সাদামাটা সাক্ষাৎকার

সাদামাটা সাক্ষাৎকার

হিন্দি সাহিত্য পত্রিকা হানসে আমি লিখি। কিছুদিন আগে হানস থেকে আমার একটি সাক্ষাৎকার চাওয়া হয়েছে। প্রশ্নোত্তরগুলো এরকম।

প্রশ্ন ১: শাহবাগ আন্দোলন, তারপর এখন যে জামাতে ইসলামিকে নিষিদ্ধ করার হাইকোর্টের রায়– কী মনে হয় আপনার, এটা কি জনগণের মধ্যে পরিবর্তন হচ্ছে, রাজনৈতিক বদল দেখা দিচ্ছে?

উত্তর: খুব ভালো একটা রায়। তবে এই রায়ের কারণে যে বাংলাদেশ একটা ধর্মীয় রাষ্ট্র থেকে এক তুড়িতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যাবে, তা নয় কিন্তু। গত তিন দশক থেকে যে ইসলামিকণ চলছে দেশে, তা এক রায়ে পিছু হঠবে না। ইসলাম আনা খুব সহজ, কিন্তু ইসলামকে দূর করা সহজ নয়। এ অনেকটা দুষ্ট ভাই রাসের মতো, একবার চলে এলো তো গভীর শেকড় গেড়ে বসবে। জামাতি ইসলা মির ওপর ধর্ম-নিরপেক্ষ অনেক মানুষেরই রাগ ছিল। কারণ এই দলটি ক্ষমতা পেলে ইসলামি শরিয়া আইন এনে দেশের সর্বনাশ করবে, মেয়েদের পাথর ছুঁড়ে মারবে, মুক্তচিন্তার লোকদের ধরে ধরে জবাই করবে। বর্তমান সরকারেরও একটা ভয়, এই দলটির সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রধান বিরোধী দল ক্ষমতায় চলে আসতে পারে, যেহেতু এ ঘটনা আগে অনেকবার ঘটেছে, তাই এ দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি যখন জনতা তুলেছে, এবং তারাই তুলেছে, যারা আওয়ামী লীগকে ভোটে জিতিয়েছে, তাদেরও শান্ত করা গেলো, বিরোধী দলকেও আপাতত নিরস্ত্র করা গেলো। এখন নির্বাচনে জিততে হলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চালাতে হবে বিএনপির, জামাতকে বগলে নিয়ে বগল বাজিয়ে জিতে যাওয়ার আরামটা বন্ধ হবে। এইসব রাজনীতি সম্ভবত ছিল জামাতি ইসলামকে নিষিদ্ধ করার পেছনে। বিচার ব্যবস্থা রাষ্ট্র থেকে আলাদা হলেও অনেকটাই প্রভাবিত।

সব কিছুর পরও একটা ধর্ম-আক্রান্ত দেশে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে, এর চেয়ে বড় সুখবর আর কিছু নেই। এরপর মৌলবাদকে মানুষ কতটা প্রশ্রয় দেবে, সমাজের ওপর এর প্রভাব কতটুকু হবে, সবই নির্ভর করে দেশের মানুষের ওপর।

প্রশ্ন ২: আশা দেখতে পাচ্ছেন দেশে ফেরার?

উত্তর: আজ কুড়ি বছর নির্বাসন জীবন যাপন করছি। আওয়ামি লীগকে লোকে সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ দল বলে। এই আওয়ামি লীগ যখন ক্ষমতায় এলো, অনেকে ভেবেছিল, এবার আমি দেশে ফিরতে পারবো। কিন্তু আওয়ামি লীগও বিএনপির মতোই আচরণ করেছে। আসলে আমি লক্ষ্য করেছি, আমার বেলায় সব রাজনৈতিক দলই একই ভূমিকা পালন করে। সকলেই আমার ঢোকার দরজায় তালা দিয়ে রাখে। নিজেরা চুলোচুলি করলেও আমার বেলায় সবাই হাতে হাত মেলায়। আমাকে আমার দেশে ঢুকতে না দেওয়ার কী কারণ, তা কোনও সরকারই আমাকে জানায়নি।

আমার ধারণা, আমাকে দেশে ঢুকতে দিলে মৌলবাদীরা যদি সরকারকে দোষ দেয়, দুটো ভোট যদি আবার নষ্ট হয়ে যায়, সে কারণে কেউ ঝুঁকি নেয় না। ন্যায়ের পক্ষে বা সত্যের পক্ষে রাজনীতিবিদরা খুব একটা দাঁড়ায় না। আমার পক্ষে কথা বললে কারও যেহেতু রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি হয় না, যেহেতু আমাকে তাড়িয়ে দিলে দেশের লোকেরা খুব বেশি প্রতিবাদ করে না, যেহেতু বছরের পর বছর আমাকে দেশে না ঢুকতে দিলেও সবাই নীরব থাকে, যেহেতু কোনও দল নেই, সংগঠন নেই আমাকে সমর্থন করার, সেহেতু আমার জন্য দরজা খোলার, কোনও সরকারই মনে করে না যে দরকার।

আমি সত্যি বলতে কী আশা ছেড়েই দিয়েছি।

 প্রশ্ন ৩. ২০০৭ সালে আপনাকে কলকাতা ছাড়তে হয়েছিল। তারপর অনেক চেষ্টা করেছেন কলকাতা ফেরার, তা কিন্তু সম্ভব হয়নি। বর্তমান সরকার বদলেছে, এবং তারা পরিবর্তনের কথা বলছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আপনি কি মনে করেন আপনি কলকাতা ফিরে যেতে পারবেন? আপনি নতুন সরকারের কাছে আবেদন করেছেন কি?

উত্তর: অনেক চেষ্টা করেছি কলকাতায় ফেরার। নতুন সরকারের কাছেও আবেদন করেছি। কিন্তু ওঁরা রাজি নন। সিপিএমের সঙ্গে সমস্ত বিষয়ে তৃণমূল দ্বিমত পোষণ করলেও আমার বিষয়ে একমত। এ ক্ষেত্রে দুজনের অংকটা একদম মিলে যায়। এখন আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি। সত্যি কথা বলতে কী, বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে আমি কোনও পার্থক্য দেখি না। দুটো অঞ্চল থেকেই একজন লেখককে অন্যায় ভাবে তাড়ানো হয়েছে, শুধু তাই নয়, তার আর ফিরতে না পারার ব্যবস্থাও পাকাপাকি করে রাখা হয়েছে। বড় লজ্জা হয় ওঁদের জন্য। বড়ই ক্ষুদ্র মানুষ ওঁরা। দূরদৃষ্টি তো নেই-ই, দুষ্টবুদ্ধিতে মাথাটা ভরে রেখেছে।

প্রশ্ন ৪. এশিয়ার বাইরে আপনার সমর্থনে এত বিদ্বান, এত সাহিত্যিক সামাজিক কর্মী এবং জন-সমগ্র এগিয়ে এসেছেন কিন্তু এখন পর্যন্ত এশিয়া মহাদেশে একটিও সামাজিক সামগ্রিক আওয়াজ উঠলো না কেন আপনার পক্ষে?

উত্তর: এশিয়া এখনও প্রস্তুত নয় আমি যে কথাগুলো বলছি, সেগুলো মেনে নিতে। এশিয়া এখনও ঘোর পুরুষতান্ত্রিক, এখনও ধর্মান্ধ। তবে রাষ্ট্র বা কোনও হোমড়া চোমড়া কিছু সংগঠন দ্বারা স্বীকৃতি না পেলেও এশিয়ায় সাধারণ পাঠকদের প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছি। যারা ভালোবাসে, সমর্থন করে, সম্ভবত তারা সংগঠিত নয় বলেই বড় আওয়াজ ওঠে না। না, আমি অসন্তুষ্ট নই। কী পাইনি ভেবে দুঃখ করার চেয়ে কী পেয়েছি তা ভেবে খুশি থাকায় বিশ্বাসী আমি।

প্রশ্ন ৫. আপনি যা কিছু করেছেন, তা ছাড়াও সাম্প্রতিকালে মালালা, আমিনা ওদুদ, বিনা শাহ এবং আরও অনেক আওয়াজ উঠেছে ধার্মিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে, আওয়াজ উঠেছে পরিবর্তনের, বিশেষত মুসলমান মহিলাদের জন্য। এখান থেকে দশ কুড়ি বছর যদি এগিয়ে যান, তবে কি পরিবর্তন দেখতে পান, মুসলমান মহিলাদের জীবনে কি প্রগতি দেখতে পান?

উত্তর: দশ বা কুড়ি বছরে খুব যে পরিবর্তন দেখতে পাবো, তা মনে হয় না। মুসলিম দেশগুলোতে এখনও ইসলামি মৌলবাদী গোষ্ঠী প্রচণ্ড শক্তিশালী। ব্যক্তিগত ভাবে কেউ কেউ প্রতিবাদ করছে বটে, তবে এ প্রতিবাদ যথেষ্ট নয়। যতক্ষণ না রাষ্ট্র শক্তি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন, নারী-সংগঠন একযোগে মুসলিম মেয়েদের সমানাধিকারের ব্যবস্থা না করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সত্যিকার প্রগতি কিছু ঘটবে না। সত্যিকার প্রগতি চাইলে রাষ্ট্র থেকে, সমাজ থেকে, শিক্ষা থেকে, আইন থেকে ধর্মকে দূর করতে হবে। ধর্মও থাকবে, নারী স্বাধীনতাও থাকবে, এ মুখের কল্পনা বিলাস। ধর্ম যেহেতু নারীর স্বাধীনতা এবং অধিকারের বিপক্ষে, তাই ধর্মকে, ধর্মের বৈষম্যকে, ধর্মের আইনকে মাথার ওপরে অক্ষত অবস্থায় রেখে নারীর সমানাধিকার সম্ভব নয়। আমি কিন্তু সব ধর্মের কথাই বলছি। আর সব নারী-বিদ্বেষী ধর্মের মতোই ইসলাম একটি নারী বিদ্বেষী ধর্ম। কেবল ইসলামই মন্দ, অন্য সব ধর্ম ভালো, এই উদ্ভট ভাবনা আমার নয়।

এতকালের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণে যে ভীষণ রকম নারী-বিদ্বেষ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেছে, তা দুর করার জন্য শুভ বুদ্ধির সব মানুষকে কাজ করতে হবে। অন্যরা সমাজ বদলে দেবে, তারপর আমি ভোগ করবো, এটা ভেবে বসে থাকলে সমাজের বদল ঘটতে বড় দেরি হয়ে যায়। আমাদের জগত আমাদের সময়। আমাদের সমাজ। আমাদের জীবন। আমাদের সবারই দায়িত্ব একে সুন্দর করা। প্রজাতির অর্ধেকে নিগ্রহ করবো আর নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রজাতি আখ্যা দেবো এর চেয়ে হাস্যকর এবং দুঃখজনক ব্যাপার আর কী আছে!

প্রশ্ন ৬: এই উপমহাদেশে যেখানে ধর্ম আর রাজনীতি একই শরীরের দুটো হাত, একে অন্যের সঙ্গে জড়ানো। সেই অর্থে আপনি একটি আঘাতে দুবার বিধ্বস্ত হয়েছেন। আপনি ছাড়াও আরও অনেকে সেই আঘাতের শিকার। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য?

উত্তর: ধর্ম আর রাজনীতিকে মেশালে ধর্মও নষ্ট হয়, রাজনীতিও নষ্ট হয়। এ দুটোর আলাদা থাকাটা খুবই জরুরি। যে মানুষেরা বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে আলস্য বোধ করে, অথবা বিজ্ঞানকে জানতে গিয়ে দেখেছে রীতিমত কঠিন ব্যাপার এটি, তারা ধর্মে আশ্রয় নেয়, ধর্মে আরাম বোধ করে, যেহেতু ধর্মই সবকিছুর সহজ এবং চমৎকার সমাধান দেয়, ধর্ম সম্পর্কে জানতে কোনও বুদ্ধি খাটাতে হয় না, গভীরভাবে ভাবতে হয় না, কোনও প্রশ্ন করারও দরকার হয় না। যারা ধর্মের মতো অবিজ্ঞান আর নারীবিদ্বেষের একটা পিণ্ডের ভেতর নিজেকে পুরে সুখী হতে চায় হোক। কিন্তু দেশের রাজনীতি এই অবিজ্ঞান আর নারীবিদ্বেষের পিণ্ডের সঙ্গে ভাই পাবে কেন? এ দুটো ভাই পাতালে মানুষের মস্তিষ্ক নষ্ট হয়, পরিবার নষ্ট হয়, সমাজ নষ্ট হয়, দেশ নষ্ট হয়। সব নষ্টদের দখলে চলে যায়। রাজনীতির কাজ দেশের মানুষের দেখভাল করা। ঠিক ঠাক রাজনীতিটা হলে মানুষ সুখে স্বস্তিতে থাকে, অভাব, অনটন দূর হয়, সবার জন্য শিক্ষা স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা হয়, কাজকর্মের সুযোগ ভালো হয়, দুর্নীতি বদ নীতির প্রকোপটা কমে যায়। রাজনীতির মধ্যে ধর্মের ছিটে ফোঁটা ঢুকলেই সর্বনাশ। এ দুটোকে আলাদা করতে গিয়েই দেখেছি আমাকে প্রচণ্ড আঘাত করা হচ্ছে। শুধু আমি নই, আরও অনেকেই শিকার হয়েছে এই বীভৎস ধর্মরাজনীতির। ধর্মনির্ভর রাজনীতি সব দেশেই নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। এর একটিই কারণ, ধর্মের সঙ্গে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীর অধিকার, বাক স্বাধীনতা এসব যায় না। ধর্মের সঙ্গে চিরকালই এসবের বিরোধ।

রাষ্ট্র এবং রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা না করা হলে মানুষের দুর্ভোগের কখনও শেষ হবে না। সৎ এবং সাহসী মানুষদের খুন হয়ে যেতে হবে, পচতে হবে জেলে, নয়তো আমার মতো নির্বাসনে জীবন কাটাতে হবে।

প্রশ্ন ৭: এডওয়ার্ড স্নোডেনকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়নি ভারত। আপনার কি মনে হয় রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া ভারতের উচিত ছিল?

উত্তর: প্রথমেই বলতে হবে, আমেরিকার উচিত হয়নি স্নোডেনকে ভোগানো। কী অন্যায় করেছে সে, ভেতরের লুকোনো খবরগুলো জানিয়ে দিয়েছে, এই তো? আমি খুব খুশি হতাম যদি স্নোডেন আমেরিকায় বসে এই কাজটা করতো এবং আমেরিকার সরকার তাকে কোনওরকম বিরক্ত না করতো। ইওরোপ যে এত মানবাধিকারের জন্য প্রাণপাত করছে, ইওরোপি, বিশেষ করে পশ্চিম ইওরোপ স্নোডেনকে রাজনৈ তিক আশ্রয় দেবে না কেন? ভারতের কথা উঠছে কেন! ভারত দিতেই পারে তাকে আশ্রয়। কিন্তু ভারত হয়তো ভাবছে এসময় আমেরিকার সঙ্গে শত্রুতা করা উচিত হবে না। ভারতের একশ রকম সমস্যা। এক ডজন মুসলিম মৌলবাদী রাস্তায় নেমে খানিকটা চেঁচালেই ভারতকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় আশ্রিত লেখককে রাজ্য থেকে বা দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবার, সেখানে কী করে ভাববো স্নোডেনকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে আমেরিকার মতো ভয়ংকর শক্তির বিরুদ্ধে ভারত দাঁড়াবে।

সারা পৃথিবী যখন স্নোডেনকে আশ্রয় দিতে পারছিল না, তখন ভারত যদি দিতে পারতো, তাহলে শুধু আমি কেন, ভারত নিয়ে গৌরব করতে পারতো পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ। যা হয়নি, হয়নি। আপাতত স্নোডেন নিরাপদে রাশিয়ায়।

আমি যে অবস্থাটির স্বপ্ন দেখি, সেটি বিপদগ্রস্ত লেখক শিল্পীকে ভালো ভালো দেশগুলোর রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া নয়। আমি স্বপ্ন দেখি, কোনও দেশে যেন এমন অবস্থার সৃষ্টি না হয়, যে, দেশের লেখক শিল্পীকে বেরিয়ে যেতে হয় দেশ থেকে বেরিয়ে অন্য কোনও দেশে আশ্রয় চাইতে হয়। সবখানেই যেন মানুষের মত প্রকাশের অধিকার থাকে। সব অঞ্চলই, সব দেশই, পৃথিবীর সর্বত্রই যেন মানুষের জন্য নিরাপদ হয়।

প্রশ্ন ৮. এ বছর বেলজিয়ামে রয়্যাল অ্যাকাডেমি অব আর্টস, সায়েন্স, এবং লিটারেচার থেকে পাওয়া অ্যাকাডেমি পুরস্কার ছাড়াও প্যারিস থেকে ইউনিভার্সাল সিটিজেনশিপ পাসপোর্ট পেয়েছেন। এই পাসপোর্টটা ঠিক কি রকম পাসপোর্ট? আপনার পাওয়া পুরস্কারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ইম্পর্টেন্ট কোনটি?

উত্তর: ইউনিভার্সাল সিটিজেনশিপ পাসপোর্ট অনেকটা প্রতিকী পাসপোর্ট। এই পাসপোর্টটা সভ্য মানুষদের পাসপোর্ট, ভবিষ্যতের পাসপোর্ট। এই পাসপোর্টে কিন্তু নিজের জেন্ডার, জাত, ধর্ম, চোখের রং, চুলের রং, গায়ের রং, দেশ এসবের উল্লেখ নেই। শুধু নিজের নাম আর বয়সটুকুই। এই পাসপোর্টে কোনও ভিসার প্রয়োজন নেই। এই পাসপোর্ট নিয়ে পৃথিবীর সব দেশেই ভ্রমণ করা যাবে। শুধু ভ্ৰমণ নয়, যে। দেশেই বা যে অঞ্চলেই বাস করতে চাও, সেখানে বাস করতে পারবে। বাধা দেওয়ার অসভ্য নিয়ম টিয়ম নেই। এ অনেকটা স্বপ্নের মতো। এই স্বপ্ন কোনওদিন হয়তো সত্যি হবে। কিন্তু আজ আমরা একটা স্বপ্ন তৈরি করলাম। যারা সুন্দরতম একটি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে, তাদেরই দেওয়া হয়েছে এই পাসপোর্ট।

জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছি। সবচেয়ে বড় পুরস্কার মানুষের ভালোবাসা। আমার বই পড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মেয়েরা যখন ভালোবাসেন, বলেন, আমার বই তাঁদের শক্তি সাহস বাড়ায়, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখায়, তখন বড় ভালো লাগে। এর চেয়ে বড় পুরস্কার একজন লেখকের আর কী থাকতে পারে।

প্রশ্ন ৯: বিগত দু মাসে আপনি কানাডা আর আয়ারল্যাণ্ডে অ্যাথিস্ট হিউম্যানিস্ট কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলেন। এরা বিশেষ কোনও সংগঠন? এদের প্রধান উদ্দেশ্য কি?

উত্তর: সারা পৃথিবীতেই বিজ্ঞানমনস্ক, ধর্মমুক্ত, যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন, মুক্তচিন্তার মানুষ আছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই সংগঠন গড়েছেন। এই সংগঠনগুলো থেকে মাঝে মাঝেই সেমিনার আর কনভেনশনের আয়োজন করা হয়, যেখানে মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সৃষ্টিশীল চিন্তক লেখক, শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। যে ভাবনাগুলো রক্ষণশীল সমাজ মেনে নেয় না, সেই ভাবনাগুলো সকলে ওইসব সেমিনার আর কনভেনশনে নিশ্চিন্তে প্রকাশ করেন, আগ্রহী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ বি দ্বজ্জনের বক্তব্য শুনতে আসেন। বোদ্ধা শ্রোতা আর বক্তার মধ্যে মতের আদান। প্রদান হয়। সাধারণ মানুষকে বিজ্ঞান শিক্ষায় উৎসাহী করার, বিবর্তনের জ্ঞান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং প্রচার মাধ্যম থেকে ছড়িয়ে দেওয়ার, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার এসবের প্রতিবাদ করার প্রেরণা দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, মানবাধিকার, নারীর অধিকার,

শিশুর অধিকার, সমকামী বা রূপান্তরকামীর অধিকারের পক্ষেও আমরা উচ্চকণ্ঠ কই। গণতন্ত্র, মানবতন্ত্র, আর বৈষম্যহীন সমাজের প্রতিষ্ঠার জন্য যা করা দরকার, সকলে মিলে তার পরিকল্পনা করি। মূলত আমাদের স্বপ্ন, একটি সুস্থ সুন্দর পৃথিবী তৈরি করা, যেখানে ধর্মের, পুরুষতন্ত্রের, শোষক শ্রেণীর অত্যাচার নেই।

প্রশ্ন ১০: আপনি দীর্ঘদিন ধরে বাক স্বাধীনতার পক্ষে এবং সাহিত্যিক প্রতিবন্ধনের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। এ বছর ৩১ জুলাই হানস পত্রিকা তাদের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে আপনাকে আমন্ত্রণ করেছিল। এই অনুষ্ঠানের মূল বক্তব্য যা ছিল, তা নিয়েই আপনার লড়াই। তাহলে সম্ভব হলো না কেন?

উত্তর: ভারতের হায়দারাবাদে বই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মৌলবাদীরাআক্রমণ করার পর থেকে একটি অলিখিত চুক্তিই আমার ভারতবর্ষের সঙ্গে, জনতার ভিড়ে কোনও অনুষ্ঠান টনুষ্ঠানের মঞ্চে আমি উঠবো না। আমি তো ভীষণ চাই মানুষের মধ্যে থাকতে, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে, মত বিনিময় করতে। কিন্তু আপাতত এটি সম্ভব নয়। আমার নিরাপত্তার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের পরামর্শ আমাকে মানতে হয়। সে কারণেই আমি হানসের অনুষ্ঠানে যেতে পারিনি। আমি শুনেছি ওখানে অনেকে গিয়েছিলেন আমার সঙ্গে দেখা হবে এই আশায়। কিন্তু আমি খুবই দুঃখিত সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারিনি বলে।

বাক স্বাধীনতা নিয়ে আমার লড়াই। হানসের অনুষ্ঠানে না যাওয়ার মানে কিন্তু এই নয় যে আমি বাক স্বাধীনতাকে মূল্য দিইনি। জীবনের নিরাপত্তার কারণে কোনও জায়গায় শারীরিক ভাবে উপস্থিত না থাকার অর্থ বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যাওয়া নয়। আমি আমার বাক স্বাধীনতা কী রকম রক্ষা করছি এবং অন্য সবার বাক স্বাধী নতার কতটা পক্ষে আমি, তা আমার বই এবং ব্লগগুলো পড়লেই যে কেউ বুঝবে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সেসব মত আমি প্রকাশ করছি। কিন্তু নিরাপত্তা রক্ষী দের বাধা যেখানে আছে, সেখানে আমার অনুপস্থিতির জন্য আমাকে দোষ দেওয়া ঠিক নয়।

আমি আশা করছি, আমি বেঁচে থাকাকালীন সেই দিন যেন আসে, যে দিন ভার তবর্ষের কোথাও যেতে কোনও বাধা থাকবে না আমার। জনতার ভিড়ে আর সবার মতো আমিও আমার পরিচয়ে হাঁটতে পারবো। কোনও নিরাপত্তা রক্ষীর প্রয়োজন হবে না। মানুষের ভালোবাসাই হবে আমার নিরাপত্তা। সেই দিন যেন আসে, যতই ধর্মের সমালোচনা করি না কেন, কেউ মাথার দাম ঘোষণা করবে না, কেউ হত্যা করতে আসবে না, কেউ ফতোয়া দেবে না। আমিও একদিন কবিতা পড়তে পারবো আর সব কবিদের মতো, আমিও বইমেলায় অটোগ্রাফ দিতে পারবো আর সব লে খকদের মতো, আমিও সাহিত্য সংস্কৃতির পরবে অনুষ্ঠানে আমার মত প্রকাশ করতে পারবো, নির্ভয়ে, নিরাপদে।

প্রশ্ন ১১: হানস পত্রিকা বিগত দেড় বছর যাবৎ আপনার লেখার হিন্দি অনুবাদ প্রকাশ করছে। এই পত্রিকার সম্পাদকের প্রচেষ্টাকে কিভাবে স্বাগত জানাবেন?

উত্তর: আমি খুবই কৃতজ্ঞ রাজেন্দ্র যাদবের কাছে। ভারতবর্ষে যেদিন আমার বই নিষিদ্ধ হল, সেদিন থেকেই পাল্টে গেছে পুরো পরিবেশ। আমার বই প্রকাশ করতে প্রকাশকরা ভয় পান, আমার লেখা ছাপাতে সম্পাদকরা ভয় পান, সরকার আমার বিরুদ্ধে এই খবরটি মুসলিম মৌলবাদীদের এমনই ইন্ধন যোগালো যে দলে দলে তারা আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিতে শুরু করলো, পথে নামতে শুরু করলো, দেশ থেকে আমাকে তাড়ানোর দাবিও করতে লাগলো। যদি পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমার বইটি নিষিদ্ধ না করতো, তা হলে ফতোয়া, মাথার দাম ইত্যাদি কিছুই জারি হতো না। সবচেয়ে বড় দুঃখ এই, বই নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব কিন্তু মৌলবাদীদের কাছ থেকে আসেনি। কলকাতার কিছু ঈর্ষাকাতর লেখক সাহিত্যিকের কাছ থেকে এসেছে। সরকার বইটি নিষিদ্ধ করেছিল লেখকেঁদের দাবির কারণে। সরকার যখন কারও ধর্মীয় অনু ভূতিতে আঘাত লাগবে এই ছুতোয় বই নিষিদ্ধ করে, তখন তাদের ধর্মীয় অনুভূতিকে সরকারই হাজার গুণ উসকে দেয়, আর সেই ধর্মের মৌলবাদীদের হাতেই অস্ত্র তুলে দেয় বইয়ের লেখককে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করার জন্য, তাকে হয়রানি করার জন্য, পেটানোর জন্য, হত্যা করার জন্য।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে এই ছুতোয় সরকার কোনও লেখকের বই নিষিদ্ধ করলে বইয়ের প্রকাশক, পত্রিকার সম্পাদক, এমনকী পাঠকও সরকার এবং মৌলবাদীদের ভয়ে তটস্থ থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশের বেশির ভাগ মানুষ এখনও ঠিক জানে না বাক স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা।

হানস পত্রিকার নীতির প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা। রাজেন্দ্র যাদবের মতো সাহসী এবং সৎ লেখকের অভাব খুব সমাজে।

প্রশ্ন ১২: হিন্দিতে অনুবাদ করা আপনার সাম্প্রদিক বই কতদিনে আশা করবো? বইটি কি নিয়ে?

উত্তর: যে বইটি বের হতে যাচ্ছে, সেটির নাম নির্বাসন। কী করে আমি প্রথমে পশ্চিমবঙ্গ থেকে, তারপর ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হলাম, তারই কাহিনী। নির্বা সন আমার আত্মজীবনীর সপ্তম খণ্ড আমি তো সাত খণ্ডে রামায়ণের মতো আমার আত্মজীবনী লিখলাম। প্রথম খণ্ডটির নাম আমার মেয়েবেলা, ওটি আনন্দ পুরস্কার নামে বাংলা সাহিত্যের খুব বড় একটা পুরস্কার পেয়েছে। বইগুলোর সব খণ্ডই অনেক ভাষায় ছাপা হয়েছে। লোকে গোগ্রাসে পড়ে আত্মজীবনীগুলো। এসব তো কেবল আমার জীবনকাহিনীই নয়, আরো হাজারো মেয়ের জীবন কাহিনী। তৃতীয় খণ্ডটি দ্বিখণ্ডিত, যেটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কলকাতার একটি মানবাধিকার সংগঠন থেকে কিছু লোক দ্বিখণ্ডিত নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। কলকাতা হাইকোর্ট নিষিদ্ধ হওয়ার মতো কিছু পায়নি বইটিতে। নির্দিধায় মুক্ত করে দিয়েছে। নিষিদ্ধ। হওয়ার দুবছর পর মুক্তি পেয়েছে বই। জনতা নিষিদ্ধ করে না বই। শাসকেরা করে।

দুষ্ট লোকদের দুষ্ট বুদ্ধিতে চিরকালই তারা বই নিষিদ্ধ করে আসছে। বই নিষিদ্ধ বড়ই নোংরা কাজ। বাংলাদেশের সরকার নোংরা কাজে রীতিমত হাত পাকিয়েছে। আমার পাঁচটা বই নিষিদ্ধ ও দেশে। দেশের মানুষগুলোও নোংরা, কেউ এ পর্যন্ত নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে ও দেশে মামলা করেনি।

প্রশ্ন ১৩: এই শহরটাকে আপনার কেমন লাগে? কখনও কি মনে হয় এটাও আপনার ঘর? কী করতে আপনার সবচেয়ে ভালো লাগে?

উত্তর: কোনও জায়গা জুমি, দেশ, বাড়ি আমার ঘর নয়। আমার ঘর মানুষ, মানুষের হৃদয়। পৃথিবীর যেখানেই যে মানুষেরা স্বপ্ন দেখে সুন্দরের, সত্যের, যাদের সহমর্মিতা, সমর্থন,, শ্রদ্ধা পাই, ভালোবাসা পাই, সেই মানুষেরাই আমার ঘর, আমার বাড়ি। সেই মানুষের হৃদয়ই আমার নিরাপদ স্বদেশ।

প্রশ্ন ১৪: আপনি কি ভবিষ্যতে গৃহস্থ জীবনে নিজেকে সেটেল কার কথা ভাবেন?

উত্তর: আমার যে জীবন, সে জীবন কি অগৃহস্থ জীবন? আমি কি কোনও ঘরে ঘুমোই না, চাল ডাল কিনি না, রাঁধি না, খাই না? ঘুমোই, রাঁধি, খাই। আমার ঘরে কি অতিথিরা আত্মীয়রা বেড়াতে আসে না? আসে। আতিথেয়তা পায় না? পায়। আপনি কি স্বামী সন্তান নিয়ে বসবাস করাকে গৃহস্থ জীবন বলেন? ওইসব ক্ষুদ্র সংজ্ঞা থেকে আমি অনেককাল মুক্ত।

 প্রশ্ন ১৫: তসলিমা নাসরিনকে একজন লেখক, একজন অ্যাকটিভিস্ট, একজন মানুষ হিসেবে কিভাবে দেখেন?

উত্তর: একজন সৎ মানুষ হিসেবে দেখি। একজন নিঃস্বার্থ, হৃদয়বান মানুষ।

প্রশ্ন ১৬: আপনি হিন্দি সাহিত্য জগতে এখন অনেকটাই পরিচিত। বাংলা এবং হিন্দি সাহিত্যকে কিভাবে তুলনা করবেন?

উত্তর: আমি যেহেতু বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা সাহিত্য শৈশব থেকে পড়ছি, সেহেতু বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আমার জ্ঞান অন্য সব সাহিত্য সম্পর্কে আমার যা জ্ঞান, তার তুলনায় অনেক বেশি। হিন্দি সাহিত্য পড়তে গেলে অনুবাদ পড়তে হয়। পড়েছি, যতটুকু পড়েছি, তাতে মুগ্ধ আমি। সব ভাষাতেই থাকে উঁচুমান, মাঝারিমান, নিম্নমানের রচনা। দীর্ঘকাল ধরে বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা হচ্ছে বলে সম্ভবত বাংলায় উঁচু মানের সাহিত্যের পরিমাণটা বেশি।

প্রশ্ন ১৭: হিন্দি পাঠকদের জন্য কী বক্তব্য দেবেন? উত্তর: আমি রাজনৈতিক নেতা বা ধর্মীয় গুরু নই। ঘন ঘন বক্তব্য দেওয়ার বা ভাষণ দেওয়ার অভ্যেস নেই, উপদেশ বর্ষণও কম করি। আমার যা বলার, তা আমি লিখি। লেখকের কাজই তো লেখ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *