১১
প্রত্যেক মানুষের জীবনেই বোধহয় কিছু অভিজ্ঞতা হয় যার স্মৃতি সারা জীবন সে বয়ে বেড়ায়। হেমন্ত বসু খুন হওয়ার সময় যে আর্তনাদ করেছিলেন, সেই অসহায় জিজ্ঞাসা যেন আজও আমার পিছু ধাওয়া করে। “আমায় তোমরা মারছ কেন? আমি তোমাদের কি ক্ষতি করেছি? আমায় তোমরা মেরো না, মেরো না।” খুন হওয়ার মুহূর্তে হেমন্তবাবু খুনীদের প্রতি এই আবেদনটা আমার বুকে সব সময় বাজে।
একাত্তর সালের বিশে ফেব্রুয়ারি, সকাল এগারটা হবে। বিধান সরণি ও শ্যামপুকুর স্ট্রিটের মোড়ে হেমন্তবাবুকে নকশালরা খুন করল। তখন তিনি তাদের কাছে চীৎকার করে বারবার ওই কথাগুলি বলেছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে পরে আমরা শুনেছি। আর তখন থেকেই আমার মনের ভিতর গেঁথে আছে হেমন্তবাবুর মৃত্যু মানুষ হিসেবে আমাকে যে এতটা নাড়া দিয়ে গিয়েছিল, তার অবশ্য একটা কারণ আছে। ছোটবেলা থেকে আমি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ভক্ত। সেই নেতাজীর তৈরি করা পার্টির চেয়ারম্যান হেমন্ত বসুকেও আমি অসম্ভব শ্রদ্ধা করতাম। সেই অকৃতদার, উদার, জনগণের প্রকৃত বন্ধুকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না। তাই তাঁর অন্তিম কথাগুলো আমাকে আজও তাড়া করে বেড়ায়। যে সত্যিকারের দেশপ্রেমী সারাজীবন জনগণের সেবায় ব্রতী ছিলেন, তিনি হঠাৎ গজিয়ে ওঠা দুর্দিনের তথাকথিত বিপ্লবীদের হাতে প্রাণ দিলেন। এটা কোনদিনও মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। আমার মনে হয়, দেশের কোনও সুস্থমস্তিষ্ক, সৎ চিন্তাধারার নাগরিকই হেমন্ত বসু হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারেননি। আজও দেখি পশ্চিমবঙ্গে কোন রাজনৈতিক দল তাঁর খুনের ঘটনা বর্ণনা করে, জনগণের সেন্টিমেন্টে নাড়া দিয়ে নিজেদের ভোটের বাক্স ভর্তি করতে চায়। ওঁর মত সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষের হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাজনৈতিক ব্যবসা আর কতদিন চলবে জানি না। এটা দিয়ে অবশ্য প্রমাণিত হয় যে তিনি বর্তমান বেশিরভাগ নেতাদের মত অসৎ ছিলেন না। যারা শহীদ দিবস পালন করে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক ফয়দা তোলার জন্য।
ব্যক্তিহত্যার ডাকের পাশাপাশি একাত্তরে সাধারণ নির্বাচন বয়কটের ডাক দিয়েছিল নকশালরা। ততদিনে খতমের লাইনে হেঁটে তারা চূড়ান্ত সন্ত্রাস কায়েম করতে পেরেছে এ রাজ্যে। তখন মানুষের মনে আতঙ্ক ছাড়া আর কোনও বোধ কাজ করত না, মানুষের বেঁচে থাকার যন্ত্রণা মৃত্যুর চেয়ে ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল। খতমের লাইনের সঙ্গে এবার ভোট বয়কটের লাইন মিশে যেতে সাধারণ নাগরিক বুঝে গেল, ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারটুকুও নকশালরা কেড়ে নিল। অন্যদিকে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো নকশালদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছিল। সাধারণ মানুষকে অভয় দেওয়ার কোনও চেষ্টাই তারা করেনি। বরং তারা নিজেদের ঘর গোছাতেই ব্যস্ত ছিল। টালমাটাল পরিস্থিতিতে শহুরে মধ্যবিত্তের একাংশ নকশালদের সমর্থক হয়ে পড়েছিল। যেসব অঞ্চলে বামপন্থী আন্দোলনের তেমন কোনও ধারাবাহিকতা বা ঐতিহ্য ছিল না, সেসব অঞ্চলেও নকশালরা ঘাঁটি গাড়তে পেরেছিল। উত্তর কলকাতায় নকশালদের দৌরাত্ম্য তাই এত বেড়েছিল। শ্যামপুকুর অঞ্চলকে নকশালরা তাদের দূর্গে পরিণত করেছিল।
হেমন্তবাবু খুন হওয়ার অনেক আগেই লালবাজার হেড কোয়ার্টার থেকে তাঁকে দেহরক্ষী নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। নকশালদের ভোট বয়কটের স্লোগান ও প্রার্থীদের খুন করার হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে ওঁর নিরাপত্তা জোরদার করা দরকার বলে মনে করছিল পুলিশ। তাছাড়া, কিছুদিন আগে নকশালরা ওই শ্যামপুকুর মোড়েই খুন করেছিল সার্জেন্ট মনোরঞ্জনকে। সকালবেলায় মনোরঞ্জন বাজার করতে যাচ্ছিল, নকশালরা ওকে ঘিরে ধরল। তারপর গুলি করে ও ভোজালি দিয়ে কুপিয়ে খুন। আমরা তারপর থেকে শ্যামপুকুর এলাকাটাকে উপদ্রুত এলাকা বলে চিহ্নিত করেছিলাম। তাই হেমন্তবাবুকে সাবধান হতে বলা হয়েছিল, তাঁকে দেহরক্ষী দিতে চেয়েছিল পুলিশ থেকে। কিন্তু তিনি হেসে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, বলেছিলেন, “আরে আমাকে ওরা মারবে কেন? আমি তো ওদের কোনও ক্ষতি করিনি।” হেমন্তবাবু হয়ত ভুলে গিয়েছিলেন, অজাতশত্রুরও শত্রু আছে। পশুর কাছে খাদ্যটাই আসল, কিসের খাদ্য, কার খাদ্য এসব বিশ্লেষণ তাদের কাছে নিরর্থক।
হেমন্তবাবু যেদিন খুন হলেন, সেদিন সকালে তিনি বিধান সরণির ওপর সুভাষ কর্নারে নির্বাচনী মিটিং সেরে তাঁর শ্রীকৃষ্ণ লেনের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী মোহন বিশ্বাস। একে অনাথ শিশু হিসেবে কুড়িয়ে পেয়ে হেমন্তবাবু নিজে হাতে বড় করে তুলেছিলেন। সঙ্গে আরও ছিলেন ফরোয়ার্ড ব্লক পার্টির সদস্য রবি চৌধুরী। হেমন্তবাবু একাত্তর সালের নির্বাচনে শ্যামপুকুর কেন্দ্র থেকে সংযুক্ত বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন। উনি বাড়ি ফিরে একটু বিশ্রাম করে আবার বেরিয়ে পড়েছিলেন কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য। সঙ্গে ছিলেন সেই মোহন বিশ্বাস, রবি চৌধুরী, জয়দেব ও সাঁওতালি যুবক ডমরু। তাঁরা হাঁটতে হাঁটতে শ্যামপুকুর বিধান সরণির মোড়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, ট্যাক্সি ধরে মিটিংয়ে যাবেন। কিন্তু যেখানটায় তিনি দাঁড়িয়েছিলেন সেখান থেকে কোনও ট্যাক্সি পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে মিটিংয়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাই তিনি রবি চৌধুরীকে নির্দেশ দিলেন বিধান সরণির দিক থেকে তাড়াতাড়ি একটা ট্যাক্সি ধরে আনার জন্য। রবির ট্যাক্সি আনতে দেরি হচ্ছে দেখে হেমন্তবাবু শ্যামপুকুর মোড়ের দিকে সঙ্গীদের নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন। শ্যামপুকুর মোড়ের থেকে দশ বারো মিটার দূরে মিত্র বাড়ির গেটের কাছে এসে পৌঁছলেন ওঁরা। এমন সময় রবি একটা ট্যাক্সি নিয়ে এসে হাজির। ট্যাক্সিটাকে ঘুরিয়ে রবি হেমন্তবাবুকে ট্যাক্সিতে তুলতে গেল। এমন সময় “আরে এ ব্যাটাও ইলেক্শনে দাঁড়িয়েছে আমাদের কথা না শুনে, শালা ইলেকশানে দাঁড়িয়েছে, মার, মার শালাকে” বলে চিৎকার করতে করতে হেমন্তবাবুর দিকে তেড়ে এল তরোয়াল, রিভলবার, ভোজালি হাতে ছ’সাতজন ছেলে। লম্বা মত একটা ছেলে তেড়ে এসে হেমন্তবাবুর ঘাড়ের ওপর তরোয়াল চালিয়ে দিল। হেমন্তবাবু চিৎকার করে উঠলেন, “আমাকে তোমরা মারছ কেন? আমি তোমাদের কি করেছি?” এই আর্তনাদের মধ্যে তাঁর বুকে এসে লাগে গুলি, ঘাড়ে ফের এসে পড়ে তরোয়ালের কোপ।
তখন হেমন্তবাবুর আকুতি শুনবে কে? তখন ওরা চারুবাবুর “শ্রেণীশত্রু খতমের” আদা-জল খাওয়া উন্মাদ। ছিয়াত্তর বছর বয়সের বৃদ্ধ হেমন্তবাবুর রক্তে নিজেদের হাত রাঙিয়ে নিল ওরা। বিপ্লবী হওয়ার এতবড় সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? এদিকে হরির লুটের মত বোমা পড়তে লাগল। ভয়ে আতঙ্কে হেমন্তবাবুর সঙ্গীরা পালাল। ট্যাক্সি ড্রাইভারও হাওয়া। রক্তাপ্লুত হেমন্তবাবু পড়ে আছেন। চারদিকে দোকানপাট ঝটপট বন্ধ হয়ে গেল। সকাল এগারটাতেও রাস্তা জনমানবহীন। খুনীরা নিশ্চিন্তে পালাল। হেমন্তবাবুর নিথর দেহ তখনও একইভাবে পড়ে আছে রাস্তায়, যেন তখনকার পশ্চিমবঙ্গের প্রতীক ছবি হয়ে।
খবর এল লালবাজারে। আমরা বাকরুদ্ধ। বিরাট বাহিনী নিয়ে হাজির হলাম ঘটনাস্থলে। শুরু হল আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ। জানতে পারলাম, খুনীরা সংখ্যায় ছিল ছসাতজন, তারা হেমন্তবাবু ওখানে আসার প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে থেকে অপেক্ষা করছিল। হেমন্তবাবু ট্যাক্সিতে উঠবার সময় তাঁর ওপর ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ে খুন করে পালায়। আমরা হেমন্তবাবুর সঙ্গীদের খোঁজ করলাম, তাঁদের কথাও আমাদের পাওয়া প্রাথমিক তথ্যের সঙ্গে মিলে গেল।
তখন রাষ্ট্রপতির শাসন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে রাজ্য শাসনের দায়িত্বে ছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। তিনি নির্বাচনের মুখে রাজনৈতিক খেলা শুরু করলেন। তিনি দেখলেন সারা ভারতবর্ষের মানুষ হেমন্তবাবুর খুনের খবরে স্তম্ভিত, মর্মাহত এবং খুনীদের শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে উদগ্রীব, পত্রপত্রিকাগুলো নিন্দায় সোচ্চার। তখন তিনি তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী সি. পি. আই (এম)-এর ওপর হেমন্তবাবুর খুনের দায় চাপাতে উঠে পড়ে লাগলেন। কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিত গুপ্তকে নির্দেশ দিলেন তাড়াতাড়ি হেমন্তবাবুর খুনীদের ধরে চার্জশিট দিতে। সিদ্ধার্থবাবুর কথা মানতে গিয়ে তদন্তের ক্ষতি হল, তাঁর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের জন্য তড়িঘড়ি আমাদের স্পেশাল ব্রাঞ্চ গ্রেপ্তার করল বাগবাজার এলাকা থেকে কয়েকজনকে। তারা আদৌ খুনের ঘটনায় জড়িত ছিল না। এদের হেমন্তবাবুর খুনের আসামী সাজিয়ে কোর্টে চালান করা হল।
এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তকারী অফিসার নিয়োগ করা হয়েছিল গোয়েন্দা দফতারের বম্ব স্কোয়াডের ইন্সপেক্টর রঞ্জিত আদিত্য চৌধুরীকে। এতে আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম। কারণ খুনের তদন্ত ও মামলা চালান কিংবা নকশাল আন্দোলনের মোকাবিলা সম্পর্কে তাঁর কোনও অভিজ্ঞতাই ছিল না। অথচ মার্ডার সেকশনের কোন অভিজ্ঞ অফিসারকে এই গুরুদায়িত্ব দেওয়া হল না। হেমন্তবাবুর মত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির খুনের তদন্ত ও মামলার ভার এমন একজন অফিসারের ওপর ছাড়া হল, যিনি ঐ ব্যাপারে পারদর্শী নন। এই ছেলেখেলাটা তখন কি না করলেই চলত না? ব্যক্তিগত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য হেমন্তবাবুর খুনটাকেই বাছতে হল। যে মানুষটা সারা জীবন রাজনীতি করেও নোংরামির ঊর্ধ্বে ছিলেন, তাঁকেই মৃত্যুর পর চোরাবালিতে বলি হতে হল। ইতিহাসের কি নিষ্ঠুর পরিহাস!
চার্জশিট দেওয়ার সময় দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হল, কোনও প্রমাণ না থাকায়। কয়েকজনের নাম আত্মগোপনকারী হিসেবে দেখান হল। শেষ পর্যন্ত বন্দী একজনকে নিয়ে মামলা শুরু হল। জনসাধারণকে ধোঁকা দেওয়ার এই প্রচেষ্টা খানিকটা সফল হলেও, আমরা কেউ কেউ বিভিন্ন সোর্স থেকে, বিশেষ করে প্রতক্ষ্যদর্শী মোহন বিশ্বাস, রবি চৌধুরীর কাছ থেকে গোপনে খবর পেলাম, যাদের ধরা হয়েছে এবং যাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, তারা কেউই আসল খুনী নয়। এরা সবাই আগে কট্টর সি. পি. আই (এম) সদস্য ছিল, পরে নকশালদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তারা খুন করেনি। ফরোয়ার্ড ব্লক পার্টির ভেতরেও এ নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হতে লাগল।
কিন্তু আমরা নিরুপায়। দায়িত্ব যাদের হাতে, তারা যদি তেতো ওষুধ চুপচাপ হজম করতে বাধ্য হয়, অন্যদের কিই বা করার থাকতে পারে? আমরা তো আর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করতে পারি না। সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি, আসল খুনীরা নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের ধরবার জন্য কোনও উদ্যোগ নেই আর যারা নির্দোষ তারা খুনের মামলায় ফেঁসে অযথা জেলে- পচছে। প্রায় দুবছরের মাথায়, ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা ভক্তিভূষণ মণ্ডল হাইকোর্টে রিট আবেদন করলেন, হেমন্ত বসু খুনের নতুন করে তদন্ত করা হোক, প্রয়োজনে সি. বি. আইকে ওই তদন্তের ভার দেওয়া উচিত। কারণ হিসেবে বলা হল, সাধারণ মানুষ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মনে করছে ওই খুনের তদন্ত ঠিকভাবে হয়নি, আসল খুনীরা ধরা পড়েনি। আমি একদিন তখনকার কমিশনার সাহেব সুনীল চৌধুরীকে বললাম, “স্যার, আমাদেরও একটা সুযোগ দিন, নতুন করে হেমন্ত বসু খুনের তদন্ত শুরু করি।” তিনি রাজি হলেন, তাঁর কথামত আমরাও হাইকোর্টে আবেদন করলাম। নতুন করে তদন্ত শুরু করবার জন্য। মাননীয় হাইকোর্ট সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে নতুন করে তদন্তের আদেশ দিলেন এবং তার ভার দিলেন কলকাতা পুলিশকেই।
আমরা নতুন করে তদন্তে নামলাম। কিন্তু ঘটনা ঘটার পর পরই তদন্ত শুরু করা একরকম, আর ঘটনা ঘটার দুবছর পর অন্যরকম। প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতি, ঘটনার সময়কার পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতা, সূত্র পাওয়ার সম্ভাবনা ছাড়াও অনেক ছোটখাট তথ্য কালের দীর্ঘসূত্রতায় বেশীরভাগ সময়ই মিলিয়ে যায়। দুবছরের মধ্যে অনেক খুন, অনেক অপরাধ এ শহরের বুকের ওপর হয়ে গেছে। অগ্নিগর্ভ পশ্চিমবঙ্গ আমাদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। বিভীষিকার কালো রাত অক্লান্ত যুদ্ধ শেষেও পার করতে পারছি না। তার ওপর নতুন করে এই জটিল খুনের তদন্ত। তবু হেমন্তবাবুর মত শ্রদ্ধেয় নেতার আসল খুনীরা ধরা পড়ুক, শাস্তি পাক, সমগ্র ভারতবাসীর মত আমরাও চেয়েছিলাম। না পারলে, সেই ব্যর্থতার দায় পুলিশের এবং তা শুধু লজ্জা আর লজ্জা!
নতুন করে তদন্তের আদেশ পেলেও কি করে, কোনখান থেকে শুরু করা যায় ভাবতে সময় লাগছিল। একদিন জানতে পারলাম, আলিপুর স্পেশাল জেল থেকে জামিনে ছাড়া পাচ্ছে প্রমথ নামে এক তরুণ নকশাল। জেলের ভেতরের খবরাখবর জানার জন্য তাকে আবার আমি জেল গেট থেকে গ্রেফতার করলাম। তখন আলিপুর স্পেশাল জেলটা অল্পবয়সী কিংবা ছোটখাট মামলায় ধৃত ও মিসায় আটক নকশালদের রাখার জন্য ব্যবহৃত হত। প্রেসিডেন্সি, আলিপুর সেন্ট্রাল, দমদম জেলে রাখা হত গুরুতর মামলার আসামীদের ও বড়মাপের নেতাদের। প্রমথকে স্পেশাল জেলের গেটে যখন গ্রেফতার করলাম, সে কেঁদে উঠে বলল, “আমায় ছেড়ে দিন রুণুদা, আমায় ছেড়ে দিন, আমায় ছেড়ে দিলে আমি আপনাকে একটা খুব বড় খবর দেব।” আমি বললাম, “তোমার বড় খবরটা শুনি, তারপর ছাড়ব না রাখব সেটা ভেবে দেখব।” প্রমথকে গাড়িতে তুলে লালবাজারের দিকে ছুটলাম। দেখা যাক সে কি বড় খবর দেয়। জেল পালানর পরিকল্পনা করছে না কি কেউ? না কি আবারও কোনও খুনের চেষ্টা?
প্রমথকে নিয়ে লালবাজারে আমাদের দফতরের একটা ঘরে বসলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, “এবার বল, তোমার বড় খবরটা কি?” প্রমথর কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম, “দাদা, হেমন্ত বসু মার্ডার কেসে যাদের ধরা হয়েছে তারা কেউ আসল খুনী নয়।” যে সূত্র খুঁজছি তা যেন অযাচিতভাবে ধরা দিচ্ছে। নিজের ভেতরের উত্তেজনা চেপে ওকে বললাম, “সে তো আমরাও জানি, এ আর নতুন খবর কি? তুমি বল, কে কে আসল খুনী।” প্রমথ বলল, “আমি জানি না, সব জানে মিলন।” জানতে চাইলাম, “কোন মিলন?” প্রমথ বলল, “বাগবাজারের, এখন মিসায় স্পেশাল জেলে আছে।” প্রমথর কথায় আমার মনে পড়ল মিলনকে। সে বাগবাজার অঞ্চলের নকশালদের তাত্ত্বিক নেতা ছিল। আমি প্রমথকে জেরা করলাম, “মিলন যে জানে, তুমি জানলে কি করে?” প্রমথ বলল, জেলে সে মিলনের সাথে থাকত। একদিন কথায় কথায় মিলন তাকে বলেছে, “যাদের বিরুদ্ধে হেমন্ত বসুর খুনের মামলা চলছে, তারা কেউ আসল খুনী নয়। আসলদের আমি চিনি।” প্রমথ ফের কাকুতি মিনতি করতে লাগল, “এর বেশি আমি আর কিছু জানি না। এবার আমায় ছেড়ে দিন।” আমি ওকে বললাম, “তোমার খবরটা ভাল, তবে যতক্ষণ না সত্যি কিনা তা যাচাই করতে পারছি ততক্ষণ তোমাকে লালবাজারে থাকতে হবে। সত্যি হলে তক্ষুণি ছেড়ে দেব।” প্রমথকে লালবাজারেই রেখে দিলাম।
প্রমথর খবর শুনে ঠিক করলাম, মিলনকে স্পেশাল জেল থেকে নিয়ে এসে জেরা করব। ওকে একটা মামলায় জড়িয়ে পরদিন কোর্টের নির্দেশ নিয়ে জেল থেকে সোজা লালবাজারে নিয়ে এলাম। ওকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, ‘হেমন্তবাবুকে কে খুন করেছে বল, কে কে ছিল?” হঠাৎ ওরকম একটা প্রশ্ন শুনে মিলন প্রথমে থতমত খেয়ে গেল, তারপর পাকা অভিনেতার মত ধাক্কা সামলিয়ে বলল, “এ ব্যাপারে আমায় জিজ্ঞেস করছেন কেন? আমি কিছু জানি না।” ওর কথা শুনে মনে মনে বললাম, “কিছু জানো না তাতো হয় না বাবা, তুমি জান, সেই জানাটাই আমার জানতে হবে। হেমন্তবাবুর খুনের রহস্যের কপাট খুলতেই হবে। আসল খুনীদের ধরে শাস্তি দিতে হবে।’ আমার প্রশ্নের মুখে পড়ে মিলনের থতমত খাওয়াটা আমি দেখে নিয়েছি, আর মিলন যে খুনের ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানে সে ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত। তাই ওর কথায় কোনও গুরুত্ব না দিয়ে একটু কড়া গলায় বললাম, “দেখ বাপু, আমাদের হাতে সময় বেশি নেই। তাড়াতাড়ি বলে ফেল, তোমাকে তো মুখ দেখতে নিয়ে আসিনি।” এবারও মিলন বলল, “বিশ্বাস করুন আমি জানি না।” আমি এবার প্রমথকে মিলনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলাম, জিজ্ঞেস করলাম, “এবার বল, তুই জানিস না কি জানিস না?” মিলন ওখানে প্রমথকে দেখবে ভাবতেই পারেনি। বুঝল আর অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। এবার খুব আস্তে বলল, “জানি।” ওর “জানি” কথাটা শুনে আমার বুকের ভেতর থেকে যেন নিঃশব্দে একটা ভার নেমে গেল, এতদিন পর হয়ত আমরা হেমন্তবাবুর খুনের আসল রহস্য জানতে পারব। আমি প্রমথকে বাইরে পাঠিয়ে দিলাম। মিলনের সামনে বসে বললাম, “বল এবার সব ঘটনা, কিছু লুকোবি না। লুকোলেই কিন্তু আমি বুঝে ফেলব।”
মিলন জানাল, হেমন্ত বসুকে খুন করার কোনও পরিকল্পনা নকশালদের ছিলই না। এমন কি তাঁকে খুন করবে বলে ঘটনাস্থলে খুনীরা যায়ওনি। খুন করার পরিকল্পনা ছিল কংগ্রেসের প্রার্থী গোলকপতি রায়কে। সেই ষড়যন্ত্রের জন্য যে মিটিং হয়েছিল সেখানে মিলনও হাজির ছিল। গোলকপতি রায় বিশে ফেব্রুয়ারি সকালে শ্যামপুকুর মোড়ে নির্বাচনী সভা করতে আসবেন, এই খবরটা তারা কংগ্রেসের ভেতর থেকেই পেয়েছিল। সেই খবরের ভিত্তিতেই ওরা ওকে খুন করার ছক কষেছিল। কিন্তু ঘটনাক্রমে গোলকপতি রায় ওই সভা বাতিল করে দিয়েছিলেন, তিনি আসেনইনি। জনসভা যে বাতিল হয়েছে, এই খবরটা নকশালরা পায়নি। তাই আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের একটা দল গোলকপতি রায়কে খুন করার জন্য অপেক্ষা করছিল। অপেক্ষা করতে করতে ওরা অধৈর্য হয়ে পড়ছিল। শিকারীদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে হঠাৎ চলে এলেন হেমন্তবাবু। গোলকপতি রায়ের বদলে আর এক নির্বাচন প্রার্থীকে পেয়ে গিয়ে তারা আর কোনও কিছু চিন্তা না করেই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর হেমন্তবাবুকে খুন করে বোমা ফাটাতে ফাটাতে পালিয়ে গেল। মিলন জানাল, গোলকপতি রায়কে খুন করার চক্রান্তের মিটিংয়ে সে উপস্থিত থাকলেও ঘটনার দিন দলের সাথে ছিল না; কারা কারা ছিল তাদের নাম বলল, কিন্তু তারা সবাই এখন কে কোথায় তা সে কিছুই জানে না। তাদের সঙ্গে তার দীর্ঘদিন কোনও যোগাযোগ নেই, আর যেহেতু সে মিসায় আটক হয়ে জেলে আছে, তাই যোগাযোগ হওয়ার সুযোগও নেই।
আসল খুনীদের নাম তো পেলাম। কিন্তু কোথায় তারা? তাদের সন্ধানে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সবচেয়ে অসুবিধে হল, এদের কারোকে আমরা চিনি না। তাদের কোনও ফটোও নেই আমাদের কাছে। মিলনের দেওয়া খবর অনুযায়ী আমাদের সোর্সদের তৎপর হয়ে খুঁজতে বললাম। কিন্তু কোনও সোর্সই কোনও আলো দেখাতে পারল না। এর মধ্যেই একদিন খোঁজ পেলাম, প্রধান আসামীদের একজন শ্যামপুকুর এলাকারই বাসিন্দা। তাকে ঘটনার পর থেকেই আর এলাকায় দেখা যায়নি, এমন কি তার পরিবারের লোকজনও ঘটনার পরদিন থেকে উষাও। নিজেদের বাড়ি ফেলে তারা কোথায় চলে গেছে আশেপাশের কেউ জানে না। খুঁজতে খুঁজতে সেই আসামীর বাবার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুকে পেলাম, বয়স তেষট্টি চৌষট্টি হবে, তিনিও ওই এলাকারই বাসিন্দা। একদিন তাঁকে ধরে বন্ধুর খোঁজ করাতে তিনি জানালেন, কোন হদিসই তাঁর কাছে নেই। তবে তিনি বললেন, তাঁর বন্ধু নরেন্দ্রপুর অঞ্চলের এক আশ্রমের মহারাজের শিষ্য। সেখানে আগে খুবই যাতায়াত করত, তবে বর্তমানে সেখানে যায় কিনা তা তিনি বলতে পারলেন না।
তদন্ত ব্যাপারটা অনেকটা পাহাড়ে চড়ার মত। একটু অসতর্ক হলেই পা পিছলে পতন। এখানে আশ্রমের খোঁজ পেয়ে মনে হল একটু উঠলাম, কিন্তু কতটুকু? চুড়োয় পৌঁছলে বোঝা যাবে। না হলে শুধুই ধোঁয়াশা। আশ্রমের খোঁজ পেলেও কি করে জানা যাবে আসামীর বাবা ওখানে কোন কোন দিন তাঁর গুরুদর্শনে আসেন? তিনি দেখতেই বা কেমন? অনুমানের ওপর ঝপ করে কারোকে ধরা যাবে না। তিনি একবার যদি জানতে পারেন আমরা তাঁর খোঁজ করছি, তবে সাবধান হয়ে যাবেন, আশ্রমে আসাও বন্ধ করে দেবেন। অতিরিক্ত সতর্ক বলেই না তিনি কোনও ঝুঁকি না নিয়ে শ্যামপুকুরের বাড়িঘর ফেলে পুরো পরিবার নিয়ে পালিয়ে গেছেন। একদিন নরেন্দ্রপুরে গিয়ে বাইরে থেকে আশ্রমটা দেখে এলাম। প্রাচীর ঘেরা বেশ বড় বাগানের ভেতর আশ্রম। সামনে গেট।
আশ্রম দেখে আসার পর লালবাজারে একদিন হঠাৎ সেই বাচ্চা ছেলেটি এল। ছেলেটি প্রায়ই আমার কাছে আসে। ডন বস্কোর ক্লাস টেনের ছাত্র। দমদমে থাকে, বাড়ির অবস্থা ভাল। এই বয়সেই তার মাথায় ভূত চেপেছে সে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হবে। এ ব্যাপারে আমার সাহায্য চায়। আমি তাকে নিরাশ না করে রোজই বলি, “হবে, তুমি ডিটেকটিভই হবে, এখন মন দিয়ে পড়াশুনো কর, তারপর তুমি গোয়েন্দাগিরি করবে। বড় গোয়েন্দা হতে গেলে প্রচুর জানতে হয়, পড়াশুনোটা এখন মন দিয়ে না করলে তুমি জানবে কি করে? বড় গোয়েন্দাই বা হবে কিভাবে?” ছেলেটি প্রতিদিনই আমার কথা শুনে মনমরা হয়ে চলে যায়, আবার কিন্তু কদিন বাদে আসে। জানি, এই বয়সের ছেলেদের মনে এমনিতেই অ্যাডভেঞ্চারের স্বর্ণালী স্বপ্ন বাসা বেঁধে থাকে, তার ওপর আছে অতিরিক্ত রহস্য উপন্যাস, ইংরেজি থ্রিলার, শার্লক হোমস, আগাথা ক্রিস্টির বই পড়া, সিনেমা দেখা।
সেদিন ছেলেটি যখন আমার কাছে এল, আমি তাকে বসতে বললাম। ভাল করে ওর মুখের দিকে তাকালাম। সত্যজিৎ রায়ের “সোনার কেল্লা”র তোপসের মতই স্মার্ট। ওকে বসতে বলেই আমার মাথায় একটা পরিকল্পনা এল। বললাম, “এই যে আগামীদিনের ফেলুদা, তোমায় যদি আমি একটা বড় দায়িত্ব দিই, তুমি কাজটা পারবে করতে?” সে ঝটপট উত্তর দিল, “নিশ্চয়ই পারব, আপনি দিয়েই দেখুন না।” আমি ওর জবাব শুনে বেশ কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার প্রশ্ন করলাম, “পারবে তো? বিরাট বড় কাজ।” ছেলেটি এবারও বলল, “পারব।” এবার আমি একটা ঝুঁকি নিয়ে নিলাম। ছেলেটিকে আমি নরেন্দ্রপুর আশ্রমের কথা বললাম, আমি ওখানে যাঁর খোঁজ করছি তাঁর নামও বললাম। সেই ভদ্রলোক যে সেখানে মাঝেমধ্যে গুরুদর্শনে আসেন তাও জানালাম। তারপর বললাম, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভদ্রলোক কবে কবে ওই আশ্রমে আসেন এবং কোথায় থাকেন, এইসব খবর আমার চাই।” ছেলেটি আমার কথা মন দিয়ে শুনে চলে গেল। ও চলে যাওয়ার পর ভাবতে লাগলাম, এতবড় একটা ঝুঁকি নেওয়া কি ঠিক হল? ওইটুকু একটা পুঁচকে ছেলেকে এত বড় দায়িত্ব দেওয়াটা উচিত হল? অতি উৎসাহে বেফাঁস কিছু কথা বেরিয়ে গেলে সব পণ্ড হবে। দুশ্চিন্তায় দুটো দিন পার হয়ে গেল। তিনদিনের মাথায় ছেলেটি আমার কাছে এল। ওর খুশিখুশি চোখমুখ দেখেই বুঝলাম, কিছু একটা খবর এনেছে
খবর শুনে আমারও খুব ভাল লাগল। ছেলেটি দারুণ করিৎকর্মা, এই দুদিনের মধ্যেই সে ওই আশ্রমের মহারাজের শিষ্য হয়ে গেছে। আশ্রমের মধ্যেই থাকতে শুরু করেছে। সবচেয়ে বড় কথা যাঁর খোঁজে পাঠিয়েছিলাম, তাঁর খোঁজ এনেছে। সেই ভদ্রলোক স্ত্রী ও এক মেয়েকে নিয়ে আশ্রমেরই একটা ঘরে থাকেন। তবে ওঁদের সঙ্গে কোনও ছেলে থাকে না। আমার ছোট ফেলুদা সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে খুব ভাব করে নিয়েছে, তাঁর ঘরে যাতায়াত শুরু করে দিয়েছে। আমি খুদে গোয়েন্দার কৃতিত্ব দেখে ওকে জড়িয়ে ধরলাম, “বাঃ, খুব ভাল খবর এনেছ, তোমার হবে। ওদের সাথে লেগে থাক, দেখবে, আরও দরকারি খবর পাবে। খবর পেলেই তুমি আমায় দিয়ে যাবে।” ছেলেটি উৎসাহে টগবগ করতে করতে চলে গেল।
চারদিনের মাথায় সে আরও খবর আনল। তাকে নিয়ে সেই ভদ্রলোক হাঁটতে হাঁটতে কাছেই এক পোস্ট অফিসে গিয়েছিলেন মানি অর্ডার করতে। মানি অর্ডারটা করা হয়েছে আসামের কোনও এক আশ্রমে, তবে ঠিকানাটা ছেলেটি দেখতে পায়নি। আমি ওকে বললাম, “হুঁশিয়ার, কিছু যেন বুঝতে না পারে, দেখবে ঠিক পেয়ে যাবে যা আমি চাই।” সে বলল, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি খুব সাবধানে চলছি, খবর ঠিক পেয়ে যাব। ওরা বুঝতেই পারবে না।” দেখলাম, ছেলেটি রীতিমত আত্মবিশ্বাসী। সেদিনের মত সে ফিরে গেল আশ্রমে। তারপর থেকে শুরু হল আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষা, একটা একটা করে দিন চলে যাচ্ছে, কোনও খবর পাচ্ছি না। চাতক পাখির মত বসে আছি খবরের আশায়, কখন আসে আমার ফেলুদা কি নতুন খবর শোনায়? দিন কুড়ি পর গোয়েন্দা কিশোর এল। তাকে দেখেই আমি তাকে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি ব্যাপার? কোনও খবরই পাচ্ছি না!” ছেলেটি আমার প্রশ্ন শুনে হেসে বলল, “আপনার কাজ বোধহয় হয়ে গেছে।” আমি জানতে চাইলাম, “কি রকম?” সে বলল, “ওই ভদ্রলোক আজ আর নিজে পোস্ট অফিসে না গিয়ে আমাকেই আড়াইশো টাকা দিলেন মানি অর্ডার করতে। আমি মানি অর্ডার করে সোজা চলে এসেছি আপনার কাছে।” তারপর একটা কাগজ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই নিন ঠিকানাটা।”
ইউরেকা, ইউরেকা বলে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করছিল। কাগজটা বারবার দেখছি, এই তো আসামীর নাম, শুধু তার পদবির জায়গায় লেখা আছে “ব্রহ্মচারী”। আমার মনে কোনও সন্দেহই রইল না, যাকে খুঁজছি সেই ব্যক্তিই এই ব্রহ্মচারী বাবাজী। ঠিকানাটা আসামের করিমগঞ্জের এরই শাখা এক আশ্রমের। আগামীদিনের ফেলুদার দিকে তাকিয়ে রইলাম, কি ভাষায় আমি ওর কাজের প্রশংসা করব? শুধু বললাম, “তুমি অসম্ভব ভাল কাজ করেছ, একশতে একশ। ওখানে তোমার কাজ শেষ। তবু আর একবার আশ্রমে যাওয়া দরকার। মহারাজের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যাও। কেউ সন্দেহ না করতে পারে যে তুমি কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে ওখানে ছিলে। আর মানি অর্ডারের অরিজিনাল রিসিটটা ওই ভদ্রলোককে দিয়ে দেবে।” আমি রিসিটটা জেরক্স কপি করিয়ে নিলাম। আমার ছোট্ট ফেলুদা বিদায় নিয়ে চলে গেল।
ঠিকানা পাওয়ার পর আর দেরি নয়, করিমগঞ্জ যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করলাম। পরদিন আমি আর লাহিড়ী প্লেনে শিলচর গেলাম। ওখানে পৌঁছে আর এক বিপদ। দেখি, সেদিন শিলচর বন্ধ। কি করি? আমাদের তো করিমগঞ্জ যেতেই হবে। আমরা দুজন তখন কাছেই একটা থানায় গিয়ে ওখান থেকে জেলার ম্যাজিস্ট্রেট আর এস. পি.র সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলাম। এস. পি. সাহেব আমাদের ওখানেই অপেক্ষা করতে বললেন। কিছুক্ষণ পর ওঁরা এলেন। আমরা তাঁদের বললাম, এক গুরুত্বপূর্ণ খুনের আসামীকে ধরতে আমরা করিমগঞ্জ যেতে চাই। ওঁরা আমাদের কথা শুনে একটা জিপের ব্যবস্থা করে দিলেন। আমরা করিমগঞ্জের দিকে রওনা দিলাম।
আশা নিরাশার দোলায় দুলতে দুলতে আমরা করিমগঞ্জের দিকে চলেছি, রাত দশটা নাগাদ পৌঁছলাম। পৌঁছেই করিমগঞ্জ থানায় গেলাম। থানায় তখন বড়বাবু ছিলেন না, তিনি বাড়িতে ছিলেন। খবর দিতে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই থানায় এলেন। বললাম, “আমরা দেরি করব না, আজ রাতেই সেই আশ্রমে যেতে চাই।” উনি আমাদের কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে বললেন, “সে কি, সে তো এখান থেকে অনেক দূর, একেবারে বাংলাদেশের সীমান্তে। এখন সেখানে যাওয়ার কোনও গাড়িও পাবেন না। হেঁটে যেতে হবে।” একটুও না দমে বললাম, “হেঁটেই যাব, আপনি আমাদের ফোর্স দিন।” একটু পরেই ফোর্স নিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলাম। সঙ্গে করিমগঞ্জ থানার কজন সিপাই। বর্ষাকাল, আকাশে মেঘের আনাগোনা। তারই ফাঁকে ফাঁকে মাঝেমধ্যে ফুটে উঠছে তারা। গ্রামের পর গ্রাম পার হয়ে যাচ্ছি। দূরে দূরে দুচারটে বাড়ির জানালা থেকে উঁকি মারা আলোর রশ্মি জানান দিচ্ছে ওখানে মানুষ আছে। আমি আর লাহিড়ী আবোলতাবোল বকতে বকতে চলেছি। সামনে সামনে চলেছে ফোর্সের সেপাইরা। ওরাই আমাদের আশা-ভরসা। ওরা যে পথে নিয়ে যাচ্ছে সেপথেই চলেছি। তার ওপর ভাষার সমস্যা, কাজ চলার মত যা পারছি তাই বলছি।
রাত তখন প্রায় দুটো, বারো তেরো কিলোমিটার পথ ততক্ষণে হাঁটা হয়ে গিয়েছে। আমরা এসে পৌঁছলাম খরস্রোতা এক নদীর ধারে। চওড়া বেশি নয়, কিন্তু দুরন্ত ঢেউ। বর্ষার পাহাড়ী নদী কিশোরী মেয়ের মত অকারণ আনন্দে খলখলিয়ে হাসতে হাসতে নাচতে নাচতে চলেছে। আমরা তার পাড়ে দাঁড়িয়ে স্রোত দেখতে লাগলাম। মনে মনে বললাম, “হে সুন্দরী, ঘুঙুরের তালে তালে তোমার এই মেহফিল জমান নাচ দেখতে খুবই ভাল লাগছে। কিন্তু আমরা যে এসেছি সেই সুদূর কলকাতা থেকে বিরাট দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার নাচ দেখলে তো চলবে না, আজ রাতেই ওপারে যেতে হবে।” সঙ্গের এক সিপাই আগেই আমাদের জানিয়ে দিয়েছে, রাত আটটার মধ্যে খেয়া পারাপার বন্ধ হয়ে যায়। আমি অসহায়ভাবে জানতে চাইলাম, “তবে কি উপায়?” “দাঁড়ান, একটা উপায় বার করছি, আমি একটু আসছি,” এই বলে সে আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে অন্ধকারের মধ্যে কোথায় চলে গেল। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আবার ঢেউয়ের খেলা দেখতে লাগলাম। প্রায় আধঘণ্টা পর সেই সিপাই অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এল। সঙ্গে একটা লোক। দুজনের কাঁধে কটা কাটা কলাগাছ। তারপর কিছু না বলে, সিপাই আর সেই লোকটি মিলে দ্রুত একটা ভেলা বানিয়ে ফেলল।
কলাগাছের ভেতর বাঁশের চাঁচরি ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে ভেলা তো বানাল, কিন্তু এই ভেলা নিয়ে আমরা পার হব কি করে ওই খরস্রোতা নদী? ওরা কিন্তু কোন কথা বলছে না। আমরা সাহস করে ওদের কিছু জিজ্ঞেসও করছি না। দেখলাম, ওরা দুজন একটা মোটা লম্বা দড়ি বার করে নদীর পাড়ে রাখল। ভেলাটা দুজনে মিলে ধরে জলে নামাল। লোকটি ভেলাতে চড়ে দড়ির একটা দিক কোমরে বেঁধে বাঁশ দিয়ে জল ঠেলতে ঠেলতে যেন ঢেউয়ের ঝুঁটি ধরে নদীর ওপারে যেতে লাগল। লোকটার ওস্তাদি দেখে আমরা বোবা হয়ে গেলাম। সে ওপারে পৌঁছে গেল। ভেলাটা ঠেলে নদীর ধারে একটা পাথরের খাঁজে এমনভাবে রাখল যাতে ঢেউয়ের তোড়ে না ভেসে যায়। তারপর দড়ির প্রান্তটা একটা গাছের সাথে শক্ত করে বেঁধে দিল। এদিকে সিপাই তার আগেই অন্য প্রান্তটা এপারে বেঁধে দিয়েছে। লোকটি দড়ি বেঁধে ভেলা নিয়ে চলে এল আমাদের কাছে। এবার আমরা তিনজন করে দড়ি ধরে ধরে ভেলায় দাঁড়িয়ে পার হতে লাগলাম, সেই লোকটিই ভেলা নিয়ে পারাপার করতে লাগল। ভেলায় পার হতে গিয়ে জলে আমাদের জুতো, ট্রাউজার্সের তলার দিকটা ভিজে গেল। সবাই পার হয়ে যেতে, আমি অসমের কোন এক অখ্যাত গ্রামের সেই অজানা বন্ধুটিকে একশ টাকা দিলাম। যদিও জানি, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে যে কাজ সে করেছে, এই পারিশ্রমিক তার কাছে কিছুই নয়। সে গ্রাম্য সিলেটি ভাষায় কিছু বলল, তার হাসি দেখে বুঝলাম, সে আমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে।
নদী পার হয়ে আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর একজন সিপাইকে বললাম, “আমাদের এখানকার পোস্টমাস্টারের বাড়ি নিয়ে চল।” আমি ভাবলাম, আমরা তো আসামীকে চিনি না, কিন্তু পোস্টমাস্টার কিংবা তাঁর পিওন নিশ্চয়ই চেনেন, কারণ প্রতি মাসে মানি অর্ডার পৌঁছে দিতে হয় তার হাতে। মানি অর্ডারের টাকাটা সেই ব্রহ্মচারীকে পৌঁছে দেন। নদী পার হওয়ার পর আরও দু কিলোমিটার মত হাঁটলাম। পোস্টমাস্টারের বাড়ি এসে গেছে। দেখলাম, পোস্ট অফিসেরই একটা ঘরে পোস্টমাস্টারবাবু থাকেন। আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলোর পোস্ট অফিসের যেমন চেহারা এটারও তাই।
রাত তখন তিনটে। একজন সিপাই সেই পোস্টমাস্টারের নাম ধরে ডাকতে লাগল। পোস্টমাস্টার এত রাতে কেউ ডাকছে শুনে বোধহয় ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, একটু পর কোনক্রমে ঘরের দরজা ফাঁক করে পুলিশ আর অচেনা লোকজন দেখে ঘাবড়ে গেলেন। আমি তাঁকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, “কদিন আগে কলকাতা থেকে এই ব্রহ্মচারীর নামে যে মানি অর্ডার এসেছে, তা কি দিয়ে আসা হয়েছে?” আমার কথা শুনে পোস্টমাস্টার কেমন যেন ভ্যাবাচাকা খেয়ে উত্তর না দিয়েই তাড়াতাড়ি তাঁর অফিসঘর খুললেন। আমরাও তাঁর পেছন পেছন অফিসে ঢুকলাম। হ্যারিকেনের আলো, তার মধ্যে মানি অর্ডারের লেজার খুলে দেখা গেল, গত দুমাস ধরে ব্রহ্মচারীর নামে যে মানি অর্ডার এসেছে তার সব টাকাই পোস্টমাস্টার নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। আমরা তার কাণ্ড দেখে হতবাক। এবার আমরা ওর দুষ্কর্মের সুযোগ নিলাম। ওকে বললাম, “কেন টাকা দেননি? এই রকম কতজনের টাকা নিজের কাছে রেখেছেন?” পোস্টমাস্টার চুপ। আবার আমি ধমক দিলাম, “সব টাকা বোধহয় সুদে খাটান?” আমাদের প্রশ্নের তোড়ে পোস্টমাস্টারের প্রায় কেঁদে ফেলার যোগাড়। আসলে উনি ভেবেছেন, ওর বিরুদ্ধে কোন গোপন খবর পেয়ে আমরা তদন্ত করতে এসেছি। এবার ধরা গলায় বললেন, “স্যার, আমার চাকরিটা খাবেন না, আমি মরে যাব।” বললাম, “ঠিক আছে, ব্রহ্মচারীকে টাকা দেবেন চলুন।” পোস্টমাস্টার দ্বিরুক্তি না করে তাড়াতাড়ি মানি অর্ডারের ফর্ম আর টাকা নিয়ে অফিস বন্ধ করে আমাদের সঙ্গে রওনা হলেন। আমাদের সুবিধেই হল, যাকে ডেকে উনি টাকা দেবেন তাকেই আমরা ধরব।
ভোর চারটে বাজে, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে চলেছি, পাথরকুচি ছড়ান কাঁচা পাহাড়ী রাস্তায় ধুলো উড়ছে পায়ে পায়ে। আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটছে। দূরে দূরে পাহাড়, নিঝুম চরাচর, বর্ষাভেজা প্রকৃতি। দেখছি কত নাম-না-জানা গাছগাছালি, শুনছি কতরকম পাখির ডাক। পোস্টমাস্টার বকবক করতে করতে চলেছেন। কতটুকুই বা মাইনে, তাতে সংসার চলে না। আমাদের অবশ্য সেদিকে মন নেই। তখন আমাদের একমাত্র চিন্তা আসামীকে ধরতে পারব তো?
অন্যদিকে চোখের সামনে কবিতার মত প্রকৃতি। প্রায় তিন চার কিলোমিটার হাঁটার পর ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম আশ্রমের কাছে। দেখলাম, সবুজ মাথা এক টিলার মাথায় বাগান ঘেরা আশ্রম। আমরা আস্তে আস্তে টিলার ওপর উঠতে লাগলাম। আশ্রমের দক্ষিণ দিকে টিলার নিচেই বাংলাদেশের সীমান্ত, শ্রীহট্ট জেলা। টিলার ওপর থেকে পরিষ্কার ওদিকের সব কিছুই দেখা যায়। আশ্রমটা আত্মগোপন কিংবা অবসর যাপনের আদর্শ জায়গা। আমরা বাড়িটার কাছে পৌঁছে গিয়েছি। কোনও লোকজনকে দেখতে পাচ্ছি না। পোস্টমাস্টারবাবুকে এগিয়ে দিলাম। তিনি আশ্রমের সবই চেনেন, একদিকে গিয়ে ব্রহ্মচারীর নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। আমরা তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে আছি। বাড়িটার পেছন দিকে সিপাইরা আছে। ওখান দিয়ে পালানর রাস্তা আছে, তাই ওদের ওখানে রেখেছি। বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করার পর ঘুম চোখে দরজা খুলতে খুলতে ব্রহ্মচারী বলল, “মাস্টারবাবু এত সকালে, টাকা এসেছি বুঝি?” পোস্টমাস্টার জবাব দিলেন, “হ্যাঁ, মানি অর্ডার দিতে এসেছি।” ব্রহ্মচারী দরজা খুলে বলল, “আরে এত তাড়া কিসের? বেলা হলে আসতে পারতেন।”
ততক্ষণে দুধ সাদা কৌপিন পরা ব্রহ্মচারীর দৃষ্টি এদিকে পড়েছে। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমাদের দেখে আবার দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছে। এবার আমি গলা চড়িয়ে বললাম, “ব্রহ্মচারীর খেলা শেষ কর পাণ্ডবেশ্বর মুখার্জি, পালানর চেষ্টা কোরো না। কলকাতা থেকে তোমার ওই সাদা কৌপিনটা নিয়ে যেতে আসিনি। যে সাধুকে খুন করে এখানে সন্ন্যাসীর বেশ ধরে বসে আছ, তাঁর আত্মার শান্তির জন্য তোমাকে আমরা নিয়ে যাব।” কথা বলতে বলতেই ওকে আমরা ধরে নিয়েছি। পাণ্ডবেশ্বর শুধু একবার বলতে চেষ্টা করল, “আমি কারোকে খুন করিনি।” উত্তরে লাহিড়ী বলল, “অনেক খাটনি গেছে, তোর কীর্তন পরে শুনব।” ওকে টানতে টানতে আমরা নিয়ে চললাম। আমাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে আশ্রমের দু চারজন উঠে পড়েছে দেখলাম, তারা এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেছে। এদিকে পোস্টমাস্টারের মুখটা তখন দেখার মত, একদম থ হয়ে গেছেন। হাঁটতে হাঁটতেই একটু ধাতস্থ হয়ে আমায় জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার, মানি-অর্ডারের টাকাটার কি হবে?” আমার হাসি পেল, বললাম, “টাকার আর দরকার হবে না, ওটা আপনি সুদে খাটান, জেল খেটে ও যদি ফিরে আসে তখন নয় ওর টাকা ওকে দিয়ে দেবেন, তবে সে সম্ভাবনা খুব কম।” ওর মুখে হাসি ফুটল।
সকাল হয়ে গেছে। পাণ্ডবেশ্বরকে মাঝখানে রেখে হাঁটতে হাঁটতে সেই নদীর পাড়ে পৌঁছে গেলাম। দেখলাম, খেয়া পারাপার শুরু হয়ে গেছে। এবার নদী পার হতে আর জীবনের ঝুঁকি নিতে হল না। খেয়ার মাঝখানে পাণ্ডবেশ্বরকে জাপটে ধরে বসে রইলাম, যাতে সে নদীতে ঝাঁপ না দিতে পারে। পার হয়ে আবার হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে সকাল এগারটা নাগাদ করিমগঞ্জ থানায় পৌঁছলাম। থানার গারদে ওকে রেখে চলে গেলাম অসম সরকারের এক অতিথিশালায়। থানাতেই আমাদের জেরার মুখে পাণ্ডবেশ্বর স্বীকার করেছে, হেমন্তবাবুকে তরোয়াল দিয়ে সেই মেরেছিল।
গেস্ট হাউসে রাঁধুনীকে মুরগির ঝোল আর ভাত রাঁধতে বলে আমরা দুজন স্নান করেই সোজা বিছানায়। মনে অদ্ভুত তৃপ্তি। হেমন্ত বসুর হত্যাকাণ্ডের আসল আসামীকে ধরতে পেরেছি। ক্লান্তিতে শরীরের যা অবস্থা, সঙ্গে সঙ্গে একেবারে ঘুমের অতলে। ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়েছি কি ঘুমইনি, মনে হল কে যেন আমায় ঠেলছে। চোখ না খুলেই বিরক্তিতে আমি তার হাতটা সরিয়ে দিলাম। তবু আবার সে ঠেলতে শুরু করল, আবার আমি হাতটা সরিয়ে দিলাম। এবার একটা গলা শুনলাম, “আরে আমি এখানকার ম্যাজিস্ট্রেট, আসামীর জন্য রিমান্ড নেবেন না?” কথাগুলো আবছাভাবে গভীর ঘুমের মধ্যে কানে পৌঁছল বটে, কিন্তু মর্ম বুঝলাম না। এবার শুনতে পেলাম, “আমি চলে গেলে আরও দুদিন আপনাদের এখানে থাকতে হবে।” কিছুটা বুঝে, কিছুটা না বুঝে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। দেখি ধোপদুরস্ত এক ভদ্রলোক। তিনি আমার অবস্থা দেখে হেসে ফেললেন। অন্য খাটে লাহিড়ী তখনও অঘোরে ঘুমচ্ছে। ভদ্রলোক এবার কেটে কেটে বললেন, “আমি ম্যাজিস্ট্রেট, রিমান্ড নেবেন না?” আমার তখনও ভাল করে ঘুম কাটেনি। উনি সেটা বুঝে খাটের একধারে বসলেন, “এখানকার অবস্থাই এমনি। আসামী ধরা পড়লে, আমাদের এখানে এসে রিমান্ড অর্ডার নিয়ে যেতে হয়। দিনে দুটো বাস যাতায়াত করে। আজ আমি চলে গেলে আবার দুদিন পর এখানে আসব, সে পর্যন্ত আপনারাও এখানে আটকে থাকবেন। রিমান্ড ছাড়া তো আসামী নিয়ে যেতে পারবেন না। থানা থেকে আমাকে খবর দেওয়াতে চলে এলাম।” এবার আমি ব্যাপারটা বুঝলাম। বললাম, “আমি ভীষণ লজ্জিত, বুঝতে পারিনি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আপনাকে যদি কষ্ট দিয়ে থাকি সেজন্য মাপ করবেন।” উনি হেসে বললেন, “আপনাদের সব খবর শুনেছি, ঘুম তো স্বাভাবিকই।” আমি তাড়াতাড়ি লাহিড়ীকে ঠেলে তুললাম। লাহিড়ী উঠে বসে ভুরু কুঁচকে বলল, “কি হয়েছে?” আমি বললাম, “ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নিজে এসেছেন রিমান্ড দিতে। একটা কাগজ নাও আমি বলছি, তুমি ড্রাফট লেখ।” লাহিড়ী তাড়াতাড়ি একটা সাদা কাগজ নিয়ে বসল।
আমি বলছি, লাহিড়ী লিখছে। লেখা শেষ হলে কাগজটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি কাগজটা নিয়ে হাসব না কাঁদব ভেবে পাচ্ছি না। লাহিড়ীর মুখের দিকে তাকালাম, চোখভর্তি ঘুম নিয়ে সেও আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আমি আবার কাগজটার দিকে তাকালাম, কি লিখেছে লাহিড়ী! কাগজ জুড়ে কতগুলো হিজিবিজি দাগ, যেন আরশোলার ঠ্যাঙে কালি লাগিয়ে কাগজের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। লাহিড়ী তখনও আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে আমি হেসে ফেললাম, “যাও, চোখেমুখে জল দিয়ে এস।” লাহিড়ী উঠে বাথরুমে গেল। ফিরলে কাগজটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, “দেখ, কি লিখেছ।” কাগজটা হাতে নিয়ে এবার লাহিড়ীও হেসে ফেলল। তাড়াতাড়ি অন্য একটা কাগজ নিয়ে নতুন করে লিখতে শুরু করল। কলকাতার অ্যাডিশনাল চিফ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে পাণ্ডবেশ্বরকে হাজির করানর ফরমান। লেখা হলে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তাতে সই সাবুদ করে দিলেন। তাঁর ফেরার বাসের তখনও বেশ কিছুটা দেরি, আমাদের সঙ্গে গল্পগুজব করে কাটালেন।
উনি চলে গেলে আমরা খাওয়া দাওয়া সেরে গেলাম করিমগঞ্জ থানায়। দারোগাবাবু আমাদের জন্য একটা জিপ যোগাড় করে রেখেছিলেন। বিমানবন্দরের দিকে রওনা দিলাম। প্লেনে পাণ্ডবেশ্বরকে বসিয়ে আমি আর লাহিড়ী দুদিকে বসলাম। বিমান সেবিকার কফি খেতে খেতে পাণ্ডবেশ্বরকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলাম। কলকাতায় পৌঁছনর আগেই পাণ্ডবেশ্বর সমস্ত কথা স্বীকার করল। গোলকপতি রায়কে খুন করার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে হেমন্তবাবুকে খুন করা পর্যন্ত বিস্তারিতভাবে সে আমাদের বলল। দমদমে নেমে পাণ্ডবেশ্বরকে নিয়ে সোজা চলে এলাম লালবাজারে। সেখানে বসে পাণ্ডবেশ্বরের দেওয়া বিবৃতি লিখে ফেললাম।
পাণ্ডবেশ্বরের স্বীকারোক্তির ফলে আমাদের খুব সুবিধে হল। ওর কাছ থেকেই জানতে পারলাম কে হেমন্তবাবুকে গুলিটা করেছিল। এবার তাকে গ্রেফতার করার চেষ্টা শুরু করলাম। অন্যদিকে পাণ্ডবেশ্বরের কথা সত্যি না মিথ্যে তা যাচাই করার জন্য তার দেওয়া বর্ণনার খুঁটিনাটি সব মিলিয়ে দেখতে লাগলাম। অনেক সময়ই দেখেছি আসামী ভুল তথ্য দিয়ে পুলিশকে বিপথে চালিত করে। আবার এরকমও দেখেছি, বেকার যুবক, খাওয়া থাকার কোনও ঠিক নেই, কোনও অপরাধের দায় স্বেচ্ছায় নিজের ঘাড়ে নিয়ে বেঁচে থাকার সমস্যা থেকে জেলে ঢুকে যায়। কিছুদিনের জন্য হলেও তো মুক্তি পেল। এর ফল মারাত্মক। যে কিনা প্রকৃত দোষী, সে দিব্যি বুক ফুলিয়ে বাইরে ঘুরে বেড়ায়, নতুন নতুন অপরাধ করে। তাই ধৃত ব্যক্তি সঠিক অপরাধী কিনা পরীক্ষা করে নেওয়া দরকার। যা হোক একজনকে গ্রেফতার করে তাকে মামলায় জড়িয়ে দায়িত্ব পালন করার আত্মপ্রসাদ পাওয়া যায় হয়ত, কিন্তু তাতে পুলিশের কর্তব্য করা হয় না।
আলিপুরে এক গভীর রাতে ফরাসী কনসাল জেনারেল ও তাঁর স্ত্রী নিজেদের শোয়ার ঘরে খুন হয়ে গেলেন। ছুরি, ভোজালি দিয়ে খুন করা হয়েছিল। বাড়ির সিকিউরিটির গার্ডরা বা কাজের লোকজন কেউ টের পায়নি। কেন চিৎকার বা আওয়াজ কিছুই শোনা যায়নি। খুনী সম্ভবত বাড়ির পেছন দিকের জলের পাইপ বেয়ে দোতলায় উঠে তাঁদের ঘরে ঢুকে খুন করে পালিয়েছে। কিন্তু কিজন্য ওঁরা খুন হলেন? কে বা কারা ওঁদের খুন করতে পারে? এই সব প্রশ্নে তখন চারদিক তোলপাড়। পত্রপত্রিকায় ছবি ও ঘটনাস্থলের চারপাশের ম্যাপ সমেত বড় বড় খবর প্রকাশিত হতে লাগল। এটা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপার। বিদেশে আমাদের বদনাম হওয়ার আশঙ্কা।
মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে, অথচ খুনীর চরিত্র বা খুনের ব্যাপারে কোনও সূত্রই পাওয়া যাচ্ছে না। যে অফিসার ওই তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি এক নেপালি যুবককে হঠাৎ গ্রেফতার করলেন। নেপালী যুবক সেই অফিসারের সোর্সকে বলেছিল যে সেই খুন করেছে। কিভাবে খুন করেছে তার বর্ণনাও দিয়েছিল। গোয়েন্দা অফিসার ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই নেপালী যুবককে গ্রেফতার করে আদালতে মামলা শুরু করে দিলেন। কিন্তু পরে তদন্ত করে জানা গেল, নেপালী ছেলেটির সব কথাই একদম বাজে, ওই খুনের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্কই নেই। সে জেলে ঢুকবার অছিলায় নিজে খুনের দায়িত্ব নিয়েছিল। খবরের কাগজ পড়ে ও ঘটনাস্থলের আশেপাশের লোকজনের কাছ থেকে বর্ণনা শুনে সেসবই আমাদের অফিসারকে বলেছিল। কিন্তু ঘটনার খুঁটিনাটি অনেক কিছুই সে জানত না। তাই সেসম্পর্কে যুবকটি কিছুই বলতে পারেনি। কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণও খুঁজে পাওয়া যায়নি, কেন সে ওই দম্পতিকে খুন করবে? আসলে প্রথম জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যেই অনেক ফাঁক থেকে গিয়েছিল বলে তাকে দুম করে আসামী বানিয়ে জেলে পাঠান হয়েছিল। মুশকিল হল, জেরা শুরু করার সময় কোনও পূর্ব-সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করলেই ভুল পথে চালিত হওয়ার সম্ভাবনা একশ ভাগ থেকে যায়। তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অযৌক্তিক চাপ, নিজের কেরামতী দেখানর লোভে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করার তাগিদ থেকেই ভুল হয়। তদন্তে অনুমানকে বড় করে দেখলে চলে না। তদন্তের সঠিক পদ্ধতি হল, সমস্ত সম্ভাবনার সূত্র ধরে একে একে সবকটির শেষ পর্যন্ত বিস্তারিতভাবে দেখা। সহজে বলতে গেলে, তদন্তের সময় হয় ঘটনাস্থলের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আসামী পর্যন্ত পৌঁছন যায়, আবার এর উল্টোটিতে করা যায়। পাণ্ডবেশ্বরকে গ্রেফতারের পর যেমন দ্বিতীয় পদ্ধতিই নিতে হল। আসামীর দেওয়া বর্ণনা মিলিয়ে দেখা শুরু হল। পাণ্ডবেশ্বরের বিবৃতির সঙ্গে সবই মিলে যেতে লাগল।
ইতিমধ্যে আমরা জেনে গিয়েছি হেমন্তবাবুকে যে গুলি করেছিল সে বাঙালি নয়, ওড়িশাবাসী। তবে তার পরিবার বহু বছর কলকাতায় থাকার ফলে প্রায় বাঙালি হয়ে গিয়েছে। তার বাড়ি ছিল মুচিপাড়া থানা এলাকায় হিদারাম ব্যানার্জি লেনের কাছে। সেখান থেকে সে প্রতিদিন শ্যামপুকুরে আড্ডা মারতে যেত। সে ছিল শতকরা একশ ভাগ লুম্পেন, তার সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক ছিল না। শ্যামপুকুরে আড্ডা মারতে মারতে হঠাৎ সে নকশাল হয়ে গিয়েছিল।
তার বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানলাম, সে বহুদিন বাড়িতে নেই, পাড়াতেও আসে না প্রায় বছর দুয়েক। সময়টা মিলিয়ে দেখলাম, হেমন্তবাবুর খুনের পর থেকে সেও উধাও। তারা ছিল আট ভাই। আমরা সব ভাইদের পেছনে সোর্স লাগিয়ে দিলাম। সেসব সোর্সের মাধ্যমেই জানতে পারলাম, খিদিরপুরের এক বস্তি অঞ্চলে তার মত একটা ছেলে কয়েকদিন ধরে আছে। একদিন রাতে পুলিশের এক বিশাল বাহিনী বস্তি ঘিরে ফেলল। বস্তির ভেতর এদিক ওদিক সরু সরু অসংখ্য গলি, গলির মধ্যে ঘরও একটার গায়ে একটা ঘেঁষাঘেঁষি। কোন ঘরটায় সে আছে নির্দিষ্টভাবে খবর পাইনি। তাই সাবধানে একটার পর একটা ঘর আমাদের লোকেরা দেখতে লাগল। সবচেয়ে বড় অসুবিধে, পুলিশের কেউ ওকে চেনে না। ওর কোন ফটোও আমাদের কাছে নেই। আমাদের তল্লাশির মধ্যেই সে পালাল, এক সিপাইয়ের ক্ষণিক গাফিলতির সুযোগ নিয়ে। সিপাইটা যে গলির মুখে পাহারায় ছিল, সেখানে বস্তি থেকে বেরনর একটা দরজা ছিল। গ্রামের হাঁস-মুরগী রাখার ঘরের দরজার মত অনেকটা। পাতলা কাঠের ছোট ডালা মত, টেনে ওপর দিকে তুলতে হয়, মাথা গলিয়ে কোনমতে গলিতে বেরন যায়। সিপাইটা সেই দরজার সামনে পাহারা দিচ্ছিল। ভোর হয়ে এসেছিল, সিপাইটা দরজার সামনে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ছেলেটা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আস্তে দরজা ওপর দিকে টেনে তুলে বেরিয়ে গিয়েছিল। দরজা এমনভাবে ওপরে আটকে রেখেছিল যাতে নিচে পড়ে গিয়ে শব্দ না হয়। সিপাইটা টেরই পায়নি। বরং ছেলেটা যাওয়ার সময় সিপাই ঘুমের মধ্যেই ছড়ানো পাটা একটু গুটিয়ে নিয়েছিল, যাতে “পথিকের” কোন কষ্ট না হয়। আমাদের অফিসাররা পরে ওই দরজাটা খোলা দেখেই বুঝেছিল চিড়িয়া ভেগেছে! ইতিমধ্যে অবশ্য অনেক খোঁজাখুঁজি করে জানা গিয়েছিল সেই ছেলেটা কোন ঘরে আত্মগোপন করেছিল। আরও জানা গিয়েছিল, সেইদিনই দিনের বেলায় ছেলেটার ভগ্নিপতি তার সাথে ওখানে দেখা করে গেছে। ঘরের দরজা বন্ধ করে দুজনে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলেছে। এভাবে আসামী আমাদের হাত ফস্কে পালাতে ভীষণ আফশোস হয়েছিল।
তখন আর কি করা? আমরা ওর ভগ্নিপতির বাড়ি চিনতাম, সেদিন তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এলাম। সে ছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কর্মচারী। সুতরাং কিছু সাবধানতা অবলম্বন করে তাকে শালার খোঁজের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হল। সে কিন্তু ঘাড় শক্ত করে রইল। শালার সাথে যে তার ভাল যোগাযোগ তাও সে অস্বীকার করতে থাকল। এই জেদের অর্থ দাঁড়ায় বস্তি থেকে পালিয়ে তার শালা কোথায় গিয়েছে সেটা সে জানে। দুদিন ধরে সে আমাদের জেরার জবাবে কোন কিছুই বলল না। তিনদিনের দিন ভেঙে পড়ল, স্বীকার করল যে সে সব জানে। তার শালা আমেদাবাদ যাওয়ার উদ্দেশে আগের দিন সন্ধেবেলা হাওড়া থেকে ট্রেনে দিল্লির দিকে যাত্রা করেছে। বুঝলাম, শালাকে নিশ্চিন্তে আমেদাবাদের পথে রওনা করিয়ে দেওয়ার জন্য সে কৌশলে দুদিন আমাদের ঠেকিয়ে রেখেছিল। জানা গেল ছেলেটা একটা লাল রঙের জামা ও কালো রঙের প্যান্ট পরে গিয়েছে। আমেদাবাদে থাকবে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের বাড়িতে। সেটাও ঠিক করে দিয়েছিল এই ভগ্নিপতি। সে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে এই বন্দোবস্তটা করেছিল।
দিল্লির ট্রেন ছাড়া ও পৌঁছনর সময় দেখে বুঝলাম, ট্রেনে করে ওর পিছু ধাওয়া করা যাবে না। দিল্লিতে আমাদের প্লেনে যেতে হবে। অন্যদিকে আমি আমার স্ত্রীকে বালিগঞ্জে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে পাঠিয়ে আমেদাবাদের ঠিকানা যোগাড় করে ফেললাম। আমার স্ত্রীর ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, সেই সুযোগটাই নিলাম। পরদিন সকালে, প্লেনে এবারও লাহিড়ীকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লি পৌঁছে গেলাম। সেখানে আর দেরি না করে প্লেন ধরে সোজা আমেদাবাদ। গেলাম আমেদাবাদ স্টেশনে, কোনও লাল জামা -কালো প্যান্ট পরা ছেলে ট্রেনে আসছে কিনা দেখা দরকার। না, তেমন কাউকে দেখতে পেলাম না। আর অপেক্ষা না করে অটো রিক্সা নিয়ে ঢুকে পড়লাম আমেদাবাদ শহরে। প্রথমেই একটা হোটেলে গিয়ে ঘর ভাড়া করে আমাদের জিনিসপত্র রাখলাম। তারপর বেরিয়ে পড়লাম। ওখানকার ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ যে থানার অধীনে, সেই থানার খোঁজে। দারোগাবাবুকে বললাম, কেন এসেছি। তিনি আমাদের কথায় কোনও গুরুত্বই দিলেন না, তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, যা বলার মুন্সীবাবুকে গিয়ে বলুন, তিনি লিখে নেবেন। মুন্সীবাবু হচ্ছেন ডায়েরি-লিখিয়ে। আমরা তো অবাক।
ওর ঘর থেকে বেরিয়ে থানার সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ভাবছি, কি করা যায়? এমন সময় দেখলাম থানার সামনে একটা জিপ এসে দাঁড়াল। যিনি নামলেন, তাঁকে দেখেই থানার সমস্ত কর্মচারী তটস্থ হয়ে গেল। কাছে দাঁড়ান এক সিপাইকে জিজ্ঞেস করলাম, উনি কে? সে জানাল, উনি আমেদাবাদ পুলিশের ডেপুটি কমিশনার গোলাম গার্ড। আমরা ঠিক করলাম, ওঁকেই বলব আমাদের ওখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যটা। গোলাম গার্ড ভারতীয় দলের প্রাক্তন টেস্ট ক্রিকেটার। আমরা সরাসরি তাঁকে আমাদের পরিচয় দিয়ে বললাম, “আমরা আপনার সাহায্য চাই, একটা খুনের আসামীকে ধরতে আমরা এখানে এসেছি।” উনি আমাদের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। সব কথা শুনে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা কোন হোটেলে উঠেছেন?” আমরা হোটেলের নাম জানাতে উনি বললেন, “ঠিক আছে, আপনারা ওখানেই থাকুন, আমি ঠিক রাত আটটার সময় হোটেলে পৌঁছব। আপনাদের তুলে নিয়ে সোজা ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে যাব। রাত সাড়ে আটটায় সঙ্ঘের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ওখানে যারা থাকে তারা আটটার মধ্যেই ফিরে আসে। আপনাদের আসামীও বাইরে থাকলে ওই সময়ের মধ্যে চলে আসবে। এখানে কারোকে কিছু বলবেন না।”
আমরা ভরসা পেয়ে হোটেলে ফিরে এসে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম। গোলাম গার্ড ঠিক সময় মত এলেন। আমরাও প্রস্তুত ছিলাম, জিপে উঠে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের দিকে রওনা দিলাম। উনি সঙ্গে করে বেশ বড় ফোর্স এনেছিলেন, তারা অন্য গাড়িতে আমাদের পেছন পেছন আসতে থাকল। ঠিক সাড়ে আটটার সময় যখন সঙ্ঘের দরজা বন্ধ হব হব করছে, আমরা পৌঁছলাম। গার্ড সাহেব সোজা রিসেপশনে গিয়ে জানতে চাইলেন দু-এক দিনের মধ্যে কোনও ছেলে কলকাতা থেকে ওখানে এসেছে কি না। জানা গেল এসেছে, কিন্তু আগামীকালই সে চলে যাবে, সে নাকি একটা এখানকার মিলে চাকরি পেয়েছে। জানতে চাইলাম, “সে এখন কোথায় আছে?” রিসেপশনিস্ট বললেন, “ঘরেই আছে।”
সঙ্ঘেরই একজন আমাদের পথ দেখিয়ে সেই ঘরের সামনে নিয়ে এলেন। ঘরের দরজা ভেজান ছিল, ঠেলা দিতেই খুলে গেল। দেখলাম, একটা ছেলে ঘুমচ্ছে। গার্ড সাহেবই প্রথম ঘরে ঢুকে ওকে ডেকে তুললেন। ছেলেটা আমাদের দেখেই বোবা হয়ে গেছে, ওকে যা প্রশ্ন করা হচ্ছে তাতেই খালি গলা দিয়ে, “আঃ–আঃ” শব্দ বেরচ্ছে। আর অঙ্গভঙ্গি করে বোঝাতে চাইছে আমাকে অযথা কেন ঘুম থেকে ওঠালে! ওর অভিনয় দেখে গার্ড সাহেব একটু দোটানায় পড়ে গেলেন মনে হল। আমি তাড়াতাড়ি ছেলেটাকে টেনে নিয়ে ওর পেটে মারলাম এক গোঁত্তা। ছেলেটা “ও বাবা গো” বলে পেটে হাত দিয়ে পড়তে যাচ্ছিল। আমি দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললাম, “কি রে উড়ে বীরেন, ভেবেছিলি বোবা সেজে পার পেয়ে যাবি, তাই না? হেমন্তবাবুকে গুলি করার সময় তোর রিভলবার কি বোবা হয়ে ছিল?” আমার কথা শুনে বীরেন চুপ পরে রইল। বীরেনকে সবাই উড়ে বীরেন বলেই ডাকত।
ততক্ষণে লাহিড়ী বীরেনের ব্যাগ থেকে লাল জামা আর কালো প্যান্ট বের করে ফেলেছে। আমরা আর ওখানে অপেক্ষা না করে ওকে নিয়ে সোজা থানায় এসে লক আপে পুরে দিলাম। গার্ড সাহেবকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। দুজনের মনেই তখন দারুণ ফূর্তি, হেমন্তবাবুর খুনের আসল দুই আসামীকেই ধরা গেল।
আমরা ঠিক করলাম, একটু সেলিব্রেট করা যাক। কিন্তু গুজরাট তখন “ড্রাই” অঞ্চল, ওই রাজ্যে মদ্যপান নিষিদ্ধ। আমরা ভেবে দেখলাম, আমেদাবাদে যারা পুরোদস্তুর মাতাল ছিল, তারা কি নিষিদ্ধ ঘোষণা হওয়াতে মদ্যপান পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছে? তা তো হতে পারে না। নিশ্চয়ই গোপনে মদ বিক্রি হয়, সেখান থেকে তারা কিনে প্রাণধারণ করে আছে! আমরা দুজনেও ওরকম কোন গোপন ঠেক খুঁজে বার করবই। রাস্তার দুদিক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের চোখে পরীক্ষা করতে করতে হাঁটতে লাগলাম। প্রায় আধঘণ্টা ঘোরার পর হঠাৎ দেখি একটা গলি থেকে এক সিপাই টলতে টলতে বেরিয়ে আসছে। ওকে দেখে আমাদের প্রাণে জল এল। আমরা সিপাইটাকে ইশারায় ডেকে জানতে চাইলাম, কোথায় পাওয়া যাবে? সে জিজ্ঞেস করল, “ক্যায়া, দারু?” আমরা সোৎসাহে বলে উঠলাম, “হ্যাঁ।” সে বলল, “মিলেগা।” তারপর ঝট করে একটা চলন্ত অটো রিক্সা দাঁড় করিয়ে আমাদের তাতে উঠতে বলে, নিজেও উঠে বসল। অটো চলছে, আমাদের মন খুশিতে ভরপুর। ঠিক করলাম, বোতল কিনে এই অটোটা চড়েই হোটেলে ফিরে যাব, সেখানে নিজেদের ঘরে বসে আরামসে খাব।
মিনিট দশেকের মধ্যেই দেখি অটো সেই থানার গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, যেখানে আমরা বীরেনকে রেখে এসেছি। সিপাইটা অটো থেকে নেমেই আমাদের বলল, “আইয়ে।” আমরা বিপদ বুঝে তাড়াতাড়ি অটো থেকে নেমে পড়লাম। আমি পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে সিপাইটার হাতে গুঁজে দিলাম। সে তাচ্ছিল্য দেখিয়ে নোটটা ফিরিয়ে দিল, “ইসমে নেহি হোগা, এ কলকাত্তা কা পুলিশ নেহি যো পাঁচ-দশ রুপায়া মে খরিদ করনে সেকেগা। এ আমেদাবাদ হ্যায়, কমসে কম শ চাইয়ে।” ঘুষেও কলকাতার অপবাদ! সম্মান বাঁচাতে আমি আর বাক্যব্যয় না করে একটা পঞ্চাশ টাকা ওর হাতে দিলাম। খুব একটা মনঃপূত না হলেও একটু নরম হল, একটা টাল সামলে বলল, “যাইয়ে, লেকিন ইঁহা কতী দারুকি নাম মৎ লেনা।” আমরা কোনমতে “নেহি, নেহি “ বলতে বলতে ওর সামনে থেকে সরে গেলাম। ফিরে এলাম হোটেলে।
পরদিন সকালে সব কাগজে দেখি উড়ে বীরেনের গ্রেফতারের খবর ফলাও করে ছাপা হয়েছে। দিল্লি, মুম্বাই, আমেদাবাদ সব জায়গার পত্রিকাতেই বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল খবরটা। গোলাম গার্ড সাহেব পি. টি. আইকে খবরটা দেওয়াতে সারা দেশেই পৌঁছে গেছে। হেমন্তবাবু সর্বভারতীয় ফরোয়ার্ড ব্লক পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন, গুরুত্ব পাওয়ারই কথা। আমরা তৈরি হয়ে নিলাম, বীরেনকে নিয়ে কোর্টে যেতে হবে, এখানকার ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে তবেই কলকাতা যাওয়া যাবে। থানাতেও সবাই প্রস্তুত ছিল। বিশাল এক বাহিনী সঙ্গে, আমরা কোর্টে বীরেনকে নিয়ে হাজির হলাম। ম্যাজিস্ট্রেট বীরেনকে জিজ্ঞেস করলেন সে হেমন্তবাবুকে খুন করেছে কিনা। অস্বীকার করা তো দূরের কথা, বীরেন জানাল, শুধু হেমন্তবাবুকে নয়, আরও পাঁচ ছটা খুন সে করেছে। সেই কথা শুনে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব চমকে গিয়ে আমাদের বললেন, “একে আর গুজরাটেই রাখবেন না, আজই নিয়ে চলে যান, প্রয়োজনীয় সব নির্দেশ আমি দিয়ে দিচ্ছি।”
সেদিনই রাতে আমরা দিল্লির ট্রেনে বীরেনকে নিয়ে উঠলাম। বীরেন ও তার পাহারাদার আমেদাবাদ পুলিশের ছজন সিপাই দ্বিতীয় শ্রেণীর একটা কামরায় উঠল। আমি আর লাহিড়ী প্রথম শ্রেণীর কামরায় উঠলাম।
ট্রেন ছেড়ে দিল। আমি আর লাহিড়ী প্যানট্রি কারে গিয়ে বসলাম। একটু পরে একটা অল্পবয়সী ওয়েটার আমাদের কাছে এসে জানতে চাইল কি খাব? আমরা বললাম, “দূর, খাবারের কথা পরে হবে, তুমি কি আমাদের জন্য একটু দারু-টারুর ব্যবস্থা করতে পারবে, গতকাল থেকে খুঁজছি।” সে মাথা নাড়ল, “এখন তো পাবেন না স্যার, এখনও গুজরাট চলছে। তবে গুজরাট-রাজস্থান সীমান্তের কাছে একটা লেভেল ক্রসিং আছে, সেখানেই পরের জংশন স্টেশনের আউটার সিগন্যাল। এই ট্রেনটা সন্ধেবেলায় সেখানে পৌঁছবে। প্রায় রোজই সেখানে একবার দাঁড়ায়। আজ যদি দাঁড়ায় আমি দৌড়ে চলে যাব। ওখানে দোকান আছে। তারপর জংশনে ট্রেন পনের কুড়ি মিনিট দাঁড়ায়। কি ব্র্যান্ড আনব?” বললাম, “যে কোনও ব্র্যান্ড হলেই চলবে। শোন, তুমি অন্য কোথাও যেও না, অন্যদের কাজ করে যত বখশিস পাবে, আমরাই সেটা তোমাকে দিয়ে দেব।” তারপর একটা একশ টাকার নোট বার করে ওকে দিয়ে বললাম, “দুটো পাঁইট নেবে।” ছেলেটা সেটা পকেটে পুরে চলে গেল।
সন্ধে হয়ে আসছে, ছেলেটার দেখা নেই। না এলে কোথায় খুঁজব? আমরা উদগ্রীব হয়ে বসে আছি। হঠাৎ উদয় হল, বলল, “স্যার, লেভেল ক্রসিং আসছে।” আমি আর ছেলেটা কামরার দরজা খুলে তার সামনে দাঁড়ালাম। ট্রেন কিন্তু ছুটছেই। একটু পরে ছেলেটা চিন্তিত গলায় বলল, “স্যার, কি ব্যাপার, আজ দাঁড়াচ্ছে না কেন? এখানেই লেভেল ক্রসিংয়ে রোজ দাঁড়ায়! আজ বেরিয়ে যাচ্ছে।” ওর কথা শুনে বুঝলাম, যে কোনও কারণেই হোক আজ দাঁড়াবে না। তার মানে, আমাদের আশা পূরণ হবে না। আমি আর কালক্ষেপ না করে ঝট করে পাশের বাথরুমে ঢুকে চেন টেনে দিয়ে আবার দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। ট্রেন ঝক ঝক শব্দ করতে করতে থামছে। ছেলেটা উত্তেজিত, “দাঁড়াচ্ছে, দাঁড়াচ্ছে।” তারপর ঝপ করে লাফিয়ে নেমে উধাও হয়ে গেল।
আমিও নেমে পড়লাম, যেন কিছু জানি না এমন ভাব করে যে কামরায় বীরেনরা আছে, সেদিকে চলতে লাগলাম। দেখছি গার্ড সাহেব, সঙ্গে আরও কিছু লোক, হন্তদন্ত হয়ে চেন টানার কারণ জানতে সরেজমিন তদন্তে চলেছেন। গজগজ করতে করতে এদিক ওদিক দেখছেন গার্ড। আমি বীরেনদের দেখে ফিরে আসার একটু পরে গার্ড সাহেব বাঁশী বাজিয়ে দিলেন। জংশন স্টেশনে এসে ট্রেন দাঁড়াল। আমি প্ল্যাটফর্মে নেমে দাঁড়িয়েছি, মিনিট দশেক পর ছেলেটাকে দেখতে পেলাম, আসছে। কাছে এসে বলল, “স্যার জিন পেয়েছি।” আমার প্রাণ নেচে উঠল, “তাতেই হবে।” ছেলেটাকে নিয়ে আমাদের কামরায় আসতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। সে কোমরের কাছ থেকে দুটো পাঁইট বের করে বলল, “ব্লু বুল জিন, আগে দেখেছেন তো?” মনে মনে বললাম, বাপের জন্মে এমন নাম শুনিনি, দেখা তো দূরের কথা। মুখে বললাম, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি খুব ভাল জিনিস এনেছ। এই নাও আরও একশ টাকা। তুমি আমাদের জন্য ডবল ডিমের ওমলেট আর পাঁউরুটি নিয়ে এস।” একটা পাঁইট দুজনে মিলে খেয়ে, রাতের খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়লাম। একজন ওপরের বাঙ্কে, অন্যজন নিচে। দুনম্বর পাঁইট পরের রাতে জন্য ওপরের বাঙ্কের এককোণে রেখে দিলাম।
ট্রেনের দোলায়, জিনের নেশায় একটুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোরের দিকে চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে দেখি, ট্রেন একটা স্টেশনে দাঁড়িয়েছে। সেখান থেকে হৈ হৈ করে প্রচুর ছাত্র ট্রেনটায় উঠছে। প্রথম শ্রেণী, দ্বিতীয় শ্রেণী, সংরক্ষিত কামরা, কিছুই মানছে না। আমাদের কামরাতেও অনেক ছাত্র উঠল। তারা আমাদের জায়গা দখল করে নিল। ওপরের বাঙ্ক থেকে নেমে পড়তে বাধ্য হলাম। ছেলের দল সেটাও দখল করে নিল। ভোরের হাওয়ায় জানালার ধারে বসে আছি, চোখের সামনে দিয়ে সরে যাচ্ছে ধূ ধূ প্রান্তর, কানে সারাক্ষণ বাজছে কমবয়সী কলকল হাসি। মন্দ লাগছে না! নয়াদিল্লি স্টেশনের আগে একটা স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়াল। ছাত্ররা আমাকে আর লাহিড়ীকে হরেকরকম গুডবাই, বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে নেমে গেল। আমরাও উচ্ছ্বসিত হয়ে ওদের বিদায় জানালাম। ট্রেন ছেড়ে দিল। একটু পরে আমরা উঠলাম, নামার আগে একটু গুছিয়ে নিতে হবে। গোঁছাতে গিয়ে প্রথমেই দেখলাম, ওপরে রাখা জিনের পাঁইটটা পুরো ফাঁকা। বুঝলাম, ছাত্ররা কিসের প্রভাবে এত গুডবাইয়ের ঝড় বইয়ে দিয়ে গেল। কি আর করা যাবে?
নয়াদিল্লি স্টেশনে নেমে পড়লাম। বীরেনকে নিয়ে কলকাতার উদ্দেশে কালকা মেলে চড়ে বসলাম।
পাণ্ডবেশ্বর ও বীরেন ছাড়া এই হত্যাকাণ্ডের আর যারা প্রধান আসামী ছিল, তাদের মধ্যে একজন কাশীপুরের বিশু। ওকে আমরা বহুদিন ধরে খুঁজছিলাম, কারণ সে সিঁথি অঞ্চলে নকশাল আন্দোলনের বড়সড় নেতা ছিল।
একবার সিঁথিতে আমরা রুটিন তল্লাশিতে গেছি। সেখানে গিয়ে শুনলাম, নকশালরা একটা মাঠে আছে। ছুটলাম সেই মাঠের দিকে। গিয়ে দেখি, মাঠ শূন্য, কেউ কোথাও নেই। আমরা ফিরে আসছি, হঠাৎ পেছন থেকে কাতরকণ্ঠে একটা ডাক শুনতে পেলাম। আওয়াজ যেদিক থেকে আসছিল তাড়াতাড়ি সেদিকে গেলাম। গিয়ে দেখি, যে আমাদের ডাকছিল, তার দেহটা বুক পর্যন্ত মাটির তলায় পোঁতা, বাকিটা ওপরে। সারা চোখ ও মুখে অত্যাচারের চিহ্ন, রক্তাক্ত, বিধ্বস্ত। আমরা তাড়াতাড়ি তাকে ওপরে টেনে তুললাম। তার কাছ থেকে শুনলাম, নকশালরা তাকে পুলিশের গুপ্তচর ভেবে মাটির তলায় অর্ধেক পুঁতে অত্যাচার চালিয়েছে। পুলিশ ওই এলাকায় এসেছে শুনে তারা ওকে ফেলে পালিয়ে যায়, নয়ত পুরোই মেরে ফেলত। এই অত্যাচারের মূল নায়ক ছিল বিশু। তখন থেকেই আমরা বিশুকে খুঁজছি। সিঁথি অঞ্চলে সে যে আর নেই তা ঠিক। সিঁথিতে আমাদের যত সোর্স ছিল, তাদের খবর তাই বলে। কিন্তু বিশুকে আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে।
একদিন বিশুর বাড়িতে গেলাম। তার বাবা-মা খুবই ভদ্র। বললাম, “বিশু যদি আত্মসমর্পণ করে, ওকে আমি বাঁচিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।” ওঁদের বোঝালাম, “আন্দোলন তো এমনিতেই শেষ হয়ে গেছে, নেতারা প্রায় সবাই ধরা পড়েছে, নয় মারা গেছে। বাকি যারা আছে তাদের বেশির ভাগই লুম্পেন। বিশুকে বলুন আত্মসমর্পণ করতে। আমাদের কথায় কান দিলে ভাল, নয়ত যদি কোনখান থেকে গ্রেফতার করতে পারি, তখন কিন্তু ওকে কোনও সুযোগই দেব না। আর তেমন কিছু হলে আপনারাও আমাদের দায়ী করবেন না।”
এর কিছুদিন পর লালবাজারে বাবা ও মাকে সঙ্গে নিয়ে এসে বিশু আত্মসমর্পণ করল। আমরা নতুন করে চার্জশিট দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করলাম। আগে একবার চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল, মামলা কিছুটা এগিয়েও ছিল। সরকারি তরফের উকিলের পরামর্শ অনুযায়ী প্রথম চার্জশিটের সঙ্গে অতিরিক্ত সংযোজন হিসেবে নতুনভাবে চার্জশিট দেওয়ার ব্যবস্থা হল। প্ৰথম চার্জশিটে আসল অপরাধীদের মধ্যে শুধু পাণ্ডবেশ্বরের নাম ছিল, তাকে আত্মগোপনকারী হিসেবে ঘোষণা করে মামলা শুরু করা হয়েছিল। এবার যুক্ত হল বীরেন, বিশু ও আরও দুজনের নাম। বিশু রাজসাক্ষী হয়েছিল।
মামলা জোর কদমে শুরু হল। কিন্তু প্রথম চার্জশিট থেকেই মামলায় কিছু গলদ থেকে গিয়েছিল। তার ওপর আমাদের দুই ডি. সি.র চাপান উতোর, টানাপোড়েনের জন্য মামলা আরও দুর্বল হয়ে গেল। ঘটনাস্থল নিয়ে অযথা জট পাকিয়ে গণ্ডগোল দেখা দিল। আদালত থেকে “সন্দেহের অবকাশের” ভিত্তিতে আসামীরা খালাস পেয়ে গেল। আমরা দায়রা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করলাম। অবশ্য এই মামলার আসামীরা দায়রা আদালত থেকে খালাস পেলেও জেল থেকে ছাড়া পায়নি কারণ তাদের বিরুদ্ধে আরও অনেকগুলো খুন ও দাঙ্গাহাঙ্গামার মামলার বিচার চলছিল।
সাতাত্তর সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির সঙ্গেই ওরা ছাড়া পেয়ে যায়। দুর্ভাগ্য, সরকার আইনকে তার নিজের পথে চলতে দিল না। নৃশংস খুন কি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় রঙ বদলায়? রাজনৈতিক পালাবদলের সাথে আইন ও তার ব্যাখ্যা হঠাৎ কি পাল্টে যায়? সাধারণ মানুষের চোখে যারা খুনী তারা কি হঠাৎ বিপ্লবী বনে যেতে পারে? নেতারা ভাবেন, জনগণের স্মৃতিশক্তি খুব দুর্বল, তাই একাত্তরের খুনের কথা সাতাত্তরে আর কারও মনে নেই, ঝাপসা হয়ে গেছে। “আদর্শের অন্ধ বিশ্বাসে অপরাধ করে ফেলেছে” এই সিদ্ধান্তের আড়ালে হেমন্তবাবুর খুনীরা বিনা সাজায় মুক্তি পেয়ে গেল!