সাদা আমি কালো আমি – ১.৭

বড়বাজার থানা থেকে বদলি হয়ে আমি জোড়াসাঁকো থানায় যাই। সেখান থেকে লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগে। এই বিভাগটার জন্ম ১৮৬৮ সালে। তখন ব্রিটিশ আমল। পয়লা এপ্রিল রাত দুটোর সময় আমহার্স্ট স্ট্রিটে টহল দিতে গিয়ে এক কনস্টেবল ফুটপাতে রক্তাক্ত অবস্থায় একজন মহিলাকে পড়ে থাকতে দেখে। দ্রুত কাছের থানায় কর্তব্যরত অফিসারকে খবর দিয়েছিল সে। অফিসার এসে দেখলেন মহিলা মৃত। তাঁকে খুন করে ফেলে যাওয়া হয়েছে। ওই অফিসার তদন্ত শুরু করলেন। এই ঘটনা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হল। ফলে কলকাতা পুলিশ দারুণ চাপে পড়ে গেল। শেষ পর্যন্ত রিচার্ড বিড নামে এক অফিসারের ওপর ওই খুনের তদন্তের ভার পড়ল। তদন্তে প্রকাশ পেল খুন হওয়া সেই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ভদ্রমহিলার নাম রোজি ব্রাউন। সমাজের অন্যায়ের শিকার হয়ে বাধ্য হয়েছিলেন সমাজে আগাছার মত জীবনযাপন করতে। রিচার্ড রিড সেই খুনের মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করলেন।

এই খুনের ঘটনাটা আপাতদৃষ্টিতে হয়ত তেমন কিছুই না, এমন কতশত খুন তো শতাব্দী জুড়ে হয়েছে এ শহরের বুকে। কিন্তু তবু কলকাতা পুলিশের ইতিহাসে এই খুনের ঘটনাটা একটা ব্যতিক্রম হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই খুনের তদন্তের সময়ই একটা ‘বিশেষ তদন্ত বিভাগের প্রয়োজনীয়তা প্রথম অনুভব করা গেছিল। তখন কলকাতা পুলিশের অধিকর্তা স্যার স্টুয়ার্ট হগ এক নির্দেশ জারি করে আলাদা গোয়েন্দা বিভাগ তৈরি করলেন। তার বছর দশেক আগে একই ঢঙে তৈরি হয়েছিল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রথম পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হলেন মিঃ এ. ইউন্যান, তাঁর সাহায্যকারী হলেন প্রথম শ্রেণীর ইন্সপেক্টর আর. ল্যাম্ব। তাঁদের অধীনে রইলেন চার জন দারোগা, দশ জন হেড কনস্টেবল আর দশ জন করে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর কনস্টেবল। তখনকার দিনে ব্রিটিশরা বাঙালি কনস্টেবল খুব কম নিয়োগ করত। তাদের ধারণা ছিল বাঙালিরা অলস। তাই তারা ভারতের উত্তর দিককার প্রদেশগুলো থেকে কনস্টেবল নিত। আসলে এই কনস্টেবল বা সিপাই বাহিনীই পুলিশ ফোর্সের ভিত। এরাই সমাজের তৃণমূলের মানুষের মধ্যে থাকে, মেশে এবং সমস্ত খবরাখবর রাখে।

বাঙালিরা অনেকেই বুদ্ধিমত্তার জন্য অফিসার স্তরে উঠেছিলেন। তাঁদের মধ্যে শ্রীনাথ পাল এবং কালীনাথ বসু ছিলেন রিচার্ড রিডের মত দক্ষ ইন্সপেক্টর। ১৮৭৯ সালে গোয়েন্দা দফতবকে দুভাগে ভাগ করা হল। একটা বিভাগকে দেওয়া হল রিড সাহেবের অধীনে লালবাজারে, অন্য বিভাগটা চলে গেল ৩৪ নং সুতারকিন লেনে শ্রীনাথ পাল ও কেষ্টচন্দ্র ব্যানার্জির অধীনে। আরও অনেক বাঙালি অফিসার ব্রিটিশ আমলে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি, অক্ষয়কুমার ব্যানার্জি। ১৮৯৮ সালে যোগেন্দ্রচন্দ্র মিত্র গোয়েন্দা দফতরের অধিকর্তা হয়েছিলেন। কিছুদিন পর অসুস্থ হয়ে তিনি মারা গেলে কেষ্টচন্দ্র ব্যানার্জি তাঁর পদে যোগ দেন। কিন্তু তিনিও বেশিদিন ওই পদে থাকতে পারেননি, বছর তিনেকের মাথায় ব্রিটিশরা তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত কবে। যদিও এর কোনও কারণ জানা যায়নি, তবে অনুমান করা যায়, ব্রিটিশরা কোনও নেটিভকে ওই রকম গুরুত্বপূর্ণ পদে আর রাখতে চায়নি। তাঁর জায়গায় এম.বি. ইলিয়াস নামে এক সাহেবকে নিয়োগ করা হয়েছিল।

১৯০৮ সালে গোয়েন্দা দফতরের আলাদা একটা শাখা তৈরি করা হল। রাজনৈতিক খবরাখবর যোগাড় করা ও তার মোকাবিলা করা ছিল এর কাজ। সেই শাখাই হচ্ছে কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ। এস. এ. এলরিজ প্রথম এই শাখার অধিকর্তা নিযুক্ত হলেন। গোয়েন্দা দফতরের এই দুটো শাখাই একসময় ছিল স্বদেশীদের হাত থেকে কোনমতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া টেগার্ট সাহেবের হাতে। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে গোয়েন্দা দফতর চলতে লাগল। ১৯১৭ সালে ওই বিভাগের প্রথম ডেপুটি কমিশনার নিযুক্ত হলেন এল. এম. বার্ড। ১৯২০ সালে তৈরি হল বিশেষ গুণ্ডা দমন শাখা। একজন সহকারি কমিশনারের অধীনে ছিল সেটি। ১৯৪০ সালে এই শাখায় প্রথম ভারতীয় ডেপুটি কমিশনার নিযুক্ত হলেন হীরেন্দ্রনাথ সরকার। তিনি ইংল্যাণ্ডে গিয়ে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের কাজকর্ম দেখে এসে এখানকার গোয়েন্দা দফতরে “এচালি তত্ত্ব” প্রয়োগ করলেন। নানা ধরনের অপরাধীদের অপরাধের বৈশিষ্ট্য, ধরন, সময়, নকশা, কথাবার্তা, সহযোগী, যানবাহন, মানসিকতা এবং বিশেষ কোনও চিহ্ন নিয়ে দশ পয়েন্টের ব্যাখ্যা তৈরি করেছিলেন এচালি সাহেব। তাছাড়া এখনও তাঁর বানানো পরিকাঠামো অনুযায়ী গোয়েন্দা দফতর চলার কথা। যদিও যুগের সাথে মিলিয়ে কিছু ছোটখাট পরিবর্তন ও পরিমার্জন মাঝে মাঝে করতে হয়েছে। এখনও তাঁর তৈরি পরিকাঠামো অনুযায়ী গোয়েন্দা দফতর চলার কথা। তবে আমাদের সময় পর্যন্ত এচালির তত্ত্ব মানা হলেও এখন আধুনিকতার নামে অনেকে অনেক থিওরি আনছেন। তার ফল রোজ খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায়।

তাছাড়া আমাদের আমলে পুলিশের অন্যান্য দফতরের দক্ষ অফিসারদেরই শুধু মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে গোয়েন্দা দফতরে নেওয়া হত। আবার একবার গোয়েন্দা দফতরে বদলি হলে অন্য কোনও দফতরে চট করে বদলি করা হত না। বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করে অন্যখানে পাঠিয়ে দেবার কোনও অর্থ নেই বলেই এই ব্যবস্থা ছিল।

আমি দেবীবাবুর অধীনে লালবাজারে যোগ দিলাম। তার আগে গোয়েন্দা দফতরের অ্যাসিস্ট্যাট কমিশনার (ইন্টেলিজেন্স) ছিলেন মিঃ দীনেশ চন্দ, খুবই দক্ষ অফিসার ছিলেন। তিনিই প্রথম বর্তমান যুগের উপযোগী করে সোর্সের জাল বিস্তার করা দেখিয়েছিলেন। গোয়েন্দা দফতরকে আধুনিকতার পথে এগিয়ে দেওয়ার তিনিই প্রথম কাণ্ডারি বলা চলে। চন্দ সাহেব পরে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (নর্থ) হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর উত্তরসূরী দেবীবাবু চন্দ সাহেবের তৈরি বাগানটা আরও সুন্দরভাবে সাজিয়ে নিলেন। আমরা সেই বাগানে ফুল হিসাবে নয়, সহযোদ্ধা হিসাবে ছিলাম। তাঁর অধীনে কাজ করতে করতে তদন্তের অনেক নতুন কৌশল শিখতে লাগলাম। তিনি অফিসারদের তদন্তের কাজে এগিয়ে দিয়ে নিজে চুপচাপ বসে থাকতেন না, সবদিকে ছিল তাঁর তীক্ষ্ণ নজর। পরিস্থিতি অনুযায়ী পরামর্শ দিতেন, সব রকম সাহায্য তো করতেনই। সব স্তরের কর্মচারিদের সুযোগ সুবিধের দিকে খেয়াল রাখতেন দেবীবাবু। অফিসারদের অফিসে আটকে রাখার দরুণ কৌশল জানতেন উনি। ফাঁকি দিয়ে আড্ডা মারতে পালিয়ে যাওয়া ছিল অসম্ভব। প্রয়োজনে হাতের কাছে দক্ষ হাতিয়ারদের পেতেই হবে, এই ছিল তাঁর জেদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *