সাধুতার পুরস্কার

সাধুতার পুরস্কার

 পারিস নগরে এক ব্যক্তি অতি দরিদ্র ছিলেন। তিনি বহু কষ্টে দিনপাত করিতেন। সুজেট্‌ নামে এক তরুণী ভ্রাতৃতনয়া ব্যতিরিক্ত তাঁহার কেহই ছিল না। এই ভ্রাতৃকন্যা অতি সুশীলা ও সচ্চরিত্রা ছিল এবং আপন পিতৃব্যকে অত্যন্ত স্নেহ ও ভক্তি করিত। নিতান্ত অসঙ্গতি প্রযুক্ত পিতৃব্য তাহার ভরণপোষণ করিতে পারিতেন না, সে, এক গৃহস্থের বাটীতে দাসীবৃত্তি করিয়া, জীবিকা-নির্ব্বাহ করিত, এবং বেতন স্বরূপ যৎকিঞ্চিৎ যাহা পাইত, তদ্দ্বারা পিতৃব্যের আনুকূল্য করিত।

 কিছুদিন পরে, ঐ কন্যার বিবাহের সম্বন্ধ স্থির ও দিন অবধারিত হইল। সমুদয় আয়োজন হইতেছে, দুই তিন দিবসের মধ্যে বিবাহ হইবে, এমন সময়ে, সহসা তাহার পিতৃব্যের মৃত্যু হইল। তাঁহার এমন সঙ্গতি ছিল না যে, অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার ব্যয় নির্ব্বাহ হয়। তখন সেই কন্যা বরকে কহিল, দেখ, আমার পিতৃব্যের মৃত্যু হইয়াছে, তাঁহার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া নির্ব্বাহের কোনও উপায় নাই, আমি বৈবাহিক পরিচ্ছদ ক্রয়ের নিমিত্ত যাহা সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছি, তদ্ব্যতিরিক্ত আমার হস্তে এক কপর্দ্দকও নাই, এক্ষণে তদ্দ্বারা তাঁহার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন করি, পরে, পুনরায় সঞ্চয় করিয়া, পরিচ্ছদ ক্রয় করিব, আপাততঃ কিছুদিনের জন্য আমাদের বিবাহ স্থগিত থাকুক।

 সুজেট্‌ যে বাটীতে কর্ম্ম করিত, ঐ বাটীর কর্ত্রী তাহার প্রস্তাব শুনিয়া, উপহাস করিতে লাগিলেন, এবং কহিলেন, তোমার পিতৃব্যের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া যেরূপে সম্পন্ন হয় হউক, সে অনুরোধে, উপস্থিত বিবাহ স্থগিত রাখা কোনও মতেই উচিত নহে। অতএব, আমার পরামর্শ এই, অবধারিত দিবসে বিবাহ সম্পন্ন হইয়া যাউক। সুজেট্‌ তাঁহার পরামর্শ শুনিল না, কহিল, যথাবিধানে পিতৃব্যের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া না করিয়া, আমি কদাচ বিবাহ করিব না, যদি করি, তাহা হইলে, আমার মত পাপীয়সী আর কেহ নাই। আর, যদি এ জন্য আমার বিবাহ না হয়, আমি তাহাতেও দুঃখিত নহি।

 এই উপলক্ষে বিলক্ষণ বিবাদ উপস্থিত হইল। গৃহস্বামিনী ও বর উভয়ে, নির্দ্ধারিত দিবসে বিবাহ হওয়া আবশ্যক বলিয়া পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন, সুজেট্‌ কোনও ক্রমে সম্মত হইল না। অবশেষে গৃহস্বামিনী, কুপিত হইয়া তাহাকে তাড়াইয়া দিলেন, এবং বরও, আর আমি তোমায় বিবাহ করিব না বলিয়া, সম্বন্ধ ভাঙ্গিয়া দিল। সুজেট্‌ তাহাতে কিছুমাত্র দুঃখিত বা উৎকণ্ঠিত না হইয়া, তৎক্ষণাৎ তথা হইতে প্রস্থান করিল, এবং পিতৃব্যের আলয়ে উপস্থিত হইয়া, অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার আয়োজন করিতে লাগিল।

 যথাবিধানে অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন করিয়া সুজেট্‌ বিরলে বসিয়া, পিতৃব্যের শোকে বিলাপ ও পরিতাপ করিতেছে, এমন সময়ে, এক সুশ্রী সুবেশ যুবা পুরুষ সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। ইনি, বহুদিন অবধি, সুজেট্‌কে জানিতেন, তাহার কর্ম্মচ্যুত হওয়ার ও সম্বন্ধ ভাঙ্গিয়া যাওয়ার কারণ অবগত হইয়াছিলেন। ইনি বিলক্ষণ সঙ্গতিপন্ন, এ পর্য্যন্ত বিবাহ করেন নাই, এক্ষণে সুজেট্‌কে বিবাহ করিবেন, স্থির করিয়া তাহাকে আপন আলয়ে লইয়া যাইতে আসিয়াছিলেন।

 সুজেট্‌ এই ব্যক্তিকে সুশীল, সচ্চরিত্র ও বিলক্ষণ সঙ্গতিপন্ন লোক বলিয়া জানিত, ইহাকে সহসা উপস্থিত দেখিয়া, শোক সংবরণ পূর্ব্বক, উঠিয়া দাঁড়াইল। ঐ ব্যক্তি ঈষৎ হাস্য করিয়া সাদর বচনে কহিলেন, সুজেট্‌। শুনিলাম, তুমি কর্ম্মচ্যুত হইয়াছ, এবং বিবাহের সম্বন্ধও ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। যদি তোমার আপত্তি না থাকে, আমি তোমার পাণিগ্রহণে প্রস্তুত আছি। সুজেট্‌ শুনিয়া, সঙ্কুচিত হইয়া কহিল, মহাশয়। আপনি বড় লোক, আমি অতি দীন, আপনি আমায় বিবাহ করিবেন, ইহা কখনও সম্ভব নহে। আপনি পরিহাস করিতেছেন, আমার এই শোকের ও দুঃখের সময়, এরূপে পরিহাস করা উচিত নয়।

 এই কথা শুনিয়া, সেই যুবক কহিলেন, অয়ি সুশীলে। ধর্ম্মপ্রমাণ কহিতেছি, তোমায় পরিহাস করিতেছি না, আমি এত নির্ব্বোধ, নিষ্ঠুর ও অধম নহি যে, তোমার মত গুণবতী মহিলার শোকে ও দুঃখে দুঃখিত না হইয়া, পরিহাস করিব, তুমি এক মুহূর্ত্তের জন্যও সে আশঙ্কা করিও না। তুমি জান, আমার বিবাহ হয় নাই, এক্ষণে আমার বিবাহ করা স্থির হইয়াছে, বিবাহ করিতে হইলে, তোমার মত সর্ব্বগুণসম্পন্না কামিনী কোথায় পাইব?

 এই সকল কথা শুনিয়া, সুজেট্‌ কহিল, না মহাশয়। আপনি যাহা কহিলেন, ইহা শুনিয়া আর আমি পরিহাস বোধ করিতেছি না। আপনি আমায় বিবাহ করিলে, আমার সৌভাগ্যের বিষয়, সন্দেহ নাই। কিন্তু সকল লোকে আপনাকে অবজ্ঞা ও উপহাস করিবে, আপনার পক্ষে আমায় বিবাহ করা পরামর্শসিদ্ধ নহে। তখন, তিনি হাস্যমুখে কহিলেন, যদি কেবল এই তোমার আপত্তি হয়, সে জন্য ভাবনা করিতে হইবে না। এক্ষণে উঠ, আর এখানে কাল হরণ করিবার প্রয়োজন নাই, আমার জননী তোমার অপেক্ষায় বসিয়া রহিয়াছেন।

 সুজেটের পিতৃব্য একটি বিড়ালকে অত্যন্ত ভাল বাসিতেন। ঐ বিড়াল মরিয়া গেলে পর, উহার চর্ম্ম লইয়া, তিনি বিড়ালের আকৃতি নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন। ঐ আকৃতি তাঁহার শয্যার শিখরদেশে স্থাপিত থাকিত। প্রস্থানকালে সুজেট্‌ কহিল, দেখ, আমি পিতৃব্যকে অত্যন্ত ভাল বাসিতাম, তাঁহার স্মরণার্থে এই আকৃতিটি লইয়া যাইব। এই বলিয়া উঠাইতে গিয়া, উহার অসম্ভব ভার দর্শনে, সে চমৎকৃত হইল। তখন সেই যুবক, কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া, তাদৃশ ভারের কারণ নির্ণয় করিবার নিমিত্ত, বিড়ালের চর্ম্ম ছেদন করিবা মাত্র, স্বর্ণমুদ্রা বৃষ্টি হইতে লাগিল। সুজেটের পিতৃব্য অত্যন্ত কৃপণ ছিলেন, আহারাদির ক্লেশ স্বীকার করিয়াও, সহস্র লুইডোর[১] সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছিলেন। এক্ষণে, তাঁহার সঞ্চিত বিত্ত তদীয় সুশীলা ভ্রাতৃতনয়ার নিরুপম গুণের পুরস্কার হইল।

***

১. ফরাসিদেশে প্রচলিত স্বর্ণমুদ্রা, মূল্য ২০\টাকা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *