‘‘—সাথে সাথে ঘুরবে’’ – প্রমথনাথ বিশী

‘‘—সাথে সাথে ঘুরবে’’ – প্রমথনাথ বিশী

অল্পদিনের মধ্যে পর পর কয়েকটি মৃত্যুতে আমাদের বাড়িতে একটি অনৈসর্গিক আবহাওয়ার সৃষ্টি হইল৷

প্রথমে মারা গেল বাড়ির একটি ছোট ছেলে, খেলা করিবার সময় ছাদ হইতে পড়িয়া৷ সেই ঘটনায় বালকের মাতা এমন অভিভূত হইয়া পড়িল যে, সে শয্যাগ্রহণ করিল৷ সেই শয্যা আর সে ছাড়িল না৷ মৃত্যু আসিয়া শোকাতুরার সকল যন্ত্রণার অবসান করিয়া দিল৷ এই দুটি মৃত্যুর মধ্যে দেড় মাস কালেরও ব্যবধান নয়৷ তৃতীয় মৃত্যুটি আরো আকস্মিক৷ তখন বর্ষাকাল৷ বিদ্যুতের তারে কোথায় কি ত্রুটি হইয়াছিল, কেউ জানিত না৷ বাড়ির একটি বয়স্ক বালক সুইচ টিপিতে গিয়া প্রাণ হারাইল৷ সেই ঘরটিতে অপর কেহ ছিল না, কেহ তাহাকে সাহায্য করিবার অবকাশও পাইল না৷ চতুর্থ বা শেষ মৃত্যুটি ঘটিল বাড়ির একটি চাকরের৷ অনেকদিনের পুরানো চাকর, আমাদের পরিবারের স্বাঙ্গীভূতপ্রায় হইয়া গিয়াছে৷ রাতের বেলায় সুস্থ শরীরে সে শুইয়াছিল, ভোরবেলায় দেখা গেল তাহার দেহ প্রাণহীন৷ ডাক্তার আসিল, পরীক্ষা করিয়া বলিল, হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া মারা গিয়াছে৷ আমরা বলিলাম, লোকটির তো হার্টফেল করিয়া মরিবার বয়স হয় নাই৷ ডাক্তার বলিল, আর সবেরই বয়স আছে, মরিবার বয়স নাই৷ অভিজ্ঞ ডাক্তার ছাড়া এমন আর কে বলিতে পারিত৷

তিনচার মাসের মধ্যে এই চারিটি মৃত্যু বাড়িতে ঘটিল৷ পরিবারের বালকবালিকা হইতে বয়স্কগণ অবধি সকলেই ভাঙ্গিয়া পড়িল৷ কিন্তু শোক যতই তীব্র ও ব্যাপক হোক না কেন, সংসার তাহার প্রাত্যহিক দাবী ছাড়ে না৷ সেই দাবী মিটাইবার জন্য আমাকে বাধ্য হইয়া শক্ত থাকিতে হইল৷ শোক করিবার অবকাশ আমার ছিল না৷

সংসারে প্রাত্যহিক কাজকর্ম নিতান্ত অভ্যাসের তাগিদেই আপনার চিহ্নিত পথে চলিতে লাগিল৷ সকাল হয়, চাকর বাজারে যায়, যথাসময়ে আহারের ডাক পড়ে, অফিসগামীরা অফিসে যায়৷—এইভাবে সবই চলিতেছে, কিন্তু কাহারও মনে আনন্দ নাই, জীবনে উৎসাহ নাই, এমন কি সবাই যেন স্বল্পভাষী হইয়া পড়িয়াছে৷ কেহ অপরের মুখের দিকে ভালো করিয়া তাকাইতে সাহস করে না, কি জানি দুই দৃষ্টির ঠোকাঠুকিতে সুপ্ত শোকের আগুন যদি জ্বলিয়া ওঠে!

আরো একটা ভীষণতর সম্ভাবনা ছিল৷ এবার কার পালা?—এই আশঙ্কা প্রত্যেকের মনেই গুপ্ত ছিল৷ হঠাৎ যদি চোখে চোখে ঠেকিয়া প্রশ্নরূপে ঝলকিয়া ওঠে, তাই সকলে পরস্পরের চোখ এড়াইয়া চলিত৷ আর এতবড় বাড়িটা কেমন যেন অদ্ভুতরকম নিস্তব্ধ হইয়া পড়িয়াছিল৷ লোকে যে কথাবার্তা বলিত না, কিম্বা বিশেষ করিয়া ধীরপদেই চলিত এমন বলি না, কিন্তু কণ্ঠস্বর ও পদশব্দ মনে হইত যেন অনেকটা দূর হইতে আসিতেছে, মনে হইত সিঁড়ির উপরে কে যেন অদৃশ্য গদি পাতিয়া রাখিয়াছে—নতুবা ওঠা-নামার শব্দ এত ক্ষীণ কেন?

এই সময় একদিন একজন পশ্চিমা চাকর নিযুক্ত হইল৷ হঠাৎ রাত্রিবেলা তাহার আর্তস্বর শুনিয়া সকলে নিচের তলায় ছুটিয়া গেলাম, কি ব্যাপার! দেখিলাম যে লোকটা জাগিয়া থরথর করিয়া কাঁপিতেছে৷ ‘‘কি হয়েছে রে?’’ সে কেবল একটি কথা বলিল, ‘দেও!’’ এই বলিয়া সে জানালার বাহিরের বকুলগাছটার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল৷ দেখিলাম যে, বাহিরের দিকে অন্ধকারের মধ্যে বকুলগাছটা একটা সুবৃহৎ তোড়া-বাঁধা অন্ধকারের মতো দাঁড়াইয়া রহিয়াছে৷ আমি তাহাকে বুঝাইতে চেষ্টা করিলাম যে দেও অর্থাৎ ভূতটুত কিছু নয়, হঠাৎ ওই গাছটা দেখিয়া ভয় পাইয়া গিয়াছে৷ সে বুঝিতে চায় না৷ সে বলে, দেও একটা নয়, দুইটা৷ একটা লেড়কা, আর একটা আওরৎ জানলার দিকে মুখ করিয়া ওই গাছটার তলায় দাঁড়াইয়াছিল৷

আমি বলিলাম—তাহারা দেও নয়, সত্যকার মানুষ৷

সে মানিবে কেন? পাছে আরো কিছু বলিয়া ফেলে, তাই প্রসঙ্গ চাপা দিয়া তাহাকে উপরতলায় লইয়া গিয়া আমার ঘরের বারান্দায় শুইতে বলিলাম৷ ভোরবেলা উঠিয়া সে একটা পশ্চিমা ধরনের সেলাম করিয়া বিদায় লইয়া গেল৷ বলিল যে, এ বাড়িতে দেও আছে৷

এই ঘটনায় সকলের মনে শোকের সহিত ভয়ের যোগ হইল৷ আমি সকলকে বুঝাইতে চেষ্টা করি যে, বেটার পলাইবার ইচ্ছা ছিল, তাই ভূতের একটা অবতারণা করিল৷ কিন্তু মুশকিল এই যে, কেহ আমার সঙ্গে এ বিষয়ে তর্ক অবধি করে না, করিলে আমার যুক্তির স্বপক্ষে দু’চার কথা বলিবার অবকাশ পাইতাম৷ আমার কথা শুনিয়া সকলে চুপ করিয়া থাকে৷ বেশ বুঝিতে পারি, সকলেই মনের ভিতরে শোক ও ভয়কে একশয্যায় সযত্নে লালন করিতেছে৷ আমি বুঝিলাম, সকলের মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ হইবার মুখে, অতঃপর দৈহিক স্বাস্থ্যও ভাঙিয়া পড়িবে৷ তখন আমি একদিন প্রস্তাব করিলাম যে, কিছুদিনের জন্য সকলে একবার শিমুলতলা ঘুরিয়া আসিলে কেমন হয়৷ কেউ উৎসাহ প্রকাশ না করিলেও আপত্তি করিল না৷ শিমুলতলায় আমাদের একটি বাড়ি ছিল৷ কয়েকদিন পরে আমি সকলকে লইয়া গিয়া শিমুলতলায় রাখিয়া আসিলাম৷ কলিকাতার বাড়িতে আমি একা থাকিলাম, আর থাকিল একটা নূতন চাকর৷ সে পূর্বেতিহাসের কিছুই জানিত না৷

শিমুলতলা হইতে ফিরিয়া আসিয়া আমি অসুখে পড়িলাম৷ অসুখ এমন কিছু নয়৷ প্রথমটা কিছুদিন সর্দিজ্বর না ইনফ্লুয়েঞ্জা বলিয়া চালাইলাম৷ কিন্তু আট দশ দিন পরেও শয্যাত্যাগ করিতে সমর্থ না হইলে ডাক্তারকে কল দিলাম৷

ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, কোনো বিশেষ রোগের লক্ষণ মিলিতেছে না, ‘নার্ভাস শক’ বলিয়া মনে হইতেছে৷ নার্ভাস শক ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করিয়া বলিলেন, দেহের স্নায়ুপুঞ্জের উপর দিয়া অনেক ঝড়ঝাপটা গিয়াছে, তাই তাহারা সাময়িকভাবে বিকল হইবার লক্ষণ দেখাইতেছে৷ তারপরে উৎসাহ দিয়া বলিলেন, কোনো ভয় নাই—কিছুদিন শুইয়া থাকুন, সব সারিয়া যাইবে৷ ডাক্তার বিদায় হইলে ভাবিলাম, ডাক্তারের কথা মিথ্যা নয়,—এ কয় মাস আমাকে অনেক সহ্য করিতে হইয়াছে৷ মৃত্যুশোকে আর সকলে যখন কাতর হইয়া পড়িয়াছিল, আমার বিশ্রামের সময় ছিল না, এমন কি একটু নিরিবিলি বসিয়া একবার যে অশ্রুপাত করিব, সে অবসরটুকুও পাই নাই৷ বুঝিলাম যে ভিতরে ভিতরে একটা ক্ষোভ জমিয়া উঠিতেছিল, তখন প্রকাশের সময় ছিল না, এখন অবসর পাইয়া স্নায়ুপুঞ্জ এলাইয়া পড়িয়াছে৷ ডাক্তারে বলিয়াছে, কোনো ঔষধের প্রয়োজন নাই, অর্থাৎ এ রোগের কোনো ঔষধ নাই, শুইয়া থাকাই একমাত্র চিকিৎসা৷ তাই শুইয়া থাকিলাম, অবশ্য উঠিবার শক্তি ছিল না—ইচ্ছাও বড় ছিল না৷

সারাদিন একাকী শুইয়া থাকি, সারাদিন এবং সারারাত৷ চাকরটা নিয়মিত সময়ে আসিয়া খাদ্য ও পথ্য দিয়া যায়, অন্য সময়ে তাহার বড় দেখা পাই না, তবে পদশব্দে ও গার্হস্থ্য কাজের টুকটাক আওয়াজে বুঝিতে পারি যে, লোকটা নিচের তলাতেই আছে৷ আমাদের বাড়িটা নিতান্ত ছোট নয়, তিনতলা, চকমিলানো ধরনের সেকেলে বাড়ি৷ ক্ষুদ্র বৃহৎ মাঝারী অনেকগুলি কক্ষ বাড়িটিতে৷ এখন দু’তিনটি ছাড়া সব তালাবন্ধ, সকলে থাকিবার সময়েও সবগুলি খুলিবার প্রয়োজন হয় না৷

দোতলার একটি প্রশস্ত কক্ষে এক দিকে আমার শয্যা৷ শুইয়া থাকিলে বাহিরের পথের লোক-চলাচলের কতক চোখে পড়ে, রাত্রিবেলায় গ্যাসের আলো কতক ঘরে আসিয়া ঢোকে আর বসন্ত ও বর্ষাকালে যথাক্রমে দক্ষিণ ও পূর্বের জানালা দিয়া হু-হু করিয়া বাতাস প্রবেশ করে৷ অনেকগুলি বালিশ মাথায় দিয়া ঘাড় উঁচু করিয়া পড়িয়া থাকি৷ ক্লান্তি যতই বাড়ে—একটি করিয়া বালিশ সরাইয়া ফেলি, শেষ একটি বালিশ যখন অবশিষ্ট থাকে, তখন বিছানার উপর গড়াইতে থাকি,—গড়াইতে গড়াইতে কখন ঘুমাইয়া পড়ি৷ এইভাবে রাত্রি কাটিয়া যায়৷ আর দিন? দিনের বেলায় জাগিয়া ভাবিয়া এবং লঘুধরনের বই পড়িতে চেষ্টা করিয়া কাটাই, পথের আনাগোনা দেখি আর জানালা দিয়া বকুলগাছটার পাতায় আলোর চিকিমিকি দেখি ও পাখিগুলোর কিচিমিচি শুনি৷ মাঝে মাঝে চাকরটা আসিয়া পথ্য খাদ্য ও ডাকের চিঠি দিয়া যায়৷

সেদিনটার কথা কিম্বা আরো সঠিকভাবে বলা উচিত—সে রাতটার কথা, কখনো কি ভুলিতে পারিব! আজ সুস্থ হইয়া উঠিয়াছি বলিয়া সকল কথাই বলিতে পারিতেছি৷ সে দিনের অভিজ্ঞতাকে এখন অপরের অভিজ্ঞতা বলিয়া মনে হইতেছে৷ কিন্তু কখনো ভাবি নাই ‘তাহার’ হাত হইতে মুক্তি পাইব৷ অনেকে আমার অভিজ্ঞতা শুনিয়া বলিয়াছে, ওটা নার্ভাস শকের প্রতিক্রিয়া, আসলে কিছুই নয়৷

নার্ভাস শক—ডাক্তার এই যে কথাটা বলিয়াছিল লোকে তাহার বেশি আর অগ্রসর হইতে চায় না৷ কিন্তু আমি তো জানি, আমার অভিজ্ঞতায় ‘তাহার’ প্রভাব কতখানি সত্য—কত মর্মান্তিকভাবে সত্য৷ লোকে যখন নার্ভাস শক বলিয়া ব্যাপারটা উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করে, আমি তর্ক করি না, চুপ করিয়া থাকি, কিম্বা বড় দুঃখে হাসি আর ভাবি— একজনের অভিজ্ঞতা অপর একজনকে বুঝানো কত কষ্ট৷

সেই প্রথম রাত্রির অভিজ্ঞতাকে ‘তাহার’ আবির্ভাবের সূত্রপাত বলিয়া তখন বুঝিতে পারি নাই, আদ্যন্ত ইতিহাস মিলাইয়া লইয়া আজ বুঝিতেছি এবং তাহার হাত হইতে রক্ষা পাইবার পরেও শিহরিয়া উঠিতেছি, ভাবিতেছি,—মৃত্যুর কত নিকটেই না গিয়া পড়িয়াছিলাম!

সেদিন রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়া গিয়া জানালার দিকে নজর পড়িবামাত্র বুকের রক্ত একবারের জন্য ছাঁৎ করিয়া উঠিয়া যেন জমিয়া কঠিন হইয়া গেল৷ দেখিলাম জানালার ঠিক বাহিরেই অতিকায় একটি মস্তক৷ ভাবিলাম, স্বপ্ন দেখিতেছি, কিন্তু চোখে হাত দিয়া বুঝিলাম চোখের পাতা খোলা৷ গায়ে চিমটি কাটিয়া দেখিলাম—লাগিতেছে৷ সন্দেহমাত্র আর রহিল না যে আমি জাগ্রত৷ ভয়ে চিৎকার করিতে চেষ্টা করিলাম—স্বর বাহির হইল না৷ ঘরের আলো জ্বালিবার ইচ্ছা হইল—কিন্তু উঠিতে পারিলাম না—এ যেন অপরের শরীর৷ কালো প্রকাণ্ড মস্তক! নাক-চোখ-মুখগুলো দেখা যাইতেছে না বটে, কিন্তু মস্তক যে তাহাতে সন্দেহ নাই৷ ওদিকে চাহিয়া থাকা কঠিন, না থাকা আরো কঠিন৷ সেই শীতের রাত্রে কপালে ঘাম গড়াইতে লাগিল৷ এই অবস্থায় হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া যখন বন্ধ হইবার মুখে—ঠিক সেই সময়ে একখানা মোটরগাড়ি পথ দিয়া চলিয়া গেল৷ তাহার বাতি হইতে এক ঝলক আলো মুণ্ডটার উপর পড়িল৷ মুণ্ড কোথায়? সেই ঝাঁকড়া বকুলগাছটা যে! আবার বুকের রক্ত ও হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া নিয়মিত হইল৷ মনে মনে হাসিবার চেষ্টা করিলাম, কিন্তু তখনই মনে পড়িল যে এ কেমন ভ্রান্তি! যে বকুলগাছটাকে অন্তত ত্রিশ বৎসর দেখিতেছি, তাহাকে কেন হঠাৎ অতিকায় মস্তক বলিয়া মনে হইল? তখনি আবার ডাক্তারের কথা মনে পড়িল,—নার্ভাস শক৷ পুস্তকে পড়িয়াছি বটে যে, নার্ভাস শকের ফলে কত সম্ভব বস্তুকে অসম্ভব বলিয়া মনে হয়৷ যাই হোক গলা শুকাইয়া গিয়াছিল, জল খাইবার জন্য উঠিলাম৷ টেবিলের উপরে এক গ্লাস জল ঢাকা থাকে৷ ঢাকা খুলিয়া দেখিলাম গেলাস শূন্য৷ জল খাইল কে? আমিই কি আগে আর একবার উঠিয়া জল পান করিয়াছি? কই, মনে তো পড়ে না! চাকরটার উপরে রাগ হইল, ব্যাটা ফাঁকি দিতে শুরু করিয়াছে৷ জল পান আর হইল না, ঘরে আর জল ছিল না৷ শুইয়া পড়িলাম এবং ঘুম আসিতে বিলম্ব হইল না৷

আমার অভিজ্ঞতা শুনিয়া অনেকে শুধাইয়াছে—কিছু দেখিয়াছ কি? স্বীকার করিতে হয় যে, কিছু বা কাহাকেও দেখি নাই৷ লোকে হাসে, তাহাদের নার্ভাস শকের থিওরিটা আরো পাকা হয়৷ কিন্তু তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলে বুঝিয়াছি, কিছু না দেখার চেয়ে কিছু দেখা অনেক ভালো৷ অশরীরীর সহিত বোঝাপড়া চলে—কিন্তু অশরীরীর সহিত তেমন হইবার নয় বলিয়াই তাহা ভয়ঙ্কর৷ এখন হইতে আমার অজ্ঞাত, অজ্ঞেয় শত্রুকে ‘অশরীরী’ বলিয়া উল্লেখ করিব৷

পরদিন রাত্রে আবার ঘুম ভাঙিয়া গেল—দেওয়াল ঘড়িটার দিকে চাহিয়া দেখিলাম রাত্রি দেড়টা৷ তখনি বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করিয়া উঠিল, সেই কালো মাথাটা নাই তো? আড়চোখে চাহিয়া দেখিলাম বকুলগাছটার পাতাগুলি বাতাসে কাঁপিতেছে৷ স্বস্তি বোধ করিলাম, সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভীরুতার প্রতি একপ্রকার ধিক্কার বোধ হইল৷ তৃষ্ণা পাইয়াছিল—জল পান করিবার জন্য উঠিলাম, গেলাসের ঢাকনা তুলিয়া দেখিলাম গেলাস শূন্য৷ কাল বকুলগাছটাকে কালো মাথা কল্পনা করিবার ফলে মনে হইয়াছিল যে, অশরীরী জল পান করিয়া গিয়াছে৷ আজ ভয়ের সেই পরিপ্রেক্ষিত ছিল না, মনে হইল চাকরটাই ফাঁকি দিয়াছে৷ শাসন করিয়া দিবার অজুহাতে (আসল কথা নিজের ভয়টাকে অন্তঃসারশূন্য প্রমাণ করিবার আশায়) অত রাত্রেই ডাকাডাকি করিয়া চাকরটাকে জাগাইলাম৷ সে আসিয়া শপথ করিয়া বলিল যে, গেলাসে জল দিয়া একটা পিরিচ দিয়া ঢাকিয়া রাখিয়া গিয়াছে৷ আমি যখন জল খাইতে যাই, তখন সেই গেলাস পিরিচে ঢাকাই ছিল বটে৷ আমার ভুল হইয়াছে স্বীকার করিয়া তাহাকে বিদায় দিলাম৷ বিছানায় আসিয়া শুইলাম, কিন্তু চিন্তা নূতন সূত্র অবলম্বন করিয়া চলিতে আরম্ভ করিল৷ জল খাইল কে! আমিই ঘুমের ঘোরে উঠিয়া জল পান করিয়াছি,—এমন অসম্ভব না হইলেও বর্তমান ক্ষেত্রে সম্ভব মনে হইল না৷ ঘুমাইয়া পড়িবার আগে সঙ্কল্প করিলাম,—কাল হইতে ঘুমাইবার আগে প্রচুর জল পান করিয়া লইব, যাহাতে মাঝরাতে জাগিয়া উঠিয়া এরূপ অদ্ভুত সমস্যায় না পড়িতে হয়৷

দিনের বেলা আর-পাঁচটা চিন্তায় এসব বিষয় মনে পড়িত না৷ কিম্বা মনে পড়িলেও হাস্যকরভাবে তুচ্ছ বোধ হইত৷ সেদিন শুইবার আগে প্রচুর জল খাইয়া লইলাম৷ রাতে আর জাগিতে হইল না৷ ভোরবেলা চাকরে চা আনিল৷ আগের দিন তাড়া খাইয়াছিল—আজ ঘরে ঢুকিয়াই গেলাসটার দিকে তাকাইল, আমিও তাকাইলাম—গেলাস খালি৷ যে পিরিচখানা দিয়া সে জল ঢাকিত, সেখানা পাশে পড়িয়া আছে, গেলাস একখানা বই দিয়া ঢাকা৷ বইখানা দূর হইতে দেখিয়াই বুঝিলাম— Poe-র Mystery and Imagination -এর গল্প৷ চমকিয়া উঠিলাম—এই বই তো নীচের লাইব্রেরি ঘরে ছিল— এখানে আনিল কে? আর গেলাসই বা খালি করিল কে? চাকরকে আর কি বলিব, নিজের চিন্তাসূত্রে কেবল নিজেই জড়িত হইতে লাগিলাম৷

ক্রমে আমার প্রত্যয় জন্মিল যে, রাতের বেলায় কেহ আমার ঘরে ঢোকে৷ প্রকৃতিস্থ থাকিলে সহজেই বুঝিতে পারিতাম—এমন হওয়া সম্ভব নয়, কারণ আমি স্বহস্তে ঘরের দরজা বন্ধ করি এবং ভোরবেলা উঠিয়া স্বহস্তে বন্ধ দরজা খুলি৷ কিন্তু এসব বিষয় বুঝিবার মতো আমার মনের অবস্থা ছিল না৷ আমার একটি পিস্তল ছিল, বাক্সের মধ্যে থাকিত, এতদিন পরে সেটা বাহির করিয়া বালিশের তলায় রাখিলাম৷

একবার মনে হইত নির্জন বাড়ির নিঃসঙ্গতা পরিহার করিয়া লোকজনের সঙ্গে মিশিলে হয়তো অশীরীরীর হাত হইতে রক্ষা পাওয়া যায়৷ কিন্তু শরীর এত দুর্বল যে, অন্যত্র যাইবার শক্তি ছিল না৷ তাছাড়া আমি মিশুক প্রকৃতির লোক ছিলাম না বলিয়া আমার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা স্বল্প৷ যে কয়েকজন আছে, সবাই কাজের লোক, কে আসিয়া সারাদিন আমার সঙ্গে গল্প করিবে? কাজেই সারাদিন একাকী থাকা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না৷ ক্রমে অশরীরীর প্রভাব দিনের বেলাতেও অনুভব করিতে আরম্ভ করিলাম৷ মনে হইত পাশের ঘরে কে যেন ফিসফিস করিয়া কথা বলিতেছে কিম্বা খুব মৃদু পদসঞ্চারে চলাফেরা করিতেছে৷ নিশ্চয় জানিতাম কেহ নাই, তবু একবার দেখিয়া আসিতাম৷ রেলের এঞ্জিন বাষ্প ছাড়িলে যেমন একপ্রকার ঝঞ্ঝনা শব্দ হয়, কানের ভিতর সেই রকম শব্দ শুনিতে পাইতাম৷ আরো একটা ব্যাপার৷ মনে হইল সহসা আমার শ্রবণশক্তি যেন অনেক বাড়িয়া গিয়াছে৷ স্বরগ্রামের মাঝখানের অংশটুকুই সাধারণ কর্ণ ধরিতে পারে, খুব নীচু বা খুব উঁচুর দিকে শুনিতে পায় না৷ আমার শ্রবণশক্তির সীমানা যেন অনন্তবিস্তৃত হইয়াছে৷ আমি যেন কলিকাতার বাড়িটিতে বসিয়াই পাড়ার দূরবর্তী বাড়িগুলিতে কে কি বলিতেছে তাহারও অনেক কথা শুনিতাম৷ একদিন শিমুলতলার পত্র পাইলাম৷ তাহারা লিখিয়াছে যে, সকলে একদিন ডাকবাংলায় আশ্রয় লইয়া খিচুড়ি রাঁধিয়া খাইয়া আসিয়াছে৷ উত্তরে লিখিলাম যে, এ আমার অগোচর নয়৷ আরো লিখিলাম যে, ডাকবাংলার হাতার মধ্যে একটা গাছের ওপরে ঘুঘু ডাকিতেছিল, তোমরা শুনিয়াছিলে কি? সকলে আমার উত্তরকে কবিত্ব মনে করিয়া লিখিল, ঘুঘুর ডাক যদি স্বকর্ণে শুনিতে চাও, তবে এখানে চলিয়া এসো না কেন!

ঘুঘুর ডাক শুনিবার জন্য নয়, সে তো কলিকাতায় বসিয়াই আমি শুনিতে পারি, আত্মীয়স্বজনের মধ্যে গিয়া পড়িলে অশরীরীর হাত হইতে রক্ষা পাওয়া যাইবে, এই আশায় চাকরের উপর বাড়ি জিম্মা রাখিয়া আমি শিমুলতলায় রওনা হইয়া গেলাম৷ সকলে আমার শরীরের অবস্থা দেখিয়া বলিয়া উঠিল,—এ কী, দুই মাসে যে ছয় মাসের রোগী বনিয়া গিয়াছ,—ব্যাপার কী?

কেহ বলিল,—শরীর অর্ধেক হইয়াছে৷

কেহ বলিল,—মুখ ফ্যাকাসে হইয়াছে৷

কেহ বলিল,—কতকাল চুল কাটো নাই?

কেহ বা বলিল,—কেবল চোখ দুইটি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল৷

সকলে সমস্বরে বলিল,—এখানে কিছুদিন থাকো, সব সারিয়া যাইবে৷

শিমুলতলায় একটা পাহাড়ের চূড়ায় আমাদের বাড়ি৷ বাড়ির বারান্দায় বসিলে মনে হয়, থিয়েটারের গ্যালারির উচ্চতম সিটে উপবিষ্ট৷—সম্মুখে পাহাড় গড়াইয়া নামিয়াছে, গায়ে গায়ে ছোটবড় বাড়ি, বাগান, বাগানে শীতের মরসুমী ফুল৷ নিম্নে উপত্যকা, ধানের মাঠ, তখন ধান কাটা হইয়া গিয়াছে৷ এক দিকে শীর্ণ নদী৷ এখানে ওখানে দেহাতি লোকের ছোট ছোট গ্রাম৷ উপত্যকার শেষে বন, বনের মাথার উপর দিয়া দিগন্ত ঘেরিয়া অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাহাড়—মাথায় শাল ও বাঁশের ঘন বন৷ সারাদিন বারান্দায় বসিয়া থিয়েটারের দর্শকের মতো এই দৃশ্য দেখিতাম৷ এই নিস্তব্ধতার মধ্যে মূর্তিমান চঞ্চলতার মতো রেলগাড়ি মাঝে মাঝে বেগে চলিয়া যাইত—গাছের ফাঁক দিয়া দেখিতে পাইতাম৷ এখানে আসিয়া আর একটি আবিষ্কার করিলাম৷ একদিন সকালে আমরা তিনজনে দূরপাল্লার ভ্রমণে বাহির হইয়াছি৷ অনেক দূর গিয়া চায়ের তৃষ্ণা পাইল৷ একটা থলিতে স্টোভ চা চিনি কেটলি প্রভৃতি ছিল৷ কেবল দুধের অভাব৷ মাঠের মধ্যে দুধ পাইবার আশা নাই দেখিয়া নিবৃত্ত হইতে যাইতেছি, আমি বলিয়া উঠিলাম,—ওই দেখো, দূরে মাঠের মধ্যে গোটাকয়েক গরু ও রাখাল দেখা যাইতেছে—ওখানে গেলে দুধ মিলিতে পারে৷

সকলে ভালো করিয়া দেখিল,—কিন্তু কিছুই দেখিতে পাইল না৷

আমি বলিলাম,—তোমরা কেন দেখিতে পাইতেছ না? ওই তো স্পষ্ট!

তাহারা বলিল,—চায়ের তৃষ্ণায় মরিতেছি, এখন ঠাট্টা ভালো লাগে না৷

আর একজন বলিল,—লোকে মাঠের মধ্যে মৃগতৃষ্ণিকা দেখে, তুমি যে গো-তৃষ্ণিকা দেখিতে লাগিলে!

তৃতীয়জন বলিল, তুমি কি চোখে দূরবীন লাগাইয়াছ নাকি?

আমি বলিলাম,—অবিশ্বাসে কাজ কি! আমাদের তো যাইতেই হইবে—চলো ওই দিকেই যাই না!

সকলে নির্দিষ্ট দিকে চলিলাম৷ প্রায় এক ক্রোশ পথ চলিবার পরে সত্যই সকলে সেই গরুর পাল দেখিতে পাইল৷

আমার সঙ্গীদের একজন বলিল,—আশ্চর্য, তুমি একক্রোশ দূর হইতে দেখিলে কিরূপে? তাই তোমার চোখ এমন অস্বাভাবিক উজ্জ্বল!

আর একজন বলিল,—আন্দাজে ঢিল লাগিয়াছে৷ মাঠে গরু চরিবে এ আর বিচিত্র কি!

আর একজন বলিল,—এমন অস্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি কিন্তু ভালো লক্ষণ নয়৷

সেই প্রথম আমি আবিষ্কার করিলাম যে, শ্রবণশক্তির মতো আমার দৃষ্টির সীমাও অনেক বাড়িয়া গিয়াছে৷

এখানে আসিয়া অশরীরীর প্রভাব সম্বন্ধে কাহাকেও কিছু বলি নাই৷

বলিব আর কি, বলিবার আছেই বা কি, আর বলিলেই বা লোকে বিশ্বাস করিবে কেন? ভাবিতাম, অশরীরী এমন করিয়া আমার কান ও চোখের সীমানা বাড়াইয়া দিতেছে কেন? অশরীরীর প্রভাবের সহিত যে এই শক্তিবৃদ্ধি জড়িত সে বিষয়ে আমার সন্দেহমাত্র ছিল না৷

এখানে কাহারও কোনো কাজকর্ম ছিল না৷ বাড়ির টানা বারান্দায় বসিয়া সকলে তাসপাশা খেলিত ও হল্লা করিত৷ আমি তাহাদের সঙ্গ এড়াইয়া পাহাড়ের উপরে একটি ছাল ওঠা অর্জুন গাছের তলায় গিয়া বসিতাম৷ এখানে বসিলে দিগন্তের পাহাড়ের অর্ধচন্দ্র ও অরণ্যরেখা দেখিতে পাইতাম৷ উপত্যকার সমস্ত দৃশ্য অত্যন্ত স্পষ্ট দেখিতাম৷ বনের সমস্ত গাছপালাগুলো স্পষ্ট দেখিতে পাই কিনা পরীক্ষা করিবার ইচ্ছা হইল৷ বনটার দিকে ভালো করিয়া তাকাইলাম৷ কি আশ্চর্য, আমার চোখে বন আর গাছপালার ঘনীভূত সমষ্টি নয়! প্রত্যেকটি গাছ, তাহার শাখাপ্রশাখা পত্রপল্লব লইয়া স্বতন্ত্রভাবে যেন দেখিতে পাইতেছি৷ নিজের শক্তিতে নিজেই ভীত হইলাম৷ যেন চোখ দুটি ও কান দুটি কোনো এক যাদুকরের—আমি হতবুদ্ধি দর্শক মাত্র৷

রাতের বেলার উপসর্গ আরো বিচিত্র৷ বুঝিলাম অশরীরী ক্রমেই আমার বুদ্ধিকে মোহগ্রস্ত করিয়া ফেলিবে, অবশেষে শেষ গ্রাসে দেহটাকে হয়তো আত্মসাৎ করিয়া বায়ুরূপে বায়ুতে মিলিয়া যাইবে৷ রাতের বেলাতেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাসপাশা ও গানবাজনা চলিত বলিয়া স্বতন্ত্র একটি ঘরে আমার শুইবার ব্যবস্থা হইয়াছিল৷ সে ঘরে আর কেহ থাকিত না৷

এই ঘরটির একটি দেয়ালে বিহারের পূর্বতন এক ইংরেজ গভর্নরের একখানি ছবি টাঙানো ছিল৷ এক সময়ে শখ করিয়া টাঙানো হইয়াছিল, এখন খুলিয়া ফেলিলেও চলিত, কিন্তু নিতান্ত অবহেলাতেই খোলা হয় নাই৷ আমার ইচ্ছা হইল, ছবিখানি খুলিয়া ফেলি, কিন্তু ততখানি উদ্যম হইল না৷ একবার ভাবিলাম, খুলিয়া না ফেলিয়া ঘুরাইয়া দিই৷ গভর্নর বিমুখ হইয়া বিরাজ করিতে থাকুক, তাহাও হইয়া উঠিল না৷ রাত্রে ঘুমাইলাম কোনো বিঘ্ন হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না৷ ভোরবেলা উঠিয়া ছবিখানার দিকে চাহিতেই দেখিলাম, সেখানা ঘুরানো অবস্থায় আছে৷ চমকিয়া উঠিলাম, এ কাজ করিল কে? আমার মনের বাসনা জানিল কে? ঘরেই বা ঢুকিল কে? ঘরের দরজা তো এখনো বন্ধ! আমিই স্বপ্নে উঠিয়া এ কাজ করিয়াছি? বিশ্বাস হইল না৷ প্রত্যয় হইল যে, এ সেই অশরীরীর কাজ৷ ছবিখানা সোজা করিয়া দিলাম, কিন্তু ব্যাপারটা কাহাকেও আর বলিলাম না৷ বলিলেও কেহ বিশ্বাস করিত না, ভাবিত—আমি একপ্রকার নূতন ধাপ্পা দিতেছি৷ আমি সারাদিন আর সকলের হইতে দূরে সেই অর্জুন গাছটার তলায় বসিয়া কাটাইতাম৷ মন্দ লাগিত না,—মানুষের সঙ্গ আমার বিষাক্ত লাগিত৷

এই সময়ে আর একটি নূতন ভাব আমাকে পাইয়া বসিল৷ আমার মরিতে ইচ্ছা করিত, জীবনের আসক্তি আমাকে একেবারে ত্যাগ করিল৷ আমার কেবলই মনে হইত, এই যে আমার চক্ষুকর্ণের শক্তির বৃদ্ধি, মৃত্যুর পরে মানুষ যে অসীম শক্তি পাইতে পারে, এ কেবল তাহারই পূর্বাভাস৷ ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গেই পিস্তলটার কথা মনে পড়িয়া যাইত, সেটাকে হাতছাড়া করি নাই, সঙ্গে আনিয়াছি৷ আরো একটা কারণে মরিতে ইচ্ছা করিত৷ মনে হইত—একমাত্র এই উপায়েই অশরীরীর আক্রমণ হইতে রক্ষা পাইতে পারি, মনে হইত—নিজেও অশরীরী হইয়া একবার শত্রুটার সঙ্গে মোকাবিলা করিয়া না লই কেন!

রাত্রিবেলা ঘরের মধ্যে কাহার পদশব্দে ঘুম ভাঙিয়া যাইত৷ বিদ্যুতের টর্চবাতি টিপিতাম, কেহ কোথাও নাই৷ হঠাৎ চোখে পড়িত, দেয়ালের ছবিখানাকে কে যেন ঘুরাইয়া রাখিয়াছে৷

এমনি রাতের পর রাত, দিনের পর দিন চলিতে লাগিল৷ একদিন অত্যন্ত তুচ্ছ কারণে বাড়ির সকলের সহিত আমার ঝগড়া হইয়া গেল৷ এখন বুঝিতে পারিতেছি যে, দোষটা সম্পূর্ণই আমার৷ আমি সেদিন সন্ধ্যার ট্রেনে চুনার রওনা হইলাম৷ গাড়িতে উঠিবার সময়ে স্পষ্ট বুঝিলাম অশরীরী আমার সঙ্গ ছাড়ে নাই, সেই গাড়িতেই সে উঠিল৷

কামরাটিতে আর একজন মাত্র ছিল৷ একটি বার্থে তাহার শয্যা দেখিতে পাইলাম, কিন্তু লোকটি কোথায়? স্নানের ঘরে আলো দেখিয়া বুঝিলাম আমার সহযাত্রী সেখানে৷ আমি একাকী আমার বার্থে বসিয়া রহিলাম এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুম আসাতে শুইয়া পড়িলাম৷ যখন নিদ্রা ভাঙিল মোকামা জংশন ছাড়াইয়াছি৷ পাশের বেঞ্চিতে সহযাত্রীর শয্যা দেখিতে পাইলাম, কিন্তু লোকটি কোথায়! ভাবিলাম এখনো কি স্নানের ঘরেই আছে? তাহাই সম্ভব—আলো জ্বলিতেছে৷ ভাবিলাম লোকটা দীর্ঘকাল সেখানে কি করিতেছে? দরজায় কান পাতিয়া শুনিলাম যে, ভিতরে কে যেন গুনগুন করিয়া গান করিতেছে,—আর দরজায় ঘষা কাচের উপরে একটা অস্পষ্ট ছায়ার মতোও দেখিতে পাইলাম৷ বুঝিলাম মানুষ ভিতরে আছে এবং সে আমার সহযাত্রী ছাড়া আর কেহ নয়৷ কিন্তু লোকটা এতক্ষণ ধরিয়া কি করিতেছে? কৌতূহল বাড়িল৷ দরজায় টোকা মারিলাম, ভিতরে কে—বলিয়া চিৎকার করিলাম, কিন্তু ভিতর হইতে কোনো সাড়াশব্দ পাইলাম না৷ অবশেষে বিরক্ত হইয়া দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করিলাম৷ দরজার ভিতরদিকের ছিটকিনি খট করিয়া খুলিয়া গেল, কিন্তু দরজা খুলিল না৷ মনে হইল কে যেন ভিতর হইতে প্রাণপণবলে দরজা ঠেলিয়া আছে৷ দরজা খুলিয়া কোনো লোককে বিব্রত করিবার আমার ইচ্ছা ছিল না৷ একবার সাড়া দিলেই আমি নিরস্ত হইতাম৷ কিন্তু সাড়া না পাওয়াতে এবং দরজার প্রতিরোধ বৃদ্ধি পাওয়াতে আমার রোখ চড়িয়া গেল৷ আমি দরজা ঠেলিতে লাগিলাম, অবশেষে সেই উদ্যমে কপালে ঘাম দেখা দিল৷

এমন সময়ে ছোট একটা স্টেশনে গাড়ি থামিল৷ একজন যাত্রী উঠিল৷ সে আমাকে তদবস্থায় দেখিয়া বলিল, কি, খুলতে পারছেন না?

এই বলিয়া সে দরজায় হাত দিতেই অনায়াসে খুলিয়া গেল৷ ভিতরে না আছে লোক, না আছে আলো৷ আমি বিদ্যুতের টর্চ লইয়া ভিতরে ঢুকিলাম, কোনো লোক যে আজ সারাদিনের মধ্যে ঢুকিয়াছিল তাহার চিহ্ন অবধি নাই৷ তখনি মনে হইল, একি সেই অশরীরীর কাণ্ড? ওই শয্যার মালিক কি সেই অশরীরী? আমি ফিরিয়া আসিয়া ভদ্রলোকটির সঙ্গে গল্প করিয়া রাত কাটাইয়া দিলাম, কিন্তু বুকের ভিতরের কাঁপুনি কিছুতেই থামিল না৷ চুনারে নামিবার সময় অবধি বিছানার মালিকের দেখা পাইলাম না৷

চুনারে পৌঁছিতে বেলা দশটা বাজিয়া গেল৷ স্টেশনে নামিয়া একজন ওই-দেশীয় লোকের সহিত আলাপ করিয়া লইলাম৷ তাহার কাছে সন্ধান লইয়া একখানা এক্কা গাড়িতে চড়িয়া গঙ্গার ধারে একটি প্রকাণ্ড পুরাতন অট্টালিকায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম৷ সেখানে একজন কেয়ারটেকার দারোয়ান ছিল৷ তাহাকে শুধাইলাম, এ বাড়িতে থাকিতে পারা যাইবে কিনা এবং কিরূপ ভাড়া লাগিবে৷

দারোয়ানজী বলিল—আপনার যতদিন খুশি থাকুন, খুশি হইয়া যাহা দিবেন তাহাই যথেষ্ট৷

আহারের ব্যবস্থার কি করা যাইবে জিজ্ঞাসা করিলে সে বলিল, —‘বর্তন-উর্তন’ তাহার কাছেই পাওয়া যাইবে, আর রসুই করিবার জন্য একটা লোকও সে ঠিক করিয়া দিতে পারে৷’ ‘লেকিন মছলি উছলি’ চলিবে না৷ আমি ধন্যবাদ দিয়া তাহার সাহায্য গ্রহণ করিলাম এবং জানাইয়া দিলাম যে মছলি খাইবার ইচ্ছা আমার নাই৷ তখন দারোয়ানজী সোৎসাহে তাহার প্রতিশ্রুতি পালনে লাগিয়া গেল৷

বাড়িটি প্রকাণ্ড ও পুরাতন, আগেই বলিয়াছি৷ আধুনিক কৃপণ কল্পনার যুগে এত বড় অনাবশ্যকের আকাশ-ভরা বাড়ি কেহ তৈয়ারি করে না৷ বাড়ির ঠিক সমুখেই গঙ্গা৷ এখন বসন্তকালে বাড়ির কাছে অনেকটা চর পড়িয়াছে, কিন্তু তাই বলিয়া নদীর বিস্তৃতি অল্প নয়৷ গঙ্গার উপরেই প্রশস্ত টানা বারান্দা৷ আমার ব্যবহারের জন্য দুটি ঘর পাইলাম, একটি বসিবার অপরটি শুইবার৷ ঘরে পুরু গদিওয়ালা খানকতক চেয়ার ও টেবিল৷ আর শয়নঘরে একখানা মস্ত পালঙ্ক, পাশে একটা চেয়ার, টেবিল, আলনা৷ আর আছে ঘরের দেয়ালে মানুষপ্রমাণ পিতলের ফ্রেমে বাঁধানো একখানা আয়না৷

আহার শেষ করিতে বেলা তিনটা বাজিয়া গেল৷ সন্ধ্যা পর্যন্ত বারান্দায় বসিয়া কাটাইয়া দিলাম৷ রাত্রে অল্প কিছু আহার করিয়া শুইয়া পড়িলাম৷ অনেকদিন পরে এই আমার বিঘ্নহীন সুনিদ্রা হইল৷ ভোরবেলা উঠিয়া মনে আনন্দ অনুভব করিলাম, ভাবিলাম—তবে বোধ হয় অশরীরীর হাত হইতে বাঁচিয়া গেলাম! আজ তিনচার মাসের মধ্যে নির্বিঘ্ন নিদ্রার আরাম আমি পাই নাই, শরীর ভাঙিয়া পড়িবার মতো, মৃত্যু-ইচ্ছার সেটাও একটা কারণ৷ যেটুকু ঘুম হইত, তাহা যেন ওই অশরীরীর নেপথ্য বিধানের সুবিধার জন্যই হইত৷ নিদ্রার অবসরে হয় গেলাসের জল ফুরাইত, নয় ছবিখানি ঘুরিয়া যাইত৷ ঘুম এবং ঘুম না হওয়া দুই-ই আমার পক্ষে সমান আতঙ্কের কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল৷ গতরাত্রের নিশ্চিন্ত ঘুমে তাই প্রফুল্ল বোধ করিলাম৷

ভিখু নামে এক ছোকরা ভৃত্যকে দারোয়ানজী ঠিক করিয়া দিয়াছিল৷ সে কাজকর্ম সব জানে৷ চা জলখাবার ডালভাত তরকারি রুটি পুরি যাহা প্রয়োজন সমস্ত সময়মতো করিয়া আনিত৷ ঘর ঝাড়ু দিত, বিছানা পাতিয়া দিত৷ কোনো বিষয়ে আমার ভাবিবার আবশ্যক ছিল না৷ আমি সারাদিন বসিয়া গড়াইয়া বেড়াইয়া কাটাইয়া দিতাম৷

চুনার প্রবাসের দ্বিতীয় দিন বিকালে আমি গঙ্গার তীর বরাবর বেড়াইতে বাহির হইলাম৷ অনেক দূর গিয়া প্রাচীন বয়সের ঝাউগাছে ঘেরা একটি সমাধিস্থান দেখিতে পাইলাম৷ অনেকগুলি মুসলমানের কবর৷ কবরগুলি এখনো সুরক্ষিত৷ পাশেই ছোট একখানা খাপরার ঘরে একজন মুসলমান বাস করে৷ তাহার সঙ্গে আলাপ করিয়া জানিলাম যে, এই কবরগুলি রক্ষা ও মেরামত করিবার জন্য একটি জায়গীর আছে—সে তার মালিক বা জিম্মাদার৷ তাহার মুখেই শুনিলাম যে, বহুকাল আগে এখানে হুমায়ুন বাদশার সঙ্গে শেরশাহের জব্বর লড়াই হইয়াছিল৷ অনেক মোগল-পাঠান মরিয়াছিল৷ হুমায়ুন বাদশাহী লাভ করিবার পরে এখানকার কবরগুলির খবরদারির জন্য জায়গীর দান করেন৷ সেই জায়গীরের ধারা আজিও অক্ষুণ্ণ আছে৷

ইতিহাসে শেরশাহ ও হুমায়ুনের লড়াইয়ের কথা পড়িয়াছি বটে৷ আর ওই যে অদূরে গিরিচূড়ায় চুনার-গড় তাহাও সুবিদিত৷ গিরিচূড়াবলম্বী সেই গড়ের ছায়াতে চিরনিদ্রিত এই কবরগুলির উপরে প্রাচীনকাল যেন সযত্নে অঞ্চল বিছাইয়া দিয়াছে৷ স্থানটি যেমন নির্জন, তেমনি মনোরম৷ সমুখে গঙ্গা, পিছনে স্তম্ভিত চুনার-গড়—আর চারদিকে শ্মশানের ধূমের মতো ধূসর ঝাউ গাছ, ইতিহাসের দীর্ঘনিশ্বাস যেন তাহাদের শাখায় শাখায় নিরন্তর শাসিত হইতেছে৷ স্থানটি আমার মনকে বড়ই টানিল, আমি সেখানে বসিলাম৷ কতক্ষণ এরকম বসিয়াছিলাম জানি না—যখন হুঁশ হইল, দেখিলাম গঙ্গার ওপারে তৃতীয়ার অস্তমান চন্দ্রকলা গাছের আড়াল দিয়া হুমায়ুনের গুপ্তচরের মতো এপারের পরিপ্রেক্ষিতকে লক্ষ করিতেছে৷ আমি উঠিয়া বাসার দিকে রওনা হইলাম৷ সমুদ্রের জোয়ারের গর্জনের মতো ওই ঝাউয়ের একটানা হু-হু শব্দ কান ভরিয়া লইয়া রওনা হইলাম৷

পরদিন বিকালে বেড়াইতে বাহির হইবার সময়ে আমার নূতন জুতাজোড়া পাইলাম না, সন্দেহ হইল—এ ভিখুর কাজ৷ তাহাকে ডাকিলাম, শুনিলাম সে বাজারে গিয়াছে৷ অগত্যা আর একজোড়া জুতা পরিয়া বাহির হইলাম৷ সেই ঝাউ-ঘেরা গোরস্থানে গিয়া পৌঁছিলাম৷ কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরিয়া এক জায়গায় বসিলাম৷ এমন সময়ে গোরস্থানের রক্ষক সেই বৃদ্ধ মুসলমান আসিয়া সেলাম করিয়া দাঁড়াইল৷ শুধাইলাম, খবর কি? সে বলিল,—বাবুজী, কাল অনেক রাত্রে দুই বাবু এখানে বেড়াইতে আসিয়াছিলেন, তাঁহাদেরই কেহ বোধ হয় একজোড়া জুতা ফেলিয়া গিয়াছেন!

তারপরে নিবেদন করিল, আমি যেন খোঁজ করিয়া জুতাজোড়া মালিককে দিই৷ আমি তাহাকে জুতা আনিতে বলিলাম৷ লোকটা জুতা আনিলে আমি চমকিয়া উঠিলাম—একি, এ যে আমার জুতা!

আমার বিস্ময় তাহার কাছে প্রকাশ না করিয়া বলিলাম,—কি রকম লোক, আর একবার বলো তো!

সে বলিল,—বাবুজী, আমি অন্ধকার রাত্রে দূর হইতে দেখিয়াছি—কি রকম লোক কেমন করিয়া বলিব? তবে দুইজন লোক তাহাতে আর সন্দেহ নাই!

তাহার কথায় আমার বিস্ময় বাড়িয়া ত্রাসে পরিণত হইল৷ আমি খোঁজ করিয়া মালিককে দিব জানাইয়া জুতাজোড়া একটা কাগজে মুড়িয়া লইয়া আসিলাম৷

বাসায় আসিয়া ভাবিলাম, এ কেমন হইল? আমিই কি রাত্রে সেখানে গিয়াছিলাম? স্বপ্নে বা নিশিতে পাইলে লোকে এমন বেড়াইয়া থাকে শুনিয়াছি৷—তবে কি আমারও সেই রোগ হইল? কিন্তু সঙ্গের দ্বিতীয় ব্যক্তিটি কে? সেই অশরীরী নয় তো? তবে কি সেই অজ্ঞেয় সত্তা অশরীরী নয়? নতুবা কবররক্ষক তাহাকে দেখিল কিভাবে? অজ্ঞাতসারে ঘুমের ঘোরে আমি কি তাহার ভ্রমণসঙ্গী হইয়া উঠিয়াছি নাকি? এই কথা মনে হইবামাত্র সেই নিঃসঙ্গ নিস্তব্ধ ঘরের মধ্যে গা ছ্যাঁৎ করিয়া উঠিল—দেহের প্রত্যেকটি লোম খাড়া হইয়া উঠিল৷ সঙ্কল্প হইল, আজ হইতে রাত্রে আর ঘুমাইলে চলিবে না৷ স্থির করিলাম দিনের বেলা ঘুমাইয়া লইয়া রাতটা জাগিয়া কাটাইব৷

রাত্রিটা জাগিবার সঙ্কল্প করিলাম, হঠাৎ বোধ হয় একবার ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম,—দরজায় করাঘাতের শব্দে ঘুম ভাঙিয়া গেল৷ কে?—বলিয়া চিৎকার করিলাম৷ আর কোনো সাড়া নাই৷ আবার জাগিবার চেষ্টা চলিল—বোধ করি একটু তন্দ্রা আসিয়াছিল— আবার দরজা নাড়ার শব্দ!

বুঝিলাম এ সেই অশরীরীর ক্রিয়া৷ বুঝিলাম অশরীরী আজও তাহার ভ্রমণসঙ্গীর সন্ধানে আসিয়াছে৷ কাজেই এবারে আর সাড়া দিলাম না৷ চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম৷ এমনিভাবে ঘুমের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া রাতটা কাটিয়া গেল৷

তারপরে প্রতি রাত্রে এমনিধারা চলিতে লাগিল৷ জাগরণে ও তন্দ্রায় আমার চোখে মল্লযুদ্ধ চলিতে থাকে—যেমনি একটু তন্দ্রা আসে, অমনি দরজা নাড়ার শব্দ, নতুবা বাহিরে পদধ্বনি শুনিতে পাই৷ একদিন হঠাৎ পিঠের উপরে কাহার তপ্ত নিশ্বাস অনুভব করিয়া ধড়মড় করিয়া জাগিয়া উঠিলাম৷ ঘর নির্জন, কেহ কোথাও নাই৷

কয়েকদিন এমনি চলিলে আমার শরীর আরো ভাঙিয়া পড়িল৷ ভাবিলাম এরকম চলিতে থাকিলে এই বিদেশেই মরিতে হইবে৷ আমার কেমন যেন ধারণা হইয়া গিয়াছিল, এ যাত্রা আমাকে মরিতেই হইবে৷—ভাবিলাম মরিতেই হয় তো কলিকাতা ফিরিয়া মরিব—বিদেশে বিভুঁয়ে মরিব কেন? এতক্ষণ বারান্দায় বসিয়াছিলাম, এবারে কি একটা কাজে ঘরে ঢুকিতেই মনে হইল—আয়নার মধ্যে যেন কাহার ছায়া! আবার তাকাইলাম— শূন্য আয়না ঝকঝক করিতেছে, ঘরের মধ্যে কেহ কোথাও নাই৷

একবার মনে হইল আমার ছায়া—পরক্ষণেই বুঝিলাম আমার ছায়া হইতেই পারে না, কারণ আমি যেখানে দাঁড়াইয়া সেখানকার ছায়া আয়নায় পৌঁছায় না৷ তবে কী দেখিলাম? বিশ্বাস জন্মিল যে আমি কোনো দুর্জ্ঞেয় সত্তার ষড়যন্ত্রের শিকার৷

সেদিন সন্ধ্যাবেলা বেড়াইয়া সবে ঘরে ঢুকিয়াছি, দেখিলাম, স্পষ্ট দেখিলাম, মনে হওয়া বা অনুমান করা নয় যে আয়নার উপরে ছায়া—শুধু এক বিদ্যুৎঝলকের জন্য, শুধু জলে দাগ কাটার মতো, কিন্তু সত্যই যে দেখিলাম তাহাতে সন্দেহ নাই৷ তখনি মনে পড়িল—ঘর তো অন্ধকার, এখনো আলো জ্বালানো হয় নাই, তবে ছায়া পড়িবে কি উপায়ে? বিদ্যুতের টর্চ টিপিলাম৷ শূন্য ঘর৷ ঘরের সেই সুবৃহৎ শূন্যতাকে একটা বিরাট হাঁ-র মতো মনে হইল৷

অবশেষে কিভাবে আমার ত্রাস যে রোখে পরিণত হইল সে প্রশ্নের উত্তর দিবার সাধ্য আমার নাই৷ তবে আমার ধারণা এই যে, কোনো একটা মনোভাব চরমে পৌঁছিলে তাহা অপর একটা মনোভাবে পরিণত হয়৷ মানুষের মনের সব ভাবগুলার মধ্যে গোপন চলাচলের একটা পথ আছে বলিয়াই এমন বোধ করি সম্ভব হয়৷

আমার মাথায় রোখ চাপিয়া গেল যে মরিতেই যখন হইবে, মরিতেই যখন বসিয়াছি,—অশরীরীর মুখের গ্রাস কাড়িয়া লইয়া মরিব৷ আর কিছু না পারি তাহাকে শিকারের আনন্দ হইতে বঞ্চিত করিয়া মরিব৷ মৃত্যু যখন আমার আসন্ন, মনে হইল—এইভাবে মরিলেই আমার মরা সার্থক হইবে৷ আমি স্থির করিলাম যে, আর দুই-এক রাত্রি অশরীরীর রহস্য উদঘাটনের শেষ চেষ্টা করিব৷ পারি তো উত্তম, না পারি তো নিজের প্রাণ নিজের হাতে লইব, অশরীরীর শিকারে পরিণত হইব না৷ এখন হইতে গুলিভরা পিস্তলটা সর্বদা পকেটে রাখিতে লাগিলাম৷

সেদিন রাত্রি আমার জীবনের শেষ রাত্রি হইবে যখন ভাবিয়াছিলাম, তখন সে জানিত যে সেই রাত্রিই আমার মোহমুক্তির রাত্রি হইবে৷

অনেক রাত্রি পর্যন্ত বারান্দায় বসিয়াছিলাম—বলা বাহুল্য—একাকী৷ রাত্রি ঘন অন্ধকার৷ দূরাগত ঝাউগাছের হু-হু শব্দ পরলোকের তীরভূমি হইতে বাহিত দীর্ঘনিশ্বাসের মতো শ্রুত হইতেছিল৷ সমুখে গঙ্গা—সেখানে অন্ধকার কিছু ফিকা, নতুবা বুঝিবার আর কোনো উপায় নাই৷ বসিয়া বসিয়া একটু তন্দ্রা আসিয়াছিল, এমন সময় মনে হইল, ঘরের মধ্যে কে যেন শিস দিতেছে৷ দ্রুতপদে ঘরে ঢুকিয়া পড়িলাম—আজ আমার মনে আর ভয় ছিল না৷ অশরীরীকে গুলিবিদ্ধ করিয়া হত্যা করা সম্ভব হইলে অবশ্যই করিতাম, কিন্তু মনের ওই অবস্থাতেও বুঝিয়াছিলাম যে তাহা সম্ভব নয়, তাই নিজেই মরিব৷ অশরীরীর উপস্থিতিতে নিজের হাতেই মরিব, তাহার শিকার ফসকাইয়া যাইবে, সে হতাশ হইবে৷ সে কি আনন্দ! ঐ এক আনন্দই তখন জীবনে অবশিষ্ট ছিল৷ উৎকট উল্লাসে হাসিয়া উঠিলাম৷ অনেকদিন হাসি নাই, এত উচ্চস্বরে কখনো হাসি নাই৷ নিজের হাসিতে নিজে চমকিয়া উঠিলাম৷ হঠাৎ সেই ছায়া, ঈষদালোকিত কক্ষের আয়নার উপরে সেই ছায়া—শুধু এক পলকের জন্য৷ পিস্তল বাহির করিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম৷ দরজাটা খোলা ছিল, বন্ধ করিয়া আসিলাম৷ তখন আমার মুখ দরজার দিকে৷ আমার ঠিক পিছনে দেয়ালের গায়ে আয়না৷ পিছনে সেই শিস দিবার শব্দ৷ পিছন ফিরিবামাত্র ছায়াশরীরী অশরীরী—মনে হইল সে যেন আর আয়নার উপরে নাই৷ আমার দিকে অনেকটা অগ্রসর হইয়া আসিয়াছে৷ কি করিতেছি ভাবিয়া দেখিবার আগেই পিস্তল তুলিয়া নিজের মাথা লক্ষ্য করিয়া গুলি ছুঁড়িলাম, কেবল তড়িদবেগে মনে হইল, আমার ঠিক পিছনে সে যখন রহিয়াছে, সেও মরিবে৷ এক গুলিতে শিকার ও শিকারীর দুইজনেরই জীবনাবসান!

বোধ হয় হাত একটু কাঁপিয়া গিয়াছিল৷ শূন্যঘরে পিস্তলের শব্দ মাথা কুটিতে লাগিল৷ পিছন হইতে একটা নিদারুণ নিষ্ঠুর হাসির খনখন শুষ্ক আওয়াজ কানে আসিল, মনে হইল অশরীরী আমার ব্যর্থ চেষ্টাকে ধিক্কার দিয়া হাসিতেছে৷ চারিদিকে বারুদের গন্ধ৷ ঘরের মেজে কাঁপিতেছে, ছাদ ঘুরিতেছে, সমস্ত অন্ধকার৷

পরদিন যখন জ্ঞান হইল, দেখিলাম আমি শয্যার উপরে শায়িত, ভিখু মাথায় বাতাস করিতেছে৷ পায়ের কাছে দারোয়নজী গম্ভীরমুখে দণ্ডায়মান৷ শিমুলতলার ঠিকানায় একটা তার করিতে বলিয়া আবার আমি ঘুমাইয়া পড়িলাম৷

পরদিন যখন ঘুম ভাঙিল, দেখিলাম যে আমার পরিবারের জনাতিনেক কাছে বসিয়া আছে৷ তাহাদের বলিলাম, আজই আমাকে এখান হইতে লইয়া চল৷

পরদিন প্রাতে শিমুলতলায় আসিয়া পৌঁছিলাম৷

এই ঘটনার পরে পাঁচ-সাত বৎসর অতীত হইয়াছে৷ এখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক৷ অশরীরীর স্মৃতি আমার মনে ফিকা হইয়া আসিয়াছে৷ কিন্তু সত্য করিয়া বলি, এই রহস্যের উত্তর আজও পাই নাই৷ ডাক্তারদের

জিজ্ঞাসা করিয়া সেই পুরাতন উত্তরই পাইয়াছি—নার্ভাস শক৷ মনস্তাত্ত্বিকদের জিজ্ঞাসা করিয়া উত্তর পাইয়াছি—সমস্ত ব্যাপারটাই একটা সাবজেকটিভ রিঅ্যাকশন৷ বন্ধুরা বলে—আমি ধাপ্পা দিতেছি৷ কিন্তু আমি জানি, মর্মান্তিকভাবে জানি, সমস্তই নিদারুণ সত্য৷ কেমন করিয়া না-জানি অশরীরীর মোহময় খোলসের মধ্যে আমি ঢুকিয়া পড়িয়াছিলাম৷ সেই রাত্রের পিস্তলের গুলি সেই মোহ ভেদ করিয়া দিয়া আমাকে বাঁচাইয়া দিয়াছিল৷ অশরীরীর নিজের ব্যর্থতায় আত্মধিকারের অট্টহাস্য করিয়া সঙ্গ পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছিল৷ বন্ধুরা বলে, ওসব তোমার কবিত্ব৷ যাহাকে ধিক্কারের অট্টহাস্য বলিতেছ বস্তুত তাহা পিস্তলের গুলি লাগিয়া সেই বৃহৎ আয়নাখানা ভাঙিবার শব্দ ছাড়া আর কিছুই নয়৷ আমি বুঝাইতে পারি না, চুপ করিয়া থাকি৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *