সাধনা
ঠাকুর আমাদের কাছে আটটি জিনিস চেয়েছেন—(১) সাধনা, (২) একটু লজ্জা, (৩) সচ্চিদানন্দে প্রেম, (৪) মৃত্যু-স্মরণ, (৫) বিশ্বাস, (৬) সতর্কতা, (৭) ব্যাকুলতা, (৮) অনুধ্যান। আমরা একটি কাগজে এই নির্দেশগুলি লিখে যত্রতত্র টাঙিয়ে রাখতে পারি। আমরা জ্ঞানের কথা শুনি। এ-কান দিয়ে ঢুকিয়ে ও-কান দিয়ে বের করে দিই। পায়রার গলায় মটরের দানার মতো বিষয়-চিন্তা গজগজ করে।
ঠাকুর বলছেন : “পায়রার ছানার গলায় হাত দিলে যেমন মটর গজগজ করে, সেইরকম বদ্ধ জীবের সঙ্গে কথা কইলে টের পাওয়া যায়, বিষয়-বাসনা তাদের ভিতর গজগজ করছে। বিষয়ই তাদের ভাল লাগে, ধর্মকথা ভাল লাগে না।”
এই ভাল লাগানোটাই সাধনা। যেমন তুলসীদাস বলছেন—
“এক ঘড়ি আধি ঘড়ি, আধি হুমে আধ।
তুলসী সঙ্গত সন্তকি, হরে কোটি অপরাধ।।”
–এক ঘণ্টা, আধ ঘণ্টা এমনকি আধেরও আধ ঘণ্টা যদি সাধুসঙ্গ করা যায়, তাহলেই কাজ হয়। অসংখ্য অপরাধজনিত পাপবোধ নষ্ট হয়। একটু সাধুসঙ্গ। তুলসী বলছেন—
“সঙ্গত কিজিয়ে সাধুকি, হরে আউর কি ব্যাধ।
সঙ্গত কিজিয়ে নীচ কি, আঠো পহর উবাস।।
—সাধুর সঙ্গ ব্যাধি হরণ করে। ভবরোগ হরণ করে। আর অসাধু সংসর্গে অষ্টপ্রহর উপবাসী থাকতে হয়। তাহলে আমরা কার সঙ্গ করব? এ-প্রশ্ন নিজেকেই নিজের। ঠাকুর বলছেন : “খুব সাবধান। যেসকল লোক নিজে কখনো ধর্মচর্চা করে না, অন্যকেও ধ্যান-পূজা করতে দেখলে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে, ধর্ম ও ধার্মিকদের নিন্দা করে, সাধন-অবস্থায় কখনো এরূপ লোকদের সঙ্গ করবে না। তাদের কাছ থেকে একেবারে দূরে থাকবে। ত্রিসীমানা মাড়াবে না।” তুলসী বলছে –
“জঁহা রাম তহাঁ কাম নহী, জঁহা কাম তহাঁ নহী রাম।
ছুঁহু মিলত নহী রব রজনী নহী মিলত একঠাম।।”
—দিন আর রাত তো এক জায়গায় থাকতে পারে না! অসম্ভব সম্ভাবনা। সেইরকম যেখানে নিরন্তর রামের আরাধনা সেইখানে বিষয়বাসনা, ভোগবাসনা থাকে কেমন করে। আর যেখানে শুধুই ভোগ সেখানে রামের আরাধনা হয় কি করে!
“যো পরবিত্ত হরে সদা, ‘সো কহু দান কিয়া ন কিয়া।
যো পরদার করে সদা, সো কহু তীর্থ গয়া ন গয়া।।
যো পর আশ করে সদা, সো বহু দিন জিয়া ন জিয়া।
যো মুহুমে পরচুক্লি ওগারত সো মুহুমে হরিনাম লিয়া ন লিয়া।।”
—যার ধান্দা কেবল পরস্বাপহরণ, তার নিরন্তর ভুরিদান বা অদান—দুই সমান।— কোন ফল নেই। যে নিরন্তর পরস্ত্রীতে আসক্ত তার পক্ষে তীর্থদর্শন বা অদর্শন—দুইই সমান। যে পরপ্রত্যাশী হয়ে বাঁচতে চায় তাঁর বাঁচাও যা মরাও তাই। তার জীবন-মরণ দুইই সমান। আর যে-মুখে পরনিন্দা, সে-মুখে হরিনাম করা আর না-করা—দুইই সমান।
ঠাকুর বলছেন : “দু-রকম মাছি আছে—একরকম মধু মাছি, তারা মধু ভিন্ন আর কিছুই খায় না। আরেক রকম মাছি মধুতেও বসে, আর যদি পচা ঘা পায় তখনি মধু ফেলে পচা ঘায়ে গিয়ে বসে। সেই রকম দুই প্রকৃতির লোক আছে— যারা ঈশ্বরানুরাগী, তারা ভগবানের কথা ছাড়া অন্য প্রসঙ্গ করতেই পারে না। আর যারা সংসারাসক্ত জীব, তারা ঈশ্বরীয় কথা শুনতে শুনতে যদি কেহ কাম- কাঞ্চনের কথা কয়, তাহলে ঈশ্বরীয় কথা ফেলে তখনই তাতে মত্ত হয়।”
মাছি আর মৌমাছি—এই হলো জীবের উপমা। প্রথমে চাই বিবেক-বৈরাগ্য। আমার ভাল লাগছে না। সমস্ত কিছু মনে হচ্ছে বিস্বাদ আর আলুনি। ঠাকুর বলছেন : “বিষয়ে বিতৃষ্ণার নাম বৈরাগ্য।” বলছেন : “বিবেক-বৈরাগ্য না থাকলে শাস্ত্র পড়া মিছে। বিবেক-বৈরাগ্য ছাড়া ধর্মলাভও হয় না। এইটি সৎ আর এইটি অসৎ বিচার করে সদ্বস্তু গ্রহণ করা, আর দেহ আলাদা আর আত্মা আলাদা—এইরূপ বিচার-বুদ্ধির নাম বিবেক।”
এইবার এক কঠিন প্রশ্ন, শাস্ত্রের অধিকারী কে? বিবেক-বৈরাগ্য কার ভিতর জাগবে? কিভাবে জাগবে? আর সেই জাগরণটা কি? এই দেহ পরিপাটি বিছানায় ঘুমোচ্ছিল, সকালে জেগে উঠল, সে জাগরণ আর এই জাগরণ এক নয়। এ হলো অন্তরে উঠে বসা। চৈতন্যলীলায় গিরিশ ঘোষ যে গানটি বেঁধেছিলেন, সেই গানেই আছে সরল ইঙ্গিত—
“আর ঘুমায়ো না মন।
মায়া-ঘোরে কত দিন রবে অচেতন।।
কে তুমি কি হেতু এলে আপনারে ভুলে গেলে,
চাহরে নয়ন মেলে, ত্যজ কুস্বপন
রয়েছ অনিত্য ধ্যানে নিত্যানন্দ হের প্রাণে
তম পরিহরি হের তরুণ-তপন।।”
যোগবশিষ্ঠসার গ্রন্থে শাস্ত্রকার বলছেন, তিনিই এই শাস্ত্রের অধিকারী, যাঁর মনে হয়েছে—
“অহং বদ্ধো বিমুক্তঃ স্যামিতি যস্যাস্তি নিশ্চয়
মাত্যন্তমজ্ঞো নো তজ্ঞঃ সোহস্মিংচ্ছাস্ত্রেঽধিকারবান।।”
—সংসারবন্ধনে আমি আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি। এই বন্ধনদশা থেকে আমি মুক্ত হতে চাই। দৃঢ়সঙ্কল্প আমার। আমি একেবারে অজ্ঞ নই, আবার তেমন তত্ত্বজ্ঞও নই। শাস্ত্রকার বলছেন এমন কৃতসঙ্কল্প অভিলাষী এই শাস্ত্রে অধিকারী। শাস্ত্রটি কি? না বেদান্ত। বেদান্ত কি? আত্ম-সাক্ষাৎকার ও মোক্ষ লাভের উপায়। ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ বস্তুতত্ত্ব জানেন, শাস্ত্রের প্রয়োজন নেই তাঁর। প্রয়োজন নেই উপদেশের। আর যে ঘোর বিষয়ী, তাকে উপদেশ দেওয়ার অর্থ হয় না। ঠাকুর যা বলে গেছেন একেবারে সহজ কথায়, একটু খোঁচা মেরেই—কুকুরের বাঁকা লেজ সোজা হবার নয়। বলছেন : “চিল, শকুনি অনেক উঁচুতে ওড়ে কিন্তু তাদের দৃষ্টি থাকে গো-ভাগাড়ে। অনেক শাস্ত্র পাঠ করলে কি হবে? তাদের মন সর্বদা কাম-কাঞ্চনে আসক্ত থাকার দরুন জ্ঞানলাভ করতে পারে না।“
শাস্ত্রকার অধিকারীদের আবার দুটি ভাগে ফেলেছেন—মুখ্য আর অমুখ্য। মুখ্যের গুরুমুখে মহাবাক্য শ্রবণ মাত্রই জ্ঞান হয়। মুণ্ডক উপনিষদ্ বলছেন :
“তস্মৈ স বিদ্বানুপসন্নায় সম্যক্
প্রশান্তচিত্তায় শমান্বিতায়।
যেনাক্ষরং পুরুষং বেদ সত্যং
প্রোবাচ তাং তত্ত্বতো ব্ৰহ্মবিদ্যাম্।।”
একটি শর্ত। শিষ্যকে হতে হবে প্রশান্তচিত্ত ও সংযতেন্দ্রিয় আর গুরুকে হতে হবে প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞ। এইরকম গুরুর উপদেশে ওইরকম শিষ্যেরই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হবে। নচেৎ নয়। আর তিনি কি উপদেশ দেবেন—সত্যস্বরূপ অক্ষর পুরুষের তত্ত্ব। শাস্ত্রপাঠ করে পরোক্ষজ্ঞান হতে পারে, অপরোক্ষ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে হলে ব্রহ্মবিদ্ গুরুর উপদেশ প্রয়োজন।
শাস্ত্রকার আবার অমুখ্যের দুটি ভাগ করেছেন–(১) বেদান্ত বিচারসমর্থ, (২) বিচার যাঁদের ভাল লাগে না। যাঁর বিচার ভাল লাগে—তিনি বিচারের মাধ্যমেই অপরোক্ষজ্ঞান লাভ করতে পারেন। এইখানে আমরা নিদিধ্যাসন বলে একটি কথা পাই। এর অর্থ ধ্যান নয়, অপরোক্ষজ্ঞান। প্রথমে আমার যথেষ্ট সংশয় ছিল। এই মায়ারূপিণী জগৎকেই আমার সত্য বলে মনে হতো। জগৎকারণ ব্রহ্মকে আমার মনে হতো, সে আবার কি? যা আছে, যা ভীষণভাবে আছে তা নেই আর আপাত দৃষ্টিতে যা নেই, সেইটাই পরম সত্য তা কেমন করে হয়! এ তো মহা ধন্দ। অথচ মনে হচ্ছে কোথায় একটা গোলমাল হচ্ছে। যমরাজ নচিকেতাকে বললেন : “তুমি আমার কাছে অন্য কিছু প্রার্থনা কর, অন্য বর চাও।”
“এতুত্তল্যং যদি মন্যসে বরং বৃণীস্ব বিত্তং চিরজীবিকাঞ্চন।
মহাভূমৌ নচিকেতত্ত্বমেধি কামানাং ত্বা কামভাজং করোমি।।”
—প্রভূত বিত্ত নাও তুমি, বংশানুক্রমে জীবিকানির্বাহের উপায় অথবা চিরজীবন। বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে তুমি রাজা হও, স্বর্গীয়, পার্থিব সমস্ত কাম্য বস্তুর ভোক্তা তুমি হও নচিকেতা। আত্মতত্ত্ব জানতে চেও না। সে বড় গূঢ়, গোপন কথা। এই পৃথিবীতে যেসকল কাম্যপদার্থ অতি দুর্লভ সেইসমস্ত তুমি ইচ্ছামতো প্ৰাৰ্থনা কর। যেমন ধর রথারূঢ়, বাদ্যযন্ত্র সমন্বিত রমণীসকল। তারা তোমার পরিচর্যা করবে। কিন্তু হে নচিকেতা, মরণ-বিষয়ক প্রশ্ন আর আমাকে জিজ্ঞাসা করো না।
নচিকেতা হাসলেন—”প্রভু! আপনি যা আমাকে দিতে চান—তা অতি ক্ষণস্থায়ী, আজ আছে কাল নেই। মানুষের ইন্দ্রিয়শক্তি ক্ষয়কারী। আমাকে গলিত, জরিত করে দেবে। আর দীর্ঘজীবনের লোভ দেখাচ্ছেন আমাকে? সে কত দীর্ঘ! অনন্তকালের তুলনায় কতটুকু? এই রথ, এই অশ্ব, নৃত্য-গীত, সুন্দরী রমণী সব আপনারই থাক”-
“শ্বোভাবা মর্তস্য যদন্তকৈত সৰ্বেন্দ্রিয়াণাং জরয়ন্তি তেজঃ।
অপি সর্বঞ্জীবিতমল্পমেব তবৈব বাহস্তব নৃত্য গীতে।।”
নচিকেতার এই ভাব আমাদেরও গ্রাস করে জীবন অনেকটা চলে আসার পর। সংসারকে মনে হতে থাকে ছায়াসংসার। তখনি তৈরি হয় সংশয়। তখনই মনে হয়, আচ্ছা তাহলে দেখি ব্যাপারটা কি! তখনি বিচার, পুনঃ পুনঃ বিচার। ধ্যান নয়, নিদিধ্যাসন। বিচার মার্গ। ঠাকুর বলছেন : “মানুষ আপনাকে চিনতে পারলে ভগবানকে চিনতে পারে। আমি কে! ভালরূপ বিচার করলে দেখতে পাওয়া যায়, আমি বলে কোন জিনিস নেই। হাত, পা, রক্ত, মাংস ইত্যাদি–এর কোন্টা আমি? যেমন প্যাজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে কেবল খোসাই বেরোয়, সার কিছু থাকে না, সেইরূপ বিচার কল্লে, আমি বলে কিছু পাইনে! শেষে যা থাকে, তাই আত্মা, চৈতন্য। আমার আমিত্ব দূর হলে ভগবান দেখা দেন।”
শাস্ত্রকার বলছেন দুটি মার্গ! মুখ্য আর অমুখ্য অধিকারীর দুটি পথ- ‘পিপীলিকামার্গ’ আর ‘বিহঙ্গম বা শুক-মার্গ”। আহা! সে বড় সুন্দর কথা! বড় আনন্দ! সেকথা পরে হবে।