সাতজনের তিনজন

সাতজনের তিনজন

হিমালয়ের খুব গহন অঞ্চলের দু’জন লোক ঘুরে বেড়াচ্ছিল। একজন খুব রোগা, লম্বা আর শুকনো চেহারার বুড়ো; আর একজন বেশ শক্ত সমর্থ জোয়ান, কিন্তু তার মাথার চুলের মাঝখানে একটা গোল গর্ত। কেউ এক সময় তার মাথায় ওই জায়গার চুল কেটে নিয়েছিল, সেখানে আর চুল গজায়নি।

হিমালয়ের এরকম জায়গায় কোনো মানুষজন দেখা যায় না। পর পর বিরাট বিরাট পাহাড়, যেন একেবারে আকাশচুম্বী, আর মাঝে মাঝে উপত্যকা। এছাড়া দারুণ গভীর সব খাদও আছে। পাহাড়ের চূড়াগুলোয় বরফ, কিন্তু মাঝামাঝি জায়গায় বেশ ঘন—জঙ্গল। সেই জঙ্গলের মধ্যেই থাকে ওই লোক দু’জন। ওদের বাড়ি—ঘর কিছু নেই, রাত্তিরবেলা গাছতলায় ঘুমোয় আর সারাদিন টো—টো করে ঘোরে।

এখানকার জঙ্গলে ফলমূল বিশেষ পাওয়া যায় না, যা পাওয়া যায়, তাও খাওয়া যায় না, এমন বিস্বাদ। তবে কিছু খরগোশ আর হরিণ আছে। ওরা তাই মেরে খায়। বুড়ো লোকটির আর শিকার করার ক্ষমতা নেই, জোয়ানটির কাঁধে ঝোলে ধনুক আর কয়েকটা তীরভর্তি তূনীর। এমনি জামা—কাপড়ও নেই ওদের, গাছের বাকল দিয়ে কোনোরকমে পোশাক বানিয়েছে।

পর পর দু’দিন ওরা কোনো শিকার খুঁজে পায়নি। পেট জ্বলছে খিদেয়। এক জঙ্গল থেকে আর এক জঙ্গলে এসে ওদের মনে হচ্ছে সব জন্তু—জানোয়ার বুঝি ওদের ভয়ে নিরুদ্দেশে চলে গেছে।

জোয়ানটি বললো, মামা, আর যে পারি না।

বুড়ো লোকটি বললো, ওরে আশু, আমিই কি আর পারছি! কিন্তু উপায় তো নেই, বেঁচে থাকতে হবেই, আর বাঁচতে হলে খাদ্যও খুঁজতে হবে!

আশু বললো, এই বন—জঙ্গল আর ভালো লাগে না। চলো, যেখানে মানুষজন আছে, সেখানে যাই!

মামা বললো, খবরদার না! ওকথা বলিস না! লোকজনরা যদি আমাদের চিনে ফেলে? তবে সর্বনাশ হবে!

আশু বললো, এতকাল পরেও আমাদের কে চিনবে? ওঃ খিদেয় আমার পেট একেবারে পুড়ে যাচ্ছে চিঁ—হিঁ—হিঁ—হিঁ।

মামা চমকে উঠে বললেন, ওকি! অমন শব্দ করছিস কেন?

খিদে পেলে আমার অমন হয়!

না না, ছি! অমন করতে নেই! ছোটবেলায় তোর ওই দোষ ছিল, অনেক কষ্টে সারিয়েছি!

চিঁ—হিঁ—হিঁ—হিঁ, মামা, আমি আর পারছি না, চিঁ—হিঁ—হিঁ—হিঁ।

আরে ছি ছি ছি ছি, অমন করে না। চল—চল, খাদ্য খুঁজে দেখি।

আরও কিছুক্ষণ বনে বনে ঘুরলো ওরা। তারপর মামাই বেশি ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লো মাটিতে পড়ে—থাকা একটা গাছের গুঁড়ির ওপর।

সঙ্গে সঙ্গে গাছের গুঁড়িটা নড়ে উঠল।

মামা উল্টে চিৎপাত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল, ভাগ্নে আশু তার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে তুলে ফেললো। মামা বলে উঠলো, ওরে বাপ রে, এটা কী রে?

সেটা আসলে একটা ময়াল সাপ। বনের শুকনো পাতায় তার মুখটা ঢাকা পড়ে আছে। এবার সে সড়াৎ করে মাথাটা ঘুরিয়ে আনলো এদিকে।

ভাগ্নে আর মামা দু’জনেই কিছুটা সরে দাঁড়িয়েছে। মামা প্রথমে চমকে উঠেছিল, কিন্তু এখন আর মুখে বেশি ভয়ের চিহ্ন নেই।

ভাগ্নে ধনুকে তীর জুড়ে বললো, মামা, আজ এই সাপটাকে মেরে তারপর এটাকে পুড়িয়ে খাবো।

মামা বললো, আরে ছি ছি, রাম রাম! আমরা উচ্চ বংশের লোক, ব্রাহ্মণ, আমরা কখনো অসভ্য বুনো লোকদের মতন সাপ খেতে পারি?

ভাগ্নে বললো, এখানে কে আমাদের দেখতে যাচ্ছে।

মামা বললো, তা ছাড়া এই সাপটা কোনো শাপগ্রস্ত মুনি—ঋষি কিংবা বিশিষ্ট লোক কিনা তাই বা কে জানে। ওকে মেরে কাজ নেই।

এমন সময় সাপটা মুখ ঘুরিয়ে এনে মামার একখানা পা কামড়ে ধরলো।

মামা তাতে একটুও ভয় না পেয়ে হাসতে হাসতে বললো, ওরে, তাহলে এটা মুনি—ঋষি নয়, আসল সাপ!

ভাগ্নে তখন সাপটার মাথায় একটা ধারালো তীর ছুঁড়লো। সাপটা অমনি মামার পা ছেড়ে দিয়ে ছটফট করতে লাগলো যন্ত্রণায়।

ভাগ্নে সাপটাকে একেবারে মেরে ফেলবার জন্যে আর একটা তীর ছুঁড়তে যাচ্ছিল, মামা তাকে বাধা দিয়ে বললো, ওরে আশু, থাক থাক! আর মারবার দরকার নেই। আমরা সত্যিই তো আর সাপ খাবো না। চল।

সাপটা যে মামার পায়ে কামড়ে দিয়েছে, তাতেও মামার পায়ে একটু দাঁতও বসেনি, রক্তও বেরোয়নি।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভাগ্নেকে মামা টানতে টানতে নিয়ে গেল সেখান থেকে।

আরও প্রায় দু’ঘণ্টা ঘুরে কিছুই না পেয়ে বিরক্ত আর ক্লান্ত হয়ে ওরা একটা খাদের ধারে বসলো। তারপরই চমকে উঠলো একটা গাছের দিকে তাকিয়ে।

গাছটা উঠেছে একেবারে খাদের ধার ঘেঁষে। গাছটা বেশ বড়, লম্বা ধরনের, সোজা উঠে গেছে। নিচে কোনো ডাল—পালা নেই, একেবারে ডগার কাছে দুটি মাত্র ডাল, তাতে কয়েকটি ফল ফলে আছে। গাছটাকে দেখতে অনেকটা ইউক্যালিপটাস গাছের মতন, আর ফলগুলো আমের মতন। এমন আশ্চর্য গাছ এই জঙ্গলে আর একটাও নেই।

মামা বলে উঠলো, আরে!

ভাগ্নে বললো, এতক্ষণে বাঁচলুম, এবার খিদে মেটাবো, চিঁ—হিঁ—হিঁ—হিঁ।

মামা বললো, চুপ কর। এটা কি গাছ জানিস? বহু ভাগ্যে এই গাছ দেখতে পাওয়া যায়। এর নাম মৃতসঞ্জীবনী, এ গাছের ফল খেলে মরা মানুষ বেঁচে ওঠে।

ভাগ্নে বললো, মরা মানুষের কথা আমরা জানি না। এই ফল খেলে পেট তো ভরবে। চিঁ—হিঁ—হিঁ—হিঁ!

মামা বললো, ছিঃ আশু, এমন আওয়াজ করে না। ফলগুলো কী করে পাড়া হবে, সেই কথা ভাব। ওই একটা ফল খেলেই আমাদের পেট ভরে যাবে।

গাছটায় ওঠা অসম্ভব। নিচে কোনো ডালপালা নেই, গা—টা মসৃণ। ফলগুলো এমন পাকা যে দেখলেই লোভ হয়।

ভাগ্নে বললো, সে আমি ব্যবস্থা করছি।

সে অমনি ধনুকে তীর জুড়লো। তারপর একচোখ বন্ধ করে ছুঁড়লো তীর। ভাগ্নের হাতের টিপ বেশ ভালোই, তীরটা গিয়ে বিঁধলো একটা ফলে। কিন্তু ফল—সমেত তীর মাটিতে না পড়ে গিয়ে পড়লো খাদে।

ভাগ্নে বললো, এই রে!

মামা বললো, ইস, অমন দামি ফল তুই নষ্ট করলি?

তীর দিয়ে ফল পাড়ার সুবিধা হবে না। তাহলে কী করা যায়? গাছটার কাছে দাঁড়িয়ে দু’জন ওপরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো।

ভাগ্নে বললো, মামা, এক কাজ করা যাক। তুমি আমার কাঁধের ওপর দাঁড়াও। তাহলে তুমি হাতে পেয়ে যাবে।

মামা বললো, ওরে বাপরে, এই বুড়ো শরীর নিয়ে তা কি আমি পারবো?

ভাগ্নে বললো, তাহলে তোমার কাঁধে আমি উঠি?

মামা বললো, ওরে না না, তোর ভার আমি সইতে পারবো না। তার চেয়ে আমিই উঠছি বরং।

ভাগ্নে তখন হাঁটু গেড়ে বসলো, মামা তার দু’কাঁধে পা দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ব্যালান্স রাখবার জন্য মামা এক হাতে খামচে ধরলো ভাগ্নের মাথার চুল। তাতে চুলের মাঝখানের গর্তটাতেও হাত লেগে গেল।

ভাগ্নে বললো, উঁহুহু, ওখানে হাত দিও না। ওখানে হাত দিলে এখনো ব্যথা লাগে!

তারপর ভাগ্নে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। মামা এক হাতে গাছটা ধরে অন্য হাত বাড়িয়ে দিল ওপরের দিকে। তাতেও ঠিক হাতে পাওয়া যায় না। মামা ডিঙি মেরে আর একটু উঁচু হবার চেষ্টা করতে তার আঙুলের ডগা ছুঁয়ে গেল একটা ফলকে! কিন্তু ধরা যায় না।

ভাগ্নে জিজ্ঞেস করলো, হয়েছে?

মামা বললো, আর একটু উঁচু।

ভাগ্নে আঙুলে ভর দিয়ে আর একটু উঁচু হলো। মামা তখন দু’হাত তুলে গাছের একটা ডাল ধরবার চেষ্টা করলো কোনোক্রমে। ফলসুদ্ধ একটা ছোট ডাল ধরামাত্রই সেটা ভেঙে গেল মটাস করে, তাল সামলাতে না পেরে মামাও পড়ে গেল হুড়মুড়িয়ে।

ভাগ্নে চোখ কপালে তুলে দেখলো, একটা ফল দু’হাতে নিয়ে মামা পড়ে যাচ্ছে খাদের মধ্যে। ভাগ্নে হাত বাড়িয়েও কিছু করতে পারলো না!

সে—খাদ যে কত গভীর তা চোখে দেখে বোঝা যায় না। নিচের দিকটা মিশেমিশে অন্ধকার। ভাগ্নে হায় হায় করে উঠলো।

ফল খাওয়া তো হবেই না, সে তার মামাকেও হারালো। মামা যতই বুড়ো হোক, তবু তো একজন কথা বলার সঙ্গী ছিল। এখন তাকে একা থাকতে হবে।

সে কেঁদে চেঁচিয়ে উঠলো, মামা!

অমনি খাদের বহু নিচ থেকে খুব অস্পষ্ট গলায় উত্তর এলো, আশু…

ওরকম খাদে পড়ে গেলে কোনো মানুষ কিছুতেই বাঁচতে পারে না। কিন্তু মামা বেঁচে আছে।

ভাগ্নে আবার চ্যাঁচালো, মামা, তুমি কোথায়?

মামা সেই রকম বহুদূর থেকে উত্তর দিল, আমি এখানে। ওপরে ওঠার উপায় নেই, খাড়া পাহাড়।

ভাগ্নে বললো, আমিই বা নামবো কী করে?

মামা বললো, তুই নামতে পারবি না! বি—দা—য়! আ—র আ—মা—দে—র দে—খা হ—বে—না।

ভাগ্নে বললো, মামা, আমি যে কোনো উপায়ে হোক তোমায় উদ্ধার করবো। তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই!

খিদে—তেষ্টা ভুলে গিয়ে ভাগ্নে দৌড়োতে লাগলো উল্টো দিকে ফিরে। তার একটা কথা মনে পড়েছে। মামাকে উদ্ধার করার সেই একটামাত্র উপায়ই আছে।

এখান থেকে তিনখানা পাহাড় পেরিয়ে যেতে হবে। অত দূরে তারা বহু বছর যায়নি। মামাই বারণ করতো সব সময়। ওখানে বিপক্ষ দলের একজন থাকে। এখন বাধ্য হয়েই তার কাছ থেকে সাহায্য চাইতে হবে।

এক—একটা পাহাড় পেরিয়ে যেতে লাগলো ভাগ্নে। মাঝখানে একটা ঝর্ণার জল খেয়ে পেট ভরিয়ে নিল। এক সময় মাথার ওপর দিয়ে একটা এরোপ্লেন যেতে দেখে সে লুকিয়ে পড়লো ঝোপের মধ্যে। সে এরোপ্লেনের শব্দে ভয় পায় না বটে, কিন্তু তাকে কেউ দেখে ফেলুক, এটা সে চায় না।

শেষ পর্যন্ত তিনখানা পাহাড় ডিঙিয়ে সে উপস্থিত হলো একটা উপত্যকায়। সেখানে একটা ঝর্ণার পাশে গাছের ছায়ায় একটি ছোট্ট বাঁদর শুয়ে আছে।

ভালো করে দেখলে অবশ্য বোঝা যায়, সেটি বাঁদর নয়, হনুমান। মুখটা কালো, চার পায়ের হাতের পাঞ্জাও কালো, লেজটি বেশ লম্বা।

হনুমানটি ঘুমিয়ে ছিল। ভাগ্নে তার পাশে হাঁটু গেড়ে হাত জোড় করে কাতর গলায় ডাকলো, প্রভু! প্রভু!

দু—তিনবার ডাকার পর হনুমানটি চোখ মেলে বললেন, আঃ! কে রে বিরক্ত করে?

হনুমানটি সত্যিই মানুষের মতন কথা বলতে পারেন। কারণ, ইনি যে—সে হনুমান নন, ইনি রামায়ণের সেই হনুমান। রামচন্দ্রের সেবক। এঁর তো মৃত্যু নেই, ইনি অমর, যতকাল পৃথিবী থাকবে, ততকাল ইনিও বেঁচে থাকবেন। আগে এঁর শরীরটা ছিল ইলাস্টিক, ইচ্ছে মতন বড় কিংবা ছোট করা যেত। বহুকাল কেটে গেছে বলে এঁর শরীরের কলকব্জায় মরচে পড়েছে, এখন আর শরীরটা বড় হয় না।

হনুমানের প্রশ্ন শুনে ভাগ্নে বললো, আজ্ঞে আমি দ্রোণের পুত্র অশ্বত্থামা।

হনুমান বললেন, আমায় এখানে জ্বালাতে এসেছো কেন?

আজ্ঞে আমার বড় বিপদ।

তোমার বিপদ তাতে আমি কী করব? যাও যাও।

প্রভু, আমি বহু দূর থেকে এসেছি, ক্ষুধা—তষ্ণায় কাতর, চিঁ—হিঁ—হিঁ—হিঁ!

কী আপদ! এটা এখানে এত উৎকট শব্দ করে কেন? যা, যা!

প্রভু, আমার মামা খাদে পড়ে গেছেন! তাকে আপনি বাঁচান! ইয়ে, মানে বাঁচাতে হবে না, উদ্ধার—

তোমার মামা খাদে পড়েছেন, বেশ করেছেন। আমি তাকে উদ্ধার করতে যাবো কেন? তোমার মামাটা কে?

আমার মামার নাম কৃপ। এক সময় ছিলেন মহাবীর। কৌরব—পাণ্ডবদের পাঠশালায় অস্ত্র শিখিয়েছেন।

হুুঁ! ভারী তো মহাবীর! কোন যুদ্ধটায় তিনি জিতেছেন শুনি? তাঁকে উদ্ধার করার কী দায় পড়েছে আমার?

প্রভু, আমরা তো মোট সাতজন আছি। আমরা যদি পরস্পরকে বিপদের সময় সাহায্য না করি, তাহলে কে করবে বলুন? এতদিন পরেও শত্রুতা মনে রাখতে আছে?

তা সাতজন যখন আছে, তখন অন্য কারুর কাছে যাও না। আমাকে বিরক্ত করছো কেন?

আর কার কাছে যাব বলুন? আমাদের মধ্যে বলি আছেন পাতালে। আর ব্যাসদেব সকলের ঠাকুরদা, অতি বুড়ো মানুষ তাঁকে কি খাদে নামতে বলা যায়? তাছাড়া, শুনেছি তিনি থাকে কাশীতে। বিভীষণ আছেন শ্রীলঙ্কায়। পরশুরাম দক্ষিণ সমুদ্রতীরে তপস্যা করতে চলে গেছেন, এদিকে আর আসেন না। রইলাম বাকি আমরা তিনজন। এখন আপনি যদি সাহায্য না করেন…

আমি এত বুড়ো হয়েছি, আমার গায়ে আর শক্তি নেই। নড়তে—চড়তেই পারি না, আমি যাবো খাদে নামতে!

অশ্বত্থামা এবার রেগে গিয়ে ধনুকে বাণ জুড়ে বললো, তবে রে ব্যাটা হনুমান, এত করে বলছি, তবু তুই যাবি না? তাহলে তোকে মেরেই শেষ করবো।

হনুমান চোখ পিটপিট করে একটু দেখলেন অশ্বত্থামাকে। তারপর হঠাৎ তাঁর লেজটা দিয়ে অশ্বত্থামার গলায় তিন পাক জড়িয়ে তাকে হ্যাঁচকা টানে মাটিতে ফেলে দিলেন।

আস্তে আস্তে চিবিয়ে চিবিয়ে হনুমান বললেন, বুড়ো হয়েছি বলে কি গায়ে একটুও শক্তি নেই যে তোর মতন একটা চুনোপুঁটিকেও ঢিট করতে পারবো না?

লেজের পাকে বন্দী অবস্থায় অসহায়ভাবে অশ্বত্থামা হনুমানের স্তব করতে লাগলো। সে বললো, হে প্রভু, আপনাকে একটু উত্তেজিত করার জন্যই আমি মিছিমিছি ভয় দেখাচ্ছিলাম। নইলে আপনাকে ভয় দেখাবো এমন সাধ্য কী আমার! আপনি মহা শক্তিমান, আপনি জন্মাবার পরই আকাশে সূর্যকে একটা ফল ভেবে এক লাফে ধরতে গিয়েছিলেন, আপনি এক লাফে সমুদ্র লঙ্ঘন করেছিলেন, আপনার মতো মহাবীর আর কেউ নেই…।

প্রশংসা শুনে একটু খুশি হলেন হনুমান। তারপর অশ্বত্থামার গলায় তাঁর লেজের পাক একটু আলগা করে বললেন, হ্যাঁ, এক সময় ওসব করেছি বটে, কিন্তু এখন আর লাফ—ঝাঁপ দিতে ভালো লাগে না। মরণ নেই, তাই কোনোরকমে বেঁচে আছি।

অশ্বত্থামা বললো, কিন্তু আপনি ছাড়া কেউ পারবে না আমার মামাকে বাঁচাতে। আপনি লঙ্কা থেকে লাফিয়ে মন্দার পাহাড়ে গিয়েছিলেন, আর হিমালয়ের একটা খাদে লাফানো তো আপনার কাছে নস্যি। ছোট্ট একটা লাফ দিলেই হবে।

হনুমান জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় সে পড়েছে?

অশ্বত্থামা হাত তুলে তিনটে পাহাড় দূরে জায়গাটা দেখালো। হনুমান বললেন, ওরে বাবা, অতদূর আমি হাঁটতেই পারবো না, হাঁটুতে দারুণ ব্যথা।

আজ্ঞে, হাঁটতে হবে কেন? আপনি এক লাফেই তো পৌঁছে যেতে পারেন।

বুড়ো বয়সে যখন—তখন কেউ তিড়িং তিড়িং করে লাফায়? একবার লাফালে সেই ঢের। আমি যদি বা লাফিয়ে যাই, তুই যাবি কী করে?

আপনি যদি আমায় পিঠে করে নিয়ে যান।

লজ্জা করল না ওই কথাটা বলতে? আমি বুড়ো মানুষ, তোর মতন একটা জোয়ানকে ঘাড়ে করে নিয়ে যাবো? তুই যদি আমায় ঘাড়ে করে নিয়ে যাস, তাহলে যেতে পারি।

শেষ পর্যন্ত তাই করতে হলো, হনুমান কিছুতেই হেঁটে বা লাফিয়ে যেতে রাজি নয়। অশ্বত্থামা তাকে কাঁধে করে সেই তিনখানা পাহাড় ডিঙিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে পরদিন সকালে পৌঁছালো খাদটার কাছে।

অমররা কিছুতেই মরবে না, বেঁচে আছে ঠিকই, তবু জ্ঞান আছে কিনা জানবার জন্য অশ্বত্থামা ডাকলো, মামা—

খাদের তলা থেকে উত্তর এলো, আশু, আমায় এখান থেকে তোল, এখানে বড্ড পিঁপড়ে—

অশ্বত্থামা বললো, মামা, ভয় নেই, ব্যবস্থা হয়ে গেছে, হনুমানজী এসেছেন।

হনুমান অমনি একলাফে গাছটায় গেলেন।

কিন্তু কী কাণ্ড, হনুমান মোটে গাছটার আধখানা উঁচু পর্যন্ত উঠতে পারলেন, তারপরই পড়ে যাচ্ছিলেন।

হনুমান বললেন, ইস, দেখলি কী অবস্থা হয়েছে আমার। এইটুকুও লাফাতে পারি না। খাদ থেকে তোর মামাকে তুলবো কী করে?

অশ্বত্থামা নিরাশ হয়ে বললো, তাহলে কি হবে?

দেখছি কী ব্যবস্থা করা যায়!

হনুমান গাছটা দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন, আর আস্তে আস্তে উঠতে লাগলেন গাছটা বেয়ে। নিজের জাতের এই পুরনো অভ্যেসটা তিনি এখনো ভোলেননি। ক্রমে একেবারে উঠে গেলেন গাছের ডগায়। একটা ফল ছিঁড়ে কামড়েই তিনি বললেন, আঃ, কী অপূর্ব স্বাদ!

অশ্বত্থামা লোভীর মতন বললো, প্রভু, আমায় একটা দিন। আপনি ছুঁড়ে দিন, আমি লুফে নেব।

হনুমান এক ধমক দিয়ে বললেন, দাঁড়া বাপু! আমি আগে পেট ভরে খেয়ে নিই। এক হাজার বচ্ছর কিছু খাইনি, শুধু রাম নাম জপ করে খিদে মিটিয়েছি।

এক এক করে সে—গাছের সব কটা ফলই খেয়ে ফেললেন তিনি। অমনি তাঁর শরীরটাও বড় হতে লাগল মৃতসঞ্জীবনী ফলের গুণে। তিনি বিশাল হয়ে গেলেন এবং এমন গর্জন করে উঠলেন যে সমস্ত বন কেঁপে উঠল।

তারপর লাফিয়ে নিচে নেমে অশ্বত্থামাকে নিজের এক বগলের মধ্যে চেপে ধরলেন।

অশ্বত্থামা বললো, এ কী, এ কী! আপনি আমায় একটাও ফল দিলেন না?

হনুমান বললেন, চল।

তারপর অশ্বত্থামাকে বগলে চেপে রেখেই তিনি একলাফে চলে এলেন খাদের তলায়।

সেখানটায় একেবারে মিশমিশে অন্ধকার। কেউ কারুকে দেখতে পাচ্ছে না। শব্দ শুনে কৃপ বললে, ওরে আশু, এসেছিস?

হনুমানকে পাওয়া গেছে, আর চিন্তা নেই। ওই গাছের ফলগুলো যে কী সুন্দর, কী মিষ্টি, তোকে কী বলবো। একটা ফল খেয়েই আমার গায়ে যেন অনেক জোর বেড়ে গেছে। হনুমান আমাদের ফলগুলো পেড়ে দেবে, নিশ্চয়ই দেবে, নিশ্চয়ই দেবে, তাই না হনুমান?

হনুমানের বগলের চাপে অশ্বত্থামার প্রায় দম আটকে আসার মতন অবস্থা। সে চিঁ চিঁ করে বললো, মামা, উনি সব ফলগুলো খেয়ে ফেলেছেন। চিঁ—হিঁ—হিঁ—হিঁ।

হনুমান প্রচণ্ড হুঙ্কার দিয়ে বললেন, চোপ!

তারপরেই তিনি কৃপকে উদ্দেশ্য করে পেল্লায় এক চড় কষালেন।

কৃপ বললো, এ কী?

হনুমান বললেন, এখন আমার সব মনে পড়ে গেছে। ভীম আমার সম্পর্কে ভাই হয়। সেই হিসেবে সব পাণ্ডবরাই আমার ভাই। তোমরা পাণ্ডবদের সঙ্গে শত্রুতা করেছিলে। শুধু তাই নয়, পাঁচটা কচি কচি ছেলে তারা যখন ঘুমিয়ে ছিল, তখন তাদের গলা টিপে মেরে ফেলেছিল এই পাষণ্ড অশ্বত্থামা। আর তুমি কৃপ, তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিলে। আমার ভাইপোদের তোমার মেরেছিলে, আজ আমিও তোমাদের গলা টিপে মেরে ফেলবো।

কৃপ বললো, ওসব পুরনো কথা আর এখন কেন মনে করছো ভাই? যা হবার তা তো হয়ে গেছে অনেক কাল আগে। তাছাড়া আমাদের কী মরণ আছে যে তুমি মারবে?

হনুমান বললেন, তাহলে তুমি এই খাদের মধ্যে অন্ধকার নরকে থাকো। আমি এর অন্য ব্যবস্থা করছি।

কৃপ কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, ও হনুমান ভাই, আমাকে এখানে ফেলে যেও না। এখানে ভীষণ পিঁপড়ে, আমায় সর্বক্ষণ কামড়াচ্ছে।

নরকেও এরকম পিঁপড়ে থাকে।

এই বলেই হনুমান ‘হুপ’ শব্দ করে এক লাফে উঠে এলেন খাদের ওপরে। তারপর সেখান থেকে আর এক লাফে চলে এলেন কাশ্মীরে। সেখানে পীরপাঞ্জাল পর্বতমালার একটা চূড়ায় এসে নেমে হনুমান অশ্বত্থমামাকে বগল থেকে মুক্ত করলেন।

অশ্বত্থামা বললো, এ কোথায় এলাম, চিঁ—হিঁ…

হনুমান বললেন, তোকে খুব ভালো জায়গায় এনেছি।

আঙুল দিয়ে অনেক নিচের একটা উপত্যকা দেখিয়ে বললেন, ওখানে কী ঘুরে বেড়াচ্ছে, দেখছিস?

অশ্বত্থামা বললো, ঘোড়া মনে হচ্ছে।

হনুমান বললেন, হ্যাঁ, ওখানে একজাতের খুব ভালো ঘোড়া থাকে। কোনো মানুষ আজ পর্যন্ত ওদের ধরতে পারেনি, কারণ ওখানে কেউ নামতে পারে না। আর যদি বা নামে, উঠতে পারে না। শিশু হত্যাকারী পশু, তুই চিরকাল ওই ঘোড়াদের সঙ্গে থাকবি। ভীম তোর মাথার চুল কেটে মণি কেড়ে নিয়েছিল, তাতেও তোর শাস্তি হয়নি। আমি তোকে এই শাস্তি দিলাম।

অশ্বত্থামা বাধা দেবার আগেই হনুমান তার ঘাড় ধরে প্রচণ্ড এক ধাক্কা দিলেন যে সে ছিটকে পড়ে গিয়ে গড়াতে লাগলো। গড়াতে গড়াতে একেবারে সেই অনেক নিচের উপত্যকায় গিয়ে পড়লো। ওখান থেকে আর উঠতে পারবে না কোনোদিন।

সন্তুষ্ট মনে হনুমান ‘জয় রাম’ বলে এক লাফ দিয়ে আবার ফিরে এলেন হিমালয়ে, সেই ঝর্ণাটার ধারে, তাঁর জায়গায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *