১৪
আমরা শান্তির কথা বললেও, নকশালরা কারোকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। ব্যক্তিহত্যাই তখন ওদের একমাত্র রাজনৈতিক কর্ম হয়ে উঠেছিল। ব্যক্তিহত্যা করেই সব সমস্যার সমাধান হবে, ভেবেছিল ওরা।
অনেকে বলেন, নকশালও তো অনেক মারা গেছে। হ্যাঁ গেছে। আপনি যদি কারোকে খুন করতে যান সেখানে আপনারও মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ওরা যখন “শ্রেণীশত্রু” খুন করবে, তখন ওদের “শ্রেণীশত্রুরা” কি মুখে আঙুল দিয়ে বসে থাকবে? তারাও বাঁচার অধিকার নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছে। আক্রান্ত হলে প্রতি আক্রমণ করার অধিকার কি আপনার নেই? আপনাকে যদি কেউ ছুরি-বোমা নিয়ে আক্রমণ করে আপনি কি বাঁচার চেষ্টায় হাতের সামনে যা পাবেন তাই দিয়ে আপনার খুনীকে প্রতি আক্রমণ করে নিজের মৃত্যুকে ঠেকাতে চেষ্টা করবেন না? নিশ্চয়ই করলে। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। পিঁপড়েকে মারতে গেলে পিঁপড়েও তার ক্ষমতা অনুযায়ী কামড় দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। আগুনে ঝাঁপ দিয়ে কেউ মরলে সে দোষ কি আগুনের না কি যে ঝাঁপ দেয় তার? একটা ঘটনার কথা এখানে বলি। আশুতোষ চ্যাটার্জি নামে এক নকশাল ছিল, যার অন্য দুটো নাম ছিল জন আর ক্যাপ্টেন। খুন করার পর নিহত ব্যক্তির মাথা নিয়ে ফুটবল খেলা ছিল তার নেশা। চারুবাবুর শিষ্য সেই বিপ্লবীকে আমরা সাঁকরাইলে গ্রেফতার করতে গেলাম। গভীর রাত, যে বাড়িতে সে ছিল আমরা সেটা ঘিরে ফেললাম। একটা ঘরে সে ঘুমচ্ছিল। হঠাৎ জেগে দেখে পুলিশ বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। বালিশের তলা থেকে একটা রিভলবার বার করে জন আমাদের গুলি করতে গেল। আমাদের পাল্টা গুলিতে সেখানেই লুটিয়ে পড়ল সে। তার রিভলবারটা লক হয়ে গিয়েছিল, তাই তার কোনও গুলি আমাদের দিকে আসতে পারেনি। সে যদি আমাদের দিকে রিভলবার নিয়ে আক্রমণ না করত, আমরাও তাকে প্রতি আক্রমণ করতাম না। সে বেঁচে যেত। খুনের রাজনীতির এই তো পরিণতি! আসলে ওরা হিংসা আর মৃত্যুর খেলায় এত মেতে উঠেছিল যে নিজেরাই জানত না কি করছে।
আর আমাদের এই নিয়েই সারাটা দিন, মাস, বছর লালবাজারে কাটাতে হত। এখানে খুন ছোটো, ওখানে সংঘর্ষ ছোটো, সেখানে রাহাজানি কিংবা ডাকাতি, ছোটো ছোটো। তদন্ত কর, খুনী ধর, সাক্ষী যোগাড় কর, আদালতে পাঠাও। জনসাধারণের নিরাপত্তার দায়িত্ব তোমার, আইন শৃঙ্খলার রক্ষী তুমি, বসে থাকলে চলবে কেন? সরকারে কে এল, কে গেল, তোমার দেখার প্রয়োজন নেই। তুমি কাজ করে যাও। যতদিন কাজ করছ ততদিন কোনও দিকে তাকাবার অবসর নেই।
সারা একাত্তর সাল জুড়ে নকশালরা আমাদের দম ফেলতে দেয়নি। একদিকে সরকারের চাপ, অন্যদিকে খুনের পর খুনের কিনারা করতে না পারার আগেই আবার খুন, নির্বিচারে খুন। তখন নাগরিকদের কোনও স্তরই খুনের আশঙ্কা ছাড়া দিন রাত পার করতে পারেননি। যদিও একাত্তরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে অধিকাংশ পুরনো নকশাল যুবকযুবতীকে আমরা গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু ওদের লুম্পেনদের “দেশপ্রেমিক” বানাবার প্রচেষ্টার ফলে ঝাঁকে ঝাঁকে সমাজবিরোধীরা ওদের দলে ঢুকে গিয়েছিল। লুম্পেনদের হাতে চলে গিয়েছিল ওদের পার্টির নেতৃত্ব। তারা কিছু একটা “কাজ” করে নিজেদের জাহির করার লোভে খেয়ালখুশি মত কাজগুলো করত। আর আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখতাম, চারুবাবুর লেখার মধ্যে সেইসব কাজের ভূয়সী প্রশংসা। অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। চারুবাবু নিজেই বলতেন উনি নাকি মাও সে-তুঙের থেকেও অনেক দূরের ভবিষ্যৎ দেখতে পান। কারণ হিসাবে উনি বলেছিলেন, “বাবা যেমন ছোট ছেলেকে কাঁধে চাপিয়ে রাস্তায় হাঁটলে বাবার থেকে ছেলে বেশি দূর পর্যন্ত দেখতে পায়, তেমনি তিনিও মাও সে-তুঙের কাঁধে চড়ে চলেছেন বলে তাঁর থেকে বেশি দেখতে পান।” অথচ ওঁকে কি কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, ছোট ছেলে বেশি দূর দেখতে পায় ঠিকই, কিন্তু কিছু চিনতে পারে কি? ছেলে বাবাকে জিজ্ঞেস করে, এটা কি, ওটা কি? বাবা তখন অবোধ ছেলেকে চিনিয়ে দেয় পৃথিবীর এটা আর ওটা, ভাল আর মন্দ।
শুনেছি এক বড় নকশাল নেতা যখন চীনে গিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, চৌ এন-লাই সেই নেতাকে মোটামুটি ধমকই দিয়েছিলেন। চারুবাবুর মস্তিষ্কপ্রসূত “চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান” স্লোগানের জন্য। তিনি সেই নকশাল নেতাকে নাকি বলেছিলেন, “আমাদের পার্টির চেয়ারম্যান আপনাদের পার্টির চেয়ারম্যান কবে থেকে হল? আমাদের পার্টি আলাদা, আপনাদের পার্টি আলাদা। আপনাদের পার্টির ভাল কি মন্দ কোনরকম কাজের দায়িত্বই আমাদের পার্টির চেয়ারম্যানের ওপর বর্তায় না, বর্তাবেও না কোনদিন। সুতরাং ওই রকম কথাবার্তা আর স্লোগান দেওয়া আপনারা বন্ধ করুন।”
মনে হয়, বাড়ির ছাদের ওপর টবের গাছ যদি মহীরূহ হওয়ার চেষ্টা করে তার পরিণতি যা হয়, এখানেও তাই হয়েছিল। একদিকে ব্যক্তিগত দম্ভ, অন্যদিকে হতাশা, দুইয়ে মিলে সন্ত্রাসবাদকে চালিয়ে যাওয়ার বসদ যুগিয়েছিল। চারুবাবুর রাজনীতির লাইসেন্স পেয়ে তাই লুম্পেনরা একদিকে দাদাগিরি, ‘অন্যদিকে সস্তার বিপ্লবী সাজার স্বাদ পেয়ে গিয়েছিল। আর রাজনীতি বলতে তো শুধু চারুবাবুর নাম জপ করা। যে যত চারুবাবুর নাম ভজনা করতে পারবে সে তত বড় নেতা! এই জপ করাটাই ওদের রাজনীতির প্রথম ও শেষ কথা। আর এর সঙ্গে যদি দু চারটে খুনের স্কোয়াডে থাকা যায় তাহলে তো সে অতি বড় বিপ্লবী। আর খুনেরও তো কোন বাছবিচার নেই। যে কোন লোককে ইচ্ছেমত “শ্রেণীশত্রু” বানিয়ে খুন করে দিলেই হল। তাতেই কেল্লা ফতে! দেশসেবার কি জ্বলন্ত নিদর্শন! এমনকি দরকার হলে নিজেদের লোককেই নিজেরা খুন করত। যেমন বাহাত্তরের এপ্রিলে ওদের পার্টির দক্ষিণ কলকাতা আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক কমল সান্যাল ও তার সঙ্গীকে কসবার বোসপুকুর মাঠে গভীর রাতে নিয়ে গিয়ে পুলিশের গুপ্তচর নাম দিয়ে খুন করে দিল। যাকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে তাকেই ওরা পুলিশের চর বলে খুন করে বড় বিপ্লবী বনে গেল।
নভেম্বরে দেওঘর থেকে অসীম চ্যাটার্জিকে গ্রেফতার করার সময় ওদের অনেকেই চারুবাবুর রাজনীতির অসারতা ও দেউলিয়াপনা বুঝে গিয়েছিল। দুচারটে পুলিশ, হোমগার্ড কিংবা নিরীহ মানুষ মেরে যে দেশের কোন উপকার হয় না তা তারা বুঝেছিল। কিন্তু অনেক দেরিতে, ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। অসংখ্য তরুণ তরুণী মারা গেছে, নিরীহ সাধারণ মানুষ খুন হয়েছে, অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে নিজের বাড়ি ছেড়ে মানুষজন পালিয়ে গেছে, জেলে জেলে কয়েক হাজার তরতাজা যুবক অযথা দিন গুজরান করছে। চরম ক্ষতি হবার যা, তা হয়ে গেছে। উদ্দেশ্য যতই মহৎ থাক, সঠিক পথ না জানা থাকলে, জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ গাইড সাথে না থাকলে কেউ কি হিমালয়ের শীর্ষে উঠতে পারে? পারে না। উল্টে বরফের অতল গহ্বরে অকালে হারিয়ে যায়। এখানে নকশালরা তো নিজেরা ঝরে গেলই, বাঙালির এতদিনের তিলে তিলে গড়া মনোবল ভেঙে চুরমার করে দিয়ে ভবিষ্যৎকে অন্ধকার পাতালে ফেলে দিল। পশ্চিমবাংলার মানুষ আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে গেল আর সেই পটভূমিতে বাহাত্তর সালে পশ্চিমবাংলার মানুষ একটা অদ্ভুত নির্বাচন দেখলেন। ওই রকম নির্বাচন তারা আগে কখনও দেখেননি, ভবিষ্যতেও কখনও দেখবেন কিনা জানি না। আর সেই ভোটের ফলে কংগ্রেস আবার ক্ষমতায় এল। অবশ্য রাষ্ট্রপতির শাসনের বকলমে ওরা মাঝেমধ্যেই শাসন চালিয়েছিল এবং নির্বাচনের সময়ও পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল।
ততদিনে নকশালরা বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত দিশাহীন ছোট ছোট ভ্রাম্যমাণ মাস্তান গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। আমাদের তাড়া ও ধরপাকড়ের জেরে ওদের নিজেদের মধ্যেই কোন যোগাযোগ রাখা সম্ভব ছিল না। ফলে হতাশায় যেখানে সেখানে যা ইচ্ছে তাই করতে লাগল তারা। আবার চারুবাবুর শিক্ষা মেনে পুরনো নকশালদের কোনও কথাই নতুনরা শুনত না। চারুবাবু ওদের শিখিয়েছিলেন, “নতুন পুরনো বিরোধে নতুনকে সমর্থন কর।” শুনতে হয়ত কথাটা ভাল লাগে, চমক লাগে। কিন্তু সেটা মানলে তো অভিজ্ঞতার কোন দামই দেওয়া হয় না। কোচিংয়ের কোন মূল্যই দেওয়া হয় না। চারুবাবুর বুলি আওড়ান সেইসব নতুন নতুন নকশালরা যারা অধিকাংশই লুম্পেন, ‘তারা পুরনোদের হটিয়ে “ভ্রাম্যমাণ গোষ্ঠী” নিয়ে এলাকায় এলাকায় দাপট দেখাতে লাগল। আর এদের কীর্তিকলাপে যেটুকু জনসমর্থন অবশিষ্ট ছিল, তাও হারাল নকশালরা। এমনও হয়েছে যেখানে ওরা রাতে আত্মগোপন করেছে, সেখানকার লোকেরাই লুকিয়ে এসে আমাদের খবর দিয়ে গেছে। আমরা গিয়ে ওদের ধরে নিয়ে এসেছি। আমরা অনেক এলাকায় নকশালদের ধরতে গিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে দারুণ অভ্যর্থনাও পেয়েছি। সহযোগিতা তো বটেই, অনেকে বাড়িতে ডেকে মিষ্টি খেতে দিয়েছে, বহুক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পেয়েছি। বিশেষ করে সি. পি. আই (এম) পার্টির নেতা ও কর্মীদের কাছ থেকে প্রচুর সাহায্য, খবর পেতাম। সেইসব সাহায্য ও সহযোগিতা না পেলে হয়ত আরও বহু অপকর্ম আমাদের দেখতে হত।
অন্যদিকে এও জানি, বহু সাধারণ মানুষ অযথা হয়রানির শিকার হয়েছেন আমাদের অভিযানে। সেজন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আসলে আমাদের উপায় ছিল না। হয়ত খবর পেলাম, অমুক জায়গায় নকশালরা গোপনে মিটিং করছে, কিংবা অমুক এলাকায় ওদের জমায়েত হয়েছে, আমাদের তখন কি করণীয় থাকত? একদিকে ওদের অধিকাংশ কর্মীরই কোনও ফটো আমাদের কাছে ছিল না। চিনতামই না, শুধু ওদের সংগঠনের ভেতরে আমাদের যেসব সোর্স ছিল তাদের দেওয়া বিবরণ তো যথেষ্ট নয়। তাছাড়া ওরা সবসময়ই সশস্ত্র থাকত। আমাদেরও তাই নিরাপত্তার প্রশ্নে বিভিন্ন পন্থা নিতে হয়েছিল। আর্মি ও সি. আর. পি.র সাহায্য নিতে হয়েছিল। ভাবুন, কোন পর্যায়ে গেলে আর্মির সাহায্য নিতে হয় আমাদের। আর্মি ও সি. আর. পি. দিয়ে এলাকার পর এলাকা ঘিরে, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালাতে হয়েছিল। জানি, সেই সময় অনেক নিরাপরাধ সাধারণ লোককে অশেষ অশান্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। অনেক সাধারণ মানুষকে সন্দেহের বশে, চেহারার মিল বা নামের মিলের জন্য গ্রেফতারও করা হয়েছিল। এগুলো সবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। কিন্তু দয়া করে একে পুলিশি জুলুম আখ্যা দেবেন না। কই এখন কি আর পুলিশ এলাকা ঘিরে খানাতল্লাশি করছে? এখন এই নব্বইয়ের দশকে পঞ্জাবে আর কাশ্মীরে, আসামের কিছু কিছু এলাকায় কর্ডনিং করে চিরুনি তল্লাশি করতে হচ্ছে উগ্রপন্থীদের ধরার জন্য। যা আমাদের তখন করতে হয়েছিল, আমরা বাধ্য হয়েই আপনাদের নিরাপত্তার জন্যই তা করেছিলাম। আর আপনারা সেই কাজটা সহ্য করেছেন বলেই যেখানে একাত্তর সালে শুধুমাত্র কলকাতাতে একশ আঠের জনকে হত্যা করেছিল ওরা, সেটাই বাহাত্তর সালে নেমে এসে দাঁড়াল মাত্র আট জনে। এই আট জনের মধ্যে পুলিশ তিনজন, কংগ্রেস কর্মী একজন, সি. পি. আই (এম)-এর একজন ও সাধারণ মানুষ দুজন
ইতিমধ্যে আমরা অনেক নকশাল নেতাকে ধরলেও চারুবাবুকে গ্রেফতার করতে পারিনি। চারুবাবুকে ধরতে না পারলে নকশাল আন্দোলন পুরোপুরি দমন করা যাচ্ছে না। সেটা বাহাত্তরের এপ্রিল মাস। একদিন খবর পেলাম ইছাপুরে গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরির পাশে আনন্দমঠ বলে একটা জায়গায় অস্ত্র পাচার হয়। গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরির থেকে ময়লার গাড়ির ভেতর রাইফেলের সব পার্টস বেরিয়ে এসে ওই এলাকায় কয়েকটা বাড়িতে জমা হয়, তারপর সেগুলো জোড়া লাগিয়ে রাইফেল বানিয়ে নকশালরা বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দেয়। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আর্মি দিয়ে ঘিরে ওই এলাকায় চিরুনি তল্লাশি চালালাম। বেশ কয়েকটা বাড়ি থেকে পেলাম আটত্রিশটা নতুন জোড়া লাগান রাইফেল, তাছাড়া প্রচুর সরঞ্জাম, পার্টস। আমরা আনন্দমঠ থেকে গ্রেফতার করে আনলাম আঠাশ জনকে। তার মধ্যে এমন একজন ছিল যাকে আমরা বহুদিন ধরে খুঁজছি। সে চারু মজুমদারের চিঠির ক্যুরিয়ার ছিল। এইসব ক্যুরিয়াররা এক জায়গা থেকে জিনিসপত্র, চিঠি নিয়ে অন্য জায়গায় দিত এবং অন্য জায়গা থেকে খবরাখবর নিয়ে আসত। নেতাদের নির্দেশ এদের মাধ্যমেই বিভিন্ন জায়গায় যেত। তাকে জেরা করে জানতে পারলাম সে মাত্র একবারই চারুবাবুর চিঠি নিয়ে উত্তরবাংলায় শিলিগুড়িতে গিয়েছে। এখন যায় না, তবে এখন যে যায় তাকে সে চেনে। সে মাসের দুটো বৃহস্পতিবার দার্জিলিং মেলে করে শিলিগুড়ি যায়।
পরদিনই ছিল বৃহস্পতিবার! আমরা শিয়ালদহ স্টেশনে সেই ছেলেটিকে নিয়ে গেলাম। দার্জিলিং মেল যে প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়ে সেখানে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। না, যার অপেক্ষায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি সে এল না, আমাদের সামনে দিয়ে দার্জিলিং মেল হুস হুস করে চলে গেল। আমরা লালবাজারে ফিরে এলাম। এইভাবে চলে গেল কয়েকটা বৃহস্পতিবার। আমরা দার্জিলিং মেল দেখতে আসি, সে আমাদের কিছু না দিয়ে টা টা করে চলে যায়। মে মাস থেকে জুন। জুন থেকে জুলাই মাস এসে গেল, তাকে পাচ্ছি না। অবশেষে পনেরই জুলাই, বৃহস্পতিবার, আমাদের ধৈর্যের বাঁধ যখন ভেঙে যাচ্ছে প্রায়, আমরা পেয়ে গেলাম এতদিনের প্রতীক্ষার ফসল। সেই ছেলেটি দার্জিলিং মেল ধরতে এল, শিলিগুড়ি যাবে। আমরা তাকে ধরলাম, লালবাজারে নিয়ে এলাম। তার কাছ থেকে পেলাম একগাদা চিঠি, তার মধ্যে ছিল চারুবাবুর স্ত্রীকে লেখা একখানা চিঠি। এই সব চিঠি শিলিগুড়ির একটা হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকানে দিয়ে আসার কথা ছিল। চারুবাবু তাঁর স্ত্রীকে কি লিখেছিলেন? এখানে তা হুবহু তুলে দিলাম।
১৪.৭.৭২
লীলা,
তোমাদের খবর পাই না অনেকদিন। এখন তো যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হয়েছে। তুমি চিঠি লিখলে সেটা আমি পেতে পারি একমাসের মধ্যেই। কাজেই চিঠি দিও। অনীতা বোধহয় কলেজে চলে এসেছে। মিতু, অভী কেমন আছে জানিও। ওদেরও বোল আমাকে চিঠি দিতে। এখানে আমাদের অবস্থা ভাল। ভিয়েতনাম ডে তে একটা মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মিছিলটা হবে শ্রমিক কমরেডদের নিয়ে, ২০শে জুলাই। কাগজে নিশ্চয়ই বেরোবে। আমাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম বড় কম হচ্ছে। তার কারণ খতমের উপর বড় বেশী জোর পরে গিয়েছে। এটা বিচ্যুতি। এই বিচ্যুতি আমরা কাটিয়ে উঠছি। পার্টির মধ্যে সমালোচনা বেড়েছে, কাজেই সংশোধিত হবে। আমাদের পার্টি অল্প দিনের, অভিজ্ঞতাও কম, ফলে বিচ্যুতি হওয়া স্বাভাবিক। কমরেডদের নজরে পরেছে বিচ্যুতি, এটাই শুভ লক্ষণ, যাইহোক, তোমাদের খবর দিও। আমি একরকম আছি। ভালবাসা নিও। যদি সম্ভব হয় তাহলে কলকাতায় এসো।——চারু মজুমদার।
এই চিঠিটাই চারুবাবুকে গ্রেফতার করার মূল সূত্র হয়ে দাঁড়াল। আমরা বুঝলাম চারুবাবু কলকাতা বা তার আশেপাশেই আত্মগোপন করে আছেন। এই চিঠিটা হাতে পাওয়ার আগে আমাদের কাছে খবর ছিল তিনি জামশেদপুর অঞ্চলে আছেন। চিঠিটা হাতে পাওয়ার পর বুঝলাম, আমাদের “কাছে যে খবরটা ছিল তা সম্পূর্ণ ভুল। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি, যা আমার দীর্ঘ পুলিশ জীবনের একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। আমি দেখেছি, যে সব গুপ্তচর বহুদিন আমাদের হয়ে বিশ্বস্তভাবে কাজ করেছে কিন্তু বয়স হয়ে যাওয়ায় আর আগের মত চটপট কাজ করতে পারছে না, তারা আমাদের পরোক্ষভাবে শোষণ করতে শুরু করে। ভিত্তিহীন খবর পাঠায়, আমাদের বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেয়। চারুবাবুর জামশেদপুর অঞ্চলে থাকার খবরটা এইরকম এক বহু পুরনো বয়স্ক গুপ্তচরের পাঠান ভিত্তিহীন খবর ছিল। সেই গুপ্তচরটি আমাদের এক উঁচুস্তরের অফিসারের বহুদিনের নিজস্ব সোর্স ছিল। আমরা যখন চারুবাবুর চিঠিটা হাতে পেয়ে মোটামুটি নিশ্চিত যে চারুবাবু কলকাতা কিংবা তার আশেপাশেই আছেন, ওই অফিসার প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাননি। কিন্তু আমি গোঁ ধরাতে তিনি আমাকে নিজের মত করে কাজ করতে দিলেন।
আমরা আমাদের কাজ শুরু করলাম। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ শেষ করতে হবে, কারণ ওদের খুব গুরুত্বপূর্ণ এক ক্যুরিয়ার আমাদের হাতে বন্দী, এই খবরটা ওদের কাছে পৌঁছনর আগেই আমাদের যা কিছু করতে হবে। একবার যদি ওদের কাছে এই ক্যুরিয়ার গ্রেফতারের খবর পৌঁছে যায়, তবে চারুবাবু সমেত ওই ক্যুরিয়ারের জানা সবাই এমন জায়গায় চলে যাবে যাতে সে কোন খবরই না জানাতে পারে। এই ছেলেটার কাছ থেকে জানলাম, ওকে কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নকশাল এইসব চিঠি দিয়েছে আগের দিন সন্ধেবেলায়, বজবজ অঞ্চলের এক বাড়িতে। সে তারপর চলে আসে কলকাতায়, পরের দিন দার্জিলিং মেল ধরে শিলিগুড়ি যাওয়ার জন্য।
সেদিন ছিল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান খেলা। আমাদের ওপরের সব অফিসারেরা খেলা দেখতে মাঠে গেছেন। ওদের একটা খবর পাঠিয়ে আমরা একটা অন্য খেলা খেলতে ওই ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে আমরা বিশ-বাইশ জনের দল কয়েকটা গাড়িতে বজবজের দিকে রওনা দিলাম। বজবজে পৌঁছে ছেলেটি দেখিয়ে দিল কোন বাড়িতে ওই শীর্ষস্থানীয় নকশাল নেতারা ছিল। আমরা ওই বাড়িতে হানা দিলাম, কাউকে পেলাম না। তারা সকালেই সবাই চলে গেছে। এরপর আমরা বজবজের আরও চারটে বাড়িতে তল্লাশি চালালাম, কিন্তু সেখানেও কারোকে পেলাম না। সেই সূত্র ধরে আমরা বাটা আর বেহালার কয়েকটা বাড়িতে অনুসন্ধান চালালাম। কিন্তু কোথাও কাউকে গ্রেফতার করতে পারলাম না। আমাদের এত ছোটাছুটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হল। রাত দশটা নাগাদ লালবাজারে ফিরে এলাম। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে বসে থাকলে তো চলবে না।
ব্যর্থ হলেই লোকে আঙুল তুলে বলবে যে ব্যর্থ অমুক, ব্যর্থ তমুক, আর আমাদের ক্ষেত্রে ব্যর্থ পুলিশ অফিসার। তুমি যতই তোমার প্রচেষ্টার কথা বল লোকে ফুঁ মেরে উড়িয়ে দেবে। তাই আমাদের একবার ব্যর্থ হয়ে বসে থাকলে চলবে না। সুতরাং “একবার না পারিলে দেখ শতবারের” নির্দেশ মাথায় রেখে আবার ওই ছেলেটাকে নিয়ে পড়লাম। নতুন কোন তথ্য পাওয়া যায় কিনা। পেতে আমাদের হবেই। ততক্ষণে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে গেছে যে, চারুবাবু কলকাতাতেই আছেন, তাঁর চিঠিতে সেই আভাসই পেয়েছি, নয়ত তিনি তাঁর স্ত্রীকে লিখতেন না, পারলে যেন একবার কলকাতাতে আসেন। রাত এগারটা নাগাদ সেই ছেলেটি জানাল, বহুদিন আগে এন্টালি এলাকার একটা বাড়ি থেকেও তাকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল শিলিগুড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য। আবার নেচে উঠলাম। ততক্ষণে আমাদের বিশ বাইশ জনের দল ছোট হয়ে নয়জনে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সূত্র যখন একটা পেয়েছি তাকে তো না দেখে ফেলে রাখা যাবে না। তদন্তের নিয়মই হচ্ছে, যে কোন সূত্র বা তথ্য পেলে তা অনুসন্ধান করে শেষ করা এবং একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়া। তাই আমরা দেরি না করে ছেলেটিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমি ছাড়া অন্যরা হচ্ছে শচী মজুমদার, উমাশংকর লাহিড়ী, সমীর গাঙ্গুলি, দেবনাথদা আর ডি. ডি. সেকশনের তিনজন কনস্টেবল ও ছয়জন আর্মড সিপাই। আমরা মৌলালির মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। সেই ছেলেটিকে নিয়ে একটা গাড়িতে তার নির্দেশে চললাম। ছেলেটি দেব লেনে এসে দূর থেকে একটা টিনের বাড়ি দেখিয়ে দিল। আমি সেই ছেলেটিকে নিয়ে ফিরে এলাম। রাত তখন বারটা বাজে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে সবার। সারাদিনের ছোটাতে কারও পেটে চা ছাড়া আর কিছু পড়েনি। বেলেঘাটার এক বন্ধু রামগোপাল দাসের বাড়িতে আমার নেমন্তন্ন ছিল। তাঁর ছেলের বৌভাত। সেই সময়কার বেলেঘাটা মানে একটা বিভীষিকাময় অঞ্চল। বেলেঘাটার বহু অঞ্চল থেকে বহু সাধারণ মানুষ নকশালদের অত্যাচারে বাড়িঘরদোর ফেলে কিছুটা নিরাপদ জায়গায় চলে গেছে। যা হয় হবে, ঠিক করলাম, বেলেঘাটায় গিয়ে নেমন্তন্ন খাব, তারপর দেব লেনের ওই নয় নম্বর বাড়িতে হানা দেব। আমরা সবাই মিলে বেলেঘাটার দিকে রওনা দিলাম। নেমন্তন্ন আমার একার, যাচ্ছি এত জন। যেতে গিয়ে লজ্জাও হচ্ছিল কারণ পুত্রবধূর জন্য কোন উপহারও কিনিনি, কেনার সময়ও পায়নি। তবে ভরসা হচ্ছে, বন্ধুটি আমাকে “ব্যক্তি হিসাবে” খুব ভালভাবে চেনে। আমি যে কাজপাগল লোক সে তা খুব ভালই জানে। আর এই বছর তিনেক তো নকশালদের সন্ত্রাসের ঠেলায় দম ফেলার সময়ও পাচ্ছি না। কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া তো দূরের কথা, “অনুষ্ঠানের কথাও মনে রাখতে পারছি না। তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলাম রাজাগোপালের বাড়ি।
বন্ধু দেখেই বলল, “এই সময় হল আসার? আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম, তুমি আসছ না। হয়ত কোন বিশেষ কাজে ফেঁসে গিয়েছ।” আমি বললাম, “তা গিয়েছি, সে পরে শুনবে, এখন বল, খাবার-দাবার আছে? আমরা ন-দশজন আছি।” বন্ধু বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, সবাইকে নিয়ে এসো।” আমরা সবাই মিলে পাত পেড়ে বসলাম এবং এত উদ্বেগের মধ্যেও আয়েস করে পেট ভরে খেলাম। তারপর ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা দেব লেনে পৌঁছে গেলাম।
একে নকশাল আমল তায় বর্ষাকালের গভীর রাত। পথঘাট জনমানবশূন্য। মাঝে মাঝে রাস্তার কুকুরদের ডাক ছাড়া সব নিশ্চুপ। আমরা কিছু দূরে গাড়ি রেখে ন নম্বর বাড়ির সামনে পৌঁছে গেলাম। টিনের বাড়ি, বাড়ির সামনে বিরাট টিনের গেট। অন্ধকার, ভেতর থেকে গেটটা বন্ধ। পাশের পাঁচিলে উঠে গেল আমাদের অফিসার সমীর গাঙ্গুলি। দেখল, গেটের ওপাশে একটা ছেলে গেটের পাশে বসে ঘুমচ্ছে। সমীর নেমে গেটটা খুলতে গিয়ে অন্ধকারে ছেলেটার গায়ে পা লাগিয়ে ফেলেছে। ছেলেটা জেগে জিজ্ঞাসা করল, “কে?” সমীরের চটপট উত্তর, “কমরেড।” গেটটা খুলে ফেলল সমীর। আমরা দ্রুত ঢুকে পড়লাম। প্রথমেই ওই ছেলেটাকে বেঁধে ফেললাম, যাতে সে চিৎকার না করতে পারে।
তখনও জানি না, ভেতরে কাকে পাব, কি পাব, কারণ আমরা শুধুমাত্র চান্সের ওপর এসেছি। চান্সটা হচ্ছে প্রায় আট-নয় মাস আগে এই বাড়ি থেকে একবার সেই ক্যুরিয়ার ছেলেটিকে শীর্ষস্থানীয় নেতারা চিঠি দিয়েছিল শিলিগুড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। সুতরাং বাড়ির ভেতরে কাকে পাব জানি না, আমাদের মত সঙ্গের সেই ছেলেটিও জানে না। তাছাড়া, নকশাল নেতারা একটা বাড়ি কিংবা শেলটার একবার ব্যবহার করার পর অন্তত পাঁচ-ছ মাস পরে নিরাপদ থাকলে আবার ব্যবহার করত। সুতরাং আট-ন মাস আগে ওরা এই বাড়িটা ব্যবহার করে গেছে আর আমরা আজ এসেছি হাতড়াতে, ব্যাপারটাকে চান্স বলা ছাড়া আর কিভাবেই বা ব্যাখ্যা করা যায়? গেটের ভেতর ওদের যখন পাহারাদার আছে তখন বুঝলাম, কপাল মন্দ নয়, একদম খান্সি হাতে ফিরতে হবে না, সোনা না হয় তামা, রুপো কিছু না কিছু পাবই। ভেতরে দুটো ঘর, দরজা খোলা, কয়েকজন ঘুমচ্ছে। আসলে সারাদিন খাটাখাটনির পর দীর্ঘক্ষণ মিটিং করে ওরা অঘোরে ঘুমচ্ছিল। আমরা ওদের ঘুমের মধ্যেই টেনে টেনে তুলে ঝপাঝপ বেঁধে ফেললাম। ওরা কোন বাধাই দিতে পারল না। তখনও আমরা জানি না কাকে কাকে আমরা গ্রেফতার করছি। ওদেরকে কিছু বুঝতে না দিয়েই সোজা গাড়িতে এনে বসিয়ে লালবাজারের দিকে ছুটলাম। মোট ন-জনকে পেলাম। ওদের কাছে যা জিনিসপত্র ছিল তা দুজন কনস্টেবলের হেফাজতে রেখে এলাম সব গুছিয়ে লালবাজারে নিয়ে আসার জন্য। ওদেরকে প্রায় কিডন্যাপের কায়দায় লালবাজারে তুলে আনলাম। আশেপাশের বাড়ির লোকজন কেউ কিছু বুঝলই না, এত বড় একটা অপারেশন ওদের এলাকায় করে এলাম।
লালবাজারে এনে ন -জনকে আলাদা আলাদা করে দিলাম। তারপর লালবাজারে ওদের ভেতরকার যে সোর্স আটক ছিল, তাকে এনে দূর থেকে চিহ্নিত করালাম কাকে কাকে আমরা ধরে এনেছি। সেই সোর্সও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল, কারণ আমরা ধরে এনেছি সি. পি. আই (এম. এল) পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির প্রত্যেকটি সদস্যকে। রাজ্য কমিটির সম্পাদক দীপক বিশ্বাস, দিলীপ ব্যানার্জি সমেত পুরো কমিটিই আমাদের কব্জায়। এ যে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি, সোনা নয় একেবারে মণি মুক্তা পেয়ে গেছি। আর তাও কিনা বিনা রক্তপাতে, বিনা যুদ্ধে, একটা গুলিগোলা না খরচ করে।
কিন্তু তখন আমাদের আনন্দ করার সময় নয়। আমাদের চারুবাবুর আস্তানা খুঁজে বার করতে হবে। আমি বুঝলাম, এরা যখন রাজ্য কমিটির সদস্য, এদের সঙ্গে চারুবাবুর সক্রিয় যোগাযোগ থাকবেই থাকবে। কারণ চারুবাবুর সমস্ত নির্দেশ এদের কাছেই আগে। এরাও চারুবাবুকে প্রতিদিনকার খবরাখবর পাঠায়। সুতরাং এদের কাছ থেকেই বার করতে হবে চারুবাবুর গোপন আস্তানা। আর সেটা করতে হবে আজ রাতের মধ্যেই, কারণ ওদের ক্যুরিয়ার আর পুরো পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যকমিটির সব সদস্য উধাও হয়ে যাওয়ার খবর যদি একবার ওঁর কাছে পৌঁছে যায়, তিনি নিশ্চয়ই আমাদের অপেক্ষায় বসে থাকবেন না ফুলবেলপাতা নিয়ে। আমরা যাব আর উনি ফুল ছিটিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করে বলবেন, “এসো, এই যে আমি, চারু মজুমদার। কেন্দ্রীয় সরকার, বিহার, ওড়িশা, আসাম, অন্ধ্রপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কয়েক লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে মৃত অথবা জীবিত ধরবার জন্য, আমি এখানে বসে আছি, তোমরা আসবে বলে। ভীম নাগের সন্দেশও আনিয়ে রেখেছি, ওইগুলো খাও, তারপর আমায় লালবাজারে নিয়ে যাও।”
সুতরাং যা করতে হবে ভোর হওয়ার আগেই। রাত তখন দেড়টা বাজে। আমি একটা ঘরে বসে আছি। আমাদের ন-জন ওদের ন-জনকে আলাদা আলাদা ঘরে নিয়ে গিয়ে জেরা শুরু করেছে, যাতে কে কি বলছে অন্যেরা না জানতে পারে। প্রত্যেকের বক্তব্যের সিনথেসিস করেই সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
কিছুক্ষণ পর আমি ওই ঘর থেকেই শুনতে পেলাম আমাদের অফিসার ও কনস্টেবলরা ওদের দিল্লি-আগ্রা- মথুরা-বৃন্দাবন সব দেখিয়ে দিচ্ছে। ওরা কি আর সহজে বলবে ওদের “ভগবান” এখন কোন্ মন্দিরের থানে বসে আছে?
রাত বাড়ছে, আমাদের লোকেরা ট্যুর প্রোগ্রাম অনুযায়ী ওদের দেশ বিদেশ দেখাচ্ছে। এইভাবে অনেক ঘোরাঘুরি করার পর আমি বুঝলাম, ওই ন-জনের মধ্যে সবাই জানে না কোথায় সেই মুহূর্তে চারুবাবুর আস্তানা। এক এক করে বাদ দিয়ে অবশেষে একজনে এসে ঠেকলাম। সে আমাদের প্রচণ্ড চাপের মুখে রাত তিনটে নাগাদ বলতে বাধ্য হল যে, সে জানে কোথায় আছেন চারুবাবু। তাঁর নামটা এই এত বছর পরেও গোপন রাখছি, যদিও তাঁকে ছাড়া পাওয়ার পর নকশালরা খুন করেছে, তবুও তাঁর পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের নিরাপত্তার কথাটা মাথায় রেখেই গোপন রাখছি কে সেই নকশাল নেতাটি। কারণ বলা তো যায় না, কার মাথায় কখন ভূত চাপে, আর সেই ভূতের ঠেলায় আক্রোশে অন্ধ হয়ে “বিশ্বাসঘাতকের পরিবার” বলে সেই নকশাল নেতার পরিবারের ওপর আক্রমণ করে ফেলে এবং অযথা কোন জীবন হানি করে দেয়। আসলে আমার পুলিশি জীবনে এইসব তথাকথিত বীর পুরুষদের অনেক দেখেছি। দেখেছি, সেই সব বীরপুরুষদের যারা জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য গোপনে গোপনে কতই না কাকুতি-মিনতি করেছে। কতজনকে দেখেছি, ছাড়া পেয়ে যে সব দলকে দিনে কমপক্ষে পাঁচশ বার গালাগালি দিত, গালাগালি না দিলে ভাত হজম হত না, তাদেরই ছত্রছায়ায় যাওয়ার জন্য কত রকমই না হ্যাংলাপনা। কেউ কেউ সেই সব সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে নিজের কেরিয়ার বানানোর জন্য লাইন দিল। একসময় সে সব দেশের নাম শুনলেও তাদের মুখ ঘৃণায় একেবারে বেঁকে যেত। দেখেছি, সেইসব আগুনখেকো বিপ্লবীদেরই বেশি বেশি করে ভোল পাল্টে আখের গোছানর রাস্তায় নেমে পড়তে। বরং অন্যদিকে দেখেছি, যারা কিছুটা লো-প্রোফাইল নকশাল ছিল অর্থাৎ আগুন বোধহয় কিছুটা কম খেয়েছিল, তারা এখনও অনেক সতেজ আছে, এখনও তাদের দেখি না টাকার জন্য কাঙালপনা। হয়তো তারা অনেকে আর সক্রিয় রাজনীতি করে না, বসে গেছে, কোন দলেই আর যোগ দেয়নি, নকশালদের বর্তমান হাজারও গ্রুপের মধ্যেও আর নেই, পুরনো নাম ভাঙিয়ে রাজনীতির ময়দানে ব্যবসাও করে না, অতি সাধারণ জীবন যাপন করছে। এদের সততার জন্য এখনও আমরা শ্রদ্ধা করি।
আসলে পুলিশে চাকরি করে, লালবাজারে থেকে, বহু বিচিত্র চরিত্রকে অতি কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি, যা অন্য কোন পেশায় মানুষ পায় না। তাই অনেক সময় চমকে উঠেছি, অবাক হয়েছি যখন একজন মানুষের মুখোশ খসে আসল রূপটা বেরিয়ে পড়েছে। যেমন বহু খুনী, ডাকাত, গুণ্ডা, মাস্তান, চোর, চিটিংবাজ, ঠকবাজদের দেখেছি, তেমনি নকশাল ছাড়াও অন্য সমস্ত পার্টির নেতা ও কর্মীদেরও বহুবার কাছ থেকে দেখেছি। আমাদের কাছে এসে যখন আসল রূপটা বেরিয়ে পড়েছে, তখন অবাক হয়ে ভেবেছি, এরা সাধারণ মানুষকে কত ঠকায় এবং আরও কত ঠকাবে। কিন্তু আমাদের হাত পা বাঁধা, আমরা পুলিশে চাকরি করে অনেক তথ্যই পাই এবং পেয়েছি যা জনসমক্ষে আনা যায় না বা সেইসব তথ্যকে গোপন রাখতে বাধ্য হই। যদি আমরা সব তথ্য বলতে পারতাম, তবে আজকের বহু নেতাকেই আপনারা আর সেই সম্মান দিতেন না বা নেতার আসনেও বসিয়ে রাখতে পারতেন না। মন্ত্রীদের মন্ত্রগুপ্তির শপথের মত আমাদেরও কিছু অলিখিত লক্ষণরেখা আছে, যা আমরা ভাঙতে পারি না। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরও সেই অলিখিত নিয়মটা মেনে চলা আমাদের ভদ্রতা ও নিষ্ঠার মধ্যে পড়ে। আর আমরা আইনের পরিকাঠামোর মধ্যে কাজ করেছি। তাই আমরা জানি, আইন ছাড়া কাউকে আর এমনি এমনি বাঁধা যায় না। আমাদের কাজ তো আর কুৎসা প্রচার করা নয়। যতক্ষণ না একজন আইনের চোখে অপরাধ করছে, ততক্ষণ আমরা কিছুই করতে পারি না আর সবচেয়ে বড় জিনিস হল সাক্ষীসাবুদ যোগাড় করা। সেটাও খুব কঠিন কাজ।
প্রসঙ্গে ফিরে আসি, সেই নকশাল নেতাকে নিয়ে তাঁর কথা মত চললাম মৌলালির মোড়ের দিকে। মৌলালির মোড়ে আমরা আমাদের গাড়িগুলি দাঁড় করালাম। ঠিক করলাম, ওই নেতাকে নিয়ে গোপনে আগে বাড়িটা দেখে এসে তারপর হানা দেব। কিন্তু গাড়ি নিয়ে যাব না। ছদ্মবেশে যাব, যেন কাকপক্ষীও টের না পায় আমরা কে এবং কি উদ্দেশে আমাদের আসা। দেখলাম মৌলালির মোড়ে একটা টানা রিকশা। চালক তাঁর রিকশার মধ্যে গুটিসুটি মেরে ঘুমচ্ছে। তাকে গিয়ে আমি তুললাম। কিছু বোঝার আগেই গ্রেফতারের কায়দায় নিয়ে গিয়ে বসালাম আমাদের একটা গাড়িতে, যাতে আমাদের আগে সে কোনদিকে যেতে না পারে। তারপর তার রিকশাটা নিলাম। সিটের তলায় ওর একটা লুঙ্গি ছিল। আমি প্যান্ট-শার্ট ছেড়ে সেটা পরে নিলাম। কাঁধে ফেলে দিলাম তার প্রচণ্ড ময়লা গামছাটা। তারপর সেই নকশাল নেতাকে রিকশায় বোরখা পরিয়ে বসালাম, আমাদের একজন ওকে ধরে বসে রইল। লালবাজারে সেই নেতা খুব কেঁদেছিল, তখন কান্না থামিয়ে দিয়েছে। কান্না থামিয়ে আমাকে নির্দেশ দিচ্ছে কোনদিক দিয়ে যেতে হবে।
আমি রিকশা টানছি। রাত তিনটে। চারদিক নিস্তব্ধ, নিঝুম। রিকশা টানার অভিজ্ঞতা তো নেই, মন দ্রুত চললেও, রিকশাকে অত দ্রুত টানতে পারছি না। সেইভাবেই চলতে চলতে নকশাল নেতাটি আমাকে মিডল রোডের একেবারে শেষ প্রান্তে নিয়ে এসে একটা তিনতলা বাড়ি দেখিয়ে দিল, কোনদিকের কোন ফ্ল্যাটটায় তাদের বিখ্যাত নেতা চারুবাবু আত্মগোপন করে আছেন তা জানিয়ে দিল। আমি আবার রিকশা ঘুরিয়ে মৌলালির মোড়ে এসে পৌঁছলাম। মৌলালিতে পৌঁছে রিকশা চালককে তার গাড়ি, লুঙ্গি, গামছা দিয়ে দিলাম। নকশাল নেতাকে একটা গাড়িতে আমাদের ড্রাইভার ও একজন আর্মড সেপাই-এর জিম্মায় দিয়ে আমরা গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম মিডল রোডের দিকে। রওনা হওয়ার আগে আমি প্রত্যেককে বুঝিয়ে দিলাম বাড়িটা কোথায়। মিডল রোডের কাছাকাছি এসে আমরা গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম সেই বাড়িটার কাছে। ১৭০ এ, মিডল রোড, তিনতলা বাড়ির একতলায় পেছনের দিকের ফ্ল্যাটে চারুবাবু আছেন। বাড়ির পেছনের দিকের প্রাচীর ঘেঁষে চলে গিয়েছে শিয়ালদহ-বালিগঞ্জ ট্রেন লাইন। আমরা অফিসার আর আর্মড সিপাই মিলে মোট চোদ্দ জন। প্রথমেই বাড়িটা ঘিরে ফেললাম। এমনভাবে ঘিরলাম, যে কোন দিক দিয়ে দেখলেই মনে হবে যেন সেখানেই আমরা প্রচুর শক্তি নিয়ে উপস্থিত। ঠিক করলাম, আমি একাই বাড়ির ভেতর ঢুকব। শচী এমনভাবে পাঁচিলের ওপর দাঁড়াল, যাতে আমি ঢুকলে সে দেখতে পায় ভেতরে কি করছি।
আমি সদর দরজায় গিয়ে কড়া নাড়লাম। রাত তখন তিনটে তিরিশ। ক্যালেন্ডারের ডেট অনেকক্ষণ হয় পাল্টে গেছে, অভিযান শুরু করেছিলাম পনেরই জুলাই, আর আজ ষোলই জুলাই। অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর একজন বছর পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বয়সের লোক এসে দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করল, “কাকে চাই?” আমি তাঁর প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়েই তাঁকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে সোজা সেই ঘরের দিকে হাঁটতে লাগলাম, সেই নকশাল নেতার বিবরণ অনুযায়ী যেখানে চারুবাবুর থাকবার কথা। যে দরজা খুলে দিয়েছিল সে আমার পেছন পেছন আসছে আর আমায় জিজ্ঞাসা করেই চলেছে, “আপনি কে? কাকে চাইছেন?”
ততক্ষণে দেখে নিয়েছি যে ঘরটা আমার লক্ষ্যস্থল, সেই ঘরটার দরজা খোলা, একজন বৃদ্ধ দরজার উলটোদিকে মুখ করে দেওয়ালের দিক করে শুয়ে আছেন। আমি সেই লোকটির প্রশ্নের কোনও জবাব না দিয়ে ওকেই জিজ্ঞাসা করলাম, “উনি কে?” লোকটি আমায় বলল, “আমার দাদু।” আমি সরাসরি ওই ঘরে ঢুকে পড়লাম। তারপর সেই জীর্ণশীর্ণ বৃদ্ধের গায়ে হাত দিয়ে ডাকলাম, “দাদু, দাদু।” দাদু প্রায় সাথে সাথেই উঠে বসলেন। পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা, এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা সত্য, তবু শেষ সত্য নয়- এই কথাটা কবি কেন বলেছিলেন?” দাদু কোন কথাই বললেন না।
আমি নীরবতা ভেঙে একটা চুরুট এগিয়ে দিয়ে বললাম, “এটা ধরান, টানুন।” উনি এবার বললেন, “টানব?” আমি বললাম, “হ্যাঁ।” দেশলাই দিয়ে ওঁকে চুরুটটা ধরাতে সাহায্য করলাম। চুরুট ধরাবার সাথে সাথেই আমি বাইরে শচীকে ইশারা করলাম ভেতরে আসার জন্য। আমাদের চারজন ফ্ল্যাটের ভেতর ঢুকে পড়ল। ফ্ল্যাটের অন্য আর একটা ঘর থেকে পাওয়া গেল একটি আঠাশ-তিরিশ বছর বয়সের ভদ্রমহিলাকে এবং অন্য একজন প্রায় চল্লিশ বছর বয়স্ক ব্যক্তিকে। আমি দ্রুত শচীদের জিম্মায় “দাদু” এবং অন্য তিনজনকে রেখে বাড়ির বাইরে এসে টেলিফোনের খোঁজ করলাম। কারণ তখন আমার অনেকগুলো ফোন করা জরুরী প্রয়োজন। খোঁজ করতে গিয়েই জানতে পারলাম, ওই বাড়ির মালিকের কাছেই ফোন আছে। তিনতলা বাড়ির ওপর উঠে কলিং বেল বাজালাম। দরজা খুললেন মালিক নিজেই। আমি তাকে আমার পরিচয় দিয়ে প্রয়োজন জানাতেই তিনি ফোনের কাছে নিয়ে গেলেন।
প্রথমেই লালবাজারের হেড কোয়ার্টার্সে ফোন করে ফোর্স পাঠাতে বললাম। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তারপর আমাদের ডি সি ডি ডি দেবী রায়কে ফোন। উনি ফোন ধরতেই আমি বললাম, “গুড মরনিং স্যার, আমি রুণু বলছি, একটা গুড খবর আছে।” উনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কি গুড খবর?” বললাম, “চারু মজুমদারকে ধরেছি।” উনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না প্রথমে। আমি বললাম, “হ্যাঁ স্যার, আমি ওঁকে দেখেই চিনেছি, যদিও ওঁর যা ফটো আগে দেখেছি তা সব দাড়ি গোঁফসমেত ছিল, এখন তা পরিষ্কার, তবু চিনতে আমার কোন অসুবিধা হয়নি। আমি ওঁকে চুরুট দিয়েছি, উনি সেটা ধরিয়েছেন। আমি জানতাম, চারুবাবু চুরুট টানতে খুব ভালবাসেন।” দেবীবাবু ততক্ষণে ফোন নামিয়ে আমার অবস্থান জেনে নিয়ে এখানে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বাড়িওয়ালা ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, নিচের ওরা কবে এসেছেন? খোদ চারুবাবু যে তাঁর বাড়িতে আত্মগোপন করে আছেন সেটা শুনে তিনিও তাজ্জব বনে গেলেন। যাই হোক, উনি জানালেন, প্রবাল রায় নামে এক ভদ্রলোক জুন মাসে তাঁর থেকে ওই ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছে। আরও বললেন, আগের দিন তাঁর ভাইয়ের বিয়েতে ওদের সবাইকে ওরা নেমন্তন্ন করেছিল, কিন্তু দাদুর শরীর খারাপ এই অজুহাতে কেউ সেখানে যোগ দেয়নি। আমি নিচে নেমে এলাম।
দাদুকে এসে বললাম, “চারুবাবু, আমার নাম রুণু গুহ নিয়োগী। আপনাকে আমরা গ্রেফতার করতে এসেছি।” উনি ততক্ষণে বুঝে গেছেন যে তাঁর খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে। আমার দিকে একবার তাকালেন। তখন নকশালদের মধ্যে আমার নামটা খুব পরিচিত ছিল, সেটা চারুবাবুরও জানা ছিল। তাই উনি একদম ভেঙে পড়ে পাশে দাঁড়ান সেই ছেলেটিকে, যে আমায় দরজা খুলে দিয়েছিল, তাকে বললেন, “আমায় ইনজেকশান দাও।” দেখলাম পেথিড্রিন ইনজেকশান সমেত প্রচুর ওষুধ চারুবাবুর খাটের পাশেই রয়েছে। আমি সেই ছেলেটিকে বাধা দিয়ে বললাম, “না, কোন ইনজেকশান এখন দেওয়া চলবে না। যা কিছু ইনজেকশান বা ওষুধ দেওয়ার দরকার সব আমাদের ডাক্তাররা দেবে।” ততক্ষণে তল্লাশিও চালাতে শুরু করেছি, চারুবাবুর বালিশের তলা থেকে পাওয়া গেল চোদ্দ হাজার ছ’শ টাকা ও অনেক চিঠিপত্র, তার মধ্যে বিদেশ থেকে আসা চিঠিও অনেক ছিল। আমরা ওই ফ্ল্যাটটা থেকে যা যা পেলাম তার একটা সিজার লিস্ট বানিয়ে ফেললাম। জেরা করে জানতে পারলাম, মেয়েটির নাম নীলিমা ব্যানার্জি, সে নকশালদের ত্রিপুরার রিজিওনাল কমিটির সম্পাদিকা। তার সাথে একই ঘর থেকে যে ভদ্রলোককে পাওয়া গিয়েছে, তাঁর নাম প্রবাল রায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গেজেটেড অফিসার, উনিই ওই ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছিলেন। আর যে আমাকে প্রথম সদর দরজা খুলে দিয়েছে, তার নাম অনিল রায় ওরফে অনল রায়, উনি শিলিগুড়ির সেটেলমেন্ট অফিসে চাকরি করতেন, এখন চারুবাবুর সেবা ও শুশ্রূষায় নিযুক্ত। উনিই চারুবাবুকে ওষুধপত্র দেন, প্রয়োজনে ইনজেকশান উনিই প্রয়োগ করেন। চারুবাবু ক্রনিক হাঁপানি রোগী ছিলেন, তাছাড়া পেথিড্রিন ইনজেকশান নিয়ে নিয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
ইতিমধ্যে আমাদের হেড কোয়ার্টার্স থেকে প্রচুর ফোর্স চলে এসেছে। তারা এসে বাড়িটা ঘিরে রেখেছে। আশেপাশের লোকজনও উঠে পড়েছে, তারাও জেনে গেছে, চারুবাবু বহুদিন ওই বাড়িটায় তাদের পাড়াতেই ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি নিয়ে হাজির হলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার রবীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি, অ্যাডিশনাল পুলিশ কমিশনার সুনীল চৌধুরী, দেবী রায় সমেত আরও অনেক বড় বড় অফিসাররা। ওঁরা আসতেই আমরা ওদের বার করে আমাদের গাড়িতে তুললাম। ভ্যানে তুলে দিলাম চারুবাবু বাদে অন্য তিনজনকে। চারুবাবুকে একটা প্রাইভেট গাড়িতে তুলে আমি অন্য একটা গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, দেবীবাবু কিছুতেই আমায় অন্য গাড়িতে উঠতে দিলেন না। চারুবাবুর গার্ড হিসাবে চারুবাবুকে যে গাড়িতে তুলেছি তাতেই যেতে বললেন। আমি বললাম, “উনি ভাল করে হাঁটতেই পারেন না, পালাবেন কোথায়।” তবু দেবীবাবু আমাকে প্রায় জোর করে চারুবাবুর পাশে বসিয়ে দিলেন। আমরা লালবাজারের দিকে রওনা দিলাম। এলাকার মানুষ আশ্চর্য হয়ে দেখছিল, এই বৃদ্ধ লোকটাই এতদিন তাঁদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল?
আমরা চারুবাবুদের লালবাজারে এনে চা-টা খাইয়ে, বিশ্রাম করতে বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। যদিও আমাকে ও আমাদের সেই অভিযানের বাহিনীর সব সদস্যকে নিয়ে অন্য অফিসাররা দারুণ হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল, কিন্তু আমরা তখন এত ক্লান্ত ছিলাম যে তাদের অভিনন্দনও ভালভাবে গ্রহণ করতে পারছিলাম না। তবে বাড়ি যাওয়ার আগে দেব লেন থেকে গ্রেফতার করা ওদের নজন রাজ্য কমিটির সদস্যকে লালবাজারের অন্যত্র সরিয়ে দিয়েছিলাম, যাতে চারুবাবু জানতে না পারেন তাঁর সাধের রাজ্য কমিটির সব সদস্যই আমাদের মুঠোয় আর সেখান থেকেই সূত্র পেয়ে তাঁকে আমরা ধরেছি। এটা জানতে পারলে রাজ্য কমিটির সদস্যদের জীবন সংশয়ও হতে পারে। সত্যি বলতে কি, আমরা কলকাতার পুলিশ কখনও চাইনি অযথা কোন জীবন অকালে ঝরে যাক। তার জন্য প্রয়োজন মাফিক অনেক সতর্কতা নিয়েছি। কিন্তু তবুও বহু যুবক অকালে প্রাণ হারিয়েছে শুধুমাত্র তাদের হঠকারিতার জন্যই, অথবা যেখানে আমরা ক্ষণিকের জন্য অসতর্ক হয়েছি, সেইসব ক্ষেত্রে।
চারুবাবুর রাজ্য কমিটির এই সব সদস্যদের দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম, কারণ যারা ভারতবর্ষে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিল, আর বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু পশ্চিমবঙ্গের মত একটা প্রদেশের বিপ্লবের দায়িত্বে ছিল তাদের পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কেই কোনরকম ধ্যানধারণা ছিল না, ভারতবর্ষ তো দূর অস্ত! কি করে, কি ভিত্তিতে যে চারুবাবু এদের ওপর এত বড় দায়িত্ব দিয়েছিলেন তা তিনি নিজেই বলতে পারতেন। অবশ্য কি আর করার ছিল, উনি নিজেই তো ছেলেমানুষী “বিপ্লব বিপ্লব খেলায়” মেতেছিলেন। আর বিপ্লব করতে গিয়ে “শ্রেণীশত্রু খতমের” রাজনীতি আমদানি করেছিলেন। আর তাঁর পাশে তাঁর পুরনো কোন সঙ্গীসাথী ছিলেন না। কেউ মারা গেছেন, কেউ গ্রেফতার হয়ে জেলে আছেন, কেউ সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির বিরোধিতা করে তাঁর কাছ থেকে সরে গিয়েছেন। সুতরাং বাধ্য হয়েই তাঁর কিছু স্তাবকদের উনি এইসব অকল্পনীয় দায়িত্ব দিয়েছিলেন। যেন ছোট ছোট মেয়েদের পুতুল খেলা। যাকে ইচ্ছা যখন খুশী রাজা করব, রাণী করব। কিন্তু তাঁর পুতুল খেলার সঙ্গীসাথী তো আর কোন সুস্থ চিন্তাশীল মানুষ হতে পারে না। কেউ তো আর শিশু নয় যে “ভারতবর্ষের বিপ্লব” নিয়ে ছেলেমানুষী খেলা খেলতে গিয়ে খুনোখুনিতে মেতে উঠবে কিছু না বুঝেই।
গ্রেফতার হওয়ার আগে মনে হয় তিনি কিছুটা ভুল বুঝেছিলেন। স্ত্রীকে লেখা চিঠিটাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন, “খতমের উপর বড় বেশী জোর পরে গিয়েছে, এটা বিচ্যুতি।” খতম অর্থাৎ ব্যক্তিহত্যার মাধ্যমে যে একটা দেশের বিপ্লব সমাধা হয় না সেই সত্যটা তিনি ধরতে পেরেছিলেন। যদিও তাঁরই দেওয়া “বিপ্লবী কৌশলকে” শুধুমাত্র “বিচ্যুতি” বলেই ক্ষান্ত হয়েছেন। আরও লিখেছিলেন, “এই বিচ্যুতি আমরা কাটিয়ে উঠছি, পার্টির মধ্যে সমালোচনা বেড়েছে, কাজেই সংশোধিত হবে। আমাদের পার্টি অল্পদিনের, অভিজ্ঞতাও কম, ফলে বিচ্যুতি হওয়া স্বাভাবিক।” যে বিচ্যুতির কথা তিনি বলতে চেয়েছেন, সেই “খতমের লাইন” তিনি ও তাঁর সবচেয়ে বড় সমর্থক সরোজ দত্ত প্রায় জোর করে নকশাল পার্টিতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সুতরাং সেটা কাটিয়ে ওঠার প্রশ্নে তাঁকেই সর্বপ্রথম পার্টির নীতি নির্ধারক পদ থেকে বহিষ্কারের কথা। যা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না। তাছাড়া কোন্ পার্টিতে সমালোচনা বেড়েছে? যে পার্টির অস্তিত্ব তখন প্রায় বিলুপ্তির মুখে? সুতরাং সংশোধিত হয়ে আবার এগিয়ে যাওয়ার প্রশ্নও ওঠে না। আর অল্পদিনের পার্টি বলেই কি সবসময় “বিচ্যুতি হওয়া স্বাভাবিক” এই যুক্তি মেনে নেওয়া যায় কি? দীর্ঘদিনের পার্টিগুলোর বুঝি বিচ্যুতি হয় না? আসলে শর্ট-কাট মেথডে দেশের কোন উপকার করা যায় না, এটা তিনি ধরতে পেরেছিলেন। কিন্তু তিনি ভুলটা ধরতে এত দেরি করেছিলেন যে, সর্বনাশ যা হওয়ার তা ততদিনে হয়ে গেছে, ধ্বংস হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গের তরুণ একটা প্রজন্ম। অর্থনৈতিক অগ্রগতি পিছিয়ে গেছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। চূড়ান্ত ধ্বংস হওয়ার পর আমরা ওঁকে গ্রেফতার করতে পারলাম।
চারুবাবুকে গ্রেফতার করার পর আমাদের থেকে আমাদের ডাক্তারদের কাজ অনেক বেড়ে গেল। এমনিতেই তিনি প্রচণ্ড অসুস্থ ছিলেন। তার ওপর নিজে ধরা পড়ে ও তাঁর সব শক্তিশালী সদস্যরা আমাদের কব্জায় জেনে তিনি মানসিকভাবে একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। তার ওপর পেথিড্রিন ইনজেকশান আমাদের ডাক্তাররা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে জেরার চাপ তো একটা ছিলই। তিনি ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়েছিলেন।