সাদা আমি কালো আমি – ১.১

বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব কোণের এক ছোট্ট সুন্দর সাজান শহরের এক বাড়িতে খুব ছোট্ট একটা ছেলে মায়ের কোল ঘেঁষে ঘুমত আর স্বপ্ন দেখত টগবগ করে ঘোড়া ছুটিয়ে সে চলে যাবে কোনও এক কিন্নর-কিন্নরী আর পরীদের দেশে, সেখানে তাদের সাথে সারাদিন খেলবে, হাসবে, নাচবে। তারপর ক্লান্ত শরীর নিয়ে পাখিদের গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়বে, আবার তাদেরই ঘুম-জাগানিয়া কলরবে জেগে উঠে ছুটিয়ে দেবে ঘোড়া খোলা প্রান্তরে।

ঘোড়ার খুরের শব্দে ছোট্ট ছেলেটা ভোরবেলায় জেগে উঠত। ততক্ষণে মদনমোহন মন্দিরের নহবতখানায় বেনারসী ওস্তাদ সানাইবাদক আহির ভৈরব কিংবা ভাটিয়ার ললিতরাগের মূর্ছনা ভোরের বাতাসের তরঙ্গে তরঙ্গে পৌঁছে দিয়েছে সবার মনে। সেই সুরের আবেগের সাথে, ঘোড়ার খুরের শব্দের টানে ছেলেটা মায়ের কোলের উষ্ণতা ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে যেত বাড়ি থেকে মহারাজের ভোরের ঘোড়া ছোটান দেখতে। সেই সুন্দর শহরের মধ্যে আরও সুন্দর রাজপ্রাসাদের চারধারে সোজা লম্বা লম্বা লাল সুরকির রাস্তায় রোজ ভোরে মহারাজ ঘোড়া ছুটিয়ে দেখতেন তাঁর শহরে কোথাও ময়লা নেই তো? যৌবনের অহংকার ভরা ঘোড়ার ছোটার ভঙ্গিমা দেখে ছোট্ট ছেলেটার উত্তেজনা বেড়েই যেত। শুধু সে নয়, তার মত আরও অনেক ছোট্ট ছোট্ট ছেলেরা মহারাজের ঘোড়া ছোটানর মত্ত মুহূর্তের সাক্ষী হতে আসত আর নিজেদের রঙিন স্বপ্নের ঘোড়াগুলোর মত্ততা ততই বাড়ত। এরা সবাই বন্ধু ছিল। ভোরের আলো একটু পরিষ্কার হলেই তারা ছুটে ফিরে যেত যে যার বাড়ি। তারপর বাড়ি মাথায় করে চেঁচিয়ে তারা স্কুলের পড়া পড়ত। পড়া শেষ হলে পুকুর আর দীঘির জল উথাল-পাথাল করে ছুটত সবাই স্কুলে। স্কুলের ক্লাস শেষ করে ফুটবল নিয়ে নামত তারা মাঠ দাপাতে। তাদের স্কুলের ভেতর ছিল অনেকগুলো ফুটবল দল। কোচবিহারের মহারাজাদের নামে ছিল তাদের নাম। ওই সময়কার যিনি মহারাজ তিনি ফুটবলে দারুণ উৎসাহী ছিলেন। তিনি নিজেই স্কুলের আর শহরের ফুটবলের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তার ফলে ফুটবল খেলা ওই শহরটার প্রধান আকর্ষণে পরিণত হয়েছিল, সেটাই বিনোদনের একমাত্র পথ ছিল।

সন্ধেবেলায় আবার মন্দিরের নহবতখানায় ওস্তাদদের সানাই উঠত বেজে। কোনওদিন পূরবী, কোনওদিন মূলতানী কিংবা পুরিয়াধানেশ্রী বা কল্যাণ রাগ শহরের আকাশ সুরে সুরে মেখে ডাক দিত ঘরে ফেরার। সন্ধে সাতটার মধ্যেই শহরটা নিঝুম শুনশান হয়ে যেত। শহরের বুকচেরা দীর্ঘ রাস্তাগুলোর দুপাশে সারি দিয়ে লাগান গাছে পাতার খসখসানির আওয়াজ ছাড়া কিছুই যেত না শোনা। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেরা সারাদিনের ছুটন্ত দাপানির চোটে ক্লান্তির কোলে ঢুলে ঢুলে সন্ধের পড়াটা কিছুটা পড়েই ঘুমের দোলনায় শুয়ে পড়ত, চলে যেত স্বপ্নের দেশে। সেখানে শুধু ঘোড়া আর ফুটবল।

ছোট্ট ছেলেটার রক্তে ফুটবল গিয়েছিল মিশে। তখন তাদের শহরে মহারাজের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার দল আসত খেলতে। খেলতে আসত রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ির জেলাদলগুলো। তাছাড়া আসত কলকাতার সব নামী দামী দল। সেইসব খেলা সে মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে দূর থেকে চোখ দিয়ে গিলত। সব দলের খেলোয়াড়দের সে স্বপ্নরাজ্যের লোক বলে ভাবত। স্বপ্ন দেখত, সেও একদিন ওদের মত সব পেয়েছি দেশে বিচরণ করবে।

দেশ স্বাধীন হতে গঙ্গা আর পদ্মা দুদিকে চলে গেল। চোখের জলের রেখায় সীমানা টেনে বাংলাদেশ দুটুকরো হয়ে গেল। তারপর থেকে পূর্ববাংলার দলগুলো আর সেই ছোট্ট শহরটায় খেলতে আসত না। ছেলেটার খুব খারাপ লাগত, কিন্তু তার তো আর সেই জোর ছিল না যে ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে আবার আগের মত সীমানা মুছে দিয়ে মাঠে ফুটবল নিয়ে মাতবে সবাই! তখন তাদের ছোট্ট শহর ও জেলাটা ভারতবর্ষের করদ রাজ্য ছিল। পূর্ববাংলার দলগুলির খেলতে আসা বন্ধ হলেও কলকাতা থেকে অনেক ছোট বড় দল অবশ্য সেখানে ফুটবল খেলতে যেত। কলকাতার মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের খেলোয়াড় রানা সামসের জং, নূর মহঃ, জুম্মা খাঁ আর বাচ্চি খাঁর খেলা ছোট্ট ছেলেটাকে মুগ্ধ করেছিল।

ছেলেটা যখন ক্লাস এইটে পড়ত তখনই সে তার জেনকিনস স্কুলের প্রধান ফুটবল দলের সদস্য হয়ে গেল। জেলার স্কুলগুলোর মধ্যে যে শিল্ড খেলা হত সেখানে সে নিজের স্কুল দলের হয়ে খুব দাপটের সঙ্গে খেলতে শুরু করল। খেলাধুলোয় চৌকস ছিল বলে স্কুলের মাস্টারমশাইরা ছেলেটাকে ভালবাসতেন।

মহারাজের ফুটবল খেলার ওপর আকর্ষণের জন্যই ছেলেটা তাঁর সুনজরে পড়ে গেল। সেই মহারাজ কলকাতার কালীঘাট টিমের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। শুধু ফুটবল নয়, তিনি ক্রিকেটেও খুব উৎসাহী ছিলেন। মহারাজ ক্রিকেট ক্লাব অফ বেঙ্গলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তখন টেস্ট খেলতে যাঁরাই কলকাতায় আসতেন, মহারাজের আমন্ত্রণে তাঁরা ওই ছোট্ট

শহরে বেড়াতে ও শিকার করতে যেতেন। ছেলেটা ওঁদেরও দেখত দূর থেকে। কিন্তু ক্রিকেটের থেকে ফুটবলের প্রতি তার টান ছিল বেশি, তাই ছেলেটা ফুটবল নিয়েই মাঠ থেকে মাঠে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। ততদিনে মহারাজের সেই করদ রাজ্যের রাজত্ব উঠে গিয়ে সেটা পশ্চিমবঙ্গের একটা রাজ্য হয়ে গেছে।

ছেলেটাও স্কুল থেকে বেরিয়ে তার শহরের ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হয়েছে। কলেজে ঢুকে সে শুধুমাত্র ফুটবলেই নয়, অ্যাথেলেটিক্সেও দাপট দেখাতে শুরু করল। কলেজের ফুটবল দলে তো ছিলই, অন্যদিকে পরপর চাব বছর সে কলেজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ অ্যাথেলেট হিসেবে পুরস্কার পেল। স্কুলের মত কলেজের প্রফেসররাও তাকে খুব ভালবাসতেন। অধ্যাপকদের মধ্যে বাংলা পড়াতেন বিখ্যাত কবি হরপ্রসাদ মিত্র।

সেই ছোট্ট ছেলেটা এখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। কলেজে পড়ে। চাকরি করে। হ্যাঁ, চাকরিও তাকে করতে হয়। অবশ্য শুধুমাত্র হাজিরা খাতায় সই করেই তার চাকরির দায়িত্ব শেষ। ওই ছোট্ট শহরে অফিস টিমগুলোর মধ্যে একটা ভীষণ নামকরা টুর্নামেন্ট হত। সেই শশীকান্ত মেমোরিয়াল শিল্ডে পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের হয়ে ছেলেটা খেলতে শুরু করল। সেই সুবাদে তাকে ওই ডিপার্টমেন্টে ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরি করতে হত।

কলেজ আর মাঠ, মাঠ আর কলেজ, এই ছেলেটার সারাদিনের কাজ। পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের হয়ে শশীকান্ত মেমোরিয়াল শিল্ডে দারুণ খেলে তাদের চ্যাম্পিয়ান করে দিল ছেলেটা। অন্যদিকে সে তখন তার জেলা দলের হয়ে বহু জায়গায় খেলে বেড়াচ্ছিল। অসমের গুয়াহাটিতে খেলে ওখানে দারুণ নাম করল। ওখানকার মহারানা ক্লাব ছেলেটাকে তার জেলা দলের থেকে ধার করে অন্য পরিচয়ের আড়ালে কলকাতায় নিয়ে এল আই. এফ. এ শিল্ডে খেলাতে। সেই প্রথম ছেলেটার কলকাতায় আসা। তারা পুরো দলকে রাখল শিয়ালদার “শান্তিনিকেতন হোটেলে”।

শিল্ডের খেলায় মহারানা ক্লাব হেরে যেতে ছেলেটা ফিরে গেল তাঁর আপন মায়ামাখা শহরে। যেখানে বেঁচে আছে তার স্বপ্ন। সেখানে ফিরে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই মহারাজা ছেলেটাকে প্লেনে করে পাঠিয়ে দিলেন কলকাতায় তাঁর দল কালীঘাটের হয়ে লিগ ফুটবল খেলতে। তখন কলকাতার লিগ ফুটবল একটা দারুণ রমরমা ব্যাপার। যেসব বিখ্যাত খেলোয়াড়দের এতদিন সে দূর থেকে দেখে রোমাঞ্চিত হত, তাঁদের সাথেই কলকাতার ময়দানে পায়ে পা মিলিয়ে খেলতে লাগল। তাকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল ডেকার্স লেনের মেট্রোপলিটন হোটেলে। তখনকার দিনে বহু খ্যাতনামা খেলোয়াড় ওই হোটেলে থাকতেন। সালে, কেম্পিয়া, ধনরাজ, গাজীর মত ময়দান কাঁপান কিংবদন্তী সব খেলোয়াড়রা ওই হোটেলের ঘর

আলো করতেন। বড় বড় খেলোয়াড়দের পাশে থাকতে পেরে সুদূর মফস্বল থেকে আসা ছেলেটা নিজেকে ধন্য মনে করত। ময়দান আর হোটেল এই ছিল তার গণ্ডি। কিন্তু সেই খাঁচার জীবনে আবদ্ধ পাখি সীমাহীন আকাশে ফিরে যেতে চাইত। ডেকার্স লেনের ভিড় থেকে সে পালাতে চাইত। তাই সে একদিন চলে গেল আলিপুরে উডল্যান্ডে মহারাজার বাড়ির কর্মচারীদের থাকার কোয়ার্টারে। সেখানে রাতে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখত আর ভোরবেলার অসংখ্য পাখির ডাকের সাথে বিছানা ছেড়ে উঠে দৌড় লাগাত ময়দানের দিকে। ময়দানে ক্লাবের মাঠে শুরু হত তাঁর বল নিয়ে অনুশীলন। কিন্তু মন যে তার পড়ে থাকত “যেখানে আকাশে খুব নীরবতা, শান্তি খুব আছে।”

কিন্তু কি করবে সে? একদিকে ফুটবলের মোহ, অন্যদিকে ঘরের টান। এই দোটানার মধ্যে শেষ হল সে বছরের লিগের খেলা, লিগ শেষ হতেই ছেলেটা ছুটে চলে গেল তার ছোট্ট শহরটায়। এবার সে মন দিল পড়াশুনোয়। বি. এ. পাশ করল। কিন্তু ফুটবল অন্ত তার প্রাণ, ফুটবল ছাড়া যে তার জীবন অচল। তাই সে কদিন পরই জলপাইগুড়ির বহু চা বাগানের মালিক, ফুটবল পাগল, তখনকার কংগ্রেস পার্টির রাজ্যসভার সদস্য মিঃ এস. পি. রায়ের ডাকে জলপাইগুড়ি জেলার হয়ে খেলতে চলে গেল। রায়সাহেব তাঁর একটা চা বাগানে ছেলেটাকে চাকরি দিলেন। তিনিই ছিলেন জলপাইগুড়ি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। তিনি ফুটবল খেলার উন্নতির জন্য প্রচুর টাকা খরচ করতেন। কর্মব্যস্ততার মধ্যেও ফুটবলের জন্য অনেক সময় দিতেন।

ছেলেটা তারপর থেকে জলপাইগুড়ি জেলার হয়ে খেলতে শুরু করল। কদিনেই সে জলপাইগুড়ির সাধারণ মানুষের চোখের মণি হয়ে উঠল। সেও অল্পদিনেই জলপাইগুড়ির মানুষজনকে আপন করে নিল। তার কারণও ছিল। তার নিজের জেলার সাথে জলপাইগুড়ি জেলার মানুষের আচার-ব্যবহার, সংস্কৃতি, মানুষকে আপন করে নেওয়ার মানসিকতার মিল ছিল। জলপাইগুড়ির বহু বাড়িতেই তার মেলামেশা, যাতায়াত অবাধ হয়ে গেল। নিজের বাড়ি নিজের শহর ছেড়ে আসার দুঃখ, বাড়ির জন্য মনকেমন সে আর তেমন অনুভব করে না। অন্য জেলার খেলোয়াড় হলেও সে একসময় জলপাইগুড়ি জেলা টিমের অধিনায়ক হয়ে গেল। অধিনায়ক হয়েই সে অসম থেকে জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় “বরদলৈ কাপ” জিতে নিয়ে এল। জলপাইগুড়ি জেলার মানুষ এই জয়ে তখন আত্মহারা। ছেলেটাও তাদের জন্য কিছু করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করল।

যখন খেলা থাকত না, সে শহর ছেড়ে দূরে চাকরিস্থলে চা বাগানে চলে যেত। চা বাগানের নির্জনতায় থাকতেই সে বেশি ভালবাসত। সেখানে সন্ধের পর একা একা মনের সুখে গলা ছেড়ে গান ধরত আর রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের কবিতা শোনাত খোলা আকাশ আর উতলা বাতাসকে। এভাবেই হয়ত ছেলেটার জীবন শেষ হয়ে যেত নিস্তরঙ্গ নির্জনতায়, চা বাগানের সবুজে সবুজে ঘেরা নীল নীলিমায় যদি না উত্তরবঙ্গ দলের সাথে কলকাতার মহমেডান স্পোর্টিংয়ের খেলাটা দেখতে আসতেন তখনকার কলকাতা পুলিশের এক উচ্চপদস্থ অফিসার মিঃ রঞ্জিত গুপ্ত। একসময় তিনি জলপাইগুড়ি জেলার পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন্ট ছিলেন। সেই সূত্রে জলপাইগুড়ির মানুষের সাথে তাঁর নিবিড় যোগ ছিল। তিনি নিজেও খেলাধুলো, বিশেষ করে ফুটবল ভীষণ ভালবাসতেন। আবার মিঃ এস. পি. রায়ের বিশেষ ঘনিষ্ঠও ছিলেন। উত্তরবঙ্গ ও মহমেডান স্পোর্টিংয়ের খেলা আছে শুনে মাঠে চলে এসেছিলেন। যদিও বিশেষ কাজ নিয়ে তিনি জলপাইগুড়িতে গিয়েছিলেন, সেটা ফেলে রেখেই খেলা দেখতে মাঠে এসে বসে পড়লেন। ওই খেলায় সেই ছেলেটা উত্তরবঙ্গ দলের সেন্টার হাফে খেলছিল। সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সেই ছেলেটা মহমেডান স্পোর্টিংয়ের জালে একটা গোল ঢুকিয়েছিল যা মিঃ রঞ্জিত গুপ্তকে একেবারে মুগ্ধ করে ফেলল। সেই গোলের ছবিটা আজও ছেলেটার মনে উজ্জ্বল। এক খেলোয়াড়ের থেকে বলটা মাঝমাঠে ডানপায়ে ধরে দ্রুত সে প্রতিপক্ষের সীমানায় ঢুকতে থাকে। বল নিয়ে দৌড়ে পরপর কাটিয়ে যায় মহমেডান স্পোর্টিংয়ের চারজন রক্ষণভাগের খেলোয়াড়কে। সামনে শুধু গোলকিপার। গোলকিপার বিপদ বুঝে গোলের মুখ ছোট করতে গোল ছেড়ে বেরিয়ে আসে পেনাল্টি এরিয়ার মাথায়। ছেলেটা সেটা দেখে মাথা ঠাণ্ডা রেখে, ডান পায়ে আস্তে লব করে গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে বলটা রাখে গোলে। গোল, গোল, সারা মাঠ জুড়ে শুধু চিৎকার, সহ খেলোয়াড়দের অভিনন্দনে ডুবে যায় ছেলেটা।

সেদিন খেলা শেষে মিঃ রঞ্জিত গুপ্ত ছেলেটাকে চোস্ত ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি কলকাতা পুলিশে যোগ দেবে?” মিঃ গুপ্তের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মিঃ দাজু’ সেন। তিনি ছিলেন জলপাইগুড়ির এক চা বাগানের ডিরেক্টর, জলপাইগুড়ির মানুষের কাছে খুবই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তিনি ছিলেন দারুণ দাপুটে ও ব্যক্তিত্বময় মানুষ। ছেলেটা মিঃ রঞ্জিত গুপ্তকে কিছু বলার আগেই মিঃ দাজু সেন বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাবে, কোচবিহার থেকে এখানে রায়সাহেব নিয়ে এসেছে, কিন্তু এখানে ও পড়ে থেকে কি করবে?” মিঃ গুপ্ত ছেলেটাকে ফের প্রশ্ন করলেন, “তুমি কোচবিহারের ছেলে?” লাজুক ছেলেটা উত্তর দিল, “হ্যাঁ।” মিঃ গুপ্ত বললেন, কোচবিহারের অনেক খেলোয়াড় কলকাতায় খেলে। তুমিও কলকাতার পুলিশ টিমে খেলবে।” ছেলেটার উত্তরের অপেক্ষা না করে মিঃ গুপ্ত ও মিঃ সেন চলে গেলেন। ছেলেটা ভাবতে লাগল, ওদের জেলার বহু খেলোয়াড়ই কলকাতায় খেলে প্রচুর নাম করেছে। কলকাতার নামী দামী ক্লাবে খেলে সারা ভারতে তাঁদের, পরিচিতি হয়েছে। যেমন অরুণ বা ঝান্টু দাশগুপ্ত, কুমার সুরেন, কুমার রুণুনারায়ণ, সুব্রত রায়চৌধুরী, অমল বসু। ছেলেটা ভাবল, সেও কলকাতায় ভাল খেলতে পারলে সারা ভারতের ফুটবল আঙ্গিনায় পৌঁছে যাবে। তখন কলকাতা পুলিশের টিম কলকাতার ফুটবল লিগে প্রথম ডিভিশনে দাপিয়ে খেলছে। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের মত বড় বড় ক্লাবও সমীহ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে খেলতে নামত।

একদিকে উত্তরবঙ্গের সবুজ গালিচায় মোড়া চা বাগানের টান, অন্যদিকে কলকাতার ময়দানে ফুটবল খেলার আকর্ষণ, দুয়ের দোলায় ছেলেটার মন দুলতে লাগল। মন যখন টানাপোড়েনে চঞ্চল তখনই হঠাৎ একদিন মিঃ দাজু সেনের বাড়িতে ছেলেটার নামে এল মিঃ রঞ্জিত গুপ্তের টেলিগ্রাম। টেলিগ্রামে লেখা, “সিলেকশনের জন্য তাড়াতাড়ি এস।” ছেলেটা কিছু ভাবার আগেই মিঃ দাজু সেন কলকাতায় আসার প্লেনে টিকিট হাতে ধরিয়ে দিলেন। সে জামিয়ার এয়ারক্র্যাফ্টে চড়ে আমবারি ফালাকাটা থেকে সোজা এল কলকাতায়।

এর আগে ছেলেটা যখনই কলকাতায় এসেছে, প্রতিবারই ছিল অল্পদিনের জন্য, পেছনের টানটা বজায় রেখে। এবার এল অন্য পরিস্থিতিতে, চাকরি করতে, খেলতে। তার অর্থ দাঁড়ায় প্রায় বাকি জীবনের জন্য। এসেছে একা। ফেলে এসেছে তার আপনার প্রিয় ছোট্ট শহর, মা, বাবা, একসঙ্গে বেড়ে ওঠা কৈশোরের বন্ধুদের, তোর্সা নদীর ঢেউয়ের সাথে তালে তালে নাচ, রাজবাড়ি, সাগরদীঘির পাড়ে সুন্দর ভোর আর সন্ধ্যা, নহবতখানা থেকে ভেসে আসা সানাইয়ের সুর। আসার সময় সে নিয়ে এসেছে তার জেলার খেলোয়াড় ঝন্টু দাশগুপ্তের ও অমল বসু বা বেনুর ঠিকানা। বেনু তখন উয়াড়ি টিমে খেলত। কলকাতায় নেমেই ছেলেটা বেনুর সাথে দেখা করল। ওর সব কথা শুনে বেনু আশ্বাস দিল, “আরে ঘাবড়াস না, এখানে থাকতে থাকতে দেখবি এখানেই মন বসে গেছে, এখানেই অনেক বন্ধুবান্ধব হয়ে যাবে, তখন আর কোচবিহারের জন্য সবসময় মন আঁকুপাঁকু করবে না। প্রথম প্রথম আমারও কিছু ভাল লাগে না, ভাল লাগে না এমন একটা মন খারাপ থাকত। আরে তুই তো ফুটবল প্লেয়ার, ফুটবল নিয়েই ভাববি, ফুটবল নিয়েই ঘুমবি, ফুটবল নিয়েই ভাত খাবি, ফুটবলকে পুজো করবি, আর সব বাদ দিয়ে দে। এখন থেকে তোর কাছে মা, বাবা, ভাই, বোন, বন্ধুবান্ধব সব ওই ফুটবল। এরকম ভাবতে পারলে তখনই দেখবি তোর স্বপ্ন সফল হচ্ছে, দেখবি তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিস।” ছেলেটা বেনুর কথাটা মন দিয়ে শুনল। তারপর বেনু বলল, “চল, আজ বিকেলে ফোর্ট উইলিয়মে আমাদের টিমের সাথে ফৌজি টিমের একটা প্রদর্শনী ম্যাচ আছে। আমাদের টিমে প্লেয়ার কম আছে, তুই আমাদের হয়ে খেলবি।”

সেদিন বিকেলে উয়াড়ি টিমের হয়ে ফোর্ট উইলিয়মে ফৌজি দলের বিরুদ্ধে সে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলল। ওখানে ছিলেন কলকাতা পুলিশ টিমের নিয়মিত খেলোয়াড় সার্জেন্ট সুদেব দত্ত। তিনি ছেলেটাকে মাঠ থেকেই নিয়ে যান মিঃ রঞ্জিত গুপ্তের কাছে। সুদেব দত্ত ছেলেটাকে দেখিয়ে বললেন, “স্যার, এই ছেলেটা খুব ভাল খেলে।” মিঃ গুপ্ত একপলক তাকিয়ে হেসে বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওকে আমি আগেই সিলেক্ট করেছি।” তারপর ছেলেটার দিকে ফিরে বললেন, “আগামীকাল সকালে এস, তোমার ইন্টারভিউ হবে।”

পরদিন ছেলেটা তার ও তার জেলার সমস্ত মানুষেরই আরাধ্য দেবতা মদনমোহনের নাম করতে করতে ইন্টারভিউয়ের জন্য হাজির হল। মিঃ রঞ্জিত গুপ্ত ছাড়াও ইন্টারভিউ বোর্ডে অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু মিঃ গুপ্তই ছেলেটাকে প্রথম প্রশ্নটা করলেন। উত্তরবঙ্গ বনাম মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের খেলায় ছেলেটা যে গোলটা মহামেডানের বিরুদ্ধে দিয়েছিল, তার বিবরণ দিতে বললেন। ছেলেটা যথাসাধ্য গুছিয়ে বলল। মিঃ গুপ্ত বললেন, “তুমি আগামীকালই আমাদের টিমে যোগ দাও।” তারপর থেকে শুরু হল তার কলকাতা পুলিশ টিমের হয়ে খেলা আর ব্যারাকপুরে পুলিশের ট্রেনিং। এক বছর বিস্তর পরিশ্রম করে কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে ছেলেটা সরাসরি অফিসার হিসেবে যোগ দিল। তার থাকার ব্যবস্থা হল আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোডের পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে। খেলায় ময়দানে অল্প অল্প নাম হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কলকাতার হালচাল, কলকাতার ভিড় সে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছে না। রাতে বিছানায় শুয়ে সে কোচবিহারে চলে যায়। সেখানকার মন্দির, নহবতখানা, রাজবাড়ি, সবুজে ঘেরা ছোট্ট শহরের আনাচে কানাচে সে মনে মনে ঘুরে বেড়ায়। তার মনে হয়, কলকাতাটা নিঃসঙ্গ মানুষের ভিড়ে ভরা। যে যার ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত, অন্যের দিকে ফিরে তাকাবার সময় কোথায়? বন্ধুত্বটাও বড় নিক্তি মাপা। তাদের কথাবার্তার

মধ্যে সে সরলতা খুঁজে পায় না, তাই নিজে একমাত্র খেলার মাঠ ছাড়া অন্যখানে কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে থাকে। মনে হয় “ভিড়ে ভরা নির্জন দ্বীপে” সে একা।

সেদিন ছিল তার পুলিশ টিমের সঙ্গে মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবের খেলা। ইতিমধ্যে কেটে গেছে দুটো বছর। সেদিন খেলার মাঝামাঝি সময় বল দখলের লড়াইতে আচমকা বিপক্ষ দলের এক খেলোয়াড় সজোরে আঘাত করে বসল তার ডান পায়ের হাঁটুতে। ছেলেটা মাঠে পড়ে গেল। অসম্ভব যন্ত্রণা। সে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। পারল না। সহ খেলোয়াড়দের সাহায্যে বেরিয়ে এল মাঠ থেকে। ব্যস, ওখানেই শেষ হয়ে গেল তার খেলোয়াড় জীবন।

তারপর সেই হাঁটু নিয়ে কলকাতার সব নামী দামী অর্থোপেডিক ডাক্তারের কাছে শুরু হল ছোটাছুটি, কিন্তু কোন ডাক্তারই আশ্বাস তেমন দিলেন না। ছেলেটা পুলিশ ট্রেনিং স্কুলের বিছানায় শুয়ে শুয়ে বালিশ ভিজিয়ে দিত নিঃশব্দে। খেলা শেষ, সে ভাবতে পারত না। তবু বাস্তবকে মেনে নিতেই হবে। অগত্যা সে মন দিল চাকরিতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *