সাদা আমি কালো আমি – ১.২১

২১

দেখার চোখ থাকলে সবই দেখা যায়। তবে সেই দেখাটা দেখতে হয় হৃদয় দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে। গোয়েন্দা দফতরের কাজে এই দেখাটাই আসল। আমি যখন গোয়েন্দা দফতরের ডাকাতি দমন শাখার অন্যতম প্রধান হিসাবে ছিলাম, তখন আমরা একটা সুবিন্যস্ত টিম হিসাবে তৈরি হয়েছিলাম, সেই হিসাবেই আমরা কাজ করতাম।

আমাদের সময় চল্লিশটা ডাকাতি হয়েছিল কলকাতা ও তার আশেপাশে। আমরা তার মধ্যে উনচল্লিশটার মীমাংসা করতে পেরেছিলাম, একটা পারিনি। অর্থাৎ সাড়ে সাতানব্বই শতাংশ। কেন আমরা ওই একটা ডাকাতির কিনারা করে একশভাগ সফল হলাম না তা নিয়ে এখনও আমরা সব সহকর্মীরা হা-হুতাশ করি, নিজেদের ব্যর্থ মনে করি!

রাজ্য পুলিশের সি. আই. ডি. দফতরের সাথে আমাদের দারুণ সুসম্পর্ক ছিল, খবরের আদান প্রদানের জন্য আমরা যেমন তাঁদের ভবানী ভবনের কেন্দ্রীয় দফতরে যোগাযোগ করতাম, তাঁরাও ঠিক তেমনি লালবাজারে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতেন। একদিকে যেমন তাঁদের সঙ্গে ছিল সহযোগিতার সম্পর্ক, অন্যদিকে ছিল প্রতিযোগিতার, কারা আগে ধরতে পারে আসামীদের।

আমাদের টিমটা ডাকাতি ধরার ক্ষেত্রে এমন পারদর্শী হয়ে উঠেছিল যে, সারা পশ্চিমবঙ্গে পুলিশের মধ্যে আমাদের সুনাম তো হয়েছিলই, এমন কি মুখ্য তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের প্রতি তাঁর আস্থার কথা বিধানসভায় পর্যন্ত ঘোষণা করেছিলেন।

একদিন বর্ধমান শহরে একটা ব্যাঙ্কে ডাকাতি হয়ে গেল। সাধারণভাবে শান্ত শহর বর্ধমান। ব্যাঙ্ক ডাকাতিতে সবাই চমকে উঠলেন। খবর শুনে এস. পি. সমেত সমস্ত অফিসাররা ব্যাঙ্কে গিয়ে পৌঁছলেন। বর্ধমানের তৎকালীন এস. পি. ছিলেন এস. আই. এস. আহমেদ। সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখে তাঁর মনে হল, ডাকাতরা সব কলকাতা শহরের। কারণ কলকাতা শহরে যে কায়দায় ডাকাতি হয়, এই ডাকাতিটা অনেকটা সেই কায়দায় করা হয়েছে।

তিনি তখন সেখানে প্রাথমিক তদন্ত সেরে, অন্য তদন্ত শুরু করার আগে সময় নষ্ট না করে ব্যাঙ্কের সমস্ত কর্মচারীকে প্রাইভেট গাড়িতে তুলে সোজা কলকাতায় আমাদের লালবাজারের ডাকাতি দমন শাখায় নিয়ে এলেন। কারণ তাঁরাই ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী এবং তাঁদের দেওয়া বিবরণটা আমাদের কাজে লাগবে ভেবেই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিলেন।

এস. পি. সাহেব বর্ধমানের ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের যখন আমাদের দফতরে নিয়ে এসেছিলেন, তখন আমি দফতরের বাইরে অন্য কাজে গিয়েছিলাম। তিনি সন্ধের সময় এসেছিলেন, দফতরে অনেক কর্মচারীই তখন এদিক ওদিক ছিলেন। তবে যাঁরা তখন দফতরে ছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই খুব দক্ষ। তিনি তাঁর আসার উদ্দেশ্য তাঁদের কাছে সবিস্তারে বললেন। তাঁরা এস. পি. সাহেবের কথা মন দিয়ে শুনে নিজেদের মধ্যে যখন আলোচনায় ব্যস্ত, তখন আমি দফতরে ফিরে আসি। দফতরে এসে বর্ধমানের এস. পি. সাহেবকে দেখি, উনিও আমাকে তাঁর আসার উদ্দেশ্য বললেন।

আমরা আলোচনা করে ঠিক করলাম, ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে ডাকাতির কথা ও ডাকাতদের চেহারার বর্ণনা শুনব। এবং জিজ্ঞাসাবাদের পর সবাই যেখানে বসে আছেন সেখানে না গিয়ে অন্যত্র গিয়ে অপেক্ষা করবেন। আমরা এস. পি. সাহেবকে আমাদের প্রস্তাব দিতে উনি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলেন। কথা মত আমাদের অফিসাররা তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন একজন একজন করে।

প্রথমেই ডাকা হল ওই ব্যাঙ্কের এক মহিলা কর্মচারীকে। আমরা ছজন অফিসার ছিলাম। তাঁর চোখে মুখে তখনও আতঙ্কের ছাপ। বর্ধমান থেকে লালবাজারে আসার ধকল স্পষ্ট। রাজকুমার তাঁকে অভয় দিয়ে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা দিদিমণি, আপনি এর আগে কখনও কি ডাকাতি দেখেছেন?”

ভদ্রমহিলা আঁৎকে উঠে বললেন, “না—না।” এমনভাবে তিনি বললেন যেন মনে হল ডাকাতরা এখনও ব্যাঙ্কেই রয়েছে।

রাজকুমারই জানতে চাইল, “এই ডাকাতির কথা কি আপনি জীবনেও ভুলতে পারবেন?” তিনি সাথে সাথে বললেন, “এ কি ভোলার জিনিস? কখনও ভুলব না।”

বললাম, “তাহলে চোখ বুজে একবার দেখে নিন তো ডাকাতির সেই দৃশ্যগুলো, তারপর বলুন কি কি হয়েছিল।”

ভদ্রমহিলা সত্যিই চোখ বুজে ভাবতে থাকলেন। আমরা সবাই বসে আছি। আসলে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে ঘটনার বিবরণ নেওয়ার এটা একটা কৌশল। ঘটনা যখন দ্রুত ঘটে যায় তখন তারা আতঙ্কিত চোখে দেখে, মস্তিষ্ক ঠিক মত কাজ করে খুব কম লোকেরই। তাই ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আতঙ্কিত চোখে দেখা আতঙ্কিত মনের বিবরণ হয়ে যায়। সে সময় তাকে শান্ত হওয়ার জন্য সময় দিয়ে চোখ খুঁজে ফ্ল্যাশ ব্যাক দেখতে দিতে হয়, যাতে পূর্বাপর দৃশ্যগুলো তার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। এবং সেই অনুযায়ী বিবরণ দিতে পারে। প্রত্যক্ষদর্শীর তুচ্ছাতিতুচ্ছ কথাও আমাদের কাজে এসে যায়। বিবরণের সত্যমিথ্যার পার্থক্য বোঝা যায়।

অনেক সময় মিথ্যা ঘটনার কথা বলে, মিথ্যা বিবৃতি দিয়ে আমাদেরও কেউ কেউ ফাঁদে ফেলে নিজের কুকর্মকে আড়াল করে বাঁচতে চায়।

একদিন সন্ধেবেলা লালবাজারে এসে দেখি আমার চেম্বারের সামনে একজন বেশ স্বাস্থ্যবান মধ্যবয়স্ক লোক বসে আছে। চুলগুলো উসকো খুসকো, চোখ উদভ্রান্ত। কাছেই ছিল রাজকুমার। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কে ইনি, কি কারণে বসে আছেন?”

রাজকুমার বলল, “লোকটা ডায়মন্ড হারবারের কাছে থাকে। আজ সকালে ওর দাদা ওকে আশি হাজার টাকা দিয়েছিল, নিউ আলিপুরের একটা ব্যাঙ্কে জমা দিতে। সে টাকাটা একটা থলিতে করে নিয়ে যাচ্ছিল। মাঝেরহাট ব্রিজের ওপর বাস থেকে নেমেছিল। তারপর ব্রিজ থেকে নেমে নিউ আলিপুরের দিকে যখন যাবে, সে সময় ব্রিজের নিচে চার পাঁচজন ছেলে ওকে মেরে থলি নিয়ে চম্পট দেয়। এখন আপনার কাছে এসেছে একটা কিছু ব্যবস্থা করতে।”

লোকটার কাছে জানতে চাইলাম, “কটার সময়?” লোকটা বলল, “বারোটা-সাড়ে বারোটা হবে।”

আমি তার উত্তর শুনে রাজকুমারের দিকে তাকিয়ে বললাম, “ওর থেকে আর কি কি জেনেছিস?”

আমার ইশারা বুঝে রাজকুমার তাকে প্রশ্ন করল, “আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?”

সে জানাল।

রাজকুমারের প্রশ্ন, “আপনি কি প্রায়ই কলকাতায় আসেন?”

সে বলল, “প্রয়োজন পরলেই আসি।”

রাজকুমার বলল, “যেমন আজ এসেছেন।”

সে বলল, “হ্যাঁ।”

“বাসে আসতে কত সময় লাগে?” রাজকুমারের প্রশ্ন।

সে বলল, “ঘণ্টা দুয়েক।”

রাজকুমার এবার জানতে চাইল, “আজ কখন বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন?”

সে জানাল, “আটটা নাগাদ।”

আমি তখন রাজকুমারকে বললাম, “রাজু একটু পর একে আমার ঘরে নিয়ে আয়, তুই একটা ডাণ্ডা নিয়ে আসিস।” আমি চেম্বারে ঢুকে গেলাম।

রাজকুমার মিনিট পাঁচেক পর হাতে একটা “রুল” নিয়ে লোকটাকে নিয়ে আমার সামনে হাজির।

লোকটা কাঁপতে কাঁপতে হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠে আমার পা জড়িয়ে ধরে বলল, “আমায় বাঁচান রুণুবাবু, আমায় বাঁচান।”

আমি পা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, “উঠে বস, ভেবেছিলি, আমাদের মিথ্যা ঘটনার কথা বলে, দাদার টাকাটা মেরে দিবি? আমরাও তোর কথায় ধিতাং ধিতাং নেচে এদিক ওদিক ছুটে দেখাব, সত্যিই টাকাটা চোট।”

লোকটা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “সত্যি আমি মারিনি।” জানতে চাইলাম, “তবে কে মেরেছে?” সে বলল, “মহিলাটা, ওই মহিলাটা, ওর ভীষণ লোভ।”

প্রশ্ন করলাম, “কোন মহিলাটা? কোথায় থাকে?” সে তখন কান্না থামিয়ে বলল, “থাকে ঠাকুরপুকুরে, ওকে আমি রেখেছি।” রাজকুমার সে কথা শুনে লোকটাকে কিছু গালাগালি দিয়ে দিল। আমি থামিয়ে দিলাম। গালাগালি খেয়ে লোকটার বোধহয় একটু লজ্জা হয়েছে, সে বলল, “আজ সকালে ওর কাছে যাব প্রথমে ভাবিইনি। বাসে করে আসছিলাম, জোকা পেরিয়ে ঠাকুরপুকুর আসতেই হঠাৎ মাথায় কি ক্যাঁড়া ঢুকল, বাস থেকে নেমে ওর বাড়ি গেলাম। বাড়িতে ও একাই থাকে। বাড়িটাও আমি বানিয়ে দিয়েছি। সেখানে গিয়ে ওর সাথে খাওয়াদাওয়া করার পর আমি বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখি টাকার থলিটা ঘরে নেই। থলিটা কোথায় জানতে চাইলে সে বলল, থলিটা সে আর ফেরত দেবে না। তারপর আমাকে জোর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।”

রাজকুমার বলল, “ তারপর এখানে আমাদের বুদ্ধ বানাতে এসেছিস? তুই কি ভেবেছিস, সময়ের অসঙ্গতি স্যার ধরতে পারবে না?”

লোকটা আমায় বলল, “না স্যার, আমি কোন উপায় না দেখে ভবানীপুরে আমার এক বন্ধুর কাছে যাই, সে তখন ওই মাঝেরহাটের গল্পটা বানিয়ে আপনার কাছে এসে বলতে বলল।”

বললাম, “তবে এখন বাড়ি যা।” সে আবার কেঁদে উঠে বলল, “বাড়ি যাব কি করে? দাদা আমায় আস্ত খেয়ে নেবে।”

ওই নোংরা চরিত্রের লোকটার আমাদের বোকা বানাতে আসার সাহস দেখে এমনিতেই ওর ওপর প্রচণ্ড রাগ ধরছে, সেই রাগের স্বরেই বললাম, “তা আমরা কি করব?”

বেহায়া লোকটা বলল, “ওর কাছ থেকে যদি উদ্ধার করে দেন।” বললাম, “কে কোথায় যাবে, আর টাকা দিয়ে আসবে, সেটা গিয়ে আমরা উদ্ধার করে আসব, এ জন্য কি এখানে বসে আছি? অন্য কোন কাজ নেই?”

লোকটা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “কিন্তু টাকাটা না পেলে আমি আর বাঁচব না স্যার, এমনিতে অনেক জমি জায়গা বিক্রি করে ওকে দিয়েছি। এবার কি করব জানি না।”

কি আর করি? রাজকুমারকে বললাম, “দুজন কনস্টেবল নিয়ে দেখ, উদ্ধার করতে পারিস কিনা।” রাজকুমার আমার নির্দেশ শুনে লোকটাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

রাজকুমাররা যখন ঠাকুরপুকুরে সেই বাড়ির কাছে পৌঁছল তখন রাত দশটা বাজে প্রায়। নির্জন, গ্রাম্য মত পরিবেশ। গিয়ে দেখল, বাড়ির সামনে তালা ঝুলছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর রাজকুমার যখন ভাবছে ফিরে আসবে, সে সময় একটা ট্যাক্সিতে অন্য একটা লোকের সঙ্গে টাল খেতে খেতে মহিলা নামল।

মহিলা রাজকুমারদের সাথে লোকটাকে দেখেই গালাগালি করতে লাগল। সঙ্গের পুরুষটা রাজকুমারদের ভেবেছে মাস্তান, সে বীরত্ব দেখাতে চেষ্টা করল। মাতলামি যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন রাজকুমার তার কলারটা চেপে ধরে বলল, “আমরা লালবাজার থেকে এসেছি, একটাও কথা বলবি না। তাহলে তুলে নিয়ে যাব।”

রাজকুমারের কঠিন, রক্ত হিম করা গলা শুনে মাতালের নেশা মাথা থেকে নেমে পায়ে গিয়ে পৌঁছল।

মহিলা ততক্ষণে অশ্রাব্য ভাষায় লোকটার সাথে ঝগড়া করতে করতে দরজার তালা খুলে ঘরে ঢুকল।

রাজকুমাররা টাকার থলিটা উদ্ধার করল। কিন্তু তাতে দেখা গেল কুড়ি হাজার টাকা কম। লোকটা মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, “কেন কুড়ি হাজার টাকা কম?” মহিলা বলল, “আমার ব্যবসার টাকা থেকে ভাইকে দিয়েছি ব্যবসা করতে।”

রাজকুমার বের হয়ে এল। লোকটা থলি নিয়ে চলে গেল।

তাই ঘটনার বিবরণ নেওয়ার সময় মাথা খুব ঠাণ্ডা রেখে প্রত্যক্ষদর্শীকে বলতে দিতে হয়। প্রশ্নের পর প্রশ্নের জালে জড়িয়ে ঘাবড়ে দিতে নেই। করার মত প্রশ্ন থাকলে তবেই প্রশ্ন করতে হয়।

বর্ধমান ব্যাঙ্কের ভদ্রমহিলা চোখ বুজে ফ্ল্যাশ ব্যাক দেখে নিয়ে ঘটনার বিবরণ দিয়ে গেলেন। কখন ডাকাতিটা হল, কিভাবে ডাকাতরা এসে সবাইকে হুমকি দিয়ে টাকা নিয়ে চলে গেল। তিনি জানালেন, ডাকাতরা সংখ্যায় ছ-সাতজন ছিল, বয়স সব তিরিশের আশেপাশে।

তাঁর কথা শেষ হলে প্রশ্ন করলাম, “তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই কাউকে মনে হয়েছে সেই-ই লিডার, অর্থাৎ ডাকাতিটার নেতৃত্ব সে দিচ্ছে?” তিনি সাথে সাথে বললেন, “হ্যাঁ, তা মনে হয়েছে।” জানতে চাইলাম, “তার চেহারাটা কেমন?” এবার তিনি বললেন, “বেঁটে, কালো, মাঝারি ধরনের স্বাস্থ্য।” আবার আমাদের প্রশ্ন, “তার মুখটা নিশ্চয়ই মনে আছে, আচ্ছা তার মুখের আদলটা কেমন ছিল বলতে পারেন, তা কি গোলাকার না চৌকো, না কি অন্যরকম, ধরুন লম্বা বা কি ধরনের?” ভদ্রমহিলা ভাবতে লাগলেন, আমি বললাম, “দাঁড়ান, আমি আসছি।” তারপর আমার কাছে রাখা বিভিন্ন রকম মুখের ফটো এনে টেবিলের ওপর রেখে বললাম, “এবার বলুন, কোন রকম।” তিনি দেখালেন। বললাম, “ঠিক আছে আপনি যান।” মহিলা চলে গেলেন অন্য ঘরে।

এবার অন্য এক ভদ্রলোককে ডাকা হল, তাকেও ওই একই প্রশ্ন করা হল। তিনি উত্তর দিলেন, “ছেলেটার মুখ একটা অদ্ভুত ধরনের, সচরাচর দেখা যায় না। ত্রিকোণ টাইপের।” তাঁকেও ফটোগুলো দেখালাম। তিনিও ভদ্রমহিলা যে ফটোটা চিহ্নিত করেছেন, সেটাই দেখালেন। মুখটা অনেকটা ইংরেজি “ভি” অক্ষরের মত। আমরা প্রশ্ন করলাম, “ঠিক বলছেন তো?” তিনি দ্রুত বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ।”

ভদ্রলোককে ছেড়ে দিয়ে আমরা নিজেরা কিছুক্ষণ আলোচনা করে নিলাম। তারপর একে একে চারজন ব্যাঙ্ক কর্মচারীকে ডেকে সেই ফটোগুলো দেখিয়ে প্রশ্ন করা হল, ডাকাত সর্দারের মুখের আদলটা কেমন। তারাও সবাই “ভি” আদলের ফটোর মুখটা দেখিয়ে দিল।

তখনও আটজনকে আমাদের প্রশ্ন করা বাকি ছিল। কিন্তু আমরা ঠিক করলাম আর কাউকে প্রশ্ন করব না। সেই অনুযায়ী আমি এস. পি. সাহেবকে গিয়ে বললাম, “স্যার, আপনি ব্যাঙ্কের কর্মচারীদের বর্ধমানে ফিরে যেতে বলতে পারেন, আমাদের যা জানার জেনে নিয়েছি। আপনাকে আমরা দুচার দিনের মধ্যেই খবর দিচ্ছি কতদূর কি করতে পারলাম, আর প্রয়োজন হলে আমরা আপনার সাথে যোগাযোগ করে নেব।” এস. পি. আহমেদ সাহেব ব্যাঙ্কের কর্মচারীদের নিয়ে লালবাজার থেকে চলে গেলেন।

আমাদের জানা এক “ডি” আদল মুখের ডাকাত ছিল। তাকে অনেক আগেই দুটো ডাকাতির মামলায় ধরেছিলাম। সে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তার গড়িয়ার বাড়িতে বাস করত। “ভি” আদলের আর কোনও ডাকাতকে আমরা জানতাম না। আমাদের কাছে রাখা, সেই ডাকাতের জবানবন্দি নিয়ে আসলাম, সেটা পড়ে আমরা আলোচনা করে ওর গতিবিধি ও মোডাস অপারেন্ডি খুঁটিয়ে দেখে নিলাম। দিন কয়েক আগে আমরা এক সোর্সের কাছে খবর পেয়েছিলাম, সে গোসাবায় এক গরুর মেলায় চরকির জুয়া চালাচ্ছে। তবুও আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম তাকেই আগে গ্রেফতার করা হবে। তখন যদি দেখা যায় সে ওই ডাকাতির সঙ্গে যুক্ত নয়, তারপর নতুন করে সিদ্ধান্ত নিয়ে তদন্তে এগিয়ে যেতে হবে। এস. পি. সাহেব বর্ধমান থেকে এসে যখন আমাদের শরণাপন্ন হয়েছেন, তখন তাঁর সম্মানটা তো আমাদের রাখতেই হবে।

সেদিন রাতেই আমাদের অফিসাররা সেই “ভি” মুখের ডাকাতের গড়িয়ার বাড়িতে হানা দিল। বাড়ি ঘিরে ফেলতে, ডাকাতের বৌদি আর স্ত্রী ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, যাকে আমরা খুঁজছি সে বেশ কিছুদিন হল বাড়িতে নেই। সে তার দাদার শালীকে নিয়ে কোথায় গেছে কেউ বলতে পারল না।

তার একটা বিশেষ কৌশল ছিল, ডাকাতি করার কদিন আগে সে নিজের বাড়ি থেকে অন্য জায়গায় চলে যেত, কোথায় যেত কাউকে বলত না। এমন কি বাড়ির লোকজনকেও জানাত না। এবারও গিয়ে যখন পাওয়া গেল না, তখন ধারণা হল, সে এবারও একই কৌশল নিয়ে আগের থেকেই আস্তানা পাল্টেছে। ওই বাড়িতে দক্ষিণ ভারতীয় এক ভদ্রলোক পেয়িং গেস্ট হিসাবে থাকতেন। আমাদের অফিসারেরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য লালবাজারে নিয়ে এলেন।

তাঁরা তাকে এই বিশ্বাসে আনলেন যে, যেহেতু সে দক্ষিণ ভারতীয়, তাই ভয়ে আমাদের কাছে অন্তত মিথ্যা বলবে না। সেই ভদ্রলোককে প্রশ্ন করাতে তিনিও বললেন, যাকে খুঁজছি, সে এখন নিজের স্ত্রীকে ছেড়ে দাদার শালীকে নিয়ে থাকে। কোথায় এখন আছে, তিনি সঠিক বলতে পারবেন না। তবে সে মাঝে মধ্যে কোন্নগর যেত এক ভদ্রলোকের বাড়িতে, কেন যেত তা তিনি জানেন না। কোন্নগরের ঠিকানাটা তার পুরনো বিবৃতি থেকে আমরা সেটা পেয়ে গেলাম।

আমাদের অফিসাররা পরদিন বিকেলেই কোন্নগর গিয়ে পৌঁছল। কোন্নগরে সেই বাড়িতে সে একটা মেয়ের কাছে যেত। তাকে না পেয়ে তার ভাইকে লোকটার গতিবিধি সম্পর্কে প্রশ্ন করাতে সে বলল, “তাদের বাড়িতে সে ইদানীং কমই আসত, কিন্তু ওই পাড়ার প্রদীপ নামে এক চাল বিক্রেতার কাছে সে আসত, সেই প্রদীপ হয়ত কিছু জানলেও জানতে পারে।”

সেদিন ছিল কালীপুজোর রাত। রাত তখন প্রায় নটা বাজে। ছেলেটা প্রদীপের বাড়ি দেখিয়ে দিলে, অফিসাররা প্রদীপের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারল, প্রদীপ নেই। কোথায় আছে কেউ বলতে পারবে না।

কালীপুজোর রাত, চারিদিকে বাজি পুড়ছে, ফাটছে, বাচ্চারা হৈ চৈ করে আনন্দে মত্ত। অফিসাররা ফিরে না এসে প্রদীপের পাড়ার কালীপুজোর প্যান্ডেলের দিকে এগিয়ে গেল। সঙ্গে সেই ছেলেটা, কারণ প্রদীপকে তো আমাদের কেউ চেনে না। তাই ছেলেটার সাহায্যের দরকার। আমাদের লোকেরা চুপিসাড়ে কায়দা করে প্যান্ডেলটা মোটামুটি ঘিরে ফেলল, যাতে প্রদীপ থাকলে পালিয়ে না যেতে পারে। প্যান্ডেলে গিয়ে প্রদীপের খোঁজ করতে প্যান্ডেলে বসে থাকা ছেলেগুলো জানাল, প্রদীপ সেখানে আসেইনি। এমন সময় রাজকুমার লক্ষ্য করল, একটা ছেলে প্যান্ডেলের পাশ দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে প্যান্ডেল থেকে পালানোর চেষ্টা করছে। রাজকুমার আস্তে আস্তে প্যান্ডেলের পেছন দিক দিয়ে গিয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল।

ছেলেটা প্যান্ডেলের কাপড় তুলে যেই বের হল, রাজকুমার খপ করে ওকে ধরে ফেলে বলল, “কি রে প্রদীপ পালাচ্ছিস যে খুব, ভেবেছিস আমরা তোকে চিনি না, এখন চল, আমাদের সাথে লালবাজার।”

রাজকুমার প্রদীপকে সত্যিই চিনত না, কিন্তু ওর হামাগুড়ি দিয়ে পালানোর চেষ্টা দেখেই সন্দেহ হয়েছিল, আর তখনই ওকে ঝপ করে ধরে আন্দাজে ঢিল মারল। আর তাতেই প্রদীপ কাৎ। সে কোনমতে বলল, “আমি কিছু জানি না, আমায় কেন ধরছেন আপনারা?” রাজকুমার জানতে চাইল, কিছু যদি না জানিস, তবে পালানোর চেষ্টা করছিলি কেন? ঠিক আছে কি জানিস না জানিস পরে বোঝা যাবে। প্যান্ডেল থেকে চল, তোকে আমাদের দরকার।”

রাজকুমার ও অন্য অফিসাররা প্রদীপকে প্যান্ডেলের বাইরে নিয়ে এসে জানতে চাইল, যার সন্ধানে ওখানে তারা গিয়েছে সে এখন কোথায়? প্রদীপ বলল, “জানি না। সে অনেকদিন হল আমার কাছে আসেনি।” রাজকুমার বলল, “ঠিক আছে, তবে চল, আমাদের সাথে। সেখানে গিয়ে বলবি, কি জানিস না জানিস।” প্রদীপকে নিয়ে এসে তারা লালবাজার লকআপে ঢুকিয়ে যে যার বাড়ি চলে গেল।

পরদিন সকালবেলা, প্রদীপকে লকআপ থেকে নিয়ে আসা হল। তাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “প্রদীপ, সে কোথায় আছে বল, নয়ত, তার বদলে তোকেই ডাকাতির কেসে চালান করে দেব।” শেষের কথাটা ওকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য বললাম। কাজ হল, প্রদীপ হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে বলল, “আমি ডাকাতির কিছু জানি না, সে খুব সম্ভবত ব্যান্ডেলে আছে।” প্রশ্ন করলাম, “ব্যান্ডেলে কোথায় আছে বল?” প্রদীপ বলল, “ব্যান্ডেল স্টেশনের রেল কোয়ার্টারের পাশে একটা ঘরে।” বললাম, “ঠিক আছে, তুই আমাদের সাথে যাবি, দূর থেকে দেখিয়ে দিবি, সে বুঝতেই পারবে না যে তুই ওর বাড়িটা দেখিয়ে দিয়েছিস। সুতরাং তোর কোনও ভয় নেই।”

সেই অনুযায়ী আমাদের লোকেরা দুটো গাড়ি নিয়ে প্রদীপকে সাথে তুলে ব্যান্ডেলের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেল। ব্যান্ডেলে পৌঁছে স্টেশনের পাশে রেলের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কোয়ার্টারের পাশে একটা দরমার বাড়ি দেখিয়ে প্রদীপ বলল, “ওই বাড়িতে সে দিন পনেরো হল দাদার শালীর সাথে ঘর ভাড়া নিয়ে আছে।”

প্রদীপকে গাড়িতে বসিয়ে আমাদের বাহিনী ওই দরমার বাড়িতে হানা দিল, এবং তাকে পেয়ে গেল। পুলিশ দেখে সে তো ভূত দেখার মত চমকে তাকিয়েই অভিনয় শুরু করল। প্রথমেই সে প্রশ্ন করল, “আপনারা?”

রাজকুমার তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, “সুভাষ মজুমদার, তুই নিজেকে খুব চালাক মনে করিস, না? প্রতিবার ডাকাতির আগে ঠেক পাল্টে ভাবিস তোকে আমরা খুঁজে পাব না, এবারও ভেবেছিস বর্ধমানে ডাকাতি করে এখানে এসে পার পেয়ে যাবি, না?” সে বলল, “আমি কিছুই জানি না স্যার, আমি কোনও ডাকাতিই করিনি।” ততক্ষণে ওর নতুন সংসারে আমাদের লোকেরা তল্লাশি শুরু করেছে, জিনিসপত্র সব নতুন, কিন্তু ডাকাতির কোনও কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না।

অফিসাররা ধন্দে পড়ে গেল, সত্যিই কি সুভাষ বর্ধমানে ডাকাতি করেনি, আমরাই কি ভুল করলাম? কিন্তু এতসব নতুন বিছানাপত্র, থালাবাসন আর অন্যান্য জিনিস ঘরে সাজান, তা কেনার এত টাকা একসঙ্গে পেলই বা সে কি করে? কেনই বা সে ব্যান্ডেলে এসে থাকতে শুরু করেছে? কেনই বা তার বাড়ির লোককে না বলে সে আত্মগোপন করে আছে ব্যান্ডেলে? দাদার শালীকে নিয়ে যে থাকে, তা তো তার বাড়ির লোকজন সবই জানে। সেই মহিলাও আছে, তার শরীর দেখে সবাই বুঝল মহিলা সন্তানসম্ভবা এবং খুব সম্ভবত মাসখানেকের মধ্যেই মা হতে চলেছে।

অত সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে তারা সুভাষকে লালবাজারে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করাই শ্রেয় মনে করে বলল, “ঠিক আছে, চল, তুই যদি ডাকাতি নাই করে থাকিস, তবে ওখান থেকে তোকে ছেড়ে দেব, এখন আমাদের সাথে তোকে যেতে হবে।” সুভাষ আমাদের জানে। ফালতু কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। বিনয়ের সাথে বলল, “চলুন, যেতে যখন হবে।” সুভাষকে ঘর থেকে নিয়ে আসার সময় সুভাষের দ্বিতীয় স্ত্রী চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। রাজকুমার ভাবল, এই মহিলাকে এই অবস্থায় একা এখানে ফেলে রাখা ঠিক হবে না। একেও কলকাতায় নিয়ে যাওয়া উচিত। সে মহিলাকে বলল, “আপনিও চলুন আমাদের সাথে।” মহিলা ভ্যাবাচাকা খেয়ে প্রশ্ন করল, “আমি, আমি যাব?” রাজকুমার বলল, “হ্যাঁ।”

রাজকুমারের ছ’ফুটের ওপর বলিষ্ঠ চেহারার সামনে সেই মহিলা আর কি উত্তর দেবে, তাড়াতাড়ি বেরনর জন্য তৈরি হয়ে নিল, তারপর মাটির বারান্দায় রাখা একটা ঘুঁটের বস্তা ঘরে টেনে নিয়ে গেল। তা দেখে, রাজকুমারের সন্দেহ হল, সে ঘুঁটের বস্তাটা এক টানে উপুড় করে দিল। ঝপঝপ করে ঘুঁটে পড়তে পড়তে হঠাৎ টাকার বান্ডিল পড়তে লাগল। সে একটা বান্ডিল তুলে দেখল তখনও বর্ধমানের ব্যাঙ্কের স্লিপ তাতে লাগান।

রাজকুমার একটু হেসে সুভাষকে জিজ্ঞেস করল, “কিরে সুভাষ তুই নাকি বর্ধমানে ডাকাতি করিস নি? লালবাজারে গিয়ে তো রুণুবাবুর কাছে সবই বলে দিতিস ফটফট করে, তখন আমাদের আবার ঝামেলা হত, তোকে নিয়ে আবার ব্যান্ডেলে আসতে হত এই টাকাগুলো নিতে। আমাদের তো চিনিস। ঠিক আছে, চল।” “ভি” আদলের মুখের মালিক সুভাষ মজুমদার তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

তারপর তারা সুভাষের বাড়িতে পাওয়া টাকা ও অন্যান্য জিনিসের সিজার লিস্ট বানিয়ে সুভাষ ও সেই মহিলাকে নিয়ে কলকাতার দিকে রওনা দিল। লালবাজারে পৌঁছে তাকে আমার কাছে নিয়ে এল।

আমি বর্ধমানের এস. পি. আহমেদ সাহেবকে টেলিফোনে যোগাযোগ করে বললাম, “স্যার, আপনার মূল আসামীকে ডাকাতির টাকা সমেত আজ আমাদের অফিসাররা গ্রেফতার করে এনেছে, আপনি এসে নিয়ে যান।” পরদিন বর্ধমান থেকে এস. পি. সাহেব সঙ্গে অন্যান্য, অফিসার ও সিপাই নিয়ে এসে হাজির। আমরা তাদের হাতে সুভাষ মজুমদারকে ও ব্যাঙ্কের ডাকাতির টাকা তুলে দিলাম। ডাকাতির ধরন দেখে তাঁর সন্দেহটা সঠিক হয়েছিল বলেই খুব তাড়াতাড়ি টাকা সমেত ডাকাত ধরা পড়ল।

আমরা সুভাষের দ্বিতীয় স্ত্রীকে ছেড়ে দিলাম, কারণ তখন সে মা হতে চলেছে। যদিও আইনের চোখে সেও অপরাধী, কারণ ডাকাতির টাকা লুকিয়ে রাখার অপরাধ সে তখন করে বসেছে, তার বিরুদ্ধেও সাজাযোগ্য মামলা হতেই পারে। কিন্তু মানবিক কারণটাকেই আমরা প্রাধান্য দিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *