1 of 2

সাতভূতুড়ে – মহাশ্বেতা দেবী

সাতভূতুড়ে – মহাশ্বেতা দেবী

ফল্গু যে বড়ো হতে না হতে অমন গল্পবাজ হবে, তা আগে কেন বুঝিনি এখন তাই ভাবি। সবসময়ে ওর জীবনে তাজ্জব সব ঘটনা ঘটত আর আমাদের গল্প বলত। সে সব কি সত্যি, তাও আর জানা যাবে না। ওর ঠিকানাটা তো দিয়ে যায়নি, যে গিয়ে জিগ্যেস করব।

ওষুধ কোম্পানির কাজ নিয়ে যখন পাটনা গেল, তখন তো ওকে সমানে ঘুরতে হত। তখন নাকি অবধলাল বলে একটা লোককে নিয়ে সে ঘুরত। অবধলাল সঙ্গে থাকলে গাঁজা খাবে, পূর্ণিয়া বললে মতিহারির টিকিট করবে, নোট হাতে পেলে খুচরো ফেরত দেবে না, তবু ওকে সঙ্গে রাখা চাই।

কেন রাখা চাই?

আহা! বুঝলে না! কোন বাড়িটায় বিদেহীদের বাস, কোন রাস্তায় সন্ধের পর ডাইনি ঘোরে, এসব বিষয়ে ওর একটা ব্যাপার আছে।

তাতে তোর কি?

তুমি কি বুঝবে? কত জায়গা ঘুরতে হয়। কখন কোথায় গিয়ে ফেঁসে যাব, এই তো সেবার…

কি হয়েছিল?

কাজে নয়। কাজ সেরে বেড়াতেই গিয়েছিল ফল্গু। ডালটনগঞ্জের কাছাকাছি কোন একটা জায়গায় পেয়ে গেল জঙ্গল বাংলা। চৌকিদার নাকি বলে দিল, জল—টল তুলে দিয়ে, খানা বানিয়ে দিয়ে ও চলে যাবে। রাতে ও থাকবেই না।

ঘর দুটো। দুটো ঘরই ফাঁকা। লোক নেই। দু—কামরাতেই নেয়ারের খাট। চেয়ার টেবিল আছে। অবধলাল ফল্গুকে কিছুতেই ভালো ঘরটায় থাকতে দিল না। ছোটো ঘরটায় দুজনে থাকব।

কেন রে?

অবধলাল শুধু বলে, ও ঘরে থাকবেন কী দাদা, পরিষ্কার দেখলাম ঘরে স্বামী—স্ত্রী বসে আছে।

ফল্গু তো কিছুই দেখেনি। কিন্তু বাইরে তখন বিকেল শেষ হচ্ছে। হেমন্তের বিকেল! বাতাসটা ঠান্ডা হচ্ছে। চারদিকে জনমানব নেই। এ সময়ে অবধলালের কথা অমান্য করতে গেলে অবধলাল তুলকালাম কাণ্ড বাধাবে।

অবধলাল চোখ মটকে বলল, ব্যাপারটা বুঝলেন না? ওই যে চৌকিদার, ও কেন রাতে থাকে না? ও ঘরে কারা বসে আছে, তা তো ও জানে। কেন বসে আছে, সেটাই দেখতে হবে।

ফল্গু তো দেখেছে কামরা জনশূন্য, জানলা বন্ধ, অবধলাল কি তা মানে? ও চোখ মটকে বলল, রাতে খেয়ে দেয়ে আপনি ঘুমোন, আমি দেখি ওরা কী করে। ওঃ মেয়েটা ছেলেমানুষ। ভয়ও পেয়েছে খুব, লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে বসে আছে।

ফল্গু ধমকে বলল, আমি ভিতু মানুষ। আমি ওর মধ্যে নেই। তুমি দরজা বন্ধ করে দাও মাঝখানের।

দাদা! অবধলাল থাকতে আপনার কাছেও কেউ আসবে না, কোনো অনিষ্ট করবে না। আমিও ওদের চিনতে পারি, ওরাও আমাকে চিনতে পারে।

এসব চেনাচেনির কথা সন্ধের মুখে কি ভালো লাগে? চৌকিদারটা এ সময়ে তেল ভরা দুটো লণ্ঠন জ্বেলে রেখে গেল। তারপর ঢেঁড়স দিয়ে ডিমের ডালনা, রুটি আর জলের কলসি রেখে গেল ঘরে। বলে গেল, সাবধানে থাকবেন বাবু, রাতে বাইরে বেরোবেন না।

ফল্গুকে আর দু—বার বলতে হল না। ঢেঁড়স দিয়ে ডিমের ডালনা কে কবে খেয়েছে বলো? তা ফল্গুবাবুর কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে ও ছাপরায় অড়হর ডাল আর পিঁপড়ের ডিমের মোগলাই কারি (অবধলালের রান্না), গৈরীপুরে আলু আর আটার গোলাসেদ্ধ (ওর রান্না), মজঃফরপুরে কামরাঙা দিয়ে পাবদা মাছের ঝোল (অবধলালের রান্না) খেয়েছে। এসব কথার সত্যি আর মিথ্যে জানা যাবে না। কেননা অবধলালও ফল্গুর উধাও হবার সময় থেকেই উধাও।

সত্যি বলতে কি, অবধলালকে আমরা চর্মচক্ষে আজও দেখিনি। ও আরেকটা ফল্গুবাবুকে খুঁজছে। যাকে পেলে তার সঙ্গে জুটে যাবে।

রাতে তো ফল্গু খুব ঘুমোল। সকালে উঠে দেখে অবধলাল চৌকিদারকে খুব চোটপাট করছে।

ব্যাপার তো কিছুই নয়। লোকটা ওই আওরতকে খুন করেছিল। নিজেও খুদকুশি (আত্মহত্যা) করে। তা তুমি এ কামরায় কোনো বন্দোবস্ত করোনি কেন?

কি করব বাবু!

অবধলাল থাকতে ভাবনা?

অবধলাল তার ঝোলা থেকে কী একটা জড়িবুটি বের করল। ঘরের দেয়াল ফুটো করে পুঁতে দিল। ওগুলো নাকি ভূত তাড়াবার মোক্ষম ওষুধ।

ফল্গুরা যখন ট্যুর সেরে ফিরেছে, সেই চৌকিদার তো অবধলালকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম। না না সে দুটো ভূত আর আসছে না। তবুও ভূতুড়ে ঘর শব্দটা চৌকিদার চালু রেখেছে।

কেন?

চৌকিদার খৈনি মুখে দিয়ে বলল, চৌকিদারিতে আর কি মিলে বাবু! এখন আমরা মাঝে মাঝে ও ঘরে একটু জুয়া সাট্টা খেলি। ধরম পথে পয়সাও কামাই হয় দুটো।

পুলিশ জানে?

পুলিশের সঙ্গেই তো খেলি বাবু। এ আপনারা খুব বড়ো কাজ করলেন। পাবলিকের ডাক বাংলো। এখন পাবলিকের কাজে লাগছে। সবাই অবধলালজীকে খুব আশীর্বাদ করছে। তবে কি বাবু! কামরায় তো ঢুকতে পারে না। রোজ ওই তেঁতুল গাছে বসে দুজনে খুব ঝগড়া করে।

তা করুক না। ও বেচারীরা যায় কোথায়। ভূত বলুন, পিশাচ বলুন, ওদের তো থাকার জায়গা চায়। আমার গ্রামেই তো ডাক্তারবাবুর বউ যখন ভূত হয়ে গেল, কেবল সাবান চুরাত, কুয়াতলায় চান করত, আমিই তো তার ব্যবস্থা করে দিলাম। এখন সে পুকুরপাড়ে বেলগাছে থাকে। রোজ একটা সাবান মেখে স্নান করে।

ফল্গু বলল, তবে যে শুনি গয়াতে গেলে…

অবধলাল ফচফচ করে হাসল। বলল, গয়াজীতে গেলেও বাবু! ভূতের মধ্যে যারা গিটগিটা আর পিচপিচা, তাদের মুক্তি হয় না।

সে আবার কী?

সে আপনি বুঝবেন না। সবচেয়ে পাজি হল কিরকিচা ভূত। গ্রামের ঝগড়াটি মেয়েছেলেরা কিরকিচা ভূত হয়। তবে হ্যাঁ, বহুত কাজও করে।

কীরকম?

এই আমার মা আর পিসিকে দেখুননা। গ্রামে ঝগড়া লাগলে সবাই ওদের নিয়ে যেত। ওদের মতো গাল দিতে আর ঝগড়া করতে কেউ পারত না। এই যে দুজনে মরে গেল মেলায় গিয়ে কলেরা হয়ে, এখনও কত কাজ করে। বাপ রে বাপ!

কী করে!

সন্ধে হলেই আসবে, ঘরের চালে বসবে, আর বাবাকে, আমার সৎমাকে বাড়ির সকলকে গাল দেবে। কে ঠিকমতো কাজ করেনি। বাবা মাঠে গিয়ে কাজ না করে ঘুমোচ্ছিল কেন, বউরা কেন ঝগড়া করেছে, বাসনে কেন এঁটো থাকবে, কাপড়ালত্তা কেন সাফ হয় না— এই নিয়ে এক ঘণ্টা গাল দেবে, তারপর চলে যাবে।

এ তো সর্বনেশে কথা!

অবধলাল ক্ষমার হাসি হাসল। বলল বাবুজী! কিরকিচা ভূত না থাকলে কোনো গ্রামে শান্তি থাকে না। মেয়েছেলেরা সবচেয়ে বেশি ঝগড়া করে। কিরকিচারা গিয়ে ডবল তিন ডবল গালি দিয়ে সবাইকে ঠান্ডা রাখে। বাপ রে! আমার বাবা বলছিল গয়াজীতে যাব। তাতে মা আর পিসিমা গয়াজী গিয়ে এমন গাল দিতে থাকল যে পাণ্ডাজী বাবাকে লাঠি দিয়ে পিটাল। তুমি কিরকিচার পিণ্ড দিতে এসেছ?

চৌকিদারও বলল, হাঁ হাঁ, কিরকিচা প্রতি গ্রামে থাকা খুব দরকার।

ফল্গুর মুখে গল্প শুনে আমাদের খুব ইচ্ছে হয়েছিল একটা কিরকিচা ধরে আনি। মায়ের পুষ্যি যত পাড়ার বাজখেঁয়ে মেয়েছেলে, তারা কি কম ঝগড়া করত?

সাতভূতুড়ে বাড়িতে অবশ্য ও ভূতের বাড়ি জেনে যায়নি। দুমকা ছাড়িয়ে অনেক দূরে কোথায় রাজবাড়ি পোড়ো হয়ে আছে, তাই দেখতে গিয়েছিল।

বাড়িটা দেখিয়ে দিয়েই দুমকার বন্ধু কমলবাবু বলল, আজ চোখে দেখুন, তারপরে সকালে এসে ভালো করে দেখবেন ঘুরে ঘুরে।

সাপের ভয়?

শীতকালে সাপের ভয়?

বদলোকের আড্ডা আছে?

না মশাই। আসলে…

অবধলাল তো মহা খুশি। কি ব্যাপার বাবু? ভূত আছে নাকি? গিটগিটা না পিচপিচা?

সে আবার কী?

বাবুজী জ্যান্ত মানুষের জাত আছে, ভূতের জাত নেই? গিটগিটা, পিচপিচা, কিরকিচা, কত জাতের ভূত আছে তা জানেন?

না বাপু, আমি জানতেও চাই না।

কি আছে ওখানে?

সবাই বলে সাতটা ডাকাত এ তল্লাটে খুব তরাস তুলেছিল। তা রাজবাড়ির একটা কামরায় ডাকাতির মাল ভাগ করতে গিয়ে মারামারি করে সাতটাই মরে। তারাই ও ঘরে দাপাদাপি করে।

মনে হচ্ছে গিটগিটা।

ডাকাতির মালের লোভে যেই গেছে সেই মারা পড়েছে। কেউ যায় না।

অবধলাল বলল, তাহলে তো থেকে যেতে হয়। আমার নাম অবধলাল। আমি সাতটাকেই তাড়াব।

কমলবাবু বললেন, আমি ওর মধ্যে নেই।

গ্রামের লোকেরা খুশি। বাপরে, রাজবাড়ির বাগান তো এখন জঙ্গল। ভয়ের চোটে কেউ কুলটা আমটা আনতে যাই না। ভূতগুলো তাড়াও বাবু। আমাদের ঘরে আজ থাকো। খাও দাও আরাম করো।

কমলবাবুও থেকে গেলেন। ও বাড়িতে উনি ঢুকবেন না। কিন্তু তামাশা তো দূর থেকেও দেখা যায়।

মাহাতোদের গ্রাম। ফলে মুরগি, ভাত, জবর খাওয়া হল।

পরদিন অবধলাল আর ফল্গু বাড়িতে ঢুকল। একেবারে পোড়ো বাড়ি। দোতলা দিয়ে বটগাছ উঠেছে বড়ো বড়ো।

একতলায় দুটো ঘর তবু থাকার মতো। অবধলাল বড়ো ঘরটা দেখিয়ে বলল, ওখানেই বেটাদের আড্ডা।

সে ঘর যেমন ধুলোপড়া, তেমনি বড়ো। কোণের দিকে একটা কাঠের সিন্দুক।

আরে আরে দেখুন!

কী দেখব?

জানালা দিয়ে দেখুন।

জানালার নীচে বেশ বড়ো একটা খাত। পাশে একটা গাছ।

ওর মধ্যে কিছু আছে বোধহয়।

পাশের ঘরটা সাফসুতরো করল অবধলাল। গ্রাম থেকে চাটাই আনল, বালিশ তেলভরা লণ্ঠন, কুঁজো বোঝাই জল। সন্ধের মুখে বলল আমি তো চললাম। আপনার ডর লাগে তো আপনি থেকে যান গ্রামে।

ফল্গু বলল, মোটেই না, আমিও যাব।

লোকগুলোর লাশ কোথায় গেল?

মাহাতোরা বলল, সে তো সে সময়েই পুলিশ নিয়ে যায়। পুলিশ ডাকাতির মালও খোঁজে, পায়নি।

অবধলাল আর ফল্গু তো চলে এল। ফল্গু বলল, অবধলাল, আমি শুয়ে পড়েছি। তুমি ভূত তাড়িয়ে তবে আমাকে ডাকবে।

আগে দেখি ব্যাটারা কেমন জাতের। আর একটু কাজ সেরে আসি।

কী কাজ?

খাতের পাশে গাছটা দেখলেন না?

দেখলাম তো!

বেচারি! ওখানে একটা কিরকিচা আছে। বেচারি আছে বলেই কেউ জানে না। একটু খইনি একটু বিড়ির জন্যে বড়ো কষ্ট পাচ্ছে।

এখানেও কিরকিচা?

বাবুজী, কিরকিচা কোথায় নেই?

ও কেন ভূতগুলোকে তাড়াচ্ছে না?

কিরকিচা বলে ওর আত্মসম্মান নেই? ওকে কেউ বলেছে?

তুমি কি ওকেই ডাকবে?

না না, সে দেখা যাবে। একটু খইনি, দুটো বিড়ি, একটা দেশলাই তো রেখে আসি। বাবুজী, ভূত তাড়াবার জড়িবুটিও তো আমাকে একটা কিরকিচাই দিয়েছিল।

এমনি সময়েই প্যাঁচা ডাকল, আর ফল্গু একটা ঘুমের বাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

মাঝরাতে সে কী গণ্ডগোল। অন্য কারও গলা শোনা যাচ্ছে না, অবধলাল চেঁচাচ্ছে।

তাই বলো! কিরকিচার ভয়ে এখানে ঢুকে বসে আছ? কেন, পুলিশ যখন লাশ নিয়ে গেল, তখন সঙ্গে গেলে না কেন?

একটা গলা মিউমিউ করে বলল, গিটগিটা কোথাও যেতে পারে?

সর্দার কে?

আমি তো ছিলাম।

ঘরে কেন, বাইরে জঙ্গল আছে না?

অহি কিরকিচা!

ওর ভয়ে মরে গেলে?

হাঁ বাবু। আগে তো মারামারি করে মরলাম। তারপর পালাতে যাব, কিরকিচা যা গাল দিল আবার মরে গেলাম। এখন তো পালাতে পারলে বাঁচি। কিন্তু দু—বার মরলে কেমন করে পালাব?

হায় হায়, এ তো বহত আফশোস। ডবল ডেথ হয়ে গেল। তোমরা তো গিটগিটাও নেই, পিচপিচাও নেই। বিলবিলা হয়ে গেছ, হায় হায়!

আমাদের ছেড়ে দাও ভৈয়া।

ছাড়ব তো, যাবে কোথায়?

তা ফল্গু বলল, অবধলাল বলেছে যে কখনো কোনো কিরকিচা নিজের গ্রাম থেকে নড়ে না।

যদি বেড়াতেও আসে!

না না সে অসম্ভব।

ফল্গুকে বলতাম, অবধলালের কথা বিশ্বাস করিস?

ও বলত, বিশ্বাস করব না? জঙ্গলে যারা কাজ করে তারা বাঘের চেয়ে ভালুককে ডরায়। বাঘ মানুষ দেখলে সরে যায়। ভালুক তেড়ে এসে আক্রমণ করে। সেবার হাজারিবাগে…

একটা গল্পের সুতো ধরিয়ে দিয়েই, এমন হতভাগা বলত, সকাল আটটা। বসে গল্প করার সময় নয়। থলিটা কোথায়, বাজারে চল।

আমাকে বাজারে টেনে নিয়ে যাবে, যা দেখবে সব কিনবে আর বাড়ি ঢুকে বলবে, ছ্যা ছ্যা, বুড়ো হয়েছে তো! যা দেখে সব কেনা চাই।

গল্প বলার সময় সন্ধেবেলা। বাগানের চাতালে বসে। লোডশেডিং হলে আরও জমত।

হাজারিবাগের জঙ্গলে ঘোরার আসল মজা বিট অফিসারের সঙ্গে পায়ে হাঁটে, তাঁবুতে থাকো, মাঝে মাঝেই দেখব গ্রামের মেয়ে—পুরুষ কাজ করছে।

তেমনি ঘুরতে ঘুরতে ওরা নাকি ভালুকের সামনে পড়ে। ভালুক দেখে ওরা তো দৌড় লাগিয়েছে। ভালুকও তেড়ে আসছে। তখন অবধলাল চেঁচিয়ে বলছে, আরে জঙ্গলে তো কত আওরতও মারা পড়েছে। একটাও কিরকিচা নেই? আরে কিরকিচা, কোথায় আছ?

সঙ্গে সঙ্গে গাছপালায় ঝড়তুফান তুলে ভালুকের দু—পাশে দুই কিরকিচা এমন চেঁচাতে শুরু করল যে ভালুক ঘাবড়ে পালাল।

এটা সত্যি?

ইচ্ছে হলেই বিট অফিসারকে জিজ্ঞেস করে জেনে আসতে পারো।

তা, অবধলাল সঙ্গে থাকত বলে ফল্গুরও ঝোঁক চেপেছিল ভূতের বাড়ি হলেই ওকে নিয়ে সেখানে থাকবে।

বাইরে থেকে কে খনখন করে হাসল। ঠিক যেন হায়েনা হাসল।

যৈসে ভি হো, ভাগ যায়েগা।

কে যেন খনখনে গলায় বলল, সত্যি কথাটা বলনা বাপু। আমি তোদের কেন পুরে রেখেছি?

ফিঁচফিঁচ করে কেঁদে একজন বলল, অরে লখিয়াকে মা! তোর তামাকুর ডিব্বা আমরা নিইনি।

গিটগিটার দোহাই?

গিটগিটার দোহাই।

বিলবিলার দোহাই?

বিলবিলার দোহাই।

আমার কাছে মাপ চাইবি?

চাইলাম, চাইলাম।

যা তবে, ছেড়ে দিলাম।

অবধলাল এ সময়ে কী যে করল কে জানে। ঘরে ভীষণ একটা ঝুটোপাটি পড়ে গেল।

সকালে ফল্গুকে তো অবধলাল ডেকে তুলল। ফল্গু বলল, কাল অত চেঁচামেচি সব শুনেছি।

ছাই শুনেছেন। সিদ্ধির শরবত খেয়ে ঘুম মারলেন। কি শুনবেন?

চেঁচামেচি হয়নি?

সব মনে মনে।

ওরা চলে গেছে?

দেখুন না।

ধুলোর ওপর সাত জোড়া ছোটো ছোটো পায়ের ছাপ। সব বাইরের দিকে বেরিয়ে গেছে।

ছোটো ছোটো ভূত?

না বাবু। বেচারাদের মতো অভাগা হয় না। মরল তো গিটগিটা হয়েছিল। গিটগিটারা বড়ো বড়ো ভূত। কিরকিচার ভয়ে আবার মরে গেল। এখন তো ওরা বিলবিলা। বেঁটে বেঁটে ভূত। কী দুঃখ!

দুঃখ কেন?

আর বিলবিলা দেখলে গিটগিটা, পিচপিচা, কিরকিচা, সবাই পিটাবে। বিলবিলা হওয়া তো ডর—পোকের লক্ষণ। এক দফে মরলে, ঠিক আছে। আবার ডবল দফে মরবে? ওরা সমাজের কলঙ্ক।

এখন ওরা কী করবে?

পালাবে আর কী করবে।

আসার আগে অবধলাল খাতে নেমে অনেক খুঁজেও কিছু পেল না। মাহাতোদের বলে, ওহি গাছের নীচে পিতলের ডিব্বায় তামাক পাতা, চুন রেখে দেবে। ভূত তো তাড়িয়ে দিয়েছি। গাছে যে কিরকিচা আছে, তাকে চটাবে না।

ডাকাতির মাল?

নির্ভয়ে খোঁজ গে।

গ্রামের লোক তো পায়ের ছাপ দেখতে পেল। গিটগিটাদের বিলবিলা হবার কথাও সব শুনল। ওদের কি আনন্দ! মাহাতোরা, সাঁওতালরা, তেলিরা, সবাই যাবে। দরজা, জানালার কপাট নেবে, ইট নেবে। বাগান থেকে যথেষ্ট কুল, আমলকি, আম নেবে। গাছ কেটে জ্বালানি করবে। ওই মস্ত পুকুরে স্নান করবে। ঘাসবনে গোরু চরাবে।

প্রচুর মুরগি কাটা হল, খুব খাওয়া—দাওয়া।

কমলবাবু সবই খেলেন, কিন্তু বললেন, ভূতের ডবল ডেথ, ধুলোতে পায়ের ছাপ, দূর মশাই, সব ধাপ্পা।

অবধলাল বলল, ও সব বলবেন না বাবুজী, তাহলে কিরকিচাটা আপনার পেছনে লেগে যাবে। আপনাকে গিরগিটা বানিয়ে ছেড়ে দেবে। আপনি যা ভিতু হয়তো আবারও মরে যাবেন। তখন বিলবিলা হয়ে থাকতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *