৫
সিনিয়র অফিসারের বাড়িতে বিজয়া করতে যাওয়ার কথায় একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমি একবার ছুটি নিয়ে নেপাল বেড়াতে গেলাম। সঙ্গে আমার স্ত্রী, ছেলে, আর আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার উমাশংকর লাহিড়ী, সে তখনও বিয়ে করেনি। আমরা নেপাল যাব শুনে, গোয়েন্দা বিভাগের বড়সাহেব আমাকে আর লাহিড়ীকে ডেকে বললেন, “ছুটি তোমাদের দিতে পারি একটা শর্তে, যদি তোমরা পশুপতিনাথ মন্দিরে পুজো দিয়ে দাও আমার নামে।” আমরা বললাম, “নিশ্চয়ই দেব স্যার।” উনি মনে করিয়ে দিলেন, “ফুল, প্রসাদ আনবে কিন্তু।” আমি বললাম, “এটা কি আর বলতে হবে স্যার।” উনি খুবই ধার্মিক ছিলেন। সকালে পুজো না করে জলও খেতেন না।
আমরা নির্দিষ্ট দিনে রকসৌল দিয়ে নেপাল পৌঁছলাম। তারপর আমি আর লাহিড়ী কাঠমাণ্ডু, তার আশেপাশের বহু জায়গায় ঘুরলাম। খুব ফূর্তি করলাম, খাওয়া দাওয়া হল প্রচুর, ক্যাসিনোতে গিয়ে খেললাম। বৌ-বাচ্চার আবদার মেটালাম। অনেক ফটো তুললাম। মধ্যবিত্ত বাঙালি বেড়াতে গিয়ে যা যা করে আর কি! চাকরির পিছুটান নেই, বাঁধনহারা হয়ে সময়ের গণ্ডিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিব্যি কাটল। কিভাবে যে দশটা দিন উড়িয়ে দিলাম বুঝতেই পারলাম না। বুঝলাম যখন ফেরার টিকিটের তারিখটা ঘণ্টা বাজিয়ে দিল। আমরা লোটাকম্বল গুটিয়ে ফেরার জন্য বাসে চেপে বসলাম। রকসৌল স্টেশনে কিছু যাত্রী প্রচণ্ড গণ্ডগোল করল, ঢিল ছুঁড়ে ট্রেনের জানলার কাঁচফাচ ভেঙে দিল। কোনমতে মাথা বাঁচিয়ে চলে আসতে পেরেছি।
হাওড়া স্টেশনে নামলাম। একটুও ভাল লাগছে না। এই কোলাহল, ঘিঞ্জি, নোংরা পরিবেশ। বেশ ছিলাম কিছুদিন, খোলা আকাশের তলায় নেপালের অপূর্ব প্রকৃতির মাঝখানে এক অন্যরকম জীবন কাটান। সেখানে হাত বাড়িয়ে যেন জীবনটা উপভোগ করা যায়, দেখা যায়, স্বাদ পাওয়া যায় বেঁচে থাকার। বেড়িয়ে এসে সবারই মনের ভাব বোধ হয় আমার মত হয়।
আমরা অলস পায়ে এগিয়ে চলেছি স্টেশনের বাইরে ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডের দিকে। একটা ট্যাক্সি ধরে চলতে শুরু করলাম, আবার সেই ছোটাছুটির জীবনের দিকে, চাকরির গণ্ডিতে, লালবাজারে। লালবাজারের কথা মনে হতেই আমি তাড়াতাড়ি ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললাম, “দাঁড়াও দাঁড়াও।” তখন আমাদের ট্যাক্সি হাওড়া ব্রিজে উঠে গেছে। ড্রাইভার আমার আতঙ্কগ্রস্ত গলা শুনে অবাক হয়ে ট্যাক্সিটা দাঁড় করাতে লাহিড়ীকে বললাম, “নাম, নাম।” লাহিড়ী আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল, “এখানে?” আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, “হ্যাঁ, হ্যাঁ।” ‘আমার মুখ চোখ দেখে লাহিড়ী বুঝল কিছু একটা হয়েছে, সে আর দ্বিতীয় প্রশ্ন না করে নেমে পড়ল। আমি ট্যাক্সির জানালায় ঝুঁকে স্ত্রীকে বললাম, “তোমরা বাড়ি চলে যাও, আমি একটু পরে যাচ্ছি।” আমার স্ত্রী এতদিনে আমার চলাফেরা, আচরণে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, সবার স্ত্রীই বোধহয় হয়। আমার হঠাৎ মত পরিবর্তনে সে বুঝে গেছে বিশেষ একটা কিছু ঘটেছে। সে আর প্রশ্ন না করে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি চলে গেল। আমি দৌড়ে গিয়ে একটা ফাঁকা ট্যাক্সিতে উঠে বসলাম। পেছনে লাহিড়ী। ড্রাইভারকে বললাম, “শিয়ালদা চল।” লাহিড়ী একবার আমার মুখের দিকে তাকাল, কিন্তু আমার বিরক্তি মাখা মুখ দেখে জানতে চাইল না, হঠাৎ কি হয়েছে, কেন আমি শিয়ালদা যেতে চাইছি।
শিয়ালদা পৌঁছে আমি ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রাখলাম। নেমে হাঁটতে শুরু করেছি, এবার আর লাহিড়ী ধৈর্য রাখতে পারল না। তবে প্রশ্ন নয় কোন, শুধু বলল, “স্যার।” আমারও সংক্ষিপ্ত জবাব, “বড়সাহেব।” লাহিড়ী তাড়াতাড়ি এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বড়সাহেবকে খুঁজতে লাগল, না পেয়ে আমায় জিজ্ঞেস করল, “কোথায়?” আমি সোজা চলতে চলতে বললাম, “লালবাজারে।” লাহিড়ী তখন জানতে চাইল, “তাহলে এখানে কি?” বুঝলাম, ওর স্মৃতিশক্তি আমার চেয়েও প্রখর! গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলাম, “লাহিড়ী তুমি কখনও ব্রাহ্মী শাক খেয়েছ?” আমার প্রশ্ন শুনে লাহিড়ী অবাক হয়ে গেল, “কি শাক স্যার?” ওর কৌতূহলী মুখটা দেখে আমার এবার হাসি পেল, আর ভণিতা না করে বললাম, “তোমার কি মনে নেই, বড়সাহেব আমাদের পশুপতিনাথ মন্দিরে পুজো দিতে বলেছিলেন? আমরা কি দিয়েছি?” লাহিড়ী জিভ কেটে বলল, “তাই তো, এখন কি হবে?” আমি বললাম, “কি আর হবে? এখন যাচ্ছি সেই পুজো দিতে।” লাহিড়ী আশ্চর্য হয়ে বলল, “এখানে?” আমি শুধু মাথা নেড়ে একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম।
আমি যখন মুচিপাড়া থানায় ছিলাম তখন থেকেই চিনি, ওখানে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর ফটো পাওয়া যায়। আমি দোকানদারকে বললাম, “ভাই আমাকে একটা নেপালের পশুপতিনাথের ফটো দাও তো।” দোকানদার তার অজস্র দেবদেবীর ফটোর স্টক থেকে খুঁজে বার করল টিনের ওপর রং দিয়ে আঁকা পশুপতিনাথের ফটো। ফটোটা দেখে আমার ঠিক পছন্দ হল না। পশুপতিনাথ মন্দিরে আমি গিয়েছিলাম, পুজোটুজোও দিয়েছিলাম। পশুপতিনাথের মূর্তি দেখেছি, কিন্তু ছুটির আনন্দে লাহিড়ীর মত আমিও সে সময় বড়সাহেব, লালবাজার, চাকরি সব ভুলে বেমালুম হজম করে ফেলেছিলাম। তাই এখন ছোটাছুটি। ফটোটা হাতে নিয়ে দেখলাম, মূর্তির সঙ্গে মিলের থেকে অমিলই বেশি। তাই আমি দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই, এটা পশুপতিনাথের ফটো তো?” দোকানদার জোর গলায় জানাল, “একশ ভাগ আসল।” এমনভাবে সে বলল যেন পশুপতিনাথকে স্বচক্ষে দেখেছে। আমি জানতে চাইলাম, “সে কি, দেবদেবীর ফটোর মধ্যে আবার আসল-নকল আছে না কি?” দোকানদার আমার বোকামি দেখে অবাক, “নেই? নতুন যারা এ লাইনে নেমেছে তারা যা সব ছবি আঁকায়, আপনার দেখে ভক্তিই আসবে না। আর আমরা তো এ লাইনে নতুন নয়, তিনপুরুষ ধরে আছি। ঠাকুর্দার আমল থেকে সব ঠাকুরের একই আদলে ছবি তৈরি করি, দেখলেই আপনার গড় করতে ইচ্ছে করবে।”
সত্যিই তাই, আমার তখন ওই টিনের ফটোটা নিয়ে গড় করতেই ইচ্ছে করছিল। মনে মনে প্রার্থনা করলাম, “বাবা পশুপতিনাথ, বড় সাহেবের গালাগালির হাত থেকে তুমি বাঁচিও। তুমি না বাঁচালে আর কে বাঁচাবে এ যাত্রা।” ফটোর দাম মিটিয়ে আমি আর লাহিড়ী ওই টিনের ফটোটা বুকে ধরে অন্য একটা দোকানের দিকে চললাম। ফুল, বেলপাতা, দূর্বা, প্রসাদ কিনতে হবে তো! দোকানদারকে বললাম, “আমাকে কিছু দুচার দিনের পুরনো ফুল, বেলপাতা, নকুলদানা, বাতাসা দাও তো।” দোকানদার অবাক হয়ে বলল, “পুরনো ফুল তো নেই।” আমি বললাম, “ঠিক আছে, যা আছে তাই দাও।” দোকানদার একটা শালপাতার ঠোঙায় জবা, গাঁদা ফুল আর সিঁদুর মাখান বেলপাতা দিল। আমি ফুলগুলো নিয়ে দুহাতে দলাইমলাই করে নিলাম, যাতে বোঝা যায় অন্তত তিনচার দিনের পুরনো। ফটোটাতে একটু তেল চিটচিটে সিঁদুর মাখিয়ে দিয়ে শালপাতার ঠোঙার মধ্যে রাখলাম। তারপর নকুলদানা ও বাতাসা সেই ঠোঙার একপাশে গুঁজে দিলাম। হাতে একটু জল নিয়ে ঠোঙার গায়ে ছিটিয়ে দিলাম। যাতে বাতাসা ও নকুলদানাগুলো মিইয়ে কাদা কাদা হয়ে যায়। বাসি প্রসাদ বোঝাতে হবে তো!
কাজ শেষ হলে আমরা ট্যাক্সিতে এসে বসলাম। ঠোঙাটা আমি দুহাতে ধরে বসে আছি। ট্যাক্সি চলেছে লালবাজারের দিকে। লাহিড়ী আমার কাণ্ডকারখানা দেখে চুপ, মাঝে মাঝে একবার করে আমার দিকে তাকিয়েই মুখ ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে রাস্তা দেখছে। কি ভাবছে ও কে জানে? ট্যাক্সি এসে আমাদের গোয়েন্দা দফতরের বাড়িটার নিচে দাঁড়াল। আমি ঠোঙাটা লাহিড়ীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, “লাহিড়ী তুমি এটা বড়সাহেবকে দিও।” লাহিড়ী আঁতকে উঠে বলল, “না, না স্যার, ও আমার কম্মো নয়, আপনিই দেবেন।” আমি আর কি বলি, বললাম, “ঠিক আছে, চল।” দুরু দুরু বুকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। বড়সাহেবের চেম্বারে এসে বীরের মত প্রথমে আমি ঠোঙা হাতে ঢুকে পড়লাম, পেছনে লাহিড়ী। বড়সাহেব আমাদের দুজনকে দেখে বললেন, “ও তোমরা এসে গেছ? আমার পুজো?” আমি বললাম, “এই যে স্যার আপনার পুজোর প্রসাদ।” আমি ঠোঙাটা ওঁর দিকে এগিয়ে দিলাম। উনি চেয়ার ছেড়ে উঠে হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে ঠোঙাটা নিতে গিয়েই হাতটা সরিয়ে নিলেন, বললেন, “না, না, দাঁড়াও আমি আসছি।” তারপর দ্রুতগতিতে নিচে নেমে গেলেন। আমি জানি, উনি কি জন্য নিচে গেলেন। ওঁর গাড়িতে সবসময় একটা গঙ্গাজলের বোতল থাকে, সেই জল দিয়ে হাত ধুতে গেলেন। আমরা উদভ্রান্তের মত দাঁড়িয়ে আছি শালপাতার ঠোঙাটা নিয়ে। সারারাতের ট্রেন জার্নিতে চেহারা আর জামাকাপড়ের যা হাল, মাথায় একমণ করে ধুলো, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তার ওপর বড়সাহেবের পুজোর টেনশনে চোখমুখের করুণ অবস্থা। বেশিক্ষণ অবশ্য আমাদের দাঁড়াতে হল না। সাহেব সামনে এসে দুহাত বাড়িয়ে খুশিতে ডগমগে মুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন, “এবার দাও।” আমি ঠোঙাটা তাঁর হাতে দিতে উনি “জয় বাবা পশুপতিনাথ” বলে চোখ বুজে ঠোঙাটা কপালে ঠেকালেন তিনবার, আমাদের বললেন, “আমি আসছি।” তারপর উনি নিচে নেমে গাড়ি করে সোজা বাড়ি চলে গেলেন।
আমি আর লাহিড়ী আর কি করি, একটু পর বাড়ি চলে গেলাম। তারপর কাজের চাপে আমি আর লাহিড়ী এই ঘটনা পুরো ভুলে গিয়েছিলাম।
বেশ কিছুদিন পর বিজয়ার প্রণাম করতে বড়সাহেবের বাড়িতে সকালবেলা গেলাম। বৌদির কাছে শুনি, উনি ঠাকুরঘরে পুজো করছেন। বেরতে দেরি হবে। আমার তাড়া ছিল, তবু ভাবলাম, এসেছি যখন তখন দেখা করেই যাই। আমি পায়ে পায়ে ঠাকুরঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। চোখ বুজে বসে পুজো করছেন বড়সাহেব। দেবদেবীর সিংহাসনের দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলাম। দেখি, আমার দেওয়া ওই টিনের পশুপতিনাথের ফটোটা সিংহাসনের একদম মাঝখানে, তার চারপাশে অন্যান্য দেবদেবীর ফটো। তা দেখে আমার নিজের ওপরই একটা ধিক্কার এল। আমি কোনমতে বড়সাহেবকে ডাকলাম, “স্যার।” উনি ঘাড় ঘুরিয়ে আমায় দেখে বললেন, “আরে তুমি, কি ব্যাপার।” আমি নিচু স্বরে বললাম, “স্যার বিজয়াটা।” উনি বললেন, “এখন থাক।” তারপর আমার চাপাচাপিতে বাধ্য হয়ে ঠাকুরঘর থেকে উনি বেরিয়ে এলেন। আমি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে করতে ভাবলাম, ভক্তিটাই আসল, ভক্তিভরে যে কোনও মূর্তিকেই বোধহয় পুজো করা যায়!
বড়সাহেবের বাড়ি থেকে বেরনর সময় মনে হল, সেদিন আমরা ভেবেছিলাম জিতে গিয়েছি। না, আসলে আমরা সেদিন বড়সাহেবের কাছে গো-হারা হেরে গিয়েছি।