরা সেই তপস্যা করেন। সাধু হয়েও তাঁরা অফিসে অফিসে ঘুরছেন সঙ্ঘের কাজের জন্য। কোর্টে যাচ্ছেন। মামলা-মকদ্দমা পর্যন্ত করছেন সাধুরা—নিষ্ঠুরভাবেই করছেন। মনে হতে পারে : সাধুরা কেন মামলা করবে? তাদের তো ক্ষমাধর্ম, মামলা না করে বিপক্ষের দাবি মেনে নিলেই তো পারে। কিন্তু আমাদের ভাব হচ্ছে : ঠাকুরের সম্পত্তি, ঠাকুরের জিনিস—অন্যায়ভাবে কেউ এ কেড়ে নিতে পারবে না। একে রক্ষা করার জন্য শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করব। তার পরেও যদি মামলায় হার হয়, তাহলে বুঝব ঠাকুরের ইচ্ছাতেই তা হয়েছে। দুঃখ করব না তার জন্য। আমি একবার একজনের সাথে এক অফিসে দেখা করতে গেছি। আমার পূর্বাশ্রমের বন্ধু সে। আমার হাতে একটা পোর্টফোলিও ব্যাগ, তাই দেখে সে ঠাট্টা করে বলছে : সাধু হয়েছ, কোথায় তোমার হাতে কমণ্ডলু থাকবে—তা না পোর্টফোলিও ব্যাগ নিয়ে ঢুকলে? আমি বললাম : আমার হাতে যদি কমণ্ডলু থাকত তাহলে তোমার ঐ দারোয়ান আর আমাকে ঢুকতে দিত না—ঐ দরজার কাছেই আটকে দিত। আর কমণ্ডলুর কথা বলছ? এই পোর্টফোলিও ব্যাগই আমার কমণ্ডলু। এর মধ্যে আমার নিজের কোন কাগজপত্র নেই। আমি যে আশ্রমে আছি সেখানকারই কাগজপত্র আছে এর মধ্যে। এই ব্যাগ আমার কাছে কমণ্ডলুর সমান পবিত্র।

বাস্তবিক যে কাজই সাধুরা করুন না কেন, সব কাজ সমান পবিত্র। কারণ, সব কাজই ঈশ্বরের উদ্দেশে। আর এই কাজের মাধ্যমেই সাধুদের কর্মবন্ধন কেটে যাচ্ছে। শ্রীরামকৃষ্ণের একটা কথা আছে যে, কেউ যদি তিনদিন ঈশ্বরের জন্য কাঁদতে পারে, তাহলে ঈশ্বর তাকে দেখা দেবেন। স্বামী তুরীয়ানন্দ ঠিক একই রকম কথা বলছেন :১৩ কেউ যদি ঠিক ঠিক নারায়ণজ্ঞানে তিনদিনও অপরের সেবা করতে পারে, তাহলে তিনদিনেই সে সিদ্ধ হয়ে যাবে। কী বিরাট কথা! রামকৃষ্ণ মঠের সাধুদের আর একটা জিনিস লক্ষণীয় যে, তাঁরা ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে ততটা গুরুত্ব দেন না। সঙ্ঘের ইচ্ছাই তাঁদের কাছে ঠাকুরের ইচ্ছা। কেউ হয়তো একটা বড় আশ্রমের পরিচালনার ভার নিয়ে আছেন। অনেকদিন ধরে আছেন। সেখানকার সবাই তাঁকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে। হয়তো মঠ থেকে একটা নির্দেশ এল : তোমাকে অন্য জায়গায় যেতে হবে। তৎক্ষণাৎ তিনি সেই আশ্রম ছেড়ে চলে যাবেন, খুশি মনেই যাবেন। আর যখন যাবেন তখন নিজের নিত্যব্যবহার্য যেসব জিনিস, জামাকাপড় বা দু-একটা বই, সেগুলিই শুধু তিনি নিয়ে যাবেন, আর কিছু নিয়ে যাবেন না। হয়তো যে নতুন কেন্দ্রে তিনি গেলেন সেখানে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য যেখানে তিনি আগে ছিলেন তার চেয়ে কম, হয়তো আগে যে আশ্রমে ছিলেন সেখানে তিনিই ছিলেন অধ্যক্ষ, আর এখানে হয়তো তিনি সাধারণ একজন কর্মী—কিন্তু এসব নিয়ে তিনি মাথা ঘামাবেন না। ঠাকুর যেখানে যে অবস্থায় আমার সেবা চাইছেন, সেখানেই যাব আমি, সেভাবেই তাঁর সেবা করব—এই তাঁর ভাব। সত্যিই এ এক নতুন ধরনের সাধু-সম্প্রদায়। এতদিন যাঁরা সাধু হতেন, তাঁরা সমাজ থেকে দূরে চলে যেতেন। তাঁদের চিন্তা, তাঁদের অবদান থেকে সমাজ বঞ্চিত থাকত। তার ফলে এই হয়েছিল যে, ভারতের যেসব উচ্চতম আধ্যাত্মিক চিন্তা তা সাধারণের মধ্যে ততটা প্রসারলাভ করেনি। শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সন্ন্যাসীরা সমাজেই থাকছেন। সকলের চোখের সামনেই রয়েছেন তাঁরা। সকলের নাগালের মধ্যে। বনের বেদান্তকে তাঁরা লোকালয়ে বসেই আচরণ করছেন এবং মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ঠাকুরের অন্তর্ধানের পর শ্রীশ্রীমা কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করেছিলেন : ঠাকুর, তুমি এলে আর চলে গেলে, তাতেই কি সব শেষ হয়ে গেল? তাহলে আর এত কষ্ট করে আসবার কি দরকার ছিল তোমার? আমার ইচ্ছে করে, এরা সব একত্রে তোমার ভাব আর চিন্তা নিয়ে থাকবে, আর সংসারী লোকেরা এখানে এসে তোমার কথা শুনে শান্তি পাবে। শ্রীশ্রীমায়ের সেই প্রার্থনা পূর্ণ হয়েছিল। ঠাকুরের ত্যাগী-সন্তানদের নিয়ে একটা সঙ্ঘ তখনই গড়ে উঠেছিল। ছোট অথচ প্রচণ্ড শক্তিধর। আজ সেই সঙঘ একটা বিরাট মহীরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চারদিকে সে তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে দিয়েছে। আর হাজার হাজার নরনারী তার ছায়ায় এসে শান্তি পাচ্ছে, নবজীবন লাভ করছে—ভারতের শাশ্বত বাণী শুনে ধন্য হয়ে যাচ্ছে।

আকর-তালিকা

 । কুলার্ণবতন্ত্র, ১/৫৬

 । গরুড়পুরাণ, উত্তরখণ্ড, ৭/১১১

 । রামচরিতমানস, সুন্দরকাণ্ড, ৪

 । মোহমুদ্গর, ৫

 । Lycidas, Milton

 । মহানির্বাণতন্ত্র, ৮/২৭৭

 । গীতা, ৪/২২

 । ভাগবত, ১১/৮/১১

 । কৈবল্যোপনিষদ্‌, ২

১০। সূত্তনিপাত, উরগবগ্‌গ, মেত্তাসুত্ত (উদ্ধৃত : বুদ্ধদেব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৩৬৩, পৃঃ ৫০)

১১। বিবেকচূড়ামণি, ৩৭

১২। প্রমদাদাস মিত্রকে লেখা পত্র, ১০/১/১৮৯৯ (‘স্বামী অখণ্ডানন্দ’, স্বামী অন্নদানন্দ)

১৩। Spiritual Talks, 1955, p. 281

* স্বামী আত্মানন্দের পূর্বাশ্রমের নাম শুকুল। বয়োজ্যেষ্ঠ সন্ন্যাসীরা তাঁকে ঐ নামেই ডাকতেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *