সাদা রাস্তা কালো বাড়ি
ঠিক এই রকম নামে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি সুন্দর উপন্যাস আছে। তবে সেখানে বাড়িটা সাদা এবং রাস্তাটা কালো। এবং তাই হওয়াই স্বাভাবিক।
কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উলটো। কারণ আর কিছুই নয় আমি রঙকানা, বর্ণান্ধ। মনুষ্যেতর জীবজন্তুরা নাকি সাদা-কালো এই দুটি রঙ ছাড়া দেখতে পায় না। স্পেনের যে বিখ্যাত যাঁড় লাল চাদর দেখে উত্তেজিত হয়ে আক্রমণে মেতে ওঠে, সে নাকি লাল রঙ আর নীল রঙের পার্থক্যই ধরতে পারে না। কোনও বর্ণবোধই নেই তার। যে সবুজ ঘাসের গালিচায়, শ্যামল শস্যের খেতে পাখিরা উড়ে যায় সেই সবুজ রঙ তারা বুঝতেই পারে না। তারা বোঝে শুধু সাদা আর কালো। আর বলতে গেলে এ দুটো কোনও রঙই নয়, একটা হল সব রঙের সমাহার আর অন্যটা হল যে কোনও রঙের অনুপস্থিতি।
আমার অবশ্য ঠিক পশুপাখির অবস্থা নয়। সাদা-কালো ছাড়াও আমি লাল, নীল ইত্যাদি রঙ মোটামুটি ধরতে পারি। কিন্তু হলুদ, সবুজ এগুলো সব ঘুলিয়ে যায়। বহুকাল আগে এক বৃষ্টির দিনে আমাদের কালীঘাট বাড়ির জানলা দিয়ে আমি দেখেছিলাম পাশের বাড়ির ছাদের থেকে রঙিন শাড়ি পরিহিতা জনৈকা সুন্দরী অন্য একটি রঙিন শাড়ি তাড়াতাড়ি নামিয়ে আনছেন। আমার কল্পনাশক্তির খুব অভাব। সুতরাং যা দেখেছিলাম বা দেখেছি বলে ভেবেছিলাম, সেই ভাবে একটা পদ্য লিখেছিলাম, ‘ছাদে সবুজ, গায়ে হলুদ।’ আমার রচনা চিরকালই হাস্যকর, কিন্তু সেই জনৈকা সুন্দরীকে তাঁর উদ্দেশে রচিত কবিতাটি শোনাতেই তিনি হাসিতে মুখর হয়ে উঠলেন। যৎসামান্য একটি স্তব্ধ প্রেমের কবিতায় এত হাসির কী আছে প্রশ্ন করায় তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন যে আমি রঙকানা, আসলে ওই পঙ্ক্তিটি হবে ‘ছাদে হলুদ; গায়ে সবুজ।’ তারে মেলা এবং শরীরে জড়ানো শাড়িদ্বয়ের রঙ ছিল যথাক্রমে ওই রকম।
এর পরে আমি অনেক চিন্তা করেছি। একজন বর্ণান্ধের পক্ষে কবি যশঃপ্রার্থী হওয়া উচিত কিনা, সম্ভব কি না—এ বিষয়ে অনেক ভেবেছি। পরে এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছি যে মিলটন থেকে হেমচন্দ্র যদি পুরোপুরি অন্ধ হয়েও কবি হতে পারেন আমিও বর্ণান্ধ দশায় পার পেয়ে যাব।
পরবর্তী জীবনে এতে আমার কিছু কিছু সুবিধে হয়েছে। যেমন আমার স্ত্রী কখনও আমাকে কোনও রঙিন জিনিস, শাড়ি, জামাকাপড় ইত্যাদি কিনতে পাঠান না। আমার ছেলে তার ইস্কুলের খাতায় ছবি কোনওদিন আমাকে এঁকে দিতে বলেনি। বর্ণান্ধতার দোষে আমি অবশ্য প্লেনের পাইলট অথবা রেলগাড়ির সিগন্যালারের কাজ পেতাম না। অন্যদিকে আমি রঙকানা বলে বাড়িতে কেউ রঙিন টি, ভি, কেনার দাবি তুলতে পারছে না। আমার কাছে সাদা-কালো আর রঙিন টি.ভি. একই। আমি কেন কিনতে যাব? তার চেয়ে একটা জীবন সাদা-কালোতেই কেটে যাবে। ভগবান আমাকে দেননি, আমি কেন নিতে যাব?
একদা এক বিমানযাত্রায় এক বিদেশি উড়োজাহাজের সমীরণ-সেবিকা স্বভাবোচিত নম্রতা সহকারে আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন আমি রেড ওয়াইন খাব কি না। আমি তাঁকে বিনীত ভাবে বলেছিলাম, “দিদি, আমি রঙকানা, লাল মদ সাদা মদে আমি কোন তফাত করতে পারি না।’ আমার এই বক্তব্যে ভদ্রমহিলা কেন গম্ভীর হয়ে আমাকে শুধু এক গেলাস বরফজল দিয়েছিলেন তা আমি বুঝে উঠতে পারিনি।
এর চেয়ে গভীরতর হৃদয়বিদারক একটি ঘটনার কথা আমি জানি। সেই ঘটনার নায়ক আমি নই। অন্য এক ব্যক্তি, তিনিও বর্ণান্ধ। তবে তিনি সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত রঙকানা। দিনের আলোয় বোঝেন, কিন্তু রাতের বেলায় বোঝেন না। অর্থাৎ, এক ধরনের রাতকানা। এই রাত-রঙকানা ব্যক্তিটির একটি খেদোক্তি আমি একবার কার্জনপার্কের বেঞ্চিতে বসে শুনেছিলাম। ভদ্রলোক তাঁর এক বন্ধুকে বলছিলেন।
তার আগে একটু বলি। আমাদের এই কলকাতা শহর। এই আপাত নির্লিপ্ত উদাসীন মহানগর কয়েক বছর পর পর সহসা সাময়িক জ্বরবিকারে ভোগে। এই রকম হয়েছিল, উনিশশো বাষট্টি সালের শেষাশেষি। সীমান্তে ভারত-চিন সংঘর্ষ। ম্যাকমোহন রেখা, যুদ্ধ, উত্তেজনা, আতঙ্ক, চারদিকে নানা রকম গুজব। কলকাতা শহর হঠাৎ একদিন কী রকম গোলমাল করে ফেলল। এক সন্ধ্যায় একদল লোক বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে চিনেবাজারে বেশ কয়েকটা চিনেদের জুতোর দোকান লুঠ করল।
আমার ওই কার্জনপার্কের ভদ্রলোকটি এই নিয়েই দুঃখ করছিলেন। তাঁর দুঃখের কারণটা অবশ্য নিতান্তই ব্যক্তিগত। আগের দিন সন্ধ্যাবেলা আরও দশজনের সঙ্গে একটি জুতার দোকান লুঠে তিনিও অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু যেহেতু তিনি পেশাদার লুঠেরা নন, শৌখিন মানে কালেভদ্রে, কখনও-কখনও টুকটাক লুঠে অংশ নেন। তাই বিশেষ কিছু হস্তগত করতে পারেননি। মাত্র একজোড়া জুতো বাড়ি নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু তিনি রাত-রঙকানা হওয়ায় কাল সন্ধ্যায় ধরতে পারেননি আজ সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে দিনের আলোয় দেখেন একপাটি জুতো ব্রাউন আর অন্যপাটি ব্ল্যাক। তবে তাঁর আশা যে শিগগিরই একদিন প্রকাশ্য দিবালোকে অন্য কোনও চিনের জুতোর দোকান অন্তত চিনে লন্ড্রি লুঠ হবেই, সেদিন তিনি অবশ্যই রঙ মিলিয়ে জিনিস নিয়ে বাড়ি যাবেন এবং সেই আশাতেই এখন প্রতিদিন কার্জনপার্কে এসে বসে প্রতীক্ষা করেন। কোথায়, কখন লুঠ হয়।
ইস্কুলের মাঝারি ক্লাসে আমাদের নিজেদের মধ্যে একটা শব্দঘটিত ধাঁধা ছিল। তার প্রথম কিংবা দ্বিতীয়টি ছিল যদি কালো কুচকুচে, সাদা ধবধবে, লাল টুকটুকে, তবে নীল কী, হলুদ কী, সবুজ কী? কেউ কেউ সরাসরি বলত ক্যাটকেটে নীল, ক্যাটকেটে হলুদ, এগুলো সবই ক্যাটকেটে। কিন্তু নীল কিংবা হলুদ, সবুজ রঙটা খারাপ হলেই তো ক্যাটকেটে, ভাল হলে আর এই বাজে শব্দটা দেব কী করে। অবশ্য একটি ফাজিল জবাব ছিল একটু অন্যরকম। ক্যাটকেটে (মানে বেড়াল কেটে) লাল হবে। বেড়ালের রঙ আবার হলুদ বা নীল হল কবে? মনে আছে, আমাদের এক স্বভাবকবি মাস্টারমশায় খুব যত্ন করে আমাদের পরে শিখিয়েছিলেন, ছিমছাম সবুজ, হিমহিম হলুদ ইত্যাদি। তখন কি ছাই আমি জানতাম যে সবুজ আর হলুদের পার্থক্য আমি ধরতে পারি না।
দুঃখের কথা থাক। নিজের অযোগ্যতার ফিরিস্তি বাড়িয়ে লাভ নেই। বরং অনেকদিন পরে একটা সাহেব মেমদের গল্প বলি। বিবাহের সুবর্ণ জয়ন্তী (পঞ্চাশ বছর) পূর্ণ হয়েছে এমন কয়েকটি বিরল দম্পতির মার্কিন দূরদর্শনে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। অনেক প্রশ্নের মধ্যে একজন স্বামীকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘আপনার কী রকম চূলের মহিলা পছন্দ— স্বর্ণকেশী না কৃষ্ণকেশী?’ বুড়ো সাহেব অর্ধশতাব্দীর সঙ্গিনী বুড়ি মেমের সাদা হয়ে যাওয়া একমাথা ধবধবে চুলের দিকে তাকিয়ে তোবড়ানো গালে আলতো হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘শুভ্রকেশী।’