সাদা আমি কালো আমি – ১.১৩

১৩

সিঁথির এক তথাকথিত “মুক্তাঞ্চলে” একদিন আমরা ফাঁদ পাতলাম। অন্যদিনের মত সেদিনও সন্ধেবেলায় আমরা সেখানে তল্লাশি চালাতে গেলাম। ঢুকলাম একটা খালি বাড়িতে, সে বাড়ির আশেপাশের অনেক বাড়িই খালি পড়ে ছিল। সেই বাড়িতে তল্লাশির অভিনয় করে কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এলাম। ভেতরে রেখে এলাম আমাদের আট জনকে। তারা বাড়ির ভেতর বিভিন্ন জায়গায় ঘাপটি মেরে বসে রইল যাতে নকশালরা ওখানে ঢুকলে ধরা যায়। নকশালরা ওই বাড়িতে প্রায়ই রাত এবং ভোরের দিকে মিটিং করতে আসত। আমরা বাড়ির বাইরে তালা লাগাবার নাটক করে ওই অঞ্চল থেকে চলে এলাম।

আমাদের আটজন বাড়ির ভেতর বসে রইল। নিশ্চুপ। প্রহরের পর প্রহর চলে যেতে লাগল। চারদিক থেকে ভেসে আসছে গুলি আর বোমার আওয়াজ। ওরা দম বন্ধ করে বসে রইল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিড়ি-সিগারেট টানার প্রশ্ন নেই। এমনকি উপায় নেই প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বাইরে বের হওয়ার। রাত প্রায় দুটো বাজে, টুক করে একটা শব্দ। বেড়াল টেড়াল না কি নকশালরা এল? না, একটা লোক। ছোট্ট একটা টর্চ জ্বালিয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগল। আমাদের লোকেরা বুঝতে পারল না ওই লোকটা ওদের দলের কিনা! একটু পরে ওর গতিবিধি লক্ষ্য করে যখন নিশ্চিন্ত হওয়া গেল সে এই বাড়ির কেউ নয় তখন ওরা লোকটাকে জাপটে ধরে একটা ঘরে বেঁধে রেখে আবার অপেক্ষা করতে লাগল। তখন ভোরের দিকেই নকশালরা বেশি আসত। কিন্তু ভোর হয়ে গেল, আর কেউ এল না। লোকটাকে নিয়ে পুলিশেরা চলে এল লালবাজারে। অনেক জেরা করে নিশ্চিন্ত হলাম, সে একটা চোর। চুরি করতেই সে ওই বাড়িতে ঢুকেছিল। আমাদের এত আশার ফাঁদে শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ল কিনা একটা চোর। বাঘ ধরতে গিয়ে পেলাম একটা ইঁদুর! চোরটার নাম আবার মহাদেব! আমরা কিন্তু সেই ইঁদুরকে কাজে লাগিয়েই একদিন ধরেছিলাম এক বড়মাপের নকশাল বাঘকে। ওদের পরিভাষায় বলতে গেলে “কাগুজে বাঘ”!

মহাদেবের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, এ তো সাধারণ চোর নয়। অসাধারণ চোর তো, ধরা পড়ল কেন? আপনারা ভাবছেন, অসাধারণ চোর তো তারাই হয়, যারা ধরা পড়ে না। এ তো ধরা পড়ে গেছে, তাহলে আর অসাধারণ হল কই? আসলে ওর অসাধারণত্ব ছিল অন্যখানে, যেখানটা আমাদের কাজে লেগে গেল।

মহাদেবকে বললাম, “বাবা মহাদেব, তুমি তো যা তা চোর নও। তোমার নাম-মহিমাই বলছে তুমি বিরাট শক্তিধর।”

মহাদেব কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “না স্যার, আমি খুব গরিব, চুরি করা ছাড়া আর কোন কাজই আমার নেই।”

আমি বললাম, “তা তো ঠিকই, কিন্তু তুমি একটু আলাদা। যেখানে আমরাই একা খালি হাতে ঢুকতে ভয় পাই, সেখানে তুমি দিব্যি রাতের বেলা চুরি করে বেড়াচ্ছ আর নকশালরা তোমায় কিছু বলছে না, এটা আমায় বিশ্বাস করতে বল?”

মহাদেব চুপ করে রইল। অচেনা, অজানা, সন্দেহভাজন কোন লোক “নিজেদের এলাকায়” দেখলেই নকশালরা তাকে ধরে জেরা করত। ঠিকমত প্রশ্নের জবাব দিতে না পারলে তাকে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিত। ধরেই নিত এ পুলিশের চর। কত নিরীহ কাগজকুড়ানী আর ফুটপাতবাসী যে তাদের হাতে এভাবে মারা গেছে তার ঠিক নেই। পুলিশ আর ওরকম আদ্যিকালের গুপ্তচরগিরিতে বিশ্বাসীই নয়। একমাত্র বাংলা সিনেমাতেই দেখা যায় এদের। যেখানে তাদের দলের ভেতর থেকেই আমরা খবর পাচ্ছি, অযথা একটা বাইরের লোককে কেন মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে যাব? রাস্তায় রাস্তায় কাগজ কুড়িয়ে একটা লোক কি খবরই বা নিয়ে আসবে? তার থেকে সরষের মধ্যে ভূত ঢুকিয়ে দেওয়ার সূত্রটাই প্রয়োগ করেছি। তাতে হাতে নাতে ফলও পেয়েছি। সারা পৃথিবীর পুলিশই ভূত কেনা বেচা করে। আমরা বাদ যাব কেন? ভাবি, যারা দেশে বিপ্লব করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবার স্বপ্ন দেখেছিল, তারা এই সামান্য জিনিসটাই তখন বুঝতে পারল না কেন? পারলে, নিরীহ কিছু লোককে ওই ভাবে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হত না। তাই মহাদেব যতই বোঝানর চেষ্টা করুক না কেন সে সামান্য একটা চোর, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করলাম না। শেষমেষ সে স্বীকার করল, সে সিঁথি অঞ্চলের নকশালদের চেনে আর তাদের সাথে তার ভালই যোগাযোগ আছে। তারপর ঠিক করলাম, ওকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করব। ও রাজি হল। ওই শর্তে ওকে আমি ছেড়ে দিলাম। তারপর থেকে মহাদেব আমাদের অনেক খবর দিতে লাগল। আমরা সেইসব খবরকে ভিত্তি করে ওই অঞ্চলের নকশালদের ছত্রভঙ্গ করতে শুরু করলাম। বিনিময়ে মহাদেবকে টাকাপয়সা দিতাম, যাতে ওকে আর চুরি করে খেতে না হয়।

মহাদেবের খবরে আমাদের অনেক উপকার হলেও বড় ধরনের কোন নকশাল নেতা বা গ্রুপকে তখনও আমরা সিঁথি অঞ্চল থেকে ধরতে পারিনি। এভাবেই কেটে গেল তিন-চার মাস। কিন্তু ওর কাজে আমি পুরোপুরি খুশি হতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, কোথাও একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। এই ফাঁকটা ধরতে পারলেই কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা জানতে পারি। তবে এটুকু বুঝলাম, মহাদেবকে নকশালরা শুধুমাত্র ছোট একটা চোর ভাবে না, তার থেকে কিছুটা অন্যরকম। এই অন্যরকমটা কি এবং কেন? সে যে অবাধে ওদের সঙ্গে মিশে যেতে পারছে, তা কি শুধু সে আজ নকশালের ভেক ধরেছে বলে নাকি এমন কিছু আছে যা আমরা এখনও জানি না?

গোপন সূত্র থেকেই জানলাম, মহাদের তার মার সঙ্গে থাকে। তার বাড়িতে আর কেউ নেই। মহাদেব তার মাকে খুব ভালবাসে। সেখানেই ওর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। প্রত্যেক মানুষেরই কোথাও না কোথাও দুর্বলতা থাকে, তা সে টাইসন কিংবা অরণ্যদেব যেই হোক না কেন। সেই দুর্বলতাটা জানতে পারলে আর সেটা ধরে ঠিকমত নাড়া দিতে পারলে অতি বড় শক্তিধর মানুষও নরম পুতুল হয়ে যায়। মহাদেবের দুর্বলতাটা জানি। ভাবলাম ওকে একটু নাড়া দিয়ে দেখি ফাঁকটা ভরাট করা যায় কিনা। একদিন মহাদেবকে ধরে নিয়ে এলাম। স্পষ্ট করে বললাম, “দেখ মহাদেব, তুমি আমার কাছে এমন কিছু গোপন করেছ যা তোমার উচিত হয়নি। সেই গোপন কথাটা যদি তুমি আমায় না বল তাহলে তোমার মাকে আমরা ধরে নিয়ে আসতে বাধ্য হব, তখন কিন্তু পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যাবে।”

মহাদেবের দুর্বলস্থানে ঘা দিয়েছি। মাকে ধরে নিয়ে আসব শুনেই ও ভেঙে পড়ল। এতদিন যেসব কথা আমাদের বলেনি, তা বলে ফেলল। মহাদেব বলল, সে কোনদিনই নকশাল ছিল না। কিন্তু তাদের সঙ্গে মিশত শুধু নিজের চুরির পেশাটা ঠিকমত চালানর জন্য। এই সুবিধেটা সে পেয়েছিল তার দিদি সঞ্জু নকশাল বলে।

মহাদেবকে ছাড়লাম না। এতদিনে পেয়েছি ফাঁক ভরাটের সেতু, তার দিদি সঞ্জুর নাম। স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে খবর নিয়ে জানলাম, ঠিকই, সঞ্জু নামে একটা মেয়ে নকশাল নেত্রী। সিঁথি অঞ্চলে অনেকদিন ধরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, কিন্তু ধরা যাচ্ছে না। তার নামে অনেকগুলো মামলাও আছে। মহাদেবকে বললাম, “সঞ্জু এখন কোথায় ঠিক করে বল। তাকে আমাদের চাই।” মহাদেব বলল, তাকে দুদিন সময় দিতে হবে। তার মধ্যে সে খবর এনে দেবে। আমি ওকে শাসালাম, “ঠিক আছে, দুদিনের মধ্যে সঠিক খবর নিয়ে আসবে, নয়ত ফল খুব খারাপ হবে।”

ঠিক দুদিন পর মহাদেব ফিরে এল। জানাল, সঞ্জু এখন আছে বিহারের দেওঘরে। আমি জানতে চাইলাম, সঞ্জুর সাথে আর কে কে সেখানে গেছে? মহাদেব বলল, তা সে জানে না, তবে সঞ্জু সেখানে গেছে নকশালদের এক বড় নেতার সঙ্গে মিটিং করতে। তাকে নিয়ে যদি আমরা দেওঘরে যাই তবে সে দেখিয়ে দিতে পারবে সঞ্জু ঠিক কোথায় আছে। আমরা ভাবলাম, সঞ্জু নিশ্চয়ই একা দেওঘরে যায়নি, তার সাথে আরও অনেকে গেছে। কিন্তু কারা? আর নেতাটাই বা কে? একমাত্র দেওঘরে গেলেই পুরোটা বোঝা যাবে। সিদ্ধান্ত নিলাম, যাব।

মহাদেবকে সঙ্গে করে কুড়ি-পঁচিশ জনের দল হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপে বসলাম। নামতে হবে যশিডি। হাওড়া থেকে কোনও ট্রেন সোজা দেওঘর পর্যন্ত যায় না। ট্রেনে উঠে আমাদের কি ফূর্তি! পিকনিক পিকনিক ভাব। এমনিতে তো আর ছুটিছাটা পাই না। এমন চাকরি যে মনের সব দুয়ার বন্ধ করে শুধু ছুটতে হয়। বাড়িঘর, সংসার, মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, সমাজ, অনুষ্ঠান কিচ্ছু নেই। শুধু দৌড়। মাঝেমাঝে মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু উপায় নেই। নিয়েছি দায়িত্ব, চাকরি করছি সরকারের। জনসাধারণের পয়সায় মাইনে হয় আমাদের। তাদের কাছে তাই দায়বদ্ধ।

আজ যেন ছুটি। সবাই তারিয়ে তারিয়ে সেটা উপভোগ করছে। আমাদের মধ্যে কে যেন গান ধরেছে, “যাব না, যাব না, যাব না ঘরে”। হাসি ঠাট্টায় সবাই মশগুল। যেন ভুলে গেছে কি কাজে যাচ্ছে।

আমাদের ভোরবেলায় নামতে হবে যশিডি। ওখানেই আমরা থাকব। কলকাতার এক নামজাদা ভদ্রলোকের বাগানবাড়িতে। বাংলার রেনেসাঁস ও তার পরবর্তী যুগের তাবড় তাবড় বাঙালিরা গিরিডি, শিমুলতলা, ঝাঁঝা, যশিডি, মধুপুর, দেওঘর ঘিরে একটা ছোটখাট উপনিবেশ তৈরি করেছিলেন। একে বলা ভাল বাগানবাড়ির উপনিবেশ। আগে বাঙালি পরিবার এইসব স্বাস্থ্যকর জায়গায় লোটাকম্বল নিয়ে বছরে অন্তত একবার মাসখানেকের জন্য বেড়াতে যেত শরীর মন চাঙ্গা করার উদ্দেশে। বাগানবাড়ির কনসেপ্টটা যদিও “বাবু কালচারের” মধ্যে পড়ে, তবু আমার ভালই লাগে। সে আমলের বাগানবাড়ির কর্তারা অনেকেই রুচিশীল, সংস্কৃতিবান, সুশিক্ষিত ও অভিজাত ছিলেন। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন আমি একটু হেসে ফেলেছি। পাশে বসে ছিল শচী কিংবা সুকমল। জিজ্ঞেস করল, “স্যার, হাসছেন যে?”

আমি বললাম, “আমাদের ড্যানচিবাবু সেজে নামতে হবে, তাই।”

“ড্যানচি কি স্যার?” তার প্রশ্ন।

সাঁওতাল পরগনার গিরিডি, মধুপুর, যশিডি, দেওঘর ইত্যাদি জায়গায় আগে যখন বাঙালিবাবুরা চেঞ্জে যেত, সকালবেলায় দল বেঁধে বাজার করতে যেত। যে কোনও জিনিসের দাম কলকাতার তুলনায় এত কম মনে হত যে, বাঙালিবাবুরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলত, “ড্যাম চিপ” “ড্যাম চিপ”। ইংরেজি “ড্যাম চিপ”-এর অর্থ আদিবাসীদের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকত। আদিবাসীরা ওই “ড্যাম চিপ’”টাকে “ড্যানচি” করে নিয়েছে। বাঙালিবাবুরা বাজারে ঢুকলেই ওরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত, ওই যে “ড্যানচি বাবু” এসে গেছে। তাই আমি ভাবছিলাম এবার এতগুলো পুলিশ অফিসারকে পরিচয় গোপন করে ‘ড্যানচিবাবু” হয়ে যেতে হবে।

এরকম টুকটাক গল্প করতে করতে আমি কখন একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোরবেলায় যশিডি আসতে সঙ্গের কেউ আমাকে জাগিয়ে দিল। আমরা সবাই “ড্যানচিবাবু” সেজে যশিডি স্টেশনে নামলাম। যেন ট্যুরিস্ট, হাওয়া বদলে এসেছি। এমন কি মহাদেবকেও খুশিখুশি লাগছিল। সব বাঙালির মনের মধ্যেই একটা ছুটন্ত, ঘুরন্ত, উড়ন্ত “ড্যানচিবাবু” বাস করে। সুযোগ পেলেই ডানা মেলে বেরিয়ে পড়ে। হোক না সে চোর কিংবা লালবাজারের পুলিশ অফিসার।

বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম খোলা হাওয়ায়। কলকাতায় এর ভীষণ অভাব। তারপর অন্য ভ্রমণবিলাসী মানুষের মত আমরাও রিক্সায় চড়ে বসলাম। যে উদ্দেশে এসেছি তা কতটা সফল হবে জানি না, আপাতত এই চমৎকার ভোরবেলা তো প্রাণভরে উপভোগ করা যাক। দুর্গাপুজো গেছে, সামনে কালীপুজো। এখানে এখন বাতাসে বেশ ঠাণ্ডার আমেজ। যশিডির প্রায় শেষ প্রান্তে আমাদের গন্তব্যস্থল। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম। গাছগাছালিতে ভরা, প্রাচীরঘেরা এক বিরাট বাড়ি। আগের থেকে বলা ছিল আমরা আসব, তাই কাজের লোকজন ঠিক করা আছে দেখলাম।

বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে ভাবলাম, যে ভদ্রলোক শখ করে বাড়িটা বানিয়েছিলেন, তিনি কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন একদিন কলকাতার পুলিশ অফিসাররা এসে সেখানে শিবির গেড়ে বসবে? ইতিহাসের চাকা কখন কাকে কোথায় নিয়ে যায় কে জানে। সুন্দর করে সাজানো বড় বড় অয়েল পেন্টিং। অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু! আমি ঠায় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম। হায়রে বাঙালি! দেশ জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা। ধসে গেছে অর্থনৈতিক কাঠামো। সমাজে শৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই। বাংলার এই মুখই কি দেখেছিলেন জীবনানন্দ!

“স্যার, চা।”

যেন স্বপ্নের থেকে জেগে উঠে বললাম, “দাও।” মুহূর্তের মধ্যে মনে পড়ে গেল কি কাজে এসেছি এখানে। মহাদেবকে ডেকে এনে বললাম, “চল মহাদেব আমাদের দেখিয়ে দাও কোথায় আছে সঞ্জু।” মহাদেবকে নিয়ে কয়েকমিনিটের মধ্যে আমরা বেরিয়ে পড়লাম দেওঘর-বৈদ্যনাথধামের উদ্দেশে। তীর্থ ভ্রমণ ট্রমণ তো আর আমাদের কপালে নেই, ভাবলাম, এক কাজে দুকাজই হয়ে যাবে! বাবা বৈদ্যনাথ যেন আমাদের মুখ রক্ষা করেন!

দেওঘরে পৌঁছে মহাদেব বেশ কিছুটা ঘুরিয়ে আমাদের একটা বাড়ি দেখাল। বলল, “ওই বাড়িতেই সঞ্জু আছে। এখানেই বোধহয় এক বড় নকশাল নেতার সাথে মিটিং করছে।” বাড়ি দেখে আমরা মহাদেবকে আমাদের যশিডির আস্তানায় ফেরত পাঠিয়ে দিলাম। যারা যশিড়িতে ছিল তারা মহাদেবকে রান্নাবান্নার দায়িত্ব দিয়ে চলে এল। আমরা ওই বাড়ি রেড করব। কজন নকশাল ভেতরে আছে তা জানি না। তাই যত বেশি সম্ভব ফোর্স নিয়ে আক্রমণ করব। নকশালদের কাছে আধুনিক অস্ত্র নিশ্চয়ই আছে। তাই আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। আগের থেকে বুঝতে দিলে চলবে না। হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের গ্রেফতার করতে হবে। নিয়মমত স্থানীয় থানায় গিয়ে আমাদের পরিচয় জানালাম। কি উদ্দেশে আমরা কলকাতা থেকে দেওঘর এসেছি তা বলার পর ওঁরা আমাদের সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন বেশ কিছু কনস্টেবল এল আমাদের সঙ্গে।

ওই বাড়ি ও তার চারপাশ ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে ছক করতে লাগলাম কিভাবে, কখন, কোনখান থেকে আমরা আক্রমণ করব। বাড়িটা এমনভাবে ঘিরে রাখলাম যেন কেউ বুঝতে না পারে আমরা ওই বাড়ির ওপর কড়া নজর রেখেছি। কেউ ঢুকছে বা বেরচ্ছে কিনা সেদিকেও খেয়াল রাখা হল। অন্যদিকে স্থানীয় সিপাইদের সাহায্যে আশেপাশের লোকজনের কাছ থেকে খবর যোগাড় করতে লাগলাম, বাড়িতে কে কে থাকে, কতজন থাকে, বাইরের কেউ সম্প্রতি এসেছে কিনা, এইসব।

যে বাড়িটা নিয়ে আমাদের এত কর্মব্যস্ততা, সেই একতলা বাড়িটা কিন্তু নিঝুম দাঁড়িয়ে আছে, ভেতরের কোন কথাবার্তার বা জিনিসপত্র নাড়াচাড়ার আওয়াজ কিছুই বাইরে থেকে পাচ্ছি না। বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়ে এল। অবশেষে জানা গেল, একটা আদিবাসী কাজের লোক ছাড়া ওই বাড়িতে আর কেউ নেই। এমন কি বাড়ির মালিকও প্রায় দু-তিনমাসের মধ্যে কলকাতা থেকে আসেননি। সারাদিনের পরিশ্রম তো বৃথা গেলই, উল্টে ওখানকার পুলিশের কাছে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেল। ভাবছি, মহাদেব আমাকে এত বড় ধোঁকা দিল? প্রচণ্ড রেগে গেলাম মহাদেবের ওপর। কি আর করব, সন্ধেবেলায় ফিরে এলাম যশিডি।

সারাদিন আমাদের কারও কিছু খাওয়া হয়নি। আগে খেয়ে তারপর ঠিক করব কি করা যায়। রান্না হয়েছে কি না দেখি। মহাদেবকে ডাকলাম। কিন্তু কোথায় মহাদেব? উনি তখন মহাযোগ করে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে আছে। আসলে আমরা সবাই দেওঘর চলে যেতেই ও কাজের লোককে দিয়ে মহুয়া আনিয়েছে। তারপর সবাই মিলে খেয়ে ব্যোম ভোলানাথ হয়ে শুয়ে আছে। কোথায় রান্না? চাল, ডাল, বাজার যেমন আনা হয়েছিল তেমনই পড়ে আছে। এদিকে সবার পেটে ছুঁচোতে ডন মারছে। তার ওপর যে কাজে এসেছি তার কোন হদিস নেই। একদিকে কলকাতায় ফিরে বড়সাহেবদের কি কৈফিয়ৎ দেব তার চিন্তা, অন্যদিকে খিদেয় চোখে অন্ধকার দেখছি। মহাদেব নিশ্চিন্ত মনে ঘুমচ্ছে। আমাদের আর উপায় কি? হাত লাগালাম রান্নায়। ছোটবেলায় পিকনিকে দু-একবার শখ করে নুনছাড়া মাংস কিংবা পোড়া বেগুনি রেঁধেছি। সেই অভিজ্ঞতাই কাজে লেগে গেল যশিডির সে রাতের পিকনিকে! মহাদেবকেও জাগিয়ে সেবা করালাম। সেই এখন আমাদের হাতের পাঁচ, ওকে চটালে চলবে না।

ভুরিভোজের পর মহাদেবকে বললাম, “ব্যাপারটা কি? তুমি আমাদের এত দূর নিয়ে এলে ইয়ার্কি মারতে? যে বাড়িতে কেউ থাকে না তেমন একটা বাড়ি দেখিয়ে এখানে এসে মহুয়া খেয়ে ঘুমচ্ছ?” মহাদেব নির্বিকার মুখে বলল, “না স্যার, আসলে আমি আপনাদের দিনেরবেলায় বাড়ি দেখিয়েছি তো, তাই গুলিয়ে ফেলেছি, চিনতে পারিনি। রাতেরবেলায় নিয়ে চলুন, ঠিক চিনিয়ে দেব। দিনেরবেলায় আমার সব ওলোটপালোট হয়ে যায়।” হাসব না রাগব? ভাবলাম, আমাদেরই গোড়ায় গলদ। ব্যাটা চোর। দিনেরবেলাটা ওর ঘুমের সময়, রাতটা কাজের। রাতেই জেগে ওঠে। রাতই তো ওর দিন।

তাই হোক। মহাদেবের কথা শিরোধার্য করে রাত দশটা নাগাদ আমরা তাকে সঙ্গে নিয়ে যশিড়ি থেকে দেওঘরের উদ্দেশে রওনা হলাম।

দেওঘরে পৌঁছে দেখলাম, মহাদেবের চোখ দুটো বেড়ালের মত জ্বলছে। নানা রাস্তা ঘুরিয়ে একটা বাড়ি সে দেখিয়ে দিল। বাড়িটা বেশ বড়, অন্ধকার। বুঝলাম ভেতরে যারা আছে তারা সবাই ঘুমচ্ছে। আবার আমরা স্থানীয় থানার থেকে সেপাই নিয়ে এলাম। ঠিক করলাম, সরাসরি রেড করব। প্রথমেই আমরা বাড়িটা ঘিরে ফেললাম। তারপর অন্ধকারের মধ্যে পাঁচিল টপকে খুব সন্তর্পণে বাড়ির কাছে গিয়ে লুকিয়ে রইলাম। স্থানীয় একজন সেপাই এ বাড়ির কাজের লোককে চিনত। সে লোকটার নাম ধরে ডাকতে লাগল। কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর, আদিবাসী গোছের একটা লোক দরজা খুলল। আমরাও আড়াল থেকে বেরিয়ে, সেই লোকটা কিছু বোঝার আগেই দ্রুত বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলাম। এঘর-ওঘর খুঁজতে লাগলাম। একটা ঘরে একটি মেয়েকে পেলাম। সেই-ই মহাদেবের দিদি সঞ্জু। সঞ্জু তো মহাদেবকে দেখে যা তা গালাগালি দিতে লাগল। আমি সঞ্জুকে প্রশ্ন করলাম, “আর কে কোথায় আছে, তাড়াতাড়ি বল। কোন নেতার সাথে তুমি মিটিং করতে এসেছ? নাম কি সেই নেতার? কোথায় সে এখন?” সঞ্জু বলল, “আমি একা এসেছি, কোনও নেতার সাথে মিটিং করতে আসিনি। কে কোথায় আছে আমি কিচ্ছু জানি না।” ধমকে উঠলাম, “ফালতু কথা শোনার সময় আমাদের নেই।” ও ফের বলল, “সত্যিই আমি একা এসেছি।” জিজ্ঞেস করলাম, “কেন এসেছ? ভয়ে?” সঞ্জু নিরুত্তর। কি করি? আমরা সঞ্জুকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। তারপর ওকে একটা টিলার ওপর নিয়ে গিয়ে একেবারে ধারে দাঁড় করিয়ে দিলাম। পেছনে গভীর খাদ। একজনকে বললাম সঞ্জুর দিকে রিভলবার তাক করে রাখতে, যাতে ও ভয় পায়। “বল এবার, নয়ত—।” রিভলবারের সামনে দাঁড়িয়েও সঞ্জু একই কথা বলতে লাগল। সে একা ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছে, কে কোথায় আছে কিছুই জানে না। এদিকে রাত বাড়ছে। আমি সঞ্জুকে বললাম, “সত্যি কথা না বললে ওরা কিন্তু তোমায় গুলি করে পেছনের খাদে ফেলে চলে যাবে। কেউ টের পাবে না, তুমি মরে পড়ে থাকবে। এখনও সময় আছে।”

সঞ্জু তবু নির্বাক। স্থানীয় এক সেপাই আমায় হিন্দিতে বলল, “কি করছেন স্যার। ওই খাদের ওপাশেই এস-ডি-পি ওর বাংলো, এখানে গুলি করবেন না।” সেপাইরা ভেবেছিল, সত্যিই বোধহয় আমরা সঞ্জুকে মেরে ফেলব। আসলে ওকে যে আমরা শুধুই ভয় দেখাতে এখানে নিয়ে এসেছি তা ওরা বুঝতে পারেনি। সঞ্জুই তো এখন আমাদের নতুন সোর্স, তাকে মেরে ফেলে কি নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়ুল মারব? শেষ পর্যন্ত সঞ্জুকে টিলা থেকে নামিয়ে দেওঘর থানায় মেয়েদের লকআপে রেখে যশিডিতে ফিরে এলাম।

যশিড়ি ফিরে সবাই বিছানা নিলাম। কিন্তু ঘুম আর আমার আসছে না। ভাবছি, কাল কি কলকাতায় ফিরে যাব শুধু সঞ্জুকে নিয়ে? তাহলে বলতে হয়, আমাদের এই অভিযান পুরোপুরি ব্যর্থ। তার আগে সঞ্জুকে আবার জেরা করে দেখতে হবে যদি কোন আলো পাওয়া যায়। মেয়েটা ঠিক বলছে তো, ভয়ে পালিয়ে এসেছে? নাকি কোন নেতার সঙ্গে সত্যিই মিটিং করতে এসেছিল? এখন পর্যন্ত যত নকশাল দেখলাম, কজনই বা আমাদের জেরার মুখে দাঁড়াতে পেরেছে? বেশিরভাগ ধমকধামকেই ভেঙে পড়েছে। কান্নাকাটি করতেও কতজনকে দেখলাম। অথচ বাজারে রটেছে, আমরা নাকি দারুণ দারুণ নির্যাতনের কৌশল বার করেছি। সেসব নকশালদের শরীরে প্রয়োগ করছি। এসব প্রবাদে আমাদের লাভই হয়েছিল অবশ্য। অল্প ধমকেই ভয় পেয়ে সব বলে দিত বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে। মারধর করতে নিজেদেরও তো পরিশ্রম করতে হয়!

তবে কি পুলিশকে আদৌ বলপ্রয়োগ করতে হয় না? নিশ্চয়ই হয়, মাঝে মধ্যে হয়। পৃথিবীর সব দেশের পুলিশকেই করতে হয়। এমন কি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতেও। শুনেছি স্তালিন সাহেবকেও প্রচুর বলপ্রয়োগ করতে হয়েছিল। যদি তিনি সেসময় শক্ত হাতে দেশদ্রোহীদের না দমন করতেন, তবে কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই ভয়াল দিনগুলোতে হিটলারের বাহিনীকে স্তব্ধ করে শান্তির পৃথিবী ফিরিয়ে আনা সম্ভব হত? কোন কোন সময় কি পরিস্থিতিতে পুলিশকে ওই পন্থা নিতে হয়? একটা উদাহরণ দিচ্ছি এখানে। ধরুন, হেমন্ত বসুর মত এক বড় মাপের নেতা খুন হলেন। পুলিশ কোনও সূত্র পাচ্ছে না। খুনীদের ধরা যাচ্ছে না। সরকার থেকে পুলিশকে ক্রমাগত চাপ দেওয়া হচ্ছে। জনসাধারণের দিক থেকেও আসছে চাপ। পত্রপত্রিকায় পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার বিস্ফোরক অভিযোগ। চারদিকে মিটিং মিছিল হচ্ছে খুনীদের ধরে শাস্তির দাবি জানিয়ে। যেন পুলিশ ইচ্ছে করেই খুনীদের ধরছে না। পুলিশের তখন কি অবস্থা? তারা তো প্রচণ্ড চেষ্টা করছে খুনীদের ধরবার। কিন্তু ধরতে পারছে না। অবশেষে হয়তো একজন খুনীকে ধরা হল। কিন্তু সে তো আর সাধু যুধিষ্ঠির নয়—ধরা পড়েই গড়গড়িয়ে সব বলে দেবে। এদিকে পুরো দলটাকে ধরতে হবে। তখন কি করবে পুলিশ? গ্রেফতার হওয়া আসামীকে বাবা-বাছা বলে আদর করবে? এমন অবস্থায় পুলিশকে বাধ্য হয়েই বলপ্রয়োগের পন্থা নিতে হয়। তবে সাধারণত পুলিশ ততটুকুই শক্তি প্রয়োগ করে যতটুকু দরকার। কখনই হিন্দি সিনেমার মত সেটে সাজানো উদ্ভট কল্পিত অত্যাচার হয় না। পুলিশে চাকরি করতে যারা আসে তারাও সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়ে। চাকরি করতে এসে কেউ খুনী হয়ে যেতে পারে? কে আর চায় “মানবাধিকার কমিশন” বা আদালতে দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করতে? অথচ দেখুন, যারা পুলিশকে অত্যাচারীর অপবাদ দিয়ে “অপরাধী” বানায়, তারাই তুচ্ছ কারণে নিজেরা মারপিট করে। এমনকি ট্রামে-বাসে কেউ পা মাড়িয়ে দিলেও রাগ সামলাতে পারে না। হাতাহাতি করে বসে। আর পুলিশ যদি একটা খুনী বা ডাকাত ধরতে প্রয়োজনে সামান্য চড়চাপড়ও দেয়, তক্ষুনি চারদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়। অপরাধী হয়ে যায় নায়ক, আর যারা জনসাধারণের নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যস্ত তারা হয়ে যায় খলনায়ক! আর এই খলনায়কের অভিশাপ কাঁধে নিয়েই পুলিশকে একদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়। ভাগ্যের কি পরিহাস। ওই চাকরিতে সবসময় শাঁখের করাতের ওপর বসে থাকতে হয়। কাজ করলেও দোষ, না করলেও দোষ। ভিক্ষুকের পাশে দাঁড়ানোর লোক পাওয়া যাবে, কিন্তু তুমি পুলিশ, তোমার পাশে কেউ নেই। তোমার হয়ে কেউ সাফাই গাইবে না। না কোনও সরকার, না কোনও দল। দু-একটা পদকটদক হয়তো কপালে জুটবে। ব্যস, আর কিচ্ছু না। ওই মেডেল বুকে ঝুলিয়ে অবজ্ঞার, অবহেলার লাথি খেয়ে কাটিয়ে দাও বাকিটা জীবন।

আধো ঘুম, আধো জাগরণের মধ্যে কেটে গেল বাকি রাতটুকু। সঞ্জুকে জেরা করে দেখতে হবে কোন সূত্র পাওয়া যায় কিনা। উঠে পড়লাম। আজ তেসরা নভেম্বর, সাল ১৯৭১। দেখলাম, শচীও জেগে গেছে। ওকে বললাম, “কাউকে জাগিয়ে লাভ নেই, চল বাইরে কোনও দোকান থেকে চা খেয়ে আসি।” লুঙ্গি পরা, জামার ওপর একটা আলোয়ান চাপিয়ে বেরিয়ে এলাম। রাস্তায় নেমে বুঝলাম হাওড়া থেকে ভোরের ট্রেনটা যশিডিতে এসে পৌঁছেছে।

রিকশায় রিকশায় ট্রেনযাত্রীরা লোটাকম্বল নিয়ে যে যার জায়গায় যাচ্ছে। আমার লুঙ্গিটা দক্ষিণ ভারতীয়দের মত দুর্ভাজ করে কোমরে গোঁজা। হঠাৎ টের পেলাম, ঘুম থেকে উঠেই যে কাজটা প্রথমে সারি সেটা না সেরে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। তাই নর্দমার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। শচীও “বাঙালির একতা একমাত্র এখানেই” বলে আমার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ রাস্তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়েছি, একটা রিক্সায় চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। শচীকে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, “রিভলবার এনেছ?” শচী অবাক হল, “না স্যার, কেন?” ফিসফিসিয়ে বললাম, “ঘাড় ঘুরিও না।” শচী জানতে চাইল, “কিছু দেখেছেন?” বললাম, “রিক্সায় অসীম যাচ্ছে।” শচী আরও অবাক, “অসীম মানে অসীম চ্যাটার্জি?” বললাম, “হ্যাঁ। সাথে আর একটা ছেলেও আছে।” অসীমদের রিক্সা তখন আমাদের পার হয়ে চড়াই থেকে উৎরাইয়ে নেমে পাঁই পাঁই করে ছুটছে দেওঘরের দিকে।

আমরা নর্দমার ধার থেকে রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম ওদের রিক্সা ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে। আমি আর শচী অসহায়ের মত দেখছি। ছুটে বা অন্য রিক্সা করে ওকে তাড়াও করতে পারছি না। কারণ আমাদের দুজনের কাছেই তখন কোন অস্ত্র নেই। আমাদের কাছে নিশ্চিত খবর ছিল অসীম সবসময় সঙ্গে রিভলবার বা পিস্তল রাখে। একবার যদি তাড়া করে ধরতে না পারি ওরা সতর্ক হয়ে যাবে। পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে।

শচীকে জিজ্ঞেস করলাম, “টাকা পয়সা সাথে কত আছে?” শচী জানাল, “দশ-পনের হবে।” আমি বললাম, “চল, ছাড়া যাবে না।” যশিডি থেকে দেওঘর যাওয়ার ট্রেন তখনই ছাড়ে। আমরা ছুটতে ছুটতে যশিডি স্টেশনে গিয়ে ওই ট্রেনে উঠে পড়লাম। ট্রেন ছাড়ার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। ছাড়ছে না। আমি আর শচী ড্রাইভারের কাছে গিয়ে অনুরোধ করলাম। ড্রাইভার আমাদের বেশভূষা দেখে দুচারটে গালাগালি দিয়ে তাড়িয়ে দিল। ইয়ার দোস্তদের সাথে ফের হাসিমস্করায় মেতে গেল। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে। আমাদের হার্ট বিট দ্রুত হচ্ছে! ড্রাইভারের ভ্রূক্ষেপ নেই। শেষে আমাদের নাছোড়বান্দা ভাব দেখে ড্রাইভারের মন গলল। ট্রেন ছাড়ল। ততক্ষণে কুড়ি পঁচিশ মিনিট পার হয়ে গেছে।

অসীম চ্যাটার্জি, নকশালদের “কাকা”কে আমি আগের থেকেই চিনতাম। সেই ১৯৬৭-৬৮ সালে যখন প্রেসিডেন্সি কলেজকে ঘাঁটি করে নকশালরা কলেজ স্ট্রিট অঞ্চল জুড়ে রোজই কিছু না কিছু ঝামেলা পাকাত, তখন থেকেই আমি অসীমকে চিনি। আমাকেই বেশির ভাগ সময় ওদের মোকাবিলা করতে যেতে হত। এমনও অনেকদিন হয়েছে, অসীম আর ওর চ্যালাচামুণ্ডারা যখন কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের টেবিলে “বিপ্লবের ঝড়” তুলছে, আমি আর কলকাতা পুলিশের কয়েকজন অফিসার তখন পাশের টেবিলে বসে ব্ল্যাক কফি খাচ্ছি। আসলে আমরা ওদের আলোচনা শুনতাম। তখন অসীম প্রেসিডেন্সি কলেজের বি. এস. সি-র ছাত্র। ৬৯ সালে পড়া শেষ না করেই আত্মগোপন করে। তারপর থেকে ওকে আর দেখিনি। শুধু গোপন সূত্র থেকে খবর পেয়েছিলাম রমা নামে এক বিবাহিতা ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করেছে। আর আজ এই ‘৭১-এর শেষে এসে ওকে দেখলাম। নিজেকে আড়াল করতে চশমা পরেছে। কিন্তু ওকে যে একবার দেখবে, সে আর ভুলবে না। শচী ওকে চেনে না। শচী কেন, আমরা যারা এবার যশিডিতে এসেছি তার মধ্যে একমাত্র আমি ছাড়া ওকে আর কেউই চেনে না। শচীকে ওর চেহারার মোটামুটি বিবরণ দিলাম। স্টেশনে নেমেই ছুটলাম যেখান দিয়ে অসীমদের রিক্সা দেওঘরে ঢুকবে, সেই যশিডি-দেওঘর রাস্তার মোড়ের দিকে।

মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। এখান দিয়েই দেওঘরে ঢোকে যশিডি থেকে আসা রিক্সা। আমরা প্রায় পলক না ফেলে যশিডির রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি, অসীমদের রিক্সার অপেক্ষায়। না, এল না। তার মানে আমরা আসার আগেই ওরা দেওঘরে ঢুকে গেছে। এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকাটা বোকামি। আমি আর শচী অসীমদের খুঁজতে দেওঘরে ঢুকে পড়লাম। ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম চা খেতে। তখন চা আমার আর শচীর মাথায় উঠে গেছে। আমাদের সামনে একটাই চ্যালেঞ্জ। অসীমরা কোথায় আছে খুঁজে বার করতেই হবে। তারপর সময়, সুযোগ বুঝে রেড করে ওদের গ্রেফতার করা। ওকে যদি ধরতে পারি তবে কলকাতায় বড়সাহেবদের কাছে এ যাত্রা আমাদের মুখ রক্ষা হবে।

শুরু করলাম সারা দেওঘর চষা। গরু খোঁজার মত খুঁজতে লাগলাম। কোথায় অসীম? শচী তো বিড়বিড় করে বৈদ্যনাথ বাবার নাম জপ করে যাচ্ছে। আমার চোখদুটো একবার বাঁ থেকে ডানে আবার ডান থেকে বাঁয়ে সিনেমার ক্যামেরা প্যান করার মত ঘুরছে। চোখ দুটো কটকট করছে। দুরাত্রি একটুও ঘুমইনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখেমুখে জলও দিইনি। খাওয়া নেই, দাওযা নেই, চক্কর মারছি। পকেটে পয়সাও নেই যে কিছু কিনে খাব। হঠাৎ ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয়ে গেল আমাদের দলের তিনজনের সঙ্গে, উমাশংকর লাহিড়ী, সুভাষ চ্যাটার্জি, সুকমল রক্ষিত। তারা আমাদের যশিডিতে খুঁজে না পেয়ে দেওঘরে চলে এসেছে। আমি আর শচী কি পরিস্থিতিতে চলে এসেছি তা ওদের জানালাম। শুনে ওরা আশ্চর্য হয়ে গেল। ওরাও আমাদের সঙ্গে ঘুরতে শুরু করল। ওদের কাছে টাকাপয়সা ছিল, খুঁজে খুঁজে মহুয়ার দোকানে ঢুকতে লাগলাম। এরকম পাঁচটা মহুয়ার দোকানে ঢুকে পাঁচ বোতল মহুয়া কিনে রাস্তায় ফেলে দিলাম। সম্ভাব্য সব জায়গাতেই আমরা অসীমকে খুঁজতে লাগলাম উদভ্রান্তের মত। এমন সময় জেলেদের ঘুনি বা আটলের কথা মনে পড়ে গেল। বাঁশের সরু সরু বাখরি দিয়ে তৈরি হয়। মাছ ধরার জন্য বর্ষাকালে জলের স্রোতের বিপরীত দিকে নালা, নর্দমায়, মাঠেঘাটের আলের মাঝে ভাল করে খুঁটি দিয়ে বেঁধে বসিয়ে দেওয়া হয়। মাছ স্রোতের টানে ঘুনির মধ্যে ঢুকে যায়। ঘুনির দরজা এমন কায়দায় বানান হয় যে ঢোকা যায়, কিন্তু যতই চেষ্টা কর বেরনো যায় না। ঘুনির ছাদের ওপর একটা ফুটো থাকে। জেলেরা ঘুনি তুলে মাছ-টাছ যা ভেতরে ঢোকে তা ছাদের ফুটো দিয়ে ঝেড়ে ঝেড়ে বের করে নেয়। আমার কেন যেন মনে হল অসীম এবার ঘুনির মধ্যে ঢুকে গেছে। শুধু দরজা আটকে দিলেই হল, আর পালাতে পারবে না। নিশ্চয়ই জানে না, আমরা এখানে এবং ওকে দেখে ফেলেছি। দেওঘরের দরজা হল যশিডি। ওখান দিয়েই বেরতে হবে। দেওঘর ছাড়তে হলে অসীম যশিডি আসবেই। আমাদের এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যশিডি স্টেশন ও তার আশপাশ ঘিরে ঘাঁটি গাড়তে হবে। এবার আমরা দেওঘর স্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। যশিড়ি ফিরে যাব। স্টেশনের উল্টোদিকে এসে একটা পানের দোকান দেখলাম। সকাল থেকে এত পরিশ্রমে গা গোলাচ্ছে। শচীকে বললাম, “দেখ তো, ওই দোকানে বাংলা পান পাওয়া যায় কিনা, পেলে একটু সুপারি দিয়ে নিয়ে এস।” এবার বিদ্যুৎ চমক। পানের দোকানের লাগোয়া একটা পাইস হোটেল। ওখানে অসীম একটা টেবিলে বসে আছে। উল্টোদিকে দুজন, তাদের সঙ্গে কথা বলছে। বিকেল পাঁচটা। হোটেলের নামটা দেখে নিলাম, “ও কে হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট।” আমি সবাইকে ইশারায় ডাকলাম। ঠিক করলাম, এখানেই ওকে ধরব, যা হয় হবে। অসীম আমাদের দেখতে পাচ্ছে না। দেখলেও বুঝতে পারবে না। আমাকে ছাড়া আমাদের দলের আর কারোকে ও চেনেই না। আমাদের শুধু একটাই অসুবিধে, আমাদের কারও কাছে কোন অস্ত্র নেই। দেখছি ওর সামনে একটা ফোলিও ব্যাগ টেবিলের ওপর রাখা আছে। নিশ্চয়ই তার ভেতর রিভলবার বা পিস্তল আছে। ও কিছু বোঝার আগেই ওকে ধরে ফেলতে হবে। ঠিক করলাম, আমরা প্রত্যেকে আলাদা ভাবে খদ্দের সেজে হোটেলে ঢুকব, যাতে অসীমদের কোনরকম সন্দেহ না হয়। আমি মাথা চুলকানর ভান করা মানেই চার্জ, আক্রমণের নির্দেশ। আলোয়ান দিয়ে মাথা ঢেকে দেহাতি ঢঙে হোটেলে ঢুকে পড়লাম। অন্যেরাও এক এক করে ঢুকে পড়েছে। অসীমের পাশে একটা চেয়ার খালি, আমি তাতে গিয়ে বসলাম। সেটা অসীমের ডান দিক, সে তার ফোলিও ব্যাগটা সরিয়ে বাঁ দিকে টেবিলের ওপর রাখল। ওর সঙ্গী দুজন খাবার খাবে বলে হাত ধুতে উঠে গেল বেসিনের কাছে। সুকমল আর সুভাষ ও হাত ধোওয়ার অছিলায় বেসিনের কাছে পৌঁছল। আমি মাথা চুলকানর ভান করে সঙ্কেত দিলাম। ঝট করে জাপটে ধরলাম অসীমকে, “অসীম তোমার খেলা শেষ।” ততক্ষণে সুকমল আর সুভাষ অসীমের সঙ্গী দুজনকে ধরে ফেলেছে। লাহিড়ী তুলে নিয়েছে অসীমের ফোলিও ব্যাগ। শচী এসে দাঁড়িয়েছে অসীমের সামনে। এমনভাবে জামার ভেতর ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা রেখেছে যে মনে হচ্ছে রিভলবারের নল। যা ভেবেছিলাম, লাহিড়ী অসীমের ফোলিও খুলে পেল গুলি ভর্তি রিভলবার। ওটাই এখন আমাদের একমাত্র অস্ত্র। অসীমকে ধরার সময় আমার মাথা থেকে আলোয়ানের ঘোমটা পড়ে গিয়েছিল। ও আমাকে চিনে ফেলল। নরম গলায় বলল, “প্লিজ রুণুদা, ছেড়ে দিন। সবে দুলাইনের লড়াইটা শুরু করেছি, ওটা শেষ করি, তারপর ধরবেন।” আমি ভাবলাম, বোকা ছেলে, তোমাদের দু লাইন, দশ লাইনের সাথে আমাদের কি সম্পর্ক? তখন নকশালদের ভেতর তত্ত্বগত একটা লড়াই চলছিল। একদিকে চারু মজুমদারের “খতমের” লাইন, অন্যদিকে “খতমের” লাইন ছেড়ে সংগঠন নির্ভর সংগ্রামের লাইন। এই দ্বিতীয় লাইনে ছিল অসীম। এতসব লাইনের ব্যাখ্যা শুনে আমাদের কি লাভ? আমরা পুলিশের চাকরি করি। সরকারের নির্দেশ আমাদের মানতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার, বিহার সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার অসীমকে ধরার জন্য নগদ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে বহু খুন, জখম, ডাকাতি, রাহাজানি ইত্যাদির মামলা বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন আদালতে ঝুলছিল। ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে এমন কোন ধারা নেই যেখানে খুনের কোন অন্যরকম ব্যাখ্যা আছে। খুন খুনই, ডাকাতি ডাকাতিই। তার কোন রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক চরিত্র নেই। আমরা খুন বা ডাকাতি কিংবা অন্য অপরাধের উদ্দেশ্য এবং চরিত্র দেখে নিজেরা ব্যাখ্যা দিয়ে থাকি। ব্যক্তিস্বার্থ যেখানে জড়িত সেসব অপরাধকে আমরা অরাজনৈতিক অপরাধ বলি আর রাজনৈতিক উদ্দেশে যেসব অপরাধ, তাকে রাজনৈতিক অপরাধ বলি। কিন্তু সব অপরাধই আই.পি.সির চোখে এক। যেরকম জেল কোড অনুযায়ী রাজবন্দী আর সাধারণ বন্দীতে কোন ফারাক নেই। তবু রাজনৈতিক কারণে কারোকে গ্রেফতার করলে তাকে রাজবন্দী বলি এবং আলাদা সম্মানও দিয়ে থাকি।

আমি আইনের হাতে বন্দী আর তখন আমার হাতে বন্দি নকশাল নেতা অসীম চ্যাটার্জি ওরফে কাকা। ও ছটফট করে উঠল। বুঝল, উপায় নেই। মরীয়া হয়ে মুক্তি পাওয়ার শেষ চেষ্টা শুরু করল। আমি ওকে দুহাত দিয়ে জাপটে ধরে আছি আর ও বক্তৃতা দিচ্ছে গরম গরম হিন্দিতে। গরিবদের জন্য লড়াই করছি আমরা, আমাদের লড়াই ধনীদের বিরুদ্ধে যারা গরিবদের শোষণ করছে। আমাদের দেখিয়ে বলল, “এরা ধনীদের পোষা গুণ্ডা। আমাদের মারধর করছে। যাতে গরিবদের হয়ে লড়াইটা বন্ধ করি।”

অসীমের বক্তৃতা শুনে হোটেল ঘিরে লোকজন জমে গেল। আমরা কি করব ভেবে পাচ্ছি না। আমাদের অসীম গুণ্ডা বলে দেখাচ্ছে। লোকজনের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। একবার যদি অসীমের কথায় বিশ্বাস করে এখানকার সাধারণ লোক আমাদের মারপিট শুরু করে, তাহলে খুব বিপদ। এখানকার লোকজন তো আমাদের চেনে না। আমাদের সঙ্গে এ মুহূর্তে কোন পরিচয়পত্রও নেই। চারদিকে চিৎকার, চেঁচামেচি, হৈ হল্লা শুরু হয়ে গেছে। আমি অসীমকে জাপটে ধরে আছি। সুকমল আর সুভাষও অসীমের সঙ্গী দুজনকে ধরে আছে। ওদিকে লাহিড়ী অসীমের রিভলবারটা তুলে চিৎকার করছে। ওটাই এখন আমাদের ভরসা। যাকে ধরেছি তার অস্ত্র দিয়েই তাকে কাবু করে এখান থেকে কোনমতে নিয়ে যেতে হবে। হল্লার মধ্যেই অসীমের বক্তৃতা চলছে। আমাদের লোকেরাও বারবার বলছে, “আমরা গুণ্ডা বদমাইশ নই, কলকাতা থেকে এসেছি, পুলিশ।” কে কার কথা শোনে।

এইরকম পরিস্থিতিতে সাক্ষাৎ ঈশ্বরের দূতের মত হাজির হল বিজিন্দ্রপ্রসাদ সিং। দেওঘর থানার সেই সেপাইটা, যে গতরাতে সঞ্জুকে টিলার ওপর ভয় দেখানর সময় আমায় এস-ডি পি-ওর বাংলো দেখিয়েছিল। সে হোটেলের সামনের রাস্তা দিয়ে বগলে রুলটা চেপে খইনি টিপতে টিপতে দেওঘর থানার দিকে যাচ্ছিল। ভিড় দেখে, হৈ চৈ শুনে সে হোটেলে উঁকি মারল। বিজিন্দ্রপ্রসাদকে এখানকার প্রায় সব লোকই চেনে। সে ডাণ্ডা উঁচিয়ে ভিড় হটাতে লাগল। বলতে লাগল, ওই আদমি মিথ্যে কথা বলছে, এরা কেউ গুণ্ডা নয়, কলকাতার পুলিশ অফিসার, এদের ধরতে এখানে এসেছে। ও আমাদের চেনে, জানে। বিজিন্দ্রপ্রসাদের কথায় আস্তে আস্তে ভিড় পাতলা হতে লাগল। লোকজন চলে যেতে অসীম হতাশ হয়ে একসময় বক্তৃতা বন্ধ করে দিল। আমরা অসীমদের তিনজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে সামনেই দেওঘর থানার হাজতে ঢুকিয়ে দিলাম।

থানায় চেয়ারে বসে প্রথমে এক গ্লাস জল খেলাম। মনে হল, কোন থ্রিলার ছবির একটা রিল যেন দেখে এলাম। কিছুক্ষণ পর হাজত থেকে একজন একজন করে ডেকে আনালাম। প্রথমেই ডাকলাম সেই ছেলেটাকে যাকে অসীমের সঙ্গে সকালবেলায় যশিডি থেকে রিক্সায় দেওঘর আসতে দেখেছি। জেরা করে জানলাম, তার নাম দীপাঞ্জন রায়চৌধুরী। ভাল পরিবারের শিক্ষিত ছেলে, অসীমের অনেকদিনের বন্ধু, একসাথে নকশাল রাজনীতি করে। আর অন্যজন যাকে হোটেলেই প্রথম দেখি সেও বাঙালি, নাম শচীন্দ্রকুমার বাগচী, বিহার সরকারের কৃষি ও বিপণন মন্ত্রণালয়ের গেজেটেড অফিসার। দেওঘরে পোস্টিং। সক্রিয় না হলেও সে নকশালদের সমর্থক। এর সঙ্গে দেখা করতে অসীম ও দীপাঞ্জন দেওঘরে এসেছিল। অসীমের চশমাটা পরীক্ষা করে দেখলাম। পাওয়ার লেস আর রিভলবারটা পুলিশের থেকে ছিনতাই হওয়া পয়েন্ট ৩৮ রিভলবার। ওদের সবাইকে হাজতে ফেরত পাঠিয়ে ও.সি.র ঘর থেকে স্থানীয় টেলিফোন এক্সচেঞ্জে লালবাজারের নাম্বার দিয়ে ট্রাঙ্ক কল বুক করে অপেক্ষা করতে লাগলাম। রাত বাড়ছে। খিদেও প্রচণ্ড পেয়েছে। বাবা বৈদ্যনাথ, তুমি আমাদের এ যাত্রায় মুখ রক্ষা করেছ, এখন শুধু তাড়াতাড়ি লালবাজারের লাইনটা পাইয়ে দাও।

ভাবছি যশিডিতে আমাদের বাকি লোকজনকেও খবর দিতে হবে, কোথায় আমরা হারিয়ে গেছি! হয়তো ওরা এতক্ষণে যশিডি থানায় মিসিং ডায়েরি লিখিয়ে এসেছে। হঠাৎ একটা দুষ্টুবুদ্ধি মাথায় খেলে গেল। রাত আর একটু বাড়ুক, তখন এমনভাবে খবর দেব প্রথমে যেন হকচকিয়ে যায়। টেলিফোনটা বেজে উঠল, আমিই ধরলাম। না, লালবাজার নয়, স্থানীয় কল। বিজিন্দ্রপ্রসাদকে ফোনটা দিয়ে দিলাম। বিজিন্দ্রপ্রসাদ আমাকে আর ছাড়ছে না, ছায়ার মত লেগে আছে। কে একজন চা আর সিঙাড়া নিয়ে এল। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। খালি পেটে এগুলো খেলে রাতে আর চোরা অম্বলের ঠেলায় কিছু খেতে হবে না। যা হয় হবে, মা কালীর নামে ওই সিঙাড়াই দুতিনটে চায়ের সাথে খেয়ে নিলাম। রাত নটা নাগাদ পেয়ে গেলাম লালবাজার। ধরলাম ডি.সি.ডি.ডি (ওয়ান) দেবী রায়কে। বললাম, “স্যার, আমি দেওঘর থানা থেকে বলছি।” আমি গলাটা নামিয়ে বললাম, “অসীমকে ধরেছি।” “তার মানে?” ওঁর গলায় অবিশ্বাস। বললাম, “হ্যাঁ, অসীম চ্যাটার্জি, কাকাকে ধরেছি স্যার।” “সত্যি?” উনি এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না। “সত্যি স্যার, এখানকার লকআপে রেখেছি।” আমার উত্তর। “দারুণ কাজ করেছ, ওয়েল ডান, দেখ আবার পালিয়ে টালিয়ে না যায়। আমি কাল সকালেই ওখানে যাচ্ছি।” টেলিফোনে ওঁর গলা দারুণ খুশি খুশি শোনাচ্ছিল। আমি ওঁকে আশ্বস্ত করে বললাম, “ঠিক আছে স্যার। আমরা আছি, পালানর কোন চান্স দেব না।” আমি ফোন নামাতেই বিজিন্দ্রপ্রসাদ ডায়াল করল। হিন্দিতে ওদের এস ডি পিও সাহেবের সঙ্গে কথা বলছে। বলছে এখানে আমরা তিনজন নকশাল ধরেছি। এতক্ষণ বিজিন্দ্রপ্রসাদের কাছে আমরা অসীমের নামটা গোপন রেখেছিলাম। বিজিন্দ্ৰপ্ৰসাদ ফোনে কথা বলতে বলতে আমার কাছে ওদের নাম জিজ্ঞেস করল। বোধহয়, সাহেব ওর কাছে ওদের নাম জানতে চাইলেন। আমি নামগুলো ওকে বললাম। বিজিন্দ্রপ্রসাদ নির্বিকার মুখে অসীমের নামটা বলার পরই দেখলাম পরিবর্তন। বিজিন্দ্রপ্রসাদ থরথর করে কেঁপে উঠল। মুখটা লাল হয়ে গেল। টেলিফোনের রিসিভার হাত থেকে ফেলতে ফেলতে সামলে নিয়ে শুধু, “সাব, সাব” বলতে লাগল। তারপর কোনমতে রিসিভারটা নামিয়ে থমথমে মুখে আমায় বলল, “আমাকে এতক্ষণ বলেননি ওই নকশালদের নাম। সাহেবকে আগেই খবর দিতে পারতাম।” আমি ওর শরীরের ভাষা পড়ে বুঝলাম সাহেব ওকে প্রচণ্ড গালাগালি দিয়েছেন। অপমানে লজ্জায় ওর এই অবস্থা। বিজিন্দ্রপ্রসাদ ধমক খেতেই পারে, কারণ অসীমের ফটো এখানকার বহু পত্রপত্রিকায় পুলিশের পক্ষ থেকে ছাপান হয়েছে, সব থানায় ওর ফটো দেওয়া আছে “হাইলি ওয়ান্টেড” বলে। সেখানে বিজিন্দ্রপ্রসাদ এতক্ষণ অসীমকে দেখেও চিনতে পারেনি। এটা ওর নিশ্চিত গাফিলতি, অন্যায়ও বটে। আমি বললাম, “তুমি তো আমার কাছে ওদের নাম জিজ্ঞেস করনি। ভাবলাম তুমি বোধহয় জান, তাই বলিনি।” বিজিন্দ্রপ্রসাদ জানাল, সাহেব এক্ষুণি এখানে আসছেন।

রাত দশটা। ফোন বেজে উঠল, ‘আমিই ধরলাম। ওদিক থেকে হিন্দিতে আমাদের খোঁজ করল, গলা শুনেই বুঝলাম যশিডি থেকে দেবনাথদা। চট করে দুষ্টুবুদ্ধিটা খেলে গেল, এমনভাবে কথা বলতে শুরু করলাম যেন সারাদিন ধরে আমি আর শচী মদদে খেয়ে বেহেড মাতাল হয়ে গিয়েছি। বললাম, “আমি রুণু বলছি।” দেবনাথদা জিজ্ঞেস করল, “কি করছ কি ওখানে?” আমি উত্তর দিলাম,, “ভেরেন্ডা ভাজছি।” “তা তো বুঝতেই পারছি। আমি যে তোমার দেবনাথদা কথা বলছি তাও তুমি বুঝতে পারছ না। সারাদিন তুমি আর শচী বোধহয় আদাড়ে-বাদাড়ে ঘুরেছ।” আমি জবাব দিলাম, “শুধু ঘুরিনি, খুব ছুটেওছি।” দেবনাথদা বলল, “লাহিড়ীদের পাঠালাম তোমাদের খুঁজতে, তাদেরও পাত্তা নেই। ঠিক আছে তোমরা ওখানে থাক, আমি একটা গাড়ি নিয়ে তোমাদের আনতে যাচ্ছি, বুঝতেই পারছি তোমরা এমনি আসতে পারবে না।” আমি বললাম, “কোন দরকার নেই, আমি আর শচী হাঁটতে হাঁটতেই যশিড়ি পৌঁছে যাব।” দেবনাথদা আঁতকে উঠল, ভাবল দুই মাতাল গলা জড়াজড়ি করে দেওঘর থেকে যশিডি সারারাত রাস্তায় মাতলামি করতে করতে আসবে। কি দৃশ্য! তাড়াতাড়ি বলল, “না, না, আমি আসছি।” এবার আমারও হাসি পেয়ে গেল। গলা স্বাভাবিক করে বললাম, “তোমরা সবাই এস।” দেবনাথদা তখনও ভাবছে আমি ঘোরেই কথা বলছি। বলল, “সবাই এসে কি হবে? আমি আসছি।” আমি বললাম, “দরকার আছে, আজ আমাদের সকলকে আসামী পাহারা দিতে হবে।” দেবনাথদা বলল, “কি যা তা বকছ।” আমি বললাম, “ঠিকই বলছি, আজ আমাদের সবাইকে দেওঘর থানায় থাকতে হবে। আসামী পাহারা দিতে হবে।” দেবনাথদার প্রশ্ন, “কোন আসামীকে?” আমি বললাম, “অসীমকে।” দেবনাথদার গলায় সন্দেহ, “কোন অসীমকে?” বললাম, “অসীম, মানে অসীম চ্যাটার্জি, কাকাকে, আজ বিকেলে আমরা ধরেছি, লাহিড়ীরা আমাদের সাথেই আছে।” দেবনাথদা জানাল এক্ষুণি চলে আসছে। ফোন নামিয়ে রাখতেই শুনলাম বাইরে জিপের আওয়াজ। এস ডি পি সাহেব এলেন। আমাদের খুব অভিনন্দন জানালেন। তারপর হাজতে গিয়ে অসীমদের দেখে এলেন। আমরা রাতটা এখানেই থাকব শুনে খাবারদাবারের ব্যবস্থা করে সকালে আবার আসব বলে চলে গেলেন। আগেই দেখে নিয়েছিলাম, লক আপ থেকে টয়লেট অনেকটা দূর। দেখেই আমি রাতে থানায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। অসীমদের তো টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন হবেই। তখন শুধু এই থানার রাতের পাহারাদাররা থাকবে। ওদের ওপর এই সাঙ্ঘাতিক আসামীকে ছেড়ে যাওয়াটা আমি ভরসা করতে পারিনি।

সময় কাটাতে নিজেরা গল্পগুজব শুরু করলাম। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। শচীকে দেখে নিজের অবস্থাটা বুঝলাম। দুদিনের খোঁচা খোঁচা একমুখ দাড়ি। ঘুম নেই, খাওয়া নেই, উদভ্রান্তের মত এলোমেলো চুল। লুঙ্গি পরা, গায়ে জামার ওপর একটা আলোয়ান। থানায় কেউ এলে আমাকে আর শচীকে দেখে ভাববে আসামী, চুরিটুরির কেসে ধরে এনে বসিয়ে রেখেছে। ও.সির ঘরে একটা বহু পুরনো, অর্ধেক পারা ওঠা আয়না দেখেছিলাম। ভাবলাম, দেখব নাকি একবার নিজের চেহারাটা!

খাবার এসে গেছে। তরকা রুটি। গরম থাকতেই খেতে হবে। ঠাণ্ডা হয়ে গেলে ওই রুটি কি আর ছেঁড়া যাবে? খেয়েদেয়ে হাজতের দিকে এগিয়ে গেলাম। বসে পড়লাম সামনে। সেপাইদের থেকে খইনি নিয়ে টিপতে শুরু করব নাকি? তাহলেই দৃশ্যটা সম্পূর্ণ হয়। দেবনাথদাও বাকি সবাইকে নিয়ে হাজির হয়ে গেল। দেওঘর থানা এখন লালবাজারের অফিসারদের দখলে। আমরা অসীমদের পাহারা দিচ্ছি আর আমাদের জাগিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে মশারা। মাঝে মাঝে রাতজাগা পাখির দল ডেকে উঠছে। থানার দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। পাহাড়ের কোল বেয়ে নেমে আসছে শীত। কুয়াশা পড়ছে। আলো ফুটছে অল্প অল্প। বুঝলাম, ভোর এগিয়ে আসছে। জানি, দেবীবাবুরাও গাড়ি নিয়ে দেওঘরের দিকে এগিয়ে আসছেন দ্রুত।

হঠাৎ ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। এমন ভোরে মা পরীক্ষার আগে জাগিয়ে দিতেন। মা জানেন না, তাঁর খোকাকে এখন আর জাগিয়ে দিতে হয় না। চাকরির খাতিরে প্রায়ই রাতভর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় কোন না কোন দূরের থানায়!

চা এল, খেলাম। সকাল হয়ে গেছে। এক এক করে বড় বড় অফিসাররা সব আসতে শুরু করলেন। কলকাতা থেকে এসে গেলেন দেবীবাবু ও অরুণ মুখার্জি, সঙ্গে প্রায় কুড়িজনের দল। জামশেদপুর থেকে এলেন বিহার পুলিশের আই.জি.সাহেব, এস.পি এবং অন্যান্য পুলিশ অফিসাররা। দেওঘর থানায় এর আগে একসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের এত উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারের সমাবেশ কখনও হয়নি। তাই সবাই তটস্থ। আপ্যায়নে যেন কোন ত্রুটি না থাকে। আমরা অভিনন্দনের জোয়ারে আপ্লুত। একটু পরেই অবশ্য বড়সাহেবদের জিম্মায় সব কিছু চলে গেলে আমরা ফের ‘খড়কুটো’ হয়ে দেখতে লাগলাম।

আজ অসীমদের দেওঘর সাব-ডিভিশনাল কোর্টে হাজির করাতে হবে। নিয়ম হচ্ছে, যে কোনও আসামীকেই গ্রেফতারের পর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কোর্টে হাজির করাতে হয়। আমরা চাইছি, কোর্টের সম্মতি নিয়ে অসীমদের কলকাতায় নিয়ে যেতে। আর বিহার পুলিশ চাইছে, কলকাতায় পাঠানর আগে তাদের প্রদেশের মামলাগুলোতে অসীমকে হাজির করাতে। ওদের যুক্তি হচ্ছে, যেহেতু অসীম দেওঘরে তাদের এলাকায় ধরা পড়েছে এবং নগদ পুরস্কার বিহার সরকার আমাদের সরকারের থেকে বেশি ঘোষণা করেছেন, সুতরাং প্রথম অধিকার তাদেরই। আর আমাদের যুক্তি হল, হোক না বিহার, কিন্তু ধরেছি তো আমরা, তাই আমাদেরই প্রথম অধিকার। অনেক টানাপোড়েনের পর ঠিক হল, বিহার পুলিশ সাতদিন পর অসীমকে আমাদের হাতে তুলে দেবে। কি আর করব, আমরা সঞ্জু, দীপাঞ্জন আর শচীন্দ্রকুমার বাগচীকে নিয়ে কলকাতায় চলে এলাম।

বিহার পুলিশ সাতদিন নয়, প্রায় তিনমাস হাজারিবাগ সেন্ট্রাল জেলে অসীমকে রেখেছিল। তারপর আমাদের হাতে পৌঁছে দিল।

নকশাল নেতাদের বিচারের জন্য যে পঞ্চম ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল, অসীমকেও সেই মামলায় যুক্ত করা হল। এর আগের চতুর্থ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছিল অনন্তবাবু ও তাঁর দলের। স্বাধীনতার পর প্রথম ও দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল আদালত গঠন করা হয়েছিল পান্নালাল দাশগুপ্তদের বিচারের জন্য, দমদম-বসিরহাট মামলায়। আর তৃতীয় ট্রাইব্যুনালে বিচার হয়েছিল সোনারপুরের কংসারী হালদারদের। সাধারণত রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে আনা হয় তাদের বিচারের জন্য রাজ্যপালের আদেশ অনুযায়ী এইসব ট্রাইব্যুনাল আদালত গঠন করা হয়। সুবিধে হল, একই ছাদের তলায় একই আদালতে বিভিন্ন আদালতের মামলাগুলো একসঙ্গে চালান যায়।

১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেয়। তখন অসীমের বিরুদ্ধেও পশ্চিমবঙ্গে যত মামলা ছিল তা তুলে নেওয়া হল। কিন্তু বিহার সরকার কিছুতেই তার বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করেনি। ফলে তখন অসীম জেল থেকে মুক্তি পেল না। অবশেষে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুরোধে সব মামলা প্রত্যাহার করল বিহার। অসীম ১৯৭৮ সালে মুক্তি পায়।

মহাদেবকে আমরা কিন্তু আর কোনদিনই ধরিনি। সে তারপর এক মন্দিরের পাণ্ডা হয়ে যায়। সেই চোর এখন মন্দিরের সাধু। একমুখ দাড়ি, গেরুয়া বসনধারী। জানি না, সেও একদিন বাল্মীকির মত কোন রামায়ণ লিখবে কিনা! মহাদেব রামায়ণ লিখুক বা না লিখুক, তার দিদি সঞ্জু কিন্তু আর পাঁচটা বাঙালি মেয়ের মত বিয়ে থা করে ঘরসংসার করছে। আমার শুভেচ্ছা রইল, সে যেন আগামীদিনেও সুখে শান্তিতে থাকে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *