সাত সমুদ্র
‘একদম গোড়া থেকে বল।’ প্রথমা লাহিড়ীর কপালে নাইন এম এম পিস্তলের নল ঠেকিয়ে বলল সানা চৌধুরী।
প্রথমা নিজের পরিস্থিতিটা একবার ভেবে নিল। সে রয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিনশো ফুট নীচে, সাবমেরিনের মধ্যে। সে এবং সানা চৌধুরী ছাড়া সাবমেরিনে তৃতীয় কেউ নেই। এক্সপিডিশান টিমের বাকি সদস্যরা তিনশো ফুট ওপরে, জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, কখন সানা এবং প্রথমা ফিরে আসবে। সাবমেরিনের সঙ্গে জাহাজের যোগাযোগের সুযোগ নেই। তিনশো ফুট নোনা জলের নীচে যোগাযোগের কোনও ব্যবস্থাই কাজ করে না।
প্রথমা বসে রয়েছে সাবমেরিনের ফ্লোরে, হাঁটু মুড়ে। দুই হাত মাথার পিছনে। পরনে নাবিকদের ঢিলে শার্ট-প্যান্ট, পায়ে জুতো-মোজা। সে জানে, একটু পরেই মরে যেতে হবে। মৃত্যুর জন্যে মন প্রস্তুত। কিন্তু প্রথমা চায় জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো নিজের মতো পরিচালনা করতে। নিজের মতো করে মরার জন্যে হাতদুটো মাথার পিছন থেকে শরীরের পাশে আনা জরুরি।
প্রথমার কিছুটা সময় চাই।
‘বল!’ সাবমেরিনের ওয়ার্ক স্টেশানের চালকের আসনে হ্যালান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল সানা।
প্রথমা কথা বলা শুরু করল…
১
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রঞ্জিতের অফিসে ঢুকে প্রথমা বলল, ‘হঠাৎ জরুরি তলব?’
‘বসে পড়!’ হাতের ইশারায় সোফা দেখালেন রঞ্জিত। তাঁর টেবিলে একটি ডেস্কটপ কম্পিউটার আর একটি ল্যান্ডফোন ছাড়া আর কিছু নেই। পিছন দিকের পুরো দেওয়াল জুড়ে এলইডি মনিটর। রঞ্জিত যখন কোনও অডিও ভিজুয়াল প্রেজেন্টেশান দেন, তখন ওইখানে ছবি প্রতিফলিত হয়। সোফায় বসে প্রথমা দেখল আর একটি সোফায় বসে রয়েছেন ইন্ডিয়ান নেভির চিফ যশপাল নেগি।
প্রথমা সম্পর্কে যশপাল নেগি জানেন যে মেয়েটা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকাল উইং’ বা ‘র’-এর এজেন্ট। প্রথমা যে কাইমেরা নামের একটি এলিট ইনটেলিজেন্স উইং-এর সদস্য—এই তথ্য জানেন না।
এলইডি স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে একটি জাহাজের ফোটোগ্রাফ। ফোটোটি বেশ পুরোনো। সেটি দেখিয়ে রঞ্জিত বললেন, ‘গালফ ওয়ার শুরু হওয়ার বছর তিনেক আগে ‘সেভেন সিজ’ নামের এই জাহাজটি কিনেছিলেন সাদ্দাম হুসেন। তেল রপ্তানির কাজে ব্যবহার করা হত। গালফ ওয়ারের সময়ে সাদ্দাম একে যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করা শুরু করেন। আমেরিকার কম্যান্ডার ইন চিফ নর্মান শোয়ার্জকফের নির্দেশে জাহাজ তাক করে টোমাহক মিসাইল ছোড়া হয়েছিল। টোমাহকের আঘাতে সেভেন সিজ ডুবে যায়। তবে কেউ মারা যায়নি। একটি ভারতীয় জাহাজ সেভেন সিজের সমস্ত ক্রুকে উদ্ধার করে।’
যশপাল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জাহাজডুবি কোথায় হয়েছিল?’
এলইডি স্ক্রিনে এখন স্যাটেলাইটে তোলা ছবি। জুম ইন এবং জুম আউট করতে করতে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে ছবি স্থির হচ্ছে। ভারতবর্ষের দক্ষিণ দিক…ভারত মহাসাগর…ভারতবর্ষের দক্ষিণ দিকে ওয়ারিস্তান নামের দ্বীপ রাষ্ট্র…আরও দক্ষিণ দিক…ভারত মহাসাগরের একটি বিন্দু। সেখানে কার্সর নিয়ে গিয়ে রঞ্জিত বললেন, ‘এই সেই স্পট, যেখানে জাহাজডুবি হয়েছিল। একটা কথা বলে রাখা ভালো, সেভেন সিজ যে ওখানে ডুবেছে, এটা সারা পৃথিবী জানে। সমুদ্রের নীচে ডুবে যাওয়া জাহাজের শয়ে শয়ে কঙ্কাল পড়ে আছে। কোনও দেশ মাথা ঘামায় না।’
‘তা হলে আমরা ঘামাচ্ছি কেন?’ জানতে চাইল প্রথমা।
রঞ্জিত বললেন, ‘ঘামাচ্ছি, কেন না সম্প্রতি ওয়ারিস্তানের উদ্যোগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থেকে শুধুমাত্র মহিলা সমুদ্র বিশেষজ্ঞ নিয়ে একটি এক্সপিডিশান টিম তৈরি করা করেছে। ওয়ারিস্তান, ভারতবর্ষ, শ্যামলদেশ, জাফরানাবাদ, ভোটল্যান্ড, সিংহদ্বীপ আর মালব্যনগর থেকে আমন্ত্রিত ওসানোগ্রাফার, মেরিন বায়োলজিস্ট, ডিপ সি ডাইভার, সি এক্সপ্লোরার— এঁরা থাকবেন।’
‘জাহাজ উদ্ধারের ব্যাপারে ওয়ারিস্তানের এত আগ্রহ কেন? গুপ্তধন আছে নাকি?’ প্রশ্ন করলেন যশপাল।
‘গুপ্তধন বলতে যদি সোনাদানা বোঝেন, তা হলে নেই। তবে ওয়ারিস্তান বলছে যে ওই জাহাজে সাদ্দাম হুসেনের জমানার প্রচুর ডকুমেন্ট আছে, যেগুলো ওদের কাজে লাগবে। এবং এই অল ফিমেল টিমের প্রধান হলেন পৃথিবীর এক নম্বর ওসানোগ্রাফার, ওয়ারিস্তানের সানা চৌধুরী। উনি ছাড়াও এই টিমে রয়েছেন…’ রঞ্জিত স্ক্রিনের দিকে নির্দেশ করলেন। সেখানে চারজন মহিলার ছবি। রঞ্জিত বললেন, ‘সিংহদ্বীপের মেয়ে মাকি, ভোটল্যান্ডের লুসি, জাফরানাবাদের মাহিরা আর শ্যামলদেশের লায়লা। টিমের ষষ্ঠ সদস্য হিসেবে প্রথমাকে রাখা হবে।’
‘আমাকে কেন?’ প্রথমা বেজায় অবাক,’আমি ওসানোগ্রাফির কিছু বুঝি না।’
‘কারণ আছে,’ প্রথমার দিকে তাকিয়ে বললেন রঞ্জিত, ‘মিশকা খাতুন নামটা চেনা লাগছে?’
প্রথমা বলল, ‘আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র শ্যামলদেশের ওসানোগ্রাফার।’
‘একদম ঠিক।’ রিমোট টিপে পর্দায় মিশকার মৃতদেহের ফোটো এনেছেন রঞ্জিত। ‘মিশকা ওয়ারিস্তানে গিয়েছিল ওসানোগ্রাফি নিয়ে পড়াশুনো করতে। কাজ করছিল সানার আন্ডারে। অ্যাকাডেমিক সেশান শেষ হলে শ্যামলদেশে ফিরে যাবে, এই রকম প্ল্যানও ছিল। তিনদিন আগে হঠাৎ মেয়েটি ওয়ারিস্তানের অ্যাপার্টমেন্টে খুন হয়েছে। ওয়ারিস্তান পুলিশ সেই খুনের সমাধান করতে পারেনি। অ্যাকচুয়ালি, ওয়ারিস্তান পুলিশ এই খুনের সমাধান করবে না। তারা জানে কে খুন করেছে।’
‘ইন্টারেস্টিং!’ বললেন যশপাল।
‘আমাদের যেমন র, শ্যামলদেশের তেমন ‘সেন্ট্রাল অরগানাইজেশান অফ পোলিস’ বা ‘সি-ও-পি’ বা ‘কপ’। মিশকা কপের এজেন্ট ছিল। ও জেনে গিয়েছিল, ওয়ারিস্তানের উদ্যোগে জাহাজ উদ্ধার আসলে একটা নাটক। সেভেন সিজের মধ্যে সাদ্দামের ডকুমেন্ট আছে না নেই, সেটা অবান্তর। ওই জাহাজে অন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রাখা আছে।’
‘সেটা কী?’ জিজ্ঞাসা করল প্রথমা।
‘সেটা জানতে গেলে একটু ইতিহাস ঘাঁটতে হবে। ওয়ারিস্তানের সিক্রেট সার্ভিস এজেন্সির নাম ‘এজেন্সি টু প্রিভেন্ট এভিল’ বা ‘এ-পি-ই’ বা ‘এপ’। এপের এক মাইক্রোবায়োলজিস্ট নব্বইয়ের দশকে ল্যাবরেটরিতে একটি ভাইরাস তৈরি করেন। জেনেটিক্যালি মডিফায়েড সেই ভাইরাসের নাম, ‘ইনফেকশাস অ্যামনেসিয়া ভাইরাস’ বা ‘এ-আই-ভি’। গালফ ওয়ারের সময় ইরাক এবং ওয়ারিস্তান মিত্রশক্তি ছিল। সেই সূত্রে বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ারের অস্ত্র হিসেবে ভাইরাস ভর্তি একটি সিলিন্ডার সাদ্দাম হুসেনকে দান করে তৎকালীন ওয়ারিস্তান সরকার। সাদ্দাম তখন আর্কটিক ক্যাপে একটি গোপন বাঙ্কার বানাতে ব্যস্ত। সে চেয়েছিল, অন্য নানা অস্ত্রের মধ্যে সিলিন্ডারটিও বাঙ্কারে রেখে দিতে। খাঁড়ি যুদ্ধে আমেরিকার কাছে হেরে গেলে সাদ্দাম ওই সিলিন্ডারের ভাইরাস আর্কটিক ওসান বা উত্তর মহাসাগরে ভাসিয়ে দিত। ভাইরাসটির টার্গেট হল ‘গ্রোইং ব্রেন সেল’ বা শিশুর মগজ। এই ভাইরাস সংক্রমণের ফলে ‘ইনফেকশাস অ্যামনেসিয়া’ নামে একটি রোগ হয়। এই রোগে মস্তিষ্কের বিকাশ বন্ধ হয়ে গিয়ে শিশুরা দশ বছর বয়স হওয়ার আগেই মারা যায়। ইনফেকশাস অ্যামনেসিয়ার মহামারি শুরু হলে আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে।’
২
জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখে সিংহদ্বীপের সমুদ্র বিশারদ মাকি বলল, ‘সাতচল্লিশ মিনিট হয়ে গেল। ওরা এখনও আসছে না কেন?’
মাকির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভোটল্যান্ডের সমুদ্র বিশারদ লুসি। ঘাড় ঝাঁকিয়ে সে বলল, ‘আর একটু সময় দেওয়া যাক।’
শ্যামলদেশের লায়লা উৎকণ্ঠিত মুখে বলল, ‘যোগাযোগ করা যাবে না বলেই ওদের ঠিক সময়ে উঠে আসা উচিত ছিল। ওরা জানে যে আমরা চিন্তা করছি।’
সাবমেরিনের ফ্লোরে বসে তখন প্রথমা বলছে…
যশপাল বললেন, ‘গালফ ওয়ার হয়েছিল গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। এটা দু’হাজার কুড়ি সাল। এত বছর ধরে সিলিন্ডারের মধ্যে ভাইরাস বেঁচে আছে?’
রঞ্জিত বললেন, ‘ভাইরাস এমনিই বেঁচে থাকে। এবং ক্রমাগত নিজেকে কপি করে। যাকে বলা হয় সেলফ রেপ্লিকেশান।’
‘সিলিন্ডার আর্কটিক ক্যাপের বাঙ্কারে রাখা থাকলে পরে সেটা কীভাবে ফাটানোর কথা ভেবেছিল সাদ্দাম? কোনও টাইমার তো এই কাজ করতে পারবে না।’
‘মানুষ পাঠিয়ে এই কাজটি করার প্ল্যান ছিল সাদ্দামের। বাঙ্কার তৈরির জন্যেই সেভেন সিজ জাহাজকে ঘুরপথে আর্কটিক ক্যাপে পাঠাচ্ছিল। জাহাজডুবির ফলে প্ল্যান ভেস্তে যায়।’
‘এতদিন বাদে ওয়ারিস্তান ভাইরাসটার খোঁজ করছে কেন?’
‘ওয়ারিস্তান সম্প্রতি এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছে। ওয়ারিস্তান চাইছে ইরাকি ডকুমেন্ট তুলে আনার অছিলায় সিলিন্ডারটি খুলে ভাইরাস আর্কটিক ওশানে ছড়িয়ে দিতে। উত্তর মহাসমুদ্রে পড়ে ওই ভাইরাস জিওমেট্রিক প্রগ্রেশানে নিজেকে কপি করতে শুরু করবে। এক থেকে দুই থেকে চার থেকে ষোলো থেকে দুশো চৌষট্টি। তারপরে হাজার, লক্ষ, নিযুত, কোটি। সেভেন সিজ থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে সাত সমুদ্রে। সমুদ্রে স্নান করলেই এই ভাইরাস শরীরে বাসা বাঁধবে। প্রতিটি মানুষ হয়ে যাবে ভাইরাসের কেরিয়ার। তারা হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে অন্য মানুষের শরীরে ভাইরাস ছড়াবে। ইনফেকশাস অ্যামনেসিয়ায় আক্রান্ত হবে শুধু শিশুরা। দু’এক বছরের মধ্যেই এই রোগের অতিমারি দেখা দেবে। ওয়ারিস্তান তখন ভ্যাকসিন বিক্রি করে একচেটিয়া মুনাফা করবে। ভারতের সঙ্গে প্রক্সি ওয়ার করে দেশটা দেউলিয়া হয়ে গেছে। প্রতিরক্ষা খাতে বাজেটের সত্তর শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে হয়। প্রথমে সারা পৃথিবী জুড়ে মারণ রোগের অতিমারি সৃষ্টি করবে। তারপরে ভ্যাকসিন বিক্রি করে স্থিতিশীল অর্থনীতি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করবে।’
‘এই ষড়যন্ত্রের কথা জেনে যাওয়ায় মিশকাকে মরতে হল?’ জিজ্ঞাসা করলেন যশপাল।
‘একদম তাই,’ বললেন রঞ্জিত, ‘কপের কনট্যাক্ট পারসনকে মিশকা ইনফরমেশান দিত অদ্ভুত একটা পদ্ধতিতে।’
এলইডি স্ক্রিনে একটি ইমেলের ড্রাফট দেখা যাচ্ছে। রঞ্জিত বললেন, ‘মিশকার একটা ফেক ইমেল আইডি ছিল। মিশকা এবং তার কনট্যাক্ট পারসন, দু’জনেই ওই মেল আইডির পাসওয়ার্ড জানত। ড্রাফট বক্সে গিয়ে মিশকা প্রয়োজনীয় তথ্য লিখে রাখত। কিন্তু ইমেলটা কোথাও পাঠাত না। কেন না সমস্ত ইমেল ট্র্যাক করা যায়। কপের কনট্যাক্ট পারসন শ্যামলদেশে বসে ওই মেল আইডিতে লগ ইন করে মিশকার লেখা ড্রাফট পড়ে নিয়ে লগ আউট করত। কোনও মেল চালাচালি হল না। অথচ তথ্য পৌঁছে গেল ওয়ারিস্তান থেকে শ্যামলদেশে।’
‘দারুণ!’ বলতে বাধ্য হল প্রথমা।
‘শেষ ড্রাফটে মিশকা লিখেছিল, ‘এক্সপিডিশানের কুমির ছানার আড়ালে সমুদ্রের জলে ভাইরাস মিশিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের কথা যে আমি জেনে গেছি এই কথাটা এপ জেনে গেছে। কী হবে বুঝতে পারছি না।’ এই ড্রাফট লেখার আট ঘণ্টার মাথায় মিশকা খুন হয়।’
যশপাল বললেন, ‘এতক্ষণে বোঝা গেল কেন ওয়ারিস্তান পুলিশ মিশকা মার্ডার কেসের সমাধান করবে না। শ্যামলদেশ কী চাইছে?’
‘শ্যামলদেশ মিশকা হত্যার প্রতিশোধ চাইছে। ওরা চাইছে, সিলিন্ডার যেন ওয়ারিস্তানের হাতে না পড়ে। ওরা চাইছে আমাদের সাহায্য।’
যশপাল বললেন, ‘ভারতবর্ষ আর শ্যামলদেশ পরষ্পরের রাজনৈতিক বন্ধু। একই সঙ্গে এই দুটি দেশ ওয়ারিস্তানের রাজনৈতিক শত্রু। শ্যামলদেশ আমাদের সাহায্য চাইতেই পারে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, প্রথমা কেন? ‘র’-এর এজেন্ট কেন? ইন্ডিয়ান নেভির কোনও মহিলা অফিসার নয় কেন?’
রঞ্জিত বললেন, ‘প্রথমার নাম আমি সাজেস্ট করেছি। কারণ এই মিশনে এমন কিছু কাজ করতে হবে, যা নেভির অফিসারের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না। আপনি প্লিজ আমার অনুরোধ রাখুন।’
যশপাল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘নেভির বেসিক নলেজ আছে আশা করি।’
রঞ্জিত বললেন, ‘জাহাজে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই। ওসানোগ্রাফি সম্পর্কে জ্ঞান শূন্য। সাবমেরিন নেভিগেশানও কখনও করেনি। এইখানে আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে। এক্সপিডিশান শুরু হতে দু’মাস বাকি আছে। আপনি প্রথমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিন।’
প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর অনুরোধ মানে আদেশ। কথা বাড়ালেন না যশপাল। প্রথমার দিকে করমর্দনের হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘হিন্দিতে বলা হয় ‘সাত সমুন্দর’। ইংরিজিতে বলে ‘সেভেন সি’। কিন্তু সমুদ্র তো পাঁচটা। কী ব্যাপার বল তো প্রথমা?
প্রথমা করমর্দন করে বলল, ‘পাঁচটি সমুদ্র হল অতলান্তিক মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর, ভারত মহাসাগর, উত্তর মহাসাগর আর দক্ষিণ মহাসাগর। অতীতে ভাগটা আর একটু বড় ছিল। অ্যাটলান্টিক ওসানকে ভাগ করা হত নর্থ অ্যাটলান্টিক এবং সাউথ অ্যাটলান্টিকে। প্রশান্ত মহাসাগরকে ভাগ করা হত নর্থ প্যাসিফিক এবং সাউথ প্যাসিফিক ওসানে। অতীতের সাত এখনকার পাঁচে এসে ঠেকেছে। তবে পুরাণে সপ্তসিন্ধুর অন্য একটা ব্যাখ্যা আছে।’
‘সেটা কী?’ জিজ্ঞাসা করলেন যশপাল। জ্ঞানগম্যিওয়ালা বঙ্গ তনয়াকে তাঁর পছন্দ হয়েছে।
প্রথমা বলল, ‘পুরাণে বর্ণিত সাত সমুদ্র হল লবণ, ইক্ষুরস, সুরা, ঘৃত, দধি, ক্ষীর ও মিষ্টি জলের সমুদ্র। বাস্তবে এদের অস্তিত্ব নেই। এইসব সমুদ্রে পৌঁছবার এবং সেগুলো ভোগ করার অধিকার নির্দিষ্ট আছে শুধুমাত্র পুণ্যকর্মের অধিকারীদের জন্যে।’
যশপাল বললেন, ‘দেশের জন্যে কাজ করার থেকে বড় পুণ্যকর্ম আর কী-ই বা আছে? তুমি আমার সঙ্গে চলো। দু’মাসের মধ্যে তোমাকে ওসানোগ্রাফার বানাতে না পারলেও জলদস্যু বানিয়েই ছাড়ব।’
৩
‘একটু জল পাওয়া যাবে?’ জিজ্ঞাসা করল প্রথমা।
সানা জবাব দিল, ‘মরার আগে জল খেয়ে কী করবি?’
‘একটানা কথা বলছি। গলা শুকিয়ে গেছে।’
সানা একটু ভাবল। তারপর মিনারেল ওয়াটারের বোতল ছুড়ে দিল প্রথমার দিকে। বোতলটা লুফে নিল প্রথমা।
‘জল খেয়ে বোতল ফেরত দে।’ হুকুম করল সানা। প্রথমা এক ঢোক জল খেয়ে বোতলটা পাশে রাখল।
সানা বলল, ‘তেষ্টা মিটেছে? এবার বল।’
প্রথমা বলল, ‘গত দু’মাস ধরে ইন্ডিয়ান নেভিতে ট্রেনিং নিয়েছি। জাহাজ এবং সাবমেরিন চালানো, ডিপ সি ডাইভিং, স্নরকেলিং, স্কুবা ডাইভিং…কী নয়? সঙ্গে ছিল ওসানোগ্রাফির থিয়োরিটিক্যাল পড়াশুনো। আমার নতুন পরিচয়, আমি একজন সমুদ্র বিশেষজ্ঞ। আসল মিশন ছিল সিলিন্ডারটা কবজা করা। সে আর পারলাম কই। তুই যে এপের এজেন্ট এটা আমার দেশের ইনটেলিজেন্স জানতে পারেনি। কিন্তু তুই জানতে পেরেছিলি যে ভারতের এজেন্ট প্রথমা লাহিড়ী ওসানোগ্রাফারের ছদ্মবেশে এক্সপিডিশানে থাকছে। তুই-ই আমাকে সাবমেরিনে ডেকে নিলি। সাবমেরিন চালানোর কাজে ব্যস্ত করে দিয়ে মাথার পিছনে নাইন এম এম ঠেকিয়ে পেড়েও ফেললি। যাই হোক! এই মুহূর্তটা একদিন না একদিন আমার জীবনে আসতই।’
‘ইন্ডিয়াকে হারতে দেখলে আমার যে কী আনন্দ হয় তোকে বলে বোঝাতে পারব না।’ মিনারেল ওয়াটারের বোতল সরিয়ে নিয়ে বলল সানা।
প্রথমা বলল, ‘জল খাব।’
‘তোর কাছ থেকে আমার আর কিছু জানার নেই। কাজেই তুই গলা শুকিয়ে মরে গেলেও কোনও প্রবলেম নেই।’ হাসছে সানা, ‘ইন্ডিয়ার ইনটেলিজেন্স অনেক আগেই হেরে বসে আছে! কেন না, জাহাজডুবির ঘটনাটা সত্যি হলেও বাকি সবটাই গল্প। ইনফেকশাস অ্যামনেসিয়া ভাইরাসের কোনও অস্তিত্বই নেই। ভাইরাস ভর্তি সিলিন্ডার, ইনফেকশাস অ্যামনেসিয়া রোগের অতিমারি, নতুন ভ্যাকসিন—সবটাই ডিকয় বা টোপ। যা মিশকার মাধ্যমে ইন্ডিয়ান ইনটেলিজেন্সকে ফিড করা হয়েছে। মিশকাকে খুন করাটাও ফাঁদের অংশ। আর এই জটিল ফাঁদের পিছনে একটাই অ্যাজেন্ডা। তোকে খতম করা। তুই বারবার ওয়ারিস্তানের ক্ষতি করে দিচ্ছিস।’
মেঝেতে রাখা দু’হাত বুকের সামনে জড়ো করে প্রথমা বলল, ‘তাই?’
সানা বলল, ‘তোকে আর একটা ইনফর্মেশান দিই। এক্সপিডিশান শুরুর আগের রাতে ওয়ারিস্তানের আর্মি চিফের নির্দেশে সানা চৌধুরীকে জেলে ঢোকানো হয়েছে।’
‘সানা জেলে বন্দি? তা হলে তুই কে?’
প্রথমার দিকে নাইন এম এম তাক করে থাকা মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, ‘আমি ওয়ারিস্তানের নেভাল অফিসার লিমা মণ্ডল। আমার মিশন হল তোকে খুন করা। সানা সত্যিকারের ওসানোগ্রাফার। রাজনীতির দাবা খেলা ও বোঝে না। তাই ওকে আটকে রেখে আমি সানা সেজে জাহাজে উঠেছি। এইবার তোর ডেড বডি সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে সাবমেরিন চালিয়ে ওপরে উঠে বলব তুই ডিপ সি ডাইভিং করতে গিয়ে নিখোঁজ। ইরাকি ডকুমেন্ট খোঁজা চালু থাকবে না বন্ধ হয়ে যাবে, সেটা পরে ভাবা যাবে।’
‘তোর জন্যে মন খারাপ লাগছে।’ বলল প্রথমা।
‘আমার জন্যে মন খারাপ? কেন?’ নাইন এম এমের ট্রিগারে হাত ঠেকিয়েছে লিমা।
‘তুই যেমন সানা নোস, আমিও তেমনি প্রথমা নই। আমার নাম জারা। আমি শ্যামলদেশের সুইসাইড বোম্বার।’
‘বাজে কথা বলিস না।’ হাসছে লিমা।
‘শ্যামলদেশের মাইয়ারা বাজে কথা বলে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় তোরা শ্যামলদেশের কত মানুষকে খুন করেছিলি মনে আছে? আমার নানা, নানি, ভাই, বোন—সব্বাই ওয়ারিস্তানি সেনার হাতে খুন হয়েছে। বেঁচে গিয়েছিলাম এক বছরের আমি আর আমার আব্বু। আব্বু না থাকলে আমিও মরে যেতাম। আমার যখন চোদ্দ বছর বয়স, তখন আব্বু গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। তখনই ঠিক করেছিলাম, আমিও মরব। তবে শ্যামলদেশের জন্যে মরব। এবং একা মরব না। ওয়ারিস্তানের কাউকে না কাউকে মেরে মরব। আজ আমার সেই সাধ পূর্ণ হচ্ছে। আমি জানতাম যে তুই সানা চৌধুরী নোস। তুই আসলে ওয়ারিস্তানের আর্মি চিফ লিমা। তোদের এই ডিকয়ের গল্পটা ভারতের র এবং শ্যামলদেশের কপ আগেই জেনে গিয়েছিল।’
‘কীভাবে?’ ঘামছে লিমা।
‘এপ-এর একজন এজেন্ট ভারতের হয়ে ডাবল এজেন্টের কাজ করে। তোদের প্রতিদিনের গোপন প্ল্যানিং সে ভারত আর শ্যামলদেশকে জানিয়ে দিত। প্রথমা লাহিড়ীকে খুন করাই যে এই মিশনের লক্ষ্য এটা জানা ছিল। সেই কারণেই প্রথমা এই এক্সপিডিশানে এসেছে শ্যামলদেশের লায়লা সেজে। আর আমি উঠেছি প্রথমা সেজে। প্রথমা, জারা এবং লিমা—আমাদের তিনজনের ডকুমেন্টই জাল। কিন্তু সেটা পরীক্ষা করার সাহস কার আছে? তিনটে দেশের ইনটেলিজেন্স এজেন্সি এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। ওয়ারিস্তানের এপ, ভারতের র এবং শ্যামলদেশের কপ। কে কাকে সন্দেহ করবে? আমি আর তুই যখন সাবমেরিনে মধ্যে বসে কথা বলছি, তখন প্রথমা জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে বিস্ফোরণের শব্দ শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে।’
‘বিস্ফোরণ কেন হবে?’ ক্রুর হাসল লিমা। ‘একটাই গান শট হবে। বাই দ্য ওয়ে, গপপোটা ভালোই বানিয়েছিস।’
জারা বিষণ্ণ হেসে নাবিকের ঢিলে শার্ট ওপরে তুলল। লিমা দেখল জারা শার্টের নীচে জ্যাকেট পরে রয়েছে। জ্যাকেটে গোটা দশেক পকেট। প্রতিটা পকেট এক্সপ্লোসিভে ঠাসা। একটা পকেট থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি সুইচ। সুইচে হাত রেখে জারা বলল, ‘কে বা আগে প্রাণ করিবেক দান? তুই আগে ট্রিগার টিপবি? না আমি আগে সুইচ টিপব?’
ভারত মহাসাগরের তিনশো ফুট নীচে, সাবমেরিনের মধ্যে, দুটি মেয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সময় বয়ে যাচ্ছে…
৪
সবার আগে খেয়াল করল জাফরানাবাদের মাহিরা। উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘ওই দ্যাখো! স্প্রে ডোম!’
ভোটল্যান্ডের লুসি বলল, ‘বুদবুদগুলো স্প্রে জেটের মতো উঠে স্প্রে ডোম তৈরি করছে। তার মানে জলের নীচে এক্সপ্লোশান হয়েছে। ওই দ্যাখো, দু’একটা ধাতুর পাতও দেখা যাচ্ছে!’
সিংহদ্বীপের মাকি বলল, ‘আমার মনে হয় সাবমেরিনে বিস্ফোরণ হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সানা এবং প্রথমার বাঁচার আশা নেই। রেসকিউ মিশন শুরু করো। মেন ল্যান্ডের সঙ্গে ইমিডিয়েটলি যোগাযোগ করতে হবে।’
জাহাজ জুড়ে তুমুল ব্যস্ততা। মাকি, লুসি আর মাহিরার নির্দেশে জাহাজের সব ক্রু সমুদ্রে স্পিডবোট আর লাইফ বোট নামাচ্ছে, নিজেরাও লাইফ জ্যাকেট পরে নিচ্ছে। ঠিক সেই সময়ে বাথরুম ঢুকে পড়েছে শ্যামলদেশের লায়লা ওরফে প্রথমা। ব্যক্তিগত স্যাটেলাইট ফোনে যোগাযোগ করছে রঞ্জিতের সঙ্গে।
একবার রিং হতেই রঞ্জিত ফোন ধরলেন। কোনও কথা বললেন না।
‘মিশন সাকসেসফুল।’ বলল প্রথমা। ফোন কেটে বাথরুম থেকে বেরিয়ে রেসকিউ মিশনের কাজে বাকিদের সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ফোন কেটে, সাউথ ব্লকের অফিসের জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন রঞ্জিত। ওপরওয়ালাকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ ভারত আর শ্যামলদেশের বন্ধুত্বকে। আরও একবার ওয়ারিস্তানের নাকে ঝামা ঘষে দেওয়া গেল।