সাদা আমি কালো আমি – ১.১৬

১৬

নকশাল আন্দোলন এরপর আস্তে আস্তে প্রায় থেমে গেল। আমাদের ছোটাছুটি অনেক কমে গেল। তারপর থেকে লালবাজারে বা রাস্তাঘাটে যখনই পরিচিত পুরনো নকশাল নেতা বা কর্মীদের সাথে দেখা হয়েছে তখনই তাদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছি, “কি কারণে তারা ব্যর্থ হল?” কিন্তু যুক্তিপূর্ণ কোন সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা কারও কাছে পাইনি। আমাদেরও প্রয়োজনে মার্কসবাদ কিছু পড়াশুনা করতে হয়েছে। জানতে হয়েছে। সে অনুযায়ী বিখ্যাত এক তরুণ নকশাল নেতার সঙ্গে আলোচনা করে বুঝেছিলাম, তাঁর বোধহয় মার্কসবাদের গোড়ার কথা “দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ” সম্পর্কেই কোনও ধ্যান ধারণা নেই, অথচ তিনি কাগজপত্রে বিরাট মার্কসবাদী নকশাল নেতা! নকশালদের অনেক নেতা ও কর্মী পরবর্তীকালে আমাদের কাছে এসেছে বিভিন্ন প্রয়োজনে। তাদের অনেককে আমি প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছি, চাকরি বাকরি করে দিয়েছি। প্রয়োজনমত সমস্যার সমাধান করে দিয়েছি। একবার এক তুখোড় নকশাল নেতা ও পরবর্তীকালের সাহিত্যিক, আমার কাছে এসে বললেন, “আমার মেয়েটা এক বখাটে মাড়োয়ারি ছেলের সাথে প্রেম করে, তাকেই বিয়ে করে চলে যেতে চায়, আপনি একটা ব্যবস্থা করুন যাতে বিয়েটা বন্ধ করা যায়।” আমি সেই উচ্চবিত্ত পরিবারের নকশাল নেতাকে বললাম, “ঠিক আছে, আমি মাড়োয়ারি ছেলেটাকে ভাগিয়ে দেব, যাতে সে আপনার মেয়ের পেছনে আর না লাগে। কিন্তু আপনার মেয়ের দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে, যাতে তারপরে আর সে ছেলেটার কাছে না যায়।” সেই প্রাক্তন নেতা বললেন, “আপনি আর কি করবেন, আমার মেয়ের দায়িত্ব আমিই নেব।” তারপর সেই নেতা মাড়োয়ারি ছেলেটার নাম-ঠিকানা আমার কাছে দিয়ে চলে গেলেন। আমি পরদিনই ছেলেটাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এমন ধমক দিলাম যে সে কান্নাকাটি করে বলে গেল, জীবনে আর ওই মেয়ের মুখ দেখবে না। তারপর মেয়েটির অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়।

হাজারও ছোট ছোট দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে নকশাল আন্দোলন অনেকদিন হল শেষ হয়ে গেছে। সাতাত্তর সালে প্রথম বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে তাঁদের জেল থেকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছে। আমরা তখন রাজনৈতিক আন্দোলন মোকাবিলা করার থেকে অন্য কাজে ব্যস্ত। সে সময় আশির দশকের মাঝামাঝি একদিন বিকেলে লালবাজারে বসে আছি আমরা অনেকে। দেখলাম, অনন্তবাবুর দলের রাজারাম চৌধুরী এসেছে আমাদের দফতরে। তার পাড়ার একটা অল্পবয়সী মেয়ে দুদিন ধরে নিখোঁজ, সেই খবরটা আমাদের মিসিং স্কোয়াডে লেখাতে এসেছে। আমি তাকে ডাকলাম আমাদের কাছে, এমনিতে আমরা প্রত্যেকে ওদের ভীষণ ভালবাসতাম। তাকে চা খেতে দিলাম, চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, এখন কি করছে। রাজারাম জানাল। তারপর তাকে সেই প্রশ্নটা করলাম, “কি কারণে নকশাল আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে?”

সে আমার প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বলে আমি মানি না, যেমন ধরুন দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহসটা নকশাল আন্দোলনের ফলেই সামনে এসেছে, এবং দুর্নীতিকে শেষ করতে গেলে যে ডাণ্ডাটাই একমাত্র কার্যকরী সেটাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সেইসময় কি আপনারা দেখেন নি সমস্ত দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষেরা লুকিয়ে পড়েছিল? এমন কি পাড়ায় পাড়ায় ছোট খাট মাস্তানরা পর্যন্ত ভয়ে মেয়েদের টিটকারি দিত না। তাছাড়া ভারতবর্ষের সমস্ত রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতারা যে বদমাইস এবং ভণ্ড সেইটা কিন্তু নকশাল আন্দোলনের ফলেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। তাঁদের মুখোশ খুলে গিয়েছে। আর আমাদেরও জানা হয়ে গিয়েছে যে ভারতবর্ষে কোন কমিউনিস্ট পার্টি নেই, কোনও কালে সাইনবোর্ড সর্বস্ব ছাড়া কিছুই ছিল না। এগুলো সবই নকশাল আন্দোলনের ফল। আর ব্যর্থতারও কিছু কারণ আছে। মাও সে-তুং বলেছিলেন, নীতি যদি সঠিক থাকে তবে কিছু না থাকলেও সবকিছু পাওয়া যায়, জয় হয়। আর নীতি যদি বেঠিক থাকে তবে সব কিছু থাকলেও শেষে সব কিছু হারিয়ে ফল হয় শূন্য। তার মানে আমাদের নীতি সঠিক ছিল না, এটাই ব্যর্থতার মূল কারণ। আর লেনিন রুশ বিপ্লবের পর বলেছিলেন, রাশিয়াতে যেভাবে বিপ্লব সংগঠিত হল, তা পৃথিবীতে একবারই হল, এরকম আর হবে না, অন্য কোনও দেশের কমিউনিস্টরা যেন রুশ বিপ্লবের অনুকরণ না করেন। লেনিনের এই শিক্ষাটা আমরা ভারতীয়রা কখনও শুনিনি, সবসময় আমরা অন্যান্য দেশের অনুসরণ করে গেছি, বুঝে অথবা না বুঝে, কখনও রাশিয়া কখনও বা চীন ও ভিয়েতনামের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে। অথচ ভারতবর্ষের পরিস্থিতির কোন বিশ্লেষণই আমরা করিনি, যা করা হয়েছে সবই অপক্ক, ভাসা-ভাসা। তাই আমরা এই দেশে কি ভাবে বিপ্লব করব, যে দেশটাকে চিনিই না?

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তা এই যে এত বিশ্লেষণ, লেখালেখি, এগুলো তবে কি?” রাজারাম নির্দ্বিধায় বলল, “সব টুকলিফাইয়িং, নিজেদের বিশ্লেষণ একটাও নয়, দেশের অবস্থান বুঝতে যে ব্যাপক অনুসন্ধান দরকার তা কোনদিনও হয়নি। অন্য দেশের নেতারা যা বলে দিয়েছেন, তা না বুঝেই আওড়ে গেছি।” প্রশ্ন করলাম, “এসব কি নেতারা জানত না?” সে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ ভালভাবেই জানে, আমার চেয়ে কি আর তারা কম মার্কসবাদ পড়েছে? তা না, আসলে এখানেই তো বিশ্বাসঘাতকতা, দালালী। আর তাছাড়া ভারতবর্ষের বিপ্লবী প্রয়াসে সবসময়ই নেতৃত্ব দিয়েছে মধ্যবিত্তরা, যে মধ্যবিত্তদের জন্ম দিয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের নিজেদের প্রয়োজনে। তাই সেই ব্রিটিশের ঔরসজাত মধ্যবিত্তরা একটা দূর পর্যন্ত যেতে পারে, তারপরই তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়, আত্মসমর্পণ করে বসে। এমন কি এই মধ্যবিত্তরা ট্রেড ইউনিয়নে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শ্রমিকদের মধ্যেও নিজেদের সমস্ত সুবিধাবাদী মানসিকতা ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাই শ্রমিকরা এখন অর্থনৈতিক আন্দোলন ছাড়া অন্য আন্দোলনে কোনও উৎসাহই পায় না। আর আমরা, নকশালরা তো প্রকৃতপক্ষে শ্রমিকদের সংগঠিতই করতে পারিনি। বাকি প্রায় সব শ্রমিক নেতা মাসে একবার ইউনিয়নে যায়, মাসকাবারী মাইনে নেওয়ার জন্য নেতারা তো পরস্পরের পিঠ চুলকে আরামেই আছে।”

রাজারাম একটানা বলে চুপ করে গেল। আমরাও চুপ করে আছি। হঠাৎ সে বলে উঠল, “অবশ্য এসব আপনাদের বলে কোনও লাভ নেই, তবু প্রশ্ন শুনলেই বুকের জ্বালাটা বেরিয়ে আসে।” রাজকুমার ও আমার সহকর্মী তখন রাজারামকে প্রশ্ন করল, “তুই যদি সবই বুঝিস, তবে রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে বসে গেলি কেন?” রাজারাম এবার হেসে উত্তর দিল, “দূর, আমি লেনিনও নই মাও সে-তুংও নই যে এতবড় দেশের বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে পারব। এখন ওদের মত কাউকে চাই একদম প্রথম থেকে শুরু করার জন্য। আমি জানি পারব না, তাই চুপ করে গেছি। সাধারণ জীবন যাপন করছি! সেটাও খুব কঠিন, রাজনীতির ব্যবসার চেয়ে কঠিন তো বটেই, তবে, না-থাক—।” এই পর্যন্ত বলে সে চুপ করে গিয়ে বলল, “আজ আমি যাই”, রাজারাম উঠে পড়ল। চলে গেল। আমরা সবাই চুপ করে বসে রইলাম। এরপর আর কোনদিন কোনও নকশাল কর্মী বা নেতাকে তাদের আন্দোলন কি জন্য ব্যর্থ হয়েছে সে প্রশ্ন করিনি।

তারপর থেকে ওই প্রশ্ন কলকাতা পুলিশের কোনও অফিসারকে কি করতে হয়েছে? মনে হয়, হয় নি। কারণ ‘বিপ্লবী আন্দোলনের কোনও রকম ঝড় ঝাপটার মোকাবিলা তাঁদের করতে হয়নি। গলিতে গলিতে আরবান গেরিলাদের সাথে লড়তে হয়নি। যারা তেমন কর্মকাণ্ড করবে বলে ঘোষণা করেছিল, তারা তো নন্দন, চ্যাপলিন আর রূপায়ণ নিয়ে ব্যস্ত। জমির দালালী আর দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াতেই বেশি সময় ব্যয় করে, সুতরাং কি আর বিশেষ এখন কাজ আছে কলকাতা পুলিশের? তাতেই নাকানিচোবানি। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্যই প্রাক্তনদের কুৎসা গেয়ে বেড়ানটাই তাদের কর্মের শীর্ষস্থানে রয়েছে।

মধ্যবিত্তের চরিত্রের একটা অদ্ভুত রূপ, ব্যর্থতার দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেকে কর্মবীর হিসাবে প্রচার করে দায়মুক্ত থাকার অপচেষ্টা। পুলিশে চাকরি করতে এসে যে সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে, তাকে এড়িয়ে অন্য কাজে নিজেকে মগ্ন রাখলে তার আর পুলিশে চাকরি করতে আসা উচিত নয়।

বর্তমানে দেখি, পুলিশের নিচুতলার কিছু কর্মীকে বিভিন্ন সমাজবিরোধী দুষ্কর্মে অংশ নিতে। তার দায় যাদের তাঁরা কি সেটা বন্ধ করার কোনও সক্রিয় চেষ্টা করছেন? তাঁরা কি কখনও ভেবে দেখেছেন কি কারণে বাহিনীর লোকেরা জড়িয়ে পড়ছে? বাহাত্তর সাল থেকে যে মূল্যবোধহীন সামাজিক অবক্ষয় পশ্চিমবঙ্গকে গ্রাস করেছে, তার থেকে উঠে আসা যে সব লোকেরা পুলিশে যোগ দিচ্ছে, তাদের মানসিকতা পরিবর্তন না করেই তারা বাহিনীতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ফলে তারা সমাজবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ট্রেনিংয়ের সময় চরিত্র গঠনের জন্য যে ঝাড়াইপোছাই দরকার তার দিকে যাঁদের নজর দেওয়া উচিত তাঁরা সেই কাজটা ঠিকমত করছেন কি? করছেন না বলেই এত বদনাম। আর সেই বদনামের দায় কিন্তু তাঁরই যিনি যখন থাকেন গৃহকর্তার দায়িত্বে। খরগোশের মত গর্তে মুখ লুকিয়ে কেউ যদি ভাবে তার কর্ম অন্যেরা দেখল না তবে তার মত মূর্খ কজন হয়? হয় না। সেই সব খরগোশদের আর যাই করা উচিত পুলিশে চাকরি করা উচিত নয়, কারণ পুলিশে চাকরি করতে হলে ন্যায়ের পক্ষে প্রিয়–অপ্রিয় সবরকম কাজ করতে হবে। পুলিশের চাকরি তো মুখস্ত করা বই নয়, যে পরীক্ষায় মুখস্ত করা পড়া ছাড়া অন্য কিছু লিখব না। এটা বড় বাস্তববাদী, র‍্যাশনাল, সামাজিক কাজ। এখানে মুখস্ত বিদ্যার কোনও স্থান নেই। স্থান আছে বোধের। যে বোধের মর্যাদা দিতে পুলিশকেও অনেকসময় করতে হয় অদ্ভুত কাজ। যা হয়ত কারও চোখে কালো আর কারও চোখে সাদা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *