সাত নম্বর ঘর

সাত নম্বর ঘর

আমি তখন সবে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ঢুকেছি। সেই সময় একবার আমরা দু’জন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম বিষ্ণুপুর বেড়াতে যাব। বিষ্ণুপুরে মল্লরাজাদের স্থাপত্য এবং মন্দিরের টেরাকোটার কাজ দেখার শখ ছিল বহুদিনের। বিষ্ণুপুর তখন এখনকার মতো এত জমজমাট ছিল না। রেল স্টেশনের কাছে একটা দোতলা হোটেল ছিল। এখন সেটা আছে কিনা জানি না। হোটেলের মালিকের নাম ছিল পঞ্চানন সাধুখাঁ। অমায়িক ভদ্রলোক। একটা ডবল বেডের রুমের ভাড়া ছিল মাত্র পাঁচ টাকা। আর পেটভরে ডাল ভাত মাছ তরকারি খেলে লাগত এক টাকা চার আনা। তখন তো এখনকার মতো এত বাসের ব্যবস্থা ছিল না। কাজেই আমরা চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারে চেপে শেষ রাতে বিষ্ণুপুরে যখন নামলাম তখন ঘন অন্ধকার। সময়টা বোধ হয় কার্তিকের শেষ, কাজেই একটু ঠাণ্ডার আমেজও ছিল। যাই হোক, শেষ রাতের সেই অন্ধকারে আমরা পায়চারি করতে করতে ভোরের প্রতীক্ষা করতে লাগলাম।

আমরা যখন এইভাবে পায়চারি করছি তখন কোথা থেকে একটি বেঁটেখাটো ঘাড়ে গদ্দানে লোক এসে জিজ্ঞেস করল আমাদের, “বাবুরা কোত্থেকে আসছেন?”

“আমরা আসছি হাওড়া থেকে।”

“বিষ্ণুপুর বেড়াতে এসেছেন বুঝি?”

“হ্যাঁ।”

“কোথায় উঠবেন কিছু ঠিক করেছেন?”

“না। আগে সকাল হোক, তারপর দেখা যাবে।”

লোকটা এবার উৎসাহিত হয়ে হাত কচলাতে কচলাতে বলল, “স্টেশনের সামনে আমাদের হোটেল আছে। ভাল হোটেল। যদি দয়া করে পায়ের ধুলো দেন তো ধন্য হই। জল কল বাথরুমের সবকিছুরই ব্যবস্থা ভাল। এমন হোটেল এ অঞ্চলে দুটি নেই।”

আমরা দু’জনে একবার পরস্পরের চোখের দিকে তাকালাম। তারপর বললাম, “স্টেশনের সামনে বলতে কি একেবারেই সামনে, না একটু যেতে হবে?”

“একটুও যেতে হবে না। ওই দেখা যাচ্ছে। একেবারে রাস্তার উলটো দিকে। চলুন না আমার সঙ্গে।”

আমরা ওর কথায় রাজি হয়ে ওর সঙ্গে স্টেশনের বাইরে এসে সেই হোটেলে ঢুকলাম। হোটেলের মালিক পঞ্চাননবাবু তখন সবে চেয়ারটিতে এসে গুছিয়ে বসেছেন। আমরা গিয়ে তাঁকে নমস্কার জানিয়ে ঘর চাইতেই উনি বেঁটেখাটো লোকটিকে বললেন, “যাও তো হে সিধু, বাবুদের ঘর দেখিয়ে দাও।”

হোটেলটি ছোট হোক, তবে বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। আমরা সিধুর সঙ্গে দোতলায় উঠে প্রথম যে ঘরখানি দেখলাম সেটিকেই পছন্দ করলাম।

আমরা অবশ্য ঘরের ভেতরে ঢুকলাম না। বাইরে থেকেই দেখলাম। পরিপাটি বিছানা। সাজানো-গোছানো সুন্দর ঘর। দরজাটা হাট করে খোলা ছিল।

সিধু দরজাটা টেনে বন্ধ করে বলল, “চলুন, ওদিকের ঘর দেখাই।”

‘কেন, এই তো একটা ভাল ঘর ছিল।”

“এ ঘরটা নয়। এটা সাত নম্বর ঘর। এটা একটু আগেই হয়ে গেছে। আপনাদের অন্য ঘর দেখাচ্ছি।”

আমার বন্ধুটির নাম গোরা। ভয়ানক একরোখা সে। বলল, “হয়ে গেছে মানে? এই ভোরে আমরাই তো প্রথম যাত্রী। তা ছাড়া এ ঘরে অন্য কেউ এলে তার কিছু মালপত্তর থাকবে। মালপত্তর না থাকলেও দরজাটা তো বন্ধ থাকবে? ঘরে লোক নেই, জন নেই দু’হাট করে দরজা খোলা, হয়ে গেছে বললেই হল?”

আমি বললাম, “তোমাদের যদি বেশি ভাড়ার দরকার হয় সে কথা বললেই পারতে? আমরা কি দিতাম না?”

সিধু আমতা আমতা করে বলল, “না মানে, আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করছেন না তো? যাই হোক, ঘর যখন খালি তখন আপনারা ঢুকুন। আমার মনে হয় আমি যখন স্টেশনে গেছি সেই সময় ওরা হয়তো চলে গেছে।”

গোরা বলল, “সে যাক গে। আমাদের দরকার নেই। এই ঘরই আমাদের পছন্দ। এই ঘরেই আমরা থাকব। তুমি যাও, এখন চটপট আমাদের জন্য দু’ কাপ চা নিয়ে এসো দেখি?” সিধু চা আনতে নীচে চলে গেল।

একটু পরেই শুনতে পেলাম পঞ্চাননবাবুর গলা, “ওই ঘরটা কে খুলল, কে?”

“তা জানি না বাবু। ও ঘর তো খোলাই হয় না। সবসময় তালা দেওয়া থাকে। বাবুদের নিয়ে ওপরে উঠেই দেখি দরজা একেবারে দু’ হাট করে খোলা।”

” পঞ্চাননবাবু বললেন, “ছোঁড়া দুটো কি ওই ঘরেই থাকতে চায়?”

“হ্যাঁ।”

এর পর চুপচাপ। আমরা বিছানায় আধশোয়া হয়ে সবই শুনলাম। একটু পরেই সিধু এসে চা দিয়ে গেল।

আমরা চা খেতে খেতে খোলা জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। বাইরে তখনও অন্ধকার। একটি দুটি করে পাখির ডাক কানে আসছে তখন। খুব ভাল লাগল পরিবেশটা।

চা খাওয়া শেষ করে গোরা বলল, “যাই, বাথরুমের কাজটা সেরে আসি এবার। আমি এলে তুই যাবি।” এই বলে গোরা বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল। অ্যাটাচড বাথ। কিন্তু এ কী! বাথরুমের দরজা ঠেলতে গিয়ে দেখল দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ।

গোরা একটু রাগী প্রকৃতির ছেলে। সে দরজায় জোরে ধাক্কা দিয়ে বলল, “এই কে আছ ভেতরে? শিগগির বেরিয়ে এসো।”

বলার সঙ্গে সঙ্গে ভিজে শাড়ি পরা এক তরুণী চকিতে দরজা খুলে গোরার পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এসেই চোখের পলকে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। আমরা দু’জনে হতভম্ব।

এ কী রে বাবা!

এতক্ষণ রয়েছি এখানে অথচ ওর কোনও অস্তিত্বই বুঝতে পারিনি? অবশ্য এমনও হতে পারে আমরা রয়েছি বলেই ভেতরে ঢুকে অপ্রস্তুতে পড়ে গিয়েছিল সে। লজ্জায় বেরোতে পারছিল না। কিন্তু যদি না গোরা বাথরুমে যেত? যদি আমরা চা খেয়েই দরজায় তালা দিয়ে বাইরে যেতাম, তা হলে? তা হলে কী করত বেচারি? যাই হোক, আমাদের মাথাব্যথা নেই। আমরা বাথরুমের কাজ সেরে যখন পোশাক পালটালাম তখন অন্ধকার দূর হয়ে ভোর হয়ে গেছে। চারদিকের প্রকৃতি বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পাখির ডাক আরও বেশি করে শোনা যাচ্ছে তখন। জানলার ফ্রেমে লাল মাটির প্রান্তর আর ঘন সবুজের শোভা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল।

আমরা ঘরে তালা লাগিয়ে বাইরে এলাম। তারপর একটা সাইকেল রিকশা ভাড়া করে গোটা বিষ্ণুপুর ঘুরে দেখব ঠিক করলাম। রিকশাওয়ালা তিন টাকার বিনিময়ে সব কিছু ঘুরিয়ে দেখাতে রাজি হল। আমরা মাঝেমধ্যে তাকে জলখাবার খাওয়াতে লাগলাম।

প্রথমেই আমরা মদনমোহন মন্দির দেখলাম। তারপর রাসমঞ্চ, দলমাদল কামান, লালদিঘি হয়ে গভীর বনের ভেতর গেলাম বিষ্ণুপুরের নূরজাহান লালবাঈ-এর নতুন মহলের ধ্বংসস্তূপ দেখতে। আমরা নতুন মহলের চারদিক ঘুরে দেখতে দেখতে পেছন দিকের বাগানে এসে অবাক হয়ে গেলাম। সেখানে ঘন ঘাসের ওপর শতরঞ্চি পেতে এক সুবেশা তরুণী টিফিন কৌটো খুলে খাবার ভাগ করছে। আমরা যেতে আমাদের চোখে চোখ পড়তেই হেসে বলল, “আপনারা কাল রাত্রে চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারে এসেছেন না?”

“হ্যাঁ। আপনি কী করে জানলেন?”

“আমরাও ওই গাড়িতে এসেছি। কোথায় উঠলেন? স্টেশনের সামনে ওই হোটেলে?”

গোরা বলল, “হ্যাঁ।”

তরুণী বলল, “আমরাও ওই হোটেলেই উঠেছিলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই প্রথমে যে ঘর তাইতে। সাত নম্বর ঘর।”

“সে কী!”

“তারপর যেই না শুনেছি, এই ঘরে একবার একটা খারাপ ঘটনা ঘটে গিয়েছিল সেই থেকে উপদ্রব হয়, অমনই পালিয়ে এসেছি ওখান থেকে। আমার স্বামীর আবার ভূতের ভয় খুব।”

গোরা আর কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই আমি ওর হাতে টান দিলাম, “চল চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে।” বলে বনের বাইরে এসে বললাম, “আর এক মুহূর্ত এখানে নয়। ওই হোটেলে আমি আর ঢুকছি না ভাই। এবার বুঝতে পারছিস তো ভোরবেলা বাথরুম থেকে কে বেরিয়েছিল?’

গোরা চমকে উঠে বলল, “তাই তো! ওর কথা একদম ভুলেই গিয়েছিলাম রে! ঠিকই তো। তবে আমরা হয়তো অহেতুক কল্পনা করছি। ও মেয়েটি ভূত না হয়ে মানুষও তো হতে পারে?”

আমার মন কিন্তু গোরার এই কথায় সায় দিল না। আমার ভূতের ভয় খুব। তাই ভয়ে বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল আমার। আমরা বেশ বেলা পর্যন্ত চারদিক ঘুরে বেড়িয়ে স্নান খাওয়ার পর ঘরের দরজা বন্ধ করে তেড়ে একটা ঘুম দিলাম। বিকেলবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখলাম হোটেলের অন্যান্য ঘরে আরও অনেক যাত্রী এসেছে। দেখে খুব আনন্দ হল। আমরা চা-টা খেয়ে আশপাশের লোকেশানগুলো আরও একটু ঘুরে দেখতে চললাম।

সন্ধের পর হোটেলে ফিরে এসে রাতের খাওয়া খেয়ে অন্য ঘরের দু-একজন ভদ্রলোককে ডেকে এনে মেতে ওঠা হল জোর তাস খেলায়। আমি অবশ্য তাস খেলা জানতাম না। তাই শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়তে লাগলাম।

তাস খেলা শেষ হলে ওরা সবাই শুতে চলে গেলে আমরাও শয্যা গ্রহণ করলাম। তারপর আলো নিভিয়ে শুধুমাত্র ব্লু রঙের ডিমলাইট জ্বেলে রেখে দু’জনে শুয়ে শুয়ে ভোরের মেয়েটির কথা আলোচনা করতে লাগলাম।

গোরা বলল, “খুব ভুল হয়ে গেল। ভদ্রমহিলার মুখে এই ঘরের দুর্নাম শোনার পরও পঞ্চাননবাবুকে জিজ্ঞেস করা হল না তো ওই মেয়েটির কথা। মেয়েটি কে?”

আমি বললাম, “যেই হোক, আমাদের যা দেখার তা তো দেখা হয়ে গেছে। কাল সকালেই আমরা চলে যাচ্ছি। অতএব কিছুরই দরকার নেই আজ। কোনওরকমে রাতটা কাটাতে পারলে আর আমাদের পায় কে?”

রাত তখন কত তা কে জানে! হঠাৎ বাথরুমের ভেতর প্রচণ্ড একটা শব্দ। ঠিক মনে হল কে যেন একটা বালতিকে সশব্দে ফেলে দিল লাথি মেরে। অথবা শ্যাওলায় পা পিছলে বালতিসুদ্ধু হুমড়ি খেয়ে পড়ল কেউ।

সেই শব্দে আমরা দু’জনেই লাফিয়ে উঠে বসলাম। ডিমলাইটটা জ্বালাই ছিল। আমরা উঠে বসেই জোরালো আলোর সুইচটা অন করে দিলাম। আলোয় ভরে উঠল গোটা ঘর। কী হল? ব্যাপার কী? উঠে বসেই শুনতে পেলাম বাথরুমের ভেতর কী যেন একটা ছটফট করছে।

আমি আতঙ্কে নীল।

গোরা উঠে গিয়ে বাথরুমের দরজা ঠেলল। কিন্তু আশ্চর্য! দরজাটা সেই কালকের মতোই ভেতর থেকে বন্ধ।

গোরা সশব্দে ধাক্কা দিতে লাগল দরজায়, “কে আছ ভেতরে, শিগগির দরজা খোলো। খোলো বলছি।”

বাথরুমের ভেতর থেকে তখন নারীকণ্ঠের চাপা একটা আর্তনাদ ভেসে এল, “আঃ-আঃ-আঃ।”

আমরা দু’জনেই একসঙ্গে গায়ের জোরে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলাম।

হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল দু’হাট হয়ে। আর তারপরেই যে দৃশ্য চোখে পড়ল তাতে দু’জনেই শিউরে উঠলাম। দেখলাম বাথরুমের চৌবাচ্চায় ভর্তি জলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে এক তরুণী। ঘাড় মাথা জলের তলায়। অসহায় একটা হাত দেওয়াল ধরে আছে। পা দুটো বেঁকে মুড়ে স্থির। ক্ষীণ একটু রক্তের ধারা গড়িয়ে আসছে জলের স্রোতে। গোরা ছুটে গিয়ে তরুণীকে জল থেকে টেনে তুলতেই আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। এ তো সেই। আজই দুপুরে লালবাঈয়ের নতুন মহলের বনের ভেতর যাকে দেখেছিলাম।

সে দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখতে পারলাম না আমরা। বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। বেরিয়ে এসে চেঁচামেচি করে হোটেলের সবাইকে ডেকে তুললাম। পঞ্চাননবাবুকে ডাকলাম। কিন্তু কোথায় কী তখন? সব ফাঁকা।

আমাদের কথা শুনে পঞ্চাননবাবু বললেন, “কী আর বলি বলুন আপনাদের! এ ঘর তো আমি দিতে চাইনি। আপনারাই জোর করে নিলেন। বছর দুই আগে এক দম্পতি এখানে হনিমুনে এসেছিলেন। একদিন রাত্রে হঠাৎ এক দুর্ঘটনা হয়ে গেল। মহিলা মাঝরাত্তিরে বাথরুমে ঢুকেছিলেন। তারপর সম্ভবত পা পিছলেই হুমড়ি খেয়ে চৌবাচ্চায় পড়ে যান। বাথরুমের দরজা ভেতর থেকে লক করা ছিল। সেই থেকেই এই ঘরে কেউ থাকতে পারে না। আমরাও কাউকে ভাড়া দিই না। এটা সবসময় তালা দেওয়া থাকে। কিন্তু কাল ভোরে কে যে তালা খুলল—।”

যেই খুলুক, আমরা আর থাকিনি।

আমরা পঞ্চাননবাবুর টাকাপয়সা মিটিয়ে দিয়ে পরদিনই বিষ্ণুপুর ত্যাগ করেছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *