সাতাশ বছর আগে
সুলেখা রান্নাঘরে থাকলেও স্বামীর আসার অপেক্ষায় ছিলেন। সুভাষবাবু ঘরে ঢুকতে—না—ঢুকতে বসার ঘরে এসে চেঁচিয়ে উঠলেন, ”শোনো, দীপার এই অঙ্কের মাস্টারটাকে বিদায় করো।”
সুভাষবাবু ঘেমেনেয়ে ঘরে ঢুকে ছিলেন, সকাল থেকে দোকান সামলে আর পারা যায় না। তবে মা লক্ষ্মীর কৃপায় তাঁর ব্যাবসা দিন দিন ফুলেফেঁপে উঠছে। গতমাসে দুটো কর্মচারী রেখেছেন।
দোকানটা পৈতৃক হলেও সুভাষবাবুর বাবা দেবেন্দ্রমোহনের সময় আয়তনে, আকারে সবেতেই অনেক ছোটো ছিল। সুভাষবাবু নিজে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ব্যাবসা বাড়িয়েছেন, দু—পাশের দুটো দোকানঘর কিনে অনেকটা বাড়িয়েছেন।
এখন বলতে নেই; বৃদ্ধ বাবা—মা, স্ত্রী আর একমাত্র কন্যাকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার ছোটোবেলার সেই দারিদ্র্য—অনটন আর নেই।
সুভাষবাবু হাত দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।
সুলেখার সব ভালো, পরিশ্রমী, ঘরোয়া, সবাইকে নিয়ে চলতে পারে। কিন্তু এই এক দোষ, সবেতেই বড্ড মাথাগরম করে ফেলে।
তিনি বললেন, ”কেন কী হয়েছে আবার?”
”কী আর বাকি আছে হওয়ার? তোমাকে তো কবে থেকে বলছি আমার ওই মাস্টারটার ভাবগতিক মোটেই সুবিধার লাগে না। কাল সমাদ্দারদের বাড়ির বউটা এসে বলে গেল, তোমার মেয়েকে ওর মাস্টারের সাথে দেখলাম; শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে ফুচকা খাচ্ছে।” সুলেখা খিঁচিয়ে উঠলেন, ”বাপের বয়সি মাস্টার, তার সাথে এসব কী ঠিক হচ্ছে?”
সুভাষবাবু মানানোর ভঙ্গিতে বললেন, ”আহ সুলেখা, আমার মনে হয় তুমি একটু বেশি চিন্তা করছো। দীপা হয়তো ওদিক দিয়ে কোথাও যাচ্ছিল, ওর স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছে, আবদার করে ফুচকা খেয়েছে। এনিয়ে এত গোলমালের কী আছে?”
সুভাষবাবু একটু থেমে বললেন, ”আর তা ছাড়া গদুমাস্টারের মতো নামডাক এই তল্লাটে ক—টা মাস্টারের আছে? প্রত্যেক বার মাধ্যমিকে ওর হাত দিয়ে গাদা গাদা ছেলে—মেয়ে অঙ্কে লেটার পেয়ে পাশ করছে। দীপা আমার পড়াশুনোয় ভালো, গদুমাস্টারের কাছে পড়ে রেজাল্টও ভালো করছে। দুম করে ছাড়িয়ে দেব তা হয় নাকি? কী যে বলো তুমি!”
সুলেখা অপ্রসন্নকণ্ঠে বললেন, ”দু—বছর ধরে তো ওই মাস্টারের কাছে পড়ছে, আমি কখনো কিছু বলেছি কী? ইদানীং …।”
সুলেখার কথাটা একেবারে ভুল নয়। সুদীপা, মানে সুভাষ আর সুলেখার একমাত্র মেয়ে এখন ক্লাস টেনে পড়ে। এইতো মাধ্যমিকের আর দশমাস মতো বাকি।
সুদীপা ওই গদুমাস্টারের কাছে পড়ছে ক্লাস এইট থেকে, মোটামুটি ১৯৮৮—র গোড়ার দিক থেকে। প্রথমে মাস্টারের বাড়ি গিয়ে ব্যাচে পড়ত, তারপর মেয়েকে যাতে পুরো মনোযোগটা দিতে পারে, সেইজন্য সুভাষবাবু বেশি টাকা দিয়ে বাড়িতে সন্ধ্যা বেলা এসে পড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন।
সুভাষবাবুর খুব ইচ্ছে, সুদীপা বড়ো হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা কোনো কেউকেটা হোক। তাঁর নিজের ছোটোবেলায় পড়ার খুব শখ থাকলেও সংসারের দারিদ্রের কারণে ব্যবসায় ঢুকে যাওয়ায় তিনি বেশিদূর পড়তে পারেননি। সেই আক্ষেপ তাঁর এখনও রয়ে গেছে। সুদীপার মাথা ভালো, ঠিকমতো যত্ন নিলে সে নিশ্চয়ই বাবার স্বপ্নপূরণ করবে।
কেউ কি ধীরে ধীরে মনে করতে পারছেন সেই কালান্তক ঘটনাটা? ১৯৯১ সালে ইছাপুরের নোয়াপাড়ায় ঘটে যাওয়া সেই সাংঘাতিক হত্যাকাণ্ড? যেটা তখন বিস্ময়ে আতঙ্কে মূক করে দিয়েছিল অধিকাংশ মানুষকে? যার নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতা দিনের পর দিন বিস্তারিত ভাবে প্রকাশ পেত প্রতিটা বাংলা সংবাদপত্রে? যার মনোস্তাত্বিক কারণ বিশ্লেষণ করতে হিমশিম খেয়েছিলেন মনোবিদরা?
হ্যাঁ, এতক্ষণ সুদীপা নামে যে দশম শ্রেণির কিশোরীটির কথা বলছিলাম, এ সেই সুদীপা পাল; সে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ তথা গোটা ভারতবর্ষকে।
আসুন জেনে নিই কী ঘটনা ঘটেছিল সেইসময়।
ইছাপুরের নোয়াপাড়ার ছাব্বিশ নম্বর ব্রজনাথ পাল স্ট্রিটের ছিমছাম দোতলা বাড়িটা আসলে তৈরি করেছিলেন দেবেন্দ্রমোহন পাল। প্রথমে একতলা ছিল, পরে ছেলে সুভাষ দোতলা করেছেন। আগেই বলেছি, সুভাষের কঠোর পরিশ্রমে একদা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারটিতে সচ্ছলতা এসেছিল। ব্যবসায় ক্রমাগত লাভে পালবাড়িতে বিত্তেরও বিকাশ ঘটছিল।
বাড়ির একমাত্র মেয়ে সুদীপা। দাদু—ঠাকুমা, বাবা—মার প্রচণ্ড আদরের। সুভাষ একমাত্র সন্তান, ওদিকে সুলেখার দিকেও তেমন কেউ নেই। কাজেই, পরিবারের সবেধন নীলমণি ওই মেয়েই। সবাই তাকে খুব ভালোবাসে। দাদু—ঠাকুমা তো নাতনি বলতে অজ্ঞান। ছোটো থেকে মুখ ফুটে একবার কিছু চাইলেই চোখের পলকে তা হাজির হয়ে যায় সামনে। দাদু দেবেন্দ্রমোহন নাতনির জন্য নিয়ে আসেন দামি জামা, চকোলেট। ওদিকে ঠাকুমা লতিকা ঘরে তৈরি করেন হরেক রকমের আচার, মিষ্টি।
মা সুলেখাও সুদীপাকে ভীষণ ভালোবাসেন, কিন্তু তিনি একটু কড়াপ্রকৃতির। এই নোয়াপাড়া অঞ্চলটা এখনও তেমন বর্ধিষ্ণু হয়ে ওঠেনি। বেশিরভাগই নতুন আসা সব পরিবার। কেমন ধরনের সব ছেলেমেয়ে, তাদের সঙ্গে মিশলে সুদীপা যদি খারাপ হয়ে যায়?
এই ভয়ে তিনি পাড়ায় কারুর সঙ্গে মেয়েকে মিশতে দেননি। যদিও পালবাড়ির একটু দূরেই খেলার মাঠ আছে, সেখানে বিকেল হলেই সব ছেলে মেয়েরা খেলত—তবু সুদীপার সেখানে যাওয়া বারণ ছিল। তাকে দামি দামি সব পুতুল, খেলনা, গাড়ি কিনে দেওয়া হত, ছোটোবেলায় স্কুল থেকে ফিরে দোতলার বারান্দায় বসে সে আপনমনে সেগুলো নিয়ে খেলত।
ছোটো থেকে কোনো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে না—মিশে সুদীপা একটু অন্তর্মুখী স্বভাবের হয়ে গিয়েছিল। স্কুলেও কারুর সঙ্গে তেমন মিশতে পারত না। তা ছাড়া মা বারবার সাবধান করতেন, ”যার তার সঙ্গে মিশবি না। ভালো ছেলে—মেয়েদের সঙ্গে শুধু মিশবি, বুঝলি?”
মেশার আগে কি বোঝা যায় কে ভালো আর কে মন্দ? এই করতে করতে সুদীপার শৈশব কেটে কৈশোর শেষ হতে চলল, অথচ তার একটাও বন্ধু হল না।
১৯৯০ সালের গোড়ার দিকের এক সন্ধ্যে বেলা সুদীপা দোতলায় নিজের ঘরে বসে জানলার দিকে তাকিয়েছিল। ওর চোখ দিয়ে অলক্ষ্যেই জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছিল।
মা আজ ওকে স্কুল থেকে দেরি করে ফেরার জন্য শুধুমুধু বকলেন। অতসীর শরীর খারাপ শুনে স্কুল থেকে বেরিয়ে ও আরও দুটো বন্ধুর সঙ্গে শুধু একবার দেখতে গিয়েছিল, তাই নিয়ে মার রাগ। অতসীর বাবা রিকশা চালান, কেন সুদীপা ওর সাথে মিশবে?
সুদীপা ভেবে পায় না, অতসীর বাবা রিকশা চালান তো তাতে অতসী কী দোষ করেছে? অতসী তো ওকে কত ভালোবাসে, আর ওর অসুখ হলে সুদীপা একটু দেখতে যাবে না?
ভালো লাগে না, ওর চোখ দিয়ে আবার জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে। মা ওকে একটুও ভালোবাসে না। সবসময় খালি বকে আর মারে। বাবা, দাদু আর ঠাকুমা না থাকলেও ও কবেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেত।
”একী! তুমি কাঁদছো কেন?” সুদীপা চমকে তাকিয়ে দেখে ওর অঙ্কের মাস্টারমশাই কখন এসে পড়েছেন, ও খেয়ালই করেনি।
ও তাড়াতাড়ি চোখ মুছে চেয়ারটা এগিয়ে দেয়, ”বসুন স্যার!”
তারপর নিজে গিয়ে বসে উলটোদিকের সোফায়।
”সে তো বসছি; কিন্তু আগে বলো তোমার কী হয়েছে?”
সুদীপা প্রাণপণে নিজেকে সংবরণ করে হাসার চেষ্টা করে, ”কই, কিছু হয়নি তো স্যার!” পরক্ষণেই কথা অন্যদিকে ঘোরাতে চেষ্টা করে ও, ”স্যার, আপনি যে হোমওয়ার্ক দিয়ে গিয়েছিলেন, সেগুলো সব করে রেখেছি, শুধু এই দুটো অঙ্ক কিছুতেই মেলাতে পারছি না। একটু দেখিয়ে দেবেন? উত্তর তো মিলছেই না, কেমন একটা বিচ্ছিরি রেজাল্ট আসছে।”
অঙ্কের মাস্টার রণধীর বসু আর কথা না—বাড়িয়ে খাতাটা টেনে নেন। পাড়ায় তাঁর পরিচিতি গদুমাস্টার হিসেবে, প্রাইভেট টিউশনি করে সংসার চালালেও তাঁর নামডাক বেশ। তবে কিনা ওই; শুধু প্রাইভেট পড়িয়ে আর যাই হোক, সংসারের অভাব মেটে না। তার ওপর মেয়েটা এখনও ছোটো। তিনি একটু বেশি বয়সেই বিয়ে করেছেন কিনা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কিংবা নিজের ওই একচিলতে ঘরে কত ছাত্রই বা পড়ানো যায়। একটু ভালো ঘরের ছেলেমেয়ে হলে অভিভাবক ওই জায়গায় পাঠাতে রাজিও হন না।
রাস্তার ওপরে একটা ভালো কোনো ঘর কোচিং—এর জন্য ভাড়া নিতে পারলে যেন অনেকটা সুবিধা হয়। রণধীর একদিকে সুদীপার আটকে যাওয়া অঙ্কটা করতে থাকেন, আর মনে মনে জীবনের জটিল হিসাব কষতে থাকেন।
গোটা ব্যাপারটা এখানেই মিটে গেলে ভালো হত, কিন্তু মিটল না। এরপর আরও একদিন মায়ের বকুনি খেয়ে সুদীপার কান্না দেখতে পেয়ে গেলেন রণধীর।
সেদিন সামান্য দ্বিধা করে হাত রাখলেন ছাত্রীর পিঠে, ”কেঁদো না সুদীপা, কেঁদো না।”
সুদীপা সেদিন আর কান্না লুকোবার চেষ্টা করল না; বরং সহানুভূতি পেয়ে তার কান্নার দমক আরও বেড়ে গেল, ”জানেন স্যার, মা আমাকে সবসময় বকে আর মারে। কারুর সঙ্গে মিশতে দেয় না। একটু কিছু হলেই আমাকে মারে।”
”আমিও তাই লক্ষ করেছি সুদীপা।” রণধীর চশমাটা খুলে বলেন, ”বউদি যেন তোমাকে সহ্য করতেই পারেন না। আচ্ছা, কিছু মনে করো না, তুমি … মানে তোমার বাবার কি আগে একবার বিয়ে হয়েছিল? তুমি কি সেইপক্ষের সন্তান?”
”মানে?” সুদীপার চোয়াল মুহূর্তে শক্ত হয়ে উঠল, ”এসব আপনি কী বলছেন!”
”না তোমার মা যেমনভাবে তোমাকে বকাঝকা করেন, সৎমারা সাধারণত এমন করে তো, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম!”
সুদীপার নাকের পাটা ফুলে উঠল, ”মা আমার নিজের মা। কিন্তু এটা সত্যি যে মা আমাকে দেখতে পারে না। আমার সবকিছুতেই মার সমস্যা।”
শুরুটা এইভাবেই হল। এরপর সুদীপা ধীরে ধীরে নিজের মার প্রতি সমস্ত ক্ষোভ উজাড় করে দিতে শুরু করল পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই রণধীরের কাছে।
রণধীরও কোথায় তাকে বোঝাবেন যে, মা হয়তো একটু রাগী, কিন্তু উনি যা করেন তোমার ভালোর জন্যই করেন, সেসব না—করে সুদীপার মনটা আরও বিষিয়ে দিতে লাগলেন।
শিক্ষক—ছাত্রীর সম্পর্ক আর শিক্ষার আঙিনায় আটকে রইল না—পরিণত হল এক অসমবয়সি অবৈধ সম্পর্কে।
সুদীপা পড়াশুনোয় ভালোই ছিল, কিন্তু ছোটো থেকেই তার মধ্যে অপরাধপ্রবণতা ছিল সুপ্তভাবে প্রচ্ছন্ন। সে ছিল ভীষণ জেদি আর একগুঁয়ে প্রকৃতির। মার কড়া শাসন সেই একরোখা অপরাধপ্রবণতার সঙ্গে স্বার্থপরতা আর নির্মমতা মিশিয়ে তাকে বয়ঃসন্ধিতে যেন আরও অচেনা করে তুলছিল। আর তাতে অনুঘটকের কাজ করছিল গৃহশিক্ষকের ক্রমাগত ইন্ধন।
রণধীর বসু তখন অন্য ছক কষছেন। নিজের সংসারের অবস্থা তথৈবচ, স্ত্রী অলকা রোজ উঠতে—বসতে খোঁটা দেয়। তিনি যতই যত্ন নিয়ে পড়ান না কেন, অভিভাবকেরা ইদানীং স্কুলের মাস্টারদের কাছেই প্রাইভেট ঠিউশন পড়ানোর দিকে বেশি ঝুঁকছেন; ফলে টিউশনির ব্যাবসা তাঁর দিন দিন মার খাচ্ছে।
একদিন তিনি সুদীপার কাছে ধরা গলায় বললেন, ”আমি আর কাল থেকে তোমাকে পড়াতে আসতে পারব না সুদীপা!”
সুদীপা চমকে উঠল। এই ক—মাসে মাস্টার তার শুধু প্রেমাস্পদ নয়, প্রিয়তম বন্ধু হয়ে উঠেছে। খুঁটিনাটি প্রতিটা ব্যাপার মাস্টারকে না বললে ওর পেটের ভাত হজম হয় না। ওর নিজের সুখ—দুঃখ, রাগ, হতাশা সবই সে অকপটে শেয়ার করে মাস্টারের সাথে।
মাঝেমাঝে অবশ্য ওর মনে হয়, কী দেখে মাস্টারকে এতটা ভালোবেসে ফেলল ও? পঞ্চাশ বছরের একজন লোক; সত্যি বলতে কী মাস্টারমশাইকে কুদর্শনই বলা চলে। শুধু তাই নয়, তাঁর সারা গায়ে শ্বেতির দাগ।
পরক্ষণেই ও মনকে বোঝায়, হোক কুৎসিত; বাহ্যিক রূপটাই কী সব নাকি? ওর নিজের মা—ও তো কত সুন্দরী, তবে তাঁর ভেতরটা এমন কুশ্রী কেন?
কিন্তু মাস্টার আর পড়াতে আসবেন না একেমন কথা!
ও মাস্টারমশাইয়ের হাত চেপে ধরল, ”কী বলছেন আপনি স্যার! আপনি না এলে আ—আমি কার সাথে সব গল্প করব! আর কাকেই বা …!”
রণধীর নিঃসংকোচে সুদীপাকে টেবিলের উলটোদিক থেকে ঝুঁকে কাছে টেনে নেন। এই ক—দিনে মানসিক দূরত্বের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে কমেছে তাঁদের শারীরিক ব্যবধান।
সুদীপা এই পনেরো বছর বয়সেই বেশ সুন্দরী। রণধীর গভীর আশ্লেষে তাকে চুমু খেয়ে বলেন, ”কিছু করার নেই সুদীপা। আমাকে অন্য কোথাও কাজ নিয়ে চলে যেতে হবে। এই টিউশনি করে সংসার আর চলছে না! দেখি যদি কোনো কারখানা—টারখানায় …! চিন্তা হয় শুধু তোমার জন্য। আমি না থাকলে তোমার মা তোমাকে আরও অত্যাচার করবে।”
”নানা!” সুদীপা মাস্টারমশাইয়ের মুখ চেপে ধরে, ”আপনি কোথাও যাবেন না। আমাকে একটু সময় দিন। আমি দেখছি কী করতে পারি!”
রণধীর টোপ ফেলে নিরুত্তর হয়ে যান। ব্যস্ত হয়ে পড়েন পড়ানোয়।
বয়ঃসন্ধির চটজলদি বিশ্বাসে ওদিকে সুদীপার সারারাত ঘুম আসে না। সত্যিই তো, টাকায় না কুলোতে পারলে স্যারকে তো চলে যেতেই হবে।
নাঃ, ওকেই কিছু—একটা করতে হবে।
মাঝরাতে ও পা টিপে টিপে ওঠে। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে চলে যায় ঠাকুমার ঘরে। মা—র আলমারি থেকে কোনো সুবিধা করা যাবে না, মা সেটা নিজের বালিশের নীচে রেখে ঘুমোন।
বরং ঠাকুমা বুড়ো মানুষ, আফিং খেয়ে সন্ধ্যে থেকেই ঝিমোতে থাকেন। এটাই সুযোগ।
সুদীপা সতর্কপায়ে ঠাকুমার আলমারি খোলে। সেখান থেকে সরিয়ে নেয় একটা সোনার আংটি।
পরেরদিন গর্বের সঙ্গে সেটা ও তুলে দিল স্যারের হাতে। যাক, স্যারের এই দুর্দিনে ও সামান্য হলেও কিছু তো করতে পারল!
ধরা না পড়লে মানুষের সাহস বাড়তে থাকে। সুদীপার ক্ষেত্রেও সেটাই হল। তার বিনা আয়াসে চুরি করে সাহস বেড়ে গিয়েছিল। রণধীরও কল্পনা করতে পারেননি, সামান্য একটু কান্নাকাটির অভিনয় করে তিনি একটা আস্ত সোনার আংটি পেয়ে যাবেন।
অতঃপর রণধীর প্রায়ই অন্য কোথাও চলে যাওয়ার ভুজুং—ভাজুং দিয়ে নাটক করতে লাগলেন, সুদীপাও একে একে সরাতে লাগল সোনার আংটি, চেন, বালা, মোটা টাকার ইন্দিরা বিকাশ পত্র।
একবার স্যারের মিথ্যে কোনো বিপদের নাম করে বাবার কাছে এমন কেঁদে পড়ল সুদীপা, সুভাষবাবুও রণধীরকে ছ—হাজার টাকা ধার দিলেন।
সুলেখা আপত্তি করতে গেলে বললেন, ”আহা, শুনলে তো, গদুমাস্টারের মেয়ের অসুখ। এখন বিপদে পড়ে টাকাটা চাইছে, পরে দিয়ে তো দেবেই!”
এইভাবেই চলছিল, কিন্তু একদিন হঠাৎ ছন্দপতন হল। দিনটা ছিল ১৯৯০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর।
সাধারণত মেয়ের পড়ার সময় সুলেখা বা কেউই ঘরে ঢোকেন না, কিন্তু সেদিন কী একটা কাজে সুলেখা ঘরে ঢুকলেন। আর ঢুকেই আঁতকে উঠলেন।
বইখাতা একদিকে হেলায় পড়ে আছে, রণধীর সোফায় সটান শুয়ে পড়েছেন।
সুলেখা হিমচোখে দেখলেন রণধীরের মাথাটা সুদীপার কোলে। সুদীপা হাসতে হাসতে মাস্টারমশাইয়ের মাথা টিপে দিচ্ছে।
সেদিন সুলেখা মেয়েকে বেদম মারলেন। ব্যাবসার কাজে কয়েক দিনের জন্য সুভাষবাবু তখন বাইরে গিয়েছিলেন, সুলেখা কাউকে কিছু বলতেও পারলেন না।
মারের চোটে সুদীপার গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেল।
পরেরদিন সেই দাগ দেখে শিউড়ে উঠলেন রণধীর, ”ইশ! এইভাবে কেউ মারে? তোমার মা কি মানুষ?” গালের দাগগুলোয় হাত বোলাতে লাগলেন তিনি।
সুদীপা সেদিন স্কুল যায়নি। স্কুলে যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে রণধীরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল একটা পার্কে। রণধীরের স্পর্শ পেয়ে ওর চোখে আবার জল চলে এল, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারল না।
”আমার ইচ্ছে করছে … আমার ইচ্ছে করছে তোমার মাকে পাহাড়ের ওপর নিয়ে গিয়ে ঠেলে ফেলে দিতে বুঝলে!” রণবীর বললেন, ”এইভাবে যে নিজের মেয়েকে অত্যাচার করে, তার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।”
”আমিও তাই চাই।” কেটে কেটে পরিষ্কার উচ্চারণে বলল সুদীপা, ”মা না মরলে আমাকে এইভাবেই জ্বালাবে।”
”শুধু জ্বালাবে, তাই নয়।” রণবীর বললেন, ”তোমার ভালো দেখতে পারে না ওই ডাইনি। দেখলে না, আশুতোষ মাস্টারকে কেমন পড়া থেকে ছাড়িয়ে দিল! আমাকেও আপ্রাণ চেষ্টা করছে ছাড়ানোর, নেহাত তোমার বাবা চান না বলে কিছু করতে পারছে না।”
সুদীপা মাথা নেড়ে সায় দিল। স্যার ঠিকই বলছেন। আশুতোষ চক্রবর্তী নামে একটা মাস্টারের কাছে সুদীপা পড়তে যেত। বাড়ি থেকে অনেকটা দূর বলে সাইকেল নিয়ে যেত। মা দুম করে ওই পড়াটা ছাড়িয়ে দিল। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, শেষের দিকে বেশ কয়েক দিন পড়ার নাম করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে সুদীপা পার্কে এসে রণবীর স্যারের সঙ্গে দেখা করেছে, কিন্তু সেটা তো আর মায়ের জানার কথা নয়!
মা নিশ্চয়ই চায় না সুদীপা মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করুক! রণধীর স্যারকে ছাড়ানোর কথা তো উঠতে—বসতে বাবাকে বলে। নেহাত বাবা বলেছে ছ—হাজার টাকাটা শোধ হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে, তাই কিছু করতে পারছে না।
”মা একটা শয়তানি। আমি ওকে শেষ করে দেব।” হাতের মুঠি শক্ত করে বলল সুদীপা।
এইভাবে আরও মাসদুয়েক কাটল। যত দিন যাচ্ছে, সুদীপা পুরোপুরি মাস্টারের বশবর্তী হয়ে যাচ্ছে। ও এখন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, এই পৃথিবীতে একমাত্র স্যারই ওর ভালো চায়, আর সবাই ওকে মারে, বকে। এমনকী স্যারের মাথা টেপার কথাটা মার থেকে শুনে বাবাও ওকে বকেছে।
এই বাড়িতে সবাই ওর শত্রু। সব্বাইকে ও শেষ করে দেবে!
এভাবেই ১৯৯০ সাল শেষ হল। একানব্বই সাল শুরু হতে—না—হতে একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটল।
জানুয়ারি মাসের আট তারিখে সক্কালবেলা পালবাড়ির সামনে এসে চেঁচামেচি শুরু করল রণধীরের স্ত্রী অলকা।
তার কানে অনেক দিন ধরে কানাঘুষো আসছে, দিনের পর দিন যেভাবে এখন সুদীপা আর রণধীর পার্কে, রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, গোটা তল্লাটেই গুঞ্জন উঠেছে বেশ।
অলকা অনেক দিন সহ্য করেছে, অবশেষে আজ একটা হেস্তনেস্ত করতে এসেছে।
অলকা বাড়ির সামনে এসে তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করে, ”নোংরা মেয়েছেলে! বাপের বয়সি মাস্টারকে নিয়ে নোংরামি করিস লজ্জা করে না? আর বাপ—মা—ই বা কেমনধারা? অমন মেয়েকে তো বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে হয়! নাকি বাপ—মা নিজেই মেয়েকে লাইনে নামিয়েছে …!” এমন হাজারো সব অশ্লীল গালিগালাজ।
পালবাড়ি এলাকায় ভদ্র শান্ত বলে বেশ সুনাম ছিল। সবাই রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেল। আশপাশের বাড়ি থেকে রীতিমতো উঁকিঝুঁকি মারা, ফিসফাস শুরু হল। সুলেখা তো রাগে লজ্জায় কাঁপতে লাগলেন।
”আর একবার এইসব নষ্টামি দেখি, বাড়ি এসে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে যাব। এইবয়সেই বেশ্যাগিরি …!”
সুদীপার ঠাকুমা সব জানলা দরজা বন্ধ করলেও কথাগুলো শেলের মতো এসে বিঁধছিল সবার কানে।
সুলেখা আর সহ্য করতে পারলেন না, সুভাষবাবুর একটা বেল্ট পড়েছিল সামনে, সেটা তুলে সপাসপ তিনি মারতে লাগলেন সুদীপাকে, ”অসভ্য মেয়ে! তোর জন্য এত বড়ো অপমান সহ্য করতে হল! মরে যা! মরে যা তুই এক্ষুনি!”
পরেরদিন গোটা ঘটনাটা সুদীপার মুখে শুনে রণধীর দাঁতে দাঁত চিপে বললেন, ”মরবে তো বটেই! তবে তুমি নও, তোমার শয়তান মা।”
সুদীপা তখনও ব্যথায় কোঁকাচ্ছিল।
রণধীর মাথা নেড়ে বললেন, ”আমার বউয়ের তো জানার কথা নয়, তোমার মা—ই তাকে ডেকে এনে পাড়ার মধ্যে নাটক করিয়েছে, যাতে তোমার চরম অসম্মান হয় পাড়ায়।”
সুদীপা দ্বিধাগ্রস্থ গলায় বলল, ”মা? কিন্তু মা তো তাহলে অত অবাক হয়ে গিয়ে আমাকে মারল …!”
”সব সাজানো নাটক। শোনো সুদীপা।” রণধীর শক্তগলায় বললেন, ”এরপরেও যদি তুমি এসপার—ওসপার না করো, তুমি তো শেষ হবেই—ওই ডাইনি সব ছারখার করে দেবে। এত অত্যাচারের পরেও তুমি যদি না প্রতিশোধ নাও, আমিও আর তোমার পাশে থাকব না।”
”প্রতিশোধ তো আমি নেবই!” শরীরের ফুলে ওঠা দাগগুলোয় হাত বোলাতে বোলাতে বলল সুদীপা, ”তুমি শুধু বলো কী করে খতম করব ওই মহিলাকে।”
”এক কাজ করো।” রণধীর বললেন, ”তোমার মা তো প্রেশারের রুগি, রোজ দুধের সাথে ওষুধ খায়। আমি তোমাকে ক্যাম্পোজ ট্যাবলেট এনে দেব, তুমি পঞ্চাশ—ষাটটা ট্যাবলেট ওই দুধে মিশিয়ে দেবে।”
”পঞ্চাশটায় কাজ হবে তো?” সুদীপা খরচোখে তাকায়।
”কী যে বলো। ওই ট্যাবলেট কুড়িটা খেলেই লোকে টেঁসে যায়, তো পঞ্চাশটা। তোমায় শুধু কায়দা করে মিশিয়ে দিতে হবে।”
”ঠিক আছে।” সুদীপা বলল, ”তুমি ট্যাবলেটটা দিও আমায়।”
রণধীর ওঠার আগে কী একটা মনে পড়তে পেছনে তাকালেন, ”ও ভালো কথা, বললে কিছু টাকা সরাবে, পেয়েছ কিছু?”
”হ্যাঁ, এই যে!” সুদীপা ফ্রকের ভেতর থেকে একতাড়া নোট বের করে দেয়, ”দাদু কাকে দেবে বলে তুলেছিল। পুরোটাই নিয়ে নিয়েছি। সকালে দেখলাম আমাদের কাজের ঝি—টার ওপর খুব চেঁচামেচি চলছে।”
কিন্তু দু—দিনের মধ্যেই রণধীর প্রায় ষাট—পঁয়ষট্টিটা ক্যাম্পোজ জোগাড় করে সুদীপাকে দিয়ে গেলেও সুদীপা শেষ অবধি দুধে মিশিয়ে উঠতে পারে না।
কোনো অনুশোচনা বা ওইজন্য নয়, যদি কেউ দেখে ফ্যালে!
ট্যাবলেটগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে এগোয় ও, কিন্তু এত ভয় করতে শুরু করে, শেষপর্যন্ত ছুটে চলে যায় নিজের ঘরে।
পরেরদিন রণধীর সব শুনে বিরক্ত হয়ে ওঠেন, ”তুমি যদি নিজে মনস্থির করতে না পারো, তাহলে আমার আর কিছু করার নেই। পাগলেও নিজের ভালো বোঝে সুদীপা! যে তোমার জীবনটাকে ছারখার করে দিচ্ছে, তার জন্য তোমার দরদ উথলে উঠছে নাকি?”
সুদীপা আজও স্কুল না—গিয়ে পার্কে এসেছে। মা আজ লুচি আলুরদম টিফিনে বানিয়ে দিয়েছিলেন, সঙ্গে সুদীপার প্রিয় ঘরে বানানো ক্ষীর। সেটা খেতে খেতে ও বলল, ”দরদের কোনো প্রশ্ন উঠছে না স্যার। কিন্তু প্রচণ্ড ভয় করছে। যদি মেশাতে গিয়ে কেউ চলে আসে …!”
রণধীর বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করলেন মুখ দিয়ে। নাহ, এভাবে হবে না। যা করার ওঁকেই করতে হবে। এই মেয়েটা কতদিন বাগে থাকবে তার ঠিক নেই, সুযোগটা হারালে পরে হাত কামড়াতে হবে।
স্থানীয় এক স্কুলের কেমিস্ট্রির ল্যাবরেটরির অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল কৃষ্ণেন্দু জানা। স্কুলের চাকরির পাশাপাশি সে কেমিক্যালস সাপ্লাইয়ের বিজনেসও চালায়। সে আবার রণধীরের ছোটোবেলার বন্ধু।
রণধীর সব ভেবেচিন্তে কৃষ্ণেন্দুকেই গিয়ে ধরলেন। সুদীপার কাছ থেকে হাতানো একটা আংটি তাকে দিয়ে বললেন, ”আসল কাজটা হলে তোকে আরও অনেক কিছু দেব।”
”কী করতে হবে আমাকে?” কৃষ্ণেন্দু আংটিটা হাতে নিয়ে ওজন বোঝার চেষ্টা করে।
”তোকে ক—টা জিনিস জোগাড় করে দিতে হবে। কিছু সায়ানাইড আর ক্লোরোফর্ম।”
”ওরে শালা!” কৃষ্ণেন্দু চমকে ওঠে, ”বলিস কী! এসব তো মারাত্মক ব্যাপার! ল্যাবে কোথায় পাব। বানাতে হবে তো!”
”বানাতেই তো বলছি তোকে।” রণধীর গলা নামিয়ে বলেন, ”বুঝতে পারছিস না কেন, আংটিটা স্রেফ টোকেন, পুরো জুয়েলারির দোকান রয়েছে মেয়েটার বাড়িতে। কাজ হাসিল হলেই সব আমি আর তুই ভাগাভাগি করব।”
আগেই বলেছি, সুদীপা ছিল তার বাবা—মা, দাদা—ঠাকুমার নয়নের মণি। ছোটো থেকে ঠাকুমা আর মা দু—জনেই সুদীপার নাম করে অনেক গয়না গড়াতেন যেগুলোর কিছু থাকত ঠাকুমার আলমারিতে, কিছুটা মার কাছে। সুদীপা সব গয়নার খোঁজ রাখত। সে—ই সব বিস্তারিত বলেছিল রণধীরকে।
এরপর শুরু হল পরীক্ষানিরীক্ষা। দিন কয়েক কৃষ্ণেন্দু আর রণধীর মিলে নানারকম মিক্সচার এদিক—ওদিক করে তৈরি করল মারকিউরিক ক্লোরাইড আর সোডিয়াম সায়ানাইড। এ ছাড়া জোগাড় করা হল ক্লোরোফর্ম।
প্ল্যানমাফিক ২০ মার্চ সকালবেলা স্কুল যাওয়ার নাম করে সুদীপা বেরিয়ে গিয়ে দেখা করল রণধীরের সঙ্গে। তারপর দু—জনে মিলে শ্যামবাজারের কেসি দাশের দোকান থেকে মিষ্টি কিনতে গেল।
”কালোজাম নাও, ওটা খেতেই মা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।” শোকেসের কাঁচে আঙুল ঠেকিয়ে বলল সুদীপা।
অতএব বেশ কিছু কালোজাম আর এক প্যাকেট সীতাভোগ কেনা হল। তারপর রণধীর সুদীপাকে নিয়ে গেলেন পাশের এক রেস্তরাঁয়।
পর্দাঢাকা কেবিনে বসে দু—প্লেট গরম বিরিয়ানি অর্ডার দিয়ে রণধীর একটা সিগারেট ধরালেন, ”যা বলেছি সব মনে আছে তো?”
”হ্যাঁ।” সুদীপা উত্তর দেওয়ার সময় অজান্তেই গলাটা কেমন কেঁপে গেল।
”একটা কথা ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নাও সুদীপা। তোমার নিজের জীবনটা বাঁচাবার সুযোগ কিন্তু আজই শেষ। ওষুধ খাওয়ানোর দিনের মতো ঝোলালে কিন্তু আমি কোনোদিনও আর তোমার সঙ্গে দেখা করব না।” সিগারেটের লম্বা ধোঁয়া ছাড়লেন রণধীর, ”সে তুমি সারাজীবন ওই নরকে পচে মরে যাও, আমার আর কিছু করার থাকবে না। কারণ তোমাকে বাঁচানোর আমি অনেক চেষ্টা করেছি।”
সুদীপা আর্তনাদ করে উঠল, ”এসব বোলো না। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে …!” কথাটা কল্পনা করতেই ও আর স্থির থাকতে পারলো না, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল বড়ো বড়ো দুটো জলের ফোঁটা।
”তবে যা যা বলেছি ঠিকমতো কোরো যেন!” রণধীর আর অপেক্ষা করলেন না, বেয়ারা ইতিমধ্যেই বিরিয়ানি দিয়ে পর্দা নামিয়ে চলে গেছে।
কাজটা এখনই সেরে ফেলতে হবে।
তিনি পকেট থেকে ছোটো দুটো শিশি বের করলেন, দুটোতেই রয়েছে সেই মারাত্মক বিষ। কালোজাম আর সীতাভোগ বের করে তাতে ভালো করে মাখালেন বিষের গুঁড়োগুলো।
সুদীপা ঠোঁট কামড়াল, বিভিন্ন সময় মার প্রহার ওর মনে পড়ছিল। ও একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, ”কালোজামগুলোয় পুরু করে লাগাও।”
কাজটা হয়ে গেলে সুদীপা বলল, ”তুমি ভাবছ তুমি একাই এসব পারো? আমি কিছু পারি না? এই দ্যাখো!” কথাটা বলেই ও স্কুলের ব্যাগ থেকে একটা বড়ো জলের বোতল বের করল। বোতলটা টেবিলের ওপর রেখে মিটিমিটি হাসল ও।
”কী এটা?” রণধীর ভ্রূ কুঁচকে বললেন।
”ঘরে দুটো টিকটিকি ছিল। সেদুটোকে ভালো করে এই জলে ফুটিয়েছি। জানো না, টিকটিকিসেদ্ধ জল মারাত্মক বিষ?” সুদীপা তির্যক হাসল, ”তোমার প্ল্যান বাতিল হলে এইটা অ্যাপ্লাই করব।”
”ওয়াহ! দারুণ তো!” চমৎকৃত রণধীর বন্ধ কেবিনে মুহূর্তে কাছে টেনে নিলেন সুদীপাকে।
সুদীপা যখন বাড়ি ফিরল, তখন বিকেল সাড়ে চারটে। কেউ কিছু বলল না, এমনিতেও এই সময়েই ও বাড়ি ফেরে স্কুল থেকে।
বাড়িতে পা দিয়েই ওর মনটা খারাপ হয়ে গেল।
সেদিন স্যারের বউ এসে চেঁচিয়ে যাওয়ার পর থেকে দাদু—ঠাম্মাও ওর সঙ্গে ভালো করে কথা বলছেন না। বসার ঘর দিয়ে যাওয়ার সময় ঠাম্মার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ঠাম্মা গম্ভীরগলায় বললেন, ”মোহনভোগ বানিয়েছি তোর জন্য। মিটসেফে আছে।”
সুদীপার রাগে মাথায় ভেতরটা আগুন হয়ে গেল। আগে ঠাম্মা নিজের হাতে এসে ওকে খাইয়ে দিতেন, আর এখন?
একমুহূর্তের জন্য ওর মনে হল, শুধু মা নয়, আসলে মা—বাবা, দাদু—ঠাম্মা কেউই আর ওকে ভালোবাসে না। এই পৃথিবীতে স্যার ছাড়া আর কেউ ওর আপনার বলতে নেই।
পরিকল্পনামাফিক রণধীর এলেন প্রায় আটটা নাগাদ। বাড়ি থেকে আসার আগে তিনি আরেকপ্রস্থ বিষ মাখিয়ে নিয়েছেন মিষ্টিগুলোর গায়ে। এসেই তিনি সটান সুদীপার ঘরে উঠে গেলেন।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার আগে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে সুদীপার মাকে বললেন, ”বউদি, একটা বিশেষ কারণে আজ এলাম। একটু ওপরে আসবেন? আমি ওপরে গিয়ে বসছি।”
গত কয়েকটা ঘটনার পর থেকে সুলেখা রণধীরের সঙ্গে কোনো বাক্যালাপ করতেন না। তবু রাগ চেপে তিনি বললেন, ”আপনি যান। আমি আসছি।”
রণধীর উপরে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই এলেন সুলেখা। হাতটা আঁচলে মুছতে মুছতে বললেন, ”কী ব্যাপার?”
সুদীপার মুখটা থমথম করছিল। সে অন্যদিকে মুখ ফেরাল।
রণধীর গদগদ হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ”বউদি, যা হয়েছে সব ভুলে যান। জানি আমি অনেক অপরাধ করেছি, কিন্তু আর রেগে থাকবেন না। আমি কালই কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছি।”
সুলেখা অবাক হয়ে বললেন, ”চলে যাচ্ছেন?”
”হ্যাঁ।” একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রণধীর বললেন, ”একটা মাঝারিগোছের চাকরি পেয়েছি। এখানে আর সংসার টানতে পারছি না। তাই ভাবলাম যাওয়ার আগে ভুল বোঝাবুঝিটা মিটিয়ে যাই। এই নিন।” রণধীর মিষ্টির প্যাকেটটা খুলে একটা কালোজাম এগিয়ে ধরলেন, ”চাকরি পাওয়ার আনন্দে শুধু নয়, সমস্ত মনকষাকষি মিটিয়ে নিতে মিষ্টি নিয়ে এলাম। আর হয়তো কোনোদিন দেখা হবে না।”
এমন অপ্রত্যাশিত ব্যবহারে সুলেখা প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেন। তারপর একটু হাসার চেষ্টা করে মিষ্টিটা হাতে নিতে নিতে বললেন, ”ও এত খুব ভালো কথা! আপনি বসুন …!”
সুলেখা মিষ্টিটা মুখে পুরতেই ঘরের দরজায় সুদীপার বাবা সুভাষবাবুর গলা শোনা গেল, ”কী ব্যাপার?”
”রণধীরবাবু চাকরি পেয়েছেন, এখান ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তাই মিষ্টি খাওয়াতে এসেছেন।” সুলেখা চিবোতে চিবোতে বললেন।
সুদীপা আর রণধীরের চোখাচোখি হল। সুদীপার বাবা যে এমন অপ্রত্যাশিতভাবে চলে আসতে পারেন, সেটা কারুর মাথাতেই আসেনি।
রণধীর সিদ্ধান্ত নিতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেন। তারপর ওই একই কথা হাসিমুখে বলতে বলতে সুভাষবাবুর মুখে ঢুকিয়ে দিলেন আরেকটা কালোজাম।
সুদীপা কয়েকমুহূর্ত ইতস্তত করল, তারপর মৃত্যু নিশ্চিত করতে নিজের বানানো সেই টিকটিকিসেদ্ধ বিষাক্ত জল ঢেলে দিল বাবা—মার মুখে।
কয়েক মিনিট মাত্র।
সুদীপার বাবা—মা দু—জনেই মাটিতে পড়ে গিয়ে ছটফট করতে লাগলেন। দু—জনেই যেন লম্বা লম্বা শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না।
যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে তাঁদের শরীর!
অতিকষ্টে সুভাষবাবু বলতে পারলেন, ”দীপা … দীপা, তোরা এটা কী করলি? ক—করতে পারলি? আ—আমি তোকে এত …” কথাটা আর শেষ করতে পারলেন না তিনি, তার আগেই ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে।
সুলেখা তৎষণে জ্ঞান হারিয়েছেন। অচেতন অবস্থাতেই তাঁর প্রাণবায়ু ধীরে ধীরে নিভে আসছে।
ওদিকে রণধীরের স্ত্রী চিৎকার করে যাওয়ার পর থেকে রণধীর এই ক—দিন একবারও এবাড়ি আসেননি, আর আজকে এসেই ওপরে চলে গেল, তারপর ছেলে—বউমা দুজনেই ওপরে গিয়ে আর কোনো সাড়াশব্দ নেই, সুদীপার দাদু—ঠাকুমার কেমন যেন সন্দেহ হয়েছিল।
দু—জনকেই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসতে দেখে সুদীপা রণধীরের দিতে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, ”এবার?”
ঘরের মধ্যে দুটো তাজা মৃতদেহ পড়ে রয়েছে।
রণধীরও ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন, ”একই কাজ করতে হবে এদের সাথেও।”
দাদু আর ঠাকুমাকে ঘরে ঢুকতেই দেওয়া হল না, ছেলে—বউমার মৃতদেহ দেখতে পাওয়ার আগেই তাদের মুখে পুরে দেওয়া হল সেই কালান্তক কালোজাম আর সীতাভোগ। শেষে সুদীপা ঢেলে দিল প্রাণঘাতী সেই জল।
দু—জনেই বয়স্ক, এঁদের হৃদপিণ্ড আরও তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে গেল।
পুরো ঘটনাটা যেন ঘটে গেল রুদ্ধশ্বাস এক নাটকের মতো।
সুদীপা আর রণধীর দু—জনেই যখন নিশ্চিত হলেন, চারটে মানুষই লাশে পরিণত হয়েছে, তখন রণধীর বললেন, ”শোনো, আসল কাজ কিন্তু এখনই। আমি তোমাকে বেঁধে রেখে যাচ্ছি। তারপর যেমনটা বলেছি তেমনটা করবে। মনে আছে তো?”
”হ্যাঁ, সব মনে আছে।” সুদীপা লাশগুলো টপকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তার স্যারকে।
আহহ! আর কারুর কিছু বলার নেই। আর কেউ নেই ওর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার মতো। এখন সে আর স্যার যা—খুশি তাই করতে পারে।
”গুড! এবার পুরো জায়গাটাকে ডাকাতিতে কনভার্ট করতে হবে।” রণধীর পকেট থেকে একগোছা তামার তার বের করলেন। সেই তারগুলো প্রতিটা লাশের গায়ে ভালো করে পেঁচিয়ে দিয়ে কানেক্ট করে দিলেন প্লাগপয়েন্টের সুইচের সাথে।
ওদিকে সুদীপা এতদিন যেটার নাগাল পায়নি, মায়ের সেই আলমারি খুলে গয়নাগাটি, টাকাপয়সা সব বের করে ফেলল, তারপর স্যারের কথামতো সব ঘরগুলো লণ্ডভণ্ড করল।
ডাকাত এসেছিল বলে কথা! ঘর কি সাজানোগোছানো থাকবে নাকি!
গয়নাগাটি আর টাকাপয়সাগুলো রণধীর পকেটে পুরে সুদীপাকে প্ল্যানমাফিক পিছমোড়া করে কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেললেন, তারপর মুখে একটা ন্যাকড়া গুঁজে বসার ঘরের সামনেটা ফেলে রেখে বেরিয়ে গেলেন।
রণধীর বেরিয়ে যাওয়ার মিনিটদশেক পর থেকে সুদীপা প্রাণপণে গোঙাতে শুরু করল। ন্যাকড়া গোঁজা মুখে সে চিৎকার করছিল শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে।
রাত প্রায় সোয়া বারোটার সময় প্রতিবেশী রবীন্দ্রনাথ পাল আরও কজন পাড়ার লোক নিয়ে দেখতে এলেন ব্যাপারটা কী। অনেকক্ষণ থেকেই তাঁরা শব্দ পাচ্ছিলেন, কিন্তু কোথা থেকে আসছে ঠিক ঠাহর করতে পারছিলেন না।
সুদীপাকে এই অবস্থায় দেখে তাঁরা হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। সুদীপাকে তাড়াতাড়ি সব ফাঁস থেকে মুক্ত করা হল। সে তখন অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল।
বাড়ির এই ভয়ংকর অবস্থা দেখে সবাই একটুও কালবিলম্ব না—করে পুলিশে খবর দিলেন। কীভাবে ডাকাতরা বাবা—মা, দাদু—ঠাকুমাকে মেরেছে, টাকাপয়সা, গয়নাগাটি সব নিয়ে গেছে, কীভাবে ওকে এরকম করে বেঁধে রেখে গেছে, কিচ্ছু বাদ দিল না ও। বলতে বলতে দুঃখে আতঙ্কে কেঁদে ফেলল পঞ্চদশী সুদীপা।
কিন্তু যতই অভিনয় করুক, পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে পারাটা কি অতটাই সোজা? ডাকাতরা সবাইকে মারল, অথচ সুদীপাকে কেন ছেড়ে গেল, সেটাই পুলিশের প্রধান খটকা হয়ে দাঁড়াল। সাথে রণধীর বসুর সাথে সম্প্রতি চলা চাপানউতোরও তাদের কানে এল।
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসতেই সেই সন্দেহ বহুগুণ বেড়ে গেল। কারণ দেখা গেল ওই তামার তারগুলো স্রেফ দেখানোর জন্য জড়ানো ছিল, প্রতিটা মৃত্যু হয়েছে বিষক্রিয়ায়।
কোথা থেকে এল এই বিষ?
কে মেশাল?
অবশেষে ওই মর্মান্তিক খুনগুলোর প্রায় ছ—মাস পর ৯ অক্টোবর পুলিশ অ্যারেস্ট করল সুদীপা আর রণধীরকে।
ধরা পড়ল কৃষ্ণেন্দু জানাও।
সে জেরায় কবুল করল, রণধীরের কথামতো কীভাবে সে বিষ বানিয়েছে, বানিয়ে তা গিনিপিগের ওপর পরীক্ষা করেছে, করে তুলে দিয়েছে রণধীরের হাতে।
পুলিশ রণধীর আর সুদীপার বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় 302/34/120B/201/ IPC রুজু করল। আর কৃষ্ণেন্দুর বিরুদ্ধে 302/120B/109 IPC।
এই হল ১৯৯১ সালের নোয়াপাড়া হত্যাকাণ্ড।
কিন্তু, এই কাহিনির একটা দ্বিতীয় পর্ব আছে। সেটাও কিছু কম চমকপ্রদ নয়।
জেল কাস্টডিতে থাকার সময়েই সুদীপা জড়িয়ে পড়ল বয়স্ক এক পুলিশকর্মীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে। আর সেই পুলিশকর্মীই তাকে বুদ্ধি দিল, ”তুমি রাজসাক্ষী হয়ে যাও। হয়ে আদালতকে সব খুলে বলো। ওরা শাস্তি পাবে, কিন্তু তুমি ছাড়া পেয়ে যাবে।”
ওইবয়সেই সুদীপার বুদ্ধি কেমন ছিল, তা আশা করি আর বোঝাতে হবে না। আদালতকে সে জানাল, ”আমি স্বীকারোক্তি করতে চাই।”
ওদিকে রণধীর আর কৃষ্ণেন্দু তখনও নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেনি, সুদীপা অ্যাপ্রুভার হতে রাজি হয়ে যাওয়ায় পুলিশের কাজ অনেক সহজ হয়ে গেল। সুদীপা পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল। দিনের পর দিন তার অবৈধ প্রেম, মার সঙ্গে রাগ—অভিমান কিছুই বাদ দিল না।
অতএব আদালতের নির্দেশে রণধীর বসুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল। আর নাবালিকা, তায় অ্যাপ্রুভার হওয়ায় সুদীপা বেকসুর খালাস পেল।
সুদীপার ছাড়া পাওয়ার ঘটনায় সেইসময়েই অনেকেই খুব ক্ষিপ্ত হয়েছিল। এই নিয়ে বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন আন্দোলনও হয়েছিল। যে নিজের স্নেহময় বাবা—মা—দাদু—ঠাকুমাকে এইভাবে ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে খুন করতে পারে, তাকে কোন যুক্তিতে ছাড়া হল; এমনকী তাকে সংশোধনাগারে পর্যন্ত পাঠানো হল না।
অথচ সেইসময়েরই আরেক কীর্তিমান কিশোর সজল বাড়ুই বাবা মা—কে হত্যার দায়ে জেল খাটছিল। সুদীপা মেয়ে বলেই কি তাকে ছাড়া হল? দেশের বিচারব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়েও উঠল অনেক প্রশ্ন।
শোনা যায়, সুদীপার মুক্তি পাওয়ার পেছনে তার সেই ক্ষণস্থায়ী প্রেমিক পুলিশটিরও হাত ছিল।
তবে সুদীপা বেশিদিন সেই বয়স্ক প্রেমিককে পাত্তা দেয়নি। জেল কাস্টডিতে থাকার সময় পুলিশ ভ্যানে আসাযাওয়ার সময় রাজু নামে একটা আসামির সাথে তার আবার প্রেম হয়ে যায়। সেই রাজু তখন ডাকাতির দায়ে জেল খাটছে।
ছাড়া পেয়ে সে রাজুর সাথে চলে যায় কোথাও। গিয়ে সংসার পাতে।
যাইহোক, এবার আসি কাহিনির উপসংহারে।
মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী ২০১২ সালে রাজ্যের বেশ কিছু যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে মুক্তি দিয়েছিলেন।
তার মধ্যে ছিলেন রণধীর বসুও। টানা কুড়িবছর জেল খেটে মুক্তি পান তিনি। জেলে তাঁর ট্র্যাকরেকর্ড ছিল অত্যন্ত ভালো। লালগোলা মুক্ত সংশোধনাগারে বসে তিনি জেলে কোচিং চালাতেন। তাঁর কাছে পড়ে অসংখ্য আসামি মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছিল।
রণধীর যখন ছাড়া পান, তখন এক প্রথম সারির সংবাদপত্র দুজনেরই বর্তমান অবস্থা নিয়ে একটা এনকোয়ারি রিপোর্ট করেছিল।
তখনই জানা গিয়েছিল, রণধীরের বাড়িতে তখন দারিদ্র্য চরমে। তরুণী কন্যাকে নিয়ে হিমশিম খান স্ত্রী অলকা। তবু তিনি চান স্বামী ফিরে আসুক।
”আমার স্বামী সত্যিকারের শিক্ষক। তিনি জেলেও অজস্র ছাত্র তৈরি করেছেন। যে আসল দোষী, তাঁর কিছু হল না, আর উনি কিনা …!”
আর সুদীপা পাল?
তাকে সেই সংবাদপত্র খুঁজে পেয়েছিল বারুইপুরের একটাবাড়ির একতলার ভাড়াটে হিসেবে; তিনি তখন বোরখা পরিহিতা। এখন তিনি মুসলিম একজনকে বিয়ে করেছেন। পাড়া বা বাড়িওয়ালা কেউই তাঁকে ‘সেই সুদীপা’ নামে চেনেন না। তাঁর ধর্মান্তরের পর নামও এখন পালটে গেছে।
”আমার কিচ্ছু বলার নেই, একটাও ছবি তুলবেন না।” কর্কশগলায় কথাগুলো বলে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি।
জীবন সত্যিই বড়ো বিচিত্র!